Thursday, June 9, 2016

অনুপদ্য - ৪

ছবি : নিজস্ব 
অপেক্ষাতে সময় গুনি 

কংসাবতীর চর.......... 

বসন্তরাগ উঠলো বেজে 

তোর চিঠি পাবার পর 







#bengalishortpoems

Tuesday, June 7, 2016

অনুপদ্য - ৩

নীরবে মেঘ আসে..... আমার মনের আকাশে 
নিভৃতে গোপনে পায়ে পায়ে... বিস্তীর্ণ মন্থর নিস্তব্ধতায় 
সে এসে বলে, "তোমায় বৃষ্টি দিলাম...... 
আর বদলে একখানি চিঠি লিখো,
যেমন করে আগে লিখতে আমায়
তাতে কি বা আসে যায় !
হোক না সে চিঠি বড় বা ছোট....হোক না সে কবিতার মত
তবু লিখো তোমার কথা..... আমাদের সময় "......
নীরবে নিভৃতে বারে বারে.......মেঘ আসে যায়.....

ছবি : নিজস্ব 
















#bengalishortpoems

Monday, June 6, 2016

সাপ্তাহিকী ১১ # ছায়াসঙ্গী - প্রথম পর্ব





লাহোর - পটোহার মালভূমির প্রান্তর

পাহাড়ের ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘদেহী কৃষ্ণকায় যুবক। পিড়হান পাগড়ির নিচে সন্দিহান চোখে যেন কোনো গোপন সংবাদ ঝিলিক দিচ্ছে। এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে তাঁবুর সামনে চলে আসে সে। রক্ষীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, 'সুলতানকে খবর দেওয়ার আছে'। যুবককে আপাদমস্তক জরিপ করে নেয় পাহারাদার, পাস্তুনী জোব্বার খাঁজে তলোয়ারটা চোখে পড়ে। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, 'তারিফ'?

যুবক আবারও ফিসফিস করে বলে, 'জামাল.....জামালউদ্দিন ইয়াকুত'। রক্ষী হাত দেখিয়ে দাঁড়াতে বলে, তারপর ঢুকে যায় তাঁবুর ভেতর। পরক্ষনেই বেরিয়ে এসে বলে, 'সুলতান অপেক্ষা করছেন, আসুন'।

পর্দা সরিয়ে তাঁবুতে ঢোকে জামাল। পিঠ ঝুঁকিয়ে লম্বা কুর্নিশ করে বলে, 'আল্লাহ সালামত রাখুন সুলতানকে'।

- এ কি চেহারা হয়েছে তোমার জামাল !! তোমায় বিধ্বস্ত লাগছে যে !!
- অনেক কসরত করে লুকিয়ে চুরিয়ে এসেছি সুলতান, একটা ভয়ংকর খবর আছে !!
- ভয়ংকর !!!.......হাহাহাহা....... কি খবর শুনি ?
- আপনি হাসছেন সুলতান !!......ওদিকে ইখতিয়ার বাকি ওমরাহদের ফুঁসলাচ্ছে...........জোট পাকাচ্ছে সবাই মিলে, বলছে নাকি আপনার বিরুদ্ধে ইনকিলাবের আগুন জ্বালাবে।

জামালের কথা শুনে তাঁবুর জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন সুলতান। রেশমি পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। আকাশে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি চলছে, পটোহারের মালভূমির বাঁ দিকটা রুপোলি জোছনায় থৈ থৈ করছে অথচ ডান দিকের তরাইটা গাঢ় কাজলের মত তমসাবৃত। লাহোরের সমস্যা মিটেছে এতদিনে, আবার নতুন করে দিল্লির ঝামেলা শুরু হয়েছে। জামালের দিকে ঘুরে তাকান সুলতান, বলেন, 'এটা আমার কাছে নতুন কিছু নয় জামাল। অনেকদিন আগে থাকতেই এর এহ্সাস হয়েছিল আমার। চেহলগণির ওমরাহরা যে আমাকে সুলতান হিসেবে মেনে নিতে পারবে না এ আমি জানতাম। দিল্লির তখ্ত এই প্রথম একজন জেনেনার দখলে, ওদের তো তকলিফ হবেই'।

- আপনি এটা নজরান্দাজ করবেন না সুলতান !!, চেহলগণিরা এবার জবরদস্ত সাজিশ করেছে। আমার অনুরোধ, আপনি দিল্লী ফিরবেন না। অন্য কোথাও চলে যান, আমি বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।

- নাআআআআআআআ...............আমার অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না জামাল, কারণ তোমাদের সুলতান কোনো নাদান নয় যে সাজিশের ভয় করবে। আমি ইলতুতমিশ এর যোগ্য ওয়ারিস, মামলুক বংশের উত্তরাধিকারী, আমি রাজিয়া সুলতান।

গর্জন করে ওঠেন দিল্লীর তখ্ত-ও-তাজের একনায়িকা সম্রাজ্ঞী। তাঁবুর মোলায়েম আবছা হলদেটে আলোয় জ্বলজ্বল করে ওঠে তাঁর চোখ। উত্তরের হাওয়ায় পিঠ ছাপানো চুল দুলতে থাকে বিষধর সাপের মত। এক অপার্থিব তেজের দ্যুতি ঠিকরে বেরিয়ে আসে যেন শরীরের আশপাশ থেকে। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সুলতানের বফাদার অনুচর জামালউদ্দিন। রাজিয়াকে কোনো এক ফেরেস্তার চেয়ে কম কিছু মনে হয় না তার। অজান্তেই ঝুঁকে আসে মাথা, আমতা আমতা করে বলে, 'গুস্তাখি মাফ করবেন সুলতান, কিন্তু সামনের বিপদটা যে অনেক বড়'।

- জামাল, ভুলে যেও না, আব্বাজানের মৃত্যুর পর দিল্লীর তামাম সালতানাতকে একা হাতে সামলে এসেছি আমি। এরকম অনেক ইনকিলাব আমার মুট্ঠীর মধ্যে গুঁড়িয়ে গেছে। লাহোরের বান্দা আমার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে কাল। চেহলগণির ওমরাহদের কি করে মাত দিতে হয় সেটা আমি ভালো করেই জানি। তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাক। বাকিটা আমি দেখছি.........
- জো হুকুম সুলতান ! তবে এর সাথে আরেকটা খবরও দেওয়ার আছে।
চোখ সরু হয়ে যায় রাজিয়ার, জিজ্ঞেস করেন, 'কি'? জামাল মাথা না তুলেই বলে, 'জনাব মালেককেও দলে টানার চেষ্টা করছে ওরা, আপনার বিরুদ্ধে ওনার ক্ষমতাকে কাজে লাগাবে বলে'।
- মালেক !!! কি বাকোয়াস করছ জামাল ?? তুমি জানো কার বিরুদ্ধে কথা বলছ?? খবর ভুল হলে তোমার গর্দান নেব আমি !!
- খবর ভুল নয় সুলতান, আমার নিজের কানে শোনা, কয়েকদিন বাদেই চেহলগনির সভা বসবে ভাতিন্ডায়.....জনাব মালেকের দরবারে। আপনি অন্য জায়গা থেকেও পরখ করতে পারেন।
- ইয়া আল্লাহ !!!!

পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যায় রাজিয়ার। মখমলের গদির ওপর বসে পড়েন কাঁপতে কাঁপতে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে জামাল কখনই ভুল খবর দেওয়ার লোক নয়। এতদিনের বফাদার ছায়াসঙ্গী সে, তামাম সাম্রাজ্যের হাল হকিকত তার নখদর্পণে, মুর্দার পেটের ভেতর থেকেও খবর বার করে আনতে পারে সে। তার কথায় অবিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব।

গভীর বেদনায় হৃদপিণ্ড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে পটোহারের নির্জন প্রস্তর প্রান্তরে। শেষ পর্যন্ত, মালেক !!! সেই ছোট্ট বয়েস থেকে দুজনে দুজনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে এসেছে এতদিন, হৃদয়ের দরওয়াজায় যার নাম খোদাই করা, নিকাহ করার স্বপ্ন দেখেছে যাকে, ছদ্দবেশের আড়ালে আজ সেই ছোরা বসাবে বুকে ! কোন আকাঙ্খায় ! কিসের প্রলোভনে? দিল্লী সালতানাত !! একবার মুখ ফুটে তো বলতে পারতো, দিল্লীর তখ্ত পায়ে লুটিয়ে দিত রাজিয়া.......

দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অচিরেই। ব্যর্থ প্রেমের বাষ্পে তাঁবুর পরিবেশ গুমোট হয়ে ওঠে.....

জামাল কোনো কথা না বলে লম্বা সেলাম করে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে তাঁবু থেকে। নিজের ওপর রাগ ধরে অযথাই। কি দরকার ছিল সুলতানকে মালেকের কথা বলার ! মনে মনে ভাবে, বেওকুফের মত কাজ করে ফেলেছে। বক বক করতে করতে সব উগরে দিয়েছে। আসলে সুলতানকে মনে মনে গভীর শ্রদ্ধা করে, তাই কোনো কিছু লুকোনোর কথা ভাবতেই পারে না। সুলতানও যে তাকে পরম স্নেহে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন এতকাল। তখ্ত পাওয়ার আগে থেকেই রাজিয়ার বাধ্য অনুচর, এক হুকুমে জান দিতে পারে সে। সেই কিনা সুলতানের হৃদয় ভারী করে এলো ?

মনটা খারাপ হয়ে যায় জামালের। কিছুটা দুরে একটা বড় পাথরের ওপরের গিয়ে বসে পড়ে। পাগড়িটা খুলে রাখে পায়ের কাছে। বহু দুরে রাতের পাহাড়ের গা বেয়ে মেঘের ছায়া সরে যাচ্ছে একের পর এক। বন্য শূন্যতা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে জামাল.......... ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হতে থাকে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিশোধ সে নেবেই। চেহলগণির পান্ডাকে ছাড়বে না সে। ইখ্তিয়ারের পাঁজরে তলোয়ারটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারলে তবেই তার শান্তি। চাপা আক্রোশে ভেতরে দাবানল জ্বলতে থাকে জামালের। কোমরে গোঁজা স্বর্ণালী বাঁটটায় হাত বুলিয়ে নিয়ে একটানে খাপ থেকে বের করে আনে কঠিন ক্ষুরধার ধাতুটাকে। চাঁদের আলোয় ঝলসে ওঠে রুপোলি বিদ্যুৎ। বিড়বিড় করে ওঠে জামাল, 'ইন্শাল্লাহ'.......

(ক্রমশ)
 
#bengalishortstories #drama #lovestories #romanticstories #sadstories #bengalihistory #raziasultan
#jamaluddinyakut #thriller

Saturday, June 4, 2016

আর কেউ না

ঝরাপাতার দিনগুলো সব
বর্ষা ডেকে আনে
নির্ভেজাল সত্যিগুলো
হৃদয় শুধু জানে...........আর কেউ না !

কবর খুঁড়ে বের করে দিই
তপ্ত বিষম জ্বালা
ইতিহাসরা খুলতে জানে
বর্তমানের তালা ........আর কেউ না।

বন্ধু ছিল, স্বপ্ন ছিল
সাজানো চিত্রপটে
পরিচিত মানুষ যারা
এখন অপিরিচিত বটে.....আর কেউ না।

ছবি : নিজস্ব 




















#bengalipoems

Friday, June 3, 2016

ঘুম আসছে

আজ পদ্মপাতায় পদ্য লিখব
শব্দেরা জ্বলজ্বল করবে মুক্তোর মতো
সেইখানে রেখে যাবো অনুস্বর বিসর্গের মাত্রা
যা আগে দেয়নি কেউ, যা আগে লেখা হয়নি কখনো
কারণ, আজ যে বৃষ্টি পড়বে।

জলের ছায়ায় দেখে নেব শঙ্খচিলের শেষ প্রতিচ্ছবি
গড়িয়ে পড়ে যাবার আগে ছুঁয়ে যাব মেঘের ধূসর
কতক্ষন বিন্দু হয়ে থাকতে পারবো জানি না
মৌমাছির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ব হঠাৎ
কারণ, আজ যে বৃষ্টি পড়বে।

ছবি : নিজস্ব 
















#bengalipoems

Thursday, June 2, 2016

বার্ষিকী

ছবি : নিজস্ব 
আবার চলো প্রেমে পড়ি, ছায়াপথের বাঁকে
স্বপ্নে কাটুক দিনগুলো সব, রাত্রি কথার ফাঁকে
শেষের কথায় ছিল শুরু, শুরুর থাকুক রেশ
এমন করেই চলুক না হয়, এমনটাই তো বেশ....

