Showing posts with label প্রেমের গল্প. Show all posts
Showing posts with label প্রেমের গল্প. Show all posts

Saturday, October 17, 2020

দূরত্ত্বের মাঝামাঝি

পরবর্তী স্টেশন, কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ডানদিকে। 

আগলা স্টেশন, কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ডাহিনে তরফ। 

দ্য নেক্সট স্টেশন ইজ কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ইজ অন দ্য রাইট সাইড। 

পরপর তিনটে ভাষায় মধুমন্তী মৈত্রের দৃপ্ত কণ্ঠের ঘোষণা বেজে ওঠে মেট্রোর প্রথম কামরা থেকে শেষ কামরা অবধি। সুকন্যার চোখ চলে যায় উল্টোদিকের দেওয়ালে ডিজিটাল স্ক্রিনের ওপর। পরবর্তী স্টেশনের নাম হালকা হলদেটে আলোর বলয়ে ফুটে উঠেছে। দু চারজন যাত্রী ধীরে ধীরে সিট্ ছেড়ে উঠে পড়ে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। এখন আর সেই পুরোনো দমবন্ধ করা ভিড়টা নেই। মৌমাছির চাকের মতো একে ওপরের গায়ে সেঁটে থাকার বিড়ম্বনাও ইদানীং উধাও । উপরন্তু মেট্রো রেলের নানান নিয়ম কানুনের ঘেরাটোপে অধিকাংশ কামরাগুলো একপ্রকার ফাঁকা বললেই চলে। যেসমস্ত স্টেশনে মাছি গলবার জো ছিল না সেসব স্টেশনে দূরে দাঁড়ানো মানুষের কথাও টানেলের দেওয়ালে ঠিকরে লেগে কানে ভেসে আসে। 

সুকন্যা সিট্ পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। সামাজিক দূরত্বের নিয়মে একটা সিট্ ছেড়ে বসতে হয় এখন। স্বাভাবিকভাবেই টালিগঞ্জ বা তার আগের স্টেশন থেকেই সিটগুলো ভর্তি হয়ে আসে। সুকন্যা রবীন্দ্র সরোবর থেকে ওঠে বরাবর, চারু মার্কেটের কাছাকছি থাকার ফলে সুবিধে হয়। তার গন্তব্য মহাত্মা গান্ধী রোড স্টেশন। দেরি আছে এখন। সোয়া দশটার মধ্যে ইউনিভার্সিটি ঢুকতে হবে। সাড়ে দশটায় ফার্স্ট ক্লাস। 

কম্প্যারেটিভ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচারের ছাত্রী সুকন্যা, ফাইনাল ইয়ার মাস্টার্স । ভারতীয় ভাষার প্রতি অগাধ অনুরাগ। সেখানে তাকে আরও বেশি আকর্ষণ করে থিয়েটার এন্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ। এই ভালোবাসাটা সুকন্যা শিরায় উপশিরায় বয়ে বেড়ায়। এমন বিরল বিষয়ের প্রতি প্রেম খুব একটা আকস্মিক নয়। তার কারণ সুকন্যার মা একই বিষয়ের ছাত্রী ছিলেন। পাশাপাশি একটা নামী নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে কয়েক বছর মঞ্চে অভিনয় করেছেন। খুব ছোট বয়েসে সুকন্যার পিতৃবিয়োগের পর  সমস্ত তালিম মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে এসেছে সে। সুতরাং এই আবহে বড় হয়ে ওঠাটা একরকম অনুঘটকের কাজ করেছে সুকন্যার বিষয় নির্বাচনে। 

পরবর্তী স্টেশন যতীন দাস পার্ক, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে.......

অভ্যাসবশত সুকন্যা দেওয়ালে ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সেখান থেকে চোখ নামাতে গিয়ে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায় একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে। মধ্য পঞ্চাশের আশেপাশে বয়স হবে। ছ ফুটের কাছাকাছি হাইট, মাঝারি গড়ন। মাথায় কাঁচাপাকা ঘন চুল। চোখে রিমলেস চশমা। সুপুরুষ বললে অন্যায় কিছু বলা হবে না। ভদ্রলোক অকলুষ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। সামান্য অপ্রস্তুত হয় সুকন্যা। পথেঘাটে পুরুষ মানুষদের বিভিন্ন চাহনিতে অভ্যাস হয়ে গেছে তার। আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিতা সুকন্যার সুশ্রী চেহারায় লাবণ্যের চিহ্ন ভীষণ রকম চোখ টানে। সুকন্যা খেয়াল করে ভদ্রলোক যেন বেশ খানিকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। 

এই সামাজিক দূরত্বের সময়ে এমনটা বড় বেমানান লাগে। মুখেচোখে অস্বস্তি প্রকাশ পেলেও সুকন্যা কোনো কথা বলে না, সামান্য বাঁদিকে সরে দাঁড়ায়। যতীন দাস পার্ক স্টেশনে কিছু মানুষ ওঠার ফলে ভদ্রলোকও খানিকটা সরে আসেন সুকন্যার দিকে। সুকন্যা ভারী বিরক্ত হয় এবার, দু'পা আরও সরে দাঁড়ায়। আড়চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকায়। কি আশ্চর্য ! ভদ্রলোক এখনো অপলক চেয়ে আছেন তার দিকে তাকিয়ে। রাগে গা জ্বলে যায় সুকন্যার। বিরক্তি ভাবটা কাটাতে ব্যাগের চেন খুলে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে ঘাঁটতে থাকে আর মনে মনে ভদ্রলোকের প্রতি বাংলা ভাষার অন্য প্রয়োগ করতে থাকে। 

পরবর্তী স্টেশন নেতাজি ভবন, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে....... 

খানিক বাদে কামরার বাঁদিকের দরজা দিয়ে আরও কয়েকজন যাত্রী ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই সুকন্যাকে এবার ডানদিকে সরে দাঁড়াতে হয়। দু'পা দূরত্ত্বে সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। সুকন্যা গম্ভীর হয়ে বলে, "আপনি একটু সরে দাঁড়াবেন প্লিজ" ? 

"আমায় বলছেন ! কেন, আমি তো সরেই দাঁড়িয়েছি"। ভদ্রলোকের স্বরে চাপা কৌতুকের ইঙ্গিত। 

সুকন্যার কান লাল হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বলে, "না, সরে দাঁড়ানোটা যথেষ্ট নয়। বেসিক ডিস্ট্যান্সটা মেন্টেন করুন একটু"। 

ভদ্রলোক রসিক ভঙ্গিতে জবাব দেন, "বেসিক ডিসট্যান্স বলতে যদি আপনি ছ ফিটের দূরত্ত্ব বোঝান তাহলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সেটা কতটা সম্ভব হচ্ছে তা আপনিই বলুন"।

ভদ্রলোক যে কথাটা ভুল কিছু বলেননি, এটা সুকন্যা মনে মনে বুঝলেও বাইরে তা প্রকাশ পেতে দেয় না।

আশেপাশে যে কজন যাত্রী দাঁড়িয়েছিল তারা সকলেই প্রায় ঘাড় নেড়ে সহমত প্রকাশ করে ভদ্রলোকের কথায়। মুহূর্তে কামরায় একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়। একেবারে টাটকা বিষয়ের ওপর রেখাপাত করাটা কেউই প্রায় এড়িয়ে যেতে চায় না। বিশেষ করে যেখানে একটা গোটা আস্ত পৃথিবী জড়িয়ে, সেখানে চটজলদি আলোকপাত করাটা আবশ্যিক হয়ে ওঠে।  

সেটা লক্ষ্য করে সুকন্যা আরও খানিকটা গম্ভীর হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে, "কিন্তু তাই বলে সামান্য দূরত্ত্ব রাখার সৌজন্যবোধটুকুও দেখাব না আমরা, তাইত" ?

একথায় ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে তাকান সুকন্যার দিকে। বিস্ময়ে বিহ্বলতায় খানিকটা দমে যান যেন। গলার স্বরে কৌতুক উধাও হয়ে যায় পলকে। আনমনে বিড়বিড় করে বলেন, "দূরত্ত্ব রাখার সৌজন্যবোধ" !   

"হ্যাঁ, দূরত্ত্ববিধি না মানাটাকে আমরা নানান অজুহাত দিয়ে বেঁধে ফেলেছি, তাই আমাদের যতই সাবধান করা হোক না কেন, আমরা নির্বিচারে সেসব জলাঞ্জলি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখি। এতে অবশ্য আর কিছু না হোক, আপনার মতো লোকেরা খানিকটা তামাশার খোরাক পেয়ে যান, আর বাকিদের জন্য সেটা খুবই বিব্রতকর হয়"। একটানা কথাগুলো বলে থেমে যায় সুকন্যা। শব্দের তীক্ষ্ণতায় কামরার গুঞ্জন খানিক নিভে আসে।  

ভদ্রলোক আর কোনো কথা বলেন না। মুখ ফিরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। টানেলের দেওয়ালে খোপকাটা চৌকো আলোর সারি স্মৃতির মতো পরপর সরে যেতে থাকে তীব্র গতিতে। যে চোখে বিদ্রুপ খেলা করছিল কিছুক্ষন আগেও, সেখানে ঘনিয়ে আসে বিষণ্ণতার ধূসর। ট্রেন চলতে থাকে নির্বিবাদ দুরন্ত গতিতে, সমান লয়ে কামরার মধ্যে যান্ত্রিক শব্দের ছন্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে একটানা। 

বাইরে পরপর কিছু স্টেশন বদলে যায় প্রেক্ষাপটের মতো। যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমে যাওয়ায় দুজনের মাঝখানে ব্যবধান বাড়ে। যোগ্য জবাব দেওয়ায় সুকন্যা মনেমনে পরম তৃপ্তি পায়। উটকো আলগা কথাবার্তাকে কখনোই সে পাত্তা দেয়নি, বিশেষ করে যেসমস্ত দিশাহীন আলোচনা শক্ত পাথরের মতো তার দিকে উড়ে আসে সেসব নিমেষে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তার অনমনীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। এক মুহৃর্ত আড়চোখে সুকন্যা দেখে নেয় সেই ভদ্রলোককে। একইরকম ভাবে নির্লিপ্ত হয়ে তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে। তাচ্ছিল্যের হাসি অধরপ্রান্ত ছুঁয়ে যায় সুকন্যার। 

পরবর্তী স্টেশন মহাত্মা গান্ধী রোড, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে....... 

সুকন্যা দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। অভ্যাসমতো ডিজিটাল স্ক্রিনে চোখ যায়, তারপর বাঁহাতের কব্জিতে সময় মেপে নেয় একপলক। কাঁটায় কাঁটায় দশটা বাজে। সুতরাং হাতে এখনো আধঘন্টা মতো সময় আছে। ক্যান্টিনে গিয়ে চট করে কিছু খেয়ে নিতে হবে, তারপর সোজা ক্লাসে। দরজা খোলার সাথে সাথে ট্রেন থেকে নেমে এগিয়ে যায় এস্কেলেটরের দিকে। কয়েক পা এগোনোর পর কে যেন পিছন থেকে ডাকে। 

- এই যে শুনছেন !! হ্যালো ?.... হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি......

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সুকন্যা। কি আশ্চর্য ! ট্রেনের সেই ভদ্রলোক ! ব্যস্ত হয়ে সুকন্যার দিকে এগিয়ে আসছেন। 

'কি ব্যাপার' ! কঠিনস্বরে জিজ্ঞেস করে সুকন্যা। 

- আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। 

- আমাকে ?

- হ্যাঁ, মানে... না বললে আর বলা হবে না বোধহয়।  

- ওহ ! এতক্ষন ধরে আমাকে দেওয়ার মতো উত্তর খুঁজছিলেন, আর তাই এসেছেন আবার নতুন করে কথা বাড়াতে ? শুনুন মিস্টার ! আপনার সাথে অপচয় করার মতো সময় বা ধৈর্য কোনোটাই আমার নেই। তাই মাপ করবেন। 

ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বলেন, 'না না, আপনি দূরত্ত্ব রাখার কথা বলছিলেন না ? জানেন, আমি সেই দূরত্ত্বটা প্রায় সাতাশ আঠাশ বছর ধরে মেন্টেন করে আসছি। আমার কথা দেওয়া ছিল যে, আর আজ অবধি সে কথার খেলাপ করিনি কখনো। তাই আপনার দূরত্ত্ববিধির কথাটা আমার ক্ষেত্রে ঠিক খাটে না, তাই না' ? 

চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করে সুকন্যা, 'তার মানে ? কি ভুলভাল বকছেন' ?

- মানেটা বরং আপনি সুভাকে জিজ্ঞেস করবেন।

- সুভা ?

- হ্যাঁ সুভা..... মানে সুপ্রভা...... সুপ্রভা বাগচী....আপনার মা ! 

সুকন্যার কানের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে যেন। চরম বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে কয়েক মুহূর্ত। তারপর মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, 'আপনি আমার মা কে কিভাবে চেনেন' ?

স্মিত হাসেন ভদ্রলোক, বলেন, 'আমি যে আপনাকেও একরকম চিনি সুকন্যা'। 

একথায় প্রায় নিশ্চুপ হয়ে যায় সুকন্যা। অকাশপাতাল ভেবেও বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পায় না। মনের মধ্যে নানান চিন্তার ঢেউ তোলপাড় করতে থাকে। যে অপরিচিতের সাথে খানিক্ষন আগে যুক্তিতর্কের পাঞ্জা কষে এল সে কিনা তার নাড়িনক্ষত্র চেনে ! 

'কই আগে তো একে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না', মনে মনে ভাবে সুকন্যা। ভদ্রলোক স্মিত হেসে বলে ওঠেন, 'যদি সময় দেন তাহলে মনের ভার কিছুটা লাঘব করতে পারি, আপনারও....... আর সাথে আমারও'। বাঁ হাত দিয়ে অনতিদূরে একটা প্ল্যাটফর্ম সিট দেখান ভদ্রলোক। সুকন্যা বাধ্য ছাত্রীর মতো সেখানে গিয়ে বসে পড়ে। 

'তুমি বললে অসুবিধে নেই তো ? আপনি আমার থেকে অনেকটাই ছোট', ভদ্রলোক সম্মতি চেয়ে নেন। সুকন্যা বিনা বাক্যব্যয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। যে কিছুক্ষন আগেও দাবানলের মতো জ্বলছিল, ঘটনার আকস্মিতায় সে এখন মাঝসমুদ্রের মত স্থির। একটা সিট ছেড়ে পাশের সিটে বসেন অপরিচিত বয়স্ক। তারপর ধীরে ধীরে শুরু করেন.....

'নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, তখন আমি চুটিয়ে থিয়েটার করছি। কলকাতা শহরের বুকে যে কটা নামকরা দল ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল নাট্যদর্শন, হয়ত তুমি নাম শুনে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা শো করে বেড়াতাম। সেবার পুজোয় আমাদের জলপাইগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অভিনেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাদের পরিচালক সুপ্রভাকে নিয়ে আসেন। সুপ্রভার বাবা অর্থাৎ তোমার দাদু নারায়ণ সরকার ছিলেন পরিচালকের সহৃদয় বন্ধু। ভীষণ রাশভারী মানুষ ছিলেন। প্রথমটায় সটান নাকচ করে দিলেও পরে  কতকটা নিমরাজি হয়ে সুভাকে পারমিশন দেন। রিহার্সালেই আমাদের প্রথম আলাপ। দিনের পর দিন মহড়া, একসাথে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, সমস্তটা জুড়ে একটা নতুন সম্পর্কের গন্ধ পেতে থাকি আমরা দুজনে। 

জলপাইগুড়িতে আমাদের শো দারুন হিট হয়। ফিরে এসে আমরা নিয়মিত বাইরে দেখা করতে শুরু করি। তখন সুভা মাস্টার্স পড়ছে। সুতরাং অসুবিধে হয়নি খুব একটা। প্রায় বছর দুই পর আমরা মনস্থির করি যে এবার বাড়িতে জানাব। আমাদের সমস্ত স্বপ্ন মিথ্যে করে দিয়ে তোমার দাদু এই সম্পর্কটা মেনে নিলেন না। স্থায়ী রোজগেরে পাত্র ছিলাম না, তাছাড়া থিয়েটারটা ভালবেসে করতাম, দু পয়সা কামাব বলে মঞ্চে উঠিনি কখনো। নিরুপায় হয়ে ঠিক করলাম তোমার দাদুর অমতেই সুভাকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে তুলব। সুভা রাজি ছিল, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। 

হঠাৎ এর কয়েকমাস বাদে তোমার দাদুর হৃদরোগ ধরা পড়ল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুভাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে আমাদের যেন কখনোই বিয়ে না হয়। হ্যাঁ, শুনতে ঠিক সিনেমার মতো লাগলেও কতকটা সেরকমই ঘটেছিল। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল সেদিন। তবে আমি সম্মানহানি করিনি কারোর। ওই যেটা তুমি ট্রেনে বলছিলে - সৌজন্যবোধ, ঠিক ওই কারণেই কিছু করে উঠতে পারিনি। শুধু দগ্ধ হয়েছি তিলে তিলে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সুভা দুরত্ত্ব রাখার কথা দিয়েছিল ওর বাবাকে, আর আমি কথা দিয়েছিলাম সুভাকে। যার অন্যথা আজ অবধি হয়নি।

সুকন্যা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, 'আ....আপনার নাম' ?

