পাড়ার সেলুন আর বিউটি পার্লারের মধ্যে বেশ কিছু চরিত্রগত তফাত আছে যা আমরা সকলেই জানি। না না, পরিষেবা ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের যুক্তিতক্কের ফাঁকে ঢুকতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি, এই দুই প্রতিষ্ঠানের মূল তফাৎ হল আবেগে। খানিকটা আগ বাড়িয়ে বলা যেতে পারে যে পাড়ার সেলুন হল মধ্যবিত্ত বাঙালির অস্থায়ী আড্ডার চরম ঠিকানা, সহজ ভাষায় যাকে বলে - ঠেক। সেখানে 'বাজার আগুন দাদা, কিছু ছুঁলেই হাত পুড়ে যাচ্ছে' অথবা 'কুলদীপের অফ ফর্মটা এবার ওয়ার্ল্ড কাপে বেশ ভোগালো' বা 'যাদবপুরের সিটটা এবার যুক্তিসম্মত হলো না' ইত্যাদি কথাবার্তায় চুল দাড়ির নকশাটা যেন অন্য মাত্রা পায়। সেখানে পার্লারে শুধু কাঁচি চলার শব্দটাই যেন বেশি করে কানে লাগে। তার কারণ বাকিরা ধ্যানগম্ভীর ঋষি মুনির ন্যায় খবরের কাগজ বা স্মার্ট ফোনের মধ্যে অমৃতের সন্ধান পেতে থাকে। তাই পার্লারে যাবতীয় স্বর্গীয় হাতছানি উপেক্ষা করে নিয়মিত ক্ষুরকর্মের জন্য আমি বরাবরই আমার পাড়ার সেলুনগুলোকে অগ্রাধিকার দিই। ভাবছেন, ধান ভাঙতে শিবের গীতটা গাইতে লেগেছি কেন ? বলছি...
এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে যেটা আমার কাছে অন্যতম আকর্ষণ তা হল কুইক ম্যাসাজ। চুল কাটার পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ মানুষেরই ম্যাসাজ নেবার একটা পাশবিক ইচ্ছে জাগে। আর আশ্চর্য জনক ভাবে নাপিত ছেলেটিরও যেন এক নৈসর্গিক আনন্দ হয়। ভাবটা এমন যেন - 'আহা কি বললে গো দাদা, এটার অপেক্ষাতেই তো ছিলুম'। আর তারপরেই যেটা শুরু হয় তা দিয়ে সহজেই একটা দশ মিনিটের শর্ট ফিল্ম বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। মাথার চুল পেরিয়ে ঘাড় আর পিঠ অবধি যে অবাধ তবলা বাদন চলে তার মধুর সংগীতের মূর্ছনায় গোটা সেলুনটা যেন সিনেমা হলের মতো লাগে। কারণ যারা চুল কাটার অপেক্ষায় বসে থাকে বা গুলতানি করে তারাও যেন এ দৃশ্যপটের সামনে কিছু মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা হয়ে যায়।
ম্যাসাজের প্রতি কোনোরকম স্পৃহা আমার কখনোই ছিল না, তার কারণ শরীরের উপর কোনোরকম অত্যাচার আমি সইতে পারি না মোটে। আর আমার বলতে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই যে এ যাবৎ এমনধারা ম্যাসাজ আমি ছোটোর থেকে নিই নি কখনো । তবে কপালের ফেরে সে ভয়কর অভিজ্ঞতাও আমার হল একদিন । গত রোববার ল্যাদপ্রিয় মানুষের মতো আমিও একটু দেরিতে বিছানা ছেড়ে ছিলাম। দেরিতে ওঠার ফলেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক মাথাটা বেজায় টনটন করছিল। উঠেই ভাবলাম, সামনে পুজো, যাই, আজ চুল কাটার সাথে সাথে ম্যাসাজটাও করিয়ে নিই। চুল ছাঁটাও হবে সঙ্গে নতুন অভিজ্ঞতাও হবে। কিন্তু কপালটা চিরকাল আমার সাথে বেইমানি করে এসেছে। এবারেও তার অন্যথা হল না।
সেলুনটা আমার বাড়ির পাশেই। সাত ফুট বাই সাত ফুটের একটা ঘর। ছাপা পর্দার আড়ালে ফোর-জি স্পিডে দক্ষযজ্ঞ ঘটে চলেছে। ভিতরে ছটা চেয়ারই ভর্তি। মাঝে একফালি একটা সরু কাঠের বেঞ্চ, সেখানে বসে জনা তিনেক লোক আড্ডায় মশগুল। ডানদিকের চেয়ারে একটা কাঠের পাটাতনের ওপর একটা পুঁচকে ছেলে ঘাড় গুঁজে বসে, আড়চোখে সামনের আয়নায় আঁখো দেখা হাল এর বিশদ বিবরণী মেপে নিচ্ছে। পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে, খুব সম্ভব ছেলেটির মা, যিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরামর্শ দিয়ে চলেছেন নাপিতকে। মধ্যবয়সী নাপিত বেচারা চেয়ারের চারপাশে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। দেওয়ালে লাগানো প্রীতি জিন্টা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। বাঁদিকের দেওয়ালে আমির আর শাহরুখ আলাপচারিতায় মগ্ন। দক্ষিণ পূর্ব কোণে একটা স্পিকার ঝুলছে। যেটা দেখে আমার প্রত্যেকবার মনে হয় সেটা যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়ে যাবে, কিন্তু আশ্চর্য ভাবে মাধ্যাকর্ষণ এর সমস্ত থিওরি ভুল প্রমাণিত করে দিনের পর দিন টিকে আছে সে এইভাবেই। সেটা দিয়ে নব্বইয়ের দশকের হিন্দী গান ভেসে আসছে। সবটা মিলিয়ে একেবারে মাখ মাখো মধ্যবিত্তের আধার কার্ড।