ঘুম ভেঙ্গে যাক অন্ধকারে, জ্যোৎস্না গড়াক এসে
আলগা ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে যাক ঠুনকো কথার শেষে
শেষ আকাশে চিবুক ছুঁয়ে বর্ষা আসুক নেমে
খুনসুটিতে পথ চলা হোক একটুকু না থেমে......

হৃদয় জুড়ে সময় ছোটে, সোনার থেকেও খাঁটি
বার্ষিকীতে লেপ্টে থাকুক নতুন ধুলো মাটি।


#bengalishortpoems #marriageanniversarypoems

Wednesday, June 1, 2016

অনুপদ্য - ২

ফাগুন রঙের আগুন পাখি
ছবি : গুগল 
আঁধার রাতের আলো....
মনের মানুষ খোঁজা দায়
কে যে মন্দ....আর কে ভালো.....

ঠিক ভুল গুলো হিসেব বাড়ায় 
আছে মোমবাতিরও কালো...
মন্দ যতই হই না আমি 
তবু তাদের থেকো তো ভালো !!





#bengalishortpoems 

Tuesday, May 31, 2016

সাপ্তাহিকী ১০ # ট্রফি

টক দই এর মত ঘন জমাট বেঁধে আছে সন্ধেটা। লেকের ধারে সিমেন্টের বেঞ্চগুলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। বিস্ময়ের ঘোর লেগে থাকে আত্রেয়ীর চোখে মুখে। পলকা কথার ঢিলে সম্পর্কের কাঁচটা যে এভাবে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যাবে এমনটা আন্দাজ করতে পারেনি সে কখনই। চোখের কাজলের মত লেপ্টে ছিল অরিজিৎ এতদিন। ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করার সময় থেকে রূপকথার জালবোনা শুরু। অত ছেলেমেয়ের ভিড়ে আলাদা করে চোখ টেনেছিল ছিপছিপে, ফর্সা, মাঝারি উচ্চতার তরুণটি। প্রথম দিকের আলগা চাউনি থেকে মাঝের আলাপী খেজুর ও শেষের দিকে কখন যে আঙ্গুল ছুঁয়ে প্রেমের আগুন জ্বলেছিল তা হয়ত এখন আর দুজনের কারোরই মনে নেই।

'আমরা বিয়ে করব না'? কোনো এক নরম বিকেলের আলোতে শুধিয়েছিল আত্রেয়ী। কেরিয়ার ও পারিবারিক জটিলতার দোহাই দিয়ে প্রত্যেকবার কাটিয়ে দিয়েছে অরিজিৎ। বলেছে, এখনি সংসারের ঘেরাটোপে বদ্ধ হতে রাজি নয় সে। আগে চাকরি তে সেট্ল করবে, প্রমোশন পেয়ে তারপর বিয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনা। এই কবছর তাই চুটিয়ে প্রেম করেছে দুজনে। অনুরাগের উত্তাপে সেঁকে নিয়েছে একে অপরকে। কিন্তু আত্রেয়ীর জন্য সময় থেমে থাকে নি। সামাজিক নিয়ম মেনে পাত্র দেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক দিন আগে থেকেই। রক্ষনশীল বাড়িতে আত্রেয়ীর কোনো কথা কানেই নেয় নি কেউই। তাই আজ বাধ্য হয়ে অরিজিৎ কে চাপ দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল পুরোনো লেকের ধারে। করুণ মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, 'আর কবে? এখন তো তোর চাকরি বাঁধা, কিছুদিনেই প্রমোশন হবে, এটলিস্ট আমার বাড়িতে তো কথা বলে রাখ। সবাই যেরকম উঠে পড়ে লেগেছে তাতে তো কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেবে আমার'। শুনে অদ্ভূত উত্তর দিয়েছিল অরিজিৎ।

-'এখন কোনো মতেই সম্ভব নয়, নতুন প্রজেক্ট এসেছে, সামনের মাসে অফিস থেকে বিদেশ পাঠাচ্ছে দু বছরের জন্য। ফিরে এসে তারপর চিন্তা ভাবনা করব'। শুনে থ হয়ে গিয়েছিল আত্রেয়ী। অস্ফুটে বলেছিল, 'আর আমি !! আমি কি চিরকাল অপেক্ষা করে থাকব তোর জন্য? সেটাই কি তুই চাইছিস'? উত্তর দেয়নি অরিজিৎ। প্রশ্নটা শুনে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। নিঃশব্দের মোড়কে না বলা উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিল আত্রেয়ী। ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করেছিল, 'তবে কেন স্বপ্ন দেখালি আমায়.......একসাথে ঘর বাঁধার, একসাথে বাঁচার' ?

-আমি তো কোনো স্বপ্ন দেখাইনি তোকে, বরং তুই স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলি, তাই দেখেছিস। তার দায়টা নিশ্চই আমার নয়, তাই না ?
- ওহ, নতুন ভবিষ্যতের হাতছানিতে পুরনো যা কিছু সব ধুলো ময়লার মত ঝেড়ে ফেলতে চাইছিস ? তাই তো ?
- দ্যাখ আত্রেয়ী, আমায় অহেতুক দোষ দিস না, তোর সাথে এই দুএক বছর কাটিয়েছি বলেই যে বিয়ের পিঁড়িতে বসব এমন দাসখত তো লিখে দিই নি। তাছাড়া তোর অমতেও হয়নি কিছু, সেটা বোধকরি ভালো করেই জানিস।
- তার মানে কানাঘুষোয় যা শুনতে পাচ্ছি সেটাই সত্যি।
- কি শুনেছিস ঠিক ?
- তোর অফিসের এক কলিগের সাথে এ যাবৎ তোর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। বিভিন্ন জায়গায় একসাথে দেখা যাচ্ছে তোদের, একথা অস্বীকার করতে পারবি তুই ?
- অন্তরা আমায় প্রপোজ করেছে মাত্র। আমি এখনো উত্তর দিই নি। আমার কথা বাদ দে, কলেজে এরকম প্রপোজাল তো তুইও অনেক পেয়েছিলি। ইনফ্যাক্ট সৈকতের প্রপোজ করার পরের দিনই আমি প্রপোজ করি তোকে। মনে আছে নিশ্চই ?
- আছে। ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নে সৈকতের সাথে তোর রেষারেষিটাও মনে আছে আমার। শুধু ইউনিয়ন কেন, পড়াশোনা, খেলার মাঠ, ক্যান্টিন এমনকি সমস্ত এক্টিভিটি তে সৈকতকে টেক্কা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা দেখেছিলাম সেসময়।
- হেরে যাবার ছেলে কোনদিনই আমি ছিলাম না আত্রেয়ী, সৈকতের কাছে তো নয়ই।
-তার মানে বলতে চাইছিস আমি শুধু সৈকতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া একটা ট্রফি মাত্র ? একজন জিতে যাওয়া ক্যান্ডিডেটের বিজয় স্মারক ? যাকে কাঁধে নিয়ে কিছুদিন বয়ে বেড়ানো যায়, সস্তা আড়ম্বরে বুক ফুলিয়ে গোটা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানো যায় আর পুরনো হয়ে গেলেই ঘরের এক কোনে ফেলে দিতে হয় অন্য সব আসবাবের মত। এ ছাড়া আমার আর কোনো মূল্য নেই তোর কাছে ?
-দ্যাখ, অনর্থক ঝগড়া বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি আগেই বলেছি আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়। তোর বাড়িতে বিয়ে দিতে চাইছে, বিয়ে করে নে, খামোকা আমার জন্য ওয়েট করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই। 

বিষাদের মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল আত্রেয়ীর সারা মুখ জুড়ে। বুকের অতল থেকে উঠে আসা যন্ত্রণাগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে এসেছিল ফোঁটায় ফোঁটায়।
- সময় নষ্ট !!! হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস, তাই বোধহয় করে এলাম এতকাল। তোকে প্রতিদিন ফোন করে ঘুম থেকে তোলা, তোর চাকরির জন্য কাগজের বিজ্ঞাপন খুঁজে বার করা, তোর পছন্দের রেসিপি তৈরী করা, ইন্টারভিউয়ের ডেট মনে করিয়ে দেওয়া, এসবই সময় নষ্ট ছিল রে আমার................ তবে তুইও জেনে রাখিস তুই শুধু সময় কুড়িয়েছিস আরেকজনের ফেলে যাওয়া সময় থেকে, নিজের জন্য সময় তৈরী করেছিস তারই তৈরী করা মুহূর্ত থেকে। ট্রফিটা তুই জিতলি বটে..........খেলাটা তোর কখনই জেতা হলো না অরিজিৎ। আজ তাহলে সত্যি কথাটা শুনে যা।

- সত্যি কথা !!!! কোন সত্যিটা ? তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায় অরিজিৎ আত্রেয়ীর দিকে।
- সৈকত আমাকে কোনোদিনই প্রপোজ করেনি অরিজিৎ, ইনফ্যাক্ট আমিই সৈকত কে প্রপোজ করি।
- কিইই !!!!??................. না না, তুই মিথ্যে কথা বলছিস।
- মিথ্যে আমি বলছি না অরিজিৎ............

'না না এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না', বিস্ময়ে, আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে অরিজিৎ।

- তুই বিশ্বাস না করলেই তো আর সত্যিটা পাল্টে যাবে না। তোর প্রপোজ করার আগের দিন, সৈকত নয়, আমিই ওকে প্রপোজ করি। কিন্তু ও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিল সেদিন। বলেছিল, ইউনিভার্সিটির ইউনিয়ন থেকেই সরাসরি সক্রিয় পলিটিক্সে ঢুকবে, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছিল সেসময়, প্রেম করার মত সময় বা পকেটের জোর কোনোটাই ওর ছিল না। সৈকত জানত তুই আমায় পছন্দ করতিস, বলেছিল, আমাকে সুখী করতে পারবি তুই.........ও নয়।

অরিজিৎ এর মুখে কোনো কথা জোগায় না। কান মাথা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। প্রবল হাওয়ায় খড় কুটোর মত উড়ে যায় আত্মাভিমান। বেলুনের মত মিইয়ে চুপসে যায় কপট দম্ভ। আকস্মিক বিহ্বলতায় ন্যুব্জ হয়ে বেঞ্চিতে বসে থাকে আত্রেয়ীর পাশে নিশ্চুপ। আত্রেয়ী বলে চলে.........

- ট্রফি জেতার অহংকারে তুই অন্ধ হয়ে ছিলি এতদিন। তোর জানা ছিল না খেলাটা অনেকদিন আগে থেকেই তুই গোহারা হেরে বসে আছিস সৈকতের কাছে। ও ছিল সৎ, নির্ভেজাল, নিজের কাছে, আমার কাছেও। রঙিন ডানা নিয়ে জন্মায়নি তোর মত আর তাই প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াবার সখও ছিল না ওর। প্রথম দফাতেই কবুল করে সেটা। তোর মত ল্যাজে খেলায় নি আমায় মাসের পর মাস ধরে। তাই ওর অকপট সিদ্ধান্ত কে আমি আজও সম্মান করি মনে মনে। আর এই যে এখন তুই ভীরু কাপুরুষের মত পালিয়ে যাচ্ছিস সেটার জন্য ঘেন্না হচ্ছে তোর ওপর। তোর ভন্ডামির মুখোসটা খুলে গেল আজ অরিজিৎ। হেরোর তকমাটা গায়ে লেগে গেল আজ থেকে তোর, সব দিক দিয়েই। দুয়ো অরিজিৎ, তোকে দুয়ো। কদাকার, মরচে পড়া মনুষ্যত্বটা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তোকে সারাজীবন। এটাই হবে তোর চরম শাস্তি। আজ থেকে আর দেখতে চাইনা তোকে...........কোনদিনও না। 
রাগে অপমানে গর্জে ওঠে আত্রেয়ী। দু হাতে মুখ চেপে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে..................

