Tuesday, September 13, 2016

সাপ্তাহিকী ১৬ # দুর্গা

'এ বছর কেমন অর্ডার হলো গো' ? সোমলতা বঁটিতে খড় কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করে রাখালকে। দাওয়ার এক কোনে বসে রাখাল এক মনে মাটি লেপে যায় মৃন্ময়ী মুখের ওপর। কথাটার খুব একটা আমল দেয় না সে, দ্রুত হাতে কাজ শেষ করতে হচ্ছে এখন, পুজোর বেশি দেরি নেই আর। শেষ বেলার অর্ডারগুলো ছেড়ে দিতে পারলে তবে নিশ্চিন্তি। সোমলতা আবার জিজ্ঞেস করে, 'কি গো ? কথার উত্তর দিচ্ছ না যে মোটে '? নিপুণ হাতের টানে মাটি কেটে দেবীর চোখ তৈরীর কাজ শেষ করে রাখাল। ছাঁচটা আলতো করে পাশে রেখে উঠে গিয়ে বালতির জলে হাত ধুতে ধুতে বলে, 'মা লক্ষীর কৃপায় এবার মন্দ হয় নি, শুধু বিষ্টিটা আর না হলেই বাঁচি'। খড়ের বান্ডিল হাতে নিয়েই দুহাত মাথায় ছোঁয়ায় সোমলতা। বিড়বিড় করে বলে, 'মা, মাগো, জগজ্জননী মা, দেখো একটু'। হলদেটে তাঁতের শাড়ির আঁচলের মতো বিকেলের পড়ন্ত আলো এলিয়ে পড়ে আছে উঠোনের পশ্চিম দিকটায়। সেদিকে তাকিয়ে রাখাল জিজ্ঞেস করে, 'দুগ্গা ফেরেনি এখনো' ?

বলতে বলতেই দুদ্দাড় করে ছুটতে ছুটতে ঢোকে একটি বছর সতেরোর শ্যামলা তরুণী। 'মা ভাত দাও তাড়াতাড়ি। আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেলো'। সাইকেলটা কোনোরকমে হেঁশেলের দেওয়ালের ওপর হেলান দিয়ে রেখে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় সে।

- ঐ এলেন, দুদণ্ড জিরোবার সময় নেই, সবসময় যেন রেলগাড়ির মতো ছুটছে, বলি হাত মুখটা তো ধুবি, তবে তো ভাত বাড়ব.......

'আমি হাত মুখ ধুয়ে নেব মা, তুমি ভাতটা বাড় দেখি তাড়াতাড়ি', ঘরের ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে বলে দুর্গা।

সোমলতা ব্যস্ত হয়ে বঁটি সরিয়ে উঠে পরে, গাল ফুলিয়ে বলে, 'আমি অত হুড়োমাতুনি করতে পারবো না বাপু, আসন পাত্চি, ধীরে সুস্থে এসে বোসো'।  

রাখাল মৃদু হাসে, মা মেয়ের কথা চালাচালিতে বেশ মজা লাগে তার। দাওয়ায় বসে মৌজ করে বিড়ি ধরিয়ে তালপাখা ঘোরাতে থাকে একহাতে। দুর্গা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে ইতিমধ্যে, শাড়ি ছেড়ে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নিয়েছে, গোয়ালপাড়ায় রিন্টুদের বাড়ি যেতে হবে। কিছু ছাত্রছাত্রী পড়ায় সেখানে। বাবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে দুর্গা। যৎসামান্য প্রসাধনে পানপাতার মতো মুখখানা লাবণ্যময় লাগে। দেখে ভারী মায়া হয় রাখালের। অভাবের সংসারে মেয়েটার যত্নআত্তি হয়না তেমন। অথচ গেলো বার মাধ্যমিকে দারুন ফল করে রাখালের বুকটা গর্বে ভরিয়ে দিয়েছে। তাই পণ করেছে, যে করেই হোক মেয়েকে যতদূর পারবে লেখাপড়া শেখাবে, সমাজের চারটি লোকের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াবার যুগ্যি করে তুলবে। অনটনের গেরস্থে সেটা খুব একটা সহজ কাজ নয় তা খুব ভালো করেই জানে দুর্গা আর তাই ছাত্র পড়িয়ে সেও যতটা সম্ভব বাবার বোঝা লাঘব করার চেষ্টা করে। দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়, সন্ধ্যে নেমে আসছে, ছেলেমেয়েগুলো হাঁ করে বসে থাকবে.............

