Thursday, December 22, 2016

সাপ্তাহিকী ২২ # শখের জিনিস - অন্তিম পর্ব

চৈতালীর তির্যক মন্তব্যের উত্তর না দিয়ে দেবাঞ্জন চলে যান শোবার ঘরে। মনের মধ্যে একরাশ দ্বন্দ্ব সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করতে থাকে। 'ভবিষ্যৎ' কথাটা কাঁটার মতো বিঁধে থাকে কোনো এক গহীন স্থানে ।

পরদিন সকালে অভ্যাসমতো অফিস বেরোলেন দেবাঞ্জন। চোখে সানগ্লাস। নতুন চশমাটা ব্যাগে নিয়ে নিয়েছেন। নানারকম চিন্তায় অন্যমনস্ক ভাবে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যান। পথচলতি দু চারজন চেনা মানুষের 'কেমন আছেন' , 'গুড মর্নিং' , ইত্যাদি কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করেন না। অফিসে পৌঁছে নিজের কিউবিক্যলে গুছিয়ে বসেন। সামান্য ইতস্তত করে নতুন চশমাটা বাক্স থেকে বের করে পড়ে নেন। বাকি কলিগদের নজর এড়ায় না সেটা। দেবাঞ্জনের নতুন অবয়বে হৈ  হৈ করে ওঠে গোটা অফিস। সবাই মিলে ঘিরে ধরে তাঁকে। 'দারুন লাগছে', 'চোখ আছে বটে' , 'কোথা থেকে কিনলে', 'কত দাম নিল',  ইত্যাদি সমস্ত কথাবার্তায় দেবাঞ্জনের মনের গুরুভার লাঘব হয় কিছুটা। দেবাঞ্জনও যতটা সম্ভব ছোট করে বর্ণনা করেন কেমন করে এই বিরল জিনিসটি তাঁর হাতে এসে পড়লো। স্বাভাবিকভাবেই গতরাতের ঘটনাও কিছুটা ফিকে হয়ে আসে আপনিই । অসোয়াস্তির কালো মেঘ কেটে যেতে থাকে একটু একটু করে। দেবাঞ্জন মনে মনে মেনে নেন ওটা হয়তো দেখারই ভুল ছিল। সমস্ত কিছুই নিজস্ব নিয়মে ফিরে আসছিলো একটু একটু করে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় দেবাঞ্জনকে নিয়ে অন্য কোনো পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলে তাঁর স্বস্তির কাল খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সারাদিনের রুটিনমাফিক সমস্ত কাজই করলেন দেবাঞ্জন। সামনে জেনারেল মিটিং আসছে, মার্কেটিংয়ের প্রেজেন্টেশন তৈরির কাজটা প্রায় হয়ে এসেছে। আর দু একটা ডেটাশিট পেয়ে গেলেই শেষ করে ফেলবেন। সেটা নাহয় কালই দেখা যাবে এই ভেবে ডেস্কটপের শাট ডাউন বাটন টা ক্লিক করলেন। স্ক্রিনের আলো ক্রমশ আবছা হতে হতে মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো।

অকস্মাৎ, এক মায়াবী আলোর ঝলকানিতে সামনের স্ক্রিনটা ফের সচল হয়ে উঠলো। দেবাঞ্জন আঁতকে উঠলেন। ভালো করে দেখতে লাগলেন স্ক্রীনটাকে। স্ক্রিনের ওপর ফুটে উঠেছে আগুনের লেলিহান শিখা। সে শিখার সর্বগ্রাসী জিহ্বা স্ক্রিনের চারিদিকে এঁকে বেঁকে ঘুরতে লাগলো ভয়ঙ্কর লালসায়। ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন দেবাঞ্জন। স্পষ্ট দেখতে পেলেন একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে আগুন জ্বলছে। ভারী চেনা লাগলো বিল্ডিংটাকে, কিন্তু মনে করতে পারলেন না কোথায় দেখেছেন। এ দিক ওদিক তাকিয়ে বাকি কলিগদের লক্ষ্য করলেন দেবাঞ্জন। বুঝতে পারলেন ওর স্ক্রিনের দিকে কেউই নজর করছে না তেমন। অজান্তেই গলা শুকিয়ে এলো। চশমাটা সামান্য নাকের নিচে নামিয়ে খালি চোখে দেখার চেষ্টা করলেন স্ক্রিনটা। অবিশ্বাস্য ! স্ক্রিনটা ঘন কালো, নিরীহ বোকা বাক্সের মতো তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, আগুনের ছিঁটেফোঁটা নেই কোনো জায়গাতে। চশমাটা উঠিয়ে নিতেই আবার আগুনের তুর্কি নাচন প্রত্যক্ষ করলেন। তাড়াতাড়ি করে ডেস্কের ওপর থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই ছুটে চলে গেলেন লিফটের দিকে। অফিস থেকে বেরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়লেন মেট্রো স্টেশনের দিকে। মেট্রোতে উঠে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন সমানে। ডিসেম্বরের হিমেল সন্ধ্যাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখাচিত্র ফুটে উঠলো।

বাড়ি ফিরে চৈতালীর সাথে বেশি কথা বললেন না।  চৈতালী ভারী অবাক হলেন। সচরাচর এমনটা হয় না, ডিনার টেবিলে সারাদিনের আলোচনা চলে সুখী দম্পতির মধ্যে। আজ সেখানে দেবাঞ্জন একটাও কথা বললেন না, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। কোনোমতে দুটো রুটি নাকেমুখে গুঁজে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে এলেন। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি যেন রাতের নিস্তব্ধতায় বেশি করে শুনতে পেলেন নিজে। বারে বারে স্ক্রিনের ছবিটা ফুটে উঠছিলো চোখের সামনে। এরকমটা কেন দেখলেন আবার ? তাহলে কি গতরাত্রে আয়নায় যা দেখেছিলেন সেটাও সত্যি ? তবে কি কোথাও আগুন লাগবে আজ ? বিল্ডিংটা যে ভারী চেনা চেনা ঠেকছে, কোথায় যেন দেখেছেন.........কোথায় যেন...........ভাবতে ভাবতেই ড্রয়িং রুমে ফোন বেজে উঠলো তারস্বরে। চমকে উঠলেন দেবাঞ্জন। কান পেতে শুনলেন চৈতালী ফোনটা ধরেছে। কিছুক্ষন কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রেখে দৌড়োতে দৌড়োতে চৈতালী বারান্দায় এসে বললেন, 'এই শোনো, বিভাস ফোন করেছিল, বলল তোমাদের অফিসে নাকি আগুন লেগেছে, দুটো ফ্লোর পুড়ে ছাই একেবারে, তোমায় ফোন করতে বলল তাড়াতাড়ি'।