কোনো রকমে শরীরটা টেনে তোলে অরিজিৎ, উঠে দাঁড়ায় আস্তে আস্তে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় গেটের দিকে, ফিরে তাকানোর মত আর সাহস ছিল না তার, ফিরে আসারও না। পিছনে জীবন্ত শবের মত বসে থাকে তার প্রাক্তন প্রণয়ী। নিভু সন্ধ্যার আলোতে লেকের চারপাশটা ফিকে হয়ে আসে। কেউ ফিরেও তাকায় না ফাঁকা বেঞ্চিটায় তুমুল অদৃশ্য ঝড়ের মধ্যে বসে থাকা একলা আত্রেয়ীর দিকে।


বিন্যাস : নিজস্ব 


#bengalishortstories #drama #lovestories #romanticstories #sadstories #separation

Monday, May 30, 2016

চুপকথা

লেপের তলায় নাক ডুবিয়ে শীতের গন্ধ পাই 
আড়ালটুকু ঘুচিয়ে দিও তোমার কাছে যাই 

স্পষ্ট কথায় কষ্ট বড় ! জিভ কেটে যায় দাঁতে
বন্ধ ঘরের আগল ভাঙে, আমার অবাধ যাতায়াতে

ভয় পেলে কি ? ভয়টা কোথায় ! ছোঁয়াছুয়ি খেলে ?
এমন কি আর হবে, তুমি আমার কাছে এলে......

আমার কাছে আগুন আছে, আতসবাজির খেলা
ছাতের কোনে বারুদ জমাই, একলা দুপুরবেলা

আতসকাঁচে দুনিয়াদারি সবার দেখা চাই.....
আড়ালটাকেই আড়াল কোরো, তোমার কাছে যাই...

নিন্দুকেরা বলবে কথা......বলুক তারা যতই
নষ্ট হওয়ার ইচ্ছেগুলো, আমার.......তোমার মতই !

ছবি : নিজস্ব 

















#bengalishortpoems #bengalipoems

অনুপদ্য - ১

তোর দিকে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে, 
.................একমুঠো আকাশ নীল 
তুলোটে মেঘের মত উড়ে যাবে, 
........................বিষন্নতার ফানুস। 
আলগোছে এক পশলা বৃষ্টি, 
...................জুড়ে দেবে অন্ত্যমিল
জেগে উঠুক তোর আমার ভেতর,
..............ঘুমিয়ে থাকা আসল মানুষ।  

ছবি : গুগল 


















#bengalishortpoems

Friday, May 27, 2016

অ - সৎপাত্র

ছবি : নিজস্ব 
#bengalipoetry #bengalipoems

Tuesday, May 24, 2016

সাপ্তাহিকী ৯ # ঝাড়ের বাঁশ

- দাদা, দুটো দিই ?
- নাহ......
- দিই না দুটো ?
- না, লাগবে না।
- একবার নিয়েই দেখুন, ভালো লাগবে........
- নাহ ! বললাম তো !!
- আচ্ছা অন্তত একটা নিয়ে যান......দারুন জিনিস আছে, সন্ধেবেলা জ্বালিয়ে দেবেন, রাত পেরিয়ে          ভোর অবধি ম ম করবে।
- না ভাই আমার এসবের দরকার নেই।
ধুপওলাকে ভাগিয়ে দেয় শৈবাল, ট্যাক্সির জানলা দিয়ে হাত নেড়ে। এমনিতেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে, দুপুর থেকে। মৌমিতা সেই যে ফোন করে বলেছে বাপের বাড়ি যাব, তখন থেকেই ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে। কতকটা বাংলা চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ এর মত। একবার শুরু হয়েছে কি নতুন ইস্যু পাওয়া অবধি থামানো দুস্কর। শৈবাল ভেবে পায়না বাবাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে। গত দু মাসে এই নিয়ে তিনবার হবে। শালার বিয়ের তোড়জোড় চলছে। সেই নিয়েই মৌমিতার ঘনঘন বাপের বাড়ি ট্যুর। সে নাহয় হলো। এদিকে মেয়েটারও স্কুল কামাই হচ্ছে যে। সেদিকে নজর নেই মোটে। বাবা মোটেই ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখছেন না। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন গতবার, যে এরপরে একেবারে পাকাদেখায় যাওয়া। সেই বিধানকে রীতিমত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মৌমিতা আরো একবার দমদম যাওয়ার নতুন ফিকির খুঁজে পেয়েছে। আচ্ছা ফাঁপড়ে পড়া গেছে। 'শ্যাম রাখি না কুল রাখি' র মত জাঁতাকলে আটকে পড়েছে মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবি শৈবাল। নিজেকে এখন গোল আটার রুটির থেকে বেশি কিছুই আর মনে হচ্ছে না তার। মৌমিতা আর বাবা মিলে সময়সুযোগ পেলেই বেলে নিচ্ছে যে যার মত করে।
সিগন্যাল সবুজ হয়। ট্যাক্সি এগিয়ে যায় ভবানীপুরের বাড়ির দিকে।

শৈবালের গা ঘেঁষে বসে মৌমিতা। ডিনার শেষ, টিভি চলছে। মৌড়ির দানা চিবোতে চিবোতে আইপিএল এ কোহলি কে দেখছে শৈবাল। অবিবাহিত ছেলেটার মাঠজোড়া দাপট দেখছে গোটা পৃথিবী। হিংসেয় বুক পোড়ে শৈবালের।
- এই শুনছও ?
- কালা হতে আর পারছি কই ?
- আঃ শোনোই না। দ্যাখো, পল্টুর বিয়ের তো আর দেরী নেই। সামনের মাসেই পাকা দেখা। তার আগে একটু একটু করে কিছু জিনিস কিনে রাখাটা খুব ইম্পর্টান্ট। তাছাড়া পল্টুর পরে আমাদের বাড়িতে তো আর কারো বিয়ে হবার নেই।
- ভাগ্যিস !!!
- বাবা মাও খুব ভরসা করছে দ্যাখো আমার ওপর। হাজার হোক বড়দি বলে কথা।
- গড়িয়াহাট বা নিউ মার্কেটে কি বিয়ের শপিং ব্যানড করে দিয়েছে ?
(কোহলি চার মারে স্ট্রেট ড্রাইভে )

- আঃ তা কেন ? এসব কেনাকাটা পল্টুকে নিয়েই করতে হবে। ও কি অফিস টফিস ছেড়ে দিয়ে এই গড়িয়াহাট আসবে বলো?
- সে তো বটেই, আইটি কোম্পানির ম্যানেজাররা সেকেলে সস্তা ফুট্পাথী ফ্যাশনের চৌকাঠ মাড়াবে কেন ? শপিং মল না হলে জাতে পতিত হওয়ার ভয়টা থাকে বৈকি।
(কভারের ওপর দিয়ে কোহলির ছয়)
- তুমি কিন্তু খামোখাই রাগ করছ। আমার একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে আমার ইনভল্ভমেন্ট টা খুব জরুরী সেটা কি বোঝো না ?
- ইনভল্ভমেন্ট মানে তো দুহাত বোঝাই নামিদামী ব্রান্ডের পলিথিনের প্যাকেট আর সকাল বিকেল বেলাগাম গুলতানি। মেয়েটার স্কুল তো আর মামার বিয়ে বলে দিনের পর দিন ছুটি দেবে না ! সেটার কি হবে ?
- ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও, ওটা আমি ম্যানেজ করে নেবখন।
- আর বাবা ? বাবাকে কি বলবে ?
- ওটা তুমি ম্যানেজ করো না................ প্লিইইইইইজজ।
(কোমরের কাছে উঠে আসা গুড লেংথ বলে কোহলির ব্যাকফুট ডিফেন্স। টিভি বন্ধ হয়, শোবার ঘরের আলো নিভে আসে।)

পরদিন সকালে

-বাবা তুমি আর অমত কোরো না। বুঝতেই তো পারছ, ভাইয়ের বিয়ে। কি করবে বল বেচারী ! একা হাতে সব সামলাতে হচ্ছে ওকে।
- মাথাটা ভালো করে পালিশ করে দিয়েছে তো তোমার ? শোনো খোকা, আমাকে এসব বুজরুকি শোনাতে এস না, বুঝলে ? সামনের মাসেই তো পাকা দেখা, তখন তো আরেকদফা বানপ্রস্থে যাবেন উনি। এর মধ্যেই আবার কেন? তার চেয়ে বরং পাকা দেখাটা হোক তারপরেই কেনাকাটি করতে বোলো।
- সে তো বটেই। তবে কিনা একমাত্র ভাই তো, তাই একটা আবেগ কাজ করে বোধহয়।
- সকাল সকাল আমায় বেশি আবেগ দেখিও না। বুড়ো শ্বশুর কি খাবে না খাবে, কিভাবে দিন কাটাবে নাতনীকে ছাড়া, তার তো ছিটেফোঁটা চিন্তা নেই আর স্বামীকে পাঠিয়েছে সালিশী করতে ! নেহাত তুমি বড় হয়েছ, সংসার করছ, নাহলে তোমায় বুঝিয়ে দিতুম আবেগের তাড়না কি !!
- আজ্ঞে।

সুড়সুড় করে নিজের দোতলার ঘরে চলে আসে শৈবাল। জাঁদরেল উকিল বিভূতি বসুমল্লিককে কোনদিনই খুব একটা কায়দা করতে পারেনি সে। খুব ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর থেকে বাবার কোলেপিঠে মানুষ। ভয় ও শ্রদ্ধার কোনদিনই খামতি পড়েনি তার পক্ষ থেকে। এ যাত্রাও এর থেকে বেশি কিছু কথা ফুটল না মুখে। মৌমিতা শৈবালকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, 'কি গো ! একেবারে বিছানায় শুয়ে পড়লে যে ? বাবাকে বলেছ কিছু ? কি বললেন' ? 
সিলিং এর দিকে উদাস চাউনি দিয়ে দুদিকে ঘাড় নাড়ে শৈবাল। মৌমিতার মুখের ওপর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 'ওও.......আচ্ছা........ তা একদিকে ভালই হয়েছে'............।
শৈবাল নাগাল পায় না সুন্দরী গৃহবধুর কথায়। মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। মৌমিতা বলে চলে, 'গড়িয়াহাটেই নাহয় কাজটা সেরে নেবখন। মন্দ কি ! বাড়ির কাছেও হবে, আর জামাইয়ের সম্মানটাও বজায় থাকবে। ইসসস, এটা তো আমার মাথায় আসে নি এতদিন' ?..............
বিছানার ওপর নড়ে চড়ে বসে শৈবাল। ভুরু কুঁচকে যায়। মৌমিতার উক্তিতে সম্ভাব্য প্রলয়টা ঠাহর করার চেষ্টা করে। আকাশপাতাল ভেবে এর অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে, 'জামাইয়ের সম্মানটা কি বলছিলে ? ঠিক বুঝলাম না তো' ?
-ও মা !! সে কি ? জামাই হিসেবে তোমার তো একটা দায়িত্ব আছে ওবাড়ির প্রতি।
- সে তো বটেই, কিন্তু...........
- আর পল্টুর একমাত্র জামাইবাবু হিসেবে তোমার তো মস্তবড় দায় থেকেই যায়।
-ক্কি... কি রকম !!!!
- আমি ভেবেছিলাম দমদম গেলে, বাবা, পল্টু আর আমি মিলে কেনাকাটার খরচটা ম্যানেজ করে নেব। সেটা যখন হচ্ছে না, তখন এখান থেকে আমি কিভাবে বাবা বা পল্টুর থেকে টাকা চাইতে পারি ? তুমিই বলো ? খুব অসম্মানের হবে তোমার কাছে, তাই না? তাই ভাবছিলাম আমার একাউন্টে যা আছে তার ওপর আরো হাজার বিশেক দিলেই বাকিটা আমি চালিয়ে নেব। তুমি কিন্তু দেরী কোরো না। আজ রোববার, কালই অফিসে ফার্স্ট আওয়ারে টাকাটা ট্রান্সফার কোরো আমার একাউন্টে, কেমন ?'