"দু এক্কে দুই .....দু দুকুনে চার.........তিন দুকুনে ছয়........ চার দুকুনে আট......" দুলে দুলে নামতা মুখস্থ করতে থাকে কচি ছেলেমেয়ের দল।

বাকিদের কিছু সরল যোগ বিয়োগের আঁক কষে দেখায় দুর্গা। কিন্তু কিছুতেই যেন আজ মন দিতে পারে না সেদিকে। বারে বারে অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। চোখ চলে যায় উত্তরের জানলার বাইরে। পলকা হাওয়ায় ছিট্ কাপড়ের পর্দা উড়তে থাকে আর সেই পর্দার আড়াল দিয়ে আড়চোখে দেখতে থাকে দুর্গা।

চায়ের দোকানের ঠিক বাঁদিক ঘেঁষে তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর। কিছু একটা বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে আর মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ চাউনিতে রিন্টুদের বাড়ির এই জানলাটা মেপে নিচ্ছে একনজর করে। ছেলেগুলোকে চিনতে পারে না দুর্গা। কিন্তু তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু এবং চাউনির লক্ষ্য যে সে নিজে সেটা বুঝতে একফোঁটা অসুবিধে হয় না তার। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি ক্রমাগত খোঁচা দিতে থাকে তাকে।

ঘড়ির কাঁটায় সাতটা বাজে। আজ আর মন দিতে পারছে না দুর্গা। নির্ধারিত সময়ের আগেই সে ক্লাস ছুটি দিয়ে দেয়। ছুটির আনন্দে কচিকাঁচার দল হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে যে যার মতো।

শুধু রিন্টু এসে অপার বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, 'দিদি, আজ যে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিলে' ?

রিন্টুর সরল প্রশ্নে হেসে ফেলে দুর্গা, বলে, 'আজ দিয়েছি, কাল কিন্তু সব অঙ্ক করে রাখিস, তবেই ছুটি, মনে থাকে যেন'।

বাধ্য ছাত্রের মতো ঘাড় হেলায় রিন্টু। দুর্গা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে সেই তিনটে ছেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবকটাই তেইশ চব্বিশ বছরের আশেপাশে। ঠিক ঠাহর করতে পারে না তাদের। তবে, একটি ছেলের মুখ যেন আবছা মনে পড়ছে এখন। গতমাসের ভোটে এই ছেলেটিকেই ঝান্ডা লাগাতে দেখেছিলো না তাদের পাড়ায় ? তাই তো ! জামালপুরের পার্টি অফিসে হপ্তা দুয়েক আগে গিয়েছিলো বাবার সাথে একটা কাজে, হ্যাঁ সেখানেও যেন দেখেছে এই ছেলেটিকে। কি যেন নাম বলছিলো, কি যেন.................
নাহ কিছুতেই মনে করতে পারে না সে। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় দুর্গা, গোয়ালপাড়া ছাড়িয়ে, পুকুরঘাট পেরিয়ে নিজের পাড়ার দিকে ঘুরে যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই।

এরপর কয়েক দিন কেটে যায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত দুর্গার জীবন রুটিনমাফিক বয়ে চলে, যেমন করে খেয়ামতি বয়ে চলেছে গ্রামের দক্ষিণ দিক বরাবর, তেমনি। স্কুলে যাওয়া আসা, বন্ধুদের সাথে বটতলার মাঠে আড্ডা দেওয়া, বাবাকে হাতে হাতে মূর্তি গড়ার কাজ এগিয়ে দেওয়া, নিজের পড়াশুনো, রিন্টুদের বাড়ি ছাত্র পড়ানো সবই চলতে থাকে জাগতিক নিয়মের ফিতে বেঁধে।

এরই মাঝে তাল কেটে যাওয়ার মতো সেবন্তীর কথায় তার খটকা লাগে বেশ। সেবন্তী, দুর্গার সুখ দুঃখের সহচরী ও অভিন্ন হৃদয়ের সই।

স্কুল যাওয়ার পথে সে দুর্গাকে জিজ্ঞেস করে, 'কি ব্যাপার বলতো ? আজ কদিন ধরে লক্ষ্য করছি রন্জু  তোর পিছু পিছু ঘুরছে, কিছু হয়েছে'?

দুর্গা ভারী অবাক হয়ে বলে, 'রন্জু ! সে আবার কে' ?

