Showing posts with label মজারু. Show all posts
Showing posts with label মজারু. Show all posts

Tuesday, October 1, 2019

শর্ট ম্যাসাজ সার্ভিস

পাড়ার সেলুন আর বিউটি পার্লারের মধ্যে বেশ কিছু চরিত্রগত তফাত আছে যা আমরা সকলেই জানি। না না, পরিষেবা ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের যুক্তিতক্কের ফাঁকে ঢুকতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি, এই দুই প্রতিষ্ঠানের মূল তফাৎ হল আবেগে। খানিকটা আগ বাড়িয়ে বলা যেতে পারে যে পাড়ার সেলুন হল মধ্যবিত্ত বাঙালির অস্থায়ী আড্ডার চরম ঠিকানা, সহজ ভাষায় যাকে বলে - ঠেক। সেখানে 'বাজার আগুন দাদা, কিছু ছুঁলেই হাত পুড়ে যাচ্ছে' অথবা 'কুলদীপের অফ ফর্মটা এবার ওয়ার্ল্ড কাপে বেশ ভোগালো' বা 'যাদবপুরের সিটটা এবার যুক্তিসম্মত হলো না' ইত্যাদি কথাবার্তায় চুল দাড়ির নকশাটা যেন অন্য মাত্রা পায়। সেখানে পার্লারে শুধু কাঁচি চলার শব্দটাই যেন বেশি করে কানে লাগে। তার কারণ বাকিরা ধ্যানগম্ভীর ঋষি মুনির ন্যায় খবরের কাগজ বা স্মার্ট ফোনের মধ্যে অমৃতের সন্ধান পেতে থাকে। তাই পার্লারে যাবতীয় স্বর্গীয় হাতছানি উপেক্ষা করে নিয়মিত ক্ষুরকর্মের জন্য আমি বরাবরই আমার পাড়ার সেলুনগুলোকে অগ্রাধিকার দিই। ভাবছেন, ধান ভাঙতে শিবের গীতটা গাইতে লেগেছি কেন ? বলছি...

এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে যেটা আমার কাছে অন্যতম আকর্ষণ তা হল কুইক ম্যাসাজ। চুল কাটার পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ মানুষেরই ম্যাসাজ নেবার একটা পাশবিক ইচ্ছে জাগে। আর আশ্চর্য জনক ভাবে নাপিত ছেলেটিরও যেন এক নৈসর্গিক আনন্দ হয়। ভাবটা এমন যেন  - 'আহা কি বললে গো দাদা, এটার অপেক্ষাতেই তো ছিলুম'। আর তারপরেই যেটা শুরু হয় তা দিয়ে সহজেই একটা দশ মিনিটের শর্ট ফিল্ম বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। মাথার চুল পেরিয়ে ঘাড় আর পিঠ অবধি যে অবাধ তবলা বাদন চলে তার মধুর সংগীতের মূর্ছনায় গোটা সেলুনটা যেন সিনেমা হলের মতো লাগে। কারণ যারা চুল কাটার অপেক্ষায় বসে থাকে বা গুলতানি করে তারাও যেন এ দৃশ্যপটের সামনে কিছু মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা হয়ে যায়।

ম্যাসাজের প্রতি কোনোরকম স্পৃহা আমার কখনোই ছিল না, তার কারণ শরীরের উপর কোনোরকম  অত্যাচার আমি সইতে পারি না মোটে। আর আমার বলতে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই যে এ যাবৎ এমনধারা ম্যাসাজ আমি ছোটোর থেকে নিই নি কখনো । তবে কপালের ফেরে সে ভয়কর অভিজ্ঞতাও আমার হল একদিন । গত রোববার ল্যাদপ্রিয় মানুষের মতো আমিও একটু দেরিতে বিছানা ছেড়ে ছিলাম। দেরিতে ওঠার ফলেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক মাথাটা বেজায় টনটন করছিল। উঠেই ভাবলাম, সামনে পুজো, যাই, আজ চুল কাটার সাথে সাথে ম্যাসাজটাও করিয়ে নিই। চুল ছাঁটাও হবে সঙ্গে নতুন অভিজ্ঞতাও হবে। কিন্তু কপালটা চিরকাল আমার সাথে বেইমানি করে এসেছে। এবারেও তার অন্যথা হল না।

সেলুনটা আমার বাড়ির পাশেই। সাত ফুট বাই সাত ফুটের একটা ঘর। ছাপা পর্দার আড়ালে ফোর-জি স্পিডে দক্ষযজ্ঞ ঘটে চলেছে। ভিতরে ছটা চেয়ারই ভর্তি। মাঝে একফালি একটা সরু কাঠের বেঞ্চ, সেখানে বসে জনা তিনেক লোক আড্ডায় মশগুল। ডানদিকের চেয়ারে একটা কাঠের পাটাতনের ওপর একটা পুঁচকে ছেলে ঘাড় গুঁজে বসে, আড়চোখে সামনের আয়নায় আঁখো দেখা হাল এর বিশদ বিবরণী মেপে নিচ্ছে। পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে,  খুব সম্ভব ছেলেটির মা, যিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরামর্শ দিয়ে চলেছেন নাপিতকে। মধ্যবয়সী নাপিত বেচারা চেয়ারের চারপাশে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। দেওয়ালে লাগানো প্রীতি জিন্টা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। বাঁদিকের দেওয়ালে আমির আর শাহরুখ আলাপচারিতায় মগ্ন। দক্ষিণ পূর্ব কোণে একটা স্পিকার ঝুলছে। যেটা দেখে আমার প্রত্যেকবার মনে হয় সেটা যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়ে যাবে, কিন্তু আশ্চর্য ভাবে মাধ্যাকর্ষণ এর সমস্ত থিওরি ভুল প্রমাণিত করে দিনের পর দিন টিকে আছে সে এইভাবেই। সেটা দিয়ে নব্বইয়ের দশকের হিন্দী গান ভেসে আসছে। সবটা মিলিয়ে একেবারে মাখ মাখো মধ্যবিত্তের আধার কার্ড।

আমি দরজায় দাঁড়িয়ে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। রাজু আমায় দেখে বললে, 'দাদা দো মিনিট ! ব্যাস হয়ে গিয়েছে । একে ছেড়ে দিয়ে ফির আপনাকে ধরছি' ।

রাজু হল অল্পবয়সী খোস মেজাজি বিহারী নাপিত। বয়স ২৬ - ২৭ হবে। শ্যামলা রং, মাঝারি গড়ন, পান মশলায় বেশ আসক্তি আছে। 'একে' বলতে যাকে বোঝালো সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক চুল কাটাতে কাটাতে ভারী বীরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখেমুখে অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট । মনে মনে ভাবলেন বোধহয়, কোথাকার কোন নবাব খাঞ্জা খাঁ এসেছি যে মাত্র দুটো মিনিটেই ছেড়ে দিতে হবে ! আমি বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। অকারণ মাতামাতি সহ্য হয় না।  তবু রাজু আমায় বিশেষ খাতির করে। কি কারণে করে তা বলতে পারব না। হতে পারে আমি তার কাঁচির তলায় নির্বিচারে মাথা পেতে দিই এবং সমস্ত নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলি। রাজুও দিব্যি খোশগল্প করতে থাকে আমার সাথে। তার কোনো কথায় আমি বাধা দিই না, বরং সে একজন শান্ত নির্বাক শ্রোতা পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে চুল কাটতে থাকে।

মিনিট দশেক পরে রাজুর চেয়ার ফাঁকা হয়ে যেতে সে একগাল হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকাল। যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তিনি পাশ দিয়ে যাবার সময় তির্যক চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন আমার দিকে। আমিও সামান্য বোকা হাসি দিয়ে চুপচাপ নির্বিচারে বসে পড়লাম চেয়ারে। রাজুর কাঁচির পথচলা শুরু হল।

পিছন থেকে শুরু করে কানের দুপাশ দিয়ে রাজুর কাঁচি নির্বিবাদ চলতে লাগল। আর আমিও সামনের আয়নায় আমার চুলের ব্রেকিং নিউজ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। পেছনের দেওয়ালে শাহরুখ আর আমির আমার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে। প্রীতি জিন্টা সমানে মুচকি হাসছে। খানিক বাদে এই খুনখারাপির অবসান ঘটল। বরাবরই আমার চুল কাটতে বিশেষ সময় লাগে না। কমতে কমতে বর্তমান সময়ে এসে মাথার ওপর যে ক'গাছা পড়ে আছে তা ছোটবেলার স্মৃতি আর গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘাড়ের চারিদিকে খোঁচাওয়ালা পাউডার লাগিয়ে দিল রাজু। এই জিনিসটা তাকে প্রত্যেকবার বারণ করা হলেও সে শোনে না। খামোখা অত পাউডার লাগিয়ে ফুলবাবু সাজিয়ে ঠিক কি লাভ হয় বুঝিনা। অথবা হয়ত ভাবে, যে এই অবস্থায় ঠাকুর দেখে আসা সম্ভব.....

সমস্তটা হয়ে যাওয়ার পর রাজু জিজ্ঞেস করল, 'ওউর বলেন দাদা.........'

আমি খানিক ইতস্ততঃ করে বললাম, 'ইয়ে মানে তুমি তো ম্যাসাজ করো দেখি। আমার ঘাড় আর মাথার দিকটা একটু করে দিতে পারো......সকাল থেকে বড্ড টনটন করছে'।

রাজুর সারা মুখমন্ডল জুড়ে শরতের রোদ খেলে গেল যেন। আমার এহেন আবদার সে যে কিভাবে পূরণ করবে ভেবেই পেল না। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললে, 'আরে কি বলছেন দাদা, একদমসে করে দেব। আপনাকে এমন স্পেশাল ম্যাসাজ দেব যে আপনার নেশা লেগে যাবে'।

মনে মনে ভারি আশ্চর্য হলাম, 'ম্যাসাজের নেশা ! এ ব্যাটা বলে কি ! এতেও কি মানুষের আসক্তি আছে নাকি ? অবশ্যি তথাকথিত ম্যাসাজ পারলারের যে সমস্ত খবর কানে আসে তাতে করে ম্যাসাজ বিষম বস্তু হতেই পারে বৈকি'।

সে যাই হোক, রাজু সামনের ড্রয়ার খুলে সযত্নে চিরুনি আর কাঁচি রেখে দিল তাতে। তারপর দু হাত ওপরে তুলে নিজের দশটা আঙ্গুল কটমট করে ফাটিয়ে নিল। ঘাড়টা দুপাশে কাত করে নানান কায়দায় কসরত করে রেডি হয়ে গেল একেবারে। বক্সিং শুরু করার আগে ফাইটাররা যেমন করে থাকে, কতকটা সেই রকম। আমার কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এ যেন বল্লালদেবকে নিকেশ করার আগে বাহুবলী প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিনেমার দৃশ্যটা ভেবেই আমার গলা শুকিয়ে এল একেবারে। কেবলই মনে হতে লাগল একটু বেশি রিস্ক নিয়ে ফেললাম নাতো !

অবশ্য খুব একটা ভাবার অবকাশ পেলাম না। কারণ ততক্ষনে রাজু দুহাত দিয়ে কপ করে আমার মাথাটা ধরে ফেলেছে। দু আঙুলের মুদ্রায় কপালের সামনেটা টেনে টেনে ধরতে লাগল। তারপর একইভাবে ভাবে কপালের দুপাশে চক্রাকারে আঙ্গুল ঘোরাতে লাগল। বেশ আরাম পেলাম। মনে মনে রাজুর প্রতিভার তারিফ না করে পারলাম না। এরপর মাথার পিছন দিকটায় দু হাত দিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে জড়ো করে আঙুলের বিশেষ কায়দায় চটপটি বাজনার মতো করে ফটাফট শব্দ করতে লাগল। মাথার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের তরঙ্গ খেলে গেল যেন। দু চোখে অপার শান্তির ঘুম নেমে এলো আমার। কয়েক মুহূর্ত সেলুন আর স্বর্গের তফাৎ করতে পারলাম না।

বেশ খানিকক্ষণ এমনটা হবার পরে রাজু আমার কাঁধের দিকে নেমে এল। ফেনিল মসৃন ঢেউয়ের মতো সে আমার কাঁধের ওপর ছোট ছোট অবকাশে আঙ্গুল চালাতে লাগল। এমন স্তিমিত মৃদু অঙ্গুলিচালনায় মনে মনে একেবারে নিশ্চিত হলাম যে ম্যাসাজ কম্পিটিশনের ওয়ার্ল্ড কাপটা একমাত্র রাজুরই পাওয়া উচিত। এমন চমৎকার ট্যালেন্ট বুড়োশিবতলার গলিতে অবহেলায় ও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে ভেবে মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল।

হর্ষ আর করুণার দোলাচলে দুলতে দুলতে আমার অন্তরাত্মায় প্রগাঢ় আবেগ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আমার দু কাঁধের ওপর নেমে এলো বিরাশি সিক্কার দুখানি রাম রদ্দা । কতকটা সাংঘাতিক ঠোক্কর খাওয়ার মত মালুম হল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, আধা চোখ খুলে বললুম, 'ওরে আস্তে রে পাগল ! অমন করে কেউ মারে' ?

রাজু অকপট ভাবে বলল, 'এতক্ষন মেলোডি ছিল দাদা, এইবার রক দিচ্ছি'।

একথায় আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্ট্যাচুর মতো নিশ্চল হয়ে গেলাম। সে প্রাণান্তকর কথা অনুধাবন করতে খানিক সময় লাগল আমার মতো মূর্খের। যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। দু কথা বলার অবকাশ পর্যন্ত সে দিল না আমায়। তার আগেই আমার বাঁ হাতটা টেনে ধরে গামছার জল নিংড়ানোর মতো করে মোচড়াতে শুরু করলে। আমার চোখে কালবৈশাখীর আঁধার নেমে এল প্রায়।

ঢোঁক গিলে বললুম, 'একি কচ্ছিস রাজু ? হাতটা তো খুলে যাবে মাইরি' !

রাজু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলল, 'কি যে বলেন দাদা, হাত আবার অমনি খুলে যায় নাকি ! একি টেবিলের ড্রয়ার না আলমারির দরজা, যে টানলাম আর খুলে গেল' !

আমি প্রায় হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলাম, বললুম, 'ছেড়ে দে সোনাভাই আমার, ছেড়ে দে আমায়, যথেষ্ট হয়েছে আমি আর ম্যাসাজ নিতে চাইনা, এই অবধিই নেওয়ার ছিল আমার, আজ আর নয়.......'

রাজু শোনার পাত্র নয়। ঘাড় নেড়ে বললে, ' তা বললে কি হয় দাদা, এতদিন বাদে আপনি ম্যাসাজ নিচ্ছেন, অমন ছেড়ে দেয়া যায় নাকি ? সবে তো শুরু হল, এবার পিঠটা ভালো করে চাপড়ে দলাই মলাই না করলে মনেই হবে না যে ম্যাসাজ হচ্ছে'।

আমি কাতর ভাবে রাজুকে বললাম, 'দ্যাখ রাজু, এতদিন ম্যাসাজ নিইনি মানে এই নয়, যে আজ আমাকে পুরোটা উসুল করে নিতে হবে। আর তাছাড়া খামোখা আমার পিঠ চাপড়ে কি করবি বল ? বলার মতো তো তেমন কোনো কাজ করে উঠতে পারিনি আমি, সুতরাং অত তরিবত না করলেও চলবে......... আ - আমায় ছেড়ে দে ভাইটি.....'

রাজুর প্রত্যয়ী মুখে চোখে তেমন কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেল না। তবু আমি চেষ্টা করতে ছাড়লাম না। ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, 'শোন না, লক্ষ্মী ভাইটি, আমার না হঠাৎ একটা অফিসের কাজ মনে পড়েছে, বাড়িতে গিয়ে চট করে করতে হবে বুঝলি, আজ ছেড়ে দে, পরে নাহয় অন্য কোনো একদিন..........'

রাজু আমার ছেলে ভোলানো কথাকে অবলীলায় ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল, 'না দাদা, রোববারে আবার অফিসের কাজ কি, আর এতো কাজ করে করেই তো পিঠে ব্যথা হয়েছে। এরপর তো কোমর আছে, আপনি আরাম করে বসুন না, ঘাবড়াচ্ছেন কেন.....পিঠের বাইপাস ম্যাসাজটা আমি দেবই' ।

বাইপাস ম্যাসাজ !! আতঙ্কে আমার পেটের ভেতর সবকিছু যেন ফণীর ঝড়ের মতো গুলিয়ে উঠল। আমি প্রায় কেঁদে উঠে বললুম, 'ওরে ! আমার কোমরের দায়ভার তোর না নিলেও চলবে ভাই, বাঁকা পথ দিয়ে তাও মানুষ ভবনদী পেরোতে পারে কিন্তু ভাঙা কোমর নিয়ে আমি যে সরু নালাও টপকাতে পারব না'।

আমার কথার মর্মার্থ তার মাথায় ঢুকল কিনা জানি না কিন্তু আমাকে সে একেবারে প্রশ্রয় দিল না। বলল, 'অত ভয় পাচ্ছেন কেন দাদা, দেখুন না কেমন জম্পেশ টাইপের করে দিচ্ছি' ।

আড়চোখে দেখলাম, আশেপাশের লোকজন কেউই এই যাত্রাপালাটা মিস করছে না। দু চারজন সেলুনের বাইরেও জড়ো হয়েছে বিনি পয়সার কমেডি দেখবে বলে। আমার কেবলই মনে হতে লাগল আমার মতো অসহায় জীব এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ নেই।

তবে উল্টোদিক থেকে ভয় পাওয়ার কথা বললে চিরকালই বাঙালির পৌরুষে আঘাত লাগে, আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। ভিতরে ভিতরে কলজের মুড়োটা আচ্ছা করে বেঁধে নিলাম আমার দুঃসাহসের ফিতে দিয়ে। সাদা আলখাল্লার ভেতর দিয়ে প্রাণপণে চেয়ারের হ্যান্ডেল চেপে ধরলাম। এরপর যা শুরু হল তার সাথে একপ্রকার নটরাজের নৃত্যেরই তুলনা করা যায়।

কোনোমতে নাক মুখ গুঁজে নিরুপায় হয়ে সহ্য করতে লাগলাম সেসব। ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করল না। প্রীতি জিনটা নির্ঘাত শাহরুখ আর আমিরের সাথে মিলে আমায় ট্রোল করছে। মনে হল সেলুনের বাকিরাও ভোগের বাতাসের মতো সবটুকু সাঁতলে লুটেপুটে নিচ্ছে। আমি প্রায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম। সীতা হলে বলতুম - ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু এখানে কোনো কিছুই বলে উঠতে পারলুম না। আর বললেই বা ! শুনছে কৈ ?

পিঠ চাপড়ানো শেষ হতে রাজু এবার কোমর নিয়ে পড়ল। যা চলল তাতে করে কোমরের কৌমার্য হরণ হল বলা যায়। চোখের সামনে আমার বাঁচার কোনো রাস্তাই আর খোলা দেখতে পেলুম না। কোমরের ওপর দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে সে আমার শিরদাঁড়ার প্রতিটা হাড় যথাস্থানে আছে কিনা একেবারে অর্থোপেডিক ডাক্তারের মতো পরখ করতে লাগল। আয়নায় নিজের কাতর মুখটা দেখে আমি আরও বিমর্ষ হয়ে পড়লুম। নিজের এতো করুন মুখ আমি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমার অন্তঃরাত্মা হাহাকার করে উঠল সে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ম্যাসাজের ঠেলায়।

আরো মিনিট দশেক বাদে সে বিষাক্ত তান্ডব শেষ হল। ঝড়ের শেষে তালগাছ যেমন একদিকে হেলে নুয়ে পড়ে, আমিও কতকটা ডানদিকে হেলে কাত হয়ে গেলাম। চেয়ারের হ্যান্ডেলের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে তৃভঙ্গমুরারীর কায়দায় উঠে দাঁড়ালাম। রাজু একগাল হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। বুঝতে পারলাম দারুন বা সাবাশ টাইপের কিছু একটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মনে হল ওর চুলের মুঠিটা ধরে সামনের আয়নায় মাথাটা ঠুকে চুরমার করে দিই। পুলিশি হ্যাপা আমার পোষাবে না ভেবে ওই প্ল্যান ভেস্তে দিলুম মনে মনেই। বিশেষ কিছুই আর বলতে ইচ্ছে করল না আমার, তবু কোনোরকমে দাঁত চেপে, বাঁকা মুখ করে বললাম, 'টাকাটা রাখ, পুজো ভালো কাটাস.......'

বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে। বহুযুগ আগে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় মহাভারত সিরিয়ালে শকুনির চরিত্রে গুফি পেন্টাল যেভাবে হেঁটেছিল আমিও কার্যত কতকটা তেমনই আধা খুঁড়িয়ে আধা বেঁকে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা চালালুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম ম্যাসাজের মায়াজালে আর নয় রে ভাই। যতই হোক, পিতৃদত্ত প্রাণের সাথে ছেলেখেলা করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।

যাঁরা নিয়মিত ম্যাসাজ নেন এবং ম্যাসাজ নেওয়াটাকে প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছেন তাঁরা নিশ্চই ভাবছেন, ওঃ ! ছেলের যেন ননীর শরীর, সামান্য ম্যাসাজেই কাতর হয়ে পড়েছে ! কৈ ! আমরা তো এতো বছর ধরে নিচ্ছি আমাদের তো কিছু হয়নি। তাঁদেরকে হাত জোড় করে বলি, আপনারা প্রণম্য ব্যক্তি, ঈশ্বর আপনাদের সাহস ও শক্তি দুটোই দিয়েছেন। তবে বিশ্বাস করুন, এর থেকে মেট্রো বা বনগাঁ লোকালের ভিড় সামলানো সহজ, সারারাত কালী পুজোর মাইকের অত্যাচার এর কাছে নস্যি, এমনকি খালি পায়ে গরম পিচের রাস্তায় হাঁটাও সুখের, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তাতে করে ম্যাসাজ কথাটা আমার কাছে যে আমৃত্যু বিভীষিকাময় অসুর হয়েই থাকবে এ বলাই বাহুল্য......

তবে আপনাদের সবার পুজো নির্ভাবনায় ও নির্বিবাদে ভালো কাটুক এই কামনা করি......শুভ শারদীয়া।



#pujobarshiki #bengalishortstories #pujastories #bengalihumours #molat #DebdattaSinha

Friday, June 14, 2019

পিচ-বৃষ্টি ও আন্দোলন

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ বৈচিত্রে ভরপুর। সমর্থকদের জন্য এমন অভূতপূর্ব সারপ্রাইজ মাথাকুটেও ভাবা যায় না। মারকাটারি খেলার সাথে সাথে বাম্পার বোনাঞ্জার মতো বৃষ্টি দেখার আনন্দটুকুও যে ষোলো কলায় পূর্ণ  হবে এ বোধহয় অতি বড় সমর্থকও বুঝতে পারেননি। আর এই খেলাকে খেলা না বলে ছেলেখেলা বলব না পুতুল খেলা বলব সেসব ভাবতে গেলে আবার একটা ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে বরং বসে বসে সুপার সপারের কেরামতি দেখি ও গোটা মাঠ না ঢাকার ফলে মাঠকর্মীদের দ্বিগুন পরিশ্রমের পর্যালোচনা করে দুখী মনটাকে চায়ের কাপে ভিজিয়ে নিই।  

জনৈক উচ্চপদস্থ এক আইসিসি কর্মকর্তা বলেছেন যে ওনারা জানতেন ইংল্যাণ্ডে বৃষ্টি হবে তবে দ্বিগুন বৃষ্টি হবে সেটা নাকি আগাম আঁচ করতে পারেন নি। আবহাওয়াবিদরা অনেক আগেই বলেছেন এই সময়টায় বৃষ্টি হবে - এটাই যথেষ্ট নয় কি এবং সেটা জানার পরও এই সময় ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেললেন কি কারণে ? থর কি হাতুড়ি মারফত স্বপ্নাদেশে বরাভয় দান করেছিলেন নাকি আগাম সতর্কবার্তাকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তারা বলতে চেয়েছিলেন "চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা"...…..

১৮টা ম্যাচের মধ্যে এখনো অবধি ৪টে ম্যাচ বাতিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এই বছরটা বাদ দিলে এখনো অবধি শুধুমাত্র দুটো ম্যাচই বাতিলের খাতায় নাম তুলেছে। একটি ২০১৫ সালে এবং আরেকটি ১৯৭৯ সালে। এক্ষেত্রে রিসার্ভড-ডের উপকারিতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইসিসির কর্মকর্তারা বলছেন যে প্রত্যেকটা ম্যাচের জন্য রিসার্ভড-ডে রাখা হলে বহুদিন ধরে খেলা চালিয়ে যাওয়া পারতপক্ষে সম্ভব ছিল না। হরিবোল ! খেলাটা যখন বিশ্বকাপ এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের নজর থাকবে যেখানে সেটা নিয়ে আরও একটু দূরদর্শিতা দেখালে কি বিগ বাজারের উইকেন্ড ডিসকাউন্টটা মিস হয়ে যেত ! একটি চমকপ্রদ তথ্য দিই। ১৯৯৯ সালে এই ইংল্যান্ডেই আয়োজিত বিশ্বকাপে প্রত্যেকটি ম্যাচের জন্য একটি করে রিসার্ভড-ডে রাখা ছিল। 

আগামী দিনগুলোর মধ্যে যে সব দিনে ম্যাচ হবে সেখানে কয়েকটা দিন বাদ দিলে বাকি প্রায় সবকটা ম্যাচেই বৃষ্টি হবার প্রভূত সম্ভাবনা আছে - এমনটাই নাকি পূর্বাভাস। হরি হে মাধব ! চান করব না গা ধোব ! সুতরাং যে সমস্ত টিমের ম্যাচ বাতিল হতে থাকবে সেমি ফাইনালে ওঠাটা তাদের পক্ষে ততটাই দুঃসাধ্য হতে থাকবে। সবথেকে আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে ইংল্যান্ডের প্রায় সবকটা মাঠেই নাকি জল নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। শুধু পিচ ও পিচের চারিধারটা ঢেকে ফেললেই নিশ্চিন্তি, এতেই রাত্তিরে ভালো ঘুম হবে। ওরে পাগল ! ইডেনটা একবার দেখে যেতে পারতিস তো। তাছাড়া চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে সাব-এয়ার ড্রেনেজ সিস্টেমটা শিখে নিলেও তো হত। শ্রীলঙ্কায় পর্যন্ত গোটা মাঠ ঢাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আদ্যিকালের ভেঁপু বাজিয়ে কি আর জাস্টিন বিবারের শো হয় গুরুদেব ! 
   
এমতাবস্থাতেও আইসিসির পক্ষ থেকে তেমন কোনো হেলদোল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পরের ম্যাচগুলো ভেস্তে গেলে ঠিক কি হতে পারে তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভাবটা এমন যে ছাড়ুন তো মশাই, মোটে তো চারটে বছর, ও দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। পরের বার নাহয় ভরা জ্যৈষ্ঠে  সাহারা মরুভূমিতে স্টেডিয়াম করে বিশ্বকাপ করাব। বৃষ্টি হলেও বালিতে শুষে নেবে। সে আপনারা করুন গে, কিন্তু তাই বলে সমর্থকদের অপেক্ষা, আনন্দ আর উত্তেজনা মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, তার কি হবে ? কয়েকশো কোটি টাকার ভোজে প্যান্ডেলটাই ঠিক মতো বেঁধে উঠতে পারলেন না যে। অগত্যা সন্ধ্যের দিকে টিভি খুলে চপ মুড়ি খেতে খেতে শাপ শাপান্ত করা ছাড়া আর তেমন কোনো গতি নেই সমর্থকদের। একটা লাভ অবশ্য আছে। চপ মুড়ির শিল্পে একটা উন্নতি দেখা দিলেও দিতে পারে।
 



#molat #rainatengland #matchabandoned #CWC2019 #DebdattaSinha
   
 

Saturday, October 6, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৮ # বিবাহ বিভ্রাট

কৈলাশ। ভাদ্র মাসের সকাল। বেলা দশটার আশেপাশে। একটা অস্ফুট কান্নার চাপা আওয়াজ ভেসে আসছে যেন । দেখা গেল মহিষাসুর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে একটা শিলনোড়া দিয়ে পোস্ত বাটছে। আর মাঝে মাঝেই বাঁ হাত দিয়ে আলতো করে চোখ মুছে নিচ্ছে। পাশ দিয়ে লুচির থালা নিয়ে পার্বতী হেঁটে যাচ্ছিলেন দেবাদিদেবকে খাওয়াবেন বলে। এমন সময় কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখলেন মহিষাসুরকে, তারপর বললেন......

পার্বতী : কি ব্যাপার রে ? এই সাতসকালে পোগোর মোষের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস কেন ? কিছু হয়েছে ?

মহিষাসুর করুন মুখে ঘুরে তাকাল । চোখের জলে সাধের পাকানো গোঁফটা পর্যন্ত ভিজে জবজব করছে। পার্বতীর দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়াল । অর্থাৎ কিচ্ছু হয় নি।


পার্বতী : (বিরক্ত হয়ে) তাহলে কাঁদছিস যে বড় ?...….ওহ ! কুসুমদোলা দেখেছিস বুঝি ?

মহিষাসুর সেকথাতেও দুদিকে ঘাড় নাড়াল।  

পার্বতী : (আতঙ্কিত হয়ে) তবে কি ডাস্টিং করতে গিয়ে কাঁচের ফুলদানিটা ভাঙলি ?
মহিষাসুর : (করুণসুরে) না, তা নয়…
পার্বতী : (গম্ভীর গলায়) বাবা কি কিছু বলেছে ? আমি কিন্তু জানি, ইদানিং তুমি বাবার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে গাঁজা ভাঙ ধরেছ। রোজ সন্ধ্যেয় ওই পিপুল গাছের আড়ালে তোমাদের আড্ডা বসে।
মহিষাসুর : (কাঁদো কাঁদো হয়ে) না মা, সেসব নয়…..
পার্বতী : (ভীষণ রেগে গিয়ে) তবে কি আসল কথাটা বলবি, নাকি উঠোনের মুড়ো ঝ্যাঁটাটা দিয়ে আচ্ছা করে ঘা কতক দেব ?

একথায় মহিষাসুর প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠল।

পার্বতী : (মেগা বিরক্ত হয়ে) এতো আচ্ছা ঝামেলা হল দেখছি.....
শিব : (ত্রিশূল নিয়ে যোগাসন করতে করতে) কৈ গো ! লুচি আনতে যে রাত কাবার করে দিলে। পেট তো জ্বলে যাচ্ছে।
পার্বতী : এদিকে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। সকাল সকাল মহিষটা কেমন মরা কান্না জুড়েছে দ্যাখো।
শিব : (চোখ মুখ কচ্লে মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে) কি আশ্চর্য ! তুই কাঁদছিস কেন !! নাহয় কাল একটু বেশিই হয়ে গেছিল। তাই বলে সামান্য হ্যাংওভারও যদি সকালবেলাতে কাটিয়ে না উঠতে পারিস, তাহলে আজ থেকে আর পিপুলের পিছনে আসিস না বাপু। লোকের কাছে মান থাকে না আমার।
মহিষাসুর : আঃ, কি আবোল তাবোল বকছেন মাইরি ! বলছি তো সেসব কিছু নয়।
শিব : তবে কি ডান্স বাংলা ডান্সে সিলেকশন হয়নি বলে মন খারাপ ? আমি আগেই বলেছিলুম ওসব তোর কম্ম নয়। আমার কাছে ট্রেনিংটা পর্যন্ত নিলি না ঠিক করে।
মহিষাসুর : (কান্না থামিয়ে) নিকুচি করেছে...... (তারপর জোর গলায়) এবার পুজোয় আমি মর্ত্যে যাব না।

এই শুনে পার্বতী তাড়াতাড়ি লুচির থালাটা শিবের হাতে চালান করে দিয়ে কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়ালেন।


পার্বতী : (অত্যন্ত রেগে) তার মানে ?
মহিষাসুর : (মিন মিন করে) মানে আমি ঠিক করেছি আমি যাব না।
পার্বতী : একি ইয়ার্কি হচ্ছে !! সমস্ত জায়গায় প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেছে, চতুর্দিকে নীলসাদা রং হয়ে গেছে, পুজো কমিটিদের কোটি টাকা দেওয়া হয়ে গেছে, মহালয়ার প্রোমো পর্যন্ত চলছে, আর এখন বলছিস যাব না !
মহিষাসুর : (মাথা নিচু করে) না, এবারটা আমায় ছেড়ে দিন…..
শিব: (শান্ত হয়ে লুচি চিবোতে চিবোতে) আঃ ছেড়ে দাও না, যেতে যখন চাইছে না তখন খামোখা টানাটানি করে লাভ কি ? নাহয় আমার সাথেই থাকল ওই ক'দিন।
পার্বতী : (ক্ষিপ্তস্বরে) হুঁহ, ওকে তোমার কাছে ছেড়ে দিয়ে যাই আর সকলে মিলে এখানে মোচ্ছবের মহল্লা তৈরী করো। ওটি হচ্ছে না। (তারপর মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে) অ্যাই ন্যাশনাল জিওগ্রাফির রিজেক্টেড মোষ ! আসল কারণটা বল এক্ষুনি, নাহলে তোকে যেকোনো একটা ব্রিজের নিচে বেঁধে রেখে আসব, এই বলে দিলুম।

সকলে উৎসুক নেত্রে মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নন্দী, ভৃঙ্গী, গণেশ, কার্ত্তিক সকলে মজা দেখবে বলে পায়ে পায়ে এসে জড় হল সামনে। শিবের তৃতীয় নয়ন পর্যন্ত খুলে গিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। মহিষাসুর কতকটা কাঁচুমাচু হয়ে মুখ খুলল অবশেষে। 

মহিষাসুর : (খানিক লজ্জা পেয়ে, আমতা আমতা করে) ইয়ে, মানে... আমি বিয়ে করব…..

কৈলাশে যেন বাজে পড়ল তৎক্ষণাৎ। শিবের মুখ থেকে লুচির টুকরো খসে পড়ল মাটিতে। পার্বতী প্রকাণ্ড একটা হাঁ করে রইলেন। সকলে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন একঠায়। এমন আজব, অস্বাভাবিক কথায় কারোর মুখে রা পর্যন্ত সরল না। কি বলবেন, কি করবেন, কেউ বুঝেই উঠতে পারলেন না। মধ্যিখান থেকে গনেশ আর কার্ত্তিক  'মামা বিয়ে করবে, মামা বিয়ে করবে' বলে হর্ষধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললে একেবারে। আকস্মিক সংবাদের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠলেন পার্বতী।

পার্বতী : (গলা খাঁকরে) তুই যা বলছিস, ভেবে বলছিস তো ?
মহিষাসুর : (আরও খানিকটা লজ্জা পেয়ে) হ্যাঁ.... আমি বিয়ে করব…..
পার্বতী : তোকে ঠাস করে এক চড় মারব.......... উটপাখির এরোপ্লেন হওয়ার শখ ! বাথরুম সিঙ্গার নাকি কোক ষ্টুডিও যাবে ! বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ?
শিব : (মোলায়েম স্বরে) আহা, ওকে অত তড়পাচ্ছ কেন ? বেচারা বিয়েই তো করবে বলেছে, রোহিঙ্গা তাড়াবে তো আর বলেনি।
পার্বতী : ওহ ! বেচারা ? মাইনরিটি সেকশন ? রোজ সকালে, তোমার ব্লাড সুগারের জন্য কচি নিমপাতা কি নিজে থেঁতো করবে ভাবছ ? তাছাড়া সারা সপ্তাহের বাজার, দোকানের জিনিসপত্র, মাস গেলে আমার মোবাইলের রিচার্জ, সংসারের আরও যাবতীয় খুঁটিনাটি  এসব কে করবে শুনি.......তুমি ?
শিব : আহা ! এসব তো আর ও একা করে না, নন্দীরাও তো হেল্প করে, নাকি ?
পার্বতী : হেল্প !! কে কি করে জানা আছে তোমার ? খোঁজ রাখো কিছুর ? যবে থেকে ওয়ার্ল্ড যোগা ডে চালু হয়েছে তবে থেকে পাড়ার দেবদেবীদের নিয়ে তোমার ব্যাচের পর ব্যাচ যোগা ট্রেনিং চলে। আর সন্ধ্যে হলেই পিপুল গাছের পিছনে চলে যাওয়া। এই তো তোমার রুটিন। ছেলেমেয়েগুলোকে একটু টিউশন থেকে নিয়েও তো আসতে পারো।
শিব : এই দ্যাখো, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে চলে যাচ্ছে.....

এমন সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে নারদমুনির প্রবেশ। ইনফাইনাইট লুপে 'নারায়ণ নারায়ণ' ছাড়াও ইদানিং 'দিল দিয়া গল্লা' গানটা খুব শুনছেন। গানের পজ বাটনটা টিপে, হেডফোন খুলে সামনের দিকে মুখ তুলে তাকালেন।

নারদ : (পার্বতীর দিকে তাকিয়ে) পেন্নাম হই জগজ্জননী......(শিবের দিকে তাকিয়ে) জয় মহাদেবের জয় !

সকাল সকাল নারদের এমন অনাহূত আগমনে শিব ভারী বিরক্ত হলেন। একটা লুচি মুখে চালান করে দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন...…

শিব : ওই এল ! এক নম্বরের বিসি.....
নারদ : আজ্ঞে , কিছু বললেন মহাদেব ?
শিব : (শশব্যস্ত হয়ে), কই, কিছু না তো !
নারদ : আমার মনে হল আপনি বোধহয় আমাকে কাঁচা ভাষায় কিছু একটা বললেন।
শিব : (অমায়িক হেসে) ও কিছু নয় রে পাগলা, ও কিছু নয়। আমি বলছিলাম তুমি হলে কিনা স্বর্গের ব্রডকাস্টিং চ্যানেল অর্থাৎ বিসি । হেঁ হেঁ হেঁ......তুমি চাপ নিও না নাড়ু। তা আজ, এদিকে ? কি মনে করে ?
নারদ : না আমি তো আসলে দিল দিয়া শুনতে শুনতে (পরক্ষনেই সামলে নিয়ে) আই মিন এ দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় হট্টগোল শুনে থমকে দাঁড়ালাম, ভাবলাম কৈলাসে আবার কোন কেলেঙ্কারি হল, দেখে যাই।
শিব : ("শশালা….বা…....")  (গলা খাঁকরে) তা বেশ করেছ……..লুচি খাবে ?


শিব লুচির থালাটা বাড়িয়ে দেন সামনে।

নারদ : (শিবের মনের কথাটা খানিক আঁচ করে) আজ্ঞে না, আপনি চিবোন....... (তারপর পার্বতীর দিকে তাকিয়ে).....কি হয়েছে মা, এখানে এত চেঁচামেচি কিসের ?