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে শৈবাল। মৌমিতার আইডিয়াটা জলছবির মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখের সামনে। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। উফফফ !! এরকম প্যাঁচে ফেলার কায়দা একমাত্র মেয়েদের মাথাতেই আসে। মাসের শেষে পাহাড় প্রমান খরচের ধাক্কা .............ইম্পসিবল। তার চেয়ে বরং বাবাকে বোঝানো সহজ। যে করেই হোক এই দুঃসাধ্য কাজটা তাকে করতেই হবে। না হলে আর রক্ষে থাকবে না। দ্রুত ক্যালকুলেট করে নেয় বাবাকে কি করে বোঝাবে ।  শৈবাল খুব ভালো করেই জানে নাতনীর আবদার কোনভাবেই ফেলতে পারবেন না স্নেহপ্রবণ বৃদ্ধ দাদু। চট করে পাশের ঘর থেকে ছোট্ট তিতাসকে ডেকে নেয় সে। কানে কানে কিছু একটা বলতেই এক পায়ে খাড়া হয়ে যায় তিতাস। ওকে নিয়ে বাবার বইয়ের ঘরের দিকে ছুটে যায়................

- কি হয়েছে দিদিভাই ?
- দাদু আমি মামার বাড়ি যাব। কয়েক দিনের জন্য, প্লিইইইজ তুমি পারমিশন দাও।
- কিন্তু তোমার তো স্কুল আছে, আর তাছাড়া এমনিতেও তুমি সামনের মাসে যাবে সেখানে।
- এখন খুব যেতে ইচ্ছে করছে যে। বেশিদিন না, তুমি দেখো, যাব আর চলে আসব।
- আমার যে মন কেমন করবে দিদিভাই, তুমি তো জানো।
- জানি তো, শুধু কয়েকটা দিন, আবার চলে আসব ঠিক, তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না, প্রমিস।

দাদুর কোলে উঠে গলা জড়িয়ে আবদার করে তিতাস, বলে, 'যাই ?' বিভূতির কোনো উপায় থাকে না সম্মত হওয়া ছাড়া। তিতাসকে যে বড্ড ভালবাসেন তিনি। বলেন, 'আচ্ছা, তবে তিন চার দিনেই ফিরে এস কিন্তু'। কলকল করতে করতে স্রোতস্বিনী নদীর মত ছুটে বেরিয়ে যায় তিতাস।
দরজার আড়াল থেকে সবটা শোনে শৈবাল। যাক, এ যাত্রা সামলে দিয়েছে সে। হালকা লাগে কিছুটা.............. তবুও কোথাও যেন মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধতে থাকে খচখচ করে, একটা অব্যক্ত অস্বস্তি, কয়েকদিনের অনিবার্য নিঃস্তব্ধতা, যা কাউকে বলার নয়, বোঝানোর নয়..........দুর্বোধ্য.........বড় কঠিন সে যন্ত্রণা। পায়ে পায়ে ফিরে আসে নিজের ঘরে, মৌমিতাকে বলে ,'প্যাক করে নাও, বাবা রাজি হয়েছেন'।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে বারান্দায়..............


ছবি : গুগল 

#bengalishortstories #drama #sadstories

Wednesday, May 18, 2016

সাপ্তাহিকী ৮ # আড়বাঁশি


অনেকটা বেলা হয়ে গেল আজ। সাড়ে সাতটা বাজে। তাড়াহুড়ো করতে থাকে বাসুদেব। 

বকুল বাগানের পুকুরে কোনো মতে এক আঁজলাটাক ডুব দিয়ে এসেছে। গা মুছে, মেরুন রঙের জামাটা গলিয়ে নেয়। ফকির বাজারে গাজনের বিরাট মেলা বসছে আজ থেকে। আশপাশের দশ বারোটা গ্রাম থেকে তো লোক আসেই, এছাড়া ঘাটাল মহকুমা থেকেও মানুষ জড়ো হয় বিস্তর। 

এ চত্বরের সবথেকে বড় মেলা বটে। সেবছর যখন ঘোষেদের ছেলেকে সাপে কাটলো তখন ওর বাবা দূর্গানারায়ণ ঘোষ মানত করেছিলেন হাটমনসার মন্দিরে, ছেলে ভালো হলে ফকির বাজারের জমিটা মেলার জন্য দান করে দেবেন। সেই থেকে শুরু। 

গ্রাম পঞ্চায়েতের তদারকিতে ক্রমে এই মেলা উৎসবের আকার নিয়েছে এখন। কত্ত লোক, কত্ত জিনিস, দেখে তাক লেগে যায়। এই সুযোগ.......... খড়িদারির এমন মওকা বড় একটা আসে না সারাবছর। 

পেয়ারা গাছের পাশে রাখা তেলতেলে খয়েরী রঙের পেটমোটা বাঁশটা ঘাড়ে ফেলে নেয় বাসুদেব। বাঁশের ডগায় ফুলের স্তবকের মত বোঝাই খেলনা বাঁধা আছে। গতকাল বিকেলেই যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে সে। তালপাতার ভেঁপু, আড়বাঁশি, কঞ্চির তীর ধনুক, প্লাস্টিকের মুগুর, গদা, ফটফটি, ম্যাজিক ক্যামেরা, দুরবীন, আতস কাঁচ, ডুগডুগি, কি নেই তাতে। 

বড় গর্বের সাথে বাসুদেব বার হয় বাইরে। এমন রকমারি খেলনা আর অন্য কোনো ফেরীর কাছে নেই এ তল্লাটে। বাঁশের বেড়াটা ক্যাঁশম্যাশ শব্দ করে খোলে। 

সুরমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে বাইরে, বলে, "এই নাও, চাড্ডি মুড়ি বাতাসা বেঁধে দিছি, দুপুরে খিদা পাবে, খেও"। 

পোটলাটা হাতে নিয়ে সামান্য হাসে সুরমার দিকে তাকিয়ে, ঘাড় হেলিয়ে বলে, 'আচ্ছা', তারপর এগিয়ে যায় পল্তাবেড়ে গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে। 

সুরমা দু হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, 'দুগ্গা দুগ্গা'। দক্ষিন-পশ্চিমের আকাশে মেঘের চিহ্ন ফুটে ওঠে। বাসুদেব প্রমাদ গোনে, মনে মনে আওড়ায়, 'হায় ভগবান, আজ যেন জল না হয়। দয়া কর ঠাকুর, আজকের দিনটা উতরে দিও'।

সারদাপল্লী হয়ে প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে পাঁশকুড়া -ঘাটাল রোডে ওঠে বাসুদেব। এখান থেকে ফকির বাজার পায়ে হেঁটে ঘন্টা খানেকের পথ। দু চারটে সাইকেল ভ্যান যেতে থাকে পাশ কাটিয়ে । সে জানে পায়ে হেঁটে গেলে কিছু খদ্দের পাবে। তাই ভ্যানের দিকে তাকায় না মোটে, এগিয়ে চলে দুলকি চালে। 

কিছুটা যাবার পর একটা এলোমেলো ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে। জামার ফাঁকফোকর দিয়ে শীতল করে দিয়ে যেতে থাকে। ভারী আমেজ লাগে সে হাওয়ায়। কাল একইভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল সুরমা। তেল নুন হলুদের সেই কড়ামিঠে গন্ধ এখনো লেগে আছে বাসুদেবের কপালে। মন ভালো হয়ে যায় একপলকে। দ্বিগুন হয় চলার গতি.................

দেখতে দেখতে ফকির বাজার এসে পড়ে। বিরাট জায়গা, দিগন্ত জোড়া মাঠ। এখনো তেমন ভিড় জমেনি। খদ্দের আসতে শুরু করেছে একটু একটু করে। বড় বড় দোকানে সবে পসরা সাজাচ্ছে। খুচরো ও খুদেরা তাদের ডালা বসিয়েছে একটা লাইন ধরে। ফেরিওয়ালারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক ওদিক। কেউ কেউ খেদিয়ে দিচ্ছে তাদের। দোকানের সামনেটা খালি রাখতে চাইছে সবাই। 

একটা অশ্বত্থ গাছের নিচে জটলা বাঁধছে ফেরিদের। সেখানেই একটু জায়গা করে বাঁশটা কাঁধ থেকে নামায় বাসুদেব। স্বস্তি পায় কিছুটা। কম পথ তো নয়। হাতের ব্যাগ থেকে একটা ছোট জলের বোতল বের করে জল খায় কিছুটা। শরীরটা জুত লাগে। 

এরপর সুর করে ডাকতে লাগে, "আনা আনা আআআনা, মেলা বেচা কেএএএনা, বাদ্যি ছোটা ছোওওওটা, খেলনা গোটা গোওওওটা, ও দোকানি, দাম কোরোনি"। 

আসে পাশের ফেরিওয়ালারা চেয়ে দেখে এক পলক। তারাও যে যার মত হাঁকতে থাকে। একজন দুজন করে খদ্দের আসতে থাকে। বেলা বেড়ে চলে দম দেওয়া পুতুলের মতো। সময়ের সাথে সাথে আমদানিও চলতে থাকে গড়িয়ে গড়িয়ে। 

হঠাৎ দু এক ফোঁটা জল গায়ে পড়ে বাসুদেবের। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখে কালো করে এসেছে চারপাশটা। গলা শুকিয়ে যায়। এখনো অর্ধেকের বেশি খেলনা পরে আছে। মুখের ছড়াটা মিহি হতে থাকে আস্তে আস্তে। 

"আনা আনা আআনা, মেলা বেচা কেএএনা".................. পেঁচানো ধুলো উড়তে থাকে মাঠ জুড়ে, জলের ফোঁটা বড় হয়। সারা মাঠে হই হই পড়ে যায়। যে যার মত ছুটে পালাতে থাকে এদিক ওদিক। 

বাসুদেব বগলদাবা করে নেয় বাঁশটাকে। কিছুটা দূরে উত্তর দিকের একটা টিনের চালের গুমটি দেখতে পেয়ে সেদিকে ছুটতে শুরু করে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে............বাসুদেবের চোখেও মেঘের আনাগোনা শুরু হতে থাকে.........

"তুমি কান্দ ক্যান ফেরিওয়ালা" ?

কচি কচি গলায় কে একজন জিগ্যেস করে। বাসুদেব পিছনে তাকিয়ে দেখে একটি বছর ছ সাতেকের ছেলে তার দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। অবাক হয় বাসুদেব, পিছন ফিরে বলে,

-"আমি কান্দি নাই গো, কান্দি নাই, মেঘের জল পড়িছে"।

-"না না, মিছে কথা, আমি খুব দেখিছি তুমি কান্ছিলে.............কি হইছে তোমার"?

বাসুদেব হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, ছেলেটির উচ্চতায় নিয়ে আসে নিজেকে। 

বলে, "তুমি কে গো, ইখানে কি করে এলে ? 

ছেলেটি মাঠের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, "আমি তো জিলাপি কিনছিলাম। এমন সময় খুব ঝড় হল আর ধুলায় ঢেকে গেলো তখন আআর বাবাকে দেখতে পেলুম না, তাই ছুটে এসে একানে দাঁড়িইছি"।

-"ওরে বাবা রে...... তুমার তো খুব সাহস দেকচি ! তা তুমার ঘর কোন দিকে" ?

-"উইই দিকে", পশ্চিম দিকে হাত তুলে দেখায় ছেলেটি।

-"গোকুলপাড়া"? বাসুদেব জিজ্ঞেস করে। 

সম্মতিসূচক ঘাড় কাত করে ছেলেটি। 

"কাদের ঘর"? আবার জিগ্যেস করে ছেলেটিকে। 

প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে ছেলেটি বলে, "তুমি কান্ছিলে ক্যান, বললে না তো"?