ফস করে সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে গেলো দেবাঞ্জনের। এক ঝটকায় মনে পড়ে  গেলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে যে বিল্ডিংটা দেখেছিলেন সেটা তাঁর অফিসেরই উত্তর দিক, ওদিকটা খুব একটা যাওয়া হয় না বলেই স্পষ্ট মনে পড়ছিলো না। নিমেষে দেবাঞ্জনের মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেলো ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন বারান্দার ধাপিতে।

চৈতালী চেঁচিয়ে উঠলেন, 'কি হলো' ?
 "ভবিষ্যৎ !.......ভবিষ্যৎ" !, ভয়ার্ত গলায় ঘড়ঘড় করতে লাগলেন দেবাঞ্জন।
'কিসের ভবিষ্যৎ ? কি বলছ কি ?'  চৈতালী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা হাত তুলে তর্জনী দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। চৈতালী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেবাঞ্জনের নতুন চশমাটা রাখা আছে উপুড় করে। টেবিলের ওপর থেকে পড়া সাদা আলোতে যেন তার ঔজ্বল্য বেড়ে গিয়েছে আরও কয়েকগুন । সে চশমাটা যেন উপুড় হয়েই তাকিয়ে রয়েছে তাদের দুজনের দিকে। চশমার লেন্স দিয়ে যেন নিক্ষেপিত হচ্ছে কোনো এক পৈশাচিক হাহাকারের জ্বলন্ত দৃষ্টি।

সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সমস্ত ঘটনা শুনে, চৈতালী কাকতলীয় বলে উড়িয়ে দিলেও নিজেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না পুরোপুরি। একটা সূক্ষ্ম ধন্দ রয়ে গেলো তাঁর মনেও। ইতিমধ্যে দেবাঞ্জনের অফিসে অস্থায়ী কর্মবিরতি ঘোষণা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মচারীদের অনুরোধ করা হয়েছে যে আগামী নোটিস না পাওয়া অবধি কেউ যেন অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন। 

পরের দিন দেবাঞ্জন ঠিক করে নিলেন যেমন করেই হোক একবার বৌবাজারের সেই দোকানে যোগাযোগ করতে হবে। আসল সত্যটা কি, সেটা খুঁজে বার না করা অবধি তিনি শান্তি পাবেন না। টেবিল, আলমারি তন্নতন্ন করে ফেললেন দেবাঞ্জন কিন্তু কোথাও চশমার রিসিটটা খুঁজে পেলেন না। বৃদ্ধ দোকানির ফোন নম্বরটা যে ওতেই লেখা ছিল। চৈতালী বারে বারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন যে এই সমস্ত ঘটনায় অলৌকিক কিছু খুঁজে বেড়ানো সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু দেবাঞ্জন তাঁর কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না। ভবিষ্যতের বিভীষিকা দেবাঞ্জনকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ফেলতে লাগলো। এক অজানা নেশায় মত্ত হয়ে উঠলেন যেন। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, 'আজ সকালেও আমি চশমাটা পড়েছিলাম। কি দেখলাম জানো ? সেই বৃদ্ধ দোকানদার যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওহ ! কি ভয়ঙ্কর প্রলয় সে চাহনিতে ! স্পষ্ট দেখতে পেলাম সে যেন আমার দিকে হাত নেড়ে নেড়ে কি একটা বলছে, কিন্তু আমি একবর্ণ বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু সে উত্তরে এক কুটিল হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো চোখের সামনে থেকে'।   

- এ সমস্তটাই তোমার অতি কল্পনা দেবাঞ্জন। তুমি উচ্চশিক্ষিত, বাস্তববাদী, এসব খেয়ালী বিভ্রম তোমাকে মানায় না। 
- তুমি বুঝবে না চৈতালী, চশমাটা পড়া অবধি আমি ভিতরে ভিতরে বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পাচ্ছি । সে অনুভূতির কেমন যেন এক অন্ধকার, অমোঘ আকর্ষণ। সে আকর্ষণ অবজ্ঞা করার ক্ষমতা নেই আমার। কতকটা............ কতকটা যেন নিশির পিছনে ধাওয়া করার মতো। 
 - এ কি বলছ তুমি দেবাঞ্জন ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? কোথাকার কি একটা চশমা, কি দেখতে কি দেখেছ, তাই দিয়ে নিজের মাথা খারাপ করছ খামোকা ?
- ভুল আমি কিছু দেখিনি চৈতালী........ কোনোরকম ভুল আমার হয় নি, আমি শুধু জানি এ চশমা কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে, একটা ভয়ঙ্কর কিছুর ! আ.....আমায় সেই দোকানে যেতেই হবে......... যে করেই হোক। 

চৈতালী নির্বাক নিস্তব্ধ বসে রইলেন। দেবাঞ্জনকে ক্ষান্ত করতে পারলেন না একবিন্দু। সমস্ত রকম চেষ্টা বিফলে গেলো তাঁর। দেবাঞ্জন বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে গেলেন বৌবাজারের উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োতে একটা ভুল করে বসলেন। চশমাটা ভুলে রেখে গেলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর। কিছুক্ষণ পর চৈতালীর সে দিকে নজরে পড়তেই ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চশমাটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একটা নীলচে আভা আছে যেন। তবে অসাধারণ কিছু নয়। দেখতে দেখতেই এক অদ্ভুত টান অনুভব করলেন চশমাটা পড়ে দেখার। নিয়তির অমোঘ আকর্ষণের বেড়াজালে জড়িয়ে গেলেন ক্ষনিকের বেখেয়ালে। আলতো হাতে চশমাটা তুলে ধীরে ধীরে চোখের ওপর বসালেন। আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখলেন নিজেকে। ছেলেদের চশমা হলেও মন্দ লাগছে না তাকে। তাছাড়া, কি আছে চশমাটাতে ? দেবাঞ্জন অযথাই পাগলামো করছে। একটা নিরীহ গোবেচারা চশমা, তাই নিয়ে একেবারে আকাশকুসুম কল্পনা করছে দেবাঞ্জন। মনে মনেই হাসতে থাকলেন চৈতালী। 'ভবিষ্যৎ' !! ওহ পারেও বটে লোকটা, বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ছাড়া আর কিস্যু নয়। মনে মনে ভাবলেন, একবার বাড়ি ফিরুক, আচ্ছা করে পেছনে লাগবেন দেবাঞ্জনের।

