Saturday, April 29, 2017

এ মণিহার

স্রোতের অভিমুখে চলা এক আর স্রোতের বিপরীতে চলা আরেক। আমি সাধারণ, নির্ঝঞ্ঝাট, নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয় একজন। জলে নামতেই ভয় পাই, সাঁতরানো তো দূর। দশটা ছটা অফিস করি, সংসারের নিয়ম মেনে কিছু কাজ করি আবার কিছু করিও না। মাজি-মধ্যি এলার্জি হলে ঘাড় মুখ গুঁজে কলমের আঁচড় কাটতে থাকি। সে আঁচড়ের দাগে কখনো গল্প, কখনো কবিতা আবার কখনো ছাইপাঁশ তৈরী হয়। সেসব জড়ো করে লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে ফেসবুক ও ব্লগের দেওয়ালে পোস্টারের মতো সাঁটিয়ে দিই। গুণীজনরা সেসব পড়েন, ভালোবাসেন, সমালোচনা করেন, উৎসাহ দেন, কেউ বিরক্ত হন আবার কেউ এড়িয়ে যান। এহেন লোকের কাছে যদি ছোটবেলার স্কুল টিচারের মেসেজ আসে তবে ঘাবড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয় বৈকি। মনে হতে থাকে এইরে ! নীল ডাউন হবার মতো কিছু করলাম নাকি ? অবশ্য ওতে আমি ভয় পাইনা মোটে। ওসবে যথেচ্ছ অভিজ্ঞতা আছে আমার। শুধু বুড়ো বয়েসে লোকে পোলাপান বলে হাসবে, ওতেই যা এট্টু মানহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ফোন করে তিনি যা বললেন তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছের আবডালে উঠে স্থির হয়ে জিরোচ্ছিল বেশ কিছুক্ষন। খানকতক চড়াইপাখি বনবন করে ফ্যানের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার চারপাশে। দুচারবার বিষম খেয়ে বুঝতে পারলুম নবনালন্দার সুবর্ণজয়ন্তী ম্যাগাজিনে আমার "নব নালন্দা ডট ইস্কুল" লেখাটা চাইছেন।

কি আশ্চর্য !........ যে স্কুলের ম্যাগাজিন ছোটোর থেকে বরাবর হাতে নিয়ে পড়ার অভ্যেস ছিল সেই স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী প্রকাশনায় আমার লেখা ? বিশ্বাস হয়নি প্রথমটায়। সেজন্য অনিরুদ্ধ স্যারকে দুয়েকবার ফোন করে বিরক্তও করেছি। হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন সমস্ত কিছুর। হঠাৎ করে যেন কোনো এক নাম না জানা নদী কুলকুল করে বয়ে গিয়েছিলো বুকের মধ্যে দিয়ে। সেই জলের সুরে আমার আহ্লাদ, আনন্দ, নষ্টালজিয়া প্রভাত বীণার মতো বেজে উঠেছিল। অনুরণনে ছড়িয়ে পড়েছিল মুগ্ধতার বেরোখ উচ্ছাস। কেবলই মনে হয়েছিল, ছুটে যাই একবার, দেখা করে আসি সবার সাথে। ছোট ছোট কাঠের বেঞ্চিগুলোয় পিঠ ঠেকিয়ে আয়েস করে বসে গল্প জমাই। পাকেচক্রে কিছুতেই হয়ে উঠলো না, সেজন্য আমি আন্তরিক লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। প্রতিশ্রুতি রইল, একদিন প্রপার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে স্কুলে গিয়ে দেখা করে আসবো। আর অনিরুদ্ধ স্যারকে শুকনো ধন্যবাদ দেব না। আমার জীবনে অন্যতম আনন্দঘন মুহূর্তের কারণ আপনি, ঋণী হয়ে রইলাম চিরতরে..........। মাঝে মধ্যেই ফোন করে বিরক্ত করব আবার। সম্পাদক মণ্ডলীর সমস্ত আন্টি, স্যার এবং গোটা পরিচালন পর্ষদকে আমার আজানু প্রণাম ও অফুরান ভালোবাসা। 

পুনশ্চ : "নব নালন্দা ডট ইস্কুল" যদি কেউ পড়তে চান তাহলে আমার ব্লগের ডান দিকে 'জনপ্রিয় পোস্ট' কলামটির শীর্ষে দেখুন। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি এই লেখাটিতে এখনো পর্যন্ত প্রায় চারহাজার ভিউজ হয়েছে।
চিত্র : নিজস্ব 

চিত্র : নিজস্ব 

চিত্র : নিজস্ব 

#bengaliarticle #oldschool #schoolmemories #nostalgia #navanalanda #navanalandaalumni #schoolmagazine #goldenjubilee

Tuesday, April 18, 2017

সাপ্তাহিকী ২৬ # গুপ্তপ্রাণ


বিকেলের আলো নিভে গেছে অনেক্ষণ। দাওয়ার ওপর জামরুল গাছের ছায়ায় সন্ধ্যে নেমেছে। বাঁশ বেড়ার ওপার থেকে গুটিকয়েক বাড়ি থেকে বসন্তের হাওয়ায় শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে। 

পায়ে পায়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন ইন্দিরা। শাঁখের আওয়াজে হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন তুলসী মঞ্চের সামনেটায়। 

মাটির ওপর ধূপকাঠি পুঁতে হেঁটে হয়ে মাথা ঠেকালেন মঞ্চের কারুকাজ করা ধাপিতে। বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে আরেকদফা হাত জড়ো করলেন কপালে। 

অকস্মাৎ, সাঁৎ করে যেন একটা ছায়ামূর্তি সরে গেলো উঠোনের পশ্চিম দিকে। অন্ধকারে ঠাহর করতে পারলেন না ইন্দিরা। 

তবু অভ্যাসবশে হাঁক পেড়ে বললেন, 'কে এলি ? বিশু নাকি' ? যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে জিভ কেটে প্রকট হল আলোয়।

ইন্দিরা তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, 'আচ্ছা বিশু, কতবার তোকে বলেছি যে এমন ভর সন্ধেবেলা গেরস্থের বাড়ি পা টিপে টিপে ঢুকবি নে, তাও আবার পশ্চিমের পাঁচিল টপকে। কথা কিছুতেই কানে যায়না দেখি তোর' !! 

বিশু অত্যন্ত কুন্ঠিত হয়ে জবাব দিল, 'আজ্ঞে মাঠাকরুণ, পত্যেকবার ভুল হয়ে যায়, এতোদিনকার অভ্যেস তো, কিচ্ছুতে মনে থাকে না'।

- 'হুঁ, তোর ভুলের ঠেলায় বাড়ির একটা অকল্যাণ হোক আর কি, তাই কি চাস তুই' ?

বিশু একথায় প্রায় মাটিতে মিশে যায়, একহাত জিভ বার করে বলে, 'ছি ছি মাঠাকরুন, অকল্যাণ আপনার হতে যাবে কেন, হোক আপনার শত্তুরের। তাছাড়া আমি থাকতে কেউ সাহস করুক তো দেখি' ! 

বিশুর ডেঁপমি দেখে হেসে ফেলেন ইন্দিরা, বলেন, 'ওই তো তোর সিড়িঙ্গেপানা চেহারা, তুই কোন কাজে লাগবি আমার ? তোর যত বাতেলা ওই মুখেই.......'

সেকথায় বিশু গলার তেজ চড়িয়ে বলে, 'মাঠাকরুণ, আমার বাপ ছিল হারু ডাকাত। বাবার ভয়ে তাবড় জমিদাররা ভয়ে জুজু হয়ে থাকতো, এক হাঁকে সাতগাঁয়ের লেঠেলদের মুখের রক্ত সরে যেত। মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে, কপালে শ্মশান কালীর তিলক লাগিয়ে যখন ওই পাহাড়ের মতো শরীরটা নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতো, ভয়ে মুচ্ছ যেতে দেখেছি অনেককেই। আমি সেই হারু ডাকাতের ছেলে, চেহারাটা না থাকলে কি হবে, শরীরে তেনার রক্তই তো বইছে। 

ইন্দিরা বললেন, 'সে নাহয় বুঝলুম, তা তুই ওমনধারা কাজ করিস কেন বাপু ? যার বাপ নামকরা ডাকাত ছিল সে এমন রাত বিরেতে ছিঁচকে চুরি করতে বেরোয় কেন বল দিকি ? এতে কি তোর বাপের মান থাকে' ?

ইন্দিরার কটাক্ষে বিশু মিইয়ে যায় খানিক। 

আমতা আমতা করে বলে, 'আজ্ঞে, সবই তো জানেন মা, উনি সেই যে নিঁখোজ হলেন তারপর তো দলটাই ভেঙে গেলো। যে যার মতো ছিটকে গেল এদিক ওদিক। দু চারটেকে পুলিশ পাকড়াও করলে আর পাড়ার লোকে আমাকে দূর করে দিলে আমার ভিটে থেকে। কাজের চেষ্টা করেছিলুম দিনকতক কিন্তু নামের জন্য কেউ আমায় রাখতে চাইলে না। কি করব মা, পেটটা তো চালাতে হবে, তাই আর উপায় না দেখে এই কাজে নেমে পড়লুম'। 

'তা এইসব করে চলে যায় তোর' ? ইন্দিরা কোমল স্বরে জানতে চান।

- রোজ কি আর চলে মাঠাকরুণ, বড় হাত আর মারতে পারি কই, সবাই সেয়ানা হয়ে গেছে, এমন এমন জায়গায় মালপত্র লুকিয়ে রাখে ঘরের মাছি পর্যন্ত জানতে পারেনা। আমি তো কোন ছার। তাছাড়া ধরা পড়লে হাটুরে ঠ্যাঙানি তো আছেই। এই তো গেলো বিষ্যুৎবার, তপেন স্যাঁকরার টেবিলের ওপর থেকে একশো টাকার নোটটা প্রায় নিয়ে ফেলেছিলুম জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে। তাড়াহুড়োয় হাতটা বের করতে গিয়ে ঠক করে লেগে গেলো গরাদে। অমনি তপেন কোথা থেকে এসে খপ আমার হাতটা ধরে এক পেল্লায় গাঁট্টা মেরে আমার বহ্মতালু গরম করে দিলে একেবারে ! বলি, তোর তো স্যাঁকরার ব্যবসা, অমন একটা একশো টাকার নোটের জন্য এই ডাকাত সন্তানের গায়ে হাত তুললি ? ধম্মে সইবে তো তোর' ?

ইন্দিরা বিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন। নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। মেধাবী ছাত্র, কলেজ শেষ করে সেই যে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলো আজ দশ বচ্ছর হয়ে গেছে সে গ্রামের মাটিতে পা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। সময়ের শরীর বেয়ে স্মৃতিটুকু লেপ্টে থাকে শুধু, যোগাযোগের সূত্রটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। তবু স্নেহের আঁচলের ঘের কম পড়েনি ইন্দিরার। বিশুকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন। সময় অসময় বিশুর সাথেই গালগল্প করে দিন কাটে তাঁর। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশুকে জিজ্ঞেস করেন, 'খেয়েছিস কিছু ? মুড়ি খাবি চাট্টি' ? 

বিশু গদগদ হয়ে বলে, 'তা আপনি দিলে কি আর আপত্তি করতে হয় মাঠাকরুণ, তবে কিনা দুটো লঙ্কা আর পেঁয়াজ দেবেন সাথে, মুখটা ছেড়ে যায় তাহলে'। 

স্মিত হেসে হেঁসেলের দিকে পা বাড়ান ইন্দিরা। মৃদু হাওয়ায় বিশু আয়েস করে বসে উঠোনের একপাশে।

হঠাৎ রে রে করে চারজন ষণ্ডামার্ক লোক ঢুকে পড়ে বেড়ার দরজা খুলে। বিশু ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। 

সবারই প্রায় পেটানো চেহারা। চোখে মুখে আগুন জ্বলছে যেন। কোমরে গোঁজা ছুঁচোলো অস্ত্রের বাঁটগুলো জামার আড়াল থেকে উঁকি মারছে। এছাড়া হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আছে লাঠি, দা, কোদাল। উঠোনের মাঝবরাবর এসে চারজনেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিশুর দিকে। 

তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বিশুর কাঁধে হাত রেখে আগুনদৃষ্টি হেনে বলে, 'কি রে.....চিনতে পারছিস' ? 

