Showing posts with label ভূতের গল্প. Show all posts
Showing posts with label ভূতের গল্প. Show all posts

Saturday, July 1, 2017

সাপ্তাহিকী ২৮ # ছোট্ট উপহার

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। দুর্যোগের কালো মেঘ যেন ঘনিয়ে এসেছে গোটা শহর জুড়ে। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ফলা বর্শার মতো ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। প্রবাহ দক্ষিণের জানলার সমানে এসে দাঁড়ায়। অনতিদূরে স্ট্রিট ল্যাম্পের নিয়ন আলো ফোঁটায় ফোঁটায় জানলার কাঁচ ভেদ করে চুঁইয়ে পড়ছে। প্রবাহ সেদিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। পাশের বাড়ির এসবেস্টসের ছাদে কোনো এক মোহময় ছন্দে জলের তীব্রধ্বনি বেজে চলেছে এক নাগাড়ে। খুব কাছেই কোথাও একটা কড়কড় শব্দে বাজ পড়ে। কেঁপে ওঠে প্রবাহ। আজ রাত্রিটা অফিসেই কাটাতে হবে মনে হচ্ছে। কয়েক ঘন্টার একটানা বৃষ্টিতে অফিসের আশেপাশের এলাকায় জল জমেছে বেশ। এই অবস্থায় বাইক চালিয়ে কসবা থেকে বাড়ি ফেরা একপ্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া কাল সকালেই আবার অফিস থেকে সুন্দরবন যেতে হবে তাকে। সুতরাং সমস্ত দিক ভেবে অফিসেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে প্রবাহ। বসকে আগাম জানিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষন আগে বাড়িতেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।

উল্টো দিকের চাইনিজ রেস্তোঁরার হাক্কা নুডলস দিয়ে চটজলদি ডিনার সারা হয়ে যায় তার। দশটা অবধি জনা তিনেক ছিল অফিসে। ধীরে ধীরে তারাও যে যার সুবিধেমতো বেড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই। অতঃপর এই চারতলার বিল্ডিংটায় ভূতের মতো চুপচাপ রাত কাটানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সিকিউরিটি আছে একজন অবশ্য, নাম হরিপদ। সেও বোধহয় এতক্ষনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে লোহার গেট বন্ধ করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। নিচের থেকে হিন্দী গানের একটা কলি ভেসে আসছে যেন। হরিপদ বোধহয় রেডিও চালিয়েছে। গুনগুন করে সেই সুরটা ভাঁজতে ভাঁজতে প্রবাহ সোফার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। পশ্চিমের এই ঘরটা খুব একটা বড় না হলেও বেশ আরামদায়ক। দক্ষিণ আর পূর্ব দিকে একটা করে জানলা, কোণের  দিকে একটা টেবিল, ডান পাশে একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর খানকতক অফিসের কিছু জার্নাল, ম্যাগাজিন, একটা পেন স্ট্যান্ড আর একটা টেবিল ক্যালেণ্ডার। ঘরের পশ্চিম দেওয়াল ঘেঁষে একটা সুদৃশ্য মেহগনী রঙের এলাহী সোফা যার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে প্রবাহ একটার পর একটা ধোঁয়ার রিং ছাড়তে থাকে। এই ঘরটা আগে সিনিয়র অপারেশন ম্যানেজারের ঘর ছিল। তিনি দুতলায় শিফট হয়ে যাওয়াতে এখন টুকটাক অবসর কাজের জন্যই এটা ব্যবহৃত হয়। প্রবাহর কাছে অবশ্য অফিসে রাত কাটানোটা নতুন কিছু নয়। প্রোডাকশন হাউজ হওয়ার দরুন এডিটিংয়ের কাজে মাঝেমাঝেই টিমের প্রায় সকলকেই এখানে থাকতে হয়েছে কোনো না কোনো সময়ে। তবে তফাতের মধ্যে আজ শুধু প্রবাহকে একা থাকতে হচ্ছে। সেটাও হতো না যদি না কাল সকাল সকাল বেরোনোর ঝঞ্ঝাট থাকতো।

হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচটা নিভিয়ে দেয় প্রবাহ। উইন্ডো এসিটাকে বাইশ ডিগ্রিতে সেট করে নিজের ফোনটা বের করে আনে। এখন সবে সাড়ে বারোটা। রাস্তা থেকে কোনো এক গাড়ির হেডলাইটের আলো, জানলার মসৃন কাঁচ ছুঁয়ে ঘরের দেওয়াল বেয়ে মিলিয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টিটা বোধহয় সামান্য ধরেছে। যতক্ষণ না ঘুম আসে ততক্ষন একটা সিনেমা দেখার প্ল্যান করে নেয় সে।

ফোনের স্ক্রিনে হাত দিতেই ফোনটা তীক্ষ্ন সুরে বেজে ওঠে। স্ক্রিনের আলোয় দপদপ করছে দীপ্তদার নাম। কি আশ্চর্য এতো রাত্রে ? উঠে বসে প্রবাহ। বোধহয় খোঁজ নিতেই ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে ফোনটা কানের কাছে ধরতেই ওদিক থেকে দীপ্তদার গলা পাওয়া যায়।

- কিরে, কাঁচা ঘুম ভাঙালাম নাকি ?
- না না, ঘুমোইনি, বলো.....
- তিনতলার অফিসে আছিস তো ?
- হ্যাঁ, ওখানেই.....কেন ?
- আমি আসছি দু মিনিটে.....মোড়ের মাথায় সিগারেট কিনছি.....
- সেকি ? এতো রাত্রে ? মানে তুমি, কিভাবে....... !!
- বলছি বলছি....এসে সব বলছি.....

দীপ্ত একই অফিসের কর্মী। প্রবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। একটা আনন্দ ও অবিশ্বাস মিশ্রিত ঢেউ খেলে যায় মনের মধ্যে। কতকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন। যাক ! এখন এই বিভীষিকার মধ্যে আর একা থাকতে হবে না। তড়িঘড়ি বলে, 'আচ্ছা, এসো এসো..... আমি হরিপদকে বলছি গেটটা খুলে দিতে '।
- তার দরকার নেই, হরিপদকে ফোন করা হয়ে গেছে আমার, তুই বরং ফ্লোরের দরজাটা খুলে রাখ।  
- আচ্ছা বেশ.....

প্রবাহ ঘর থেকে বেরিয়ে তিনতলার দরজাটা খুলে দেয়। কিছুক্ষন বাদেই জুতোর মশমশ শব্দ করতে করতে দীপ্ত উঠে আসে ওপরে। ঘরে এসেই একগাল হাসি দিয়ে বলে, 'কিরে, কেমন সারপ্রাইজ দিলুম বল' ? প্রবাহ হৈ হৈ করে ওঠে, উচ্চস্বরে বলে, 'ওয়েলকাম ওয়েলকাম। এ যে একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটিয়ে দিলে তুমি ! এটা কি করে সম্ভব হল' ? জল ঝাড়তে ঝাড়তে ছাতাটা এককোণে রাখে দীপ্ত। তারপর ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি ঝুলিয়ে বলে, 'বলছি বলছি, খাওয়া দাওয়া করেছিস তো' ? 'হ্যাঁ হ্যাঁ সেসব করে নিয়েছি অনেক্ষণ, তুমি বলো, হঠাৎ এখানে কিভাবে, কি করে' ? প্রবাহর আর তর সয় না। দীপ্ত চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে। ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, 'আর বলিস কেন, বাড়ি ফিরে দেখি তোর বৌদি মুখটা এত্তবড় হাঁড়ি করে বসে আছে'। জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ব্যাপার, এমন মুড্ অফ কেন ? কিছু হয়েছে ? তা সে বললে আমি নাকি কথা দিয়েছিলুম আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব, একসাথে সিনেমা দেখব, আমি নাকি কথার খেলাপ করেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি...... আরেবাবা, বৃষ্টি কি আর আগাম নোটিশ পাঠিয়ে কলকাতার বুকে ঝরে পড়বে, নাকি আমি হাত গুনে বলে দিতে পারব যে আজ আকাশের পরিস্থিতি কেমন থাকবে' ?

প্রবাহ হাহা করে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করে, 'তারপর' ? 

- তারপর আর কি, যতই বোঝাতে যাই আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি, ততই সে ইনিয়ে বিনিয়ে নানারকম ফিরিস্তি দিয়ে প্রমান করতে থাকে আমি নাকি এক কথার মানুষ নই, আমি যেন ইচ্ছে করেই এসব ষড়যন্ত্র করি, আড্ডা মারা নাকি আমার বেসিক ট্রেটের মধ্যে পরে, সমস্তটাই আমার কারসাজি, অমুক তমুক..........'।
প্রবাহ কোনোক্রমে হাসি চেপে জিজ্ঞেস করে, 'আর তাই তুমি রাগ করে বেরিয়ে এলে, তাইতো' ?

