Thursday, November 23, 2017

কার্ত্তিক শীল

ছবি : নিজস্ব 
উপরোক্ত নামটি কোনো রক্তমাংসের মানুষের নয়। অকপট ভক্তি, স্থির বিশ্বাস ও গভীর শ্রদ্ধার নামান্তর মাত্র। যুগ যুগ ধরে সমস্ত পৌরাণিক উপচার ও নিয়মবিধি মেনে পূজিত হচ্ছেন যিনি, তাঁকে অধিকাংশ সময়েই বাড়ির চৌকাঠে ফেলে রাখা হয় সুসন্তান লাভের আশায়। অনেকেই হয়ত জানেন না, অবহেলা অনাদরের ঠাকুরটি কিন্তু রীতিমতো খাস জমিদারি কায়দায় পূজিত হন পশ্চিমবঙ্গের এক বিশেষ জায়গায়। 'চুঁচুড়ার শীলবাড়ি' - এই নাম বললে সে তল্লাটে একডাকে লোকে বাড়ি অবধি চিনিয়ে দিয়ে যাবে। যদিও চুঁচুড়ার অন্যান্য জায়গায় কার্ত্তিক পুজো মহা আড়ম্বরেই হয় তবু জৌলুশ ও প্রাচুর্যে কামারপাড়ায় বিখ্যাত বনেদী শীলবাড়ির পুজো একাধারে বর্ণাঢ্য এবং ঐতিহাসিক। তিনশো বছর ধরে যার বৈচিত্রের প্রতিফলন বাড়ির সমস্ত সদস্যদের হৃদয়ে কোহিনূরের মতো উজ্জ্বল।

ছবি : নিজস্ব 
চুঁচুড়া স্টেশন থেকে নেমে প্রথমে টোটো বা অটো স্ট্যান্ডে আসতে হবে। ফুরফুরে দূষণহীন যাত্রার জন্য টোটো যানটির বিকল্প নেই । সেইটে চড়ে একেবারে শীলগলির মুখে নামবেন, তেমন তেমন হলে বাড়ির সিংদরজায় গাড়িবারান্দার তলাতেও নামিয়ে দিতে পারে। পেরেক পোঁতা ভারী সবুজ কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে আপনি এসে দাঁড়াবেন এক মনকেমন করা উঠোনের একেবারে মাঝ মধ্যিখানে। যে উঠোনে অনায়াসে একটা চার পাঁচতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে চারকোনা জায়গা জুড়ে। তারপরেও যেটুকু জায়গা অবশিষ্ট থাকবে তাতে করে মনের মতো একটা বাগান সাজিয়ে নেওয়া কঠিন কিছু হবে না, এমনই তার ব্যাপ্তি। ওপরে তাকালে খোপকাটা চৌকো আকাশের আলো চুঁইয়ে পড়বে আপনার গায়ে। 

ছবি : নিজস্ব 
মুখ ঘুরিয়ে পূর্ব দিকে যদি দেখেন তাহলে লাল টুকটুকে শান বাঁধানো গোটা আষ্টেক সিঁড়ি পাবেন। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে এক ফুঁয়ে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাবে আপনার ফেলে আসা শহর, যানজট আর দূষণের অবিমিশ্র কোলাহল। মুখোমুখি এসে দাঁড়াবেন কয়েকশো বছরের পুরোনো ইতিহাসের দোরগোড়ায়। সেখানে ফিসফিস করে সংলাপ বলে চলে আদি বাংলার ইতিবৃত্ত। নকশা কাটা দেওয়াল ও খিলান দেওয়া ঐরাবতীয় স্তম্ভের নিচে একটা প্রশস্ত ঠাকুরদালান লম্বালম্বি শুয়ে থাকে যা আড়ে বহরে প্রায় রাখালিয়া মাঠের সমান। তার ঠিক মাঝামাঝি পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ঝলমলে বাদশাহী পোশাক পরিহিত পনেরো ফিটের উঁচু 'রাজা কার্তিক'। শীলবাড়ির আরাধ্য দেবতা, সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বিশ্বস্ত সঙ্গী ও মহলের একনিষ্ঠ রক্ষক। 

ছবি : সৌরভ শীল 
এই বাড়িতে প্রথম পুজো চালু করেন শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র শীল। তখন বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে ঘাঁটি গড়েন এই চুঁচুড়া শহরে। শুরু করেন রাজবেশী কার্ত্তিকের আরাধনা। বংশপরম্পরার হাত ধরে একবিংশ শতকে এসেও যার অন্যথা হয়নি বিন্দুমাত্র। এক বিরাটকায় ময়ূরের ওপর আসীন হয়ে রাজকীয় ঢংয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটানা পূজিত হয়ে চলেছেন এই ধনুর্ধারী রাজা।

তাঁর গৌরবর্ণ, সৌম্যকান্তি মুখের দিকে তাকালে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, খেয়াল থাকে না কোনোরকম সময়ের বা পিছুটানের। মনে হয় ঠাকুরদালানের একপাশে জায়গা করে দিলে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে সে নির্মলমূর্তির সামনে। বাড়ির খিড়কি দুয়ারের পুকুরে যখন সূর্য ডোবে তখন দালান জুড়ে গড়িয়ে পড়ে সোনালী আলোর মূর্ছনা। জোড়া ঢাক, কাঁসর আর ঘন্টার প্রতিধ্বনিতে সে বাড়ি জেগে ওঠে অতীতের মাটি ফুঁড়ে, শুরু হয় রাজবন্দনার উৎসব। গোটা শীলবাড়ি প্রাঙ্গন মূর্ত হয়ে ওঠে দৈবিক অবয়বে। প্রায় দুশো আড়াইশো মানুষ জমা হয় এই মিলনমেলায়, একে ওপরের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গনে সম্পর্কের ওম জড়ায় শরীরে। তাঁদের আপ্যায়নের মাধুর্যে ও আন্তরিকতার স্পর্শে হৃদয় গলবে কখন আপনি টেরও পাবেন না। শুধু মনে হবে এই সাতপুরুষের ভিটেয় ইতিহাসের ছবিটা বরং গোপন থাকুক, ঠিক এমনি করেই, তবেই বোধহয় প্রকৃত পুজো হবে প্রচারের আড়ালে, দেবতার উপস্থিতিতে।



ছবি : নিজস্ব 
আদিগন্ত বিস্তৃত এজমালি ছাতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যতক্ষণে সন্ধ্যে নামে ততক্ষনে হয়ত আপনি স্টেশন পৌঁছে যাবেন। টানা দুদিনের আনন্দোল্লাসের পর যখন ফিরে আসবেন তখনও আপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনশো বছরের সোঁদা গন্ধ লেগে থাকবে আবার ফিরে আসার অপেক্ষায়, যেমন করে শীলবাড়ির প্রতিটি মানুষ অপেক্ষা করেন প্রত্যেক বছর। যাঁরা চুঁচুড়া গেছেন বা যাননি তাঁদের বলব কার্ত্তিক মাসের শেষ দিনটা একবার অন্তত নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে আসুন। এমন  নয়নাভিরাম সাবেকী উন্মাদনা পশ্চিমবঙ্গের বুকে খুব কমই বেঁচে আছে। আপ্যায়নের কোনোরকম ত্রুটি ঘটবে না এটুকু বলতে পারি, কারণ শ্বশুরবাড়ির অভ্যর্থনা চৌকাঠে আমিও দাঁড়াই।


ছবি : নিজস্ব 

#bengaliarticle #kartikpuja #chuchurasilbari #silbarirkartikpuja




    

3 comments: