Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts

Saturday, May 13, 2023

পাকোদা - ইতিহাসের নাম

পাকোদা - এমন অদ্ভুত নাম কেন হল সেটা ওনারও জানা নেই। তবে পাকোদা একটা ইতিহাসের নাম, কয়েকটা যুগ আর একটা "ছোট্ট কথার দাম" হল পাকোদা। সেটা কোন "কথা" সে বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে নি। 

১৯৬৭ সালে পাকোদা প্রায় এক বস্ত্রে, বলা ভালো হাফ প্যান্টে চলে আসেন কলকাতায় কাজের সন্ধানে, এক আত্মীয়র হাত ধরে, যিনি তদানীন্তন উত্তর কলকাতার এক বিখ্যাত বাড়িতে রান্নার কাজ সামলাতেন। বেথুন কলেজের পিছনে ১৩৩ নম্বর রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বাড়িটি বিখ্যাত, তার কারণ আজ থেকে প্রায় দুশ বছর আগে প্রসিদ্ধ উর্দু কবি মির্জা গালিব নাকি কলকাতায় এই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।

বিষয়টা তর্কাতীত হলেও মির্জা গালিবের ভাড়া বাড়ি হিসেবে গুগল খুঁজলে এই প্রাসাদোপম বাড়ির ছবিই দেখাবে। 

গত রবিবার ইতিহাসের শায়রী জড়ানো এই বাড়িতে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ঘটনাক্রমে এই বাড়িটি আমার শ্বশুর মশাইয়ের পিসীমার বাসস্থান। মজার ব্যাপার হল ওই বাড়ির অধিকাংশ ওয়ারিশ হয় উকিল নয় এটর্নি। আমার শ্বশুর মশাইয়ের পিসেমশাই শ্রী রমেন্দ্রনাথ ধর তাঁর সময়কার বেশ নামকরা এটর্নি ছিলেন। অন্দরমহলের খবর, এই অট্টালিকার পুরোটাই পরবর্তী কালে উনি কিনে নেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাকোদার সাথে এসবের কি সম্পর্ক ? সমস্ত কিছু ছাপিয়ে এই লেখাটা শুধুমাত্র সেই বিষয় নিয়েই.......

না, কোনো রকম রক্তের সম্পর্ক নেই ঠিকই তবে বছরের পর বছর নিষ্ঠা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে কখন যে পাকোদার আত্মার সাথে যোগাযোগ ঘটে গেছে এই বাড়ির, তা এক বিরাট উপন্যাস। সে কথা জানতে চাইলে, পাকোদা সহাস্যে এড়িয়ে যায়। তবু আমি চাপাচাপি করি, জানতে চাই পুরোনো রংচটা ইতিহাসের হালখাতা, কারণ আমি যে আনকোরা গল্পের গন্ধ পেয়েছি ততক্ষণে। 

জোর করে প্রশ্ন করি..... 

- আচ্ছা আপনি যখন এই বাড়িতে আসেন তখন আপনার বয়স কত?

পাকোদা খানিক লজ্জায়, খানিক আতান্তরে পরে উত্তর দিতে থাকেন।

- ওই দশ বারো হবে...

- আগে কোথায় থাকতেন?

- উড়িষ্যা, বালেশ্বর....

- সেখান থেকে চলে এলেন কেন ?

- কাজের দরকার ছিল যে.....

- এত কম বয়সে ?

- হ্যাঁ, বাবা মা মারা গিয়েছিল, তাই.....

- তা এখানেই থেকে গেলেন ? ....আজীবন ?

- (মাথা নেড়ে)...... হ্যাঁ..... 

- অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করল না ?

- না, এ বাড়ির বাবু চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, "আমি না থাকলে বাকিদের দেখিস"। আমিও রয়ে গেলাম.......

- রয়ে গেলেন...... মানে ?

- কথা দিয়েছি, যাওয়া হল না.....

কথাটা হজম করতে সময় লাগল। বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় আমি বাকরুদ্ধ রইলাম কিছু মূহুর্ত। যাঁরা জানতেন না তাঁরাও হতবাক তাকিয়ে রইলেন পাকোদার দিকে। এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমনটা সম্ভব !!!.......... কিংবা হয়ত সম্ভব, যাঁরা জানেন মুখের কথার মূল্য আছে, বোধহয় তাঁদের পক্ষেই সম্ভব। 

ঘোর কাটতে সময় লাগল খানিক। কোনো প্রশ্ন জোগালো না মুখে, ইচ্ছেও করল না। হয়ত পাকোদার অন্য কোথাও যাওয়ার সঙ্গতি ছিল না, বা হয়ত সত্যিই উনি কোথাও যেতে চান নি। বর্তমান সময়ে সেসব কথা অবান্তর।

তবে উত্তর কলকাতার বুকে বহু বছর আগে দেওয়া শুধুমাত্র মুখের কথা একনিষ্ঠ ভাবে মেনে চলেছেন পাকোদা..... একটানা.....একভাবে....... এইটুকুনটাই সম্ভ্রম জাগানোর জন্য যথেষ্ট। 

পাকোদা আপানি সুস্থ থাকুন, আর আরও একবার আমার শ্রদ্ধা জানবেন।

আর বাড়ির সমস্ত মানুষদের আমার প্রণাম যাঁরা পাকোদার দেখাশোনা করে চেলেছেন নিরন্তর। 



Thursday, April 8, 2021

ভাষার জুলুম

সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক উৎসবে প্রত্যাশা মতোই মানুষের প্রাতঃরাশের থালায় এখন রাজনীতির নানান পদ। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে গড়ে ওঠা বড়, ছোট, মাঝারি সমস্ত দল অন্যদিকে ধর্মীয় রাজনীতির আবহে বেড়ে ওঠা এক সর্বভারতীয় পার্টি। 

রাজনীতির গনগনে আঁচ যখন বাংলার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক সেই সময় কোনো এক অজ্ঞাতকারণে একটি সরকারি নির্দেশনামা নেমে এল এমন এক জায়গায় যা বৈজ্ঞানিক গবেষণার শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ২৪শে মার্চ ২০২১ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দা কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠানে প্রায় সমস্ত পর্যায়ে হিন্দি ভাষাতেই লেখালিখি করতে হবে। ৫৫% চিঠিপত্র হিন্দিতে লিখতে হবে (সে মানুষ হিন্দি জানুন বা নাই জানুন, কিচ্ছু এসে যায় না) এবং হিন্দিতে লেখা চিঠির জবাব দিতে হবে হিন্দিতেই। ফাইলে প্রথম নাম লিখতে হবে হিন্দিতে, পরে ইংরেজিতে। সার্ভিস বুকও যথাসম্ভব হিন্দিতে লিখতে হবে, প্রয়োজনে ফাইলে স্বাক্ষরও করতে হবে হিন্দিতে। এখানেই শেষ নয়, এই হিন্দি ভাষার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তার নিয়মিত নজরদারি করা হবে এবং এই অত্যাশ্চর্য নিয়মের অন্যথা হলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, এমনটাই বলা আছে। 

আতঙ্কের ব্যাপার হল এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, ছাত্র, গবেষক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মীদের প্রায় ৯০ শতাংশই বাঙালি যাদের মধ্যে এহেন নির্দেশিকায় যুগপৎ বিস্ময় ও বিতর্ক ছড়িয়েছে। এই সাংঘাতিক কর্মকাণ্ডের অর্থ হল বাঙালি যদি না শোনে তাহলে বাঙালির কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে জোর করে  হিন্দিতে লেখাতে হবে এবং তেমন প্রয়োজন হলে পরবর্তী সময়ে জোর করে বলাতেও হবে।  

স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যিক ও শিক্ষিত মহলে এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ উঠে এসেছে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্তকে 'ভাষা-সন্ত্রাস' নামে আখ্যা দিয়েছেন এবং বিখ্যাত বাঙালি অধ্যাপক সুগত বসু এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছেন এমন নির্দেশ বিজ্ঞান চর্চার অন্তরায় এবং বাংলার জন্য মর্যাদাহানিকর। 

বাংলা ও বাঙালির সম্মানে এমন খড়্গাঘাত অবশ্য এখানেই থেমে থাকছ না। গত ১৩ই ডিসেম্বর ২০২০-তে আনন্দাবাজার পত্রিকায় আরেকটি প্রতিবেদনে বেরিয়েছিল যে সাংসদ সুব্রহ্মন্য়ম স্বামী ভারতের জাতীয় সংগীত জনগণমন-র পরিবর্তন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সে চিঠির দ্রুত সাড়াও পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আন্দাজ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না যে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে আপাতত এই প্রস্তাবটি স্থগিত রাখা আছে, তবে ভোট মিটলেই সে প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। 

এসবের পরে খুব সঙ্গত কয়েকটা প্রশ্ন উঠছে - আমরা কি অজান্তেই বড্ড বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি কতিপয় নেতা নেত্রীদের যার ফল ভুগতে হচ্ছে আমাদেরই ? নাকি বাংলার মানুষকে নির্বোধ ও দুর্বল ভাবছেন কিছু শ্রেণীর মানুষ ? তাই যদি হয় তাহলে যারা বাংলা ভাষাটাকে খাটো করে, জোর করে অন্য ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইছেন তাদের জেনে রাখা ভালো যে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ বা বিপ্লব, এসবের কোনো কিছু গড়ে উঠতে সময় লাগে না এই পুণ্য বঙ্গভূমিতে.... ইতিহাস জানে সে কথা.....

Friday, April 3, 2020

বসন্ত আটকে গেছে

এই আশ্চর্য দুনিয়ায় নানান জিনিস দেখার আছে। তবে চোখ বুজে যে সব জিনিস দেখতে পাই তাদের মধ্যে অন্যতম হল স্বপ্ন। সে স্বপ্ন নীল আকাশে বকের ডানায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়াক বা অন্ধ গলির বাঁকে হুমড়ি খেয়ে পড়ুক, স্বপ্ন দেখতে আমার বরাবরই দিব্যি লাগে।  

তবে কিনা আমি শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী, ল্যাদখোর বাঙালি। নিত্যদিনের অফিস আর সংসারের আওতায় নিজের জীবনটাকে আচ্ছা করে গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলেছি। এর থেকে বেশি লংজাম্প দিয়ে হনুমানের মতো গন্ধমাদন বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়, বা হলেও তেমন কোনো ইচ্ছে মনের মধ্যে পোষণ করি না। সারা সপ্তাহ নানান চাপের জোয়াল কাঁধে বয়ে রোববারের বারবেলাটুকু কচি পাঁঠার লাল লাল ঝোলের তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারলেই নিশ্চিন্তি, অর্ধেকের বেশি যুদ্ধ আমার ওখানেই জেতা হয়ে যায়। এর ওপর রয়েছে সিনেমা, শপিং মল, রেস্তোঁরা ও বছরে একবার পারিবারিক ভ্রমণের অব্যক্ত উত্তেজনা। তার ওপর যদি প্রসংশার মালা গলায় ঝোলে তাহলে তো চোখের জল মাপতে চিবুকের নিচে বাটি ধরতে হয় আমাকে ।

কিছু কিছু স্বপ্ন আমার যেমন আওতার মধ্যেই থাকে। এই ধরুন বন্ধু জুটিয়ে দুম করে বেপাত্তা হয়ে যথেচ্ছ বেলেল্লাপনা করে ফিরে আসা অথবা চিলেকোঠার ঘরে চুপচাপ নির্বিবাদ ল্যাদ খেতে খেতে বই পড়া বা খানিক লেখালিখি করা ইত্যাদি। যদিও এসব ক্ষেত্রে সাফল্যের হার নিচের দিকেই থাকে, তবু এ সমস্ত স্বপ্ন দেখতে আমি বিন্দুমাত্র কসুর করি না, কারণ ওটুকুতেই আমার স্বর্গলাভ হয়।
 
বরং সেই সমস্ত স্বপ্ন আমি দেখিই না যেগুলো আমার আওতার বাইরে। এই যেমন মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আমাদের জীবনে রে রে করে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল করোনাভাইরাস নামক একধরণের সাইক্লোন যা আমাদের সমস্ত হিসেবের খাতা এক নিমেষে ওলোট পালট করে দিশেহারা করে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চব্বিশ ঘন্টার জনতা কার্ফ্যু, তার পরেই ৩১শে মার্চ অবধি ট্রেন-মেট্রোর বন্ধ ঘোষণা আর তার দুদিন কাটতে না কাটতেই একেবারে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন।

চোখ মুখ একযোগে ঝাপসা হয়ে গেল আমার। প্রথমটায় খানিক থম মেরে গেলেও ধীরে ধীরে প্রাথমিক শকটা কাটিয়ে উঠে এই সময় ঠিক কি করা প্রয়োজন তার একটা লিস্ট আমি মনে মনেই বানিয়ে ফেলে ছিলাম। সঙ্গে আগামী ২১ দিন কি কি অসুবিধে হতে পারে আর কেমন করে সেগুলো ডজ করে বেরোতে হবে এটাও ভাবতে আমার দু মিনিটের বেশি সময় লাগে নি।

আমি নিশ্চিত, এসময় অনেকেই হয়ত আমার মতো চিমটি কেটে দেখেছেন নিজেদের, এই ভেবে, যে স্বপ্নটা কি বেশি দেখা হয়ে গেল নাকি ? কাল রাতে ভুল করে কিছু খেয়ে ফেলিনি তো বাপ্ ! ভিতরে ভিতরে অনেকেই নির্ঘাত ভেবেছেন - ২১ দিনের অপরিমিত ল্যাদ ! মাইরি ! ঠিক শুনছি তো ?

