Monday, May 9, 2016

সাপ্তাহিকী ৭ # পঁচিশ টাকা ভাড়া

'তাআতলা...নিয়াল্লেপুর....গড়িয়াহাট......তাআতলা...নিয়াল্লেপুর....গড়িয়াহাট.....'
অভ্যস্ত গলায় এক বিশেষ ভঙ্গিতে ডাকতে থাকে রঞ্জু। অফিস টাইমের এই সময়টা খুব বেশি ডাকাডাকি করতে হয় না। ঝট্পট ভরে যায় অটো। আজ শনিবার বলেই ভিড়টা একটু পাতলা আছে। প্রতিদিন বেহালা ট্রাম ডিপো থেকে গড়িয়াহাট ভাড়া খাটে রঞ্জু। ঠিকঠাক প্যাসেঞ্জার থাকলে সারাদিনে পনেরো ষোলোটা ট্রিপ হয়ে যায়। আজ কটা দিতে পারবে কে জানে। অটোর লাইনে স্বপনদা কে দেখতে পায়। একই পাড়ায় থাকে, একসাথেই অটো চালায়। স্বপনদা দূর থেকে চোখ নাচিয়ে বলে , 'কি রে কটা হলো' ?

মুখ দিয়ে একটা আক্ষেপ সূচক শব্দ করে রঞ্জু , বলে, 'ধুসস , কোথায় আর......এই তো বেরোলাম। বউনিই হয়নি এখনো। একে গরম তার ওপর শনিবারের বাজার.....গলার শিরা ছিঁড়ে গেল ডাকতে ডাকতে'।
-'যা বলেছিস মাইরি। আজ তো তবুও একটু মেঘলা আছে, তাই বাঁচোয়া। অন্য দিন তো......ফেটে যায়। হাতের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় স্বপনদা। রঞ্জু হেসে ফেলে। সত্তরোর্ধ্ব এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জিগ্গেস করে, 'যাবে তো' ? 
'হ্যাঁ যাব বসুন'। হাতের ইশারায় পিছনের সিটটা দেখিয়ে দেয় রঞ্জু। 
'এখনই ছাড়বে ভাই' ? ভদ্রলোক মুখ বাড়িয়ে আবার জিগেস করেন।
- হ্যাঁ, লোক হলেই ছেড়ে দেব দাদু.....
বলতে না বলতেই পিছন পিছন তিনটে প্যাসেঞ্জার এসে হাজির হয়। 'গড়িয়াহাট তো দাদা' ? সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করে। 'হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন', রঞ্জু তাড়াতাড়ি ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। 

কি অদ্ভূত !! এই শনিবারের মড়া বাজারে চারজন গড়িয়াহাট, তাও আবার একসাথে। দাদু বেশ পয়া লোক আছে........'জয়গুরু', মনে মনে বলে রঞ্জু। পিছনে বয়স্ক ভদ্রলোকের পাশে একজন মহিলা আর একটি অল্প বয়েসী মেয়ে। সামনে মাঝবয়েসী ভদ্রলোককে নিজের পাশে বসায়। হ্যান্ডেলে তিনবার হাত ছুঁইয়ে কপালে ঠেকিয়ে নেয় চটজলদি। ভালো বউনি হয়েছে সকাল সকাল। মনটা দারুণ খুশ হয়ে যায় এক্কেবারে। সবজে রঙের সেল্ফ স্টার্ট বাটনটায় চাপ দিয়ে অটোটা স্টার্ট করে। বাঁ হাতে গিয়ার তুলে ডান হাতে এক্সিলারেটরের কান মোচরাতেই গাড়ি চলতে শুরু করে। দুটো কাঁধ সোজা করে, সামনে চোখ রেখে সবুজ-হলুদ তেচাকা উড়িয়ে নিয়ে যায় স্টোনচিপ ফেলা কালো পিচের ওপর দিয়ে। শক্ত মুঠোয় দু হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডেল চেপে ধরলেই কিরকম পক্ষিরাজের ডানায় ভর করেছে বলে মনে হয় নিজের। হ্যাঁ, পক্ষিরাজের চেয়ে কম কিছু নয় তার এই সাধের বাহনটি। ভারী যত্ন করে সে। প্রতিদিন সকালবেলা ভালো করে ধুয়ে মুছে চকচকে করে নেয় বেরোনোর আগে। এই নিয়ে পাড়ার বৌদিরা হাসাহাসিও করে বিস্তর। বলে, 'রঞ্জু, এবার ওটাকে সিঁদুর পড়িয়ে ঘরে তোলার ব্যবস্থা কর। দিন দিন যা চেকনাই হচ্ছে...........'। গায়ে মাখে না রঞ্জু। হেসে এড়িয়ে যায় ।

