Showing posts with label রহস্য-রোমাঞ্চ. Show all posts
Showing posts with label রহস্য-রোমাঞ্চ. Show all posts

Monday, August 7, 2017

সাপ্তাহিকী ৩০ # প্রতিবিম্ব - অন্তিম পর্ব

এ কথায় মৈথিলী সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে যায়। আঙুলের নখ দিয়ে চেয়ারের কোন খুঁটতে থাকে। কিছুক্ষন বাদে ডঃ সেন আবার কোমলস্বরে জিজ্ঞেস করেন, 'আমি জানি মৈথিলী, জীবনের কিছু কিছু প্রশ্ন বড্ড জটিল হয়, কিন্তু তার উত্তর না পেলে যে আমার চিকিৎসা পদ্ধতি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুতরাং, আপনার মনে এই সময় কি চলছে সেটা জানা ভীষণ জরুরী'।
কিছুক্ষন নীরব থেকে অস্ফুটে বলে ওঠে মৈথিলী, 'আমি সঠিক জানি না, তবে এই ক দিনে আমার কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে জানেন, প্রতিদিন দেখতে দেখতেই হয়তো........এক অদ্ভুত চাহিদা তৈরী হয়েছে, তবে সেটাকে ইমোশনাল এট্যাচমেন্ট বলে কিনা আমার জানা নেই ডক্টর'।   
- আচ্ছা, আপনি বলছিলেন আপনাকে কেউ ফলো করছে কয়েকদিন ধরে, তাকে দেখেছেন কখনো ?
- না, আসলে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের গলিটা বেশ অন্ধকার থাকে, তাই হয়তো তেমন ঠাহর করে উঠতে পারিনি। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে, হয়তো বা আমারই মনের ভুল। হয়তো তেমন কিছু নয়। সবটাই মিথ্যে।

ডঃ সেন ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা পঞ্চাশ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, 'বেশ, আজ বরং এই অবধিই থাক মৈথিলী। আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। পরপর কয়েকদিন নিয়ম করে খেয়ে যান। সপ্তাহখানেক বাদে আবার আসবেন। তখন নাহয় আমরা আরেকটা সেশন করব। কেমন' ?
মৈথিলী প্রেসক্রিপশন ভাঁজ করতে করতে বলে, 'আয়নায় অন্য মুখ দেখা একদমই স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তা আমি জানি ডক্টর। আর তাছাড়া আমি ভূত প্রেতে মোটেই বিশ্বাস করি না। করলে একা ফ্ল্যাটে কিছুতেই থাকতে পারতাম না। আমি জানি না কেন এমনটা হচ্ছে । আচ্ছা ডক্টর,....আমার ঠিক কি হয়েছে সেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন ?

- কিছুটা........যদিও আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হবে আপনি হ্যালুসিনেট করছেন।
- হ্যালুসিনেশন !! কিন্তু কেন ?
- সেই প্রশ্নের উত্তরটাই তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে মৈথিলী। আমার বিশ্বাস সে প্রশ্নের উত্তর আগামী সেশনেই পাব। আপাততঃ আপনি ওষুধগুলো খেয়ে যান। চিন্তার কিছু নেই। বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট কার্ল জাং কি বলেছেন জানেন ?

মৈথিলী দুদিকে ঘাড় নাড়ে।
- বলেছেন, 'who looks outside.......dreams ; who looks inside......awakes'। সুতরাং, মনের ভেতরের মানুষটাকে জানা খুব প্রয়োজন, ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট সেটা.........আমাদের আবার দেখা হবে মৈথিলী।

ডঃ সেন দুহাত জড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন। মৈথিলী প্রতিনমস্কার করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডঃ সেন চিন্তাক্লিষ্ট মুখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে, মনে মনে সম্ভাব্য ঝড়ের আভাস টের পেলেন বোধহয়।

সপ্তাহখানেক বাদে। ডঃ সেনের চেম্বারে মৈথিলীকে অনেকটা ক্লান্তিমুক্ত লাগে। মুখের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ ভাব লক্ষ্য করা যায়। 'কেমন আছেন মৈথিলী' ? মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করেন ডঃ সেন।
- আগের থেকে ভালো....
- ওষুধগুলো ঠিকঠাক চলছে তো ?
- হ্যাঁ, যেমনটা বলে দিয়েছেন..... ইদানীং রাত্রে ভালো ঘুম হচ্ছে।
- বেশ বেশ, এতো সুখবর......

একথায় আলগা হাসে মৈথিলী। ডঃ সেন দু চোখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'এর মধ্যে সেই মুখটা আর দেখতে পেলেন' ?
- রোজ দেখিনি, তবে এই কদিনে বার দুয়েক দেখেছি....
- কোথায় ? বাড়িতে না বাইরে ?
- বাড়িতেই.....
- চিনতে পারলেন ?
- নাহ, কিন্তু আগের বারের মতো এবারেও ভীষণ চেনা মনে হলো জানেন।
- হুমমম........... কোনোরকম কথার আদান প্রদান ?
- নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম.....
- কি বলল ?
- কিছু বলেনি, শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে.....
- কিন্তু তার নাম তো আপনার জানার কথা, তাই না মৈথিলী ?

'আমার জানার কথা' !! মৈথিলী বিস্মিত হয় খুব। 'এ আপনি কি বলছেন ডঃ সেন ? আমি জানলে কি আপনাকে বলতাম না.....'
ডঃ সেন বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুলে বললেন, 'এমনও তো হতে পারে আপনি বলতে চান না......'

- এ কেমন কথা ডক্টর ! নাম লুকিয়ে আমার কি লাভ ? আর খামোকা লুকোতেই বা যাব কেন ?
- বেশ........আমরা একটা কাজ করি বরং মৈথিলী, আজ আপনি আপনার অতীতের কথা বলুন আমাকে, যতটা পারবেন.....আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো সূত্র আমরা পাবই। কি, বলবেন তো ?
- বেশ, বলব.....

ডঃ সেন নিজের চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে এলেন সামনে, ঈষৎ ঝুঁকে বললেন, 'আপনি যাতে মুক্তমনে সবটা বলতে পারেন তার জন্য আমাকে সামান্য হিপটোনিজমের সাহায্য নিতে হবে। শুধু আপনি মনের দরজা জানলাগুলো সম্পূর্ণ খুলে রাখবেন, তাতে আপনার ভার লাঘব হবে শতগুন। আমি কথা দিচ্ছি, এতে কোনোরকম ঝুঁকি নেই'। মৈথিলী মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে । দুহাত কোলের ওপর জড়ো করে নিস্তব্ধ বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত। ডঃ সেন মৈথিলীর মনের ভাব আন্দাজ করতে পেরে বললেন, 'দেখুন, এই হিপ্নোটিজমটা সম্পূর্ণ আপনার সম্মতির ওপরেই নির্ভর করছে। আপনি রাজি না হলে আমি কখনোই জোর করব না'। মৈথিলী মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, 'আমি জানি ডক্টর, আমায় শুধু বলুন আপনি কি জানতে পারবেন ওই মুখটা কার' ?
- আমার বিশ্বাস আমি পারব, যদি আপনি কোয়াপরেট করেন তবেই......

মৈথিলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।

ডঃ সেন উঠে গিয়ে জানালার সবকটা পর্দা টেনে দিলেন। ঘরের আলো নিভিয়ে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে দিয়ে মৈথিলীর মুখোমুখি বসলেন। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র ধীরে ধীরে ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল যেন। আবছা আলোয় শুধুমাত্র দুজনের মুখ আলোকিত হয়ে রইল অজ্ঞাত কাহিনীর প্রত্যাশায়। পকেট থেকে একটা সরু ফাউন্টেন পেন বের করে আনলেন ডঃ সেন। অস্ফুটে বললেন, 'আপনি সমস্ত কিছু ভুলে যান মৈথিলী, শুধুমাত্র এই পেনের মুখের দিকে ফোকাস করুন, কোনোভাবেই এর থেকে চোখ সরাবেন না'। তারপর মৈথিলীর চোখের সামনে এক অদ্ভুত ঢিমে ছন্দে পেনটা দোলাতে লাগলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মৈথিলীর চোখ আঁটকে গেল পেনের মুখে। পেনের দুলুনির সাথে সাথে মৈথিলীর চোখও সরতে লাগলো সমানতালে। ডঃ সেন অত্যন্ত ধীরগম্ভীর গলায় বললেন, 'অতীতের কথা মনে করুন মৈথিলী, অতীতের কথা আমায় বলুন.......আপনি কি কিছু মনে করতে পারছেন..... দেখতে পাচ্ছেন কিছু' ? মায়াময় পরিবেশে মৈথিলীর চোখ বুজে এল আপনা আপনি। এক স্তিমিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল যেন বহুদূর থেকে, 'কলেজ..............ক্যান্টিন.............'

- আর কি দেখতে পাচ্ছেন ?
- আমি বসে আছি ............সামনে দুমড়ানো মুচড়ানো একটা কাগজ..........
- কিসের কাগজ ?
- চিঠি..............ইন্দ্রনীলকে লিখেছিলাম.........
- তারপর ?
-সে ফেরত দিয়ে গেছে.........বলেছে আমার গার্লফ্রেন্ড হবার যোগ্যতা নেই........আমি কাঁদছি.......একা.....
- আর কি দেখছেন মৈথিলী ?

কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা......... আবার মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এল.......

- আউট্রাম ঘাট................হাওড়া ব্রিজ.............চারিদিকে সন্ধ্যের আলো জ্বলছে........
- আপনি একা ?
- না...............পারিজাত আছে......
- পারিজাত ?
- পুরোনো অফিসের কলিগ.......
- কি বলছে পারিজাত ?
- বিয়ে করতে পারবে না...........
- কেন ?
- বাড়িতে...............সুন্দরী বৌ চায়...............আলো নিভে যাচ্ছে.........আমি কাঁদছি.............একা.......
- আর কিছু মনে পড়ছে মৈথিলী, আর কিছু ?

মৈথিলীর চোখের পাশ দিয়ে সরু জলের রেখা গড়িয়ে পড়তে থাকে। ডঃ সেন গলাটা আরও এক খাদ নিচে নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'বলুন মৈথিলী........আমায় বলতে থাকুন, থামবেন না.......'। মৈথিলী নিরুত্তর বসে থাকে......সামান্য ঠোঁট নড়ে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ পাওয়া যায় না, চোখের পাতা কাঁপতে থাকে তিরতির করে। এমন সময় হঠাৎ, ঘরের সমস্ত নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে এক চাপা অথচ কঠিন পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে ওঠে মৈথিলীর ভেতর থেকে।

"আপনি কেন মৈথিলীকে কষ্ট দিচ্ছেন ? কি চান আপনি"..........??

চমকে ওঠেন ডঃ সেন। দু হাতে চেয়ারের হাতলদুটো আঁকড়ে ধরেন উত্তেজনায়। বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে থাকেন মৈথিলীর দিকে। সন্দেহের তীর যে এতো অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যভেদ করবে বিশ্বাস করতে পারেন না। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, 'ক্কে, কে কথা বলল' ? কিছুক্ষনের শীতল নীরবতা বয়ে যায় সমস্ত ঘর জুড়ে । ডঃ সেন আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, 'বলুন, কথা বলুন, কে আপনি'। কোনো এক অতল গভীর থেকে সে পুরুষ কণ্ঠস্বর আবার কথা বলে ওঠে, 'আমি ময়ূখ..... ময়ূখ দাশগুপ্ত'।

- ময়ূখ !! কে ময়ূখ ?
- আমি মৈথিলীকে ভালোবাসি......

ডঃ সেন প্রায় হাঁ হয়ে গেলেন এই কথায়। কিছুক্ষনের জন্য মুখে কোনো কথা সরল না। পরক্ষণেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, 'আপনাদের পরিচয় হল কি করে' ?

- মৈথিলী আমাকে চিঠি লিখত।
- চিঠি লিখত !! আপনাকে ?
- হ্যাঁ........প্রতি রাত্রে নিয়ম করে...........ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয় ......আমরা ভালোবাসতে শুরু করি একে অপরকে।
- মৈথিলী আপনাকে ভালোবাসে ? আপনাকে বলেছে সে কথা ?
- হ্যাঁ বলেছে, চিঠির মধ্যে দিয়ে.......নিঃশব্দে জেনেছি আমরা একে অপরকে.............. প্রতিনিয়ত আয়নার মধ্যে দিয়ে খুঁজে নিয়েছি দুজনকে ..............মৈথিলী আমার প্রাণ...........মৈথিলী আমার প্রেম।
- কিন্তু......আপনি তো মৈথিলীরই অন্য স্বত্বা। নিজের সাথেই নিজের সম্পর্ক তৈরী হওয়া..... এ কি করে সম্ভব ? 
- নিজেকে ভালোবাসা অপরাধ নাকি ডাক্তার ? কে বলে ?
- কিন্তু আপনি মৈথিলীর দুর্বলতাকে আশ্রয় করে তার মনে বাসা বেঁধেছেন......একথা মৈথিলী জানলে সে কখনোই আপনাকে প্রশ্রয় দিত না।

'আপনি ভুল বলছেন ডঃ সেন', চিৎকার করে ওঠে পুরুষ কণ্ঠস্বর, 'আপনি ভুল..........আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক, বেঁচে থাকার প্রেরণা'।
- না আমি ভুল নই ময়ূখ, আমি একজন স্পেশালিস্ট ডাক্তার, সমস্তটা জেনেই আমি বলছি। পক্ষান্তরে আপনি মৈথিলীর চরম ক্ষতি করছেন।
- আমি ক্ষতি করছি মৈথিলীর ? আমি !!
- অবশ্যই করছেন, একটা অবাস্তব সম্পর্কের বন্ধনে মৈথিলীর মনস্তত্বে আপনি ধীরে ধীরে ক্ষত সৃষ্টি করছেন। সময়ের সাথে সাথে সে ক্ষতের আকার এমন বিপর্যয় ডেকে আনবে, তখন মৈথিলীকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
- না না, আমি মানি না, আপনার সমস্ত কথা মিথ্যে।
- আমার কথা বিশ্বাস করুন ময়ূখ, আপনি বরং মৈথিলীকে বোঝান, সে নিশ্চই বুঝবে আপনার কথা। সময় বিশেষে তার কষ্ট হবে একথা ঠিক, কিন্তু এই অলীক সম্পর্কের জেরে মৈথিলীকে আপনি অজান্তেই নিদারুন বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। আপনি কি চান না মৈথিলী সুস্থ হয়ে আর চার পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকুক ? ভালোবেসেছেন যখন, তখন ভালোবাসাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্য নয় কি ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আবার একা হয়ে পড়বে ? তখন ?
- উনি আজ একা আছেন, কাল নাও থাকতে পারেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকায় আপনি অন্তরায় হবেন কেন ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আমায় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে.......
- ঠিক, কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঘটনার অস্বাভাবিকতায় সে নিজেই একজন ডাক্তারের পরামর্শ চেয়েছে। সুতরাং আপনি যদি তার বাস্তব হতেন তাহলে সে কখনোই আমার কাছে আসতো না। তাই না ??.....বলুন ময়ূখ ? বলুন আমাকে......

বিপরীত চরিত্র নিরুত্তর থাকে । ডঃ সেন অধৈর্য হয়ে ওঠেন, বলেন, 'কথা বলুন ময়ূখ, কথা বলুন আমার সাথে'। কিন্তু ময়ূখের দিক থেকে আর কোনো রকম সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। বারকয়েকের চেষ্টাতেও যখন ময়ূখ নীরব থাকে তখন উপায়ন্তর না দেখে ডঃ সেন নিজস্ব পদ্ধতিতে মৈথিলীকে জাগিয়ে তোলেন ধীরে ধীরে। মৈথিলী কোনো এক গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে নির্বাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। ঘরের সমস্ত আলো জ্বালিয়ে দিয়ে ডঃ সেন নিজের চেয়ারে এসে বসেন। 'একটু জল', মিনমিন করে বলে মৈথিলী। মৈথিলীর সামনে একটা জলের গ্লাস রাখেন ডঃ সেন। ঢকঢক করে সমস্ত জলটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে মৈথিলী। চোখেমুখে অপার ক্লান্তি নিয়ে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসে চেয়ারে।

ডঃ সেন চশমা মুছতে মুছতে বলেন, 'মনস্তত্ব বড় জটিল জিনিস মৈথিলী। মানুষের মনের হদিস পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার, বিশেষ করে সে মন যদি রোগাক্রান্ত হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে মানুষের মন হচ্ছে কতকটা সমুদ্রের মতো। আমরা সাইকিয়াট্রিস্টরা সেই সমুদ্রের মাঝে ডুব দিয়ে কিছু কিছু স্পন্দন ছুঁয়ে আসতে পারি মাত্র। অধিকাংশটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আপনার ক্ষেত্রেও কতকটা তাই ঘটেছে। বেশ কিছুটা জানতে পেরেছি, বাকিটা সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পাবে আশা করি.....'। মৈথিলী অবাক হয়ে বলে, 'আপনি ঠিক কি বলছেন, আমি তো কিছুই............'।

'বলছি', স্মিত হাসেন ডঃ সেন, চশমাটা গলিয়ে নিয়ে বলেন, 'আপনার যে রোগটি হয়েছে সেটি সচরাচর দেখা যায় না। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার, সংক্ষেপে ডিআইডি। প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার। অর্থাৎ একই দেহের মধ্যে একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি। আমার অনুমান এই রোগ সম্বন্ধে আপনি শুনে থাকবেন আগে, কারণ এই বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্বে রিসার্চ চলছে এবং অগণিত বই ও সিনেমাও বেরিয়েছে। মৈথিলী একরাশ বিস্ময় মিশিয়ে বলে, 'আর.... আর সেই মুখটা, সেই মুখটার ব্যাপারে জানতে পারলেন কিছু' ?

