Saturday, May 26, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৬ # স্বরলিপি


প্রিয় রূপম,
এই চিঠি লেখার প্রয়োজন পড়বে ভাবিনি কখনো। অথচ কিছু না বলা কথার পাহাড় জমে আছে বুকে।

ফ্রেশার্সের দিন স্টেজে যখন সি মেজরে ধরলে 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ' ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর একের পর এক 'একটুকু ছোঁয়া লাগে', 'তুমি রবে নীরবে' শুনতে লাগলাম, কেমন মাতাল মাতাল লাগছিলো জানো। অজান্তে কোনো এক অলীক ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। বেঁহুশ জ্বরের মতো তোমার গানের হাত ধরে ছায়াপথের যাত্রী মনে হচ্ছিল নিজেকে।

আমি জানি তুমি ঠিক লক্ষ্য করেছিলে আমায়। অনুষ্ঠানের শেষে কায়দা করে জেনে নিয়েছিলে আমার কেমন লেগেছে। 'ভালো' ছাড়া কিছুই বলে উঠতে পারিনি তখন। তুমি সামনে এসে দাঁড়াতেই খানিক আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলাম যে। ছাইরঙের পাঞ্জাবি, রিমলেস ফ্রেম আর হালকা দাড়িতে দিব্বি মানিয়েছিল। 

ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকতে না ঢুকতেই ফাইনাল ইয়ারের রূপম চক্রবর্তীর সাথে প্রেম, আমরা তখন বেদুইন মেঘের মতো হাওয়ায় উড়ছি। সবাই কানাঘুষো বলত পল সায়েন্স আর ইংলিশ লিটারেচারের মহাজোট তৈরি হয়েছে। 

তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম ক্যান্টিন, সিনেমা, নন্দন, আর ময়দানের সেই অশ্বত্থ গাছের ছায়া ছায়া দিনগুলো। নারায়ণগঞ্জের পিকনিক স্পটে যখন সবার আড়ালে তুমি কাছে এলে, কি লজ্জা কি লজ্জা ! তোমায় ছুঁয়ে দেখার লোভ সামলানো বড় কঠিন ছিল জানো, পারিও নি....। 

এরপর থেকেই বোধহয় লুকোচুরির পালা চুকল আমাদের, তাই না ? ছোটখাট অসুস্থতায় তুমি বাড়ি অবধি চলে আসতে, মনে পড়ে ? ফোনে নাকি আমার মুখ দেখা যায় না, এসএমএসে কথা হয় না, আরও কত কি ! ক্রমে দুই বাড়ির লোকজনের কাছে আমরা আরও স্পষ্ট হলাম। সাড়ে তিন বছরের প্রেম পরিণত হল পরিণয়ের দোরগোড়ায় এসে। এক পৌষের সন্ধ্যায় তোমার মা এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন।

আমার তখন ফাইনাল ইয়ার শেষ। তুমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে একবছর হল চাকরিতে ঢুকেছ। কয়েক মাস বাদেই তোমার বিদেশযাত্রা। এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ বলে মেনে নিলেন সকলে। সেদিন কুণ্ঠার ভারে তোমার বাবা মায়ের সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি। বলতে পারিনি তুমি ফেরার পরেই বিয়ে নিয়ে ভাবা যেতে পারে। তোমার চোখেমুখের ঔজ্জ্বল্য আমার কণ্ঠরোধ করেছিল সেবার। তোমাকে নিরাশ করতে প্রাণ চায়নি। বেশ মনে আছে, সিঁদুরদানের সময় আমার পা কাঁপছিল। বারবার ভেবেছিলাম যদি তুমি না ফেরো, আর যদি না আসো...........। মনকে বুঝিয়েছিলাম এমন কপাল কজনের থাকে ? হৃদয়ের ঘরে যার আসন পাতা সেই এসে বসছে এমন ভাগ্য কজনার হয় ?

তুমি যাওয়ার পর বড় অগোছালো হয়ে গেলাম। আমার সবটুকুন নিয়ে চলে গেলে যেন। আমি পড়ে রইলাম একক শূন্যতা নিয়ে। দিন যেতে লাগল। তুমি ফেরার পথ ভুলে গেলে। আমারও ভুল ভাঙতে একবছর সময় লেগেছিল, বিশ্বাস করতে আরও এক বছর। আমার উদ্বেগ, ভয় সমস্তটা সত্যি হল যখন শুনলাম তুমি লিভ টুগেদার করছ একজন ফরাসী শ্বেতাঙ্গীর সাথে। 

অন্তঃস্বত্ত্বা বিদেশিনীর দায়িত্ব তোমার কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল আমার থেকেও। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল রূপম। 

............ কেমন করে !! কেমন করে পারলে তুমি আমার সমস্ত অস্তিত্বকে এক ঝটকায় মিথ্যে করে দিতে ? কেমন করে পারলে তুমি জড়িবাঁধা মুহূর্তদের ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলতে ? তবে কেন গালভরা প্রতিশ্রুতির জালে বেঁধেছিলে আমায় ? এমন করে দূরে সরিয়ে দেবে বলেই কি ? পুরোনো মানুষ, পুরোনো কথার আয়ু এক - দু বছরের বেশি নয়, এ যেন তুমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে......

তবু ভেবেছিলাম তুমি ফিরবে, হয়ত কোনো একদিন..........

তোমার গানের খাতাটা যত্ন করে তুলে রেখেছি আমাদের শোবার ঘরের ছোট দেরাজে। তোমার গিটারের তারটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আশরাফের দোকান থেকে কিনে একটা নতুন লাগিয়ে দিয়েছি। বারান্দার আরাম কেদারায় তুলো বেরিয়ে গিয়েছিল। মুন্নাকে দিয়ে ফুলফুল ছিটের একটা নতুন গদি করিয়েছি। তুমি এলে সব দেখতে পাবে....... আসবে তো...... ?

ইদানিং মাথার ভেতর একটা যন্ত্রনা হতে থাকে জানো। কেমন যেন পাগল পাগল লাগে সেসময়। কানের মধ্যে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে একনাগাড়ে। বড় কষ্ট হয়, বড় কষ্ট .......... মনে হয় তোমার বুকের মধ্যে গুটিয়ে শুয়ে থাকি। তোমার শার্টের হাতাটা আঙুলের মধ্যে জড়াই। ঘুমের মধ্যে কত খুঁজেছি তোমায়, তোমার মাথার বালিশটা আঁকড়ে পড়ে থাকি রাতের পর রাত। দরজায় সামান্য আওয়াজ হলেই ঘুম ভেঙে যেত। ভাবতাম তুমি এলে বুঝি। আরও একবার মোহভঙ্গ হত।

আজকাল কেমন যেন হাত পা অবশ লাগে। বিশেষ কথা বলতে ইচ্ছে করে না। লোকে বলে আমার নাকি মাথার রোগ হয়েছে। ওরা জানে না মনের রোগের উপশম কোথায়। তুমি যদি একবার এসে বসতে কাছে, একবার যদি চুলে বিলি কেটে দিতে, আমার সকল গ্লানি, ক্ষয়, আপনিই জুড়িয়ে যেত। ক্লান্ত হয়ে গেছি রূপম, বড় ক্লান্ত লাগে এখন.........

----------------------------------------------------------------------------

এপর্যন্ত এসে অতসী জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। গরাদের গায়ে ধাক্কা লেগে ভাঙা রোদের টুকরো এসে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। দুপুরের তপ্ত হাওয়ায় চুল এলোমেলো হতে থাকে সর্বহারা উন্মাদিনীর, ফড়ফড় করে উড়তে থাকে পেপারওয়েটের নিচে রাখা অক্ষরহীন দিস্তা কাগজগুলো। মেঝের ওপর ছায়া পড়ে দুজন মানুষের। 

একজন পুরুষকণ্ঠ ডেকে ওঠেন, 'মাসিমা.........মাসিমা......' ? 

এই দুটি শব্দে অতসীর বলিরেখায় বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় না। আগের মতোই সে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে। 

পুরষকণ্ঠটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 'আজও আপনি চিঠিটা শুরু করলেন না' ?

পাশে দাঁড়ানো একজন তরুণী বিদেশিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, 'চিঠি লিখব, চিঠি লিখব করে রোজ কাগজের তলব করেন। অথচ কাগজ দিলে এক বর্ণও লিখে উঠতে পারেন না। চিঠি লেখা তো দূর উনি ভালো করে কথাই বলেন না এই হোমের কারোর সাথে। আপনিও তো গত কয়েকদিন ধরে আসছেন, ফিরে তাকাচ্ছে কি ? সর্বক্ষণ যেন অন্য জগতে পড়ে রয়েছেন । অথচ এই অবস্থায় আপনি বিদেশে  নিয়ে যেতে চাইছেন। আমি তো বলব ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন'।

'এটা ঝুঁকি নয় ডঃ সেন, উনি আমার দায়িত্ব'। স্পষ্ট বাংলায় দৃপ্তস্বরে কথাগুলো বলল শ্বেতাঙ্গী তন্বী। 

ডঃ সেন খানিক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, 'বেশ, আপনি যখন সমস্ত পেপার্স সাবমিট করেছেন আমার আর কি আপত্তি থাকতে পারে। শুধু কয়েকটা জায়গায় সইয়ের ব্যাপার আছে'। 

পাশের টেবিলের ওপর কয়েকটা জরুরী কাগজ এগিয়ে দেন চিকিৎসক। বিদেশিনী সই করতে থাকে একের পর এক। 

ডঃ সেন খানিক সংকোচে জিজ্ঞেস করলেন, 'কিছু মনে করবেন না, মানে হঠাৎ এইভাবে এতবছর পর অতদূর থেকে এসে ওনাকে নিয়ে যেতে চাইছেন......কারণটা ঠিক.............'

স্মিত হাসে তরুণী, তারপর সই করে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলে, 'বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল, আমি যেন ওনার কাছেই থাকি। কাজের সূত্রে আমার ফ্রান্সের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তাই ওনাকেই নিয়ে যেতে এসেছি। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, খুব ছোটবেলায় মা হারিয়েছি, ওনার চিকিৎসার কোনোরকম গাফিলতি আমি হতে দেব না'।

ডঃ সেন সম্মতিসূচক মৃদু ঘাড় নাড়লেন। কাগজের ওপর চোখ বুলিয়ে সইগুলো চেক করে নিলেন। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা...... ক্যাথরিন চক্রবর্তী।

ক্যাথরিন পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় জানলার দিকে। হাঁটুমুড়ে বসে অতসীর কাঁধের ওপর আলতো করে হাত রাখে। তারপর কোমলস্বরে ডাকে, 'মা......... মা......'?

ধীরে ধীরে অতসী ঘুরে তাকায় ক্যাথরিনের দিকে, বেশ কিছুক্ষন নিরীক্ষণ করে নিস্তেজ গলায় বলে, 'কেএএ......' ?  

ক্যাথরিন জড়িয়ে ধরে অতসীকে। অচেনা মানুষের ভীষণ অদ্ভুত চেনা গন্ধ এসে লাগে নাকে।  

কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যাথরিনের মুখের ওপর হাত বোলায় অতসী। অবিন্যস্ত রুপোলি চুলের ফাঁকে দৃষ্টি ঝাপসা লাগে যেন। চোখের পাতায় জল চিকচিক করতে থাকে। 

তারপর ভাঙা গলায় অস্ফুটে বলে, 'বড় চেনা লাগে মুখটা...........কোথায় যেন..........'  

ক্যাথরিনের মুখে শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি খেলে যায়। ঘরময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এক নতুন বন্ধনের আলো.......


