Saturday, July 23, 2016

সাপ্তাহিকী ১৪ # জ্যোতিষী

দুপুরের গনগনে আঁচটা এমাসে আর তেমন নেই বললেই চলে। ঘড়ির কাঁটা চারটে দশ ছুঁই ছুঁই করছে। শ্রাবনের শেষের দিনগুলো ইদানিং একটু গুমোট বেঁধে আছে। অস্থির হয়ে উঠেছে রায়া। সিমেন্টের বেঞ্চিটাতে বসে ঘন ঘন হাতঘড়িটার দিকে তাকাতে থাকে। কিঞ্জল বড্ডো দেরি করছে যেন আজকে ! দক্ষিণ কলকাতার লেকের এই পূর্ব-দক্ষিণ দিকটা বরাবর তাদের ভীষণ প্রিয়। শান্ত, নিরিবিলি, ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটায় দুদণ্ড কথা বলা যায় মনের সুখে। সামান্য অযত্নের জঙ্গল আর এভিনিউ সম্মিলনী ক্লাবের পিছন দিক হওয়ার দরুন অনেকেই এদিকটা এড়িয়ে চলে। ফলে নিজেদের আলাপচারিতার টুকরো মুহূর্তগুলো অবলীলায় প্রজাপতির মতো বাধাহীন উড়ে বেড়ায় ইতিউতি।

অকস্মাৎ বাঁদিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে রায়ার। দুটো বিবর্ণ ঘোলাটে চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঝট করে চোখ সরিয়ে নেয় রায়া। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা অস্বস্তি শুরু হয় যেন। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। প্রবল আশঙ্কায় ধীরে ধীরে আবার বাঁ দিকে ঘুরে তাকায় সে। একজন রোগাটে, শীর্ণ বৃদ্ধ অপলক তাকিয়ে আছেন তার দিকে। বড় অদ্ভুত সে চাহনি। মাথা থেকে পা অবধি পড়ে ফেলার এক তীব্র প্রচেষ্টা যেন সে চোখ দুটোতে। প্রথম নজরে চমকে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কি করবে ভেবে পায়না রায়া। উঠে চলে যাবে নাকি অন্য কোনো দিকে ? গিয়ে বসবে অন্য কোনো বেঞ্চিতে ? কিঞ্জলটাই বা দেরি করছে কেন এতো ? শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হতে থাকে অজান্তেই।

- কিরে ? কতক্ষণ ?
চমকে ওঠে রায়া। কিঞ্জলকে সামনে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ঠোঁটের ওপর আলগা হাসি ঝুলিয়ে, হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে ঈষৎ হাঁপাচ্ছে কিঞ্জল।