মনের দ্বন্দ্ব সরে যেতেই চশমাটা খুলতে গেলেন চৈতালী। হঠাৎ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো খানিক। পরক্ষণেই সামনেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে চশমার মধ্যে দিয়ে যা দেখলেন তাতে তৎক্ষণাৎ ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেলো তাঁর। পলক পড়লো না চোখে। শ্বাসরুদ্ধ করে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নিস্পৃহ ভাবটা কেটে যেতেই চশমাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেলেন মোবাইলটা আনতে। দেবাঞ্জনকে ফোন করতে হবে...... এক্ষুনি।    

অটো চেঞ্জ করে মেট্রো ধরে নিলেন দেবাঞ্জন। পুঞ্জীভূত মেঘের মতো দমবন্ধ কৌতূহল ঘন জমাট বাঁধতে লাগলো বুকের মধ্যে। সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমেই ডান দিকের ফুটপাথ ধরে হনহন করে হাঁটা লাগালেন। মিনিট তিনেকের পথ। প্রবল আশঙ্কায় হৃদস্পন্দন দ্বিগুন হলো। সামনের সিগন্যাল পেরিয়ে ডানদিকে ঘোরার জন্য রাস্তায় নামলেন। এমন সময় পকেটের ভেতর ঝনঝন করে বেজে উঠলো মোবাইল ফোনটা। দেবাঞ্জন ফোনটা তুললেন না। এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ফোন আসাতে কপালে একরাশ  বিরক্তির ভাঁজ দেখা দিল। ফোনটা কেটে গেলো আপনাআপনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার কম্পন অনুভব করলেন পকেটের মধ্যে। চোখ মুখ কুঁচকে হাত গলিয়ে পকেট থেকে বের করলেন দূরভাষ যন্ত্রটি। চৈতালী ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে রিসিভ করে বললেন, 'হ্যাঁ বলো' । খেয়াল করলেন না ওদিকে সিগনালের রংও সবুজ হয়ে গেছে কখন। চকিতের অন্যমনস্কতায় কথা বলতে বলতে রাস্তা পেরোতে গেলেন দেবাঞ্জন। ঠিক সেই সময়েই বাঁ দিক থেকে সাক্ষাৎ দানবের মতো একটা কালো সিডান এসে সজোরে ধাক্কা মারলো তাঁর কোমরে। তীব্র চিৎকার করে প্রায় কুড়ি গজ দূরে ছিটকে পড়লেন দেবাঞ্জন। মোবাইলটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো রাস্তার চারপাশে। মুহূর্তের মধ্যে রক্তের স্রোত নেমে এলো দেবাঞ্জনের গাল আর চিবুক বেয়ে। সর্পিল গতিতে এঁকে বেঁকে রক্তাভ করে তুললো কালো পিচের পথ । হৈ হৈ করে ভিড় জমে গেলো আশেপাশে। চৈতালীর শেষ ফোনটা তুলতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সাবধান বাণী আটকে পড়ে রইল অপ্রত্যাশিত দুর্ভাগা মুহূর্তদের মধ্যে। অবশ দেহে ডান হাতের কম্পমান রক্তাত আঙ্গুল তুলে ফোনের একটা টুকরো ছুঁতে চাইলেন কোনোরকমে................পারলেন না। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন ভিড় ঠেলে সেই বৃদ্ধ দোকানি এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। ভুরু তুলে এক রহস্যময় চোখে বিড়বিড় করে বললেন, 'চশমা বড়িয়া থি না বাবুজি ? একদম হটকে' ? 
দেবাঞ্জনের চোখের পাতায় ঘন অন্ধকার নেমে এলো ক্রমে ।

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব


#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki


Saturday, December 17, 2016

সাপ্তাহিকী ২১ # শখের জিনিস - প্রথম পর্ব

সকালের কাগজটা নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালেন দেবাঞ্জন। সামান্য ঝাপসা লাগছে যেন। তবে কি পাওয়ার বাড়লো ? তা কি করে হয় ? এই তো কমাস আগেই দোকানে গিয়ে পাওয়ার চেক করালেন। ঠিকই তো ছিল। তবে ? তাহলে বোধহয় চোখে কিছু পড়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে ভালো করে চোখে মুখে জল দিয়ে এলেন, কিন্তু না, ঝাপসা ভাবটা কিছুতেই যেন কাটছে না। ভারী বিপদ হলো। সত্যিই যদি পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো সবকটা চশমার লেন্স চেঞ্জ করতে হবে। সে তো বিরাট ঝক্কির কাজ। নয় নয় করে কম চশমা নেই দেবাঞ্জনের। খান পনেরো বিশেক তো হবেই। দেবাঞ্জনের চশমার ফ্রেমের ভারী শখ। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে নিত্য নতুন চশমার ফ্রেম কিনতে ভারী পছন্দ করেন তিনি। পাড়ার দোকানগুলো তো বটেই বৌবাজারের প্রায় সবকটা দোকানই দেবাঞ্জনকে বিলক্ষণ চেনে। নতুন কোনো ডিজাইন এলেই একাধিক দোকান থেকে ফোন আসে দেবাঞ্জনের কাছে। চশমার খাঁটি সমঝদার হিসেবে পরিচিত মহলেও বেশ সুনাম আছে তাঁর। সুতরাং এহেন দেবাঞ্জনের যদি চোখের পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তবে সমূহ সমস্যা তো বটেই । সাতপাঁচ ভেবে দেবাঞ্জন ঠিক করলেন অফিস ফেরত একবার ইন্ডিয়ান অপ্টিকালসটা ঘুরে আসবেন। লালবাজার আর বৌবাজারের সংযোগস্থলে বহু বছরের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এখানেই দেবাঞ্জন চোখ দেখিয়ে থাকেন বরাবর। আজ একটু কায়দা করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে...........