টানা বেশ ক'দিন রুটি আর পানসে তরকারি খাওয়ার পর হঠাৎ করে যদি গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি পাতে পড়ে, তখন মুখ চোখের ওপর যেমন চরম উল্লাসের মানচিত্র ফুটে ওঠে এ খবর শোনার পর আমারও প্রাণটা চড়াই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে শরীর থেকে বেরিয়ে সারা ঘর নেচে কুদে আবার বুকের মধ্যে সেঁধিয়েছিল। যতটা পেরেছি মুখ চোখ ভাবলেশহীন রেখেছিলুম। কি জানি, বেশি আমোদ করলে আবার লোকে বলবে,কেমন মানুষ তুমি বাছা ? সারা দেশে যুদ্ধ লেগেছে, লোকজন মরতে বসেছে , মানুষের চাকরি থাকবে কিনা ঠিক নেই, খাবার পাব কিনা জানা নেই আর তুমি ল্যাদ খাবে বলে তার সুখটানের খুসবু ছড়াচ্ছ চাদ্দিকে !

আহ, সে চিন্তা কি আর আমার নেই বলে ভাবছেন ? আছে গো কত্তা আছে, বরং আমার এবং আমার মতো আরও অনেকেরই আছে। চাকরি পেতে আর সেইটা ধরে রাখতে কি কি করতে হয় সে আর আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে ! আর খাবার ? সে তো সরকার বন্দোবস্ত করছে । সুতরাং সারা সপ্তাহ পাহাড়প্রমাণ চাষের পর ওটুকু ল্যাদের স্বপ্ন বলদও দেখে থাকে, আমরা তো কোন ছার !

যাগ্গে যাক, যে কথা হচ্ছিল.............তো সময়মতো লকডাউন হল। আর আমার মনের মধ্যে অযাচিত ভাবেই 'দোলে মন দোলে, অকারণ হরষে…' এর মতো অবস্থা হতে লাগল।

এই গোটা সিজনে আমার ক্যালকুলেশনে চরম ভুলটা ওইখানেই হল। ওয়ার্ক ফ্রম হোম ডিক্লেয়ার ছিল আগে থেকেই আর তার সাথে ছিল শেষ না হওয়া কাজের লিস্ট। তাই সকাল বিকেল কতকটা নারায়ণের মতো আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপের সামনে ধ্যানগম্ভীর মুখ করে কাজ করলাম। কাজের সময়টুকু শেষ হবার পর পরই লাগামছাড়া গরুর মতো সারা বাড়ি পায়চারি করে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলাম, ভাবটা এমন যে কি কি কাজ বাকি আছে দেখে নিই, সেগুলো এই লকডাউনেই সরে ফেলতে হবে। এছাড়া অতি উৎসাহে ঝাড়পোঁছ, আনাজ কেটে দেওয়া, বাজার করা, গাছে জল দেওয়া, কাপড় শুকোতে দেওয়া আবার নামিয়ে আনা ইত্যাদি বিবিধ গৃহস্থালি কাজে একেবারে পারদর্শী হয়ে উঠলাম।  

তবে বেশ কদিন কেটে যাওয়ার পর আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে যাওয়ার মতো চেতনার উন্মেষ ঘটল যেন। মনে হল,বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে চরে বেড়ানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমন করে বসন্ত এল কই ????? অর্থাৎ কিনা যে প্রলম্বিত অবসরের কথা ভেবে মনে মনে উত্তেজনার আঁচ পোহাচ্ছিলুম সেতো দুদিন না যেতে যেতেই ফুস করে নিভে গেল। 

উপরন্তু কাজের পরিমান দ্বিগুন হল......তার কারণ কাজের ও রান্নার মাসিরা আগের থেকেই আসব না বলে পেন্নাম ঠুকে রেখেছেন। মধ্যিখান থেকে আমি বলির পাঁঠা হয়ে খামোখাই দিন রাত জবাই হতে লাগলুম। বাড়ির গিন্নি তিন বেলা রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতে লাগলেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই যাবতীয় ঠিকে কাজটা আমারই ঘাড়ে এসে পড়ার যোগাড় হল। অতএব যে কাজটা 'বোনাস দিলুম' বলে এক দু'বার করে দিয়েছিলুম সে কাজটাই যেন প্রত্যেকদিন গলার ফাঁস হয়ে চেপে বসতে লাগল। তার ওপর সন্তান ছোট এবং স্কুল যেহেতু ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ, সেক্ষেত্রে তারও অর্দ্ধেক দায়িত্ত্ব এসে পড়ল এই শর্মারই কাঁধে, বোঝো ঠ্যালা ! এ যে ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার হয়ে গেল……!  মাইরি বলছি, এমন বসন্ত চেয়েছি বলে তো মনে করতে পারছি না। 

বাড়ি ফিরে অনেক সময়ই বলতাম ‘আজ ব্যাপক স্ট্রেস গেছে, একটু চা করে দিও প্লিজ’। মুশকিলটা হচ্ছে এই বাজারে কোথা থেকে ফিরব আর কাকেই বা বলব ! অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের থেকেই চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিতে হয়েছে। তাতে অবশ্য মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হচ্ছে না, বরং তেমন দেখতে গেলে বলা যায় প্রেম খানিকটা বাড়ছে বইকি…….. এইটাই বা কম কি! তবে ঝামেলাও যে হচ্ছে না তাই বা বলি কি করে....ঘরের বাসন কোসন একত্রে পাশাপাশি রয়েছে অথচ ঝনঝন করে শব্দ হবে না এমন অলীক কল্পনা আমি করি না। এই করেই চলছে....... সাথে গুরুমন্ত্রের মতো কাঁসর বাজানো আর লাইট জ্বালানো তো আছেই......

আমার বিশ্বাস অনেকেরই বাড়িতে একই ঘটনা ঘটছে। যারা ভাগ্যবান এবং এসব তুচ্ছ জিনিসের উর্দ্ধে তাঁদেরকে আমার প্রণাম কিন্তু যাঁরা আমার মতো অন্য বসন্তের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা আপাতত ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রেমটাই ভালো করে করতে থাকুন, আর কি করবেন ? কিছু কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থাকুক নাহয়।

পুনশ্চ : এরই মধ্যে যাঁরা আপৎকালীন পরিষেবার জন্য দিনরাত এক করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁদের জন্য আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বস্তুত আপনাদের জন্যই এযাত্রা টিকে যাব বোধহয়। 



#bengaliarticle #molat #coronavirus #COVID19 #debdattasinha

Saturday, August 10, 2019

বন্ধু চল # ৪ - ফলতা

কতটা মরিয়া হলে মানুষ এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে সেদিন আমাদের দেখলে খানিকটা হলেও
ছবি : সৌম্য 
বোঝা যেত বোধহয়। বাইক নিয়ে শেষ বেরিয়েছিলাম সেই গত বছর। তারপর যাচ্ছি যাব করে দুটো গ্রীষ্ম, দুটো বর্ষা আর একটা শীত পেরিয়ে গেলেও কিছুতেই ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে পারিনি দুজনে। বাইরে না বেরোতে পারার গুমোট ভাবটা ততদিনে কয়লার ধোঁয়ার মতো লতিয়ে উঠেছে। অবশেষে, 'নিকুচি করেছে ! যা থাকে কপালে' বলে দুম করে বানিয়ে ফেললাম একেবারে দুদিন-এক রাত কাটানোর মতো একটা চরমতম প্ল্যান। নাহ, ফ্যামিলি নিয়ে নয়, বরং লাগামছাড়া বাউলের মতো স্বাধীনভাবে কাটানো কয়েক মুহূর্তের অবকাশ যাপন।  

যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাড়িতে সমস্তটা গুছিয়ে বলার আগেই গুগল ঘেঁটে ফলতার হোটেল সি-বার্ড ইন্টারন্যাশনাল বুক করা হয়ে গেল। এ যেন কতকটা সেই স্কুলের পিকনিকে যাওয়ার মতো। বাস তো বুক করা হয়ে গিয়েছে, এখন তো আর না বলার উপায় নেই।

"কি আশ্চর্য ! বুক করে ফেললে ! কোথায় হোটেল ? কি ব্যাপার ? সঙ্গে আমরা গেলেও তো হত ! দিনের দিনে কি ফেরা যেত না" ? এমন ধারার নানাবিধ প্রশ্নকে মেসির মতো ডজ করে কাটিয়ে বেরিয়ে গেলুম দুজনেই। কারণ আগেই বলেছি মরিয়া হলে মানুষ যা ইচ্ছে করতে পারে। অতএব সক্কাল সক্কাল বাইকে তেল ভরে নিয়েই ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে দে চম্পট।

ছবি : নিজস্ব 
মাঝে শুধু একবার মাত্র দাঁড়িয়েছিলাম। আমতলা পেরিয়ে সরিষাহাট মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে দু তিন কিলোমিটারের মাথায় একটা স্বামীনারায়ণের মন্দির পড়ে। সে এক দেখার মতো স্থাপত্য। পোড়ামাটির রঙে সে আশ্চর্য শিল্প অজান্তেই মনের মধ্যে সম্ভ্রম জাগায়। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আবার দৌড়।

অর্জুন, শাল, টিক, মেহগনি আর সেগুন গাছের ছায়ায় ততক্ষনে আমাদের শহুরে ক্লান্তি খসে পড়েছে শরীর থেকে। রাস্তার দু দিকে ঘাড় ঘোরালে অজস্র সবুজের কোলাজে চোখে নেমে আসছে পরম শান্তি। দূর আকাশে ধূসর মেঘের ছবি আঁকা হয়ে চলেছে রাস্তার ওপরেই, বাইকের চাকা সে ছবি ছুঁয়ে ছুটে চলেছে অদম্য, অজানা আকর্ষণে।

প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর নৈনান মোড় থেকে বাঁদিক ঘুরে সটান উপস্থিত হলাম হোটেলের সামনে। আশেপাশে আরও দু একটা হোটেল আছে বটে তবে আমাদেরটা গঙ্গার একেবারে লাগোয়া। এমনিতে জনবসতি শূন্য এলাকা তবে দু একটা ইন্ডাস্ট্রি থাকার ফলে রাস্তার ওপর কখনো কখনো মানুষের দেখা মেলে। অবশ্য আমাদের তাতে কিছু আসে যায়নি। বেলেল্লাপনা করাটাই যাদের লক্ষ্য তাদের কাছে চড়াই পাখিও যা, চিংড়ি মাছও তা।

প্রথমটায় কটেজ বুক করা ছিল। দেখার পর নাপসন্দ করে আমরা সোজা একটা ডিলাক্স রুম ভাড়া
ছবি : হোটেল সি বার্ড 
নিই, ডাবল বেডরুমের ভাড়াতেই। ম্যানেজার কি কারণে সদয় হয়েছিল জানা নেই। বোধহয় ভেবেছিল, আহারে ! অত দূর থেকে দুটো বাঁধা গরু ছাড়া পেয়ে এসেছে, ওদের খানিক শান্তি  না দিলে নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হতে পারে। সে যাইহোক, চটপট লাগেজপত্র রেখে তোয়ালে নিয়ে চলে গেলুম সুইমিংপুলের ধারে। কোমর সমান জল, তাতেই কৈ মাছের মতো এমাথা ওমাথা সাঁতার কেটে নিল সৌম্য। আমার বরাবরই ডুবে যাবার ভয়, তাই আধা ডুবন্ত - আধা ভেসে থাকা অবস্থায় সুইমিং পুলের পার ধরে হেঁটে চলে বেড়ানোটাই নিরাপদ বলে মনে হল । যেদিকটায় জল বেশি, অর্থাৎ আমার গলা পর্যন্ত  ডুবছে সেদিকটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলাম।  সৌম্য যদিও আমাকে সাঁতার শেখাবে বলে জানপ্রাণ লাগিয়ে দিয়েছিল, তবু কাতলা মাছের মতো ঝটাপটি করা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছুই হয়ে উঠল না সে যাত্রা।

ঘন্টাখানেক পর সুইমিংপুলের মায়া ত্যাগ করে ঘরে এসে চেঞ্জ করে ডাইনিং হলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মিনিট পাঁচেক বাদেই চলে এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, এক চামচ ঘি, সোনামুগের ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, চাটনি আর পাঁপড়। খিদের চোটে সেসব কর্পূরের মতো উবে গেল দেখতে দেখতে। আয়েশের ঢেকুর তুলে মৌরি চিবোতে চিবোতে ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটে ছোঁব কি ছোঁব না করছে।

ছবি : হোটেল সি বার্ড 
রিমোট নিয়ে এদিক ওদিক চেক করতে করতে দেখলাম কোনো একটা মুভ্যি চ্যানেলে 'লাডলা'  চলছে, সবে শুরু হয়েছে। নব্বই দশকের অনিল কাপুর - শ্রীদেবীর দুরন্ত হিট ছবি। প্রত্যেকটা গান আমাদের মুখস্ত ছিল। মনে পড়ল স্কুলে এক সময় টেবিল বাজিয়ে এই ছবির কত গান করেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে ছবিটা দেখতে শুরু করে দিলাম দুজনেই। যেন এতো দূরে এসেছি দুপুরবেলা লাঞ্চ করে 'লাডলা' দেখব বলে। এক একটা সিন্ চলছে আর আমরা নিজেরাই ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছি। আবার ভেবে অবাকও হচ্ছি যে সিন্ পর্যন্ত মুখস্ত আছে আমাদের, এখনও......