- এতো দেরি করলি ? আমি তো সেই কখন থেকে ওয়েট করছি !!
- আর বলিস না, অফিস থেকে বেরোতে যাবো, অমনি বসের জরুরী তলব। তড়িঘড়ি একটা কাজ            মিটিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছি।
- হুমম, যত কাজ তোর, আর আমার সময়ের কোনো দাম নেই না ?
- বুঝিসই তো, প্রাইভেট কোম্পানি, হুট্ করে বেরোনোটা খুব চাপের হয়। নেহাত অফিসটা পাশেই, তাই   কিছুক্ষনের জন্য ম্যানেজ করতে পেরেছি।  যাইহোক...... বল, হঠাৎ ডেকে পাঠালি ?
- হ্যাঁ, কথা ছিল। বাবা ফোন করেছিলেন কাকুকে গত রাত্রে, জানিস নিশ্চই ?
- হ্যাঁ, জানি তো।
- বিয়ের ডেটটা খুব সম্ভব নভেম্বরেই ফিক্সড হচ্ছে।
- হ্যাঁ, সেটাও জানি........তো ?
- আঃ, তুই ব্যাপারটা বুঝছিস না ! আমার কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে ভেতর ভেতর।
- হ্যাঁ, এরকমটা হয় বটে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে....... তো ?
- ধ্যাৎ ! কি তো তো করছিস তখন থেকে ? এরকম একটা ইম্পরট্যান্ট ইস্যু, আগের থেকে একটু ভাবা     দরকার কিনা আমাদের ? তা নয়, শুধু ইয়ার্কি !
- হাহাহাহাহা, দ্যাখ রায়া, এতো টেনশন করছিস কেন ? আমাদের বাবা মায়েরা তো অনেকদিন আগে  থেকেই জানেন আমাদের সম্পর্কটা, তাঁরা তো কোনো আপত্তি করেননি কখনোই, তাই না ? আর  তাছাড়া আমরা ছোটবেলার বন্ধু। দুজনে দুজনের বাড়ির লোকদের খুব ভালো করে চিনি। ফলে  কোনো সমস্যা হবে না দেখিস। আমি বলছি তো, দ্যাখ সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, শুধুশুধু টেনশন করিস  না ওতো।
- তুই জানিস নারে কিনু, আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে জানিস আজ সকাল থেকে, একটা চাপা      অস্বস্তি............বুকের মধ্যে কেমন যেন....... মানে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না তোকে, কিন্তু কেন  যেন আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে......... ভয়ঙ্কর কিছু একটা !
- ধুর পাগল ! ওসব ভাবিস না তো। তারচেয়ে বরং চল, আমরা একটু শপিং করে নিই, হাতে আর মাত্র     কয়েকটা দিন......
- নাহ ! আমার এখন এসব কিচ্ছু ভালো লাগছে না, আমি কোত্থাও যাবো না........
- সে কিরেএএ !! তোর শপিং এ অনীহা ! আমি তো ভাবতেই পারছি না মাইরি !
- হ্যাঁ, আজ বাদ দে, অন্য কোনো একদিন যাবো, আজ মোটেই ইচ্ছে করছে না।

ভারী অবাক হয় কিঞ্জল। সচরাচর এমনটা দেখেনি সে, শপিং বলতেই যে এক পায়ে খাড়া হয়ে যেত সে আজ যেতেই চাইছে না কোথাও !

-দ্যাখ, তুই যদি না যাস তবে আমি চললুম অফিসে, খামোকা এখানে বসে থেকে থেকে আমার  কাজগুলো হ্যাম্পার হবে। এমনিতেই বিয়ের কাজে টুকটাক ছুটি নিতে হবে, তারওপর লম্বা ছুটি তো  আছেই পরে। তাই এখন কোনোরকম ফাঁকি মারাটা এফোর্ড করতে পারবো না, সিরিয়াসলি !
- ঠিক আছে, তুই যা অফিস। অন্য কোনো একদিন বেরোবো না হয়।
- বোঝো ঠ্যালা ! কি হলো বলতো তোর ? শরীর ঠিক আছে তো ?
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, আমি বরং একটু বসি এখানে, তারপর চলে যাবো।
- তুই সিওর ? যাবি না তো তাহলে ?
- হুমম।
- বেশ, আমি আসছি, সাবধানে বাড়ি যাস, দেখি সন্ধের দিকে যদি একবার তোর বাড়িতে ঢুঁ মারতে            পারি।
- আচ্ছা।

হাত নেড়ে কিঞ্জলকে টাটা করে দেয় রায়া। যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো, অফিসের তাড়ায় ঠিক তেমনই ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায় কিঞ্জল। গেট অবধি চোখ যায় রায়ার, কিঞ্জল চলে যেতেই মুখ ঘুরিয়ে লেকের জলের দিকে তাকায় সে। দমবন্ধ ভাবটা কাটছে না কিছুতেই। বাঁদিকে তাকাতেই আবার একপ্রস্থ চোখাচোখি হয় সেই বৃদ্ধের সাথে। ঘোলাটে চাউনির সাথে এবার যোগ হয়েছে কিঞ্চিৎ পরিহাস। কিছু বুঝে উঠতে পারে না রায়া। দোনোমোনো করে উঠে পরে বেঞ্চটা থেকে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বৃদ্ধের দিকে। ভালো করে জরিপ করে নেয় আপাদমস্তক। সত্তরের আসেপাশে বয়েস হবে। উস্কোখুস্কো সাদা চুল, কাঁচা পাকা দাড়ি, পুরোনো সুতির পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত বৃদ্ধের সারা শরীর জুড়ে অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতার ছাপ। মুখের বলিরেখায় দৃঢ়তার চিহ্ন স্পষ্ট। অনাবশ্যক কৌতূহল জাগে রায়ার।