বিশু থতমত খায় খানিক। তারপর ভালো করে ঠাহর করে বলে, 'মনোহর দাদা না' ? 

পাকানো গোঁফের নিচে এক ঝলক হাসি খেলে যায় মনোহরের ঠোঁট ঘেঁষে। বলে, 'চিনেছিস তাহলে ?

- কি যে বলো ! বাবার ডান হাত ছিলে যে তুমি, আর তোমায় চিনব না গো ?

- তা ভালো, তাহলে তো সুবিধেই হল.......

বলেই মনোহর আড়চোখে তাকিয়ে নেয় তার বাকি সঙ্গীদের দিকে। 

বিশু মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে, কিসের সুবিধে' ? 

মনোহর ফিসফিস করে বলে, 'বুড়ি কি ঘরের ভেতর নাকি' ?

-কে ? মাঠাকরুন ? হ্যাঁ তিনি তো ঘরের ভিতরেই আছেন, আমার জন্য মুড়ি আনতে গেছেন কিনা........

একথায় হো হো করে হেসে ওঠে মনোহর ও তার সাগরেদরা।

- এক্কেবারে মা ছেলের সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েচিস দেখছি, হ্যাঁ ?....ভালো ভালো, তোর বুদ্ধির তারিফ করতে হয় রে বিশু ।

মনোহরের কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না বিশু, বোকার মতো মুখের দিকে চেয়ে থাকে। 

মনোহর আবার বলে ওঠে, 'শোন, ওই তুলসী মঞ্চের তলায় যে হারু কাকা ঘড়া পুঁতে গেছে সে খবর আমরাও পেয়েচি, বুঝলি ? তাই পুরো মালটা একা হাতাবি সেটা মোটেও ভাবিস না'। 

বিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, 'তুলসী মঞ্চ !! ঘড়া !! কি বলছ মনোহর দাদা......আমি তো কিছুই.......'। 

বিশুকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে মনোহর কর্কশ গলায় বলে ওঠে, 'ন্যাকা সাজিস নে বিশে, হারু কাকা নিরুদ্দেশ হবার আগে ওখানে যে ঘড়াটা পুঁতে রেখেছিলো সেইটে নিতে এসেছি আজ। ওতে আমাদের সকলের হিস্সা আছে, এটা ভালো করে বুঝে নে, নাহলে...........'।

'কার সাথে কথা বলছিস বিশু ? কে এসেছে রে' ? ইন্দিরা মুড়ির বাটি নিয়ে বাইরে আসেন। 

উঠোনের মাঝখানে কজন ভীমকায় পুরুষ দেখে কাঠ হয়ে যান এক লহমায়। ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'কে তোমরা বাছা, বলা নেই কওয়া নেই একেবারে দোর খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েছ' ? 

'আমরা আমাদের জিনিস নিতে এসেছি, পেয়ে গেলেই চলে যাবো', ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় মনোহর।

ইন্দিরা সে রক্তবর্ণ চোখের দিকে তাকাতে পারে না, বিশুর দিকে ফিরে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করেন, 'ও কি বলছে বিশু ? কে ও ? তুই চিনিস নাকি' ? 

বিশু বলে, 'আজ্ঞে, ও মনোহর দাদা, বাবার দলে ছিল। বলছে বাবা নাকি ওই তুলসী মঞ্চের নিচে কি একটা ঘড়া পুঁতে রেখেছিল, সেইটে নিতে এসেছে'। 

ইন্দিরা ভারী অবাক হয়ে বলেন, 'তুলসী মঞ্চের নিচে ঘড়া ? হারু পুঁতেছে ? কি বাজে বকছিস, তেমন হলে আমি জানব না ? আর তাছাড়া এ কবেকার তুলসী মঞ্চ, শুধু হারু কেন, কাউকেই আমি ছুঁতে দিইনি কখনো' ? 

মনোহর ইন্দিরার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, 'বাজে আমরা বকচিনে মাসিমা, সমস্ত খবর নিয়ে তবে এসেচি, তাছাড়া বিশু তো সবই জানে, কিরে বিশু ?

- আ-আমি কিন্তু সত্যি জানিনা মনোহর দাদা যে বাবা এখানে কিছু পুঁতে রেখে গেছে কিনা........

- তাই নাকি ! বেশ, তবে আর তোর জেনে কাজ নেই, এখনই তুলসী মঞ্চ ভেঙে ঘড়া তুলে নিয়ে চলে যাবো, তাহলেই সব জানতে পারবি।

ইন্দিরা মুড়ির বাটিটা ঠক করে দাওয়ায় নামিয়ে রেখে মনোহরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। 

চোখে চোখ রেখে বললেন, 'সেইটে হচ্ছে না বাপু, ওই তুলসী গাছ আমি নিজের হাতে পুঁতেছি এককালে, ও গাছ আমি উপড়াতে দেব না'। 

মনোহর দাঁত কিড়মিড় করে বলে, 'বটে ! তা কে আটকাবে শুনি ? আপনি ?

বিশু বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসে সামনে, ইন্দিরাকে আড়াল করে গম্ভীর গলায় বলে, 'না.........আমি' ?

একথায় মনোহরের দলবল অট্টহাস্য করে ওঠে। 

মনোহর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 'তাহলে বুড়িকে মেরে পুরোটাই একা হাপিস করবি ভাবচিস, তাই তো' ?

বিশু আচমকা কোথা থেকে যেন জোর পায়, হুঙ্কার দিয়ে বলে, 'উনি আমার মায়ের মতো, ওনার গায়ে হাত লাগাতে দেব না আমি, এই কথাটা ভালো করে বুঝে নাও মনোহর দাদা। উনি যখন বলচেন এখানে ঘড়া নেই, তাহলে সত্যিই নেই। মানে মানে তফাৎ হয়ে যাও, নাহলে ভালো হবে না কিন্তু........'। 

মনোহর আর সামলাতে পারেনা নিজেকে, হাতের লাঠিটা দিয়ে সজোরে চালিয়ে দেয় বিশুর মাথা লক্ষ্য করে। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় মাথা সরিয়ে সে লাঠির ধাক্কা এড়ায় বিশু,পরক্ষনেই বেড়ার ধার থেকে একটা মাঝারি মাপের মোটা বাঁশ নিয়ে চড়াও হয়ে যায় মনোহরের ওপর। 

দলের বাকিরা বিশুকে ঘিরে ধরে। ইন্দিরা ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বিশুর নিপুণ লাঠি চালনায় দুজন ঘায়েল হয়ে পড়ে খুব শীঘ্রই। বাকি দুজনের সাথে চরম লড়াই হতে থাকে। 

হঠাৎই তীব্র বেগে মনোহরের লাঠি বিশুর পাঁজরে আছড়ে পড়ে। বিশু যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে, টলমল করতে করতে জমির ওপর বসে পড়ে পাঁজরে হাত দিয়ে। কালক্ষেপ না করে মনোহর লাঠি ঘুরিয়ে বিশুর মাথায় মোক্ষম আঘাত করতে যায়। ইন্দিরা চিৎকার করে ছুটে এসে জাপ্টে ধরেন বিশুকে। 

মনোহরের লাঠি অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ইন্দিরার কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। মাথায় হাত দিয়ে উঠোনের ওপর লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা। বিশু আর্তনাদ করে ওঠে। হাতের বাঁশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে এসে ধরে ফেলে ইন্দিরাকে। 

ইন্দিরার কপাল বেয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকে। বিশু কোনোরকমে ধরাধরি করে দাওয়ার ওপর ইন্দিরাকে উঠিয়ে বসায়। 

মনোহর বজ্রকঠিন স্বরে বলে, 'লাঠিতে হাত পাকিয়েছিস বলে ভাবিস না মনোহরকে মাত দিবি। ওখানেই চুপ করে বোস, এর যদি অন্যথা হয়েছে তবে আর লাঠি নয়, এই ভোজালি দিয়ে তোর গলার নলিটা কেটে দিয়ে যাব'। 

বিশু বশ্যতা স্বীকার করে, দ্বিতীয়বার আর কোনো কথা বলে না। 

কাঁপা কাঁপা হাতে ইন্দিরার শুশ্রষা করতে থাকে। মনোহর চোখের ইশারায় তার সাগরেদদের তুলসী মঞ্চের দিকে দেখায়। বিনা বাক্যব্যয়ে বাকি তিনজন চটপট খুঁড়তে শুরু করে। 

বেশ খানিক্ষন খোঁড়ার পর হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ হয়। সবাই লুব্ধ দৃষ্টিতে যে যার মুখের দিকে তাকায়। বিশুও উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকে সেদিকে। মনোহরের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। 

নিজেই এগিয়ে এসে একজনের হাত থেকে কোদাল কেড়ে নিয়ে দ্বিগুন বেগে খুঁড়তে শুরু করে। কিছুটা খোঁড়ার পরই এক ভয়ার্ত শব্দ করে হাতের কোদাল ফেলে ছিটকে দুকদম পিছিয়ে আসে সে। 

পলকে বাকিদের মুখও ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে যায়। বিশু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, তুলসী মঞ্চের নিচের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। মাটির ভেতর থেকে উঁকি মারছে ফ্যাকাশে বিবর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া একটা আস্ত নরখুলি। তমসাচ্ছন্ন, ভয়াল তার চাহনি ! কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে অতীতের জমাট নিকষ কালো অন্ধকার যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চাইছে স্তব্ধ দর্শকের চোখ। 

মনোহর ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বার হয় না। 

ইন্দিরার দু গাল বেয়ে সরু জলের রেখা নেমে আসে। 

বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, 'কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত ছিল...........আমি রান্নাঘরে হাঁড়ি চাপিয়েছিলুম। এমন সময়ে উঠোনের কাছে ধড়াম করে একটা শব্দ হয়। আমি নিচে নেমে এসে দেখি হারু চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওই গোয়ালঘরের দিকটায়। ওকে দেখে আমি ছুটে যাই। পুলিশের গুলি লেগেছিলো বুকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল মাটি। বাঁচার আশা ছিল না। 

বদ্যি ডাকবো বলে চিৎকার করে উঠতেই হারু শক্ত করে আমার হাতদুটো ধরে মুখ ফুটে বলেছিলো, 'পুলিশের হাতে যেতে চাই নে রে ইন্দি.......... চিরকাল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েচি। মরার পর তারা আমার লাশ নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে, গর্ব করে বলবে হারু ডাকাতকে মেরেছে, তা যেন না হয়। তুই দেখিস। আর পারলে তোর এই উঠোনটায় আমার জন্য একটু জায়গা করে দিস, যেমন করে এতকাল.................বলেই শরীরটা একবার কেঁপে উঠেই নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিলো' ।

'আমি হারুর শেষ কথা রেখেছিলাম..........' , দুহাতে মুখ চেপে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন ইন্দিরা। অতীতের অব্যক্ত গ্লানি হু হু করে বেরিয়ে আসে তাঁর দুচোখ থেকে। 

সবাই নির্বাক শ্রোতার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নিমেষে থমথমে ভারি হয়ে যায় পরিবেশটা। মাথার ওপর দিয়ে করুণ রাতের কোনো পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়। ইন্দিরার অকপট বয়ানে মোহাচ্ছন্ন নিস্পন্দ বিশু অপলক চেয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে । 

বিহ্বলতার ঘোর কাটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখে ইন্দিরার, নরম স্বরে বলে, 'ঘরে চলুন মাঠাকরুন, অনেকটা কপাল কেটে গেছে আপনার........... রক্ত ঝরছে এখনো..............'    
 

