Thursday, November 30, 2017

বন্ধু চল # ২

ছবি : সৌম্য 
কয়েকদিন যাবৎ দুদিক থেকেই ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিল। টিপ্ করে কেউই একটা কমন ডেট লাগাতে পারছিলুম না। শেষমেষ 'দুত্তোর নিকুচি করেছে' বলে একটা শনিবার তাক করে জুতো মোজা পড়ে দুজনেই ফুলবাবুটি সেজে বেরিয়ে পড়লুম। অবশ্যি যাবার আগে কেউই তেমন বাড়িতে বলে বেরোতে পারিনি ঠিক কোথায় যাচ্ছি। কারণটা পরে বলছি। 'চললাম, ফিরতে দেরি হবে' বলে কতকটা বুক চিতিয়ে কুচকাওয়াজের ঢঙে বেরিয়ে পড়েছিলাম শহরের দক্ষিণ দিক বরাবর। এটা অনেকটা আমাদের এক পুরোনো স্কুল বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরোনোর মতো।  বিকেল বেলায় 'মা, একটু বেরোচ্ছি'... বলে সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে রাঁচি এক্সপ্রেস ধরে এক্কেবারে বিহার চলে গিয়েছিলো সে। পাক্কা হপ্তাখানেক পর বাড়ি ফেরাতে তার বাবা বাঁজখাই গলায় বলেছিলেন, 'যেখানেই যাও না কেন তোমার বডি আমার চাই, রোজগার করতে না পারো তোমার ইন্সিওরেন্সের টাকাতে সংসারের হিল্লে হবে অন্তত কিছুটা'। তবে এক্ষেত্রে ততটা দুঃসাহস দেখানোর মতো বুকের পাটা ইদানীং কালে আমাদের কারোরই হয় নি। ঘর সংসারের নাগপাশে যাঁরা বন্দী হয়ে উইকেণ্ডের ছুটিতে দুদণ্ড নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পান না তাঁরা বুঝবেন নিশ্চই। সে যাগ্গে.....

ছবি : নিজস্ব 
টালিগঞ্জের গাছতলা স্টপেজে যখন দুজনে দেখা করলুম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটা ছুঁয়েছে। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঝিলমিলে রোদের ফাঁকে দুজনেই নিরুদ্দেশের ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছি প্রাণপণে। কিছু না পেয়ে, দোনোমোনো করে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা চললুম বারুইপুরের দিকে। সেখানে গিয়ে কোথায় যাব, কি করব তেমন সম্যক ধারণা দুজনের কারোরই ছিল না। বারুইপুর পৌঁছে আমার খেয়াল হল আমি প্রায় কোনো টাকাপয়সা না নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। 'ওরে ও বাউল শোন, মণিকাঞ্চনে  নাহি মন '.......  অতএব চটজলদি একটা এটিএমের সামনে দাঁড়াতে হল। খানিক বাদে রাস্তা পেরিয়ে যখন বন্ধুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালুম তখন সে বললে, 'বুঝলি, একটা কাজ করা যেতে পারে। এদিক ওদিক না ঘুরে চল ডায়মন্ড হারবার চলে যাই। এখান থেকে ঘন্টা আড়াইয়ের পথ হবে। এখন সাড়ে বারোটা বাজে, তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাব, তারপর কোথাও একটা লাঞ্চ করে গঙ্গার পারে বসে একটু আড্ডা মেরে ফিরে আসব। কি বলিস' ?

এমন অবাক করা কথায় আমিও অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারলুম না সেই সময়। ডায়মন্ড হারবার !! কলকাতার বাইরে অন্য সমস্তরকম রাস্তা আমার কাছে পার্ল হারবারের সামিল। ঢোঁক গিলে বললুম, 'তুই রাস্তা চিনিস' ? কোনোরকম কুন্ঠা না রেখে সে বললে, 'নাহ, জিজ্ঞেস করতে করতে চলে যাব, অসুবিধে হবে না'। কালক্ষেপ না করে বললুম, 'চল তবে'...........'বাহির হয়েছি  আজ, কিসের শরম, কিসের লাজ  '......