গনেশ : (ফিচেল হাসি দিয়ে) মামা বলছে বিয়ে করবে.....
কার্ত্তিক : আর আমি নিতবর হব........
নারদ : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) বলিস কি !!!
পার্বতী :  কি আর বলব রে নাড়ু, এসব হচ্ছে বাংলা সিরিয়াল দেখার ফল। যথেচ্ছ বিয়ে আর পরকীয়া দেখে মহিষের মাথাটা গুবলেট হয়ে গেছে একেবারে। বলছে মর্ত্যে যাবে না, বিয়ে করবে। এই লাস্ট মোমেন্টে এসব হ্যাপা কি পোষায় বল দিকি !
নারদ : (গম্ভীর হয়ে) কঠিন সমস্যা মা….. আপনার কথাও ঠিক আবার দেখতে গেলে মহিষেরও একটা ন্যায্য দাবি আছে। কোনোটাই ফেলে দেবার নয়। আমার মনে হয় এই সময় একমাত্র যিনি হেল্প করতে পারেন, তিনি হলেন পরম কল্যাণময় স্বয়ং নারায়ণ।
শিব : (মনে মনে) ব্যাস ! একা নরেন রক্ষে নেই, রাহুল দোসর......
পার্বতী : (চিন্তান্বিত হয়ে) বলছিস ! উনি পারবেন ?
নারদ : হেঁ হেঁ,... কি যে বলেন মা ! উনি পারেন না বিশ্বসংসারে এমন কাজ কই !
শিব : (তির্যক ভাবে) হ্যাঁ ! সে আর বলতে ……(পরক্ষনেই গলা খাঁকরে) তবে ওনার কি সময় হবে ?
নারদ : আজ্ঞে হ্যাঁ, এই সময়টা তো উনি ফেসবুকে 'পপুলার বেঙ্গলি জোকস' পড়েন। সকলে মিলে স্মরণ করুন, এক্ষুনি আবির্ভূত হবেন।

একথায় সকলে মিলে হাতজোড় করে নারায়ণ স্তব করতে লাগলেন। যথাসময়ে তেজদীপ্ত আলোকরশ্মির মধ্যে দিয়ে সাদা শার্ট আর জিন্স পরিহিত চতুর্ভূজ, কমলকান্তি শ্রীবিষ্ণু প্রকট হলেন স্বমহিমায়। সকলেই নতজানু হয়ে শ্রীবিষ্ণুর অভ্যর্থনা করলেন।  এমন সময় ……..

নন্দী : (আর্তনাদ করে) ওরে বাবারে, ওরে দাদারে, লাগছে লাগছে ...…..

সবাই মিলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সবিস্ময়ে নন্দীর দিকে ঘুরে তাকালেন। নারায়ণও ভারী বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নন্দীকে দেখলেন।

নন্দী : (নারায়ণের দিকে তাকিয়ে) আঃ ! পা'টা ছাড়ুন মাইরি, ছাড়ুন প্লিজ। ডানদিক বাঁদিক না তাকিয়ে একেবারে সোজা আমার পায়ের উপর এসে প্রকট হলেন যে বড় ! কি ভেবে ? হ্যাঁ ??

নারায়ণ ব্যাপারটা আঁচ করে তড়াক করে লাফ দিয়ে পাশে সরে দাঁড়ালেন।

নারায়ণ : (জিভ কেটে) ইসসস্স, একদম দেখতে পায়নি না রে ভাইপো। আসলে আমার জিপিএসটা ক'দিন ধরে খুব গোলমাল করছে। ল্যাটিচিউড লঙ্গিচিউড মোটে মিলছে না। এই তো কদিন আগে ভোরভোর একটু ঝিলের ধারে জগিং করতে যাব বলে চোখ বুজে জিপিএসটা অন করলুম । চোখ খুলে দেখি যমপত্নীর কোলে শুয়ে আছি। কি লজ্জা কি লজ্জা !.......

পার্বতী : সে যাগ্গে। এদিকে শুনেছ তো কেমন গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। কি করবে এবার দ্যাখো, আমরা তো আর ওকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পারছি না বাপু।
নারায়ণ : হ্যাঁ মা।  আমার অজ্ঞাত কিছুই নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সালটে নিচ্ছি পুরোটা। (এরপর মহিষের দিকে তাকিয়ে) দ্যাখো ছোটভাই, বিয়ের চিন্তাভাবনা করছ এ অতি ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে তোমার একটা দায়িত্ত্ব আছে সেটা ভুলে গেলে চলবে কি করে ?
মহিষ : বেশ তো। আমার বিয়েটা আগে দিয়ে দিন। তারপর মর্ত্যে যাব, কোনো চাপ নেই।
নারায়ণ : আহাহাহা, কি মুশকিল ! বিয়েটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া বিয়ের জোগাড় করতেও তো সময় লাগে নাকি ? উঠল বাই আর সিঙ্গুর যাই অমন করলে চলে নাকি। সবকিছুরই একটা ভেবে দেখার বিষয় আছে।  আর কেউ তো বলছে না বিয়ে কোরো না। পুজোটা ভালোই ভালোই মিটিয়ে এসে ছাদনাতলায় বসলেই হল। ঠিক কিনা ?

একথায় মহিষ গম্ভীর মুখে বারমুডার পকেট থেকে চারটি কাঁঠাল পাতা বের করে চোখ বুজে চিবোতে লাগল। নারায়ণের কথায় খানিক জাবর কাটল বটে কিন্তু সঠিক মনস্থির করে উঠতে পারল না।

মহিষ :  নাহ, আপনি আমায় কথার জালে ফাঁসাচ্ছেন মাইরি।
নারায়ণ : আরে, এতো আচ্ছা পাগল ! একি লোকসভার ইলেকশন হচ্ছে নাকি ? তোমায় ফাঁসিয়ে কার কি লাভ হবে শুনি ?  আর তাছাড়া বড়রা যখন বলছেন তখন অমন জেদ করতে নেই। আমরা তো বলছি বিয়ে হবে। কথা দিচ্ছি।
মহিষ : নাহ, আপনারা কাজ গুছিয়ে নিতে ওস্তাদ। কাজ হয়ে গেলে আর ফিরেও তাকাবেন না, আমি জানি।
পার্বতী : মারব এক থাপ্পড়। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস ? বড়দের মুখে মুখে চোপা !
শিব : আঃ পারো। এই সময় ভায়োলেন্স নয়। কমন সেন্স ইউজ করো। ওর দোষ কোথায় ? যুগের পর যুগ ধরে তো ভুগছে। আচ্ছে দিন এসেছে কি ? ডিজিটাল স্বর্গ মানেই তো আর ডেভেলপ্ড স্বর্গ নয়। এটা বুঝতে হবে। আমার মনে হয় প্রজাপতি ব্রহ্মাকে একবার কল দেওয়া উচিত। উনি সর্বজ্ঞানী, এই বিশ্ব চরাচরের সমস্ত সমাধান ওনারই কৃপায়। এহেন সমস্যায় যোগ্য সিদ্ধান্ত উনিই নিতে পারবেন একমাত্র। এস আমরা কালবিলম্ব না করে ওনাকে স্মরণ করি ।

প্রজাপতি ব্রহ্মা অনতিদূরেই একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। এ যাবৎ ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে চুপিচুপি শুনে নিয়েছেন ওখানে দাঁড়িয়েই। স্বর্গে ফোর জি চালু হয়ে যাওয়াতে ওনার ধারেকাছে বিশেষ কেউ ঘেঁষে না। সমস্ত দিনটা উনি ফাঁকাই থাকেন। সময় সুযোগ পেলে পুরোনো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভিতে সারেগামাপা দেখে পা নাচান অথবা নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম শুনে দুঃখ পান। মহিষের ঘটনায় উনি বেশ মজা পেয়েছেন এবং লুকিয়ে অকুস্থলে এসে হাজির হয়েছেন। সকলে মিলে স্মরণ করতেই উনি তড়িঘড়ি সামনে এসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে শুরু করলেন।

ব্রহ্মা :  বন্ধুগণ........ সরি, দেবদেবীগণ, তোমাদের আর ডাকাডাকি করতে হবে না।  আমি নিজে থেকেই হাজির হয়েছি। আফটার অল তোমাদের পাশে দাঁড়ানোটাই আমার প্রধান কর্তব্য। বিষয়ের গুরুত্ব বিচার করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে যতক্ষণ না মহিষের একটা হিল্লে হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত অসুর ভাতায় ওকে একটা সাইকেল দেওয়া হবে। আপাতত ওই সাইকেলটা চড়েই ও ঘোরাঘুরি করুক, পরে কিছু একটা করা যাবে।
নারায়ণ : (বিরক্ত হয়ে) এই, এটা  কে রে ! সাইকেল দেওয়ার সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক ! আর তাছাড়া পরে আর কবে ? একি এসএসসি পরীক্ষা ? পরে কোনো একটা সময় করে নিলেই হল।
শিব : আঃ অত উত্তেজিত হতে নেই, ধৈর্য ধর। (ব্রহ্মার দিকে তাকিয়ে) কৈলাসে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই প্রজাপতি। আমি বরং গোড়া থেকে আপনাকে বুঝিয়ে বলি, তাহলে আপনার পুরোটা বুঝতে সুবিধা হবে।
ব্রহ্মা : (হাত তুলে থামিয়ে) ভুলে যেও না দেবাদিদেব, আমি সর্বজ্ঞ, আমার অজানা কিছুই নেই। রণে বনে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমায় স্মরণ করিও, আমি তোমাদের রক্ষা করিব।
নন্দী : (ফিসফিস করে ভৃঙ্গিকে) যাহ কলা ! এতো লোকনাথ বাবার ডায়লগ। বেমালুম ঝেঁপে দিল যে !!
ভৃঙ্গি: চেপে যা রে ভাই, ভাঁওতাবাজি দিয়েই চলছে চাদ্দিক । বেশি বলবি, মাওবাদী বলে খেদিয়ে দেবে।
শিব : যাক ! তাহলে তো ভালোই হল। এবার এই ক্যাচালটার আপনি একটা বিহিত করুন তো দেখি।  সেই সকাল থেকে কান মাথা সব ঝালাপালা হয়ে গেল।
ব্রহ্মা : মাথা টনটন, কান ঝনঝন
        মহিষ বলেছে আড়ি.....
        হাতে লণ্ঠন মাছি ভনভন
        না এসে কি পারি ?

কবিতার রসেই হোক অথবা কিছু না বুঝেই  হোক উপস্থিত সকলে মিলে হাততালি দিয়ে উঠলেন।


নন্দী : (ফিসফিস করে) কবিতাটায় কেমন যেন একটা চেনা প্যাটার্ন পাওয়া যাচ্ছে .....নারে ?
ভৃঙ্গি : ঠিকই ধরেছিস। তবে শুনেছি নাকি অফটাইমে অফবিট ছবিও আঁকছেন এখন।
ব্রহ্মা : (মহিষের দিকে তাকিয়ে) এই যে মোষের পো, বিয়ে করবে সে ভালো কথা কিন্তু কাকে করবে শুনি ? বলি পাত্রীটি কে ?

সকলে উৎসুক নেত্রে মহিষের দিকে চেয়ে রইলেন। মহিষ লজ্জিত হয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। কিছুতেই  মুখ ফুটে বলে উঠতে পারল না। এইভাবে বেশ কিছুক্ষন কাটল। ধীরে ধীরে সকলেই অধৈর্য হয়ে পড়লেন।

নারায়ণ : কিরে ছোটভাই ? নামটা বল, চট করে টুইট করে দিই.......
গনেশ : বলো না মামা...... মামীর নাম কি ?
পার্বতী : (ধৈর্য হারিয়ে) এই ! তুই কি ইন্ডিয়ান আইডলের অডিশন দিতে এসেছিস যে চুপ করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছিস ? নামটা বলবি নাকি পিছনে গরম ত্রিশূলের খোঁচা দেব ?
মহিষ : (থতমত খেয়ে ) সানি ........ও..ওর নাম হল সানি..........
ব্রহ্মা : লিওন ???......জয় গুরু .....
পার্বতী : সে আবার কে ?

শিব ফিসফিস করে যতটা সম্ভব সহজ ভাষায় পার্বতীকে নামের ইতিবৃত্ত বুঝিয়ে দিলেন । সবটা শুনে পার্বতীর চোখ কপালে উঠে গেল। ধপ করে বসে পড়লেন পাশের বেদীতে।

নারায়ণ : যাই বলো, নামের মধ্যে কিন্তু বেশ একটা ষ্টার ষ্টার ব্যাপার আছে। জমবে ভালো।
শিব : দাঁড়া বাপু ! আমি যদ্দুর জানি তার তো বিয়ে হয়ে গেছে ? সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিবাহটা বেআইনি।
ব্রহ্মা : একজ্যাক্টলি। তাছাড়া পরকীয়া আইনসিদ্ধ হয়েছে বলে তুমি একেবারে পরস্ত্রী ফুঁসলে আনবে একথাও তো ঠিক নয়।  
নারায়ণ : শুধু তাই নয়, যাকে বিয়ে করবে সে রাজি আছে কিনা সেটাও তো জানা দরকার। এতো আর কোলগেট নয় যে নিম, লবঙ্গ, নুন আছে কিনা জানলেই হয়ে গেল। বিয়ে বলে কথা।
নারদ : তেমন হলে আমি গিয়ে একবার জেনে আসতে পারি ........যাব ?
ব্রহ্মা : তুই থাম ছোঁড়া। নাম শুনেই অমনি দৌড়ে মেডেল আনতে চলল। আগে সবটা জানা দরকার, তারপর অন্য কথা।
মহিষ : কি আশ্চর্য মাইরি !! আপনারা কি আবোল তাবোল বকছেন ?
শিব : তার মানে ?
মহিষ : এ সানি সে সানি নয় .....
নারায়ণ : খেয়েছে ! তবে কোন সানি ?
নন্দী : (ফিসফিস করে ভৃঙ্গিকে ) আমার মনে হয় গাভাস্কারের কথা বলছে।
পার্বতী : হা কপাল !!
মহিষ : এসব কি হচ্ছে !!! কাদের সব নাম বলছেন বলুন তো ? এরা কেউ নয়।
সকলে একযোগে : তবে কে  ?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিষ একবার সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ খুলল।

মহিষ : সানি...... মানে ইয়ে, আমাদের সূর্যদেবের কথা বলছিলুম......

একথা শুনে পার্বতী প্রায় মূর্চ্ছা গেলেন। শিব তাড়াতাড়ি একঘটি জল এনে পার্বতীর মুখেচোখে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। উপস্থিত বাকি সকলেই বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। পোষা সিংহটাও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মহিষের দিকে। গোটা কৈলাসে নিস্তব্ধতার ছায়া ঘনিয়ে এল। কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করলেন না। এই অপ্রত্যাশিত নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথমে ব্রহ্মা সরব হলেন।

ব্রহ্মা : একি সত্যি নাকি !
মহিষ : (বিড়বিড় করে) পুরোটাই....
শিব : কদ্দিন ধরে ?
মহিষ : তা, বছরখানেক হল........
নারায়ণ : ইয়ে....মানে, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না ?
নারদ : হরিবোল.....
শিব : দাঁড়াও দাঁড়াও। আমরা একটু শক খেয়েছি বটে, কিন্তু তাই বলে প্রতিবাদী মিছিল করার কোনো দরকার নেই। আমি তো এতে দোষের কিছু দেখছি না।
ব্রহ্মা ; ঠিকই, তাছাড়া এমনটা তো নতুন নয়। মর্ত্যে যদি ৩৭৭ চেঞ্জ হতে পারে তাহলে আমাদের এখানে নয় কেন। আমাদেরও খোলা মনে ব্যাপারটা বিবেচনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি বরং অসুরশ্রীর একটা ব্যবস্থা করে দেব।

পার্বতী কিছুটা সুস্থলাভ করার পর কোনোরকমে উঠে মহিষের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।

পার্বতী : (মেলোড্রামাটিক সুরে) আমি তোর ওপর বড্ড বেশি অত্যাচার করি......নারে ? তাই বোধহয় এভাবে শোধ নিলি ?
মহিষ : (জনপ্রিয় শিল্পীর নকলে) আ--আমি কিছু করিনি । বিশ্বাস করুন, আ--আমি অন্যায় করিনি ।
শিব : দ্যাখো পার্বতী, তুমি মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছ। হৃদয় বিনিময় কোনো নিয়ম মেনে হয় নাকি ? নাকি তার কোনো সংজ্ঞা আছে ? তুমি তো মা। সন্তানের সুখ দুঃখের ভার তো তোমারই। এমন সময় পিছিয়ে এলে কি করে হবে ? তুমি সম্মতি না দিলে ও যে সারাটা জীবন কষ্ট পাবে। মা হয়ে তুমি কি তাই চাও ?

পার্বতী চোখ বুজে নিজের মতো করে চিন্তা করতে লাগলেন।

ব্রহ্মা : তাছাড়া এখানেও কিন্তু একইভাবে সেই দ্বিতীয় বিবাহের প্রশ্নটা থেকে যায়। সানি, আই মিন, সূর্যদেবও কিন্তু বিবাহিত। সূর্যপত্নী কি মেনে নেবেন ব্যাপারটা ?
মহিষ : হ্যাঁ, সেটা কথা বলা আছে। সানির স্ত্রী, ওঁর এই ওরিয়েন্টেশনটা জানার পর নিজে থেকেই  ডিভোর্স ফাইল করেছেন। আপাতত আমরা লিভ ইন করব, ডিভোর্স পেলেই বিয়ে ।
নারায়ণ : আশ্চর্য, এতো কিছু হয়ে গেলো অথচ আমরা কেউ টেরই পেলুম না !
নারদ : আমার কিন্তু একটা জিনিস খচখচ করছে বাপু। অমন প্রখর তেজস্বী ব্যক্তিত্ব, কাছাকাছি গেলেই তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবার রিস্ক থাকে। সেক্ষেত্রে কিভাবে......
মহিষ : (লাজুকস্বরে) সাধারণত সকাল আর দুপুরের দিকটা এড়িয়ে চলি। সন্ধ্যের পর থেকেই ওর মধ্যে একটা ডিমলাইট টাইপের ভাব চলে আসে.....তারপর আর অসুবিধে হয় না.....
শিব : ব্রাভো ! তোর বুদ্ধি দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি মাইরি ! (পার্বতীর দিকে ঘুরে) দ্যাখো পারো, ওদের ইন্টেন্সিটিটা লক্ষ্য কর একবার। এরপরও তুমি আপত্তি করবে ? তুমিই তো বলো, তোমার প্রত্যেক সন্তানের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। এসময় আমাদের সকলের ওর পাশে থাকাটা খুব জরুরি।
পার্বতী : (একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বেশ, তোমরা যেমন ভালো বোঝো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
মহিষ : বলুন মা।
পার্বতী : মর্ত্যের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। ওদেরকে লাস্ট মোমেন্টে কোনোভাবেই ডিপ্রাইভ করতে পারব না। সুতরাং আগে পুজো, পরে বিয়ে। ফিরে এসেই নাহয় আমিই সেসবের ব্যবস্থা করব।
শিব : (অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে) ওরে তোর মা রাজি হয়েছেন রে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কি ইডিয়ট, একটা পেন্নাম কর শিগগির। 

মহিষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলল। চিৎকার করে বলল, "বলো দুগ্গা মাইকী".........গোটা কৈলাস হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে একসাথে গলা মেলাল মহিষের সাথে।




বিন্যাস  : অর্ণব দাসগুপ্ত 

















 




#Durgapuja #bengalishortstories #durgapujastories #pujabarshiki #Molat #DebdattaSinha

Saturday, June 2, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৭ # আট-আর সারপ্রাইজ