দুপুর গড়িয়ে, বিকেল পেরিয়ে কখন সন্ধ্যে নেমেছে আমাদের খেয়াল ছিল না। সিনেমা শেষ হতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরেটা ধূসর হয়ে এসেছে। হোটেলের বাইরে গঙ্গার পারে বসে চা খাব বলে ঠিক করলাম। দু মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে গঙ্গার পারে এসে দেখলাম একটা ঢাউস স্টিমার নদীর একেবারে মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে জিরোচ্ছে বলে মনে হল। হলদিয়ার বন্দরটা সীমান্তের শেষে আবছায়া দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপরে টিমটিমে আলোয় একটা চায়ের দোকানে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। তার সোঁদা গন্ধ কুণ্ডলী পাকিয়ে নদী পেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। দোকানের পাশেই ভূত বাংলোর মতো একটা সাদা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। অন্ধকারে কয়েক বছরের জীর্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। বেশ একটা গা ছমছমে মায়াবী পরিবেশ। বেশি দূর এগোলাম না আর আমরা। একটা শান বাঁধানো ধাপিতে বসে খানিক গুলতানি করে আবার পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

ফিরে এসে আবার আরেক রাউন্ড সিনেমা। যেন সিনেমা দেখাই মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের। অবশ্য বিনা বাধায় বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পাওয়া অনেকটা লটারি পাওয়ার মতোই। যাঁরা বিবাহিত তাঁরা নিশ্চই সহমত হবেন আমার সঙ্গে। আপনার পছন্দের সেরা ছবিটা টিভিতে চলছে, আর আপনি নিশ্চিন্তে বসে মৌজ করে সেটা গিলছেন, এমনটা আপনার কপালে যদি জুটে থাকে তাহলে আপনি যথেষ্ট ঈর্ষার পাত্র। খানিক সিনেমা দেখে আর বেশ খানিকটা আড্ডা মেরে আমাদের সময় কাটছিল। রাতে তন্দুরি রুটি আর মালাই কোফতা খেয়ে দিব্যি আমেজ এল। বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেদেরই খেয়াল ছিল না।

পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল। সৌম্যর ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বেচারা কোনো কাজ না পেয়ে ঘরের টেবিল চেয়ার সরিয়ে ঠিক করে রাখছিল। সংসারী ছেলে। সেসবের আওয়াজেই ঘুম ভাঙে আমার। এমন নির্ঝঞ্ঝাট অলস সকাল শেষ কবে পেয়েছিলুম মনে করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার দিকে। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বুকভরা অজস্র মুহূর্ত আর বেঁচে থাকার রসদটুকু। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে পিছুটান ভুলে এমন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অনেকটা দূরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরাটা একটু বেপরোয়া হলেও দিব্যি লেগেছিল কিন্তু আমাদের।

এই প্রসঙ্গে বলি - পরের বারটার জন্য একটা বেড়ে লোকেশন খুঁজছি.....জানা থাকলে বলবেন তো.....

কৃতজ্ঞতা : সৌম্য ও সৌম্যর বাইক 


ছবি : নিজস্ব 
#bengalitravelblog #traveldiaries #Molat #debdattasinha #bengaliarticle #bengalweekendtour #travelstories

Friday, June 14, 2019

পিচ-বৃষ্টি ও আন্দোলন

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ বৈচিত্রে ভরপুর। সমর্থকদের জন্য এমন অভূতপূর্ব সারপ্রাইজ মাথাকুটেও ভাবা যায় না। মারকাটারি খেলার সাথে সাথে বাম্পার বোনাঞ্জার মতো বৃষ্টি দেখার আনন্দটুকুও যে ষোলো কলায় পূর্ণ  হবে এ বোধহয় অতি বড় সমর্থকও বুঝতে পারেননি। আর এই খেলাকে খেলা না বলে ছেলেখেলা বলব না পুতুল খেলা বলব সেসব ভাবতে গেলে আবার একটা ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে বরং বসে বসে সুপার সপারের কেরামতি দেখি ও গোটা মাঠ না ঢাকার ফলে মাঠকর্মীদের দ্বিগুন পরিশ্রমের পর্যালোচনা করে দুখী মনটাকে চায়ের কাপে ভিজিয়ে নিই।  

জনৈক উচ্চপদস্থ এক আইসিসি কর্মকর্তা বলেছেন যে ওনারা জানতেন ইংল্যাণ্ডে বৃষ্টি হবে তবে দ্বিগুন বৃষ্টি হবে সেটা নাকি আগাম আঁচ করতে পারেন নি। আবহাওয়াবিদরা অনেক আগেই বলেছেন এই সময়টায় বৃষ্টি হবে - এটাই যথেষ্ট নয় কি এবং সেটা জানার পরও এই সময় ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেললেন কি কারণে ? থর কি হাতুড়ি মারফত স্বপ্নাদেশে বরাভয় দান করেছিলেন নাকি আগাম সতর্কবার্তাকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তারা বলতে চেয়েছিলেন "চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা"...…..

১৮টা ম্যাচের মধ্যে এখনো অবধি ৪টে ম্যাচ বাতিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এই বছরটা বাদ দিলে এখনো অবধি শুধুমাত্র দুটো ম্যাচই বাতিলের খাতায় নাম তুলেছে। একটি ২০১৫ সালে এবং আরেকটি ১৯৭৯ সালে। এক্ষেত্রে রিসার্ভড-ডের উপকারিতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইসিসির কর্মকর্তারা বলছেন যে প্রত্যেকটা ম্যাচের জন্য রিসার্ভড-ডে রাখা হলে বহুদিন ধরে খেলা চালিয়ে যাওয়া পারতপক্ষে সম্ভব ছিল না। হরিবোল ! খেলাটা যখন বিশ্বকাপ এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের নজর থাকবে যেখানে সেটা নিয়ে আরও একটু দূরদর্শিতা দেখালে কি বিগ বাজারের উইকেন্ড ডিসকাউন্টটা মিস হয়ে যেত ! একটি চমকপ্রদ তথ্য দিই। ১৯৯৯ সালে এই ইংল্যান্ডেই আয়োজিত বিশ্বকাপে প্রত্যেকটি ম্যাচের জন্য একটি করে রিসার্ভড-ডে রাখা ছিল। 

আগামী দিনগুলোর মধ্যে যে সব দিনে ম্যাচ হবে সেখানে কয়েকটা দিন বাদ দিলে বাকি প্রায় সবকটা ম্যাচেই বৃষ্টি হবার প্রভূত সম্ভাবনা আছে - এমনটাই নাকি পূর্বাভাস। হরি হে মাধব ! চান করব না গা ধোব ! সুতরাং যে সমস্ত টিমের ম্যাচ বাতিল হতে থাকবে সেমি ফাইনালে ওঠাটা তাদের পক্ষে ততটাই দুঃসাধ্য হতে থাকবে। সবথেকে আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে ইংল্যান্ডের প্রায় সবকটা মাঠেই নাকি জল নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। শুধু পিচ ও পিচের চারিধারটা ঢেকে ফেললেই নিশ্চিন্তি, এতেই রাত্তিরে ভালো ঘুম হবে। ওরে পাগল ! ইডেনটা একবার দেখে যেতে পারতিস তো। তাছাড়া চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে সাব-এয়ার ড্রেনেজ সিস্টেমটা শিখে নিলেও তো হত। শ্রীলঙ্কায় পর্যন্ত গোটা মাঠ ঢাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আদ্যিকালের ভেঁপু বাজিয়ে কি আর জাস্টিন বিবারের শো হয় গুরুদেব ! 
   
এমতাবস্থাতেও আইসিসির পক্ষ থেকে তেমন কোনো হেলদোল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পরের ম্যাচগুলো ভেস্তে গেলে ঠিক কি হতে পারে তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভাবটা এমন যে ছাড়ুন তো মশাই, মোটে তো চারটে বছর, ও দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। পরের বার নাহয় ভরা জ্যৈষ্ঠে  সাহারা মরুভূমিতে স্টেডিয়াম করে বিশ্বকাপ করাব। বৃষ্টি হলেও বালিতে শুষে নেবে। সে আপনারা করুন গে, কিন্তু তাই বলে সমর্থকদের অপেক্ষা, আনন্দ আর উত্তেজনা মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, তার কি হবে ? কয়েকশো কোটি টাকার ভোজে প্যান্ডেলটাই ঠিক মতো বেঁধে উঠতে পারলেন না যে। অগত্যা সন্ধ্যের দিকে টিভি খুলে চপ মুড়ি খেতে খেতে শাপ শাপান্ত করা ছাড়া আর তেমন কোনো গতি নেই সমর্থকদের। একটা লাভ অবশ্য আছে। চপ মুড়ির শিল্পে একটা উন্নতি দেখা দিলেও দিতে পারে।
 



#molat #rainatengland #matchabandoned #CWC2019 #DebdattaSinha
   
 

Friday, September 7, 2018

অস্থায়ী সংলাপ

বিন্যাস : নিজস্ব

এ পৃথিবীর কোনো কিছুই যে স্থায়ী নয় তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আজ যা আছে কাল তা নেই এ যেন আমাদের সংক্ষিপ্ত যাপনের মর্মকথা। সংবাদপত্রের পাতায় একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনার সাজানো অক্ষরের রেলগাড়ি ছুটে যায় আমাদের চোখের সামনে দিয়ে। সেসব আমাদের ভাবায়, শেখায় আবার কখনো বা উপেক্ষার রুক্ষ প্রান্তরে ধুলোমেখে গড়াগড়ি খেতে থাকে। উপেক্ষার একমাত্র কারণ বোধহয় অভ্যাস, যার দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলতেই ভালোবাসি আমরা সকলে। বন্যা, সেতুভঙ্গ, জনসমক্ষে খুন, রাহাজানি ও সর্বোপরি শৈশব ছিনতাই - এর কোনোটাই বোধহয় আর দাগ কাটে না আমাদের। 'এই বেশ আছি' এই ফাঁপা বোধটা আঁকড়ে ধরে নিশ্চিন্তে বালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকি রাতের পর রাত। পরের দিন মনখারাপের জেটল্যাগ কাটিয়ে আবার আগামী স্বপ্নের ফিতে কাটতে বেড়িয়ে পড়ি।   

এই প্রসঙ্গে বহুদিন আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। সালটা বোধহয় '৯৩ বা '৯৪ হবে। তখন আমি এইট বা নাইনে পড়ি। সম্ভবত ছুটির দিন হওয়াতে আমি বাড়িতেই ছিলাম। এমন সময় অনাহূত প্রচন্ড ঝড়ের মতো আমার নার্সারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের মৃত্যুসংবাদ এল। সে স্কুলের কথা ভাবলেই আলিপুর রোডের মোড়ে দুটো বিরাট কালো রঙের থামওয়ালা একটা তিনতলা বাড়ির কথা মনে পড়ে। ছোট্ট একটা লোহার গেট পেরিয়ে কাঠের দরজা খুলে যে ঘরটায় ঢুকতাম তার দেওয়ালে আঁকা থাকত আমার আধো, অস্ফুট শৈশব। ঘন সবুজ ছায়াঘেরা জঙ্গল আর তার মধ্যে থাকত হাতি, গণ্ডার, জিরাফ আর বাঘের খেয়ালি রূপকথারা। ভিতরের দরজা দিয়ে ঢুকতেন গোলগাল, গৌরবর্ণা, সহজপ্রাণ এক প্রবীণা। ঠিক আমার দিদিমার মতো মুখের অবয়ব। তাঁর পরিপাটি শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা স্নেহের ঘ্রান পেতুম সেসময়। তিনি আমার অবোধ সময়ের বড় আন্টি। তিনি আর নেই এই খবরটা শোনার পর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সোজা হাজির হয়েছিলুম পুরোনো স্কুলের দোরগোড়ায়। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গিয়েছিলুম দোতলার বড় ঘরটাতে যেখানে প্রায়শই আমাদের অনেককেই ডেকে নিয়ে বারান্দার বাগান দেখাতেন। এসমস্ত জলছবির মত মনে আছে আজও তার কারণ সেসব মুহূর্তদের ভুলে যেতে চাইনি কখনোই। 