আমি দরজায় দাঁড়িয়ে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। রাজু আমায় দেখে বললে, 'দাদা দো মিনিট ! ব্যাস হয়ে গিয়েছে । একে ছেড়ে দিয়ে ফির আপনাকে ধরছি' ।
রাজু হল অল্পবয়সী খোস মেজাজি বিহারী নাপিত। বয়স ২৬ - ২৭ হবে। শ্যামলা রং, মাঝারি গড়ন, পান মশলায় বেশ আসক্তি আছে। 'একে' বলতে যাকে বোঝালো সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক চুল কাটাতে কাটাতে ভারী বীরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখেমুখে অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট । মনে মনে ভাবলেন বোধহয়, কোথাকার কোন নবাব খাঞ্জা খাঁ এসেছি যে মাত্র দুটো মিনিটেই ছেড়ে দিতে হবে ! আমি বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। অকারণ মাতামাতি সহ্য হয় না। তবু রাজু আমায় বিশেষ খাতির করে। কি কারণে করে তা বলতে পারব না। হতে পারে আমি তার কাঁচির তলায় নির্বিচারে মাথা পেতে দিই এবং সমস্ত নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলি। রাজুও দিব্যি খোশগল্প করতে থাকে আমার সাথে। তার কোনো কথায় আমি বাধা দিই না, বরং সে একজন শান্ত নির্বাক শ্রোতা পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে চুল কাটতে থাকে।
রাজু হল অল্পবয়সী খোস মেজাজি বিহারী নাপিত। বয়স ২৬ - ২৭ হবে। শ্যামলা রং, মাঝারি গড়ন, পান মশলায় বেশ আসক্তি আছে। 'একে' বলতে যাকে বোঝালো সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক চুল কাটাতে কাটাতে ভারী বীরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখেমুখে অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট । মনে মনে ভাবলেন বোধহয়, কোথাকার কোন নবাব খাঞ্জা খাঁ এসেছি যে মাত্র দুটো মিনিটেই ছেড়ে দিতে হবে ! আমি বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। অকারণ মাতামাতি সহ্য হয় না। তবু রাজু আমায় বিশেষ খাতির করে। কি কারণে করে তা বলতে পারব না। হতে পারে আমি তার কাঁচির তলায় নির্বিচারে মাথা পেতে দিই এবং সমস্ত নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলি। রাজুও দিব্যি খোশগল্প করতে থাকে আমার সাথে। তার কোনো কথায় আমি বাধা দিই না, বরং সে একজন শান্ত নির্বাক শ্রোতা পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে চুল কাটতে থাকে।
মিনিট দশেক পরে রাজুর চেয়ার ফাঁকা হয়ে যেতে সে একগাল হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকাল। যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তিনি পাশ দিয়ে যাবার সময় তির্যক চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন আমার দিকে। আমিও সামান্য বোকা হাসি দিয়ে চুপচাপ নির্বিচারে বসে পড়লাম চেয়ারে। রাজুর কাঁচির পথচলা শুরু হল।
পিছন থেকে শুরু করে কানের দুপাশ দিয়ে রাজুর কাঁচি নির্বিবাদ চলতে লাগল। আর আমিও সামনের আয়নায় আমার চুলের ব্রেকিং নিউজ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। পেছনের দেওয়ালে শাহরুখ আর আমির আমার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে। প্রীতি জিন্টা সমানে মুচকি হাসছে। খানিক বাদে এই খুনখারাপির অবসান ঘটল। বরাবরই আমার চুল কাটতে বিশেষ সময় লাগে না। কমতে কমতে বর্তমান সময়ে এসে মাথার ওপর যে ক'গাছা পড়ে আছে তা ছোটবেলার স্মৃতি আর গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘাড়ের চারিদিকে খোঁচাওয়ালা পাউডার লাগিয়ে দিল রাজু। এই জিনিসটা তাকে প্রত্যেকবার বারণ করা হলেও সে শোনে না। খামোখা অত পাউডার লাগিয়ে ফুলবাবু সাজিয়ে ঠিক কি লাভ হয় বুঝিনা। অথবা হয়ত ভাবে, যে এই অবস্থায় ঠাকুর দেখে আসা সম্ভব.....
