আমার এক দাদা ছিল। ছিল বলাটা বোধহয় একটু অতিসোয়াক্তি হচ্ছে, তবে বর্তমানে ঠিক কোথায় ঘাঁটি গেঁড়ে বসে আছে আমার জানা নেই। না, কোনো নিকট দূরে বা কোনো রক্তারক্তির সম্পর্কও নয়। এক নিপাট নির্ভেজাল পাতানো পাড়াতুতো দাদা। ডাকনাম পয়লা। আমরা ডাকতুম পয়লাদা বলে। ভালো নাম অবশ্যি একটা ছিল বটে তবে আমরা কেউই তেমন ভালো ছিলুম না বলে ওই অদ্ভূত নামেই ডাকতুম। নিরীহ, ভদ্র ছেলে, ফর্সা মেদহীন গড়ন। তখন ওর ২৬ - ২৭ বছর বয়েস হবে বড়জোর। উদ্ভট চিন্তাভাবনা, বিচিত্র কার্যকলাপ আর আমুদে স্বভাবের জন্য আমাদের সকলেরই ভীষণ প্রিয় পাত্র ছিল পয়্লাদা। আমায় খুবই স্নেহ করত। সচরাচর বাবা মায়েরা ছেলেদের এমন নাম রাখে না, তাই আমার কাছে একটু অদ্ভূতই লেগেছিল। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আচ্ছা, তোমার নাম পয়লা কেন গো? পৃথিবীতে তো আরো নাম আছে, এরকম একটা নাম কে দিলে তোমায়' ? আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলেছিলো, 'ধুর বোকা ! ভারী তো একটা নাম, কি আসে যায় তাতে' ?
পরে জেনেছিলাম পয়লা বৈশাখে জন্ম বলেই...........।
পরে জেনেছিলাম পয়লা বৈশাখে জন্ম বলেই...........।
মনে আছে কোনো এক বিকেলবেলায় পয়্লাদার বাড়ি গেছি। দেখি কতকটা লোকনাথ বাবার স্টাইলে বিছানার ওপর বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে বেভুল হয়ে কি যেন ভাবছে। পরনে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা কুঁচকানো সাদা পাজামা, যার দড়ির একদিকটা কোমর থেকে বেরিয়ে হাঁটুর ওপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। এমন কঠিন আত্মহারা ভাব আমার কাছে নতুন কিছু নয় । তাই সেদিকে পাত্তা না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ভাবছ পয়্লাদা' ? স্বপ্নাবিষ্টের মতো বলেছিল, 'ভাবছি না রে......... শুনছি'। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ? মহাজাগতিক শব্দের কোনো আবহ প্যাটার্ন শুনতে পেলে বুঝি' ? ফাজলামি করার অভ্যেস ছিল আমার বরাবরের। সেটা বোধহয় ক্ষমা ঘেন্না করেই বলেছিলো, 'ওই যে শোন, একটা পাখি ডাকছে'। পয়্লাদার ভাব গতিক হাড়ে হাড়ে চিনি বলেই গলায় আরও বেশ কতকটা ছ্যাবলামি মিশিয়ে বললাম, 'কি পাখি পয়্লাদা ? জটায়ু' ?
একথায় আমার দিকে কটমট করে তাকিয়েছিল এক পলক, তারপরেই মুখ ঘুরিয়ে কোমলস্বরে বলেছিল, 'না..........বেনেবউ.......কেমন যেন একটা সুর করে জিজ্ঞেস করছে দ্যাখ ! কি পরিচয় ......কি পরিচয়' ? সেই প্রথম জানলাম বেনেবউ নামের একটা পাখি আছে। এক নিবিড় ভালোলাগায় আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম সেদিন। বড় মন ভালো করা একটা নাম - বেনেবউ।
জিজ্ঞেস করলাম, 'পাখিটা কি কোনো গান গাইছে' ? বলল, 'না, সুর করে থেমে থেমে ডাকছে'।
বলেই এক লাফ দিয়ে ঘরের কোনে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো গীটারটা বের করে আনলো। তারপর বিছানার ওপর বসে, স্ট্রিং এ আঙুল ছুঁইয়ে বলল, 'শোন এটা..........'। চোখ বন্ধ করে শুনতে পেলাম গীটারে সঙ্গত করে দরাজ গলায় পয়্লাদা গাইছে, 'মুসাফির হু ইয়ারো, না ঘ্যর হ্যায় না ঠিকানা, মুঝে চ্যলতে জানা হ্যায় বাস চ্যলতে জানা'..........................
বলেই এক লাফ দিয়ে ঘরের কোনে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো গীটারটা বের করে আনলো। তারপর বিছানার ওপর বসে, স্ট্রিং এ আঙুল ছুঁইয়ে বলল, 'শোন এটা..........'। চোখ বন্ধ করে শুনতে পেলাম গীটারে সঙ্গত করে দরাজ গলায় পয়্লাদা গাইছে, 'মুসাফির হু ইয়ারো, না ঘ্যর হ্যায় না ঠিকানা, মুঝে চ্যলতে জানা হ্যায় বাস চ্যলতে জানা'..........................
