এ কথায় মৈথিলী সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে যায়। আঙুলের নখ দিয়ে চেয়ারের কোন খুঁটতে থাকে। কিছুক্ষন বাদে ডঃ সেন আবার কোমলস্বরে জিজ্ঞেস করেন, 'আমি জানি মৈথিলী, জীবনের কিছু কিছু প্রশ্ন বড্ড জটিল হয়, কিন্তু তার উত্তর না পেলে যে আমার চিকিৎসা পদ্ধতি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুতরাং, আপনার মনে এই সময় কি চলছে সেটা জানা ভীষণ জরুরী'।
কিছুক্ষন নীরব থেকে অস্ফুটে বলে ওঠে মৈথিলী, 'আমি সঠিক জানি না, তবে এই ক দিনে আমার কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে জানেন, প্রতিদিন দেখতে দেখতেই হয়তো........এক অদ্ভুত চাহিদা তৈরী হয়েছে, তবে সেটাকে ইমোশনাল এট্যাচমেন্ট বলে কিনা আমার জানা নেই ডক্টর'।
- আচ্ছা, আপনি বলছিলেন আপনাকে কেউ ফলো করছে কয়েকদিন ধরে, তাকে দেখেছেন কখনো ?
- না, আসলে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের গলিটা বেশ অন্ধকার থাকে, তাই হয়তো তেমন ঠাহর করে উঠতে পারিনি। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে, হয়তো বা আমারই মনের ভুল। হয়তো তেমন কিছু নয়। সবটাই মিথ্যে।
ডঃ সেন ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা পঞ্চাশ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, 'বেশ, আজ বরং এই অবধিই থাক মৈথিলী। আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। পরপর কয়েকদিন নিয়ম করে খেয়ে যান। সপ্তাহখানেক বাদে আবার আসবেন। তখন নাহয় আমরা আরেকটা সেশন করব। কেমন' ?
মৈথিলী প্রেসক্রিপশন ভাঁজ করতে করতে বলে, 'আয়নায় অন্য মুখ দেখা একদমই স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তা আমি জানি ডক্টর। আর তাছাড়া আমি ভূত প্রেতে মোটেই বিশ্বাস করি না। করলে একা ফ্ল্যাটে কিছুতেই থাকতে পারতাম না। আমি জানি না কেন এমনটা হচ্ছে । আচ্ছা ডক্টর,....আমার ঠিক কি হয়েছে সেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন ?
- কিছুটা........যদিও আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হবে আপনি হ্যালুসিনেট করছেন।
- হ্যালুসিনেশন !! কিন্তু কেন ?
- সেই প্রশ্নের উত্তরটাই তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে মৈথিলী। আমার বিশ্বাস সে প্রশ্নের উত্তর আগামী সেশনেই পাব। আপাততঃ আপনি ওষুধগুলো খেয়ে যান। চিন্তার কিছু নেই। বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট কার্ল জাং কি বলেছেন জানেন ?
মৈথিলী দুদিকে ঘাড় নাড়ে।
- বলেছেন, 'who looks outside.......dreams ; who looks inside......awakes'। সুতরাং, মনের ভেতরের মানুষটাকে জানা খুব প্রয়োজন, ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট সেটা.........আমাদের আবার দেখা হবে মৈথিলী।
ডঃ সেন দুহাত জড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন। মৈথিলী প্রতিনমস্কার করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডঃ সেন চিন্তাক্লিষ্ট মুখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে, মনে মনে সম্ভাব্য ঝড়ের আভাস টের পেলেন বোধহয়।
সপ্তাহখানেক বাদে। ডঃ সেনের চেম্বারে মৈথিলীকে অনেকটা ক্লান্তিমুক্ত লাগে। মুখের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ ভাব লক্ষ্য করা যায়। 'কেমন আছেন মৈথিলী' ? মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করেন ডঃ সেন।
- আগের থেকে ভালো....
- ওষুধগুলো ঠিকঠাক চলছে তো ?
- হ্যাঁ, যেমনটা বলে দিয়েছেন..... ইদানীং রাত্রে ভালো ঘুম হচ্ছে।
- বেশ বেশ, এতো সুখবর......