সমস্তটা হয়ে যাওয়ার পর রাজু জিজ্ঞেস করল, 'ওউর বলেন দাদা.........'
আমি খানিক ইতস্ততঃ করে বললাম, 'ইয়ে মানে তুমি তো ম্যাসাজ করো দেখি। আমার ঘাড় আর মাথার দিকটা একটু করে দিতে পারো......সকাল থেকে বড্ড টনটন করছে'।
রাজুর সারা মুখমন্ডল জুড়ে শরতের রোদ খেলে গেল যেন। আমার এহেন আবদার সে যে কিভাবে পূরণ করবে ভেবেই পেল না। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললে, 'আরে কি বলছেন দাদা, একদমসে করে দেব। আপনাকে এমন স্পেশাল ম্যাসাজ দেব যে আপনার নেশা লেগে যাবে'।
মনে মনে ভারি আশ্চর্য হলাম, 'ম্যাসাজের নেশা ! এ ব্যাটা বলে কি ! এতেও কি মানুষের আসক্তি আছে নাকি ? অবশ্যি তথাকথিত ম্যাসাজ পারলারের যে সমস্ত খবর কানে আসে তাতে করে ম্যাসাজ বিষম বস্তু হতেই পারে বৈকি'।
সে যাই হোক, রাজু সামনের ড্রয়ার খুলে সযত্নে চিরুনি আর কাঁচি রেখে দিল তাতে। তারপর দু হাত ওপরে তুলে নিজের দশটা আঙ্গুল কটমট করে ফাটিয়ে নিল। ঘাড়টা দুপাশে কাত করে নানান কায়দায় কসরত করে রেডি হয়ে গেল একেবারে। বক্সিং শুরু করার আগে ফাইটাররা যেমন করে থাকে, কতকটা সেই রকম। আমার কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এ যেন বল্লালদেবকে নিকেশ করার আগে বাহুবলী প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিনেমার দৃশ্যটা ভেবেই আমার গলা শুকিয়ে এল একেবারে। কেবলই মনে হতে লাগল একটু বেশি রিস্ক নিয়ে ফেললাম নাতো !
অবশ্য খুব একটা ভাবার অবকাশ পেলাম না। কারণ ততক্ষনে রাজু দুহাত দিয়ে কপ করে আমার মাথাটা ধরে ফেলেছে। দু আঙুলের মুদ্রায় কপালের সামনেটা টেনে টেনে ধরতে লাগল। তারপর একইভাবে ভাবে কপালের দুপাশে চক্রাকারে আঙ্গুল ঘোরাতে লাগল। বেশ আরাম পেলাম। মনে মনে রাজুর প্রতিভার তারিফ না করে পারলাম না। এরপর মাথার পিছন দিকটায় দু হাত দিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে জড়ো করে আঙুলের বিশেষ কায়দায় চটপটি বাজনার মতো করে ফটাফট শব্দ করতে লাগল। মাথার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের তরঙ্গ খেলে গেল যেন। দু চোখে অপার শান্তির ঘুম নেমে এলো আমার। কয়েক মুহূর্ত সেলুন আর স্বর্গের তফাৎ করতে পারলাম না।
বেশ খানিকক্ষণ এমনটা হবার পরে রাজু আমার কাঁধের দিকে নেমে এল। ফেনিল মসৃন ঢেউয়ের মতো সে আমার কাঁধের ওপর ছোট ছোট অবকাশে আঙ্গুল চালাতে লাগল। এমন স্তিমিত মৃদু অঙ্গুলিচালনায় মনে মনে একেবারে নিশ্চিত হলাম যে ম্যাসাজ কম্পিটিশনের ওয়ার্ল্ড কাপটা একমাত্র রাজুরই পাওয়া উচিত। এমন চমৎকার ট্যালেন্ট বুড়োশিবতলার গলিতে অবহেলায় ও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে ভেবে মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল।
হর্ষ আর করুণার দোলাচলে দুলতে দুলতে আমার অন্তরাত্মায় প্রগাঢ় আবেগ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আমার দু কাঁধের ওপর নেমে এলো বিরাশি সিক্কার দুখানি রাম রদ্দা । কতকটা সাংঘাতিক ঠোক্কর খাওয়ার মত মালুম হল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, আধা চোখ খুলে বললুম, 'ওরে আস্তে রে পাগল ! অমন করে কেউ মারে' ?
