Showing posts with label জিয়ানস্টাল. Show all posts
Showing posts with label জিয়ানস্টাল. Show all posts

Tuesday, April 10, 2018

জিয়ানস্টাল ৩ # আজবৈশাখী ঝড়

তখন আমার চার সাড়ে চার বছর বয়স। চৈত্র মাসে হপ্তাশেষের ছুটিতে মা আর আমি মামার বাড়ি গেছি। মাঝেমাঝেই আমরা শনিবার সকালে যেতুম আর রোববার সন্ধ্যের দিকে বাবা গিয়ে নিয়ে আসতো আমাদের। আমাদের এই চটজলদি হাওয়াবদলের বেশ একটা রেওয়াজ ছিল তখন। সাধারণত শনিবার হলেই সকাল সকাল বাহারি জামা প্যান্ট পরে মায়ের হাত ধরে ট্যাক্সিতে উঠে পড়তুম চেতলার মোড় থেকে। তারপর সোজা সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরতুম। চিতপুর রোড হয়ে জোড়াসাঁকোর ধার ঘেঁষে ডানদিক নিয়ে শিকদার পাড়া স্ট্রিটে এসে থামতুম। উত্তর কলকাতার অতি চেনা বনেদী পাড়ার সরু সর্পিল গলি। গলির একমাথা থেকে আরেকমাথা অবধি বাড়িগুলো এমন বেমক্কা গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকত যে মনে হত যেন গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে এসেছে। আদি ঐতিহাসিক শহরের অনন্য প্রচ্ছদ আর এক আশ্চর্য নোনাধরা দেওয়ালের গন্ধে মনটা মাখামাখি হয়ে যেত। সেই সময় চোখ বুজলেও দিব্যি বলে দিতে পারতুম মামারবাড়ির আশেপাশে কোথাও একটা এসেছি। পুরনো তিনতলা বাড়িটার নিচের তলায় একটা ছোট্ট সোনা রুপোর দোকান ছিল। চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেই কারিগরদের ছেনি হাতুড়ির ঠুক ঠুক আওয়াজ শোনা যেত। ভারি মন মাতানো ছন্দ ছিল সে শব্দে। ভিতরে ঢুকে একটা শান বাঁধানো  কলতলা পেরিয়ে কাঠের রেলিং ঘেরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হতো। সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু থাকার দরুণ আমাকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হতো। 

একদিন দুপুরে দোতলার ঘরে সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে। সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা পুরোনো আমলের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক, তাতে আমি, মা আর দিদা পাশাপাশি শুয়ে আছি। দাদু আর মামারা যে যার কাজে বাড়ির বাইরে। আমার অনিচ্ছা সত্বেও অকারণ ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমাকে প্রায় জোর করেই ঘুম পাড়ানো হতো। সেদিন কি এক কারণে কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। বাড়ির পূর্বদিক লাগোয়া একটা মার্বেলের কারখানা ছিল। সর্বক্ষণ মেশিনের আওয়াজ আর মিস্ত্রীদের অনর্গল কথাবার্তা শোনা যেত। মনে আছে একবার দিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম এই এতো আওয়াজে ঘুমোও কি করে। দিদা বলেছিল, 'অভ্যেস হয়ে গেছে রে, এখন এই আওয়াজটা না হলে যেন ঘুমই আসতে চায় না'। ভারী অবাক হয়েছিলুম সে কথায়। 

যাইহোক সবাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখে আমি দিব্যি পা টিপে টিপে ঘরের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এলুম। এরপর বাঁদিক ঘুরে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ছাতে চলে এসেছিলুম। ছাতটা খুব বেশি বড় না হলেও উঁচু পাঁচিল আর খোপকাটা  জাফরির খাঁজে খাঁজে বিকেল দেখাটা ভারী মনোরম বস্তু ছিল আমার। মান্ধাতা যুগের এজমালি ছাতে একটা চিলেকোঠার ঘর আর সামনে খানিকটা বেওয়ারিশ একফালি চৌকো মতন জায়গা ছিল। ওই জায়গাটায় দাঁড়ালে ছাতের একেবারে মাঝখানটাতে গিয়ে দাঁড়ানো হতো। সেখান থেকে চারপাশটা খুব ভালো করে দেখা যেত। ছোট ছিলাম বলে পাঁচিল পেরিয়ে নিচে রাস্তা দেখতে পেতুম না বটে তবে আশেপাশের বাড়ি আর অনেকটা খোলা আকাশ দেখতে পাওয়ার রোমাঞ্চই ছিল আলাদা।পরে শুনেছিলুম ছাতের দক্ষিণ পূর্ব কোণটা নাকি বাড়ির প্রায় সবারই প্রিয় অবসর ছিল। ওই কোণে বসার জন্য মা আর মামাদের মধ্যে নাকি হাতাহাতি হয়ে যেত প্রায়। বরাবরের মতো ছাতের একচক্কর ঘুরে আমিও ওই কোণটায় এসে দাঁড়িয়েছি। 

