এদিকের রাস্তাটা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে এসেছে এখন। পনেরো কুড়ি গজ দূরের স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো এসে ঢুকেছে জানলার পর্দার পাশ দিয়ে। তাই দিয়েই মোটামুটি ঘরের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। পাশ ফিরে টেবিল ক্লকটার দিকে তাকালেন সুকুমার। পৌনে দুটো। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। বিছানার পাশে রাখা বোতল থেকে দু ঢোঁক জল খেয়ে পায়ে পায়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সিমেন্ট কংক্রিটের ধুলো ওড়া গন্ধ এসে লাগলো নাকে। রায়দের বাড়ির রকটার সামনে তিনটে কুকুর একটা রুটির টুকরো নিয়ে সমানে চেঁচাচ্ছে। পাশের বাড়িতে নিউজ চ্যানেল চলছে বোধহয়। ব্রেকিং নিউজ কানে আসে সুকুমারের। চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে অজান্তেই। অজানা আশঙ্কায় ঢোঁক গেলেন সুকুমার। অন্যসময় পাড়াটা নিঃঝুম থাকে, আজ আশপাশ থেকে গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কোথা থেকে চারটে ভিখিরি এসে জড়ো হয়েছে। লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। দেখা যাচ্ছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। কিন্তু সুকুমারের চোখে ঘুম নেই আজ। বয়েস হওয়ার দরুন ঘুমের ওষুধ খেতে হয় বটে, তবে রোজ নয়।
বয়েস !!......তা অনেকটাই হলো বটে। গত মাঘে চুয়াত্তর পেরিয়ে পঁচাত্তরে পড়লেন। এর মধ্যেই দু বার ছানি অপারেশন হয়ে গেছে। স্মৃতির সাথে সাথে দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসছিল, ছেলে জোর করে করিয়ে দিল।
সুকুমারের একমাত্র ছেলে, পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মস্ত বড় কোম্পানিতে চাকরি। বেশির ভাগ সময়ই কলকাতার বাইরে কাটাতে হয়। বড় কোম্পানি, বিস্তীর্ণ কাজ। তাতে অবশ্য সমস্যা হয় না সুকুমারের। অলোকা মারা যাবার পর চৌধুরী বাড়ির দোতলার ঘরে একা থাকাটা একরকম অভ্যেসই হয়ে গেছে। জীবনের কাছে আজ আর কোন অভিযোগ অনুযোগ নেই, শুধু ছেলেটার একবার বিয়ে হয়ে গেলেই নিশ্চিন্তি। একমাত্র ছেলেকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন সুকুমার। বুকে আগলে মানুষ করেছেন একা হাতে। প্রাইমারি স্কুলের মাঝারি বেতন থেকে জমিয়ে জমিয়ে ছেলের উচ্চ শিক্ষার জন্য সঞ্চয় করেছেন। তবেনা আজ ছেলে নামী কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। গর্বে বুক চওড়া হয়ে গিয়েছিল যখন রাজকুমার এর নামটা জয়েন্ট এন্ট্রান্স এর লিস্টে দেখেছিলেন।
ছেলের কথা ভাবলেই বুকের ভেতরটা এখন মোচড় দিয়ে উঠছে। কাল থেকে কোনো পাত্তা নেই। দুপুরবেলা ফোন করে সেই যে বলল দিল্লী যাচ্ছি তারপর থেকে প্রায় সতেরোবার ফোন করেছেন, প্রত্যেকবারই সুইচ্ড অফ বলছে। কি হলো, কোথায় গেল, ঠিকঠাক পৌছল কিনা, কিছুই বুঝতে পারছেন না। নাহ, এমন তো কোনো বার হয়নি। তাহলে কি কোনো বিপদ হলো ? নাকি নিউজ চ্যানেলগুলো যা বলছে সত্যি ? বিশ্বাস করতে মন চায় না। ধীরগতিতে দোতলার বারান্দায় এসে পশ্চিম দিকে তাকালেন সুকুমার। ভেঙে পড়া পোস্তা ব্রিজের বিধ্বস্ত কঙ্কালটা এখান থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। প্রায় সবকটা নিউজ চ্যানেলেই ছেলের কোম্পানির নামটা বলছে বারে বারে। গলা বুজে আসছে, স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোটা এসে পড়েছে মুখের ওপর......কঙ্কালের মতই বিবর্ণ ফ্যাকাশে লাগছে এখন।
![]() |
| ছবি : গুগল |
#bengalishortstories #drama

No comments:
Post a Comment