- কি ব্যাপার বলুন তো ? আমি দেখছিলাম আপনি সমানে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আপনি কি       কিছু বলবেন ?

একটা শান্ত, স্মিত হাসি খেলে যায় বৃদ্ধের মুখজুড়ে, ধীরে ধীরে ঘোলাটে দৃষ্টিটা পরিষ্কার হয়। একটু কেশে, চোখ তুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করেন রায়াকে। তারপর পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলেন, 'বোসো'। কৌতূহলের বশে বৃদ্ধের পাশে বসে পরে রায়া, সামান্য দূরত্ব রেখে। ভাঙা গলায় খুব আস্তে আস্তে শুরু করেন তিনি।

- তোমায় দু একটা কথা বলার ছিল মা, অবশ্যি তোমার যদি সময় থাকে কিছুটা।
- কি ব্যাপারে ? মানে আমি তো ঠিক.......
- বলছি, বলছি, তার আগে তোমার নামটা বলো দেখি.......
- রায়া..........রায়া সেনগুপ্ত।
- হুমমমমম,........ (সামান্য দম নিয়ে) খুব মন দিয়ে শোনো মা। আমি যা বলছি সেটা বিশ্বাস করা একটু   কঠিন হবে, তবে একটুও মনগড়া কিছু বলছি না এটুকু জেনে রেখো।

রায়া এবার একটু নড়েচড়ে বসে বেঞ্চিটায়। বাঁ হাতটা চিবুকের তলায় রেখে একনিষ্ঠ শ্রোতার মতো বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিস্পলক। বৃদ্ধ কম্পিত স্বরে বলে চলেন........

- খুব টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ তুমি মা। তোমার গ্রহকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এর অবিশ্যি দু একটা কারণ আছে বটে, তবে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তোমার হবে না। তাই আমি পরামর্শ দেব, তুমি একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো রাস্তাঘাটে। গ্রহরাজের প্রকোপটা বড় বেশি পড়েছে এই সময়টাতে। তোমার নক্ষত্রেরা অন্য পথে ছুটতে শুরু করেছে,....... অর্থাৎ..... একটা ভীষণ রকমের গোলমাল হতে পারে যখন তখন। সুতরাং খুউউব সাবধাআন ! সামনে তোমার চরম বিপদ !! তুমি হয়তো জানো না, সে বিপদ ছায়ার মতো তোমার সাথেই ঘোরাফেরা করছে সর্বক্ষণ। একটু অন্যমনস্ক হয়েছ কি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। তখন কিন্তু আর রক্ষে থাকবে না। তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না, এই আমি বলে দিলুম হ্যাঁ।

চোখের পলক পড়ে না রায়ার। হ্রদের জলে বিকেল মিশে এসেছে অনেকটা। ঘরের ফেরার তাড়াহুড়োয় একঝাঁক পাখি কিচিরমিচির করতে করতে  উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ধীর লয়ে বহুদূর থেকে কোনো এক ঠান্ডা অথচ মৃদু হাওয়া বইতে থাকে। জলের ওপর ছোট ছোট তরঙ্গের রেখা আঁকা হয়ে যায় অচিরেই। হঠাৎই একটু শীত শীত করতে থাকে রায়ার। খানিক থমকে, সমস্ত জড়তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে গলা খাকারি দেয়। তারপর বলে,