বৈশাখের সেই বিকেলে এক অপার মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল বেনেবউ এর সুরের মূর্ছনা প্রাঞ্জল ভাষায় অনুবাদ করে দিচ্ছে পয়্লাদা। একের পর এক গান গেয়েছিল সেদিন, আর আমি কোনো এক খেয়ালী যুবকের মন্ত্রবলে নিশ্চুপ শুনে গিয়েছিলাম সেসব। গান শেষ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, 'কিরে, তুই যে একেবারে স্পিকটি নট হয়ে গেলি !! চাউমিন খাবি' ?
ঘোর কাটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'চাউমিন !! এখন ? না মানে এত ভালো গান হচ্ছিল যে'..............
সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'চল চল, ভবানী সিনেমার উল্টোদিকে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট খুলেছে, সাত টাকায় এক প্লেট চাউমিন.......হেব্বি টেস্ট........একবার খেলে ভুলতে পারবি না'।
প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেছিল সেদিন।
ঘোর কাটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'চাউমিন !! এখন ? না মানে এত ভালো গান হচ্ছিল যে'..............
সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'চল চল, ভবানী সিনেমার উল্টোদিকে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট খুলেছে, সাত টাকায় এক প্লেট চাউমিন.......হেব্বি টেস্ট........একবার খেলে ভুলতে পারবি না'।
প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেছিল সেদিন।
এতক্ষণ পড়ে যাঁরা ভাবছেন যে পয়্লাদা আর পাগলা দাশু সমার্থক শব্দ, তাদের বলি পাগলা দাশুর কিছু বৈশিষ্টতা ছিল বটে তবে উচ্চশিক্ষিত এবং যথেষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল পয়্লাদা। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রি নিয়ে এম এস সি পাশ করে বিদেশে পি এইচ ডি করার প্ল্যান করছিল সেসময়। বিভিন্ন বিদেশী ইউনিভার্সিটির ম্যাগাজিন আর জার্নাল নিয়মিত আসতো বাড়িতে। আমি অভিমান করে বলতাম, 'তুমি কি সত্যি চলে যাবে একদিন ? পি এইচ ডি তো এখানেও করা যায় নাকি ? আর বাইরে গেলে কত খরচ হবে বলো তো' !! আমায় থামিয়ে দিয়ে হেসে বলেছিল, 'ধুর পাগল ! বিদেশে পড়াশোনার কত সুযোগ সুবিধে জানিস ? আর তাছাড়া স্কলারশিপটা পেয়ে গেলে চিন্তা কি' ?
কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিলাম, 'তাহলে আমি আর আসছি না কাল থেকে, আমায় আর কেমিস্ট্রি পড়াতেও হবে না, তুমি বরং বাইরেই যাও'।
কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিলাম, 'তাহলে আমি আর আসছি না কাল থেকে, আমায় আর কেমিস্ট্রি পড়াতেও হবে না, তুমি বরং বাইরেই যাও'।
- আর তোর্ পরীক্ষা ? তার কি হবে ? ফার্স্ট ইয়ারের অ্যানুয়ালটা তো দিবি ঠিক করে নাকি !!.........
- সে খোঁজে তোমার দরকার কি, তুমি তো চলেই যাবে........
এর বেশ কয়েকদিন বাদে আমার সমস্ত অভিমান, মন-খারাপ, রাগ, মিথ্যে করে পয়্লাদার বাড়িতে এসেছিল এক নামকরা বিদেশী ইউনিভার্সিটির চিঠি। সারা বাড়ি নেচে কুদে মাতিয়ে দিয়েছিল পয়্লাদা। ফোন করে সুখবর দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল আমায়। সেদিন কি ভীষণ অনিচ্ছা সত্বেও গিয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারব না........শেষ বারের মত।
যেদিন ফ্লাইট ছিল তার আগের দিন ফোন করে বলেছিল, 'শোন পড়াশোনাটা চালিয়ে যাস, যতদুর পারবি, মনে রাখিস ওটাই সম্বল, অসময়ের হাতিয়ার.......আর মন খারাপ করিস না, আমি তো আসব মাঝে মাঝেই, তখন দেখা হবে'। 'সাবধানে যেও' কথাটাও ভালো করে বলতে পারিনি সেদিন। পেটের ভেতর থেকে কে যেন জোর করে গলাটা চেপে ধরে রেখেছিল। স্বজন হারানোর বেদনার থেকেও কঠিন ছিল সেই ফোন। নির্বাক নিস্তব্ধতায় ল্যান্ড লাইনের রিসিভার ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠায়। শুধু বলেছিলাম, 'আচ্ছা..........'
যেদিন ফ্লাইট ছিল তার আগের দিন ফোন করে বলেছিল, 'শোন পড়াশোনাটা চালিয়ে যাস, যতদুর পারবি, মনে রাখিস ওটাই সম্বল, অসময়ের হাতিয়ার.......আর মন খারাপ করিস না, আমি তো আসব মাঝে মাঝেই, তখন দেখা হবে'। 'সাবধানে যেও' কথাটাও ভালো করে বলতে পারিনি সেদিন। পেটের ভেতর থেকে কে যেন জোর করে গলাটা চেপে ধরে রেখেছিল। স্বজন হারানোর বেদনার থেকেও কঠিন ছিল সেই ফোন। নির্বাক নিস্তব্ধতায় ল্যান্ড লাইনের রিসিভার ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠায়। শুধু বলেছিলাম, 'আচ্ছা..........'
