Monday, June 6, 2016

সাপ্তাহিকী ১১ # ছায়াসঙ্গী - প্রথম পর্ব





লাহোর - পটোহার মালভূমির প্রান্তর

পাহাড়ের ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘদেহী কৃষ্ণকায় যুবক। পিড়হান পাগড়ির নিচে সন্দিহান চোখে যেন কোনো গোপন সংবাদ ঝিলিক দিচ্ছে। এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে তাঁবুর সামনে চলে আসে সে। রক্ষীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, 'সুলতানকে খবর দেওয়ার আছে'। যুবককে আপাদমস্তক জরিপ করে নেয় পাহারাদার, পাস্তুনী জোব্বার খাঁজে তলোয়ারটা চোখে পড়ে। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, 'তারিফ'?

যুবক আবারও ফিসফিস করে বলে, 'জামাল.....জামালউদ্দিন ইয়াকুত'। রক্ষী হাত দেখিয়ে দাঁড়াতে বলে, তারপর ঢুকে যায় তাঁবুর ভেতর। পরক্ষনেই বেরিয়ে এসে বলে, 'সুলতান অপেক্ষা করছেন, আসুন'।

পর্দা সরিয়ে তাঁবুতে ঢোকে জামাল। পিঠ ঝুঁকিয়ে লম্বা কুর্নিশ করে বলে, 'আল্লাহ সালামত রাখুন সুলতানকে'।

- এ কি চেহারা হয়েছে তোমার জামাল !! তোমায় বিধ্বস্ত লাগছে যে !!
- অনেক কসরত করে লুকিয়ে চুরিয়ে এসেছি সুলতান, একটা ভয়ংকর খবর আছে !!
- ভয়ংকর !!!.......হাহাহাহা....... কি খবর শুনি ?
- আপনি হাসছেন সুলতান !!......ওদিকে ইখতিয়ার বাকি ওমরাহদের ফুঁসলাচ্ছে...........জোট পাকাচ্ছে সবাই মিলে, বলছে নাকি আপনার বিরুদ্ধে ইনকিলাবের আগুন জ্বালাবে।

জামালের কথা শুনে তাঁবুর জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন সুলতান। রেশমি পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। আকাশে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি চলছে, পটোহারের মালভূমির বাঁ দিকটা রুপোলি জোছনায় থৈ থৈ করছে অথচ ডান দিকের তরাইটা গাঢ় কাজলের মত তমসাবৃত। লাহোরের সমস্যা মিটেছে এতদিনে, আবার নতুন করে দিল্লির ঝামেলা শুরু হয়েছে। জামালের দিকে ঘুরে তাকান সুলতান, বলেন, 'এটা আমার কাছে নতুন কিছু নয় জামাল। অনেকদিন আগে থাকতেই এর এহ্সাস হয়েছিল আমার। চেহলগণির ওমরাহরা যে আমাকে সুলতান হিসেবে মেনে নিতে পারবে না এ আমি জানতাম। দিল্লির তখ্ত এই প্রথম একজন জেনেনার দখলে, ওদের তো তকলিফ হবেই'।

- আপনি এটা নজরান্দাজ করবেন না সুলতান !!, চেহলগণিরা এবার জবরদস্ত সাজিশ করেছে। আমার অনুরোধ, আপনি দিল্লী ফিরবেন না। অন্য কোথাও চলে যান, আমি বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।

- নাআআআআআআআ...............আমার অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না জামাল, কারণ তোমাদের সুলতান কোনো নাদান নয় যে সাজিশের ভয় করবে। আমি ইলতুতমিশ এর যোগ্য ওয়ারিস, মামলুক বংশের উত্তরাধিকারী, আমি রাজিয়া সুলতান।

গর্জন করে ওঠেন দিল্লীর তখ্ত-ও-তাজের একনায়িকা সম্রাজ্ঞী। তাঁবুর মোলায়েম আবছা হলদেটে আলোয় জ্বলজ্বল করে ওঠে তাঁর চোখ। উত্তরের হাওয়ায় পিঠ ছাপানো চুল দুলতে থাকে বিষধর সাপের মত। এক অপার্থিব তেজের দ্যুতি ঠিকরে বেরিয়ে আসে যেন শরীরের আশপাশ থেকে। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সুলতানের বফাদার অনুচর জামালউদ্দিন। রাজিয়াকে কোনো এক ফেরেস্তার চেয়ে কম কিছু মনে হয় না তার। অজান্তেই ঝুঁকে আসে মাথা, আমতা আমতা করে বলে, 'গুস্তাখি মাফ করবেন সুলতান, কিন্তু সামনের বিপদটা যে অনেক বড়'।