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #saptahiki

Thursday, April 13, 2017

পয়লাবার

পয়লাবার যেদিন আমি স্কুলে
দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন লাগার ঘোর
একলা থাকার অভ্যাসটা ভুলে
প্রথম পাওয়া বৈশাখী এক ভোর।

পয়লাবার স্বাদ বসলো মুখে
হজমিগুলি বিটনুন সব কালো
মেঘলা দুপুর বিকেল আলোর সুখে
হাফপ্যান্টে কাটছিলো দিন ভালো।

পয়লাবার বৃষ্টিশহর বুক
ট্রামলাইন আর সিনেমা নাটক ভিড়
প্রথম দেখায় তুমি আমি চুপ
কালবৈশাখী সন্ধ্যারাগের মীড়।

পয়লাবার বিরহ বিষম জ্বালা
আটপৌড়ে নালিশ বাজে কানে
ছন্নছাড়া পায়ের মেপে চলা
রূপকথারা বিষাদ ডেকে আনে।

পয়লাবার পাশ ফিরল মন
বসন্তগানে কোকিল বসে দূর
শাস্ত্রমতে অমল আয়োজন
সাতপাকেতে সানাই সোহাগ সুর।

পয়লাবার পিতৃধর্ম পালন
স্কুল, কাছারি, সংসার, ডালভাত
নিয়মবাঁধা রুলটানা ক্ষণযাপন
পাহাড়, সমূদ্র, কদাচিৎ  দৈবাৎ।

পয়লাবার স্পষ্ট দেখছি আজ
বার্ধক্যের ঝাপসা ঘরের কোন
অতীত ঘেঁষা মুহূর্ত কোলাজ
একলা থাকার বৈশাখী স্পন্দন।

শহর, বাড়ি, জ্যোৎস্না ভরা রাত
নির্ঘুমজ্বর আঁকড়ে ধরে সব
পয়লাবার সুযোগ ছোঁয় হাত
পিছুটানের শৈশব কলরব।


চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব 
#poilabaisakh #bengalinewyear #bengali #bengalipoems #poetries

Wednesday, April 5, 2017

১ বছর

আজ একবছর পূর্ণ হল। দেখতে গেলে এই তো সেদিনের কথা মনে হয়। হ্যাঁ, তখন দু চার কলম পদ্য, কবিতা ও অন্যান্য অভিজ্ঞতার কথা লিখতুম বটে। যখন যেমন মনে আসতো.....গান লেখার ভারী শখ ছিল, লিখেওছিলুম খানকতক সেসময়। কিন্তু গল্প, প্রবন্ধ ? নাহ, সেসব লেখার কথা দুঃস্বপ্নেও মনে হয়নি কখনো। তবু কি করে যেন বসন্তের খেয়ালী হাওয়ার মতো আপনা আপনি কলম চলতে লাগলো। কখনো মৃদু গতিতে, কখনো কাঁচভাঙ্গা ঝড়ের দাপটে। কালির নদীপথ পেরিয়ে গল্পের মোহনা ছুঁয়ে কখন যে সাহিত্যের সমুদ্রে ঝাঁপ দিলুম মনে পড়ে না। হয়তো এর শিকড় খুঁজতে গেলে দেখা যাবে ৩০শে মার্চ ২০১৬য় এই কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনাই এর মূল কারণ। সেবার সংবাদ মাধ্যমের চ্যানেলে চ্যানেলে আমরা লাইভ দেখেছিলাম মৃত্যুর মিছিল, আর্তের হাহাকার, কংক্রিটের ছাদের তলায় প্রতি মিনিটে পিষে যাওয়া শেষ প্রাণটুকুর নিস্পন্দ আর্তনাদ। আর দেখেছিলাম উদ্ধারকার্যে দলে দলে বিবিধ মানুষের তৎপরতা, আগুপিছু না ভেবে পাথরের আড়াল থেকে খুঁজে বের করা প্রাণের শেষ আধার, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া হাতের দিকে জলের বোতল বাড়িয়ে দেওয়ার অন্তিম চেষ্টা। পোস্তা ব্রিজের ভগ্নাংশে তখন রাজদণ্ড সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক কষছে। প্রতিবাদের ঝঞ্ঝা বয়ে গিয়েছিলো শহরের বুকের ওপর দিয়ে। মনে হয়েছিল আমারও কিছু করা প্রয়োজন, যে করেই হোক যতটুকু সামর্থের মধ্যে পড়ে। সেই লিখতে শুরু করি। কিন্তু সে লেখা যে কখন চেতনার কানাগলি ছুঁয়ে গল্পের ছাঁচে গড়ে  উঠেছিল বুঝে উঠতে পারিনি। পুরোটা লেখার পর মনে হল, বেশ হয়েছে, এমনটাই তো চেয়েছিলুম। অস্ত্র নিয়ে ছুটে যেতে না পারি, বাকিদের সাথে বিদ্রোহের পতাকাটা তো চেপে ধরে রাখতে পারি। 

পোস্ট হল আমার প্রথম ছোট গল্প - "ফেরার' । অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম......... দাদা, দিদি ,বন্ধু, আত্মীয় পরিজন, ছোট, বড় সকলে প্রশংসা করেছিলেন। সাহস জুগিয়েছিলেন।
সেই শুরু................................................. 
'সাপ্তাহিকীর' হাত ধরে একে একে বের হতে থাকল 'টিকিট' ,'পয়লা দা', 'লাইন', 'কলরব' , 'একুশ টাকা ভাড়া' ,'আড়বাঁশি' প্রভৃতি। পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো কবিতা, অনুপদ্য, প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখা। পাশাপাশি ছিল পাঠকদের নিরন্তর ভালোবাসা ও উৎসাহ । ছোটগল্প - প্রবন্ধের সাথে তাঁরা যুক্ত হতে থাকলেন এক এক করে, নিজস্ব ভাবভঙ্গিতে জীবনের সাথে সংযোগ খুঁজে পেলেন অনেকেই । আমাকে মন খুলে বললেন সেকথা। নিয়মিত আসতে লাগলো তাঁদের মন্তব্য, প্রশ্ন, সঙ্গে বিভিন্ন গল্পের ঘটনা উল্লেখ করে তার দরদী বিশ্লেষণ। এক দৈব আনন্দে কানায় কানায় ভরে গিয়েছিলো হৃদয়। বন্ধুরা ভরসা দিলেন যেমন, অভিজ্ঞরা ছোটখাট ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে কলমের ভিতটাকে আরও মজবুত করে তুললেন। ক্রমে 'মলাট' নাম দিয়ে ব্লগ খুলে ফেললুম। কল্পনার ধোঁয়া উড়িয়ে হৈহৈ করে এগিয়ে চলল গল্পের রেলগাড়ি। এক একটা স্টেশন অতিক্রম করে আজ সর্বসাকুল্যে ২৫টা ছোটগল্প বিদ্যমান যার মধ্যে ৪টা সিরিজ 'মলাটের' পেজের ডান দিকে দিব্য জায়গাজুড়ে বসে আছে। এছাড়াও ২৪টা কবিতা, ১১টা অনুপদ্য ও ১৩টা প্রবন্ধ নিয়ে 'মলাটের' ভাঁজ আরও দৃঢ় হয়েছে। আজও দেরি হলে মেসেজ আসে, 'পরের সাপ্তাহিকীটা কবে আসছে' ? এই পরম পাওয়ার সত্যিই কোনো বিকল্প নেই।

এক বছর অনেকটা সময়। এই একবছরে পেয়েছিও অনেক, হারিয়েছিও বেশ কিছু। কিছু লিখতে পেরেছি কিছু ইচ্ছে করেই লিখিনি। এমন আনন্দঘন মুহূর্তে সে লাভ লোকসান বিচার করার সময় নয় হয়তো। তবু কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে, তবু কিছু ঋণ শোধ হয়না কখনো........ 
সময় এগিয়ে চলেছে........ আমিও........একবছর আগের ফেলে আসা দীর্ঘ ছায়ার অবয়ব দেখে আজ অবাক লাগে বৈকি........ 

ভালো থাকবেন সকলে................

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengaliarticles #experience #readers #bengaliwriteups #anniversary

Tuesday, March 28, 2017

দহন

তোমার চোখে বিষের আগুন
       তীব্র দহন জ্বালো
এড়িয়ে যাবে কার সে সাহস
        সর্বনাশের কালো

স্পর্শে বাতাস তপ্ত তোমার
   উষ্ণ আবেগ মেশে
যেমন করে রাত্রি নেভায়
     স্বর্ণাভ ভোর এসে

তেমন করে দাও কথা দাও
    পুড়িয়ে দেবে তুমি
আগুন যতই বিষাক্ত হোক
     পতঙ্গ হব আমি

বিন্যাস : নিজস্ব 






















#bengalipoems #darkpoem #poetry #love #romance


Tuesday, March 21, 2017

আজ কিন্তু বিশ্ব কবিতা দিবস - সুবোধ সরকার

কবিতা আবার কোন কাজে লাগে? কবিতার কোনও সেনসেক্স হয় না, কবিতার কোনও বাজার নেই। কবিতা কি এক ইঞ্চিও উপকার করতে পেরেছে মানুষের? জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ— এই তিনটি সময়ে তিনটি ল্যাটিন শ্লোক আর তিনটি সংস্কৃত পদ্য প্রয়োজন পড়ে বটে, তবে তার জন্য একটা বিশ্ব-কবিতা দিবস? ‘ইউনেস্কো’ যখন প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন এ ভাবেই প্রশ্ন উঠে এসেছিল কবিতার বিরুদ্ধে। আড়াই হাজার বছর আগে আরও মারাত্মক কথা উঠেছিল, কবিদের নির্বাসন দেওয়া হোক। যে প্রাচীন গ্রিসে কথাটা উঠেছিল, সেই গ্রিসই ছিল ইউরোপীয় কবিতার তলপেট।

একটা পেসমেকার যেমন কাজে লাগে, একটা হুইলচেয়ার যেমন কাজে লাগে, কবিতা কি তেমন কোনও কাজে লাগে? কবিতা লিখে তো কবিরা কিছুই পান না। টাকা নেই, পয়সা নেই, মান নেই, মর্যাদা নেই। এক ভাঁড় চা আর গলায় একটা ন্যাতা ছাড়া কবিদের কপালে কিছুই জোটে না। কবি-খ্যাতি? সে-ও তো আজ আছে, কাল নেই। তা হলে পৃথিবী জুড়ে পাঁচ শতাধিক ভাষায় কেন প্রতি দিন লেখা হয়ে চলেছে কবিতা? কবিতাই কি মনুষ্য প্রজাতির আদিমতম ও আধুনিকতম শিল্প যা মুদ্রাকে, টাকাকে, ক্যাপিটালকে তাচ্ছিল্য করে এল নিঃশব্দের তর্জনি দিয়ে?

আলাবামায় পিটার বললেন— গত দশ বছর আগে আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম কালো মানুষের সুবিচার চেয়ে। তার পিছনে ছিল একটি কবিতা, মায়া এঞ্জেলু-র ‘হোয়াই দ্য কেজেড বার্ড সিঙ্গস।’ সান্তিয়াগোর রাস্তায় যেমন এক দিন পাবলো নেরুদার কবিতা শুনে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, ধর্মতলার মোড়ে যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায় শুনে পদাতিক হয়েছিল, তেমনই ‘বিদ্রোহী’ শুনে রক্ত গরম হয়নি এ রকম কোনও বাঙালি ছিল না পরাধীন ভারতে। চারশো বছর আগে শূদ্র কবি তুকারামকে খুন করেছিল মরাঠি ব্রাহ্মণেরা। তাঁর কবিতা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাণ্ডুলিপি জলে ফেলে দিলেই কি কবিতা ডুবে যায়? সারা ভারতে যে গরিব মানুষ, দলিত মানুষ উঠে এসেছেন, তার পিছনে কি তুকারামের কবিতা নেই? হার্লেম রেনেসাঁসের সময় কি ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা আগুন দেয়নি?