'ওই তো, সুখেন মুদির ভাইপো, জামালপুরে থাকে, বাইক নিয়ে ঘোরে, পার্টি ফার্টিও করে নাকি শুনেছি', নিঁখুত বর্ণনা দেয় সেবন্তী। 

এক ঝট্কায় কদিন আগেকার কথা মনে পড়ে যায় দুর্গার। ঢোঁক গিলে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে, 'হ্যাঁ রে, মনে পড়েছে, কদিন আগে রিন্টুদের বাড়ির সামনেও দেখেছি, সঙ্গে আরও দুটো ছেলে ছিল, কি বিশ্রী চাউনি........ কিন্তু, তুই কি করে জানলি ?'

- রোজ স্কুলের ছুটির পর রন্জুকে দাঁড়াতে দেখছি চালতা বাগানের মোড়ে, আর তোর দিকেই যে নজর রাখছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন ?

- আসলে ওই জামালপুরের পার্টি অফিসে গিয়েছিলাম বাবাকে নিয়ে, বেশ কয়েকদিন আগে, সেখানে দু একটা ব্যাপারে কথা কাটাকাটি হয় আমার, হতে পারে সেটার জের থেকেই হয়তো.........

- সাবধানে চলাফেরা করিস দুর্গা, একটু নজর করিস সবদিক, তেমন উল্টোপাল্টা কিছু হলে জানাস, আমরা মহিলা সমিতিতে যাব.......

- আচ্ছা.......আজ তবে আসি রে, বাড়িতে আবার মেলা কাজ পরে রয়েছে.......

সেবন্তীকে হাত নেড়ে বাড়ির দিকে সাইকেল ঘোরায় দুর্গা, হাজারো চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে  থাকে। বাঁদিক ঘুরে শিবমন্দিরের দিকে যেতেই সামনে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। রন্জু দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে সেই দুটো ছেলে, পাশে একটা লাল বাইক দাঁড় করানো। পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায় দুর্গা, রন্জু পথ আটকে দাঁড়ায়। দুর্গার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।

শিবমন্দিরের এদিকের জায়গাটা নিঃঝুম থাকে বরাবর। আশেপাশে বাঁশবাগান ছাড়া আর কিছুই নেই, জলা জঙ্গল বলে লোকজন খুব একটা যাওয়া আসাও করে না তেমন। শর্টকাট হবে বলে প্রত্যেকবার এদিককার পথটাই ধরে দুর্গা। কোনোদিন কল্পনাও করেনি যে এমন বিপদ হতে পারে। রন্জু হেলতে দুলতে পান মশলা চেবানো দাঁত বের করে সামনে এসে দাঁড়ায়।

আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেয় সারা শরীরে। সে চাউনিতে দুর্গা কুঁকড়ে যায় খানিক। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ফেলে একটা কর্কশ সুরে বলে, 'রোজ রোজ ঘু ঘু তুমি খেয়ে যাবে ধান ? আর আমি কি বসে বসে শুধুই চেবাবো পান'?

খ্যাঁকখ্যাক করে পিছনের ছেলেদুটো হেসে ওঠে রন্জুর কথা শুনে ।

'কি চাও তুমি ?' দুর্গার গলা কেঁপে ওঠে।

'আমি সুধু তোমায় চাই গো দুগ্গাদেবী, সুধু তোমায় চাই', বলেই দুর্গার হাতটা খপ করে  চেপে ধরে রন্জু ।

তারপর চোখের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলে, 'কেন ? পার্টি অফিসে সবার সামনে আমাকে অপমান করার সময় মনে ছিল না? আজ যদি তোকে তুলে নিয়ে যাই, কেমন হয় ? তোর ফড়ফড়ে বুলি আওড়ানোর সখ একলপ্তে মিটিয়ে দিই, কি বল'? হিসহিসিয়ে ওঠে রন্জু ।

দুর্গা থরথর করে কাঁপতে থাকে সাইকেলটা চেপে ধরে। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় কেমন। নিথর মূর্তির মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময়ে উল্টো দিক থেকে ভঁপু বাজাতে বাজাতে একটা সাইকেল রিকশা আসতেই ঝট করে হাত ছেড়ে দেয় রন্জু । আর ওই সুযোগেই দুর্গা প্যাডেলে চাপ দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় তড়িঘড়ি। রিকশাটার জন্য দুর্গাকে আটকানোর সুযোগ পায়না সে।

তবু পিছন ফিরে চিৎকার করে বলে, 'ভাবিস না এখানেই শেষ হল, সন্ধেবেলা পড়াতে বেরোবি না ? তখন বাকিটা বুঝে নেব', বাইকে স্টার্ট দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যায় সবাই ।  

বাড়ি ফিরে কোনো কথা বলে না দুর্গা, কোনোরকমে ভাতের থালা নাড়াচাড়া করে উঠে পরে, ঘরে ঢুকে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। সোমলতার কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেয় না সে।

রাখাল পায়ে পায়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। জিজ্ঞেস করে, 'কি হয়েছে মা, আজ এতো চুপচাপ আছিস যে ? কেউ কিছু বলেছে ?