-যে মুখ আপনি আয়নায় দেখেছেন সে আপনারই ছায়া মৈথিলী, আপনার অবিচ্ছেদ্য প্রতিবিম্ব.......

মৈথিলী বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, 'কেমন করে.......? উত্তরে ডঃ সেন বলেন, 'একাধিক প্রত্যাখ্যান ও বহুদিনের নিঃসঙ্গতার কারণে আপনি মনে মনে এমন এক পুরুষ চরিত্রের কল্পনা করেছেন যে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে কোনোরকম কারণ ছাড়াই। বিশেষত রূপের কারণে তো নয়ই। আমরা সাধারণ মানুষ সেটাই চেয়ে থাকি, কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার দরুণ আপনার ক্ষেত্রে সে ভালোবাসার আবির্ভাব ঘটেনি বলেই আপনি এক কাল্পনিক প্রেমিকের চিত্র এঁকেছেন মনে মনে। রাতের পর রাত প্রেমপত্র লিখেছেন কোনো এক অজ্ঞাত ভালোবাসার মানুষকে। এবং পরবর্তীকালে, অজান্তেই, 'ময়ূখ দাশগুপ্ত' নাম দিয়ে আপনি হাজির করেছেন সেই কল্পনার পুরুষকে। আপনার কল্পনার তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি তাকে বিভিন্ন জায়গায় হ্যালুসিনেট করতে শুরু করেন, কখনো বাড়িতে আবার কখনো বাইরে। কিন্তু আপনি আমাকে একটা ছোট্ট অথচ ভাইটাল ইনফরমেশন চেপে গেছেন। আমার বিশ্বাস আপনার এই চিঠি লেখালিখিটা আরও আগের থেকেই। কিন্তু পরে যখন আপনি চোখের সামনে একটা মুখ দেখতে পেলেন তখনই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। কারণ আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এইবার এই ঘটনাগুলো একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। তবে যেহেতু এটা আর্লি স্টেজ এবং আপনার মৈথিলী সত্ত্বার প্রভাব অনেকাংশেই বেশি তাই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কিছুটা এড়ানো গেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেতে সময় লাগবে এখনো।

মৈথিলী উদ্বিগ্ন মুখে বলে, 'তাহলে ডক্টর, এখন উপায়' ?

- একমাত্র উপায় হচ্ছে রেগুলার কাউন্সেলিং, নিয়মিত কিছু ওষুধ খাওয়া ও মানসিক জোর বাড়ানো।
- তাহলেই কি আমি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবো ?

- হাই চান্স, তবে অধিকাংশটাই আপনার ওপর ডিপেন্ড করছে। আপনি কি চাইছেন এবং মনকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন সেটাই মেজর ইস্যু। এখন থেকে আপনার প্রধান কাজ হবে ময়ূখের সত্বাকে কোনোরকম ভাবেই ইনফ্লুয়েন্স না করা এবং এই বিষয়ে কোনোভাবেই চিন্তা না করা। অবসর সময় ভালো বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, অথবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিন। মনকে শান্ত রাখা বড় কঠিন মৈথিলী, আমি জানি, কিন্তু এই কঠিন কাজটাই আপনাকে করে যেতে হবে। বাকিটা আমি চেষ্টা করব সাধ্যমতো। এই ওষুধ কটা লিখে দিলাম, এগুলো কোনোভাবেই বন্ধ করবেন না, তাহলে কিন্তু আবার এটাকটা হতে পারে। আমার বিশ্বাস আমরা যদি দুজনেই যথাযথ চেষ্টা করি, তাহলে এই রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। আপনি বরং সামনের সোমবারই চলে আসুন, সেদিন থেকেই আপনার থেরাপি শুরু হবে। কেমন ?

সমস্তটা শুনে মৈথিলী ধীরে ধীরে উঠে পড়ে সোফা থেকে। একবুক চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ। কোনো রকম শব্দ খরচ না করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মন্থর গতিতে ।

পরদিন সকালে নিয়মমতো এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে মৈথিলীর। পরদার ফাঁক দিয়ে মনখারাপের আলো ঢুকে পড়েছে যেন। কেমন যেন অন্য রকম একটা দিন আজ, মেঘলা, ছন্নছাড়া মতো । বিছানা ছেড়ে উঠে অলস পায়ে একটা ছোট দেরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রয়ারটা টানতেই ভেতর থেকে কিছু ওষুধের পাতা আর একগোছা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আসে। ডঃ সেনের কথা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ । ঘুম থেকে উঠেই ওষুধটা খাওয়ার কথা বলেছেন। ওষুধের পাতাটা হাতে নিয়ে কাগজের টুকরোগুলোয় চোখ বোলাতে থাকে মৈথিলী। ময়ূখকে লেখা সমস্ত চিঠি। ওষুধটা খাওয়া মানেই ময়ূখকে ভুলে যাওয়ার পথে এক কদম বাড়ানো। ময়ূখের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সূত্রপাত। গভীর চিন্তা করে মৈথিলী। নিজের সাথে কয়েক দিনের অন্তরঙ্গতায় তার সমস্ত দুর্বলতাকে ছাপিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বাদ পেয়েছে সে। অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে সে এতদিনে। নিজের বিপরীত স্বত্বার প্রতি অনুরাগ হলেও নিখাদ, নিষ্পাপ প্রেমই তো ! এটাই তো চেয়েছিল সে। ওষুধ খেলে সুস্থ হবে হয়তো, ভালো করে বাঁচতে পারবে কি ? বেঁচে থাকা কাকে বলে..... ? এক অদ্ভুত উভয়সংকটে পড়ে দিশাহীন খাঁচার পাখির মতো ছটফট করতে থাকে মৈথিলী। এমন সময় কোনো এক নিভৃত অতল থেকে এক পুরুষের মরমী কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, 'মৈথিলী.............মৈথিলী................'

মৈথিলী দ্রুত হাত চাপা দেয় কানে। কিন্তু সে অদম্য কণ্ঠস্বর সমস্ত প্রতিরোধ কাটিয়ে আবার ডেকে ওঠে, 'মৈথিলী...................'  ওষুধের পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মৈথিলী। সমস্ত পিছুটান, সংযম, মিথ্যে করে একছুটে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আয়নায় চোখ রেখে বলে ওঠে,...........
'ময়ূখ ? কেমন আছ ময়ূখ ? আজ দেরি করলে যে ..................' !!

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories #drama #thriller

Saturday, August 5, 2017

সাপ্তাহিকী ২৯ # প্রতিবিম্ব - প্রথম পর্ব

হাঁটতে হাঁটতে সমানে পিছনে তাকাতে থাকে মৈথিলী। বর্ষার রাস্তায় জুতোর ভারে মশমশ শব্দ হতে থাকে। সন্তর্পণে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সে চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। এক নিঃশব্দ আশঙ্কা যেন বেড়ালের মতো গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। কেউ পিছু নিয়েছে নাকি ? ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে একবার দেখে নেয়.... নাহ ! কেউ তো নেই। গলির শেষ প্রান্তে বড় রাস্তার আধা নীলচে আলো বৃত্তাকারে এলিয়ে পড়ে আছে। তাহলে কি মনের ভুল ?...... বুড়োশিবতলা থেকে কয়েক পা এগিয়ে বাঁ দিকের এই সরু গলিটা প্রায়শই অন্ধকার থাকে। ত্রিশ ফুট অন্তর পরপর তিনটে স্ট্রিট ল্যাম্প। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কখনো কখনো জ্বলে না কোনোটাই। বাকি এলাকার তুলনায় আপাত নির্জীব এই গলিটার প্রতি কেউই খুব একটা পাত্তা দেয় না। সুতরাং আলোর চেয়ে অন্ধকারেই ডুবে থাকে ফুট আটেকের চওড়া এই পথটা। তাতে অবশ্য মৈথিলীর খুব একটা সমস্যা হয় না, কিন্তু গত কয়েকদিনে এই পিছু নেওয়ার ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। বিশেষ করে রাত্রি সাড়ে আটটা নটার পর, অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই টের পাওয়া যাচ্ছে যেন। মৈথিলী ভেবে পায় না তার পিছু কেন কেউ নিতে যাবে।

মৈথিলীর পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস, অবিবাহিতা। সুন্দরী বা সুশ্রী কোনোটাই বলা চলে না তাকে। মুখে গোটাকয়েক বসন্তের দাগ, গায়ের রং গাঢ় শ্যামলা, শরীরের গড়ন স্থূল। সুতরাং এমন কুরূপা মাঝবয়েসী মহিলাকে ফলো করবে এমন আহাম্মক এই পাড়ায় কেন, আশেপাশের পাড়াতেও নেই বললেই চলে। অবশ্য হালফিলের কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনায় আট থেকে আশি যেখানে কেউই রেহাই পাচ্ছে না, সে তো নস্যি মাত্র। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গলিটা কোনোরকমে পার করে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে মৈথিলী। কোলাপ্সিবল গেটে তালা দিয়ে দু তিন বার চেক করে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালায়।

দু কামরার এই ফ্ল্যাটটায় একাই থাকে সে। সামনে একটা ছোট্ট ড্রইং রুম পেরিয়ে দুদিকে দুটো বেডরুম। বাঁ দিকে টয়লেট আর কিচেন। কাজের লোক বা রান্নার লোক রাখেনি মৈথিলী। একার সংসারে নিজেই হাত বাড়িয়ে সমস্তটা করে ফেলে। বরং বলা ভালো করতে পছন্দ করে। শাড়িটা চেঞ্জ করে এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে টিভির সুচটা অন করে। খাওয়া দাওয়ার পর এই সময়টা বেশির ভাগ টিভি দেখেই কাটিয়ে দেয় মৈথিলী। এই সময়টা তার ভারী পছন্দের ধারাবাহিক হয়...... 'সাজন'। একটি নামকরা হিন্দি চ্যানেলের মুখ্য অভিনেতাকে বেশ লাগে তার। ধপধপে ফর্সা গায়ের রং, দুর্দান্ত স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম ছেলেটির দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকাটা একরকম অভ্যেস হয়ে গেছে যেন। ফোনটাকেও সাইলেন্ট করে রাখে এই সময়। মনে মনে ছেলেটিকে কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে মৈথিলী।

পরদিন সকালে এলার্মের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তার। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর ছোট ঘড়িটাকে শান্ত করে। অভ্যাসমত স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে অর্ধমুদ্রিত চোখে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়ায় মৈথিলী। সামনের পুরোনো, মলিন আয়নায় নিজের মুখটাকে দেখে বারকতক। মনে মনে ভাবে আবার একটা দিন, আরও একবার একঘেঁয়ে একাতিত্বের সময় নিয়ে নিষ্ফল বেঁচে থাকা। নিমেষে তেতো হয়ে যায় মনটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করতে থাকে মন্থর গতিতে। মুখ ধুয়ে, মাথা তুলে আরেকবার আয়নার দিকে তাকাতেই তীক্ষ্ন আর্তনাদ করে ভয়ে ছিটকে সরে আসে মৈথিলী। আতঙ্কে মুখ সাদা হয়ে যায় তার। হাত থেকে টুথব্রাশটা ঠক করে মেঝেতে পড়ে যায়। চরম বিস্ময়ে চেয়ে দেখে আয়নায় কার যেন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। একটা পুরুষের মুখাবয়ব। অমায়িক ভঙ্গিতে নিস্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক ঝটকায় পিছন ফিরে তাকায় মৈথিলী। কি আশ্চর্য ! পিছনে তো কেউ নেই ! তাহলে কি ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকল ? কোনো চোর টোর, নাকি অন্য কেউ ? তাড়াতাড়ি ড্রয়িং রুমের চারপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে মৈথিলী।

সামনের দিকে দুটো বেতের চেয়ার, একটা কাঁচের টেবিল, ডানদিকের ঘরের কোনায় একটা ছোট বসার টুল। একপাশে একটা মাঝারি সাইজের কাঠের আলমারি। কই কেউ তো কোথাও নেই ! তাহলে কি পাশের ঘরে ঢুকল ? একছুটে লাগোয়া ঘরটায় গিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজে মৈথিলী। বাঁদিকে ঠাকুরের কিছু ফটো আর একটা লোহার ফোল্ডিং খাট ভাঁজ করে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা আছে। যেখানে যা ছিল তার থেকে একচুলও এদিক ওদিক হয়নি কিছু। বারান্দা থেকেও একবার ঘুরে এল সে। কি আশ্চর্য, লোকটা উবে গেল নাকি ? কোলাপ্সিবল গেটে তালা ঝুলছে, বারান্দাটাও গ্রিলে ঘেরা, সুতরাং বাইরে থেকে আসা বা বেরোনোর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাহলে গেল কোথায় ? নাকি ভুল দেখল সে ? পায়ে পায়ে আরেকবার বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মৈথিলী। বুকের মধ্যে তীব্র ধুকপুকানি নিয়ে উঁকি দিল আয়নায়। ডিম্বাকৃতি আয়নার ওপর নিজের মুখ ছাড়া আর কোনো কিছুর চিহ্ন নেই সেখানে। একটা হিমেল স্রোত বয়ে যায় সারা শরীর জুড়ে। দু চারবার ঢোঁক গিলে নিজের বেডরুমে গিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। একি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল ? পাগল পাগল লাগতে থাকে তার। একলা থাকার নরক যন্ত্রনা কি তাকে পেয়ে বসল শেষে ? না না এ মনের ভুল হবে নিশ্চই। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিতে থাকে মৈথিলী।

ধীরে সুস্থে কোনোরকমে নিজেকে স্থির করে রেডি হয়ে নিয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে আরও একপ্রস্থ দরজা, কোলাপ্সিবল গেট ভালো করে পরীক্ষা করে নিয়ে বেরোয়। নিত্য নৈমিত্তিক কিছু কাজ আর কাজের ফাঁকে দু একজন কলিগের সাথে সামান্য আলাপচারিতা, এছাড়া তার একপেশে জীবনে তেমন কোনো হিল্লোল ওঠে না। বন্ধুবান্ধব প্রায় নেই বললেই চলে। রূপের কারণে পুরুষ বন্ধু তো একেবারেই নেই। ঈশ্বর কেন যে তার এই দিকটায় কার্পণ্য করলেন কে জানে। বিধাতার কাছে এই নিয়ে তার অনুযোগ বিস্তর, কিন্তু হায়, সে অনুযোগ বোধহয় লক্ষকোটি প্রার্থনার ভিড়ে তাঁর দরবার অবধি গিয়ে পৌঁছয় না।

সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে নিয়মিত কাজ সেরে মৈথিলী ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখের বসন্তের দাগের ওপর আঙ্গুল বোলাতে থাকে অন্যমনস্ক হয়ে। অজান্তেই ভিজে ওঠে চোখের কোণ। নিজের অদৃষ্টকে অভিশাপ দিতে থাকে মনে মনে।
অকস্মাৎ, আয়নার দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে ! এ কি ! এ কি দেখছে সে আবার চোখের সামনে ? তার মুখের গড়নটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে আয়নায়। এক লহমার জন্য হৃদকম্পন স্তব্ধ হয়ে যায় যেন। ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে মৈথিলী তাকিয়ে থাকে একঠায়। সকালের সেই পুরুষ মুখের পুনরাগমন ঘটে কাঁচের ওপর অবিকল এক জায়গায়। এক মর্মভেদী চিৎকার করে ওঠে মৈথিলী। মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে..........