- হ্যাঁ, আমিও দুত্তোর নিকুচি করেছে বলে চটপট জামাকাপড় গলিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। বেরিয়েই ভাবলুম, কোথায় যাই এতো রাত্রে, বেরিয়ে তো পড়েছি, কিন্তু এবার ? পরক্ষনেই তোর কথা মনে হলো, ভাবলুম তুই তো একাই আছিস, তোর সাথে গল্পটল্প করে দিব্যি সময় কেটে যাবেখন, তাই সটান ট্যাক্সি বুক করে চলে এলুম।
- বেশ বেশ, সে একরকম ভালোই করেছ তুমি। আমিও একা একা কি করব ভেবেই উঠতে পারছিলাম না, যাহোক তবু একটা গল্প করার লোক পাওয়া গেল।

দীপ্ত অমায়িক হাসে। ঘরের চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, 'অনেকদিন পর এই ঘরটায় আবার জমায়েত হওয়া গেল, কি বল' ?
- হ্যাঁ তো তো বটেই, শেষ যেবার ছিলাম আমরা, সেটাও তো প্রায় মাসতিনেক হয়ে গেল, তাই না ?.....
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস.....সেবার বেশ মজা হয়েছিল।

হঠাৎ করে দীপ্তর হাতের দিকে চোখ যায় প্রবাহর। নিরীক্ষণ করে বলে, 'আচ্ছা তোমার কনুইয়ের কাছটা অমন ফোলা লাগছে কেন গো, পড়েটড়ে গিয়েছিলে নাকি' ? আঙ্গুল উঁচিয়ে দীপ্তর হাতের দিকে দেখায় প্রবাহ। দীপ্ত সে দিকে তাকিয়ে হাতটাকে ভাঁজ করে বলে, 'হ্যাঁ রে, এই আসার সময়টাতেই তো। ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে অসাবধানে কনুইটা এমন জোর ঠুকে গেল দরজায়, কি বলব'।
'ওষুধ টষুধ দিয়েছো কিছু', প্রবাহ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, 'ইশশ ছড়েও তো গেছে কিছুটা, ডেটল নিয়ে আসি' ? দীপ্ত হাত নাড়িয়ে বলে, 'আরে দূর, সামান্য চোট, তার আবার ওষুধ ! ও একদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। বাদ দে তো, তার চেয়ে বল, কাল সুন্দরবনের প্রজেক্টে কি কি হচ্ছে'............ ?

বর্ষার রাতে দুজনের মধ্যে গল্প জমে ওঠে বেশ। একই বয়েসি না হলেও একই ডিপার্টমেন্ট হওয়ার দরুন বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে নানাবিধ আলোচনা চলতে থাকে। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষন পর দীপ্তর সম্বিৎ ফেরে। চমকে উঠে বলে, 'এই রে, অনেক বেজে গেল রে। ঘড়ির দিকে তো খেয়ালই করিনি। কাল সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে যে তোকে'। প্রবাহ ঘড়ির দিকে তাকায়। দুটো দশ। মাথা নেড়ে বলে, 'হ্যাঁ, তাইতো ! রাত হয়েছে ঢের, চলো এবার একটু চোখ বুজে নিই কিছুক্ষন'। দীপ্ত উঠে দাঁড়ায়, বাঁহাত থেকে ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখে, বলে, 'আমি একটু টয়লেট থেকে ঘুরে আসি। এসে একটা সুখটান দিয়ে তবেই ঘুমোবো। তুই দেরি করিসনা, ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে তো অনেকটা পথ পেরোতে হবে তোকে' । প্রবাহ আলতো হাসে, টেবিলের ওপর রাখা দীপ্তর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, 'দাদা তোমার ঘড়ির ডায়াল শেপটা কিন্তু দারুন, বেশ অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে, যতবার দেখি ততবারই মুগ্ধ হয়ে পড়ি'। দীপ্ত মুচকি হাসে, বলে, 'তাই বুঝি ? এইরকম ডায়াল তোর খুব পছন্দ না রে' ?

- ভীষণ !.....কোথা থেকে কিনেছিলে যেন ?
- কিনিনি তো ! মনে নেই ? একটা কর্পোরেটের জন্য জিঙ্গল লিখেছিলাম, তারাই গিফট করেছিল.....
- ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ ,মনে পড়েছে। আচ্ছা আমায় একদিন পড়তে দেবে ঘড়িটা ?
- বেশ তো, নিস্ বরং, চাইলে অবশ্য কালই পড়ে যেতে পারিস।
- একেবারে কালই !
- হ্যাঁ কালই .........পড়বি ?
- তোমার অসুবিধে হবে না ?
- বিন্দুমাত্র না....
- বেশ, তবে কালই ওটা পরে নতুন প্রজেক্টের কাজে যাব।

দীপ্ত মৃদু হেসে টয়লেটের দিকে চলে যায়। প্রবাহ ঘড়িটার দিকে ঠায় দেখতে থাকে। এই ঘড়িটার প্রশংসা আগেও অনেকবার করেছে প্রবাহ। ভেবেছিলো দেশপ্রিয় পার্কের নামী ব্র্যাণ্ডের দোকানটায় গিয়ে একটা ফ্যাশনেবল রিস্টওয়াচ কিনবে। বিভিন্ন কাজের চাপে ও সময়াভাবে যাওয়া হয় নি.......দীপ্তকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় প্রবাহ। এক কথাতেই ঘড়িটা পড়তে দিয়ে দিল। এমন প্রাণখোলা মানুষ আজকের দিনে বিরল। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে আপনিই চোখ লেগে আসে প্রবাহর।

পরদিন সকালবেলা মোবাইলে সাতটার এলার্মে ঘুম ভেঙে যায়। প্রবাহ চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে। ঘর ভর্তি রোদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই কোনোরকম। মোবাইলের ডানদিকের সরু বাটনটা টিপে এলার্ম বন্ধ করে। একটা বিরাট হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে। প্রথমেই দীপ্তর কথা মনে হয় তার। দীপ্ত ছিল বলে কাল রাতের অনেকটা সময় গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া গেছে। দীপ্তর আসার কারণটা মনে পড়তেই মনে মনে হাসি পায় প্রবাহর। পায়ে পায়ে দরজা খুলে পাশের ঘরে গিয়ে খোঁজ করে। ঘর খালি ! কি আশ্চর্য ! এতো সকালে গেল কোথায় ? তাহলে কি নিচের ফ্লোরের টয়লেটে ? নাকি হরিপদকে চায়ের কথা বলতে গেছে ?  নানারকম ভাবতে থাকে প্রবাহ। মনে মনে বলে, 'ভালোই করেছে বরং দীপ্তদা, সকাল সকাল চা টা পাওয়া গেলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে পারব। পৌনে আটটার মধ্যে বেরোতে হবে যে করে হোক। তার আগে বরং অফিসের সুকান্তদাকে একবার ফোন করে তাড়া দিতে হবে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে কিনা জেনে নিতে হবে।পৌনে আটটার মধ্যেই অফিসে চলে আসার কথা'। সোফায় এসে তাড়াতাড়ি নাম্বারটা বের ডায়াল করে প্রবাহ। ওদিক থেকে সুকান্তদার গলা পেতেই প্রবাহ জিজ্ঞেস করে, 'দাদা বেরিয়ে পড়েছ তো ? আমিও রেডি হচ্ছি এদিকে'।
সুকান্তদার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায় অন্যপ্রান্ত থেকে।  

- একটা খারাপ খবর আছে রে প্রবাহ.....
'খারাপ খবর' ! সুকান্তর গলার স্বরে চমকে ওঠে প্রবাহ, 'কি খবর দাদা' ?
- গতরাতে দীপ্তর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, রাস্তাতেই স্পট হয়ে..... 

চমকে ওঠে প্রবাহ। ক্ষনিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে বলে, 'কি যাতা বলছ ! দীপ্তদা তো কাল রাত থেকে আমার সাথেই আছে......'
- কিঃ !! তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে ? নাকি এখনো ঘুমের ঘোর কাটেনি ! কাল রাত থেকে আমরা কজন মিলে সমানে হাসপাতালে বসে রয়েছি। তুই অনেকটা দূরে আছিস বলেই আর ডাকিনি ইচ্ছে করে। 
- কি বলছ সুকান্তদা !! কিন্তু আমি আর দীপ্তদা যে অনেক রাত অবধি গল্পগুজব করে......... 

ওপ্রান্ত থেকে কথাটা শেষ করতে দেয় না সুকান্ত, বলে, 'প্রবাহ, আমার মনে হচ্ছে তুই বোধহয় স্বপ্নটপ্ন দেখেছিস কিছু। তুই একটু সামলে নে নিজেকে, আর আজকের ট্রিপটা ক্যানসেল কর। আমরা আছি হাসপাতালে, বডি ছাড়লে তোকে ফোন করছি'। ফোনটা কেটে যায়..... 

বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো বসে থাকে প্রবাহ। মাথার মধ্যে তোলপাড় চলতে থাকে। গতরাতের ঘটনা গুলো পরপর জলছবির মতো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মনে মনে বলে, 'এ কিছুতেই সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়। যার সাথে আড্ডা মেরে প্রায় গোটা রাত কাটিয়েছি, কিছুক্ষন আগে অবধি যে ওই সামনের চেয়ারটায় বসেছিল, এখন তার মৃত্যুসংবাদ কিভাবে আসা সম্ভব' ? অজান্তেই সর্বাঙ্গ ঘেমে নেয়ে ওঠে প্রবাহর। 

ঘরের ভিতর হরিপদ এসে দাঁড়ায় চা নিয়ে। প্রবাহকে দেখে বলে, 'ওহ, আপনি উঠে পড়েছেন ? ভালোই হয়েছে, এই নিন, চা টা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন ....... হরিপদর দিকে তাকিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে প্রবাহ, বলে, 'আচ্ছা হরিপদ, কাল রাতে দীপ্তদাকে তুমি গেট খুলে দিয়েছিলে না' ? 
অমন আচমকা প্রশ্নে হরিপদ ঘাবড়ে যায় খানিক। মিন মিন করে বলে, 'দীপ্তবাবু !! কাল, কখন?
- এই বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ.......
- কই না তো ? দীপ্তবাবু তো সেই নটা নাগাদ বের হলেন বাকিদের সাথে......তারপর তো......
- হ্যাঁ হ্যাঁ..... তারপর তো রাতের দিকে আবার এসেছিলো, আমায় ফোন করল, সারপ্রাইজ দিল.....তুমি তো নিচে ছিলে !!
- কিন্তু দাদা, দীপ্তবাবু তো আর আসেননি, আমি তো একটা অবধি জেগেই ছিলুম কাল, রেডিওতে গান শুনছিলুম তো.....
- কি আবোলতাবোল বকছ, ভালো করে মনে করে দেখো, দীপ্তদা তো তোমাকে ফোনও করেছিল...... 

'এ কি বলছেন দাদা' !, হরিপদ কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় প্রায়, 'এই তো.....এই তো দেখুন আমার ফোন, কই দীপ্তবাবু তো ফোন করেননি আমায়.....'