একথায় আলগা হাসে মৈথিলী। ডঃ সেন দু চোখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'এর মধ্যে সেই মুখটা আর দেখতে পেলেন' ?
- রোজ দেখিনি, তবে এই কদিনে বার দুয়েক দেখেছি....
- কোথায় ? বাড়িতে না বাইরে ?
- বাড়িতেই.....
- চিনতে পারলেন ?
- নাহ, কিন্তু আগের বারের মতো এবারেও ভীষণ চেনা মনে হলো জানেন।
- হুমমম........... কোনোরকম কথার আদান প্রদান ?
- নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম.....
- কি বলল ?
- কিছু বলেনি, শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে.....
- কিন্তু তার নাম তো আপনার জানার কথা, তাই না মৈথিলী ?
'আমার জানার কথা' !! মৈথিলী বিস্মিত হয় খুব। 'এ আপনি কি বলছেন ডঃ সেন ? আমি জানলে কি আপনাকে বলতাম না.....'
ডঃ সেন বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুলে বললেন, 'এমনও তো হতে পারে আপনি বলতে চান না......'
- এ কেমন কথা ডক্টর ! নাম লুকিয়ে আমার কি লাভ ? আর খামোকা লুকোতেই বা যাব কেন ?
- বেশ........আমরা একটা কাজ করি বরং মৈথিলী, আজ আপনি আপনার অতীতের কথা বলুন আমাকে, যতটা পারবেন.....আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো সূত্র আমরা পাবই। কি, বলবেন তো ?
- বেশ, বলব.....
ডঃ সেন নিজের চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে এলেন সামনে, ঈষৎ ঝুঁকে বললেন, 'আপনি যাতে মুক্তমনে সবটা বলতে পারেন তার জন্য আমাকে সামান্য হিপটোনিজমের সাহায্য নিতে হবে। শুধু আপনি মনের দরজা জানলাগুলো সম্পূর্ণ খুলে রাখবেন, তাতে আপনার ভার লাঘব হবে শতগুন। আমি কথা দিচ্ছি, এতে কোনোরকম ঝুঁকি নেই'। মৈথিলী মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে । দুহাত কোলের ওপর জড়ো করে নিস্তব্ধ বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত। ডঃ সেন মৈথিলীর মনের ভাব আন্দাজ করতে পেরে বললেন, 'দেখুন, এই হিপ্নোটিজমটা সম্পূর্ণ আপনার সম্মতির ওপরেই নির্ভর করছে। আপনি রাজি না হলে আমি কখনোই জোর করব না'। মৈথিলী মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, 'আমি জানি ডক্টর, আমায় শুধু বলুন আপনি কি জানতে পারবেন ওই মুখটা কার' ?
- আমার বিশ্বাস আমি পারব, যদি আপনি কোয়াপরেট করেন তবেই......
মৈথিলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।
ডঃ সেন উঠে গিয়ে জানালার সবকটা পর্দা টেনে দিলেন। ঘরের আলো নিভিয়ে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে দিয়ে মৈথিলীর মুখোমুখি বসলেন। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র ধীরে ধীরে ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল যেন। আবছা আলোয় শুধুমাত্র দুজনের মুখ আলোকিত হয়ে রইল অজ্ঞাত কাহিনীর প্রত্যাশায়। পকেট থেকে একটা সরু ফাউন্টেন পেন বের করে আনলেন ডঃ সেন। অস্ফুটে বললেন, 'আপনি সমস্ত কিছু ভুলে যান মৈথিলী, শুধুমাত্র এই পেনের মুখের দিকে ফোকাস করুন, কোনোভাবেই এর থেকে চোখ সরাবেন না'। তারপর মৈথিলীর চোখের সামনে এক অদ্ভুত ঢিমে ছন্দে পেনটা দোলাতে লাগলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মৈথিলীর চোখ আঁটকে গেল পেনের মুখে। পেনের দুলুনির সাথে সাথে মৈথিলীর চোখও সরতে লাগলো সমানতালে। ডঃ সেন অত্যন্ত ধীরগম্ভীর গলায় বললেন, 'অতীতের কথা মনে করুন মৈথিলী, অতীতের কথা আমায় বলুন.......আপনি কি কিছু মনে করতে পারছেন..... দেখতে পাচ্ছেন কিছু' ? মায়াময় পরিবেশে মৈথিলীর চোখ বুজে এল আপনা আপনি। এক স্তিমিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল যেন বহুদূর থেকে, 'কলেজ..............ক্যান্টিন.............'