- এরকমটা কি আগেও হয়েছে ?
- কক্ষনো না....
- কতদিন থেকে হচ্ছে এমনটা ?
- তা প্রায় সপ্তাহ তিনেক হল। প্রথম দুবার বাড়িতেই হয়েছিল। ইদানিং বাইরেও হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট যেখানেই আয়না দেখছি সেখানেই......
- আপনি কি ড্রাগ বা অন্য কোনোরকম কিছু...... ?
- না না, আমার কোনোরকম নেশা নেই।

ষাটোর্দ্ধ ডঃ অবিনাশ সেন গম্ভীর হয়ে গেলেন একথা শুনে। দু হাতের আঙুলের ওপর থুতনি রেখে চেয়ে রইলেন মাটির দিকে। মৈথিলীর চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। পরপর কয়েক সপ্তাহের দুরন্ত ঝঞ্ঝা প্রায় ন্যুব্জ করে দিয়েছে তাকে। কলকাতার এই অন্যতম নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টের নাম জানতে পারে অফিসেরই এক কলিগের থেকে। প্রথম প্রথম মন সায় দেয়নি। কিন্তু পরের দিকে ঘটনাগুলোর তাৎপর্য বুঝে আর উপেক্ষা করেনি সে। ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তড়িঘড়ি দেখা করতে এসেছে তাঁর দেশপ্রিয় পার্কের চেম্বারে। চেম্বারটা অবশ্য ওনার বাড়িতেই। ক্ষনিকের বিরতিতে চারপাশটা নজর বোলায় মৈথিলী। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা বড় সুদৃশ্য হলঘরে মুখোমুখি দুটো গদিওয়ালা চেয়ার। একপাশে একটা কারুকাজ করা টিপয়, তার ওপর বাহারি ফুলদানি বসানো। মখমলি কার্পেটের ওপর পা রাখলেই চোখ বুজে আসে আপনি। একটা শান্ত ধীর স্থির ভাব রয়েছে গোটা ঘর জুড়ে। দুদিকের দেওয়াল জুড়ে নয়নাভিরাম অয়েল পেন্টিং। একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। পশ্চিমের জানলা দিয়ে বিকেলের নরম আলো ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরটায় বেশ মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বোধহয় পেশেন্টদের জন্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে এমনটা বানানো। ডঃ সেন মুখ তুলে তাকালেন আবার।

- আপনি কি একাই থাকেন ফ্ল্যাটে ?
- হ্যাঁ...
- বরাবর ?
- আসলে আমি জ্যাঠার কাছে মানুষ। এটা ওনারই ফ্ল্যাট। অনেক ছোটবেলায় আমার বাবা মা মারা যান। তারপর জ্যাঠাই নিজের কাছে নিয়ে আসেন আমাকে। পড়াশুনার সমস্ত দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। নিজের মেয়ের মতো বড় করেছেন আমাকে। বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান ছিলেন। তাই অপত্য স্নেহের ছায়ায় কখনো বাবা মার অভাব বুঝতে দেন নি। মৃত্যুর আগে আমায় ফ্ল্যাটটা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন।
- বেশ........আপনি বিবাহিতা ?
- নাহ, আগেও ছিলাম না, এখনো নই......
- কোনো বিশেষ কারণ ?
- (সামান্য হাসি) সেটা আমাকে দেখেও বুঝতে পারছেন না ডঃ সেন ?
- কিরকম ?
- রূপ বড় বিষম বস্তু ডক্টর। এর ক্ষমতা গগনস্পর্শী। অথচ কি অদ্ভুত দেখুন, এর স্থায়িত্ব কিন্তু ক্ষণকালের। আমরা সাধারণ মানুষ রূপের মোহতেই ভুলি, রূপের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা হৃদয়ের খোঁজ করতে যাইনা সচরাচর। কথাতেও আছে না, 'পেহলে দর্শনধারী ফির গুণবিচারী' । আমার ক্ষেত্রে কথাটা একেবারে একশো শতাংশ খাঁটি।

- কিন্তু কখনোই কি আপনার জীবনে.......মানে আমি বলতে চাইছি আজকের দিনে রূপের কারণে বিয়ে না হওয়াটা........
- হ্যাঁ, অত্যন্ত আশ্চর্যের বটে। কিন্তু আমার জীবনে ঠিক তাই ঘটেছে। আমি যে বিয়ে করতে চাইনি তা নয়। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন বাঁকে যে সমস্ত পুরুষের সংস্পর্শে এসেছি তারা কখনোই প্রেম নিবেদন করেনি আমায়, উল্টে আমার দিক থেকে অনুরাগের লেশমাত্র অনুমান করতে পারলেই তারা যেন নিজেরাই সরে যেত মানে মানে। তাই আর...........
- বেশ, আমায় একটা কথা বলুন দেখি এবার ?

দু চোখে একরাশ বিষাদ নিয়ে তাকায় মৈথিলী। ডঃ সেন প্রশ্ন করেন, 'আচ্ছা, আয়নায় যে মুখ আপনি দেখছেন, সে কি প্রত্যেকবার একই মানুষ, নাকি সময়বিশেষে পাল্টে যাচ্ছে' ?
- না না, প্রত্যেকবার একই মুখ, একই গড়ন, একই চোখ, নাক, কান.......কিচ্ছু পাল্টাচ্ছে না.....
- এরকম দেখতে কারোর কথা মনে পড়ে আপনার ?

ব্যস্ত হয়ে ওঠে মৈথিলী, বলে, 'আমি জানিনা, আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু, বহু অতীতের ঘটনা আবার নতুন করে মনে করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিচ্ছু মনে পড়েনি। অথচ যখনই আমি আয়নায় ওই মুখটা দেখি আমার ভারী চেনা মনে হয় জানেন। মনে হয়, কোথায় যেন দেখেছি একে, কোথায় যেন......... কিন্তু কিছুতেই......... ওহ, আমি পাগল হয়ে যাব ডঃ সেন, আমি পাগল হয়ে যাব......'

দুহাতে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মৈথিলী। অব্যক্ত যন্ত্রণার মেঘ ছড়িয়ে পড়ে ঘরের চারপাশে। ডঃ সেন এগিয়ে এসে মৈথিলীর দুটো হাত ধরেন। বলেন, 'আপনি ধৈর্য ধরুন। এতো সহজে ভেঙে পড়বেন না। আপনি যাকে দেখছেন তাকে আমরা ঠিক খুঁজে বার করবই। নিন একটু জল খান'। একটা জগ থেকে খানিকটা জল গ্লাসে ঢেলে এনে মুখের সামনে ধরলেন ডঃ সেন। মৈথিলী সবটুকু শেষ করে রুমাল বার করে চোখ মুখ মুছে নিজেকে গুছিয়ে নেয় আবার। ডঃ সেন পরের প্রশ্ন করেন।

- আপনি কি সেই মুখের একটা বয়স আন্দাজ করতে পারেন ?
- হ্যাঁ পারি....... মাঝবয়েসী, এই পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে........
- কেমন দেখতে ?
- মন্দ না, গায়ের রং ময়লার দিকেই, ব্যাকব্রাশ করা চুল, গোলগাল মুখ, হালকা দাড়ি আছে, চোখের চাউনি বেশ মায়াময়.....
- আপনি কি কমিউনিকেট করতে পারছেন তার সঙ্গে, মানে এই কয়েক সপ্তাহে আপনি তো প্রায় অনেক বার দেখেছেন......
- কমিউনিকেট ? না, তা পারিনি, কিন্তু প্রতিবার মনে হয়েছে সে যেন কিছু বলতে চাইছে আমায়...... আমি তার চোখ দেখেছি জানেন ডক্টর, সে চোখে অনেক আবদার, অনেক কথা লুকিয়ে আছে, কি অদ্ভুত প্রাণের আকুতি সে চোখে, কি করুণ মায়াভরা দৃষ্টি......আ আমি প্রত্যেকবার তাকে ছুঁয়ে দেখতে গেছি, কিন্তু তারপরই হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, নয়তো সে মিলিয়ে যায়।

- তার মানে এখনো পর্যন্ত সে কোনোরকম এগ্রেসিভ আচরণ করেনি, তাই তো ?
- না না, একেবারেই নয়, বরং সে শুধুই তাকিয়ে থেকেছে, কখনো এমনি, কখনো বা সরল দৃষ্টিতে, আবার কখনো......
- আবার কখনো ?
- কখনো আবার স্মিত হেসেছে.......
- হেসেছে ?........ স্ট্রেঞ্জ !
- হ্যাঁ, মানে, কেন যে করছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি.....

মৈথিলীর সলাজ কণ্ঠস্বরের আবেগ ডঃ সেনের চোখ এড়াতে পারে না। সে দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করেন তিনি, 'আমায় একটা সত্যি কথা বলবেন ? মানে, আপনি কি কোনোভাবে..........সেই মুখের সাথে ইমোশনালি এট্যাচড হচ্ছেন' ?

(ক্রমশ)

চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories #drama #thriller

Thursday, December 22, 2016

সাপ্তাহিকী ২২ # শখের জিনিস - অন্তিম পর্ব

চৈতালীর তির্যক মন্তব্যের উত্তর না দিয়ে দেবাঞ্জন চলে যান শোবার ঘরে। মনের মধ্যে একরাশ দ্বন্দ্ব সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করতে থাকে। 'ভবিষ্যৎ' কথাটা কাঁটার মতো বিঁধে থাকে কোনো এক গহীন স্থানে ।

পরদিন সকালে অভ্যাসমতো অফিস বেরোলেন দেবাঞ্জন। চোখে সানগ্লাস। নতুন চশমাটা ব্যাগে নিয়ে নিয়েছেন। নানারকম চিন্তায় অন্যমনস্ক ভাবে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যান। পথচলতি দু চারজন চেনা মানুষের 'কেমন আছেন' , 'গুড মর্নিং' , ইত্যাদি কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করেন না। অফিসে পৌঁছে নিজের কিউবিক্যলে গুছিয়ে বসেন। সামান্য ইতস্তত করে নতুন চশমাটা বাক্স থেকে বের করে পড়ে নেন। বাকি কলিগদের নজর এড়ায় না সেটা। দেবাঞ্জনের নতুন অবয়বে হৈ  হৈ করে ওঠে গোটা অফিস। সবাই মিলে ঘিরে ধরে তাঁকে। 'দারুন লাগছে', 'চোখ আছে বটে' , 'কোথা থেকে কিনলে', 'কত দাম নিল',  ইত্যাদি সমস্ত কথাবার্তায় দেবাঞ্জনের মনের গুরুভার লাঘব হয় কিছুটা। দেবাঞ্জনও যতটা সম্ভব ছোট করে বর্ণনা করেন কেমন করে এই বিরল জিনিসটি তাঁর হাতে এসে পড়লো। স্বাভাবিকভাবেই গতরাতের ঘটনাও কিছুটা ফিকে হয়ে আসে আপনিই । অসোয়াস্তির কালো মেঘ কেটে যেতে থাকে একটু একটু করে। দেবাঞ্জন মনে মনে মেনে নেন ওটা হয়তো দেখারই ভুল ছিল। সমস্ত কিছুই নিজস্ব নিয়মে ফিরে আসছিলো একটু একটু করে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় দেবাঞ্জনকে নিয়ে অন্য কোনো পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলে তাঁর স্বস্তির কাল খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সারাদিনের রুটিনমাফিক সমস্ত কাজই করলেন দেবাঞ্জন। সামনে জেনারেল মিটিং আসছে, মার্কেটিংয়ের প্রেজেন্টেশন তৈরির কাজটা প্রায় হয়ে এসেছে। আর দু একটা ডেটাশিট পেয়ে গেলেই শেষ করে ফেলবেন। সেটা নাহয় কালই দেখা যাবে এই ভেবে ডেস্কটপের শাট ডাউন বাটন টা ক্লিক করলেন। স্ক্রিনের আলো ক্রমশ আবছা হতে হতে মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো।

অকস্মাৎ, এক মায়াবী আলোর ঝলকানিতে সামনের স্ক্রিনটা ফের সচল হয়ে উঠলো। দেবাঞ্জন আঁতকে উঠলেন। ভালো করে দেখতে লাগলেন স্ক্রীনটাকে। স্ক্রিনের ওপর ফুটে উঠেছে আগুনের লেলিহান শিখা। সে শিখার সর্বগ্রাসী জিহ্বা স্ক্রিনের চারিদিকে এঁকে বেঁকে ঘুরতে লাগলো ভয়ঙ্কর লালসায়। ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন দেবাঞ্জন। স্পষ্ট দেখতে পেলেন একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে আগুন জ্বলছে। ভারী চেনা লাগলো বিল্ডিংটাকে, কিন্তু মনে করতে পারলেন না কোথায় দেখেছেন। এ দিক ওদিক তাকিয়ে বাকি কলিগদের লক্ষ্য করলেন দেবাঞ্জন। বুঝতে পারলেন ওর স্ক্রিনের দিকে কেউই নজর করছে না তেমন। অজান্তেই গলা শুকিয়ে এলো। চশমাটা সামান্য নাকের নিচে নামিয়ে খালি চোখে দেখার চেষ্টা করলেন স্ক্রিনটা। অবিশ্বাস্য ! স্ক্রিনটা ঘন কালো, নিরীহ বোকা বাক্সের মতো তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, আগুনের ছিঁটেফোঁটা নেই কোনো জায়গাতে। চশমাটা উঠিয়ে নিতেই আবার আগুনের তুর্কি নাচন প্রত্যক্ষ করলেন। তাড়াতাড়ি করে ডেস্কের ওপর থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই ছুটে চলে গেলেন লিফটের দিকে। অফিস থেকে বেরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়লেন মেট্রো স্টেশনের দিকে। মেট্রোতে উঠে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন সমানে। ডিসেম্বরের হিমেল সন্ধ্যাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখাচিত্র ফুটে উঠলো।

বাড়ি ফিরে চৈতালীর সাথে বেশি কথা বললেন না।  চৈতালী ভারী অবাক হলেন। সচরাচর এমনটা হয় না, ডিনার টেবিলে সারাদিনের আলোচনা চলে সুখী দম্পতির মধ্যে। আজ সেখানে দেবাঞ্জন একটাও কথা বললেন না, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। কোনোমতে দুটো রুটি নাকেমুখে গুঁজে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে এলেন। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি যেন রাতের নিস্তব্ধতায় বেশি করে শুনতে পেলেন নিজে। বারে বারে স্ক্রিনের ছবিটা ফুটে উঠছিলো চোখের সামনে। এরকমটা কেন দেখলেন আবার ? তাহলে কি গতরাত্রে আয়নায় যা দেখেছিলেন সেটাও সত্যি ? তবে কি কোথাও আগুন লাগবে আজ ? বিল্ডিংটা যে ভারী চেনা চেনা ঠেকছে, কোথায় যেন দেখেছেন.........কোথায় যেন...........ভাবতে ভাবতেই ড্রয়িং রুমে ফোন বেজে উঠলো তারস্বরে। চমকে উঠলেন দেবাঞ্জন। কান পেতে শুনলেন চৈতালী ফোনটা ধরেছে। কিছুক্ষন কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রেখে দৌড়োতে দৌড়োতে চৈতালী বারান্দায় এসে বললেন, 'এই শোনো, বিভাস ফোন করেছিল, বলল তোমাদের অফিসে নাকি আগুন লেগেছে, দুটো ফ্লোর পুড়ে ছাই একেবারে, তোমায় ফোন করতে বলল তাড়াতাড়ি'।

ফস করে সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে গেলো দেবাঞ্জনের। এক ঝটকায় মনে পড়ে  গেলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে যে বিল্ডিংটা দেখেছিলেন সেটা তাঁর অফিসেরই উত্তর দিক, ওদিকটা খুব একটা যাওয়া হয় না বলেই স্পষ্ট মনে পড়ছিলো না। নিমেষে দেবাঞ্জনের মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেলো ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন বারান্দার ধাপিতে।

চৈতালী চেঁচিয়ে উঠলেন, 'কি হলো' ?
 "ভবিষ্যৎ !.......ভবিষ্যৎ" !, ভয়ার্ত গলায় ঘড়ঘড় করতে লাগলেন দেবাঞ্জন।
'কিসের ভবিষ্যৎ ? কি বলছ কি ?'  চৈতালী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা হাত তুলে তর্জনী দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। চৈতালী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেবাঞ্জনের নতুন চশমাটা রাখা আছে উপুড় করে। টেবিলের ওপর থেকে পড়া সাদা আলোতে যেন তার ঔজ্বল্য বেড়ে গিয়েছে আরও কয়েকগুন । সে চশমাটা যেন উপুড় হয়েই তাকিয়ে রয়েছে তাদের দুজনের দিকে। চশমার লেন্স দিয়ে যেন নিক্ষেপিত হচ্ছে কোনো এক পৈশাচিক হাহাকারের জ্বলন্ত দৃষ্টি।

সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সমস্ত ঘটনা শুনে, চৈতালী কাকতলীয় বলে উড়িয়ে দিলেও নিজেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না পুরোপুরি। একটা সূক্ষ্ম ধন্দ রয়ে গেলো তাঁর মনেও। ইতিমধ্যে দেবাঞ্জনের অফিসে অস্থায়ী কর্মবিরতি ঘোষণা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মচারীদের অনুরোধ করা হয়েছে যে আগামী নোটিস না পাওয়া অবধি কেউ যেন অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন। 

পরের দিন দেবাঞ্জন ঠিক করে নিলেন যেমন করেই হোক একবার বৌবাজারের সেই দোকানে যোগাযোগ করতে হবে। আসল সত্যটা কি, সেটা খুঁজে বার না করা অবধি তিনি শান্তি পাবেন না। টেবিল, আলমারি তন্নতন্ন করে ফেললেন দেবাঞ্জন কিন্তু কোথাও চশমার রিসিটটা খুঁজে পেলেন না। বৃদ্ধ দোকানির ফোন নম্বরটা যে ওতেই লেখা ছিল। চৈতালী বারে বারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন যে এই সমস্ত ঘটনায় অলৌকিক কিছু খুঁজে বেড়ানো সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু দেবাঞ্জন তাঁর কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না। ভবিষ্যতের বিভীষিকা দেবাঞ্জনকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ফেলতে লাগলো। এক অজানা নেশায় মত্ত হয়ে উঠলেন যেন। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, 'আজ সকালেও আমি চশমাটা পড়েছিলাম। কি দেখলাম জানো ? সেই বৃদ্ধ দোকানদার যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওহ ! কি ভয়ঙ্কর প্রলয় সে চাহনিতে ! স্পষ্ট দেখতে পেলাম সে যেন আমার দিকে হাত নেড়ে নেড়ে কি একটা বলছে, কিন্তু আমি একবর্ণ বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু সে উত্তরে এক কুটিল হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো চোখের সামনে থেকে'।   

- এ সমস্তটাই তোমার অতি কল্পনা দেবাঞ্জন। তুমি উচ্চশিক্ষিত, বাস্তববাদী, এসব খেয়ালী বিভ্রম তোমাকে মানায় না। 
- তুমি বুঝবে না চৈতালী, চশমাটা পড়া অবধি আমি ভিতরে ভিতরে বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পাচ্ছি । সে অনুভূতির কেমন যেন এক অন্ধকার, অমোঘ আকর্ষণ। সে আকর্ষণ অবজ্ঞা করার ক্ষমতা নেই আমার। কতকটা............ কতকটা যেন নিশির পিছনে ধাওয়া করার মতো। 
 - এ কি বলছ তুমি দেবাঞ্জন ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? কোথাকার কি একটা চশমা, কি দেখতে কি দেখেছ, তাই দিয়ে নিজের মাথা খারাপ করছ খামোকা ?
- ভুল আমি কিছু দেখিনি চৈতালী........ কোনোরকম ভুল আমার হয় নি, আমি শুধু জানি এ চশমা কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে, একটা ভয়ঙ্কর কিছুর ! আ.....আমায় সেই দোকানে যেতেই হবে......... যে করেই হোক। 