- প্রশান্ত....প্রশান্ত চৌধুরী। 

মাথাটা টলে যায় কেমন সুকন্যার। এই নামটা তো সে বহুকাল আগে শুনেছে মায়ের কাছে। বিস্তারিত না হলেও ভাষাভাষা একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল তার মনে। প্রশান্তকে বড় চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছা ছিল সুকন্যার। আজ সে ইচ্ছা এভাবে পূরণ হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। কি করবে সে ? মা কে জানাবে ? ওনাকেই বা কি বলবে এখন ? এই হেমন্তের সকালে সুকন্যার বুকে কালবৈশাখীর দামামা বেজে ওঠে। অধীর উত্তেজনায় গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে। কোনোরকমে জিগ্যেস করে, 'তারপর' ?

- তারপর তোমার দাদু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার মাস দুয়েকের মধ্যেই ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দেন সুভার। আমি আরো কিছুকাল থিয়েটারটা চালিয়ে যাই একইভাবে। পরবর্তীকালে দলটা ভেঙে যাওয়ায় কোনোক্রমে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়ে শহরের বাইরে চলে যাই। 

- আর বিয়ে ?

- সেসব আর করা হয়ে ওঠেনি। বলতে পারো হৃদয় থেকে আর কখনো কোনো সাড়া পাইনি। 

- কিন্তু আমায় চিনলেন কি করে ?

-  গত পরশু তোমায় মেট্রোয় দেখে চমকে উঠেছিলাম। অবিকল তরুণী সুভার মুখ। যেমন ঋজু ভঙ্গিমা তেমনই বলিষ্ঠ চলন। তোমার ওই হ্যান্ড ব্যাগের ট্যাগে সুকন্যা বাগচী লেখা দেখে সন্দেহ হয়েছিল। শুনেছিলাম দক্ষিণ কলকাতার কোনো এক বাগচী পরিবারের সাথে সুভার বিয়ে হয়। পদবীটা মনে ছিল। তাই তোমার নামটা পরখ করতে একদিন ফেসবুকে তোমায় খুঁজলাম। ফোটো সেকশনে তোমার মায়ের সাথে তোমার কয়েকটা ছবি ছিল। এত বছর পরেও সুভাকে চিনতে আমার এতটুকু ভুল হয়নি। 

এ পর্যন্ত বলে প্রশান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বেশ কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা। একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় উল্টোদিকে । কিছু যাত্রী নামে........দুরত্ত্ব বজায় রেখে যে যার নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। খানিক বাদে নীরবতা ভেঙে সুকন্যা জিজ্ঞেস করে -

- কিন্তু এতবছর আগের কথা এতদিন ধরে কেন এভাবে বয়ে বেড়ালেন ?  কি পেলেন আপনি ?

একথার কোনো উত্তর দেন না প্রশান্ত। কিছু কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না বোধহয়। 'কি পেলেন' কথাটা যেন ভারী ধাতব শব্দ করে ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনটা। প্রশান্ত নির্বাক বসে থাকেন সে দিকে তাকিয়ে।  

সুকন্যা ধীরে ধীরে বলে, 'আপনি কি একবার কথা বলবেন মায়ের সাথে, নাম্বার দেব' ?

- না সুকন্যা, কথা বলার হলে নাম্বার আমি আগেই জোগাড় করতে পারতাম। বরং সামাজিক দূরত্ত্বটা বজায় থাক, যে সময়টা চলে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। আর এতদিন বাদে তার কোনো অর্থও আমি দেখি না।

তুমি বরং এগোও, তোমায় আর দেরি করাব না। তোমার সাথে কথা বলব বলে আমি আমার স্টেশনের আগেই নেমে পড়েছি। পরের ট্রেনের জন্য এখানেই ওয়েট করি বরং। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল......ভালো থেকো.....

সুকন্যা কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। টালমাটাল করতে থাকে মাথাটা। ধীরে ধীরে সিট্ ছেড়ে উঠে পড়ে। দোনোমোনো করে বলে, 'কাল কি আপনি একই টাইমের মেট্রো ধরবেন' ?

- নাহ, তার আর প্রয়োজন পড়বে না। আগামীকালের ফ্লাইটে আমি দিল্লি ফিরে যাচ্ছি। কলকাতায় কয়েকদিনের জন্য একটা কাজে এসেছিলাম। আমার সব কাজ শেষ হয়েছে...  

- ওহ ! আচ্ছা.....বেশ...... আমি চলি তাহলে........ ভালো থাকবেন......

কোনোরকমে কথাগুলো বলে সুকন্যা। করজোড়ে একটা নমস্কার করে সামনে এগিয়ে যায়। টিকিটিং মেশিনে চেক আউট করার আগে একবার পিছন ফিরে দেখে। ভদ্রলোক ক্লান্ত মুখে বসে আছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে যায় সুকন্যা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ব্যাগের মধ্যে ফোনটা বেজে ওঠে। 

- হ্যাঁ  মা। 

- কিরে ! তুই ফোন করলি না ? এখনো ইউনিভার্সিটি ঢুকিসনি ?

- নাহ, আজ একটু দেরি হল...... 

- কেন রে ? ট্রেন লেট্ ?

- না, ট্রেন ঠিক সময়ই এসেছিল, দূরত্ত্বটা বুঝতে অনেকটা দেরি হল। 

- কি আবোলতাবোল বলছিস ? কি হয়েছে ?

- প্রশান্ত চৌধুরীর সাথে দেখা হল মা। তোমার মনে আছে তুমি যার কথা আমায় বলেছিলে ?

'কে !.......কার সাথে দেখা হল ? কি নাম বললি' ? গলাটা সামান্য কেঁপে যায় সুপ্রভার। এত বছর পর পুরোনো একটা নাম শুনে মাথার ভেতরটা কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে যায়। 

- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছ। প্রশান্ত চৌধুরী। অদ্ভুতভাবে মেট্রোয় দেখা হল জানো। 

- মেট্রোয় দেখা হল ??.......তার মানে প্রশান্ত কলকাতায় !! কিন্তু আমি যতদূর জানতাম ও তো কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছিল !

- হ্যাঁ আমাকেও তাই বললেন। কদিনের জন্য এসেছিলেন। কালই ফিরে যাচ্ছেন। জানো তোমাদের দুজনের পুরোনো দিনের অনেক কথা বললেন। তোমাদের প্রথম দেখা, রিহার্সাল, নাটক, আরও কত কি।

- তোর সাথে এতো কথা হল !

- হ্যাঁ, হল তো । তুমি কথা বলবে একবার ? তুমি চাইলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। নিচে প্ল্যাটফর্মে বসে আছেন পরের ট্রেনের জন্য.............. কি ?.... কথা বলবে ?

'বলব বলছিস ! পারবি তুই ? পারবি একবার কথা বলিয়ে দিতে ! ছুটে যা না তাহলে একবারটি ! বল আমি কথা বলতে চাইছি', কাতরস্বরে বলেন সুপ্রভা, 'বলতে না চাইলে বলবি আমাদের প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়েছে' !

গুপ্তধন ফিরে পাওয়ার উত্তেজনায় সুপ্রভা ছটফট করতে থাকেন মনে মনে। পুরোনো যা কিছু গ্লানি, অভিমান তার কিছুটা বোধহয় লাঘব করার সময় এসেছে এবার। সুপ্রভার দুচোখ বেয়ে অপেক্ষার ধারা নেমে আসে।

'আচ্ছা দাঁড়াও আমি দেখছি', বলে সুকন্যা ফিরে যায় সিঁড়ির দিকে। ফোনে কথা বলতে বলতে প্রায় স্টেশনের গেটের কাছে এসে গেছিল। এখন অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আবার চেক ইন করতে হবে। কোনোরকমে কাঁধের ব্যাগটা সামলে সিঁড়ি বেয়ে সে তরতর করে নামতে থাকে। ডানদিক ঘুরে আবার কয়েকটা সিঁড়ি। সেখান থেকে নেমে একটা বাঁক ঘুরে তারপর টিকিটিং মেশিন। পড়িমরি করে ছুট লাগায় সুকন্যা। স্টেশনের ডিজিটাল টাইমারে এখন সময় দশটা আটত্রিশ। উনচল্লিশে পরের ট্রেন। সামনে জনা দশেকের লাইন। "ওহ ভগবান ! কি করি ! হাতে আর এক মিনিট সময় আছে", মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠে সুকন্যা । লাইনের পিছনে পিছনে এগিয়ে গিয়ে কার্ড পাঞ্চ করে ভিতরে ঢোকে। সামনে আরও কিছু সিঁড়ি পেরিয়ে তবে নিচে প্ল্যাটফর্ম। 

ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যেন ! 

দুরন্ত গতিতে নিচে নেমে আসে সুকন্যা । ট্রেন ঢুকে পড়েছে ততক্ষনে প্ল্যাটফর্মে। সুকন্যা দৌড়ে যায় সেই প্ল্যাটফর্ম সিটটার দিকে। সিটিটা খালি ! কোথায় গেলেন প্রশান্ত। কি আশ্চর্য ! এই তো বসে ছিলেন। ট্রেনে উঠেছেন তো আদৌ ! ট্রেনের দরজা খুলে যায়। কামরাগুলো থেকে বেশ কিছু যাত্রী বেরিয়ে আসে। সুকন্যা পাগলের মতো প্রত্যেকটা কামরার দরজার কাছে গিয়ে খুঁজতে থাকে প্রশান্তকে। কোথায় গেলেন ভদ্রলোক ! যান্ত্রিক শব্দ করে কয়েক সেকেন্ড বাদেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ প্রশান্তকে দেখতে পায় সুকন্যা। পরের কামরায় জানলার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন। 

দূর থেকে সুকন্যা আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, 'প্রশান্তবাবু !! প্রশান্তবাবু !! আপনার ফোন এসেছে। ........ প্রশান্তবাবু......' !

কঠিন পুরু কাঁচের জানলা ভেদ করে শব্দেরা ভিতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ট্রেন চলতে শুরু করে । সুকন্যা পাশে পাশে দৌড়তে শুরু করে..... 'প্রশান্তবাবু........আপনার ফোন......একবার কথা বলুন প্লিজ .....একটিবার অন্তত.......প্রশান্তবাবু.........' !

ট্রেন গতি বাড়ায়, সুকন্যাও কোনোরকমে টলোমলো পায়ে ছুটতে থাকে......'প্রশান্তবাবু আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন ???'.............ফোনটা ধরুন প্লিজ.!!.......... আপনার প্রায়শ্চিত্ত..............' কথাটা শেষ করতে পারে না সুকন্যা। মেট্রো পুলিশ ছুটে এসে পথ আটকায়। ট্রেন ক্রমশ গতিবেগ বাড়িয়ে উল্কার মতো ছুটে পাতাল প্রান্তের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। 

'প্রশান্তবাবুউউউউউ ............' !!!!! 

সুকন্যার ব্যর্থ মর্মন্তুদ হাহাকার প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে আছড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িযে পড়ে ............মাঝের দুরত্ত্বটা মহাকাশের কৃষ্ণগহ্বরের মতো একটানা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বেড়েই চলে.........বাড়তেই থাকে ক্রমশ..........

গ্রাফিক্স : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalilovestories #bengalishortfilmscript #Molat #DebdattaSinha


Saturday, May 26, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৬ # স্বরলিপি


প্রিয় রূপম,
এই চিঠি লেখার প্রয়োজন পড়বে ভাবিনি কখনো। অথচ কিছু না বলা কথার পাহাড় জমে আছে বুকে।

ফ্রেশার্সের দিন স্টেজে যখন সি মেজরে ধরলে 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ' ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর একের পর এক 'একটুকু ছোঁয়া লাগে', 'তুমি রবে নীরবে' শুনতে লাগলাম, কেমন মাতাল মাতাল লাগছিলো জানো। অজান্তে কোনো এক অলীক ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। বেঁহুশ জ্বরের মতো তোমার গানের হাত ধরে ছায়াপথের যাত্রী মনে হচ্ছিল নিজেকে।

আমি জানি তুমি ঠিক লক্ষ্য করেছিলে আমায়। অনুষ্ঠানের শেষে কায়দা করে জেনে নিয়েছিলে আমার কেমন লেগেছে। 'ভালো' ছাড়া কিছুই বলে উঠতে পারিনি তখন। তুমি সামনে এসে দাঁড়াতেই খানিক আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলাম যে। ছাইরঙের পাঞ্জাবি, রিমলেস ফ্রেম আর হালকা দাড়িতে দিব্বি মানিয়েছিল। 

ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকতে না ঢুকতেই ফাইনাল ইয়ারের রূপম চক্রবর্তীর সাথে প্রেম, আমরা তখন বেদুইন মেঘের মতো হাওয়ায় উড়ছি। সবাই কানাঘুষো বলত পল সায়েন্স আর ইংলিশ লিটারেচারের মহাজোট তৈরি হয়েছে। 

তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম ক্যান্টিন, সিনেমা, নন্দন, আর ময়দানের সেই অশ্বত্থ গাছের ছায়া ছায়া দিনগুলো। নারায়ণগঞ্জের পিকনিক স্পটে যখন সবার আড়ালে তুমি কাছে এলে, কি লজ্জা কি লজ্জা ! তোমায় ছুঁয়ে দেখার লোভ সামলানো বড় কঠিন ছিল জানো, পারিও নি....। 

এরপর থেকেই বোধহয় লুকোচুরির পালা চুকল আমাদের, তাই না ? ছোটখাট অসুস্থতায় তুমি বাড়ি অবধি চলে আসতে, মনে পড়ে ? ফোনে নাকি আমার মুখ দেখা যায় না, এসএমএসে কথা হয় না, আরও কত কি ! ক্রমে দুই বাড়ির লোকজনের কাছে আমরা আরও স্পষ্ট হলাম। সাড়ে তিন বছরের প্রেম পরিণত হল পরিণয়ের দোরগোড়ায় এসে। এক পৌষের সন্ধ্যায় তোমার মা এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন।

আমার তখন ফাইনাল ইয়ার শেষ। তুমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে একবছর হল চাকরিতে ঢুকেছ। কয়েক মাস বাদেই তোমার বিদেশযাত্রা। এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ বলে মেনে নিলেন সকলে। সেদিন কুণ্ঠার ভারে তোমার বাবা মায়ের সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি। বলতে পারিনি তুমি ফেরার পরেই বিয়ে নিয়ে ভাবা যেতে পারে। তোমার চোখেমুখের ঔজ্জ্বল্য আমার কণ্ঠরোধ করেছিল সেবার। তোমাকে নিরাশ করতে প্রাণ চায়নি। বেশ মনে আছে, সিঁদুরদানের সময় আমার পা কাঁপছিল। বারবার ভেবেছিলাম যদি তুমি না ফেরো, আর যদি না আসো...........। মনকে বুঝিয়েছিলাম এমন কপাল কজনের থাকে ? হৃদয়ের ঘরে যার আসন পাতা সেই এসে বসছে এমন ভাগ্য কজনার হয় ?