প্রবাহ ফোনটা নিয়ে পাগলের মতো কল হিস্ট্রি সার্চ করতে থাকে, কোত্থাও দীপ্তর নাম খুঁজে পায় না। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সোফার ওপর বসে পড়ে আবার। বিড়বিড় করে বলে, 'কিন্তু এতটা সময়, এতগুলো কথা, সেসব ধোঁয়ার মতো কি করে মিলিয়ে যেতে পারে' ? হরিপদ থতমত খেয়ে যায় বেশ, 'আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে দাদা, কিছু হয়েছে নাকি ? আপনি এমন করে.......'

হরিপদর কথায় আমল দেয় না প্রবাহ, অস্ফুটে বলে, 'আর.........আর সেই ঘড়িটা, যেটা দীপ্তদা আমাকে.........' বলতে বলতেই টেবিলের ওপর চোখ যায় তার। সকালের নরম রোদে ঘড়ির ডায়ালটা টলটলে হ্রদের জলের মতো চিকচিক করছে। যেন দীপ্তই তাকিয়ে আছে আর রহস্যের মর্মান্তিক পরিণতিতে তারিয়ে তারিয়ে হাসছে। বিমূঢ় বিস্ময়ে প্রবাহ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে।
শেষ উপহারের যন্ত্রনা মনের মধ্যে ঘনীভূত হতে থাকে গত রাত্রের মেঘের মতো............

বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories 

Thursday, December 22, 2016

সাপ্তাহিকী ২২ # শখের জিনিস - অন্তিম পর্ব

চৈতালীর তির্যক মন্তব্যের উত্তর না দিয়ে দেবাঞ্জন চলে যান শোবার ঘরে। মনের মধ্যে একরাশ দ্বন্দ্ব সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করতে থাকে। 'ভবিষ্যৎ' কথাটা কাঁটার মতো বিঁধে থাকে কোনো এক গহীন স্থানে ।

পরদিন সকালে অভ্যাসমতো অফিস বেরোলেন দেবাঞ্জন। চোখে সানগ্লাস। নতুন চশমাটা ব্যাগে নিয়ে নিয়েছেন। নানারকম চিন্তায় অন্যমনস্ক ভাবে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যান। পথচলতি দু চারজন চেনা মানুষের 'কেমন আছেন' , 'গুড মর্নিং' , ইত্যাদি কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করেন না। অফিসে পৌঁছে নিজের কিউবিক্যলে গুছিয়ে বসেন। সামান্য ইতস্তত করে নতুন চশমাটা বাক্স থেকে বের করে পড়ে নেন। বাকি কলিগদের নজর এড়ায় না সেটা। দেবাঞ্জনের নতুন অবয়বে হৈ  হৈ করে ওঠে গোটা অফিস। সবাই মিলে ঘিরে ধরে তাঁকে। 'দারুন লাগছে', 'চোখ আছে বটে' , 'কোথা থেকে কিনলে', 'কত দাম নিল',  ইত্যাদি সমস্ত কথাবার্তায় দেবাঞ্জনের মনের গুরুভার লাঘব হয় কিছুটা। দেবাঞ্জনও যতটা সম্ভব ছোট করে বর্ণনা করেন কেমন করে এই বিরল জিনিসটি তাঁর হাতে এসে পড়লো। স্বাভাবিকভাবেই গতরাতের ঘটনাও কিছুটা ফিকে হয়ে আসে আপনিই । অসোয়াস্তির কালো মেঘ কেটে যেতে থাকে একটু একটু করে। দেবাঞ্জন মনে মনে মেনে নেন ওটা হয়তো দেখারই ভুল ছিল। সমস্ত কিছুই নিজস্ব নিয়মে ফিরে আসছিলো একটু একটু করে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় দেবাঞ্জনকে নিয়ে অন্য কোনো পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলে তাঁর স্বস্তির কাল খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সারাদিনের রুটিনমাফিক সমস্ত কাজই করলেন দেবাঞ্জন। সামনে জেনারেল মিটিং আসছে, মার্কেটিংয়ের প্রেজেন্টেশন তৈরির কাজটা প্রায় হয়ে এসেছে। আর দু একটা ডেটাশিট পেয়ে গেলেই শেষ করে ফেলবেন। সেটা নাহয় কালই দেখা যাবে এই ভেবে ডেস্কটপের শাট ডাউন বাটন টা ক্লিক করলেন। স্ক্রিনের আলো ক্রমশ আবছা হতে হতে মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো।

অকস্মাৎ, এক মায়াবী আলোর ঝলকানিতে সামনের স্ক্রিনটা ফের সচল হয়ে উঠলো। দেবাঞ্জন আঁতকে উঠলেন। ভালো করে দেখতে লাগলেন স্ক্রীনটাকে। স্ক্রিনের ওপর ফুটে উঠেছে আগুনের লেলিহান শিখা। সে শিখার সর্বগ্রাসী জিহ্বা স্ক্রিনের চারিদিকে এঁকে বেঁকে ঘুরতে লাগলো ভয়ঙ্কর লালসায়। ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন দেবাঞ্জন। স্পষ্ট দেখতে পেলেন একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে আগুন জ্বলছে। ভারী চেনা লাগলো বিল্ডিংটাকে, কিন্তু মনে করতে পারলেন না কোথায় দেখেছেন। এ দিক ওদিক তাকিয়ে বাকি কলিগদের লক্ষ্য করলেন দেবাঞ্জন। বুঝতে পারলেন ওর স্ক্রিনের দিকে কেউই নজর করছে না তেমন। অজান্তেই গলা শুকিয়ে এলো। চশমাটা সামান্য নাকের নিচে নামিয়ে খালি চোখে দেখার চেষ্টা করলেন স্ক্রিনটা। অবিশ্বাস্য ! স্ক্রিনটা ঘন কালো, নিরীহ বোকা বাক্সের মতো তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, আগুনের ছিঁটেফোঁটা নেই কোনো জায়গাতে। চশমাটা উঠিয়ে নিতেই আবার আগুনের তুর্কি নাচন প্রত্যক্ষ করলেন। তাড়াতাড়ি করে ডেস্কের ওপর থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই ছুটে চলে গেলেন লিফটের দিকে। অফিস থেকে বেরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়লেন মেট্রো স্টেশনের দিকে। মেট্রোতে উঠে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন সমানে। ডিসেম্বরের হিমেল সন্ধ্যাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখাচিত্র ফুটে উঠলো।

বাড়ি ফিরে চৈতালীর সাথে বেশি কথা বললেন না।  চৈতালী ভারী অবাক হলেন। সচরাচর এমনটা হয় না, ডিনার টেবিলে সারাদিনের আলোচনা চলে সুখী দম্পতির মধ্যে। আজ সেখানে দেবাঞ্জন একটাও কথা বললেন না, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। কোনোমতে দুটো রুটি নাকেমুখে গুঁজে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে এলেন। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি যেন রাতের নিস্তব্ধতায় বেশি করে শুনতে পেলেন নিজে। বারে বারে স্ক্রিনের ছবিটা ফুটে উঠছিলো চোখের সামনে। এরকমটা কেন দেখলেন আবার ? তাহলে কি গতরাত্রে আয়নায় যা দেখেছিলেন সেটাও সত্যি ? তবে কি কোথাও আগুন লাগবে আজ ? বিল্ডিংটা যে ভারী চেনা চেনা ঠেকছে, কোথায় যেন দেখেছেন.........কোথায় যেন...........ভাবতে ভাবতেই ড্রয়িং রুমে ফোন বেজে উঠলো তারস্বরে। চমকে উঠলেন দেবাঞ্জন। কান পেতে শুনলেন চৈতালী ফোনটা ধরেছে। কিছুক্ষন কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রেখে দৌড়োতে দৌড়োতে চৈতালী বারান্দায় এসে বললেন, 'এই শোনো, বিভাস ফোন করেছিল, বলল তোমাদের অফিসে নাকি আগুন লেগেছে, দুটো ফ্লোর পুড়ে ছাই একেবারে, তোমায় ফোন করতে বলল তাড়াতাড়ি'।

ফস করে সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে গেলো দেবাঞ্জনের। এক ঝটকায় মনে পড়ে  গেলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে যে বিল্ডিংটা দেখেছিলেন সেটা তাঁর অফিসেরই উত্তর দিক, ওদিকটা খুব একটা যাওয়া হয় না বলেই স্পষ্ট মনে পড়ছিলো না। নিমেষে দেবাঞ্জনের মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেলো ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন বারান্দার ধাপিতে।

চৈতালী চেঁচিয়ে উঠলেন, 'কি হলো' ?
 "ভবিষ্যৎ !.......ভবিষ্যৎ" !, ভয়ার্ত গলায় ঘড়ঘড় করতে লাগলেন দেবাঞ্জন।
'কিসের ভবিষ্যৎ ? কি বলছ কি ?'  চৈতালী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা হাত তুলে তর্জনী দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। চৈতালী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেবাঞ্জনের নতুন চশমাটা রাখা আছে উপুড় করে। টেবিলের ওপর থেকে পড়া সাদা আলোতে যেন তার ঔজ্বল্য বেড়ে গিয়েছে আরও কয়েকগুন । সে চশমাটা যেন উপুড় হয়েই তাকিয়ে রয়েছে তাদের দুজনের দিকে। চশমার লেন্স দিয়ে যেন নিক্ষেপিত হচ্ছে কোনো এক পৈশাচিক হাহাকারের জ্বলন্ত দৃষ্টি।

সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সমস্ত ঘটনা শুনে, চৈতালী কাকতলীয় বলে উড়িয়ে দিলেও নিজেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না পুরোপুরি। একটা সূক্ষ্ম ধন্দ রয়ে গেলো তাঁর মনেও। ইতিমধ্যে দেবাঞ্জনের অফিসে অস্থায়ী কর্মবিরতি ঘোষণা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মচারীদের অনুরোধ করা হয়েছে যে আগামী নোটিস না পাওয়া অবধি কেউ যেন অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন। 