শীতকাল বলে সন্ধে হয়ে গেছে অনেক্ষণ। চোখ দেখানো হয়ে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন দেবাঞ্জন। পাওয়ার বাড়েনি, ডাক্তার বলেছেন বয়সকালে অমন হয় একটু আধটু। মাঝে মাঝে দৃষ্টি ঝাপসা লাগে। তেমন চিন্তার কিছু নেই। একটা আই ড্রপ লিখে দিয়েছেন শুধু। কয়েকদিন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ফুরফুরে হিমেল হাওয়ায় শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে দেবাঞ্জনের। হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের দিকে এগোতে থাকেন তিনি। সহসা একটা সরু গলির মধ্যে দূরে একটা ভাঙাচোরা দোকানের দিকে চোখ পড়ে যায়। টিমটিম করে একটা হলদেটে বাল্ব জ্বলছে সামনেটায়। একজন বৃদ্ধ একমনে একটা লেন্স পরিষ্কার করছেন একটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয়। দেবাঞ্জন ভেবে মনে করতে পারেন না এই দোকানটা আগে দেখেছিলেন কিনা। আশপাশের দুচারটে দোকান বন্ধ থাকাতে বেশি করে যেন নজর পড়ে এই দোকানটার দিকে। হতে পারে বাকি দোকানের ভিড়ে এই দোকানটা বেমানান বলে ততটা দৃশ্যমান ছিল না। কৌতূহলবশে পায়ে পায়ে এগিয়ে যান দেবাঞ্জন। দোকানের আশপাশটা বেশ সংকীর্ণ, অন্ধকার। বাল্বের আলোর ছটায় দোকানের সামনেটাই যা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চারপাশের জীর্ণ দেওয়ালগুলোয় মান্ধাতা আমলের ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যায় এই গলিটায় খুব একটা জনসমাগম হয় না। দেবাঞ্জনের পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকান বৃদ্ধ। খনখনে গলায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলেন, 'সেলাম বাবুজি, কুছ চাহিয়ে' ?। দেবাঞ্জন লক্ষ্য করেন বৃদ্ধের পরনে সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি পাজামা, মাথায় সাদা মুসলমানি টুপি। কাঁচাপাকা দাড়ির আড়ালে মুখে সরল মৃদু হাসির আভাস। দেবাঞ্জন বলে ওঠেন, ' না না, কিছু চাই না, আসলে এই গলিটায় তো ঢুকিনি কখনো, আপনার দোকানের আলো জ্বলছে দেখে এগিয়ে এলাম'।

'তো কেয়া হুয়া বাবুজি, আপ তসরিফ রাখিয়ে, আপকো আভি বড়িয়া ফ্রেম দিখাতে হেঁ,' বলেই বৃদ্ধ প্লাস্টিকের টুলটা এগিয়ে দেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন চলে আসতে চান, কিন্তু অশীতিপরের প্রতি অসম্মান করা হবে ভেবে বসে যান খানিক। মনে মনে ভাবেন, 'ঠিক আছে, দু একটা ফ্রেম দেখেই উঠে পড়বেন নাহয়, তাছাড়া দোকান দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওঁর মনের মতো জিনিস এখানে পাওয়া সম্ভব নয়'। বৃদ্ধ কাঁচের আলমারি থেকে একের পর এক ফ্রেম বের করে রাখতে থাকেন টেবিলের ওপর। অধিকাংশ ডিজাইনই হয় পুরোনো আমলের নয় সাধারণ মানের। দেবাঞ্জনের মতো শৌখিন মানুষের উপযুক্ত নয় সেসব। দু একটা ফ্রেম নেড়েচেড়ে উঠে পড়েন তিনি। কোনোটাই পাতে দেবার মতো নয়। বলেন, 'আজ নাহয় থাক, আমি আরেকদিন আসব'। বৃদ্ধ হাঁ হাঁ করে ওঠেন, 'সে কি বাবুজি, ঔর একদিন কিঁউ, হাম আভি আপকো...........' কথাটা শেষ করতে দেন না দেবাঞ্জন, বিরক্ত হয়ে বলেন, 'না না থাক, আমি অন্যদিন আসবখন'। বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বলেন, 'আচ্ছা আচ্ছা রুকিয়ে, মুঝে পাতা হ্যায় আপকো ক্যায়সা ফ্রেম পসন্দ আয়েগা, এক মিনিট'..........বলেই পিছন ফিরে আলমারির তলা থেকে বের করে আনেন একটা সোনালী রঙের কাজ করা চৌকো মতো বাহারি কাঠের বাক্স। কাঠের বাক্সটা দেখে কিঞ্চিত থমকান দেবাঞ্জন। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বাক্স খুলে মখমলি কাপড়ের মধ্যে থেকে বের করে আনেন একটা ঈষৎ নীলচে রঙের মোটা ফ্রেমের চশমা। সে চশমার কোনো অসামান্য কারুকাজ নেই বটে তবে তার জৌলুস ও চেকনাই যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সে দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে যান দেবাঞ্জন। বহু ডিজাইনার চশমা পড়েছেন এ যাবৎ কিন্তু এমন জিনিস কখনই তাঁর নজরে আসেনি। হলদেটে বাল্বের আলোয় সে চশমার দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোতে থাকে।

'প্যহনিয়ে বাবুজি, একবার প্যহনকে কে তো দেখিয়ে', মিটিমিটি হাসতে থাকেন বৃদ্ধ। চশমাটা পড়ে নিয়ে আয়নায় চোখ রাখেন দেবাঞ্জন, বাহান্ন বছরের মুখটা যেন ঝকঝক করছে, বয়সের বলিরেখা ছাপিয়ে এক আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে যেন। বেশ বুঝতে পারেন এ জিনিস দিশি নয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কোথায় পেলেন এইটা' ? বৃদ্ধ এক মোহময় হাসি ছড়িয়ে বলেন, 'বাহারকা চিজ হ্যায় বাবুজি, সিঙ্গাপুর সে আয়া হ্যায়, সোচেথে কোই আচ্ছা সমঝদার আয়েগা তো নিকালেঙ্গে ইসে। আপহিকো দিখরহেঁ পেহলিবার'। দেবাঞ্জন চশমাটা খুলে তেরছা চোখে বলেন, 'লেন্সের পাওয়ার বললে কত তাড়াতাড়ি বানিয়ে দিতে পারবেন' ? বৃদ্ধ সামান্য চোখ কুঁচকে বলেন, 'করিব একঘন্টে মে রেডি হো জায়গা সাহাব'।

- আর দাম কত নেবেন ? ঠিক করে বলবেন কিন্তু, নাহলে........
- ঢাইহাজার কা এক পয়সা কম নেহি হোগা বাবুজি.......আপ সে কেয়া ঝুট বোলনা, আপ পেহলইবার মেরে দুকান আয়েহেঁ.....

