কাব্যে গদ্যে 'ধূসর অতীত' কথাটার বিচ্ছুরণ ঘটে অনাবিল ভাবেই কোনো রকম গাণিতিক নিয়ম না মেনে। আমার জীবনে ধূসর অতীত শুধুমাত্র গণিত নয়, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, জীব বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, মায় শরীর শিক্ষা পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি ঘটে। শুধু আমার কেন, আমার বিশ্বাস আমার প্রত্যেক সহপাঠী বা সহপাঠিনীর ক্ষেত্রে তা একইরকম প্রযোজ্য। ধূসর রঙের ইউনিফর্মটা দশ বছর দ্বিতীয় ত্বকের মতোই টানটান লেপ্টে ছিল আমাদের শরীরের সঙ্গে, যার ঘ্রান এখনো কোনো এক মনখারাপের দুপুরবেলাতে দিব্যি পাওয়া যায়। গতকাল রাতে আমার স্কুলের বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ এর একটি গ্ৰুপে আলোচনা করছিলুম, যদি হঠাৎ করে সবাই মিলে একদিন পুরনো স্কুলটাতে গিয়ে হাজির হওয়া যেত, বিনা পরিকল্পনায়, প্রায় বিনা নোটিশেই....তাহলে কেমন হত ?
একুশ বছরের প্রায়ান্ধকার একটা স্মৃতির ঘরে টিমটিম করে লো ওয়াটের বাল্বের মতো আমাদের কচিবেলা জ্বলছে, সেটাই নাহয় চোখের দেখা দেখে এলাম একবার, ছোটোছুটি করলাম নাহয় ফেলে আসা কিছু মুহূর্ত গলির আনাচে কানাচে, শ্বাস প্রশ্বাসে আবার করে ভরে নিলাম নাহয় বছর দশেকের স্নিগ্ধ টাটকা ইতিহাস, বেশ হতো, তাই না?................ নানাবিধ আলোচনায় যেটা জানতে পারলাম সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলুম না মোটেই, তাই বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে যন্ত্রনা পেয়েছি দ্বিগুন। সে ব্যাথা স্বজন হারানোর যন্ত্রণার থেকে কম বড় নয়। আমাদের স্কুলের মেইন বিল্ডিং এর গোটাটাই নাকি ভাঙা হয়েছে, কারণ নতুন বিল্ডিং মাথা তুলে দাঁড়াবে চড়চড়িয়ে। ২৫নং, সাদার্ন এভিনিউ এখন একটা ফাঁকা মাঠ বই আর কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে লাল দেওয়ালের ওপর শ্যাওলার মতো আটকে থাকা আমাদের পুরোনো সময়গুলো পলেস্তরার মতো ভেঙে ঝরে পড়েছে, একথা ভাবতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে অজান্তেই । এমন ঘটনায় কিভাবে রিয়্যাক্ট করব জানিনা, অনেকেই হয়তো বলবে, "এতো সুখবর ! নতুন নির্মাণে ছাদের পরিসরটাও তো বাড়ল খানকতকটা"। হয়তো সত্যিই তাই। পুরোনো কাঠামোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে বটে, তবে পুরোনো ছাদটা ধূলিসাৎ হওয়ার সাথে সাথে অতীতের চিহ্নগুলোও বিলুপ্তির পথে কয়েক গজ পা বাড়ালো না কি ?