ঘরটায় এসে যখন দাঁড়ালাম তখন তিনি লাল সিমেন্টের মেঝেতে ফরাস পাতা গদির ওপর পরমশান্তিতে ঘুমিয়ে ছিলেন। আত্মীয়স্বজনের থমথমে মুখ আর দীর্ঘশ্বাসের আবহে সময়ের ঘরে কাঁটা সরছে না। ঘরভর্তি মানুষের মাঝখানে স্থানুর মতো কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। সম্বিৎ ভাঙল যখন কেউ একজন অকস্মাৎ বলে উঠলেন, 'মা, তুমি টিউশন চলে যাও, শ্মশানে যাওয়ার দেরি আছে এখনো, টিউশনটা কামাই কোরো না'। তাকিয়ে দেখলাম, মা বলে যাকে সম্বোধন করা হল সে আর কেউ নয়, বড় আন্টির আদরের নাতনি। খানিকক্ষণ দোনোমনো করে ছলছল চোখে সে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সম্ভবত কোচিং ক্লাসের গুরুত্বটা তার কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল অথবা গুরুজনের বজ্রনির্ঘোষ উপেক্ষা করে না বলাটা সে রপ্ত করতে পারেনি সেসময়। স্তম্ভিত হয়েছিলাম বললেও খুব ছোট করে বলা হয়। কথাটা যেন তীরের মতো ছুটে এসে মাথাটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠা তথা অঞ্চলের অন্যতম প্রবীণা শিক্ষিকার প্রয়াণের থেকে কোচিং ক্লাসের গুরুত্ব কেন যে এত অপরিসীম তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি সেদিন। আরও আশ্চর্য হয়েছিলাম কারণ পরিবারের দু চারজন সে কথার সমর্থন করেছিলেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার দরুণ বিবিধ সমীকরনের সান্নিধ্যে এসেছি, কিন্তু এহেন জটিল সমীকরণ কিভাবে মেলাতে হয় তা আমার বুদ্ধির বাইরে ছিল। 

আজ বুঝতে পারি, যেকোনো মৃত্যুই একটা ঘটনা মাত্র। স্থান, কাল, পাত্রের চিত্রপটে তা কখনো গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে আবার সময়ের প্রলেপে হয়ে পড়ে নির্জীব, গুরুত্বহীন। বিশেষত পরিবারের বাইরে হলে গম্ভীর মুখে পাশে গিয়ে দাঁড়াই বটে তবে অনুভবের ইচ্ছে বা শক্তি দুটোর কোনোটাই থাকে না। তাতে অবশ্য দোষের কিছু দেখি না। তার জন্য দায়ী ব্যক্তিগত ঘেরাটোপ বা সময়ের স্বার্থপরতা। দুটোই মাধ্যাকর্ষনের মোহে টানতে থাকে নিজেদের মাপা কক্ষপথের দিকে। সেখান থেকে বেরোবার বিশেষ উপায় থাকে না। তার ওপর যখন মরণোত্তর পুরস্কারের ঘোষণা থাকে তখন যেন প্রাণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ভাবি, যাক বাবা ! কিছুটা অন্তত রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট পাওয়া গেছে। মনে শান্তি আসে, পেট ভর্তি চোরা অম্বলের তৃপ্তির ঢেকুর তুলে গুটিগুটি পায় বিছানার দিকে পা বাড়াই। বুঝতে পারলেও ঘুনাক্ষরেও নিজেকে টের পেতে দিই না যে যখন তখন 'আছি' থেকে 'নেই' হয়ে যেতে পারি। সমালোচকরা অবশ্য বলবেন জন্ম মৃত্যু তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। ঠিক ! কিন্তু তাকে অস্বাভাবিকতার রাংতায় মুড়ে রোজ রোজ অকাল প্রয়ানের প্লেটে সাজিয়ে দেওয়ার মধ্যে ঠিক কোন বাহাদুরি আছে তা আমার জানা নেই।  অন্য কারোর জানা থাকলে বলবেন, তাহলে রাস্তায় যাঁরা বেরোচ্ছেন তাঁরা পিছন ফিরে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আপনজনদের টা টা করবেন....এই আর কি ! 

#Molat #bengaliarticle #majherhat #bridgecollapse #kolkata


Wednesday, June 27, 2018

কা(আপ)ডেট # ২

ভেবেছিলাম দ্বিতীয় পর্বটা আর লিখব না। চোখের সামনে একের পর এক অঘটন দেখে মনে হচ্ছিল  বিশ্বজয়ী টিমরা খেই হারিয়ে ফেলেছে। যথেচ্ছ ক্লাব ফুটবল আর মুহুর্মুহু চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ঝড়ের দাপটে উড়ে গেছে নিজেদের দেশের হয়ে খেলার উন্মাদনা। ধ্বংসাবশেষের মতো পড়ে আছে শুধু নিয়মমাফিক বিশ্বকাপ খেলতে আসার অনিচ্ছেটুকু। আইসল্যান্ডের সাথে আর্জেন্টিনার ড্র, পরের দিকে বিরাট ব্যবধানে ক্রোয়েশিয়ার কাছে নতিস্বীকার, সুইজারল্যান্ডের সাথে ব্রাজিলের ড্র, পরের ম্যাচে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে কোনোরকমে গোল, মেক্সিকোর সাথে জার্মানির বিপর্যয় এবং ফ্রান্স জিতলেও তাদের ঢিলেঢালা ফুটবলে সেই আবেগ বড় অনুপস্থিত লেগেছিল। বড় বড় টিমের এমন অবিন্যস্ত ফুটবল দেখার অভিজ্ঞতা আমার মতো ক্রীড়াপ্রেমীদের একেবারেই যে নেই এটুকু বাজি রেখে বলতে পারি। তাই রাতের পর রাত জাগাটা যে ক্রমশ মাঠে মারা যাচ্ছে সেটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিলাম।  

লাভের মধ্যে ছোট ছোট টিমগুলোর যে চরম উত্তেজনা আর কমিটমেন্ট দেখলাম তাতে করে মনে হচ্ছিল এদের মধ্যে অনেককেই হয়ত নক আউট পর্যায়ের ওপরের দিকে দেখতে পাব। বিশেষভাবে উল্লেখ্য পেরু, ইরান, মরোক্কো, জাপান, সুইডেন এবং সেনেগাল যারা সবুজ ঘাসের কানায় কানায় যে দরদটা মজুদ করে  এল তা বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখার মতো। এর পাশাপাশি ছিল রাশিয়া, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড আর ঊরুগুয়ের চোখ ধাঁধানো ফুটবল আর অক্লান্ত নিম্নচাপ বর্ষণের মতো বেশ কিছু গোল। চেয়ার ছেড়ে ওঠার অবকাশটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না তার আগেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গোলপোস্টের জালে আছড়ে পড়ছে একের পর এক সোনালী মুহূর্তরা। 

কিন্তু কথায় আছে পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে, এবং সময় বুঝে তা বাড়লও বটে। ৩০ মিনিটের মাথায় সুইডেনের বিরুদ্ধে এক গোল খাওয়ার পর জার্মানরা ফেরার টিকিট প্রায় নিশ্চিত করে নিয়েছিল। কিন্তু জার্মান রক্ত যে অন্য ধাতু দিয়ে গড়া তা বুঝতে বেশিক্ষন সময় লাগল না। হাফ টাইমের ঠিক পরেই মার্কো রিউসের গোলে জার্মানি সমান সমান পাঞ্জা কষতে শুরু করল। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো জার্মান ডিফেন্ডার বোয়েতাং বেরিয়ে গেল রেড কার্ড দেখে। ১০ জন মিলেও যে বিধ্বংসী ফুটবল খেলা যায় সেটা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল জার্মানি। ইনজুরি টাইমে পেনাল্টি বক্সের সামান্য বাইরে কোনাকুনি জায়গা থেকে ফ্রি কিকে যে গোলটা করল টনি ক্রুস সেখান থেকে গোল হওয়া একরকম অসম্ভব। ঠিক সেই অসম্ভব কাজটাই অসাধারণ বাঁকানো শটে গোল করে গ্রূপের প্রথম ম্যাচ জিতল জার্মানি। তবে পুরোনো চাল ভাতে বাড়লেও মুখ অবধি পৌঁছতে পেলো না। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে লজ্জাজনক পরাজয়ে জার্মানি যে লীগ টেবিল থেকেই ছিটকে যাবে এটা বোধহয় অতি বড় ফুটবল বোদ্ধারও বোঝার ঊর্দ্ধে ছিল।    

গ্রূপ ডির শেষ ম্যাচে যখন আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া মুখোমুখি হচ্ছিল তখন ক্যামেরার ফ্রেমে বারে বারে উঠে আসছিল লিওনেল মেসির মুখটা। গ্যালারিতে তখন নীল সাদার উৎকণ্ঠার মেঘ জমেছে। আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি মিস আর তার পরেই ক্রোয়েশিয়ার কাছে বড় ব্যবধানে হার, এই দুয়ে মিলে বিশ্বের চাপ নিয়ে শুধু টিমটা মাঠে নামছে না, যেন গোটা আর্জেন্টিনা দেশটা খেলতে নামছে তাদের প্রিয় ঈশ্বরের স্বর্গীয় আতশবাজির ঝলক দেখার জন্য। সমস্ত উদ্বেগ, গ্লানি এক লহমায় নস্যাৎ করে দিয়ে, গোটা স্টেডিয়ামকে প্রায় বাকরুদ্ধ করে যেন ঐশ্বরিক প্রত্যাবর্তন ঘটল মেসির। ১৪ মিনিটের মাথায় মাঝ মাঠ থেকে ব্যানেগার একটা উড়ন্ত পাশ ধরার জন্য যে দুর্দান্ত স্প্রিন্ট টেনে বলটা  রিসিভ করল বাঁ পায়ের ঊরুতে সেটা অনেকের কাছেই স্বপ্ন। ওই একইভাবে দৌড়তে দৌড়োতে ঊরু থেকে বলটা বাঁ পায়ের পাতার ওপর নিয়ে দু চার পা আরও দৌড়ে ডান পায়ের কোণাকুণি মর্মভেদী শটে জাল কাঁপিয়ে দিল আর্জেন্টিনার বন্দিত মহানায়ক। অন্যান্য ফুটবলারের চোখের পলক পড়ার সময়টুকুর মধ্যে যে ক্ষিপ্রতায় গোলটা হল সেটা দেখার জন্য আরও অনেক রাত জাগা যেতে পারে। নাইজেরিয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা ফেরালেও আর্জেন্টিনা যে ফুটবলটা খেলল তাতে প্রত্যাশিত ভাবে শেষ গোলটা হল মার্কোস রোহোর দুরন্ত ফিনিশে।

এছাড়া সাম্বা ফুটবলের শৈল্পিক ভাঁজে নেইমার, কুটিনহো, পৌলিনহোদের দেশ অবলীলায় সার্বিয়াকে পাশ কাটিয়ে রাউন্ড ১৬ তে মেক্সিকোর মুখোমুখি হতে চলেছে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর ফিনিশ বিশ্বমানের ফুটবলাররা করবে তাতে সন্দেহ নেই বটে তবে মনের মধ্যে যেটুকু কুয়াশা জমেছিল সেটা কেটে গিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি খেলা জমে উঠেছে........