- আর কি দেখতে পাচ্ছেন ?
- আমি বসে আছি ............সামনে দুমড়ানো মুচড়ানো একটা কাগজ..........
- কিসের কাগজ ?
- চিঠি..............ইন্দ্রনীলকে লিখেছিলাম.........
- তারপর ?
-সে ফেরত দিয়ে গেছে.........বলেছে আমার গার্লফ্রেন্ড হবার যোগ্যতা নেই........আমি কাঁদছি.......একা.....
- আর কি দেখছেন মৈথিলী ?
কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা......... আবার মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এল.......
- আউট্রাম ঘাট................হাওড়া ব্রিজ.............চারিদিকে সন্ধ্যের আলো জ্বলছে........
- আপনি একা ?
- না...............পারিজাত আছে......
- পারিজাত ?
- পুরোনো অফিসের কলিগ.......
- কি বলছে পারিজাত ?
- বিয়ে করতে পারবে না...........
- কেন ?
- বাড়িতে...............সুন্দরী বৌ চায়...............আলো নিভে যাচ্ছে.........আমি কাঁদছি.............একা.......
- আর কিছু মনে পড়ছে মৈথিলী, আর কিছু ?
মৈথিলীর চোখের পাশ দিয়ে সরু জলের রেখা গড়িয়ে পড়তে থাকে। ডঃ সেন গলাটা আরও এক খাদ নিচে নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'বলুন মৈথিলী........আমায় বলতে থাকুন, থামবেন না.......'। মৈথিলী নিরুত্তর বসে থাকে......সামান্য ঠোঁট নড়ে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ পাওয়া যায় না, চোখের পাতা কাঁপতে থাকে তিরতির করে। এমন সময় হঠাৎ, ঘরের সমস্ত নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে এক চাপা অথচ কঠিন পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে ওঠে মৈথিলীর ভেতর থেকে।
"আপনি কেন মৈথিলীকে কষ্ট দিচ্ছেন ? কি চান আপনি"..........??
চমকে ওঠেন ডঃ সেন। দু হাতে চেয়ারের হাতলদুটো আঁকড়ে ধরেন উত্তেজনায়। বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে থাকেন মৈথিলীর দিকে। সন্দেহের তীর যে এতো অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যভেদ করবে বিশ্বাস করতে পারেন না। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, 'ক্কে, কে কথা বলল' ? কিছুক্ষনের শীতল নীরবতা বয়ে যায় সমস্ত ঘর জুড়ে । ডঃ সেন আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, 'বলুন, কথা বলুন, কে আপনি'। কোনো এক অতল গভীর থেকে সে পুরুষ কণ্ঠস্বর আবার কথা বলে ওঠে, 'আমি ময়ূখ..... ময়ূখ দাশগুপ্ত'।
- ময়ূখ !! কে ময়ূখ ?
- আমি মৈথিলীকে ভালোবাসি......
ডঃ সেন প্রায় হাঁ হয়ে গেলেন এই কথায়। কিছুক্ষনের জন্য মুখে কোনো কথা সরল না। পরক্ষণেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, 'আপনাদের পরিচয় হল কি করে' ?
- মৈথিলী আমাকে চিঠি লিখত।
- চিঠি লিখত !! আপনাকে ?
- হ্যাঁ........প্রতি রাত্রে নিয়ম করে...........ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয় ......আমরা ভালোবাসতে শুরু করি একে অপরকে।
- মৈথিলী আপনাকে ভালোবাসে ? আপনাকে বলেছে সে কথা ?