নবনালন্দা বলতেই গুগল ম্যাপে সাদার্ন এভিনিউয়ে ঢোকার মুখে বাঁদিকে সবুজ লোকাটরটা দেখাবে বটে, তবে যেটা দেখাবে না বা আর কখনোই দেখা যাবে না তা হলো লাল মাটির নকশা করা ১৯৬৭ র একটা চাঁপাফুল রঙা আদি দোতলা বাড়ি। যে বাড়ির সামনে দুটো লোহার গেট দুপাশে ফাঁক হলেই খুলে যেত আমাদের বাঁধভাঙ্গা উল্লাসের ম্যাজিক বক্স। যেখান থেকে বেরিয়ে আস্ত আমাদের কচিবেলার হুল্লোড়ের পায়রাগুলো, যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেলাগাম উড়ে বেড়াতো ঠিক মাঝখানের তকতকে উঠোনটায়। যেখানে নিয়ম করে সারি দিয়ে দাঁড়াতে হতো প্রেয়ারের সময় আর তার সাথে উড়ে আসতো উটকো চিমটি আর ফক্কুড়ি এদিক ওদিক থেকে। ফলে, 'ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা' দায়সাড়া গোছের কিছু প্রেয়ার করে যে যার খোপে ঢুকে যেতুম এক এক করে। 'পিনড্রপ সাইলেন্সের' ঝিঁ ঝিঁ পোকাটা নাগাড়ে বেজে চলতো কানের মধ্যে টিফিন টাইম অবধি। বাদিক ঘেঁষা বাঁধানো সিমেন্টের জলের ট্যাঙ্কটা অপেক্ষা করে থাকতো কখন আমরা টিফিন টাইমে ঠেলাঠেলি করে এ ওর গায়ে জল ছেটাবো। গুরুগম্ভীর ধমকানি বা গার্জেন কলের তোয়াক্কা করতুম না আমরা তেমন কেউই। পিছন দিকের আম গাছ আর বাঁদিকের নিম গাছটা নিপাট সাক্ষী থাকতো সেসব ডেঁপোমির। রেক্টর রুমের সামনে একটা একোরিয়াম ছিল, পানিশমেন্টের সময় অনেকেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো সেদিকে চেয়ে, ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ঘোর কাটতো না। মাছেদের কথা শুনতে পেতুম হয়তো আমরা কেউ কেউ । ঠিক তার ডান দিকেই কাঠের রেলিং দেওয়া শান বাঁধানো, কুয়াশা মাখা (আধো অন্ধকার থাকতো ) একটা সিঁড়ি ছিল যেটা দোতলায় উঠে লম্বা করিডোর শুরু হওয়ার ঠিক আগেই শেষ হতো। করিডোর বরাবর তিনটে সেকশনের তিনটে ক্লাসরুম ছিল যার প্রত্যেকটায় পিছনের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যেত। আমরা অনেকেই সেদিকে তাকিয়ে থাকাটা বেশি ইম্পরট্যান্ট মনে করতুম ব্ল্যাকবোর্ডের চেয়ে। ফলে নীল ডাউন বা বেঞ্চির ওপর গণ দাঁড়ানোটা প্রায় রেওয়াজই হয়ে গিয়েছিলো একরকম। আজও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, 'চল না ! আরো একবার দাঁড়াই সকলে মিলে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, ঠিক যেমনি করে দাঁড়াতুম সেই সব দিনে'..................
সেই জানলাগুলো বোধহয় না খোলার যন্ত্রনায় গুমরে মরেছে এতদিনে। সেই মেরুন রঙের সোফাটা, যেটা একাউন্টস সেকশনের প্রবেশপথে পড়ত, সেটা হয়তো আজ আস্তাকুঁড়ে বোঝাপড়া করছে অতীতের সঙ্গে। নিচের উঠোনটার চারপাশে লাল রঙের দেওয়াল ঘেরা ক্লাসরুম গুলোয় মৌমাছির গুঞ্জন এখনো কান পাতলে শোনা যাবে দস্তুরমতো। সেই লাল রঙে আঙ্গুল ছুঁলে হাতে রং উঠে আসতো সেসময়, অথচ কোনো এক জাদুবলে সেই জায়গাটার রং ফিকে হতো না কিছুতেই। এই ধাঁধাটা সেসময় বিস্তর মাথা চুলকেও বুঝে উঠতে পারিনি, আজ পারি। আর তাই ছিটেফোঁটা যেটুকু বাকি আছে সে রঙের, সেইটে দুহাত দিয়ে জাপ্টে জড়িয়ে রেখেছি, নিজের কাছে............ এটুকুই তো সম্বল, এটুকুই থাক বরং.........
সাঁঝবেলার ছেলেমেয়েদের বাগানের মাটি উপড়ে নতুন করে নতুন গাছ লাগানো হোক নির্দ্বিধায়, ক্ষতি নেই, তবে পুরোনো ফুলের গন্ধগুলো অমলিন ও টাটকা থাকবে আমাদের সকলের, সে ব্যাপারে আমি দুশোভাগ নিশ্চিত। তবুও.................... আলাদা করে আরেকটা বাগান করা যেত না কি ?
