পাকোদা - এমন অদ্ভুত নাম কেন হল সেটা ওনারও জানা নেই। তবে পাকোদা একটা ইতিহাসের নাম, কয়েকটা যুগ আর একটা "ছোট্ট কথার দাম" হল পাকোদা। সেটা কোন "কথা" সে বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে নি।
১৯৬৭ সালে পাকোদা প্রায় এক বস্ত্রে, বলা ভালো হাফ প্যান্টে চলে আসেন কলকাতায় কাজের সন্ধানে, এক আত্মীয়র হাত ধরে, যিনি তদানীন্তন উত্তর কলকাতার এক বিখ্যাত বাড়িতে রান্নার কাজ সামলাতেন। বেথুন কলেজের পিছনে ১৩৩ নম্বর রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বাড়িটি বিখ্যাত, তার কারণ আজ থেকে প্রায় দুশ বছর আগে প্রসিদ্ধ উর্দু কবি মির্জা গালিব নাকি কলকাতায় এই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
বিষয়টা তর্কাতীত হলেও মির্জা গালিবের ভাড়া বাড়ি হিসেবে গুগল খুঁজলে এই প্রাসাদোপম বাড়ির ছবিই দেখাবে।
গত রবিবার ইতিহাসের শায়রী জড়ানো এই বাড়িতে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ঘটনাক্রমে এই বাড়িটি আমার শ্বশুর মশাইয়ের পিসীমার বাসস্থান। মজার ব্যাপার হল ওই বাড়ির অধিকাংশ ওয়ারিশ হয় উকিল নয় এটর্নি। আমার শ্বশুর মশাইয়ের পিসেমশাই শ্রী রমেন্দ্রনাথ ধর তাঁর সময়কার বেশ নামকরা এটর্নি ছিলেন। অন্দরমহলের খবর, এই অট্টালিকার পুরোটাই পরবর্তী কালে উনি কিনে নেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাকোদার সাথে এসবের কি সম্পর্ক ? সমস্ত কিছু ছাপিয়ে এই লেখাটা শুধুমাত্র সেই বিষয় নিয়েই.......
না, কোনো রকম রক্তের সম্পর্ক নেই ঠিকই তবে বছরের পর বছর নিষ্ঠা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে কখন যে পাকোদার আত্মার সাথে যোগাযোগ ঘটে গেছে এই বাড়ির, তা এক বিরাট উপন্যাস। সে কথা জানতে চাইলে, পাকোদা সহাস্যে এড়িয়ে যায়। তবু আমি চাপাচাপি করি, জানতে চাই পুরোনো রংচটা ইতিহাসের হালখাতা, কারণ আমি যে আনকোরা গল্পের গন্ধ পেয়েছি ততক্ষণে।
জোর করে প্রশ্ন করি.....
- আচ্ছা আপনি যখন এই বাড়িতে আসেন তখন আপনার বয়স কত?
পাকোদা খানিক লজ্জায়, খানিক আতান্তরে পরে উত্তর দিতে থাকেন।
- ওই দশ বারো হবে...
- আগে কোথায় থাকতেন?
- উড়িষ্যা, বালেশ্বর....
- সেখান থেকে চলে এলেন কেন ?
- কাজের দরকার ছিল যে.....
- এত কম বয়সে ?
- হ্যাঁ, বাবা মা মারা গিয়েছিল, তাই.....
- তা এখানেই থেকে গেলেন ? ....আজীবন ?
- (মাথা নেড়ে)...... হ্যাঁ.....
- অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করল না ?
- না, এ বাড়ির বাবু চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, "আমি না থাকলে বাকিদের দেখিস"। আমিও রয়ে গেলাম.......
- রয়ে গেলেন...... মানে ?
- কথা দিয়েছি, যাওয়া হল না.....
কথাটা হজম করতে সময় লাগল। বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় আমি বাকরুদ্ধ রইলাম কিছু মূহুর্ত। যাঁরা জানতেন না তাঁরাও হতবাক তাকিয়ে রইলেন পাকোদার দিকে। এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমনটা সম্ভব !!!.......... কিংবা হয়ত সম্ভব, যাঁরা জানেন মুখের কথার মূল্য আছে, বোধহয় তাঁদের পক্ষেই সম্ভব।
ঘোর কাটতে সময় লাগল খানিক। কোনো প্রশ্ন জোগালো না মুখে, ইচ্ছেও করল না। হয়ত পাকোদার অন্য কোথাও যাওয়ার সঙ্গতি ছিল না, বা হয়ত সত্যিই উনি কোথাও যেতে চান নি। বর্তমান সময়ে সেসব কথা অবান্তর।
তবে উত্তর কলকাতার বুকে বহু বছর আগে দেওয়া শুধুমাত্র মুখের কথা একনিষ্ঠ ভাবে মেনে চলেছেন পাকোদা..... একটানা.....একভাবে....... এইটুকুনটাই সম্ভ্রম জাগানোর জন্য যথেষ্ট।
পাকোদা আপানি সুস্থ থাকুন, আর আরও একবার আমার শ্রদ্ধা জানবেন।
আর বাড়ির সমস্ত মানুষদের আমার প্রণাম যাঁরা পাকোদার দেখাশোনা করে চেলেছেন নিরন্তর।



