- এসব কি আবোলতাবোল বকছেন বলুন তো ? আমার বিপদ ! হঠাৎ আমার বিপদ কেন হতে যাবে ?     আর আপনি কে, বলা নেই কওয়া নেই আমায় আজগুবি গল্প শোনাচ্ছেন।
- হাহাহাহা, আমি তো প্রথমটাতেই বলেছিলুম যে তোমার বিশ্বাস হবে না, অথচ তুমিই জানতে চাইছিলে আমার কিছু বলার আছে কিনা।

চোখের কোণে কৌতুক খেলে যায় বৃদ্ধের। কিন্তু পরমুহূর্তেই চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে, দু চোখের দৃষ্টি পাল্টে যায় এক লহমায়। ঘড়ঘড়ে গলায় বলে ওঠেন, "শোনো হে খুকি ! আমি হলুম জ্যোতিষ কালীপ্রসাদ মুখুজ্জে, শহরের নামি দামী জ্যোতিষীরা আমার নাম আউড়ে, মনে মনে পেন্নাম ঠুকে তবে গণনার আঁক কষতে বসে, আমার বিধান ইস্পাতের ফলার মতোই কঠিন এবং দৃঢ়। যা বলে এসেছি তার একচুলও নড়চড় হয়নি কোনোদিন, তার অন্যথা আজও হবে না জেনে রেখো। তোমায় সাবধান করা উচিত বলে মনে হলো, তাই বললুম, বিশ্বাস করা না করাটা তোমার ব্যাপার, বিপদে যখন পড়বে তখনই টনক নড়বে দেখছি"।

হাঁ হয়ে যায় রায়া, কোনো কথাই জোগায় না মুখে, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বৃদ্ধের মুখের দিকে। ওনার কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনি হতে থাকে কানের মধ্যে। কোনো মতে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা আমার যে বিপদ তা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন"?
এক চিলতে হাসি খেলে যায় কালীপ্রসাদের দাড়িগোঁফের ফাঁকে।
-আমি জানতুম, তুমি এই প্রশ্নই করবে। একটু পরীক্ষা করে নিতে চাইছ, তাই তো ? আচ্ছা বেশ, তোমার জন্ম তারিখটা বলো.....
- ১৯শে আগস্ট ১৯৮৯।
-  আর জন্ম সময়টা...... মনে আছে কি ?
- খুব সম্ভব..... সকাল আটটা পয়ঁত্রিশ।
- বেশ.....

দুপা জড়ো করে সটান বাবু হয়ে বসেন কালীপ্রসাদ, দুটো হাত রাখেন কোলের ওপর, তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেন। বিস্ময়ে হতবাক রায়া নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধের দিকে। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কাটে, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খোলেন উনি। রায়ার দিকে এক অদ্ভুত রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, "শিবরামপুরে তোমাদের একটা জমি আছে সেটা নিয়ে বিস্তর ঝামেলা হচ্ছে কমাস ধরে........... গত কয়েকদিন যাবৎ তোমার মা বেজায় কোমরের ব্যাথায় ভুগছেন...........গতকাল সন্ধে থেকে তোমার ভাইয়ের জ্বর হয়েছে...........আজ সকালে বাড়ির সদর দরজায় পিছলে পড়ে গেছিলে তুমি............দুপুরে খাওয়ার সময় তোমার বাবার গলায় ইলিশ মাছের কাঁটা ফুঁটে যায়............ তোমার সাধের মিনি বেড়ালটা আজ দুদিন হলো বেপাত্তা..........
কি ? আরও  বলব, নাকি এতেই যথেষ্ট মনে হচ্ছে" ?