পরের দিন দেবাঞ্জন ঠিক করে নিলেন যেমন করেই হোক একবার বৌবাজারের সেই দোকানে যোগাযোগ করতে হবে। আসল সত্যটা কি, সেটা খুঁজে বার না করা অবধি তিনি শান্তি পাবেন না। টেবিল, আলমারি তন্নতন্ন করে ফেললেন দেবাঞ্জন কিন্তু কোথাও চশমার রিসিটটা খুঁজে পেলেন না। বৃদ্ধ দোকানির ফোন নম্বরটা যে ওতেই লেখা ছিল। চৈতালী বারে বারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন যে এই সমস্ত ঘটনায় অলৌকিক কিছু খুঁজে বেড়ানো সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু দেবাঞ্জন তাঁর কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না। ভবিষ্যতের বিভীষিকা দেবাঞ্জনকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ফেলতে লাগলো। এক অজানা নেশায় মত্ত হয়ে উঠলেন যেন। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, 'আজ সকালেও আমি চশমাটা পড়েছিলাম। কি দেখলাম জানো ? সেই বৃদ্ধ দোকানদার যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওহ ! কি ভয়ঙ্কর প্রলয় সে চাহনিতে ! স্পষ্ট দেখতে পেলাম সে যেন আমার দিকে হাত নেড়ে নেড়ে কি একটা বলছে, কিন্তু আমি একবর্ণ বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু সে উত্তরে এক কুটিল হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো চোখের সামনে থেকে'।   

- এ সমস্তটাই তোমার অতি কল্পনা দেবাঞ্জন। তুমি উচ্চশিক্ষিত, বাস্তববাদী, এসব খেয়ালী বিভ্রম তোমাকে মানায় না। 
- তুমি বুঝবে না চৈতালী, চশমাটা পড়া অবধি আমি ভিতরে ভিতরে বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পাচ্ছি । সে অনুভূতির কেমন যেন এক অন্ধকার, অমোঘ আকর্ষণ। সে আকর্ষণ অবজ্ঞা করার ক্ষমতা নেই আমার। কতকটা............ কতকটা যেন নিশির পিছনে ধাওয়া করার মতো। 
 - এ কি বলছ তুমি দেবাঞ্জন ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? কোথাকার কি একটা চশমা, কি দেখতে কি দেখেছ, তাই দিয়ে নিজের মাথা খারাপ করছ খামোকা ?
- ভুল আমি কিছু দেখিনি চৈতালী........ কোনোরকম ভুল আমার হয় নি, আমি শুধু জানি এ চশমা কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে, একটা ভয়ঙ্কর কিছুর ! আ.....আমায় সেই দোকানে যেতেই হবে......... যে করেই হোক। 

চৈতালী নির্বাক নিস্তব্ধ বসে রইলেন। দেবাঞ্জনকে ক্ষান্ত করতে পারলেন না একবিন্দু। সমস্ত রকম চেষ্টা বিফলে গেলো তাঁর। দেবাঞ্জন বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে গেলেন বৌবাজারের উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োতে একটা ভুল করে বসলেন। চশমাটা ভুলে রেখে গেলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর। কিছুক্ষণ পর চৈতালীর সে দিকে নজরে পড়তেই ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চশমাটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একটা নীলচে আভা আছে যেন। তবে অসাধারণ কিছু নয়। দেখতে দেখতেই এক অদ্ভুত টান অনুভব করলেন চশমাটা পড়ে দেখার। নিয়তির অমোঘ আকর্ষণের বেড়াজালে জড়িয়ে গেলেন ক্ষনিকের বেখেয়ালে। আলতো হাতে চশমাটা তুলে ধীরে ধীরে চোখের ওপর বসালেন। আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখলেন নিজেকে। ছেলেদের চশমা হলেও মন্দ লাগছে না তাকে। তাছাড়া, কি আছে চশমাটাতে ? দেবাঞ্জন অযথাই পাগলামো করছে। একটা নিরীহ গোবেচারা চশমা, তাই নিয়ে একেবারে আকাশকুসুম কল্পনা করছে দেবাঞ্জন। মনে মনেই হাসতে থাকলেন চৈতালী। 'ভবিষ্যৎ' !! ওহ পারেও বটে লোকটা, বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ছাড়া আর কিস্যু নয়। মনে মনে ভাবলেন, একবার বাড়ি ফিরুক, আচ্ছা করে পেছনে লাগবেন দেবাঞ্জনের।

মনের দ্বন্দ্ব সরে যেতেই চশমাটা খুলতে গেলেন চৈতালী। হঠাৎ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো খানিক। পরক্ষণেই সামনেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে চশমার মধ্যে দিয়ে যা দেখলেন তাতে তৎক্ষণাৎ ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেলো তাঁর। পলক পড়লো না চোখে। শ্বাসরুদ্ধ করে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নিস্পৃহ ভাবটা কেটে যেতেই চশমাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেলেন মোবাইলটা আনতে। দেবাঞ্জনকে ফোন করতে হবে...... এক্ষুনি।    

অটো চেঞ্জ করে মেট্রো ধরে নিলেন দেবাঞ্জন। পুঞ্জীভূত মেঘের মতো দমবন্ধ কৌতূহল ঘন জমাট বাঁধতে লাগলো বুকের মধ্যে। সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমেই ডান দিকের ফুটপাথ ধরে হনহন করে হাঁটা লাগালেন। মিনিট তিনেকের পথ। প্রবল আশঙ্কায় হৃদস্পন্দন দ্বিগুন হলো। সামনের সিগন্যাল পেরিয়ে ডানদিকে ঘোরার জন্য রাস্তায় নামলেন। এমন সময় পকেটের ভেতর ঝনঝন করে বেজে উঠলো মোবাইল ফোনটা। দেবাঞ্জন ফোনটা তুললেন না। এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ফোন আসাতে কপালে একরাশ  বিরক্তির ভাঁজ দেখা দিল। ফোনটা কেটে গেলো আপনাআপনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার কম্পন অনুভব করলেন পকেটের মধ্যে। চোখ মুখ কুঁচকে হাত গলিয়ে পকেট থেকে বের করলেন দূরভাষ যন্ত্রটি। চৈতালী ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে রিসিভ করে বললেন, 'হ্যাঁ বলো' । খেয়াল করলেন না ওদিকে সিগনালের রংও সবুজ হয়ে গেছে কখন। চকিতের অন্যমনস্কতায় কথা বলতে বলতে রাস্তা পেরোতে গেলেন দেবাঞ্জন। ঠিক সেই সময়েই বাঁ দিক থেকে সাক্ষাৎ দানবের মতো একটা কালো সিডান এসে সজোরে ধাক্কা মারলো তাঁর কোমরে। তীব্র চিৎকার করে প্রায় কুড়ি গজ দূরে ছিটকে পড়লেন দেবাঞ্জন। মোবাইলটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো রাস্তার চারপাশে। মুহূর্তের মধ্যে রক্তের স্রোত নেমে এলো দেবাঞ্জনের গাল আর চিবুক বেয়ে। সর্পিল গতিতে এঁকে বেঁকে রক্তাভ করে তুললো কালো পিচের পথ । হৈ হৈ করে ভিড় জমে গেলো আশেপাশে। চৈতালীর শেষ ফোনটা তুলতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সাবধান বাণী আটকে পড়ে রইল অপ্রত্যাশিত দুর্ভাগা মুহূর্তদের মধ্যে। অবশ দেহে ডান হাতের কম্পমান রক্তাত আঙ্গুল তুলে ফোনের একটা টুকরো ছুঁতে চাইলেন কোনোরকমে................পারলেন না। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন ভিড় ঠেলে সেই বৃদ্ধ দোকানি এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। ভুরু তুলে এক রহস্যময় চোখে বিড়বিড় করে বললেন, 'চশমা বড়িয়া থি না বাবুজি ? একদম হটকে' ? 
দেবাঞ্জনের চোখের পাতায় ঘন অন্ধকার নেমে এলো ক্রমে ।

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব


#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki


Saturday, December 17, 2016

সাপ্তাহিকী ২১ # শখের জিনিস - প্রথম পর্ব

সকালের কাগজটা নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালেন দেবাঞ্জন। সামান্য ঝাপসা লাগছে যেন। তবে কি পাওয়ার বাড়লো ? তা কি করে হয় ? এই তো কমাস আগেই দোকানে গিয়ে পাওয়ার চেক করালেন। ঠিকই তো ছিল। তবে ? তাহলে বোধহয় চোখে কিছু পড়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে ভালো করে চোখে মুখে জল দিয়ে এলেন, কিন্তু না, ঝাপসা ভাবটা কিছুতেই যেন কাটছে না। ভারী বিপদ হলো। সত্যিই যদি পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো সবকটা চশমার লেন্স চেঞ্জ করতে হবে। সে তো বিরাট ঝক্কির কাজ। নয় নয় করে কম চশমা নেই দেবাঞ্জনের। খান পনেরো বিশেক তো হবেই। দেবাঞ্জনের চশমার ফ্রেমের ভারী শখ। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে নিত্য নতুন চশমার ফ্রেম কিনতে ভারী পছন্দ করেন তিনি। পাড়ার দোকানগুলো তো বটেই বৌবাজারের প্রায় সবকটা দোকানই দেবাঞ্জনকে বিলক্ষণ চেনে। নতুন কোনো ডিজাইন এলেই একাধিক দোকান থেকে ফোন আসে দেবাঞ্জনের কাছে। চশমার খাঁটি সমঝদার হিসেবে পরিচিত মহলেও বেশ সুনাম আছে তাঁর। সুতরাং এহেন দেবাঞ্জনের যদি চোখের পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তবে সমূহ সমস্যা তো বটেই । সাতপাঁচ ভেবে দেবাঞ্জন ঠিক করলেন অফিস ফেরত একবার ইন্ডিয়ান অপ্টিকালসটা ঘুরে আসবেন। লালবাজার আর বৌবাজারের সংযোগস্থলে বহু বছরের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এখানেই দেবাঞ্জন চোখ দেখিয়ে থাকেন বরাবর। আজ একটু কায়দা করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে...........