সামান্য একটু চিন্তা করেন দেবাঞ্জন, তারপর পকেট থেকে সদ্য পাওয়া প্রেসক্রিপশনের কাগজটা বের করে বলেন, 'ঠিক আছে, যত তাড়াতাড়ি পারেন বানিয়ে দিন, আমি ওয়েট করছি'............   

নতুন চশমা পাওয়ার আনন্দে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢোকেন দেবাঞ্জন। চৈতালী জিজ্ঞেস করেন, 'কি ব্যাপার এতো দেরি করলে আজ' ?
- আর বোলো না বৌবাজার গিয়েছিলাম চোখ দেখাতে, ফেরার পথে একটা ভালো ফ্রেম পেলাম বুঝলে, কিনে নিলাম। বানাতেই যা একটু সময় লাগলো। 
- ওফফ, আবার চশমা, তোমাকে যে কি এক অদ্ভুত শখে পেয়ে বসেছে ভগবান জানেন। 

চৈতালীর কটাক্ষে খুব একটা পাত্তা দিলেন না দেবাঞ্জন। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ডিনার সেরে নিলেন। চশমাটা আরেকবার চোখে না পড়া অবধি শান্তি নেই। ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঠের বাক্স খুলে বের করে আনেন চশমাটা। টিউব লাইটের আলোয় ফ্রেমটা চকচক করে ওঠে। দেবাঞ্জনের মুখাবয়ব জুড়ে চরম তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে পড়ে। পুরোনো চশমাটা খুলে রেখে নতুন ফ্রেম গলিয়ে নেন দু কানের পাশে । প্রথমটায় সামান্য একটু ঝাপসা লাগে। আলতো হাতে ফ্রেমটা আরেকবার সেট করেন নাকের ওপর। এইবার পরিষ্কার লাগে চারিদিক। বেশ দেখাচ্ছে। তারিয়ে তারিয়ে দেখতে থাকেন নিজেকে আর মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেন বিরল অর্জনের উল্লাসে।
  
কিন্তু এ কি !! এটা কি দেখছেন ! কপালের ওপর একটা কাটা দাগ আর সামান্য ফোলা লাগছে যেন।
কি আশ্চর্য ! এটা তো খেয়াল করেননি আগে। কখন চোট লাগলো আর কোথায়ই বা লাগলো ? দেবাঞ্জন চিন্তা করতে লাগলেন। কিন্তু কপালের চোটটা কিছুতেই মনে করে উঠতে পারলেন না। দোকানে কি আয়না দেখেছিলেন ? হ্যাঁ, কিন্তু তখন তো ছিল না। তাহলে কি মেট্রোতে কোনোভাবে ধাক্কা টাক্কা ..................নাহ, মনে পড়ছে না বিন্দুমাত্র। ছটফট করতে থাকেন দেবাঞ্জন। আনন্দের এমন সন্ধিক্ষণে সামান্য চোটের চিন্তায় বিব্রত হয়ে পড়েন বেশ। হাত বাড়িয়ে কাটা জায়গাটায় ছুঁয়ে দেখলেন একবার। অদ্ভুত ! কোনো ব্যাথা তো নেই ! চশমাটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে রেখে আবার আয়নার দিকে তাকালেন। একি ! একি দেখছেন তিনি ? বার কতক ভালো করে মুখটা দেখলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কপালের কাটা দাগটা বেমালুম উধাও। আশ্চর্য ! এই তো ছিল ! তাহলে কি ভুল দেখছিলেন এতক্ষণ ? তাড়াতাড়ি চশমাটা গলিয়ে নিয়ে আবার আয়নায় চোখ রাখলেন।  এই তো ! এই তো দেখা যাচ্ছে কাটা দাগটা ! কি ব্যাপার হলো ? চশমা পড়ে দাগটা দেখা যাচ্ছে দিব্যি অথচ চশমা খুলতেই দাগটা উধাও ! চশমাটা খুলে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন দেবাঞ্জন, সন্দেহ করার মতো কিছু পেলেন না খুঁজে। টেবিলের ওপর চশমাটা রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন । এ কি হচ্ছে ? এমনটাতো হয়নি আগে, তবে কি বয়েসের ভারে চোখেও ভুল দেখতে শুরু করলেন এবার ? মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন তোলপাড় করতে লাগলো। ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে এগোলেন কপাল কুঁচকে। চৈতালী রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হলো ফ্রেমটা দেখালে না আমায়' ? ব্যাজার মুখ করে দেবাঞ্জন বললেন, 'আসছি, ব্রাশটা করে আসি'। 

এইবার এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। বাথরুম থেকে বেরোবার সময়, ক্ষনিকের বেখেয়ালে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে দড়াম করে সামনে পরে গেলেন দেবাঞ্জন। মাথাটা জোর ঠুকে গেলো বাঁদিকের বেসিনটাতে। 'কি হলো কি হলো' বলে চিৎকার করে ছুটে এলেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কপাল ধরে মুখ কুঁচকে বসে রইলেন মেঝের ওপর। চরম যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছে সারা শরীর জুড়ে। কোনোরকমে ধরাধরি করে দেবাঞ্জনকে ওঠালেন। বললেন, 'একটু দেখে বেরোবে তো, ইশশশশ..... দেখো তো কপালটা কেমন কেটে গেলো বিচ্ছিরিরকম, তুমি সোফায় গিয়ে বস, আমি আয়োডিন নিয়ে আসছি',। 

আয়োডিন লাগিয়ে ধীরে ধীরে সোফা থেকে উঠলেন দেবাঞ্জন। বিছানায় যাবার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন একবার। ভালো করে দেখতে লাগলেন কতটা কেটেছে। যা দেখলেন তাতে দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। দুহাত আয়নার ওপর ভর দিয়ে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন কপালটা। কিছুক্ষন আগে আয়নায় দেখা কপালের অবিকল একই জায়গায় চোটটা লেগেছে, ঠিক ততটাই কেটেছে এবং ততটাই ফুলে উঠেছে। বেশ কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চুপ। ভুল দেখছেন নাকি ? এ কি করে সম্ভব ! চিৎকার করে ডাকলেন চৈতালীকে। চৈতালী ছুটে এলেন হুড়মুড়িয়ে।