বিস্ফারিত চোখে রায়া তাকিয়ে থাকে কালীপ্রসাদের দিকে। শব্দগুলো জিভের সাথে জড়িয়ে যায় মুখের ভিতর। চোখের সামনে লেকের চারপাশটা দুলে ওঠে কেমন যেন। কোনো মতে আমতা আমতা করে জড়ানো স্বরে বলে, "আপনি কি করে এসব.........!!! মানে আপনাকে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না, অথচ আপনি গড়গড় করে সমস্ত কিছু............ কিভাবে !!!  এ, এ  কেমন করে সম্ভব ??
- কালীপ্রসাদের কিছু দেখতে শুনতে লাগে না মা........ নিখুঁত,নির্ভুল গণনায় বরাবর আমি সিদ্ধহস্ত।

রায়ার ঘোর কাটে না কিছুতেই, কেমন নেশার মতো বুঁদ হয়ে কালীপ্রসাদের কথা শুনতে থাকে অবিচল। কালীপ্রসাদ বলেন, "সে যাইহোক, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যাটা হলো তোমার বিপদ, যে অজান্তেই তোমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, একটা ভুল পদক্ষেপ আর তুমিও তোমার বন্ধুর মতো......."
- আমি ঠিক বুঝলাম না.......আমার বন্ধু.... ? মানে ?
এদিক ওদিক সন্তর্পনে তাকিয়ে গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন কালীপ্রসাদ, "তোমায় ডাকছে রায়া, তোমার বন্ধু তোমায় ডাকছে......... তুমি সাড়া দিলেই বিপদ !!........"
- আপনি কি বলছেন......... আমি ঠিক.......
- কেন ? তোমার ছোটবেলার বন্ধু.........তোমার হবু স্বামী.......কিঞ্জল !!
- কিঞ্জল ?? কেন......কিঞ্জলের কি হবে !!
- কিঞ্জল যে তোমায় ডাকছে মা ! বহুদূর থেকে বারেবারে সে যে ডেকেই চলেছে তোমায়.......সে ডাক অগ্রাহ্য কোরো তুমি, নাহলে আর বাঁচবে না কিছুতেই......
- এ আপনি কি বলছেন ?? দুদিন পর যার সাথে আমার বিয়ে, তাকে অগ্রাহ্য করতে বলছেন ?? শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায় রায়ার।
"এ বিয়ে তো হওয়ার কথা নয় মা, অশরীরীর সাথে বিয়ে তো হয় না কোনো মানুষের..........." ঠান্ডা গলায় বলেন কালীপ্রসাদ। একটা পেঁচা ডানা ঝাপটিয়ে চলে যায় এগাছ  থেকে ওগাছে।

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পরে রায়া। রেগে যায় প্রচন্ড। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, "এবার কিন্তু আপনি বড্ডো বাড়াবাড়ি করছেন মশাই, অতীত, ভবিষ্যতের কথা জ্যোতিষীরা মিলিয়ে দেয় বটে, তবে এটা আপনি যা বললেন তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না"।
-আমি কোনো কথাই এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না............টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আজ দুপুরের পথ দুর্ঘটনায় তোমার কিঞ্জল.............

"না-না-নাআআআ", এক মরমী, গগনভেদী চিৎকার করে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে তোলে রায়া। "এই তো কিছুক্ষন আগেই আমার সাথে দেখা করে গেল........আর আপনি বলছেন........না না, এ হতে পারে না, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন, এ সমস্তটাই আপনার ভণ্ডামি, সস্তার ট্রিক্স দেখিয়ে টাকা কামানোর উপায় ফেঁদে বসা, আমি এসব বুঝি না ভেবেছেন ??
-ঠিকই বলেছো, কিছুক্ষন আগে যে তোমার সাথে দেখা করে গেল সে কিঞ্জলই বটে, তবে রক্তমাংসের নয় এটুকু হলপ করে বলতে পারি। আর সে তোমায় নিয়ে যেতে এসেছিলো তার সঙ্গে করে, তোমার ভিতরের চাপা অস্বস্তিটাই তার পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলে। তবে বিপদ দূর হয়নি এখনো। সে আবার আসবে.............
- কিঞ্জলের যদি কিছু হতো তাহলে আমার কাছে ফোন আসতো সবার আগে। কই তেমন তো কিছু আসেনি এখনো।
- তোমার ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই......... পরখ করে দেখতে পারো।

তাড়াহুড়ো করে কাঁধের ব্যাগের চেন খুলে ভিতর থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে রায়া, তড়িৎ গতিতে আঙ্গুল চালায় কিপ্যাডে, পরক্ষনেই বুকটা কেঁপে ওঠে ধড়াস করে...................
ফোনটা সুইচড অফ !!.............. এক অব্যক্ত আতঙ্ক নিয়ে তাকায় কালীপ্রসাদের দিকে। কালীপ্রসাদ মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, "কি......আমার কথা মিলল তো" ?