এমন সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ভয়ানক মেঘ করেছে। পাক খেতে খেতে ধূসর তুলোটে গোলাগুলো যেন রে রে করে তেড়ে আসছে আমারই দিকে। ক্রমশ তার সাথে উড়ে এল ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত। ক্ষনিকের মধ্যেই জমাট বাঁধা দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেল যেন। স্নিগ্ধ তিরতিরে হাওয়ার এক ঝাপটায় আমার শরীরের আনাচে কানাচে আতরের মতো ছড়িয়ে পড়ল ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। এক অদ্ভুত নেশার মতো পেয়ে বসেছিল আমায়। কতক্ষন এভাবে বুঁদ হয়ে দেখছিলুম জানি না। আমার পিলে চমকে দিয়ে হঠাৎ কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল কাছেই। পাল্লা দিয়ে শুরু হল প্রবল ঝড়ের তান্ডব। চোখের সামনে এমন অপরিকল্পিত চিত্রনাট্য দেখে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলুম। তাড়াতাড়ি কোনোমতে সেই চিলেকোঠা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। চিড় খাওয়া কাঠের ফাঁক দিয়ে দেখলুম চতুর্দিক কেমন আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। যেন কেউ তুলির ওপর কালো কালি লাগিয়ে ক্রমাগত আকাশের একদিক থেকে আরেক দিকে বুলিয়ে দিচ্ছে। নাম না জানা উত্তেজনা আর অবিমিশ্র ভয়ের যুগলবন্দিতে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। অদ্ভুতভাবে নিচে নেমে যেতেও মন চাইল না। কোনো এক অনুচ্চারিত মন্ত্রবলে কিছুতেই এক পা নড়াতে পর্যন্ত পারলুম না। শোঁ শোঁ শব্দে গোটা ব্রহ্মান্ড যেন তোলপাড় করছে তখন। দরজাটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছিলুম। মনে হল এই ঝড় যেন আমায় দেখতেই হবে। এরপর যা যা হবে তা না দেখলে বড্ড আফশোষ রয়ে যাবে আমার।

একঠায় নির্বাক দাঁড়িয়ে ঝড়ের রুদ্ররূপ প্রত্যক্ষ করলুম দুচোখ ভরে। এর পরপরই  শুরু হল তেড়ে বৃষ্টি। তীক্ষ্ন ছুরির ডগা দিয়ে আকাশের মাঝবরাবর কেউ যেন ফালা ফালা করে কেটে দিয়েছে। অবিরাম শ্বেত রক্তক্ষরণের বড় বড় ফোঁটায় ছাতের এক কোণ থেকে আরেক কোণ সে ভিজিয়ে দিল অবলীলায়। নিমেষে জলধ্বনির চরবর চরবর আওয়াজে আমার উৎকণ্ঠাকে দ্বিগুন বাড়িয়ে বাড়ির লোকজনকে একেবারে জাগিয়ে তুললে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার খোঁজ পড়ে গেল চারদিকে। কারণ আমার হারিয়ে যাবার বদরোগের সাথে মামার বাড়ির সকলেই বিশেষ অবগত ছিল। সে আরেক গল্প। অন্য একদিন বলব নাহয়। ততক্ষনে মা ছুটে গেছে নিচে আর দিদা আমার খোঁজে ছাতে চলে এসেছে। আমি তখন দরজার আড়ালে বিমুগ্ধ্ নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। দিদা এসে জিজ্ঞেস করেছিল, 'কি রে ! তুই কাউকে না বলে দিব্যি ছাতে এসে একলা একলা কি করছিস' ? আমি বলেছিলাম, 'এই যে কেমন ঝড় হচ্ছে ! সেটাই দেখছি গো'। দিদা বললে, 'এই ঝড় কি আর একলা বাইরে এসে দেখার জিনিস রে ? এ যে কালবৈশাখী ! তোকে যে উড়িয়ে নিয়ে যায়নি এই আমাদের ভাগ্যি, নিচে চল শিগগির'। 

