প্যাকেটটা খুলেই চোখ কপালে উঠে যায় সুজাতার। একি কাণ্ড ! এমনটা তো হবার ছিল না। ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে সে বারকতক। নাহ, এড্রেস তো ঠিকই আছে, নিজের নামটাও জ্বলজ্বল করছে লেবেলের ওপর। প্রেরকের নামটাও দিব্যি মিলে গেছে। তাহলে ? তবে কি পুরো টাকাটাই চোট গেলো ? মনে মনে হায় হায় করতে থাকে সুজাতা। অমন খাদি সিল্কের ওপর হাফ এন হাফ প্যাটার্নের ময়ূরপঙ্খী শাড়ি, সেটা কিনা আমূল বদলে গিয়ে সিঁদুর আলতা রঙের ঢাকাই জামদানি এসেছে ! বলিহারি যাই, এমন ভুলটা সে করলো কি করে ? শাড়ি কেনার ব্যাপারে এমন ভুল তো তার হয়না সচরাচর। বরং পরিচিত মহলে তার শাড়ি সিলেকশনের বেশ কদর আছে। গড়িয়াহাট, নিউমার্কেট চষে, সময় নিয়ে, যত্ন করে, বাছাই করা যেসমস্ত শাড়ি সে কিনে এসেছে এতকাল, তা তারিফযোগ্য বললে কম বলা হবে। বরং হালফ্যাশনের অফবিট শাড়িই হোক অথবা আদি অকৃত্রিম, সাবেকি ধাঁচেরই হোক, শাড়ির কালেকশন নিয়ে তাকে যে বরাবর সমীহের চোখে দেখে লোকজন তাতে তার প্রচ্ছন্ন গর্ববোধটা তার আঁচলের মতোই ফিন্ফিনে আলগা হাওয়ায় উড়তে থাকে বেশ। আর সেই কিনা এই ভুলটা করে বসলো ! ছি, ছি................
প্যাকেটটা নিয়ে সে একছুটে ভিতরের ঘরে চলে যায়। তাড়াতাড়ি মোবাইলে অনলাইন শাড়ির পোর্টালটা খোলে। অর্ডার লিস্ট চেক করে দ্রুতগতিতে। নাহ, সে তো ঠিক অর্ডারই দিয়েছিলো। যাক ! তার মানে ভুল সে করেনি, শাড়িটা যারা পাঠিয়েছে তারাই গন্ডগোলটা পাকিয়েছে তাহলে। এই হচ্ছে মুশকিল ! মনে মনে ভাবে সুজাতা। বরাবর সে পায়ে হেঁটে, দোকান ঘুরে, অজস্র, অগুন্তি শাড়ি নামিয়ে, একেবারে চিলের চোখে জরিপ করে, তবে মনের মতো দুএকটায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে যুদ্ধজয়ের উল্লাস করে। সেখানে অনলাইন বলে মনটা একবার খুঁতখুঁত করেছিলো বটে তবে পছন্দসই শাড়িটা পেয়ে যেতে আর দ্বিতীয় বার ভাবে নি। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে একচান্সে 'অর্ডার নাউ' বাটনটা টিপে দিয়েছিলো নির্দ্বিধায়। যেমন চোখটানা ময়ূরপঙ্খী রঙ, তেমনি মনকাড়া ডিজাইন, ছাড়া যায় না কি কখনো ? অষ্টমীতে একবার গায়ে তুলতে পারলে আর দেখতে হবে না। হাঁ হয়ে থাকা ছাড়া আর গতি থাকবে না কারোর। সবার ট্যারা চাউনিগুলোই মেডেলের মতো গলায় শোভা পাবে নির্ঘাৎ।.............. অথচ এখন ? নিজের গালেই ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে সুজাতার। অর্ডার বিলে ফোননম্বর আছে কি না চেক করতে থাকে সে। পাওয়া গেছে !! যাক, এইবার ফোন করতে হবে, আচ্ছা করে দুচার কথা শুনিয়ে দিতে হবে যা হোক। শাড়ি নিয়ে ইয়ার্কি ? বুঝবে বাছাধনরা ! তড়িৎগতিতে আঙ্গুল চালিয়ে নম্বর ডায়াল করে। কিছুক্ষন কথা বলে দূরভাষে, তারপর একরাশ বিরক্তি আর পাঁচন গেলা মুখ নিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। সকাল সকাল তেতো হয়ে যায় মনটা। কোনোরকমে নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে চলে যায়। ফিরে এসে অভিরূপকে জানাতে হবে। ভালো গ্যাঁড়াকল হলো !............