তারাতলা পার হয়ে নিউআলিপুর ঢোকে অটো। দুর্গাপুর ব্রীজ ক্রস করে আলিপুর চৌমাথার সিগন্যালে এসে দাঁড়ায়। অন্যান্য দিনের মত জ্যাম আজ প্রায় নেই বললেই চলে। আড়চোখে লুকিং গ্লাসে পিছনের সিটটা দেখে নেয় এক ঝলক। বাঁ দিকে বসা অল্প বয়েসী মেয়েটা ফোনে কথা বলছে চাপাস্বরে। টুকরো কিছু কথা কানে ভেসে আসে। 'এই তো কালিঘাট পেরিয়ে গেছি, রাসবিহারীর জ্যামে ফেসে আছি। আসছি......প্লিজ, দশ মিনিট'। অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলে রঞ্জু। আজকাল মোবাইল ফোন হয়ে হেব্বি সুবিধে হয়েছে। যে যখন ইচ্ছে, যাকে পারছে ঢপ দিচ্ছে। বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে চোখ পড়ে। এক অদ্ভূত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে, ক্রমাগত কি যেন বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। কারোর সাথে কথা বলছেন নাকি ?
সিগন্যাল সবুজ হয়। অটো এগোয় গড়িয়াহাটের দিকে.........

'আসুন,.......গড়িয়াহাট'। মেন রোড ছেড়ে বাঁ দিকে সাইড করে থামায় রঞ্জু। ভাড়া গুনে নেয় সবার কাছ থেকে। পিছনে তাকিয়ে দেখে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক এখনো চুপ করে বসে আছেন বাইরের দিকে তাকিয়ে। ঘাড় কাত করে বলে, 'দাদু ! গড়িয়াহাট এসে গেছে, নামুন'।
'হ্যাঁ ? এসে গেছে' ? কোনো এক হারিয়ে যাওয়া মন খারাপের জায়গা থেকে যেন এক ঝটকায় ফিরে আসেন ভদ্রলোক। ধীরে ধীরে নেমে আসেন অটো থেকে। একই রকম শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেন, 'কত ভাই' ? 'পঁচিশ টাকা', বলে হাত বাড়ায় রঞ্জু।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট্ বের করে এগিয়ে দেন ভদ্রলোক।
- খুচরো দিন দাদু, পঞ্চাশ টাকার ভাঙানি দিতে পারব না। সবে বেড়িয়েছি।
- খুচরো ??!!!! খুচরো তো নেই আমার কাছে , যা আছে সব পঞ্চাশ একশোর নোট্।

পকেট থেকে কতগুলো একশো আর পঞ্চাশ টাকার নোট্ বের করে দেখান বৃদ্ধ।
'এই তো মুস্কিল, আমারই ভুল, আগে বলে নেওয়া উচিত ছিল। আপনারা বাইরে বেরোবেন খুচরো না নিয়ে, আর আমরা রেজগি দিয়ে দিয়ে মরব', খিঁচিয়ে ওঠে রঞ্জু।
'সত্যি বলছি ভাই, আমার কাছে একদম খুচরো নেই', কাতর স্বীকারোক্তি করেন ভদ্রলোক।
'আচ্ছা পাঁচ টাকা দিন, দেখছি', পঞ্চাশ টাকার নোট্ আর পাঁচ টাকার কয়েন নিয়ে রঞ্জু বাকি টাকা ফেরত দেয় ভদ্রলোককে।

- অনেক ধন্যবাদ ভাই..............আচ্ছা আমার আরেকটা উপকার করে দেবে ?
'কি' ? সামান্য বিরক্তি ফুটে ওঠে রঞ্জুর চোখে মুখে।
- রবি বাবুর বাড়িটা কোন দিকে একটু দেখিয়ে দেবে ?
- রবি বাবু মানে ? এম এল এ রবিশঙ্কর ঘটকের কথা বলছেন ?
- না না, আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলছি..................
খানিক থমকায় রঞ্জু, নাকের ওপর দুটো ভুরু জড়ো করে জিজ্ঞেস করে, 'কার কথা বলছেন' ? ....