বাসুদেব একগাল হাসে, বলে, "তুমি কচি ছেলে, কি বলি তুমায়............ এই খেলনার পুঁজি দিয়া দিন চলে আমার। চাষের ক্ষেতও আছে টুকুন, তবে ফলন হয় না তেমন। এই মেলাতে খুব ভরসা করেছিলুম। আজ যদি অনেকটা বেচতে পারতুম তালে সন্ধ্যায় মাল তুলে আবার আসতে পারতুম কাল। কিন্তু আকাশটা সাথ দিলো নি। এখন জানিনা কি হবে" ,দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসুদেব। 

"তুমি চিন্তা করো নি, তোমার সব খেলনা বিক্রি হয়ে যাবে, জল পড়া থেমে যাবে, আমি বলচি দেকো", আশ্বাস দেয় ছেলেটি। 

শিশুর নিষ্পাপ সরলতায় মন ভরে ওঠে বাসুদেবের। চোখের কোনে মেঘ জমে ওঠে আবার। তুমুল বর্ষণে কুয়াশার মত ঢেকে যায় সারামাঠ। টিনের চালের নিচে কাঁচা পাকা গলায় আলাপচারিতা চলতে থাকে।

-"এই বাঁশিটার দাম কত গো"? ছেলেটি একটি বাঁশিতে আঙুল ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করে।

-"এই আড়বাঁশিটা ? এটা দশ টাকা। তুমি নেবে? নাও না.......পয়সা লাগবে না", মোলায়েম স্বরে বলে বাসুদেব।

-"না না, এমনি এমনি নেব কেনো, আমি পয়সা দিয়েই নেব"।

কচি ছেলের দৃঢ়তায় অবাক হয় বাসুদেব। 

বলে, "আচ্ছা নাহয় দাম দিয়েই কিনো, কিন্তু তুমি বাজাতে পারো"? 

দুদিকে মাথা নাড়ে ছেলেটি। 

"আচ্ছা আমি শিখিয়ে দেবখন", বলে আড়বাঁশিটা ঠোঁটে ছোঁয়ায় বাসুদেব। 

দেশ রাগের আশ্চর্য মনকেমন করা মূর্ছনায় চারপাশটা মাখামাখি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। বুঁদ হয়ে বাজাতে থাকে বাসুদেব। নিবিড় নিস্তব্ধতায় মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে একরত্তি ছেলেটি। 

বাজানো শেষ হলে হাততালি দিয়ে ওঠে, বলে "বাহ্, কি সুন্দর বাজাও তুমি !" 

আড়বাঁশিটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে আনে বাসুদেব। খেয়াল করে জল ধরে এসেছে। 

বলে, "চল আমরা ওই মাঠের দিকে যাই, দেখি তুমার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা"। 

দুজনে এগিয়ে যায়.........বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে যুদ্ধ শেষের ছাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মাইকে বিভিন্ন এনাউন্সমেন্ট চলছে। মাইকের সুত্র ধরে এগিয়ে যায় দুজনে পরিচালন কমিটির অফিসের দিকে।

হঠাৎ পিছন থেকে ঝড়ের মত কে যেন এসে কোলে তুলে নেয় ছেলেটিকে, আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় চোখ মুখ। 

চিৎকার করে বলে, "কোথায় ছিলি সোনা, তুই কোথায় ছিলি" ? বলেই ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। 

ছেলেটি বলে, "বাবা আমি তো হারিয়ে যায়নি। আমি তো ওইদিকে ওই ফেরিওয়ালার সাথে বসেছিলুম, ও আমার সাথে কত কথা বললে, জানো আমাকে বাঁশি বাজিয়ে শোনালে................. অনর্গল বলে যেতে থাকে পুরো ঘটনাটা। 

নিস্পলক শুনতে থাকে ছেলেটির বাবা, অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে গাল বেয়ে। 

-"বড় সাহসী ছেলে আপনার বাবু, এট্টুকুন ভয়ডর নেই ! দিব্যি গল্প করে কাটিয়ে দিলে আমার সাথে !", বাসুদেব বড় বড় চোখ করে বলে।

-"বাবা আমি একটা বাঁশি কিনবও", গলা জড়িয়ে বায়না করে ছেলেটি। 

একটু সামলে নিয়ে বলেন ভদ্রলোক, "হ্যা হ্যা নিশ্চই, শুধু বাঁশি কেন ? আজ আমার বড় আনন্দের দিন, বড় সুখের দিন, আচ্ছা ভাই তোমার এই সবকটা খেলনা কত দামে দেবে"?

-"সওওব কটা বাবু" ?
-"হ্যা হ্যা সবকটা, যা আছে সব"। 

-"কি ফেরিওয়ালা, আমি বলেছিলুম না, তোমার সব খেলনা বিক্রি হয়ে যাবে !! কেমন? মিলল তো?", মুখ টিপে হাসে ছেলেটি।

দাম বুঝে নেয় বাসুদেব ছেলেটির বাবার থেকে, বলে, "এই আড়বাঁশিটার জন্য কোনো দাম নেবোনি.......এটা তোমায় এমনি দিলুম খোকা.....বাজিও কিন্তু" ! 

কচি আঙুলে বাঁশিটা চেপে ধরে ছেলেটি, চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে দিকে তাকিয়ে বাসুদেব বলে, "আচ্ছা খোকা, তোমার নাম বল্লে না তো" ?

-"কৃষ্ণকিশোর দাস ", হাসিমুখে বলে ছেলেটি।

বটেই তো, যে ছেলের এমন বাঁধভাঙা সাহস, এমন মখমলের মত হৃদয় আর বাঁশির প্রতি আকর্ষণ সে ছেলের নাম কৃষ্ণ হতেই হবে যে। অজান্তেই বুকের ভিতরটা এক অপার মায়ায় ভরে ওঠে বাসুদেবের। চোখের জল সামলাতে পারে না। 

কোনমতে বলে, "আমি আসি বাবু" বলেই পিছন ফিরে হাঁটতে থাকে খালি বাঁশটা কাঁধে নিয়ে। 

মনে মনে গেয়ে ওঠে, "আনা আনা আআআনা, মেলা বেচা কেএএএনা, বাদ্যি ছোটা ছোওওওটা, খেলনা গোটা গোওওওটা, ও দোকানি, দাম কোরোনি".................................. 



ছবি : নিজস্ব 

#bengalishortstories #drama #separation

Monday, May 9, 2016

সাপ্তাহিকী ৭ # পঁচিশ টাকা ভাড়া

'তাআতলা...নিয়াল্লেপুর....গড়িয়াহাট......তাআতলা...নিয়াল্লেপুর....গড়িয়াহাট.....'
অভ্যস্ত গলায় এক বিশেষ ভঙ্গিতে ডাকতে থাকে রঞ্জু। অফিস টাইমের এই সময়টা খুব বেশি ডাকাডাকি করতে হয় না। ঝট্পট ভরে যায় অটো। আজ শনিবার বলেই ভিড়টা একটু পাতলা আছে। প্রতিদিন বেহালা ট্রাম ডিপো থেকে গড়িয়াহাট ভাড়া খাটে রঞ্জু। ঠিকঠাক প্যাসেঞ্জার থাকলে সারাদিনে পনেরো ষোলোটা ট্রিপ হয়ে যায়। আজ কটা দিতে পারবে কে জানে। অটোর লাইনে স্বপনদা কে দেখতে পায়। একই পাড়ায় থাকে, একসাথেই অটো চালায়। স্বপনদা দূর থেকে চোখ নাচিয়ে বলে , 'কি রে কটা হলো' ?

মুখ দিয়ে একটা আক্ষেপ সূচক শব্দ করে রঞ্জু , বলে, 'ধুসস , কোথায় আর......এই তো বেরোলাম। বউনিই হয়নি এখনো। একে গরম তার ওপর শনিবারের বাজার.....গলার শিরা ছিঁড়ে গেল ডাকতে ডাকতে'।
-'যা বলেছিস মাইরি। আজ তো তবুও একটু মেঘলা আছে, তাই বাঁচোয়া। অন্য দিন তো......ফেটে যায়। হাতের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় স্বপনদা। রঞ্জু হেসে ফেলে। সত্তরোর্ধ্ব এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জিগ্গেস করে, 'যাবে তো' ? 
'হ্যাঁ যাব বসুন'। হাতের ইশারায় পিছনের সিটটা দেখিয়ে দেয় রঞ্জু। 
'এখনই ছাড়বে ভাই' ? ভদ্রলোক মুখ বাড়িয়ে আবার জিগেস করেন।
- হ্যাঁ, লোক হলেই ছেড়ে দেব দাদু.....
বলতে না বলতেই পিছন পিছন তিনটে প্যাসেঞ্জার এসে হাজির হয়। 'গড়িয়াহাট তো দাদা' ? সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করে। 'হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন', রঞ্জু তাড়াতাড়ি ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। 

কি অদ্ভূত !! এই শনিবারের মড়া বাজারে চারজন গড়িয়াহাট, তাও আবার একসাথে। দাদু বেশ পয়া লোক আছে........'জয়গুরু', মনে মনে বলে রঞ্জু। পিছনে বয়স্ক ভদ্রলোকের পাশে একজন মহিলা আর একটি অল্প বয়েসী মেয়ে। সামনে মাঝবয়েসী ভদ্রলোককে নিজের পাশে বসায়। হ্যান্ডেলে তিনবার হাত ছুঁইয়ে কপালে ঠেকিয়ে নেয় চটজলদি। ভালো বউনি হয়েছে সকাল সকাল। মনটা দারুণ খুশ হয়ে যায় এক্কেবারে। সবজে রঙের সেল্ফ স্টার্ট বাটনটায় চাপ দিয়ে অটোটা স্টার্ট করে। বাঁ হাতে গিয়ার তুলে ডান হাতে এক্সিলারেটরের কান মোচরাতেই গাড়ি চলতে শুরু করে। দুটো কাঁধ সোজা করে, সামনে চোখ রেখে সবুজ-হলুদ তেচাকা উড়িয়ে নিয়ে যায় স্টোনচিপ ফেলা কালো পিচের ওপর দিয়ে। শক্ত মুঠোয় দু হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডেল চেপে ধরলেই কিরকম পক্ষিরাজের ডানায় ভর করেছে বলে মনে হয় নিজের। হ্যাঁ, পক্ষিরাজের চেয়ে কম কিছু নয় তার এই সাধের বাহনটি। ভারী যত্ন করে সে। প্রতিদিন সকালবেলা ভালো করে ধুয়ে মুছে চকচকে করে নেয় বেরোনোর আগে। এই নিয়ে পাড়ার বৌদিরা হাসাহাসিও করে বিস্তর। বলে, 'রঞ্জু, এবার ওটাকে সিঁদুর পড়িয়ে ঘরে তোলার ব্যবস্থা কর। দিন দিন যা চেকনাই হচ্ছে...........'। গায়ে মাখে না রঞ্জু। হেসে এড়িয়ে যায় ।

তারাতলা পার হয়ে নিউআলিপুর ঢোকে অটো। দুর্গাপুর ব্রীজ ক্রস করে আলিপুর চৌমাথার সিগন্যালে এসে দাঁড়ায়। অন্যান্য দিনের মত জ্যাম আজ প্রায় নেই বললেই চলে। আড়চোখে লুকিং গ্লাসে পিছনের সিটটা দেখে নেয় এক ঝলক। বাঁ দিকে বসা অল্প বয়েসী মেয়েটা ফোনে কথা বলছে চাপাস্বরে। টুকরো কিছু কথা কানে ভেসে আসে। 'এই তো কালিঘাট পেরিয়ে গেছি, রাসবিহারীর জ্যামে ফেসে আছি। আসছি......প্লিজ, দশ মিনিট'। অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলে রঞ্জু। আজকাল মোবাইল ফোন হয়ে হেব্বি সুবিধে হয়েছে। যে যখন ইচ্ছে, যাকে পারছে ঢপ দিচ্ছে। বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে চোখ পড়ে। এক অদ্ভূত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে, ক্রমাগত কি যেন বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। কারোর সাথে কথা বলছেন নাকি ?
সিগন্যাল সবুজ হয়। অটো এগোয় গড়িয়াহাটের দিকে.........