সেদিন রাত্রে
- এই শুনছ ? কি গো ?
- হুমমম......
- শোনো না, একটা কথা আছে....
- কি ?
- আহ ! কি সারাক্ষন টিভিটা মুখে করে নিয়ে বসে থাকো। আমার তো কোনো কথা থাকতে পারে, নাকি ?
- শুনছি তো....বলো.....
- বলছি কি, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে......
- হুমমম.......
- দেখেছো তো, আমাকে পাত্তা না দেওয়াটা তোমার কেমন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, টিভির মধ্যে তো ঢুকে যাবে এবার ! আমার দিকে ঘুরে বসো তো, ইম্পরট্যান্ট কথা আছে.......
- আঃ,.. আচ্ছা জ্বালাতন মাইরি, কি হয়েছে কি ?
টিভির দিকে চোখ রেখে বিছানার ওপর এলিয়ে শুয়ে ছিল অভিরূপ। সুজাতার কথায় সামান্য বিরক্তি নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে।
- দুদিন আগে একটা শাড়ি অর্ডার করেছিলুম অনলাইনে, আজ সকালে দেখলাম ভুল শাড়ি এসেছে।
- বেশ তো, ফিরিয়ে দিলেই হলো।
- সে চেষ্টা কি আর করিনি ভাবছো ? ফোন করেছিলাম তো। বলল, ছবি তুলে, অর্ডার নাম্বার দিয়ে একটা মেল্ করতে হবে।
- হ্যাঁ, করে দাও, কি অসুবিধে ?
- সকাল থেকে চেষ্টা করছি, একদম পারছি না, বলছি কি......... তুমি একটু মেলটা করে দাও না.......
- আশ্চর্য ! তুমি অনলাইনে শাড়ি অর্ডার করতে পারলে আর একটা মেল্ করতে পারছ না ? ওটাও আমাকে করতে হবে ?
- করে দাও না লক্ষীটি, দেখছো তো বিপদে পড়েছি।
- অদ্ভুত !
সুজাতার মোবাইলটা নিয়ে বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে নেট অন করে অভিরূপ। টিভিতে টি২০ সিরিজটার মাঝে ব্যাঘাত সহ্য হয় না মোটে, নিঃশব্দ কষাঘাত অনুভূত হয় যেন সারা শরীরে। কিন্তু উপায়ও নেই, যতক্ষণ না কাজটা করবে কানের কাছে একনাগাড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো বলতেই থাকবে সুজাতা। বিড়বিড় করতে থাকে অভিরূপ মনে মনে বলে, 'যত্তসব আদিখ্যেতা'। শাড়িটা বের করে দেয় সুজাতা। অভিরূপ একনজর দেখে শাড়িটার দিকে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে, 'শাড়িটা অন্য কাউকে দিয়ে দিলেই তো হয়, আত্মীয়স্বজন তো কম নয় আমাদের কারোর'।
-প্রথমটা তেমনই ভেবেছিলাম জানো, কিন্তু পরে মনে হলো এই শাড়িটা পড়ার মতো লোক নেই।
- কেন ? মা......
- তোমার মা ঠিক এই রঙের ঢাকাই জামদানি পড়বেন না এই বয়েসে। আমি জানি।
- তাহলে মাসিমণি ?
- খেপেছ নাকি ! বিরাট কারুকাজ করা শাড়ি মাসিমণি মোটেই পছন্দ করেন না, সেবার দেখলে না, তসর দিয়েছিলাম, তাও পাড়ে অত কলকার কাজ করা ছিল বলে তুলে রেখেছিলেন। জোরাজুরি করতে চুমকির মুখেভাতে পরেছিলেন কোনোরকমে। না না, মাসিমণি এটা পছন্দ করবেন না।
- আচ্ছা সে নাহয় হলো, তোমার সেজকাকিমা ? তিনি তো বেশ সাজতে টাজতে ভালোবাসেন, ওনাকে দিয়ে দিলেই তো হয়।
- হুমম, কায়দা করে ফোন করেছিলাম আজ বিকেলে, বললেন লাল রঙটা নাকি এভোয়েড করছেন ইদানীং......কি একটা যেন সমস্যা হচ্ছে।
- সে আবার কি ? ইদানীং এভোয়েড করছেন মানে !! এ আবার কেমন কথা ?
- কি জানি বাপু, কি ব্যাপার, ওনার যে কখন কি মর্জি হয় !! জানোই তো ওনাকে ? ছেলের বিয়েতে লগ্ন নিয়ে কিরকম সিন্ ক্রিয়েট করলেন....মনে নেই ?