শীতকাল বলে সন্ধে হয়ে গেছে অনেক্ষণ। চোখ দেখানো হয়ে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন দেবাঞ্জন। পাওয়ার বাড়েনি, ডাক্তার বলেছেন বয়সকালে অমন হয় একটু আধটু। মাঝে মাঝে দৃষ্টি ঝাপসা লাগে। তেমন চিন্তার কিছু নেই। একটা আই ড্রপ লিখে দিয়েছেন শুধু। কয়েকদিন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ফুরফুরে হিমেল হাওয়ায় শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে দেবাঞ্জনের। হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের দিকে এগোতে থাকেন তিনি। সহসা একটা সরু গলির মধ্যে দূরে একটা ভাঙাচোরা দোকানের দিকে চোখ পড়ে যায়। টিমটিম করে একটা হলদেটে বাল্ব জ্বলছে সামনেটায়। একজন বৃদ্ধ একমনে একটা লেন্স পরিষ্কার করছেন একটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয়। দেবাঞ্জন ভেবে মনে করতে পারেন না এই দোকানটা আগে দেখেছিলেন কিনা। আশপাশের দুচারটে দোকান বন্ধ থাকাতে বেশি করে যেন নজর পড়ে এই দোকানটার দিকে। হতে পারে বাকি দোকানের ভিড়ে এই দোকানটা বেমানান বলে ততটা দৃশ্যমান ছিল না। কৌতূহলবশে পায়ে পায়ে এগিয়ে যান দেবাঞ্জন। দোকানের আশপাশটা বেশ সংকীর্ণ, অন্ধকার। বাল্বের আলোর ছটায় দোকানের সামনেটাই যা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চারপাশের জীর্ণ দেওয়ালগুলোয় মান্ধাতা আমলের ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যায় এই গলিটায় খুব একটা জনসমাগম হয় না। দেবাঞ্জনের পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকান বৃদ্ধ। খনখনে গলায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলেন, 'সেলাম বাবুজি, কুছ চাহিয়ে' ?। দেবাঞ্জন লক্ষ্য করেন বৃদ্ধের পরনে সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি পাজামা, মাথায় সাদা মুসলমানি টুপি। কাঁচাপাকা দাড়ির আড়ালে মুখে সরল মৃদু হাসির আভাস। দেবাঞ্জন বলে ওঠেন, ' না না, কিছু চাই না, আসলে এই গলিটায় তো ঢুকিনি কখনো, আপনার দোকানের আলো জ্বলছে দেখে এগিয়ে এলাম'।

'তো কেয়া হুয়া বাবুজি, আপ তসরিফ রাখিয়ে, আপকো আভি বড়িয়া ফ্রেম দিখাতে হেঁ,' বলেই বৃদ্ধ প্লাস্টিকের টুলটা এগিয়ে দেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন চলে আসতে চান, কিন্তু অশীতিপরের প্রতি অসম্মান করা হবে ভেবে বসে যান খানিক। মনে মনে ভাবেন, 'ঠিক আছে, দু একটা ফ্রেম দেখেই উঠে পড়বেন নাহয়, তাছাড়া দোকান দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওঁর মনের মতো জিনিস এখানে পাওয়া সম্ভব নয়'। বৃদ্ধ কাঁচের আলমারি থেকে একের পর এক ফ্রেম বের করে রাখতে থাকেন টেবিলের ওপর। অধিকাংশ ডিজাইনই হয় পুরোনো আমলের নয় সাধারণ মানের। দেবাঞ্জনের মতো শৌখিন মানুষের উপযুক্ত নয় সেসব। দু একটা ফ্রেম নেড়েচেড়ে উঠে পড়েন তিনি। কোনোটাই পাতে দেবার মতো নয়। বলেন, 'আজ নাহয় থাক, আমি আরেকদিন আসব'। বৃদ্ধ হাঁ হাঁ করে ওঠেন, 'সে কি বাবুজি, ঔর একদিন কিঁউ, হাম আভি আপকো...........' কথাটা শেষ করতে দেন না দেবাঞ্জন, বিরক্ত হয়ে বলেন, 'না না থাক, আমি অন্যদিন আসবখন'। বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বলেন, 'আচ্ছা আচ্ছা রুকিয়ে, মুঝে পাতা হ্যায় আপকো ক্যায়সা ফ্রেম পসন্দ আয়েগা, এক মিনিট'..........বলেই পিছন ফিরে আলমারির তলা থেকে বের করে আনেন একটা সোনালী রঙের কাজ করা চৌকো মতো বাহারি কাঠের বাক্স। কাঠের বাক্সটা দেখে কিঞ্চিত থমকান দেবাঞ্জন। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বাক্স খুলে মখমলি কাপড়ের মধ্যে থেকে বের করে আনেন একটা ঈষৎ নীলচে রঙের মোটা ফ্রেমের চশমা। সে চশমার কোনো অসামান্য কারুকাজ নেই বটে তবে তার জৌলুস ও চেকনাই যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সে দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে যান দেবাঞ্জন। বহু ডিজাইনার চশমা পড়েছেন এ যাবৎ কিন্তু এমন জিনিস কখনই তাঁর নজরে আসেনি। হলদেটে বাল্বের আলোয় সে চশমার দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোতে থাকে।

'প্যহনিয়ে বাবুজি, একবার প্যহনকে কে তো দেখিয়ে', মিটিমিটি হাসতে থাকেন বৃদ্ধ। চশমাটা পড়ে নিয়ে আয়নায় চোখ রাখেন দেবাঞ্জন, বাহান্ন বছরের মুখটা যেন ঝকঝক করছে, বয়সের বলিরেখা ছাপিয়ে এক আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে যেন। বেশ বুঝতে পারেন এ জিনিস দিশি নয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কোথায় পেলেন এইটা' ? বৃদ্ধ এক মোহময় হাসি ছড়িয়ে বলেন, 'বাহারকা চিজ হ্যায় বাবুজি, সিঙ্গাপুর সে আয়া হ্যায়, সোচেথে কোই আচ্ছা সমঝদার আয়েগা তো নিকালেঙ্গে ইসে। আপহিকো দিখরহেঁ পেহলিবার'। দেবাঞ্জন চশমাটা খুলে তেরছা চোখে বলেন, 'লেন্সের পাওয়ার বললে কত তাড়াতাড়ি বানিয়ে দিতে পারবেন' ? বৃদ্ধ সামান্য চোখ কুঁচকে বলেন, 'করিব একঘন্টে মে রেডি হো জায়গা সাহাব'।

- আর দাম কত নেবেন ? ঠিক করে বলবেন কিন্তু, নাহলে........
- ঢাইহাজার কা এক পয়সা কম নেহি হোগা বাবুজি.......আপ সে কেয়া ঝুট বোলনা, আপ পেহলইবার মেরে দুকান আয়েহেঁ.....

সামান্য একটু চিন্তা করেন দেবাঞ্জন, তারপর পকেট থেকে সদ্য পাওয়া প্রেসক্রিপশনের কাগজটা বের করে বলেন, 'ঠিক আছে, যত তাড়াতাড়ি পারেন বানিয়ে দিন, আমি ওয়েট করছি'............   

নতুন চশমা পাওয়ার আনন্দে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢোকেন দেবাঞ্জন। চৈতালী জিজ্ঞেস করেন, 'কি ব্যাপার এতো দেরি করলে আজ' ?
- আর বোলো না বৌবাজার গিয়েছিলাম চোখ দেখাতে, ফেরার পথে একটা ভালো ফ্রেম পেলাম বুঝলে, কিনে নিলাম। বানাতেই যা একটু সময় লাগলো। 
- ওফফ, আবার চশমা, তোমাকে যে কি এক অদ্ভুত শখে পেয়ে বসেছে ভগবান জানেন। 

চৈতালীর কটাক্ষে খুব একটা পাত্তা দিলেন না দেবাঞ্জন। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ডিনার সেরে নিলেন। চশমাটা আরেকবার চোখে না পড়া অবধি শান্তি নেই। ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঠের বাক্স খুলে বের করে আনেন চশমাটা। টিউব লাইটের আলোয় ফ্রেমটা চকচক করে ওঠে। দেবাঞ্জনের মুখাবয়ব জুড়ে চরম তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে পড়ে। পুরোনো চশমাটা খুলে রেখে নতুন ফ্রেম গলিয়ে নেন দু কানের পাশে । প্রথমটায় সামান্য একটু ঝাপসা লাগে। আলতো হাতে ফ্রেমটা আরেকবার সেট করেন নাকের ওপর। এইবার পরিষ্কার লাগে চারিদিক। বেশ দেখাচ্ছে। তারিয়ে তারিয়ে দেখতে থাকেন নিজেকে আর মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেন বিরল অর্জনের উল্লাসে।
  
কিন্তু এ কি !! এটা কি দেখছেন ! কপালের ওপর একটা কাটা দাগ আর সামান্য ফোলা লাগছে যেন।
কি আশ্চর্য ! এটা তো খেয়াল করেননি আগে। কখন চোট লাগলো আর কোথায়ই বা লাগলো ? দেবাঞ্জন চিন্তা করতে লাগলেন। কিন্তু কপালের চোটটা কিছুতেই মনে করে উঠতে পারলেন না। দোকানে কি আয়না দেখেছিলেন ? হ্যাঁ, কিন্তু তখন তো ছিল না। তাহলে কি মেট্রোতে কোনোভাবে ধাক্কা টাক্কা ..................নাহ, মনে পড়ছে না বিন্দুমাত্র। ছটফট করতে থাকেন দেবাঞ্জন। আনন্দের এমন সন্ধিক্ষণে সামান্য চোটের চিন্তায় বিব্রত হয়ে পড়েন বেশ। হাত বাড়িয়ে কাটা জায়গাটায় ছুঁয়ে দেখলেন একবার। অদ্ভুত ! কোনো ব্যাথা তো নেই ! চশমাটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে রেখে আবার আয়নার দিকে তাকালেন। একি ! একি দেখছেন তিনি ? বার কতক ভালো করে মুখটা দেখলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কপালের কাটা দাগটা বেমালুম উধাও। আশ্চর্য ! এই তো ছিল ! তাহলে কি ভুল দেখছিলেন এতক্ষণ ? তাড়াতাড়ি চশমাটা গলিয়ে নিয়ে আবার আয়নায় চোখ রাখলেন।  এই তো ! এই তো দেখা যাচ্ছে কাটা দাগটা ! কি ব্যাপার হলো ? চশমা পড়ে দাগটা দেখা যাচ্ছে দিব্যি অথচ চশমা খুলতেই দাগটা উধাও ! চশমাটা খুলে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন দেবাঞ্জন, সন্দেহ করার মতো কিছু পেলেন না খুঁজে। টেবিলের ওপর চশমাটা রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন । এ কি হচ্ছে ? এমনটাতো হয়নি আগে, তবে কি বয়েসের ভারে চোখেও ভুল দেখতে শুরু করলেন এবার ? মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন তোলপাড় করতে লাগলো। ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে এগোলেন কপাল কুঁচকে। চৈতালী রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হলো ফ্রেমটা দেখালে না আমায়' ? ব্যাজার মুখ করে দেবাঞ্জন বললেন, 'আসছি, ব্রাশটা করে আসি'। 