রাজু অকপট ভাবে বলল, 'এতক্ষন মেলোডি ছিল দাদা, এইবার রক দিচ্ছি'।
একথায় আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্ট্যাচুর মতো নিশ্চল হয়ে গেলাম। সে প্রাণান্তকর কথা অনুধাবন করতে খানিক সময় লাগল আমার মতো মূর্খের। যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। দু কথা বলার অবকাশ পর্যন্ত সে দিল না আমায়। তার আগেই আমার বাঁ হাতটা টেনে ধরে গামছার জল নিংড়ানোর মতো করে মোচড়াতে শুরু করলে। আমার চোখে কালবৈশাখীর আঁধার নেমে এল প্রায়।
ঢোঁক গিলে বললুম, 'একি কচ্ছিস রাজু ? হাতটা তো খুলে যাবে মাইরি' !
রাজু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলল, 'কি যে বলেন দাদা, হাত আবার অমনি খুলে যায় নাকি ! একি টেবিলের ড্রয়ার না আলমারির দরজা, যে টানলাম আর খুলে গেল' !
আমি প্রায় হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলাম, বললুম, 'ছেড়ে দে সোনাভাই আমার, ছেড়ে দে আমায়, যথেষ্ট হয়েছে আমি আর ম্যাসাজ নিতে চাইনা, এই অবধিই নেওয়ার ছিল আমার, আজ আর নয়.......'
রাজু শোনার পাত্র নয়। ঘাড় নেড়ে বললে, ' তা বললে কি হয় দাদা, এতদিন বাদে আপনি ম্যাসাজ নিচ্ছেন, অমন ছেড়ে দেয়া যায় নাকি ? সবে তো শুরু হল, এবার পিঠটা ভালো করে চাপড়ে দলাই মলাই না করলে মনেই হবে না যে ম্যাসাজ হচ্ছে'।
আমি কাতর ভাবে রাজুকে বললাম, 'দ্যাখ রাজু, এতদিন ম্যাসাজ নিইনি মানে এই নয়, যে আজ আমাকে পুরোটা উসুল করে নিতে হবে। আর তাছাড়া খামোখা আমার পিঠ চাপড়ে কি করবি বল ? বলার মতো তো তেমন কোনো কাজ করে উঠতে পারিনি আমি, সুতরাং অত তরিবত না করলেও চলবে......... আ - আমায় ছেড়ে দে ভাইটি.....'
রাজুর প্রত্যয়ী মুখে চোখে তেমন কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেল না। তবু আমি চেষ্টা করতে ছাড়লাম না। ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, 'শোন না, লক্ষ্মী ভাইটি, আমার না হঠাৎ একটা অফিসের কাজ মনে পড়েছে, বাড়িতে গিয়ে চট করে করতে হবে বুঝলি, আজ ছেড়ে দে, পরে নাহয় অন্য কোনো একদিন..........'
রাজু আমার ছেলে ভোলানো কথাকে অবলীলায় ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল, 'না দাদা, রোববারে আবার অফিসের কাজ কি, আর এতো কাজ করে করেই তো পিঠে ব্যথা হয়েছে। এরপর তো কোমর আছে, আপনি আরাম করে বসুন না, ঘাবড়াচ্ছেন কেন.....পিঠের বাইপাস ম্যাসাজটা আমি দেবই' ।
বাইপাস ম্যাসাজ !! আতঙ্কে আমার পেটের ভেতর সবকিছু যেন ফণীর ঝড়ের মতো গুলিয়ে উঠল। আমি প্রায় কেঁদে উঠে বললুম, 'ওরে ! আমার কোমরের দায়ভার তোর না নিলেও চলবে ভাই, বাঁকা পথ দিয়ে তাও মানুষ ভবনদী পেরোতে পারে কিন্তু ভাঙা কোমর নিয়ে আমি যে সরু নালাও টপকাতে পারব না'।
আমার কথার মর্মার্থ তার মাথায় ঢুকল কিনা জানি না কিন্তু আমাকে সে একেবারে প্রশ্রয় দিল না। বলল, 'অত ভয় পাচ্ছেন কেন দাদা, দেখুন না কেমন জম্পেশ টাইপের করে দিচ্ছি' ।
আড়চোখে দেখলাম, আশেপাশের লোকজন কেউই এই যাত্রাপালাটা মিস করছে না। দু চারজন সেলুনের বাইরেও জড়ো হয়েছে বিনি পয়সার কমেডি দেখবে বলে। আমার কেবলই মনে হতে লাগল আমার মতো অসহায় জীব এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ নেই।
তবে উল্টোদিক থেকে ভয় পাওয়ার কথা বললে চিরকালই বাঙালির পৌরুষে আঘাত লাগে, আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। ভিতরে ভিতরে কলজের মুড়োটা আচ্ছা করে বেঁধে নিলাম আমার দুঃসাহসের ফিতে দিয়ে। সাদা আলখাল্লার ভেতর দিয়ে প্রাণপণে চেয়ারের হ্যান্ডেল চেপে ধরলাম। এরপর যা শুরু হল তার সাথে একপ্রকার নটরাজের নৃত্যেরই তুলনা করা যায়।
কোনোমতে নাক মুখ গুঁজে নিরুপায় হয়ে সহ্য করতে লাগলাম সেসব। ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করল না। প্রীতি জিনটা নির্ঘাত শাহরুখ আর আমিরের সাথে মিলে আমায় ট্রোল করছে। মনে হল সেলুনের বাকিরাও ভোগের বাতাসের মতো সবটুকু সাঁতলে লুটেপুটে নিচ্ছে। আমি প্রায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম। সীতা হলে বলতুম - ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু এখানে কোনো কিছুই বলে উঠতে পারলুম না। আর বললেই বা ! শুনছে কৈ ?
