Tuesday, April 19, 2016

সাপ্তাহিকী ৪ # লাইন

আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে অরূপের। অন্যান্য দিন নটার আগে সূর্য ওঠেনা। আজ অবশ্য একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে মনে মনে। সেটাই বোধহয় ব্যতিক্রমের কারণ। আড়মোড়া ভেঙ্গে ড্রয়িং রুমে এসে দেখে বাবা টিভি খুলে বসেছে।

'কি বলছে গো ? কোথাও কোনো গন্ডগোল বলছে ?' চাপা গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করে অরূপ।
'নাহ তেমন কিছু নয়, বালিগঞ্জ আর কসবার দু একটা জায়গায় একটু ঝামেলা চলছে। বাকি তো ঠিকই আছে, তাছাড়া এই তো সবে শুরু, বেলা বাড়ুক... তবে তো' ! বিড়বিড় করে ওঠেন মলয়।

সামান্য চিন্তার ভাঁজ পড়ে অরূপের কপালে, ব্যস্ত হয়ে বলে, 'শোনো আমি কিন্তু একাই যাব, একদম আতুপুতু করবে না'।

সামান্য একটু ঘাড় ঘুরিয়ে অরূপের আকস্মিক বড় হয়ে যাওয়াটা দেখেন মলয়, স্মিত হেসে বলেন, 'যেমন বুঝবে...'। 

অভ্যস্তহাতে সোফার পাশের টেবিলে চায়ের কাপ রাখেন পরমা, বলেন, 'তাই ভালো, আমরা বরং দুজনে গিয়ে কাজটা মিটিয়ে আসি, তারপর ও ওর সময়মত যাবে। আমায় আবার রান্না চড়াতে হবে এসে, বেশি দেরি করলে চলবে না'।

'হুমম, তাই চলো', চায়ের কাপে তাড়াতাড়ি দুচুমুক দিয়েই উঠে পড়েন মলয়। ফতুয়াটা গলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পরমাকে সঙ্গে নিয়ে ।

অরূপের বেশ ফুরফুরে লাগছে হঠাৎ করে। আজকের দিনটা অন্যরকম। অন্যান্য বছরে বারান্দার ধাপিতে বসে বাবা মাকে, বাড়ির লোকজনকে, পাড়ার সকলকে একসাথে যেতে দেখত। আজ সেও যাবে...... একা..........ভোট দিতে। আজ সেও হয়ে উঠবে এই রাজ্য, এই দেশ গড়ার কারিগর। রাজনীতির মসনদে তারও আঙুলের ছাপ থাকবে। গত বছরের শেষের দিকে আঠারো কমপ্লিট করে কিশোর অরূপ এখন যুবক। ফিনফিনে লতার মত বাবা মার ছায়ায় বেড়ে উঠেছে সে এতকাল। মুঠোয় এখন তার পরিবর্তনের শক্তি, বিপ্লবের অঙ্গীকার। এক মুহুর্তে ওলট পালট করে দেবার ক্ষমতা এখন তার হাতে। বেশ রোমাঞ্চই হচ্ছে মনে মনে। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়ে অরূপ। রেডি হতে হবে...........................

বাইরে বড্ড রোদ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান দিকের গলিটা নিলেই বড় রাস্তা। দুচার মিনিট হেঁটে চন্ডীতলার দিকে এগোলেই বাঁ দিকে স্কুলটা পড়ে। বরাবর ওখানেই পোলিং বুথটা হয়। একটু ছায়ায় ছায়ায় যেতে হবে। ছাতাটা নিয়ে বেরোলেই হত, কিন্তু ভীষণ বোকা বোকা দেখতে লাগে, তাই সানগ্লাসটা পড়ে নিয়েছে সে। মানানসই টিশার্ট আর জিন্স এ মন্দ দেখাচ্ছে না। দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় অরূপ..................

বুথের কাছাকাছি আসতেই দেখা যায় বিরাট লাইন। তেঁতুল বিছের মত কোমর বাঁকিয়ে এ যে স্কুল ছাড়িয়ে একবারে রাস্তায় এসে পড়েছে। ভারী মজা লাগে অরূপের। হাজার হোক প্রথমবার। হোক না বড় লাইন, কি আসে যায় তাতে। লাইন হোক বা রোদ, কোনো কিছুই আজ দমিয়ে রাখতে পারবে না তাকে। এদিক ওদিক চেয়ে দেখে অরূপ, পাড়ার কোনো বন্ধুটন্ধু লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কি ? নাহ। ফেসবুকে একটা পোস্ট দেওয়া যাক বরং। একটা ছবি তুলে পোস্ট করে, 'ফিলিং এক্সাইটেড ইন আ পোলিং কিউ'.........