এরপর বহু বৈশাখ এসেছে আর গেছে। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি আর তারপর কালের নিয়মে সংসার হয়েছে। ভবানী সিনেমার উল্টোদিকের সেই ছোট রেস্টুরেন্ট বেশ কয়েক বছর হলো বন্ধ। জরাজীর্ন টিনের চার দেওয়ালে আমাদের যে কত সুখস্মৃতি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। ফুড কোর্টের চাউমিনে আজ আর সেই সাত টাকার স্বাদ পাইনা কোথাও। বহুবছর হল যোগাযোগ একেবারে স্তব্ধ। ফোন নম্বর জানিনা, তার কারণ পয়লাদার বাড়ির লোকজন অন্যত্র শিফট হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও খুঁজেছি অনেক, পাইনি। একটা পুরোনো মেল্ আইডি ছিল বটে তবে একবার মেল্ করে উত্তর না পাওয়ায় অভিমানে আর চিঠি লিখিনি কখনো। বুকের খাঁজে পয়্লাদার অমোঘ শূন্যতা ঘিরে ধরে মাঝে মাঝেই। রোজের অফিস আর বাড়ির ব্যস্ততার ফাঁকে কখনো কখনো পুরনো বিকেলগুলোর অতীতগুলো পুঁটি মাছের মত বুর্বুরি কেটে ভেসে ওঠে স্মৃতির পুকুরে.............
প্রতিদিনের মত নিয়ম করে আজও সকালে অফিসে এসেছি। অভ্যাসবশে মেলের ইনবক্স ঘেঁটে দিনের শুরু হয় নিয়ত। একঢোঁক জল খেয়ে স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখেছি আজও ।
কিন্তু একি !!!! আজ একি দেখছি চোখের সামনে !!!! স্ক্রীনের সাদাটে আলোয় জ্বলজ্বল করছে এ কার নাম ?? অম্লান মজুমদার !!! ঠিক দেখছি তো ? দু চার বার চোখ ঘষে আবার স্ক্রিনের দিকে তাকালাম।বুকের ধুকপুকানি এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে গতি বাড়াচ্ছে। কেমন অবশ মত লাগছে নিজের।চারপাশের লোকজন, দেয়াল, জানলা, কেমন ঘোলাটে হয়ে অফ ফোকাসে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে...........
পয়্লাদা !!!!!!..........পয়্লাদার মেল.........এত বছর পর !!!........চোখের সামনে সেই পুরনো বিকেলগুলো স্ন্যাপশটের মত সরে যাচ্ছে একের পর এক। কাঁপা কাঁপা হাতে নামের ওপর কার্সরটা নিয়ে গিয়ে ক্লিক করি। মেল্ খুলছে........আমার অতীত বর্তমান নিমেষে একাকার হয়ে যাচ্ছে। একটা অলীক স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি যেন আস্তে আস্তে। বাঁ হাত দিয়ে জলের বোতলটা খুঁজতে থাকি। পাচ্ছি না......................
প্রতিদিনের মত নিয়ম করে আজও সকালে অফিসে এসেছি। অভ্যাসবশে মেলের ইনবক্স ঘেঁটে দিনের শুরু হয় নিয়ত। একঢোঁক জল খেয়ে স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখেছি আজও ।
কিন্তু একি !!!! আজ একি দেখছি চোখের সামনে !!!! স্ক্রীনের সাদাটে আলোয় জ্বলজ্বল করছে এ কার নাম ?? অম্লান মজুমদার !!! ঠিক দেখছি তো ? দু চার বার চোখ ঘষে আবার স্ক্রিনের দিকে তাকালাম।বুকের ধুকপুকানি এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে গতি বাড়াচ্ছে। কেমন অবশ মত লাগছে নিজের।চারপাশের লোকজন, দেয়াল, জানলা, কেমন ঘোলাটে হয়ে অফ ফোকাসে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে...........
পয়্লাদা !!!!!!..........পয়্লাদার মেল.........এত বছর পর !!!........চোখের সামনে সেই পুরনো বিকেলগুলো স্ন্যাপশটের মত সরে যাচ্ছে একের পর এক। কাঁপা কাঁপা হাতে নামের ওপর কার্সরটা নিয়ে গিয়ে ক্লিক করি। মেল্ খুলছে........আমার অতীত বর্তমান নিমেষে একাকার হয়ে যাচ্ছে। একটা অলীক স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি যেন আস্তে আস্তে। বাঁ হাত দিয়ে জলের বোতলটা খুঁজতে থাকি। পাচ্ছি না......................
![]() |
| ছবি : গুগল |
#bengalishortstories #drama #poilaboisakh #bengalinewyear #molat

No comments:
Post a Comment