চৈতালী নির্বাক নিস্তব্ধ বসে রইলেন। দেবাঞ্জনকে ক্ষান্ত করতে পারলেন না একবিন্দু। সমস্ত রকম চেষ্টা বিফলে গেলো তাঁর। দেবাঞ্জন বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে গেলেন বৌবাজারের উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োতে একটা ভুল করে বসলেন। চশমাটা ভুলে রেখে গেলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর। কিছুক্ষণ পর চৈতালীর সে দিকে নজরে পড়তেই ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চশমাটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একটা নীলচে আভা আছে যেন। তবে অসাধারণ কিছু নয়। দেখতে দেখতেই এক অদ্ভুত টান অনুভব করলেন চশমাটা পড়ে দেখার। নিয়তির অমোঘ আকর্ষণের বেড়াজালে জড়িয়ে গেলেন ক্ষনিকের বেখেয়ালে। আলতো হাতে চশমাটা তুলে ধীরে ধীরে চোখের ওপর বসালেন। আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখলেন নিজেকে। ছেলেদের চশমা হলেও মন্দ লাগছে না তাকে। তাছাড়া, কি আছে চশমাটাতে ? দেবাঞ্জন অযথাই পাগলামো করছে। একটা নিরীহ গোবেচারা চশমা, তাই নিয়ে একেবারে আকাশকুসুম কল্পনা করছে দেবাঞ্জন। মনে মনেই হাসতে থাকলেন চৈতালী। 'ভবিষ্যৎ' !! ওহ পারেও বটে লোকটা, বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ছাড়া আর কিস্যু নয়। মনে মনে ভাবলেন, একবার বাড়ি ফিরুক, আচ্ছা করে পেছনে লাগবেন দেবাঞ্জনের।

মনের দ্বন্দ্ব সরে যেতেই চশমাটা খুলতে গেলেন চৈতালী। হঠাৎ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো খানিক। পরক্ষণেই সামনেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে চশমার মধ্যে দিয়ে যা দেখলেন তাতে তৎক্ষণাৎ ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেলো তাঁর। পলক পড়লো না চোখে। শ্বাসরুদ্ধ করে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নিস্পৃহ ভাবটা কেটে যেতেই চশমাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেলেন মোবাইলটা আনতে। দেবাঞ্জনকে ফোন করতে হবে...... এক্ষুনি।    

অটো চেঞ্জ করে মেট্রো ধরে নিলেন দেবাঞ্জন। পুঞ্জীভূত মেঘের মতো দমবন্ধ কৌতূহল ঘন জমাট বাঁধতে লাগলো বুকের মধ্যে। সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমেই ডান দিকের ফুটপাথ ধরে হনহন করে হাঁটা লাগালেন। মিনিট তিনেকের পথ। প্রবল আশঙ্কায় হৃদস্পন্দন দ্বিগুন হলো। সামনের সিগন্যাল পেরিয়ে ডানদিকে ঘোরার জন্য রাস্তায় নামলেন। এমন সময় পকেটের ভেতর ঝনঝন করে বেজে উঠলো মোবাইল ফোনটা। দেবাঞ্জন ফোনটা তুললেন না। এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ফোন আসাতে কপালে একরাশ  বিরক্তির ভাঁজ দেখা দিল। ফোনটা কেটে গেলো আপনাআপনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার কম্পন অনুভব করলেন পকেটের মধ্যে। চোখ মুখ কুঁচকে হাত গলিয়ে পকেট থেকে বের করলেন দূরভাষ যন্ত্রটি। চৈতালী ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে রিসিভ করে বললেন, 'হ্যাঁ বলো' । খেয়াল করলেন না ওদিকে সিগনালের রংও সবুজ হয়ে গেছে কখন। চকিতের অন্যমনস্কতায় কথা বলতে বলতে রাস্তা পেরোতে গেলেন দেবাঞ্জন। ঠিক সেই সময়েই বাঁ দিক থেকে সাক্ষাৎ দানবের মতো একটা কালো সিডান এসে সজোরে ধাক্কা মারলো তাঁর কোমরে। তীব্র চিৎকার করে প্রায় কুড়ি গজ দূরে ছিটকে পড়লেন দেবাঞ্জন। মোবাইলটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো রাস্তার চারপাশে। মুহূর্তের মধ্যে রক্তের স্রোত নেমে এলো দেবাঞ্জনের গাল আর চিবুক বেয়ে। সর্পিল গতিতে এঁকে বেঁকে রক্তাভ করে তুললো কালো পিচের পথ । হৈ হৈ করে ভিড় জমে গেলো আশেপাশে। চৈতালীর শেষ ফোনটা তুলতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সাবধান বাণী আটকে পড়ে রইল অপ্রত্যাশিত দুর্ভাগা মুহূর্তদের মধ্যে। অবশ দেহে ডান হাতের কম্পমান রক্তাত আঙ্গুল তুলে ফোনের একটা টুকরো ছুঁতে চাইলেন কোনোরকমে................পারলেন না। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন ভিড় ঠেলে সেই বৃদ্ধ দোকানি এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। ভুরু তুলে এক রহস্যময় চোখে বিড়বিড় করে বললেন, 'চশমা বড়িয়া থি না বাবুজি ? একদম হটকে' ? 
দেবাঞ্জনের চোখের পাতায় ঘন অন্ধকার নেমে এলো ক্রমে ।

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব


#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki


Saturday, December 17, 2016

সাপ্তাহিকী ২১ # শখের জিনিস - প্রথম পর্ব

সকালের কাগজটা নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালেন দেবাঞ্জন। সামান্য ঝাপসা লাগছে যেন। তবে কি পাওয়ার বাড়লো ? তা কি করে হয় ? এই তো কমাস আগেই দোকানে গিয়ে পাওয়ার চেক করালেন। ঠিকই তো ছিল। তবে ? তাহলে বোধহয় চোখে কিছু পড়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে ভালো করে চোখে মুখে জল দিয়ে এলেন, কিন্তু না, ঝাপসা ভাবটা কিছুতেই যেন কাটছে না। ভারী বিপদ হলো। সত্যিই যদি পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো সবকটা চশমার লেন্স চেঞ্জ করতে হবে। সে তো বিরাট ঝক্কির কাজ। নয় নয় করে কম চশমা নেই দেবাঞ্জনের। খান পনেরো বিশেক তো হবেই। দেবাঞ্জনের চশমার ফ্রেমের ভারী শখ। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে নিত্য নতুন চশমার ফ্রেম কিনতে ভারী পছন্দ করেন তিনি। পাড়ার দোকানগুলো তো বটেই বৌবাজারের প্রায় সবকটা দোকানই দেবাঞ্জনকে বিলক্ষণ চেনে। নতুন কোনো ডিজাইন এলেই একাধিক দোকান থেকে ফোন আসে দেবাঞ্জনের কাছে। চশমার খাঁটি সমঝদার হিসেবে পরিচিত মহলেও বেশ সুনাম আছে তাঁর। সুতরাং এহেন দেবাঞ্জনের যদি চোখের পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তবে সমূহ সমস্যা তো বটেই । সাতপাঁচ ভেবে দেবাঞ্জন ঠিক করলেন অফিস ফেরত একবার ইন্ডিয়ান অপ্টিকালসটা ঘুরে আসবেন। লালবাজার আর বৌবাজারের সংযোগস্থলে বহু বছরের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এখানেই দেবাঞ্জন চোখ দেখিয়ে থাকেন বরাবর। আজ একটু কায়দা করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে...........

শীতকাল বলে সন্ধে হয়ে গেছে অনেক্ষণ। চোখ দেখানো হয়ে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন দেবাঞ্জন। পাওয়ার বাড়েনি, ডাক্তার বলেছেন বয়সকালে অমন হয় একটু আধটু। মাঝে মাঝে দৃষ্টি ঝাপসা লাগে। তেমন চিন্তার কিছু নেই। একটা আই ড্রপ লিখে দিয়েছেন শুধু। কয়েকদিন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ফুরফুরে হিমেল হাওয়ায় শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে দেবাঞ্জনের। হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের দিকে এগোতে থাকেন তিনি। সহসা একটা সরু গলির মধ্যে দূরে একটা ভাঙাচোরা দোকানের দিকে চোখ পড়ে যায়। টিমটিম করে একটা হলদেটে বাল্ব জ্বলছে সামনেটায়। একজন বৃদ্ধ একমনে একটা লেন্স পরিষ্কার করছেন একটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয়। দেবাঞ্জন ভেবে মনে করতে পারেন না এই দোকানটা আগে দেখেছিলেন কিনা। আশপাশের দুচারটে দোকান বন্ধ থাকাতে বেশি করে যেন নজর পড়ে এই দোকানটার দিকে। হতে পারে বাকি দোকানের ভিড়ে এই দোকানটা বেমানান বলে ততটা দৃশ্যমান ছিল না। কৌতূহলবশে পায়ে পায়ে এগিয়ে যান দেবাঞ্জন। দোকানের আশপাশটা বেশ সংকীর্ণ, অন্ধকার। বাল্বের আলোর ছটায় দোকানের সামনেটাই যা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চারপাশের জীর্ণ দেওয়ালগুলোয় মান্ধাতা আমলের ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যায় এই গলিটায় খুব একটা জনসমাগম হয় না। দেবাঞ্জনের পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকান বৃদ্ধ। খনখনে গলায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলেন, 'সেলাম বাবুজি, কুছ চাহিয়ে' ?। দেবাঞ্জন লক্ষ্য করেন বৃদ্ধের পরনে সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি পাজামা, মাথায় সাদা মুসলমানি টুপি। কাঁচাপাকা দাড়ির আড়ালে মুখে সরল মৃদু হাসির আভাস। দেবাঞ্জন বলে ওঠেন, ' না না, কিছু চাই না, আসলে এই গলিটায় তো ঢুকিনি কখনো, আপনার দোকানের আলো জ্বলছে দেখে এগিয়ে এলাম'।

'তো কেয়া হুয়া বাবুজি, আপ তসরিফ রাখিয়ে, আপকো আভি বড়িয়া ফ্রেম দিখাতে হেঁ,' বলেই বৃদ্ধ প্লাস্টিকের টুলটা এগিয়ে দেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন চলে আসতে চান, কিন্তু অশীতিপরের প্রতি অসম্মান করা হবে ভেবে বসে যান খানিক। মনে মনে ভাবেন, 'ঠিক আছে, দু একটা ফ্রেম দেখেই উঠে পড়বেন নাহয়, তাছাড়া দোকান দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওঁর মনের মতো জিনিস এখানে পাওয়া সম্ভব নয়'। বৃদ্ধ কাঁচের আলমারি থেকে একের পর এক ফ্রেম বের করে রাখতে থাকেন টেবিলের ওপর। অধিকাংশ ডিজাইনই হয় পুরোনো আমলের নয় সাধারণ মানের। দেবাঞ্জনের মতো শৌখিন মানুষের উপযুক্ত নয় সেসব। দু একটা ফ্রেম নেড়েচেড়ে উঠে পড়েন তিনি। কোনোটাই পাতে দেবার মতো নয়। বলেন, 'আজ নাহয় থাক, আমি আরেকদিন আসব'। বৃদ্ধ হাঁ হাঁ করে ওঠেন, 'সে কি বাবুজি, ঔর একদিন কিঁউ, হাম আভি আপকো...........' কথাটা শেষ করতে দেন না দেবাঞ্জন, বিরক্ত হয়ে বলেন, 'না না থাক, আমি অন্যদিন আসবখন'। বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বলেন, 'আচ্ছা আচ্ছা রুকিয়ে, মুঝে পাতা হ্যায় আপকো ক্যায়সা ফ্রেম পসন্দ আয়েগা, এক মিনিট'..........বলেই পিছন ফিরে আলমারির তলা থেকে বের করে আনেন একটা সোনালী রঙের কাজ করা চৌকো মতো বাহারি কাঠের বাক্স। কাঠের বাক্সটা দেখে কিঞ্চিত থমকান দেবাঞ্জন। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বাক্স খুলে মখমলি কাপড়ের মধ্যে থেকে বের করে আনেন একটা ঈষৎ নীলচে রঙের মোটা ফ্রেমের চশমা। সে চশমার কোনো অসামান্য কারুকাজ নেই বটে তবে তার জৌলুস ও চেকনাই যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সে দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে যান দেবাঞ্জন। বহু ডিজাইনার চশমা পড়েছেন এ যাবৎ কিন্তু এমন জিনিস কখনই তাঁর নজরে আসেনি। হলদেটে বাল্বের আলোয় সে চশমার দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোতে থাকে।

'প্যহনিয়ে বাবুজি, একবার প্যহনকে কে তো দেখিয়ে', মিটিমিটি হাসতে থাকেন বৃদ্ধ। চশমাটা পড়ে নিয়ে আয়নায় চোখ রাখেন দেবাঞ্জন, বাহান্ন বছরের মুখটা যেন ঝকঝক করছে, বয়সের বলিরেখা ছাপিয়ে এক আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে যেন। বেশ বুঝতে পারেন এ জিনিস দিশি নয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কোথায় পেলেন এইটা' ? বৃদ্ধ এক মোহময় হাসি ছড়িয়ে বলেন, 'বাহারকা চিজ হ্যায় বাবুজি, সিঙ্গাপুর সে আয়া হ্যায়, সোচেথে কোই আচ্ছা সমঝদার আয়েগা তো নিকালেঙ্গে ইসে। আপহিকো দিখরহেঁ পেহলিবার'। দেবাঞ্জন চশমাটা খুলে তেরছা চোখে বলেন, 'লেন্সের পাওয়ার বললে কত তাড়াতাড়ি বানিয়ে দিতে পারবেন' ? বৃদ্ধ সামান্য চোখ কুঁচকে বলেন, 'করিব একঘন্টে মে রেডি হো জায়গা সাহাব'।

- আর দাম কত নেবেন ? ঠিক করে বলবেন কিন্তু, নাহলে........
- ঢাইহাজার কা এক পয়সা কম নেহি হোগা বাবুজি.......আপ সে কেয়া ঝুট বোলনা, আপ পেহলইবার মেরে দুকান আয়েহেঁ.....

সামান্য একটু চিন্তা করেন দেবাঞ্জন, তারপর পকেট থেকে সদ্য পাওয়া প্রেসক্রিপশনের কাগজটা বের করে বলেন, 'ঠিক আছে, যত তাড়াতাড়ি পারেন বানিয়ে দিন, আমি ওয়েট করছি'............   

নতুন চশমা পাওয়ার আনন্দে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢোকেন দেবাঞ্জন। চৈতালী জিজ্ঞেস করেন, 'কি ব্যাপার এতো দেরি করলে আজ' ?
- আর বোলো না বৌবাজার গিয়েছিলাম চোখ দেখাতে, ফেরার পথে একটা ভালো ফ্রেম পেলাম বুঝলে, কিনে নিলাম। বানাতেই যা একটু সময় লাগলো। 
- ওফফ, আবার চশমা, তোমাকে যে কি এক অদ্ভুত শখে পেয়ে বসেছে ভগবান জানেন। 

চৈতালীর কটাক্ষে খুব একটা পাত্তা দিলেন না দেবাঞ্জন। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ডিনার সেরে নিলেন। চশমাটা আরেকবার চোখে না পড়া অবধি শান্তি নেই। ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঠের বাক্স খুলে বের করে আনেন চশমাটা। টিউব লাইটের আলোয় ফ্রেমটা চকচক করে ওঠে। দেবাঞ্জনের মুখাবয়ব জুড়ে চরম তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে পড়ে। পুরোনো চশমাটা খুলে রেখে নতুন ফ্রেম গলিয়ে নেন দু কানের পাশে । প্রথমটায় সামান্য একটু ঝাপসা লাগে। আলতো হাতে ফ্রেমটা আরেকবার সেট করেন নাকের ওপর। এইবার পরিষ্কার লাগে চারিদিক। বেশ দেখাচ্ছে। তারিয়ে তারিয়ে দেখতে থাকেন নিজেকে আর মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেন বিরল অর্জনের উল্লাসে।
  
কিন্তু এ কি !! এটা কি দেখছেন ! কপালের ওপর একটা কাটা দাগ আর সামান্য ফোলা লাগছে যেন।
কি আশ্চর্য ! এটা তো খেয়াল করেননি আগে। কখন চোট লাগলো আর কোথায়ই বা লাগলো ? দেবাঞ্জন চিন্তা করতে লাগলেন। কিন্তু কপালের চোটটা কিছুতেই মনে করে উঠতে পারলেন না। দোকানে কি আয়না দেখেছিলেন ? হ্যাঁ, কিন্তু তখন তো ছিল না। তাহলে কি মেট্রোতে কোনোভাবে ধাক্কা টাক্কা ..................নাহ, মনে পড়ছে না বিন্দুমাত্র। ছটফট করতে থাকেন দেবাঞ্জন। আনন্দের এমন সন্ধিক্ষণে সামান্য চোটের চিন্তায় বিব্রত হয়ে পড়েন বেশ। হাত বাড়িয়ে কাটা জায়গাটায় ছুঁয়ে দেখলেন একবার। অদ্ভুত ! কোনো ব্যাথা তো নেই ! চশমাটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে রেখে আবার আয়নার দিকে তাকালেন। একি ! একি দেখছেন তিনি ? বার কতক ভালো করে মুখটা দেখলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কপালের কাটা দাগটা বেমালুম উধাও। আশ্চর্য ! এই তো ছিল ! তাহলে কি ভুল দেখছিলেন এতক্ষণ ? তাড়াতাড়ি চশমাটা গলিয়ে নিয়ে আবার আয়নায় চোখ রাখলেন।  এই তো ! এই তো দেখা যাচ্ছে কাটা দাগটা ! কি ব্যাপার হলো ? চশমা পড়ে দাগটা দেখা যাচ্ছে দিব্যি অথচ চশমা খুলতেই দাগটা উধাও ! চশমাটা খুলে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন দেবাঞ্জন, সন্দেহ করার মতো কিছু পেলেন না খুঁজে। টেবিলের ওপর চশমাটা রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন । এ কি হচ্ছে ? এমনটাতো হয়নি আগে, তবে কি বয়েসের ভারে চোখেও ভুল দেখতে শুরু করলেন এবার ? মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন তোলপাড় করতে লাগলো। ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে এগোলেন কপাল কুঁচকে। চৈতালী রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হলো ফ্রেমটা দেখালে না আমায়' ? ব্যাজার মুখ করে দেবাঞ্জন বললেন, 'আসছি, ব্রাশটা করে আসি'। 