তুমি যাওয়ার পর বড় অগোছালো হয়ে গেলাম। আমার সবটুকুন নিয়ে চলে গেলে যেন। আমি পড়ে রইলাম একক শূন্যতা নিয়ে। দিন যেতে লাগল। তুমি ফেরার পথ ভুলে গেলে। আমারও ভুল ভাঙতে একবছর সময় লেগেছিল, বিশ্বাস করতে আরও এক বছর। আমার উদ্বেগ, ভয় সমস্তটা সত্যি হল যখন শুনলাম তুমি লিভ টুগেদার করছ একজন ফরাসী শ্বেতাঙ্গীর সাথে। 

অন্তঃস্বত্ত্বা বিদেশিনীর দায়িত্ব তোমার কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল আমার থেকেও। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল রূপম। 

............ কেমন করে !! কেমন করে পারলে তুমি আমার সমস্ত অস্তিত্বকে এক ঝটকায় মিথ্যে করে দিতে ? কেমন করে পারলে তুমি জড়িবাঁধা মুহূর্তদের ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলতে ? তবে কেন গালভরা প্রতিশ্রুতির জালে বেঁধেছিলে আমায় ? এমন করে দূরে সরিয়ে দেবে বলেই কি ? পুরোনো মানুষ, পুরোনো কথার আয়ু এক - দু বছরের বেশি নয়, এ যেন তুমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে......

তবু ভেবেছিলাম তুমি ফিরবে, হয়ত কোনো একদিন..........

তোমার গানের খাতাটা যত্ন করে তুলে রেখেছি আমাদের শোবার ঘরের ছোট দেরাজে। তোমার গিটারের তারটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আশরাফের দোকান থেকে কিনে একটা নতুন লাগিয়ে দিয়েছি। বারান্দার আরাম কেদারায় তুলো বেরিয়ে গিয়েছিল। মুন্নাকে দিয়ে ফুলফুল ছিটের একটা নতুন গদি করিয়েছি। তুমি এলে সব দেখতে পাবে....... আসবে তো...... ?

ইদানিং মাথার ভেতর একটা যন্ত্রনা হতে থাকে জানো। কেমন যেন পাগল পাগল লাগে সেসময়। কানের মধ্যে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে একনাগাড়ে। বড় কষ্ট হয়, বড় কষ্ট .......... মনে হয় তোমার বুকের মধ্যে গুটিয়ে শুয়ে থাকি। তোমার শার্টের হাতাটা আঙুলের মধ্যে জড়াই। ঘুমের মধ্যে কত খুঁজেছি তোমায়, তোমার মাথার বালিশটা আঁকড়ে পড়ে থাকি রাতের পর রাত। দরজায় সামান্য আওয়াজ হলেই ঘুম ভেঙে যেত। ভাবতাম তুমি এলে বুঝি। আরও একবার মোহভঙ্গ হত।

আজকাল কেমন যেন হাত পা অবশ লাগে। বিশেষ কথা বলতে ইচ্ছে করে না। লোকে বলে আমার নাকি মাথার রোগ হয়েছে। ওরা জানে না মনের রোগের উপশম কোথায়। তুমি যদি একবার এসে বসতে কাছে, একবার যদি চুলে বিলি কেটে দিতে, আমার সকল গ্লানি, ক্ষয়, আপনিই জুড়িয়ে যেত। ক্লান্ত হয়ে গেছি রূপম, বড় ক্লান্ত লাগে এখন.........

----------------------------------------------------------------------------

এপর্যন্ত এসে অতসী জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। গরাদের গায়ে ধাক্কা লেগে ভাঙা রোদের টুকরো এসে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। দুপুরের তপ্ত হাওয়ায় চুল এলোমেলো হতে থাকে সর্বহারা উন্মাদিনীর, ফড়ফড় করে উড়তে থাকে পেপারওয়েটের নিচে রাখা অক্ষরহীন দিস্তা কাগজগুলো। মেঝের ওপর ছায়া পড়ে দুজন মানুষের। 

একজন পুরুষকণ্ঠ ডেকে ওঠেন, 'মাসিমা.........মাসিমা......' ? 

এই দুটি শব্দে অতসীর বলিরেখায় বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় না। আগের মতোই সে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে। 

পুরষকণ্ঠটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 'আজও আপনি চিঠিটা শুরু করলেন না' ?

পাশে দাঁড়ানো একজন তরুণী বিদেশিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, 'চিঠি লিখব, চিঠি লিখব করে রোজ কাগজের তলব করেন। অথচ কাগজ দিলে এক বর্ণও লিখে উঠতে পারেন না। চিঠি লেখা তো দূর উনি ভালো করে কথাই বলেন না এই হোমের কারোর সাথে। আপনিও তো গত কয়েকদিন ধরে আসছেন, ফিরে তাকাচ্ছে কি ? সর্বক্ষণ যেন অন্য জগতে পড়ে রয়েছেন । অথচ এই অবস্থায় আপনি বিদেশে  নিয়ে যেতে চাইছেন। আমি তো বলব ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন'।

'এটা ঝুঁকি নয় ডঃ সেন, উনি আমার দায়িত্ব'। স্পষ্ট বাংলায় দৃপ্তস্বরে কথাগুলো বলল শ্বেতাঙ্গী তন্বী। 

ডঃ সেন খানিক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, 'বেশ, আপনি যখন সমস্ত পেপার্স সাবমিট করেছেন আমার আর কি আপত্তি থাকতে পারে। শুধু কয়েকটা জায়গায় সইয়ের ব্যাপার আছে'। 

পাশের টেবিলের ওপর কয়েকটা জরুরী কাগজ এগিয়ে দেন চিকিৎসক। বিদেশিনী সই করতে থাকে একের পর এক। 

ডঃ সেন খানিক সংকোচে জিজ্ঞেস করলেন, 'কিছু মনে করবেন না, মানে হঠাৎ এইভাবে এতবছর পর অতদূর থেকে এসে ওনাকে নিয়ে যেতে চাইছেন......কারণটা ঠিক.............'

স্মিত হাসে তরুণী, তারপর সই করে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলে, 'বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল, আমি যেন ওনার কাছেই থাকি। কাজের সূত্রে আমার ফ্রান্সের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তাই ওনাকেই নিয়ে যেতে এসেছি। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, খুব ছোটবেলায় মা হারিয়েছি, ওনার চিকিৎসার কোনোরকম গাফিলতি আমি হতে দেব না'।

ডঃ সেন সম্মতিসূচক মৃদু ঘাড় নাড়লেন। কাগজের ওপর চোখ বুলিয়ে সইগুলো চেক করে নিলেন। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা...... ক্যাথরিন চক্রবর্তী।

ক্যাথরিন পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় জানলার দিকে। হাঁটুমুড়ে বসে অতসীর কাঁধের ওপর আলতো করে হাত রাখে। তারপর কোমলস্বরে ডাকে, 'মা......... মা......'?

ধীরে ধীরে অতসী ঘুরে তাকায় ক্যাথরিনের দিকে, বেশ কিছুক্ষন নিরীক্ষণ করে নিস্তেজ গলায় বলে, 'কেএএ......' ?  

ক্যাথরিন জড়িয়ে ধরে অতসীকে। অচেনা মানুষের ভীষণ অদ্ভুত চেনা গন্ধ এসে লাগে নাকে।  

কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যাথরিনের মুখের ওপর হাত বোলায় অতসী। অবিন্যস্ত রুপোলি চুলের ফাঁকে দৃষ্টি ঝাপসা লাগে যেন। চোখের পাতায় জল চিকচিক করতে থাকে। 

তারপর ভাঙা গলায় অস্ফুটে বলে, 'বড় চেনা লাগে মুখটা...........কোথায় যেন..........'  

ক্যাথরিনের মুখে শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি খেলে যায়। ঘরময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এক নতুন বন্ধনের আলো.......


চিত্র: গুগল ; বিন্যাস : নিজস্ব 


#bengalishortstories #bengalilovestories #Molat   





  

Wednesday, February 14, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৪ # হ্যাপি শিবলেন্টাইন

ভোর সাড়ে চারটে।  কৈলাসের বেডরুম। শিব জোর ঘুমোচ্ছেন। পার্বতী আলতো করে টোকা মেরে অনেক্ষন ধরে  জাগাবার চেষ্টা করছেন কিন্তু শিব চোখ খুলছেন না। অগত্যা পার্বতী রেগে গেলেন। 

পার্বতী : বলি সারাদিন ধরে মোষের মতো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলে চলবে ? চোখ জোড়া খোলো এবার। বেলা তো বয়ে যায়......
শিব : (ঘুম চোখে ধড়মড় করে উঠে বসে) আচ্ছা জ্বালাতন মাইরি ! সকাল সকাল অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন ? বাড়িতে তো কাক চিল বসতে ভয় পাবে !
পার্বতী : তার জো আছে নাকি ! কৈলাসের এই উঁচুতলায় বাড়ি বানিয়েছো। শীতকালে হাড়েহাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে যাবার জোগাড় হয়। যম পর্যন্ত আসতে ভয় পায় এখানে। কাক চিল কি পবনের রথে চড়ে আসবে ? 
শিব : কি ব্যাপার বলো তো ? আজ একেবারে তিরিক্ষি মেজাজ দেখছি তোমার ! ভোরবেলাতেই  দিদি নাম্বার ওয়ান দেখেছো নাকি ? 
পার্বতী : এই শোনো, বাংলা সিরিয়াল দেখা নিয়ে খোঁটা দেবে না কিন্তু, এ আমি আগে থেকেই বলে রাখছি, নইলে আমি প্রলয় বাধাব বলে দিলুম। 
শিব : (থতমত খেয়ে) আচ্ছা আচ্ছা বেশ, ক্কি কি হয়েছে সেটা বলবে তো......

পার্বতী : (লজ্জা লজ্জা ভাব করে) আজ কি দিন মনে আছে তোমার ?
শিব : (সামান্য হেসে) বিলক্ষণ ! বিলক্ষণ ! মনে থাকবে না আবার ? আজ তো শিবরাত্রি। 
পার্বতী : (পাত্তা না দিয়ে) হ্যাঁ, সে তো আছেই, এছাড়া আরও একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে। 
শিব : (মনে মনে) খেয়েছে রে ! কোনটা ভুলে গেলাম ! আমাদের এনিভার্সারি ! যাচ্চলে আমি তো মনেই করতে পারছি না। সারাদিন এতো গাঁজা ভাঙে ব্যস্ত থাকি, কবে যে কি দিন মনে রাখাই চাপ হয়ে যাচ্ছে এখন। 
পার্বতী : কি বিড়বিড় করছ বোলো তো তখন থেকে, হ্যাঁ ?
শিব : (জটা চুলকে) ইয়ে মানে.... মাইরি বলছি। একটু ধরিয়ে দাও প্লিজ। 
পার্বতী : (রেগে গিয়ে) মোটেই না, এই সাতসকালে মোটেই তোমার গাঁজার কল্কে ধরিয়ে দিতে পারব না, আমার মেলা কাজ আছে। 
শিব : আহাহাহা, আমি সে ধরানোর কথা বলিনি গো, মানে ভুলটা একটু ধরিয়ে দিতে বলছিলুম আরকি। পার্বতী : ওহ ! (আবার লজ্জা লজ্জা ভাব করে) আজ তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে.....ভুলে গেলে ?
শিব : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) হা কপাল ! সেটা আবার কি ?
পার্বতী : (আদিখ্যেতার স্বরে) যাও, তুমি না বড্ড ইয়ে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কি সেটা জানো না নাকি ?
শিব : (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) মা কালির দিব্যি বলছি !..... আঃ সরি, আমি আবার অন্য লোকের দিব্যি খাচ্ছি কেন ? মানে সত্যি বলছি আমি এসব কিচ্ছু জানি না। 
পার্বতী : (মুখ নিচু করে সলাজ কণ্ঠে) যাও....... আমার লজ্জা করছে। 
শিব : আঃ, কি আপদ ! ধানাইপানাই না করে একটু খোলসা করে বলোই না মাইরি ! 

পার্বতী শাড়ির খুঁট জড়াতে লাগলেন। তারপর শিবের গলা থেকে সাপটাকে একটানে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেই দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলেন। অপ্রত্যাশিত প্রেমের জোয়ারে শিব একটু খেই হারিয়ে ফেললেন। 

পার্বতী : ভ্যালেন্টাইন্স ডে মানে হল প্রেমদিবস, বুঝলে ? 
শিব : (ভারী অবাক হয়ে) প্রেমদিবস !! প্রেমের আবার দিবস রজনী হয় নাকি গো ? 
পার্বতী : (দুহাত ছাড়িয়ে নিয়ে) হয় গো হয়। ইদানীং হচ্ছে, আর সবাই কচ্ছে। এই আমরাও না  আজ করব কিন্তু। 
শিব : (পার্বতীকে কাছে টেনে দুষ্টুমির গলায়) আজ আমরাও করব ?? যাহ ! সাতসকালে একঘর  ছেলেপুলেদের সামনে এসব আবার কেউ করে নাকি ! কি যে বলো না তুমি ! ধ্যাৎ !
পার্বতী : আঃ ! তুমি তো ভারী অসভ্য। আমি কি সেসব কথা বলেছি নাকি ! 
শিব : তাহলে ?
পার্বতী : মানে, আজ আমরা একটু সেলিব্রেট করব। এই যেমন ধরো একটু সেন্ট্রাল পার্ক গেলাম, তারপর একটা মলে গিয়ে একটু শপিং টপিং.......

পার্বতীর কথা শেষ হবার আগেই  শিব সঙ্গে সঙ্গে দুহাত ছিটকে এলেন। 

শিব :(নাকে হাত দিয়ে) ছিছিছিছি, পার্বতী ! ছি, আজকের একটা পবিত্র দিনে তুমি এসব কি মলমূত্র টেনে আনছ বলো দেখি ?
পার্বতী : আ মোলো যা ! এ মল সে মল নয় দেব.........এ হল গিয়ে শপিং মল, সেখান গিয়ে একটু শপিং করব, হাত জড়াজড়ি করে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুরব, রেস্টুরেন্ট যাব, তারপর একেবারে পদ্মাবৎ দেখে তবে বাড়ি ফিরব। 
শিব :(চোখ কপালে তুলে) পদ্মাবৎ !! বোঝো ! এ আবার কি নতুন সংস্কৃত ? বলি কথায় কথায় দুম করে অমন খণ্ড-ত লাগিয়ে দিলে ভারী অসুবিধে হয় জানো। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলবে একটু ? 
পার্বতী : সে কি কথা !! কত বড় কাণ্ড হয়ে গেল ! কোনো খবরই তো রাখো না দেখছি। অবশ্য সারাদিনে ছিলিম ছাড়ার ফুরসত পেলে তো !
শিব :(সামান্য রেগে গিয়ে) এই শোনো, ত্রিশূলের দিব্যি বলছি, ছিলিম নিয়ে খোঁটা দেবে তো একেবারে দক্ষযজ্ঞ রিটার্নস বানিয়ে ছাড়ব। 
পার্বতী : থাক ! হয়েছে অনেক। ও মুরোদ আর নেই তোমার। বাহুবলী তোমায় ঘাড়ে করে ঝর্ণার জলে চুবিয়ে ছেড়েছে। সেই দেখে নমো আর মমোর কি হাসাহাসি। আমি তো হপ্তাখানেক মুখ দেখাতে  পারিনি কোথাও। পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। 
শিব : (বিষম খেয়ে) আঃ, কি মুশকিল ! থাক না সেসব কথা। আমিও তো কম হেঁচে কেশে অস্থির হইনি সেসময়। ভক্ত বলে কথা, অমন ফস করে কিছু বলা যায় নাকি ? 
পার্বতী : বেশ তো ! তাহলে শিবায় ছবিতে অজয় যে তোমার নামটা ধার নিল আর সারাক্ষন 'বোলো হর হর' বলে চেঁচিয়ে গেল, কই টাইটেল স্ক্রোলে তোমায় কার্টসি পর্যন্ত দিল না মোটে, তার বেলা ?
শিব : কি বলি বলো দেখি, সিংঘমের পর থেকে বাজারটা তেমন ভালো যাচ্ছে না ওর। শুধু গুটখা খাচ্ছে আর বোলো জুবান কেশরী বলছে। আমি তো আর রয়্যালটি চাইতে পারিনা এই সময়.....!