ছবি : নিজস্ব 
অতএব একের পর এক তেপান্তরের পথ অতিক্রম করে আমাদের দু চাকার পক্ষীরাজ উড়ে চলল। মাঝে একটা স্টেশন পেরোলাম। নামটা ভারী মায়াময়  - 'কৃষ্ণমোহন'। জায়গাটা বেশ ঘুম জড়ানো। শান্ত, ধীর স্থির। শহরের ক্যাকোফোনি থেকে কয়েক যোজন দূরে। নামের সাথে তাল মিলিয়ে যদি সেখানে মোহনবাঁশির রাগ শুনতে পেতুম বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হতুম না। সে চত্ত্বরের আশেপাশে বিশেষ জনবসতি নেই। একটা পুরোনো চায়ের দোকান আর কয়েক হাত দূরে দূরে গোটা কয়েক মাটির ঘর। দুরন্ত হাঁস মুরগির পায়ের ছাপে দুপুর গড়ায় সেখানে। পল্লী বাংলার আদি অকৃত্রিম চিত্রপট। খানিক এগিয়ে একটা ডাবওলাকে দেখে বাইক দাঁড় করানো হল। টলটলে মিষ্টি জলে প্রাণ জুড়িয়ে গেল একেবারে। দু চারটে ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললুম সামনে। যাবার আগে রুটটা জিজ্ঞেস করেছিলুম একজনকে। বলল, 'পঁচিশ কিলোমিটার নাক বরাবর এগিয়ে যান, বিষ্ণুপুরের আগে আর কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার পড়বে না'। 'আজ হারিয়ে যাবার মন , অত শুধোবার কি প্রয়োজন '.........অগত্যা....... 

ছবি : নিজস্ব 
জয়নগর পেরিয়ে যে মনভোলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছিলাম তার ভুবনমোহিনী রূপ চোখে না দেখলে দু চার কথায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। দু দিকে বট, অশ্বত্থ আর মেহগনি গাছের অনুষ্টুপ সারি। একদিক থেকে আরেকদিকে ঝুঁকে পড়ে যে যার মতো জড়াজড়ি করে পথের ওপর আলোছায়ার আলপনা তৈরী করেছে। সে ছায়াপথের একদিকে দিগন্ত জোড়া মাঠ আর ক্ষেতের সবুজ হাতছানি আর অন্যদিকে একফালি লম্বাটে ডোবা সোজা চলে গেছে দূরের থেকেও দূরে। সেই ডোবার ওপর থোকা থোকা পানিফলের আগাছা ভেসে রয়েছে দ্বিপ্রহরের সূর্যের দিকে চেয়ে। দু চার গজ অন্তর যেখানে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে আগাম শীতের জানান দিচ্ছে। দেরি না করে নেমে পড়লুম সেখানে। একটানা জার্নির ধকল উধাও হল মুহূর্তে। শরীরের আনাচে কানাচে বয়ে গেল হেমন্তের মিঠে পশমিনা হাওয়া। বদ্ধ শহরের আগল খুলে খোলা হাওয়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম দুজনে। খানিক্ষন রাস্তার ধারে গুলতানি করে আবার এগিয়ে চললুম। সামনে বিষ্ণুপুর। ...... 'এ পথের নেই শেষ, আমার বাংলা, এই আমার দেশ '...... 