'কি ব্যাপার ? আবার কিছু হলো নাকি' ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'আচ্ছা, মনে করে দেখো তো, বাড়ি ঢোকার পর আমার কপালে কি কোনো কাটা দাগ বা চোট দেখতে পেয়েছিলে' ?.......... 'চোট ? কই না তো.......... কেন' ? চৈতালী অবাক হন। 'না, মানে আমি নতুন চশমাটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম জানো, স্পষ্ট দেখতে পেলাম কপালের এই বাঁদিকটায় একটা কাটা দাগ আর কেমন ফুলেও উঠেছিল' , বলে আঙুল দিয়ে কপালের জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দেখান দেবাঞ্জন। চৈতালী ভারী আশ্চর্য হয়ে দেবাঞ্জনের মুখের দিকে তাকান, তারপর বলেন, 'আমি কিন্তু কোনো চোট টোট দেখিনি বাপু, আমার মনে হয় তুমি ভুল দেখেছ'। 
'না না চৈতালী, ভুল আমি দেখিনি, বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছিলাম, কারণ আমি চশমাটা পড়েছিলাম,....... দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক এই জায়গাটায়..............' তোতলাতে থাকেন দেবাঞ্জন। 
'হ্যাঁ বুঝেছি, তুমি আয়নায় দেখলে আর তারপরেই পড়ে গিয়ে এক্কেবারে কপালের ঠিক ঐখানটাতেই চোট পেলে তাই তো' ? ঘাড় বেঁকিয়ে কৌতুকভরে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন হতভম্ব হয়ে যান, স্ত্রীর পরিহাসের কি উত্তর দেবেন ভেবে পান না। বটেই তো, যে আগের ঘটনাটা দেখেনি তাকে নির্ভুল ভাবে বোঝানো অসম্ভব, তাছাড়া বয়সজনিত সমস্যাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয় একেবারে। কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন দেবাঞ্জন, তারপর অস্ফুটে বলতে থাকেন, 'আমি কিন্তু ঠিকই দেখেছিলাম....... জানিনা কি করে ................' 
চৈতালী অট্টহাস্য করে ওঠেন, বলেন, 'তোমার নতুন চশমায়, কয়েক ঘন্টা পর কি হবে সেসব দেখা যায় বুঝি ? হাঃহাঃহাঃহাঃ, ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া যায় বলছো' ?....................

(ক্রমশ)

শিল্প বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki

Thursday, December 8, 2016

চিঠি

সন্ধ্যাতারা হারিয়ে গেছে 
ধূসর মেঘে খুঁজেছিলাম 
চিঠির জবাব পাইনি তবু 
কাল, তোমায় চিঠি লিখেছিলাম...... 

বলার সবই রইল বাকি 
চলার পথে পড়ল ফাঁকি 
ঘূর্ণি ঝড়ে অথৈ জলে 
সোনার তরী ভাসিয়েছিলাম 
চিঠির জবাব পাইনি তবু 
কাল, তোমায় চিঠি লিখেছিলাম...... 

ছায়ার মতো অন্ধকারে 
ছায়াটাকেই সঙ্গে করে 
রুদ্ধশ্বাসে বন্ধদ্বারে 
প্রতীক্ষাতে কাটিয়েছিলাম
চিঠির জবাব পাইনি তবু 
কাল, তোমায় চিঠি লিখেছিলাম..... 

ছবি : গুগল 













#bengalipoems #poetries

Monday, November 21, 2016

দুষ্টু ছেলে - ২

পুণ্যতোয়া নদীর তীরে মধ্যবিত্তের শহর......
কার কত জমা পাপ, সকলি রেখেছে খবর । 

Friday, November 18, 2016

দুষ্টু ছেলে - ১

খেটে খাওয়া অগুন্তি মানুষের ভিড়ে
তুমি পাঁচফোড়ন, আর আমি শুধুই কালো জিরে !! 

Monday, November 14, 2016

সাপ্তাহিকী ২০ # শিরঃপীড়া


মাথার পিছনে একটা অদ্ভুত ব্যাথা হচ্ছে নিখিলেশের । সাধারণ মাথাধরা নয়। একনাগাড়ে একটানাও নয়। থেমে থেমে ধীর লয়ে ব্যাথাটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ভারী কিছু একটা জিনিস দিয়ে অল্প অল্প চাপ দিচ্ছে পিছন থেকে। গতকাল রাতে ঘুমের ওষুধটা খাওয়ার পর থেকেই যেন শুরু হয়েছিল। অতটা পাত্তা না দিয়ে নিয়মমাফিক খানিক্ষন টিভি দেখেই শুয়ে পড়েন নিখিলেশ। ভেবেছিলেন ভালো ঘুম হলেই কেটে যাবে। অথচ সকালে উঠেও ব্যাথাটা দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে। ভারী মুস্কিলে পড়লেন, সারাদিন ধরে এই বেয়াড়া ব্যাথাটা যদি পাথরের মতো বয়ে বেড়াতে হয় তাহলেই তো হয়েছে। অফিসের কাজ তো গোল্লায় যাবে। বেসরকারী অফিসে হিসাব রক্ষকের কাজ তো কম ঝক্কির নয়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই বড় রকমের ঝামেলা পোয়াতে হবে তখন। পেশাগত দক্ষতায় এত বছরের কর্মময় জীবনে খুব একটা গলদ তাঁর হয়নি কখনো। তবুও শারীরিক দুর্বলতার কারণে হিসেবের গরমিল, মোটেও কাজের কথা নয়। তার ওপর অফিসের নতুন ম্যানেজার একাধারে বেশ দাপুটে এবং বাচাল। ছোটখাটো সমস্যাতেও লঘু গুরু জ্ঞান করেন না কখনো। দু চার কথা শুনিয়ে দেবার সুযোগ খোঁজেন যেন সবসময়। এই তো দুদিন আগে, মান্থলি মিটিংয়ে, জনসংযোগ দপ্তরের এক জুনিয়র কলিগকে যাচ্ছেতাই কথা শোনালেন সবার সামনে, শুধুমাত্রই একটা ভুল মেল্ টাইপ করেছেন বলে। নিরীহ, মিতভাষী নিখিলেশ ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিবাদটা এড়িয়ে গেছেন ইচ্ছে করে। ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পারতপক্ষে সহ্য হয় না তাঁর। আর তাছাড়া আর তো তিন চার বছর বাকি । তারপরেই অখণ্ড বেহিসেব অবসর। শেষের এই বছরগুলো যতটা শান্তিতে কাটানো যায় ততই মঙ্গল। খামোকা তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করাই ভালো।