সেই প্রথম আমি এই ঝড়ের নাম জানলুম। কালবৈশাখীর সাথে সেই আমার প্রথম একক পরিচয়। এমন দুর্নিবার উন্মাদ আচরণ অন্য কোনো কিছুর হতে দেখিনি আগে। যে বেলাগাম দুরন্ত প্রতিচ্ছবি দেখলুম তা সেসময় অন্য কিছু দেখার কাছে নস্যি। এর তুলনা বোধহয় একমাত্র প্রথম জুরাসিক পার্ক দেখার অভিজ্ঞতার সাথে করা যায়। তবে প্রজন্মের কাঁধে মাথা রেখে ইতিহাস যে পুনঃরচিত হয় তার প্রমাণ পেলুম গতকাল হাতেনাতে। 

চিত্র : নিজস্ব 
গতকাল ঠিক তেমনি করেই আমার তিন বছরের পুত্র তাকিয়ে ছিল বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে। বাইরে তখন দিগ্বিদিগ কাঁপিয়ে তীব্র প্রলয় চলছে। তার সাথে একের পর এক ছুটে আসছে মর্মভেদী জলের বাণ। চরম বিস্ময়ে আধো আধো গলায় সে শুধিয়েছিল, 'এতা কি হচ্ছে বাবা' ?  বললুম, 'ঝড় হচ্ছে রে..... কালবৈশাখী ঝড়....... তোর ভালো লাগছে' ? সে কথার উত্তর না দিয়ে বড় বড় চোখে শুধু আলতো করে ঘাড় নেড়েছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলুম কালবৈশাখী দেখার প্রখর উন্মাদনা উজ্জ্বল আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তার সারামুখ জুড়ে। গভীর বিস্ময়ে লেপ্টে থাকা  অবয়বে প্রথম ঝড়ের তৃপ্তি । যেমনটা ঠিক বছর পঁয়ত্রিশ আগে শিকদার পাড়া স্ট্রিটের কোনো এক অখ্যাত বাড়ির ছাতে একটা বছর পাঁচেকের ছেলের মুখে ছিল। অবিকল একইরকম। সোঁদা গন্ধ মেশানো, বৃষ্টি ভেজা, অনামী ছোট্ট চিলেকোঠার ছাপ। অবশ্য চরিত্রের বদল ঘটেছে, বদল ঘটেছে স্থান কালেরও। শুধু বদল হয়নি আদি অকৃত্রিম মুহূর্ত রোমাঞ্চের, বদল হয়নি বৈশাখীর......কাল ছিল......সে আজও তেমনি আছে।




#kalboishakhi #nostalgia #childhoodmemories #bengaliarticle #Molat 









Saturday, September 3, 2016

জিয়ানস্টাল ২ # অফ পিরিয়ড

"দুই......চাআআর.......ছওওওক্কা........ "
কোথা থেকে যেন উটকো কথার টুকরোগুলো কানে এসে ঠক করে লাগলো। গেলো হপ্তার কথা। নিউআলিপুর থেকে বাসে উঠেছি অফিস যাবো বলে। পিছনের দিকে একটা জানলার ধারের সিট পেয়ে বেশ আয়েশ করে বসেছি। হাঁসফাঁশ গরমে মৃদুমন্দ এসির হাওয়ায় শরীরটা বেশ জুত লাগছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ফাঁকা বাস তায় আবার উইন্ডো সিট্ ! চোখ বুজে ভাবছি বঙ্গলক্ষী বাম্পার লটারীটা কাটবো কিনা, এমন সময় আবার সেই অযাচিত শব্দধ্বনি। আচ্ছা জ্বালা তো ! সাময়িক নিরিবিলির ব্যাঘাত ঘটাচ্ছো কে ভাই ? বলি ব্যাপারখানা কি ! পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দভেদী বাণের মতো জোরালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম। যা দেখলুম তাতে থ হয়ে গেলুম খানিক। দুটো স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলে একটা বই নিয়ে প্রজাপতির ডানার মতো একবার খুলছে আবার বন্ধ করছে, আর মাঝেমাঝেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠছে ...."চাআআর....ছওওওক্কা...."  পোলাপানরা করে কি !! ছানাবড়াও লজ্জা পাবে এমন গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলুম। প্রায় ফসিল হয়ে যাওয়া একটা খেলা, সেটাই কিনা এই স্মার্ট ফোন, এংগ্রি বার্ডের যুগে দিব্যি খেলে চলেছে দুজনে ! একরাশ প্রভাতী শিউলি ফুলের মতো অদ্ভুতরকম বুকচাপা আনন্দ ঝরে পড়লো মনের মধ্যে, বড় মনভালো করা এক সৃষ্টিছাড়া আবেগ। প্রায় কুড়ি বছর পর কাউকে "বুক ক্রিকেট" খেলতে দেখলুম......... 