পিঠ চাপড়ানো শেষ হতে রাজু এবার কোমর নিয়ে পড়ল। যা চলল তাতে করে কোমরের কৌমার্য হরণ হল বলা যায়। চোখের সামনে আমার বাঁচার কোনো রাস্তাই আর খোলা দেখতে পেলুম না। কোমরের ওপর দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে সে আমার শিরদাঁড়ার প্রতিটা হাড় যথাস্থানে আছে কিনা একেবারে অর্থোপেডিক ডাক্তারের মতো পরখ করতে লাগল। আয়নায় নিজের কাতর মুখটা দেখে আমি আরও বিমর্ষ হয়ে পড়লুম। নিজের এতো করুন মুখ আমি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমার অন্তঃরাত্মা হাহাকার করে উঠল সে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ম্যাসাজের ঠেলায়।
আরো মিনিট দশেক বাদে সে বিষাক্ত তান্ডব শেষ হল। ঝড়ের শেষে তালগাছ যেমন একদিকে হেলে নুয়ে পড়ে, আমিও কতকটা ডানদিকে হেলে কাত হয়ে গেলাম। চেয়ারের হ্যান্ডেলের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে তৃভঙ্গমুরারীর কায়দায় উঠে দাঁড়ালাম। রাজু একগাল হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। বুঝতে পারলাম দারুন বা সাবাশ টাইপের কিছু একটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মনে হল ওর চুলের মুঠিটা ধরে সামনের আয়নায় মাথাটা ঠুকে চুরমার করে দিই। পুলিশি হ্যাপা আমার পোষাবে না ভেবে ওই প্ল্যান ভেস্তে দিলুম মনে মনেই। বিশেষ কিছুই আর বলতে ইচ্ছে করল না আমার, তবু কোনোরকমে দাঁত চেপে, বাঁকা মুখ করে বললাম, 'টাকাটা রাখ, পুজো ভালো কাটাস.......'
বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে। বহুযুগ আগে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় মহাভারত সিরিয়ালে শকুনির চরিত্রে গুফি পেন্টাল যেভাবে হেঁটেছিল আমিও কার্যত কতকটা তেমনই আধা খুঁড়িয়ে আধা বেঁকে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা চালালুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম ম্যাসাজের মায়াজালে আর নয় রে ভাই। যতই হোক, পিতৃদত্ত প্রাণের সাথে ছেলেখেলা করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।
যাঁরা নিয়মিত ম্যাসাজ নেন এবং ম্যাসাজ নেওয়াটাকে প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছেন তাঁরা নিশ্চই ভাবছেন, ওঃ ! ছেলের যেন ননীর শরীর, সামান্য ম্যাসাজেই কাতর হয়ে পড়েছে ! কৈ ! আমরা তো এতো বছর ধরে নিচ্ছি আমাদের তো কিছু হয়নি। তাঁদেরকে হাত জোড় করে বলি, আপনারা প্রণম্য ব্যক্তি, ঈশ্বর আপনাদের সাহস ও শক্তি দুটোই দিয়েছেন। তবে বিশ্বাস করুন, এর থেকে মেট্রো বা বনগাঁ লোকালের ভিড় সামলানো সহজ, সারারাত কালী পুজোর মাইকের অত্যাচার এর কাছে নস্যি, এমনকি খালি পায়ে গরম পিচের রাস্তায় হাঁটাও সুখের, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তাতে করে ম্যাসাজ কথাটা আমার কাছে যে আমৃত্যু বিভীষিকাময় অসুর হয়েই থাকবে এ বলাই বাহুল্য......
তবে আপনাদের সবার পুজো নির্ভাবনায় ও নির্বিবাদে ভালো কাটুক এই কামনা করি......শুভ শারদীয়া।
#pujobarshiki #bengalishortstories #pujastories #bengalihumours #molat #DebdattaSinha
পিছন থেকে শুরু করে কানের দুপাশ দিয়ে রাজুর কাঁচি নির্বিবাদ চলতে লাগল। আর আমিও সামনের আয়নায় আমার চুলের ব্রেকিং নিউজ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। পেছনের দেওয়ালে শাহরুখ আর আমির আমার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে। প্রীতি জিন্টা সমানে মুচকি হাসছে। খানিক বাদে এই খুনখারাপির অবসান ঘটল। বরাবরই আমার চুল কাটতে বিশেষ সময় লাগে না। কমতে কমতে বর্তমান সময়ে এসে মাথার ওপর যে ক'গাছা পড়ে আছে তা ছোটবেলার স্মৃতি আর গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘাড়ের চারিদিকে খোঁচাওয়ালা পাউডার লাগিয়ে দিল রাজু। এই জিনিসটা তাকে প্রত্যেকবার বারণ করা হলেও সে শোনে না। খামোখা অত পাউডার লাগিয়ে ফুলবাবু সাজিয়ে ঠিক কি লাভ হয় বুঝিনা। অথবা হয়ত ভাবে, যে এই অবস্থায় ঠাকুর দেখে আসা সম্ভব.....