কলকাতা।বছর আটেক আগে।রাত্রি নটার আশেপাশে,ঘরে টিভি চলছে।

পাত্রের মা : (হাসিহাসি মুখে) এই নে, ছবিটা দেখ।
পাত্র : (ছবিটা হাতে নিয়ে ) এটা কি ?
পাত্রের মা : পাত্রী। কাল দেখতে যাচ্ছি। তুই যাবি সঙ্গে ?
পাত্র : (মনে মনে) গেলেই হয়......
পাত্রের মা : হ্যাঁ ? কিছু বললি ?
পাত্র : না না, কিছু না। ও আমার অন্য কাজ আছে কাল। তোমরা যাও....
পাত্রের মা : ছুটির দিনে আবার কাজ কিসের ?
পাত্র : অফিসের ইভেন্ট আছে। আমায় যেতেই হবে....তোমরা দেখে এসো। কোনও চাপ নেই...
পাত্রের মা : চাপ নেইটা আবার কি ধরণের কথা ?
পাত্র : ইয়ে...(মাথা চুলকে) মানে ওটা চলতি কথা। অর্থাৎ কোনো সমস্যা নেই ।
পাত্রের মা : চলতি কথা ! কই শুনিনি তো আগে ?
পাত্র : আঃ তুমি এসব কি করে শুনবে। কিছু কিছু কথা ব্যাপক খাচ্ছে এখন.....
পাত্রের মা : ব্যাপক খাচ্ছে !!! .....(অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে) এসবের মানে কি ?
পাত্র : মানে এগুলো এখন চলছে......কিছু কিছু শব্দের, ভাষার রূপবদল হয়েছে আর কি। অনেক কথা একসাথে বলার চেয়ে ছোট ছোট কথায় বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। যেমন ধরো - কোনো একটা জিনিস দারুন লেগেছে। সেটা অনেক কথায় না বলে বললাম.... 'একঘর' ..
পাত্রের মা : ওহ তাই নাকি ? আসলে ভদ্রলোকের মুখে শোনা যায়না তো এসব, তাই বোধহয় শুনিনি.....
পাত্র : (চুপ) (একমনে টিভি দেখতে থাকে)

পরদিন রাত্রে। দশটার আশেপাশে....পাত্র উপুড় হয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে।

পাত্রের মা : (বেশ উত্তেজিত হয়ে) কি রে কোথায় গেলি ? এই যে ! পড়ছিস বুঝি ?....আচ্ছা শোন, আজ দেখে এলাম রে !
পাত্র : (পড়তে পড়তে) হুমম.....
পাত্রের মা : আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে বুঝলি। মেয়েটা ভীষণ গুণী (পাত্রের বাবার দিকে ঘুরে) কি গো তাই না ?
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ , মানে আমাদের তো মত আছে... এখন তুই যদি....
পাত্রের মা : (ভুরু কুঁচকে) মত ? মত আবার কি ? আমি তো একরকম কথা দিয়েই এলুম....
পাত্র : (ধড়মড় করে উঠে বসে) সে কি ! দেখলাম না শুনলাম না, একেবারে কথা দিয়ে এলে মানে ? আমার কি কোনো মতামত নেই !!!!
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ মানে... আমিও ঠিক সেই কথাই বলছিলাম। তোর মতামতটা অন্তত একবার....
পাত্রের মা : (দাবড়ানির স্বরে) তুমি থামো তো........(পাত্রের দিকে ঘুরে) তোর আবার মতামত কিসের ? যেমনটা চাইছিলি প্রায় তেমনটাই তো দেখে এলাম। মেয়েটি উচ্চশিক্ষিতা, রুচিশীলা। তাছাড়া আমি চেয়েছিলাম নূন্যতম কোনো একটা শিল্প জানুক। সেটাও তো দারুণ ম্যাচ করেছে......
পাত্র : মানে ?
পাত্রের মা : (একগাল হাসি) ভরতনাট্যমে থার্ড ইয়ার কমপ্লিট করেছে রে।
পাত্র : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) নাচ জানে বলে তুমি একেবারে কথা দিয়ে চলে এলে !! আমার কথাটা চিন্তাই করলে না ? আমি কি ভরতনাট্যম শিখব নাকি !!!!
পাত্রের মা : (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) চাইলে শিখতেও পারিস.....ও শিখিয়ে দিতে পারবে বলে মনে হয়।
পাত্র : (ভীষণ রেগে) এসব কি হচ্ছে ! (বাবার দিকে ঘুরে) তুমি কি করছিলে ? তুমিও কিছু না বলে ঘাড় নেড়ে চলে এলে....??
পাত্রের বাবা : (আমতা আমতা করে) দ্যাখ, আমার তো ওনাদের ব্যবহার খুবই ভাল লেগেছে। এমন বনেদী বাড়ি, পাত্রীর বাবা রিটায়ার্ড হেডমাস্টার.....তাছাড়া নলেন গুড়ের এমন একটা মিষ্টি খাওয়ালেন.....আহহ.... কি স্বাদ ! এখনও মুখে লেগে আছে। (তৃপ্তির হাসি দিয়ে) আমি তো চারটে খেয়েছি।
পাত্র : তুমি কেমন বাবা !.....তুমি কি মিষ্টির দোকানে গেছিলে যে মিষ্টি খাওয়ালো আর অমনি ছেলের বিয়ের কথা দিয়ে দিলে......??
পাত্রের বাবা : আহ ! অত চিন্তার কি আছে। তুই গেলে তোকেও খাওয়াবে....
পাত্র : (বিমর্ষ হয়ে) বাহ বাহ ! কি অদ্ভুত পাত্রী দেখে এলেন দুজনে। ভরতনাট্যম আর নলেন গুড়ের জাঁতাকলে আমার ভবিষ্যতটা বন্ধক রেখে এলে একেবারে।
পাত্রের মা : বেশি নাটক করিস না তো। তুই গেলে কি বলতিস ? (ডান হাত তুলে) "ওকে, থ্যাঙ্কু সবাই। এ বিয়েতে আমি রাজি....কোনো চাপ নেবেন না আপনারা".... এই তো তোর ভাষা হবে.......
পাত্র : (কাঁদো কাঁদো হয়ে) কিন্তু তাই বলে....
পাত্রের বাবা : শোন, অত দুঃখ করার কিছু হয়নি। বলে এসেছি আগামী রোববার তুই যাবি। তখন যা কথা বলার বলে নিস। সঙ্গে মামা আর মেসো যাবে, আমি বলে দেবখন।
পাত্র : (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) যাক ! তবু ভালো....
পাত্রের মা : আর হ্যাঁ....... "চাপ নেবেন না", "ব্যাপক খাচ্ছে" এই ধরণের শব্দ ইউজ করবে না একেবারে....
পাত্র : তুমি কি ভাবো বলো তো আমাকে......ওসব চাপ নিও না.....(পরক্ষনেই দাঁত কেটে) ইয়ে মানে চিন্তা করো না......ওসব কিছু বলব না।
পাত্রের মা : মনে থাকে যেন...

পরের রোববার। দুপুরের দিকে। চুঁচুড়ার শীলবাড়ি। কড়ি বর্গা দেওয়া দোতলার ঘর। আশেপাশে আত্মীয়স্বজনের ভিড় চোখে পড়ার মতো। পাত্রের মামা মেসো বেশ কিছুক্ষন ধরে কথা বলেছেন পাত্রীর বাবা মা এর  সাথে। থেকে থেকে বিচিত্র সব বিষয় উঠে আসছে আলোচনার মধ্যে। অধিকাংশই শারীরিক রোগ সম্পর্কিত। যেমন পাত্রের মামার অর্শর ব্যাথা,পাত্রীর বাবার হাঁটুর সমস্যা ইত্যাদি। পাত্র পাত্রী দুচারবার চোখাচোখি করলেও এখনো অবধি শব্দ খরচ করেনি কেউ। 

পাত্রের মামা : (বেশ কিছুক্ষন পর) তোরা বরং একটু কথা বল। (পাত্রীর বাবার দিকে তাকিয়ে)  ততক্ষনে চলুন আমরা একটু বাড়িটা দেখি। কি সুন্দর চারপাশটা......
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চলুন, তিনশো বছরের পুরোনো বাড়ি.......কত ইতিহাস.....কত ঘটনা....

কণ্ঠস্বরগুলো ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যায়....... 

পাত্রী : আপনি কি করেন ?
পাত্র : (সামান্য নার্ভাস) আমি মানে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি।
পাত্রী : কি দেখেন ?
পাত্র : মার্কেটিং............(তারপর থেমে থেমে) আপনি....কি....করেন  ?
পাত্রী : এস.এস.সি দিয়েছি। রেজাল্টের অপেক্ষা করছি।
পাত্র : পাবেন ?
পাত্রী : (চোখ কুঁচ্কে) মানে ?
পাত্র : না মানে আপনি ভালো স্টুডেন্ট পেয়ে যাবেন নিশ্চই। তাই না ? হেঁহেঁ.....
পাত্রী : (সামান্য গম্ভীর) আশা করি.........কেন, চাকরীতে আপনার আপত্তি আছে নাকি ?
পাত্র : নানা ছিছি। আমি ঠিক তা বলিনি.........(সামান্য একটু থেমে) আচ্ছা...... ইয়ে মানে আপনি নাচেন শুনলাম.......
পাত্রী : (রেগে গিয়ে)...আজ্ঞে না, আমি নাচি না.....আমি নাচ শিখতাম। অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি....
পাত্র : ওহ.....আচ্ছা আচ্ছা.....
পাত্রী : কেন বলুন তো ? আপনি শিখবেন ?
পাত্র : (অম্লান বদনে) হাহা......না না মানে আমি কি করে.......
পাত্রী : শুনলাম আপনিও নাকি খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন ?
পাত্র : হ্যাঁ ওই আর কি.....
পাত্রী : তাহলে খাচ্ছেন না কেন ? সব তো সাজানো আছে সামনে.....
পাত্র : তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই তেমন,.... খাবোখন.....আপনি চাপ.... (পরক্ষনেই জিভ কেটে) মানে চিন্তা করবেন না।
পাত্রী : তেমন চাইলে নিয়েও যেতে পারেন.... বলব প্যাক করে দিতে ?
পাত্র : না না ব্যস্ত হবেন না, আমি তো লাঞ্চ করে এসেছি.......
(সামান্য বিরতি)
পাত্রী : আচ্ছা, অবসর সময়ে কি করেন ? মানে আপনার হবি আছে কোনো ?
পাত্র : (ফিসফিস করে) ল্যাদ খাই....
পাত্রী : হ্যাঁ ? কি বললেন ?
পাত্র : (সামলে নিয়ে) না মানে সিনেমা দেখি, বই পড়ি, টুকটাক ছবি তোলার শখ আছে, এই আর কি....

পাত্রীর মায়ের প্রবেশ

পাত্রীর মা : (পাত্রীর দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা ওকে নিয়ে একটু ছাতে যা না বরং। আমাদের বাড়িটা দেখতে পাবে পুরোটা। (পাত্রের দিকে তাকিয়ে) তুমি যাও বাবা, ওপর থেকে ঘুরে এস, ভালো লাগবে।
পাত্রী : ফাঁকা ছাত !......ওতে আবার দেখার কি আছে ?
পাত্রীর মা : (বিরক্ত হয়ে) অাহ্ , তোর সবতাতে তর্ক।
পাত্র : (হাঁপ ছেড়ে) হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো.......
পাত্রী : (ব্যাজার মুখে) চলুন তবে.........মিষ্টিটা কি খেতে খেতে যাবেন ?
পাত্র : (ব্যস্ত হয়ে) না না থাক, ও পরে খেয়ে নেবখন.....

কলকাতা। পাত্রের বাড়ি। সন্ধ্যের দিকে, সাতটা নাগাদ। 

পাত্রের মা : (উত্তেজিত হয়ে) কি রে কেমন দেখলি ? পছন্দ তো ?
পাত্র : নাহ.....
পাত্রের মা : না মানে !!! পছন্দ হয়নি !!
পাত্র : নাহ.....
পাত্রের মা : ওমা ! সে কি কথা ! কিন্তু কেন ?
পাত্র : আঃ ! আমি অত ডিটেলস বলতে পারব না।
পাত্রের মা : আরে কি হয়েছে সেটা বলবি তো ? অপছন্দের কারণটা কি ?
পাত্র : বড্ড বাজে বকে......
পাত্রের মা : বাজে বকে !! কই আমাদের সাথে তো তেমন কিছু.......(পাত্রের বাবার দিকে তাকিয়ে) কি গো তুমি কিছু খেয়াল করেছিলে সেদিন ?
পাত্রের বাবা : কই না তো ! বরং ভালোই তো কথা বলল। একটা কনফিডেন্স দেখেছিলাম যেন.....
পাত্র : কনফিডেন্স ! হুঁহ, ওদিকে আমার সেলফ ডিফেন্সটাই ভেঙে দিল। বলছে নাকি মিষ্টি প্যাক করে দেবে।
পাত্রের বাবা : সে তো ভালো কথা। চুঁচুড়ার মিষ্টি বিখ্যাত। নাহয় দুটো নিয়েই..........
পাত্র : তুমি তো অদ্ভুত বাবা দেখছি !
পাত্রীর মা : (হতাশ হয়ে) বোঝো কাণ্ড ! আমি এখন কি বলব ওনাদের ?
পাত্র : আমি একটু ভেবে দেখি......

চুঁচুড়ার শীলবাড়ি। নিচের ঘর। 

পাত্রীর মা : তাহলে আমরা হ্যাঁ বলি ? কি গো ?
পাত্রীর বাবা : হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো। এই মাসের শেষের দিকে গিয়ে ডেটটা ফাইনাল করে ফেলা দরকার। তারপর তো মেলা কাজ আছে।
পাত্রী : দাঁড়াও দাঁড়াও, অত তাড়াহুড়ো কোরো না।
পাত্রীর মা : সেকি কথা ? তাড়াহুড়ো করব না মানে ?
পাত্রী : মানে আমার একটু সময় চাই।
পাত্রীর মা : কেন , তোর কি পছন্দ হয়নি ?
পাত্রী : কি করে হবে ? চারটে প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়। কোনোদিন শুনেছ ল্যাদ খাওয়া কারোর হবি হতে পারে ? তাছাড়া কেমন যেন। একরকম ভাবছে, আরেকরকম বলছে। আমার তো মনে হয়  ছেলেটার মাথায় ছিট্ আছে।
পাত্রীর মা : (আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে) না না, ছিট্ আবার কি। ও হয়ত ঘাবড়ে গিয়ে একটু........অমনটা তো হতেই পারে।
পাত্রী : তুমি থামো তো। কচি ছেলে নাকি যে ঘাবড়ে যাবে ?
পাত্রীর মা : সর্বনাশ ! তাহলে এবার কি হবে গো ! ওনারা তো ফোন করলেন বলে.....কি বলব ওঁদের ?
পাত্রী : আমায় একটু ভাবতে দাও.....

এর প্রায় বেশ কয়েকদিন পর। রোববার সকালবেলা। ঘরে টিভি চলছে। পাত্র আধশোয়া হয়ে ল্যাদ খাচ্ছে। হঠাৎ ফোন। 

পাত্র : হ্যালো......
পাত্রী : সকাল সকাল বিরক্ত করলাম না তো।
পাত্র : ওহ আপনি ! (অমায়িকভাবে) না না কি যে বলেন.....
পাত্রী : আসলে একটা কথা বলার ছিল। আপনার কি সময় হবে একটু ?
পাত্র : হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি তো দিব্যি ফ্রী.......না মানে....(চটপট সামলে নিয়ে) ওই একটু বাইরে যাওয়ার ছিল আরকি......
পাত্রী : ওহ....আচ্ছা তাহলে পরে করব ?
পাত্র :না না, বলুন বলুন.....এখন সময় আছে....
পাত্রী : শুনলাম আপনার নাকি এ বিয়েতে মত নেই ?
পাত্র : কই না তো ! (আবার সামলে নিয়ে) না মানে হ্যাঁ......আসলে সেদিন.....
পাত্রী : হ্যাঁ সেদিন আমি বোধহয় একটু বেশিই বলে ফেলেছিলাম। অমন করে হয়ত বলা উচিত হয়নি। তবে আপনারও কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যারাম আছে জানেন তো ?
পাত্র : (হতচকিত হয়ে) আমার !! ক্কি কি বলুন তো ?
পাত্রী : কোনো কথারই যেন ঠিকমতো উত্তর দেন না। কিছুটা পেটে রাখেন কিছুটা মুখে, কেন বলুন তো ?
পাত্র : ইয়ে মানে ওটা আমার বদভ্যাস বলতে পারেন....
পাত্রী : দেখুন কথা চেপে রাখাটা কিন্তু মোটেই পছন্দ করি না আমি, বুঝেছেন তো.....ওটা হলে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী হয় না বলে আমি মনে করি।
পাত্র : তা ঠিক....তা ঠিক......
পাত্রী : যাগ্গে, আমারটা নয় আমি শুধরে নেব, আপনি তাহলে কি ঠিক করলেন ?
পাত্র : কি করা যায় বলুন তো !
পাত্রী : এটা আমায় জিগ্গ্যেস করছেন ?
পাত্র : না মানে আমিও শুনেছি আপনিও নাকি এই বিয়েতে তেমন কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।
পাত্রী : আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, আমি কেন ফোন করেছি আজ আপনাকে ?
পাত্র : (সরল কণ্ঠে) বোধহয় এই নাম্বারটা আমারই কিনা সেটাই ভেরিফাই করার......
পাত্রী : না না আমি ঠিকই বুঝেছি আপনার মাথায় একটু ছিট্ আছে। আমি রাখছি......
পাত্র : না না শুনুন......ইয়ে শোনো.....তোমার মতটা তো জানাই হলো না.......হ্যালো........

ওপাশ থেকে ফোন কেটে যাওয়ার শব্দ। পিছনে সানাইয়ের সুর বেজে ওঠে....

(এছাড়া আরও অনেক কিছুই ঘটেছিল। সবটা লিখলে ধরানো মুশকিল। তাই যতটা সম্ভব ছোট করে বলা হল)
ছবি : রাজ দত্ত

Wednesday, February 14, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৪ # হ্যাপি শিবলেন্টাইন

ভোর সাড়ে চারটে।  কৈলাসের বেডরুম। শিব জোর ঘুমোচ্ছেন। পার্বতী আলতো করে টোকা মেরে অনেক্ষন ধরে  জাগাবার চেষ্টা করছেন কিন্তু শিব চোখ খুলছেন না। অগত্যা পার্বতী রেগে গেলেন। 

পার্বতী : বলি সারাদিন ধরে মোষের মতো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলে চলবে ? চোখ জোড়া খোলো এবার। বেলা তো বয়ে যায়......
শিব : (ঘুম চোখে ধড়মড় করে উঠে বসে) আচ্ছা জ্বালাতন মাইরি ! সকাল সকাল অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন ? বাড়িতে তো কাক চিল বসতে ভয় পাবে !
পার্বতী : তার জো আছে নাকি ! কৈলাসের এই উঁচুতলায় বাড়ি বানিয়েছো। শীতকালে হাড়েহাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে যাবার জোগাড় হয়। যম পর্যন্ত আসতে ভয় পায় এখানে। কাক চিল কি পবনের রথে চড়ে আসবে ? 
শিব : কি ব্যাপার বলো তো ? আজ একেবারে তিরিক্ষি মেজাজ দেখছি তোমার ! ভোরবেলাতেই  দিদি নাম্বার ওয়ান দেখেছো নাকি ? 
পার্বতী : এই শোনো, বাংলা সিরিয়াল দেখা নিয়ে খোঁটা দেবে না কিন্তু, এ আমি আগে থেকেই বলে রাখছি, নইলে আমি প্রলয় বাধাব বলে দিলুম। 
শিব : (থতমত খেয়ে) আচ্ছা আচ্ছা বেশ, ক্কি কি হয়েছে সেটা বলবে তো......