আবছা আলোয় একটা কাগজের উড়োজাহাজ উড়ে গেলো যেন চোখের সামনে দিয়ে, সে উড়োজাহাজ এঁকে বেঁকে গোঁত্তা খেয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লো একেবারে আমাদের ক্লাস টু এর ঘরটাতে। স্পষ্ট দেখতে পেলুম এমন প্রচুর উড়োজাহাজ ক্লাস জুড়ে উড়ে চলেছে জলফড়িঙের মতো, এর ওর হাত থেকে পটাপট তৈরী হয়ে যাচ্ছে সাদা সাদা রুলটানা কাগজের অজস্র খোয়াবি উড়ান। খেয়ালি হাওয়ার টানে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত আর সেই স্বপ্নের উড়ানে সওয়ারী হয়ে খিলখিলিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের গোল্লাছুটের দিনগুলো। কতরকম যে খেলা খেলতাম সেসময় তার ইয়ত্তা নেই। মনে আছে, আমাদের ক্লাস ফোরে এই বুক ক্রিকেট খেলাটাই খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ক্রমশ সে এক মহামারীর আকার ধারণ করেছিল। একেবারে টুর্নামেন্ট অবধি গিয়ে ঠেকেছিল শেষটায়। আমার ধারণা শুধু আমাদের স্কুল কেন, কমবেশি সকলের স্কুলেই এমন অসংখ্য বেমক্কা খেলার রসবড়া সাজানো থাকতো থরে থরে, যা সকলে মিলে চেটেপুটে খেলেও আশ মিটতো না এতটুকু। এ সমস্ত বেঞ্চ গেম্স্ নিতান্তই খেলা ছিল না তখন, বরং বন্ধুদের সাথে দেদার খিল্লি করার নানাবিধ ফিকির ছিল যা আমাদের সবাইকে এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘন করে বেঁধে রাখতো, আলগা হওয়ার জো ছিল না মোটে। সেসব খেলাগুলো যখন মনের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ভিড় করে এলই, তাহলে বরং তরিবত করে দু চার কলম বলেই ফেলি।

শুধু ক্রিকেটেই আমাদের নন্দী ভৃঙ্গীর নাচগুলো থেমে থাকে নি। 'চোর -পুলিশ -বাবু' র পুরিয়া তোলা, আঙ্গুল পেতে 'ইকির মিকির' খেলা, 'নেম, প্লেস, এনিম্যাল, থিং' কাগজের ওপর লিখে একই শব্দ খুঁজে বার করা, রাবারব্যান্ডে কাগজের গুলতি তৈরী করে একে ওকে ছুঁড়ে মারা, ইরেযারের ওপর নামের আদ্যক্ষর লিখে লুডো খেলা, রাফ খাতার পাতা ছিঁড়ে কাগজের বন্দুক বানানো, এমনকি বেঞ্চের ওপর ফুটবল পর্যন্ত শুরু হয়ে গিয়েছিলো একসময়। বেঞ্চের একপ্রান্তে আঙ্গুল ছড়িয়ে গোলপোস্ট বানানো ও  শেষপ্রান্ত থেকে টিপ্ করে পেন্সিল ছুঁড়ে গোল করা প্রায়শই অফ পিরিয়ডে গনউৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমাদের। সচরাচর এই অফ পিরিয়েডেই আমাদের মাথার পোকাগুলো গা ঝাড়া দিয়ে উঠতো বেশি করে। অপেক্ষা করে থাকতুম ক্লাসের ফাঁকে কখন একটু সময় পাবো, আর তারপরেই শুরু হতো ইতরামির চুড়ান্ত। সেসব চরম বেলেল্লাপনায় হাতযশ ছিল প্রায় সবারই, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে। একটা বিপজ্জনক খেলা ছিল সেসময়। 'রসকষ, সিঙ্গারা, বুলবুলি, মস্তক'।  অবশ্য এক্ষেত্রে একজনের বিপদই হতো বেশি, আঙ্গুল গুনে শেষমেশ যে পড়ে থাকতো তারই কপাল পুড়ত অনেকটা। হাঁড়িকাঠে গলা দেবার মতো করে তাকে হাত বাড়িয়ে দিতে হতো সামনে, আর পালা করে সকলে মিলে পরের পর চটাস চটাস করে চড় মেরে চলত তার হাতে। বলাই বাহুল্য সে রামচড়ের ধাক্কায় শুধু তার হাত নয়, শরীরের বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গও জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠতো। মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে, কিছুই হয়নি ভাব করে বেমালুম সহ্য করতে হতো সেসব অত্যাচার। তবে সে খেলা শেষের দিকের ক্লাসগুলোতে খুব একটা খেলা হতো না কারণ সে আড়ংধোলাই কেউই খুব একটা খেতে রাজি হতো না তেমন।