'কেন ? আমি পরম শ্রদ্ধেয়, বিশ্বকবি, আমাদের সকলের গুরুদেব রবি ঠাকুরের কথা বলছি', নিস্পাপ সরলতায় কথাগুলো বলেন ভদ্রলোক। রঞ্জু হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। অবিশ্বাস আর কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোকের দিকে। আশপাশ দিয়ে গাড়িগুলো হর্ন মেরে বেরিয়ে যেতে থাকে। 
'কি হলো বললে না'? ভদ্রলোক অমায়িক স্বরে জিজ্ঞেস করেন।
'আপনি গড়িয়াহাটের মোড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি খুঁজছেন' ? ঠোঁটের ডগায় বিদ্রুপের লেশ মাখিয়ে জিজ্ঞেস করে রঞ্জু।

'ওহ ! আমি কি তবে ভুল পথে এলাম ? অনেকটা দেরী হয়ে গেল যে !! সময়মত কবিতাগুলো না পেলে যে ছেপে উঠতে পারব না'। ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভদ্রলোক। ক্রমবর্দ্ধমান ট্র্যাফিকের সাথে পাল্লা দিয়ে কৌতুহল বাড়ে রঞ্জুর। কোথাও একটা অসঙ্গতির আভাস পায় যেন, আশঙ্কা তৈরী হয় ভিতরে ভিতরে। বলে, 'আপনি চট করে উঠে পড়ুন তো ? অটোটা ঘুরিয়ে নিই। এমনিতেও জোড়াসাঁকোর গাড়ি পাবেন না এখান থেকে'। বাধ্য ছাত্রের মতো ভদ্রলোক অটোতে চেপে বসেন আবার। অটোর মুখ ঘুরিয়ে ট্রাম লাইন পেরিয়ে গড়িয়াহাট স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায় রঞ্জু। 

স্ট্যান্ডে এসে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির। তারপর পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করে, 'হ্যাঁ , এবার বলুন তো, ঠিক কোথায় যাবেন ?
- আমি রবি ঠাকুরের বাড়ি যাব। উনি খান কতক কবিতা লিখেছেন গত মাসে। ওগুলো তো ছাপতে হবে।
- রবি ঠাকুর কবিতা লিখেছেন !........গত মাসে !!!! কি ভুলভাল বকছেন ? আপনাকে আগে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল........ আপনার কি শরীর খারাপ করছে ? একটু জল খাবেন ?
- না না আমার শরীর একদম ঠিক আছে। দেখো ভাই, আমি একজন প্রকাশক, কলেজ স্ট্রিটে আমার ছাপাখানা আছে। আজ কবিতা গুলো না পেলে ছাপার কাজ আটকে যাবে যে।

এবার ধৈর্য হারায় রঞ্জু, গলাটা এক পারদ উঁচুতে তুলে বলে, 'আপনার কি মনে হয় উনি এখনো কবিতা লিখছেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে' ?

'কেন ? তোমার বুঝি তা মনে হয় না' ? কঠিনস্বরে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক। হকচকিয়ে যায় রঞ্জু, বলে, 'কি বলছেন বলুন তো দাদু তখন থেকে !! আজ কত বছর হল উনি মারা গেছেন........ আর আপনি বলতে চাইছেন স্বর্গ থেকে নেমে এসে উনি কাগজ কলম নিয়ে পদ্য লিখছেন ? সাত সকালে মস্করা করবেন না তো.............' 

'কে বললে রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন' ? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বৃদ্ধের। 'কে বললে তোমায় ? রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন এইখানে, ভালো করে দেখো ঠিক এইখানটার সমস্তটা জুড়ে উনি রয়েছেন'। নিজের বুকের ওপর আঙ্গুল ঠেকিয়ে দেখান রঞ্জুকে। তারপর দুইদিকে বুড়ো আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে বলেন, 'রবীন্দ্রনাথকে দেখাও যাবে না, ছোঁয়াও যাবে না, শুধু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে আর উনি তোমার অজান্তেই অক্সিজেন হয়ে তোমার শরীরের আনাচে কানাচে, মননে, চেতনায়, কল্পনায়, সর্বসাধনায়, বিরাজমান থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন বললেই হলো !! উনি কোনো সাধারণ মানুষ নন যে পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। উনি অজেয়, অমর, উনি পুন্যবাণীর দূত, হৃদয়ের অমৃত, ওনার ক্ষয় নেই, শেষ নেই, ফুরিয়ে যাবার যো নেই। পারবে ওনাকে ছাড়া চলতে ?........এক পাও এগোতে ? .........পারবে' ?