পার্বতী : (লজ্জা লজ্জা ভাব করে) আজ কি দিন মনে আছে তোমার ?
শিব : (সামান্য হেসে) বিলক্ষণ ! বিলক্ষণ ! মনে থাকবে না আবার ? আজ তো শিবরাত্রি। 
পার্বতী : (পাত্তা না দিয়ে) হ্যাঁ, সে তো আছেই, এছাড়া আরও একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে। 
শিব : (মনে মনে) খেয়েছে রে ! কোনটা ভুলে গেলাম ! আমাদের এনিভার্সারি ! যাচ্চলে আমি তো মনেই করতে পারছি না। সারাদিন এতো গাঁজা ভাঙে ব্যস্ত থাকি, কবে যে কি দিন মনে রাখাই চাপ হয়ে যাচ্ছে এখন। 
পার্বতী : কি বিড়বিড় করছ বোলো তো তখন থেকে, হ্যাঁ ?
শিব : (জটা চুলকে) ইয়ে মানে.... মাইরি বলছি। একটু ধরিয়ে দাও প্লিজ। 
পার্বতী : (রেগে গিয়ে) মোটেই না, এই সাতসকালে মোটেই তোমার গাঁজার কল্কে ধরিয়ে দিতে পারব না, আমার মেলা কাজ আছে। 
শিব : আহাহাহা, আমি সে ধরানোর কথা বলিনি গো, মানে ভুলটা একটু ধরিয়ে দিতে বলছিলুম আরকি। পার্বতী : ওহ ! (আবার লজ্জা লজ্জা ভাব করে) আজ তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে.....ভুলে গেলে ?
শিব : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) হা কপাল ! সেটা আবার কি ?
পার্বতী : (আদিখ্যেতার স্বরে) যাও, তুমি না বড্ড ইয়ে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কি সেটা জানো না নাকি ?
শিব : (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) মা কালির দিব্যি বলছি !..... আঃ সরি, আমি আবার অন্য লোকের দিব্যি খাচ্ছি কেন ? মানে সত্যি বলছি আমি এসব কিচ্ছু জানি না। 
পার্বতী : (মুখ নিচু করে সলাজ কণ্ঠে) যাও....... আমার লজ্জা করছে। 
শিব : আঃ, কি আপদ ! ধানাইপানাই না করে একটু খোলসা করে বলোই না মাইরি ! 

পার্বতী শাড়ির খুঁট জড়াতে লাগলেন। তারপর শিবের গলা থেকে সাপটাকে একটানে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেই দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলেন। অপ্রত্যাশিত প্রেমের জোয়ারে শিব একটু খেই হারিয়ে ফেললেন। 

পার্বতী : ভ্যালেন্টাইন্স ডে মানে হল প্রেমদিবস, বুঝলে ? 
শিব : (ভারী অবাক হয়ে) প্রেমদিবস !! প্রেমের আবার দিবস রজনী হয় নাকি গো ? 
পার্বতী : (দুহাত ছাড়িয়ে নিয়ে) হয় গো হয়। ইদানীং হচ্ছে, আর সবাই কচ্ছে। এই আমরাও না  আজ করব কিন্তু। 
শিব : (পার্বতীকে কাছে টেনে দুষ্টুমির গলায়) আজ আমরাও করব ?? যাহ ! সাতসকালে একঘর  ছেলেপুলেদের সামনে এসব আবার কেউ করে নাকি ! কি যে বলো না তুমি ! ধ্যাৎ !
পার্বতী : আঃ ! তুমি তো ভারী অসভ্য। আমি কি সেসব কথা বলেছি নাকি ! 
শিব : তাহলে ?
পার্বতী : মানে, আজ আমরা একটু সেলিব্রেট করব। এই যেমন ধরো একটু সেন্ট্রাল পার্ক গেলাম, তারপর একটা মলে গিয়ে একটু শপিং টপিং.......

পার্বতীর কথা শেষ হবার আগেই  শিব সঙ্গে সঙ্গে দুহাত ছিটকে এলেন। 

শিব :(নাকে হাত দিয়ে) ছিছিছিছি, পার্বতী ! ছি, আজকের একটা পবিত্র দিনে তুমি এসব কি মলমূত্র টেনে আনছ বলো দেখি ?
পার্বতী : আ মোলো যা ! এ মল সে মল নয় দেব.........এ হল গিয়ে শপিং মল, সেখান গিয়ে একটু শপিং করব, হাত জড়াজড়ি করে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুরব, রেস্টুরেন্ট যাব, তারপর একেবারে পদ্মাবৎ দেখে তবে বাড়ি ফিরব। 
শিব :(চোখ কপালে তুলে) পদ্মাবৎ !! বোঝো ! এ আবার কি নতুন সংস্কৃত ? বলি কথায় কথায় দুম করে অমন খণ্ড-ত লাগিয়ে দিলে ভারী অসুবিধে হয় জানো। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলবে একটু ? 
পার্বতী : সে কি কথা !! কত বড় কাণ্ড হয়ে গেল ! কোনো খবরই তো রাখো না দেখছি। অবশ্য সারাদিনে ছিলিম ছাড়ার ফুরসত পেলে তো !
শিব :(সামান্য রেগে গিয়ে) এই শোনো, ত্রিশূলের দিব্যি বলছি, ছিলিম নিয়ে খোঁটা দেবে তো একেবারে দক্ষযজ্ঞ রিটার্নস বানিয়ে ছাড়ব। 
পার্বতী : থাক ! হয়েছে অনেক। ও মুরোদ আর নেই তোমার। বাহুবলী তোমায় ঘাড়ে করে ঝর্ণার জলে চুবিয়ে ছেড়েছে। সেই দেখে নমো আর মমোর কি হাসাহাসি। আমি তো হপ্তাখানেক মুখ দেখাতে  পারিনি কোথাও। পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। 
শিব : (বিষম খেয়ে) আঃ, কি মুশকিল ! থাক না সেসব কথা। আমিও তো কম হেঁচে কেশে অস্থির হইনি সেসময়। ভক্ত বলে কথা, অমন ফস করে কিছু বলা যায় নাকি ? 
পার্বতী : বেশ তো ! তাহলে শিবায় ছবিতে অজয় যে তোমার নামটা ধার নিল আর সারাক্ষন 'বোলো হর হর' বলে চেঁচিয়ে গেল, কই টাইটেল স্ক্রোলে তোমায় কার্টসি পর্যন্ত দিল না মোটে, তার বেলা ?
শিব : কি বলি বলো দেখি, সিংঘমের পর থেকে বাজারটা তেমন ভালো যাচ্ছে না ওর। শুধু গুটখা খাচ্ছে আর বোলো জুবান কেশরী বলছে। আমি তো আর রয়্যালটি চাইতে পারিনা এই সময়.....!

পার্বতী আবার শিবের গা ঘেঁষে এলেন। শিবের গলার রুদ্রাক্ষের মালা নিজের আঙুলে পেঁচাতে থাকলেন। 

পার্বতী :(গদগদ কণ্ঠে ) হ্যাঁ সেই। ভক্তের ভক্তিতেই তুমি অস্থির। যাগ্গে, যাক। মোট কথা হল সারাদিন দুজনে মিলে একটু কাছাকাছি, একটু এনজয়, মানে একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড.......বোঝোই তো..... 
শিব : আচ্ছা বেশ, সেসব নাহয় বুঝলাম, কিন্তু শিবরাত্রির ব্যাপারটা....... ?
পার্বতী : সে নাহয় রাতের দিকে তোমার মাথায় একটু জল ছিটিয়ে দিলেই হল। তাছাড়া গঙ্গাকে তো জটায় করে নিয়ে ঘুরছো। তেমন হলে মাথাটা একটু গোল করে ঝাঁকিয়ে নিও বুঝলে। যুগ যুগ ধরে একইরকম করে আসছি তো। তা এবারটা নয় একটু অন্যরকম হল, অসুবিধে কি ?
শিব : কিন্তু তাই বলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করবে বলে শিবরাত্রি ডিলেইড হবে ? নানানানা, এটা ঠিক হচ্ছে না। তোমার হাতের জলটাই তো সবার আগে পেয়ে থাকি বরাবর। তারপর গিয়ে মর্ত্যের জল নিই। ওদিকে সবাই অপেক্ষা করে থাকবে যে !
পার্বতী : (অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে) ওহ ! তাই নাকি ? আমার আব্দারটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়, তাই তো ? মর্ত্যের জল না পেলে বুড়োর বুঝি নেশা কাটবে না ! বয়সকালে স্বপ্নদোষ ? আচ্ছা দাঁড়াও, আমিও এর শেষ দেখে তবে ছাড়ব। 

মহাদেব এ কথায় জিভ কেটে কানে আঙ্গুল দিলেন। 
নারদমুনির প্রবেশ। 

নারদ : (সুর করে) নারায়ণ নারায়ণ ! পেন্নাম হই দেবাদিদেব..... প্রণাম নেবেন মা। (শিবের দিকে তাকিয়ে) একি প্রভু !! আপনি কানে আঙ্গুল দিয়ে আছেন কেন ? কি হয়েছে ?
শিব : (কান থেকে আঙ্গুল সরিয়ে) ভাষার বাণ খেয়েছি রে বাপ্। ডিটেলস বলতে পারব না। 
  
পার্বতী : এই যে নাড়ু ! এসে গেছ দেখছি ! ব্যাস আর তো কোনো কথা গোপন রাখার জো নেই । স্বগ্গ জুড়ে ঢি ঢি পরে যাবে এবার........আমাদের সেলিব্রেশনটা তাহলে মাঠে মারা গেল একেবারে ! 
নারদ : ছি মা। এসব কি বলছেন ! আমি এখন অনেক চেঞ্জড হয়ে গেছি। এখন শুধু দিনে একবার করে  'আধঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন' এর চ্যানেলে ঢুঁ মারি। বাংলাবাজারটা ওই তো গরম করে। আমায় আর কোনো এক্সট্রা এফর্ট দিতে হয় না। 
পার্বতী : ব্যাস ! তবে আর কি ! স্বগ্গ তো গেলোই, এবার সারা বাংলা জুড়ে মোমবাতি মিছিল শুরু হবে। বলি আমাদেরও কি একটু আধটু সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই গা ?
নারদ : কে বলেছে মা থাকতে নেই ? আমায় শুধু বলুন কি চাই, আমি আগাপাশতলা সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। 

পার্বতী : (করুণ স্বরে) দুঃখের কথা আর কি বলি নাড়ু। শখ হয়েছিল আজ তোমাদের বাবার সাথে একটু ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করব। তা উনি কানেই নিচ্চেন না কথাটা। এবার বলো, এই জগৎসংসারের বাইরে আমারও তো একটু ইচ্ছে করে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর। ওনার হাতটি ধরে একটু এদিক ওদিক যাওয়া, ভালোমন্দ খাওয়া......... একি আর খুব বেশি চাওয়া হল আমার ? 
নারদ :(হাত নাড়িয়ে) বিন্দুমাত্র না, বিন্দুমাত্র না। এতো অতি উত্তম কথা, তা আটকাচ্ছে কে ? সুপ্রিয়া ?

পার্বতী মনে মনে বললেন, 'খুব খারাপ জোক নাড়ু , এ মিরাক্কেলেও নেবে না '। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মহাদেবের দিকে আঙ্গুল তুললেন শুধু । 

পার্বতী : ওই যে, ওই তোমার প্রভু। বলছে নাকি মর্ত্যের ধিঙ্গিরা ওনার শিবরাত্রির জন্যে ওৎ পেতে আছে। বাগছালটা পড়ে দৌড়ে না গেলে নাকি ওনার পুজোই শুরু হবে না। বুঝলুম, যাদের বিয়ে হয়নি তাদের নাহয় একটা কারণ আছে। কিন্তু যাদের হয়ে গেছে, তোরা কেন খামোখা ওঁকে নিয়ে টানাটানি কচ্ছিস বাপু। এই রিটায়ারমেন্টের সময় আমাদের দিকটাও তো একটু ভেবে দেখতে হবে নাকি !

শিব :আঃ যত্ত বাজে কথা। আচ্ছা তুই বল নাড়ু, এই বয়েসে আমাদের কি এসব মানায়, হ্যাঁ ? তাছাড়া আজকে শিবরাত্রি, কোথায় সকালবেলা তোর মায়ের হাতের এক বালতি গরম জলে একটু আয়েস করে সাবান দিয়ে রগড়ে গা ধোব, তা নয় উনি এক্কেরে সারাদিন কচি খুকির মতো ঘুরে বেড়াবার মতলব এঁটেছেন। যত্তসব !
পার্বতী : ওহ ! আমি কচি খুকি ? আর তোমার বয়েস বুঝি ডিসেন্ডিং অর্ডারে বাড়ছে। প্রস্টেটের সমস্যায় যে তুমি শুয়ে ছিলে একমাস, তখন কে তোমায় দুবেলা বাথরুম নিয়ে যেত শুনি ? হ্যাঁ ?অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ব্যাথায় রোজ রাতে কে মলম ঘষে দেয় তোমার হাঁটুতে ? বলব নাড়ুকে সেসব কথা ? ভাঙব হাটে হাঁড়ি ?
শিব : আহাহাহা ! এসব কি কথা হচ্ছে বলো দেখি ? ঘরের লুঙ্গি কি এমনি করে বাইরে শুকোতে আছে ? হাওয়া দিচ্চে তো !
নারদ : হ্যাঁ সেই তো, এসব ব্যক্তিগত কেচ্ছাগুলো এখন নাহয় থাক মা, বুঝলেন। অন্য সময় বরং........ 
পার্বতী :(নারদকে এক দাবড়ানি দিয়ে) তুই থাম নাড়ু ! আমার ইহকাল পরকাল সব আনন্দবাজারে বেরিয়ে গেছে গা। প্রাইভেট লাইফ বলে আর কিচ্ছুটি নেই। দুগ্গাপুজো এলেই সবাই মিলে একেবারে পুরাণ থেকে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে। ভারী বিরক্ত লাগে মাইরি। আমারও তো একটা প্রাইভেসি আছে, নাকি ?  

এই বলে পার্বতী একটা শিলাখণ্ডের ওপর বসে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। নারদ ও শিব যুগপৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। শিব আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন। পার্বতীর কান্নায় সেসব হলাহলের মতো নির্বাক হজম করে ফেলতে হল। উপায়ন্তর না দেখে পার্বতীর কাছে ছুটে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। 

শিব :(মোলায়েম স্বরে) ছি, পারো ! ওসব ছোটখাট কথায় কি কাঁদতে আছে। তুমি আজকাল সমস্ত ব্যাপারে বড্ড ইমোশনাল হয়ে পড়ো দেখছি। তোমার না হাই বিপি ? এসময় এতটা স্ট্রেস নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে শরীরের পক্ষে ?
পার্বতী : (ফোঁপাতে ফোঁপাতে) 'পারো' বলে আমায় ডেকো না গো। অন্দরমহলের পরমেশ্বরীর কথা বড্ড মনে পড়ে যায়। আহা বেচারী মেয়েটা কি কষ্টটাই না করছে। দোজবরে স্বামীটা গাছেরও খাচ্ছে তলারও কুড়োচ্ছে। এ অনাচার চোখে দেখা যায় না গো ! চোখে দেখা যায় না। 

নারদ: (শিবের দিকে তাকিয়ে) প্রভু, আমার না মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে জানেন। মা এসব কি বলছেন ? একবার প্রস্টেট একবার আর্থ্রাইটিস, আনন্দবাজার, অন্দরমহল, পারো........আমার কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রক্ষা করুন প্রভু, রক্ষা করুন। 

শিব ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। মনে মনে নানারকম বলতে থাকেন ......

শিব :(মনে মনে) হুঁহ ! দুবেলা আমায় কে রক্ষা করে তার নেই ঠিক, আমি যাব ওকে রক্ষা করতে। সাত সকালবেলা দেকচিস বাড়িতে মহাভারত শুরু হয়েছে, কোথায় মানে মানে সরে পড়বি তা নয়, নারায়ণ নারায়ণ করতে করতে কোমর দুলিয়ে উপস্থিত হয়েচে। যত্তসব বলিহারি ! (ভেংচি কেটে) আবার রক্ষা করুন প্রভু.........আপদ কোথাকার !

নারদ :আ, আমায় কি কিছু বলছেন মহাদেব ?
শিব :(শশব্যস্ত হয়ে) তোমায় আর কি বলব বাছা, সকালবেলা এয়েচ। এক কাজ করো দিকি। ঐদিকে দেখো মিক্সি রাখা রয়েছে, তিন গ্লাস ফ্রুট জ্যুস বানিয়ে আনো তো চট করে। 

নারদ ব্যাজার মুখ করে মিক্সির দিকে এগিয়ে যান। 

শিব : (ফিসফিস করে) ইয়ে বলছি কি, তুমি তো 'পারো' মানে শরৎ বাবুর দেবদাসের ইন্সট্যান্সও টানতে পারতে তাই না ? খামোখা বাইরের লোকের সামনে তোমার বাংলা সিরিয়াল কাল্চারটা না দেখালেই কি নয়।
পার্বতী :(অবাক হয়ে) কাল্চার ! আমাদের গোটা বাংলা তো এগ্রিকালচার আর চপ ফুলুরির ওপর ডিপেন্ড করছে গো। এই স্বর্ণ যুগে টিভি না দেখাটা নেগলেক্ট করি কি করে বলো তো ?
শিব : আচ্ছা বেশ ! মন খারাপ কোরো না লক্ষীটি। তুমি বলে দাও তোমায় কি নামে ডাকব ?   
পার্বতী : (চোখ মুছে গদগদ ভাব করে) থাক, তোমায় আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। তুমি যা বলবে তাই.... 
শিব : (আরেকটু কাছে এসে) না, তুমি বলে দাও.... 
পার্বতী : না তুমি বলো....
শিব : না তুমিই বলো.....
পার্বতী : না তুমি.....

(নারদ তার তাম্বুরায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজাতে থাকেন - 'এই পথ যদি না শেষ হয়.........'
শিব জড়িয়ে ধরেন পার্বতীকে। দুজনের নিভৃত চাপা ফিসফিসানি আর হাসির শব্দ শোনা যায়। 
নারদ জিভ কেটে অন্য দিকে চোখ ঘোরান। তারপর জোরে গলা খাকরানি দেন। শিব পার্বতী দুজনেই ব্যস্ত হয়ে একটু সরে বসেন)।

নারদ : এই নিন শরবত। 

শিব আর পার্বতী  দুজনেই হাত বাড়িয়ে গ্লাস নেন।

পার্বতী : (জিভ কেটে) এই রে ! আমার তো খেতে নেই, আজ তো আমার উপোস। 
শিব : এই বয়েসে আর উপোস করে কাজ নেই। তাছাড়া ফ্রুট জ্যুসে আবার দোষ কিসের ? 
পার্বতী : তাহলে তুমিই খাইয়ে দাও বরং। 

শিব পরম স্নেহে পার্বতীকে ফ্রুট জ্যুস খাওয়াতে থাকেন। 

নারদ : আমি বলছিলুম কি, ব্যাপারটা যখন আর অতটা সিরিয়াস নয়, তাহলে বরং মহাদেব আজ  একবার মাকে গোলাপ দিয়েই দিনের শুরুটা করে ফেলুন। তারপর নাহয় আপনি চট করে মায়ের দেওয়া জলে চান করে একবার মর্ত্য থেকে ঘুরে আসুন। ততক্ষনে মা রেডি হয়ে যাবেন। তারপর দুজনে মিলে একটু ঘুরে আসুন, আপনাদের ভ্যালেন্টাইন্স ডেও সেলিব্রেট হবে আবার প্রাইভেট টাইমও, কি বলেন ?

শিব : (পার্বতীর দিকে তাকিয়ে) ছেলেটা অনেকদিন পর বেশ ভালো বলেছে........তাই না গো ?
পার্বতী :(লজ্জা পেয়ে মিষ্টি করে হেসে) আমি জানি না.......যাও.......