এইবার এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। বাথরুম থেকে বেরোবার সময়, ক্ষনিকের বেখেয়ালে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে দড়াম করে সামনে পরে গেলেন দেবাঞ্জন। মাথাটা জোর ঠুকে গেলো বাঁদিকের বেসিনটাতে। 'কি হলো কি হলো' বলে চিৎকার করে ছুটে এলেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কপাল ধরে মুখ কুঁচকে বসে রইলেন মেঝের ওপর। চরম যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছে সারা শরীর জুড়ে। কোনোরকমে ধরাধরি করে দেবাঞ্জনকে ওঠালেন। বললেন, 'একটু দেখে বেরোবে তো, ইশশশশ..... দেখো তো কপালটা কেমন কেটে গেলো বিচ্ছিরিরকম, তুমি সোফায় গিয়ে বস, আমি আয়োডিন নিয়ে আসছি',। 

আয়োডিন লাগিয়ে ধীরে ধীরে সোফা থেকে উঠলেন দেবাঞ্জন। বিছানায় যাবার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন একবার। ভালো করে দেখতে লাগলেন কতটা কেটেছে। যা দেখলেন তাতে দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। দুহাত আয়নার ওপর ভর দিয়ে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন কপালটা। কিছুক্ষন আগে আয়নায় দেখা কপালের অবিকল একই জায়গায় চোটটা লেগেছে, ঠিক ততটাই কেটেছে এবং ততটাই ফুলে উঠেছে। বেশ কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চুপ। ভুল দেখছেন নাকি ? এ কি করে সম্ভব ! চিৎকার করে ডাকলেন চৈতালীকে। চৈতালী ছুটে এলেন হুড়মুড়িয়ে।

'কি ব্যাপার ? আবার কিছু হলো নাকি' ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'আচ্ছা, মনে করে দেখো তো, বাড়ি ঢোকার পর আমার কপালে কি কোনো কাটা দাগ বা চোট দেখতে পেয়েছিলে' ?.......... 'চোট ? কই না তো.......... কেন' ? চৈতালী অবাক হন। 'না, মানে আমি নতুন চশমাটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম জানো, স্পষ্ট দেখতে পেলাম কপালের এই বাঁদিকটায় একটা কাটা দাগ আর কেমন ফুলেও উঠেছিল' , বলে আঙুল দিয়ে কপালের জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দেখান দেবাঞ্জন। চৈতালী ভারী আশ্চর্য হয়ে দেবাঞ্জনের মুখের দিকে তাকান, তারপর বলেন, 'আমি কিন্তু কোনো চোট টোট দেখিনি বাপু, আমার মনে হয় তুমি ভুল দেখেছ'। 
'না না চৈতালী, ভুল আমি দেখিনি, বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছিলাম, কারণ আমি চশমাটা পড়েছিলাম,....... দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক এই জায়গাটায়..............' তোতলাতে থাকেন দেবাঞ্জন। 
'হ্যাঁ বুঝেছি, তুমি আয়নায় দেখলে আর তারপরেই পড়ে গিয়ে এক্কেবারে কপালের ঠিক ঐখানটাতেই চোট পেলে তাই তো' ? ঘাড় বেঁকিয়ে কৌতুকভরে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন হতভম্ব হয়ে যান, স্ত্রীর পরিহাসের কি উত্তর দেবেন ভেবে পান না। বটেই তো, যে আগের ঘটনাটা দেখেনি তাকে নির্ভুল ভাবে বোঝানো অসম্ভব, তাছাড়া বয়সজনিত সমস্যাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয় একেবারে। কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন দেবাঞ্জন, তারপর অস্ফুটে বলতে থাকেন, 'আমি কিন্তু ঠিকই দেখেছিলাম....... জানিনা কি করে ................' 
চৈতালী অট্টহাস্য করে ওঠেন, বলেন, 'তোমার নতুন চশমায়, কয়েক ঘন্টা পর কি হবে সেসব দেখা যায় বুঝি ? হাঃহাঃহাঃহাঃ, ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া যায় বলছো' ?....................

(ক্রমশ)

শিল্প বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki

Saturday, July 23, 2016

সাপ্তাহিকী ১৪ # জ্যোতিষী

দুপুরের গনগনে আঁচটা এমাসে আর তেমন নেই বললেই চলে। ঘড়ির কাঁটা চারটে দশ ছুঁই ছুঁই করছে। শ্রাবনের শেষের দিনগুলো ইদানিং একটু গুমোট বেঁধে আছে। অস্থির হয়ে উঠেছে রায়া। সিমেন্টের বেঞ্চিটাতে বসে ঘন ঘন হাতঘড়িটার দিকে তাকাতে থাকে। কিঞ্জল বড্ডো দেরি করছে যেন আজকে ! দক্ষিণ কলকাতার লেকের এই পূর্ব-দক্ষিণ দিকটা বরাবর তাদের ভীষণ প্রিয়। শান্ত, নিরিবিলি, ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটায় দুদণ্ড কথা বলা যায় মনের সুখে। সামান্য অযত্নের জঙ্গল আর এভিনিউ সম্মিলনী ক্লাবের পিছন দিক হওয়ার দরুন অনেকেই এদিকটা এড়িয়ে চলে। ফলে নিজেদের আলাপচারিতার টুকরো মুহূর্তগুলো অবলীলায় প্রজাপতির মতো বাধাহীন উড়ে বেড়ায় ইতিউতি।

অকস্মাৎ বাঁদিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে রায়ার। দুটো বিবর্ণ ঘোলাটে চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঝট করে চোখ সরিয়ে নেয় রায়া। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা অস্বস্তি শুরু হয় যেন। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। প্রবল আশঙ্কায় ধীরে ধীরে আবার বাঁ দিকে ঘুরে তাকায় সে। একজন রোগাটে, শীর্ণ বৃদ্ধ অপলক তাকিয়ে আছেন তার দিকে। বড় অদ্ভুত সে চাহনি। মাথা থেকে পা অবধি পড়ে ফেলার এক তীব্র প্রচেষ্টা যেন সে চোখ দুটোতে। প্রথম নজরে চমকে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কি করবে ভেবে পায়না রায়া। উঠে চলে যাবে নাকি অন্য কোনো দিকে ? গিয়ে বসবে অন্য কোনো বেঞ্চিতে ? কিঞ্জলটাই বা দেরি করছে কেন এতো ? শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হতে থাকে অজান্তেই।

- কিরে ? কতক্ষণ ?
চমকে ওঠে রায়া। কিঞ্জলকে সামনে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ঠোঁটের ওপর আলগা হাসি ঝুলিয়ে, হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে ঈষৎ হাঁপাচ্ছে কিঞ্জল।

- এতো দেরি করলি ? আমি তো সেই কখন থেকে ওয়েট করছি !!
- আর বলিস না, অফিস থেকে বেরোতে যাবো, অমনি বসের জরুরী তলব। তড়িঘড়ি একটা কাজ            মিটিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছি।
- হুমম, যত কাজ তোর, আর আমার সময়ের কোনো দাম নেই না ?
- বুঝিসই তো, প্রাইভেট কোম্পানি, হুট্ করে বেরোনোটা খুব চাপের হয়। নেহাত অফিসটা পাশেই, তাই   কিছুক্ষনের জন্য ম্যানেজ করতে পেরেছি।  যাইহোক...... বল, হঠাৎ ডেকে পাঠালি ?
- হ্যাঁ, কথা ছিল। বাবা ফোন করেছিলেন কাকুকে গত রাত্রে, জানিস নিশ্চই ?
- হ্যাঁ, জানি তো।
- বিয়ের ডেটটা খুব সম্ভব নভেম্বরেই ফিক্সড হচ্ছে।
- হ্যাঁ, সেটাও জানি........তো ?
- আঃ, তুই ব্যাপারটা বুঝছিস না ! আমার কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে ভেতর ভেতর।
- হ্যাঁ, এরকমটা হয় বটে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে....... তো ?
- ধ্যাৎ ! কি তো তো করছিস তখন থেকে ? এরকম একটা ইম্পরট্যান্ট ইস্যু, আগের থেকে একটু ভাবা     দরকার কিনা আমাদের ? তা নয়, শুধু ইয়ার্কি !
- হাহাহাহাহা, দ্যাখ রায়া, এতো টেনশন করছিস কেন ? আমাদের বাবা মায়েরা তো অনেকদিন আগে  থেকেই জানেন আমাদের সম্পর্কটা, তাঁরা তো কোনো আপত্তি করেননি কখনোই, তাই না ? আর  তাছাড়া আমরা ছোটবেলার বন্ধু। দুজনে দুজনের বাড়ির লোকদের খুব ভালো করে চিনি। ফলে  কোনো সমস্যা হবে না দেখিস। আমি বলছি তো, দ্যাখ সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, শুধুশুধু টেনশন করিস  না ওতো।
- তুই জানিস নারে কিনু, আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে জানিস আজ সকাল থেকে, একটা চাপা      অস্বস্তি............বুকের মধ্যে কেমন যেন....... মানে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না তোকে, কিন্তু কেন  যেন আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে......... ভয়ঙ্কর কিছু একটা !
- ধুর পাগল ! ওসব ভাবিস না তো। তারচেয়ে বরং চল, আমরা একটু শপিং করে নিই, হাতে আর মাত্র     কয়েকটা দিন......
- নাহ ! আমার এখন এসব কিচ্ছু ভালো লাগছে না, আমি কোত্থাও যাবো না........
- সে কিরেএএ !! তোর শপিং এ অনীহা ! আমি তো ভাবতেই পারছি না মাইরি !
- হ্যাঁ, আজ বাদ দে, অন্য কোনো একদিন যাবো, আজ মোটেই ইচ্ছে করছে না।

ভারী অবাক হয় কিঞ্জল। সচরাচর এমনটা দেখেনি সে, শপিং বলতেই যে এক পায়ে খাড়া হয়ে যেত সে আজ যেতেই চাইছে না কোথাও !