পার্বতী আবার শিবের গা ঘেঁষে এলেন। শিবের গলার রুদ্রাক্ষের মালা নিজের আঙুলে পেঁচাতে থাকলেন। 

পার্বতী :(গদগদ কণ্ঠে ) হ্যাঁ সেই। ভক্তের ভক্তিতেই তুমি অস্থির। যাগ্গে, যাক। মোট কথা হল সারাদিন দুজনে মিলে একটু কাছাকাছি, একটু এনজয়, মানে একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড.......বোঝোই তো..... 
শিব : আচ্ছা বেশ, সেসব নাহয় বুঝলাম, কিন্তু শিবরাত্রির ব্যাপারটা....... ?
পার্বতী : সে নাহয় রাতের দিকে তোমার মাথায় একটু জল ছিটিয়ে দিলেই হল। তাছাড়া গঙ্গাকে তো জটায় করে নিয়ে ঘুরছো। তেমন হলে মাথাটা একটু গোল করে ঝাঁকিয়ে নিও বুঝলে। যুগ যুগ ধরে একইরকম করে আসছি তো। তা এবারটা নয় একটু অন্যরকম হল, অসুবিধে কি ?
শিব : কিন্তু তাই বলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করবে বলে শিবরাত্রি ডিলেইড হবে ? নানানানা, এটা ঠিক হচ্ছে না। তোমার হাতের জলটাই তো সবার আগে পেয়ে থাকি বরাবর। তারপর গিয়ে মর্ত্যের জল নিই। ওদিকে সবাই অপেক্ষা করে থাকবে যে !
পার্বতী : (অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে) ওহ ! তাই নাকি ? আমার আব্দারটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়, তাই তো ? মর্ত্যের জল না পেলে বুড়োর বুঝি নেশা কাটবে না ! বয়সকালে স্বপ্নদোষ ? আচ্ছা দাঁড়াও, আমিও এর শেষ দেখে তবে ছাড়ব। 

মহাদেব এ কথায় জিভ কেটে কানে আঙ্গুল দিলেন। 
নারদমুনির প্রবেশ। 

নারদ : (সুর করে) নারায়ণ নারায়ণ ! পেন্নাম হই দেবাদিদেব..... প্রণাম নেবেন মা। (শিবের দিকে তাকিয়ে) একি প্রভু !! আপনি কানে আঙ্গুল দিয়ে আছেন কেন ? কি হয়েছে ?
শিব : (কান থেকে আঙ্গুল সরিয়ে) ভাষার বাণ খেয়েছি রে বাপ্। ডিটেলস বলতে পারব না। 
  
পার্বতী : এই যে নাড়ু ! এসে গেছ দেখছি ! ব্যাস আর তো কোনো কথা গোপন রাখার জো নেই । স্বগ্গ জুড়ে ঢি ঢি পরে যাবে এবার........আমাদের সেলিব্রেশনটা তাহলে মাঠে মারা গেল একেবারে ! 
নারদ : ছি মা। এসব কি বলছেন ! আমি এখন অনেক চেঞ্জড হয়ে গেছি। এখন শুধু দিনে একবার করে  'আধঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন' এর চ্যানেলে ঢুঁ মারি। বাংলাবাজারটা ওই তো গরম করে। আমায় আর কোনো এক্সট্রা এফর্ট দিতে হয় না। 
পার্বতী : ব্যাস ! তবে আর কি ! স্বগ্গ তো গেলোই, এবার সারা বাংলা জুড়ে মোমবাতি মিছিল শুরু হবে। বলি আমাদেরও কি একটু আধটু সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই গা ?
নারদ : কে বলেছে মা থাকতে নেই ? আমায় শুধু বলুন কি চাই, আমি আগাপাশতলা সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। 

পার্বতী : (করুণ স্বরে) দুঃখের কথা আর কি বলি নাড়ু। শখ হয়েছিল আজ তোমাদের বাবার সাথে একটু ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করব। তা উনি কানেই নিচ্চেন না কথাটা। এবার বলো, এই জগৎসংসারের বাইরে আমারও তো একটু ইচ্ছে করে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর। ওনার হাতটি ধরে একটু এদিক ওদিক যাওয়া, ভালোমন্দ খাওয়া......... একি আর খুব বেশি চাওয়া হল আমার ? 
নারদ :(হাত নাড়িয়ে) বিন্দুমাত্র না, বিন্দুমাত্র না। এতো অতি উত্তম কথা, তা আটকাচ্ছে কে ? সুপ্রিয়া ?

পার্বতী মনে মনে বললেন, 'খুব খারাপ জোক নাড়ু , এ মিরাক্কেলেও নেবে না '। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মহাদেবের দিকে আঙ্গুল তুললেন শুধু । 

পার্বতী : ওই যে, ওই তোমার প্রভু। বলছে নাকি মর্ত্যের ধিঙ্গিরা ওনার শিবরাত্রির জন্যে ওৎ পেতে আছে। বাগছালটা পড়ে দৌড়ে না গেলে নাকি ওনার পুজোই শুরু হবে না। বুঝলুম, যাদের বিয়ে হয়নি তাদের নাহয় একটা কারণ আছে। কিন্তু যাদের হয়ে গেছে, তোরা কেন খামোখা ওঁকে নিয়ে টানাটানি কচ্ছিস বাপু। এই রিটায়ারমেন্টের সময় আমাদের দিকটাও তো একটু ভেবে দেখতে হবে নাকি !

শিব :আঃ যত্ত বাজে কথা। আচ্ছা তুই বল নাড়ু, এই বয়েসে আমাদের কি এসব মানায়, হ্যাঁ ? তাছাড়া আজকে শিবরাত্রি, কোথায় সকালবেলা তোর মায়ের হাতের এক বালতি গরম জলে একটু আয়েস করে সাবান দিয়ে রগড়ে গা ধোব, তা নয় উনি এক্কেরে সারাদিন কচি খুকির মতো ঘুরে বেড়াবার মতলব এঁটেছেন। যত্তসব !
পার্বতী : ওহ ! আমি কচি খুকি ? আর তোমার বয়েস বুঝি ডিসেন্ডিং অর্ডারে বাড়ছে। প্রস্টেটের সমস্যায় যে তুমি শুয়ে ছিলে একমাস, তখন কে তোমায় দুবেলা বাথরুম নিয়ে যেত শুনি ? হ্যাঁ ?অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ব্যাথায় রোজ রাতে কে মলম ঘষে দেয় তোমার হাঁটুতে ? বলব নাড়ুকে সেসব কথা ? ভাঙব হাটে হাঁড়ি ?
শিব : আহাহাহা ! এসব কি কথা হচ্ছে বলো দেখি ? ঘরের লুঙ্গি কি এমনি করে বাইরে শুকোতে আছে ? হাওয়া দিচ্চে তো !
নারদ : হ্যাঁ সেই তো, এসব ব্যক্তিগত কেচ্ছাগুলো এখন নাহয় থাক মা, বুঝলেন। অন্য সময় বরং........ 
পার্বতী :(নারদকে এক দাবড়ানি দিয়ে) তুই থাম নাড়ু ! আমার ইহকাল পরকাল সব আনন্দবাজারে বেরিয়ে গেছে গা। প্রাইভেট লাইফ বলে আর কিচ্ছুটি নেই। দুগ্গাপুজো এলেই সবাই মিলে একেবারে পুরাণ থেকে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে। ভারী বিরক্ত লাগে মাইরি। আমারও তো একটা প্রাইভেসি আছে, নাকি ?  

এই বলে পার্বতী একটা শিলাখণ্ডের ওপর বসে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। নারদ ও শিব যুগপৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। শিব আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন। পার্বতীর কান্নায় সেসব হলাহলের মতো নির্বাক হজম করে ফেলতে হল। উপায়ন্তর না দেখে পার্বতীর কাছে ছুটে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। 

শিব :(মোলায়েম স্বরে) ছি, পারো ! ওসব ছোটখাট কথায় কি কাঁদতে আছে। তুমি আজকাল সমস্ত ব্যাপারে বড্ড ইমোশনাল হয়ে পড়ো দেখছি। তোমার না হাই বিপি ? এসময় এতটা স্ট্রেস নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে শরীরের পক্ষে ?
পার্বতী : (ফোঁপাতে ফোঁপাতে) 'পারো' বলে আমায় ডেকো না গো। অন্দরমহলের পরমেশ্বরীর কথা বড্ড মনে পড়ে যায়। আহা বেচারী মেয়েটা কি কষ্টটাই না করছে। দোজবরে স্বামীটা গাছেরও খাচ্ছে তলারও কুড়োচ্ছে। এ অনাচার চোখে দেখা যায় না গো ! চোখে দেখা যায় না। 

নারদ: (শিবের দিকে তাকিয়ে) প্রভু, আমার না মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে জানেন। মা এসব কি বলছেন ? একবার প্রস্টেট একবার আর্থ্রাইটিস, আনন্দবাজার, অন্দরমহল, পারো........আমার কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রক্ষা করুন প্রভু, রক্ষা করুন। 

শিব ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। মনে মনে নানারকম বলতে থাকেন ......

শিব :(মনে মনে) হুঁহ ! দুবেলা আমায় কে রক্ষা করে তার নেই ঠিক, আমি যাব ওকে রক্ষা করতে। সাত সকালবেলা দেকচিস বাড়িতে মহাভারত শুরু হয়েছে, কোথায় মানে মানে সরে পড়বি তা নয়, নারায়ণ নারায়ণ করতে করতে কোমর দুলিয়ে উপস্থিত হয়েচে। যত্তসব বলিহারি ! (ভেংচি কেটে) আবার রক্ষা করুন প্রভু.........আপদ কোথাকার !

নারদ :আ, আমায় কি কিছু বলছেন মহাদেব ?
শিব :(শশব্যস্ত হয়ে) তোমায় আর কি বলব বাছা, সকালবেলা এয়েচ। এক কাজ করো দিকি। ঐদিকে দেখো মিক্সি রাখা রয়েছে, তিন গ্লাস ফ্রুট জ্যুস বানিয়ে আনো তো চট করে। 

নারদ ব্যাজার মুখ করে মিক্সির দিকে এগিয়ে যান। 

শিব : (ফিসফিস করে) ইয়ে বলছি কি, তুমি তো 'পারো' মানে শরৎ বাবুর দেবদাসের ইন্সট্যান্সও টানতে পারতে তাই না ? খামোখা বাইরের লোকের সামনে তোমার বাংলা সিরিয়াল কাল্চারটা না দেখালেই কি নয়।
পার্বতী :(অবাক হয়ে) কাল্চার ! আমাদের গোটা বাংলা তো এগ্রিকালচার আর চপ ফুলুরির ওপর ডিপেন্ড করছে গো। এই স্বর্ণ যুগে টিভি না দেখাটা নেগলেক্ট করি কি করে বলো তো ?
শিব : আচ্ছা বেশ ! মন খারাপ কোরো না লক্ষীটি। তুমি বলে দাও তোমায় কি নামে ডাকব ?   
পার্বতী : (চোখ মুছে গদগদ ভাব করে) থাক, তোমায় আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। তুমি যা বলবে তাই.... 
শিব : (আরেকটু কাছে এসে) না, তুমি বলে দাও.... 
পার্বতী : না তুমি বলো....
শিব : না তুমিই বলো.....
পার্বতী : না তুমি.....

(নারদ তার তাম্বুরায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজাতে থাকেন - 'এই পথ যদি না শেষ হয়.........'
শিব জড়িয়ে ধরেন পার্বতীকে। দুজনের নিভৃত চাপা ফিসফিসানি আর হাসির শব্দ শোনা যায়। 
নারদ জিভ কেটে অন্য দিকে চোখ ঘোরান। তারপর জোরে গলা খাকরানি দেন। শিব পার্বতী দুজনেই ব্যস্ত হয়ে একটু সরে বসেন)।

নারদ : এই নিন শরবত। 

শিব আর পার্বতী  দুজনেই হাত বাড়িয়ে গ্লাস নেন।

পার্বতী : (জিভ কেটে) এই রে ! আমার তো খেতে নেই, আজ তো আমার উপোস। 
শিব : এই বয়েসে আর উপোস করে কাজ নেই। তাছাড়া ফ্রুট জ্যুসে আবার দোষ কিসের ? 
পার্বতী : তাহলে তুমিই খাইয়ে দাও বরং। 

শিব পরম স্নেহে পার্বতীকে ফ্রুট জ্যুস খাওয়াতে থাকেন। 

নারদ : আমি বলছিলুম কি, ব্যাপারটা যখন আর অতটা সিরিয়াস নয়, তাহলে বরং মহাদেব আজ  একবার মাকে গোলাপ দিয়েই দিনের শুরুটা করে ফেলুন। তারপর নাহয় আপনি চট করে মায়ের দেওয়া জলে চান করে একবার মর্ত্য থেকে ঘুরে আসুন। ততক্ষনে মা রেডি হয়ে যাবেন। তারপর দুজনে মিলে একটু ঘুরে আসুন, আপনাদের ভ্যালেন্টাইন্স ডেও সেলিব্রেট হবে আবার প্রাইভেট টাইমও, কি বলেন ?

শিব : (পার্বতীর দিকে তাকিয়ে) ছেলেটা অনেকদিন পর বেশ ভালো বলেছে........তাই না গো ?
পার্বতী :(লজ্জা পেয়ে মিষ্টি করে হেসে) আমি জানি না.......যাও.......

শিব আর নারদ দুজনেই অট্টহাস্য করে ওঠেন। 

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পুনশ্চ : এই গল্পের সাথে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যোগাযোগ খুঁজতে যাবেন না দয়া করে। কোনোরকম ভাবাবেগে আঘাত করা উদ্দেশ্য নয়, নির্মল আনন্দের জন্যই এ গল্প লেখা।


ছবি : সংগৃহিত 

#bengalishortstory #valentinesday #shibratristory #lovestory #shivparvati #Molat

Tuesday, November 14, 2017

সাপ্তাহিকী - ৩৩ # ডাবলস পার্টনার

গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে থমকে দাঁড়াল অর্জুন। ইদানীং সাড়ে পাঁচটাতেই সন্ধ্যে নেমে আসছে। পশ্চিম আকাশে মরিচগুঁড়োর মতো ধূসর রং জমেছে। বৃষ্টি হবে নাকি ? এই হেমন্তের শুরুতেই অকালবর্ষণ হয়ে গেছে একদিন। আজও যদি বৃষ্টি হয় তাহলে খেলাটা মাটি হবে একেবারে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে ফ্লাইওভারের তলায় পার্কিং স্পেসটাতে এসে দাঁড়ায়। পলাশ আর সুমন এসে গেছে ততক্ষনে। অর্জুনকে দেখতে পেয়েই দুজনে প্রায় একসাথে বলে উঠল, 'কিরে, দেরি করলি যে' ? পলাশের মুখের দিকে তাকিয়ে অর্জুন একটু ধমক দিয়ে বলে, 'তোদের মতো কি আর আরামের চাকরি রে ভাই, যে বললেই টুক করে বেরিয়ে পড়ব ? সাতঘাটের কাজ নামিয়ে তবে আসতে হল'। সুমন সুর করে বলে, 'আহা ! চটছ কেন বরফি ? বৃষ্টি টিষ্টি আসতে পারে তাই আর কি'.......।

অর্জুন একটা বেঞ্চের ওপর কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'অনুপমদাকে দেখছি না তো ? কোথায় সে ? আসেনি এখনো' ? পলাশ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, 'আরে অনুপমদাকে তো কখন থেকে ফোন করছি, ধরছেই না। কি ব্যাপার কে জানে' ? সুমন অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলে, 'দ্যাখগে আবার ডুব মারল কিনা। না এলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে'। অর্জুনের চোখে সন্দেহ ঘনায়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বলে, 'আমি দেখি একবার ট্রাই করে, তোরা ততক্ষনে বোর্ডটা বার কর'।

গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের নিচে ক্যারাম প্লেয়ার্স এসোসিয়েশনের মেম্বার অর্জুন, পলাশ, সুমন, অনুপম এবং আরও অনেকে। প্রত্যেক সন্ধ্যেবেলা নিয়মিত খেলা হয় সেখানে। ছটা থেকে নটা। পার্কিং স্পেসটার ডানদিকে একটা উঁচু চাতালের ওপর দুটো বোর্ড সাজানো হয়। সন্ধ্যের দিকে বেশ বড় একটা জমায়েত হয়। যারা নিয়মিত খেলে তারা তো থাকেই এছাড়া দর্শকের সংখ্যাও নেহাত মন্দ হয় না। সবমিলিয়ে বেশ একটা জমজমাট আসর বসে। আসছে শনিবার টুর্নামেন্ট আছে। কয়েকদিন আগেই এনাউন্স হয়েছে। দুদিকে দুটো ফ্লেক্সও টাঙানো হয়েছে। পথচলতি ক্যারাম আগ্রহীদের কাছে এটা একটা বিষয় বটে। প্লেয়াররা রীতিমত সিরিয়াস। এর মধ্যে প্রায় প্রতিদিন ওয়ার্ম আপ ম্যাচ আছে। ডাবলসে যে যার জুটির সাথে নিয়মিত প্রাকটিস করছে। যারা ভালো খেলে অর্জুন তাদের মধ্যে অন্যতম। বুদ্ধিদীপ্ত খেলায় ইতিমধ্যেই সে বাহবা কুড়িয়েছে সবার। সিঙ্গল শট এঙ্গেল হোক বা ডাবল শটের কাট, অর্জুনের মতো শিল্পী হাতের তালিকা নামমাত্র সেখানে। একমাত্র সম্রাট আর মোহিতই আছে যারা অর্জুনকে টক্কর দিতে পারে সমানে সমানে। তারাও আসন্ন টুর্নামেন্টের আঁচে সেঁকে নিচ্ছে নিজেদের। সকলে বলাবলি করছে সম্রাট - মোহিত আর অর্জুন - অনুপম এর মধ্যেই ফাইনালটা হবে। এহেন মোক্ষম সময় অনুপম ফোন তুলছে না।

ভারী বিরক্ত হয় অর্জুন। ফোনটা কেটে রিডায়াল করে। বেশ কিছুক্ষন রিং হবার পর ওদিক থেকে মহিলা কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়।

- হ্যালো ?
- হ্যালো, কে বৌদি ? অর্জুন বলছি....
- ওহ অর্জুন ! বলো কি ব্যাপার !
- অনুপমদাকে একটু দেবে ? অনেক্ষন থেকে ট্রাই করছি, পাচ্ছি না......
- তোমার অনুপমদার তো অবস্থা খারাপ, ফোন তুলবে কি ! সে তো বিছানায় শুয়ে আছে....
- সেকি !! কেন কি হয়েছে ??
- তিনদিন ধরে জ্বর, আজ সকালে ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট পেয়েছি - ডেঙ্গু !
- বলো কি !! ইস্সসস ! এ যে একেবারে কেলেঙ্কারি হল !
- আর বলো কেন ? তোমার অনুপমদার ঠেলায় সংসার মাথায় উঠেছে আমার।
- আচ্ছা, প্লেটলেট কি খুব কমে গেছে ?
- নাহ, ওটা মোটামুটি ঠিকই আছে, তবে জ্বরটা কমছে না মোটে। ডাক্তার বলেছে দিন পনেরোর আগে বিছানা ছেড়ে ওঠার কোনো প্রশ্নই নেই।
- ওহ ! আচ্ছা বেশ, আমি নাহয় কালকের দিকে যাব একবার। কোনো প্রয়োজন হলে বোলো কিন্তু.......

দুচারটে টুকটাক কথা সেরে ফোন কেটে দেয় অর্জুন। শুকনো মুখে ফিরে আসে চাতালটার দিকে। সুমন সে দিকে তাকিয়ে বলে, 'কি রে, অনুপমদাকে পেলি ? আসছে' ? অর্জুন হতাশ হয়ে বলে, 'নাহ, অনুপমদার ডেঙ্গু হয়েছে, পনেরো দিনের জন্য গ্যারেজ' ।

- য়্যাঁ !! সে কি রে ?? তাহলে ?

অর্জুন বিড়বিড় করে বলতে যায়, 'তাহলে আর কি, আমার হাতে তো আর কিছু..........' । কথাটা শেষ করতে পারে না। উল্টোদিক থেকে মোহিত আর সম্রাট হৈহৈ করে এগিয়ে আসে। মোহিত বলে, 'তাহলে তো তোর হাতে হ্যারিকেন অর্জুন' ! একথায় সম্রাট খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে। বলে, 'ট্রফিটা ফস্কে গেল হে অর্জুন, এই শেষ সময় পার্টনার ডুব ? হরি হে মাধোবো, চান করব না গা ধোবো' ! একথায় আশেপাশের সমস্ত লোকজন খলখলিয়ে হেসে ওঠে।

গা জ্বলে যায় অর্জুনের। পায়ে পায়ে নিজেদের বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখেচোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। পলাশ জিজ্ঞেস করে, 'ভাই, কি করবি এবার' ? অর্জুন এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। আশেপাশের তীব্র হর্নের শব্দে তার কানে যেন ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে একনাগাড়ে। টুর্নামেন্টটা কি তাহলে সত্যিই ফস্কে গেল ? অনুপমদার দাঁড়ানোর উল্টোদিকে ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। ডাবলস পার্টনারের অনুপস্থিতিটা ঘুণপোকার মতো কুড়তে থাকে ভিতরে ভিতরে। সন্ধ্যে ঘন হয়ে জমাট বাঁধে।

'আচ্ছা এখানে মেম্বার হতে গেলে কি করতে হয়' ?

এক অতর্কিত নারীকন্ঠের প্রশ্নে সকলেই হতচকিত হয়। অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একজন তেইশ চব্বিশ বছরের শ্যামলা তরুণী তার দিকেই তাকিয়ে আছে বড়বড় চোখ করে। যেন প্রশ্নটা সে অর্জুনকেই করেছে। সে চোখের দিকে তাকিয়ে থতমত খায় অর্জুন। পরক্ষনেই সুমনকে ইশারা করে ব্যস্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সুমন তৎক্ষণাৎ গলায় কপট গাম্ভীর্য এনে বলে ওঠে, 'এককালীন রেজিস্ট্রেশন ফিইজ আছে, এছাড়া মাসে মাসে একটা মেম্বারশিপ ফিইজ দিতে হয়, এই, এছাড়া আর কিছু নেই'। পলাশ মাতব্বরের মতো জিজ্ঞেস করে, 'কে খেলবে ? ভাই না বয়ফ্রেন্ড' ?

তরুণী নিঃশব্দ থাকে কিছুক্ষন, তারপর ধীরে ধীরে বলে, 'আমি' !

বোম ফাটার মতো আওয়াজ করে কাছেই কোথাও একটা ট্যাক্সির টায়ার বার্স্ট হয়। কিন্তু সে আওয়াজ ছাপিয়ে অপিরিচিতা তন্বীর আত্মবিশ্বাসের স্বর ছড়িয়ে পড়ে চারিপাশে। অর্জুনদের বোর্ড তো বটেই তাদের পাশের বোর্ড থেকেও লোকজন উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকে এদিকে। অর্জুন, সুমন আর পলাশ গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে থাকে তরুণীর দিকে। সুমন অপার বিস্ময়ে বলে, 'আপনি' !!??
অপরিচিতা ততধিক ঋজু ভঙ্গিমায় বলে, 'হ্যাঁ আমি। কেন, মহিলা মেম্বার হওয়া যায় না ? নাকি, হলে আপত্তি আছে ? অর্জুন অস্ফুটে বলে, 'না, তা নেই বটে, তবে আমাদের মহিলা মেম্বার কেউ হয়নি এখনো অবধি। আপনারই অসুবিধে হতে পারে'।

তরুণী স্মিত হেসে বলে, 'না না, তাতে আমার কোনো অসুবিধে নেই'।
অর্জুন ঘাড় নেড়ে বলে, 'বেশ। তাহলে ওই দিকটায় এগিয়ে যান, সুবিমলদা বলে একজন বসে আছেন, উনিই মেম্বারশিপটা দেখেন, ওনাকে গিয়ে বলুন, উনিই বলে দেবেন কি কি করতে হবে'।
'ধন্যবাদ' , বলে তরুণী এগিয়ে যায় সুবিমলদার দিকে। পলাশ আর সুমন একঠায় চেয়ে থাকে ব্লু জিন্স আর ধূসর টপ পরিহিতার দৃঢ় পদক্ষেপের দিকে। অর্জুন ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়। বলে, 'আঃ কি ক্যাবলার মতো চেয়ে আছিস তোরা ? মেয়ে দেখিসনি নাকি আগে' ?

পলাশ স্বগতোক্তির ঢঙে বলে, 'দেখেছি গুরু, কিন্তু লেডি ক্যারাম প্লেয়ার তো তেমন দেখিনি আগে' ! সুমন হাহা করে হেসে ওঠে। অর্জুনও ফিক করে হেসে বলে, 'ওসব কিচ্ছু না রে পলাশ, এ হলো হুজুগ। আজকাল সব নানারকম ট্রেন্ড হয়েছে কিনা। রাজকন্যের খেয়াল হয়েছে গড়িয়াহাটের মোড়ে ম্যাচ বোর্ডে একটু আঙ্গুল ঘষবে, এই আর কি। অমন আনকোরা আঁতেল আমি ঢের দেখেছি। দুদিন যেতে দে, পাখি নিজেই উড়ে যাবে'। পলাশ আর সুমন একযোগে হেসে ওঠে। সন্ধ্যের ক্যাকোফোনির সঙ্গতে স্ট্রাইকার আর ঘুঁটির সঙ্গীত জমে ওঠে দারুণ। খেলা চলতে থাকে পরের পর। আজ অনুপম না আসায় অর্জুন অন্য একজন মেম্বারকে নিয়ে খেলতে থাকে। পলাশ আর সুমন যথারীতি পার্টনার।
বেশ কিছুক্ষন পর আবার সেই নারীকন্ঠস্বর পাওয়া যায়।

- রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে আমার....

অর্জুন ডান দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। প্রত্যুত্তরে একটা 'বাহ্' বলে নিজের বাঁ দিকে একটা লাইন ঘেঁষা বেস খেলতে লাগে সে। সুমন একবার পলাশের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, 'কার্ড পেয়েছেন তো ? কবে থেকে খেলবেন তাহলে' ? মেয়েটি তার উত্তরে বলে, 'না, কার্ডটা কাল দেবেন বলেছেন সুবিমলদা। আর বললেন সুযোগ হলে আজ থেকেই খেলতে পারি'। পলাশ বলে উঠল, 'ওহ ! এতো দারুন ব্যাপার'। কথাটা শেষ হতে না হতেই অর্জুনের ওপরের একটা কোণাকুণি এঙ্গেল মিস করে ফেলল। ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, 'অাহ্ পলাশ ! গল্পই যদি করবি তো সাইডে গিয়ে কর। খেলার সময় ভীষণ ইরিটেটিং লাগে এসব'। সুমন সেটা লক্ষ্য করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করেই বলল, 'তা আপনি যদি চান আজই খেলতে পারেন, মানে এই বোর্ডেই'। অর্জুন ক্রুদ্ধনেত্রে তাকাল সুমনের দিকে। সুমনের মুখেচোখে একটা ফিচেল চাপা হাসি খেলে যায়। অনাহূত তরুণী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, 'না না আপনারা তো একটা গেম খেলছেন, ওটা শেষ হোক আগে.....তারপর না হয়..........'
খেলা চলতে লাগল নিজস্ব নিয়মে।

মিনিট চল্লিশেক বাদে অর্জুনের প্রায় একার কৃতিত্ত্বে পলাশ আর সুমন গেম খেয়ে গেল। মেয়েটি হাততালি দিয়ে উঠল। চোখে মুখে উচ্ছাস নিয়ে অর্জুনের দিকে ফিরে বলল, 'আপনি তো দারুন খেলেন' ! অর্জুন প্রত্যুত্তরে সামান্য হাসল শুধু। আসলে এই অযাচিত উপস্থিতি সে একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না। বিশেষ করে এই খেলার সময়। ক্যারামটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে অর্জুন। আর এই খেলা ঘিরে কোনোরকম ছেলেমানুষি বা বালখিল্যতা সে পছন্দ করে না একেবারেই। সুমন পলাশের দিকে একবার চোখে চোখে ইশারা করে নিয়ে মেয়েটিকে বলল, 'ইয়ে মানে, আপনি খেলতে পারেন এবার। অনুপমদা মানে অর্জুনের রেগুলার পার্টনার এবসেন্ট। আপনি বরং অর্জুনের পার্টনার হয়েই শুরু করুন'।

উল্টো দিক থেকে মোহিত চেঁচিয়ে বলে, 'অর্জুন কি নতুন পার্টনার পেল সুমন' ? অর্জুন সেকথায় পাত্তা না দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বলল, 'দ্যাখ সুমন, ক্যারামটা ঠিক হাসি ঠাট্টার খেলা নয়, যে যখন তখন যেভাবে খুশি আমায় খেলতে হবে। আমায় বরং আজ মাপ কর। তোরা খেল, আমি যাই'। তারপর মেয়েটির দিকে ফিরে কঠিন সুরে বলল, 'আসলে এই খেলাটা আমি ভালোবেসে খেলি, তাই ঠাট্টা তামাশা করে খেলা আমার দ্বারা হবে না, দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না'।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে বলে, 'দেখুন আপনি যদি না চান, আমি না হয় অন্য একজন পার্টনার নিয়ে খেলব। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কাছেও ক্যারাম খুব পছন্দের খেলা। তাছাড়া আমি আপনার নাম শুনেছি অর্জুনবাবু। তাই আপনার সাথে খেলার ইচ্ছে ছিল, এই আর কি'। একথায় তিনজনেই অবাক হয়ে যে যার মুখের দিকে তাকাতে থাকে। নাম শুনে খেলতে আসার ব্যাপারটা সবার কাছেই বেশ আশ্চর্যের বিষয় মনে হয়। অর্জুন খানিক অপ্রতিভ হয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, 'আমার নাম শুনেছেন ? মানে ?...... ঠিক বুঝলাম না তো '।

'দেখুন গড়িয়াহাট চত্ত্বরে ক্যারাম প্লেয়ারদের মধ্যে আপনার নাম প্রথম সারিতে আসে। আর যেহেতু আমিও খেলাটাকে ভালোবাসি সেই সূত্রেই বলতে পারেন আপনার নাম শুনেছি। আপনার একরকম ভক্ত বলতে পারেন', মেয়েটি মোলায়েমস্বরে উত্তর দিল। অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। ক্যারাম খেলেও যে ফ্যান অর্জন করা যায় এটা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না কিছুতেই। কি বলবে ভেবেই উঠতে পারল না সে। সাময়িক বিরতির পর সুমন বলল, 'বেশ তো অর্জুন, তুই পলাশকে নিয়ে খেল আর আমি নাহয় ম্যাডামকে নিয়ে খেলি। তাহলে হবে তো ? আর তাছাড়া উনি তোর নাম শুনে এসেছেন, তুই না খেললে ভীষণ খারাপ দেখায় তাই না' ? একথায় মেয়েটি করুণ মুখে তাকিয়ে রইল অর্জুনের দিকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কতকটা নিমরাজি হল অর্জুন। এই গেমটা চার বোর্ডের বেশি লাগবে না ভেবে পলাশের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি দাঁড়াল অর্জুনের বাঁদিকে, সুমনের মুখোমুখি। পলাশ প্রায় বিড়বিড় করে বলল, 'এখানে ম্যাডাম যখন আজ প্রথম খেলছেন, তখন আর লাইন করে কাজ নেই, হিটটা বরং উনিই করুন, তাই না ?' সুমন আর অর্জুন ঘাড় নেড়ে সায় দিল। আগন্তুক বলে উঠল, 'আমায় ম্যাডাম বলবেন না প্লিজ, আমার নাম চিত্রা'।

নামটা বেশ শোনা শোনা লাগল অর্জুনের। কিন্তু কোথায় শুনেছে কিছুতেই মনে করে উঠতে পারল না। 'চিত্রা.....চিত্রা....', নামটা বার কয়েক মৌমাছির মতো গুনগুন করতে লাগল মাথার মধ্যে। নাঃ, মনে পড়ছে না একদম। ঝুলন্ত বাল্বের হলুদ আলোয় আনমনা হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। চটক ভাঙল হিটের খ্যাটাক আওয়াজে।

ব্ল্যাঙ্ক হিট করেছে চিত্রা। কোনো পকেটেই ঘুঁটি যায় নি। লজ্জায় লাল হয়ে যায় চিত্রার মুখ। জিভ কেটে বলে, 'আসলে এখানে নতুন তো, এক দুটো বোর্ড লাগবে হাত সেট হতে'। অর্জুন একটা মিহি হাসি ঝুলিয়ে আড়চোখে সুমন আর পলাশের দিকে তাকায়। ভাবটা এমন যে আমি আগেই বলেছিলুম এসব আনকোরাকে নিয়ে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর পাঁচটা ঘুঁটি পরপর পকেট করে অর্জুন। সুমন আর পলাশের দান ঘুরে আবার চিত্রার স্ট্রাইক আসে। ডানদিকের একটা বেস খেলার পর একটা সহজ ইঞ্চি মিস করে চিত্রা। অর্জুনের স্ট্রাইক আসে। রেড সমেত পরপর দুটো ঘুঁটি ফেলে দিয়ে একটা বেস নামায় পলাশের হাতে। সুমন তিনটে ঘুঁটি ফেলার পর পলাশ দান পেয়ে বাকি ঘুঁটি ক্লিয়ার করে বোর্ড শেষ করে। প্রথম বোর্ডে এগারো পয়েন্ট পায় অর্জুন আর পলাশ। চিত্রার মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যায়। প্রথম দিন এসেই নীল গেম খেয়ে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা দেখতে পায় চোখের সামনে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হেসে অর্জুন ঘুঁটি সাজিয়ে হিট করে। জোরালো হিটে রেডশুদ্ধু দুটো সাদা ঘুঁটি পকেটে চলে যায়। এরপর নিখুঁত এঙ্গেলে ঘুঁটি ফেলতে থাকে পরের পর। প্রায় সেঞ্চুরীর মুখে এসে লাস্ট ঘুঁটিটা ভুলবশত মিস করে। সুমন দান পেয়ে চারটে ঘুঁটি ফেলে কোনোরকমে। মিস করার পর পলাশ শেষ সাদা ঘুঁটি পকেট করে। চিত্রা দান পায় না, তার আগেই বোর্ড শেষ হয়ে যায়। দুটো বোর্ড মিলিয়ে মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় একুশ। পলাশ কতকটা মস্করার সুরে চিত্রাকে বলে, 'আপনি কি এই প্রথম ক্যারাম খেলছেন না আগেও খেলেছেন' ?