- হ্যাঁ বলেছে, চিঠির মধ্যে দিয়ে.......নিঃশব্দে জেনেছি আমরা একে অপরকে.............. প্রতিনিয়ত আয়নার মধ্যে দিয়ে খুঁজে নিয়েছি দুজনকে ..............মৈথিলী আমার প্রাণ...........মৈথিলী আমার প্রেম।
- কিন্তু......আপনি তো মৈথিলীরই অন্য স্বত্বা। নিজের সাথেই নিজের সম্পর্ক তৈরী হওয়া..... এ কি করে সম্ভব ?
- নিজেকে ভালোবাসা অপরাধ নাকি ডাক্তার ? কে বলে ?
- কিন্তু আপনি মৈথিলীর দুর্বলতাকে আশ্রয় করে তার মনে বাসা বেঁধেছেন......একথা মৈথিলী জানলে সে কখনোই আপনাকে প্রশ্রয় দিত না।
'আপনি ভুল বলছেন ডঃ সেন', চিৎকার করে ওঠে পুরুষ কণ্ঠস্বর, 'আপনি ভুল..........আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক, বেঁচে থাকার প্রেরণা'।
- না আমি ভুল নই ময়ূখ, আমি একজন স্পেশালিস্ট ডাক্তার, সমস্তটা জেনেই আমি বলছি। পক্ষান্তরে আপনি মৈথিলীর চরম ক্ষতি করছেন।
- আমি ক্ষতি করছি মৈথিলীর ? আমি !!
- অবশ্যই করছেন, একটা অবাস্তব সম্পর্কের বন্ধনে মৈথিলীর মনস্তত্বে আপনি ধীরে ধীরে ক্ষত সৃষ্টি করছেন। সময়ের সাথে সাথে সে ক্ষতের আকার এমন বিপর্যয় ডেকে আনবে, তখন মৈথিলীকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
- না না, আমি মানি না, আপনার সমস্ত কথা মিথ্যে।
- আমার কথা বিশ্বাস করুন ময়ূখ, আপনি বরং মৈথিলীকে বোঝান, সে নিশ্চই বুঝবে আপনার কথা। সময় বিশেষে তার কষ্ট হবে একথা ঠিক, কিন্তু এই অলীক সম্পর্কের জেরে মৈথিলীকে আপনি অজান্তেই নিদারুন বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। আপনি কি চান না মৈথিলী সুস্থ হয়ে আর চার পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকুক ? ভালোবেসেছেন যখন, তখন ভালোবাসাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্য নয় কি ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আবার একা হয়ে পড়বে ? তখন ?
- উনি আজ একা আছেন, কাল নাও থাকতে পারেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকায় আপনি অন্তরায় হবেন কেন ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আমায় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে.......
- ঠিক, কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঘটনার অস্বাভাবিকতায় সে নিজেই একজন ডাক্তারের পরামর্শ চেয়েছে। সুতরাং আপনি যদি তার বাস্তব হতেন তাহলে সে কখনোই আমার কাছে আসতো না। তাই না ??.....বলুন ময়ূখ ? বলুন আমাকে......