সমস্তটা হয়ে যাওয়ার পর রাজু জিজ্ঞেস করল, 'ওউর বলেন দাদা.........'
আমি খানিক ইতস্ততঃ করে বললাম, 'ইয়ে মানে তুমি তো ম্যাসাজ করো দেখি। আমার ঘাড় আর মাথার দিকটা একটু করে দিতে পারো......সকাল থেকে বড্ড টনটন করছে'।
রাজুর সারা মুখমন্ডল জুড়ে শরতের রোদ খেলে গেল যেন। আমার এহেন আবদার সে যে কিভাবে পূরণ করবে ভেবেই পেল না। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললে, 'আরে কি বলছেন দাদা, একদমসে করে দেব। আপনাকে এমন স্পেশাল ম্যাসাজ দেব যে আপনার নেশা লেগে যাবে'।
মনে মনে ভারি আশ্চর্য হলাম, 'ম্যাসাজের নেশা ! এ ব্যাটা বলে কি ! এতেও কি মানুষের আসক্তি আছে নাকি ? অবশ্যি তথাকথিত ম্যাসাজ পারলারের যে সমস্ত খবর কানে আসে তাতে করে ম্যাসাজ বিষম বস্তু হতেই পারে বৈকি'।
সে যাই হোক, রাজু সামনের ড্রয়ার খুলে সযত্নে চিরুনি আর কাঁচি রেখে দিল তাতে। তারপর দু হাত ওপরে তুলে নিজের দশটা আঙ্গুল কটমট করে ফাটিয়ে নিল। ঘাড়টা দুপাশে কাত করে নানান কায়দায় কসরত করে রেডি হয়ে গেল একেবারে। বক্সিং শুরু করার আগে ফাইটাররা যেমন করে থাকে, কতকটা সেই রকম। আমার কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এ যেন বল্লালদেবকে নিকেশ করার আগে বাহুবলী প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিনেমার দৃশ্যটা ভেবেই আমার গলা শুকিয়ে এল একেবারে। কেবলই মনে হতে লাগল একটু বেশি রিস্ক নিয়ে ফেললাম নাতো !
অবশ্য খুব একটা ভাবার অবকাশ পেলাম না। কারণ ততক্ষনে রাজু দুহাত দিয়ে কপ করে আমার মাথাটা ধরে ফেলেছে। দু আঙুলের মুদ্রায় কপালের সামনেটা টেনে টেনে ধরতে লাগল। তারপর একইভাবে ভাবে কপালের দুপাশে চক্রাকারে আঙ্গুল ঘোরাতে লাগল। বেশ আরাম পেলাম। মনে মনে রাজুর প্রতিভার তারিফ না করে পারলাম না। এরপর মাথার পিছন দিকটায় দু হাত দিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে জড়ো করে আঙুলের বিশেষ কায়দায় চটপটি বাজনার মতো করে ফটাফট শব্দ করতে লাগল। মাথার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের তরঙ্গ খেলে গেল যেন। দু চোখে অপার শান্তির ঘুম নেমে এলো আমার। কয়েক মুহূর্ত সেলুন আর স্বর্গের তফাৎ করতে পারলাম না।
বেশ খানিকক্ষণ এমনটা হবার পরে রাজু আমার কাঁধের দিকে নেমে এল। ফেনিল মসৃন ঢেউয়ের মতো সে আমার কাঁধের ওপর ছোট ছোট অবকাশে আঙ্গুল চালাতে লাগল। এমন স্তিমিত মৃদু অঙ্গুলিচালনায় মনে মনে একেবারে নিশ্চিত হলাম যে ম্যাসাজ কম্পিটিশনের ওয়ার্ল্ড কাপটা একমাত্র রাজুরই পাওয়া উচিত। এমন চমৎকার ট্যালেন্ট বুড়োশিবতলার গলিতে অবহেলায় ও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে ভেবে মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল।
হর্ষ আর করুণার দোলাচলে দুলতে দুলতে আমার অন্তরাত্মায় প্রগাঢ় আবেগ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আমার দু কাঁধের ওপর নেমে এলো বিরাশি সিক্কার দুখানি রাম রদ্দা । কতকটা সাংঘাতিক ঠোক্কর খাওয়ার মত মালুম হল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, আধা চোখ খুলে বললুম, 'ওরে আস্তে রে পাগল ! অমন করে কেউ মারে' ?