চিত্র: গুগল ; বিন্যাস : নিজস্ব 


#bengalishortstories #bengalilovestories #Molat   





  

Saturday, May 19, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৫ # বহিছে ধারা

ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে সমরেশ গজগজ করতে থাকেন। পাঁচটার মধ্যে ফেরার কথা ঋকের। সাড়ে পাঁচটা বাজে অথচ ধারে কাছে টিকি পাওয়া যাচ্ছে না ছেলের। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে এলেন তিনি। হাজরা কালীঘাটের মুখে ডানদিকের সরু গলির দোতলা রংচটা বাড়ি। গলির শেষ মাথাটা অবধি দেখা যায় বারান্দা থেকে। দুচারজন পথচলতি মানুষের ভিড়ে অতিপরিচিত মুখটা খুঁজতে থাকেন সমরেশ। বিকেল শেষের ছিঁটেফোঁটা আলোয় সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ ছেলের দেখা নেই। আজ আইপিএলের খেলা আছে ইডেনে। প্রায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুটো টিকিট জোগাড় করেছেন সমরেশ। বাবা ছেলের ক্রিকেট দেখার শখ সাংঘাতিক। এখনই বেরোতে না পারলে ঠিকমতো গুছিয়ে বসা যাবে না। ভিড় তো আছেই তার ওপর জ্যাম। এসব ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওঠেন নিরুপায় বাবা। আর ধৈর্য রাখতে না পেরে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নম্বরটা ডায়াল করতে থাকেন। 

অকস্মাৎ দরজা ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ভিতরে ঢোকে ঋক। ব্যাগটা সাইডে ফেলে সোফার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। সমরেশ চেঁচিয়ে ওঠেন। 
-  কিরকম আক্কেল তোর ? কটা বাজে খেয়াল আছে ? এখনই বেরোতে না পারলে....... 
পুরোটা শেষ করতে দেয় না ঋক। হাত তুলে থামায় বাবাকে। টেবিলের ওপর রাখা বোতল থেকে দু ঢোঁক জল খেয়ে নেয়। তারপর একটু দম নিয়ে নিচুস্বরে বলে, 'কোচিং থেকে বেরিয়ে দেখলাম পাশের পাড়ায় ব্লাড ক্যাম্প হচ্ছে। দিয়ে আসতেই যা একটু দেরি হল'। 

মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেলেন সমরেশ। ঋকের প্রতি আরও কিছু ক্ষোভের কথা মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল আপনিই। ঘুরে তাকালেন দেওয়ালে ঝোলানো একটা বাঁধানো ছবির দিকে। একফুট বাই একফুটের কাঠের ফ্রেমে একটা গোটা ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে আছে। বছর দুয়েক আগের স্মৃতি এখনো দগদগে ঘায়ের মতো দুজনের বুকেই জীবন্ত। কান পাতলে এখনো সেই গাড়ির কর্কশ আওয়াজটা মাথার মধ্যে তীব্র জ্বালা ধরায়। মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনার ভয়াল কোপে স্নেহলতা আজ দুজনের থেকে বিচ্ছিন্না। দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে এক উন্মাদ ট্যাক্সির চাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় একটা শরীর, ক্ষতবিক্ষত হয় দুটো হৃদয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও শুধুমাত্র রক্তের অভাবে সেদিন ফেরানো যায়নি তাঁকে। 

বাবার পিছনে এসে দাঁড়ায় ঋক। ছবির কাঁচে সন্তানের ছায়া পড়ায় সম্বিৎ ফেরে সমরেশের। কোমল স্বরে বলেন, 'যা, মুখ হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। সময়মতো পৌঁছতে হবে তো'। বাবার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দেয় ঋক। কনুইয়ের ভাঁজে একটা গোলাকার ব্যান্ডেড চোখে পড়ে। তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কি ব্যাপার ! চোট লাগল কি করে তোমার' ? সমরেশ কোনোমতে কম্পিতস্বরে বলেন, 'ও কিছু না, তুই অত ভাবিস না'। ঋক হাল ছাড়ে না, গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করে, 'সত্যি করে বলো, এটা কি করে হল'। সমরেশ খানিক্ষন চুপ করে থাকেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, 'আসলে আজকের দিনেই তো........তাই অফিস যাওয়ার আগে আমিও একবার ওই ব্লাড ক্যাম্পে.......'। 
নিজেকে আর সামলাতে পারে না ঋক । এক লহমায় জড়িয়ে ধরে সমরেশকে। অন্তর্নিহিত গ্লানি জল হয়ে বেরিয়ে আসে দুজনেরই গাল বেয়ে। অস্ফুটে বলে, 'বাবা...........'

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এমন গল্প হয়ত খুঁজলে পরে অনেক পাওয়া যাবে। তার কারণ ভারতবর্ষে রক্তের জোগানে বরাবরের সমস্যা আছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক, ভারত সরকারের একটি রিপোর্টে জানা গেছে যে ২০১৬ সালে ১২ মিলিয়ন ইউনিটের চাহিদা অনুযায়ী শুধুমাত্র ১০.৯ মিলিয়ন ইউনিট রক্তই পাওয়া গেছে। সুতরাং ঘাটতির পরিমাণটা যে এখনও বিপুল তা এই সহজ অঙ্কের মাধ্যমেই বোঝা যায়। আমাদের মধ্যে এখনো অনেকেই আছেন যাঁরা রক্তদান এড়িয়ে চলেন, বিভিন্ন রকমের অজুহাত দেন এবং সর্বোপরি রক্তদান সম্পর্কে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন। যেমন - রক্তদান করলে শরীরে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে বা পরবর্তীকালে নানান রকম শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে ইত্যাদি। তাঁদেরকে বলব সময় করে নাহয় একবার আপনার চিকিৎসককেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। তাঁর কথা নিশ্চই বিশ্বাসযোগ্য হবে এই আশা রাখি।

আর বাকিদের বলি, আগামী ২০শে মে জেনেসিস হাসপাতালে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হবে। যাঁরা রক্ত দিতে ইচ্ছুক তাঁরা একঝলক এই ছবিতে চোখ বোলালেই পুরোটা বুঝতে পারবেন। বাকি সুস্থ থাকুন আর রবিবার দেখা হচ্ছে ......

#blooddonationcamp #blooddonation #bengalishortstory #Molat #GenesisHospitalKolkata

Tuesday, April 17, 2018

ভবঘুরে

আমার দেখা এই শহরের জলপাহাড়ি মুখ
আমার যত খেয়ালখুশি পালিয়ে বাঁচার সুখ
অস্থির মন আকাশ ঝড়ে উড়ছে অনুভব
এমন সময় ঘরের বাঁধন নেহাত অসম্ভব।

বসত তবে ছাড়তে পারি পরান যাযাবর
দুঃসাহসের ইচ্ছে ডানা মুক্ত হৃদয়ঘর।
সাগর মরু পেরিয়ে যাব দূরের থেকেও দূরে
চিনুক শহর ভিন্ন নামে, নির্জন ভবঘুরে....
ছবি: নিজস্ব

Tuesday, April 10, 2018

জিয়ানস্টাল ৩ # আজবৈশাখী ঝড়

তখন আমার চার সাড়ে চার বছর বয়স। চৈত্র মাসে হপ্তাশেষের ছুটিতে মা আর আমি মামার বাড়ি গেছি। মাঝেমাঝেই আমরা শনিবার সকালে যেতুম আর রোববার সন্ধ্যের দিকে বাবা গিয়ে নিয়ে আসতো আমাদের। আমাদের এই চটজলদি হাওয়াবদলের বেশ একটা রেওয়াজ ছিল তখন। সাধারণত শনিবার হলেই সকাল সকাল বাহারি জামা প্যান্ট পরে মায়ের হাত ধরে ট্যাক্সিতে উঠে পড়তুম চেতলার মোড় থেকে। তারপর সোজা সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরতুম। চিতপুর রোড হয়ে জোড়াসাঁকোর ধার ঘেঁষে ডানদিক নিয়ে শিকদার পাড়া স্ট্রিটে এসে থামতুম। উত্তর কলকাতার অতি চেনা বনেদী পাড়ার সরু সর্পিল গলি। গলির একমাথা থেকে আরেকমাথা অবধি বাড়িগুলো এমন বেমক্কা গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকত যে মনে হত যেন গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে এসেছে। আদি ঐতিহাসিক শহরের অনন্য প্রচ্ছদ আর এক আশ্চর্য নোনাধরা দেওয়ালের গন্ধে মনটা মাখামাখি হয়ে যেত। সেই সময় চোখ বুজলেও দিব্যি বলে দিতে পারতুম মামারবাড়ির আশেপাশে কোথাও একটা এসেছি। পুরনো তিনতলা বাড়িটার নিচের তলায় একটা ছোট্ট সোনা রুপোর দোকান ছিল। চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেই কারিগরদের ছেনি হাতুড়ির ঠুক ঠুক আওয়াজ শোনা যেত। ভারি মন মাতানো ছন্দ ছিল সে শব্দে। ভিতরে ঢুকে একটা শান বাঁধানো  কলতলা পেরিয়ে কাঠের রেলিং ঘেরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হতো। সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু থাকার দরুণ আমাকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হতো। 

একদিন দুপুরে দোতলার ঘরে সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে। সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা পুরোনো আমলের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক, তাতে আমি, মা আর দিদা পাশাপাশি শুয়ে আছি। দাদু আর মামারা যে যার কাজে বাড়ির বাইরে। আমার অনিচ্ছা সত্বেও অকারণ ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমাকে প্রায় জোর করেই ঘুম পাড়ানো হতো। সেদিন কি এক কারণে কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। বাড়ির পূর্বদিক লাগোয়া একটা মার্বেলের কারখানা ছিল। সর্বক্ষণ মেশিনের আওয়াজ আর মিস্ত্রীদের অনর্গল কথাবার্তা শোনা যেত। মনে আছে একবার দিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম এই এতো আওয়াজে ঘুমোও কি করে। দিদা বলেছিল, 'অভ্যেস হয়ে গেছে রে, এখন এই আওয়াজটা না হলে যেন ঘুমই আসতে চায় না'। ভারী অবাক হয়েছিলুম সে কথায়। 

যাইহোক সবাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখে আমি দিব্যি পা টিপে টিপে ঘরের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এলুম। এরপর বাঁদিক ঘুরে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ছাতে চলে এসেছিলুম। ছাতটা খুব বেশি বড় না হলেও উঁচু পাঁচিল আর খোপকাটা  জাফরির খাঁজে খাঁজে বিকেল দেখাটা ভারী মনোরম বস্তু ছিল আমার। মান্ধাতা যুগের এজমালি ছাতে একটা চিলেকোঠার ঘর আর সামনে খানিকটা বেওয়ারিশ একফালি চৌকো মতন জায়গা ছিল। ওই জায়গাটায় দাঁড়ালে ছাতের একেবারে মাঝখানটাতে গিয়ে দাঁড়ানো হতো। সেখান থেকে চারপাশটা খুব ভালো করে দেখা যেত। ছোট ছিলাম বলে পাঁচিল পেরিয়ে নিচে রাস্তা দেখতে পেতুম না বটে তবে আশেপাশের বাড়ি আর অনেকটা খোলা আকাশ দেখতে পাওয়ার রোমাঞ্চই ছিল আলাদা।পরে শুনেছিলুম ছাতের দক্ষিণ পূর্ব কোণটা নাকি বাড়ির প্রায় সবারই প্রিয় অবসর ছিল। ওই কোণে বসার জন্য মা আর মামাদের মধ্যে নাকি হাতাহাতি হয়ে যেত প্রায়। বরাবরের মতো ছাতের একচক্কর ঘুরে আমিও ওই কোণটায় এসে দাঁড়িয়েছি। 

এমন সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ভয়ানক মেঘ করেছে। পাক খেতে খেতে ধূসর তুলোটে গোলাগুলো যেন রে রে করে তেড়ে আসছে আমারই দিকে। ক্রমশ তার সাথে উড়ে এল ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত। ক্ষনিকের মধ্যেই জমাট বাঁধা দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেল যেন। স্নিগ্ধ তিরতিরে হাওয়ার এক ঝাপটায় আমার শরীরের আনাচে কানাচে আতরের মতো ছড়িয়ে পড়ল ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। এক অদ্ভুত নেশার মতো পেয়ে বসেছিল আমায়। কতক্ষন এভাবে বুঁদ হয়ে দেখছিলুম জানি না। আমার পিলে চমকে দিয়ে হঠাৎ কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল কাছেই। পাল্লা দিয়ে শুরু হল প্রবল ঝড়ের তান্ডব। চোখের সামনে এমন অপরিকল্পিত চিত্রনাট্য দেখে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলুম। তাড়াতাড়ি কোনোমতে সেই চিলেকোঠা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। চিড় খাওয়া কাঠের ফাঁক দিয়ে দেখলুম চতুর্দিক কেমন আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। যেন কেউ তুলির ওপর কালো কালি লাগিয়ে ক্রমাগত আকাশের একদিক থেকে আরেক দিকে বুলিয়ে দিচ্ছে। নাম না জানা উত্তেজনা আর অবিমিশ্র ভয়ের যুগলবন্দিতে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। অদ্ভুতভাবে নিচে নেমে যেতেও মন চাইল না। কোনো এক অনুচ্চারিত মন্ত্রবলে কিছুতেই এক পা নড়াতে পর্যন্ত পারলুম না। শোঁ শোঁ শব্দে গোটা ব্রহ্মান্ড যেন তোলপাড় করছে তখন। দরজাটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছিলুম। মনে হল এই ঝড় যেন আমায় দেখতেই হবে। এরপর যা যা হবে তা না দেখলে বড্ড আফশোষ রয়ে যাবে আমার।