এইবার এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। বাথরুম থেকে বেরোবার সময়, ক্ষনিকের বেখেয়ালে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে দড়াম করে সামনে পরে গেলেন দেবাঞ্জন। মাথাটা জোর ঠুকে গেলো বাঁদিকের বেসিনটাতে। 'কি হলো কি হলো' বলে চিৎকার করে ছুটে এলেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কপাল ধরে মুখ কুঁচকে বসে রইলেন মেঝের ওপর। চরম যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছে সারা শরীর জুড়ে। কোনোরকমে ধরাধরি করে দেবাঞ্জনকে ওঠালেন। বললেন, 'একটু দেখে বেরোবে তো, ইশশশশ..... দেখো তো কপালটা কেমন কেটে গেলো বিচ্ছিরিরকম, তুমি সোফায় গিয়ে বস, আমি আয়োডিন নিয়ে আসছি',। 

আয়োডিন লাগিয়ে ধীরে ধীরে সোফা থেকে উঠলেন দেবাঞ্জন। বিছানায় যাবার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন একবার। ভালো করে দেখতে লাগলেন কতটা কেটেছে। যা দেখলেন তাতে দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। দুহাত আয়নার ওপর ভর দিয়ে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন কপালটা। কিছুক্ষন আগে আয়নায় দেখা কপালের অবিকল একই জায়গায় চোটটা লেগেছে, ঠিক ততটাই কেটেছে এবং ততটাই ফুলে উঠেছে। বেশ কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চুপ। ভুল দেখছেন নাকি ? এ কি করে সম্ভব ! চিৎকার করে ডাকলেন চৈতালীকে। চৈতালী ছুটে এলেন হুড়মুড়িয়ে।

'কি ব্যাপার ? আবার কিছু হলো নাকি' ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'আচ্ছা, মনে করে দেখো তো, বাড়ি ঢোকার পর আমার কপালে কি কোনো কাটা দাগ বা চোট দেখতে পেয়েছিলে' ?.......... 'চোট ? কই না তো.......... কেন' ? চৈতালী অবাক হন। 'না, মানে আমি নতুন চশমাটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম জানো, স্পষ্ট দেখতে পেলাম কপালের এই বাঁদিকটায় একটা কাটা দাগ আর কেমন ফুলেও উঠেছিল' , বলে আঙুল দিয়ে কপালের জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দেখান দেবাঞ্জন। চৈতালী ভারী আশ্চর্য হয়ে দেবাঞ্জনের মুখের দিকে তাকান, তারপর বলেন, 'আমি কিন্তু কোনো চোট টোট দেখিনি বাপু, আমার মনে হয় তুমি ভুল দেখেছ'। 
'না না চৈতালী, ভুল আমি দেখিনি, বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছিলাম, কারণ আমি চশমাটা পড়েছিলাম,....... দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক এই জায়গাটায়..............' তোতলাতে থাকেন দেবাঞ্জন। 
'হ্যাঁ বুঝেছি, তুমি আয়নায় দেখলে আর তারপরেই পড়ে গিয়ে এক্কেবারে কপালের ঠিক ঐখানটাতেই চোট পেলে তাই তো' ? ঘাড় বেঁকিয়ে কৌতুকভরে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন হতভম্ব হয়ে যান, স্ত্রীর পরিহাসের কি উত্তর দেবেন ভেবে পান না। বটেই তো, যে আগের ঘটনাটা দেখেনি তাকে নির্ভুল ভাবে বোঝানো অসম্ভব, তাছাড়া বয়সজনিত সমস্যাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয় একেবারে। কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন দেবাঞ্জন, তারপর অস্ফুটে বলতে থাকেন, 'আমি কিন্তু ঠিকই দেখেছিলাম....... জানিনা কি করে ................' 
চৈতালী অট্টহাস্য করে ওঠেন, বলেন, 'তোমার নতুন চশমায়, কয়েক ঘন্টা পর কি হবে সেসব দেখা যায় বুঝি ? হাঃহাঃহাঃহাঃ, ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া যায় বলছো' ?....................

(ক্রমশ)

শিল্প বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki

Monday, November 14, 2016

সাপ্তাহিকী ২০ # শিরঃপীড়া


মাথার পিছনে একটা অদ্ভুত ব্যাথা হচ্ছে নিখিলেশের । সাধারণ মাথাধরা নয়। একনাগাড়ে একটানাও নয়। থেমে থেমে ধীর লয়ে ব্যাথাটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ভারী কিছু একটা জিনিস দিয়ে অল্প অল্প চাপ দিচ্ছে পিছন থেকে। গতকাল রাতে ঘুমের ওষুধটা খাওয়ার পর থেকেই যেন শুরু হয়েছিল। অতটা পাত্তা না দিয়ে নিয়মমাফিক খানিক্ষন টিভি দেখেই শুয়ে পড়েন নিখিলেশ। ভেবেছিলেন ভালো ঘুম হলেই কেটে যাবে। অথচ সকালে উঠেও ব্যাথাটা দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে। ভারী মুস্কিলে পড়লেন, সারাদিন ধরে এই বেয়াড়া ব্যাথাটা যদি পাথরের মতো বয়ে বেড়াতে হয় তাহলেই তো হয়েছে। অফিসের কাজ তো গোল্লায় যাবে। বেসরকারী অফিসে হিসাব রক্ষকের কাজ তো কম ঝক্কির নয়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই বড় রকমের ঝামেলা পোয়াতে হবে তখন। পেশাগত দক্ষতায় এত বছরের কর্মময় জীবনে খুব একটা গলদ তাঁর হয়নি কখনো। তবুও শারীরিক দুর্বলতার কারণে হিসেবের গরমিল, মোটেও কাজের কথা নয়। তার ওপর অফিসের নতুন ম্যানেজার একাধারে বেশ দাপুটে এবং বাচাল। ছোটখাটো সমস্যাতেও লঘু গুরু জ্ঞান করেন না কখনো। দু চার কথা শুনিয়ে দেবার সুযোগ খোঁজেন যেন সবসময়। এই তো দুদিন আগে, মান্থলি মিটিংয়ে, জনসংযোগ দপ্তরের এক জুনিয়র কলিগকে যাচ্ছেতাই কথা শোনালেন সবার সামনে, শুধুমাত্রই একটা ভুল মেল্ টাইপ করেছেন বলে। নিরীহ, মিতভাষী নিখিলেশ ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিবাদটা এড়িয়ে গেছেন ইচ্ছে করে। ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পারতপক্ষে সহ্য হয় না তাঁর। আর তাছাড়া আর তো তিন চার বছর বাকি । তারপরেই অখণ্ড বেহিসেব অবসর। শেষের এই বছরগুলো যতটা শান্তিতে কাটানো যায় ততই মঙ্গল। খামোকা তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করাই ভালো।

মাথার পেছনটা আবার টনটন করে ওঠে। ঘাড় কাত করে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নেন নিখিলেশ। নাহ, অফিস ফেরত একবার মনোময় ডাক্তারের চেম্বার থেকে ঘুরে আসতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি হলে আবার বিপদ আছে। একলা মানুষ নিখিলেশ। বিয়ে থা করেন নি। পৈতৃক বাড়িটায় ভূতের মতন একাই থাকেন। অনেক ছোট বয়েসে বাবা মারা যান। আর তিরিশ বছর বয়েসে মা ও চলে যান কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। মাকে খুবই ভালোবাসতেন নিখিলেশ। মা মারা যাওয়ার পর পরই নিখিলেশ অস্বাভাবিক রকমের অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। কোনো এক অজানা কারণে লোকজনের সাথে মেলামেশা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছিল। প্রায় এক বছর উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন এদিক ওদিক। মুম্বই, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর চরকিপাক খেয়েছেন শুধু। সেসময় এরকমই একটা মাথাব্যথা হতো, বেশ মনে আছে । আত্মীয় স্বজনরা কানাঘুষো বলত, নিখিলেশের নাকি মানসিক রোগ হয়েছে, কারণ নিখিলেশ মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভুত উগ্র আচরণ করতেন যার কোনো সহজ স্বাভাবিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না। ডাক্তার, মনোবিদ সমস্তরকম কনসাল্ট করে বেশ খানিকটা সুরাহা হয়েছিল পরবর্তীকালে। বছর দুয়েক বাদে কোনো এক দূরসম্পর্কের জ্যাঠা মশাইয়ের বদান্যতায় মাস্টার্স ইন কমার্স নিখিলেশের এই চাকরিটা জুটেছিল। ধীরে ধীরে চাকরিটায় থিতু হয়ে যান, হিসেব রাখার কাজটাও বেশ ভালো লেগে গিয়েছিলো পরের দিকে। ক্রমশ উন্নতিও হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু সেই থেকে আর বিয়েটা করা হয়ে ওঠে নি। এমন নয় যে জীবনে কোনো নারীর আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি কোনোটাই। নিখিলেশের কোনো না কোনো বেমক্কা আচরণে শেষে গিয়ে ঠিক নাকচ হয়ে যেত সম্বন্ধগুলো । একটা সময়ের পর নিখিলেশের একা থাকাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। তাই কয়েক বছর পর বিয়ের পিঁড়ির প্রতি আর তেমন আকর্ষণ অনুভব করেন নি। সারাদিনে অফিসের কাজ আর পাড়ায় দু চার জনের সাথে আড্ডা দিয়েই সময় কেটে যায় এখন। বাড়ির খুঁটিনাটি কাজের জন্য একজন সারাদিনের লোক আছে, নিখিলেশের থেকে বছর দশেকের ছোট, মেদিনীপুর নিবাসী, বিশ্বস্ত অনুচর, নাম - প্রসাদ। বহু বছর আগে এ বাড়িতে সে ভিক্ষে করতে এসেছিলো। সেই থেকে এখানেই থাকে। রান্নাবান্না, ঘর দোর পরিষ্কার করা ইত্যাদি সমস্ত কাজ সে যত্ন করেই করে। নিখিলেশের রোজনামচা তার মুখস্ত।

আজ সে ভাত বেড়ে দিয়ে নিখিলেশের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'দাদার কি শরীরটা খারাপ লাগছে' ? নিখিলেশ ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে বলেন, হ্যাঁ রে, মাথাটা বেজায় টনটন করছে কেমন যেন, পুরোনো রোগটা আবার ফিরে এলো কিনা কে জানে'।
'তাহলে কি একবার সন্ধের দিকে, মনোময় ডাক্তারের কাছে...........' কথাটা শেষ করতে পারে না প্রসাদ। তার আগেই নিখিলেশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, 'হুমমম, সেরকমই ভেবেছি, দেখি, ফেরার পথে একবার দেখিয়ে আসবো' । 'আচ্ছা', বলে ভিতরে ঢুকে যায় প্রসাদ। নিখিলেশও ভাতের থালা নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েন । শরীরে অস্বস্তি হওয়ার ফলে খেতেও ইচ্ছে করে না তেমন। মুখ হাত ধুয়ে বাদামি চামড়ার ব্যাগটা কাঁধে ফেলে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যান তাড়াতাড়ি । নীলচে রঙের পুরোনো মডেলের একটা মারুতি এইট হান্ড্রেড। চাকরিতে ঢোকার বছর সাত আটেকের মধ্যেই লোনের টাকায় গাড়িটা কিনেছিলেন। বড় শখের গাড়ি তাঁর। পরের দিকে উপায় থাকলেও গাড়িটা আর চেঞ্জ করেন নি। ভালোবেসে ফেলেছিলেন তার সাধের মারুতিটাকে। এখনো সমান যত্ন করেন এবং নিজের সন্তানের মতোই আগলে রাখেন। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অফিসের দিকে বেরিয়ে যান নিখিলেশ। ব্যাথাটা হতেই থাকে ঢিমে তালে।

বিকেলের দিকে নিখিলেশের ডাক পড়ে ম্যানেজারের চেম্বারে।
'আপনার আক্কেলটা বলিহারি মিঃ মুখার্জ্জী, স্টক ব্যালেন্সের সোজা হিসেবগুলো যদি এইভাবে গুলিয়ে ফেলেন তাহলে তো দুদিনেই ব্যবসা লাটে উঠবে। আপনার ভুলের মাশুল নিশ্চয়ই  কোম্পানী দেবে না' ? কথাগুলো বলে ভীষণ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন ম্যানেজার। অপরাধীর মতো মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন নিখিলেশ। মাথার ব্যাথা তার সাথে অন্যমনস্কতা, দুয়ে মিলেই এমন বিচ্ছিরি অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে। তার জন্য নিখিলেশ যারপরনাই লজ্জিত। বার তিনেক ঢোঁক গিলে ক্ষমাও চেয়েছেন, কিন্তু অধস্তন কর্মচারীকে কোনোরকম সুযোগই দিচ্ছেন না দাপুটে কর্তৃপক্ষ । একের পর এক বাঁকা শব্দের শরাঘাতে বিদ্ধ করছেন নিখিলেশকে। নিখিলেশ কাঁচুমাচু মুখ করে বলেন, 'স্যার, আমি এক্সট্রিমলি সরি, আমাকে একটু সময় দিন, আমি পুরোটা রিচেক করে আপডেট করে দেব সমস্ত কিছু। ঘন্টাখানেকের বেশি লাগবে না, কথা দিচ্ছি' ।

 - স্ট্রেঞ্জ, ঘন্টাখানেক সময়টা কি আপনি সময় বলে মনে করেন না মিঃ মুখার্জ্জী ! নাকি আপনি ভাবছেন অমন ঘন্টার পর ঘন্টা অপচয় করার মতো যথেষ্ট সময় আছে আমাদের ?
- আজ্ঞে স্যার, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। সামান্য একটা ভুল......আমি এখুনি ঠিক করে দিচ্ছি।
- হাসালেন মিঃ মুখার্জ্জী, কোনটা সামান্য আর কোনটা অসামান্য সে বিচার করার বোধ যদি আপনার থাকতো তাহলে এই ভুলটা কিছুতেই করে উঠতে পারতেন না।
- আসলে স্যার, গত দুদিন ধরে আমার একটা অদ্ভুত মাথাব্যথা........
- এই হচ্ছে মুশকিল জানেন তো ! বুড়ো ঘোড়া তায় আবার বাঙালী ! এই দিয়ে কি আর রেসের বাজি জেতা যায় ? এই বয়েসে এখন আপনার মাথাব্যথা, অম্বল, গ্যাস, বুকজ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর এসব হবেই, তাই বলে তো আর কোম্পানী আপনার সুস্থ হওয়ার দিকে হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতে পারবে না, তাই না ?