শিব আর নারদ দুজনেই অট্টহাস্য করে ওঠেন। 

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পুনশ্চ : এই গল্পের সাথে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যোগাযোগ খুঁজতে যাবেন না দয়া করে। কোনোরকম ভাবাবেগে আঘাত করা উদ্দেশ্য নয়, নির্মল আনন্দের জন্যই এ গল্প লেখা।


ছবি : সংগৃহিত 

#bengalishortstory #valentinesday #shibratristory #lovestory #shivparvati #Molat

Thursday, September 21, 2017

সাপ্তাহিকী - ৩২ # সেবুর প্যান্ডেল - অন্তিম পর্ব

পলকের আকস্মিকতা কাটাইয়া সবাই কোলাহল করিয়া উঠিল। ব্যাটা বলে কি ? পুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধবে ! সকলেই সমস্বরে বলিল, 'না না না, এ অসম্ভব' ! প্যাণ্ডেল বাঁধিতে গিয়া সেবু যে ভীষণ রকম একটা কাণ্ড ঘটাইয়া ফেলিবে এ বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত হইয়া বিধুচরণের নিকট তদ্বির করিল। বিধুচরণও মাথা নাড়িয়া বলিলেন, 'না না, সেবু তা হয় না। তুই কি প্যাণ্ডেল বেঁধেছিস আগে যে হঠাৎ করে একেবারে দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধতে লাগবি' ? সেবু ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'অাহ্ আমি কি বলেছি আমি একাই বেঁধে ফেলব ? ভূপেন মাঝি ও তার দলবল তো থাকবেই, আমি শুধু একটু হাত লাগাবো, এই যেমন ধরো একটা দড়ি বেঁধে দিলাম বা একটু বাঁশটা পুঁতে দিলাম এই আর কি। আমার ভারী ইচ্ছে, সেই ছোটোর থেকে..........বিশ্বাস করো'। শেখর ও গোরা হৈ হৈ করিয়া বলিল, 'না না, মিত্রমশাই, আপনি একদম শুনবেন না ওর কথা। আমাদের তো আগে কম বিপদ হয় নি। তাছাড়া দুর্গাপুজো নিয়ে কোনো রকম ছেলেমানুষি আমাদের না করাই ভালো'। বিধুচরণ মহা ফাঁপরে পড়িলেন। একদিকে সেবুর আবদার তিনি না মিটিয়া থাকিতে পারেন না আবার অন্যদিকে তাহাকে অনুমতি দিতেও ভরসা পাইতেছেন না। কতকটা ফাটা বাঁশের মধ্যে আটকা পড়িয়া তিনি ছটফট করিতে লাগিলেন।

সেবু তাহার জ্যাঠার পরিস্থিতি আঁচ করিয়া বলিয়া উঠিল, 'আচ্ছা জ্যেঠু, জেলেপাড়ার বসুমতীকে চেন' ? বিধুচরণ অবাক হইয়া বলিলেন, 'বসুমতী ? না, চিনি না। কেন, সে কে' ? এ কথায় শেখরের মুখ পাংশু হইয়া গেল। সে বিবাহিত অথচ বেশ কয়েকদিন হইল জেলেপাড়ার বসুমতীর সহিত তাহার একটি সম্পর্ক জমিয়া উঠিয়াছে। একথা মনোহরপুরের কাকপক্ষীও জানে না। তাহা সেবুর গোচরে কি করিয়া আইল এইটা ভাবিয়া শেখর যারপরনাই অস্থির হইয়া উঠিল। কারণ এই সম্পর্ক জানাজানি হইলে তাহার সংসারে কেন গোটা পাড়ায় কুরুক্ষেত্র হইতে বাকি থাকিবে না শেখর তাহা বিলক্ষণ জানে। সেদিকে তাকাইয়া সেবু বলিল, 'না, মানে সে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে তালপুকুরের ধারে চুপটি করে বসে থাকে। কেন ? তুমি জান' ?

বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া দুদিকে মাথা নাড়িলেন। সেবুর কথার গোপন মর্মার্থ তিনি উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। উল্টোদিকে শেখর প্রায় ঘামিয়া স্নান করিয়া গেল। বসুমতীর সাথে তাহার দেখা করিবার স্থান তালপুকুরই বটে। সন্ধ্যের দিকে সে সমস্ত রকম আঁটঘাঁট বাঁধিয়া খুবই সন্তর্পণে বসুমতীর নিকট আসে। তাহাদের প্রেমালাপ করিবার একটি গোপন আস্তানা আছে। আজ অবধি কেউ টের পায় নাই। হতভাগা সেবু কি করিয়া জানিতে পারিয়া আজ মোক্ষম সময়ে সেসব কথা তুলিতেছে। পাড়ার পাঁচজনের সামনে মাথা হেঁট হইয়া যায় বুঝি।

পরিস্থিতি নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া শেখর গলা খাকরাইয়া বলিয়া উঠিল, 'আঃ সেবু, কি সব অবান্তর কথা বলছিস ? হচ্ছিল একটা কাজের কথা, তা নয় যত্তসব অপ্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে। আমাদের আর দেরি করলে চলবে না কিন্তু, সময় বয়ে যাচ্ছে। ঝটপট ভূপেনকে একটা খবর দে দিকি'।

সেবু একগাল হাসিয়া বলিল, 'সে তো আমি এখনই দিতে পারি। কিন্তু আমার কথাটাও একবার.........'। বিধুচরণ ফোঁস করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন। শেখর একবার বিধুচরণের মুখের দিকে তাকাইয়া নিয়া বলিল, 'আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন, চারটে বাঁশ নাহয় তুইই বাঁধিস। ভূপেনকে খবরটা তো দে আগে'। বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, 'সে কি কথা শেখর, ওর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা তো সবই জানো। ও যদি কোনো  বিপদ ঘটায়, তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারবো না এ আমি আগেই সাফ জানিয়ে রাখলুম'। শেখর স্মিতহাস্যে কহিল, 'আহা সেবুর ইচ্ছে হয়েছে যখন, একটু প্যাণ্ডেলের কাজ করল নাহয়। ছোটবেলার শখ বলছে তো, করুক না একটু। আমাদেরও তো কতসময় কতরকম শখ জাগে, তাই না ? ও কিছু না। আপনি আর এ নিয়ে আপত্তি করবেন না মিত্রমশাই। সেবু তো আমাদেরই ঘরের ছেলে, কি সেবু এবার খুশি তো' ?

সেবু মহানন্দে তাহার দন্ত কপাটি বাহির করিল। বিধুচরণ বলিলেন, 'বেশ, তবে তাই হোক। তুমি পুজোর সেক্রেটারি হয়ে যখন বলছ তখন আর আমার আপত্তি করবার কিছু নেই'। এই কথাটি বলিয়াই তিনি হঠাৎ সেবুর দিকে ঘুরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তবে, তুই বসুমতী না কার যেন কি একটা কথা বলছিলি' ? সেবু চটপট হাত নাড়িয়া বলিল, 'না না সেসব কিছু না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমি বরং যাই, চানটা করে নিয়ে ভূপেন মাঝি কে খবরটা দিই গে যাই'। বলিয়াই সে ছুটিয়া ঘর হইতে অন্তর্ধান হইল। বিধুচরণ চক্ষু বুজিয়া কহিলেন, 'হরি হে ! কখন যে তোমার কি ইচ্ছে........ '।

দেখিতে দেখিতে দেড়মাস কাটিয়া গেল। প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষের পথে। ভূপেন মাঝি ও তার দলবল ঝড়ের গতিতে কাজ করিতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের মতো দুর্দান্ত আকার না হইলেও হরিসভার নৌকার আদলটা মোটামুটি হইয়াছে। যদিও গোটা নৌকা বানাইবার দরকার পড়ে নাই। সামনের দিকটায় চমৎকার একটা বজরার রূপ দিয়া পিছন দিকটায় ছোট করিয়া হাল বাঁধিয়া দিয়াছে। সামনে দাঁড়াইলে নৌকার ছাউনি ও মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাইবে। কিন্তু সেসব ছাপাইয়া যাহা চোখে পড়িবার মতো তাহা হইল সেবুর উৎসাহ ও কাজ করিবার উদ্দীপনা। বাঁশ বাঁধা, কাঁচা মালের আনা নেওয়া করা, মিস্ত্রিদের খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছুই সে নিজের হাতে দেখিতেছে। বোঝা যাইতেছে তাহার শখ পূরণের সমস্ত রসটুকু সে পরম তৃপ্তিতে আস্বাদন করিতেছে। সময়ে অসময়ে বিধুচরণ, শেখর, গোরা ও ক্লাবের বাকিরা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী সমস্ত কাজই তদারকি করিতেছেন।

পরের এক সপ্তাহে বাকি সমস্ত কাজই নিয়মমাফিক চলিয়া শেষ হইয়া গেল। প্যাণ্ডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেল। কিন্তু কেহ জানিতে পারিল না নৌকার পিছন দিকে এক ভীষণরকম কালসর্পের যোগ ঘটিয়াছে। সেটি কি তাহা পরে বলিতেছি। এদিকে ইতিমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটিল। যাহারা মনোহরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা তাহারা নিত্য আসা যাওয়ার পথে সকলেই সচক্ষে দেখিতে পাইতেছিলেন যে কোন প্যাণ্ডেলটি কিরূপ প্রস্তুত হইতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের অপেক্ষা হরিসভার নৌকা যে উত্তম কিছু হইতেছে না এ তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিলেন। হরিসভার নৌকা ধারে ও ভারে কোনোপ্রকারেই উড়োজাহাজকে টেক্কা দিতে পারিতেছিল না। তাহার কারণ উড়োজাহাজটি দুতলা সমান পেল্লাই হইয়াছিল এবং দেখিতে অবিকল আসল উড়োজাহাজের মতোই লাগিতেছিল। সেখানে হরিসভার নৌকাটি মোটের উপর চলনসই হইয়াছিল। সুতরাং ধীরে ধীরে এরকম একটি বার্তা রটিয়া গেল যে এবার হরিসভা তেমন কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের সমস্ত কর্মকর্তাদের নিকট অনুরূপ সংবাদ পৌঁছাইল। এহেন পীড়াদায়ী জনশ্রুতিতে সকলেই প্রায় ভাঙিয়া পড়িলেন। বিধুচরণও কঠিন মনকষ্টে ভুগিতে লাগিলেন। পুজো লইয়া তাহার সমস্ত উদ্দীপনা ধূম্রের ন্যায় মিলাইয়া যাইতে লাগিল।

তবুও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের যথাবিধি নিয়ম পালন করিতে হইবে। তাই ক্লাবের মধ্যে ঠিক হইল চতুর্থীর দিন প্রতিমা আনা হইবে ও পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় পাঁজির সময়ানুসারে বিধুচরণ ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উদ্বোধন করিবেন।

যথাসময়ে পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যাবেলা সকলে ক্লাবের মাঠে উপস্থিত হইলেন। মণ্ডপের সামনে একটি বিশাল ত্রিপল খাটাইয়া রাখা হইয়াছে। সামান্য কিছু উৎসুক জনতাও মাঠের ধারে জড়ো হইল। কারণ বেশিরভাগ মানুষই উড়োজাহাজের দিকে উড়িয়া গিয়াছেন। বিধুচরণ শ্বেতশুভ্র ধাক্কা পাড়ের ধুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরিহিত হইয়া ব্যথিত হৃদয়ে ক্লাবে পদার্পন করিলেন। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝা যাইতেছিল যেন তিনি এক কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন। মাঠ প্রায় জনশূন্য দেখিয়া তিনি আরও হতোদ্যম হইয়া পড়িলেন। অন্যান্য বৎসর গুলিতে যেখানে উদ্বোধনের দিন একেবারে লোক ভাঙিয়া পড়িত, আজ সেখানে ছন্নছাড়া কয়েকজন আসিয়াছে। ক্লাবের অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইয়া মণ্ডপে লইয়া আনিলেন। ঢাকিরা আগে হইতেই প্রস্তুত ছিল। তাহারা বিধুচরণকে দেখিয়া একসাথে ঢাক বাজাইতে শুরু করিল। কিন্তু সে ঢাকের আওয়াজও কেমন যেন করুণ প্রাণ মনে হইল। পাড়ার কয়েকজন মহিলা উলুধ্বনি দিয়া ও মঙ্গলশঙ্খ বাজাইয়া কোনোমতে বিলীন উৎসাহটুকু জাগাইয়া রাখিলেন।

ত্রিপল সরাইয়া, পঞ্চপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিয়া পুজোর উদ্বোধন হইবে। বিধুচরণ একটি গম্ভীর নিঃশ্বাস ছাড়িয়া রশি টানিয়া ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উন্মোচন করিলেন। তাহার পর পঞ্চপ্রদীপে আলো সঞ্চার করিয়া মণ্ডপের সিঁড়ির নিকটে আসিলেন। ইতস্তত দু একটি হাততালির শব্দ শোনা গেল। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বিধুচরণ মণ্ডপে উঠিতে গিয়া থমকাইয়া গেলেন। মণ্ডপের দিকে চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া গেল। তিনি শ্বাসরুদ্ধ করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া ক্লাবের বাকিরাও মণ্ডপের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাহাদের হৃদপিণ্ড প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেল।

দেখা গেল নৌকারূপী মণ্ডপটি ডানদিকে বেশ কিছুটা হেলিয়া কাত হইয়া গিয়াছে। কতকটা পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো। পড়িয়া যায় নাই এই রক্ষে, কিন্তু পড়িয়া যাইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। বিধুচরণ কোনো কথা কহিতে পারিলেন না প্রথমটায়। ধীরে ধীরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন অগ্নি নিক্ষেপ হইতে লাগিল। চরম ক্রোধে তিনি থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। পাশে দাঁড়ানো শেখরকে চাপাস্বরে ফিসফিস করিয়া  জিজ্ঞাসা করিলেন, 'এটা কি ? এ কি করে হল' ? শেখরের প্রায় অজ্ঞান হইবার উপক্রম হইল। সে সভয়ে কহিল, 'আজ্ঞে, সকাল অবধি তো সোজাই দাঁড়িয়েছিল এখন যে কি করে হেলে গেল জানি না'। বিধুচরণ অগ্নিনেত্রে বাকিদের থেকে ইশারায় জানিতে চাহিলেন যে ব্যাপারখানা কি। কিন্তু কেউই কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিল না। ভূপেন মাঝি কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সেও চক্ষু গোলগোল করিয়া তাকাইয়া ছিল তাহার সাধের নৌকার দিকে। বিধুচরণ তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিতে টানিতে মণ্ডপের অনতিদূরে লইয়া গিয়া কহিলেন, 'এসবের মানে কি ভূপেন ? এটা কি মস্করা হচ্ছে ? নৌকা এতো হেলে গেল কি করে' ? ভূপেন মাঝি মিনমিন করিয়া কহিল, 'আজ্ঞে মিত্রমশাই আ-আমি সত্যি কিছু জানি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলুম আমি। আজ সকালেও দেখেছি, তখন তো কিচ্ছুটি হয় নি'।

'ন্যাকা সাজছিস তুই ? সকালেও দেখেছি ? তাহলে কি বিকেলে উঠে সমুদ্রে জাল ফেলেছিস মাছ ধরবি বলে, যে নৌকা হেলে গেল' ? বিধুচরণ ক্রোধান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন। ভূপেন হাঁউমাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। বিধুচরণ আবার কহিলেন, 'সত্যি করে বল ভূপি, কি করে হল নইলে তোকে আমি এই মাঠে জ্যান্ত পুঁতব বলে রাখলুম'। ভূপেন ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল ,'আজ্ঞে, আমায় একটু সময় দিন কত্তা, আমি একবার পিছনদিকটা দেখে আসি'। বলিয়াই সে ছুটিয়া নৌকার পিছন দিকে চলিয়া গেল। কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া সে আবার ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, 'আজ্ঞে হালের দিকে দুটো বাঁশ আলগা বাঁধা হয়েছে কত্তা, দড়ি হড়কে গিয়ে বাঁশ কাত হয়ে গেছে, তাই নৌকাও হেলে  গেছে খানিক'।

'আলগা বাঁধা হয়েছে মানে ? কেন, বাঁধার সময় তুমি কি কেষ্টঠাকুরের লীলে দেখছিলে বজ্জাত' ? বিধুচরণ অগ্নিশর্মা হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন। ভূপেন কুঁই কুঁই করিয়া বলিল, 'আজ্ঞে ওই বাঁশদুটো আমি সেবুকে বাঁধতে দিয়েছিলুম। ঐটে বাঁধবে বলে সে খুবই জোড়াজুড়ি করে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই..........'। সেবু কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, 'হ্যাঁ, আমিই বেঁধেছিলুম বটে, কিন্তু আমি ভূপেনদার কথামতো ঘন্টাকেও দেখিয়ে নিয়েছিলুম। সে বলেছিল ঠিক আছে'। বিধুচরণ স্তব্ধ হইয়া গেলেন একথা শুনে। তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।

ঘটনাটা ঠিক কি হইয়াছিল তাহা বলি এখন পাঠকদের।  
সেবুর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখিয়া ভূপেন তাহাকে দুটি বাঁশ বাঁধিতে দিয়াছিল। কাজটি ছিল এই যে হালের দিকটায় একটি বাঁশের সহিত আরেকটি বাঁশ কায়দা করিয়া বাঁধিতে হইবে। তাহার সহিত একজন কারিগরকেও রাখিয়াছিল পুরোটা ভালো করিয়া দেখিয়া লইবার জন্য। তাহার নাম ঘন্টা। কিন্তু মুশকিল হইল, সন্ধ্যে হইলেই ঘন্টা গাঁজা ও কল্কের মায়ায় জড়াইয়া পড়ে। তখন আশেপাশে বোমা মারিলেও ঘন্টার ঘড়িতে কিছুমাত্র বিকার ঘটে না। সেবুর দুইটা বাঁশ বাঁধিতে সেদিন সন্ধ্যে হইয়া গিয়াছিল। কাজের শেষে সে ঘন্টাকে ডাকিয়া লইয়া ভালো করিয়া দেখাইয়াছিল। তুমুল নেশার চোটে ঘন্টা তখন চোখ খুলিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। ফলে সে বুঝিতে পারে নাই যে বাঁশ দুইটি একেবারে আলগা বাঁধা হইয়াছে। কতকটা হামাগুড়ি দিয়া সে দড়ির উপর হাত বুলাইয়াই জড়ানো কণ্ঠে বলিয়াছিল, 'ঠিক আছে, বেশ বাঁধা হয়েছে'। নানান কাজের মধ্যে ভূপেনেরও পুরোটা ভালো করিয়া দেখা হয় নাই। এখন সময়কালে এই ভয়ঙ্কর বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

সেবুর মুখে ঘন্টার কথা শুনিয়া সকলেই একপ্রকার বিপদের ঘন্টাধ্বনি শুনিতে পাইলেন। কে কি বলিবে কেহ ভাবিয়া পাইলেন না। আশেপাশে কোথাও ঘণ্টাকেও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।

ইতিমধ্যে যে জনতা দূরে জড়ো হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে এক অদ্ভুত গুঞ্জন শুরু হইল। সে গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়িয়া এক আশ্চর্য রূপ লইতে লাগিল। কারণ তাহারা কেহ জানিতে পারে নাই যে নৌকার এমন দুর্দশা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটিয়াছে। তাহারা ভাবিতে লাগিল, এইটি বোধহয় হরিসভা ক্লাবের শেষবেলার চমক, তুরুপের তাস। একেবারে অন্তিমলগ্নে আস্তিন হইতে বাহির করিয়াছে আদর্শ পল্লীকে মাত দিবে বলিয়া। এবং এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখিয়া তাহারা একেবারে হাঁ হইয়া গেল। তাহার কারণ হইল এই যে নৌকাটি হেলিয়া থাকিবার ফলে এক অদ্ভুত বাস্তব রূপ লইয়াছে। দূর হইতে দেখিলে মনে হইবে যে তুমুল ঝড়ের মধ্যে নৌকাটি কোনোপ্রকারে হেলিয়া গিয়া শেষ অবধি বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। সঙ্গে জলরাশির আবহশব্দ, মৃদু আলোর খেলা ও সন্ধ্যার মেঘাবৃত আকাশের মেলবন্ধনে গোটা ব্যাপারখানায় যেন এক মায়াবী দৃশ্যপট প্রস্তুত হইয়াছে। তাহাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিবার পর কয়েকটি উক্তি এধার ওধার থেকে উড়িয়া আসিতে লাগিল। যেমন সপত্নী সাগর ডাক্তার কহিলেন, 'ইট্স ওয়ান্ডারফুল ! এমেজিং' ! বাংলার শিক্ষক হলধর সামন্ত বলিলেন, 'দুর্দান্ত ! ওস্তাদের মার শেষরাতে'। মধু স্যাকরা বলিয়া উঠিল, 'কেয়াবাৎ ! শেষবেলায় হরিসভা কিন্তু দেখিয়ে দিলে'।  কিছু কচিকাঁচার দল সহর্ষে হাততালি দিয়া উঠিল। উপস্থিত দর্শক সকলেই হরিসভার সৃজনী পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

বিধুচরণ ও তাঁহার দলবল হকচকিয়ে গেলেন। এ কি হইল ! যে মাঠ কিয়দকাল আগে পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ও স্বপ্নভঙ্গের আঁধারে ডুবিয়া যাইতেছিল এখন সেখানেই উল্লাস ও উৎসবের আলো জ্বলিতেছে ! বিধুচরণ চকিতে পুরোটা আঁচ করিয়া ক্লাবকর্তাদের বলিলেন, 'আমাদের শীঘ্রই এটা সামাল দিতে হবে। লোকজন যদি নৌকায় উঠে পড়ে তাহলে তো সবশুদ্ধু জলাঞ্জলি যাবে ? তখন কি হবে' ? ভূপেনমাঝি আগাইয়া আসিয়া কহিল, 'কত্তা, আমি ভালো করে দেখে নিয়েচি। দড়ি খুলে গেছে বটে, তবে নৌকায় লোক না উঠলে কিচ্ছুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এ নৌকা পড়বে না'। বিধুচরণ ভুরু কুঁচকাইয়া কহিলেন, 'কি করে বলছিস পড়বে না ?

