ক্রিং ক্রিং ......ক্রিং ক্রিং......ক্রিং ক্রিং
-হ্যালো....
-হ্যালো, আমি কি মিঃ নীলাভ বসুর সাথে কথা বলছি?
-হ্যা, নীলাভ বলছি...
-গুড মর্নিং মিঃ বসু, আমি সামার ভেকেশন প্রাইভেট লিমিটেড থেকে পত্রালিকা বলছি।
-হ্যাঁ বলুন..কি ব্যাপার......
-স্যার, আপনি আমাদের লাকি ড্র কনটেস্ট এ উইনার হয়েছেন। আপনি পেয়ে যাচ্ছেন ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে আমাদের রিসর্টে থাকার ৩দিন ২রাত্রির উইকেন্ড ট্রিপ।
-সরি..., কিন্তু আমার তো মনে পড়ছে না এরকম কোনো কন্টেস্টে পার্টিসিপেট করেছি বলে।
-মিঃ বসু, গত সপ্তাহে শনিবার সাউথ সিটি মলে আমরা ক্যাম্পেন করেছিলাম। আপনি সেখানে ফর্ম ফিলাপ করেছিলেন। সেখান থেকেই লাকি ড্র......
-হ্যাঁ বুঝলাম....., কিন্তু আমার সময় হবে না........ দুঃখিত।
-আমি জানি আপনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। কলকাতার অন্যতম নামী ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার আপনি। তবু যদি একবার আমাদের অফারটা একটু শুনে নিতেন প্লিজ।
-ওরেব্বাহ !! আমায় নিয়ে বিস্তর হোমওয়ার্ক করেছেন দেখছি !.......
-হ্যাঁ (সামান্য হেসে) ওটা তো আমাদের কাজের মধ্যেই পড়ে। ক্লায়েন্ট এর ডিটেলস রাখাটা খুব জরুরী........
-সে যাইহোক ম্যাডাম, আই এয়াম রিয়েলি সরি, আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব হবে না।
-ওকে স্যার, আমি এখন আর বিরক্ত করছি না আপনাকে। তবু শুধুমাত্র জানার জন্য বলে রাখি আমরা গড়শালবনী তে আপনার উইকেন্ড ট্রিপের ব্যবস্থা করেছিলাম। আপনি আরো একবার ভেবে দেখতে পারেন। আমি বিকেলের দিকে নাহয় একবার ফিডব্যাক নিয়ে নেব আপনার, কেমন ?
লাইনটা কেটে দিয়ে জানলার বাইরে তাকায় নীলাভ। স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে বৈশাখের দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে গোটা শহর। জানলার পাশে অতবড় রাধাচুড়া গাছটাও কেমন যেন ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ঝুঁকে পড়া ডালের নিচে একটা চড়ুই বাসা বেঁধেছে। চোখ চলে যায় সেই দিকে। নীলাভর বাসা বাঁধা হয়নি। বাবা মা গত হবার পর বেহালার বনমালী নস্কর লেনের ফ্ল্যাটটায় এখন নিজের ছায়ার সাথে সহবাস করে সে। অবসর সময়ে বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা মেরে আর সিনেমা দেখে দিন চলে যায়। ফটোগ্রাফির একটা ঝোঁক আছে অবশ্য তবে বহুদিন ট্যুরে না যাওয়ার ফলে সময়ের ধুলো পড়েছে ওটার ওপর। গত মাসে ইয়ার এন্ডিং এর পর এখন বেশিরভাগটাই কলকাতায় কনসেন্ট্রেট করতে হচ্ছে। দেরাজ থেকে ডিএসেলার টা বের করে আনে নীলাভ। তোয়ালে দিয়ে একবার হালকা করে মুছে নেয় সাধের ক্যানন ৫৫০ডি টা। অভ্যস্ত হাতে লেন্স ক্যাপটা সরিয়ে ভিউ তে চোখ রাখে। জানলার মধ্যে দিয়ে ফোকাস পায় রাধাচূড়া গাছে চড়ুইয়ের বাসাটা। শাটারে তর্জনীর চাপ পড়ে.......ফ্রেমবন্দী হয় স্বপ্ন।
'কি যেন নাম বলছিল জায়গাটার? হ্যা, গড়শালবনী। কেমন যেন একটা বেয়াড়া, বাউন্ডুলে নাম', বিড়বিড় করতে করতে বাথরুমে ঢোকে নীলাভ। রোববার হওয়ার দরুন আজ একটু দেরিই হলো। ...........................................................................................
ক্রিং ক্রিং ......ক্রিং ক্রিং......ক্রিং ক্রিং
-হ্যালো.....
-গুড আফটার্নুন মিঃ বসু, আমি পত্রালিকা, সামার ভেকেশন থেকে বলছি।
-ও হ্যাঁ বলুন............(দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার রেশ কাটে নীলাভর)
-আমাদের অফারটা কি ভেবে দেখলেন আরেকবার ?