মাথা নিচু করে চরম অপমানগুলো হজম করতে থাকেন নিখিলেশ। নিমেষেই কান মাথা লাল হয়ে যায় তাঁর। কাঁচের দরজার ওপারে মাঝেমাঝেই উৎসুক মুখের চাহনি টের পাওয়া যাচ্ছে । বাকি কলিগদের মাঝে সম্মানের আর অবশিষ্ট রইল না কিছু এটা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি । এই অফিসে তিনি একাধারে সিনিয়র এবং সম্মানীয় পদে আসীন। এধরনের বাক্যালাপে অভ্যস্ত নন কোনোভাবেই । আগের ম্যানেজারদের সময়তে এমনটা হয়নি কখনো। বরাবরই তাঁকে সমীহ করে এসেছেন ছোট থেকে বড় সবাই । সেখানে এমন হেনস্থায় তাঁর মাথা শুধু হেঁটই হলো না বরং আত্মাভিমানেও সপাটে চপেটাঘাত পড়লো যেন।

নিখিলেশ ধীরে ধীরে ম্যানেজারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের সিটে গিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন খানিক্ষন। চাকরীর পড়ন্ত বেলায় পাওনা বহির্ভূত অসম্মানটা হজম করতে পারেন না কিছুতেই। ভিতরে ভিতরে ঝড় বইতে থাকে। চূড়ান্ত অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে স্টক ব্যালেন্সের ফাইলটা টেনে নিয়ে দ্রুত চোখ বোলাতে থাকেন। আশপাশ থেকে কৌতূহলী চোখের আদানপ্রদান হতে থাকে, কিন্তু সেদিকে খুব একটা আমল না দিয়ে ভুলগুলো সংশোধন করতে থাকেন একমনে। কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ম্যানেজারের টেবিলে ফাইলটা রেখে বলেন, 'আমি পুরোটা রেক্টিফাই করে দিয়েছি স্যার, আপনি কি একবার চোখ বুলিয়ে নেবেন প্লিজ' ? ।

'সেটা না করে উপায় আছে নাকি' ? দরকারী কাগজপত্রে সই করতে করতে উদ্ধত কথাগুলো নিখিলেশের মুখের দিকে না তাকিয়েই ছুঁড়ে দেন ম্যানেজার। নিখিলেশ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, কি বলবেন ভেবে পান না, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নব্য ম্যানেজারের মুখের দিকে। আগের মতো মুখ নামিয়েই ম্যানেজার বলতে থাকেন, 'আমায় তো অন্যান্য কাজও করতে হয়, আগামী সপ্তাহের অডিট রিপোর্টে এমনিই ডিলে হবে, সুতরাং কালকের আগে দেখে উঠতে পারবো না.......থ্যাংকস টু ইউ ফর মেকিং দিস রিমার্কেবল পারফর্ম্যান্স' । বাঁকা কথাগুলো চাবুকের মতো পড়ে নিখিলেশের সারা শরীরে। কানের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সেসব শ্লেষের শব্দ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে বিষাক্ত জ্বালা ধরিয়ে দেয়। ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন নিখিলেশ। মাথার মধ্যে যেন আগুনের লেলিহান শিখার উপস্থিতি টের পেতে থাকেন । বুঝতে পারেন তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। হাতের কাজগুলো চটপট সেরে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত লিফটের দরজার কাছে চলে আসেন। বোতাম টিপে পার্কিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরে নেমে আসতেই মনে হয় ব্যাথাটা যেন ক্রমশ বিদ্যুৎলতার মতো মাথা থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে । গাড়ির কাছে এসে তাঁর মনে হয় একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলে ভালো হতো, তাহলে বোধহয় এই অস্থিরতা লাঘব হত কিছুটা । এই পার্কিং ফ্লোরের উত্তর দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকাই থাকে । উত্তেজনায় কাঁপা হাতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নেন নিখিলেশ। পাঁচিলের দিকটায় এগোতে যাবেন, হঠাৎ লক্ষ্য করেন ইতিমধ্যেই ম্যানেজার নেমে এসেছেন আর অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে । নিখিলেশ একটু হকচকিয়ে যান, পরক্ষনেই সামলে নিয়ে বলেন, 'কিছু বলবেন স্যার' ? ম্যানেজার আঙ্গুল তুলে নিখিলেশের গাড়ির দিকে দেখান । নিখিলেশ কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে' ?
- বেসিক সিভিক সেন্সটা কি কিছুতেই আপনার থাকতে নেই মিঃ মুখার্জ্জী ?
একথায় নিখিলেশ খানিকটা বাক্যহারা হয়ে যান, তারপর কোনোরকমে বলেন, 'আ, আমি ঠিক বুঝলাম না স্যার' । ম্যানেজার কোমরে দুহাত দিয়ে বলেন, 'আপনার এই আপদটাকে যেভাবে রেখেছেন, তাতে করে তো আমি আমার গাড়িটা বের করে উঠতে পারছি না' । কথাটা যে তাঁর মারুতি গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বলা, এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না নিখিলেশের। কঠিন গলায় বলেন, 'ওটা আমার গাড়ি স্যার.....আপদ নয়' ।
- বটে ! বেশ তবে ওটাকে নিচের ফ্লোরে রাখবেন এবার থেকে, ওপরে আর নয়।
- কিন্তু কেন ? আমি তো বরাবর এখানেই রাখি।
- অফিসের কিছু গাইডলাইনস তৈরী করেছি মিঃ মুখার্জ্জী, ম্যানেজার বা সমগোত্রীয় এমপ্লয়ীজরা তাঁদের গাড়ি সেকেন্ড ফ্লোরে পার্ক করবেন আর বাকি স্টাফদের নিচের ফ্লোরে পার্ক করতে হবে।
- এটা একটু জবরদস্তি হয়ে গেলো নাকি ?
- কি হলো না হলো সেটার কৈফিয়ৎ নিশ্চই আপনাকে দেব না । বরং যেটা বলা হয়েছে সেটাই করবেন এখন থেকে ।

নিখিলেশের মনে হলো কেউ যেন মাথার ভেতরটায় সজোরে হাতুড়ি দিয়ে পিটছে একনাগাড়ে । কপালের দুপাশে শিরা ফুলে উঠেছে । হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে । দাঁতে দাঁত চেপে পাল্টা জবাব দেন, 'কৈফিয়ৎ আপনি নাই দিতে পারেন, কিন্তু অন্যায্য কারণে আপনারও হুকুম মানতে ঠিক বাধ্য নই আমি'। এহেন অপ্রত্যাশিত জবাবে ম্যানেজার ক্ষণিক স্তব্ধ হয়ে যান এবং পরক্ষনেই ভয়ানক চিৎকার করে বলেন, 'হাউ ডেয়ার ইউ টক্ টু মি লাইক দিস !! আপনি জানেন আপনি কার সাথে কথা বলছেন' ?
নিখিলেশের চোখ মুখ দাবানলের মতো জ্বলতে থাকে । সারা শরীর দারুণ উত্তাপে ঝলসে যেতে থাকে যেন। ক্রুদ্ধ চাহনি দিয়ে বলেন, 'জানি..... আমি একজন অভদ্র, উন্মাদ, এরোগেন্ট মূর্খের সাথে কথা বলছি, যে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না, দুর্ব্যবহার ও হেনস্থার চাবুকে কর্মচারীদের নাজেহাল করে রাখে'....... । 
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠেন ম্যানেজার, 'শাট ইওর ফাকিং মাউথ মুখার্জ্জীইই !! আই উইল মেক ইয়োর লাইফ হেল ইউ ব্লাডি সোয়াইন........' । কথাটা পুরো শেষ করতে পারেন না। তার আগেই পাঁচিলের ধার ঘেঁষে পরে থাকা একটা কংক্রিটের চাঙড় তুলে নিয়ে সজোরে ম্যানেজারের মাথায় বসিয়ে দেন নিখিলেশ। মিনিট খানেকের কম্পন আর মৃদু গোঙানির আওয়াজ। কিছুক্ষনের মধ্যেই পার্কিং ফ্লোরে নিথর হয়ে যায় ম্যানেজারের শরীর............

পরদিন সকালে ডাইনিং টেবিলে নিয়মমতো চায়ের কাপের সাথে সকালের কাগজটা বাড়িয়ে দেয় প্রসাদ। নিখিলেশ চায়ের কাপে হালকা চুমুক দেন। প্রসাদ জিজ্ঞেস করে, 'ওষুধটা এনে দেব দাদা' ? নিখিলেশ বলেন, 'থাক, দরকার নেই, কাল থেকে আর ব্যাথাটা হচ্ছে না' । 'তুমি কি এখনি অফিস বেরোবে' ? প্রসাদ আবার জিজ্ঞেস করে। নিখিলেশ নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেন, 'নাহ, আজ আর বেরোব না কোথাও'। প্রসাদ আশ্বস্ত হয়ে বলে, 'সেই ভাল, আজ বরং একটু বিশ্রাম নাও, গতকাল রাত থেকে তো দুচোখের পাতা এক করতে পারনি, আমায় ফাঁকি দিতে পারবে না, আমি জানি'। মৃদু হাসেন নিখিলেশ, বলেন, 'সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও পার্কিংয়ের সিসিটিভিটাকে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারিনি জানিস, ধরা ঠিক পরেই যাব। বছর ত্রিশ আগে পার পেয়ে গেছি.......তবে আজ আর কোনো উপায় নেই'। প্রসাদ অবাক হয়ে বলে,       'মানে' ? কোনো উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে কাগজটা চোখের সামনে ধরেন নিখিলেশ। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় হেডলাইনটা গোটা গোটা হরফে জ্বলজ্বল করছে -
"কলকাতার বুকে স্টোনম্যানের পুনরাবির্ভাব"।



#bengalishortstories #bengalisuspensestories #thrill #drama #saptahiki

Tuesday, September 13, 2016

সাপ্তাহিকী ১৬ # দুর্গা

'এ বছর কেমন অর্ডার হলো গো' ? সোমলতা বঁটিতে খড় কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করে রাখালকে। দাওয়ার এক কোনে বসে রাখাল এক মনে মাটি লেপে যায় মৃন্ময়ী মুখের ওপর। কথাটার খুব একটা আমল দেয় না সে, দ্রুত হাতে কাজ শেষ করতে হচ্ছে এখন, পুজোর বেশি দেরি নেই আর। শেষ বেলার অর্ডারগুলো ছেড়ে দিতে পারলে তবে নিশ্চিন্তি। সোমলতা আবার জিজ্ঞেস করে, 'কি গো ? কথার উত্তর দিচ্ছ না যে মোটে '? নিপুণ হাতের টানে মাটি কেটে দেবীর চোখ তৈরীর কাজ শেষ করে রাখাল। ছাঁচটা আলতো করে পাশে রেখে উঠে গিয়ে বালতির জলে হাত ধুতে ধুতে বলে, 'মা লক্ষীর কৃপায় এবার মন্দ হয় নি, শুধু বিষ্টিটা আর না হলেই বাঁচি'। খড়ের বান্ডিল হাতে নিয়েই দুহাত মাথায় ছোঁয়ায় সোমলতা। বিড়বিড় করে বলে, 'মা, মাগো, জগজ্জননী মা, দেখো একটু'। হলদেটে তাঁতের শাড়ির আঁচলের মতো বিকেলের পড়ন্ত আলো এলিয়ে পড়ে আছে উঠোনের পশ্চিম দিকটায়। সেদিকে তাকিয়ে রাখাল জিজ্ঞেস করে, 'দুগ্গা ফেরেনি এখনো' ?

বলতে বলতেই দুদ্দাড় করে ছুটতে ছুটতে ঢোকে একটি বছর সতেরোর শ্যামলা তরুণী। 'মা ভাত দাও তাড়াতাড়ি। আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেলো'। সাইকেলটা কোনোরকমে হেঁশেলের দেওয়ালের ওপর হেলান দিয়ে রেখে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় সে।

- ঐ এলেন, দুদণ্ড জিরোবার সময় নেই, সবসময় যেন রেলগাড়ির মতো ছুটছে, বলি হাত মুখটা তো ধুবি, তবে তো ভাত বাড়ব.......

'আমি হাত মুখ ধুয়ে নেব মা, তুমি ভাতটা বাড় দেখি তাড়াতাড়ি', ঘরের ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে বলে দুর্গা।

সোমলতা ব্যস্ত হয়ে বঁটি সরিয়ে উঠে পরে, গাল ফুলিয়ে বলে, 'আমি অত হুড়োমাতুনি করতে পারবো না বাপু, আসন পাত্চি, ধীরে সুস্থে এসে বোসো'।  

রাখাল মৃদু হাসে, মা মেয়ের কথা চালাচালিতে বেশ মজা লাগে তার। দাওয়ায় বসে মৌজ করে বিড়ি ধরিয়ে তালপাখা ঘোরাতে থাকে একহাতে। দুর্গা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে ইতিমধ্যে, শাড়ি ছেড়ে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নিয়েছে, গোয়ালপাড়ায় রিন্টুদের বাড়ি যেতে হবে। কিছু ছাত্রছাত্রী পড়ায় সেখানে। বাবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে দুর্গা। যৎসামান্য প্রসাধনে পানপাতার মতো মুখখানা লাবণ্যময় লাগে। দেখে ভারী মায়া হয় রাখালের। অভাবের সংসারে মেয়েটার যত্নআত্তি হয়না তেমন। অথচ গেলো বার মাধ্যমিকে দারুন ফল করে রাখালের বুকটা গর্বে ভরিয়ে দিয়েছে। তাই পণ করেছে, যে করেই হোক মেয়েকে যতদূর পারবে লেখাপড়া শেখাবে, সমাজের চারটি লোকের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াবার যুগ্যি করে তুলবে। অনটনের গেরস্থে সেটা খুব একটা সহজ কাজ নয় তা খুব ভালো করেই জানে দুর্গা আর তাই ছাত্র পড়িয়ে সেও যতটা সম্ভব বাবার বোঝা লাঘব করার চেষ্টা করে। দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়, সন্ধ্যে নেমে আসছে, ছেলেমেয়েগুলো হাঁ করে বসে থাকবে.............

"দু এক্কে দুই .....দু দুকুনে চার.........তিন দুকুনে ছয়........ চার দুকুনে আট......" দুলে দুলে নামতা মুখস্থ করতে থাকে কচি ছেলেমেয়ের দল।

বাকিদের কিছু সরল যোগ বিয়োগের আঁক কষে দেখায় দুর্গা। কিন্তু কিছুতেই যেন আজ মন দিতে পারে না সেদিকে। বারে বারে অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। চোখ চলে যায় উত্তরের জানলার বাইরে। পলকা হাওয়ায় ছিট্ কাপড়ের পর্দা উড়তে থাকে আর সেই পর্দার আড়াল দিয়ে আড়চোখে দেখতে থাকে দুর্গা।

চায়ের দোকানের ঠিক বাঁদিক ঘেঁষে তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর। কিছু একটা বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে আর মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ চাউনিতে রিন্টুদের বাড়ির এই জানলাটা মেপে নিচ্ছে একনজর করে। ছেলেগুলোকে চিনতে পারে না দুর্গা। কিন্তু তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু এবং চাউনির লক্ষ্য যে সে নিজে সেটা বুঝতে একফোঁটা অসুবিধে হয় না তার। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি ক্রমাগত খোঁচা দিতে থাকে তাকে।

ঘড়ির কাঁটায় সাতটা বাজে। আজ আর মন দিতে পারছে না দুর্গা। নির্ধারিত সময়ের আগেই সে ক্লাস ছুটি দিয়ে দেয়। ছুটির আনন্দে কচিকাঁচার দল হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে যে যার মতো।

শুধু রিন্টু এসে অপার বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, 'দিদি, আজ যে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিলে' ?

রিন্টুর সরল প্রশ্নে হেসে ফেলে দুর্গা, বলে, 'আজ দিয়েছি, কাল কিন্তু সব অঙ্ক করে রাখিস, তবেই ছুটি, মনে থাকে যেন'।

বাধ্য ছাত্রের মতো ঘাড় হেলায় রিন্টু। দুর্গা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে সেই তিনটে ছেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবকটাই তেইশ চব্বিশ বছরের আশেপাশে। ঠিক ঠাহর করতে পারে না তাদের। তবে, একটি ছেলের মুখ যেন আবছা মনে পড়ছে এখন। গতমাসের ভোটে এই ছেলেটিকেই ঝান্ডা লাগাতে দেখেছিলো না তাদের পাড়ায় ? তাই তো ! জামালপুরের পার্টি অফিসে হপ্তা দুয়েক আগে গিয়েছিলো বাবার সাথে একটা কাজে, হ্যাঁ সেখানেও যেন দেখেছে এই ছেলেটিকে। কি যেন নাম বলছিলো, কি যেন.................
নাহ কিছুতেই মনে করতে পারে না সে। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় দুর্গা, গোয়ালপাড়া ছাড়িয়ে, পুকুরঘাট পেরিয়ে নিজের পাড়ার দিকে ঘুরে যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই।

এরপর কয়েক দিন কেটে যায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত দুর্গার জীবন রুটিনমাফিক বয়ে চলে, যেমন করে খেয়ামতি বয়ে চলেছে গ্রামের দক্ষিণ দিক বরাবর, তেমনি। স্কুলে যাওয়া আসা, বন্ধুদের সাথে বটতলার মাঠে আড্ডা দেওয়া, বাবাকে হাতে হাতে মূর্তি গড়ার কাজ এগিয়ে দেওয়া, নিজের পড়াশুনো, রিন্টুদের বাড়ি ছাত্র পড়ানো সবই চলতে থাকে জাগতিক নিয়মের ফিতে বেঁধে।

এরই মাঝে তাল কেটে যাওয়ার মতো সেবন্তীর কথায় তার খটকা লাগে বেশ। সেবন্তী, দুর্গার সুখ দুঃখের সহচরী ও অভিন্ন হৃদয়ের সই।

স্কুল যাওয়ার পথে সে দুর্গাকে জিজ্ঞেস করে, 'কি ব্যাপার বলতো ? আজ কদিন ধরে লক্ষ্য করছি রন্জু  তোর পিছু পিছু ঘুরছে, কিছু হয়েছে'?

দুর্গা ভারী অবাক হয়ে বলে, 'রন্জু ! সে আবার কে' ?

'ওই তো, সুখেন মুদির ভাইপো, জামালপুরে থাকে, বাইক নিয়ে ঘোরে, পার্টি ফার্টিও করে নাকি শুনেছি', নিঁখুত বর্ণনা দেয় সেবন্তী। 

এক ঝট্কায় কদিন আগেকার কথা মনে পড়ে যায় দুর্গার। ঢোঁক গিলে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে, 'হ্যাঁ রে, মনে পড়েছে, কদিন আগে রিন্টুদের বাড়ির সামনেও দেখেছি, সঙ্গে আরও দুটো ছেলে ছিল, কি বিশ্রী চাউনি........ কিন্তু, তুই কি করে জানলি ?'

- রোজ স্কুলের ছুটির পর রন্জুকে দাঁড়াতে দেখছি চালতা বাগানের মোড়ে, আর তোর দিকেই যে নজর রাখছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন ?

- আসলে ওই জামালপুরের পার্টি অফিসে গিয়েছিলাম বাবাকে নিয়ে, বেশ কয়েকদিন আগে, সেখানে দু একটা ব্যাপারে কথা কাটাকাটি হয় আমার, হতে পারে সেটার জের থেকেই হয়তো.........

- সাবধানে চলাফেরা করিস দুর্গা, একটু নজর করিস সবদিক, তেমন উল্টোপাল্টা কিছু হলে জানাস, আমরা মহিলা সমিতিতে যাব.......

- আচ্ছা.......আজ তবে আসি রে, বাড়িতে আবার মেলা কাজ পরে রয়েছে.......