- হুমম, তবে একটা কাজ করো, বিন্দুপিসিকে দিয়ে দাও, অমন ফর্সা গায়ের রঙ, মানাবে ভাল, তাই না ?
- না ওটা করা যাবে না, গতবার পুজোয় এই ঢাকাই জামদানিই দিয়েছিলাম। পরপর একইরকম হলে মুখ ব্যাঁকাবে। তার চেয়ে বরং দেরি না করে তুমি মেলটাই করে দাও, শাড়ি নিয়ে চলে যাক, আমার টাকাটা ফেরত দিক।
অভিরূপের মুখ ব্যাজার হয়ে যায়। কোনোভাবেই এই উটকো ঝামেলাটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। সমস্ত অস্ত্রই বিপক্ষ শিবিরে লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়। অগত্যা...... বাধ্য সেবকের মতো মেল্ করতে বসে যায় সে। বেশ কিছুক্ষন ধরে নাড়াঘাটা করতে থাকে মোবাইলটা নিয়ে, শেষমেশ, 'দুত্তোর' বলে দুধ সাদা যন্ত্রটা ফেলে রাখে পাশে, নিজেও গা এলিয়ে দেয় কোলবালিশটা জড়িয়ে। সুজাতা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, 'কি হলো, পাঠালে না' ?
- নাহ তোমার মোবাইলটা ভারী অদ্ভুত, নেট আসছে যাচ্ছে, কিছুতেই ছবিটা এট্যাচ হচ্ছে না।
সুজাতা চোখ সরু করে তাকায় অভিরূপের দিকে, হাড়ে হাড়ে চেনে সে। যেটা ইচ্ছে করবে না সেটা কোনো না কোনো অজুহাতে ঠিক পাশ কাটিয়ে চলে যাবে অভিরূপ। তাই মোবাইলটা নিজে হাতে নিয়ে চেক করে..... সত্যিই নেটটা প্রব্লেম করছে। বিরক্ত লাগে সবকিছুর ওপর, তারচেয়েও বেশি করে যেন নিজের ওপর, কেন যে অর্ডার করতে গেলো সেদিন, এখন হাতে নাতে ফল পাচ্ছে। নেহাত এইরকম একটা শাড়ির প্রতি অনেকদিন ধরেই ঝোঁক ছিল....... সেজন্যই তো, তাই বলে যে এমন উটকো গাড্ডায় পড়বে এমনটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। নইলে কি আর শাড়ির অভাব ? তবে কম দাম নয় শাড়িটার, কড়কড়ে সতেরোশো টাকা গুনে দিয়েছে, এখন ফেরত দিতে না পারলে..... মনের মধ্যে নানারকম চিন্তা ভাবনার স্রোত বয়ে চলে। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সুজাতা, একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা লেগে আসে চোখে। পাশে অভিরূপ একমনে খেলা দেখে চলে টিভিতে..........
পরদিন সকালে
- 'বিছানার চাদরটা টানটান করে পাত মুনিয়া। শোবার ঘরের চাদর কুঁচকে থাকলে ভীষণ গা ঘিনঘিন করে'।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে কথাগুলো বলে সুজাতা। কথাগুলোতে যেন একটা চাপা ঝাঁঝের ইঙ্গিত পায় অভিরূপ। আড়চোখে দেখে নেয় সুজাতাকে খবরের কাগজের ফাঁক দিয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিঠছাপানো চুলে চিরুনি চালাচ্ছে মধ্যযৌবনা অর্ধাঙ্গিনী। বরাবর সকাল সকাল স্নান করে নেবার অভ্যাস সুজাতার। ভিজে চুলে ভারী স্নিগ্ধ লাগে সুজাতাকে। বিয়ের পরের দিনই সেকথা বলেছিলো অভিরূপ, তারপর থেকে সুজাতাকে স্নান করে চুল আঁচড়াতে দেখলেই হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকে সে। সুজাতা ভারী অপ্রুস্তুত হয় তাতে। অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না অভিরূপের। ছবছর বিয়ে হয়েছে বটে, তবে সে স্নিগ্ধতা এতটুকু ম্লান হয়নি আজও। ভোরের আলোর মতোই উজ্জ্বল অথচ এক মৃদু ভালোলাগার বলয় তৈরী হয় সুজাতার চারপাশটায়। কোনো এক নাম না জানা ভিজে গন্ধে ঘরের ভেতরটা ম ম করতে থাকে। এরই মধ্যে গত রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে অভিরূপের, সুজাতার ঝাঁঝের আন্দাজ পায় খানিকটা। কোনো কথা না বলে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে দেয়। হঠাৎ করে সুজাতা গর্জে ওঠে আবার, 'কি রে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড় ! বারান্দাটা কে ঝাঁড় দেবে..... আমি' ? অনাহূত আক্রমণে থতমত খেয়ে যায় মুনিয়া, ঢোঁক গিলে বলে, 'না দি'ভাই, আমি দিয়ে দিচ্ছি, ওঘরের কাজগুলো সেরে নিই'। সুজাতা সে কথার কোনো উত্তর দেয় না। গম্ভীর মুখে চিরুনি থেকে জড়ানো কুঁচো চুল বের করে দক্ষিণের জানলা দিয়ে উড়িয়ে দেয়। অভিরূপ সেটা দেখে আপত্তি করতে গিয়েও সম্ভাব্য ঝড়ের কথা ভেবে নিজেকে আটকায় । খানিক্ষন বাদে আবার মুনিয়া এসে দাঁড়ায় ঘরে।
-দি'ভাই, একটা কথা ছিল.......