সুপ্ত খোঁচাটা ধরতে ভুল হয় না চিত্রার। হেসে বলে, 'আমি খেলি মাঝে মাঝে'।
'কোথায় ? উইকেন্ডে বাড়িতে সবার সাথে গোল হয়ে বসে..... তাই না' ? পলাশ হাসির দমক সামলে বলে ওঠে।

চিত্রা একথার কোনো উত্তর দেয় না। সামান্য হাসে শুধু। সুমন হিট করে। পরপর তিনটে ঘুঁটি ফেলে। হাত ঘুরে পলাশের কাছে যায়। পলাশ একটা দূরের কালো ঘুঁটি এঙ্গেল করতে গিয়ে মিস করে। বাঁদিকে একটা বেস পায় চিত্রা। সেটা দেখার পর পুরো বোর্ডটা ভালো করে জরিপ করে সে সময় নিয়ে। বাকি ঘুঁটির পজিশন দেখতে দেখতে এলোচুলটা টাইট করে পনিটেল বেঁধে নেয়। এরপর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে একটা জোরে টোকা মেরে বেসটাকে হিট করে চিত্রা। বেসটা তো পড়েই তদুপরি স্ট্রাইকার ঘুরে বাঁদিকে একটা ইঞ্চি ঘুঁটিও পেয়ে যায়। চমৎকার শট ! এমন চোখজুড়ানো শটে অর্জুন হাঁ হয়ে যায়। পলাশ আর সুমনের চোখ গোলগোল হয়ে ওঠে। সেদিকে আমল না দিয়ে ইঞ্চিটাকে তাক করে চিত্রা। একটু বেঁকিয়ে ইঞ্চিটাকে ডানপকেটে ফেলে দিয়ে একই শটে রেডটাকেও হিট করে। নিখুঁত এঙ্গেলে রেডটা প্রায় ভেসে গিয়ে টুপ্ করে বাঁদিকের পকেটে ঢুকে যায়। দুর্দান্ত ডাবল শট ! অর্জুন, পলাশ, সুমন যে যার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। দর্শকরা অভিভূত হয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে। দূরের একটা ঘুঁটিকে এরপর সফলভাবে এঙ্গেল করে চিত্রা, রিটার্ন স্ট্রাইকারে একটা বেস নিয়ে আসে। এই বেসটাকেও কায়দা করে পকেট করার ফলে বাঁদিকে দূরের পকেটে একটা সহজ ঘুঁটি পেয়ে যায় সে। বোর্ডের বিটে স্ট্রাইকার ঘুরিয়ে ওই ঘুঁটিটা তো ফেলেই, তার ওপর শেষ ঘুঁটিটা পেয়ে যায় একেবারে হাতের নাগালে। ডানদিক আর বাঁদিকের পকেট ব্লক থাকায় একটা মাপা টাঙ্কি শটে শেষ ঘুঁটিটা পকেট করে চিত্রা। একবোর্ডেই চোদ্দ পয়েন্ট পায় চিত্রা আর সুমন। অর্জুন চান্সই পায় না এই বোর্ডে। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে সে চিত্রার দিকে। দর্শকরা হইহই করে ওঠে। 'সাবাশ' , 'কেয়াবাৎ' ইত্যাদি শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশটা। ভিড় বাড়তে থাকে একটু একটু করে। আশেপাশের দুচারজন ভূয়সী প্রশংসা করে নবাগতা প্লেয়ারের।মৃদু হাসে চিত্রা.....

পরের বোর্ড। পলাশ দারুন হিট করে। তিনটে ঘুঁটি একসাথে পকেটে পড়ে। দুটো বাঁদিকে আর একটা ডানদিকে। পরের ঘুঁটিটা মারতে গিয়ে মিস করে। দান পায় চিত্রা। দুরন্ত এঙ্গেলে দুদিকের পকেটে দুটো ঘুঁটি ফেলে দেয়। সার্কেলের ভিতর থাকা একটা অনবদ্য চাপ খেলে সে রেডটাকে  নামিয়ে দেয় সুমনের হাতে। অর্জুন যেন থৈ পায় না। এমন তুখোড় খেলার সামনে একটু থতমত খেয়ে যায়। হাতের সামনে একটা সহজ ঘুঁটি থাকা সত্ত্বেও রেডটা সুমনের বেসে চলে যাওয়াতে নিরুপায় হয়ে রেড খেলতে হয় অর্জুনকে। তাতেই মারাত্মক ভুলটা করে বসে অর্জুন। মুহূর্তের অসতর্কতায় রেডটা মিস করে ফেলে। রেডে স্ট্রাইকার লাগলেও ঘুরে এসে আবার সুমনের হাতের নাগালেই বসে পড়ে রেডটা। হাত মিস হয় অর্জুনের। দান পেয়ে রেডটা ফেলে দেয় সুমন। সুন্দর এঙ্গেলে দুটো ঘুঁটি নামিয়ে দেয় চিত্রার হাতে। একটা কঠিন ঘুঁটি খেলতে গিয়ে পলাশের হাত মিস হয় আবার। দান পায় চিত্রা। বেসলাইনের ওপর একটা ঘুঁটি দারুন ভাবে টপ করে ডাবল শটে দূরের একটা ঘুঁটিও ফেলে সে। পরের ঘুঁটি মিস হয়। অর্জুন দান পেয়ে দুর্দান্ত খেলে দুটো ঘুঁটি পকেট করে। কিন্তু আর কোনো ঘুঁটি হাতে না থাকায় একটা ইঞ্চি নামিয়ে দেয় পলাশের হাতে। সুমন হাত পায় এরপর। অসাধারণ খেলে অবশিষ্ট কালো ঘুঁটি পকেট করে। এই বোর্ডে নয় পয়েন্ট পেয়ে চিত্রা আর সুমনের মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় তেইশ। অর্জুনের আর পলাশের পয়েন্ট টপকে দুকদম এগিয়ে থাকে।

অর্জুনের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। কারণ এই তেইশ পয়েন্টটা তাদের জন্য এক বিপজ্জনক বস্তু। রেড ব্যতীত ছ পয়েন্ট পেলেও গেম আবার রেড সহ এক পয়েন্ট পেলেও গেম। বলাই বাহুল্য অর্জুন আর পলাশের কাছে গেমটা মান বাঁচানোর লড়াই হয়ে ওঠে এখন।

দুনম্বর বোর্ডে একটি অপিরচিতা তরুণী দুর্দান্ত খেলে অর্জুন আর পলাশকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে, এই খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। দেখতে দেখতে মন্দিরের জমায়েতের মতো ভিড় জমে যায়। সকলেই ফিসফাস করতে থাকে। অর্জুনের সারা মুখে অমানিশা ঘনিয়ে আসে। একজন অপরিচিতা নবীনার কাছে সবার মাঝে অপদস্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখতে পায় যেন চোখের সামনে। ধীরে ধীরে হিট সাজায় চিত্রা। অর্জুনের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে সজোরে হিট করে।

এবারে আর ব্ল্যাঙ্ক হিট হয় না। একসাথে দুটো ঘুঁটি পড়ে। এরপর যেন স্বপ্নের খেলা খেলতে থাকে চিত্রা । দর্শকদের সাথে সাথে চুপ করে সে মোহময় খেলা প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না অর্জুন আর পলাশের। নিপুণ এঙ্গেল আর তুখোড় ডাবল শটের যুগলবন্দীতে পরপর ছটা ঘুঁটি পকেটে ফেলে উড়ালপুলের দর্শকদের মাঝে চিত্রা আলোড়ন তুলতে থাকে একের পর এক। সাময়িক ঝড়ের বিরতিতে দান পায় অর্জুন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে তার। হালভাঙ্গা নাবিকের মতো আসন্ন ভরাডুবি দেখতে পায় যেন। এমন অদ্ভুত নির্ভুল খেলা দেখে ক্ষণিক বেগ পায় বটে সেও দমে যায় না কিছুতেই। 

দুর্দান্ত খেলে একের পর এক ঘুঁটি পকেট করতে থাকে অর্জুন। আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণের উত্তাপে স্ট্রাইকার ঘুঁটির খেলা মারাত্মক জমে ওঠে। নামের প্রতি সুবিচার করে পরপর অবাক করে দেওয়ার মতো শট খেলতে থাকে অর্জুন। আটটা ঘুঁটি ফেলে বোর্ডটা প্রায় শেষ করে আনে একা। ওদিকে চিত্রা আর সুমনের এখনো তিনটে ঘুঁটি বাকি। পরিস্থিতিটা যেন সম্পূর্ণ রূপে হঠাৎ করেই ভোল বদল হয়ে যায় সবার চোখের সামনে। অর্জুনদের একুশ পয়েন্টে থাকায় এখন রেড সহ একটা ঘুঁটি ফেললেই চিত্রা আর সুমন গেম খেয়ে যাবে। বোর্ডের দিকে তাকিয়ে চিত্রা মনে মনে প্রমাদ গোনে। ডানদিকে একটা কালো ঘুঁটির সাথে রেডটা কোনাকুনি অবস্থায় বসে আছে। ডাবল শটের নিশ্চিত সুযোগ। দর্শকরা একঠায় তাকিয়ে থাকে অর্জুনের দিকে। ফিসফাস বলাবলি শুরু হয়, 'এ তো অত্যন্ত সহজ ডাবল শট। অর্জুনের হাতের মোয়া' ইত্যাদি। কালো ঘুঁটিটা ঠিকঠাক এঙ্গেল করতে পারলে একই শটে রেড পড়ে অথবা বেসে চলে আসে। যে কোনোভাবেই চিত্রা আর সুমনের হার নিশ্চিত।

ধীরে ধীরে স্ট্রাইকার বসায় অর্জুন। চার পাঁচ সেকেণ্ড সময় নেয় তাক করার। তারপরেই ধনুকের ছিলা থেকে অব্যর্থ তীরের মতো স্ট্রাইকার বেরিয়ে কালো ঘুঁটিতে হিট করে। অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটে ! যে শটটা দশবারে দশবারই পকেট করতে পারে অর্জুন আজ সামান্য এঙ্গেলের হেরফেরে সেই ডাবল শট মিস হয়ে যায় সম্পূর্ণ। বিস্ময়ে থ হয়ে যায় অর্জুন........সঙ্গে বাকি দর্শকও। নিজের অপারগতায় ধিক্কার দিতে থাকে মনে মনে। রেড আর কালো ঘুঁটিটা পলাশের নাগালের বাইরে চলে যায়। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে সুমন নিজের দানে দুটো ঘুঁটি পকেট করে। দুতরফেই একটা একটা করে ঘুঁটি পড়ে থাকে এরপর। পলাশ দান পায়। অনেকটা দূরে থাকায় রেডটা মারতে গিয়ে মিস করে ফেলে। রেডটা ঘুরে চিত্রার বেস লাইনের নিচে বসে পড়ে। রেডের সামান্য কাছে ওপরের দিকে কালো ঘুঁটিটা থাকায় স্ট্রাইকার বসিয়ে আঙুল ছোঁয়ানো কঠিন হয় চিত্রার পক্ষে। স্ট্রাইকার বসছে কিন্তু আঙুল বসানো যাচ্ছে না। ভুলবশত কালো ঘুঁটিতে আঙুল ছুঁলেই ফাইন হবে।কপালে ভাঁজ পড়ে চিত্রার। দর্শক মহল থেকে এমন অসম্ভব বেস না খেলার বিস্তর মতামত আসতে থাকে। অর্জুনও মাথা নাড়তে থাকে, কোনোভাবেই এই বেসটা খেলা সম্ভব নয়। 


বেশ কিছুক্ষন পর স্ট্রাইকার বসায় চিত্রা, সমস্ত রকম জটিলতা, বারণ অগ্রাহ্য করে ঠিক ওই জায়গাতেই। এমন খামখেয়ালী সিদ্ধান্তে আলগা হাসে অর্জুন। ফাইন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। উপস্থিত দর্শকদের থামিয়ে মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে কতকটা তুড়ি মারার কায়দায় অভিনব ভাবে রেডটাকে ব্যাক স্ট্রাইক করে চিত্রা। ওপরের কালো ঘুঁটিটা একসুতোও নড়ে না। উপরন্তু মর্মভেদী শটে রেডটা পকেট হয় ও স্ট্রাইকার ঘুরে সাদা ঘুঁটিতে লাগে। বাঁদিকে কোণার পকেটে সেটাও মখমলের মতো ভেসে গিয়ে পড়ে যায়। অপ্রত্যাশিত শট এবং গেম !


মুহূর্তের জন্য দর্শকদের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায় যেন। চোখের পলক পড়ে না অর্জুনদেরও। এমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাক স্ট্রাইকের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে সবার। আর তারপরেই সমস্ত নিস্তব্ধতা কাটিয়ে উচ্ছাসে, কলরবে উড়ালপুলের নিচেটা গমগম করে ওঠে। নিমেষে চিত্রাকে নিয়ে উৎসবের আকার নেয় গড়িয়াহাট চত্ত্বর। হৈহৈ করে অকুন্ঠ প্রশংসায় ভরিয়ে তোলে চিত্রাকে।

অর্জুনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে হাসিমুখে সবাইকে অভিবাদন করে বেরিয়ে আসে চিত্রা। পিছুপিছু অর্জুন এসে অবিশ্বাসী কণ্ঠে চিত্রাকে প্রশ্ন করে, 'একটু শুনুন, ব্যাক স্ট্রাইকে বেস ফেলার শটটা কোথা থেকে শিখলেন আপনি' ? থমকে দাঁড়ায় চিত্রা। খানিক্ষন মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, 'আমায় এখনো চিনতে পারলে না অর্জুনদা' ? অর্জুন থতমত খেয়ে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে চিত্রার দিকে। চিত্রা থেমে থেমে বলে, 'আমি চিত্রাঙ্গদা...... চিত্রাঙ্গদা বসু .......কুদঘাটে বাড়ি ছিল। তোমার মনে নেই' ? 