রাজু অকপট ভাবে বলল, 'এতক্ষন মেলোডি ছিল দাদা, এইবার রক দিচ্ছি'।
একথায় আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্ট্যাচুর মতো নিশ্চল হয়ে গেলাম। সে প্রাণান্তকর কথা অনুধাবন করতে খানিক সময় লাগল আমার মতো মূর্খের। যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। দু কথা বলার অবকাশ পর্যন্ত সে দিল না আমায়। তার আগেই আমার বাঁ হাতটা টেনে ধরে গামছার জল নিংড়ানোর মতো করে মোচড়াতে শুরু করলে। আমার চোখে কালবৈশাখীর আঁধার নেমে এল প্রায়।
ঢোঁক গিলে বললুম, 'একি কচ্ছিস রাজু ? হাতটা তো খুলে যাবে মাইরি' !
রাজু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলল, 'কি যে বলেন দাদা, হাত আবার অমনি খুলে যায় নাকি ! একি টেবিলের ড্রয়ার না আলমারির দরজা, যে টানলাম আর খুলে গেল' !
আমি প্রায় হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলাম, বললুম, 'ছেড়ে দে সোনাভাই আমার, ছেড়ে দে আমায়, যথেষ্ট হয়েছে আমি আর ম্যাসাজ নিতে চাইনা, এই অবধিই নেওয়ার ছিল আমার, আজ আর নয়.......'
রাজু শোনার পাত্র নয়। ঘাড় নেড়ে বললে, ' তা বললে কি হয় দাদা, এতদিন বাদে আপনি ম্যাসাজ নিচ্ছেন, অমন ছেড়ে দেয়া যায় নাকি ? সবে তো শুরু হল, এবার পিঠটা ভালো করে চাপড়ে দলাই মলাই না করলে মনেই হবে না যে ম্যাসাজ হচ্ছে'।
আমি কাতর ভাবে রাজুকে বললাম, 'দ্যাখ রাজু, এতদিন ম্যাসাজ নিইনি মানে এই নয়, যে আজ আমাকে পুরোটা উসুল করে নিতে হবে। আর তাছাড়া খামোখা আমার পিঠ চাপড়ে কি করবি বল ? বলার মতো তো তেমন কোনো কাজ করে উঠতে পারিনি আমি, সুতরাং অত তরিবত না করলেও চলবে......... আ - আমায় ছেড়ে দে ভাইটি.....'
রাজুর প্রত্যয়ী মুখে চোখে তেমন কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেল না। তবু আমি চেষ্টা করতে ছাড়লাম না। ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, 'শোন না, লক্ষ্মী ভাইটি, আমার না হঠাৎ একটা অফিসের কাজ মনে পড়েছে, বাড়িতে গিয়ে চট করে করতে হবে বুঝলি, আজ ছেড়ে দে, পরে নাহয় অন্য কোনো একদিন..........'
রাজু আমার ছেলে ভোলানো কথাকে অবলীলায় ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল, 'না দাদা, রোববারে আবার অফিসের কাজ কি, আর এতো কাজ করে করেই তো পিঠে ব্যথা হয়েছে। এরপর তো কোমর আছে, আপনি আরাম করে বসুন না, ঘাবড়াচ্ছেন কেন.....পিঠের বাইপাস ম্যাসাজটা আমি দেবই' ।
বাইপাস ম্যাসাজ !! আতঙ্কে আমার পেটের ভেতর সবকিছু যেন ফণীর ঝড়ের মতো গুলিয়ে উঠল। আমি প্রায় কেঁদে উঠে বললুম, 'ওরে ! আমার কোমরের দায়ভার তোর না নিলেও চলবে ভাই, বাঁকা পথ দিয়ে তাও মানুষ ভবনদী পেরোতে পারে কিন্তু ভাঙা কোমর নিয়ে আমি যে সরু নালাও টপকাতে পারব না'।
আমার কথার মর্মার্থ তার মাথায় ঢুকল কিনা জানি না কিন্তু আমাকে সে একেবারে প্রশ্রয় দিল না। বলল, 'অত ভয় পাচ্ছেন কেন দাদা, দেখুন না কেমন জম্পেশ টাইপের করে দিচ্ছি' ।
আড়চোখে দেখলাম, আশেপাশের লোকজন কেউই এই যাত্রাপালাটা মিস করছে না। দু চারজন সেলুনের বাইরেও জড়ো হয়েছে বিনি পয়সার কমেডি দেখবে বলে। আমার কেবলই মনে হতে লাগল আমার মতো অসহায় জীব এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ নেই।
তবে উল্টোদিক থেকে ভয় পাওয়ার কথা বললে চিরকালই বাঙালির পৌরুষে আঘাত লাগে, আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। ভিতরে ভিতরে কলজের মুড়োটা আচ্ছা করে বেঁধে নিলাম আমার দুঃসাহসের ফিতে দিয়ে। সাদা আলখাল্লার ভেতর দিয়ে প্রাণপণে চেয়ারের হ্যান্ডেল চেপে ধরলাম। এরপর যা শুরু হল তার সাথে একপ্রকার নটরাজের নৃত্যেরই তুলনা করা যায়।
কোনোমতে নাক মুখ গুঁজে নিরুপায় হয়ে সহ্য করতে লাগলাম সেসব। ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করল না। প্রীতি জিনটা নির্ঘাত শাহরুখ আর আমিরের সাথে মিলে আমায় ট্রোল করছে। মনে হল সেলুনের বাকিরাও ভোগের বাতাসের মতো সবটুকু সাঁতলে লুটেপুটে নিচ্ছে। আমি প্রায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম। সীতা হলে বলতুম - ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু এখানে কোনো কিছুই বলে উঠতে পারলুম না। আর বললেই বা ! শুনছে কৈ ?