'আসুন,.......গড়িয়াহাট'। মেন রোড ছেড়ে বাঁ দিকে সাইড করে থামায় রঞ্জু। ভাড়া গুনে নেয় সবার কাছ থেকে। পিছনে তাকিয়ে দেখে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক এখনো চুপ করে বসে আছেন বাইরের দিকে তাকিয়ে। ঘাড় কাত করে বলে, 'দাদু ! গড়িয়াহাট এসে গেছে, নামুন'।
'হ্যাঁ ? এসে গেছে' ? কোনো এক হারিয়ে যাওয়া মন খারাপের জায়গা থেকে যেন এক ঝটকায় ফিরে আসেন ভদ্রলোক। ধীরে ধীরে নেমে আসেন অটো থেকে। একই রকম শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেন, 'কত ভাই' ? 'পঁচিশ টাকা', বলে হাত বাড়ায় রঞ্জু।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট্ বের করে এগিয়ে দেন ভদ্রলোক।
- খুচরো দিন দাদু, পঞ্চাশ টাকার ভাঙানি দিতে পারব না। সবে বেড়িয়েছি।
- খুচরো ??!!!! খুচরো তো নেই আমার কাছে , যা আছে সব পঞ্চাশ একশোর নোট্।

পকেট থেকে কতগুলো একশো আর পঞ্চাশ টাকার নোট্ বের করে দেখান বৃদ্ধ।
'এই তো মুস্কিল, আমারই ভুল, আগে বলে নেওয়া উচিত ছিল। আপনারা বাইরে বেরোবেন খুচরো না নিয়ে, আর আমরা রেজগি দিয়ে দিয়ে মরব', খিঁচিয়ে ওঠে রঞ্জু।
'সত্যি বলছি ভাই, আমার কাছে একদম খুচরো নেই', কাতর স্বীকারোক্তি করেন ভদ্রলোক।
'আচ্ছা পাঁচ টাকা দিন, দেখছি', পঞ্চাশ টাকার নোট্ আর পাঁচ টাকার কয়েন নিয়ে রঞ্জু বাকি টাকা ফেরত দেয় ভদ্রলোককে।

- অনেক ধন্যবাদ ভাই..............আচ্ছা আমার আরেকটা উপকার করে দেবে ?
'কি' ? সামান্য বিরক্তি ফুটে ওঠে রঞ্জুর চোখে মুখে।
- রবি বাবুর বাড়িটা কোন দিকে একটু দেখিয়ে দেবে ?
- রবি বাবু মানে ? এম এল এ রবিশঙ্কর ঘটকের কথা বলছেন ?
- না না, আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলছি..................
খানিক থমকায় রঞ্জু, নাকের ওপর দুটো ভুরু জড়ো করে জিজ্ঞেস করে, 'কার কথা বলছেন' ? ....

'কেন ? আমি পরম শ্রদ্ধেয়, বিশ্বকবি, আমাদের সকলের গুরুদেব রবি ঠাকুরের কথা বলছি', নিস্পাপ সরলতায় কথাগুলো বলেন ভদ্রলোক। রঞ্জু হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। অবিশ্বাস আর কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোকের দিকে। আশপাশ দিয়ে গাড়িগুলো হর্ন মেরে বেরিয়ে যেতে থাকে। 
'কি হলো বললে না'? ভদ্রলোক অমায়িক স্বরে জিজ্ঞেস করেন।
'আপনি গড়িয়াহাটের মোড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি খুঁজছেন' ? ঠোঁটের ডগায় বিদ্রুপের লেশ মাখিয়ে জিজ্ঞেস করে রঞ্জু।

'ওহ ! আমি কি তবে ভুল পথে এলাম ? অনেকটা দেরী হয়ে গেল যে !! সময়মত কবিতাগুলো না পেলে যে ছেপে উঠতে পারব না'। ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভদ্রলোক। ক্রমবর্দ্ধমান ট্র্যাফিকের সাথে পাল্লা দিয়ে কৌতুহল বাড়ে রঞ্জুর। কোথাও একটা অসঙ্গতির আভাস পায় যেন, আশঙ্কা তৈরী হয় ভিতরে ভিতরে। বলে, 'আপনি চট করে উঠে পড়ুন তো ? অটোটা ঘুরিয়ে নিই। এমনিতেও জোড়াসাঁকোর গাড়ি পাবেন না এখান থেকে'। বাধ্য ছাত্রের মতো ভদ্রলোক অটোতে চেপে বসেন আবার। অটোর মুখ ঘুরিয়ে ট্রাম লাইন পেরিয়ে গড়িয়াহাট স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায় রঞ্জু। 

স্ট্যান্ডে এসে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির। তারপর পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করে, 'হ্যাঁ , এবার বলুন তো, ঠিক কোথায় যাবেন ?
- আমি রবি ঠাকুরের বাড়ি যাব। উনি খান কতক কবিতা লিখেছেন গত মাসে। ওগুলো তো ছাপতে হবে।
- রবি ঠাকুর কবিতা লিখেছেন !........গত মাসে !!!! কি ভুলভাল বকছেন ? আপনাকে আগে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল........ আপনার কি শরীর খারাপ করছে ? একটু জল খাবেন ?
- না না আমার শরীর একদম ঠিক আছে। দেখো ভাই, আমি একজন প্রকাশক, কলেজ স্ট্রিটে আমার ছাপাখানা আছে। আজ কবিতা গুলো না পেলে ছাপার কাজ আটকে যাবে যে।

এবার ধৈর্য হারায় রঞ্জু, গলাটা এক পারদ উঁচুতে তুলে বলে, 'আপনার কি মনে হয় উনি এখনো কবিতা লিখছেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে' ?

'কেন ? তোমার বুঝি তা মনে হয় না' ? কঠিনস্বরে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক। হকচকিয়ে যায় রঞ্জু, বলে, 'কি বলছেন বলুন তো দাদু তখন থেকে !! আজ কত বছর হল উনি মারা গেছেন........ আর আপনি বলতে চাইছেন স্বর্গ থেকে নেমে এসে উনি কাগজ কলম নিয়ে পদ্য লিখছেন ? সাত সকালে মস্করা করবেন না তো.............' 

'কে বললে রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন' ? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বৃদ্ধের। 'কে বললে তোমায় ? রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন এইখানে, ভালো করে দেখো ঠিক এইখানটার সমস্তটা জুড়ে উনি রয়েছেন'। নিজের বুকের ওপর আঙ্গুল ঠেকিয়ে দেখান রঞ্জুকে। তারপর দুইদিকে বুড়ো আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে বলেন, 'রবীন্দ্রনাথকে দেখাও যাবে না, ছোঁয়াও যাবে না, শুধু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে আর উনি তোমার অজান্তেই অক্সিজেন হয়ে তোমার শরীরের আনাচে কানাচে, মননে, চেতনায়, কল্পনায়, সর্বসাধনায়, বিরাজমান থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন বললেই হলো !! উনি কোনো সাধারণ মানুষ নন যে পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। উনি অজেয়, অমর, উনি পুন্যবাণীর দূত, হৃদয়ের অমৃত, ওনার ক্ষয় নেই, শেষ নেই, ফুরিয়ে যাবার যো নেই। পারবে ওনাকে ছাড়া চলতে ?........এক পাও এগোতে ? .........পারবে' ?

রোখ চেপে যায় রঞ্জুর। জেদীস্বরে বলে, 'কিন্তু দাদু, ওনার কবিতা কে পড়ে বলুন তো আজকাল, সেই ছোটবেলার পড়ার বইতেই যা পড়ে লোকে, আজকের দিনে ওসব তো অচল..............'

- কোনটে অচল বলছ ভাই ? মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী ? নাকি কথা ও কাহিনী, ক্ষণিকা, খেয়া, বলাকা ? ........ এরা অচল ? ঋতু পরিবর্তন তো চোখে দেখে এসেছে মানুষ............হৃদয়ের বোঝাপড়া দিয়েও যে ঋতু পরিবর্তনের আস্বাদ পাওয়া সম্ভব সেই উপলব্ধি ঘটল তো ওনার বই পড়ে। গ্রীষ্মের তীব্র দহনেও উনি, কালবৈশাখীর খেয়ালী ঝড়েও উনি, বর্ষার পরম তৃপ্তিতে উনি, শীতের পশমিনা আদরেও উনি........... আর শুধু ঋতু কেন ? আনন্দ, দুঃখ, রাগ, বেদনা, বিষাদ, হর্ষ, প্রেম, মনের এমন সুক্ষ্ম অনুভূতিগুলো উনিই তো জাগিয়ে দিয়ে গেছেন ওনার কলমের আঁচড়ে। ওনার বই পড়েই তো চেতনা উন্নীত হয়। মনের জটিলতম ধাঁধা সরল হয়ে যায় ওনারই বলে দেয়া কথায় ও শিল্পে। ওনার ভাষা ধার করে কথা বলতে শিখেছি আমরা। ওনার শব্দের আশ্রয়ে গল্প বুনি বরাবর। ওনারই প্রশ্রয়ে, সাহসে, ওনারই লিখে যাওয়া কবিতা আবার করে লিখে পাতার পর পাতা ভরাই। যাদের লেখার আবহে, আবদারে গদগদ হয়ে অচল বলছ তারাই রবীন্দ্রনাথের পুঁতে যাওয়া বীজের ফসল তুলছে ঘরে। নতুন লিখবে কি ? সব তো লিখে গেছেন আগে। নতুন বলবে কি আর ? সবই তো বলে গেছেন কবে..........অচল কে ? রবীন্দ্রনাথ না তোমরা ?

এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে হাঁপ ধরে যায়। বড় বড় শ্বাস নিতে থাকেন শীর্ণ অশীতিপর। জলের বোতলটা সিটের তলা থেকে বের করে এগিয়ে দেয় রঞ্জু। ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খেয়ে পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে ঠোঁট মুছে নেন, তৃপ্তির আভাস ফুটে ওঠে মুখে। 

কিছুটা সাহসের ওপর ভর করে রঞ্জু বলে ওঠে, 'কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো ভুলে যাইনি আমরা কখনো। আমরা তো রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করি ফি বছর। আবৃত্তি, নাচ, গান, কতরকমের কত কি অনুষ্ঠান হয় চারিদিকে, একরকম বাঙালীর উৎসব-যাপন নয় কি ? সবই তো ওনার প্রতি শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে। তাহলেও কি বলবেন আমরা পরজীবী, অকৃতজ্ঞ' ? গ্রাজুয়েট পাশ করা রঞ্জুর মনে সঙ্গত প্রশ্ন ভিড় করে আসে।

- নাহ, তোমরা হিপোক্রিট, অতীতের সেজবাতি পুড়িয়ে বর্তমানের আলো জ্বালাও। উগ্র আধুনিকতার ধুন্কিতে ইতিহাস অস্বীকারের মেডেল ঝোলাও গলায়। ট্যাগোর বলে যে জাঁক করছ, ওনার কবিতা বলতে গেলে তো দশবার হোঁচট খেতে হয় তোমাদের। খাঁটি সূর্য প্রনামের মন্ত্রোচ্চারণের মত করে যদি ওনার কবিতা পড়তে পারতাম সকলে, তাহলে আত্মসুদ্ধি হত এমনিই, আলাদা করে আর উৎসব করতে হত না........' 