অর্জুন থমকায় খানিক, স্বগতোক্তির মতো করে বলে, 'কুদঘাটের বাড়ি' ? তারপরেই মনে পড়ে যায় সব। গলায় একরাশ উল্লাস এনে বলে, 'তুমি মানে....... তুই শচীন কাকার মেয়ে' ? চিত্রা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। বলে, 'মনে আছে ? বছর বারো আগে যখন আমরা একই পাড়ায় থাকতুম, তোমায় চিঠি পাঠিয়েছিলুম বইয়ের ভাঁজে। তুমি বলেছিলে আগে আমায় ক্যারামে হারাবি তারপর ভাবব'। 

অর্জুন বলে, 'সে তো অনেকদিনের কথা.....তুই এখনো......' !
'তুমি পাড়া ছেড়ে চলে যাবার কয়েকমাস পর বাবার বদলির চাকরিতে আমরাও শিলিগুড়ি শিফট করি। কয়েক বছর বাদে দমদম পার্কে বাড়ি করে আবার ফিরে আসি। ফিরে এসে তোমায় অনেক খুঁজেছিলাম জানো ? কোত্থাও পাইনি। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজে নিজেই পাড়ার ক্লাবে গিয়ে ক্যারাম খেলতাম বাকিদের সাথে। সেখানেই প্র্র্যাক্টিস। মাসখানেক আগে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপের ফর্ম তুলতে যাচ্ছিলাম এই রাস্তা দিয়েই। হঠাৎ করে এখানে দেখলাম তোমায়। তারপর কদিন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার খেলা দেখতে এসেছিলাম। চোখাচোখি হয়েছিল দু একবার। তুমি চিনতে পারনি। আজ একেবারে রেজিস্ট্রেশন করে তোমার সাথে খেলব বলে এসেছি। কিন্তু দৈব দুর্বিপাকে তুমি যে সত্যিই হেরে যাবে, একেবারে ভাবিনি। তবে আমি কিন্তু কথা রেখেছি। এবার তোমার পালা', লজ্জাবনত হয় চিত্রা।

এতটা অবাক অর্জুন হয়নি কখনো আগে। পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল এক এক করে। কৈশোরের হৃত প্রেমের জোয়ারে সমস্ত হৃদয় জুড়ে একটা প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছিলো। বিড়বিড় করে বলে, 'বারো বছর আগে যা বলেছিলাম তা মনের কথা নয়। নিছকই মজা ছিল। পাড়া ছেড়ে দেবার পর তোকেও কম খুজিনি আমি। শেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়েছিলাম। তবে, তুই কিন্তু এমনিই এসে পরিচয় দিতে পারতিস। খেলার প্রয়োজন পড়তো না'। 

চিত্রা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, 'কি করে জানব তোমার মনের কথা ? তাছাড়া তোমার ধনুক ভাঙা পণ ছিল যে' ! অর্জুন লজ্জা পায় বেশ। মুখ নামিয়ে বলে, 'বিশ্বাস কর হেরেও যে এতো আনন্দ পাওয়া যায় ভাবিনি আগে'। চিত্রা ঠোঁট কামড়ায়। অর্জুন এগিয়ে এসে বলে, 'তুই আমার.......ডাবলস পার্টনার হবি' ? 

দুহাতে মুখ চাপা দেয় চিত্রা। কাছেই কোনো মোবাইলে বেজে ওঠে....'আলবেলা.....সজন আয়ও রি......'


ছবি : গুগল 
  
#bengalishortstories #carromstories #drama #lovestories

    


Wednesday, May 17, 2017

সাপ্তাহিকী ২৭ # তুমি রবে নীরবে


- আমি বিয়ে করব না.......।

কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে অর্কর, মাথাটা ঈষৎ টলে যায় যেন। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন, তারপর ভুরু কুঁচকে ঝুঁকে আসে সামনে।

- তার মানে ?
- মানেটা যা বললাম, সেটাই.......
- তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি মারছো ?
- নাহ ! সত্যি বলছি.....

'এসবের অর্থ কি পাখি ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না' !!!  
অর্কর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। চোখে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে।

- তুমি বুঝবেও না........
- অদ্ভুত তো ! আমার সাথেই বিয়ে, আর আমিই বুঝব না ?

পাখি সে কথার কোনো উত্তর দেয় না। নির্লিপ্ত ভাবে কফিশপের জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে শুধু। তারাতলা-মাঝেরহাট ক্রসিং, অগণিত গাড়ি দুদিক দিয়ে অবিরাম ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। বুকের মধ্যে ঐরাবতের উন্মত্ততা টের পায় অর্ক।
 
- এক সেকেন্ড ! তোমায় কি কেউ কিছু বলেছে ?
- না....
- স্কুলে কিছু গোলমাল ?
- না....
- তবে ?

পাখি আবার চুপ করে যায়। মুখ নামিয়ে হলুদ ওড়নার খুঁটটা ধরে পেঁচাতে থাকে এক মনে। 

অর্কর সাথে দু বছর হলো বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। পাশাপাশি দুটো স্কুলে দুজনে শিক্ষকতা করে। একজনের বিজ্ঞান আর আরেকজনের ইতিহাস। অসম বিষয়ের মধ্যে রসায়ন জমতে সময় লাগেনি খুব একটা। টুকরো আলাপচারিতায় সমভাবাবেগ বয়ে গিয়েছিল দুজনেরই হৃদয় জুড়ে। ধীরে ধীরে সে আবেগের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে বিয়ের পিঁড়ির দিকে আরও ঘন হয়েছে। কোনো বাড়িতেই আপত্তি করেনি। বরং হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সবাই । বিয়ের দিন আর বেশি বাকি নেই। 

এহেন মোক্ষম সময় অর্ককে প্রায় মাঝসমুদ্রে ফেলে বেঁকে বসেছে পাখি। অর্ক অধৈর্য হয়ে ওঠে ভীষণ। মুখচোখ কঠিন হয়ে যায় তার।

- ওহ !! তুমি বুঝি অন্য কারোর প্রেমে পড়েছ ?
- এতো ঘন ঘন আমি প্রেমে পড়তে পারিনা তোমার মতো.....
- ঘন ঘন ? কি মুশকিল..... অনিন্দিতা তো এখন অতীত। সেটা তুমিও ভালো করে জানো। আর তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর শুধু তোমাকে নিয়েই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। সুতরাং...........কেন, অনিন্দিতা কি তোমাকে কিছু.......?

বেয়ারা এসে দুটো ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায়।

'নাহ....অনিন্দিতা কিছু বলেনি....... কেন ? তেমন বলার মতো কিছু ছিল বুঝি' ? ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিতে দিতে পাখির চোখে ব্যাঙ্গের ইঙ্গিত খেলে যায়।

- দ্যাখো পাখি, এবার কিন্তু ভীষণ বাড়াবাড়ি করছ, কি হয়েছে সেটা বলো, নচেৎ এক্ষুনি তোমার বাড়ি গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করব এই ব্যাপারে।

- আমার এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না, সেইটে জানাবো বলেই তোমায় ডেকেছি। 
- বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না মানে ??!! বিয়ের আবার এখন তখন কি !!!
- করতে ইচ্ছে করছে না, ব্যাস !

- আচ্ছা, তোমার কি মাথা খারাপ হলো? বিয়ের আর হপ্তাখানেক বাকি, কার্ড বিলি হয়ে গেছে। ডেকোরেটর, ক্যাটেরার সব বলা হয়ে গেছে, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাই জেনে গেছে, আর তুমি বলছ এখন বিয়ে করব না ??? !!

- ঠিক তাই....
- দ্যাখো, আমার কিন্তু ভীষণ টেনশন হচ্ছে ? সত্যি করে বলো প্লিজ, কি সমস্যা হয়েছে ?
- কিচ্ছু না....
- তোমার বাড়িতে কোনো .....?
- না, কিছু হয়নি.....
- আমার বাবা মা কি কিছু......
- নাহ ! কেউ কিচ্ছুটি বলেনি......
- তাহলে কারণটা কি ? সেটা তো বলবে ? যাই জিজ্ঞেস করছি সবেতেই না বলছ !

- এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
- আশ্চর্য ! যেখানে তোমার আমার দুজনের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে, সেখানে দুম করে তুমি একা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে !! কেন ?

- তার কারণ তুমি আমায় প্রপোজ করোনি..... !!

আশেপাশের লোকজন মাঝেমাঝেই আড়চোখে তাকাতে থাকে তাদের দিকে । 

অর্ক যেন খেই পায় না কোনো কিছুর। পাখি নানারকম বিদঘুটে আবদার করে এসেছে বটে এ যাবৎ, কিন্তু এটা যেন পুরনো সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে গেল। নিজেকে নিপীড়িত অসহায় মনে হতে থাকে অর্কর। পরিষ্কার করে মনে করতে পারে না যে এমন বিপাকে আগে কখনো পড়েছে কিনা। অপলক, ভাষাহীন দৃষ্টিতে অর্ক তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে। পাখির সারা মুখে কোথাও লেশমাত্র কৌতুকের চিহ্ন নেই, বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে যেন। সে দৃঢ়তার আলোকছটায় ধাঁধিয়ে যায় অর্ক।

- আজ, এইখানে, এই মুহূর্তে, প্রপোজ করো। তবেই বিয়ে.......নয়ত........ভালো করেই চেনো আমাকে......

অর্ক কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় প্রায়। হাত বাড়িয়ে পাখির হাত দুটো চেপে ধরার চেষ্টা করে।

- প্রপোজ করাটাই সবচেয়ে জরুরী হল তোমার কাছে, আর এতদিন যে এত মুহূর্ত একসাথে কাটালাম আমরা, একসাথে পথচলার অঙ্গীকার করলাম, তার কোনো মূল্য নেই বুঝি ? ভালোবাসি কথাটা ব্যবহার করতেই হবে ? একটা শব্দ তোমার কাছে এতো প্রয়োজনীয় ? এতো দামী ?

প্রত্যয়ী পাখির মুখাভাবে কোনোরকম পরিবর্তন হয় না। অর্ক কি করে জানবে পাখির শব্দহীন জগতে ওই একটা মাত্র শব্দ কত গুরুত্বপূর্ণ, কত দুর্মূল্য। ছোটবেলায় এক নির্মম পথ দুর্ঘটনায় মা বাবা হারানোর সাথে সাথে পাখি হারিয়ে ফেলে তার বাক্শক্তি ও শ্রবণ ক্ষমতাও। 

তারপর থেকে কাকাদের কাছেই সে মানুষ। নীরব সংগ্রামের সেই শুরু । ব্যক্তিগত যোগ্যতায় পড়াশোনা শেষ করে একটি মূক ও বধির স্কুলে সে চাকরি পায়। উপযুক্ত ভালোবাসার অভাব বোধ করেছে সে চিরটাকাল। 

অর্কর সাথে দেখা হয়ে তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে সে অনুরাগের সঞ্জীবনী। অর্ক উন্মাদের মতো ভালোবাসে তাকে, সে জানে। পাখির সাথে কথা বলার জন্য অর্ক শিখে নিয়েছিল মুখ ও বধিরের বিশেষ ভাষা। পরিণত যুবক যুবতীর মধ্যে শব্দ কবলিত ভাষা অন্তরায় হয় নি কখনো। ভালোবাসি বলতে হয়নি কাউকেই, বরং সময়ের স্বাভাবিক গতিতে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল পরিণয়ের পথে। 

তবু আজ পাখি চায় অর্ক প্রেম নিবেদন করুক, ভালোবাসি কথাটা কানে শুনতে না পেলেও সরাসরি চোখে দেখার তৃপ্তি থেকে সে কিছুতেই বঞ্চিত হবে না আজ। আর তাই অর্ককে ডেকে এনেছে সে। আঙুলের বিশেষ কায়দায় অর্ককে প্রশ্ন করে,     

- কি ?... প্রপোজ করবে ? নাকি.......

অর্ক থমকায় এক মুহূর্ত। চারপাশটা দেখে নেয় এক নজর। কেউ বিশেষ লক্ষ্য করছে না। স্মিত হেসে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে । হাঁটুমুড়ে বসে পড়ে পাখির পায়ের কাছে। চোখে চোখ রেখে দু হাতের আঙুলের ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলে অনুপম অভিব্যক্তি.........

'আমায় ক্ষমা কোরো, আমি এটুকু বলতে সামান্য দেরি করে ফেললাম। আমার অতীত ও বর্তমানে একটাই তফাৎ জানো....., একটায় তুমি ছিলেনা, আর অন্যটায় তুমি আছ। তোমার সান্নিধ্যে যে প্রগাঢ় শান্তি পেয়েছি, এই জীবনে আমার জন্য তা অনেকখানি। আমার সমস্ত সত্ত্বা ও আত্মার সাথে জড়িয়ে আছ শুধু তুমি, কারণ তোমাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি.............পাখি চৌধুরী, তুমি কি আমার চিরসাথী হবে' ? 

পাখির চোখ দিয়ে ফল্গুধারার মতো নেমে আসে আনন্দাশ্রু। দু হাতে সে মুখ ঢেকে নেয় তৎক্ষণাৎ।   
     
কফিশপের সমস্ত লোকজন, যাঁরা এ যাবৎ পাখি অর্কর মধ্যে অঙ্গুলিহেলনে বলা টুকরো কথাবার্তাগুলো না বোঝার ফলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, তারা অর্ককে হাঁটু মুড়ে বসতে দেখে ও পাখির অনুরূপ আবেগ আন্দাজ করে সোল্লাস করে ওঠেন। ঘর জুড়ে বয়ে যায় হর্ষধ্বনি ও হাততালির বন্যা। কেউ কেউ এসে পাখি আর অর্ককে শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়। কফিশপ থেকে কমপ্লিমেন্টারি কেকের ব্যবস্থা করা হয়। 

অর্ক আর পাখি কোনোদিকে খেয়াল করে না। দুজনে স্বপ্নাবিষ্টের মতো চেয়ে থাকে দুজনের দিকে। গোধূলির স্বর্ণালী আভা কাঁচের জানলা ভেদ করে টেবিল ছাপিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে যায় দুজনের চোখমুখ........লজ্জাবনত পাখি ধীরে ধীরে মিশে যায় অর্কর বুকে ।


অলংকরণ : অর্ণব দাশগুপ্ত 

 #bengalilovestories #bengalishortstories #bengaliromanticstories

Tuesday, April 18, 2017

সাপ্তাহিকী ২৬ # গুপ্তপ্রাণ


বিকেলের আলো নিভে গেছে অনেক্ষণ। দাওয়ার ওপর জামরুল গাছের ছায়ায় সন্ধ্যে নেমেছে। বাঁশ বেড়ার ওপার থেকে গুটিকয়েক বাড়ি থেকে বসন্তের হাওয়ায় শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে। 

পায়ে পায়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন ইন্দিরা। শাঁখের আওয়াজে হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন তুলসী মঞ্চের সামনেটায়। 

মাটির ওপর ধূপকাঠি পুঁতে হেঁটে হয়ে মাথা ঠেকালেন মঞ্চের কারুকাজ করা ধাপিতে। বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে আরেকদফা হাত জড়ো করলেন কপালে। 

অকস্মাৎ, সাঁৎ করে যেন একটা ছায়ামূর্তি সরে গেলো উঠোনের পশ্চিম দিকে। অন্ধকারে ঠাহর করতে পারলেন না ইন্দিরা। 

তবু অভ্যাসবশে হাঁক পেড়ে বললেন, 'কে এলি ? বিশু নাকি' ? যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে জিভ কেটে প্রকট হল আলোয়।

ইন্দিরা তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, 'আচ্ছা বিশু, কতবার তোকে বলেছি যে এমন ভর সন্ধেবেলা গেরস্থের বাড়ি পা টিপে টিপে ঢুকবি নে, তাও আবার পশ্চিমের পাঁচিল টপকে। কথা কিছুতেই কানে যায়না দেখি তোর' !! 

বিশু অত্যন্ত কুন্ঠিত হয়ে জবাব দিল, 'আজ্ঞে মাঠাকরুণ, পত্যেকবার ভুল হয়ে যায়, এতোদিনকার অভ্যেস তো, কিচ্ছুতে মনে থাকে না'।

- 'হুঁ, তোর ভুলের ঠেলায় বাড়ির একটা অকল্যাণ হোক আর কি, তাই কি চাস তুই' ?

বিশু একথায় প্রায় মাটিতে মিশে যায়, একহাত জিভ বার করে বলে, 'ছি ছি মাঠাকরুন, অকল্যাণ আপনার হতে যাবে কেন, হোক আপনার শত্তুরের। তাছাড়া আমি থাকতে কেউ সাহস করুক তো দেখি' ! 

বিশুর ডেঁপমি দেখে হেসে ফেলেন ইন্দিরা, বলেন, 'ওই তো তোর সিড়িঙ্গেপানা চেহারা, তুই কোন কাজে লাগবি আমার ? তোর যত বাতেলা ওই মুখেই.......'