মনে পড়ে, সেই সময় দূরদর্শনে 'ছন্দবাণী ক্লাব' বলে একটি সিরিয়াল হতো। ছন্দ মিলিয়ে কথা বলা সেই সিরিয়ালের এক বৈশিষ্টতা ছিল। দেখাদেখি আমরাও কয়েকজন সেবার খুব ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলুম ক্লাসে। সেসব ছন্দ কাল হয়ে বিপদ ডেকে এনেছিল। একবার ক্লাসে আমার এক সহপাঠী কোনো এক প্রশ্নের উত্তর ছন্দ মিলিয়ে দিতে গিয়েছিল। ফলস্বরূপ স্যারের ছোঁড়া ডাস্টার অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তারপর থেকে আমরাও বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো সহজ সরল ভাষাতেই কথা বলতুম। সেসমস্ত ছন্দের আকরে আমাদের ছোটবেলার দুরন্তপনাগুলো নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে আজও, বয়সের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেও, কয়েক যোজন দূরের কচিবেলার সোঁদামাটির ঘ্রাণে তা একইরকম মিঠে ও স্মৃতিমেদুর। আজকের আধুনিক খেলাধুলোয় সেগুলো বেমানান লাগলেও আমাদের হৃদয়ে তারা এমনভাবেই মাঝেমাঝে ডুবসাঁতার দিয়ে বুড়বুড়ি কেটে উঠবে নিশ্চিত ভাবেই। হাজার সুনামিতেও ধুয়ে মুছে মিলিয়ে যাবে না কখনো, মিলিয়ে যাতে পারে না....... কিছুতেই।

বাস থেকে নামার সময় হয়ে গেছিল। মুখ ঘুরিয়ে ছেলেদুটোকে দেখে নিলুম এক পলক, সকালবেলার নরম রোদে ঝক্ঝক করছে মুখগুলো, মনে হল পুরোনো কিছু কিছু খেলা হারিয়ে যায় না কখনো, ইতিহাসের গল্পদের মতো ঘুরে ফিরে এমনি করেই আসে বারেবার, মনকেমনের দরজায় কড়া নাড়িয়ে, রঙচটা পিলসুজের আগুন একবার হলেও অন্ততঃ উস্কে দিয়ে যাবে, সেটাই তো নিয়ম.............তাই না ?

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : অনুরাধা সেনগুপ্ত
বেশ কিছু বেঞ্চ গেম্স্ ভুলিয়েই গিয়েছিলুম প্রায়। এই লেখাটা লিখবো বলে ওর সাহায্য চাইতেই এক পায়ে খাড়া হয়ে অতদূর থেকেও সময় করে সমস্ত গেমসের নাম পাঠিয়েছিল। পুজোর আগে তোর জন্য একগোছা কাশফুল, অনু, ভালো থাকিস।  

ছবি : গুগল    
#bengaliarticles #schooldiaries #schoolarticles #schoolwriteups #navanalanda #navanalandaalumni #nostalgia #oldschool #schoolmemories #bookcricket #schoolgames   