ছবি : আনন্দবাজার পত্রিকা 
জীবনানন্দ দাশ (ছবিতে) লিখেছিলেন ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।’ তখন পৃথিবী জুড়ে দার্শনিক থিয়োডর অ্যাডোর্নোর কথা হেডলাইন হয়ে উঠে এসেছিল। ‘আউশভিৎস-এর পর আর কবিতা লেখা সম্ভব নয়।’ গত ৬৮ বছরে কথাটি প্রায় সমস্ত কবি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু কবিতা লেখা আরও পাঁচগুণ বেড়েছে। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসুখের নাম ‘জেনোফোবিয়া’। তুমি কি আমার মতো দেখতে? তুমি কি আমার মতো কথা বলো? তুমি কি আমার মতো করে ধর্মাচরণ করো? উত্তর ‘না’ হলে আমি তোমাকে ঘৃণা করব। এই অসুখ আটলান্টিক টপকে ইউরোপ হয়ে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বা উলটোটা।

মাহমুদ দারউইশ প্যালেস্টাইনের কবি। তিনি ইজরায়েলে ঢুকতে পারতেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ণ হাইফেনের নাম প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল। তিনি সেই হাইফেন মাথা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেয়ে লিখলেন সেই কবিতা, ‘আমি এক জন আরব, আমার কার্ড নম্বর ৫০০০০, আমার চুল চারকোল, চোখ ব্রাউন, আমার আটটা ছেলেমেয়ে।’ তারপরই লিখলেন, ‘অলিভ গাছ যদি জানত তাকে কারা বড় করেছে, তা হলে অলিভ থেকে তেল বেরত না। বেরিয়ে আসত চোখের জল।’ ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইনের লেখক ওডেহর কাছে শুনেছি, এই কবিতা কত মানুষকে কথা বলতে শিখিয়েছে। আমরা তো বেশির ভাগ সময়ই কথা বলতে পারিনি। কবিতা তা হলে ভয়কে অতিক্রম করতে পারে? আতঙ্কের কাঁধে বসে কৌতুক করতে পারে ‘ইউএসএ/ হোয়্যার/ দ্য লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু।’

বেঙ্গালুরু থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার দূরে এক জন লেখককে বাড়ি ঢুকে গুলি করে গেল ওরা। বিচার হল কই? হল না বলেই তো আবার সেই কর্নাটকে অসহিষ্ণুতা রাস্তায় নেমে এল গত সপ্তাহে। লেখক যোগেশ নাকি ‘ভগবান গণেশ’কে খারাপ ভাবে দেখিয়েছেন, তাই তাঁর মুখে কালি দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চলে গেল সাত জন বাইক আরোহী।

কবিতা ফ্যাসিজমের সামনে উঠে দাঁড়িয়েছে বার বার। কিন্তু কবিতার ক’টা মাথা? দারউইশ বলছেন, কবিরা ভেবেছিলেন, কবিতা লিখে সমাজ পালটে দেবেন। দূর বোকা ছেলের দল। কবিতা লিখে কাউকে পালটানো যায় না। শুধু চোখের কোনায় একটা অশ্রুবিন্দুর অর্ধেক বেরিয়ে আসে। আর অর্ধেক থেকে যায়— দুই অর্ধেক নিয়ে মানবজাতির কবিতা। পাঁচ হাজার বছরের দুর্যোগ তাকে বিনাশ করতে পারেনি, জেনোফোবিয়া থেকে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তখনও এক জন উইলফ্রেড আওয়েন বুকপকেটে ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে যুদ্ধবিমানে উঠবেন।

সুন্দরবনের কালো মেয়েটি, কালচিনি চা বাগানের রোগা ছেলেটি যদি একটা কবিতা পড়ে উঠে দাঁড়ায়, তা হলেই কবিতা আরও পাঁচ হাজার বছর বাঁচবে। এখনও একটা কবিতা পেসমেকার, এখনও একটা কবিতা হুইলচেয়ার, এখনও একটা কবিতা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে থাকা প্রজাপতি, এখনও একটা কবিতা হলুদ লাগা মায়ের আঁচল।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ মার্চ , ২০১৭

 #anandabazarpatrika #article #worldpoetryday #bengaliarticles #jibananandadas #subodhsarkar #bengaliwriteups

Saturday, March 18, 2017

সূর্যতপা তুমি

কত শতাব্দী ধরে আকাশ মিশে গিয়েছে জলে
মেঘ জড়ো করে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ নেবে বলে
মরুপ্রান্তর থেকে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরে
আরব সাগর হতে সুগভীর পালামৌয়ের জঙ্গলে......
সূর্যতপা দেখেছি তোমায়, একবিংশ শতকের নারী
সূর্যতপা তোমায়, অল্প হলেও কি ভালোবাসতে পারি ?

তমসাবৃত, ছিন্নমুল আমি, সাধারন একজন
অট্টালিকা আকাশকুসুম, স্বল্প আয়, অল্প আয়োজন
আমার উঠোন ঘেরা ঘাসের ওপর বসত করে সুখ
পুকুরডোবা সূর্যালোকে দেখেছি তোমার আবিররাঙা মুখ
সূর্যতপা তুমি নভস্পর্শী, শত নক্ষত্রের সারি..........
সূর্যতপা তোমায়, অণুমাত্র কি ভালোবাসতে পারি ?


ছবি : গুগল 

#bengalipoetry #bengalipoems #love #romance

Thursday, March 16, 2017

সাপ্তাহিকী ২৫ # সুলভ ইন্টারন্যাশনাল

রমাপদ ভীষণ খাইতে ভালোবাসে। উৎকৃষ্ট মানের সুস্বাদু রান্না হইলে তাহার আর কিছুই লাগে না। খাবার সময় থালার পাশে চার পাঁচটি বাটি যদি না থাকে তাহা হইলে তাহার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সেদিন তাহার মনে হয় সে যেন আধপেটা খাইয়া রহিয়াছে। উত্তরোত্তর ক্ষুধা পাইতে থাকে তখন। তাহার সাধের ভুঁড়িটি গ্যাসহীন বেলুনের ন্যায় চুপসিয়া যায় যেন। এহেন রমাপদ ভদ্রেশ্বরে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছিলো। পরীক্ষার ছুটিতে তাহার স্ত্রী ও কন্যাকে যত্নসহকারে গ্যারেজ করিয়া চব্যচষ্য উদরস্থ করিয়া সে ফিরিয়া আসিতেছিল। কিয়দকাল একাকী থাকিবার প্রলোভনে রমাপদ বেশ ফুরফুরে মেজাজে ট্রেনে চাপিয়া বসিল।

ট্রেন ভদ্রেশ্বর স্টেশন ছাড়িয়া হাওড়া অভিমুখে যাত্রা আরম্ভ করিল। দুপুরের দিকে ভিড় কম থাকার দরুন রমাপদ খুব সহজেই জানলার সিট্ পাইয়া আরাম করিয়া পা মেলিয়া দিল। মনে মনে ভাবিল, প্রায় পৌনে একঘন্টা মতো লাগিবে পৌঁছাইতে, তাই দু চোখের পাতা এক করিয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতে পারিলে মন্দ হয় না। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বসন্তের মিঠে হাওয়ায় ও ট্রেনের যুগপৎ দুলুনিতে সবে নিদ্রার যোগ আসিতেছিল এমন সময় ভয়ঙ্কর রূপে রমাপদর পেট কামড়াইয়া উঠিল।

সে ধড়মড় করিয়া সোজা হইয়া বসিল। এমন তো হইবার কথা নহে। তাহা হইলে ব্যাপারখানা কি ? বলিতে না বলিতেই পুনরায় বিকট এক কামড়। নিমেষে রমাপদ ঘামিয়ে উঠিল। এ কামড় রমাপদ বিলক্ষণ চেনে। এ কোনো সাধারণ উদর পীড়া নহে। অম্বল, গ্যাস, চোঁয়া ঢেঁকুর, বুকজ্বালা কোনো প্রজাতির ব্যথার সহিত ইহার কোনোরূপ কোনোপ্রকারের মিল নাই। সকালবেলার এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে অনুরূপ ব্যাথা অনুভূত হয়। এবং সে ব্যাথা হইলেই রমাপদ বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করিতে পারে না। উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াইয়া, আট মিটারের দূরত্ব এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে অতিক্রম করিয়া এক ঝটকায় বাথরুম বন্ধ করিয়া সে কমোডের শূন্যস্থান পূরণে তৎপর হইয়া ওঠে।

তাহার পর সমস্ত ব্যাথা খালি হইলে পর সে প্রসন্নচিত্তে বাহির হইয়া আসে। কিন্তু এখন এই চলমান ট্রেনে সে কি করিবে ? কোথায় যাইবে ? কাহাকে বলিবে ? এই সমস্ত চিন্তা করিয়া ঘামিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। তাহার উপর লোকাল ট্রেন, টয়লেটের কোনোরকম বন্দোবস্ত নাই, সুতরাং রমাপদ যে নিশ্চিন্তে কাজ হাসিল করিয়া হালকা হইয়া চলিয়া আসিবে তেমন কোনো সম্ভাবনাও নাই। সেইটে চিন্তা করিয়া রমাপদ আরও মুষড়িয়া পড়িল। একবার ভাবিল সামনের স্টেশনে নামিয়া টয়লেট খুঁজিয়া লইবে। পরক্ষনেই ভাবিল একবার নামিয়ে পড়িলে পরের ট্রেন আসিতে প্রায় একঘন্টা লাগিবে, হাওড়া পৌঁছাইতে দেরি হইবে বিস্তর। তাহার চেয়ে কোনোরূপ পেট চাপিয়া ধরে পরপর স্টেশনগুলি পার করিতে পারিলে একেবারে হাওড়ায় গিয়াই কাজ সারিয়া লইবে।

সেইমতো কষ্ট করিয়া রমাপদ কিছু স্টেশন পার করিল। উপায়ন্তর না দেখিয়া অনিচ্ছাকৃতভাবে বার দুয়েক বায়ু নির্গমনও করিল। ছুটন্ত ট্রেনে ঝড়ের বেগে সে বায়ু ছড়াইয়া পড়িল দিগ্বিদিগ। সহযাত্রীরা চমকাইয়া উঠিয়া যে যার মতো রুমাল চাপিয়া ধরিল নাকে। রমাপদ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করিল না। দাঁতে দাঁত চাপিয়া যুদ্ধ জয়ের আশায় বসিয়া রহিল। কিন্তু প্রকৃতির ডাক বড় কঠিন ডাক। যতই বলিষ্ঠ মানুষ হোক না কেন সে নিশির ডাক উপেক্ষা করিবে এই ধরাধামে এরূপ দুঃসাহস দেখাইবার মতো মানুষ খুঁজিয়া পাওয়া দুস্কর। অতএব রমাপদর মতো সাধারণও নিজেকে বেশিক্ষণ ধরিয়া রাখিতে পারিল না। কোন্নগর আসিবার পূর্বেই সে চক্ষে সর্ষেফুল দেখিতে লাগিল।

স্টেশন আসিবামাত্র সে বিদ্যুৎবেগে ট্রেন থেকে নামিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ধাবমান হইল সম্মুখের দিকে। এক জিআরপিএফকে দেখিতে পাইয়া তাহাকে কাতর হইয়া বলিল, 'দাদা, স্টেশনের টয়লেটটা কোনদিকে বলুন, জলদি...... '। জিআরপিএফ রমাপদর দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি হানিয়া গম্ভীরস্বরে কহিল, 'স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে'। রমাপদ বেশি জোরে দৌড়াইতে পারিল না, তাও যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হাঁটিয়া, সিঁড়ি টপকাইয়া শৌচালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইল। কপাল খারাপ থাকিলে মানুষের যা যা ঘটিতে পারে রমাপদর ক্ষেত্রে তখন ঠিক তাহাই ঘটিল।

শৌচালয়ের গেটে একটি বড় তালা ঝুলিতেছে। তাহার মুখ শুকাইয়া পাংশু হইয়া গেল। এই করুণ অভিজ্ঞতা রমাপদর জীবনে খুব বেশি ঘটে নাই। সুতরাং তালা দেখিয়া তাহার একেবারে মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করিল। কারণ পেটের ভিতর ততক্ষণে উদ্দাম তাণ্ডবনৃত্য শুরু হইয়া গেছে। সুনামীর ঢেউয়ের ন্যায় সে মরণ বেগ তাহার উদরের ভিতর একের পর এক আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। সামান্য অসাবধানে এক বিরাট গোলযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা প্রবল হইয়া উঠিল। আশেপাশে খুঁজিয়াও যখন শৌচালয়ের কাহাকেও সে দেখিতে পাইল না তখন সে অনন্যোপায় হইয়া এক রিক্সাওয়ালাকে পাকড়াও করিল।

রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল, 'বাবু কোথায় যাবেন' ? রমাপদ মুখ দিয়া কোনো কথা কহিতে পারিল না, শুধু করুণভাবে ইশারায় শৌচালয়ের দিকে আঙ্গুল তুলিয়া দেখাইল। রিক্সাওয়ালা সেদিকে তাকাইয়া কহিল, 'কি মুস্কিল, তা ওখানে যেতে আমাকে টানছেন কেন ? এর জন্য আবার রিকশা করে নাকি কেউ' ? রিক্সাওয়ালার তাচ্ছিল্যে রমাপদ ভীষণ বিরক্ত হইয়া কিছু একটা বলিতে যাইতেছিলো। পরক্ষনেই পেট চাপিয়া ধরিয়া অস্ফুটে কহিল, 'ওখানে লোক কই, কখন খুলবে' ? রিক্সাওয়ালা সে বিপদভঞ্জন ঘরের দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল, 'ওহ, বন্ধ বুঝি ? ওর লোক তো খেতে গেছে, ঘন্টাখানেক বাদে আসবে'।

রমাপদর মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। প্রায় মাটিতে বসিয়া পড়িবার উপক্রম হইল, মিহিস্বরে কহিল, 'তাহলে' ? রিক্সাওয়ালা বলিল, 'আপনি এক কাজ করুন, প্ল্যাটফর্মে চলে যান, স্টেশনকর্মীদের একটা বাথরুম আছে। জিজ্ঞাসা করুন, বলে দেবে'। রমাপদ সেকথা শুনিয়া প্রায় হামাগুড়ি দিয়া প্ল্যাটফর্মে আসিয়া উপস্থিত হইল। সটান ঢুকিয়া পড়িল স্টেশনমাস্টারের রুমে। সম্মুখে এক ভদ্রলোককে দেখিতে পাইয়া বিকৃত মুখে কোনোরকমে কয়েকটা শব্দ বাহির করিল, 'দাদা, আপনাদের টয়লেটটা.........'