সেকথায় বিশু গলার তেজ চড়িয়ে বলে, 'মাঠাকরুণ, আমার বাপ ছিল হারু ডাকাত। বাবার ভয়ে তাবড় জমিদাররা ভয়ে জুজু হয়ে থাকতো, এক হাঁকে সাতগাঁয়ের লেঠেলদের মুখের রক্ত সরে যেত। মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে, কপালে শ্মশান কালীর তিলক লাগিয়ে যখন ওই পাহাড়ের মতো শরীরটা নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতো, ভয়ে মুচ্ছ যেতে দেখেছি অনেককেই। আমি সেই হারু ডাকাতের ছেলে, চেহারাটা না থাকলে কি হবে, শরীরে তেনার রক্তই তো বইছে। 

ইন্দিরা বললেন, 'সে নাহয় বুঝলুম, তা তুই ওমনধারা কাজ করিস কেন বাপু ? যার বাপ নামকরা ডাকাত ছিল সে এমন রাত বিরেতে ছিঁচকে চুরি করতে বেরোয় কেন বল দিকি ? এতে কি তোর বাপের মান থাকে' ?

ইন্দিরার কটাক্ষে বিশু মিইয়ে যায় খানিক। 

আমতা আমতা করে বলে, 'আজ্ঞে, সবই তো জানেন মা, উনি সেই যে নিঁখোজ হলেন তারপর তো দলটাই ভেঙে গেলো। যে যার মতো ছিটকে গেল এদিক ওদিক। দু চারটেকে পুলিশ পাকড়াও করলে আর পাড়ার লোকে আমাকে দূর করে দিলে আমার ভিটে থেকে। কাজের চেষ্টা করেছিলুম দিনকতক কিন্তু নামের জন্য কেউ আমায় রাখতে চাইলে না। কি করব মা, পেটটা তো চালাতে হবে, তাই আর উপায় না দেখে এই কাজে নেমে পড়লুম'। 

'তা এইসব করে চলে যায় তোর' ? ইন্দিরা কোমল স্বরে জানতে চান।

- রোজ কি আর চলে মাঠাকরুণ, বড় হাত আর মারতে পারি কই, সবাই সেয়ানা হয়ে গেছে, এমন এমন জায়গায় মালপত্র লুকিয়ে রাখে ঘরের মাছি পর্যন্ত জানতে পারেনা। আমি তো কোন ছার। তাছাড়া ধরা পড়লে হাটুরে ঠ্যাঙানি তো আছেই। এই তো গেলো বিষ্যুৎবার, তপেন স্যাঁকরার টেবিলের ওপর থেকে একশো টাকার নোটটা প্রায় নিয়ে ফেলেছিলুম জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে। তাড়াহুড়োয় হাতটা বের করতে গিয়ে ঠক করে লেগে গেলো গরাদে। অমনি তপেন কোথা থেকে এসে খপ আমার হাতটা ধরে এক পেল্লায় গাঁট্টা মেরে আমার বহ্মতালু গরম করে দিলে একেবারে ! বলি, তোর তো স্যাঁকরার ব্যবসা, অমন একটা একশো টাকার নোটের জন্য এই ডাকাত সন্তানের গায়ে হাত তুললি ? ধম্মে সইবে তো তোর' ?

ইন্দিরা বিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন। নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। মেধাবী ছাত্র, কলেজ শেষ করে সেই যে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলো আজ দশ বচ্ছর হয়ে গেছে সে গ্রামের মাটিতে পা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। সময়ের শরীর বেয়ে স্মৃতিটুকু লেপ্টে থাকে শুধু, যোগাযোগের সূত্রটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। তবু স্নেহের আঁচলের ঘের কম পড়েনি ইন্দিরার। বিশুকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন। সময় অসময় বিশুর সাথেই গালগল্প করে দিন কাটে তাঁর। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশুকে জিজ্ঞেস করেন, 'খেয়েছিস কিছু ? মুড়ি খাবি চাট্টি' ? 

বিশু গদগদ হয়ে বলে, 'তা আপনি দিলে কি আর আপত্তি করতে হয় মাঠাকরুণ, তবে কিনা দুটো লঙ্কা আর পেঁয়াজ দেবেন সাথে, মুখটা ছেড়ে যায় তাহলে'। 

স্মিত হেসে হেঁসেলের দিকে পা বাড়ান ইন্দিরা। মৃদু হাওয়ায় বিশু আয়েস করে বসে উঠোনের একপাশে।

হঠাৎ রে রে করে চারজন ষণ্ডামার্ক লোক ঢুকে পড়ে বেড়ার দরজা খুলে। বিশু ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। 

সবারই প্রায় পেটানো চেহারা। চোখে মুখে আগুন জ্বলছে যেন। কোমরে গোঁজা ছুঁচোলো অস্ত্রের বাঁটগুলো জামার আড়াল থেকে উঁকি মারছে। এছাড়া হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আছে লাঠি, দা, কোদাল। উঠোনের মাঝবরাবর এসে চারজনেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিশুর দিকে। 

তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বিশুর কাঁধে হাত রেখে আগুনদৃষ্টি হেনে বলে, 'কি রে.....চিনতে পারছিস' ? 

বিশু থতমত খায় খানিক। তারপর ভালো করে ঠাহর করে বলে, 'মনোহর দাদা না' ? 

পাকানো গোঁফের নিচে এক ঝলক হাসি খেলে যায় মনোহরের ঠোঁট ঘেঁষে। বলে, 'চিনেছিস তাহলে ?

- কি যে বলো ! বাবার ডান হাত ছিলে যে তুমি, আর তোমায় চিনব না গো ?

- তা ভালো, তাহলে তো সুবিধেই হল.......

বলেই মনোহর আড়চোখে তাকিয়ে নেয় তার বাকি সঙ্গীদের দিকে। 

বিশু মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে, কিসের সুবিধে' ? 

মনোহর ফিসফিস করে বলে, 'বুড়ি কি ঘরের ভেতর নাকি' ?

-কে ? মাঠাকরুন ? হ্যাঁ তিনি তো ঘরের ভিতরেই আছেন, আমার জন্য মুড়ি আনতে গেছেন কিনা........

একথায় হো হো করে হেসে ওঠে মনোহর ও তার সাগরেদরা।

- এক্কেবারে মা ছেলের সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েচিস দেখছি, হ্যাঁ ?....ভালো ভালো, তোর বুদ্ধির তারিফ করতে হয় রে বিশু ।

মনোহরের কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না বিশু, বোকার মতো মুখের দিকে চেয়ে থাকে। 

মনোহর আবার বলে ওঠে, 'শোন, ওই তুলসী মঞ্চের তলায় যে হারু কাকা ঘড়া পুঁতে গেছে সে খবর আমরাও পেয়েচি, বুঝলি ? তাই পুরো মালটা একা হাতাবি সেটা মোটেও ভাবিস না'। 

বিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, 'তুলসী মঞ্চ !! ঘড়া !! কি বলছ মনোহর দাদা......আমি তো কিছুই.......'। 

বিশুকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে মনোহর কর্কশ গলায় বলে ওঠে, 'ন্যাকা সাজিস নে বিশে, হারু কাকা নিরুদ্দেশ হবার আগে ওখানে যে ঘড়াটা পুঁতে রেখেছিলো সেইটে নিতে এসেছি আজ। ওতে আমাদের সকলের হিস্সা আছে, এটা ভালো করে বুঝে নে, নাহলে...........'।

'কার সাথে কথা বলছিস বিশু ? কে এসেছে রে' ? ইন্দিরা মুড়ির বাটি নিয়ে বাইরে আসেন। 

উঠোনের মাঝখানে কজন ভীমকায় পুরুষ দেখে কাঠ হয়ে যান এক লহমায়। ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'কে তোমরা বাছা, বলা নেই কওয়া নেই একেবারে দোর খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েছ' ? 

'আমরা আমাদের জিনিস নিতে এসেছি, পেয়ে গেলেই চলে যাবো', ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় মনোহর।

ইন্দিরা সে রক্তবর্ণ চোখের দিকে তাকাতে পারে না, বিশুর দিকে ফিরে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করেন, 'ও কি বলছে বিশু ? কে ও ? তুই চিনিস নাকি' ? 

বিশু বলে, 'আজ্ঞে, ও মনোহর দাদা, বাবার দলে ছিল। বলছে বাবা নাকি ওই তুলসী মঞ্চের নিচে কি একটা ঘড়া পুঁতে রেখেছিল, সেইটে নিতে এসেছে'। 

ইন্দিরা ভারী অবাক হয়ে বলেন, 'তুলসী মঞ্চের নিচে ঘড়া ? হারু পুঁতেছে ? কি বাজে বকছিস, তেমন হলে আমি জানব না ? আর তাছাড়া এ কবেকার তুলসী মঞ্চ, শুধু হারু কেন, কাউকেই আমি ছুঁতে দিইনি কখনো' ? 

মনোহর ইন্দিরার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, 'বাজে আমরা বকচিনে মাসিমা, সমস্ত খবর নিয়ে তবে এসেচি, তাছাড়া বিশু তো সবই জানে, কিরে বিশু ?

- আ-আমি কিন্তু সত্যি জানিনা মনোহর দাদা যে বাবা এখানে কিছু পুঁতে রেখে গেছে কিনা........

- তাই নাকি ! বেশ, তবে আর তোর জেনে কাজ নেই, এখনই তুলসী মঞ্চ ভেঙে ঘড়া তুলে নিয়ে চলে যাবো, তাহলেই সব জানতে পারবি।

ইন্দিরা মুড়ির বাটিটা ঠক করে দাওয়ায় নামিয়ে রেখে মনোহরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। 

চোখে চোখ রেখে বললেন, 'সেইটে হচ্ছে না বাপু, ওই তুলসী গাছ আমি নিজের হাতে পুঁতেছি এককালে, ও গাছ আমি উপড়াতে দেব না'। 

মনোহর দাঁত কিড়মিড় করে বলে, 'বটে ! তা কে আটকাবে শুনি ? আপনি ?

বিশু বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসে সামনে, ইন্দিরাকে আড়াল করে গম্ভীর গলায় বলে, 'না.........আমি' ?

একথায় মনোহরের দলবল অট্টহাস্য করে ওঠে। 

মনোহর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 'তাহলে বুড়িকে মেরে পুরোটাই একা হাপিস করবি ভাবচিস, তাই তো' ?

বিশু আচমকা কোথা থেকে যেন জোর পায়, হুঙ্কার দিয়ে বলে, 'উনি আমার মায়ের মতো, ওনার গায়ে হাত লাগাতে দেব না আমি, এই কথাটা ভালো করে বুঝে নাও মনোহর দাদা। উনি যখন বলচেন এখানে ঘড়া নেই, তাহলে সত্যিই নেই। মানে মানে তফাৎ হয়ে যাও, নাহলে ভালো হবে না কিন্তু........'। 

মনোহর আর সামলাতে পারেনা নিজেকে, হাতের লাঠিটা দিয়ে সজোরে চালিয়ে দেয় বিশুর মাথা লক্ষ্য করে। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় মাথা সরিয়ে সে লাঠির ধাক্কা এড়ায় বিশু,পরক্ষনেই বেড়ার ধার থেকে একটা মাঝারি মাপের মোটা বাঁশ নিয়ে চড়াও হয়ে যায় মনোহরের ওপর। 

দলের বাকিরা বিশুকে ঘিরে ধরে। ইন্দিরা ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বিশুর নিপুণ লাঠি চালনায় দুজন ঘায়েল হয়ে পড়ে খুব শীঘ্রই। বাকি দুজনের সাথে চরম লড়াই হতে থাকে। 

হঠাৎই তীব্র বেগে মনোহরের লাঠি বিশুর পাঁজরে আছড়ে পড়ে। বিশু যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে, টলমল করতে করতে জমির ওপর বসে পড়ে পাঁজরে হাত দিয়ে। কালক্ষেপ না করে মনোহর লাঠি ঘুরিয়ে বিশুর মাথায় মোক্ষম আঘাত করতে যায়। ইন্দিরা চিৎকার করে ছুটে এসে জাপ্টে ধরেন বিশুকে। 

মনোহরের লাঠি অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ইন্দিরার কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। মাথায় হাত দিয়ে উঠোনের ওপর লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা। বিশু আর্তনাদ করে ওঠে। হাতের বাঁশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে এসে ধরে ফেলে ইন্দিরাকে। 

ইন্দিরার কপাল বেয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকে। বিশু কোনোরকমে ধরাধরি করে দাওয়ার ওপর ইন্দিরাকে উঠিয়ে বসায়। 

মনোহর বজ্রকঠিন স্বরে বলে, 'লাঠিতে হাত পাকিয়েছিস বলে ভাবিস না মনোহরকে মাত দিবি। ওখানেই চুপ করে বোস, এর যদি অন্যথা হয়েছে তবে আর লাঠি নয়, এই ভোজালি দিয়ে তোর গলার নলিটা কেটে দিয়ে যাব'। 

বিশু বশ্যতা স্বীকার করে, দ্বিতীয়বার আর কোনো কথা বলে না। 

কাঁপা কাঁপা হাতে ইন্দিরার শুশ্রষা করতে থাকে। মনোহর চোখের ইশারায় তার সাগরেদদের তুলসী মঞ্চের দিকে দেখায়। বিনা বাক্যব্যয়ে বাকি তিনজন চটপট খুঁড়তে শুরু করে। 

বেশ খানিক্ষন খোঁড়ার পর হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ হয়। সবাই লুব্ধ দৃষ্টিতে যে যার মুখের দিকে তাকায়। বিশুও উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকে সেদিকে। মনোহরের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। 

নিজেই এগিয়ে এসে একজনের হাত থেকে কোদাল কেড়ে নিয়ে দ্বিগুন বেগে খুঁড়তে শুরু করে। কিছুটা খোঁড়ার পরই এক ভয়ার্ত শব্দ করে হাতের কোদাল ফেলে ছিটকে দুকদম পিছিয়ে আসে সে। 

পলকে বাকিদের মুখও ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে যায়। বিশু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, তুলসী মঞ্চের নিচের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। মাটির ভেতর থেকে উঁকি মারছে ফ্যাকাশে বিবর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া একটা আস্ত নরখুলি। তমসাচ্ছন্ন, ভয়াল তার চাহনি ! কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে অতীতের জমাট নিকষ কালো অন্ধকার যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চাইছে স্তব্ধ দর্শকের চোখ। 

মনোহর ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বার হয় না। 

ইন্দিরার দু গাল বেয়ে সরু জলের রেখা নেমে আসে। 

বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, 'কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত ছিল...........আমি রান্নাঘরে হাঁড়ি চাপিয়েছিলুম। এমন সময়ে উঠোনের কাছে ধড়াম করে একটা শব্দ হয়। আমি নিচে নেমে এসে দেখি হারু চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওই গোয়ালঘরের দিকটায়। ওকে দেখে আমি ছুটে যাই। পুলিশের গুলি লেগেছিলো বুকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল মাটি। বাঁচার আশা ছিল না। 

বদ্যি ডাকবো বলে চিৎকার করে উঠতেই হারু শক্ত করে আমার হাতদুটো ধরে মুখ ফুটে বলেছিলো, 'পুলিশের হাতে যেতে চাই নে রে ইন্দি.......... চিরকাল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েচি। মরার পর তারা আমার লাশ নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে, গর্ব করে বলবে হারু ডাকাতকে মেরেছে, তা যেন না হয়। তুই দেখিস। আর পারলে তোর এই উঠোনটায় আমার জন্য একটু জায়গা করে দিস, যেমন করে এতকাল.................বলেই শরীরটা একবার কেঁপে উঠেই নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিলো' ।

'আমি হারুর শেষ কথা রেখেছিলাম..........' , দুহাতে মুখ চেপে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন ইন্দিরা। অতীতের অব্যক্ত গ্লানি হু হু করে বেরিয়ে আসে তাঁর দুচোখ থেকে। 

সবাই নির্বাক শ্রোতার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নিমেষে থমথমে ভারি হয়ে যায় পরিবেশটা। মাথার ওপর দিয়ে করুণ রাতের কোনো পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়। ইন্দিরার অকপট বয়ানে মোহাচ্ছন্ন নিস্পন্দ বিশু অপলক চেয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে । 

বিহ্বলতার ঘোর কাটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখে ইন্দিরার, নরম স্বরে বলে, 'ঘরে চলুন মাঠাকরুন, অনেকটা কপাল কেটে গেছে আপনার........... রক্ত ঝরছে এখনো..............'    
 

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #saptahiki