রোখ চেপে যায় রঞ্জুর। জেদীস্বরে বলে, 'কিন্তু দাদু, ওনার কবিতা কে পড়ে বলুন তো আজকাল, সেই ছোটবেলার পড়ার বইতেই যা পড়ে লোকে, আজকের দিনে ওসব তো অচল..............'

- কোনটে অচল বলছ ভাই ? মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী ? নাকি কথা ও কাহিনী, ক্ষণিকা, খেয়া, বলাকা ? ........ এরা অচল ? ঋতু পরিবর্তন তো চোখে দেখে এসেছে মানুষ............হৃদয়ের বোঝাপড়া দিয়েও যে ঋতু পরিবর্তনের আস্বাদ পাওয়া সম্ভব সেই উপলব্ধি ঘটল তো ওনার বই পড়ে। গ্রীষ্মের তীব্র দহনেও উনি, কালবৈশাখীর খেয়ালী ঝড়েও উনি, বর্ষার পরম তৃপ্তিতে উনি, শীতের পশমিনা আদরেও উনি........... আর শুধু ঋতু কেন ? আনন্দ, দুঃখ, রাগ, বেদনা, বিষাদ, হর্ষ, প্রেম, মনের এমন সুক্ষ্ম অনুভূতিগুলো উনিই তো জাগিয়ে দিয়ে গেছেন ওনার কলমের আঁচড়ে। ওনার বই পড়েই তো চেতনা উন্নীত হয়। মনের জটিলতম ধাঁধা সরল হয়ে যায় ওনারই বলে দেয়া কথায় ও শিল্পে। ওনার ভাষা ধার করে কথা বলতে শিখেছি আমরা। ওনার শব্দের আশ্রয়ে গল্প বুনি বরাবর। ওনারই প্রশ্রয়ে, সাহসে, ওনারই লিখে যাওয়া কবিতা আবার করে লিখে পাতার পর পাতা ভরাই। যাদের লেখার আবহে, আবদারে গদগদ হয়ে অচল বলছ তারাই রবীন্দ্রনাথের পুঁতে যাওয়া বীজের ফসল তুলছে ঘরে। নতুন লিখবে কি ? সব তো লিখে গেছেন আগে। নতুন বলবে কি আর ? সবই তো বলে গেছেন কবে..........অচল কে ? রবীন্দ্রনাথ না তোমরা ?

এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে হাঁপ ধরে যায়। বড় বড় শ্বাস নিতে থাকেন শীর্ণ অশীতিপর। জলের বোতলটা সিটের তলা থেকে বের করে এগিয়ে দেয় রঞ্জু। ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খেয়ে পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে ঠোঁট মুছে নেন, তৃপ্তির আভাস ফুটে ওঠে মুখে। 

কিছুটা সাহসের ওপর ভর করে রঞ্জু বলে ওঠে, 'কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো ভুলে যাইনি আমরা কখনো। আমরা তো রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করি ফি বছর। আবৃত্তি, নাচ, গান, কতরকমের কত কি অনুষ্ঠান হয় চারিদিকে, একরকম বাঙালীর উৎসব-যাপন নয় কি ? সবই তো ওনার প্রতি শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে। তাহলেও কি বলবেন আমরা পরজীবী, অকৃতজ্ঞ' ? গ্রাজুয়েট পাশ করা রঞ্জুর মনে সঙ্গত প্রশ্ন ভিড় করে আসে।

- নাহ, তোমরা হিপোক্রিট, অতীতের সেজবাতি পুড়িয়ে বর্তমানের আলো জ্বালাও। উগ্র আধুনিকতার ধুন্কিতে ইতিহাস অস্বীকারের মেডেল ঝোলাও গলায়। ট্যাগোর বলে যে জাঁক করছ, ওনার কবিতা বলতে গেলে তো দশবার হোঁচট খেতে হয় তোমাদের। খাঁটি সূর্য প্রনামের মন্ত্রোচ্চারণের মত করে যদি ওনার কবিতা পড়তে পারতাম সকলে, তাহলে আত্মসুদ্ধি হত এমনিই, আলাদা করে আর উৎসব করতে হত না........' 