অনাবিল মুগ্ধতায়, একরাশ বিস্ময় চোখে নিয়ে রঞ্জু তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোকের দিকে। প্রবহমান নদীর মত কথা বলে চলেন বৃদ্ধ। যুক্তি তর্কের মালা গেঁথে রবীন্দ্রস্তব চলতে থাকে একের পর এক। এ যেন কোন নাটমন্দিরের অপাপবিদ্ধ পুজারী। রবীন্দ্রবন্দনার নৈবেদ্য সাজিয়ে চলেছেন নিজের মনের মতন করে। ঠাকুর পুজোয় উৎসর্গ করেছেন নিজের গোটা জীবনটাই। ধন্য তুমি পুরোহিত, ধন্য তোমার ভক্তি। প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জাগে রঞ্জুর ভদ্রলোকের প্রতি আর তার চেয়েও বেশি ঔৎসুক্য জাগায় ঠাকুরের লেখনী ও কর্মজীবন, যা নির্বিঘ্নে, নিরলস ভাবে বলে চলেছেন উনি। বিমুগ্ধ শান্তিতে শুনে চলে রঞ্জু।

মনে মনে ঠিক করে নেয় ওনাকে বাড়ি পৌছে দেওয়া দরকার। কিন্তু বাড়িটা কোথায় সেটা তো জানা নেই। ওনাকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবেন বলেও মনে হয় না। বেহালা ট্রাম ডিপোয় তো পৌছনো যাক আগে। তেমন তেমন বুঝলে থানায় যেতে হবে। ওই এলাকাতেই বাড়ি হবে নিশ্চই। কথায় কথায় স্টার্ট দেয় অটো। পিছনের সিটে প্রভাতী বন্দনার মতো জারি থাকে রবীন্দ্রস্তুতি।

ট্রাম ডিপোর স্টান্ডে পৌছতেই একটা হট্টগোল চোখে পড়ে রঞ্জুর। একজন মধ্যবয়েসী মহিলা কাঁদোকাঁদো মুখে ঘুরে ঘুরে সবার কাছে একটা ফটো দেখাচ্ছেন। সঙ্গে আরো দুজন আছেন। খুব সম্ভব একই বাড়ির লোক। ব্যাপারটা বুঝতে বেশি সময় লাগে না রঞ্জুর। এগিয়ে যায় মহিলার দিকে, হাতের ফটোটা এক ঝলক দেখেই বলে, 'এদিকে আসুন, দেখুন তো ওনাকেই খুঁজছেন কিনা' ? মহিলাটি এগিয়ে আসেন। পিছনের সিটে ভদ্রলোক কে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন, 'বাবাআআ !!!! তুমি কোথায় ছিলে ? !!!! ...কোথায় চলে গিয়েছিলে না বলে' ? রঞ্জুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কোথায় পেলেন বাবাকে' ?

- আমার অটোয় উঠে ভুলবশত গড়িয়াহাট চলে গিয়েছিলেন। ওনার কথাবার্তায় সন্দেহ হয়েছিল, তাই আবার ফেরত আসি।
-অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা, আপনি যা করলেন, আজকের দিনে বিরল, কি বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো, আসলে ওনার মাথাটা মাঝে মাঝেই এমন গোলমাল করে........আপনি না থাকলে যে কি সর্বনাশ হত !!!!

'আরে না না......ছি ছি.... এসব কি বলছেন' ? ভারী লজ্জা পায় রঞ্জু। পিছন ফিরে ভদ্রলোক কে নামিয়ে আনে অটো থেকে, ততক্ষণে উনি চুপ করে গেছেন, একই রকম অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন রঞ্জুর দিকে। সামান্য হেসে রঞ্জু বলে, 'আচ্ছা দাদু, আসি তাহলে' ?
'হ্যাঁ ভাই ...কত হলো যেন' ? নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন উনি।
'পঁচিশ......' বলতে গিয়েও থেমে যায় রঞ্জু। কোনদিকে না তাকিয়ে চট করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। কবিপুজোর ভাড়া হয় না কখনো । মনটা নেচে ওঠে বেবাক আনন্দে। আজ দারুণ বউনি হয়েছে...........দারুণ। 

বাঁ হাত বাড়িয়ে এফএমটা অন করে নেয় সে........সামনে পঁচিশে বৈশাখ........তরঙ্গধ্বনি মুখরিত হয় -
'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ, খেলে যায় রৌদ্রছায়া বর্ষা আসে বসন্ত.......
পক্ষিরাজ ধুলো উড়িয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে দিগন্তে .........



#bengalishortstories #drama #rabindranathtagore #tributetorabindranathtagore #tribute #rabindrajayanti

Tuesday, May 3, 2016

সাপ্তাহিকী ৬ # গড়শালবনীর জঙ্গলে - শেষ পর্ব

দুজনে এগিয়ে যায় ফুটপাথের একটা চায়ের দোকানের দিকে। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে একটা কাঠের বেঞ্চি পাতা আছে। দেওয়ালের গায়ে ক্রাচটাকে হেলিয়ে দিয়ে বেঞ্চের ওপর বসে পত্রালিকা। নীলাভর দিকে তাকিয়ে বলে, 'বলুন মিঃ বসু। ........ কি জানতে চান' ?
'এক মিনিট.....তার আগে চায়ের অর্ডারটা দিয়ে আসি', নীলাভ হাত তুলে বলে। এই প্রথম নীলাভকে ভালো করে লক্ষ্য করে পত্রালিকা। ২৯-৩০ বয়স। ৫ ফুট ১০ হাইট, মাঝারি চেহারা। যত্ন করে রাখা হালকা দাড়ি..........হালফিলের ফ্যাশন। খুব চলছে এখন এটা। চোখে একটা বাদামী ফ্রেমের বিদেশী ব্র্যান্ডের চশমা। মোটের ওপর মন্দ দেখাচ্ছে না। চোখ সরিয়ে নেয় পত্রালিকা। নীলাভ পাশে এসে বসে। বলে,
-'যার কাছে এমন গল্পের ভান্ডার, ইতিহাসের প্রতি যার এমন অমোঘ টান, তার নিজেরও যে একটা কাহিনি থাকবে, সেটা একরকম অনুমান করেছি মাত্র। আর তাছাড়া আমি গল্প খুব ভালোবাসি জানেন। সে যেমনই হোক না কেন'।
-'আর তাই অপরিচিত লোকজনদের ধরে ধরে তাদের থেকে গল্প খুঁজে বেড়ান, তাই তো ?', তেরছা চোখে তাকায় পত্রালিকা। নীলাভ ভারী লজ্জা পায়। আমতা আমতা করতে থাকে, বলে, 'না না ঠিক তা নয় .....আসলে আপনার গড় শালবনির বর্ণনাটা এমন অপার বিস্ময় জাগায় যে আমি আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। মনে হয়েছিল আপনার সাথে দেখা হওয়াটা খুব জরুরী, অনেক কিছু জানার আছে আপনার থেকে।
-'আমার জীবনে তেমন কোনো রোমহর্ষক গল্প নেই, যেমনটা আপনি খুঁজছেন মিঃ বসু..........বরং আমার গল্পটা কতকটা এই শহরের মত, সরল অথচ গভীর, স্থির অথচ বাঙ্ময়, নিঃশব্দ অথচ চাঞ্চল্যকর'।
-মানে ? নীলাভ অনুধাবন করার চেষ্টা করে।
-'মানে......... দেখতে গেলে আমরা এই শহর কে কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি এর ইতিহাস। অল্পবিস্তর যা জানি তা সবই বইয়ের পাতায় লেখা আছে। তাই দিয়েই আমাদের চলে যায়। আর যেটা জানিনা সেটা আমাদের কোনো কাজেই লাগে না, তাই এ শহরকে আমাদের পাত্তা দিতে বয়েই গেছে। অথচ দেখুন কয়েকশো বছর ধরে কেমন আবহমান কালের নৌকায় আমাদের মত কত লক্ষ, কোটি মানুষদের ফেরি করে চলেছে নিয়ত। প্রতি ঘন্টায়, প্রতি মিনিটে চোখের পলকে কত সহস্র গল্পের জন্ম দিচ্ছে বলুন তো এই শহরটা। তার খোঁজ কে রাখে? তার খবরে কার প্রয়োজন ? কিন্তু কি জানেন মিঃ বসু, এই শহর একদিন সমস্ত পাত্তা আদায় করে ছাড়বে। বকেয়া পাওনা সব কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে একদিন। সেদিন পালাবার পথ পাব না আমরা কেউই, সেই দিন বড় ভয়ানক দাবী করে বসবে আমাদের সাধের এই শহরটা যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে কুলোবে না কিছুতেই'.......

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পত্রালিকা। থই পায় না নীলাভ, পত্রালিকার কথায়। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। সেটা দেখে হেসে ফেলে পত্রালিকা। বলে, 'আমার গল্প জানার জন্য একটা বিকেল যথেষ্ট নয় স্যার। আর আমার কাহিনী কোনো নববর্ষের পাঁজিতে লেখা বিধান নয় যে দিন, ক্ষণ, নক্ষত্র দেখে সব গড়গড় করে বলে যাব। ইতিহাসের শিকড় ওপড়াবেন অথচ বর্তমানের মাটি আলগা হবে না, তা কি হয়, মিঃ বসু ?

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে নীলাভ। কেমন যেন সব ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। কেমন অদ্ভূত কথা বলে মেয়েটা, মনে মনে বিড়বিড় করে নীলাভ। কেমন যেন রহস্য গুলে দেয় সব কথাতেই, অথচ না শুনেও যেন উপায় নেই, কি এক অপার্থিব চুম্বকীয় আকর্ষণে নিথর হয়ে বসে থাকে বেঞ্চের ওপর......

-'দাদা চা'............দোকানের ছেলেটি দুটো চা নিয়ে আসে।
-চা টা ধরুন মিঃ বসু। পত্রালিকা চায়ের ভাঁড়টা বাড়িয়ে দেয়।
-হ্যাঁ ??  হ্যাঁ হ্যাঁ........কই দিন...........
-কি এমন আকাশ পাতাল ভাবছেন বলুন তো !!!
-না মানে আপনার সমস্ত কথাই ঠিক যেন আন্দাজ করে উঠতে পারছি না, মাফ করবেন, তবে ভীষণ হেঁয়ালি করছেন বলে মনে হচ্ছে।
-হাহাহাহা, ওটা আমার স্বভাব মিঃ বসু, ওটা আপনি ইগনোর করুন। আমার এসব খামখেয়ালী কথায় খুব বেশি পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই আপনার। আমি ক্ষমা চাইছি আপনাকে এভাবে বিব্রত করছি বলে। আমি বরং আজ উঠি। অন্য আরেকদিন না হয়.............
-না না সেকি !!!! হাঁ হাঁ করে ওঠে নীলাভ। আমাদের আসল কথাটা তো আলোচনাই হলো না।
-কোন কথাটা ? ভুরু কুঁচকায় পত্রালিকা।
-আমাদের গড় শালবনী যাওয়ার ব্যাপারটা কি ঠিক করলেন ?
-আপনি সত্যিই সেখানে যেতে চান মিঃ বসু ?
-কি আশ্চর্য্য যেতে চাই বলেই তো আপনার সাথে দেখা করলাম।
-বেশ তবে.................আগামী শুক্রবার রাসবিহারী থেকে গাড়ি ছাড়বে। সকাল সাতটা। চেতলার দিকে মেট্রো স্টেশনের সামনে থাকব আমরা। পারলে মিনিট দশেক আগেই আসবেন। সঙ্গে আরো দুজন টুরিস্ট যাবেন। বাকি রিসর্ট বুকিংটা আমি কাল অফিস থেকেই করে দেব। এছাড়াও টুকিটাকি যা আছে সেগুলো ডিটেলস এ ফোন করে বলে দেবখন.................. আচ্ছা........আজ আসি তাহলে।
-হ্যা, সেই ভালো,আমিও তাহলে গুছিয়ে নিতে শুরু করি একটু একটু করে।
সামান্য হেসে, ক্রাচে ভর দিয়ে, মেট্রো স্টেশনের দিকে এগিয়ে যায় পত্রালিকা। নীলাভ তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।সূর্যাস্তের ছাই মাখা রঙগুলো পশ্চিমের সোনালী আকাশের সাথে মিলিয়ে যেতে থাকে একটু একটু করে। সন্ধ্যে নেমে আসে..........................................................

মাঝের কটা দিন দ্রুতবেগে কেটে যায় নিলাভর। অফিসের সমস্ত কাজ তো শেষ করেই রাখে, সামনের সপ্তাহের প্রেজেন্টেশন টাও এগিয়ে রাখে কিছুটা। শুক্রবারের লিভটা আগে থেকে এপ্লাই করে রাখার দরুন স্যাংশন পেতে অসুবিধে হয় না। শুধু বস একবার সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, 'কি ব্যাপার ? পুরুলিয়া কেন' ? খুব কায়দা করে এড়িয়ে গেছে নীলাভ। গড় শালবনী, পত্রালিকা এসব শুনলে আর রক্ষে থাকবে না। হাসির রোল উঠবে অফিস জুড়ে। পার্সোনাল বলে পার পেয়ে গেছে কোনরকমে। টিম কেও একই কথা বলে রেখেছে...................