Thursday, July 14, 2016

জিয়ানস্টাল ১ # নব নালন্দা ডট ইস্কুল

কাব্যে গদ্যে 'ধূসর অতীত' কথাটার বিচ্ছুরণ ঘটে অনাবিল ভাবেই কোনো রকম গাণিতিক নিয়ম না মেনে। আমার জীবনে ধূসর অতীত শুধুমাত্র গণিত নয়, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, জীব বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, মায় শরীর শিক্ষা পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি ঘটে। শুধু আমার কেন, আমার বিশ্বাস আমার প্রত্যেক সহপাঠী বা সহপাঠিনীর ক্ষেত্রে তা একইরকম প্রযোজ্য। ধূসর রঙের ইউনিফর্মটা দশ বছর দ্বিতীয় ত্বকের মতোই টানটান লেপ্টে ছিল আমাদের শরীরের সঙ্গে, যার ঘ্রান এখনো কোনো এক মনখারাপের দুপুরবেলাতে দিব্যি পাওয়া যায়। গতকাল রাতে আমার স্কুলের বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ এর একটি গ্ৰুপে আলোচনা করছিলুম, যদি হঠাৎ করে সবাই মিলে একদিন পুরনো স্কুলটাতে গিয়ে হাজির হওয়া যেত, বিনা পরিকল্পনায়, প্রায় বিনা নোটিশেই....তাহলে কেমন হত ? 

একুশ বছরের প্রায়ান্ধকার একটা স্মৃতির ঘরে টিমটিম করে লো ওয়াটের বাল্বের মতো আমাদের কচিবেলা জ্বলছে, সেটাই নাহয় চোখের দেখা দেখে এলাম একবার, ছোটোছুটি করলাম নাহয় ফেলে আসা কিছু মুহূর্ত গলির আনাচে কানাচে, শ্বাস প্রশ্বাসে আবার করে ভরে নিলাম নাহয় বছর দশেকের স্নিগ্ধ টাটকা ইতিহাস, বেশ হতো, তাই না?................ নানাবিধ আলোচনায় যেটা জানতে পারলাম সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলুম না মোটেই, তাই বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে যন্ত্রনা পেয়েছি দ্বিগুন। সে ব্যাথা স্বজন হারানোর যন্ত্রণার থেকে কম বড় নয়। আমাদের স্কুলের মেইন বিল্ডিং এর গোটাটাই নাকি ভাঙা হয়েছে, কারণ নতুন বিল্ডিং মাথা তুলে দাঁড়াবে চড়চড়িয়ে। ২৫নং, সাদার্ন এভিনিউ এখন একটা ফাঁকা মাঠ বই আর কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে লাল দেওয়ালের ওপর শ্যাওলার মতো আটকে থাকা আমাদের পুরোনো সময়গুলো পলেস্তরার মতো ভেঙে ঝরে পড়েছে, একথা ভাবতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে অজান্তেই । এমন ঘটনায় কিভাবে রিয়্যাক্ট করব জানিনা, অনেকেই হয়তো বলবে, "এতো সুখবর ! নতুন নির্মাণে ছাদের পরিসরটাও তো বাড়ল খানকতকটা"। হয়তো সত্যিই তাই। পুরোনো কাঠামোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে বটে, তবে পুরোনো ছাদটা ধূলিসাৎ হওয়ার সাথে সাথে অতীতের চিহ্নগুলোও বিলুপ্তির পথে কয়েক গজ পা বাড়ালো না কি ?