একঠায় নির্বাক দাঁড়িয়ে ঝড়ের রুদ্ররূপ প্রত্যক্ষ করলুম দুচোখ ভরে। এর পরপরই  শুরু হল তেড়ে বৃষ্টি। তীক্ষ্ন ছুরির ডগা দিয়ে আকাশের মাঝবরাবর কেউ যেন ফালা ফালা করে কেটে দিয়েছে। অবিরাম শ্বেত রক্তক্ষরণের বড় বড় ফোঁটায় ছাতের এক কোণ থেকে আরেক কোণ সে ভিজিয়ে দিল অবলীলায়। নিমেষে জলধ্বনির চরবর চরবর আওয়াজে আমার উৎকণ্ঠাকে দ্বিগুন বাড়িয়ে বাড়ির লোকজনকে একেবারে জাগিয়ে তুললে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার খোঁজ পড়ে গেল চারদিকে। কারণ আমার হারিয়ে যাবার বদরোগের সাথে মামার বাড়ির সকলেই বিশেষ অবগত ছিল। সে আরেক গল্প। অন্য একদিন বলব নাহয়। ততক্ষনে মা ছুটে গেছে নিচে আর দিদা আমার খোঁজে ছাতে চলে এসেছে। আমি তখন দরজার আড়ালে বিমুগ্ধ্ নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। দিদা এসে জিজ্ঞেস করেছিল, 'কি রে ! তুই কাউকে না বলে দিব্যি ছাতে এসে একলা একলা কি করছিস' ? আমি বলেছিলাম, 'এই যে কেমন ঝড় হচ্ছে ! সেটাই দেখছি গো'। দিদা বললে, 'এই ঝড় কি আর একলা বাইরে এসে দেখার জিনিস রে ? এ যে কালবৈশাখী ! তোকে যে উড়িয়ে নিয়ে যায়নি এই আমাদের ভাগ্যি, নিচে চল শিগগির'। 

সেই প্রথম আমি এই ঝড়ের নাম জানলুম। কালবৈশাখীর সাথে সেই আমার প্রথম একক পরিচয়। এমন দুর্নিবার উন্মাদ আচরণ অন্য কোনো কিছুর হতে দেখিনি আগে। যে বেলাগাম দুরন্ত প্রতিচ্ছবি দেখলুম তা সেসময় অন্য কিছু দেখার কাছে নস্যি। এর তুলনা বোধহয় একমাত্র প্রথম জুরাসিক পার্ক দেখার অভিজ্ঞতার সাথে করা যায়। তবে প্রজন্মের কাঁধে মাথা রেখে ইতিহাস যে পুনঃরচিত হয় তার প্রমাণ পেলুম গতকাল হাতেনাতে। 

চিত্র : নিজস্ব 
গতকাল ঠিক তেমনি করেই আমার তিন বছরের পুত্র তাকিয়ে ছিল বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে। বাইরে তখন দিগ্বিদিগ কাঁপিয়ে তীব্র প্রলয় চলছে। তার সাথে একের পর এক ছুটে আসছে মর্মভেদী জলের বাণ। চরম বিস্ময়ে আধো আধো গলায় সে শুধিয়েছিল, 'এতা কি হচ্ছে বাবা' ?  বললুম, 'ঝড় হচ্ছে রে..... কালবৈশাখী ঝড়....... তোর ভালো লাগছে' ? সে কথার উত্তর না দিয়ে বড় বড় চোখে শুধু আলতো করে ঘাড় নেড়েছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলুম কালবৈশাখী দেখার প্রখর উন্মাদনা উজ্জ্বল আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তার সারামুখ জুড়ে। গভীর বিস্ময়ে লেপ্টে থাকা  অবয়বে প্রথম ঝড়ের তৃপ্তি । যেমনটা ঠিক বছর পঁয়ত্রিশ আগে শিকদার পাড়া স্ট্রিটের কোনো এক অখ্যাত বাড়ির ছাতে একটা বছর পাঁচেকের ছেলের মুখে ছিল। অবিকল একইরকম। সোঁদা গন্ধ মেশানো, বৃষ্টি ভেজা, অনামী ছোট্ট চিলেকোঠার ছাপ। অবশ্য চরিত্রের বদল ঘটেছে, বদল ঘটেছে স্থান কালেরও। শুধু বদল হয়নি আদি অকৃত্রিম মুহূর্ত রোমাঞ্চের, বদল হয়নি বৈশাখীর......কাল ছিল......সে আজও তেমনি আছে।




#kalboishakhi #nostalgia #childhoodmemories #bengaliarticle #Molat 









Thursday, March 29, 2018

গোলাপি

সকাল সকাল সংবাদপত্রের পাতা ঘাঁটতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেলুম বাপ্। লাইসেন্স প্রাপ্ত মহিলা অটোচালকরা অপেক্ষা করে বসে আছেন তার কারণ পুরুষ অটোচালকরা নাকি উত্তাল ঢেউয়ের মতো করে একের পর এক আপত্তি জানিয়েছেন। অর্থাৎ কিনা মহিলারাও যে অটো নিয়ে ভাড়া খাটতে পারবেন তাতে করে পুরুষ অটোচালকের মধ্যে সাংঘাতিক রকমের একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়েছে । গত ৬ই ফেব্রুয়ারি এই খাস কলকাতার রাস্তায় গোলাপি অটো চলার কথা ছিল। অজানা জ্বরের মতো কোনো এক অযাচিত কারণে সেই বিষয়ে আপাতত স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে। জনৈক রাজনৈতিক নেতা বলছেন মহিলা অটোচালকের নাকি নিরাপত্তা নেই। তারা নাকি অটো নিয়ে বেরোলেই ধর্ষিতা হতে পারেন।

আমার বিনম্র প্রশ্ন আপনার গদির নিরাপত্তা আছে তো ? মানে সামনের ভোটে পাশা যদি উল্টে যায় তখন খাটের তোষকের তলায় আপনাকে যেন মুখ লুকোতে না হয়। আমি তো জানতাম বাকি রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের নিরাপত্তার সমস্যা অনেক কম। অন্তত সরকারের পক্ষ থেকে ঢাক পিটিয়ে যেটা বলা হয় সেটা স্রেফ গুল গোলা জল বুঝি ! কিছু বোঝার আগেই গর্বের ফুটো ফানুশটা এভাবে উড়িয়ে দিলেন মশাই। সমস্যাটা ঠিক কোথায় স্পষ্ট করে বলুন না মাইরি। আমি অবশ্য সম্ভাব্য দু একটা কারণ পেয়েছি।

১. মহিলা চালক দুহাতে হ্যান্ডেল ধরে অটো নিয়ে সিগন্যালে দাঁড়িয়েছে, এটা দেখলেই বোধহয় পুরুষ যাত্রীদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রাটা লাফ দিয়ে শরীর বেয়ে একেবারে মাথায় উঠে চু কিতকিত খেলতে পারে। অথবা পুরুষ অন্তর্বাসের কানাগলিতে ঘন্টাধ্বনি হতে পারে পুনঃপুনঃ রূপে। নিঃসন্দেহে এই দৃশ্য বিদেশী পর্নোগ্রাফির থেকে কম কিছু নয়। এহেন সরাসরি সম্প্রচারে চরম উত্তেজনায় যাত্রীদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধর্ষণ তো এর কাছে শিশু।

২. মহিলা অটোচালকের অটোতে যে মহিলা যাত্রীরাই বেশি চড়বেন এইটা বোধহয় পাঁচিলের ওপর বসা মিনি বেড়ালটাও জানে। এতে পুরুষ অটোচালকদের ব্যবসা চোট খাবে সেটা শুধুমাত্রই ছেলেভোলানো গল্প। আসল কথা হচ্ছে ড্রাইভারের বাঁদিকে যে মহিলা যাত্রীর বসাটা কমে যাবে তাতে করে কনুইয়ের কসরতে ছেদ পড়বে যে। সকাল বিকেল দুবেলা কনুই আন্দোলন করে যে ভেসলিনের কৌটো খালি হয়ে যায় তার কি হবে ? এটাও তো ভেবে দেখতে হবে নাকি !

৩. পশ্চিমবঙ্গে যে কোনো কাজ বরাবরই আমরা একটু রয়ে সয়ে করতে ভালোবাসি। সব কিছুতে   অতো তাড়াহুড়ো সয় না বাপু। যেখানে দিল্লী, নয়ডা, গুরুগ্রাম, মুম্বই, সুরাত, বেঙ্গালুরু, ভুবনেশ্বর বা রাঁচির মতো শহরে গোলাপি অটো পক্ষিরাজের মতো উড়ে চলেছে সেখানে আমরাও যদি এখনই ডানা ঝাপটাতে থাকি আমাদের কি মান থাকবে ? পিছিয়ে পড়ার ট্র্যাডিশনটা বজায় রাখতে হবে তো !

৪. আরও শুনলাম যে এই 'লাইনটা' নাকি ভালো নয়। কখন যে কি হয় কেউ জানে না। তাই 'মহিলা অটোচালক' বলে কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব থাকা মানে নিজেদের পৌরুষের খোলা বোতামটাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। অতএব চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা। গুরুদেব, দয়া করে বলুন এই নাপাক দুনিয়ায় কোন লাইনটা ভালো, আমি সেই লাইনে গিয়ে লাইন দেব, দিব্যি গেলে বলছি। 

৫. সর্বোপরি মহিলা প্লেনচালক হতে পারেন, গাড়িচালক হতে পারেন, বাসচালক হতে পারেন, বাইকস্কুটি চালক হতে পারেন কিন্তু অটোর বেলাতেও যে অটোমেটিক ভাবে ব্যাপারটা ঘটবে এমনটা নয়। তিনচাকার যানটি বোধহয় মহিলাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টতার সাথে কোনোরকম খাপ খায় না। অটো মানেই বেশ একটা পুরুষ পুরুষ গোছের ভাব আছে। পিছনে দুটো চাকা আর সামনের একটা চাকা পুরুষ দেহতত্ত্বের সাথে বেশ যায়। সেক্ষেত্রে মহিলাদের বড্ড বেমানান লাগবে কিনা, তাই বোধহয় এমন নিদানের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। 

আমার উর্বর মস্তিষ্কে এর চেয়ে বেশি আর কারণ খুঁজে বের করা যায়নি। আপনাদের যদি তেমন কোনো কারণ মাথায় আসে আমাকে নিঃসংকোচে জানাতে পারেন। আপনার নাম কার্টসি সহ যোগ করে দেব। এই লেখা পড়ে আবার মোমবাতি মিছিল শুরু করবেন না যেন। লোডশেডিং হলে সে আলাদা ব্যাপার, তা না হলে খামোখা রাস্তায় ভারী ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় বাপু। এমনিতেই জ্যাম হচ্ছে রোজ তার ওপর মোমবাতি গুঁজলে আর রক্ষে থাকবে না। 



বিন্যাস : নিজস্ব 


#pinkauto #femaleautodriver #Molat

Thursday, March 22, 2018

নীরব উপাখ্যান

বলার মতো নয় সে কথা, বলা বিপদ ভারী
মনের মতন কথার ধরণ কোথায় শিখতে পারি
বিষাদ জানে সেসব মানে অনন্ত ইন্তেজার
নিজের সাথে মুখোমুখির সময় হয়েছে এবার।

ঠোঁটের খাঁজে লুকিয়ে থাকে অঙ্ককষা মাপ
উপন্যাসের মুখ ছুঁয়ে যায় প্রেক্ষাপটের ছাপ
শব্দ প্রহর দাপিয়ে বেড়ায় মধ্যরাতের দেশ 
আমার কথার শেষ রয়ে যায়, নির্বাক অনিমেষ।