ছবি : নিজস্ব 
আরও মিনিট কুড়ি চালিয়ে বিষ্ণুপুর পৌঁছে ডানদিক নিয়ে সোজা এগিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়লাম। মাথার ওপর মেঘের নীল পেরিয়ে চলেছি একের পর এক। কালো রাস্তার পিচে আমাদের নাছোড়বান্দা ছায়া আঁকা হয়ে চলেছে সমানতালে। আলটপকা সুরে গেয়ে উঠছি কখনো কখনো.......ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি........ দেখতে দেখতে বহুদূরে চোখের সামনে ঝলসে উঠলো সহস্র রুপোলি আলো। ঈষৎ কম্পমান নদীর জলে সূর্যের রশ্মি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গার পার বাঁদিকে রেখে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম ডায়মন্ড হারবারের বুকে। বাইক স্ট্যান্ড করেই দৌড়ে গেলাম পারের ধারে। ডানদিক বাঁদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু জল। নদীর অন্য প্রান্তে হলদিয়া পোর্টের আবছায়া রেখা দেখতে পেলুম। তার কিছুটা আগে একটা জাহাজ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। নোঙর ফেলে দিনবদলের অপেক্ষা করছে যেন। জোয়ারের মৃদু দুলুনিতে জলের সাথে ভাটিয়ালি আলাপ জমাচ্ছে বোধহয়। বেশিক্ষন দাঁড়ালাম না কারণ খিদে পেয়েছে জোর। 'দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, খালিপেট আর নাহি সয় '.......

ছবি : সৌম্য 
যেতে যেতে মালুম হয়নি তিনটে বেজে গেছে অনেক্ষন। বিনা বাক্যব্যয়ে উল্টোদিকে সাগরিকা হোটেলের পথে পা বাড়ালুম। যা অর্ডার দিয়েছিলুম তাতে করে এমনি সময় আরও একজনের খাওয়া হয়ে যেত। ভাত, সোনামুগের ডাল, ঝিরঝিরে আলুভাজা, আলুপোস্ত, পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় এরা কেউই পাতে পড়ার সময় পেল না। আসার মিনিট পনেরোর মধ্যেই উড়ে গেল সেসব। তার সাথে চলল দেদার আবোলতাবোল কথা, অযৌক্তিক ফাজলামো ও প্রাণখোলা হাসি। মৌরি চিবোতে চিবোতে আরও একদফা পারে গিয়ে বসলুম দুজনে। একটা নিরিবিলি বটতলার বেদির নিচে আয়েস করে বসে বসে দেখতে লাগলুম একদল জেলেদের মাছ ধরা। দু একবার খালি জাল ওঠার পর তাদের সাথে সাথে আমরাও আফসোস করতে লেগেছিলুম খানিক।পশ্চিম আকাশে তখন বকের ডানায় সন্ধ্যা নামছে পা টিপে টিপে। এবার ফেরার পালা। একবুক তৃপ্তি আর ভালোলাগা নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলুম আবার। ডায়মন্ড হারবার রোডের অন্ধকার পেরিয়ে কখন যে কলকাতা এসে পৌঁছলুম টেরও পাইনি। 

এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে সফর করে এলাম, সঙ্গী করে নিয়ে এলাম ফেরারী মন আর মুঠোভর্তি বেঁচে থাকার কারণ। দুজনে পণ করলাম, আসছে মাসে আবার......... কিন্তু কোথায় ? আজ্ঞে কত্তা, জানিতে চাহিয়া লজ্জা দিবেন না....... 

কৃতজ্ঞতা : সৌম্যর বাইক - ১০০ কিমির বেশি চলেছিল সেদিন ।

ছবি : নিজস্ব 
 #bengaliarticle #bengalitravelstory #diamondharbourtour    

6 comments:

  1. Feeling tajjyob with 33 others...erom ekta mone hochhe

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহাহা, জায়গা ঠিক হবার পর আমাদেরও কতকটা ঐরকম মনে হয়েছিল ।

      Delete
  2. Ami ei poth diye mase 2bar up down Kori .. Apnar lekhata emnite thik ache ... Khub bhalo bolar Moto na holeo cholte pare .

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি এই পথ দিয়ে একবারই গেছি কিনা। তাই প্রথম যাওয়ার আনন্দটা সবাইকে না বলে থাকতে পারলুম না আরকি....

      Delete
  3. খাবার এর নাম গুলো তে জিভ এ জল চলে এলো !!!! কিন্তু বাইক চালাতে জানি না !!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহাহা, সেক্ষেত্রে একজন বাইকচালক বন্ধু জোগাড় করে ফেলুন !

      Delete