Thursday, April 7, 2016

সাপ্তাহিকী ২ # টিকিট

অভিনয় করবে শুনে ঠাস করে এক চড় কষিয়েছিলেন হেম। 'সিনেমায় নামবি !! তুই সিনেমায় নামবি?', চিৎকার  করে উঠেছিলেন সারা বাড়ি কাঁপিয়ে। 'নামবি' শব্দটায় বোধহয় মরমে মরে গিয়েছিল সদ্য গ্রাজুয়েট পাশ করা তন্বী প্রত্যাশা। চোয়াল শক্ত করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বলেছিল ..........
'কিন্তু মা, আমার যে স্বপ্ন অভিনয় করার'.....
'আর আমাদের স্বপ্ন ! তার বুঝি কোনো মূল্য নেই ? দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন হেম। রান্নাঘরে আগুনের আঁচে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সে চোখের দিকে তাকাতে পারেনি প্রত্যাশা। তবু কোনোরকম ভাবে অস্ফুটে বলেছিল, 'একবার আমার কথাটা....................'
'না আআআআআ !!!!!!!!!'......

ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল প্রত্যাশা রান্নাঘর থেকে। একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়েছিল। কখনো ভাবতে পারেনি মা এভাবে কথা বলবে। জ্ঞান হওয়া অবধি মাকেই সবচেয়ে কাছের বন্ধু মেনে এসেছিল এতদিন। কোনো এক অযান্ত্রিক কারণে ছোটবেলা থেকে মায়ের আঁচলের তলাতেই বেশি ঘুরঘুর করত সে বরাবর। ছোটবেলার সমস্ত কথা, আবদার, বায়না, জেদ এককথায় মিটিয়ে এসেছেন হেম। এমনকি দুদিন আগের সদ্য আলাপ হওয়া যুবকের কথাও প্রত্যাশা অবলীলায় আলোচনা করেছিল মায়ের সাথে। সেখানে নিজের স্বপ্নের খেলাঘর যে হেমের কঠিন সংস্কারের দেওয়ালে আঘাত লেগে চুরচুর হয়ে যাবে এমনটা সে ভাবেনি কখনো।

সন্ধেবেলায় বাবা ফিরতে ড্রয়িং রুমের চৌকাঠের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রত্যাশা। একটা শেষ চেষ্টা। বাবার মুখ দেখেই আন্দাজ করেছিল দুপুরবেলার ঘটনাটা বাবার অজানা নয়। একপলক হেমের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলেছিল, 'বাবা একটু কথা আছে'। প্রমথেশ জুতো খুলতে খুলতে মুখ না তুলেই বলেছিলেন, 'জানি'। এক মুহূর্ত থমকে প্রত্যাশা বলেছিল, 'আমারও তো ইচ্ছে, অনিচ্ছে, ভালোলাগা, এম্বিশন থাকতে পারে, তার কি কোনো গুরুত্বই নেই তোমাদের কাছে? আর তাছাড়া আমি অন্যায় তো কিছু করছি না। তাহলে কেন ...........'। হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে প্রমথেশ বলেছিলেন, 'প্রত্যাশা নামটা রেখেছিলেন তোমার দাদু। আমাদের বিশ্বাস ছিল তুমি আমাদের স্বপ্নপূরণ করবে। তোমার দাদু চেয়েছিলেন নাতনি পি এইচ ডি করবে, কলেজের প্রফেসর হবে। আজ তোমার দাদু বেঁচে থাকলে কি হত জানি না, তবে চলে গিয়ে এই লজ্জার হাত থেকে বেঁচেছেন এটা হলপ করে বলতে পারি। তাছাড়া সিনেমায় রোল পেতে গেলে কি করতে হয় সে বিষয়ে তোমার ধারণা আছে আশা করি। তুমি যদি সে ব্যাপারে প্রিপেয়ার্ড থাকো তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি নিজের মেয়ে হিসেবে তোমার ওপর ঘেন্না হচ্ছে আমার'। 

পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল প্রত্যাশার। কখনো ভাবেনি বাবার মুখ থেকে এরকম কদর্য শব্দ বেরিয়ে আসতে পারে। নিজের জামার খুঁটটা খামচে ধরে রেখেছিল সে আর চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বেরিয়ে এসেছিল অব্যক্ত গ্লানি আর অপমান। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবাড়িতে আর নয়............................................

আজ সকাল থেকেই ঝোড়ো হওয়া বইছে। কোথাও কোনো মেঘের আনাগোনা নেই তবুও। বসন্তের এই শেষের দিনগুলোয় যেখানে গ্রীষ্মের চাবুক পড়ছে সেখানে এই হাওয়াটা মন্দ লাগছে না প্রমথেশের। গত সপ্তাহতেই রিটায়ার্ড হয়েছেন। এখন প্রতিদিনই ছুটির দিন। বছর ন' দশেক আগে প্রত্যাশার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি আজও। কানাঘুষয় শুনেছিলেন মেয়ে মুম্বইতে অভিনয় করছে। প্রথম দিকটায় খোঁজাখুঁজি করলেও পরে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ইদানীং বারান্দায় আয়েশ করে হেমের সাথে চা খাওয়াটা নতুন একটা অভ্যেসে তৈরী হয়েছে। বাংলা কাগজটা শেষ করে ইংরেজিটার দিকে হাত বাড়াতেই ডোরবেল বেজে উঠলো। সেদিকে তাকাতেই হেম বললেন, 'আমি দেখছি'। দরজা খুলতে একটি ছেলে একটা চিঠির খাম ধরিয়ে দিল। 'ক্যুরিয়র আছে, প্রমথেশ বসু ও হেমলতা বসুর নামে'। সই করে দরজা বন্ধ করলেন হেম।

'কার চিঠি '? প্রমথেশ বারান্দা থেকে জিগ্গেস করলেন।
'জানিনা, দিল্লি থেকে এসেছে'।
চিঠিটা খুলেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন হেম। ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। প্রমথেশ উঠে এসে জিগ্গেস করলেন, 'কি হল, খারাপ কিছু'? কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠির খামটা এগিয়ে দিলেন প্রমথেশের দিকে। খামের ভেতর থেকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড সেরেমনির দুটো ইনভিটেশন কার্ড বের করলেন প্রমথেশ....... সঙ্গে ফ্লাইটের দুটো টিকিট। চিঠিতে লেখা শুধু চারটে শব্দ, 'পারলে এসো.....ইতি প্রত্যাশা'।.................

স্তম্ভিত হয়ে বারান্দায় চলে এলেন প্রমথেশ। দক্ষিনের আকাশে মেঘ করে এসেছে।
আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে.........
ছবি : গুগল 
#bengalishortstories #drama #successstory

No comments:

Post a Comment