পিঠ চাপড়ানো শেষ হতে রাজু এবার কোমর নিয়ে পড়ল। যা চলল তাতে করে কোমরের কৌমার্য হরণ হল বলা যায়। চোখের সামনে আমার বাঁচার কোনো রাস্তাই আর খোলা দেখতে পেলুম না। কোমরের ওপর দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে সে আমার শিরদাঁড়ার প্রতিটা হাড় যথাস্থানে আছে কিনা একেবারে অর্থোপেডিক ডাক্তারের মতো পরখ করতে লাগল। আয়নায় নিজের কাতর মুখটা দেখে আমি আরও বিমর্ষ হয়ে পড়লুম। নিজের এতো করুন মুখ আমি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমার অন্তঃরাত্মা হাহাকার করে উঠল সে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ম্যাসাজের ঠেলায়।
আরো মিনিট দশেক বাদে সে বিষাক্ত তান্ডব শেষ হল। ঝড়ের শেষে তালগাছ যেমন একদিকে হেলে নুয়ে পড়ে, আমিও কতকটা ডানদিকে হেলে কাত হয়ে গেলাম। চেয়ারের হ্যান্ডেলের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে তৃভঙ্গমুরারীর কায়দায় উঠে দাঁড়ালাম। রাজু একগাল হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। বুঝতে পারলাম দারুন বা সাবাশ টাইপের কিছু একটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মনে হল ওর চুলের মুঠিটা ধরে সামনের আয়নায় মাথাটা ঠুকে চুরমার করে দিই। পুলিশি হ্যাপা আমার পোষাবে না ভেবে ওই প্ল্যান ভেস্তে দিলুম মনে মনেই। বিশেষ কিছুই আর বলতে ইচ্ছে করল না আমার, তবু কোনোরকমে দাঁত চেপে, বাঁকা মুখ করে বললাম, 'টাকাটা রাখ, পুজো ভালো কাটাস.......'
বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে। বহুযুগ আগে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় মহাভারত সিরিয়ালে শকুনির চরিত্রে গুফি পেন্টাল যেভাবে হেঁটেছিল আমিও কার্যত কতকটা তেমনই আধা খুঁড়িয়ে আধা বেঁকে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা চালালুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম ম্যাসাজের মায়াজালে আর নয় রে ভাই। যতই হোক, পিতৃদত্ত প্রাণের সাথে ছেলেখেলা করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।
যাঁরা নিয়মিত ম্যাসাজ নেন এবং ম্যাসাজ নেওয়াটাকে প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছেন তাঁরা নিশ্চই ভাবছেন, ওঃ ! ছেলের যেন ননীর শরীর, সামান্য ম্যাসাজেই কাতর হয়ে পড়েছে ! কৈ ! আমরা তো এতো বছর ধরে নিচ্ছি আমাদের তো কিছু হয়নি। তাঁদেরকে হাত জোড় করে বলি, আপনারা প্রণম্য ব্যক্তি, ঈশ্বর আপনাদের সাহস ও শক্তি দুটোই দিয়েছেন। তবে বিশ্বাস করুন, এর থেকে মেট্রো বা বনগাঁ লোকালের ভিড় সামলানো সহজ, সারারাত কালী পুজোর মাইকের অত্যাচার এর কাছে নস্যি, এমনকি খালি পায়ে গরম পিচের রাস্তায় হাঁটাও সুখের, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তাতে করে ম্যাসাজ কথাটা আমার কাছে যে আমৃত্যু বিভীষিকাময় অসুর হয়েই থাকবে এ বলাই বাহুল্য......
তবে আপনাদের সবার পুজো নির্ভাবনায় ও নির্বিবাদে ভালো কাটুক এই কামনা করি......শুভ শারদীয়া।
#pujobarshiki #bengalishortstories #pujastories #bengalihumours #molat #DebdattaSinha