- জামাল, ভুলে যেও না, আব্বাজানের মৃত্যুর পর দিল্লীর তামাম সালতানাতকে একা হাতে সামলে এসেছি আমি। এরকম অনেক ইনকিলাব আমার মুট্ঠীর মধ্যে গুঁড়িয়ে গেছে। লাহোরের বান্দা আমার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে কাল। চেহলগণির ওমরাহদের কি করে মাত দিতে হয় সেটা আমি ভালো করেই জানি। তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাক। বাকিটা আমি দেখছি.........
- জো হুকুম সুলতান ! তবে এর সাথে আরেকটা খবরও দেওয়ার আছে।
চোখ সরু হয়ে যায় রাজিয়ার, জিজ্ঞেস করেন, 'কি'? জামাল মাথা না তুলেই বলে, 'জনাব মালেককেও দলে টানার চেষ্টা করছে ওরা, আপনার বিরুদ্ধে ওনার ক্ষমতাকে কাজে লাগাবে বলে'।
- মালেক !!! কি বাকোয়াস করছ জামাল ?? তুমি জানো কার বিরুদ্ধে কথা বলছ?? খবর ভুল হলে তোমার গর্দান নেব আমি !!
- খবর ভুল নয় সুলতান, আমার নিজের কানে শোনা, কয়েকদিন বাদেই চেহলগনির সভা বসবে ভাতিন্ডায়.....জনাব মালেকের দরবারে। আপনি অন্য জায়গা থেকেও পরখ করতে পারেন।
- ইয়া আল্লাহ !!!!

পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যায় রাজিয়ার। মখমলের গদির ওপর বসে পড়েন কাঁপতে কাঁপতে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে জামাল কখনই ভুল খবর দেওয়ার লোক নয়। এতদিনের বফাদার ছায়াসঙ্গী সে, তামাম সাম্রাজ্যের হাল হকিকত তার নখদর্পণে, মুর্দার পেটের ভেতর থেকেও খবর বার করে আনতে পারে সে। তার কথায় অবিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব।

গভীর বেদনায় হৃদপিণ্ড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে পটোহারের নির্জন প্রস্তর প্রান্তরে। শেষ পর্যন্ত, মালেক !!! সেই ছোট্ট বয়েস থেকে দুজনে দুজনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে এসেছে এতদিন, হৃদয়ের দরওয়াজায় যার নাম খোদাই করা, নিকাহ করার স্বপ্ন দেখেছে যাকে, ছদ্দবেশের আড়ালে আজ সেই ছোরা বসাবে বুকে ! কোন আকাঙ্খায় ! কিসের প্রলোভনে? দিল্লী সালতানাত !! একবার মুখ ফুটে তো বলতে পারতো, দিল্লীর তখ্ত পায়ে লুটিয়ে দিত রাজিয়া.......

দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অচিরেই। ব্যর্থ প্রেমের বাষ্পে তাঁবুর পরিবেশ গুমোট হয়ে ওঠে.....

জামাল কোনো কথা না বলে লম্বা সেলাম করে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে তাঁবু থেকে। নিজের ওপর রাগ ধরে অযথাই। কি দরকার ছিল সুলতানকে মালেকের কথা বলার ! মনে মনে ভাবে, বেওকুফের মত কাজ করে ফেলেছে। বক বক করতে করতে সব উগরে দিয়েছে। আসলে সুলতানকে মনে মনে গভীর শ্রদ্ধা করে, তাই কোনো কিছু লুকোনোর কথা ভাবতেই পারে না। সুলতানও যে তাকে পরম স্নেহে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন এতকাল। তখ্ত পাওয়ার আগে থেকেই রাজিয়ার বাধ্য অনুচর, এক হুকুমে জান দিতে পারে সে। সেই কিনা সুলতানের হৃদয় ভারী করে এলো ?

মনটা খারাপ হয়ে যায় জামালের। কিছুটা দুরে একটা বড় পাথরের ওপরের গিয়ে বসে পড়ে। পাগড়িটা খুলে রাখে পায়ের কাছে। বহু দুরে রাতের পাহাড়ের গা বেয়ে মেঘের ছায়া সরে যাচ্ছে একের পর এক। বন্য শূন্যতা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে জামাল.......... ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হতে থাকে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিশোধ সে নেবেই। চেহলগণির পান্ডাকে ছাড়বে না সে। ইখ্তিয়ারের পাঁজরে তলোয়ারটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারলে তবেই তার শান্তি। চাপা আক্রোশে ভেতরে দাবানল জ্বলতে থাকে জামালের। কোমরে গোঁজা স্বর্ণালী বাঁটটায় হাত বুলিয়ে নিয়ে একটানে খাপ থেকে বের করে আনে কঠিন ক্ষুরধার ধাতুটাকে। চাঁদের আলোয় ঝলসে ওঠে রুপোলি বিদ্যুৎ। বিড়বিড় করে ওঠে জামাল, 'ইন্শাল্লাহ'.......

(ক্রমশ)
 
#bengalishortstories #drama #lovestories #romanticstories #sadstories #bengalihistory #raziasultan
#jamaluddinyakut #thriller

2 comments:

  1. Replies
    1. ধন্যবাদ। পড়তে থাকুন........পরবর্তী পর্ব আসছে।

      Delete