"যে আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্বলে
নিভে যায় - ডুবে যায় - তারা যায় স্খলে
নতুন আকাঙ্খা আসে - চলে আসে নতুন সময়
পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,
নতুনেরা আসিতেছে বলে"
............জীবনানন্দ দাশ
............জীবনানন্দ দাশ
#bengaliarticles #schooldiaries #schoolarticles #schoolwriteups #navanalanda #navanalandaalumni #nostalgia #oldschool #schoolmemories

Durdanto!!!!
ReplyDeleteআমার সেলাম জানবেন
DeleteDarun bandhu
ReplyDeleteDarun bandhu
ReplyDeleteআমার কৃতজ্ঞতা
DeleteApnar lekha r proti ti shobder madhyome 2000-2003 Saal r somoy gulo high definition picture quality te kichukkhon r jonno phire Pelam..thanks
ReplyDeleteআপনি কি ২০০৩ এর ব্যাচ ? আপনার নাম জানতে পারলে সুখী হতাম, আসলে এখানে আপনার নাম দেখাচ্ছে না।
DeleteSritimedurota
ReplyDeleteস্মৃতিটুকুই সম্বল এখন
Deletejodio kabir road er amra tao....main building bole kotha!
DeleteOshadharon
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ
Deleteবাকরুদ্ধ ।।
ReplyDeleteঘটনাটা জানার পর আমারও কতকটা তাই অবস্থা হয়েছিল
Deleteosadharon koto purono kotha mone pore galo.
ReplyDeleteপুরোনো দিনের কথারা পুরোনো হয়না কিছুতেই, তাই না ?
DeletePurono din gulo vese uthlo... asadharon.
ReplyDeleteপুরোনো দিনগুলো আসলে সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে থাকা মাছেদের মতো, বুড়বুড়ি কেটে মাঝেমাঝেই ভেসে ওঠে । আপনার নাম জানতে পারলে খুব ভালো হতো...
DeleteDarun likhechen ,speechless and purono nostalgia phire pelam.
ReplyDeleteDarun likhechen ,speechless and purono nostalgia phire pelam.
ReplyDeleteনস্টালজিয়ার দেওয়ালে আমাদের শৈশবের ছবিগুলো এখনো স্পষ্ট
DeleteKichu bolar nei... really missing those days
ReplyDeleteএখন শুধুই ফিরে দেখা.......
Deleteআপনার নাম জানতে পারলে ভালো লাগবে
"Muche jawa dinguli amai j pichu daake"..
ReplyDeleteস্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে :)
DeleteSchool er bhitorta arekbar ghuriye dakhanor jonyo onek dhonyobad..
ReplyDeleteস্কুলের আনাচে কানাচে আমাদের ছোটবেলা এখনও টাটকা আর জীবন্ত, স্কুল বাড়িটা প্রকান্তরে না থাকলেও....
DeleteAshadharon chokhe jol Ene dilo
ReplyDeleteচোখে জল আসার মতোই ঘটনা বটে....
Deleteবন্ধু, আপনার নাম জানাবেন প্লিজ
Lovely ..great work, aaj e janlam (K.Bhattacharyya, 1984 batch)
ReplyDeleteঅতীতের সৌধগুলো এমনভাবে ভেঙে পড়বে ভাবিনি কখনো
Deleteলেখা টা পড়ে মনটা ভরে গেল.. অজান্তেই দুচোখের পাশ দিয়ে কয়েক ফোটা জল পড়লো
ReplyDeleteএই লেখাটা লিখতে বড় কষ্ট পেয়েছি, অথচ না লিখেও উপায় ছিল না
DeleteAladaa e chilo she shob shuborno din guli����
ReplyDeleteদিনগুলি আর সোনার খাঁচায় রইল না :(
Deleteসত্যিই বাকরুদ্ধ... ছোটবেলার সব কিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল... সাক্ষী রইলো চোখের জল
ReplyDeleteফেলে আসা দিনগুলোর জলছবির ছাপ দিয়েই আগামীর চিত্র তৈরী করছি আমরা সবাই
Deleteদেবদত্ত, খুবই সুন্দর লেখা. অনিরুদ্ধ স্যার.
DeleteOne request. Can this write-up be published in our golden jubilee magazine? My no 9163028997
নিঃসন্দেহে স্যার, এ তো আমার সৌভাগ্য.....
DeleteOpurbo. ❤️
ReplyDelete