অনাবিল মুগ্ধতায়, একরাশ বিস্ময় চোখে নিয়ে রঞ্জু তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোকের দিকে। প্রবহমান নদীর মত কথা বলে চলেন বৃদ্ধ। যুক্তি তর্কের মালা গেঁথে রবীন্দ্রস্তব চলতে থাকে একের পর এক। এ যেন কোন নাটমন্দিরের অপাপবিদ্ধ পুজারী। রবীন্দ্রবন্দনার নৈবেদ্য সাজিয়ে চলেছেন নিজের মনের মতন করে। ঠাকুর পুজোয় উৎসর্গ করেছেন নিজের গোটা জীবনটাই। ধন্য তুমি পুরোহিত, ধন্য তোমার ভক্তি। প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জাগে রঞ্জুর ভদ্রলোকের প্রতি আর তার চেয়েও বেশি ঔৎসুক্য জাগায় ঠাকুরের লেখনী ও কর্মজীবন, যা নির্বিঘ্নে, নিরলস ভাবে বলে চলেছেন উনি। বিমুগ্ধ শান্তিতে শুনে চলে রঞ্জু।

মনে মনে ঠিক করে নেয় ওনাকে বাড়ি পৌছে দেওয়া দরকার। কিন্তু বাড়িটা কোথায় সেটা তো জানা নেই। ওনাকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবেন বলেও মনে হয় না। বেহালা ট্রাম ডিপোয় তো পৌছনো যাক আগে। তেমন তেমন বুঝলে থানায় যেতে হবে। ওই এলাকাতেই বাড়ি হবে নিশ্চই। কথায় কথায় স্টার্ট দেয় অটো। পিছনের সিটে প্রভাতী বন্দনার মতো জারি থাকে রবীন্দ্রস্তুতি।

ট্রাম ডিপোর স্টান্ডে পৌছতেই একটা হট্টগোল চোখে পড়ে রঞ্জুর। একজন মধ্যবয়েসী মহিলা কাঁদোকাঁদো মুখে ঘুরে ঘুরে সবার কাছে একটা ফটো দেখাচ্ছেন। সঙ্গে আরো দুজন আছেন। খুব সম্ভব একই বাড়ির লোক। ব্যাপারটা বুঝতে বেশি সময় লাগে না রঞ্জুর। এগিয়ে যায় মহিলার দিকে, হাতের ফটোটা এক ঝলক দেখেই বলে, 'এদিকে আসুন, দেখুন তো ওনাকেই খুঁজছেন কিনা' ? মহিলাটি এগিয়ে আসেন। পিছনের সিটে ভদ্রলোক কে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন, 'বাবাআআ !!!! তুমি কোথায় ছিলে ? !!!! ...কোথায় চলে গিয়েছিলে না বলে' ? রঞ্জুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কোথায় পেলেন বাবাকে' ?

- আমার অটোয় উঠে ভুলবশত গড়িয়াহাট চলে গিয়েছিলেন। ওনার কথাবার্তায় সন্দেহ হয়েছিল, তাই আবার ফেরত আসি।
-অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা, আপনি যা করলেন, আজকের দিনে বিরল, কি বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো, আসলে ওনার মাথাটা মাঝে মাঝেই এমন গোলমাল করে........আপনি না থাকলে যে কি সর্বনাশ হত !!!!

'আরে না না......ছি ছি.... এসব কি বলছেন' ? ভারী লজ্জা পায় রঞ্জু। পিছন ফিরে ভদ্রলোক কে নামিয়ে আনে অটো থেকে, ততক্ষণে উনি চুপ করে গেছেন, একই রকম অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন রঞ্জুর দিকে। সামান্য হেসে রঞ্জু বলে, 'আচ্ছা দাদু, আসি তাহলে' ?
'হ্যাঁ ভাই ...কত হলো যেন' ? নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন উনি।
'পঁচিশ......' বলতে গিয়েও থেমে যায় রঞ্জু। কোনদিকে না তাকিয়ে চট করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। কবিপুজোর ভাড়া হয় না কখনো । মনটা নেচে ওঠে বেবাক আনন্দে। আজ দারুণ বউনি হয়েছে...........দারুণ। 

বাঁ হাত বাড়িয়ে এফএমটা অন করে নেয় সে........সামনে পঁচিশে বৈশাখ........তরঙ্গধ্বনি মুখরিত হয় -
'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ, খেলে যায় রৌদ্রছায়া বর্ষা আসে বসন্ত.......
পক্ষিরাজ ধুলো উড়িয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে দিগন্তে .........



#bengalishortstories #drama #rabindranathtagore #tributetorabindranathtagore #tribute #rabindrajayanti

No comments:

Post a Comment