(চলবে)   


  #fifaworldcup2018 #bengliarticle #football #Molat  

Saturday, June 16, 2018

কা(আপ)ডেট # ১

বাপ্ রে বাপ্ ! এই তিনটে শব্দ ছাড়া আর কিচ্ছু মাথায় আসেনি লেখার আগে। ঠিক যেভাবে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কথা তার চেয়ে অনেকগুন বেশি চমক দিয়ে শুরু হল ১৪ই জুনের সন্ধ্যেটা। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে তখন চাকবাঁধা মৌমাছির মতো প্রায় আশি হাজার দর্শকের গুঞ্জনে কান পাতা দায়। স্টেডিয়ামের আশেপাশের রাস্তায় অগণিত মোহাচ্ছন্ন মানুষের ভিড় । সেন্টার স্টেজে একের পর এক গেয়ে চলেছেন রবি উইলিয়ামস, আগুন পাখির ডানায় ভর করে এডা গ্যারিফুলিনার প্রবেশ আর বাকি লাইমলাইটের সবটুকু শুষে নিয়ে গেলেন ব্রাজিলের রোনাল্ডো, তাঁর নায়কোচিত উপস্থিতি দিয়ে। 

এরপর যে খেলাটা শুরু হল সেটাকে খেলা না বলে ছেলেখেলা বললে বোধহয় বেশি ভালো হতো। বিশ্বকাপ শুরুর দিনেই যে লজ্জাটা সৌদি আরব পেল সেটা ভুলতে বেশ কয়েক বছর লাগবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায়। প্রথম দশ বারো মিনিটের মাথাতেই গোলোভিনের ক্রস থেকে গ্যাজিনস্কির গোল ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে ২০১৮ র প্রথম গোল হিসেবে। ঠিক তার পরেই যেন লক গেট খুলে যাবার মতো উপক্রম হল সৌদি ডিফেনসের। ভেবেছিলাম আরবি ঘোড়ার দল ঘুরে দাঁড়াবে। অচিরেই ভুল প্রমাণিত হলাম। প্রথম হাফে দুটি গোল এবং পরবর্তী হাফে তিনটে গোল, মোট পাঁচটা গোল দিয়ে তিন পয়েন্ট নিয়ে গ্রূপের শীর্ষে চলে গেল রাশিয়া। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য গোলোভিন নামক প্লেয়ারটি যাঁর মধ্যে আগামী দিনে তারকা হওয়ার বারুদ জমা হয়ে আছে। মুহুর্মুহু ক্রসে একের পর এক গোল এবং শেষ মিনিটে নিঁখুত, অনবদ্য ফ্রিকিকে জাত চিনিয়ে দিয়ে গেল এই তরুণ রুশ ফুটবলার। এবারে রাশিয়ার সেরা চমক সন্দেহ নেই।

১৫ই জুন রাত জাগা সার্থক। পর্তুগাল স্পেনের খেলায় যাঁরা ঘুমিয়েছিলেন তাঁদের বলব সময় করে হাইলাইটসটা দেখে নেবেন। খেলা শুরুর প্রথম চার মিনিটের মাথায় রোনাল্ডোকে পেনাল্টি বক্সে ফাউল এবং পর্তুগালের পেনাল্টি কিক। স্বভাবসুলভ ডান পায়ের গর্জন এবং গোলকিপারকে উল্টোদিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে প্রথম গোলে রোনাল্ডোচিত জয়োল্লাস। এখানেই ভেবেছিলাম স্পেন বোধহয় ব্যাকফুটে চলে যাবে। কিন্তু তারকাখচিত স্পেন গুছিয়ে নিতে সময় নিল মিনিট কুড়ি মতো। ছোট ছোট পাসে নিজেদের খেলাটাকেই শুধু নয় আত্মবিশ্বাসটাকেও জড়ো করে নিল সবাই। আর তার পরেই দিয়েগো কোস্তার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে দুজনকে ড্রিবল করে প্রায় মেসিসুলভ ভঙ্গিতে গোল। এরপর স্পেন যে খেলাটা খেলল তাতে করে এটা বোঝা গেল যে তিকিতাকা পাসের ওপর ভর করে দুফুট বাই দুফুট জমি ফাঁকা পেলেও তাতে দিব্যি ফুটবল খেলা যায়। এর ঠিক পরেই  তীক্ষ্ন কাউন্টার এট্যাকে হাফটাইমের প্রায় মিনিটখানেক আগে রোনাল্ডো আরও একবার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে জোরালো শটে গোল করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল 'পিকচার আভি বাকি হ্যায়'। 

হাফটাইমের পরে দিয়েগো কোস্তার দ্বিতীয় গোলে স্পেন ফিরে এলো স্বমহিমায়। ইস্কো, সিল্ভা, ইনিয়েস্তা আর ন্যাচোর মিলিত আক্রমণে পর্তুগিজ ডিফেন্সে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। ফলস্বরূপ, আটান্ন মিনিটের মাথায়  পেনাল্টি বক্সের কয়েক গজ দূর থেকে ন্যাচোর ডান পা থেকে বর্শার ফলার মতো ইনসুইঙ্গার শট পোস্টে লেগে দুরন্ত গোল। ম্যাচের ভাগ্য নির্ণয় হয়ে যায় প্রায় তখনই। ৩ - ২ গোলে স্পেন জিতছে এই ভবিষ্যৎ বাণীটা যে কেউ করতে পারবে তখন। কিন্তু রিয়্যাল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ  প্লেয়ারটা যখন খেলছে তখন পঁয়তাল্লিশ হাজার দর্শকও শেষ দেখার অপেক্ষায় বসে ছিল। শেষ বাঁশি বাজার মিনিট কয়েক আগেই ফ্রিকিক পেল পর্তুগাল। এরপর যা হল তা ইতিহাস। দুচার বার লম্বা শ্বাস নিয়ে প্যান্টটা ঈষৎ গুটিয়ে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল রোনাল্ডো। ততক্ষনে ডানদিকে ওয়াল সাজিয়ে নিয়েছে স্পেনের গোলকিপার দি' গিয়া। সমস্ত দর্শকের হৃদপিণ্ড স্তব্ধপ্রায়। ধীরে ধীরে চোখ খুলে ছুটে এসে ডান পায়ের ভেল্কিতে যে শটটা নিল সেটা সারারাত রিওয়াইন্ড করে দেখার মতো। ওয়ালের ওপর দিয়ে নিঁখুত বাঁকে গোলপোস্টের প্রায় বাইরে থেকে ঢুকে এসে বলটা জড়িয়ে গেল জালে। দি' গিয়া একইঞ্চি নড়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত পায়নি। ৩ - ৩ স্কোরটা শুধুমাত্র একটা স্কোর নয়, আগামী দিনে এমন অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার আগুন জিইয়ে রাখল যার আঁচে পুড়তে থাকবে গোটা বিশ্ব।

(চলবে)



#fifaworldcup2018 #bengliarticle #football #Molat    

Tuesday, April 10, 2018

জিয়ানস্টাল ৩ # আজবৈশাখী ঝড়

তখন আমার চার সাড়ে চার বছর বয়স। চৈত্র মাসে হপ্তাশেষের ছুটিতে মা আর আমি মামার বাড়ি গেছি। মাঝেমাঝেই আমরা শনিবার সকালে যেতুম আর রোববার সন্ধ্যের দিকে বাবা গিয়ে নিয়ে আসতো আমাদের। আমাদের এই চটজলদি হাওয়াবদলের বেশ একটা রেওয়াজ ছিল তখন। সাধারণত শনিবার হলেই সকাল সকাল বাহারি জামা প্যান্ট পরে মায়ের হাত ধরে ট্যাক্সিতে উঠে পড়তুম চেতলার মোড় থেকে। তারপর সোজা সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরতুম। চিতপুর রোড হয়ে জোড়াসাঁকোর ধার ঘেঁষে ডানদিক নিয়ে শিকদার পাড়া স্ট্রিটে এসে থামতুম। উত্তর কলকাতার অতি চেনা বনেদী পাড়ার সরু সর্পিল গলি। গলির একমাথা থেকে আরেকমাথা অবধি বাড়িগুলো এমন বেমক্কা গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকত যে মনে হত যেন গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে এসেছে। আদি ঐতিহাসিক শহরের অনন্য প্রচ্ছদ আর এক আশ্চর্য নোনাধরা দেওয়ালের গন্ধে মনটা মাখামাখি হয়ে যেত। সেই সময় চোখ বুজলেও দিব্যি বলে দিতে পারতুম মামারবাড়ির আশেপাশে কোথাও একটা এসেছি। পুরনো তিনতলা বাড়িটার নিচের তলায় একটা ছোট্ট সোনা রুপোর দোকান ছিল। চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেই কারিগরদের ছেনি হাতুড়ির ঠুক ঠুক আওয়াজ শোনা যেত। ভারি মন মাতানো ছন্দ ছিল সে শব্দে। ভিতরে ঢুকে একটা শান বাঁধানো  কলতলা পেরিয়ে কাঠের রেলিং ঘেরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হতো। সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু থাকার দরুণ আমাকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হতো। 

একদিন দুপুরে দোতলার ঘরে সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে। সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা পুরোনো আমলের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক, তাতে আমি, মা আর দিদা পাশাপাশি শুয়ে আছি। দাদু আর মামারা যে যার কাজে বাড়ির বাইরে। আমার অনিচ্ছা সত্বেও অকারণ ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমাকে প্রায় জোর করেই ঘুম পাড়ানো হতো। সেদিন কি এক কারণে কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। বাড়ির পূর্বদিক লাগোয়া একটা মার্বেলের কারখানা ছিল। সর্বক্ষণ মেশিনের আওয়াজ আর মিস্ত্রীদের অনর্গল কথাবার্তা শোনা যেত। মনে আছে একবার দিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম এই এতো আওয়াজে ঘুমোও কি করে। দিদা বলেছিল, 'অভ্যেস হয়ে গেছে রে, এখন এই আওয়াজটা না হলে যেন ঘুমই আসতে চায় না'। ভারী অবাক হয়েছিলুম সে কথায়। 

যাইহোক সবাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখে আমি দিব্যি পা টিপে টিপে ঘরের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এলুম। এরপর বাঁদিক ঘুরে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ছাতে চলে এসেছিলুম। ছাতটা খুব বেশি বড় না হলেও উঁচু পাঁচিল আর খোপকাটা  জাফরির খাঁজে খাঁজে বিকেল দেখাটা ভারী মনোরম বস্তু ছিল আমার। মান্ধাতা যুগের এজমালি ছাতে একটা চিলেকোঠার ঘর আর সামনে খানিকটা বেওয়ারিশ একফালি চৌকো মতন জায়গা ছিল। ওই জায়গাটায় দাঁড়ালে ছাতের একেবারে মাঝখানটাতে গিয়ে দাঁড়ানো হতো। সেখান থেকে চারপাশটা খুব ভালো করে দেখা যেত। ছোট ছিলাম বলে পাঁচিল পেরিয়ে নিচে রাস্তা দেখতে পেতুম না বটে তবে আশেপাশের বাড়ি আর অনেকটা খোলা আকাশ দেখতে পাওয়ার রোমাঞ্চই ছিল আলাদা।পরে শুনেছিলুম ছাতের দক্ষিণ পূর্ব কোণটা নাকি বাড়ির প্রায় সবারই প্রিয় অবসর ছিল। ওই কোণে বসার জন্য মা আর মামাদের মধ্যে নাকি হাতাহাতি হয়ে যেত প্রায়। বরাবরের মতো ছাতের একচক্কর ঘুরে আমিও ওই কোণটায় এসে দাঁড়িয়েছি। 

এমন সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ভয়ানক মেঘ করেছে। পাক খেতে খেতে ধূসর তুলোটে গোলাগুলো যেন রে রে করে তেড়ে আসছে আমারই দিকে। ক্রমশ তার সাথে উড়ে এল ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত। ক্ষনিকের মধ্যেই জমাট বাঁধা দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেল যেন। স্নিগ্ধ তিরতিরে হাওয়ার এক ঝাপটায় আমার শরীরের আনাচে কানাচে আতরের মতো ছড়িয়ে পড়ল ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। এক অদ্ভুত নেশার মতো পেয়ে বসেছিল আমায়। কতক্ষন এভাবে বুঁদ হয়ে দেখছিলুম জানি না। আমার পিলে চমকে দিয়ে হঠাৎ কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল কাছেই। পাল্লা দিয়ে শুরু হল প্রবল ঝড়ের তান্ডব। চোখের সামনে এমন অপরিকল্পিত চিত্রনাট্য দেখে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলুম। তাড়াতাড়ি কোনোমতে সেই চিলেকোঠা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। চিড় খাওয়া কাঠের ফাঁক দিয়ে দেখলুম চতুর্দিক কেমন আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। যেন কেউ তুলির ওপর কালো কালি লাগিয়ে ক্রমাগত আকাশের একদিক থেকে আরেক দিকে বুলিয়ে দিচ্ছে। নাম না জানা উত্তেজনা আর অবিমিশ্র ভয়ের যুগলবন্দিতে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। অদ্ভুতভাবে নিচে নেমে যেতেও মন চাইল না। কোনো এক অনুচ্চারিত মন্ত্রবলে কিছুতেই এক পা নড়াতে পর্যন্ত পারলুম না। শোঁ শোঁ শব্দে গোটা ব্রহ্মান্ড যেন তোলপাড় করছে তখন। দরজাটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছিলুম। মনে হল এই ঝড় যেন আমায় দেখতেই হবে। এরপর যা যা হবে তা না দেখলে বড্ড আফশোষ রয়ে যাবে আমার।