মাথার পেছনটা আবার টনটন করে ওঠে। ঘাড় কাত করে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নেন নিখিলেশ। নাহ, অফিস ফেরত একবার মনোময় ডাক্তারের চেম্বার থেকে ঘুরে আসতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি হলে আবার বিপদ আছে। একলা মানুষ নিখিলেশ। বিয়ে থা করেন নি। পৈতৃক বাড়িটায় ভূতের মতন একাই থাকেন। অনেক ছোট বয়েসে বাবা মারা যান। আর তিরিশ বছর বয়েসে মা ও চলে যান কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। মাকে খুবই ভালোবাসতেন নিখিলেশ। মা মারা যাওয়ার পর পরই নিখিলেশ অস্বাভাবিক রকমের অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। কোনো এক অজানা কারণে লোকজনের সাথে মেলামেশা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছিল। প্রায় এক বছর উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন এদিক ওদিক। মুম্বই, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর চরকিপাক খেয়েছেন শুধু। সেসময় এরকমই একটা মাথাব্যথা হতো, বেশ মনে আছে । আত্মীয় স্বজনরা কানাঘুষো বলত, নিখিলেশের নাকি মানসিক রোগ হয়েছে, কারণ নিখিলেশ মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভুত উগ্র আচরণ করতেন যার কোনো সহজ স্বাভাবিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না। ডাক্তার, মনোবিদ সমস্তরকম কনসাল্ট করে বেশ খানিকটা সুরাহা হয়েছিল পরবর্তীকালে। বছর দুয়েক বাদে কোনো এক দূরসম্পর্কের জ্যাঠা মশাইয়ের বদান্যতায় মাস্টার্স ইন কমার্স নিখিলেশের এই চাকরিটা জুটেছিল। ধীরে ধীরে চাকরিটায় থিতু হয়ে যান, হিসেব রাখার কাজটাও বেশ ভালো লেগে গিয়েছিলো পরের দিকে। ক্রমশ উন্নতিও হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু সেই থেকে আর বিয়েটা করা হয়ে ওঠে নি। এমন নয় যে জীবনে কোনো নারীর আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি কোনোটাই। নিখিলেশের কোনো না কোনো বেমক্কা আচরণে শেষে গিয়ে ঠিক নাকচ হয়ে যেত সম্বন্ধগুলো । একটা সময়ের পর নিখিলেশের একা থাকাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। তাই কয়েক বছর পর বিয়ের পিঁড়ির প্রতি আর তেমন আকর্ষণ অনুভব করেন নি। সারাদিনে অফিসের কাজ আর পাড়ায় দু চার জনের সাথে আড্ডা দিয়েই সময় কেটে যায় এখন। বাড়ির খুঁটিনাটি কাজের জন্য একজন সারাদিনের লোক আছে, নিখিলেশের থেকে বছর দশেকের ছোট, মেদিনীপুর নিবাসী, বিশ্বস্ত অনুচর, নাম - প্রসাদ। বহু বছর আগে এ বাড়িতে সে ভিক্ষে করতে এসেছিলো। সেই থেকে এখানেই থাকে। রান্নাবান্না, ঘর দোর পরিষ্কার করা ইত্যাদি সমস্ত কাজ সে যত্ন করেই করে। নিখিলেশের রোজনামচা তার মুখস্ত।

আজ সে ভাত বেড়ে দিয়ে নিখিলেশের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'দাদার কি শরীরটা খারাপ লাগছে' ? নিখিলেশ ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে বলেন, হ্যাঁ রে, মাথাটা বেজায় টনটন করছে কেমন যেন, পুরোনো রোগটা আবার ফিরে এলো কিনা কে জানে'।
'তাহলে কি একবার সন্ধের দিকে, মনোময় ডাক্তারের কাছে...........' কথাটা শেষ করতে পারে না প্রসাদ। তার আগেই নিখিলেশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, 'হুমমম, সেরকমই ভেবেছি, দেখি, ফেরার পথে একবার দেখিয়ে আসবো' । 'আচ্ছা', বলে ভিতরে ঢুকে যায় প্রসাদ। নিখিলেশও ভাতের থালা নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েন । শরীরে অস্বস্তি হওয়ার ফলে খেতেও ইচ্ছে করে না তেমন। মুখ হাত ধুয়ে বাদামি চামড়ার ব্যাগটা কাঁধে ফেলে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যান তাড়াতাড়ি । নীলচে রঙের পুরোনো মডেলের একটা মারুতি এইট হান্ড্রেড। চাকরিতে ঢোকার বছর সাত আটেকের মধ্যেই লোনের টাকায় গাড়িটা কিনেছিলেন। বড় শখের গাড়ি তাঁর। পরের দিকে উপায় থাকলেও গাড়িটা আর চেঞ্জ করেন নি। ভালোবেসে ফেলেছিলেন তার সাধের মারুতিটাকে। এখনো সমান যত্ন করেন এবং নিজের সন্তানের মতোই আগলে রাখেন। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অফিসের দিকে বেরিয়ে যান নিখিলেশ। ব্যাথাটা হতেই থাকে ঢিমে তালে।

বিকেলের দিকে নিখিলেশের ডাক পড়ে ম্যানেজারের চেম্বারে।
'আপনার আক্কেলটা বলিহারি মিঃ মুখার্জ্জী, স্টক ব্যালেন্সের সোজা হিসেবগুলো যদি এইভাবে গুলিয়ে ফেলেন তাহলে তো দুদিনেই ব্যবসা লাটে উঠবে। আপনার ভুলের মাশুল নিশ্চয়ই  কোম্পানী দেবে না' ? কথাগুলো বলে ভীষণ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন ম্যানেজার। অপরাধীর মতো মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন নিখিলেশ। মাথার ব্যাথা তার সাথে অন্যমনস্কতা, দুয়ে মিলেই এমন বিচ্ছিরি অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে। তার জন্য নিখিলেশ যারপরনাই লজ্জিত। বার তিনেক ঢোঁক গিলে ক্ষমাও চেয়েছেন, কিন্তু অধস্তন কর্মচারীকে কোনোরকম সুযোগই দিচ্ছেন না দাপুটে কর্তৃপক্ষ । একের পর এক বাঁকা শব্দের শরাঘাতে বিদ্ধ করছেন নিখিলেশকে। নিখিলেশ কাঁচুমাচু মুখ করে বলেন, 'স্যার, আমি এক্সট্রিমলি সরি, আমাকে একটু সময় দিন, আমি পুরোটা রিচেক করে আপডেট করে দেব সমস্ত কিছু। ঘন্টাখানেকের বেশি লাগবে না, কথা দিচ্ছি' ।