সেবন্তীকে হাত নেড়ে বাড়ির দিকে সাইকেল ঘোরায় দুর্গা, হাজারো চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে  থাকে। বাঁদিক ঘুরে শিবমন্দিরের দিকে যেতেই সামনে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। রন্জু দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে সেই দুটো ছেলে, পাশে একটা লাল বাইক দাঁড় করানো। পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায় দুর্গা, রন্জু পথ আটকে দাঁড়ায়। দুর্গার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।

শিবমন্দিরের এদিকের জায়গাটা নিঃঝুম থাকে বরাবর। আশেপাশে বাঁশবাগান ছাড়া আর কিছুই নেই, জলা জঙ্গল বলে লোকজন খুব একটা যাওয়া আসাও করে না তেমন। শর্টকাট হবে বলে প্রত্যেকবার এদিককার পথটাই ধরে দুর্গা। কোনোদিন কল্পনাও করেনি যে এমন বিপদ হতে পারে। রন্জু হেলতে দুলতে পান মশলা চেবানো দাঁত বের করে সামনে এসে দাঁড়ায়।

আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেয় সারা শরীরে। সে চাউনিতে দুর্গা কুঁকড়ে যায় খানিক। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ফেলে একটা কর্কশ সুরে বলে, 'রোজ রোজ ঘু ঘু তুমি খেয়ে যাবে ধান ? আর আমি কি বসে বসে শুধুই চেবাবো পান'?

খ্যাঁকখ্যাক করে পিছনের ছেলেদুটো হেসে ওঠে রন্জুর কথা শুনে ।

'কি চাও তুমি ?' দুর্গার গলা কেঁপে ওঠে।

'আমি সুধু তোমায় চাই গো দুগ্গাদেবী, সুধু তোমায় চাই', বলেই দুর্গার হাতটা খপ করে  চেপে ধরে রন্জু ।

তারপর চোখের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলে, 'কেন ? পার্টি অফিসে সবার সামনে আমাকে অপমান করার সময় মনে ছিল না? আজ যদি তোকে তুলে নিয়ে যাই, কেমন হয় ? তোর ফড়ফড়ে বুলি আওড়ানোর সখ একলপ্তে মিটিয়ে দিই, কি বল'? হিসহিসিয়ে ওঠে রন্জু ।

দুর্গা থরথর করে কাঁপতে থাকে সাইকেলটা চেপে ধরে। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় কেমন। নিথর মূর্তির মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময়ে উল্টো দিক থেকে ভঁপু বাজাতে বাজাতে একটা সাইকেল রিকশা আসতেই ঝট করে হাত ছেড়ে দেয় রন্জু । আর ওই সুযোগেই দুর্গা প্যাডেলে চাপ দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় তড়িঘড়ি। রিকশাটার জন্য দুর্গাকে আটকানোর সুযোগ পায়না সে।

তবু পিছন ফিরে চিৎকার করে বলে, 'ভাবিস না এখানেই শেষ হল, সন্ধেবেলা পড়াতে বেরোবি না ? তখন বাকিটা বুঝে নেব', বাইকে স্টার্ট দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যায় সবাই ।  

বাড়ি ফিরে কোনো কথা বলে না দুর্গা, কোনোরকমে ভাতের থালা নাড়াচাড়া করে উঠে পরে, ঘরে ঢুকে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। সোমলতার কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেয় না সে।

রাখাল পায়ে পায়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। জিজ্ঞেস করে, 'কি হয়েছে মা, আজ এতো চুপচাপ আছিস যে ? কেউ কিছু বলেছে ?

'কদিন ধরে একদল কুকুর তাড়া করছে বাবা', শান্ত স্বরে জবাব দেয় দুর্গা।

রাখাল সেকথার মানে বুঝতে পারে না। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মেয়ের দিকে।

দুর্গা স্মিত হেসে বলে 'মেয়েদের পিছনে ওমন অনেক কুকুর ঘুরঘুর করে বাবা, ভয় পেলে কি চলে আমাদের ? এখন উঠি বরং, যাই, ছাত্ররা অপেক্ষা করছে, আজ হয়তো ফিরতে একটু দেরি হবে আমার, সামনে পরীক্ষা আছে ওদের'।

'আমি কি তোকে নিতে আসবো' ? রাখাল উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে।

দুর্গা আস্বস্ত করে বলে, 'না না, তুমি কিছু চিন্তা করো না, আমি ঠিক চলে আসব'।

উঠোনের এক কোনে দাঁড় করানো প্রায় তৈরী হয়ে আসা দুর্গামূর্তিটা পিছন ফিরে দেখে একপলক, হ্যালোজেনের আলোতে মূর্তির ছায়ায় দুর্গার ছায়া মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে রিন্টুদের বাড়ির দিকে। মনের মধ্যে এলোপাথাড়ি হাওয়া তোলপাড় করতে থাকে.........

পড়াতে পড়াতে বারেবারেই দুর্গার চোখ চলে যায় বাইরের দিকে। চায়ের দোকানটা খোলা আছে বটে, তবে ছেলেগুলোকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। তবু যেন উদ্বেগের শেষ থাকে না, রন্জুর কথাগুলো ঘুরেফিরে মনের মধ্যে বাজতে থাকে একনাগাড়ে। আর সেগুলো মনে পড়লেই ভয়, লজ্জা আর কুন্ঠা মিশ্রিত একরকম ঘূর্ণিঝড় পাক খেয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত সম্ভ্রমের চাদরটা যে এভাবে ছিঁড়ে যেতে পারে তা এতটুকু আঁচ করতে পারেনি সে কখনোই, আর তাই ভিতরে ভিতরে একরকম বিতৃষ্ণা তৈরী হয়ে যায় অজান্তেই।

ঘড়ির কাঁটায় আটটা বাজতেই ছুটি দিয়ে দেয়। আজ আর শিবমন্দিরের রাস্তাটা ধরবে না সে। বরং হাটখোলা মাঠের পাশ দিয়ে চলে যাবে। একটু ঘুরপথে হবে যদিও, তবু ক্ষতি নেই। বেশ কিছুটা পথ যেতে হবে। প্যাডেল ঘোরায় দুর্গা।

গোয়ালপাড়ার পূর্বদিকটা পিছনে ফেলে দুচাকা এগোতে থাকে হাটখোলা মাঠের দিকে। সকাল বেলায় বাজার বসে এদিকটায়, দিব্যি গমগম করে তখন, সন্ধ্যে হলেই একটু শুনশান হয়ে যায়। দুচারজন পথচলতি মানুষ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না তেমন। আজ তবু একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে আকাশে।

এমন সময় ভটভট ভটভট করে গুরুগম্ভীর ইঞ্জিনের শব্দ হতে থাকে কোথাও যেন। পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করে দুর্গা, একটা তীব্র জোরালো আলো পিচ রাস্তার বুক ভেদ করে এগিয়ে আসছে। একসেকেন্ড সময় লাগে না বুঝতে যে সেটা রন্জুর বাইকের আওয়াজ। প্রমাদ গোনে দুর্গা। দেখতে দেখতেই বাইকটা চলে আসে সাইকেলের এক্কেবারে পাশে।

'আমায় ফেলেই চলে যাচ্ছিস যে' !

একটা বিশ্রী হেসে রন্জু ছুঁড়ে দেয় কথাটা, পিছনে বসা ছেলে দুটোও চিৎকার করে নানারকম আকার ইঙ্গিত করতে থাকে।

দুর্গা কোনো উত্তর দেয় না। ওদের অঙ্গভঙ্গি দেখে হাড় হিম হয়ে যায় পলকে। জোরকদমে প্যাডেল ঘোরাতে থাকে সে। চরম বিপদ যেন কালো মেঘের মতো গ্রাস করতে ছুটে এসেছে কোথা থেকে। বিস্তর জোরে চালিয়েও ইঞ্জিনের ক্ষমতাকে কিছুতেই টেক্কা দিতে পারে না দুর্গা।

রন্জু বাইকের সামনের চাকা দিয়ে একটা ছোট্ট ঠেলা দেয়। সাইকেল শুদ্ধু একেবারে আছাড় খেয়ে মাঠের ওপর পড়ে।

"মা গো" বলেই হাঁটু চেপে ধরে যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে দুর্গা। ওদিকে বাইকটাকে স্ট্যান্ড করে মাঠের ধারে রেখে ধীর পায়ে এগোতে থাকে রন্জু ও তার ছেলেরা। হিমেল স্রোত নেমে যায় দুর্গার শিরদাঁড়া বেয়ে, কোনোরকমে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে তোলে নিজেকে, তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটতে থাকে সামনের দিকে। পিছন পিছন রন্জুরাও ছুটতে শুরু করে বুনো হায়নার মতো।

নাগালের মধ্যে শিকার পেয়ে সবারই রক্ত ফুটতে থাকে টগবগ করে। বেশ কিছুটা দৌড়োনোর পর একটুকরো মাটির ঢ্যালায় হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে দুর্গা। থুতনিটা ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে।

একলাফে শিকারী কুকুরের মতো ছেঁকে ধরে রন্জুরা। কোনোরকমে হাঁচোড় পাঁচোড় করতে করতে উঠে দাঁড়ায় দুর্গা।

'এবার? এবার কি করবে দুগ্গাদেবী'? রন্জু বাঘের মতো এগিয়ে আসে সামনে।

পৈশাচিক উল্লাসে হাটখোলার মাঠ কেঁপে ওঠে। ঠোঁটের ডগায় জিভ লকলক করে ওঠে সবার।

দুর্গা বাঁ হাতের চেটো দিয়ে থুতনির কাছটা মুছে নেয় একবার। হাঁপাতে হাঁপাতে সরাসরি চোখ রাখে রন্জুর চোখে, তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে অদ্ভুত ভাবে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসতে থাকে হি হি করে।

হকচকিয়ে যায় রন্জু, বাকি ছেলেদুটোও, এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে অবাক বিস্ময়ে।

দুর্গা আঙ্গুল তুলে দেখায় পিছন দিকে। সে দিকে তাকিয়ে রন্জুর মুখে ধরা সিগারেটটা ফস করে পড়ে যায় মাটিতে। চূড়ান্ত ভয়ে মুখ সাদা হয়ে যায় সকলেরই। মাঠের ঈশান কোন বরাবর একদল ছায়ামূর্তি জড়ো হয়েছে। চাঁদের আলোয় সে অবয়ব পরিষ্কার হতে থাকে ধীরে ধীরে।

প্রায় ষাট সত্তরজন মহিলা আগুনে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তাদের প্রত্যেকেরই হাতে দা, কাস্তে, বঁটি, হাঁসুয়া, ঝলসে উঠছে সহস্র নক্ষত্রের রুপোলি আলোয়।

একফাঁকে মহিলা সমিতিতে দুর্গার দেখা করে আসার ঘটনাটা রন্জুরা টের পায়নি কখনোই। বিপদের পাশাটা আমূল বদলে উল্টে যায় তাদের চোখের সামনেই। শিকারী হতে গিয়ে যে শিকার হয়ে যেতে হবে এমনটা রন্জুরা আঁচ করতেই পারেনি।

কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে বসে পড়ে তিনজন মাঠের ওপরে। করুনার আর্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দুর্গার দিকে।

দুর্গার এলোচুল উড়তে থাকে মেঠো হাওয়ার টানে, চন্দ্রলোকের মায়াবী ছটায় দেবীর চেয়ে কম কিছু মনে হয় না তাকে। বহুদূরে, শেষপ্রান্তে কারা যেন.কোলাহল করে ওঠে .........'বলো দুগ্গা মাইকী'..........গ্রামের কোনো এক পাড়ার প্যান্ডেলে মা আসছেন বোধহয় .............






#bengalishortstories #womenempowerment #durgapuja #thrill    


Saturday, July 23, 2016

সাপ্তাহিকী ১৪ # জ্যোতিষী

দুপুরের গনগনে আঁচটা এমাসে আর তেমন নেই বললেই চলে। ঘড়ির কাঁটা চারটে দশ ছুঁই ছুঁই করছে। শ্রাবনের শেষের দিনগুলো ইদানিং একটু গুমোট বেঁধে আছে। অস্থির হয়ে উঠেছে রায়া। সিমেন্টের বেঞ্চিটাতে বসে ঘন ঘন হাতঘড়িটার দিকে তাকাতে থাকে। কিঞ্জল বড্ডো দেরি করছে যেন আজকে ! দক্ষিণ কলকাতার লেকের এই পূর্ব-দক্ষিণ দিকটা বরাবর তাদের ভীষণ প্রিয়। শান্ত, নিরিবিলি, ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটায় দুদণ্ড কথা বলা যায় মনের সুখে। সামান্য অযত্নের জঙ্গল আর এভিনিউ সম্মিলনী ক্লাবের পিছন দিক হওয়ার দরুন অনেকেই এদিকটা এড়িয়ে চলে। ফলে নিজেদের আলাপচারিতার টুকরো মুহূর্তগুলো অবলীলায় প্রজাপতির মতো বাধাহীন উড়ে বেড়ায় ইতিউতি।

অকস্মাৎ বাঁদিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে রায়ার। দুটো বিবর্ণ ঘোলাটে চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঝট করে চোখ সরিয়ে নেয় রায়া। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা অস্বস্তি শুরু হয় যেন। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। প্রবল আশঙ্কায় ধীরে ধীরে আবার বাঁ দিকে ঘুরে তাকায় সে। একজন রোগাটে, শীর্ণ বৃদ্ধ অপলক তাকিয়ে আছেন তার দিকে। বড় অদ্ভুত সে চাহনি। মাথা থেকে পা অবধি পড়ে ফেলার এক তীব্র প্রচেষ্টা যেন সে চোখ দুটোতে। প্রথম নজরে চমকে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কি করবে ভেবে পায়না রায়া। উঠে চলে যাবে নাকি অন্য কোনো দিকে ? গিয়ে বসবে অন্য কোনো বেঞ্চিতে ? কিঞ্জলটাই বা দেরি করছে কেন এতো ? শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হতে থাকে অজান্তেই।

- কিরে ? কতক্ষণ ?
চমকে ওঠে রায়া। কিঞ্জলকে সামনে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ঠোঁটের ওপর আলগা হাসি ঝুলিয়ে, হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে ঈষৎ হাঁপাচ্ছে কিঞ্জল।

- এতো দেরি করলি ? আমি তো সেই কখন থেকে ওয়েট করছি !!
- আর বলিস না, অফিস থেকে বেরোতে যাবো, অমনি বসের জরুরী তলব। তড়িঘড়ি একটা কাজ            মিটিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছি।
- হুমম, যত কাজ তোর, আর আমার সময়ের কোনো দাম নেই না ?
- বুঝিসই তো, প্রাইভেট কোম্পানি, হুট্ করে বেরোনোটা খুব চাপের হয়। নেহাত অফিসটা পাশেই, তাই   কিছুক্ষনের জন্য ম্যানেজ করতে পেরেছি।  যাইহোক...... বল, হঠাৎ ডেকে পাঠালি ?
- হ্যাঁ, কথা ছিল। বাবা ফোন করেছিলেন কাকুকে গত রাত্রে, জানিস নিশ্চই ?
- হ্যাঁ, জানি তো।
- বিয়ের ডেটটা খুব সম্ভব নভেম্বরেই ফিক্সড হচ্ছে।
- হ্যাঁ, সেটাও জানি........তো ?
- আঃ, তুই ব্যাপারটা বুঝছিস না ! আমার কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে ভেতর ভেতর।
- হ্যাঁ, এরকমটা হয় বটে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে....... তো ?
- ধ্যাৎ ! কি তো তো করছিস তখন থেকে ? এরকম একটা ইম্পরট্যান্ট ইস্যু, আগের থেকে একটু ভাবা     দরকার কিনা আমাদের ? তা নয়, শুধু ইয়ার্কি !
- হাহাহাহাহা, দ্যাখ রায়া, এতো টেনশন করছিস কেন ? আমাদের বাবা মায়েরা তো অনেকদিন আগে  থেকেই জানেন আমাদের সম্পর্কটা, তাঁরা তো কোনো আপত্তি করেননি কখনোই, তাই না ? আর  তাছাড়া আমরা ছোটবেলার বন্ধু। দুজনে দুজনের বাড়ির লোকদের খুব ভালো করে চিনি। ফলে  কোনো সমস্যা হবে না দেখিস। আমি বলছি তো, দ্যাখ সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, শুধুশুধু টেনশন করিস  না ওতো।
- তুই জানিস নারে কিনু, আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে জানিস আজ সকাল থেকে, একটা চাপা      অস্বস্তি............বুকের মধ্যে কেমন যেন....... মানে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না তোকে, কিন্তু কেন  যেন আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে......... ভয়ঙ্কর কিছু একটা !
- ধুর পাগল ! ওসব ভাবিস না তো। তারচেয়ে বরং চল, আমরা একটু শপিং করে নিই, হাতে আর মাত্র     কয়েকটা দিন......
- নাহ ! আমার এখন এসব কিচ্ছু ভালো লাগছে না, আমি কোত্থাও যাবো না........
- সে কিরেএএ !! তোর শপিং এ অনীহা ! আমি তো ভাবতেই পারছি না মাইরি !
- হ্যাঁ, আজ বাদ দে, অন্য কোনো একদিন যাবো, আজ মোটেই ইচ্ছে করছে না।

ভারী অবাক হয় কিঞ্জল। সচরাচর এমনটা দেখেনি সে, শপিং বলতেই যে এক পায়ে খাড়া হয়ে যেত সে আজ যেতেই চাইছে না কোথাও !