-দ্যাখ, তুই যদি না যাস তবে আমি চললুম অফিসে, খামোকা এখানে বসে থেকে থেকে আমার  কাজগুলো হ্যাম্পার হবে। এমনিতেই বিয়ের কাজে টুকটাক ছুটি নিতে হবে, তারওপর লম্বা ছুটি তো  আছেই পরে। তাই এখন কোনোরকম ফাঁকি মারাটা এফোর্ড করতে পারবো না, সিরিয়াসলি !
- ঠিক আছে, তুই যা অফিস। অন্য কোনো একদিন বেরোবো না হয়।
- বোঝো ঠ্যালা ! কি হলো বলতো তোর ? শরীর ঠিক আছে তো ?
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, আমি বরং একটু বসি এখানে, তারপর চলে যাবো।
- তুই সিওর ? যাবি না তো তাহলে ?
- হুমম।
- বেশ, আমি আসছি, সাবধানে বাড়ি যাস, দেখি সন্ধের দিকে যদি একবার তোর বাড়িতে ঢুঁ মারতে            পারি।
- আচ্ছা।

হাত নেড়ে কিঞ্জলকে টাটা করে দেয় রায়া। যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো, অফিসের তাড়ায় ঠিক তেমনই ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায় কিঞ্জল। গেট অবধি চোখ যায় রায়ার, কিঞ্জল চলে যেতেই মুখ ঘুরিয়ে লেকের জলের দিকে তাকায় সে। দমবন্ধ ভাবটা কাটছে না কিছুতেই। বাঁদিকে তাকাতেই আবার একপ্রস্থ চোখাচোখি হয় সেই বৃদ্ধের সাথে। ঘোলাটে চাউনির সাথে এবার যোগ হয়েছে কিঞ্চিৎ পরিহাস। কিছু বুঝে উঠতে পারে না রায়া। দোনোমোনো করে উঠে পরে বেঞ্চটা থেকে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বৃদ্ধের দিকে। ভালো করে জরিপ করে নেয় আপাদমস্তক। সত্তরের আসেপাশে বয়েস হবে। উস্কোখুস্কো সাদা চুল, কাঁচা পাকা দাড়ি, পুরোনো সুতির পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত বৃদ্ধের সারা শরীর জুড়ে অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতার ছাপ। মুখের বলিরেখায় দৃঢ়তার চিহ্ন স্পষ্ট। অনাবশ্যক কৌতূহল জাগে রায়ার।

- কি ব্যাপার বলুন তো ? আমি দেখছিলাম আপনি সমানে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আপনি কি       কিছু বলবেন ?

একটা শান্ত, স্মিত হাসি খেলে যায় বৃদ্ধের মুখজুড়ে, ধীরে ধীরে ঘোলাটে দৃষ্টিটা পরিষ্কার হয়। একটু কেশে, চোখ তুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করেন রায়াকে। তারপর পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলেন, 'বোসো'। কৌতূহলের বশে বৃদ্ধের পাশে বসে পরে রায়া, সামান্য দূরত্ব রেখে। ভাঙা গলায় খুব আস্তে আস্তে শুরু করেন তিনি।

- তোমায় দু একটা কথা বলার ছিল মা, অবশ্যি তোমার যদি সময় থাকে কিছুটা।
- কি ব্যাপারে ? মানে আমি তো ঠিক.......
- বলছি, বলছি, তার আগে তোমার নামটা বলো দেখি.......
- রায়া..........রায়া সেনগুপ্ত।
- হুমমমমম,........ (সামান্য দম নিয়ে) খুব মন দিয়ে শোনো মা। আমি যা বলছি সেটা বিশ্বাস করা একটু   কঠিন হবে, তবে একটুও মনগড়া কিছু বলছি না এটুকু জেনে রেখো।

রায়া এবার একটু নড়েচড়ে বসে বেঞ্চিটায়। বাঁ হাতটা চিবুকের তলায় রেখে একনিষ্ঠ শ্রোতার মতো বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিস্পলক। বৃদ্ধ কম্পিত স্বরে বলে চলেন........

- খুব টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ তুমি মা। তোমার গ্রহকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এর অবিশ্যি দু একটা কারণ আছে বটে, তবে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তোমার হবে না। তাই আমি পরামর্শ দেব, তুমি একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো রাস্তাঘাটে। গ্রহরাজের প্রকোপটা বড় বেশি পড়েছে এই সময়টাতে। তোমার নক্ষত্রেরা অন্য পথে ছুটতে শুরু করেছে,....... অর্থাৎ..... একটা ভীষণ রকমের গোলমাল হতে পারে যখন তখন। সুতরাং খুউউব সাবধাআন ! সামনে তোমার চরম বিপদ !! তুমি হয়তো জানো না, সে বিপদ ছায়ার মতো তোমার সাথেই ঘোরাফেরা করছে সর্বক্ষণ। একটু অন্যমনস্ক হয়েছ কি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। তখন কিন্তু আর রক্ষে থাকবে না। তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না, এই আমি বলে দিলুম হ্যাঁ।

চোখের পলক পড়ে না রায়ার। হ্রদের জলে বিকেল মিশে এসেছে অনেকটা। ঘরের ফেরার তাড়াহুড়োয় একঝাঁক পাখি কিচিরমিচির করতে করতে  উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ধীর লয়ে বহুদূর থেকে কোনো এক ঠান্ডা অথচ মৃদু হাওয়া বইতে থাকে। জলের ওপর ছোট ছোট তরঙ্গের রেখা আঁকা হয়ে যায় অচিরেই। হঠাৎই একটু শীত শীত করতে থাকে রায়ার। খানিক থমকে, সমস্ত জড়তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে গলা খাকারি দেয়। তারপর বলে,

- এসব কি আবোলতাবোল বকছেন বলুন তো ? আমার বিপদ ! হঠাৎ আমার বিপদ কেন হতে যাবে ?     আর আপনি কে, বলা নেই কওয়া নেই আমায় আজগুবি গল্প শোনাচ্ছেন।
- হাহাহাহা, আমি তো প্রথমটাতেই বলেছিলুম যে তোমার বিশ্বাস হবে না, অথচ তুমিই জানতে চাইছিলে আমার কিছু বলার আছে কিনা।

চোখের কোণে কৌতুক খেলে যায় বৃদ্ধের। কিন্তু পরমুহূর্তেই চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে, দু চোখের দৃষ্টি পাল্টে যায় এক লহমায়। ঘড়ঘড়ে গলায় বলে ওঠেন, "শোনো হে খুকি ! আমি হলুম জ্যোতিষ কালীপ্রসাদ মুখুজ্জে, শহরের নামি দামী জ্যোতিষীরা আমার নাম আউড়ে, মনে মনে পেন্নাম ঠুকে তবে গণনার আঁক কষতে বসে, আমার বিধান ইস্পাতের ফলার মতোই কঠিন এবং দৃঢ়। যা বলে এসেছি তার একচুলও নড়চড় হয়নি কোনোদিন, তার অন্যথা আজও হবে না জেনে রেখো। তোমায় সাবধান করা উচিত বলে মনে হলো, তাই বললুম, বিশ্বাস করা না করাটা তোমার ব্যাপার, বিপদে যখন পড়বে তখনই টনক নড়বে দেখছি"।

হাঁ হয়ে যায় রায়া, কোনো কথাই জোগায় না মুখে, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বৃদ্ধের মুখের দিকে। ওনার কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনি হতে থাকে কানের মধ্যে। কোনো মতে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা আমার যে বিপদ তা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন"?
এক চিলতে হাসি খেলে যায় কালীপ্রসাদের দাড়িগোঁফের ফাঁকে।
-আমি জানতুম, তুমি এই প্রশ্নই করবে। একটু পরীক্ষা করে নিতে চাইছ, তাই তো ? আচ্ছা বেশ, তোমার জন্ম তারিখটা বলো.....
- ১৯শে আগস্ট ১৯৮৯।
-  আর জন্ম সময়টা...... মনে আছে কি ?
- খুব সম্ভব..... সকাল আটটা পয়ঁত্রিশ।
- বেশ.....

দুপা জড়ো করে সটান বাবু হয়ে বসেন কালীপ্রসাদ, দুটো হাত রাখেন কোলের ওপর, তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেন। বিস্ময়ে হতবাক রায়া নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধের দিকে। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কাটে, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খোলেন উনি। রায়ার দিকে এক অদ্ভুত রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, "শিবরামপুরে তোমাদের একটা জমি আছে সেটা নিয়ে বিস্তর ঝামেলা হচ্ছে কমাস ধরে........... গত কয়েকদিন যাবৎ তোমার মা বেজায় কোমরের ব্যাথায় ভুগছেন...........গতকাল সন্ধে থেকে তোমার ভাইয়ের জ্বর হয়েছে...........আজ সকালে বাড়ির সদর দরজায় পিছলে পড়ে গেছিলে তুমি............দুপুরে খাওয়ার সময় তোমার বাবার গলায় ইলিশ মাছের কাঁটা ফুঁটে যায়............ তোমার সাধের মিনি বেড়ালটা আজ দুদিন হলো বেপাত্তা..........
কি ? আরও  বলব, নাকি এতেই যথেষ্ট মনে হচ্ছে" ?