- আজ্ঞে, দড়ি আলগা হয়েছে, কিন্তু বাঁশদুটো তো আর পড়ে যায় নি। সে দুটো এমন ভাবে মাটির সাথে গেঁথে আছে যে এই চাপটুকু বয়ে নিতে পারবে। তবে লোকজন যেন না ওঠে এইটে খেয়াল রাখতে হবে।
- ঠিক বলছিস ?
- আজ্ঞে মা দুগ্গার দিব্যি কত্তা, হলপ করে বলছি। বরং লোকজনদের দূর থেকে দেখাবার ব্যবস্থা করুন। দড়ি বেঁধে দিন, সবাই বাঁদিক থেকে ঠাকুর দর্শন করে ডানদিক দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যাবে।
- বেশ, সে ব্যবস্থা আমরা করছি, তবে নৌকা যদি পড়ে যায় তবে ওই বাঁশ খুলে আমি তোর পিঠে ভাঙব এই বলে দিলুম।

শেখর বলিল, 'আলগা দড়ি আরেকবার বেঁধে দিলেই তো হয়'। ভূপেন কহিল, 'না দাদা, এই অবস্থায় হাত লাগাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে মানুষ আটকাবার ব্যবস্থা করুন'। বিধুচরণ তৎক্ষণাৎ গোরার দিকে ইশারা করিলেন। গোরা ঘাড় নাড়িয়া দৌড়াইয়া দড়ির ব্যবস্থা করিতে গেল।

হরিসভার যেন সমস্ত দিক হইতেই শাপমোচন হইল। 'হেলা নৌকা' র মাহাত্ম্য ছড়াইতে বেশি বিলম্ব হইল না। লোকজনের মুখে মুখে রটিয়া গেল যে হরিসভার 'হেলা নৌকা' তাহাদের অভিনব কুশলী কায়দায় শেষবেলায় আদর্শ পল্লীকে টেক্কা দিয়াছে। এই দুর্দান্ত ও চমৎকার দর্শনীয় বস্তুটি না দেখিলে সমস্তটাই বৃথা। ক্রমে ক্রমে মানুষের আগমন ঘটিতে লাগিল। এবং সকলেরই মুখে একটি প্রশ্নই ঘুরিতে লাগিল যে হরিসভা এই আশ্চর্য হেলানো অবস্থাটি বাস্তবে সম্ভব করিল কি প্রকারে ? কিন্তু সেসকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কেহই দিতে পারিল না। ফলে 'হেলা নৌকা' লইয়া আগ্রহ যেন দিগ্বিদিক ছাপাইয়া গগনচুম্বী হইল। ষষ্ঠীর দিন সকাল হইতে স্রোতের ন্যায় মানুষের ঢল নামিল হরিসভার মাঠে। বিধুচরণ ও ক্লাবের অন্যান্যদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিল। হরিসভার ঘাম ছুটিয়া গেল ভিড় সামাল দিতে দিতে।

বিধুচরণ বিজয়ীর হাসি লইয়া ক্লাবের মধ্যে সকলকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা করিলেন যে এমন আনন্দ উৎসবের মধ্যে তিনি একটি ভোজের ব্যবস্থা করিতেছেন। ক্লাবের সকলেই যেন নিজ নিজ পরিবার লইয়া সপ্তমীর রাত্রে উক্ত ভোজে সামিল হন। সকলেই বিধুচরণের জয়ধ্বনি দিতে লাগিল। সেবু এক কোনে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে জিজ্ঞাসা করিল, 'ইয়ে জ্যেঠু, আমার একটি অনুরোধ আছে'। সকলে সেবুর দিকে আতঙ্কিত হইয়া চাহিয়া রহিল। বিধুচরণ ঘাড় নাড়িয়া কিছু বলিবার পূর্বেই সে আবার বলিয়া উঠিল, 'আমিও এই ভোজে রাঁধুনির সাথে দু একটা পদ রাঁধতে চাই, রাঁধবার আমার ভারী ইচ্ছে....... সেই ছোটোর থেকে..........'। সকলে সমস্বরে গগন বিদীর্ণ করিয়া তাহাকে ধমকাইল, 'সেবুউউউউউ ......' !

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories #durgapujastory #durgapuja

  

Monday, September 18, 2017

সাপ্তাহিকী ৩১ # সেবুর প্যাণ্ডেল - প্রথম পর্ব

সেবু বড় আমুদে ছেলে। হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়া সে সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে উঠিয়াছে। রক্ত তাহার গরম। সে করিতে পারে না বিশ্ব সংসারে এমন কোনো কাজ নাই। অন্তত সে নিজে তাহাই বিশ্বাস করে। অবশ্য তাহার এই অতি চাঞ্চল্য শুধু তাহাকে নয় সময় বিশেষে তাহার বাড়ির লোকজনকেও যথেষ্ট বিপাকে ফেলিয়াছে। তাহার একমাত্র কারণ হইল সেবু ভারী পরোপকার করিতে ভালোবাসে। সে উপকার লোকের প্রয়োজনে লাগুক চাই না লাগুক সমাজসেবার নূন্যতম উপায় দেখিলেই সেবুকে ধরিয়া রাখা মুশকিল। যেন তেন প্রকারেন সেবুকে সে কাজ করিতেই হইবে। তাহাতে অধিকাংশ সময়ই অর্থের বিনিময়ে সেবুর জ্যাঠাকে সেসব অনর্থের মূল্য চোকাইতে হইয়াছে। কিন্তু ভবি ভুলিবার নহে।

এখানে বলিয়া রাখা ভালো, সেবুর বাড়িতে তাহার বাবা মা থাকিলেও বাড়ির গার্জেন হিসেবে তাহার জ্যাঠা অর্থাৎ বিধুচরণ মিত্রকে সে বেশ সমঝিয়া চলে। বিধুচরণ মনোহরপুরের নামকরা উকিল ও স্থানীয় ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। এলাকায় তাঁহার প্রতিপত্তি যথেষ্ট। বিয়ে থা করেননি। নিজে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়াছেন ও ছোট ভাইটিকেও শিখাইয়াছেন। ছোট ভাই স্কুলমাষ্টার বিদ্যাচরণ ও ভাতৃবধূ সরলা দুজনেই তাঁহাকে পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। বিদ্যাচরণ ও সরলার যখন পুত্রসন্তান হইল বিধুচরণ তখন তাহার নাম রাখিলেন সেবাব্রত। কিন্তু সেবাব্রত যে বড় হইয়া তাহার নামের প্রতি সুনাম বজায় রাখিতে তৎপর হইয়া উঠিবে তাহা তিনি ঘুনাক্ষরেও টের পান নাই। অথচ সেবুর বাবা মা হইতে তিনি সেবুকে অধিক স্নেহ করেন এবং কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ও দেন। এ যাবৎ সেবুর সমস্ত রকম বায়নাক্কা তিনিই স্মিতহাস্যে মিটিয়া আসিয়াছেন।

বিদ্যাচরণ দাদাকে এ বিষয় বলিতে গেলেই তিনি বলেন, 'আহা ! সেবু আমার আরজন্মের সন্তান, এই জন্মে তোদের কোলে এসেছে, ওকে কি আমি কিছু বলতে পারি' ? বিদ্যাচরণ তাহার দাদাকে নিরস্ত করিতে চায়, বলে, 'এ তোমার ভারী অন্যায় দাদা, ও চাদ্দিকে যা নয় তাই করে বেড়াচ্ছে, সে খবর তো পাও। কত জায়গায় নাজেহাল হতে হয়েছে বলত আমাদের, তাও কি তুমি ওমন চোখ বুজে থাকবে, একটুও শাসন করবে না ভাইপো কে' ?  এ কথায় বিধুচরণ বলেন, 'তোরা করছিস তো শাসন, তাতে হচ্চে না ? আমাকেও লাগবে' ? বিদ্যাচরণ তৎক্ষণাৎ বলে, 'ও কি তোমাকে ছাড়া কারোর কথা শোনে না পাত্তা দেয় যে আমরা বললেই একেবারে বাধ্য ছেলের মতো ঘরে চুপটি করে বসবে' ? বিধুচরণ নিরুত্তর থাকেন, চুপ করিয়া চক্ষু বুজিয়া বারান্দার আরাম কেদারায় দোল খাইতে থাকেন। এই ধরণের বাক্যালাপ সাধারণত বেশিক্ষন গড়ায় না কোনোদিনই। বিদ্যাচরণও বিরক্ত হইয়া উঠিয়া চলিয়া যায়।

এ কথা সত্য যে সেবুর কান্ডকারখানায় পাড়াসুদ্ধু মানুষ ত্রস্ত। সে যে কখন কি করিয়া বসে তাহার ঠিক নাই। এই যেমন গত মাঘে চণ্ডীতলার মাঠে ফুটবল খেলার আয়োজন হইয়াছিল। সেখানে সেবু নিজে না খেলিয়া ক্লাবের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ধরিয়া একটি ম্যাচে রেফারি হইয়াছিল। সে বিশেষ কিছু করে নাই শুধু দুইটি ভুল পেনাল্টি দিয়াছিল। যাহার ফলে পাড়ার ক্লাব সেবার দুটি গোল বেশি খাইয়া লীগ হইতে একেবারে বাহির হইয়া যায়। ক্লাবের প্রেসিডেন্টের পদে বিধুচরণ ছিলেন বলিয়া সে যাত্রা সেবু কোনোমতে পার পাইয়া যায়। নয়ত ঠিক হইয়াছিল পাড়ার মোড়ে সেবুকে কান ধরিয়া গুনে গুনে পঞ্চাশ বার ওঠবস করিতে হইবে এবং গোবর মাখিয়া নিজের হাতে একশত ঘুঁটে প্রস্তুত করিতে হইবে। তাহার জ্যেঠু ক্লাবের ছেলেদেরকে বসিয়া পাঁঠার মাংসভাত খাওয়াইবার ব্যবস্থা করাইতে তবে তাহারা ক্ষান্ত হয়। এমন লঙ্কাকাণ্ড আরও আছে তবে সেসব বলিতে গেলে নূতন করে রামায়ণ রচনা করিতে হইবে।

যাহা হউক, তাহার পর হইতে সেবু খানিক দমিলেও সময়ানুক্রমে তাহার এই পরোপকারের পোকাটা নড়িয়া ওঠে মাঝে মাঝেই। এমনই একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলি।

শ্রাবন মাস। পুজোর আর বেশি দেরি নাই। মনোহরপুর তো বটেই আশেপাশের তল্লাটেও একেবারে সাজসাজ রব পড়িয়া গিয়াছে। মেঘলা আকাশে রোদের লুকোচুরিতে মানুষের মনে আগমনীর ছোঁয়া কাশফুলের মতোই দোদুল্যমান। রবিবারের বিকেল। বিধুচরণ তাহার বাড়ির বৈঠকখানায় ক্লাবের কর্তা ব্যক্তিদের সহিত আসন্ন শারদ উৎসব লইয়া আলোচনা করিতেছেন। মনোহরপুর সম্বন্ধে যাহারা খোঁজ খবর রাখেন তাহারা জানেন মনোহরপুরে মহা আড়ম্বরে দুইটি বড় পূজা হয়। বিধুচরণদের ক্লাব - 'হরিসভা' এবং 'আদর্শ পল্লী'। এই দুইটি ক্লাবের মধ্যে রেষারেষিও চরম হইয়া থাকে। কে কাহাকে কিভাবে টেক্কা দিবে তাহা লইয়া বহুদূর অবধি জল গড়ায়। প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জা, আলো ও আবহশব্দের মিশেলে দুইটা পুজোই দেখিবার মতো এক একখানা বস্তু তৈরী হয় বটে। আশেপাশের অঞ্চল তো বটেই বহুদূর হইতেও শয়ে শয়ে মানুষ জমা হয় এই আশ্চর্য কাণ্ডদ্বয় সচক্ষে দেখিবে বলিয়া। তাহার উপর আবার প্রাইজের হাতছানি রহিয়াছে। এ যাবৎ হরিসভা সর্বাধিক বার ফার্স্ট প্রাইজ পাইয়া ক্লাবের ও বিধুচরণের সুনাম বজায় রাখিয়াছে। কিন্তু এই বছরের পুজো লইয়া সকলেই একটু বেশি চিন্তিত। তাহার কারণ হইল এই, যে খবর পাওয়া গিয়াছে এই বৎসর আদর্শ পল্লী নাকি উড়োজাহাজ বানাইবে। শহর হইতে নামকরা কারিগর ও দক্ষ মিস্ত্রী লইয়া তাহারা অতিপূর্বেই তাহাদের কাজ আরম্ভ করিয়াছে। জনান্তিকে শোনা যাইতেছে, যেরূপ গতি ও লক্ষ্য লইয়া আদর্শ পল্লী অগ্রসর হইতেছে তাহাতে তাহারা একেবারে ফার্স্ট প্রাইজটি লইয়া তবে থামিবে।

স্বভাবতই বৈঠকখানায় হরিসভার কর্মকর্তাদের মুখ তমসাচ্ছন্ন হইয়া আছে। সকলেই বিধুচরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বসিয়া আছেন। এই সংকট মুহূর্তে তাঁহাদের একমাত্র ভরসা তিনিই কারণ তাঁহার বুদ্ধি ও অর্থের উপরই নির্ভর করিবে এই বৎসর হরিসভার কি থিম হইবে। অথচ বিধুচরণ তাহার সাধের তক্তপোশের ওপর বসিয়া নির্বিকার তামাক সেবন করিতেছেন। কোনো কথা কহিতেছেন না। ক্লাবের সেক্রেটারী মাঝবয়েসী শেখর চৌধুরী নিরুপায় হইয়া বলিয়া উঠিলেন, 'মিত্রমশাই কিছু বলুন, আমরা তো কোনো হদিসই পাচ্ছিনা। তেমন কিছু না হলে আদর্শ পল্লীকে ঠেকানো মুশকিল হবে এবার'। বিধুচরণ তাহার তামাকের নলটি একপাশে সরাইয়া রাখিয়া খানিক দাবড়ানির স্বরে কহিলেন, 'দ্যাখো শেখর, তুমি বলছ বিশ্বেশ্বরের মন্দির করবে আর গোরা বলছে তাজমহল বানাবে। বলি তারপর কি দুজন সেক্রেটারি আর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিলে শিবঠাকুর আর শাজাহান হয়ে বটতলার মোড়ে বিড়ি ফুঁকবে ? কি ভেবেছ কি ? টাকাটা আসবে কোত্থেকে শুনি, য়্যাঁ ?

'আজ্ঞে টাকাটা যদি আমরা সবাই মিলে এ বছর একটু বেশি করে তুলি, তাহলে' ? গোরা মিনমিন করিয়া জিজ্ঞেস করে। বিধুচরণ ব্যঙ্গ করিয়া বলেন, 'টাকা কি শিউলি ফুল, যে কাছে গেলাম আর টুক করে তুলে নিলাম। চাঁদা বাড়ালেই যে সবাই রাজি হবে তাতো আর নয়। দিনকাল যা পড়েছে তাতে ট্যাক্সোর ঠেলায় মানুষ পাজামা ছেড়ে হাফ প্যান্টে নেমে এসেছে আর তুমি বলছ বেশি করে টাকা তুলি, হুঁহ' ।

শেখর আমতা আমতা করিয়া জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে উপায়' ? বিধুচরণ বলেন, 'সে কিছুটা নাহয় আমিই দিলাম আর কিছুটা চাঁদা উঠলো, কিন্তু বাকিটা ? তার কি কোনো উপায় ভেবেছ' ? বিজন মুখ বাড়াইয়া বলে, 'আজ্ঞে স্পনসর জোগাড় করতে পারলেই কিন্তু অনেকটাই.......... ' ।

কথাটা শেষ করিতে দেন না বিধুচরণ,ধমক দিয়া বলেন, 'গন্ডমূর্খের মতো কথা বোলো না বিজন, এটা কলকাতা নয় যে কোম্পানিগুলো একমাস আগে থেকেই সারিবাঁধা বাঁশের ওপর লাফিয়ে উঠে বসে পড়বে। এটা মনোহরপুর এখানে নিজেদের টাকা নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে সেটা মাথায় রাখো'। এ কথায় বিজন ও অন্যান্যরা মুষড়িয়া পড়িল। বিধুচরণ আবার বলিয়া উঠিলেন, 'ওহে বিজন, তুমি তো ক্যাশিয়ার, হিসেবে করে বলো দিকি, বাকি টাকার অঙ্কটা ঠিক কত' ? সে ব্যস্ত হইয়া খাতাপত্র খুলিয়া বলিল, 'আজ্ঞে সর্বসাকুল্যে লাখখানেক মতো কম পড়ছে' ।
বিধুচরণ গম্ভীর মুখে বলিলেন, 'নাহ, তাহলে বিশেষ কিছু করা যাবে না দেখছি। কম বাজেটের মধ্যে কিছু একটা ভাবা হোক'। 

এ কথায় সকলেই মাথা চুলকাইতে লাগিল। আদর্শ পল্লী কে টক্কর দিবার মতো তেমন কিছু কারোরই মাথায় আসিল না। সবাই এর ওর মুখের দিকে দেখিতে লাগিল। নানারকম ইশারা করিতে লাগিল কিন্তু কাজের কাজ কিছু হইল না। বিকেল গড়াইয়া সন্ধ্যা নামিল।

এমন সময় বিজন ঘরের দক্ষিণ দিকে আঙুল তুলিয়া কি একটা দেখাইয়া ভূ.... ভূ....করিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িয়া দিল। তাহার চিৎকারে উপস্থিত সকলেই চমকাইয়া সে দিকে মুখ তুলিয়া তাকাইল। যাহা দেখিল তাহাতে সবারই পিলে ছাদ ফুঁড়িয়া লাফাইয়া উঠিল প্রায়। একটি ঘন কালো বিটকেল মূর্তি তাহাদের দিকে চাহিয়া দাঁত বার করিয়া হাসিতেছে। কিছুক্ষন পর সেই মূর্তি কথা কহিয়া উঠিল। 'কি গো বিজন দাদা, ভয় পেলে নাকি গো ? আমায় চিনতে পারোনি' ? তাহার গলার স্বর বিধুচরণ চিনিতে পারিয়া কহিলেন, 'এ কিরেএএএ ? সেবু ! একি দশা করেছিস নিজের ! এতো পাঁক মেখে এলি কোথা থেকে' ? ঘরের সকলেই 'সেবু' নামটি শুনিয়া ধড়ে প্রাণ ফিরিয়া পাইল। সেবু ঠিক তেমনই দাঁত বাহির করিয়া বলিল, 'ওই ঘোষেদের বাগানে পেয়ারা পাড়তে উঠেছিলুম, পা ফস্কে পাশের ডোবাটায় পড়ে গেছিলুম আর কি' ?