গলা শুকিয়ে আসে রায়ার, পেটের ভিতর থেকে কে যেন জিভটাকে ভিতর দিকে টেনে নামিয়ে আনতে চাইছে। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোয় গলা থেকে, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বলে, "কিন্তু....... ফোন সুইচড অফ হওয়াটা তো কাকতলীয়ও হতে পারে তাই না"?
-বেশ.......... এখনো যদি আমার কথা বিশ্বাস নাহয় তাহলে বরং ওই ডালমুটওলাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, সে তো এদিকটাতেই ঘুরছে অনেক্ষণ ধরে, জিজ্ঞেস করো সে তোমার কিঞ্জলকে দেখেছিলো কিনা।

হ্রদের ধার ঘেঁষে পড়িমরি করে দৌড়য় রায়া উল্টোদিকে। ডালমুটওলার সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "ভাই একটা কথা বলবে" ? ডালমুটওলা ভারী অবাক হয়ে চোখ কুঁচকে তাকায় রায়ার দিকে ।
- আমি যখন বিকেলের দিকে এই বেঞ্চিটায় বসে ছিলাম........এই যে এই বেঞ্চিটায়........ আমার পাশে       নীল রঙের চেকশার্ট পরা একটি ছেলেকে বসতে দেখেছিলে ?
- কিছু মনে করবেন না দিদি,..... মানে....... একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
- কি ?
- আপনার কি শরীরটা একটু খারাপ লাগছে ?
- আঃ...... যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তরটা দাও ভাই, আমার পাশে কি কোনো নীল রঙের শার্ট পরা ছেলেকে বসতে দেখেছো তুমি ?
রোগা ছিপছিপে ছেলেটি এক কথায় উত্তর দেয়.....  "না".........

মাথাটা ভীষণরকম টলে যায় রায়ার, চেঁচিয়ে বলে, "কি যাতা বলছো !!......... আমার পাশে কাউকে বসতে দেখোনি তুমি !!!
- না দিদি, শুধু এই বেঞ্চিটা কেন ? আপনি এই বেঞ্চিতে বসার কিছুক্ষন পরেই উঠে গিয়ে ওই দিকের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন, তারপর কি যেন সব বিড়বিড় করতে লাগলেন, কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে...........কি ব্যাপার বলুন তো দিদি !! আপনার কি শরীর খারাপ ??

এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে পিছনে দূরের বেঞ্চিটার দিকে দেখে রায়া। যেখানে কালীপ্রসাদ আর সে এতক্ষন বসে কথা বলছিলো........ আশ্চর্য !!! বেঞ্চিটা বেমালুম ফাঁকা !! হাড়হিম করা একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় রায়ার পিঠ বেয়ে। তবে কি ??........... তবে কি পুরোটাই ভুল দেখলো এতক্ষণ, মাথাটা কি তাহলে খারাপ হয়ে গেলো তার ? তবে এতটা সময় কালীপ্রসাদের সাথে এতগুলো কথা.........!!!
সবটাই কি মিথ্যে ?? একের পর এক প্রশ্ন ঝড়ের মতো তোলপাড় করতে থাকে রায়ার মনের মধ্যে। মিনমিন করে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি বলছো, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা কোনো বয়স্ক ভদ্রলোককে আমার সাথে দেখোনি ওই বেঞ্চিটায় ?
-  সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ? বয়স্ক ভদ্রলোক ? আচ্ছা কাঁচা পাকা দাড়ি আর উস্কো খুস্কো চুল ছিল কি ??
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছো একদম......তুমি চেনো তাকে ?
- আমি চিনিনা বটে, তবে এক বিখ্যাত জ্যোতিষী কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওখানে এসে বসতেন বরাবর, অনেক লোকজন আসতো, প্রচুর আড্ডা হতো। দারুন নামডাক ছিল ওনার, কিন্তু উনি তো বেশ কিছুদিন হলো মারা গেছেন শুনেছি, টিবি হয়েছিল খুব সম্ভব। কেন বলুন তো ?

মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে রায়ার। কোনো দিশা পায়না কোথাও, চোখের ওপর ঘন কুয়াশার মত অন্ধকার ঘনিয়ে আসে ধীরে ধীরে ...... এ কি করে সম্ভব !! এ কি করে.........!!!!
হঠাৎ মোবাইলটা  বেজে ওঠে এক তীব্র আওয়াজ করে........সুইচড অফ ফোন বাজছে কি করে ?
এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে খেতেই স্ক্রিনের ওপর চোখ চলে যায়..........স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠেছে...... "কিঞ্জল কলিং" !!
দড়াম করে মাথা ঘুরে পড়ে যায় রায়া মাটির ওপর। মোবাইলটা বেজেই চলে একনাগাড়ে...............          

ছবি: গুগল 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #thrill #murder #mystery #astrology #bengalighoststories
         

5 comments:

  1. Like any other good story, the last phone call delivered the final chill. I guess you don't know but you have an acumen for chilling stories. So Johny walker... keep walking!


    Priyam

    ReplyDelete
  2. একটি জনপ্রিয় ভুল হ্যালুসিনেসন কে ভুত দেখা বলা। এই ভাবে একটি ভুল জিনিস কে গল্পের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে লেখক নিজের বিবেক কে এক বার জিজ্ঞেস করে দেখুন । যে শরীর মৃত্যুর দ্বারা ধ্বংস হয়ে গেছে তা মাতৃ জঠরেই আবার বিকশিত হতে পারে । অশরীরী কে অনুভব করা যায় দেখা যায় না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রথমত বলি হ্যালুসিনেশন, ভূত দেখা বা অশরীরীর সাথে সংযোগ এসব নিয়ে প্রচুর বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ রয়েছে যার আলোচনা বা বিষয়বস্তু সুদূরপ্রসারী । একটা কমেন্টে বা দুচারটে লাইন লিখে এর সমস্তটা বোঝানো আমার পক্ষে দুঃসাধ্য । দ্বিতীয়ত "যে শরীর মৃত্যুর দ্বারা ধ্বংস হয়ে গেছে তা মাতৃ জঠরেই আবার বিকশিত হতে পারে । অশরীরী কে অনুভব করা যায় দেখা যায় না" - এ আশ্চর্য তথ্য আপনি কোথায় পেলেন? পেলেও আপনার এই উক্তির কোনো বিজ্ঞান সম্মত প্রমাণ যদি দেখাতে পারেন, যারপরনাই খুশি হব। সবশেষে বলি, এযাবৎ দিকপাল ও জনপ্রিয় লেখকেরা অত্যন্ত সফল ভাবে ভূতের গল্প লিখে গেছেন, তাঁরা নিশ্চই কোনো ভুল জিনিস গল্পের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেননি ! সর্বোপরি এগুলো নিছকই "ভূতের গল্প" বিজ্ঞানের ধারাপাত নয় । সুতরাং নিজের বিবেকের কাছে যে আমার কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে এ আমি বিস্তর ভেবেও খুঁজে পেলুম না। আমারই অপারগতা হয়ত....তবুও আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

      Delete
  3. বেশ ভালো লাগলো, অন্য ধারার ভূতের গল্প। তবে একটা প্রশ্ন কিঞ্জল কি বেঁচে আছে ??

    ReplyDelete