একঠায় নির্বাক দাঁড়িয়ে ঝড়ের রুদ্ররূপ প্রত্যক্ষ করলুম দুচোখ ভরে। এর পরপরই  শুরু হল তেড়ে বৃষ্টি। তীক্ষ্ন ছুরির ডগা দিয়ে আকাশের মাঝবরাবর কেউ যেন ফালা ফালা করে কেটে দিয়েছে। অবিরাম শ্বেত রক্তক্ষরণের বড় বড় ফোঁটায় ছাতের এক কোণ থেকে আরেক কোণ সে ভিজিয়ে দিল অবলীলায়। নিমেষে জলধ্বনির চরবর চরবর আওয়াজে আমার উৎকণ্ঠাকে দ্বিগুন বাড়িয়ে বাড়ির লোকজনকে একেবারে জাগিয়ে তুললে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার খোঁজ পড়ে গেল চারদিকে। কারণ আমার হারিয়ে যাবার বদরোগের সাথে মামার বাড়ির সকলেই বিশেষ অবগত ছিল। সে আরেক গল্প। অন্য একদিন বলব নাহয়। ততক্ষনে মা ছুটে গেছে নিচে আর দিদা আমার খোঁজে ছাতে চলে এসেছে। আমি তখন দরজার আড়ালে বিমুগ্ধ্ নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। দিদা এসে জিজ্ঞেস করেছিল, 'কি রে ! তুই কাউকে না বলে দিব্যি ছাতে এসে একলা একলা কি করছিস' ? আমি বলেছিলাম, 'এই যে কেমন ঝড় হচ্ছে ! সেটাই দেখছি গো'। দিদা বললে, 'এই ঝড় কি আর একলা বাইরে এসে দেখার জিনিস রে ? এ যে কালবৈশাখী ! তোকে যে উড়িয়ে নিয়ে যায়নি এই আমাদের ভাগ্যি, নিচে চল শিগগির'। 

সেই প্রথম আমি এই ঝড়ের নাম জানলুম। কালবৈশাখীর সাথে সেই আমার প্রথম একক পরিচয়। এমন দুর্নিবার উন্মাদ আচরণ অন্য কোনো কিছুর হতে দেখিনি আগে। যে বেলাগাম দুরন্ত প্রতিচ্ছবি দেখলুম তা সেসময় অন্য কিছু দেখার কাছে নস্যি। এর তুলনা বোধহয় একমাত্র প্রথম জুরাসিক পার্ক দেখার অভিজ্ঞতার সাথে করা যায়। তবে প্রজন্মের কাঁধে মাথা রেখে ইতিহাস যে পুনঃরচিত হয় তার প্রমাণ পেলুম গতকাল হাতেনাতে। 

চিত্র : নিজস্ব 
গতকাল ঠিক তেমনি করেই আমার তিন বছরের পুত্র তাকিয়ে ছিল বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে। বাইরে তখন দিগ্বিদিগ কাঁপিয়ে তীব্র প্রলয় চলছে। তার সাথে একের পর এক ছুটে আসছে মর্মভেদী জলের বাণ। চরম বিস্ময়ে আধো আধো গলায় সে শুধিয়েছিল, 'এতা কি হচ্ছে বাবা' ?  বললুম, 'ঝড় হচ্ছে রে..... কালবৈশাখী ঝড়....... তোর ভালো লাগছে' ? সে কথার উত্তর না দিয়ে বড় বড় চোখে শুধু আলতো করে ঘাড় নেড়েছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলুম কালবৈশাখী দেখার প্রখর উন্মাদনা উজ্জ্বল আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তার সারামুখ জুড়ে। গভীর বিস্ময়ে লেপ্টে থাকা  অবয়বে প্রথম ঝড়ের তৃপ্তি । যেমনটা ঠিক বছর পঁয়ত্রিশ আগে শিকদার পাড়া স্ট্রিটের কোনো এক অখ্যাত বাড়ির ছাতে একটা বছর পাঁচেকের ছেলের মুখে ছিল। অবিকল একইরকম। সোঁদা গন্ধ মেশানো, বৃষ্টি ভেজা, অনামী ছোট্ট চিলেকোঠার ছাপ। অবশ্য চরিত্রের বদল ঘটেছে, বদল ঘটেছে স্থান কালেরও। শুধু বদল হয়নি আদি অকৃত্রিম মুহূর্ত রোমাঞ্চের, বদল হয়নি বৈশাখীর......কাল ছিল......সে আজও তেমনি আছে।




#kalboishakhi #nostalgia #childhoodmemories #bengaliarticle #Molat 









Thursday, March 29, 2018

গোলাপি

সকাল সকাল সংবাদপত্রের পাতা ঘাঁটতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেলুম বাপ্। লাইসেন্স প্রাপ্ত মহিলা অটোচালকরা অপেক্ষা করে বসে আছেন তার কারণ পুরুষ অটোচালকরা নাকি উত্তাল ঢেউয়ের মতো করে একের পর এক আপত্তি জানিয়েছেন। অর্থাৎ কিনা মহিলারাও যে অটো নিয়ে ভাড়া খাটতে পারবেন তাতে করে পুরুষ অটোচালকের মধ্যে সাংঘাতিক রকমের একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়েছে । গত ৬ই ফেব্রুয়ারি এই খাস কলকাতার রাস্তায় গোলাপি অটো চলার কথা ছিল। অজানা জ্বরের মতো কোনো এক অযাচিত কারণে সেই বিষয়ে আপাতত স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে। জনৈক রাজনৈতিক নেতা বলছেন মহিলা অটোচালকের নাকি নিরাপত্তা নেই। তারা নাকি অটো নিয়ে বেরোলেই ধর্ষিতা হতে পারেন।

আমার বিনম্র প্রশ্ন আপনার গদির নিরাপত্তা আছে তো ? মানে সামনের ভোটে পাশা যদি উল্টে যায় তখন খাটের তোষকের তলায় আপনাকে যেন মুখ লুকোতে না হয়। আমি তো জানতাম বাকি রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের নিরাপত্তার সমস্যা অনেক কম। অন্তত সরকারের পক্ষ থেকে ঢাক পিটিয়ে যেটা বলা হয় সেটা স্রেফ গুল গোলা জল বুঝি ! কিছু বোঝার আগেই গর্বের ফুটো ফানুশটা এভাবে উড়িয়ে দিলেন মশাই। সমস্যাটা ঠিক কোথায় স্পষ্ট করে বলুন না মাইরি। আমি অবশ্য সম্ভাব্য দু একটা কারণ পেয়েছি।

১. মহিলা চালক দুহাতে হ্যান্ডেল ধরে অটো নিয়ে সিগন্যালে দাঁড়িয়েছে, এটা দেখলেই বোধহয় পুরুষ যাত্রীদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রাটা লাফ দিয়ে শরীর বেয়ে একেবারে মাথায় উঠে চু কিতকিত খেলতে পারে। অথবা পুরুষ অন্তর্বাসের কানাগলিতে ঘন্টাধ্বনি হতে পারে পুনঃপুনঃ রূপে। নিঃসন্দেহে এই দৃশ্য বিদেশী পর্নোগ্রাফির থেকে কম কিছু নয়। এহেন সরাসরি সম্প্রচারে চরম উত্তেজনায় যাত্রীদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধর্ষণ তো এর কাছে শিশু।

২. মহিলা অটোচালকের অটোতে যে মহিলা যাত্রীরাই বেশি চড়বেন এইটা বোধহয় পাঁচিলের ওপর বসা মিনি বেড়ালটাও জানে। এতে পুরুষ অটোচালকদের ব্যবসা চোট খাবে সেটা শুধুমাত্রই ছেলেভোলানো গল্প। আসল কথা হচ্ছে ড্রাইভারের বাঁদিকে যে মহিলা যাত্রীর বসাটা কমে যাবে তাতে করে কনুইয়ের কসরতে ছেদ পড়বে যে। সকাল বিকেল দুবেলা কনুই আন্দোলন করে যে ভেসলিনের কৌটো খালি হয়ে যায় তার কি হবে ? এটাও তো ভেবে দেখতে হবে নাকি !

৩. পশ্চিমবঙ্গে যে কোনো কাজ বরাবরই আমরা একটু রয়ে সয়ে করতে ভালোবাসি। সব কিছুতে   অতো তাড়াহুড়ো সয় না বাপু। যেখানে দিল্লী, নয়ডা, গুরুগ্রাম, মুম্বই, সুরাত, বেঙ্গালুরু, ভুবনেশ্বর বা রাঁচির মতো শহরে গোলাপি অটো পক্ষিরাজের মতো উড়ে চলেছে সেখানে আমরাও যদি এখনই ডানা ঝাপটাতে থাকি আমাদের কি মান থাকবে ? পিছিয়ে পড়ার ট্র্যাডিশনটা বজায় রাখতে হবে তো !

৪. আরও শুনলাম যে এই 'লাইনটা' নাকি ভালো নয়। কখন যে কি হয় কেউ জানে না। তাই 'মহিলা অটোচালক' বলে কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব থাকা মানে নিজেদের পৌরুষের খোলা বোতামটাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। অতএব চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা। গুরুদেব, দয়া করে বলুন এই নাপাক দুনিয়ায় কোন লাইনটা ভালো, আমি সেই লাইনে গিয়ে লাইন দেব, দিব্যি গেলে বলছি। 

৫. সর্বোপরি মহিলা প্লেনচালক হতে পারেন, গাড়িচালক হতে পারেন, বাসচালক হতে পারেন, বাইকস্কুটি চালক হতে পারেন কিন্তু অটোর বেলাতেও যে অটোমেটিক ভাবে ব্যাপারটা ঘটবে এমনটা নয়। তিনচাকার যানটি বোধহয় মহিলাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টতার সাথে কোনোরকম খাপ খায় না। অটো মানেই বেশ একটা পুরুষ পুরুষ গোছের ভাব আছে। পিছনে দুটো চাকা আর সামনের একটা চাকা পুরুষ দেহতত্ত্বের সাথে বেশ যায়। সেক্ষেত্রে মহিলাদের বড্ড বেমানান লাগবে কিনা, তাই বোধহয় এমন নিদানের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। 

আমার উর্বর মস্তিষ্কে এর চেয়ে বেশি আর কারণ খুঁজে বের করা যায়নি। আপনাদের যদি তেমন কোনো কারণ মাথায় আসে আমাকে নিঃসংকোচে জানাতে পারেন। আপনার নাম কার্টসি সহ যোগ করে দেব। এই লেখা পড়ে আবার মোমবাতি মিছিল শুরু করবেন না যেন। লোডশেডিং হলে সে আলাদা ব্যাপার, তা না হলে খামোখা রাস্তায় ভারী ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় বাপু। এমনিতেই জ্যাম হচ্ছে রোজ তার ওপর মোমবাতি গুঁজলে আর রক্ষে থাকবে না। 



বিন্যাস : নিজস্ব 


#pinkauto #femaleautodriver #Molat

Saturday, January 13, 2018

বন্ধু চল # ৩ - কোলাঘাট

ছবি : সৌম্য 
রাস্তায় বেরিয়ে পথ হারানোর অভ্যাসটা যেন রপ্ত করে ফেলেছি আমরা। বেরোনোর আগের দিন পাক্কা আধঘন্টা ধরে নিখুঁত প্ল্যান ছকে ফেলা হল। অর্থাৎ কোন রাস্তা দিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরব শুরু করে, সাঁতরাগাছি পেরোনোর পর কোন কোন জায়গার ওপর দিয়ে যাব তার একটা নির্ভুল চিত্র এঁকে ফেলা হল প্রায়। চিত্র তো দূর, গুগল খুলে ম্যাপটা পর্যন্ত একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে ফেললুম দুজনে। ঠিক তার পরের দিন, যথারীতি সাঁতরাগাছি পেরোনোর পর বেভুল হয়ে চলে গেলাম একেবারে অন্য দিকে। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আশেপাশের অঞ্চলটা অপিরিচিত লাগার ফলে বাধ্য হয়ে এক জায়গায় বাইক থামালাম। একজন গ্রাম্য পথিককে জিজ্ঞেস করলাম কোলাঘাট যাওয়ার সঠিক পথটা। সে বেশ খানিক্ষন আমাদের নিরীক্ষণ করার পর জিজ্ঞেস করল, 'কোলাঘাট যাবেন ? তা দিল্লীরোড ধরেছেন কেন, আপনারা কি দিল্লী যাবেন, তাহলে এদিক দিয়ে সোজা...........' ? সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, 'না দাদা না, আমরা এখন দিল্লী যেতে চাই না, মাইরি বলছি, কোলাঘাট কি করে যাব সেটা দেখিয়ে দিন প্লিজ' । ভদ্রলোক খানিক ব্যাজার হয়ে বললেন, 'আচ্ছা বেশ, বাইক ঘুরিয়ে উল্টোদিকে চলে যান, একটা ব্রিজ পাবেন, তার তলা দিয়ে ঘুরে গিয়ে হাইওয়ে ধরুন, একেবারে সোজা কোলাঘাট'। একপলক থমকে, বাইক ঘুরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলুম। ভাগ্যিস জিজ্ঞেস করেছিলুম, না হলে বোধহয় মিতরোঁর সাথে কোলাকুলি করাটাই বাকি থাকত শুধু।