যাক না উড়ে দামাল ঝড়ে শুকনো পরিচয়
শরীর জুড়ে মঞ্চ আঁকা নিখুঁত অভিনয়....
এসব কথার অর্থ শুধু অনর্থ দিয়ে ঘেরা
কাঠগড়াতে অজ্ঞাতবাস নিরুত্তর জেরা।

প্রশ্ন বিশেষ থাক সে যতই, আস্কারাতেই দাম
এর চাইতে সহজ কেনা অলস দিনের নাম....
খানিকটা তাই গোপন কথার একক চন্দ্রযাপন
নিজের সাথেই বোঝাপড়ার সময় হয়েছে এখন।

ছবি : গুগল 




















#bengalipoems #molat #DebdattaSinha

Saturday, March 3, 2018

আরও একবার

আমার ঋণের শেষ নেই৷ কি লিখব, বা এই সময় ঠিক কি লেখা উচিত, প্রচুর ভেবেও সেসব আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ এ যে আমার পরম পাওয়া। চোখের সামনে ছাপার অক্ষরে নিজের কবিতাকে দেখতে পাওয়া একরকম স্বর্গলাভ বলা যেতে পারে। অন্তত আমার কাছে কতকটা তাই। গন্যমান্য মানুষদের ভিড়ে যে নগন্যের রচনাও স্থান পাবে, এ নিজের চোখে যতবার দেখছি ভালোলাগার চেয়ে বিস্মিত হচ্ছি বেশি। অঙ্কুর সাহিত্য সংকলনের সম্পাদকদ্বয় শ্রী সুরজিৎ হালদার ও শ্রীমতী কণিকা মহন্ত কে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। গ্রূপের মাননীয় ও মাননীয়া এডমিনদের আমার প্রণাম। পরের প্রকাশনাতেও যে আমার লেখাকে জায়গা করে দেবেন তা আমি সত্যিই বুঝিনি । আর ঠিক সেই কারণে এই ঋণ বেড়েই চলেছে। অঙ্কুর নিয়ে আপনাদের নিরলস প্রয়াস ও পরিশ্রমকে আমার কুর্নিশ । আশা করি সাহিত্যের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই নজির রেখে চলুক এই প্রকাশন। আপনাদের সকলকে আমার অন্তরের শুভেচ্ছা। মলাটের পাঠকদের কাছে আমি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ, যাঁরা একটানা পাশে আছেন বলেই আরো একবার অসম্ভব জিনিস সম্ভব হল।


ছবি: নিজস্ব

ছবি: নিজস্ব

Wednesday, February 14, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৪ # হ্যাপি শিবলেন্টাইন

ভোর সাড়ে চারটে।  কৈলাসের বেডরুম। শিব জোর ঘুমোচ্ছেন। পার্বতী আলতো করে টোকা মেরে অনেক্ষন ধরে  জাগাবার চেষ্টা করছেন কিন্তু শিব চোখ খুলছেন না। অগত্যা পার্বতী রেগে গেলেন। 

পার্বতী : বলি সারাদিন ধরে মোষের মতো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলে চলবে ? চোখ জোড়া খোলো এবার। বেলা তো বয়ে যায়......
শিব : (ঘুম চোখে ধড়মড় করে উঠে বসে) আচ্ছা জ্বালাতন মাইরি ! সকাল সকাল অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন ? বাড়িতে তো কাক চিল বসতে ভয় পাবে !
পার্বতী : তার জো আছে নাকি ! কৈলাসের এই উঁচুতলায় বাড়ি বানিয়েছো। শীতকালে হাড়েহাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে যাবার জোগাড় হয়। যম পর্যন্ত আসতে ভয় পায় এখানে। কাক চিল কি পবনের রথে চড়ে আসবে ? 
শিব : কি ব্যাপার বলো তো ? আজ একেবারে তিরিক্ষি মেজাজ দেখছি তোমার ! ভোরবেলাতেই  দিদি নাম্বার ওয়ান দেখেছো নাকি ? 
পার্বতী : এই শোনো, বাংলা সিরিয়াল দেখা নিয়ে খোঁটা দেবে না কিন্তু, এ আমি আগে থেকেই বলে রাখছি, নইলে আমি প্রলয় বাধাব বলে দিলুম। 
শিব : (থতমত খেয়ে) আচ্ছা আচ্ছা বেশ, ক্কি কি হয়েছে সেটা বলবে তো......

পার্বতী : (লজ্জা লজ্জা ভাব করে) আজ কি দিন মনে আছে তোমার ?
শিব : (সামান্য হেসে) বিলক্ষণ ! বিলক্ষণ ! মনে থাকবে না আবার ? আজ তো শিবরাত্রি। 
পার্বতী : (পাত্তা না দিয়ে) হ্যাঁ, সে তো আছেই, এছাড়া আরও একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে। 
শিব : (মনে মনে) খেয়েছে রে ! কোনটা ভুলে গেলাম ! আমাদের এনিভার্সারি ! যাচ্চলে আমি তো মনেই করতে পারছি না। সারাদিন এতো গাঁজা ভাঙে ব্যস্ত থাকি, কবে যে কি দিন মনে রাখাই চাপ হয়ে যাচ্ছে এখন। 
পার্বতী : কি বিড়বিড় করছ বোলো তো তখন থেকে, হ্যাঁ ?
শিব : (জটা চুলকে) ইয়ে মানে.... মাইরি বলছি। একটু ধরিয়ে দাও প্লিজ। 
পার্বতী : (রেগে গিয়ে) মোটেই না, এই সাতসকালে মোটেই তোমার গাঁজার কল্কে ধরিয়ে দিতে পারব না, আমার মেলা কাজ আছে। 
শিব : আহাহাহা, আমি সে ধরানোর কথা বলিনি গো, মানে ভুলটা একটু ধরিয়ে দিতে বলছিলুম আরকি। পার্বতী : ওহ ! (আবার লজ্জা লজ্জা ভাব করে) আজ তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে.....ভুলে গেলে ?
শিব : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) হা কপাল ! সেটা আবার কি ?
পার্বতী : (আদিখ্যেতার স্বরে) যাও, তুমি না বড্ড ইয়ে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কি সেটা জানো না নাকি ?
শিব : (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) মা কালির দিব্যি বলছি !..... আঃ সরি, আমি আবার অন্য লোকের দিব্যি খাচ্ছি কেন ? মানে সত্যি বলছি আমি এসব কিচ্ছু জানি না। 
পার্বতী : (মুখ নিচু করে সলাজ কণ্ঠে) যাও....... আমার লজ্জা করছে। 
শিব : আঃ, কি আপদ ! ধানাইপানাই না করে একটু খোলসা করে বলোই না মাইরি ! 

পার্বতী শাড়ির খুঁট জড়াতে লাগলেন। তারপর শিবের গলা থেকে সাপটাকে একটানে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেই দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলেন। অপ্রত্যাশিত প্রেমের জোয়ারে শিব একটু খেই হারিয়ে ফেললেন। 

পার্বতী : ভ্যালেন্টাইন্স ডে মানে হল প্রেমদিবস, বুঝলে ? 
শিব : (ভারী অবাক হয়ে) প্রেমদিবস !! প্রেমের আবার দিবস রজনী হয় নাকি গো ? 
পার্বতী : (দুহাত ছাড়িয়ে নিয়ে) হয় গো হয়। ইদানীং হচ্ছে, আর সবাই কচ্ছে। এই আমরাও না  আজ করব কিন্তু। 
শিব : (পার্বতীকে কাছে টেনে দুষ্টুমির গলায়) আজ আমরাও করব ?? যাহ ! সাতসকালে একঘর  ছেলেপুলেদের সামনে এসব আবার কেউ করে নাকি ! কি যে বলো না তুমি ! ধ্যাৎ !
পার্বতী : আঃ ! তুমি তো ভারী অসভ্য। আমি কি সেসব কথা বলেছি নাকি ! 
শিব : তাহলে ?
পার্বতী : মানে, আজ আমরা একটু সেলিব্রেট করব। এই যেমন ধরো একটু সেন্ট্রাল পার্ক গেলাম, তারপর একটা মলে গিয়ে একটু শপিং টপিং.......

পার্বতীর কথা শেষ হবার আগেই  শিব সঙ্গে সঙ্গে দুহাত ছিটকে এলেন। 

শিব :(নাকে হাত দিয়ে) ছিছিছিছি, পার্বতী ! ছি, আজকের একটা পবিত্র দিনে তুমি এসব কি মলমূত্র টেনে আনছ বলো দেখি ?
পার্বতী : আ মোলো যা ! এ মল সে মল নয় দেব.........এ হল গিয়ে শপিং মল, সেখান গিয়ে একটু শপিং করব, হাত জড়াজড়ি করে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুরব, রেস্টুরেন্ট যাব, তারপর একেবারে পদ্মাবৎ দেখে তবে বাড়ি ফিরব। 
শিব :(চোখ কপালে তুলে) পদ্মাবৎ !! বোঝো ! এ আবার কি নতুন সংস্কৃত ? বলি কথায় কথায় দুম করে অমন খণ্ড-ত লাগিয়ে দিলে ভারী অসুবিধে হয় জানো। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলবে একটু ? 
পার্বতী : সে কি কথা !! কত বড় কাণ্ড হয়ে গেল ! কোনো খবরই তো রাখো না দেখছি। অবশ্য সারাদিনে ছিলিম ছাড়ার ফুরসত পেলে তো !
শিব :(সামান্য রেগে গিয়ে) এই শোনো, ত্রিশূলের দিব্যি বলছি, ছিলিম নিয়ে খোঁটা দেবে তো একেবারে দক্ষযজ্ঞ রিটার্নস বানিয়ে ছাড়ব। 
পার্বতী : থাক ! হয়েছে অনেক। ও মুরোদ আর নেই তোমার। বাহুবলী তোমায় ঘাড়ে করে ঝর্ণার জলে চুবিয়ে ছেড়েছে। সেই দেখে নমো আর মমোর কি হাসাহাসি। আমি তো হপ্তাখানেক মুখ দেখাতে  পারিনি কোথাও। পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। 
শিব : (বিষম খেয়ে) আঃ, কি মুশকিল ! থাক না সেসব কথা। আমিও তো কম হেঁচে কেশে অস্থির হইনি সেসময়। ভক্ত বলে কথা, অমন ফস করে কিছু বলা যায় নাকি ? 
পার্বতী : বেশ তো ! তাহলে শিবায় ছবিতে অজয় যে তোমার নামটা ধার নিল আর সারাক্ষন 'বোলো হর হর' বলে চেঁচিয়ে গেল, কই টাইটেল স্ক্রোলে তোমায় কার্টসি পর্যন্ত দিল না মোটে, তার বেলা ?
শিব : কি বলি বলো দেখি, সিংঘমের পর থেকে বাজারটা তেমন ভালো যাচ্ছে না ওর। শুধু গুটখা খাচ্ছে আর বোলো জুবান কেশরী বলছে। আমি তো আর রয়্যালটি চাইতে পারিনা এই সময়.....!