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকাইয়া চশমার ভিতর হইতে কহিলেন, 'টয়লেটটা কি' ? রমাপদ কোনোপ্রকার একপায়ের ওপর আরেক পা ভর দিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, 'একবার যাব.......'।

ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ মাছি তাড়াইবার মতো করিয়া হাত নাড়িয়া কহিলেন, 'না নাঃ, ও বাইরের লোকের জন্য নয়, আর তাছাড়া যাত্রীদের জন্য তো বাইরে শৌচালয় আছে, সেখানে যান'। রমাপদ বলিল, 'আজ্ঞে, সেইটে বন্ধ, এক্ষুনি ঘুরে এসেছি, দয়া করে যদি আপনাদের টয়লেটটা একবার.........'।

সেই ভদ্রলোক এবার মুখ না তুলিয়াই বলিলেন, 'বন্ধ থাকলে একটু ওয়েট করুন, খুললে যাবেন, আমাদেরটা ব্যবহার করা যাবে না, স্যরি'। একথায় রমাপদ একেবারে হাঁউমাঁউ করিয়া কাঁদিয়া পড়িল। সামনে আসিয়া ভদ্রলোকের হাত জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, 'স্যার, প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন, সেই শৌচালয় ঘন্টাখানেক বাদে খুলবে, কিন্তু ততক্ষণে আমার বাঁধের লকগেট খুলে গিয়ে সমস্ত কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে একেবারে তছনছ করে চলে যাবে। আপনি কি তাই চান' ? ভদ্রলোক তখনও না না করিতে লাগিলেন, রমাপদর কাকুতিমিনতি কর্ণপাত পর্যন্ত করিলেন না।

এইবার রমাপদ সম্পূর্ণ বেসামাল হইয়া গেল। সে আর ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে পারিল না, সমস্ত সাহস সঞ্চয় করিয়া, অকুতোভয় হইয়া কহিল, 'তবে আমি এই চেয়ারের ওপর বসলুম উবু হয়ে, আমি এইখানেই করব, আপনার যা করার করে নিন'। বলিয়াই সে অনতিদূরে একটি চেয়ারের নিকট নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলিতে লাগিল। ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করিয়া উঠিলেন, ভীষণ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বলিলেন, 'একি করছেন, একি করছেন, এটা তো অফিস ! আরে ওই চেয়ারটা যে বড়বাবুর......'। রমাপদ চোখ মুখ কুঁচকাইয়া কহিল, 'আমার আর কিচ্ছু করার নেই স্যার, বড়বাবুর জন্য নতুন চেয়ার আনিয়ে নেবেন'। 

ভদ্রলোক ত্বড়িৎগতিতে ড্রয়ার খুলিয়া চাবি বাহির করিয়া রমাপদর হাতে দিয়া বলিলেন, 'এই নিন, এই নিন, ডানদিকে ওই কোণের দরজাটা, সোজা চলে যান, কিন্তু এখানে প্লিজ না'। রমাপদ আর কালক্ষেপ করিল না। চাবিটা প্রায় ছিনিয়া লইয়া বিশেষ ঘরের অভিমুখে হনহন করিয়া হাঁটা লাগাইল। পশ্চাতে শুনিতে পাইল ভদ্রলোক বলিতেছেন, 'হয়ে গেলে জলটা ঠিক করে দেবেন কিন্তু..................' ।

রমাপদ দড়াম করিয়া দরজা বন্ধ করিল। নিদারুণ আতশবাজির শব্দে গোটা অফিস মুখরিত হইয়া উঠিল, বাহিরে স্টেশনে এনাউন্স হইল, 'দুনম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়ছে............'

অলংকরণ : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalifunnystories #saptahiki #sulabh     

Monday, March 13, 2017

এই বসন্তে

বসন্ত আজ দিয়েছে ডাক
কলরবে সব তফাত যাক
চল, আঁকাবাকা ওই পথের গলিতে ভিড় হয়ে যাই

হুল্লোড়ে আজ উঠুক তুফান
তোর আর আমার স্বপ্নের গান
গেয়ে যাব তবু ক্লান্ত যতই হোক না সবাই

চল, ফাগুন ওড়াই দুহাত দিয়ে
একতারাতে গান শুনিয়ে
তুষের আগুন জ্বলবে সেথায় নির্নিমেষ

রঙের খেলায় মাতব যত
রঙিন হবে হৃদয় তত
দোলের দিনে তোর্ সাথে হব নিরুদ্দেশ..............

ছবি : 'রামলীলা' পোস্টারের সৌজন্যে 

#bengalipoems #poetries #love #romance #dolyatra #holi #basantautsav

Thursday, March 9, 2017

সাপ্তাহিকী ২৪ # নারী কথা

- কিরে কাঁকন, আবার পড়তে বসেছিস বুঝি ? এই যে টিউশন পড়িয়ে এলি........বলিহারি.....
- হ্যাঁ গো মিতিনকাকী, সামনেই পরীক্ষা তো, একদম সময় নেই হাতে.......সন্ধের এই সময়টুকুই যা         পাই।
- ওওও......তা তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কিছু মনে করবিনে তো ?
- না না, বলো না........
- তোর স্কুলের সেই বান্ধবী, কি যেন নাম......হ্যাঁ মনে পড়েছে স্বপ্না। ওরই তো বিয়ে ছিল গত সপ্তাহে,        তাই না ?
- হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো, খুব মজা করেছি জানো......
- আর তোর কলেজের সেই মেয়েটি, দেবিকা, সেই যে রে খুব আসতো তোদের বাড়ি, ওর বিয়ে হয়ে গেছে ?
- হ্যাঁ, ওর তো গত বছরই বিয়ে হয়ে গেছে। মনে নেই বৌভাতের সেই গল্পটা শুনিয়েছিলাম।
- আচ্ছা, আরেকজন ছিল না, তোর সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়তো, খুব সুন্দরী, তারও কি বিয়ে হয়েছে ?
-  হ্যাঁ তো, ওর তো সেই কবে...... একটা মেয়েও হয়েছে। কিন্তু, হঠাৎ এদের কথা জিজ্ঞেস করছো যে ?
- কিছুই না, আসলে তোরও তো বিয়ের বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছে কিনা। তাও প্রায় ঊনত্রিশ হতে চলল, তাই না রে ?
- হ্যাঁ, কিন্তু আমার তো বিএড ফাইনাল আছে এখন। সামনের এসএসসিটা দিয়ে চাকরি পেয়ে তবে তো বিয়ে করব।
- সে নাহয় হলো, কিন্তু তাই বলে কি আর ভালো ভালো পাত্ররা হাঁ দাঁড়িয়ে থাকবে বল দেখি ? তুই কবে পাশ করবি, চাকরীর পরীক্ষা দিবি তারপর চাকরী করবি.......বেলা যে অনেক গড়িয়ে যাবে ততদিনে।
- গড়িয়ে গেলে গড়িয়ে যাক কাকী, কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপরই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেব, তার আগে নয়।
- কি জানি বাপু, তোদের রকম সকম বুঝি না, একেই এতো বয়েস হয়ে গেছে, ঊনত্রিশ পেড়িয়ে ত্রিশের কোঠায় যখন পড়বি তখন কে যে তোকে বিয়ে করবে বাপু কে জানে।
- কেউ বিয়ে না করলে না করবে, তাই বলে পড়াশোনাটা ছেড়ে দেব নাকি?
- শোনো মেয়ের কথা ! তা এতো দিনরাত পড়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জোগাড় করতে পারবি তো ? দেখিস তখন যেন হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসিস নে আবার।
- বেশ তো, তাতে তোমার কি সমস্যাটা হবে সেটা একটু বুঝিয়ে বলো দেখি আমায়।
- ট্যারা ট্যারা কথা চারটি বলতে শিখেছিস বটে। আমার আর কি, তোর বাড়ির পাশে থাকি, ছোটোর থেকে দেখে আসছি তোকে, তোর ভালো চাই তাই বললুম......নাহলে আমার আর কি দায় পড়েছে বল যে তোর মতো শিক্ষিত মেয়েকে বাড়ি বয়ে এসে চারটি ভালো উপদেশ দেব। আমরা কি আর তোদের মতো বিদ্বান রে ভাই ?
- আচ্ছা কাকী, ঝুমার তো খুব অল্প বয়েসে বিয়ে হয়েছে না ?
- হ্যাঁ, সে আর বলতে, কলেজের পর পরই খুব ভালো একটা পাত্র দেখে ছাদনাতলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলুম। বলেছিলো কি সব নাকি এমএ ফেমে করবে। আমি পষ্ট বলে দিয়েছিলুম, দ্যাখ, ওসব  ছাইপাঁশ পড়ে তোর কোন শাক চচ্চড়ি রাঁধতে কাজে লাগবে শুনি ? তাই শুনে মেয়ের কি কান্না ! পরে অবশ্য ওর বাবার দাবড়ানিতে সুড়সুড় করে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসেছিল। ওহ ! সে এক হ্যাঙ্গাম বটে,  বাব্বাঃ.........
- ঝুমা তো এখন তোমাদের সাথেই থাকছে কয়েক মাস ধরে, তাই না ? শুনলুম, জামাইকে তোমরা গাড়ি কিনে দিচ্ছ না বলে ওকে নাকি খুব মারধর করে..........সত্যি ?
- ইয়ে.....মানে, আমি এখন উঠি রে কাঁকন, ওদিকে আবার মেলা কাজ পড়ে আছে। ভাতটা বসাতে  হবে নাহলে আবার তোর কাকা এসে....... 


চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories #marriage #drama  

Wednesday, March 1, 2017

স্বপ্নের মতো

অফিস থেকে ফিরে, ড্রয়িং রুমে অভ্যাসমতো কাঁধ থেকে ব্যাগটা রাখতেই মা বললেন, 'তোর একটা ক্যুরিয়ার এসেছে, ভেতরের ঘরে দেরাজের ওপর রাখা আছে'। মনে পড়তেই বুকের মধ্যে মৃদু কম্পন অনুভব করলুম। একটা পার্সেল আসার কথা ছিল বটে। জিজ্ঞেস করলাম, 'কখন এসেছে' ?
- ওই দুপুরের দিকে.......আড়াইটে তিনটে নাগাদ হবে। 
- ও........আচ্ছা।  

পায়ে পায়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। দেরাজের ওপর থেকে সাদা খামটা নিয়ে এক ঝটকায় মুখটা ছিঁড়ে ফেললুম। যেটা বেরিয়ে এলো সেটা আমার এতদিনকার নিরন্তর কলম পিষে চলার প্রথম স্বীকৃতি, আমার গোপন প্রেমের স্থির অক্ষরচিহ্ন। তবে বসন্ত বোধহয় সত্যিই এলো। আসবে যে, তার আগাম খবর পেয়েছিলুম, কিন্তু সে যে আমার তালুবন্দী হয়ে আমারই হৃদস্পন্দন দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলবে এ আমার কল্পনাতীত ছিল। একটা মাঝারি সাইজের কবিতার বই যার রঙিন প্রচ্ছদের জলরঙে আমার মধ্যবয়সী বাউন্ডুলে আবেগ মিলেমিশে এক হয়ে যেতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা হাতে সূচিপত্র খুঁজে বের করে ফেললুম আটচল্লিশ নম্বর পাতাটা। সে পাতার ওপর সারি সারি কালো কালির বিন্যাস যেন আমার বুকের ভেতর কালবৈশাখীর ঝড় হয়ে বইতে শুরু করে দিলে। আর আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠায় চেয়ে রইলুম আমার শব্দসন্তানের দিকে। 'ঘুম আসছে' - আমার প্রথম ছেপে আসা কবিতা। 

বাড়ি বসেই যে এমন ম্যাজিক দেখতে পাবো ভাবিনি কখনো। তাই সম্পাদক সুরজিৎ হালদারকে শুকনো ধন্যবাদ দেব না। আমার কবিতা ও লেখা পড়ে আপনি যে অঙ্কুরের কবিতা সংকলনে আমার কবিতাটি মনোনীত করেছেন তার জন্য চিরতরে ঋণী হয়ে রইলুম আপনার ও সংস্থার অন্যান্য সদস্যদের প্রতি। আপনাদের মঙ্গল হোক। আর কি বলি ? এই অনুভূতি প্রথম প্রেম নিবেদনেই বাজিমাত করার মতো কতকটা, ভাষায় বুঝিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমার 'মলাটের' পাঠক পাঠিকাদের অনুরোধ করি এভাবেই পাশে থাকুন..........আপনাদের উৎসাহতেই এটি সম্ভব হলো।  

পুনশ্চ : বইয়ের মূল্য চল্লিশ টাকা। এটি সংগ্রহ করার জন্য সম্পাদক সুরজিৎ হালদারের সাথে যোগাযোগ করুন সত্ত্বর।

ছবি : নিজস্ব 

ছবি : নিজস্ব 


#bengaliarticles #bengaliwriteups #respect #gratitude


Wednesday, February 15, 2017

সাপ্তাহিকী ২৩ # ছোট্ট প্রেমের গল্প

ভ্যালেনটাইন্স ডের সকালবেলায় ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল শুভেন্দুর। বাঁ হাত দিয়ে বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা বের করে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। স্ক্রিনের ওপর অপর্ণার নামটা জ্বলছে নিভছে। কি আশ্চর্য ! এতো সকাল সকাল তো ফোন আসেনা। কিছু হলো নাকি ? কল রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে, 'হ্যাঁ বলো......., এই সময় হঠাৎ' ?
ওদিক থেকে অপর্ণার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়। 
- তুমি একটু চট করে রেডি হয়ে নিয়ে বেরোতে পারবে ? 
-  কেন, কি হয়েছে ?
- বাড়িতে সমস্যা হচ্ছে খুব, একটা ডিসিশন নিতে হবে, ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসতে পারবে কি ?
ঘুম কেটে যায় শুভেন্দুর। ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসে। অপর্ণার বাড়িতে গত কয়েকদিন ধরেই সমস্যা চলছে, শুভেন্দু জানে সেটা। নিশ্চই বড় রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে আজ, নাহলে ধীর স্থির অপর্ণা এতো তাড়াহুড়ো করার মানুষ নয়। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, 'আচ্ছা বেশ, বেরোচ্ছি, কোথায় আসতে হবে বলো' ? 'গোলপার্ক.......মৌচাকের সামনে', বলে ফোনটা কেটে দেয় অপর্ণা। 

অপর্ণা শুভেন্দুর আলাপ হয় একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। প্রায় বছর দুয়েক আগে কোনো এক জ্যোৎস্না ভরা হেমন্তের রাত্রে। প্রথম পরিচয় থেকে পরবর্তী আলাপচারিতা গাঢ় হতে সময় নেয়নি বেশি। দুজন সমমনস্ক মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব ঘুচে যাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে ভালোলাগার রূপান্তর ঘটেছিলো ভালোবাসায়। 'ভালোবাসি' বলতে হয়নি কাউকেই, বরং পরিণত অনুরাগ ও আবেগের বন্ধনে অজান্তেই কাছাকাছি চলে এসেছিলো দুজনে। অপর্ণার ভালো লেগেছিলো শুভেন্দুর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। জীবনের সহজ সরল উপলব্ধি মুগ্ধ করেছিল অপর্ণাকে। শুভেন্দুকে টেনেছিল অপর্ণার স্বাধীনচেতা মনোভাব। যে কোনো জটিল পরিস্থিতি খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অপর্ণা, আশ্চর্য দক্ষতায় মানিয়ে নেয় ছোট ছোট চড়াই উতরাইয়ের মুহূর্তগুলো। সময়ের উজান বেয়ে ভেসে বেড়িয়েছিল দুজনে হাত ধরাধরি করে। বলাই বাহুল্য এই সম্পর্কের আঁচ দুজনের বাড়ি অবধি পৌঁছেছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। দুর্ভাগ্যবশত কোনো বাড়িই এদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। শুভেন্দুর বাড়িতে দারুন গোলযোগ না হলেও অপর্ণার বাড়িতে দুর্ভোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিলো অচিরেই। পরিস্থিতি কণ্টকময় হয়ে এসেছিলো ক্রমশ আর তাই অপর্ণার এই জরুরি তলব। 

নির্দিষ্ট সময় গোলপার্কে চলে আসে শুভেন্দু। দূর থেকে হাত নেড়ে ডেকে নেয় অপর্ণা। 
- ব্রেকফাস্ট করোনি নিশ্চই ?
- নাহ, তুমি এতো তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালে, কোনোরকমে স্নানটা সেরেই বেরিয়ে এসেছি। কি ব্যাপার বলো তো ?
- বলছি, চলো, তার আগে একটু পেটে কিছু দিয়ে নি। আমারও সকাল থেকে খাওয়া হয়নি কিছু। 

দুজনে আনন্দ কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। দুটো ডিম্ টোস্ট আর চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসে। শুভেন্দু জিজ্ঞেস করে, 'তুমি আজ কলেজ যাবে না' ? অপর্ণা গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলে, 'নাহ, আজ দুটো মাত্র লেকচার ছিল, আসবো না বলে দিয়েছি, তেমন অসুবিধে হবে না'। শুভেন্দু অপর্ণার হাতে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে, 'বাড়িতে কি খুব সমস্যা হচ্ছে' ?

- হ্যাঁ, বাড়িতে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কাল রাতে বিশ্রী ঝামেলা হয়েছে। কেউই এই সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছে না। 
- তুমি কি চাইছ ?
- তোমার সাথে থাকতে চাইছি, ব্যাস এটুকুই।

অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দু। পূর্ব দিকের জানলা দিয়ে কড়ামিঠে রোদ এসে পড়েছে অপর্ণার গালে। অদ্ভুত দ্যুতিময় লাগে মুখের চারপাশটা। তৃপ্তিতে শুভেন্দুর গলা বুজে আসে। অপর্ণার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, 'আমার বাড়িতেও যে কম সমস্যা নেই সে তো তোমার অজানা নয় অপা, তাহলে............'। 
- আমি জানি, আর তাই সমস্ত দিক ভেবে একরকম ঠিক করেই এসেছি। 
'কি রকম' ? সন্দিহান হয় শুভেন্দু। 
- যাদবপুরের দিকে একটা দুকামরার ফ্ল্যাট আছে। মেন রোড থেকে সামান্য ভিতরে। আমার কলেজের কলিগের থেকে খবরটা পেয়েছি। ইনফ্যাক্ট ওরই যোগসূত্রে ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে কথা হয়েছে কাল। আমাদের দুজনের স্বচ্ছন্দে হয়ে যাবে মনে হয়। একবার দেখতে যাবে ?  
- কত দাম চাইছে ?
- লাখ বিশেকের মধ্যেই। আমার জমানো যা টাকা আছে তাতে ডাউন পেমেন্টটা করে দিতে পারবো। বাকিটা লোন নিয়ে নেব। কি বলো ?
শুভেন্দু আমতা আমতা করে বলে, 'সে নাহয় হলো। কিন্তু আমাকে তো লোন দেবে না কেউ। আমার তো চাকরি নেই, তুমি জানো'।
- আমার তো আছে, আর তাই লোনটা আমার নামেই নেব। ওটা নিয়ে ভেবো না। 
- তা কি করে হয়। সমস্ত টাকাটাই তুমি দিচ্ছ, আমার ওপরেও তো কোনো দায়িত্ত্ব বর্তায়, নাকি ?

শুভেন্দুর কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে অপর্ণা। বলে, 'বেশ তো, রোজের বাজারটা কোরো আর সারা মাসের আনুষাঙ্গিক খরচগুলো তুমিই নাহয় দিও, কেমন ? স্মিত হাসে শুভেন্দু। ভেবে পায়না কি বলবে। অপর্ণার এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে বিমূঢ় হয়ে যায় কিছুটা। অথচ অপর্ণা যা বলছে, যা করছে তা সমস্ত দিক ভেবেই করছে, এছাড়া আর সত্যিই কোনো উপায় নেই, শুভেন্দু জানে সে কথা। ইদানীং দুতরফেরই বাড়ির পরিস্থিতি বিষময় হয়ে উঠেছে । নিত্যদিনের বিষোদ্গীরণ বড় বুকে বাজে। সেকথা কাউকে বলবার নয়, কাউকে বোঝানোর নয়। একমাত্র অপর্ণা জানে। জীবনের তপ্ত মরুপ্রান্তরে অপর্ণাই একমাত্র মরুদ্যান তার কাছে। হৃদস্পন্দনের অন্যতম বলিষ্ঠ কারণ। নানারকম ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় শুভেন্দু। অপর্ণার ছোঁয়ায় চটক ভাঙে। 

- কি এতো ভাবছো শুভ ?
- না....., তেমন কিছু নয় ........
- আমি জানি, বাড়ির লোকজনদের ছেড়ে থাকাটা বড় কঠিন কাজ। সে কাজ করতে তোমায় জোর করবো না আমি। আর তাছাড়া আমার মতে যে তোমাকে চলতে হবেই এমন কোনো কথা নেই। তেমন হলে তুমি দুদিন ভাবার সময় নাও। ফ্ল্যাট তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তারপরেও যদি তোমার আপত্তি থাকে, জেনো, আমি বিন্দুমাত্র কিছু মনে করবো না। আমি শুধু তোমায় পেতে চেয়েছি শুভ, নিজের মতো করে, কিন্তু তোমার অমতে নয়। 
- ওকথা বোলো না অপা, আমি কি তোমার ভেতরটা পড়িনি ভাবছো ? আমায় ভুল বুঝো না, একসাথে পথচলার সংকল্প করেছি যখন, পিছিয়ে আসার ভণ্ডামি আমার সইবে না। ওতে যে মরেও সুখ পাবো না। 

শুভেন্দুর দুগাল বেয়ে অব্যক্ত বুকচাপা স্রোত নেমে আসে। অপর্ণা শক্ত করে হাত দুটো চেপে ধরে শুভেন্দুর। শুভেন্দু চোখ নামিয়ে বলে, 'শুধু একটাই আফশোষ থাকবে জানো,..............' 
- কি ?
- দাদুভাইকে রোজ দেখতে পাবো না.........