এমন সময়, হঠাৎ কোথা থেকে এক পশলা বৃষ্টির মত হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসে একটি মেয়ে। কাছে এসে শশব্যস্ত হয়ে বলে, 'দেখি দাদা, একটু দেখি। আমার লাইন ছিল এখানে'।

'কি আশ্চর্য আপনার লাইন কি করে হয় ? আমি তো আগে এসে দাঁড়িয়েছি', অবাক হয়ে যায় অরূপ।

-'হয় দাদা হয়। ওই আপনার সামনের কাকুকে জিজ্ঞেস করুন না, আমি ছিলাম কিনা.......কি কাকু? আমি ছিলাম তো ?

সামনের পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত গোলগাল মাঝবয়সী ভদ্রলোকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অরূপ। খয়েরী দাঁত বের করে উনি বলেন, 'হ্যাঁ হ্যাঁ ও ছিল তো'। 

অগত্যা ব্যাজার মুখে দু কদম পিছিয়ে আসে অরূপ । ফাঁক দিয়ে টুক করে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। হাতে সামান্য বড় সাইজের একটা লেডিজ ব্যাগ। সেটা নামিয়ে রাখে পাশে। বিরক্তি ফুটে ওঠে অরূপের চোখে মুখে। 

মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, 'সরি কিছু মনে করবেন না, আসলে ওই সামনের দোকানে জল কিনতে গিয়েছিলাম। তারমধ্যেই আপনি ...........' বলেই অবাক হয়ে অরূপের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে বলে, 'আপনাকে কোথায় দেখেছি যেন, সবুজ সংঘের কাছেই আপনার বাড়ি না' ? 

ভারী অপ্রস্তুতে পড়ে যায় অরূপ। একে অনধিকার প্রবেশ তার ওপর আবার অযাচিত প্রশ্ন, আমতা আমতা করে বলে, 'হ্যাঁ , কিন্তু আপনি......?? 

-'আরে আমি তো একটু এগিয়ে ওই শিবমন্দিরের গলিতে দুটো বাড়ির পরেই থাকি'।

হ্যাঁ মনে পড়েছে অরূপের, গতবার সরস্বতী পুজোয় ওই গলির সামনেই ফাংশন হয়েছিল। মেয়েটি গিটার বাজিয়ে গান গেয়েছিল সেদিন। কি নাম যেন................কিছুতেই মনে করতে পারে না অরূপ।

-'আমি বিদুলা' , হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়েটি।

-'ওহ, আমি অরূপ', বলে মৃদু চাপ দেয় মেয়েটির হাতে। লক্ষ্য করে, মেয়েটি ডান হাতে অনেকগুলো কালো চুড়ি পড়েছে, বাঁ হাতে একটা পোড়ামাটির বালা। ভারী অদ্ভূত লাগে অরূপের। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে, 'ইয়ে মানে, আপনি কি এখনো গিটার বাজান'?

-'হ্যাঁ, বাজাই তো', বিদুলা হেসে বলে, 'আমার একটা ব্যান্ডও আছে, আমরা তো বিভিন্ন জায়গায় শো করি'........

লাইন এগোতে থাকে। 

অরূপ লক্ষ্য করে বিদুলার ঘাড়ের ঠিক নিচে একটি ট্যাটু করা আছে। খুব ছোট করে লেখা -'প্রেসলি'। জিজ্ঞেস করে, 'আপনি এলভিস প্রেসলির ভক্ত, তাই না'? মুখে চোখে বৈশাখের বিস্ময় নিয়ে বিদুলা বলে, 'কি করে জানলেন' ?......... ' 
'এই যে আপনার ট্যাটু টা', আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে অরূপ। 
-'ওও, হাহাহাহাহা........হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। আমি প্রেসলির ভীষণ ভক্ত .........বিশেষ করে হার্টব্রেক হোটেল.......আমার ফেভারিট। তবে কি জানেন তো প্রেসলি নামের একটা গুপ্ত জঙ্গি সংগঠনও আছে। এটা সেটাও হতে পারে'।.........