পার্বতী আবার শিবের গা ঘেঁষে এলেন। শিবের গলার রুদ্রাক্ষের মালা নিজের আঙুলে পেঁচাতে থাকলেন। 

পার্বতী :(গদগদ কণ্ঠে ) হ্যাঁ সেই। ভক্তের ভক্তিতেই তুমি অস্থির। যাগ্গে, যাক। মোট কথা হল সারাদিন দুজনে মিলে একটু কাছাকাছি, একটু এনজয়, মানে একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড.......বোঝোই তো..... 
শিব : আচ্ছা বেশ, সেসব নাহয় বুঝলাম, কিন্তু শিবরাত্রির ব্যাপারটা....... ?
পার্বতী : সে নাহয় রাতের দিকে তোমার মাথায় একটু জল ছিটিয়ে দিলেই হল। তাছাড়া গঙ্গাকে তো জটায় করে নিয়ে ঘুরছো। তেমন হলে মাথাটা একটু গোল করে ঝাঁকিয়ে নিও বুঝলে। যুগ যুগ ধরে একইরকম করে আসছি তো। তা এবারটা নয় একটু অন্যরকম হল, অসুবিধে কি ?
শিব : কিন্তু তাই বলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করবে বলে শিবরাত্রি ডিলেইড হবে ? নানানানা, এটা ঠিক হচ্ছে না। তোমার হাতের জলটাই তো সবার আগে পেয়ে থাকি বরাবর। তারপর গিয়ে মর্ত্যের জল নিই। ওদিকে সবাই অপেক্ষা করে থাকবে যে !
পার্বতী : (অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে) ওহ ! তাই নাকি ? আমার আব্দারটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়, তাই তো ? মর্ত্যের জল না পেলে বুড়োর বুঝি নেশা কাটবে না ! বয়সকালে স্বপ্নদোষ ? আচ্ছা দাঁড়াও, আমিও এর শেষ দেখে তবে ছাড়ব। 

মহাদেব এ কথায় জিভ কেটে কানে আঙ্গুল দিলেন। 
নারদমুনির প্রবেশ। 

নারদ : (সুর করে) নারায়ণ নারায়ণ ! পেন্নাম হই দেবাদিদেব..... প্রণাম নেবেন মা। (শিবের দিকে তাকিয়ে) একি প্রভু !! আপনি কানে আঙ্গুল দিয়ে আছেন কেন ? কি হয়েছে ?
শিব : (কান থেকে আঙ্গুল সরিয়ে) ভাষার বাণ খেয়েছি রে বাপ্। ডিটেলস বলতে পারব না। 
  
পার্বতী : এই যে নাড়ু ! এসে গেছ দেখছি ! ব্যাস আর তো কোনো কথা গোপন রাখার জো নেই । স্বগ্গ জুড়ে ঢি ঢি পরে যাবে এবার........আমাদের সেলিব্রেশনটা তাহলে মাঠে মারা গেল একেবারে ! 
নারদ : ছি মা। এসব কি বলছেন ! আমি এখন অনেক চেঞ্জড হয়ে গেছি। এখন শুধু দিনে একবার করে  'আধঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন' এর চ্যানেলে ঢুঁ মারি। বাংলাবাজারটা ওই তো গরম করে। আমায় আর কোনো এক্সট্রা এফর্ট দিতে হয় না। 
পার্বতী : ব্যাস ! তবে আর কি ! স্বগ্গ তো গেলোই, এবার সারা বাংলা জুড়ে মোমবাতি মিছিল শুরু হবে। বলি আমাদেরও কি একটু আধটু সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই গা ?
নারদ : কে বলেছে মা থাকতে নেই ? আমায় শুধু বলুন কি চাই, আমি আগাপাশতলা সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। 

পার্বতী : (করুণ স্বরে) দুঃখের কথা আর কি বলি নাড়ু। শখ হয়েছিল আজ তোমাদের বাবার সাথে একটু ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করব। তা উনি কানেই নিচ্চেন না কথাটা। এবার বলো, এই জগৎসংসারের বাইরে আমারও তো একটু ইচ্ছে করে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর। ওনার হাতটি ধরে একটু এদিক ওদিক যাওয়া, ভালোমন্দ খাওয়া......... একি আর খুব বেশি চাওয়া হল আমার ? 
নারদ :(হাত নাড়িয়ে) বিন্দুমাত্র না, বিন্দুমাত্র না। এতো অতি উত্তম কথা, তা আটকাচ্ছে কে ? সুপ্রিয়া ?

পার্বতী মনে মনে বললেন, 'খুব খারাপ জোক নাড়ু , এ মিরাক্কেলেও নেবে না '। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মহাদেবের দিকে আঙ্গুল তুললেন শুধু । 

পার্বতী : ওই যে, ওই তোমার প্রভু। বলছে নাকি মর্ত্যের ধিঙ্গিরা ওনার শিবরাত্রির জন্যে ওৎ পেতে আছে। বাগছালটা পড়ে দৌড়ে না গেলে নাকি ওনার পুজোই শুরু হবে না। বুঝলুম, যাদের বিয়ে হয়নি তাদের নাহয় একটা কারণ আছে। কিন্তু যাদের হয়ে গেছে, তোরা কেন খামোখা ওঁকে নিয়ে টানাটানি কচ্ছিস বাপু। এই রিটায়ারমেন্টের সময় আমাদের দিকটাও তো একটু ভেবে দেখতে হবে নাকি !

শিব :আঃ যত্ত বাজে কথা। আচ্ছা তুই বল নাড়ু, এই বয়েসে আমাদের কি এসব মানায়, হ্যাঁ ? তাছাড়া আজকে শিবরাত্রি, কোথায় সকালবেলা তোর মায়ের হাতের এক বালতি গরম জলে একটু আয়েস করে সাবান দিয়ে রগড়ে গা ধোব, তা নয় উনি এক্কেরে সারাদিন কচি খুকির মতো ঘুরে বেড়াবার মতলব এঁটেছেন। যত্তসব !
পার্বতী : ওহ ! আমি কচি খুকি ? আর তোমার বয়েস বুঝি ডিসেন্ডিং অর্ডারে বাড়ছে। প্রস্টেটের সমস্যায় যে তুমি শুয়ে ছিলে একমাস, তখন কে তোমায় দুবেলা বাথরুম নিয়ে যেত শুনি ? হ্যাঁ ?অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ব্যাথায় রোজ রাতে কে মলম ঘষে দেয় তোমার হাঁটুতে ? বলব নাড়ুকে সেসব কথা ? ভাঙব হাটে হাঁড়ি ?
শিব : আহাহাহা ! এসব কি কথা হচ্ছে বলো দেখি ? ঘরের লুঙ্গি কি এমনি করে বাইরে শুকোতে আছে ? হাওয়া দিচ্চে তো !
নারদ : হ্যাঁ সেই তো, এসব ব্যক্তিগত কেচ্ছাগুলো এখন নাহয় থাক মা, বুঝলেন। অন্য সময় বরং........ 
পার্বতী :(নারদকে এক দাবড়ানি দিয়ে) তুই থাম নাড়ু ! আমার ইহকাল পরকাল সব আনন্দবাজারে বেরিয়ে গেছে গা। প্রাইভেট লাইফ বলে আর কিচ্ছুটি নেই। দুগ্গাপুজো এলেই সবাই মিলে একেবারে পুরাণ থেকে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে। ভারী বিরক্ত লাগে মাইরি। আমারও তো একটা প্রাইভেসি আছে, নাকি ?  

এই বলে পার্বতী একটা শিলাখণ্ডের ওপর বসে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। নারদ ও শিব যুগপৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। শিব আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন। পার্বতীর কান্নায় সেসব হলাহলের মতো নির্বাক হজম করে ফেলতে হল। উপায়ন্তর না দেখে পার্বতীর কাছে ছুটে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। 

শিব :(মোলায়েম স্বরে) ছি, পারো ! ওসব ছোটখাট কথায় কি কাঁদতে আছে। তুমি আজকাল সমস্ত ব্যাপারে বড্ড ইমোশনাল হয়ে পড়ো দেখছি। তোমার না হাই বিপি ? এসময় এতটা স্ট্রেস নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে শরীরের পক্ষে ?
পার্বতী : (ফোঁপাতে ফোঁপাতে) 'পারো' বলে আমায় ডেকো না গো। অন্দরমহলের পরমেশ্বরীর কথা বড্ড মনে পড়ে যায়। আহা বেচারী মেয়েটা কি কষ্টটাই না করছে। দোজবরে স্বামীটা গাছেরও খাচ্ছে তলারও কুড়োচ্ছে। এ অনাচার চোখে দেখা যায় না গো ! চোখে দেখা যায় না। 

নারদ: (শিবের দিকে তাকিয়ে) প্রভু, আমার না মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে জানেন। মা এসব কি বলছেন ? একবার প্রস্টেট একবার আর্থ্রাইটিস, আনন্দবাজার, অন্দরমহল, পারো........আমার কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রক্ষা করুন প্রভু, রক্ষা করুন। 

শিব ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। মনে মনে নানারকম বলতে থাকেন ......

শিব :(মনে মনে) হুঁহ ! দুবেলা আমায় কে রক্ষা করে তার নেই ঠিক, আমি যাব ওকে রক্ষা করতে। সাত সকালবেলা দেকচিস বাড়িতে মহাভারত শুরু হয়েছে, কোথায় মানে মানে সরে পড়বি তা নয়, নারায়ণ নারায়ণ করতে করতে কোমর দুলিয়ে উপস্থিত হয়েচে। যত্তসব বলিহারি ! (ভেংচি কেটে) আবার রক্ষা করুন প্রভু.........আপদ কোথাকার !

নারদ :আ, আমায় কি কিছু বলছেন মহাদেব ?
শিব :(শশব্যস্ত হয়ে) তোমায় আর কি বলব বাছা, সকালবেলা এয়েচ। এক কাজ করো দিকি। ঐদিকে দেখো মিক্সি রাখা রয়েছে, তিন গ্লাস ফ্রুট জ্যুস বানিয়ে আনো তো চট করে। 

নারদ ব্যাজার মুখ করে মিক্সির দিকে এগিয়ে যান। 

শিব : (ফিসফিস করে) ইয়ে বলছি কি, তুমি তো 'পারো' মানে শরৎ বাবুর দেবদাসের ইন্সট্যান্সও টানতে পারতে তাই না ? খামোখা বাইরের লোকের সামনে তোমার বাংলা সিরিয়াল কাল্চারটা না দেখালেই কি নয়।
পার্বতী :(অবাক হয়ে) কাল্চার ! আমাদের গোটা বাংলা তো এগ্রিকালচার আর চপ ফুলুরির ওপর ডিপেন্ড করছে গো। এই স্বর্ণ যুগে টিভি না দেখাটা নেগলেক্ট করি কি করে বলো তো ?
শিব : আচ্ছা বেশ ! মন খারাপ কোরো না লক্ষীটি। তুমি বলে দাও তোমায় কি নামে ডাকব ?   
পার্বতী : (চোখ মুছে গদগদ ভাব করে) থাক, তোমায় আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। তুমি যা বলবে তাই.... 
শিব : (আরেকটু কাছে এসে) না, তুমি বলে দাও.... 
পার্বতী : না তুমি বলো....
শিব : না তুমিই বলো.....
পার্বতী : না তুমি.....

(নারদ তার তাম্বুরায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজাতে থাকেন - 'এই পথ যদি না শেষ হয়.........'
শিব জড়িয়ে ধরেন পার্বতীকে। দুজনের নিভৃত চাপা ফিসফিসানি আর হাসির শব্দ শোনা যায়। 
নারদ জিভ কেটে অন্য দিকে চোখ ঘোরান। তারপর জোরে গলা খাকরানি দেন। শিব পার্বতী দুজনেই ব্যস্ত হয়ে একটু সরে বসেন)।

নারদ : এই নিন শরবত। 

শিব আর পার্বতী  দুজনেই হাত বাড়িয়ে গ্লাস নেন।

পার্বতী : (জিভ কেটে) এই রে ! আমার তো খেতে নেই, আজ তো আমার উপোস। 
শিব : এই বয়েসে আর উপোস করে কাজ নেই। তাছাড়া ফ্রুট জ্যুসে আবার দোষ কিসের ? 
পার্বতী : তাহলে তুমিই খাইয়ে দাও বরং। 

শিব পরম স্নেহে পার্বতীকে ফ্রুট জ্যুস খাওয়াতে থাকেন। 

নারদ : আমি বলছিলুম কি, ব্যাপারটা যখন আর অতটা সিরিয়াস নয়, তাহলে বরং মহাদেব আজ  একবার মাকে গোলাপ দিয়েই দিনের শুরুটা করে ফেলুন। তারপর নাহয় আপনি চট করে মায়ের দেওয়া জলে চান করে একবার মর্ত্য থেকে ঘুরে আসুন। ততক্ষনে মা রেডি হয়ে যাবেন। তারপর দুজনে মিলে একটু ঘুরে আসুন, আপনাদের ভ্যালেন্টাইন্স ডেও সেলিব্রেট হবে আবার প্রাইভেট টাইমও, কি বলেন ?

শিব : (পার্বতীর দিকে তাকিয়ে) ছেলেটা অনেকদিন পর বেশ ভালো বলেছে........তাই না গো ?
পার্বতী :(লজ্জা পেয়ে মিষ্টি করে হেসে) আমি জানি না.......যাও.......