অপর্ণা নির্বাক বসে থাকে। বুকের ভেতরটা বেদনায় মুচড়ে ওঠে। ষাটোর্দ্ধ মানুষটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। তার নিজের নাতি নাতনি নেই বটে, তবু সংসারের মায়া যে কতবড় নাগপাশ এ তার থেকে ভালো আর কেউই জানে না। বিয়ের পর পরই স্বামী দেহত্যাগ করে। কলেজে চাকরি করে একমাত্র মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছে আজ অনেক বছর। সেও তার স্বামীকে নিয়ে অপর্ণার কাছেই থাকে। বিপত্নীক শুভেন্দুর সাথে ঘনিষ্ঠতা মেয়ে জামাই মেনে নিতে পারেনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়ে। শুভেন্দুর বাড়িতেও তার একমাত্র সন্তান ও বৌমার মুখের ভাষা লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। রিটায়ার্ড বাবার একা থাকার পরিনাম যে পরিণয়তেও শেষ হতে পারে একথা চিন্তা করা তাদের কাছে আত্মহত্যা করার সামিল। সে সংসারের একমাত্র সূক্ষ্ম যোগ শুভেন্দুর দুবছরের আদরের নাতি, যার আধো আধো গলায় দাদু শব্দটায় স্বর্গ খুঁজে পায় শুভেন্দু। সুতরাং কয়েক মাস ধরে দুজনকেই অন্যত্র স্থায়ী ঠিকানার কথা ভাবতে হয়েছে। আজ সে সন্ধিক্ষণ আগত প্রায়। শুভেন্দুর সামলে উঠতে ক্ষণিক সময় লাগে। তবুও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। অপর্ণা জিজ্ঞেস করে, 'বাড়ি যাবে তো ? ট্যাক্সি ডেকে দিই' ? 

শুভেন্দু মাথা নাড়ে দুদিকে। দৃঢ়কণ্ঠে বলে, 'ট্যাক্সি ডাকো, তবে বাড়ি নয়, যাদবপুর যাব............ফ্ল্যাটটা দেখে নিতে হবে তো ঠিকঠাক করে......... '


অলংকরণ : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories #love #romance #saptahiki

Monday, February 6, 2017

জন্মান্তর

জন্মাবধি শুনিয়াছি ভালো ছেলে হইতে হইবে। ভালো ছেলের যে প্রকৃত অর্থ কি তাহা বুঝিয়া উঠিতে সময় লাগিয়াছিল অনেক। যতদিনে বুঝিয়াছিলাম ততদিনে ছেলে হইয়া উঠিয়াছিলাম রীতিমতো, ভালো হইয়াছিলাম কিনা জানি না। ছোট থাকিতে অনেকেই জিজ্ঞাসা করিত, 'বড় হইয়া তুমি কি হইতে চাও খোকা' ? কোনোপ্রকারেই গুছাইয়া বলিতে পারিতাম না। গুছাইয়া বলিবার শিল্পটা রপ্ত করিতে পারি নাই তখন, ফলতঃ অধিকাংশ সময়ই না বলা কথাগুলি গলার কাছে আসিয়া আটকা পড়িত, কিছুতেই শব্দের পর শব্দ বসাইয়া বলিয়া উঠিতে পারিতাম না। প্রশ্নকর্তার বা কর্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম ফ্যালফ্যাল করিয়া। তিনি অবোধ বালক বলিয়া করুণা করিতেন, ভাবিতেন বোধহয় কথাই ফুটিয়া ওঠেনি, ও বেচারা এই কঠিন প্রশ্নের কি উত্তর দিবে। প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় জন্মদাত্রী রক্তচক্ষু হানিতেন আমার উপর। ভাবিতেন এ সমস্তই আমার ছল চাতুরি, কচি মাথার শয়তানি। জনসমক্ষে কথা না কহিয়া ওনাকে ছোট করিবার ফিকির খুঁজিয়া ফিরিতেছি।

কিন্তু সত্য ঘটনা তাহা নহে। সত্যটি হইল, আমি বড় হইতেই চাহিতাম না। তাহার অর্থ এই নহে যে বড় হইবার সমস্ত রকম ক্ষতিকর দিকগুলি আমার জানা ছিল । না....... বরং স্কুলে যাইয়া বন্ধুদের সাথে চরম দুরন্তপনা করা বা বাড়ি ফিরিয়া পশ্চিমের মাঠে ক্রিকেট বা ফুটবল পেটানো আমার যারপরনাই মনোরম লাগিত। কিয়দংশ হইলেও মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে বড় হইয়া কাঁধে ব্যাগ লইয়া সকাল সকাল অফিস যাইতে হইবে। যতক্ষণে ফিরিয়া আসিব বিকাল গড়াইয়া সন্ধ্যে হইবে, মাঠ অন্ধকার হইয়া আসিবে, খেলাধুলা হইবে না। সুতরাং বড় হইবার তেমন প্রয়োজন বোধ করিতাম না। আর তাই এই কারণেই সেসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে চাহিতাম না। জানিতাম লোকসমাজে হাস্যস্পদ হইব, মা জোর কানমলা দিবেন, কেননা যে ছেলের বড় হইবার কোনো সাধ নাই সে ছেলের অদূর ভবিষ্যৎ যে ঘন কৃষ্ণ কালিমালিপ্ত হইবে এ আর নুতন কথা কি। তাই চুপ করিয়া থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করিতাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার পাইয়া যাইতাম, কিছু ক্ষেত্রে পারিতাম না। তাঁহারা মাকে বলিতেন, 'তোমার ছেলেটি বড় কম কথা বলে, চারটে প্রশ্ন করিলে একটির উত্তর দেয়, দু দণ্ড বসিয়া যে আলাপ করিব তার জো নাই, সর্বক্ষণ পালাই পালাই করিতেছে'। মা ব্যর্থ হাসিতেন, বলিতেন, 'ও একটু লাজুক আছে, দুদিন যাক আপনিই আলাপ জমাবে'। কথাটা সত্য। সে মানুষ যদি আলাপ জমানোর মত হইত আমি নিজে নিজেই জমাইয়া লইতাম, কিন্তু তা যদি না হইত পারতপক্ষে এড়াইয়া চলিতাম। সে জন্য অবশ্য তাঁহারা কটাক্ষ করিতে ছাড়িতেন না, জনান্তিকে বলিতেন, 'ও ছোঁড়ার বড্ড দেমাক, মাটিতে পা পড়ে না, মিশিতে জানে না'। এ অপবাদ অবশ্য আমার অর্ধাঙ্গিনীও দিয়ে থাকেন। তাহাকে বুঝাইয়া উঠিতে পারিনা যে কম কথার মানুষও পৃথিবীতে বাঁচে, যাঁহারা বেশি কথা বলেন তাঁহাদের মতো করিয়াই। কিন্তু সফল হই নাই এ অবধি।

বেশ মনে পড়ে ছোটবেলায় বন্ধুরা আলোচনা করিতাম, যে, পরজন্মে যদি আবার এ ধরণীতে আসিবার সুযোগ পাই তাহা হইলে কি হইয়া জন্মিব। নানা রকম বলিত সকলে, কেউ বলিত গাঙচিল, কেউ বলিত প্রজাপতি, কেউ বলিত বাঘ, কেউ বলিত হাঙর। আমি ভাবিয়া কুলকিনারা পাইতাম না। পুনঃ পুনঃ মনে হইত মানব জনম লইয়া তো দেখা হইয়া গিয়াছে, তাহা হইলে কি এমন হওয়া যায়, যাহা করিয়া দিব্যি হাসিয়া খেলিয়া দিন কাটাইয়া দেওয়া যাইতে পারে। প্রথমে ভাবিতাম গরু হইলে বেশ হয়। মা শুনিলে বলিত ও আর কষ্ট করিয়া হইবার কি আছে। তবুও এই প্রাণীটির উপর ভারি মায়া হয় আমার।  বেচারা সারাদিন মাঠে লাঙল চষিয়া গোয়ালঘরে ঝিম মারিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া জাবনা চিবাইতে থাকে। অবশ্য তাহার পরেই সকাল বেলার দুধ দোয়ার অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়া সে ভাবনার কথা ত্যাগ করিয়াছিলাম। পরে ভাবিয়া দেখিয়াছি চতুষ্পদ জীব হইতে গেলে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হইবে। খেয়াল খুশিমতো নানাবিধ কাজ করা যাইতে পারলেও দু চার ঘা খাইবার ভয়ও যথেষ্ট থাকে। তদুপরি মনে হইত, মানুষ ছাড়া সকল জীবজন্তুই মনের মতো করিয়া জীবন অতিবাহিত করে, একমাত্র মানুষই এক অদৃশ্য শৃঙ্খল বেষ্টিত হইয়া ঘুরিতেছে। তাহা হইলে সকল রকম জীব হইয়া এক একবার করিয়া জন্মিতে পারিলে বেশ হয়। বলিতে বাধা নাই সে ভাবনা এখনো মনের মধ্যে জীবিত আছে। সযত্নে তাহাকে লালন পালন করিয়া রাখিয়াছি। 

সুযোগ পাইলেই প্রথমে মৎস্য দিয়া শুরু করিব। একেবারে পুরাণের মৎস্য অবতারের মতো কিয়দটা। তারপর কূর্ম , বরাহ , নরসিংহ অবধি গিয়া থামিয়া যাইতে হইবে। তাহার কারণ হইল এই, যে এর পরেই বামন অবতার, সেটা হইলেই চাঁদে হাত বাড়াইবার স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিব পুনরায়। আবার সেই ঘূর্ণিজলের মধ্যে পড়িয়া যাওয়া। আবার মানব ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সে আমার দ্বারা হইবে না। অতএব দেখিয়া বুঝিয়া জন্মিতে হইবে। সামান্য গাফিলতি হইয়াছে কি সংশোধনের অবকাশটুকু পাইব না। বিদ্বজনেরা এতক্ষনে আমার মুণ্ডপাত করিতেছেন হয়ত। হয়ত ভাবিতেছেন ছোঁড়াটার মাথাটা একেবারে গিয়াছে। মানুষ হইয়া জন্মানো যে কত বড় পুণ্যের কাজ, কত জন্ম জন্মান্তরে, কত যুগ শতাব্দী ধরে যে এ দুর্ভেদ্য বাধা পেরিয়ে আসিতে হয় তাহা আর তোমার মতো নরপাতক বুঝিবে কি করিয়া ? তা বটে, তবে বিশ্বাস করুন কত্তা, ও আর আমি বুঝিতে চাই না। বেশি বুঝিতে গেলে গোলমাল বাধে, ঝাপসা হইয়া ওঠে চতুর্দিক, শেষটায় নিদ্রা পায়। মুহুর্মুহু হাই তুলিতে থাকি। তাই জাগিয়া থাকিতে গেলে ওসব বাঁকা কথা চিন্তা করিতে সাহস পাই না। জন্মের আরও একটি বছর পার হওয়ার পর শুধু এই কথাটি ভাবিতে থাকি, মানব জন্ম হইল বটে তবে মনুষ্যোচিত কাজ করিতে পারিলাম কি। কি জানি। আপনাদেরও বলি, পরজন্মে কি হইতে চাহেন সেইটে আমাকে জানান দয়া করিয়া। দেখিয়া বুঝিয়া একটি পছন্দ করিয়া লইতে হইবে। সেইমতো ঈশ্বরকে আগাম জানাইয়া রাখিব, কি বলেন ?

পুনশ্চ : যাঁরা জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন তাঁদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

ছবি : গুগল 

#bengaliarticles #birthdaywriteups #bengaliwriteups 

Tuesday, January 24, 2017

২৬এর কবিতা

অপ্রতিহতরা আন্দোলনের পথে হাঁটে
রেকাবির ওপর সাজানো থাকে গারদ
ইনকিলাবের স্লোগান ছিল মুখেমুখে
বিপ্লবের আঁচে ঘেমে উঠেছিল পারদ.........

স্মরণীয়রা, রক্তে ভিজেছিল......
স্বাধীনতার, পতাকায় লেখা নাম
যে পথে যত শহীদ গিয়েছে হেঁটে
সে পথের ধুলোয় লক্ষকোটি প্রণাম........

এ পৃথিবী রাখবে তাঁদের মনে
এ পৃথিবীর সকল কাজের মাঝে
বিপ্লব মুছে যায় না কখনো
বিপ্লব এখনো বুকের ভিতর বাঁচে..........


ছবি : গুগল ;  বিন্যাস : নিজস্ব  















#republicday #bengalipoem #26thjanuary #tribute

Saturday, January 7, 2017

বন্ধু চল্

ইদানীং যেন শীতঘুম ভাঙতেই চায় না। চোখ খোলার বেশ কিছুক্ষন পরেও লেপ কম্বলের অন্তরাল যেন আর ঘন করে জাপ্টে জড়িয়ে ধরতে চায়। সে দুর্বার আকর্ষণের মায়াজাল ছিঁড়ে যখন বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করি তখন মনে হয় আজকের দিনটা নাহয় থাকুক এক কোনে পড়ে, আজ নাহয় নাইবা করলাম কিছু। আজ বরং নিজের সাথে নিজের মত করে দু চার কথা বলি, নিজের মত করে হেঁটে আসি দু চার কোশ পথ। উত্তুরে হাওয়ায় ঝরা পাতার মত রাস্তা জুড়ে শুয়ে থাকি আর শরীরের ওপর আঁকা হয়ে যাক পৌষের পটচিত্র। কানে ভেসে আসুক নবান্নের মর্মর ধ্বনি, তলিয়ে যাই কোনো এক বেনামী দুপুরে, নরম রোদের হাতছানিতে.............