নবনালন্দা বলতেই গুগল ম্যাপে সাদার্ন এভিনিউয়ে ঢোকার মুখে বাঁদিকে সবুজ লোকাটরটা দেখাবে বটে, তবে যেটা দেখাবে না বা আর কখনোই দেখা যাবে না তা হলো লাল মাটির নকশা করা ১৯৬৭ র একটা চাঁপাফুল রঙা আদি দোতলা বাড়ি। যে বাড়ির সামনে দুটো লোহার গেট দুপাশে ফাঁক হলেই খুলে যেত আমাদের বাঁধভাঙ্গা উল্লাসের ম্যাজিক বক্স। যেখান থেকে বেরিয়ে আস্ত আমাদের কচিবেলার হুল্লোড়ের পায়রাগুলো, যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেলাগাম উড়ে বেড়াতো ঠিক মাঝখানের তকতকে উঠোনটায়। যেখানে নিয়ম করে সারি দিয়ে দাঁড়াতে হতো প্রেয়ারের সময় আর তার সাথে উড়ে আসতো উটকো চিমটি আর ফক্কুড়ি এদিক ওদিক থেকে। ফলে, 'ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা' দায়সাড়া গোছের কিছু প্রেয়ার করে যে যার খোপে ঢুকে যেতুম এক এক করে। 'পিনড্রপ সাইলেন্সের' ঝিঁ ঝিঁ পোকাটা নাগাড়ে বেজে চলতো কানের মধ্যে টিফিন টাইম অবধি। বাদিক ঘেঁষা বাঁধানো সিমেন্টের জলের ট্যাঙ্কটা অপেক্ষা করে থাকতো কখন আমরা টিফিন টাইমে ঠেলাঠেলি করে এ ওর গায়ে জল ছেটাবো। গুরুগম্ভীর ধমকানি বা গার্জেন কলের তোয়াক্কা করতুম না আমরা তেমন কেউই। পিছন দিকের আম গাছ আর বাঁদিকের নিম গাছটা নিপাট সাক্ষী থাকতো সেসব ডেঁপোমির। রেক্টর রুমের সামনে একটা একোরিয়াম ছিল, পানিশমেন্টের সময় অনেকেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো সেদিকে চেয়ে, ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ঘোর কাটতো না। মাছেদের কথা শুনতে পেতুম হয়তো আমরা কেউ কেউ । ঠিক তার ডান দিকেই কাঠের রেলিং দেওয়া শান বাঁধানো, কুয়াশা মাখা (আধো অন্ধকার থাকতো ) একটা সিঁড়ি ছিল যেটা দোতলায় উঠে লম্বা করিডোর শুরু হওয়ার ঠিক আগেই শেষ হতো। করিডোর বরাবর তিনটে সেকশনের তিনটে ক্লাসরুম ছিল যার প্রত্যেকটায় পিছনের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যেত। আমরা অনেকেই সেদিকে তাকিয়ে থাকাটা বেশি ইম্পরট্যান্ট মনে করতুম ব্ল্যাকবোর্ডের চেয়ে। ফলে নীল ডাউন বা বেঞ্চির ওপর গণ দাঁড়ানোটা প্রায় রেওয়াজই হয়ে গিয়েছিলো একরকম। আজও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, 'চল না ! আরো একবার দাঁড়াই সকলে মিলে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, ঠিক যেমনি করে দাঁড়াতুম সেই সব দিনে'..................

সেই জানলাগুলো বোধহয় না খোলার যন্ত্রনায় গুমরে মরেছে এতদিনে। সেই মেরুন রঙের সোফাটা, যেটা একাউন্টস সেকশনের প্রবেশপথে পড়ত, সেটা হয়তো আজ আস্তাকুঁড়ে বোঝাপড়া করছে অতীতের সঙ্গে। নিচের উঠোনটার চারপাশে লাল রঙের দেওয়াল ঘেরা ক্লাসরুম গুলোয় মৌমাছির গুঞ্জন এখনো কান পাতলে শোনা যাবে দস্তুরমতো। সেই লাল রঙে আঙ্গুল ছুঁলে হাতে রং উঠে আসতো সেসময়, অথচ কোনো এক জাদুবলে সেই জায়গাটার রং ফিকে হতো না কিছুতেই। এই ধাঁধাটা সেসময় বিস্তর মাথা চুলকেও বুঝে উঠতে পারিনি, আজ পারি। আর তাই ছিটেফোঁটা যেটুকু বাকি আছে সে রঙের, সেইটে দুহাত দিয়ে জাপ্টে জড়িয়ে রেখেছি, নিজের কাছে............ এটুকুই তো সম্বল, এটুকুই থাক বরং.........    

সাঁঝবেলার ছেলেমেয়েদের বাগানের মাটি উপড়ে নতুন করে নতুন গাছ লাগানো হোক নির্দ্বিধায়, ক্ষতি নেই, তবে পুরোনো ফুলের গন্ধগুলো অমলিন ও টাটকা থাকবে আমাদের সকলের, সে ব্যাপারে আমি দুশোভাগ নিশ্চিত। তবুও.................... আলাদা করে আরেকটা বাগান করা যেত না কি ?                                

"যে আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্বলে
      নিভে যায় - ডুবে যায় - তারা যায় স্খলে
নতুন আকাঙ্খা আসে  - চলে আসে নতুন সময়
        পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,
              নতুনেরা আসিতেছে বলে"
                                                                                            ............জীবনানন্দ দাশ
                                                 


#bengaliarticles #schooldiaries #schoolarticles #schoolwriteups #navanalanda #navanalandaalumni #nostalgia #oldschool #schoolmemories