শিব আর নারদ দুজনেই অট্টহাস্য করে ওঠেন। 

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পুনশ্চ : এই গল্পের সাথে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যোগাযোগ খুঁজতে যাবেন না দয়া করে। কোনোরকম ভাবাবেগে আঘাত করা উদ্দেশ্য নয়, নির্মল আনন্দের জন্যই এ গল্প লেখা।


ছবি : সংগৃহিত 

#bengalishortstory #valentinesday #shibratristory #lovestory #shivparvati #Molat

Saturday, January 13, 2018

বন্ধু চল # ৩ - কোলাঘাট

ছবি : সৌম্য 
রাস্তায় বেরিয়ে পথ হারানোর অভ্যাসটা যেন রপ্ত করে ফেলেছি আমরা। বেরোনোর আগের দিন পাক্কা আধঘন্টা ধরে নিখুঁত প্ল্যান ছকে ফেলা হল। অর্থাৎ কোন রাস্তা দিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরব শুরু করে, সাঁতরাগাছি পেরোনোর পর কোন কোন জায়গার ওপর দিয়ে যাব তার একটা নির্ভুল চিত্র এঁকে ফেলা হল প্রায়। চিত্র তো দূর, গুগল খুলে ম্যাপটা পর্যন্ত একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে ফেললুম দুজনে। ঠিক তার পরের দিন, যথারীতি সাঁতরাগাছি পেরোনোর পর বেভুল হয়ে চলে গেলাম একেবারে অন্য দিকে। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আশেপাশের অঞ্চলটা অপিরিচিত লাগার ফলে বাধ্য হয়ে এক জায়গায় বাইক থামালাম। একজন গ্রাম্য পথিককে জিজ্ঞেস করলাম কোলাঘাট যাওয়ার সঠিক পথটা। সে বেশ খানিক্ষন আমাদের নিরীক্ষণ করার পর জিজ্ঞেস করল, 'কোলাঘাট যাবেন ? তা দিল্লীরোড ধরেছেন কেন, আপনারা কি দিল্লী যাবেন, তাহলে এদিক দিয়ে সোজা...........' ? সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, 'না দাদা না, আমরা এখন দিল্লী যেতে চাই না, মাইরি বলছি, কোলাঘাট কি করে যাব সেটা দেখিয়ে দিন প্লিজ' । ভদ্রলোক খানিক ব্যাজার হয়ে বললেন, 'আচ্ছা বেশ, বাইক ঘুরিয়ে উল্টোদিকে চলে যান, একটা ব্রিজ পাবেন, তার তলা দিয়ে ঘুরে গিয়ে হাইওয়ে ধরুন, একেবারে সোজা কোলাঘাট'। একপলক থমকে, বাইক ঘুরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলুম। ভাগ্যিস জিজ্ঞেস করেছিলুম, না হলে বোধহয় মিতরোঁর সাথে কোলাকুলি করাটাই বাকি থাকত শুধু।

ছবি : সৌম্য 
হাইওয়েতে দুবার থেমেছিলুম। একবার প্রকৃতি ডেকেছিল আরেকবার ডাবওয়ালা, দুবারই জলের কারণে। আর কোথাও থামিনি। মাঝে একবার এক পিকনিক পার্টির লোককে আওয়াজ দিয়েছিলুম। সে হতভাগা টেম্পোর পিছনে পা ঝুলিয়ে দোল খেতে খেতে যাচ্ছিল। তাকে চোস্ত বাংলা ভাষায় বুঝিয়ে দিতে সে তখন ভিতরে ঢুকে বসে। এছাড়া একটা বুলডোজারকে মাঝরাস্তায় থামিয়ে দিয়েছিলুম প্রায়। তার সমস্ত চাকাই যে ঘুরছে এটা বলার পর সে ধেয়ে এসেছিল আমাদের দিকে। সেখান থেকে এক্কেরে নাকবরাবর বাইক ছুটিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের বর্ডারে পৌঁছলুম। শরৎ সেতু দিয়ে যখন নামছি তখন রূপনারায়ণের ওপর হাজারে হাজারে রূপোর কুঁচি ঝকঝক করছে। মন ভালো হয়ে গিয়েছিল এক নিমেষে। ব্রিজ থেকে নেমে অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকেছিলুম শের-এ-পাঞ্জাবে। পেটে তখন ছুঁচোয় টি টোয়েন্টি খেলছে। তন্দুরি রুটি - তড়কা, আলুপরোটা - তরকারী আর স্যালাড এই দিয়ে ডান হাতের কাজটা চেটেপুটে শেষ করলুম। সেখান থেকে একটা মেঠো পথ ধরে সোজা রূপনারায়ণের পার। যাবার আগে অবশ্য এক সরল ছেলেকে এক অপিরিচিত দাদার বাইক পাহারায় দাঁড় করিয়ে এসেছিলুম। সে বেচারা কতক্ষন ঠায় দাঁড়িয়েছিল জানি না। 

ছবি : সৌম্য 
নদীর পারে এসে যখন পৌঁছলুম তখন সূর্য পশ্চিমের দিকে সামান্য ঘাড় কাত করেছে। ধলেশ্বরী নাম নিয়ে পুরুলিয়া থেকে তার চলার শুরু, মাঝে বাঁকুড়ায় নাম পাল্টে দ্বারকেশ্বর, তারপর ঘাটালে শিলাবতী নদীর সাথে মিশে রূপনারায়ণের নামকরণ। তারই পারে একটা ফাঁকা নিরিবিলি জায়গা দেখে আয়েস করে দুজনে পাথরের ওপর বসলুম। আবেশে শরীর জুড়িয়ে এল আপনিই। দুদিকে যতদূর দেখা যায় শুধু রুপোলি মুগ্ধতা। তার মাঝ বরাবর দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলেছে ছৈ বাঁধা ছোট্ট একটা জেলে নৌকো। এমন অপরূপ মায়া জড়ানো নদীর ধার ঘেঁষে চুপচাপ বসে রইলুম দুজনে। টুকরো কথাবার্তায় নিস্তব্ধতা ভাঙছিল ঐটুকুই.......বাকিটা অপাপবিদ্ধ জলের ছিঁটেফোঁটা উড়ে এসে পড়ছিল চোখেমুখে। ডানদিকে একটা পুরোনো কাঠের ঘুপচি ঘর চোখে পড়ল। পার থেকে ঝুলে এসে প্রায় জলের ওপর পড়ে, এমন আশ্চর্য কায়দায় সে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হল কত বছরের ভাটিয়ালি ইতিহাস ধুলোদানার মতো লেগে আছে গায়। যে অতীত, যে মুহূর্তরা জোয়ার ভাঁটায় গা ভাসিয়েছে, তার একনিষ্ঠ নিরবিচ্ছিন্ন সাক্ষী সেই একফালি ঘেরাটোপ। মনে হয়েছিল সপ্তাহান্তে যদি একবার করে এসে থাকতে পারতুম সেই ঘরে, বেশ হত। কত অবলীলায় জলের গান ভেসে আসত, কত বকের দল সন্ধ্যে নামাতো, দেখতুম বসে। পার বরাবর গাছের শিকড়ে মিষ্টি সুরের ছলাৎ শুনতে পেতুম হয়ত।  


ছবি : সৌম্য 
পার বেয়ে খুব সহজেই নদীতে নামা যায়, তবে সে দুঃসাহস আমরা দেখাইনি। যে রূপ আমরা চোখের সামনে দেখেছি তা ছুঁয়ে দেখার ধৃষ্টতা করিনি ইচ্ছে করেই। প্রাণভরে শুধু দূর থেকে তার আমেজ নিয়েছি। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কাতলা মাছের বুদ্ বুদ্ ভেসে উঠছিল মাঝে মাঝেই। দুহাত অন্তর অন্তর লাফ দিয়ে যেন তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। আর আমরা বাচ্চা ছেলেদের মতো কর গুনে মনে রাখছিলুম কে কটা দেখতে পেলুম। সে ভারী আনন্দের জিনিস। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তবে তার থেকেও কঠিন ছিল বোধহয় ফেরার টান, যা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই ছিল না। সন্ধ্যে নামার আগেই বালি ঝেড়ে উঠে পড়লুম। অনেকটা পথ, আবার অনেকটা সময়। ফেরারী মনেরও হয়ত একটা বাঁধ থাকে, একটা ফিরে আসার আশ্রয় থাকে। তবে এই অপরিকল্পিত হারিয়ে যাওয়ার উন্মাদনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সাধ নেই আমাদের। সে কয়েক সপ্তাহ পরেই হোক বা কয়েক মাস, যাদের পায়ের তলায় সর্ষে আছে তারা কতক্ষন আর সিঁড়িভাঙার অংক কষবে !  শুধু একবার বাইক স্টার্ট দেওয়ার অপেক্ষা...........তারপর...........

#bengaliarticle #suddenbreak #holiday #Molat #Kolaghat



Wednesday, December 27, 2017

অন্য সত্ত্বা

ছবি : জনৈক পরিবেশক 
শরীরের বয়েস বাড়ে। মনের বয়েস বাড়ে কই ? তাই বোধহয় প্রত্যাশিত ভাবেই কোনো এক পৌষের সন্ধ্যায় অতীতের মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। খোল নলচে বদলে যাওয়া রক্তমাংসের অবয়বগুলো ফিরে আসে দেশের টানে, মাটির টানে, হারিয়ে যাওয়া সময়ের পুনরুত্থানে। এক অন্য সত্ত্বা মূর্ত হয়ে ওঠে ভীষণ চেনা মানুষদের মাঝে। পাক্কা বাইশ বছর পর যাদের দেখলাম তাদের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি বসতুম কাঠের বেঞ্চিতে, ঠেলাঠেলি আর আলটপকা ফক্কুড়িতে দিনবদল ঘটত সেসময়। কখনো মনে হয়নি সেসব নক্ষত্রের মতো দূরে সরে যাবে একদিন, ছুঁয়ে দেখার সুযোগটুকু পর্যন্ত ব্রাত্য থেকে যাবে বছরের পর বছর। 

মুঠোফোনের দৌলতে সে দূরত্ব আজ ঘুচেছে বটে তবু সামনাসামনি ফিরে পাওয়ার মুহূর্তগুলো হয়তো না ছোঁয়াই থেকে যেত যদি না তারা ঝোড়ো হাওয়ার মত আবার এসে পড়ত শহরের বুকে। দিনক্ষণ লগ্ন ঠিক করে যখন ঢাকুরিয়ার তন্দুর পার্কে এসে পৌঁছলাম ততক্ষণে বিবর্ণ স্মৃতির পাতা থেকে উঠে এসেছে অত্যন্ত পরিচিত নামগুলো। সমস্ত মন জুড়ে এক লহমায় তিরতির করে বয়ে গিয়েছিল এক অদম্য ভালোলাগার নদী। যার দুকূল ছাপানো শুধুই মনভালো করা ছবির সারি। আমার ব্যক্তি পরিচয়ের অমূল্য প্রতিচ্ছবি - আমার স্কুলবন্ধুরা। 

ছবি : জনৈক পরিবেশক 
দেশ ভাগ হয়, অস্তিত্ব ভাগ হয় কিন্তু বন্ধুত্বের ভাগ বাঁটোয়ারা হয় না কখনো। অব্যবহার বা অনভ্যাসে ধুলো জমে হয়তো, তাকে একবার ঝেড়ে পুঁছে সাফ করে নিলেই আবার স্বমহিমায় উপস্থিত হয়। যেমনটা আমরা সবাই মিলে করে নিয়েছিলুম গতকাল সন্ধ্যের সাক্ষাতে। আর তাই আমাদের গল্পের গাড়ি থামতে চায়নি, অতীতের ছায়াসরণি বেয়ে নিজের খেয়ালে এগিয়ে চলেছিল তরতর করে। রেস্তোরাঁর পরিবেশক নির্বাক দাঁড়িয়েছিল কতক্ষন মনে নেই। বেবাক ভুলে গিয়েছিলাম খাবারের অর্ডার করতে। আর আমাদের সম্বিৎ ফিরছিল যেন প্রায় বছর ঘোরার পর। 


বছর ! হ্যাঁ, বছর তো বটেই। বাইশ বছরের উপন্যাস এক সাক্ষাতে শেষ হবার ছিল না, হয়ওনি। তবু আমরা সাপ্টে সামলে যতটা পারলুম, মুহূর্তদের দুহাত দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করলুম। পিছুটানের তঞ্চকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেহিসেবি বসে রইলুম ঘন্টার পর ঘন্টা। খিল্লি আর হুল্লোড়ে ভেসে বেড়ালুম কচিবেলার হাত ধরে। 

ছবি : অনুরাধা 
ফিরে আসতে মন চায়নি, রেস্তোরাঁর বাইরে পা রাখার পর সবারই মুখ ছোট হয়ে গিয়েছিল প্রায়। আবার কবে এমনি করে জমায়েতের আসর বসবে কেউ জানিনা। এমন দুর্নিবার ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরোবার ইচ্ছে ছিল না কারোরই এটুকু বাজি রেখে বলতে পারি। হয়তো কোনো একদিন এমনি করে আরও একবার জুটিয়ে নেব আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদটুকু। হয়তো কোনো একদিন আবার এই শহরে স্বপ্নপূরণের গান তৈরী হবে। হয়তো কোন একদিন আবার একত্রে উষ্ণতার আবেশ ছুঁয়ে নেব। অপেক্ষায় প্রহর গুনছি আমরা সবাই..........হয়তো কোনো একদিন........