'কদিন ধরে একদল কুকুর তাড়া করছে বাবা', শান্ত স্বরে জবাব দেয় দুর্গা।

রাখাল সেকথার মানে বুঝতে পারে না। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মেয়ের দিকে।

দুর্গা স্মিত হেসে বলে 'মেয়েদের পিছনে ওমন অনেক কুকুর ঘুরঘুর করে বাবা, ভয় পেলে কি চলে আমাদের ? এখন উঠি বরং, যাই, ছাত্ররা অপেক্ষা করছে, আজ হয়তো ফিরতে একটু দেরি হবে আমার, সামনে পরীক্ষা আছে ওদের'।

'আমি কি তোকে নিতে আসবো' ? রাখাল উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে।

দুর্গা আস্বস্ত করে বলে, 'না না, তুমি কিছু চিন্তা করো না, আমি ঠিক চলে আসব'।

উঠোনের এক কোনে দাঁড় করানো প্রায় তৈরী হয়ে আসা দুর্গামূর্তিটা পিছন ফিরে দেখে একপলক, হ্যালোজেনের আলোতে মূর্তির ছায়ায় দুর্গার ছায়া মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে রিন্টুদের বাড়ির দিকে। মনের মধ্যে এলোপাথাড়ি হাওয়া তোলপাড় করতে থাকে.........

পড়াতে পড়াতে বারেবারেই দুর্গার চোখ চলে যায় বাইরের দিকে। চায়ের দোকানটা খোলা আছে বটে, তবে ছেলেগুলোকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। তবু যেন উদ্বেগের শেষ থাকে না, রন্জুর কথাগুলো ঘুরেফিরে মনের মধ্যে বাজতে থাকে একনাগাড়ে। আর সেগুলো মনে পড়লেই ভয়, লজ্জা আর কুন্ঠা মিশ্রিত একরকম ঘূর্ণিঝড় পাক খেয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত সম্ভ্রমের চাদরটা যে এভাবে ছিঁড়ে যেতে পারে তা এতটুকু আঁচ করতে পারেনি সে কখনোই, আর তাই ভিতরে ভিতরে একরকম বিতৃষ্ণা তৈরী হয়ে যায় অজান্তেই।

ঘড়ির কাঁটায় আটটা বাজতেই ছুটি দিয়ে দেয়। আজ আর শিবমন্দিরের রাস্তাটা ধরবে না সে। বরং হাটখোলা মাঠের পাশ দিয়ে চলে যাবে। একটু ঘুরপথে হবে যদিও, তবু ক্ষতি নেই। বেশ কিছুটা পথ যেতে হবে। প্যাডেল ঘোরায় দুর্গা।

গোয়ালপাড়ার পূর্বদিকটা পিছনে ফেলে দুচাকা এগোতে থাকে হাটখোলা মাঠের দিকে। সকাল বেলায় বাজার বসে এদিকটায়, দিব্যি গমগম করে তখন, সন্ধ্যে হলেই একটু শুনশান হয়ে যায়। দুচারজন পথচলতি মানুষ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না তেমন। আজ তবু একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে আকাশে।

এমন সময় ভটভট ভটভট করে গুরুগম্ভীর ইঞ্জিনের শব্দ হতে থাকে কোথাও যেন। পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করে দুর্গা, একটা তীব্র জোরালো আলো পিচ রাস্তার বুক ভেদ করে এগিয়ে আসছে। একসেকেন্ড সময় লাগে না বুঝতে যে সেটা রন্জুর বাইকের আওয়াজ। প্রমাদ গোনে দুর্গা। দেখতে দেখতেই বাইকটা চলে আসে সাইকেলের এক্কেবারে পাশে।

'আমায় ফেলেই চলে যাচ্ছিস যে' !