-দ্যাখ, তুই যদি না যাস তবে আমি চললুম অফিসে, খামোকা এখানে বসে থেকে থেকে আমার  কাজগুলো হ্যাম্পার হবে। এমনিতেই বিয়ের কাজে টুকটাক ছুটি নিতে হবে, তারওপর লম্বা ছুটি তো  আছেই পরে। তাই এখন কোনোরকম ফাঁকি মারাটা এফোর্ড করতে পারবো না, সিরিয়াসলি !
- ঠিক আছে, তুই যা অফিস। অন্য কোনো একদিন বেরোবো না হয়।
- বোঝো ঠ্যালা ! কি হলো বলতো তোর ? শরীর ঠিক আছে তো ?
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, আমি বরং একটু বসি এখানে, তারপর চলে যাবো।
- তুই সিওর ? যাবি না তো তাহলে ?
- হুমম।
- বেশ, আমি আসছি, সাবধানে বাড়ি যাস, দেখি সন্ধের দিকে যদি একবার তোর বাড়িতে ঢুঁ মারতে            পারি।
- আচ্ছা।

হাত নেড়ে কিঞ্জলকে টাটা করে দেয় রায়া। যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো, অফিসের তাড়ায় ঠিক তেমনই ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায় কিঞ্জল। গেট অবধি চোখ যায় রায়ার, কিঞ্জল চলে যেতেই মুখ ঘুরিয়ে লেকের জলের দিকে তাকায় সে। দমবন্ধ ভাবটা কাটছে না কিছুতেই। বাঁদিকে তাকাতেই আবার একপ্রস্থ চোখাচোখি হয় সেই বৃদ্ধের সাথে। ঘোলাটে চাউনির সাথে এবার যোগ হয়েছে কিঞ্চিৎ পরিহাস। কিছু বুঝে উঠতে পারে না রায়া। দোনোমোনো করে উঠে পরে বেঞ্চটা থেকে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বৃদ্ধের দিকে। ভালো করে জরিপ করে নেয় আপাদমস্তক। সত্তরের আসেপাশে বয়েস হবে। উস্কোখুস্কো সাদা চুল, কাঁচা পাকা দাড়ি, পুরোনো সুতির পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত বৃদ্ধের সারা শরীর জুড়ে অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতার ছাপ। মুখের বলিরেখায় দৃঢ়তার চিহ্ন স্পষ্ট। অনাবশ্যক কৌতূহল জাগে রায়ার।

- কি ব্যাপার বলুন তো ? আমি দেখছিলাম আপনি সমানে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আপনি কি       কিছু বলবেন ?

একটা শান্ত, স্মিত হাসি খেলে যায় বৃদ্ধের মুখজুড়ে, ধীরে ধীরে ঘোলাটে দৃষ্টিটা পরিষ্কার হয়। একটু কেশে, চোখ তুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করেন রায়াকে। তারপর পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলেন, 'বোসো'। কৌতূহলের বশে বৃদ্ধের পাশে বসে পরে রায়া, সামান্য দূরত্ব রেখে। ভাঙা গলায় খুব আস্তে আস্তে শুরু করেন তিনি।

- তোমায় দু একটা কথা বলার ছিল মা, অবশ্যি তোমার যদি সময় থাকে কিছুটা।
- কি ব্যাপারে ? মানে আমি তো ঠিক.......
- বলছি, বলছি, তার আগে তোমার নামটা বলো দেখি.......
- রায়া..........রায়া সেনগুপ্ত।
- হুমমমমম,........ (সামান্য দম নিয়ে) খুব মন দিয়ে শোনো মা। আমি যা বলছি সেটা বিশ্বাস করা একটু   কঠিন হবে, তবে একটুও মনগড়া কিছু বলছি না এটুকু জেনে রেখো।

রায়া এবার একটু নড়েচড়ে বসে বেঞ্চিটায়। বাঁ হাতটা চিবুকের তলায় রেখে একনিষ্ঠ শ্রোতার মতো বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিস্পলক। বৃদ্ধ কম্পিত স্বরে বলে চলেন........

- খুব টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ তুমি মা। তোমার গ্রহকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এর অবিশ্যি দু একটা কারণ আছে বটে, তবে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তোমার হবে না। তাই আমি পরামর্শ দেব, তুমি একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো রাস্তাঘাটে। গ্রহরাজের প্রকোপটা বড় বেশি পড়েছে এই সময়টাতে। তোমার নক্ষত্রেরা অন্য পথে ছুটতে শুরু করেছে,....... অর্থাৎ..... একটা ভীষণ রকমের গোলমাল হতে পারে যখন তখন। সুতরাং খুউউব সাবধাআন ! সামনে তোমার চরম বিপদ !! তুমি হয়তো জানো না, সে বিপদ ছায়ার মতো তোমার সাথেই ঘোরাফেরা করছে সর্বক্ষণ। একটু অন্যমনস্ক হয়েছ কি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। তখন কিন্তু আর রক্ষে থাকবে না। তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না, এই আমি বলে দিলুম হ্যাঁ।

চোখের পলক পড়ে না রায়ার। হ্রদের জলে বিকেল মিশে এসেছে অনেকটা। ঘরের ফেরার তাড়াহুড়োয় একঝাঁক পাখি কিচিরমিচির করতে করতে  উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ধীর লয়ে বহুদূর থেকে কোনো এক ঠান্ডা অথচ মৃদু হাওয়া বইতে থাকে। জলের ওপর ছোট ছোট তরঙ্গের রেখা আঁকা হয়ে যায় অচিরেই। হঠাৎই একটু শীত শীত করতে থাকে রায়ার। খানিক থমকে, সমস্ত জড়তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে গলা খাকারি দেয়। তারপর বলে,

- এসব কি আবোলতাবোল বকছেন বলুন তো ? আমার বিপদ ! হঠাৎ আমার বিপদ কেন হতে যাবে ?     আর আপনি কে, বলা নেই কওয়া নেই আমায় আজগুবি গল্প শোনাচ্ছেন।
- হাহাহাহা, আমি তো প্রথমটাতেই বলেছিলুম যে তোমার বিশ্বাস হবে না, অথচ তুমিই জানতে চাইছিলে আমার কিছু বলার আছে কিনা।

চোখের কোণে কৌতুক খেলে যায় বৃদ্ধের। কিন্তু পরমুহূর্তেই চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে, দু চোখের দৃষ্টি পাল্টে যায় এক লহমায়। ঘড়ঘড়ে গলায় বলে ওঠেন, "শোনো হে খুকি ! আমি হলুম জ্যোতিষ কালীপ্রসাদ মুখুজ্জে, শহরের নামি দামী জ্যোতিষীরা আমার নাম আউড়ে, মনে মনে পেন্নাম ঠুকে তবে গণনার আঁক কষতে বসে, আমার বিধান ইস্পাতের ফলার মতোই কঠিন এবং দৃঢ়। যা বলে এসেছি তার একচুলও নড়চড় হয়নি কোনোদিন, তার অন্যথা আজও হবে না জেনে রেখো। তোমায় সাবধান করা উচিত বলে মনে হলো, তাই বললুম, বিশ্বাস করা না করাটা তোমার ব্যাপার, বিপদে যখন পড়বে তখনই টনক নড়বে দেখছি"।

হাঁ হয়ে যায় রায়া, কোনো কথাই জোগায় না মুখে, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বৃদ্ধের মুখের দিকে। ওনার কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনি হতে থাকে কানের মধ্যে। কোনো মতে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা আমার যে বিপদ তা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন"?
এক চিলতে হাসি খেলে যায় কালীপ্রসাদের দাড়িগোঁফের ফাঁকে।
-আমি জানতুম, তুমি এই প্রশ্নই করবে। একটু পরীক্ষা করে নিতে চাইছ, তাই তো ? আচ্ছা বেশ, তোমার জন্ম তারিখটা বলো.....
- ১৯শে আগস্ট ১৯৮৯।
-  আর জন্ম সময়টা...... মনে আছে কি ?
- খুব সম্ভব..... সকাল আটটা পয়ঁত্রিশ।
- বেশ.....

দুপা জড়ো করে সটান বাবু হয়ে বসেন কালীপ্রসাদ, দুটো হাত রাখেন কোলের ওপর, তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেন। বিস্ময়ে হতবাক রায়া নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধের দিকে। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কাটে, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খোলেন উনি। রায়ার দিকে এক অদ্ভুত রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, "শিবরামপুরে তোমাদের একটা জমি আছে সেটা নিয়ে বিস্তর ঝামেলা হচ্ছে কমাস ধরে........... গত কয়েকদিন যাবৎ তোমার মা বেজায় কোমরের ব্যাথায় ভুগছেন...........গতকাল সন্ধে থেকে তোমার ভাইয়ের জ্বর হয়েছে...........আজ সকালে বাড়ির সদর দরজায় পিছলে পড়ে গেছিলে তুমি............দুপুরে খাওয়ার সময় তোমার বাবার গলায় ইলিশ মাছের কাঁটা ফুঁটে যায়............ তোমার সাধের মিনি বেড়ালটা আজ দুদিন হলো বেপাত্তা..........
কি ? আরও  বলব, নাকি এতেই যথেষ্ট মনে হচ্ছে" ?

বিস্ফারিত চোখে রায়া তাকিয়ে থাকে কালীপ্রসাদের দিকে। শব্দগুলো জিভের সাথে জড়িয়ে যায় মুখের ভিতর। চোখের সামনে লেকের চারপাশটা দুলে ওঠে কেমন যেন। কোনো মতে আমতা আমতা করে জড়ানো স্বরে বলে, "আপনি কি করে এসব.........!!! মানে আপনাকে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না, অথচ আপনি গড়গড় করে সমস্ত কিছু............ কিভাবে !!!  এ, এ  কেমন করে সম্ভব ??
- কালীপ্রসাদের কিছু দেখতে শুনতে লাগে না মা........ নিখুঁত,নির্ভুল গণনায় বরাবর আমি সিদ্ধহস্ত।

রায়ার ঘোর কাটে না কিছুতেই, কেমন নেশার মতো বুঁদ হয়ে কালীপ্রসাদের কথা শুনতে থাকে অবিচল। কালীপ্রসাদ বলেন, "সে যাইহোক, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যাটা হলো তোমার বিপদ, যে অজান্তেই তোমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, একটা ভুল পদক্ষেপ আর তুমিও তোমার বন্ধুর মতো......."
- আমি ঠিক বুঝলাম না.......আমার বন্ধু.... ? মানে ?
এদিক ওদিক সন্তর্পনে তাকিয়ে গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন কালীপ্রসাদ, "তোমায় ডাকছে রায়া, তোমার বন্ধু তোমায় ডাকছে......... তুমি সাড়া দিলেই বিপদ !!........"
- আপনি কি বলছেন......... আমি ঠিক.......
- কেন ? তোমার ছোটবেলার বন্ধু.........তোমার হবু স্বামী.......কিঞ্জল !!
- কিঞ্জল ?? কেন......কিঞ্জলের কি হবে !!
- কিঞ্জল যে তোমায় ডাকছে মা ! বহুদূর থেকে বারেবারে সে যে ডেকেই চলেছে তোমায়.......সে ডাক অগ্রাহ্য কোরো তুমি, নাহলে আর বাঁচবে না কিছুতেই......
- এ আপনি কি বলছেন ?? দুদিন পর যার সাথে আমার বিয়ে, তাকে অগ্রাহ্য করতে বলছেন ?? শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায় রায়ার।
"এ বিয়ে তো হওয়ার কথা নয় মা, অশরীরীর সাথে বিয়ে তো হয় না কোনো মানুষের..........." ঠান্ডা গলায় বলেন কালীপ্রসাদ। একটা পেঁচা ডানা ঝাপটিয়ে চলে যায় এগাছ  থেকে ওগাছে।

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পরে রায়া। রেগে যায় প্রচন্ড। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, "এবার কিন্তু আপনি বড্ডো বাড়াবাড়ি করছেন মশাই, অতীত, ভবিষ্যতের কথা জ্যোতিষীরা মিলিয়ে দেয় বটে, তবে এটা আপনি যা বললেন তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না"।
-আমি কোনো কথাই এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না............টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আজ দুপুরের পথ দুর্ঘটনায় তোমার কিঞ্জল.............

"না-না-নাআআআ", এক মরমী, গগনভেদী চিৎকার করে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে তোলে রায়া। "এই তো কিছুক্ষন আগেই আমার সাথে দেখা করে গেল........আর আপনি বলছেন........না না, এ হতে পারে না, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন, এ সমস্তটাই আপনার ভণ্ডামি, সস্তার ট্রিক্স দেখিয়ে টাকা কামানোর উপায় ফেঁদে বসা, আমি এসব বুঝি না ভেবেছেন ??
-ঠিকই বলেছো, কিছুক্ষন আগে যে তোমার সাথে দেখা করে গেল সে কিঞ্জলই বটে, তবে রক্তমাংসের নয় এটুকু হলপ করে বলতে পারি। আর সে তোমায় নিয়ে যেতে এসেছিলো তার সঙ্গে করে, তোমার ভিতরের চাপা অস্বস্তিটাই তার পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলে। তবে বিপদ দূর হয়নি এখনো। সে আবার আসবে.............
- কিঞ্জলের যদি কিছু হতো তাহলে আমার কাছে ফোন আসতো সবার আগে। কই তেমন তো কিছু আসেনি এখনো।
- তোমার ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই......... পরখ করে দেখতে পারো।

তাড়াহুড়ো করে কাঁধের ব্যাগের চেন খুলে ভিতর থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে রায়া, তড়িৎ গতিতে আঙ্গুল চালায় কিপ্যাডে, পরক্ষনেই বুকটা কেঁপে ওঠে ধড়াস করে...................
ফোনটা সুইচড অফ !!.............. এক অব্যক্ত আতঙ্ক নিয়ে তাকায় কালীপ্রসাদের দিকে। কালীপ্রসাদ মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, "কি......আমার কথা মিলল তো" ?

গলা শুকিয়ে আসে রায়ার, পেটের ভিতর থেকে কে যেন জিভটাকে ভিতর দিকে টেনে নামিয়ে আনতে চাইছে। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোয় গলা থেকে, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বলে, "কিন্তু....... ফোন সুইচড অফ হওয়াটা তো কাকতলীয়ও হতে পারে তাই না"?
-বেশ.......... এখনো যদি আমার কথা বিশ্বাস নাহয় তাহলে বরং ওই ডালমুটওলাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, সে তো এদিকটাতেই ঘুরছে অনেক্ষণ ধরে, জিজ্ঞেস করো সে তোমার কিঞ্জলকে দেখেছিলো কিনা।

হ্রদের ধার ঘেঁষে পড়িমরি করে দৌড়য় রায়া উল্টোদিকে। ডালমুটওলার সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "ভাই একটা কথা বলবে" ? ডালমুটওলা ভারী অবাক হয়ে চোখ কুঁচকে তাকায় রায়ার দিকে ।
- আমি যখন বিকেলের দিকে এই বেঞ্চিটায় বসে ছিলাম........এই যে এই বেঞ্চিটায়........ আমার পাশে       নীল রঙের চেকশার্ট পরা একটি ছেলেকে বসতে দেখেছিলে ?
- কিছু মনে করবেন না দিদি,..... মানে....... একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
- কি ?
- আপনার কি শরীরটা একটু খারাপ লাগছে ?
- আঃ...... যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তরটা দাও ভাই, আমার পাশে কি কোনো নীল রঙের শার্ট পরা ছেলেকে বসতে দেখেছো তুমি ?
রোগা ছিপছিপে ছেলেটি এক কথায় উত্তর দেয়.....  "না".........

মাথাটা ভীষণরকম টলে যায় রায়ার, চেঁচিয়ে বলে, "কি যাতা বলছো !!......... আমার পাশে কাউকে বসতে দেখোনি তুমি !!!
- না দিদি, শুধু এই বেঞ্চিটা কেন ? আপনি এই বেঞ্চিতে বসার কিছুক্ষন পরেই উঠে গিয়ে ওই দিকের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন, তারপর কি যেন সব বিড়বিড় করতে লাগলেন, কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে...........কি ব্যাপার বলুন তো দিদি !! আপনার কি শরীর খারাপ ??

এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে পিছনে দূরের বেঞ্চিটার দিকে দেখে রায়া। যেখানে কালীপ্রসাদ আর সে এতক্ষন বসে কথা বলছিলো........ আশ্চর্য !!! বেঞ্চিটা বেমালুম ফাঁকা !! হাড়হিম করা একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় রায়ার পিঠ বেয়ে। তবে কি ??........... তবে কি পুরোটাই ভুল দেখলো এতক্ষণ, মাথাটা কি তাহলে খারাপ হয়ে গেলো তার ? তবে এতটা সময় কালীপ্রসাদের সাথে এতগুলো কথা.........!!!
সবটাই কি মিথ্যে ?? একের পর এক প্রশ্ন ঝড়ের মতো তোলপাড় করতে থাকে রায়ার মনের মধ্যে। মিনমিন করে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি বলছো, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা কোনো বয়স্ক ভদ্রলোককে আমার সাথে দেখোনি ওই বেঞ্চিটায় ?
-  সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ? বয়স্ক ভদ্রলোক ? আচ্ছা কাঁচা পাকা দাড়ি আর উস্কো খুস্কো চুল ছিল কি ??
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছো একদম......তুমি চেনো তাকে ?
- আমি চিনিনা বটে, তবে এক বিখ্যাত জ্যোতিষী কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওখানে এসে বসতেন বরাবর, অনেক লোকজন আসতো, প্রচুর আড্ডা হতো। দারুন নামডাক ছিল ওনার, কিন্তু উনি তো বেশ কিছুদিন হলো মারা গেছেন শুনেছি, টিবি হয়েছিল খুব সম্ভব। কেন বলুন তো ?

মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে রায়ার। কোনো দিশা পায়না কোথাও, চোখের ওপর ঘন কুয়াশার মত অন্ধকার ঘনিয়ে আসে ধীরে ধীরে ...... এ কি করে সম্ভব !! এ কি করে.........!!!!
হঠাৎ মোবাইলটা  বেজে ওঠে এক তীব্র আওয়াজ করে........সুইচড অফ ফোন বাজছে কি করে ?
এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে খেতেই স্ক্রিনের ওপর চোখ চলে যায়..........স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠেছে...... "কিঞ্জল কলিং" !!
দড়াম করে মাথা ঘুরে পড়ে যায় রায়া মাটির ওপর। মোবাইলটা বেজেই চলে একনাগাড়ে...............          

ছবি: গুগল 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #thrill #murder #mystery #astrology #bengalighoststories