#gettogether #friendsmeet #reunion #bengaliarticle

Friday, December 22, 2017

তিন এক্কে তিন

ছবি : নিজস্ব 
কতটা বয়েস বাড়লে বড় হওয়া যায় অথবা কতটা বড় হলে মানুষ বলা যায় নিজেকে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমার মতো হয়ত অনেক বাবা মায়েরাই খুঁজে থাকেন। তাঁরা এর সদুত্তর পেয়েছেন কিনা জানিনা, আমি তো আজ অবধি পাই নি। 

বছর তিনেক আগে যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছি তখন কোলে ছিল কম্বল আর তুলোয় মোড়া  দিন সাতেকের এক অবোধ টলটলে মুখ। দু চোখে একরাশ মায়া আর বেভুল চাহনিতে হৃদয় গলার স্পষ্ট ঈঙ্গিত দেখেছিলুম। আড়াই কিলো ওজনের খেলনা নিয়ে আমার আর সুতপার চোখেমুখে তখন প্রশস্তির ছাপ। কচি আঙুলে আমাদের আঙুল আঁকড়ে ধরা আর নড়বড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রোদে বৃষ্টিতে কেটে গেছিল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। কত রাত যে বিনিদ্র কেটেছিল দুজনের তার ইয়ত্তা নেই। অনবরত কাঁথা পাল্টানো আর জামাকাপড় নতুন করে পড়ানো যে কত সহস্রবার করেছি আজ তা ভেবে আতঙ্ক লাগে মাঝেমাঝেই। রাত জেগে দুধ গরম করা, চাদরটা লম্বা করে টেনে দেওয়া অথবা আলগোছে সরে যাওয়া মাথার বালিশটাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসা তখন নিত্যদিনের কাজ ছিল। অধিকাংশ সময়ই অফিসে এসে বেমালুম ঢুলতাম। দিনের বেলায় চোখ খুলে রাখাই বড় দায় হত।

ছবি : নিজস্ব 
শীত গ্রীষ্ম কাটিয়ে যখন টলমলে পায়ে ড্রেসিং টেবিলের কোণ ধরে উঠে দাঁড়াল তখন প্রথম জুরাসিক পার্ক দেখার মতো করে ফ্যামিলি শুদ্ধু সবাই হাঁ করে তাকিয়েছিলাম। ওপরে নিচে একজোড়া ইঁদুর  দাঁতের সারিতে তখন বিশ্বজয়ের উল্লাস। 'ধর ধর' 'পড়ে যাবে' 'লেগে যাবে' ইত্যাদির কলরবে চমকে উঠত পাড়া প্রতিবেশী সকলেই। অবশ্য এর অন্যথা হয় নি আজ অবধিও। দু পায়ে জোর পাবার পর তাকে আর দমিয়ে রাখা যায়নি মোটে। চোখের পলকে জায়গা বদল, জিনিস বদল, এমনকি ফ্ল্যাট বদল পর্যন্ত হয়ে যায় নিমেষে। রবি ঠাকুরের দুটো লাইনকে একেবারে বেদবাক্যের মতো মেনে চলেছে যেন  - "তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে ; একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে"। পুরাতন জিনিস তো রাখছেই না, নতুনগুলোও বেমালুম গায়েব হয়ে যাচ্ছে কোথাও না কোথাও। জিজ্ঞেস করলেই ভুরু কুঁচকে মনে করার ভান করতে থাকে, তারপর চাপ দিলেই বলে, 'আমি এট্টু দেকে আসচি'....বলেই পগার পার। 




ছবি : নিজস্ব 

তিন বছর পেরোনোর পর বাড়িতে কাক চিল বসতে পায় না, এমনি তার গলার আওয়াজ। ভবিষ্যতে মানুষ হবে কিনা বলতে পারি না, তবে ঠিক কি হয়েছে সেটা সচক্ষে দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন। আগামী বছর নতুন স্কুলে যেতে চলেছে। অর্থাৎ বাঁধা গরু ছাড়া পেয়ে মাঠে চরতে বেরোবে। তার অন্য গপ্পো আছে। পরে বলবখন সময় করে। যাইহোক, ওপরের প্রশ্নের উত্তর কেউ যদি জেনে থাকেন, দয়া করে ইনবক্স করবেন, নতুবা জানিনা আগামী দিনে কপালে কি লেখা আছে......... 


পুনশ্চ : ছবিতে নিষ্পাপ চাহনি দেখে এ লেখার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করবেন না যেন.... 



#birthdaystory #bengaliarticle #birthdayarticle #Molat



Thursday, December 14, 2017

অনুপদ্য - ২১

চিত্র : সৌম্য 
                                                                                                    

















#bengalishortpoems #mawphlang #meghalaya #molat

Saturday, December 9, 2017

অনুপদ্য - ২০

হোক না শীত তবুও খানিক অন্যরকম হল
আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে, আবার বৃষ্টি এল...
কোথাও শহর বরফ ঢাকে পশম জড়ায় ঘুম
আমার শহর মেঘের বাড়ি নির্বাক নিঃঝুম.....















#bengalishortpoems #raininbengal #molat 

Thursday, November 30, 2017

বন্ধু চল # ২

ছবি : সৌম্য 
কয়েকদিন যাবৎ দুদিক থেকেই ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিল। টিপ্ করে কেউই একটা কমন ডেট লাগাতে পারছিলুম না। শেষমেষ 'দুত্তোর নিকুচি করেছে' বলে একটা শনিবার তাক করে জুতো মোজা পড়ে দুজনেই ফুলবাবুটি সেজে বেরিয়ে পড়লুম। অবশ্যি যাবার আগে কেউই তেমন বাড়িতে বলে বেরোতে পারিনি ঠিক কোথায় যাচ্ছি। কারণটা পরে বলছি। 'চললাম, ফিরতে দেরি হবে' বলে কতকটা বুক চিতিয়ে কুচকাওয়াজের ঢঙে বেরিয়ে পড়েছিলাম শহরের দক্ষিণ দিক বরাবর। এটা অনেকটা আমাদের এক পুরোনো স্কুল বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরোনোর মতো।  বিকেল বেলায় 'মা, একটু বেরোচ্ছি'... বলে সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে রাঁচি এক্সপ্রেস ধরে এক্কেবারে বিহার চলে গিয়েছিলো সে। পাক্কা হপ্তাখানেক পর বাড়ি ফেরাতে তার বাবা বাঁজখাই গলায় বলেছিলেন, 'যেখানেই যাও না কেন তোমার বডি আমার চাই, রোজগার করতে না পারো তোমার ইন্সিওরেন্সের টাকাতে সংসারের হিল্লে হবে অন্তত কিছুটা'। তবে এক্ষেত্রে ততটা দুঃসাহস দেখানোর মতো বুকের পাটা ইদানীং কালে আমাদের কারোরই হয় নি। ঘর সংসারের নাগপাশে যাঁরা বন্দী হয়ে উইকেণ্ডের ছুটিতে দুদণ্ড নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পান না তাঁরা বুঝবেন নিশ্চই। সে যাগ্গে.....

ছবি : নিজস্ব 
টালিগঞ্জের গাছতলা স্টপেজে যখন দুজনে দেখা করলুম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটা ছুঁয়েছে। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঝিলমিলে রোদের ফাঁকে দুজনেই নিরুদ্দেশের ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছি প্রাণপণে। কিছু না পেয়ে, দোনোমোনো করে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা চললুম বারুইপুরের দিকে। সেখানে গিয়ে কোথায় যাব, কি করব তেমন সম্যক ধারণা দুজনের কারোরই ছিল না। বারুইপুর পৌঁছে আমার খেয়াল হল আমি প্রায় কোনো টাকাপয়সা না নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। 'ওরে ও বাউল শোন, মণিকাঞ্চনে  নাহি মন '.......  অতএব চটজলদি একটা এটিএমের সামনে দাঁড়াতে হল। খানিক বাদে রাস্তা পেরিয়ে যখন বন্ধুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালুম তখন সে বললে, 'বুঝলি, একটা কাজ করা যেতে পারে। এদিক ওদিক না ঘুরে চল ডায়মন্ড হারবার চলে যাই। এখান থেকে ঘন্টা আড়াইয়ের পথ হবে। এখন সাড়ে বারোটা বাজে, তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাব, তারপর কোথাও একটা লাঞ্চ করে গঙ্গার পারে বসে একটু আড্ডা মেরে ফিরে আসব। কি বলিস' ?

এমন অবাক করা কথায় আমিও অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারলুম না সেই সময়। ডায়মন্ড হারবার !! কলকাতার বাইরে অন্য সমস্তরকম রাস্তা আমার কাছে পার্ল হারবারের সামিল। ঢোঁক গিলে বললুম, 'তুই রাস্তা চিনিস' ? কোনোরকম কুন্ঠা না রেখে সে বললে, 'নাহ, জিজ্ঞেস করতে করতে চলে যাব, অসুবিধে হবে না'। কালক্ষেপ না করে বললুম, 'চল তবে'...........'বাহির হয়েছি  আজ, কিসের শরম, কিসের লাজ  '......

ছবি : নিজস্ব 
অতএব একের পর এক তেপান্তরের পথ অতিক্রম করে আমাদের দু চাকার পক্ষীরাজ উড়ে চলল। মাঝে একটা স্টেশন পেরোলাম। নামটা ভারী মায়াময়  - 'কৃষ্ণমোহন'। জায়গাটা বেশ ঘুম জড়ানো। শান্ত, ধীর স্থির। শহরের ক্যাকোফোনি থেকে কয়েক যোজন দূরে। নামের সাথে তাল মিলিয়ে যদি সেখানে মোহনবাঁশির রাগ শুনতে পেতুম বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হতুম না। সে চত্ত্বরের আশেপাশে বিশেষ জনবসতি নেই। একটা পুরোনো চায়ের দোকান আর কয়েক হাত দূরে দূরে গোটা কয়েক মাটির ঘর। দুরন্ত হাঁস মুরগির পায়ের ছাপে দুপুর গড়ায় সেখানে। পল্লী বাংলার আদি অকৃত্রিম চিত্রপট। খানিক এগিয়ে একটা ডাবওলাকে দেখে বাইক দাঁড় করানো হল। টলটলে মিষ্টি জলে প্রাণ জুড়িয়ে গেল একেবারে। দু চারটে ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললুম সামনে। যাবার আগে রুটটা জিজ্ঞেস করেছিলুম একজনকে। বলল, 'পঁচিশ কিলোমিটার নাক বরাবর এগিয়ে যান, বিষ্ণুপুরের আগে আর কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার পড়বে না'। 'আজ হারিয়ে যাবার মন , অত শুধোবার কি প্রয়োজন '.........অগত্যা....... 