রিসর্টটা মন্দ না , জঙ্গলের মাঝখানে এরকম একটা ছিমছাম থাকার জায়গা বেশ রোমাঞ্চকর এতে কোনো সন্দেহ নেই। দোতলা বাড়ি, সব মিলিয়ে আটটা ঘর। সামনে পেছনে দুদিকেই বারান্দা আছে। সামনের বেশ কিছুটা খালি জমি, সেখানে নানারকম ফুলের বাগান। উত্তর দিকে একটা চাষের ক্ষেতও আছে। বিভিন্ন সবজির ফলন হচ্ছে সেখানে। মোটের ওপর জায়গাটা বেশ তরিবত করে রাখা হয়েছে। মজার ঘটনা হচ্ছে আশ্চর্য রকমের পাখির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এখানে। এমনটা শোনেনি আগে নীলাভ। ঘন্টা খানেক আগে পৌঁছে গেছে তারা। উত্তেজনার বশে তখনি ডুলুং নদীর পাড় দেখতে চেয়েছিল সে। পত্রালিকা বলেছে ডুলুং নদীর পাড়ে নাকি গোধুলি বেলায় যেতে হয়। সেটাই নাকি বেশী ইন্টারেষ্টিং হবে। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে আজ নীলাভ। সকাল থেকে কেমন যেন আনমনা হয়ে আছে পত্রালিকা। কোনো প্রশ্ন করলে হ্যা বা না এ জবাব দিচ্ছে। গড় শালবনি নিয়ে একটু খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেই বলছে, 'সময় হোক সব জানতে পারবেন, সব বলব তখন'।
ভারী মুস্কিল হলো। কৌতুহল চেপে রাখাটা খুব সমস্যা হচ্ছে নীলাভর। কিন্তু উপায় নেই। লাঞ্চ সেরে দুপুরের পরে বেরনোটাই ঠিক হয়েছে।

লাঞ্চের পর একটু চোখটা লেগে গিয়েছিল। দরজায় আওয়াজ শুনে চটকা ভাঙে নীলাভর। পত্রালিকা দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ কুর্তি আর সালোয়াড়ে মানিয়েছে বেশ তবে একটু উদ্ভ্রান্ত লাগছে যেন।
-চলুন বেরিয়ে পড়ি। সন্ধের আগেই ফিরতে হবে।
-হ্যাঁ  চলুন। ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে নেয় নীলাভ, জিজ্ঞেস করে, 'আর বাকি দুজন ? ওরা যাবে না' ?
-হ্যাঁ, ওরা আসবে একটু বাদে।
বেরিয়ে পড়ে দুজনে.........

-কি ব্যাপার বলুন তো ? সকাল থেকে দেখছি, আপনি একটু অন্যমনস্ক, এনি প্রবলেম?
-প্রবলেম কার জীবনে নেই মিঃ বসু ? কারোর বেশি কারোর কম, কারোর সাম্প্রতিক কারোর ঐতিহাসিক............
মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না নীলাভ। সামনে এগিয়ে যায়, একটা ঝোপের মধ্যে নাম না জানা লাল সাদা ফুলের থোকা। ক্যামেরা তাক করে সেই দিকে। ছবি তুলে বলে, 'কি অদ্ভূত না !! একই ডাল থেকে দুটো রঙের ফুল হয়েছে'।
-সর্পগন্ধা............কথায় বলে এই ফুলের গন্ধে সাপ আসে। পিছন থেকে বলে পত্রালিকা।

এক পলক ফুলটা দেখে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে নীলাভ। পেছন পেছন ক্রাচে ভর দিয়ে আসতে থাকে পত্রালিকা। এক সময় একটা বিরাট অশ্বথ্ব গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে দুজনে।
-একটু জিরিয়ে নিই, কি বলেন? নদীর পাড়টা কি আরো দূরে ?
-আমরা এসে গেছি মিঃ বসু ।
-ওহ, তাই নাকি ? চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখে নীলাভ। কি অদ্ভূত রকম শান্ত জায়গাটা। একটা মৃদু অথচ তীব্র হাওয়া দিচ্ছে। কোথাও যেন হাওয়ার এই তীব্রতাই পরিবেশটার সুর কেটে দিচ্ছে।
-কি ?..........চিনতে পারলেন ? ঠোঁটের কোনে রহস্যময় এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করে পত্রালিকা।
- কি বলুন তো ? এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে নীলাভ।
- আপনার ডান দিকে কনকদূর্গার মন্দির, সোজা ওই গাছের ডালের নিচ দিয়ে দেখুন ডুলুং নদীর পাড় দেখতে পাবেন। এইখানে.............ঠিক এইখানেই দেখা হয়েছিল জয়্মল্লর সাথে নীহারিকার। আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে, এমনই এক গোধুলীর মায়াবী আলোতে। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়েছিল রাজকুমার জয়মল্ল।........... কি ?......মনে পড়ছে ? গলার স্বর তীক্ষ্ন হয় পত্রালিকার।
বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয় নীলাভর কপালে মুখে। 'এ আপনি কি বলছেন' ? 'আমার মনে পড়বে মানে !! আমি তো এর বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছি না'..... .........আপনি কি রসিকতা করছেন !!! ???
-'হাহাহাহাহাহা',
পত্রালিকার অট্টহাসিতে গড়শালবনীর জঙ্গল দিগ্বিদিক কেঁপে ওঠে। অরণ্যের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায় গাছের আড়ালে একঝাঁক পাখির কর্কশ ডাকে। দূরে ঝোপের আড়ালে কোনো এক ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণী দ্রুত অদৃশ্য হয়।
-'ঠিকই বলেছেন.......রসিকতাই বটে', হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলজ্বল করে ওঠে পত্রালিকার চোখ। নীলাভর সিড়দাঁড়া বেয়ে হিমেল বরফ নেমে যায়। চারপাশটা একঝলক দেখে নিয়ে কোনরকমে জড়ানো গলায় বলে,
-'আমার মনে হচ্ছে আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে পত্রালিকা। একটা ভীষণ বড় ভুল'..........
-'ভুল আমার কোথাও হচ্ছে না মিঃ বসু, চারশো বছরের পুরনো দগদগে ক্ষত এখনো বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে নীহারিকা। চারশো বছর ধরে তিলে তিলে মরছে সে। এই কঠিন মৃত্যুযন্ত্রণার কৈফিয়ত চাই। কৈফিয়ত চাই সেই আকস্মিক অপূর্ণতার যা কোনোদিন নীহারিকা জয়্মল্লকে এক হতে দিল না। আজ সেই দিন এসেছে। আজ পৃথিবী জানবে গড়শালবনীর মাটির অতলে চাপা পড়ে যাওয়া আসল গল্পটা............... এক ঘৃণ্য, লোভী চরিত্রের ষড়যন্ত্রের কথা। আপনি কি সত্যি ভুলে গেলেন না কি ভুলে যাবার ভান করছেন মিঃ বসু ? নাকি..............সেনাপতি নিলাদ্রীশেখর বলব !!!!!

নীলাভর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে যেন। আচমকা স্তব্ধ হয়ে যায় চারিপাশ। কোনো এক মায়াবী মন্ত্রগুনে জঙ্গলের মুখর বিকেল পলকে নিঃশ্চুপ হয়ে যায়। নীলাভর মুখ দিয়ে কথা সরে না। বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে যায় সে। এক অব্যক্ত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে পত্রালিকার দিকে।
-কি ? বিশ্বাস হচ্ছে না তো !!!!!! হিসহিসিয়ে ওঠে পত্রালিকা। সেই দিন তুমি গোপনে জানতে পেরেছিলে যে নীহারিকা দেখা করতে আসছিল জয়্মল্লর সাথে। তাই নিভৃতে তুমিও এসেছিলে তার আগে। নীহারিকার আর্তিতে যাতে সাড়া না দেয় তার জন্য আগে থেকেই জয়মল্লকে ভুল বোঝাতে গিয়েছিলে তুমি। তুমি চেয়েছিলে জয়্মল্লর সিংহাসন.......হতে চেয়েছিলে রাজ্যের অবিসংবাদী একনায়ক। জয়্মল্ল সন্দেহ করেছিল তোমাকে আর তাই ভোজালি দিয়ে জয়্মল্লকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলে এক লহমায়। নীহারিকা আসার পর তাকেও ছল করে বিষের পেয়ালা তুলে দিয়েছিলে মুখে। এমন ভাবে ঘটনার প্রেক্ষাপট সাজিয়েছিলে যে দেখে মনে হবে নীহারিকাই খুন করে জয়মল্লকে আর নিজেও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। তুমি কাপুরুষ নিলাদ্রীশেখর !! তুমি কাপুরুষ !! চিৎকার  করে ওঠে পত্রালিকা। ..........তুমি ছল কপটধারী এক পিশাচ। গড়শালবনীর বর্ণনার পর তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমি কে ?..................নীহারিকাকে চিনতে তোমার দেরী হয়ে গেছে নিলাদ্রীশেখর...........অনেক দেরী হয়ে গেছে............নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।

থর থর করে কাঁপতে থাকে নীলাভ। ঘেমে চান করে যায় আপাদমস্তক । বুকের বাঁদিকে সূঁচ ফোটার মত যন্ত্রণা অনুভব করে। কোনরকমে বুক চেপে ধরে মন্দিরের চাতালের ওপর বসে পড়ে সে। চোখের সামনে পত্রালিকা নয়, এক তরুণী যোদ্ধার বেশে রাজকুমারী নিহারিকা কে দেখতে পায় সে। সে যোদ্ধার অবিন্যস্ত চুল নদীর হাওয়ায় উড়তে থাকে সর্পিল ফনা তুলে। কাজলঘেরা চোখ থেকে নির্গত হয় দাবানলের আগুন। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে নীহারিকা নূপুরের ঝংকার তুলে। চোখের সামনেটা কুয়াশার মত ঝাপসা হয়ে আসে নীলাভর। চাতালের ওপর মাথা ঘুরে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ। প্রতিশোধের লেলিহান অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকে গড় শালবনীর জঙ্গল জুড়ে।

পরদিন সকালে জঙ্গলে তল্লাশী চালিয়ে নীলাভর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয় বডিটা। জিজ্ঞাসাবাদ করে রিসর্টের কেয়ারটেকার আর বাকি দুজন বোর্ডারকে।
-'ওদের দুজনকেই তো দেখলুম জঙ্গলের দিকে যেতে', একজন বোর্ডার জবানবন্দী দেয়।
-'ওদের সাথে আর কেউ ছিল' ? থানার তরুণ অফিসার জিজ্ঞেস করে।
-'না স্যার, আর তো কাউকে দেখিনি'।
- 'এই দুজনের ব্যাপারে কোনো ইনফর্মেশন দিতে পারেন' ?
- ছেলেটিকে তো চিনি না, তাই বলতে পারব না , তবে পত্রালিকা তো আমাদের গাইড হয়ে এসেছিল।

তরুণ অফিসারটি, সঙ্গের জুনিয়র অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলে, 'মল্লিক, কেসটা ইন্টারেষ্টিং মনে হচ্ছে । চারজন কলকাতা থেকে ঘুরতে এলো। একটি ছেলে খুন হলো। মহিলা গাইড নিখোঁজ হল। কি অদ্ভূত ব্যাপার না ! নাহ, একটু তলিয়ে দেখতে হচ্ছে যে। গাইডের নামটা কি বললে যেন ?
- 'পত্রালিকা স্যার'..........
-'আমাদের প্রাইম সাসপেক্ট মল্লিক। সবার আগে একেই খুঁজে বার করতে হবে.........বাকিদের বয়ান রেকর্ড করো, আমি ততক্ষণ একটা চক্কর দিয়ে আসি'। বাইক স্টার্ট করে বেড়িয়ে যায় তরুণ অফিসারটি।
রিসর্টের দারোয়ান, জুনিয়র অফিসার মল্লিককে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, 'উনি কি নতুন অফিসার স্যার' ?
- 'হ্যা, 'কালই জয়েন করেছে' ।
- 'কি নাম স্যার' ?
- 'ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত................জয়মাল্য সেনগুপ্ত'।

ছবি : গুগল 
#bengalishortstories #drama #lovestories #romance #thriller #adventurestories #suspense