ছবি : সৌম্য 
হাইওয়েতে দুবার থেমেছিলুম। একবার প্রকৃতি ডেকেছিল আরেকবার ডাবওয়ালা, দুবারই জলের কারণে। আর কোথাও থামিনি। মাঝে একবার এক পিকনিক পার্টির লোককে আওয়াজ দিয়েছিলুম। সে হতভাগা টেম্পোর পিছনে পা ঝুলিয়ে দোল খেতে খেতে যাচ্ছিল। তাকে চোস্ত বাংলা ভাষায় বুঝিয়ে দিতে সে তখন ভিতরে ঢুকে বসে। এছাড়া একটা বুলডোজারকে মাঝরাস্তায় থামিয়ে দিয়েছিলুম প্রায়। তার সমস্ত চাকাই যে ঘুরছে এটা বলার পর সে ধেয়ে এসেছিল আমাদের দিকে। সেখান থেকে এক্কেরে নাকবরাবর বাইক ছুটিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের বর্ডারে পৌঁছলুম। শরৎ সেতু দিয়ে যখন নামছি তখন রূপনারায়ণের ওপর হাজারে হাজারে রূপোর কুঁচি ঝকঝক করছে। মন ভালো হয়ে গিয়েছিল এক নিমেষে। ব্রিজ থেকে নেমে অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকেছিলুম শের-এ-পাঞ্জাবে। পেটে তখন ছুঁচোয় টি টোয়েন্টি খেলছে। তন্দুরি রুটি - তড়কা, আলুপরোটা - তরকারী আর স্যালাড এই দিয়ে ডান হাতের কাজটা চেটেপুটে শেষ করলুম। সেখান থেকে একটা মেঠো পথ ধরে সোজা রূপনারায়ণের পার। যাবার আগে অবশ্য এক সরল ছেলেকে এক অপিরিচিত দাদার বাইক পাহারায় দাঁড় করিয়ে এসেছিলুম। সে বেচারা কতক্ষন ঠায় দাঁড়িয়েছিল জানি না। 

ছবি : সৌম্য 
নদীর পারে এসে যখন পৌঁছলুম তখন সূর্য পশ্চিমের দিকে সামান্য ঘাড় কাত করেছে। ধলেশ্বরী নাম নিয়ে পুরুলিয়া থেকে তার চলার শুরু, মাঝে বাঁকুড়ায় নাম পাল্টে দ্বারকেশ্বর, তারপর ঘাটালে শিলাবতী নদীর সাথে মিশে রূপনারায়ণের নামকরণ। তারই পারে একটা ফাঁকা নিরিবিলি জায়গা দেখে আয়েস করে দুজনে পাথরের ওপর বসলুম। আবেশে শরীর জুড়িয়ে এল আপনিই। দুদিকে যতদূর দেখা যায় শুধু রুপোলি মুগ্ধতা। তার মাঝ বরাবর দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলেছে ছৈ বাঁধা ছোট্ট একটা জেলে নৌকো। এমন অপরূপ মায়া জড়ানো নদীর ধার ঘেঁষে চুপচাপ বসে রইলুম দুজনে। টুকরো কথাবার্তায় নিস্তব্ধতা ভাঙছিল ঐটুকুই.......বাকিটা অপাপবিদ্ধ জলের ছিঁটেফোঁটা উড়ে এসে পড়ছিল চোখেমুখে। ডানদিকে একটা পুরোনো কাঠের ঘুপচি ঘর চোখে পড়ল। পার থেকে ঝুলে এসে প্রায় জলের ওপর পড়ে, এমন আশ্চর্য কায়দায় সে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হল কত বছরের ভাটিয়ালি ইতিহাস ধুলোদানার মতো লেগে আছে গায়। যে অতীত, যে মুহূর্তরা জোয়ার ভাঁটায় গা ভাসিয়েছে, তার একনিষ্ঠ নিরবিচ্ছিন্ন সাক্ষী সেই একফালি ঘেরাটোপ। মনে হয়েছিল সপ্তাহান্তে যদি একবার করে এসে থাকতে পারতুম সেই ঘরে, বেশ হত। কত অবলীলায় জলের গান ভেসে আসত, কত বকের দল সন্ধ্যে নামাতো, দেখতুম বসে। পার বরাবর গাছের শিকড়ে মিষ্টি সুরের ছলাৎ শুনতে পেতুম হয়ত।  


ছবি : সৌম্য 
পার বেয়ে খুব সহজেই নদীতে নামা যায়, তবে সে দুঃসাহস আমরা দেখাইনি। যে রূপ আমরা চোখের সামনে দেখেছি তা ছুঁয়ে দেখার ধৃষ্টতা করিনি ইচ্ছে করেই। প্রাণভরে শুধু দূর থেকে তার আমেজ নিয়েছি। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কাতলা মাছের বুদ্ বুদ্ ভেসে উঠছিল মাঝে মাঝেই। দুহাত অন্তর অন্তর লাফ দিয়ে যেন তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। আর আমরা বাচ্চা ছেলেদের মতো কর গুনে মনে রাখছিলুম কে কটা দেখতে পেলুম। সে ভারী আনন্দের জিনিস। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তবে তার থেকেও কঠিন ছিল বোধহয় ফেরার টান, যা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই ছিল না। সন্ধ্যে নামার আগেই বালি ঝেড়ে উঠে পড়লুম। অনেকটা পথ, আবার অনেকটা সময়। ফেরারী মনেরও হয়ত একটা বাঁধ থাকে, একটা ফিরে আসার আশ্রয় থাকে। তবে এই অপরিকল্পিত হারিয়ে যাওয়ার উন্মাদনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সাধ নেই আমাদের। সে কয়েক সপ্তাহ পরেই হোক বা কয়েক মাস, যাদের পায়ের তলায় সর্ষে আছে তারা কতক্ষন আর সিঁড়িভাঙার অংক কষবে !  শুধু একবার বাইক স্টার্ট দেওয়ার অপেক্ষা...........তারপর...........

#bengaliarticle #suddenbreak #holiday #Molat #Kolaghat



Wednesday, December 27, 2017

অন্য সত্ত্বা

ছবি : জনৈক পরিবেশক 
শরীরের বয়েস বাড়ে। মনের বয়েস বাড়ে কই ? তাই বোধহয় প্রত্যাশিত ভাবেই কোনো এক পৌষের সন্ধ্যায় অতীতের মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। খোল নলচে বদলে যাওয়া রক্তমাংসের অবয়বগুলো ফিরে আসে দেশের টানে, মাটির টানে, হারিয়ে যাওয়া সময়ের পুনরুত্থানে। এক অন্য সত্ত্বা মূর্ত হয়ে ওঠে ভীষণ চেনা মানুষদের মাঝে। পাক্কা বাইশ বছর পর যাদের দেখলাম তাদের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি বসতুম কাঠের বেঞ্চিতে, ঠেলাঠেলি আর আলটপকা ফক্কুড়িতে দিনবদল ঘটত সেসময়। কখনো মনে হয়নি সেসব নক্ষত্রের মতো দূরে সরে যাবে একদিন, ছুঁয়ে দেখার সুযোগটুকু পর্যন্ত ব্রাত্য থেকে যাবে বছরের পর বছর। 

মুঠোফোনের দৌলতে সে দূরত্ব আজ ঘুচেছে বটে তবু সামনাসামনি ফিরে পাওয়ার মুহূর্তগুলো হয়তো না ছোঁয়াই থেকে যেত যদি না তারা ঝোড়ো হাওয়ার মত আবার এসে পড়ত শহরের বুকে। দিনক্ষণ লগ্ন ঠিক করে যখন ঢাকুরিয়ার তন্দুর পার্কে এসে পৌঁছলাম ততক্ষণে বিবর্ণ স্মৃতির পাতা থেকে উঠে এসেছে অত্যন্ত পরিচিত নামগুলো। সমস্ত মন জুড়ে এক লহমায় তিরতির করে বয়ে গিয়েছিল এক অদম্য ভালোলাগার নদী। যার দুকূল ছাপানো শুধুই মনভালো করা ছবির সারি। আমার ব্যক্তি পরিচয়ের অমূল্য প্রতিচ্ছবি - আমার স্কুলবন্ধুরা। 

ছবি : জনৈক পরিবেশক 
দেশ ভাগ হয়, অস্তিত্ব ভাগ হয় কিন্তু বন্ধুত্বের ভাগ বাঁটোয়ারা হয় না কখনো। অব্যবহার বা অনভ্যাসে ধুলো জমে হয়তো, তাকে একবার ঝেড়ে পুঁছে সাফ করে নিলেই আবার স্বমহিমায় উপস্থিত হয়। যেমনটা আমরা সবাই মিলে করে নিয়েছিলুম গতকাল সন্ধ্যের সাক্ষাতে। আর তাই আমাদের গল্পের গাড়ি থামতে চায়নি, অতীতের ছায়াসরণি বেয়ে নিজের খেয়ালে এগিয়ে চলেছিল তরতর করে। রেস্তোরাঁর পরিবেশক নির্বাক দাঁড়িয়েছিল কতক্ষন মনে নেই। বেবাক ভুলে গিয়েছিলাম খাবারের অর্ডার করতে। আর আমাদের সম্বিৎ ফিরছিল যেন প্রায় বছর ঘোরার পর। 


বছর ! হ্যাঁ, বছর তো বটেই। বাইশ বছরের উপন্যাস এক সাক্ষাতে শেষ হবার ছিল না, হয়ওনি। তবু আমরা সাপ্টে সামলে যতটা পারলুম, মুহূর্তদের দুহাত দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করলুম। পিছুটানের তঞ্চকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেহিসেবি বসে রইলুম ঘন্টার পর ঘন্টা। খিল্লি আর হুল্লোড়ে ভেসে বেড়ালুম কচিবেলার হাত ধরে। 

ছবি : অনুরাধা 
ফিরে আসতে মন চায়নি, রেস্তোরাঁর বাইরে পা রাখার পর সবারই মুখ ছোট হয়ে গিয়েছিল প্রায়। আবার কবে এমনি করে জমায়েতের আসর বসবে কেউ জানিনা। এমন দুর্নিবার ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরোবার ইচ্ছে ছিল না কারোরই এটুকু বাজি রেখে বলতে পারি। হয়তো কোনো একদিন এমনি করে আরও একবার জুটিয়ে নেব আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদটুকু। হয়তো কোনো একদিন আবার এই শহরে স্বপ্নপূরণের গান তৈরী হবে। হয়তো কোন একদিন আবার একত্রে উষ্ণতার আবেশ ছুঁয়ে নেব। অপেক্ষায় প্রহর গুনছি আমরা সবাই..........হয়তো কোনো একদিন........

#gettogether #friendsmeet #reunion #bengaliarticle

Friday, December 22, 2017

তিন এক্কে তিন

ছবি : নিজস্ব 
কতটা বয়েস বাড়লে বড় হওয়া যায় অথবা কতটা বড় হলে মানুষ বলা যায় নিজেকে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমার মতো হয়ত অনেক বাবা মায়েরাই খুঁজে থাকেন। তাঁরা এর সদুত্তর পেয়েছেন কিনা জানিনা, আমি তো আজ অবধি পাই নি। 

বছর তিনেক আগে যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছি তখন কোলে ছিল কম্বল আর তুলোয় মোড়া  দিন সাতেকের এক অবোধ টলটলে মুখ। দু চোখে একরাশ মায়া আর বেভুল চাহনিতে হৃদয় গলার স্পষ্ট ঈঙ্গিত দেখেছিলুম। আড়াই কিলো ওজনের খেলনা নিয়ে আমার আর সুতপার চোখেমুখে তখন প্রশস্তির ছাপ। কচি আঙুলে আমাদের আঙুল আঁকড়ে ধরা আর নড়বড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রোদে বৃষ্টিতে কেটে গেছিল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। কত রাত যে বিনিদ্র কেটেছিল দুজনের তার ইয়ত্তা নেই। অনবরত কাঁথা পাল্টানো আর জামাকাপড় নতুন করে পড়ানো যে কত সহস্রবার করেছি আজ তা ভেবে আতঙ্ক লাগে মাঝেমাঝেই। রাত জেগে দুধ গরম করা, চাদরটা লম্বা করে টেনে দেওয়া অথবা আলগোছে সরে যাওয়া মাথার বালিশটাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসা তখন নিত্যদিনের কাজ ছিল। অধিকাংশ সময়ই অফিসে এসে বেমালুম ঢুলতাম। দিনের বেলায় চোখ খুলে রাখাই বড় দায় হত।

ছবি : নিজস্ব 
শীত গ্রীষ্ম কাটিয়ে যখন টলমলে পায়ে ড্রেসিং টেবিলের কোণ ধরে উঠে দাঁড়াল তখন প্রথম জুরাসিক পার্ক দেখার মতো করে ফ্যামিলি শুদ্ধু সবাই হাঁ করে তাকিয়েছিলাম। ওপরে নিচে একজোড়া ইঁদুর  দাঁতের সারিতে তখন বিশ্বজয়ের উল্লাস। 'ধর ধর' 'পড়ে যাবে' 'লেগে যাবে' ইত্যাদির কলরবে চমকে উঠত পাড়া প্রতিবেশী সকলেই। অবশ্য এর অন্যথা হয় নি আজ অবধিও। দু পায়ে জোর পাবার পর তাকে আর দমিয়ে রাখা যায়নি মোটে। চোখের পলকে জায়গা বদল, জিনিস বদল, এমনকি ফ্ল্যাট বদল পর্যন্ত হয়ে যায় নিমেষে। রবি ঠাকুরের দুটো লাইনকে একেবারে বেদবাক্যের মতো মেনে চলেছে যেন  - "তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে ; একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে"। পুরাতন জিনিস তো রাখছেই না, নতুনগুলোও বেমালুম গায়েব হয়ে যাচ্ছে কোথাও না কোথাও। জিজ্ঞেস করলেই ভুরু কুঁচকে মনে করার ভান করতে থাকে, তারপর চাপ দিলেই বলে, 'আমি এট্টু দেকে আসচি'....বলেই পগার পার। 




ছবি : নিজস্ব 

তিন বছর পেরোনোর পর বাড়িতে কাক চিল বসতে পায় না, এমনি তার গলার আওয়াজ। ভবিষ্যতে মানুষ হবে কিনা বলতে পারি না, তবে ঠিক কি হয়েছে সেটা সচক্ষে দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন। আগামী বছর নতুন স্কুলে যেতে চলেছে। অর্থাৎ বাঁধা গরু ছাড়া পেয়ে মাঠে চরতে বেরোবে। তার অন্য গপ্পো আছে। পরে বলবখন সময় করে। যাইহোক, ওপরের প্রশ্নের উত্তর কেউ যদি জেনে থাকেন, দয়া করে ইনবক্স করবেন, নতুবা জানিনা আগামী দিনে কপালে কি লেখা আছে......... 