বিপরীত চরিত্র নিরুত্তর থাকে । ডঃ সেন অধৈর্য হয়ে ওঠেন, বলেন, 'কথা বলুন ময়ূখ, কথা বলুন আমার সাথে'। কিন্তু ময়ূখের দিক থেকে আর কোনো রকম সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। বারকয়েকের চেষ্টাতেও যখন ময়ূখ নীরব থাকে তখন উপায়ন্তর না দেখে ডঃ সেন নিজস্ব পদ্ধতিতে মৈথিলীকে জাগিয়ে তোলেন ধীরে ধীরে। মৈথিলী কোনো এক গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে নির্বাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। ঘরের সমস্ত আলো জ্বালিয়ে দিয়ে ডঃ সেন নিজের চেয়ারে এসে বসেন। 'একটু জল', মিনমিন করে বলে মৈথিলী। মৈথিলীর সামনে একটা জলের গ্লাস রাখেন ডঃ সেন। ঢকঢক করে সমস্ত জলটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে মৈথিলী। চোখেমুখে অপার ক্লান্তি নিয়ে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসে চেয়ারে।
ডঃ সেন চশমা মুছতে মুছতে বলেন, 'মনস্তত্ব বড় জটিল জিনিস মৈথিলী। মানুষের মনের হদিস পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার, বিশেষ করে সে মন যদি রোগাক্রান্ত হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে মানুষের মন হচ্ছে কতকটা সমুদ্রের মতো। আমরা সাইকিয়াট্রিস্টরা সেই সমুদ্রের মাঝে ডুব দিয়ে কিছু কিছু স্পন্দন ছুঁয়ে আসতে পারি মাত্র। অধিকাংশটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আপনার ক্ষেত্রেও কতকটা তাই ঘটেছে। বেশ কিছুটা জানতে পেরেছি, বাকিটা সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পাবে আশা করি.....'। মৈথিলী অবাক হয়ে বলে, 'আপনি ঠিক কি বলছেন, আমি তো কিছুই............'।
'বলছি', স্মিত হাসেন ডঃ সেন, চশমাটা গলিয়ে নিয়ে বলেন, 'আপনার যে রোগটি হয়েছে সেটি সচরাচর দেখা যায় না। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার, সংক্ষেপে ডিআইডি। প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার। অর্থাৎ একই দেহের মধ্যে একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি। আমার অনুমান এই রোগ সম্বন্ধে আপনি শুনে থাকবেন আগে, কারণ এই বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্বে রিসার্চ চলছে এবং অগণিত বই ও সিনেমাও বেরিয়েছে। মৈথিলী একরাশ বিস্ময় মিশিয়ে বলে, 'আর.... আর সেই মুখটা, সেই মুখটার ব্যাপারে জানতে পারলেন কিছু' ?
-যে মুখ আপনি আয়নায় দেখেছেন সে আপনারই ছায়া মৈথিলী, আপনার অবিচ্ছেদ্য প্রতিবিম্ব.......
মৈথিলী বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, 'কেমন করে.......? উত্তরে ডঃ সেন বলেন, 'একাধিক প্রত্যাখ্যান ও বহুদিনের নিঃসঙ্গতার কারণে আপনি মনে মনে এমন এক পুরুষ চরিত্রের কল্পনা করেছেন যে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে কোনোরকম কারণ ছাড়াই। বিশেষত রূপের কারণে তো নয়ই। আমরা সাধারণ মানুষ সেটাই চেয়ে থাকি, কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার দরুণ আপনার ক্ষেত্রে সে ভালোবাসার আবির্ভাব ঘটেনি বলেই আপনি এক কাল্পনিক প্রেমিকের চিত্র এঁকেছেন মনে মনে। রাতের পর রাত প্রেমপত্র লিখেছেন কোনো এক অজ্ঞাত ভালোবাসার মানুষকে। এবং পরবর্তীকালে, অজান্তেই, 'ময়ূখ দাশগুপ্ত' নাম দিয়ে আপনি হাজির করেছেন সেই কল্পনার পুরুষকে। আপনার কল্পনার তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি তাকে বিভিন্ন জায়গায় হ্যালুসিনেট করতে শুরু করেন, কখনো বাড়িতে আবার কখনো বাইরে। কিন্তু আপনি আমাকে একটা ছোট্ট অথচ ভাইটাল ইনফরমেশন চেপে গেছেন। আমার বিশ্বাস আপনার এই চিঠি লেখালিখিটা আরও আগের থেকেই। কিন্তু পরে যখন আপনি চোখের সামনে একটা মুখ দেখতে পেলেন তখনই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। কারণ আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এইবার এই ঘটনাগুলো একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। তবে যেহেতু এটা আর্লি স্টেজ এবং আপনার মৈথিলী সত্ত্বার প্রভাব অনেকাংশেই বেশি তাই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কিছুটা এড়ানো গেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেতে সময় লাগবে এখনো।
মৈথিলী উদ্বিগ্ন মুখে বলে, 'তাহলে ডক্টর, এখন উপায়' ?
- একমাত্র উপায় হচ্ছে রেগুলার কাউন্সেলিং, নিয়মিত কিছু ওষুধ খাওয়া ও মানসিক জোর বাড়ানো।
- তাহলেই কি আমি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবো ?