- ছিছিছি সেবু, এতো বয়সেও তুই পেয়ারা চুরি করে খাচ্ছিস ? কেন শীতলকে বললে অমনি দুটো পেয়ারা তোকে পেড়ে দিতে পারতে না যে তুই একেবারে গাছে উঠে চুরি করতে গেলি ?
- না জ্যেঠু, শীতল ঘোষ ভারী নচ্ছার লোক, পেয়ারা চাইতে গেলে দুকথা শুনিয়ে দেয়.....

ঘরের মধ্যে উপস্থিত গোরা ঘোষের মুখচোখ শক্ত হইয়া গেল। তাহারই সামনে সেবু তাহার বাবাকেই গালাগাল করিতেছে । সে দিকে এক নজর দিয়া বিধুচরণ সেবুকে ধমকাইলেন, 'ছিঃ সেবু, ওকি মুখের ভাষা ? গুরুজনের প্রতি সম্মান রাখা উচিৎ। তাছাড়া তুমি পেয়ারা চুরি করে মোটেও ঠিক করোনি, পারলে সেগুলো ফেরত দাও এক্ষুনি'। সেবু ব্যাজার মুখ করিয়া প্যান্টের দুই পকেট হইতে দুটা প্রমান সাইজের পেয়ারা বাহির করিয়া গোরার সামনে ধরিল। পাঁকমাখা দুইটা পেয়ারা গোরা ফিরিয়া লইতে চাহিল না। নাকে হাত দিয়া কহিল, 'থাক থাক, ছোট ছেলে পেড়ে এনেছে যখন, খাগ্গে, ও কি আর এমন' ? সেবু কঠিনস্বরে কহিল, 'না, জ্যাঠামশায়ের হুকুম, ও তোমায় নিতেই হবে'। গোরা করুণমুখে বিধুচরণের মুখের দিকে একবার চাহিয়া কহিল, 'আচ্ছা আচ্ছা রেখে দে এখন, যাবার সময় নিয়ে যাব'।

পেয়ারাগুলো যথাস্থানে রাখিয়া সেবু একগাল হাসিয়া কহিল, 'তা তোমাদের কি আলোচনা হচ্ছিল ? আদর্শ পল্লী নিয়ে কি একটা শুনলুম যেন' ?বিধুচরণ চিন্তান্বিত হইয়া বলিলেন, 'হ্যাঁ, আদর্শ পল্লী এবার যা প্যান্ডেল করছে তাতে করে আমাদের ঠাকুর দেখতে আর তেমন ভিড় হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া বিরাট কিছু করবার টাকাও নেই আমাদের। কি করে যে সমস্ত দিক ব্যবস্থা করি সেটা ভেবেই আর কুলকিনারা পাচ্ছি না....' ? 
'শুনলুম তারা নাকি উড়োজাহাজ করছে' ? সেবু জিজ্ঞাসা করে। 
- হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিস.......

সেবু চটপট কহিল, 'তা বেশ তো। তোমরা বরং একটা পালতোলা নৌকো করো। ওদেরটা আকাশের আর আমাদেরটা জলের। সমানে সমানে লড়াই হবে। তাছাড়া নৌকো তৈরীর খরচও বিশাল নয়'। সবাই যে যার মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতে লাগিল। অর্থাৎ প্রস্তাবটা যে খুব একটা মন্দ নয় তার আভাস সকলেরই মুখেচোখে খানিক খেলিয়া গেল। বিজন ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'সে কিরকম' ? বাকিরাও উৎসুক মুখে সেবুর দিকে চাহিয়া রহিল। সেবু বলিল, 'কেন ভূপেন মাঝি আর তার সাকরেদদের বললে ঠিক কম খরচায় কিছু না কিছু একটা করে দেবে। ওরা তো হামেশাই নৌকা বানায়, জানোই তো। এই তো গেল হপ্তাতেই একটা বড় নৌকো ভাসালো তমালনদীর জলে, মনে নেই ? ওদেরকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চই করবে। তাতে হরিসভার মানও থাকে, খরচও কম হয়'।

হাতের কাছে এরকম একটা সস্তা অথচ লোভনীয় প্রস্তাবে সকলেই প্রায় লাফাইয়া উঠিল। বিধুচরণ ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, 'উত্তম প্রস্তাব সন্দেহ নেই কিন্তু ভূপেন কম খরচায় নৌকা বানাতে রাজি হবে ? নৌকার খরচও তো নেহাত মন্দ নয়'। সেবু বীরের হাসি হাসিয়া বলিল, 'গোটা নৌকো তো আর বানানো হচ্চে না, নৌকোর আদলে প্যাণ্ডেল হবে। ও তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও জ্যেঠু, আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব। হাজার হোক হরিসভার সম্মান বলে কথা, রাজি সে হবেই'। বিধুচরণ বাকিদের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, 'তোমরা কি বলো হে সবাই.....কি শেখর ? তুমি তো সেক্রেটারি, তোমার কি মত' ?

শেখর ঘাড় নাড়িয়া বলে, 'আজ্ঞে বিশ্বেশ্বরের মন্দিরটা বেশি ভালো ছিল তবে এই প্রস্তাবটা বাজেটে কুলিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এখন ভূপেনমাঝির সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা বলে ফাইনাল করে নিলেই হয়'। বিধুচরণ আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন, 'বেশ, তাহলে ভূপেনকে কালই একবার সন্ধ্যের দিকে বাড়ি আসতে বলিস সেবু, আর তোমরাও থেকো সকলে'। সেবু খানিক ইতস্তত করিয়া বলিল, 'আচ্ছা বলে দেব। তবে, ইয়ে......মানে আমার একটি শর্ত আছে'। বিধুচরণের ভুরু কুঁচকাইয়া যায়, জিজ্ঞেস করেন, 'শর্ত !! তোর আবার কিসের শর্ত রে' ? বাকিরাও সন্দেহের চোখে সেবুর দিকে তাকাইয়া রহিল। সেবু অস্ফুটে বলিল, 'ভূপেন মাঝিদের সাথে আমিও প্যাণ্ডেল বাঁধব। আমার খুব ইচ্ছে......' । 
ঘরের ভিতর যেন বজ্রাঘাত হইল।

ক্রমশ...

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #durgapujastories #pujabarshiki

Thursday, March 16, 2017

সাপ্তাহিকী ২৫ # সুলভ ইন্টারন্যাশনাল

রমাপদ ভীষণ খাইতে ভালোবাসে। উৎকৃষ্ট মানের সুস্বাদু রান্না হইলে তাহার আর কিছুই লাগে না। খাবার সময় থালার পাশে চার পাঁচটি বাটি যদি না থাকে তাহা হইলে তাহার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সেদিন তাহার মনে হয় সে যেন আধপেটা খাইয়া রহিয়াছে। উত্তরোত্তর ক্ষুধা পাইতে থাকে তখন। তাহার সাধের ভুঁড়িটি গ্যাসহীন বেলুনের ন্যায় চুপসিয়া যায় যেন। এহেন রমাপদ ভদ্রেশ্বরে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছিলো। পরীক্ষার ছুটিতে তাহার স্ত্রী ও কন্যাকে যত্নসহকারে গ্যারেজ করিয়া চব্যচষ্য উদরস্থ করিয়া সে ফিরিয়া আসিতেছিল। কিয়দকাল একাকী থাকিবার প্রলোভনে রমাপদ বেশ ফুরফুরে মেজাজে ট্রেনে চাপিয়া বসিল।

ট্রেন ভদ্রেশ্বর স্টেশন ছাড়িয়া হাওড়া অভিমুখে যাত্রা আরম্ভ করিল। দুপুরের দিকে ভিড় কম থাকার দরুন রমাপদ খুব সহজেই জানলার সিট্ পাইয়া আরাম করিয়া পা মেলিয়া দিল। মনে মনে ভাবিল, প্রায় পৌনে একঘন্টা মতো লাগিবে পৌঁছাইতে, তাই দু চোখের পাতা এক করিয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতে পারিলে মন্দ হয় না। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বসন্তের মিঠে হাওয়ায় ও ট্রেনের যুগপৎ দুলুনিতে সবে নিদ্রার যোগ আসিতেছিল এমন সময় ভয়ঙ্কর রূপে রমাপদর পেট কামড়াইয়া উঠিল।

সে ধড়মড় করিয়া সোজা হইয়া বসিল। এমন তো হইবার কথা নহে। তাহা হইলে ব্যাপারখানা কি ? বলিতে না বলিতেই পুনরায় বিকট এক কামড়। নিমেষে রমাপদ ঘামিয়ে উঠিল। এ কামড় রমাপদ বিলক্ষণ চেনে। এ কোনো সাধারণ উদর পীড়া নহে। অম্বল, গ্যাস, চোঁয়া ঢেঁকুর, বুকজ্বালা কোনো প্রজাতির ব্যথার সহিত ইহার কোনোরূপ কোনোপ্রকারের মিল নাই। সকালবেলার এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে অনুরূপ ব্যাথা অনুভূত হয়। এবং সে ব্যাথা হইলেই রমাপদ বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করিতে পারে না। উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াইয়া, আট মিটারের দূরত্ব এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে অতিক্রম করিয়া এক ঝটকায় বাথরুম বন্ধ করিয়া সে কমোডের শূন্যস্থান পূরণে তৎপর হইয়া ওঠে।

তাহার পর সমস্ত ব্যাথা খালি হইলে পর সে প্রসন্নচিত্তে বাহির হইয়া আসে। কিন্তু এখন এই চলমান ট্রেনে সে কি করিবে ? কোথায় যাইবে ? কাহাকে বলিবে ? এই সমস্ত চিন্তা করিয়া ঘামিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। তাহার উপর লোকাল ট্রেন, টয়লেটের কোনোরকম বন্দোবস্ত নাই, সুতরাং রমাপদ যে নিশ্চিন্তে কাজ হাসিল করিয়া হালকা হইয়া চলিয়া আসিবে তেমন কোনো সম্ভাবনাও নাই। সেইটে চিন্তা করিয়া রমাপদ আরও মুষড়িয়া পড়িল। একবার ভাবিল সামনের স্টেশনে নামিয়া টয়লেট খুঁজিয়া লইবে। পরক্ষনেই ভাবিল একবার নামিয়ে পড়িলে পরের ট্রেন আসিতে প্রায় একঘন্টা লাগিবে, হাওড়া পৌঁছাইতে দেরি হইবে বিস্তর। তাহার চেয়ে কোনোরূপ পেট চাপিয়া ধরে পরপর স্টেশনগুলি পার করিতে পারিলে একেবারে হাওড়ায় গিয়াই কাজ সারিয়া লইবে।

সেইমতো কষ্ট করিয়া রমাপদ কিছু স্টেশন পার করিল। উপায়ন্তর না দেখিয়া অনিচ্ছাকৃতভাবে বার দুয়েক বায়ু নির্গমনও করিল। ছুটন্ত ট্রেনে ঝড়ের বেগে সে বায়ু ছড়াইয়া পড়িল দিগ্বিদিগ। সহযাত্রীরা চমকাইয়া উঠিয়া যে যার মতো রুমাল চাপিয়া ধরিল নাকে। রমাপদ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করিল না। দাঁতে দাঁত চাপিয়া যুদ্ধ জয়ের আশায় বসিয়া রহিল। কিন্তু প্রকৃতির ডাক বড় কঠিন ডাক। যতই বলিষ্ঠ মানুষ হোক না কেন সে নিশির ডাক উপেক্ষা করিবে এই ধরাধামে এরূপ দুঃসাহস দেখাইবার মতো মানুষ খুঁজিয়া পাওয়া দুস্কর। অতএব রমাপদর মতো সাধারণও নিজেকে বেশিক্ষণ ধরিয়া রাখিতে পারিল না। কোন্নগর আসিবার পূর্বেই সে চক্ষে সর্ষেফুল দেখিতে লাগিল।

স্টেশন আসিবামাত্র সে বিদ্যুৎবেগে ট্রেন থেকে নামিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ধাবমান হইল সম্মুখের দিকে। এক জিআরপিএফকে দেখিতে পাইয়া তাহাকে কাতর হইয়া বলিল, 'দাদা, স্টেশনের টয়লেটটা কোনদিকে বলুন, জলদি...... '। জিআরপিএফ রমাপদর দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি হানিয়া গম্ভীরস্বরে কহিল, 'স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে'। রমাপদ বেশি জোরে দৌড়াইতে পারিল না, তাও যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হাঁটিয়া, সিঁড়ি টপকাইয়া শৌচালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইল। কপাল খারাপ থাকিলে মানুষের যা যা ঘটিতে পারে রমাপদর ক্ষেত্রে তখন ঠিক তাহাই ঘটিল।

শৌচালয়ের গেটে একটি বড় তালা ঝুলিতেছে। তাহার মুখ শুকাইয়া পাংশু হইয়া গেল। এই করুণ অভিজ্ঞতা রমাপদর জীবনে খুব বেশি ঘটে নাই। সুতরাং তালা দেখিয়া তাহার একেবারে মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করিল। কারণ পেটের ভিতর ততক্ষণে উদ্দাম তাণ্ডবনৃত্য শুরু হইয়া গেছে। সুনামীর ঢেউয়ের ন্যায় সে মরণ বেগ তাহার উদরের ভিতর একের পর এক আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। সামান্য অসাবধানে এক বিরাট গোলযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা প্রবল হইয়া উঠিল। আশেপাশে খুঁজিয়াও যখন শৌচালয়ের কাহাকেও সে দেখিতে পাইল না তখন সে অনন্যোপায় হইয়া এক রিক্সাওয়ালাকে পাকড়াও করিল।

রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল, 'বাবু কোথায় যাবেন' ? রমাপদ মুখ দিয়া কোনো কথা কহিতে পারিল না, শুধু করুণভাবে ইশারায় শৌচালয়ের দিকে আঙ্গুল তুলিয়া দেখাইল। রিক্সাওয়ালা সেদিকে তাকাইয়া কহিল, 'কি মুস্কিল, তা ওখানে যেতে আমাকে টানছেন কেন ? এর জন্য আবার রিকশা করে নাকি কেউ' ? রিক্সাওয়ালার তাচ্ছিল্যে রমাপদ ভীষণ বিরক্ত হইয়া কিছু একটা বলিতে যাইতেছিলো। পরক্ষনেই পেট চাপিয়া ধরিয়া অস্ফুটে কহিল, 'ওখানে লোক কই, কখন খুলবে' ? রিক্সাওয়ালা সে বিপদভঞ্জন ঘরের দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল, 'ওহ, বন্ধ বুঝি ? ওর লোক তো খেতে গেছে, ঘন্টাখানেক বাদে আসবে'।

রমাপদর মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। প্রায় মাটিতে বসিয়া পড়িবার উপক্রম হইল, মিহিস্বরে কহিল, 'তাহলে' ? রিক্সাওয়ালা বলিল, 'আপনি এক কাজ করুন, প্ল্যাটফর্মে চলে যান, স্টেশনকর্মীদের একটা বাথরুম আছে। জিজ্ঞাসা করুন, বলে দেবে'। রমাপদ সেকথা শুনিয়া প্রায় হামাগুড়ি দিয়া প্ল্যাটফর্মে আসিয়া উপস্থিত হইল। সটান ঢুকিয়া পড়িল স্টেশনমাস্টারের রুমে। সম্মুখে এক ভদ্রলোককে দেখিতে পাইয়া বিকৃত মুখে কোনোরকমে কয়েকটা শব্দ বাহির করিল, 'দাদা, আপনাদের টয়লেটটা.........'

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকাইয়া চশমার ভিতর হইতে কহিলেন, 'টয়লেটটা কি' ? রমাপদ কোনোপ্রকার একপায়ের ওপর আরেক পা ভর দিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, 'একবার যাব.......'।

ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ মাছি তাড়াইবার মতো করিয়া হাত নাড়িয়া কহিলেন, 'না নাঃ, ও বাইরের লোকের জন্য নয়, আর তাছাড়া যাত্রীদের জন্য তো বাইরে শৌচালয় আছে, সেখানে যান'। রমাপদ বলিল, 'আজ্ঞে, সেইটে বন্ধ, এক্ষুনি ঘুরে এসেছি, দয়া করে যদি আপনাদের টয়লেটটা একবার.........'।

সেই ভদ্রলোক এবার মুখ না তুলিয়াই বলিলেন, 'বন্ধ থাকলে একটু ওয়েট করুন, খুললে যাবেন, আমাদেরটা ব্যবহার করা যাবে না, স্যরি'। একথায় রমাপদ একেবারে হাঁউমাঁউ করিয়া কাঁদিয়া পড়িল। সামনে আসিয়া ভদ্রলোকের হাত জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, 'স্যার, প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন, সেই শৌচালয় ঘন্টাখানেক বাদে খুলবে, কিন্তু ততক্ষণে আমার বাঁধের লকগেট খুলে গিয়ে সমস্ত কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে একেবারে তছনছ করে চলে যাবে। আপনি কি তাই চান' ? ভদ্রলোক তখনও না না করিতে লাগিলেন, রমাপদর কাকুতিমিনতি কর্ণপাত পর্যন্ত করিলেন না।

এইবার রমাপদ সম্পূর্ণ বেসামাল হইয়া গেল। সে আর ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে পারিল না, সমস্ত সাহস সঞ্চয় করিয়া, অকুতোভয় হইয়া কহিল, 'তবে আমি এই চেয়ারের ওপর বসলুম উবু হয়ে, আমি এইখানেই করব, আপনার যা করার করে নিন'। বলিয়াই সে অনতিদূরে একটি চেয়ারের নিকট নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলিতে লাগিল। ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করিয়া উঠিলেন, ভীষণ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বলিলেন, 'একি করছেন, একি করছেন, এটা তো অফিস ! আরে ওই চেয়ারটা যে বড়বাবুর......'। রমাপদ চোখ মুখ কুঁচকাইয়া কহিল, 'আমার আর কিচ্ছু করার নেই স্যার, বড়বাবুর জন্য নতুন চেয়ার আনিয়ে নেবেন'। 

ভদ্রলোক ত্বড়িৎগতিতে ড্রয়ার খুলিয়া চাবি বাহির করিয়া রমাপদর হাতে দিয়া বলিলেন, 'এই নিন, এই নিন, ডানদিকে ওই কোণের দরজাটা, সোজা চলে যান, কিন্তু এখানে প্লিজ না'। রমাপদ আর কালক্ষেপ করিল না। চাবিটা প্রায় ছিনিয়া লইয়া বিশেষ ঘরের অভিমুখে হনহন করিয়া হাঁটা লাগাইল। পশ্চাতে শুনিতে পাইল ভদ্রলোক বলিতেছেন, 'হয়ে গেলে জলটা ঠিক করে দেবেন কিন্তু..................' ।

রমাপদ দড়াম করিয়া দরজা বন্ধ করিল। নিদারুণ আতশবাজির শব্দে গোটা অফিস মুখরিত হইয়া উঠিল, বাহিরে স্টেশনে এনাউন্স হইল, 'দুনম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়ছে............'

অলংকরণ : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalifunnystories #saptahiki #sulabh