পুনশ্চ : ছবিতে নিষ্পাপ চাহনি দেখে এ লেখার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করবেন না যেন.... 



#birthdaystory #bengaliarticle #birthdayarticle #Molat



Thursday, November 30, 2017

বন্ধু চল # ২

ছবি : সৌম্য 
কয়েকদিন যাবৎ দুদিক থেকেই ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিল। টিপ্ করে কেউই একটা কমন ডেট লাগাতে পারছিলুম না। শেষমেষ 'দুত্তোর নিকুচি করেছে' বলে একটা শনিবার তাক করে জুতো মোজা পড়ে দুজনেই ফুলবাবুটি সেজে বেরিয়ে পড়লুম। অবশ্যি যাবার আগে কেউই তেমন বাড়িতে বলে বেরোতে পারিনি ঠিক কোথায় যাচ্ছি। কারণটা পরে বলছি। 'চললাম, ফিরতে দেরি হবে' বলে কতকটা বুক চিতিয়ে কুচকাওয়াজের ঢঙে বেরিয়ে পড়েছিলাম শহরের দক্ষিণ দিক বরাবর। এটা অনেকটা আমাদের এক পুরোনো স্কুল বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরোনোর মতো।  বিকেল বেলায় 'মা, একটু বেরোচ্ছি'... বলে সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে রাঁচি এক্সপ্রেস ধরে এক্কেবারে বিহার চলে গিয়েছিলো সে। পাক্কা হপ্তাখানেক পর বাড়ি ফেরাতে তার বাবা বাঁজখাই গলায় বলেছিলেন, 'যেখানেই যাও না কেন তোমার বডি আমার চাই, রোজগার করতে না পারো তোমার ইন্সিওরেন্সের টাকাতে সংসারের হিল্লে হবে অন্তত কিছুটা'। তবে এক্ষেত্রে ততটা দুঃসাহস দেখানোর মতো বুকের পাটা ইদানীং কালে আমাদের কারোরই হয় নি। ঘর সংসারের নাগপাশে যাঁরা বন্দী হয়ে উইকেণ্ডের ছুটিতে দুদণ্ড নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পান না তাঁরা বুঝবেন নিশ্চই। সে যাগ্গে.....

ছবি : নিজস্ব 
টালিগঞ্জের গাছতলা স্টপেজে যখন দুজনে দেখা করলুম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটা ছুঁয়েছে। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঝিলমিলে রোদের ফাঁকে দুজনেই নিরুদ্দেশের ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছি প্রাণপণে। কিছু না পেয়ে, দোনোমোনো করে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা চললুম বারুইপুরের দিকে। সেখানে গিয়ে কোথায় যাব, কি করব তেমন সম্যক ধারণা দুজনের কারোরই ছিল না। বারুইপুর পৌঁছে আমার খেয়াল হল আমি প্রায় কোনো টাকাপয়সা না নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। 'ওরে ও বাউল শোন, মণিকাঞ্চনে  নাহি মন '.......  অতএব চটজলদি একটা এটিএমের সামনে দাঁড়াতে হল। খানিক বাদে রাস্তা পেরিয়ে যখন বন্ধুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালুম তখন সে বললে, 'বুঝলি, একটা কাজ করা যেতে পারে। এদিক ওদিক না ঘুরে চল ডায়মন্ড হারবার চলে যাই। এখান থেকে ঘন্টা আড়াইয়ের পথ হবে। এখন সাড়ে বারোটা বাজে, তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাব, তারপর কোথাও একটা লাঞ্চ করে গঙ্গার পারে বসে একটু আড্ডা মেরে ফিরে আসব। কি বলিস' ?

এমন অবাক করা কথায় আমিও অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারলুম না সেই সময়। ডায়মন্ড হারবার !! কলকাতার বাইরে অন্য সমস্তরকম রাস্তা আমার কাছে পার্ল হারবারের সামিল। ঢোঁক গিলে বললুম, 'তুই রাস্তা চিনিস' ? কোনোরকম কুন্ঠা না রেখে সে বললে, 'নাহ, জিজ্ঞেস করতে করতে চলে যাব, অসুবিধে হবে না'। কালক্ষেপ না করে বললুম, 'চল তবে'...........'বাহির হয়েছি  আজ, কিসের শরম, কিসের লাজ  '......

ছবি : নিজস্ব 
অতএব একের পর এক তেপান্তরের পথ অতিক্রম করে আমাদের দু চাকার পক্ষীরাজ উড়ে চলল। মাঝে একটা স্টেশন পেরোলাম। নামটা ভারী মায়াময়  - 'কৃষ্ণমোহন'। জায়গাটা বেশ ঘুম জড়ানো। শান্ত, ধীর স্থির। শহরের ক্যাকোফোনি থেকে কয়েক যোজন দূরে। নামের সাথে তাল মিলিয়ে যদি সেখানে মোহনবাঁশির রাগ শুনতে পেতুম বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হতুম না। সে চত্ত্বরের আশেপাশে বিশেষ জনবসতি নেই। একটা পুরোনো চায়ের দোকান আর কয়েক হাত দূরে দূরে গোটা কয়েক মাটির ঘর। দুরন্ত হাঁস মুরগির পায়ের ছাপে দুপুর গড়ায় সেখানে। পল্লী বাংলার আদি অকৃত্রিম চিত্রপট। খানিক এগিয়ে একটা ডাবওলাকে দেখে বাইক দাঁড় করানো হল। টলটলে মিষ্টি জলে প্রাণ জুড়িয়ে গেল একেবারে। দু চারটে ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললুম সামনে। যাবার আগে রুটটা জিজ্ঞেস করেছিলুম একজনকে। বলল, 'পঁচিশ কিলোমিটার নাক বরাবর এগিয়ে যান, বিষ্ণুপুরের আগে আর কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার পড়বে না'। 'আজ হারিয়ে যাবার মন , অত শুধোবার কি প্রয়োজন '.........অগত্যা....... 

ছবি : নিজস্ব 
জয়নগর পেরিয়ে যে মনভোলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছিলাম তার ভুবনমোহিনী রূপ চোখে না দেখলে দু চার কথায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। দু দিকে বট, অশ্বত্থ আর মেহগনি গাছের অনুষ্টুপ সারি। একদিক থেকে আরেকদিকে ঝুঁকে পড়ে যে যার মতো জড়াজড়ি করে পথের ওপর আলোছায়ার আলপনা তৈরী করেছে। সে ছায়াপথের একদিকে দিগন্ত জোড়া মাঠ আর ক্ষেতের সবুজ হাতছানি আর অন্যদিকে একফালি লম্বাটে ডোবা সোজা চলে গেছে দূরের থেকেও দূরে। সেই ডোবার ওপর থোকা থোকা পানিফলের আগাছা ভেসে রয়েছে দ্বিপ্রহরের সূর্যের দিকে চেয়ে। দু চার গজ অন্তর যেখানে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে আগাম শীতের জানান দিচ্ছে। দেরি না করে নেমে পড়লুম সেখানে। একটানা জার্নির ধকল উধাও হল মুহূর্তে। শরীরের আনাচে কানাচে বয়ে গেল হেমন্তের মিঠে পশমিনা হাওয়া। বদ্ধ শহরের আগল খুলে খোলা হাওয়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম দুজনে। খানিক্ষন রাস্তার ধারে গুলতানি করে আবার এগিয়ে চললুম। সামনে বিষ্ণুপুর। ...... 'এ পথের নেই শেষ, আমার বাংলা, এই আমার দেশ '...... 

ছবি : নিজস্ব 
আরও মিনিট কুড়ি চালিয়ে বিষ্ণুপুর পৌঁছে ডানদিক নিয়ে সোজা এগিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়লাম। মাথার ওপর মেঘের নীল পেরিয়ে চলেছি একের পর এক। কালো রাস্তার পিচে আমাদের নাছোড়বান্দা ছায়া আঁকা হয়ে চলেছে সমানতালে। আলটপকা সুরে গেয়ে উঠছি কখনো কখনো.......ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি........ দেখতে দেখতে বহুদূরে চোখের সামনে ঝলসে উঠলো সহস্র রুপোলি আলো। ঈষৎ কম্পমান নদীর জলে সূর্যের রশ্মি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গার পার বাঁদিকে রেখে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম ডায়মন্ড হারবারের বুকে। বাইক স্ট্যান্ড করেই দৌড়ে গেলাম পারের ধারে। ডানদিক বাঁদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু জল। নদীর অন্য প্রান্তে হলদিয়া পোর্টের আবছায়া রেখা দেখতে পেলুম। তার কিছুটা আগে একটা জাহাজ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। নোঙর ফেলে দিনবদলের অপেক্ষা করছে যেন। জোয়ারের মৃদু দুলুনিতে জলের সাথে ভাটিয়ালি আলাপ জমাচ্ছে বোধহয়। বেশিক্ষন দাঁড়ালাম না কারণ খিদে পেয়েছে জোর। 'দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, খালিপেট আর নাহি সয় '.......

ছবি : সৌম্য 
যেতে যেতে মালুম হয়নি তিনটে বেজে গেছে অনেক্ষন। বিনা বাক্যব্যয়ে উল্টোদিকে সাগরিকা হোটেলের পথে পা বাড়ালুম। যা অর্ডার দিয়েছিলুম তাতে করে এমনি সময় আরও একজনের খাওয়া হয়ে যেত। ভাত, সোনামুগের ডাল, ঝিরঝিরে আলুভাজা, আলুপোস্ত, পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় এরা কেউই পাতে পড়ার সময় পেল না। আসার মিনিট পনেরোর মধ্যেই উড়ে গেল সেসব। তার সাথে চলল দেদার আবোলতাবোল কথা, অযৌক্তিক ফাজলামো ও প্রাণখোলা হাসি। মৌরি চিবোতে চিবোতে আরও একদফা পারে গিয়ে বসলুম দুজনে। একটা নিরিবিলি বটতলার বেদির নিচে আয়েস করে বসে বসে দেখতে লাগলুম একদল জেলেদের মাছ ধরা। দু একবার খালি জাল ওঠার পর তাদের সাথে সাথে আমরাও আফসোস করতে লেগেছিলুম খানিক।পশ্চিম আকাশে তখন বকের ডানায় সন্ধ্যা নামছে পা টিপে টিপে। এবার ফেরার পালা। একবুক তৃপ্তি আর ভালোলাগা নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলুম আবার। ডায়মন্ড হারবার রোডের অন্ধকার পেরিয়ে কখন যে কলকাতা এসে পৌঁছলুম টেরও পাইনি। 

এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে সফর করে এলাম, সঙ্গী করে নিয়ে এলাম ফেরারী মন আর মুঠোভর্তি বেঁচে থাকার কারণ। দুজনে পণ করলাম, আসছে মাসে আবার......... কিন্তু কোথায় ? আজ্ঞে কত্তা, জানিতে চাহিয়া লজ্জা দিবেন না....... 

কৃতজ্ঞতা : সৌম্যর বাইক - ১০০ কিমির বেশি চলেছিল সেদিন ।

ছবি : নিজস্ব 
 #bengaliarticle #bengalitravelstory #diamondharbourtour