- কি ?
- ইয়ে, মানে আজ বিকেলে না, আসতে পারবো না.....
-কেন ??
- মা কে নিয়ে বেরুবো...... একটু কাজ আছে...
আগুনে যেন ঘি পড়ে, সুজাতা সটান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, 'ব্যাস !! তবে আর কি, এদিন কাজ আছে, ওদিন শরীর খারাপ, আজ অমুক জায়গায় যাবো , কাল তমুক লোক আসবে......এই করিয়ে চালিয়ে দে, আমাদের কথা আর ভাবার দরকার নেই তোর, তাই না' ?? মুনিয়া ভারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বুঝতে পারে তার দি'ভাইয়ের মেজাজটা ঠিক জুত নেই আজ। আকাশপাতাল ভেবেও কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কোনোমতে মিন মিন করতে করতে বলে, 'না মানে, সত্যি একটু কাজ ছিল, তবে তেমন অসুবিধে হলে আমি নাহয় অন্যদিন যাবো, তুমি রাগ কোরো না দি'ভাই'। বছর বিশের শীর্ণ, শ্যামলা মুনিয়ার কথা কোনো পাত্তাই দেয় না সুজাতা, হাত নাড়িয়ে বলে, 'না না আজ রোববার, আমরা একটু বেরুবো বিকেলে, তুই অন্য কোনো দিন চলে যাস'। কোনোরকম বেচাল করার সাহস পায় না মুনিয়া, 'আচ্ছা', বলে পিছন ফেরে বাকি কাজ সারতে থাকে । 'তবুও...... কোন হট্টমেলায় যাওয়া হতো শুনি' ? বাঁকা চোখে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সুজাতা। অভিরূপও কাগজ নামিয়ে মুখ তুলে তাকায় মুনিয়ার দিকে। বারান্দার গ্রিলে বসা চড়ুইটাও ঈষৎ ঘাড় ঘোরায় যেন। 'নতুনবাজার', মুনিয়া ধীর লয়ে চোখ নামায়, তারপর কিছুটা কুন্ঠিত হয়ে বলে, 'আসলে দি'ভাই, তুমি যে আজ মাইনের টাকাটা দেবে, তাই দিয়ে মা কে একটা শাড়ি কিনে দেব ভেবেছি। আমি তো কখনোই মা কে কিছু দিই নি........... ছোটোর থেকে মা কেই দেখেছি এটা ওটা কিনে আনতো আমার আর ভাইয়ের জন্য। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মাকেই টেনেটুনে সংসারটা চালাতে হচ্ছে। এখন তোমাদের কাছে কাজ করছি, হাতে দুটো টাকা আসবে, তাই মনে করেছিলাম, প্রথম মাইনের টাকা পেয়ে মাকে নতুনবাজারের বড়দোকান থেকে একটা শাড়ি দেব..........কিন্তু.....'।
ঘরের মধ্যে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা জমা হয়। সুজাতার মুখে কোনো কথা সরে না, বোবা দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মুনিয়ার দিকে। চোখের পাতায় গুমোট মেঘ ভেসে আসে কোথা থেকে। ঠোঁট শুকিয়ে আসে গভীর, তীব্র যন্ত্রনায়। বোধহয় কোনো পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় এক ঝটকায়। অভিরূপ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কাগজটা মুড়ে কোলের ওপর রাখে। বারান্দায় চড়ুইটা টুপ্ করে উড়ে পালিয়ে যায়। কিছু সময়ের পর সাময়িক জড়তা কাটিয়ে ওঠে সুজাতা। ধীর পায়ে মুনিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুনিয়া চোখ তুলে তাকায় তার দি'ভাইয়ের মুখের দিকে। সে চোখের সরল, মায়া জড়ানো, ছলছল দৃষ্টিতে সুজাতা মোম হয়ে গলতে থাকে ভাদ্রের সকালে। কোনো কথা উচ্চারণ না করে চাবি ঘুরিয়ে আলমারির দরজা খুলে বের করে আনে সেই ঢাকাই জামদানি। মুনিয়ার হাতে দিয়ে বলে.......... 'এইটা দিস তোর মাকে, বলিস........তোর প্রথম রোজগার'..............