-দেখুন আমি এখনো কিছু ডিসাইড করিনি। তবে ওই জায়গাটা.........গড়শালবনী না কি যেন........ এটা কোথায় ?
-গড়শালবনী কলকাতা থেকে একশো সত্তর কিলোমিটার দূরে। ঝাড়গ্রামের খুব কাছেই।
-কিন্তু এমন একটা অদ্ভূত জায়গায় কেন বলুন তো? মানে, কি আছে সেখানে ?
-ঠিকই বলেছেন। আসলে কি জানেন, আমরা সেইসব জায়গা খুঁজে বের করি যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে নি। যেখানে ঘুম ভাঙ্গে ময়না দোয়েলের গানে। যেখানে গাছের ছাওয়ায় দু দন্ড ঠেস দিয়ে বসলে মনের সমস্ত গ্লানি, ক্লান্তি বুদবুদের মত মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। যেখানে রাত্রি নামে অরণ্যের নিঃস্তব্ধতায়, যেখানে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়, যেখানে প্রতিদিন বাঁচা যায়, প্রতিদিন শান্তিতে মরা যায়।........তেমনই কিছু জায়গার খোঁজ করি আমরা............
-বাহ্ আপনি তো ভারী সুন্দর কথা বলেন,.. নাকি এগুলো সব প্রমোশনাল গিমিক?
-না মিঃ বসু,....... গড়শালবনী আমি গেছি (দৃঢ় কন্ঠে)। ইন্টারেস্টিংলি জায়গাটার একটা রোমাঞ্চকর ইতিহাস আছে। আজও সেই ইতিহাসের চিহ্ন বহন করে চলেছে সেখানকার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, একটা সাল, টিক, মহুয়া, হিজলীর জঙ্গল, একটা পুরনো দূর্গা মন্দির এবং ডুলুং নদীর পাড়।
-আচ্ছা !!!!! কিরকম ?? (গল্পের গন্ধে বিছানার ওপর নড়ে চড়ে বসে নীলাভ)
-গড়শালবনী মূলত জঙ্গলে ঘেরা একটা জায়গা। সাল, টিক, মহুয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক গুনাবলী সম্পন্ন গাছগাছালির মেলা সেখানে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি মল্ল রাজাদের নন্দন কানন ছিল এই গড়শালবনী। আদিমল্লর সুযোগ্য পুত্র জয়মল্ল তখন এক প্রতাপশালী রাজা। সেখানকার এক অনামী গ্রামের কোনো এক সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় পরশি রাজ্যের সুদর্শনা রাজকুমারী নীহারিকার সাথে। যশ ও খ্যাতির গুনে খুব সহজেই নীহারিকার মনে গভীর রেখাপাত করে সুঠামদেহী যুবক জয়মল্ল। প্রেমের আঁচে জ্বলতে সময় লাগেনি রাজবংশীয় ক্ষত্রিয়দের। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দুই হৃদয়ের সুর একই যন্ত্রে বাঁধা পড়ে যায়। আদিমল্লর সাথে পুরনো কলহের জেরে নীহারিকার বাবা রাজা বীরভদ্র এই সম্পর্ক অস্বীকার করেন। বিষন্নতার অতলে ডুবে যান নীহারিকা। মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে জয়্মল্লর। নীহারিকা জয়ের জেদ চেপে যায় সহস্রগুন। পরশি রাজ্য আক্রমনের ছক তৈরী করে ফেলেন তড়িঘড়ি। যুদ্ধের আগে জয়্মল্লকে গোপনে ডেকে পাঠান নীহারিকা, কোনো এক গোধুলির বিকেলে, এই গড়শালবনীর জঙ্গলে, ডুলুং নদীর পাড় ঘেঁষা কনকদুর্গা মন্দিরে। জয়্মল্লকে যুদ্ধ থেকে নিরস্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন নীহারিকা, রাজবংশ ও নিরীহ প্রজাদের প্রাণ ভিক্ষা করেছিলেন সেদিন। কিন্তু জয়্মল্ল শোনেননি, নিজের জেদ এবং সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। উপায়ন্তর না দেখে ওড়নার আড়াল থেকে হাতির দাঁতের ভোজালি বের করে আমূল বসিয়ে দিয়েছিলেন জয়মল্লর বুকে। নিজেও বিষ খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন জয়মল্লর পায়ে। অব্যক্ত হাহাকারে ভরে ওঠেছিল সেদিন কনকদুর্গা মন্দিরের প্রস্তর ভূমি, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গড়শালবনীর জঙ্গল।.............. আজও ডুলুং নদীর পাড়ে কান পাতলে ইতিহাসের ফিসফিসানি শোনা যায়। শোনা যায় নীহারিকা জয়মল্লর প্রানোচ্ছল প্রেমের গল্প। .......................বলুন মিঃ বসু আপনি কি যেতে চান সেখানে? আপনি কি শুনতে চান সেই মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, আপনি কি দেখতে চান জয়মল্লর অশ্বখুরের চিহ্ন ?
বিহ্বলতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারে না নীলাভ। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, 'এমন নিখুঁত বর্ণনা, এরকম জীবন্ত ইতিহাসের গল্প !.......আপনি জানলেন কি করে? কে আপনি' !!!?
-আমি একজন সামান্য ইতিহাসের ছাত্রী মিঃ বসু, ইতিহাস নিয়ে গবেষনা করব বলে ভেবেছিলাম। কপাল ফেরে ট্যুর কোম্পানিতে চাকরি করছি। তবে হ্যাঁ, ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমন বরাবরই আমার প্রিয় বিষয়ের মধ্যে একটা। তাই বিভিন্ন জায়গার ইনফরমেশন রাখি। নতুন কিছু জানতে পারি আবার কর্মসূত্রে কাজেও লাগে .......
-আমার একটা শর্ত আছে পত্রালিকা.......
-শর্ত !!!!!! .
-হ্যাঁ, গড়শালবনী আমি যেতে পারি। কিন্তু গাইড হিসেবে সঙ্গে যেতে হবে আপনাকে, এমন আরো গল্প শোনার সুযোগটা যে আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারব না।
কয়েক মুহুর্তের নিস্তব্ধতা...........
-আমার সাথে যে আপনি যেতে চাইবেন না মিঃ বসু।
-কেন, কি সমস্যা ?
-আপনার যদি কাল সময় হয়, তাহলে টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে আসুন। বিকেল ৫টা। বাকিটা সচক্ষে দেখে নেবেন।
![]() |
| ছবি : নিজস্ব |
ঘড়ির কাঁটায় চারটে পঞ্চাশ। এখনো দশ মিনিট সময় আছে হাতে। প্রত্যেকটা মিনিট এক একটা দীর্ঘ বছরের মত লাগছে নীলাভর। কাল রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। সারারাতই প্রায় পত্রালিকার কথা চিন্তা করেছে। কেমন যেন একটা জাদু আছে মেয়েটার কথায়। কেমন রহস্যের মোড়কে, কি সাবলীল ভঙ্গিতে একটা ইতিহাসের পটচিত্রর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কাল। একে চোখে না দেখা অবধি শান্তি নেই........
পাঁচটা পাঁচ। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ........কি ব্যাপার? তাহলে কি ভুলে গেল ! নাকি মেট্রোর সামনে দাঁড় করিয়ে একটা বড় রকমের রসিকতা করলো কেউ ? তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোনোটা বোধহয় ভুল হয়ে গেল। কিন্তু দুপুরে তো ফোন করে কনফার্ম করে নিয়েছিল সে। অধৈর্য হয়ে পড়ে নীলাভ। সহসা দু হাত দুরে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সালোয়ার কামিজ পরিহিত বছর পচিশের একটি তরুণী। লম্বা বিনুনি, বগলে ক্রাচ, এদিক ওদিক তাকায় মেয়েটি, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলে যায় সামনের দিকে। নাহ ! মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায় নীলাভ। আর পাঁচ মিনিট ওয়েট করবে সে, তারপর বেরিয়ে যাবে ..........
-আপনি কি মিঃ নীলাভ বসু?
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নীলাভ,......সেই মেয়েটি......কোনরকমে একহাতে ক্রাচ সামলিয়ে অন্যহাতে কপালের অবিন্যস্ত চুল ঠিক করছে।
- হ্যা আমিই নীলাভ। আপনিই........ ?
-পত্রালিকা.........................
এক মিনিট থমকায় নীলাভ, ভালো করে চেয়ে দেখে নরম বিকেলের গোধুলির আলো পড়েছে পত্রালিকার মুখে। এক মায়াবী অবয়বে নীহারিকার আর্তি খুঁজে পায় পত্রালিকার কাজলটানা চোখে। সেই চোখ একরাশ প্রশ্ন আর অনাবিল সারল্য নিয়ে তাকিয়ে থাকে নীলাভর দিকে।
- আমি বলেছিলাম না, আপনি যেতে চাইবেন না আমার সাথে। .......
পত্রালিকা নয়, এ যেন নীহারিকার করুণ মর্মস্পশী আকুতি, কোনো এক অতলান্ত খাদ থেকে উঠে এসে ধোঁয়ার মত পাক খেতে খেতে আকাশে বিলীন হয়ে যায়।
-না, (দৃঢ় কন্ঠে বলে নীলাভ)....... আপনি ভুল বলেছিলেন, আমাকে আর নিজেকেও...............(একটু হেসে) চলুন কোথাও বসে একটু চা খাই, অনেক গল্প শোনার আছে, অনেএএএক.............. সাবধানে আসুন .......
দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ইতিহাসের কলরব জীবন্ত হতে থাকে বর্তমানের কথোপকথনে.................
(ক্রমশ)
#bengalishortstories #drama #lovestories #romance #thriller #adventurestories #suspense
#bengalishortstories #drama #lovestories #romance #thriller #adventurestories #suspense

No comments:
Post a Comment