- হাই চান্স, তবে অধিকাংশটাই আপনার ওপর ডিপেন্ড করছে। আপনি কি চাইছেন এবং মনকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন সেটাই মেজর ইস্যু। এখন থেকে আপনার প্রধান কাজ হবে ময়ূখের সত্বাকে কোনোরকম ভাবেই ইনফ্লুয়েন্স না করা এবং এই বিষয়ে কোনোভাবেই চিন্তা না করা। অবসর সময় ভালো বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, অথবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিন। মনকে শান্ত রাখা বড় কঠিন মৈথিলী, আমি জানি, কিন্তু এই কঠিন কাজটাই আপনাকে করে যেতে হবে। বাকিটা আমি চেষ্টা করব সাধ্যমতো। এই ওষুধ কটা লিখে দিলাম, এগুলো কোনোভাবেই বন্ধ করবেন না, তাহলে কিন্তু আবার এটাকটা হতে পারে। আমার বিশ্বাস আমরা যদি দুজনেই যথাযথ চেষ্টা করি, তাহলে এই রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। আপনি বরং সামনের সোমবারই চলে আসুন, সেদিন থেকেই আপনার থেরাপি শুরু হবে। কেমন ?
সমস্তটা শুনে মৈথিলী ধীরে ধীরে উঠে পড়ে সোফা থেকে। একবুক চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ। কোনো রকম শব্দ খরচ না করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মন্থর গতিতে ।
পরদিন সকালে নিয়মমতো এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে মৈথিলীর। পরদার ফাঁক দিয়ে মনখারাপের আলো ঢুকে পড়েছে যেন। কেমন যেন অন্য রকম একটা দিন আজ, মেঘলা, ছন্নছাড়া মতো । বিছানা ছেড়ে উঠে অলস পায়ে একটা ছোট দেরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রয়ারটা টানতেই ভেতর থেকে কিছু ওষুধের পাতা আর একগোছা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আসে। ডঃ সেনের কথা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ । ঘুম থেকে উঠেই ওষুধটা খাওয়ার কথা বলেছেন। ওষুধের পাতাটা হাতে নিয়ে কাগজের টুকরোগুলোয় চোখ বোলাতে থাকে মৈথিলী। ময়ূখকে লেখা সমস্ত চিঠি। ওষুধটা খাওয়া মানেই ময়ূখকে ভুলে যাওয়ার পথে এক কদম বাড়ানো। ময়ূখের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সূত্রপাত। গভীর চিন্তা করে মৈথিলী। নিজের সাথে কয়েক দিনের অন্তরঙ্গতায় তার সমস্ত দুর্বলতাকে ছাপিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বাদ পেয়েছে সে। অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে সে এতদিনে। নিজের বিপরীত স্বত্বার প্রতি অনুরাগ হলেও নিখাদ, নিষ্পাপ প্রেমই তো ! এটাই তো চেয়েছিল সে। ওষুধ খেলে সুস্থ হবে হয়তো, ভালো করে বাঁচতে পারবে কি ? বেঁচে থাকা কাকে বলে..... ? এক অদ্ভুত উভয়সংকটে পড়ে দিশাহীন খাঁচার পাখির মতো ছটফট করতে থাকে মৈথিলী। এমন সময় কোনো এক নিভৃত অতল থেকে এক পুরুষের মরমী কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, 'মৈথিলী.............মৈথিলী................'
মৈথিলী দ্রুত হাত চাপা দেয় কানে। কিন্তু সে অদম্য কণ্ঠস্বর সমস্ত প্রতিরোধ কাটিয়ে আবার ডেকে ওঠে, 'মৈথিলী...................' ওষুধের পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মৈথিলী। সমস্ত পিছুটান, সংযম, মিথ্যে করে একছুটে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আয়নায় চোখ রেখে বলে ওঠে,...........
'ময়ূখ ? কেমন আছ ময়ূখ ? আজ দেরি করলে যে ..................' !!
 |
| চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব |
#bengalishortstories #drama #thriller