ড্যাবড্যাব করে শাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে মুনিয়া। হাতের ওপর ওজন লাগে বড়।
- 'কিন্তু দি'ভাই....... এ শাড়ির তো অনেক দাম গো' !
- 'মায়ের শাড়ির আবার দাম হয় নাকি রে বোকা' ?
স্মিত হাসে সুজাতা, আঁচলের খুঁট দিয়ে চট করে নিজের চোখ মুছে নেয়। বলে, 'তোর মাইনের টাকাটাও রাখ, ভাইকে কিনে দিস কিছু একটা......'। ভোরের সিঁদুরে আলতা আভার মতোই মুনিয়ার মুখচোখ উজ্জ্বল আলোকছটায় ভরে ওঠে সহসা, একগাল হেসে, ঢিপ করে সুজাতাকে একটা প্রণাম করে। সুজাতা বলে, 'আচ্ছা আছে হয়েছে, এখন পালা দেখি, আমার মেলা কাজ আছে...........আর শোন, বিকেলে আসার দরকার নেই, চালিয়ে নেবোখন একবেলা'। উদ্দাম, বেপরোয়া হাওয়ার মতো মুনিয়া ছুট লাগায় দরজার দিকে...............
অভিরূপ উঠে এসে সুজাতার কাঁধে হাত রাখে, সুজাতার অকালে মা হারানোর যন্ত্রনাটা ভালো মতোই জানে সে। সুজাতা ভেবেছিলো চাকরি পেয়ে প্রথম মাইনের টাকা দিয়ে মা কে শাড়ি কিনে দেবে। এমএম পাশ করে স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় বসার সময়টাতেই মা চলে যান। তাই প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে মা কে শাড়ি কিনে দেবার শখ কখনোই পূরণ হয়নি সুজাতার। জগদ্দল পাথরের মতো সেই সুপ্ত বাসনা আজও চাপ হয়ে বসে আছে সুজাতার বুকে। আর তাই পুজোর আগে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনকে শাড়ি দিয়ে সে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে খানিকটা। আজ মুনিয়া আর নিজেকে একই নৌকার নাবিক মনে হয়েছে তার। যে নৌকা প্রান্তিকের মৌতাতে দাঁড় বেয়ে চলেছে একটানা, নিরলস, নিরন্তর।
দুজনে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। দক্ষিণের আকাশে ঋতু পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আশ্বিনের মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে এখনই। সুজাতাকে নিয়ে গর্ব হয় অভিরূপের, এক অনির্বচনীয়, মনোময় আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে যায় দুজনে, যা শোবার ঘরের বিছানার চাদরের মতোই মসৃন, টানটান হয়ে থাকে, অতি ঝড়েও অবিন্যস্ত হয়না কখনো.....................
![]() |
| ছবি : গুগল |
#bengalishortstories #bengalilovestories #mother'sdaystory

প্রচুর গল্প তো পড়ি... বই.. ফেসবুক.. বেশী পড়ার কারণেই কিনা জানি না লেখার অনুভূতিরা অত সহজে ছোঁয় না!! কিন্তু আপনার লেখা টা ভীষন একটা হাল্কা হাওয়া একটা রিলিফের মত.. যুঁই ফুলের গন্ধের মত ছুঁয়ে গেল.. রইল.. বুঝতে পারছি রেশ টা থাকবে।। অনেক অনেক ভালোলাগা জানালাম।
ReplyDeleteকি বলি দিদি! এমন নিখাদ অনুভূতি বুনেই চলার পথ তৈরি করছি। আপনার মতো বিদগ্ধ কিছু মানুষের সান্নিধ্যে সে পথকে নিষকনট্ক,মসৃন করে তুলেছে।
ReplyDeleteআমার শ্রদ্ধা জানবেন ।
খুব ভালো লাগলো । মন ছুঁয়ে গেল । এভাবেই আপনার কলম চলতে থাকুক ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteবেশ ভালো লাগলো
ReplyDelete