গত সপ্তাহে বছরের শেষ দিনে এমনটা হওয়াতে গোঁজ মেরে বসেছিলুম সকালবেলায়। টাটকা ফুরফুরে হাওয়ার মত ফোন এসেছিল এমন একজনের কাছ থেকে যার সাথে ছোটবেলার অগুন্তি মুহূর্ত চোখ বন্ধ করলে চলচ্চিত্রের মত দেখতে পাই আজও। ছেলেবেলার অসংখ্য বেপরোয়া সময়ের সাক্ষী, সমস্ত বিচিত্র রকম কর্মকাণ্ডের দোসর ও আমার অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু - সৌম্য। বলতে বাধা নেই কালের ঘুর্ণিঝড়ে বাঁধা পড়ে আজকাল আমাদের দেখাসাক্ষাৎ প্রায় কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তবে ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যোগাযোগটা এখনো অটুট যদিও। অথচ একসময়, এই আমরাই সারা শহর জুড়ে তুর্কি নাচন করতাম। বেহিসেবী ছেলে ছোকরার মতো উড়ে বেড়াতাম টালিগঞ্জ থেকে ধর্মতলা - চাঁদনী চক পর্যন্ত। বিভিন্ন সিনেমা হলে নিয়মিত এটেনডেন্স দেওয়া, পুজোর ভিড়ে গুঁতোগুঁতি করে ঠাকুর দেখা, বইমেলায় যথেচ্ছ বই কেনা, মাঝেমাঝেই এদিক ওদিক হারিয়ে যাওয়া, স্কুলের নানারকম কেলেঙ্কারিতে হাতযশ পাকানো, এ সমস্তই আমাদের রোজনামচা ছিল সেসময়। আজ সময়ের পলি পড়ে গিয়ে কেমন যেন আচমকা আমরা সকলেই স্থবির হয়ে গেছি। গতানুগতিক জীবনযাত্রার ছাঁচে ঢেলে নিয়ে পুরোনো 'আমি'টাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন 'আমি'র আবির্ভাব ঘটেছে যেন আমাদের। তাই ফোন পেয়ে যখন জানতে পারলাম উল্টোদিকের অবস্থাও তথৈবচ তখন একেবারে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম পুরোনো 'আমি'র সন্ধানে। প্ল্যান করতে দুমিনিটের বেশি লাগলো না। আগে আগে যেমন সূক্ষ্ম অছিলায় স্কুল, কলেজ, লেকচার বাঙ্ক করতাম, ঠিক তেমনি করে চট্জলদি হিসেব করে নিলাম দুজনের কেউই সেদিন আর অফিসমুখ হবো না। রাজারহাট আর কসবার মায়া ত্যাগ করে বিবাগী হব যেদিকে দুচোখ যায়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম বন্ধুর বাইকে সওয়ারি হয়ে। মনে মনে ঠিক করে নিলুম, আগে যে যে জায়গায় নিয়মিত যেতুম দুজনে সেইসব জায়গায় আরেকবার করে চক্কর দিয়ে আসবো। 

সাদার্ন এভিনিউর মুখটায় আসা মাত্রই চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্কুলের মেন্ বিল্ডিংটা, বর্তমানে যার ধ্বংসস্তূপের ওপর একটু একটু করে বেড়ে উঠছে নব নালন্দার নব পরিকাঠামো, যার ইঙ্গিত আমার 'নব নালন্দা ডট ইস্কুল' নামক লেখাটায় দিয়েছি এর আগে। আশপাশের বাড়ি ঘরগুলো আর উল্টোদিকের বুলেভার্ডটা যেমনটা রেখে গিয়েছিলুম ঠিক তেমনি রয়ে গেছে। ঝপ করে ফিরে গেলুম বছর কুড়ি আগে। সাদা শার্ট, ধূসর রঙের ট্রাউজার আর লাল টাইএর কচিবেলা যেন স্পষ্ট দেখতে পেলুম চোখের সামনে। বেল পড়ার শব্দ শুনতে পেলুম বুকের ভিতর। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখলুম সেও নিবিষ্ট মনে বুলেভার্ডটার দিকে চেয়ে আছে।
বিড়বিড় করে বলল, 'এই একফালি মাঠটাতে কত দৌড়াদৌড়ি করেছি একসময়, তাই না বল' ?
আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলুম।
সে বললে, 'আমাদের কুড়ি বছরের পুরোনো সেই ধুলোগুলো খুঁজলে এখনো পাওয়া যাবে.......না রে' ?
আমি কোনো কথা বলতে পারলুম না, মনের মধ্যে ধুলোঝড়ের পূর্বাভাস টের পেলুম। সে ঝড়ের ঝাপটায় পাছে চোখ ঝাপসা হয় সেই ভয় অস্ফুটে বললুম, 'চল্............... কবীর রোডে যে নতুন ব্রাঞ্চটা খুলেছে সেইটে একবার দেখে আসি'।

কবীর রোডের ব্রাঞ্চ স্বাভাবিকভাবেই শীতের ছুটিতে বন্ধ, তাই বাইরে থেকে একবার চোখের দেখা দেখে নিয়ে লেকের দিকে উড়ে চললুম। যাঁরা দক্ষিণ কলকাতা নিবাসী তাঁরা জানবেন দুপুর বিকেলের দিকে লেকের মহিমাই আলাদা। রবীন্দ্র সরোবর স্টেশন থেকে পূর্ব দিক বরাবর লেক গার্ডেন্স অবধি বিস্তৃত টলটলে হ্রদ আর দুপাশে চিরহরিৎ সীমাহীন সবুজের সারি, মন আপনিই জুড়িয়ে আসে। শান্ত, নিরিবিলি, নির্ঝঞ্ঝাট স্পটের যদি খোঁজ করেন কেউ, লেকের থেকে উত্তম স্থান আর কিছু হতে পারে না, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। আমাদের কাছে অবশ্যি লেক জড়িত সুখস্মৃতি বড়ই চিত্তাকর্ষক। মনে পড়ে, বেশ কয়েক দফা মেনকায় সিনেমা দেখে এসে লেকে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। সেসব দিনে ঘটি গরম ও ঝালমুড়ির স্বাদ যেন অমৃতকেও হার মানাতো। হাবিজাবি কথা, অকারণে হাহাহিহি হাসি আর জলের দিকে চোখ রেখে সময় পেরিয়ে যেত হুশ করে। প্রচুর আড্ডা দিয়েও যেন হুঁশ ফিরত না কারও। সেদিন লেকে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম দুজনে। আগের থেকে অনেক সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজানো। কয়েক হাত অন্তর অন্তর বসার সিট ও মেঘছোঁয়া বট, অশ্বত্থ, মেহগনির বৈভবে ছোটখাট উপবন বললে খুব একটা ভুল হবে না। মাঝের সরু রাস্তা ধরে মেনকা সিনেমার দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল এই মেনকায় একবার 'মোহরা' বলে একটি ছবি এসেছিল। সে সময় এই ছবিটি  সুপার ডুপার হিট । বলাই বাহুল্য 'মোহরা' নিয়ে আমাদের উত্তেজনাও ছিল তুঙ্গে। বেশ মনে আছে অক্ষয় কুমার রবিনা ট্যান্ডনের 'টিপ টিপ বরষা পানি' আমাদের সদ্য কৈশোর পেরোনো হৃদয়ে চরম হিল্লোল তুলেছিল সেসময়। তখন মল - মাল্টিপ্লেক্সের বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিল না কোথাও। মোবাইল ঘেঁটে বা ইন্টারনেট সার্চ করে টিকিট কাটা প্রায় চাঁদে যাওয়ার সামিল ছিল। ছবি দেখার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার উন্মাদনা যে কি, সে আমরা বিলক্ষণ জানতাম। আর তাই শুধু মেনকা কেন, নবিনা, প্রিয়া, বসুশ্রী, উজ্জ্বলা, পূর্ণ, ইন্দিরা, তার সাথে মধ্য কলকাতার মেট্রো, গ্লোব, চ্যাপ্লিন, সোসাইটি, রক্সি, এলিট এসমস্ত হলে যাতায়াত যেন পাড়ার গলিতে পায়চারি করার মত ছিল আমাদের দুজনের। আজ ভাবতে অবাক লাগে এই সব হলের অধিকাংশই এখন বন্ধ। মুষ্টিমেয় কিছু সিঙ্গল স্ক্রীন এখন মুছে যাওয়া ধূসর স্মৃতি বহন করে চলেছে নিঃশব্দে। 

লেক থেকে বেরিয়ে ভাবছিলাম লাঞ্চটা সেরে নেব 'ব্যানানা লিফ' রেস্টুরেন্টে। কয়েক যুগ যাওয়া হয়নি সেখানে। সেকথা বলব বলে সৌম্যর মুখের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠলো, 'চল্, আজ ব্যানানা লিফে খাব'..............। ভেবে আশ্চর্য হলুম যে হালফিলে দেখাসাক্ষাৎ হয় না বটে, তবে আমাদের পছন্দের হেরফের ঘটেনি মোটেও। মনে পড়ে গেলো স্কুলে বা স্কুলের বাইরে সামান্য চোখের ইশারায় আমরা কত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতুম নিমেষে। তার ফল অধিকাংশ সময়ই খুব একটা সুখের হতো না। মনে আছে তখন সেভেন কি এইটে পড়ি। একবার স্কুলে আমাদের গার্জেন কল হয়েছিল, একসাথে। ক্লাস টিচার দুজনের মায়েদের মধুর আপ্যায়ন করে বসিয়ে পুঙ্খাণুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছিলেন ঠিক কেমন করে আমরা ক্লাস ডিস্টার্ব করি। সেবার বাড়ি ফিরে দুজনেরই পিঠ লাল করে দিয়েছিলেন মায়েরা। তবে এমন গার্জেন কল প্রায় সবারই হতো ঘুরেফিরে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাঁদরামো করাটা যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছিল ক্লাসের প্রায় সবারই। সে প্রসঙ্গ অন্য আরেকদিন তুলব নাহয়। 

রেস্টুরেন্টে খেয়ে সোজা চলে গিয়েছিলুম ময়দানে। একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় বাইক ষ্ট্যান্ড করে মাঠের ধরে ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছিলাম প্রায় সোয়া একঘন্টা। ছোটবেলার কথা মনে করে আবেগে গলা বুজে এসেছিলো যেমন আবার বেশ কিছু মজার ঘটনা মনে করে খিল্লিও করেছি দারুন। সেসমস্ত কথা নতুন করে লিখে আর লম্বা করবো না বেশি, তবে দুজনেই পণ করেছি, যে এবার থেকে মাঝে মাঝেই এমন নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়ব হুড়মুড়িয়ে। তাতে করে আর যাই হোক বুকের ভিতর অক্সিজেনের যোগানটা সঠিক অনুপাতে হবে, এ ব্যাপারে আমরা একশভাগ নিশ্চিত। সর্বোপরি যাঁরা পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পারেন না বা সুযোগ খুঁজে পান না, তাঁদের বলি, একদিন এভাবেই এবসেন্ট হয়ে যান ডেইলি রুটিন থেকে। সবাইকে একসাথে না পেলেও দুএকজনকে জোগাড় করুন, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিন আর হুল্লোড় করে কাটান গোটা দিনটা। বুক ঠুকে বলতে পারি আমাদের মতো আপনিও ছোটবেলার খাঁটি  'আমি'টাকে খুঁজে পাবেন আবার........... নিঃসন্দেহে ..................

পুনশ্চ : পরেরবার যাঁরা বিবাগী হতে রাজি তাঁরা আমাদের যোগাযোগ করতে পারেন। খিল্লি গ্যারেন্টীড। 

ছবি : নিজস্ব 

#bengaliarticles #bengaliwriteups #nostalgia #bestfriends #reunion #schoolfriends #oldmemories #friendsmeet