-'জঙ্গি সংগঠন' ???!!!!! স্বগতোক্তির মত করে বলে অরূপ, বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

অরুপের মুখের ভাব দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে বিদুলা। ভুরু নাচিয়ে বলে, 'কি ভয় পেলেন নাকি? আপনি তো ভারী ভিতু দেখছি, এত ভয় পেলে আলাপ জমাবেন কি করে,' ? 

কি বলবে ভেবে পায়না অরূপ, সারা মুখে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ে, আলাপ জমানোর কথা বলছে বিদুলা.......ও কি কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে?

বৈশাখের তীব্র দহনে কালবৈশাখীর আভাস পাওয়া যায় দুজন সদ্য যুবক যুবতীর মনে। স্বভাবে লাজুক, মুখচোরা অরূপ স্নাত হয় বিদুলার চোরা খুনসুটিতে। মধ্য গগনে অনুরাগের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে জমাটি আলাপচারিতায়। 

লাইন এগোতে থাকে.....................

-'আপনি একটু লাইনটা রাখুন। আমি চট করে কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনে নিয়ে আসি। খুব তেষ্টা পেয়েছে। আপনি খাবেন তো' ? অরূপ সম্মতির আশায় তাকায় বিদুলার দিকে।

-'হ্যাঁ খাব', বিদুলা ঘাড় এলায়। 'বেশি দেরী করবেন না যেন'। 

'আসছি', বলে কয়েক পা এগিয়ে যায় অরূপ .................

আচমকা বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে গোটা এলাকা থরথর করে কেঁপে ওঠে। প্রায় দশ হাত ধুরে ফুটপাথের ওপর ছিটকে পড়ে অরূপ। চোখের সামনে যেন কালো রঙের প্রলেপ দিয়ে যায় কেউ। চারিদিকে নিবিড় অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। কানের মধ্যে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ হতে থাকে একনাগাড়ে। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বেড়ে যায় সহস্র গুন। 

মিনিট কয়েক বাদে সম্বিত ফিরে পেতেই হাত বাড়িয়ে রাস্তার ওপর ভর দিয়ে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করে অরূপ। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। মাথার পেছনে হাত দেয়। রক্ত !!!!............ আবছায়া চোখে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করে। শীতের কুয়াশার মত জমাট ঘোলাটে হয়ে আছে চারিদিক। 

লাইনের জায়গাটাতে এক বিরাট ধোয়ার কুন্ডলী পাক খেয়ে উঠছে আকাশের দিকে। ধীরে ধীরে চোখের ঝাপসা ভাবটা কাটতে থাকে। আস্তাকুঁড়ের জঞ্জালের মত ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে আছে দুহাত অন্তর অন্তর। রাস্তার দুধারে রক্তের স্রোত। ভয়ানক চিৎকার আর কান্নার কোলাহলে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।

কোনরকমে টলতে টলতে স্কুলের সামনেটাতে আসে অরূপ। এইখানে ........এইখানেই তো দাঁড়িয়েছিল সে........হ্যাঁ মনে পড়েছে। কোল্ড ড্রিঙ্কস আনতে গিয়েছিল............মুহুর্তে মনে পড়ে যায় বিদুলার কথা । বিদুলা কই ......বিদুলা ?........চিৎকার করে সে ডাকে, 'বিদুলাআআআআআ'...........................

খানিক দূরে দশ পনেরোটা বাড়ির পরে একটা গলির মুখে বিদুলা আড়াল থেকে মুখ বাড়ায়। চোখে পৈশাচিক উল্লাসের ছাপ স্পষ্ট। স্কুলের অনতিদূরেই চূড়ান্ত অবিন্যস্ত অরূপকে দেখতে পায়। ধীরে ধীরে গলির ভিতরে মিশে যায় বিদুলা। অরূপ পাগলের মত চর্কিপাক খেতে থাকে রাস্তা জুড়ে........মনে পড়ে বিদুলার বলা প্রেসলির গুপ্ত জঙ্গি সংগঠনেই কথা। চিৎকার করে ওঠে 'বিদুলাআআআআআ'.................



বিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত 

#bengalishortstories #drama #lovestories #romance #separation

No comments:

Post a Comment