বিস্ফারিত চোখে রায়া তাকিয়ে থাকে কালীপ্রসাদের দিকে। শব্দগুলো জিভের সাথে জড়িয়ে যায় মুখের ভিতর। চোখের সামনে লেকের চারপাশটা দুলে ওঠে কেমন যেন। কোনো মতে আমতা আমতা করে জড়ানো স্বরে বলে, "আপনি কি করে এসব.........!!! মানে আপনাকে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না, অথচ আপনি গড়গড় করে সমস্ত কিছু............ কিভাবে !!!  এ, এ  কেমন করে সম্ভব ??
- কালীপ্রসাদের কিছু দেখতে শুনতে লাগে না মা........ নিখুঁত,নির্ভুল গণনায় বরাবর আমি সিদ্ধহস্ত।

রায়ার ঘোর কাটে না কিছুতেই, কেমন নেশার মতো বুঁদ হয়ে কালীপ্রসাদের কথা শুনতে থাকে অবিচল। কালীপ্রসাদ বলেন, "সে যাইহোক, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যাটা হলো তোমার বিপদ, যে অজান্তেই তোমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, একটা ভুল পদক্ষেপ আর তুমিও তোমার বন্ধুর মতো......."
- আমি ঠিক বুঝলাম না.......আমার বন্ধু.... ? মানে ?
এদিক ওদিক সন্তর্পনে তাকিয়ে গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন কালীপ্রসাদ, "তোমায় ডাকছে রায়া, তোমার বন্ধু তোমায় ডাকছে......... তুমি সাড়া দিলেই বিপদ !!........"
- আপনি কি বলছেন......... আমি ঠিক.......
- কেন ? তোমার ছোটবেলার বন্ধু.........তোমার হবু স্বামী.......কিঞ্জল !!
- কিঞ্জল ?? কেন......কিঞ্জলের কি হবে !!
- কিঞ্জল যে তোমায় ডাকছে মা ! বহুদূর থেকে বারেবারে সে যে ডেকেই চলেছে তোমায়.......সে ডাক অগ্রাহ্য কোরো তুমি, নাহলে আর বাঁচবে না কিছুতেই......
- এ আপনি কি বলছেন ?? দুদিন পর যার সাথে আমার বিয়ে, তাকে অগ্রাহ্য করতে বলছেন ?? শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায় রায়ার।
"এ বিয়ে তো হওয়ার কথা নয় মা, অশরীরীর সাথে বিয়ে তো হয় না কোনো মানুষের..........." ঠান্ডা গলায় বলেন কালীপ্রসাদ। একটা পেঁচা ডানা ঝাপটিয়ে চলে যায় এগাছ  থেকে ওগাছে।

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পরে রায়া। রেগে যায় প্রচন্ড। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, "এবার কিন্তু আপনি বড্ডো বাড়াবাড়ি করছেন মশাই, অতীত, ভবিষ্যতের কথা জ্যোতিষীরা মিলিয়ে দেয় বটে, তবে এটা আপনি যা বললেন তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না"।
-আমি কোনো কথাই এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না............টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আজ দুপুরের পথ দুর্ঘটনায় তোমার কিঞ্জল.............

"না-না-নাআআআ", এক মরমী, গগনভেদী চিৎকার করে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে তোলে রায়া। "এই তো কিছুক্ষন আগেই আমার সাথে দেখা করে গেল........আর আপনি বলছেন........না না, এ হতে পারে না, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন, এ সমস্তটাই আপনার ভণ্ডামি, সস্তার ট্রিক্স দেখিয়ে টাকা কামানোর উপায় ফেঁদে বসা, আমি এসব বুঝি না ভেবেছেন ??
-ঠিকই বলেছো, কিছুক্ষন আগে যে তোমার সাথে দেখা করে গেল সে কিঞ্জলই বটে, তবে রক্তমাংসের নয় এটুকু হলপ করে বলতে পারি। আর সে তোমায় নিয়ে যেতে এসেছিলো তার সঙ্গে করে, তোমার ভিতরের চাপা অস্বস্তিটাই তার পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলে। তবে বিপদ দূর হয়নি এখনো। সে আবার আসবে.............
- কিঞ্জলের যদি কিছু হতো তাহলে আমার কাছে ফোন আসতো সবার আগে। কই তেমন তো কিছু আসেনি এখনো।
- তোমার ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই......... পরখ করে দেখতে পারো।

তাড়াহুড়ো করে কাঁধের ব্যাগের চেন খুলে ভিতর থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে রায়া, তড়িৎ গতিতে আঙ্গুল চালায় কিপ্যাডে, পরক্ষনেই বুকটা কেঁপে ওঠে ধড়াস করে...................
ফোনটা সুইচড অফ !!.............. এক অব্যক্ত আতঙ্ক নিয়ে তাকায় কালীপ্রসাদের দিকে। কালীপ্রসাদ মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, "কি......আমার কথা মিলল তো" ?

গলা শুকিয়ে আসে রায়ার, পেটের ভিতর থেকে কে যেন জিভটাকে ভিতর দিকে টেনে নামিয়ে আনতে চাইছে। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোয় গলা থেকে, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বলে, "কিন্তু....... ফোন সুইচড অফ হওয়াটা তো কাকতলীয়ও হতে পারে তাই না"?
-বেশ.......... এখনো যদি আমার কথা বিশ্বাস নাহয় তাহলে বরং ওই ডালমুটওলাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, সে তো এদিকটাতেই ঘুরছে অনেক্ষণ ধরে, জিজ্ঞেস করো সে তোমার কিঞ্জলকে দেখেছিলো কিনা।

হ্রদের ধার ঘেঁষে পড়িমরি করে দৌড়য় রায়া উল্টোদিকে। ডালমুটওলার সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "ভাই একটা কথা বলবে" ? ডালমুটওলা ভারী অবাক হয়ে চোখ কুঁচকে তাকায় রায়ার দিকে ।
- আমি যখন বিকেলের দিকে এই বেঞ্চিটায় বসে ছিলাম........এই যে এই বেঞ্চিটায়........ আমার পাশে       নীল রঙের চেকশার্ট পরা একটি ছেলেকে বসতে দেখেছিলে ?
- কিছু মনে করবেন না দিদি,..... মানে....... একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
- কি ?
- আপনার কি শরীরটা একটু খারাপ লাগছে ?
- আঃ...... যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তরটা দাও ভাই, আমার পাশে কি কোনো নীল রঙের শার্ট পরা ছেলেকে বসতে দেখেছো তুমি ?
রোগা ছিপছিপে ছেলেটি এক কথায় উত্তর দেয়.....  "না".........

মাথাটা ভীষণরকম টলে যায় রায়ার, চেঁচিয়ে বলে, "কি যাতা বলছো !!......... আমার পাশে কাউকে বসতে দেখোনি তুমি !!!
- না দিদি, শুধু এই বেঞ্চিটা কেন ? আপনি এই বেঞ্চিতে বসার কিছুক্ষন পরেই উঠে গিয়ে ওই দিকের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন, তারপর কি যেন সব বিড়বিড় করতে লাগলেন, কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে...........কি ব্যাপার বলুন তো দিদি !! আপনার কি শরীর খারাপ ??

এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে পিছনে দূরের বেঞ্চিটার দিকে দেখে রায়া। যেখানে কালীপ্রসাদ আর সে এতক্ষন বসে কথা বলছিলো........ আশ্চর্য !!! বেঞ্চিটা বেমালুম ফাঁকা !! হাড়হিম করা একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় রায়ার পিঠ বেয়ে। তবে কি ??........... তবে কি পুরোটাই ভুল দেখলো এতক্ষণ, মাথাটা কি তাহলে খারাপ হয়ে গেলো তার ? তবে এতটা সময় কালীপ্রসাদের সাথে এতগুলো কথা.........!!!
সবটাই কি মিথ্যে ?? একের পর এক প্রশ্ন ঝড়ের মতো তোলপাড় করতে থাকে রায়ার মনের মধ্যে। মিনমিন করে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি বলছো, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা কোনো বয়স্ক ভদ্রলোককে আমার সাথে দেখোনি ওই বেঞ্চিটায় ?
-  সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ? বয়স্ক ভদ্রলোক ? আচ্ছা কাঁচা পাকা দাড়ি আর উস্কো খুস্কো চুল ছিল কি ??
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছো একদম......তুমি চেনো তাকে ?
- আমি চিনিনা বটে, তবে এক বিখ্যাত জ্যোতিষী কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওখানে এসে বসতেন বরাবর, অনেক লোকজন আসতো, প্রচুর আড্ডা হতো। দারুন নামডাক ছিল ওনার, কিন্তু উনি তো বেশ কিছুদিন হলো মারা গেছেন শুনেছি, টিবি হয়েছিল খুব সম্ভব। কেন বলুন তো ?

মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে রায়ার। কোনো দিশা পায়না কোথাও, চোখের ওপর ঘন কুয়াশার মত অন্ধকার ঘনিয়ে আসে ধীরে ধীরে ...... এ কি করে সম্ভব !! এ কি করে.........!!!!
হঠাৎ মোবাইলটা  বেজে ওঠে এক তীব্র আওয়াজ করে........সুইচড অফ ফোন বাজছে কি করে ?
এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে খেতেই স্ক্রিনের ওপর চোখ চলে যায়..........স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠেছে...... "কিঞ্জল কলিং" !!
দড়াম করে মাথা ঘুরে পড়ে যায় রায়া মাটির ওপর। মোবাইলটা বেজেই চলে একনাগাড়ে...............          

ছবি: গুগল 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #thrill #murder #mystery #astrology #bengalighoststories