ছবি : নিজস্ব 
জয়নগর পেরিয়ে যে মনভোলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছিলাম তার ভুবনমোহিনী রূপ চোখে না দেখলে দু চার কথায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। দু দিকে বট, অশ্বত্থ আর মেহগনি গাছের অনুষ্টুপ সারি। একদিক থেকে আরেকদিকে ঝুঁকে পড়ে যে যার মতো জড়াজড়ি করে পথের ওপর আলোছায়ার আলপনা তৈরী করেছে। সে ছায়াপথের একদিকে দিগন্ত জোড়া মাঠ আর ক্ষেতের সবুজ হাতছানি আর অন্যদিকে একফালি লম্বাটে ডোবা সোজা চলে গেছে দূরের থেকেও দূরে। সেই ডোবার ওপর থোকা থোকা পানিফলের আগাছা ভেসে রয়েছে দ্বিপ্রহরের সূর্যের দিকে চেয়ে। দু চার গজ অন্তর যেখানে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে আগাম শীতের জানান দিচ্ছে। দেরি না করে নেমে পড়লুম সেখানে। একটানা জার্নির ধকল উধাও হল মুহূর্তে। শরীরের আনাচে কানাচে বয়ে গেল হেমন্তের মিঠে পশমিনা হাওয়া। বদ্ধ শহরের আগল খুলে খোলা হাওয়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম দুজনে। খানিক্ষন রাস্তার ধারে গুলতানি করে আবার এগিয়ে চললুম। সামনে বিষ্ণুপুর। ...... 'এ পথের নেই শেষ, আমার বাংলা, এই আমার দেশ '...... 

ছবি : নিজস্ব 
আরও মিনিট কুড়ি চালিয়ে বিষ্ণুপুর পৌঁছে ডানদিক নিয়ে সোজা এগিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়লাম। মাথার ওপর মেঘের নীল পেরিয়ে চলেছি একের পর এক। কালো রাস্তার পিচে আমাদের নাছোড়বান্দা ছায়া আঁকা হয়ে চলেছে সমানতালে। আলটপকা সুরে গেয়ে উঠছি কখনো কখনো.......ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি........ দেখতে দেখতে বহুদূরে চোখের সামনে ঝলসে উঠলো সহস্র রুপোলি আলো। ঈষৎ কম্পমান নদীর জলে সূর্যের রশ্মি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গার পার বাঁদিকে রেখে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম ডায়মন্ড হারবারের বুকে। বাইক স্ট্যান্ড করেই দৌড়ে গেলাম পারের ধারে। ডানদিক বাঁদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু জল। নদীর অন্য প্রান্তে হলদিয়া পোর্টের আবছায়া রেখা দেখতে পেলুম। তার কিছুটা আগে একটা জাহাজ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। নোঙর ফেলে দিনবদলের অপেক্ষা করছে যেন। জোয়ারের মৃদু দুলুনিতে জলের সাথে ভাটিয়ালি আলাপ জমাচ্ছে বোধহয়। বেশিক্ষন দাঁড়ালাম না কারণ খিদে পেয়েছে জোর। 'দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, খালিপেট আর নাহি সয় '.......

ছবি : সৌম্য 
যেতে যেতে মালুম হয়নি তিনটে বেজে গেছে অনেক্ষন। বিনা বাক্যব্যয়ে উল্টোদিকে সাগরিকা হোটেলের পথে পা বাড়ালুম। যা অর্ডার দিয়েছিলুম তাতে করে এমনি সময় আরও একজনের খাওয়া হয়ে যেত। ভাত, সোনামুগের ডাল, ঝিরঝিরে আলুভাজা, আলুপোস্ত, পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় এরা কেউই পাতে পড়ার সময় পেল না। আসার মিনিট পনেরোর মধ্যেই উড়ে গেল সেসব। তার সাথে চলল দেদার আবোলতাবোল কথা, অযৌক্তিক ফাজলামো ও প্রাণখোলা হাসি। মৌরি চিবোতে চিবোতে আরও একদফা পারে গিয়ে বসলুম দুজনে। একটা নিরিবিলি বটতলার বেদির নিচে আয়েস করে বসে বসে দেখতে লাগলুম একদল জেলেদের মাছ ধরা। দু একবার খালি জাল ওঠার পর তাদের সাথে সাথে আমরাও আফসোস করতে লেগেছিলুম খানিক।পশ্চিম আকাশে তখন বকের ডানায় সন্ধ্যা নামছে পা টিপে টিপে। এবার ফেরার পালা। একবুক তৃপ্তি আর ভালোলাগা নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলুম আবার। ডায়মন্ড হারবার রোডের অন্ধকার পেরিয়ে কখন যে কলকাতা এসে পৌঁছলুম টেরও পাইনি। 

এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে সফর করে এলাম, সঙ্গী করে নিয়ে এলাম ফেরারী মন আর মুঠোভর্তি বেঁচে থাকার কারণ। দুজনে পণ করলাম, আসছে মাসে আবার......... কিন্তু কোথায় ? আজ্ঞে কত্তা, জানিতে চাহিয়া লজ্জা দিবেন না....... 

কৃতজ্ঞতা : সৌম্যর বাইক - ১০০ কিমির বেশি চলেছিল সেদিন ।

ছবি : নিজস্ব 
 #bengaliarticle #bengalitravelstory #diamondharbourtour    

Thursday, November 23, 2017

কার্ত্তিক শীল

ছবি : নিজস্ব 
উপরোক্ত নামটি কোনো রক্তমাংসের মানুষের নয়। অকপট ভক্তি, স্থির বিশ্বাস ও গভীর শ্রদ্ধার নামান্তর মাত্র। যুগ যুগ ধরে সমস্ত পৌরাণিক উপচার ও নিয়মবিধি মেনে পূজিত হচ্ছেন যিনি, তাঁকে অধিকাংশ সময়েই বাড়ির চৌকাঠে ফেলে রাখা হয় সুসন্তান লাভের আশায়। অনেকেই হয়ত জানেন না, অবহেলা অনাদরের ঠাকুরটি কিন্তু রীতিমতো খাস জমিদারি কায়দায় পূজিত হন পশ্চিমবঙ্গের এক বিশেষ জায়গায়। 'চুঁচুড়ার শীলবাড়ি' - এই নাম বললে সে তল্লাটে একডাকে লোকে বাড়ি অবধি চিনিয়ে দিয়ে যাবে। যদিও চুঁচুড়ার অন্যান্য জায়গায় কার্ত্তিক পুজো মহা আড়ম্বরেই হয় তবু জৌলুশ ও প্রাচুর্যে কামারপাড়ায় বিখ্যাত বনেদী শীলবাড়ির পুজো একাধারে বর্ণাঢ্য এবং ঐতিহাসিক। তিনশো বছর ধরে যার বৈচিত্রের প্রতিফলন বাড়ির সমস্ত সদস্যদের হৃদয়ে কোহিনূরের মতো উজ্জ্বল।

ছবি : নিজস্ব 
চুঁচুড়া স্টেশন থেকে নেমে প্রথমে টোটো বা অটো স্ট্যান্ডে আসতে হবে। ফুরফুরে দূষণহীন যাত্রার জন্য টোটো যানটির বিকল্প নেই । সেইটে চড়ে একেবারে শীলগলির মুখে নামবেন, তেমন তেমন হলে বাড়ির সিংদরজায় গাড়িবারান্দার তলাতেও নামিয়ে দিতে পারে। পেরেক পোঁতা ভারী সবুজ কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে আপনি এসে দাঁড়াবেন এক মনকেমন করা উঠোনের একেবারে মাঝ মধ্যিখানে। যে উঠোনে অনায়াসে একটা চার পাঁচতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে চারকোনা জায়গা জুড়ে। তারপরেও যেটুকু জায়গা অবশিষ্ট থাকবে তাতে করে মনের মতো একটা বাগান সাজিয়ে নেওয়া কঠিন কিছু হবে না, এমনই তার ব্যাপ্তি। ওপরে তাকালে খোপকাটা চৌকো আকাশের আলো চুঁইয়ে পড়বে আপনার গায়ে। 

ছবি : নিজস্ব 
মুখ ঘুরিয়ে পূর্ব দিকে যদি দেখেন তাহলে লাল টুকটুকে শান বাঁধানো গোটা আষ্টেক সিঁড়ি পাবেন। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে এক ফুঁয়ে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাবে আপনার ফেলে আসা শহর, যানজট আর দূষণের অবিমিশ্র কোলাহল। মুখোমুখি এসে দাঁড়াবেন কয়েকশো বছরের পুরোনো ইতিহাসের দোরগোড়ায়। সেখানে ফিসফিস করে সংলাপ বলে চলে আদি বাংলার ইতিবৃত্ত। নকশা কাটা দেওয়াল ও খিলান দেওয়া ঐরাবতীয় স্তম্ভের নিচে একটা প্রশস্ত ঠাকুরদালান লম্বালম্বি শুয়ে থাকে যা আড়ে বহরে প্রায় রাখালিয়া মাঠের সমান। তার ঠিক মাঝামাঝি পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ঝলমলে বাদশাহী পোশাক পরিহিত পনেরো ফিটের উঁচু 'রাজা কার্তিক'। শীলবাড়ির আরাধ্য দেবতা, সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বিশ্বস্ত সঙ্গী ও মহলের একনিষ্ঠ রক্ষক। 

ছবি : সৌরভ শীল 
এই বাড়িতে প্রথম পুজো চালু করেন শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র শীল। তখন বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে ঘাঁটি গড়েন এই চুঁচুড়া শহরে। শুরু করেন রাজবেশী কার্ত্তিকের আরাধনা। বংশপরম্পরার হাত ধরে একবিংশ শতকে এসেও যার অন্যথা হয়নি বিন্দুমাত্র। এক বিরাটকায় ময়ূরের ওপর আসীন হয়ে রাজকীয় ঢংয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটানা পূজিত হয়ে চলেছেন এই ধনুর্ধারী রাজা।

তাঁর গৌরবর্ণ, সৌম্যকান্তি মুখের দিকে তাকালে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, খেয়াল থাকে না কোনোরকম সময়ের বা পিছুটানের। মনে হয় ঠাকুরদালানের একপাশে জায়গা করে দিলে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে সে নির্মলমূর্তির সামনে। বাড়ির খিড়কি দুয়ারের পুকুরে যখন সূর্য ডোবে তখন দালান জুড়ে গড়িয়ে পড়ে সোনালী আলোর মূর্ছনা। জোড়া ঢাক, কাঁসর আর ঘন্টার প্রতিধ্বনিতে সে বাড়ি জেগে ওঠে অতীতের মাটি ফুঁড়ে, শুরু হয় রাজবন্দনার উৎসব। গোটা শীলবাড়ি প্রাঙ্গন মূর্ত হয়ে ওঠে দৈবিক অবয়বে। প্রায় দুশো আড়াইশো মানুষ জমা হয় এই মিলনমেলায়, একে ওপরের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গনে সম্পর্কের ওম জড়ায় শরীরে। তাঁদের আপ্যায়নের মাধুর্যে ও আন্তরিকতার স্পর্শে হৃদয় গলবে কখন আপনি টেরও পাবেন না। শুধু মনে হবে এই সাতপুরুষের ভিটেয় ইতিহাসের ছবিটা বরং গোপন থাকুক, ঠিক এমনি করেই, তবেই বোধহয় প্রকৃত পুজো হবে প্রচারের আড়ালে, দেবতার উপস্থিতিতে।



ছবি : নিজস্ব 
আদিগন্ত বিস্তৃত এজমালি ছাতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যতক্ষণে সন্ধ্যে নামে ততক্ষনে হয়ত আপনি স্টেশন পৌঁছে যাবেন। টানা দুদিনের আনন্দোল্লাসের পর যখন ফিরে আসবেন তখনও আপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনশো বছরের সোঁদা গন্ধ লেগে থাকবে আবার ফিরে আসার অপেক্ষায়, যেমন করে শীলবাড়ির প্রতিটি মানুষ অপেক্ষা করেন প্রত্যেক বছর। যাঁরা চুঁচুড়া গেছেন বা যাননি তাঁদের বলব কার্ত্তিক মাসের শেষ দিনটা একবার অন্তত নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে আসুন। এমন  নয়নাভিরাম সাবেকী উন্মাদনা পশ্চিমবঙ্গের বুকে খুব কমই বেঁচে আছে। আপ্যায়নের কোনোরকম ত্রুটি ঘটবে না এটুকু বলতে পারি, কারণ শ্বশুরবাড়ির অভ্যর্থনা চৌকাঠে আমিও দাঁড়াই।


ছবি : নিজস্ব 

#bengaliarticle #kartikpuja #chuchurasilbari #silbarirkartikpuja