একটা বিশ্রী হেসে রন্জু ছুঁড়ে দেয় কথাটা, পিছনে বসা ছেলে দুটোও চিৎকার করে নানারকম আকার ইঙ্গিত করতে থাকে।

দুর্গা কোনো উত্তর দেয় না। ওদের অঙ্গভঙ্গি দেখে হাড় হিম হয়ে যায় পলকে। জোরকদমে প্যাডেল ঘোরাতে থাকে সে। চরম বিপদ যেন কালো মেঘের মতো গ্রাস করতে ছুটে এসেছে কোথা থেকে। বিস্তর জোরে চালিয়েও ইঞ্জিনের ক্ষমতাকে কিছুতেই টেক্কা দিতে পারে না দুর্গা।

রন্জু বাইকের সামনের চাকা দিয়ে একটা ছোট্ট ঠেলা দেয়। সাইকেল শুদ্ধু একেবারে আছাড় খেয়ে মাঠের ওপর পড়ে।

"মা গো" বলেই হাঁটু চেপে ধরে যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে দুর্গা। ওদিকে বাইকটাকে স্ট্যান্ড করে মাঠের ধারে রেখে ধীর পায়ে এগোতে থাকে রন্জু ও তার ছেলেরা। হিমেল স্রোত নেমে যায় দুর্গার শিরদাঁড়া বেয়ে, কোনোরকমে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে তোলে নিজেকে, তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটতে থাকে সামনের দিকে। পিছন পিছন রন্জুরাও ছুটতে শুরু করে বুনো হায়নার মতো।

নাগালের মধ্যে শিকার পেয়ে সবারই রক্ত ফুটতে থাকে টগবগ করে। বেশ কিছুটা দৌড়োনোর পর একটুকরো মাটির ঢ্যালায় হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে দুর্গা। থুতনিটা ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে।

একলাফে শিকারী কুকুরের মতো ছেঁকে ধরে রন্জুরা। কোনোরকমে হাঁচোড় পাঁচোড় করতে করতে উঠে দাঁড়ায় দুর্গা।

'এবার? এবার কি করবে দুগ্গাদেবী'? রন্জু বাঘের মতো এগিয়ে আসে সামনে।

পৈশাচিক উল্লাসে হাটখোলার মাঠ কেঁপে ওঠে। ঠোঁটের ডগায় জিভ লকলক করে ওঠে সবার।

দুর্গা বাঁ হাতের চেটো দিয়ে থুতনির কাছটা মুছে নেয় একবার। হাঁপাতে হাঁপাতে সরাসরি চোখ রাখে রন্জুর চোখে, তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে অদ্ভুত ভাবে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসতে থাকে হি হি করে।

হকচকিয়ে যায় রন্জু, বাকি ছেলেদুটোও, এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে অবাক বিস্ময়ে।

দুর্গা আঙ্গুল তুলে দেখায় পিছন দিকে। সে দিকে তাকিয়ে রন্জুর মুখে ধরা সিগারেটটা ফস করে পড়ে যায় মাটিতে। চূড়ান্ত ভয়ে মুখ সাদা হয়ে যায় সকলেরই। মাঠের ঈশান কোন বরাবর একদল ছায়ামূর্তি জড়ো হয়েছে। চাঁদের আলোয় সে অবয়ব পরিষ্কার হতে থাকে ধীরে ধীরে।

প্রায় ষাট সত্তরজন মহিলা আগুনে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তাদের প্রত্যেকেরই হাতে দা, কাস্তে, বঁটি, হাঁসুয়া, ঝলসে উঠছে সহস্র নক্ষত্রের রুপোলি আলোয়।

একফাঁকে মহিলা সমিতিতে দুর্গার দেখা করে আসার ঘটনাটা রন্জুরা টের পায়নি কখনোই। বিপদের পাশাটা আমূল বদলে উল্টে যায় তাদের চোখের সামনেই। শিকারী হতে গিয়ে যে শিকার হয়ে যেতে হবে এমনটা রন্জুরা আঁচ করতেই পারেনি।

কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে বসে পড়ে তিনজন মাঠের ওপরে। করুনার আর্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দুর্গার দিকে।

দুর্গার এলোচুল উড়তে থাকে মেঠো হাওয়ার টানে, চন্দ্রলোকের মায়াবী ছটায় দেবীর চেয়ে কম কিছু মনে হয় না তাকে। বহুদূরে, শেষপ্রান্তে কারা যেন.কোলাহল করে ওঠে .........'বলো দুগ্গা মাইকী'..........গ্রামের কোনো এক পাড়ার প্যান্ডেলে মা আসছেন বোধহয় .............






#bengalishortstories #womenempowerment #durgapuja #thrill    


No comments:

Post a Comment