 - স্ট্রেঞ্জ, ঘন্টাখানেক সময়টা কি আপনি সময় বলে মনে করেন না মিঃ মুখার্জ্জী ! নাকি আপনি ভাবছেন অমন ঘন্টার পর ঘন্টা অপচয় করার মতো যথেষ্ট সময় আছে আমাদের ?
- আজ্ঞে স্যার, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। সামান্য একটা ভুল......আমি এখুনি ঠিক করে দিচ্ছি।
- হাসালেন মিঃ মুখার্জ্জী, কোনটা সামান্য আর কোনটা অসামান্য সে বিচার করার বোধ যদি আপনার থাকতো তাহলে এই ভুলটা কিছুতেই করে উঠতে পারতেন না।
- আসলে স্যার, গত দুদিন ধরে আমার একটা অদ্ভুত মাথাব্যথা........
- এই হচ্ছে মুশকিল জানেন তো ! বুড়ো ঘোড়া তায় আবার বাঙালী ! এই দিয়ে কি আর রেসের বাজি জেতা যায় ? এই বয়েসে এখন আপনার মাথাব্যথা, অম্বল, গ্যাস, বুকজ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর এসব হবেই, তাই বলে তো আর কোম্পানী আপনার সুস্থ হওয়ার দিকে হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতে পারবে না, তাই না ?

মাথা নিচু করে চরম অপমানগুলো হজম করতে থাকেন নিখিলেশ। নিমেষেই কান মাথা লাল হয়ে যায় তাঁর। কাঁচের দরজার ওপারে মাঝেমাঝেই উৎসুক মুখের চাহনি টের পাওয়া যাচ্ছে । বাকি কলিগদের মাঝে সম্মানের আর অবশিষ্ট রইল না কিছু এটা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি । এই অফিসে তিনি একাধারে সিনিয়র এবং সম্মানীয় পদে আসীন। এধরনের বাক্যালাপে অভ্যস্ত নন কোনোভাবেই । আগের ম্যানেজারদের সময়তে এমনটা হয়নি কখনো। বরাবরই তাঁকে সমীহ করে এসেছেন ছোট থেকে বড় সবাই । সেখানে এমন হেনস্থায় তাঁর মাথা শুধু হেঁটই হলো না বরং আত্মাভিমানেও সপাটে চপেটাঘাত পড়লো যেন।

নিখিলেশ ধীরে ধীরে ম্যানেজারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের সিটে গিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন খানিক্ষন। চাকরীর পড়ন্ত বেলায় পাওনা বহির্ভূত অসম্মানটা হজম করতে পারেন না কিছুতেই। ভিতরে ভিতরে ঝড় বইতে থাকে। চূড়ান্ত অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে স্টক ব্যালেন্সের ফাইলটা টেনে নিয়ে দ্রুত চোখ বোলাতে থাকেন। আশপাশ থেকে কৌতূহলী চোখের আদানপ্রদান হতে থাকে, কিন্তু সেদিকে খুব একটা আমল না দিয়ে ভুলগুলো সংশোধন করতে থাকেন একমনে। কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ম্যানেজারের টেবিলে ফাইলটা রেখে বলেন, 'আমি পুরোটা রেক্টিফাই করে দিয়েছি স্যার, আপনি কি একবার চোখ বুলিয়ে নেবেন প্লিজ' ? ।

'সেটা না করে উপায় আছে নাকি' ? দরকারী কাগজপত্রে সই করতে করতে উদ্ধত কথাগুলো নিখিলেশের মুখের দিকে না তাকিয়েই ছুঁড়ে দেন ম্যানেজার। নিখিলেশ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, কি বলবেন ভেবে পান না, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নব্য ম্যানেজারের মুখের দিকে। আগের মতো মুখ নামিয়েই ম্যানেজার বলতে থাকেন, 'আমায় তো অন্যান্য কাজও করতে হয়, আগামী সপ্তাহের অডিট রিপোর্টে এমনিই ডিলে হবে, সুতরাং কালকের আগে দেখে উঠতে পারবো না.......থ্যাংকস টু ইউ ফর মেকিং দিস রিমার্কেবল পারফর্ম্যান্স' । বাঁকা কথাগুলো চাবুকের মতো পড়ে নিখিলেশের সারা শরীরে। কানের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সেসব শ্লেষের শব্দ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে বিষাক্ত জ্বালা ধরিয়ে দেয়। ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন নিখিলেশ। মাথার মধ্যে যেন আগুনের লেলিহান শিখার উপস্থিতি টের পেতে থাকেন । বুঝতে পারেন তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। হাতের কাজগুলো চটপট সেরে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত লিফটের দরজার কাছে চলে আসেন। বোতাম টিপে পার্কিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরে নেমে আসতেই মনে হয় ব্যাথাটা যেন ক্রমশ বিদ্যুৎলতার মতো মাথা থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে । গাড়ির কাছে এসে তাঁর মনে হয় একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলে ভালো হতো, তাহলে বোধহয় এই অস্থিরতা লাঘব হত কিছুটা । এই পার্কিং ফ্লোরের উত্তর দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকাই থাকে । উত্তেজনায় কাঁপা হাতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নেন নিখিলেশ। পাঁচিলের দিকটায় এগোতে যাবেন, হঠাৎ লক্ষ্য করেন ইতিমধ্যেই ম্যানেজার নেমে এসেছেন আর অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে । নিখিলেশ একটু হকচকিয়ে যান, পরক্ষনেই সামলে নিয়ে বলেন, 'কিছু বলবেন স্যার' ? ম্যানেজার আঙ্গুল তুলে নিখিলেশের গাড়ির দিকে দেখান । নিখিলেশ কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে' ?
- বেসিক সিভিক সেন্সটা কি কিছুতেই আপনার থাকতে নেই মিঃ মুখার্জ্জী ?
একথায় নিখিলেশ খানিকটা বাক্যহারা হয়ে যান, তারপর কোনোরকমে বলেন, 'আ, আমি ঠিক বুঝলাম না স্যার' । ম্যানেজার কোমরে দুহাত দিয়ে বলেন, 'আপনার এই আপদটাকে যেভাবে রেখেছেন, তাতে করে তো আমি আমার গাড়িটা বের করে উঠতে পারছি না' । কথাটা যে তাঁর মারুতি গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বলা, এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না নিখিলেশের। কঠিন গলায় বলেন, 'ওটা আমার গাড়ি স্যার.....আপদ নয়' ।
- বটে ! বেশ তবে ওটাকে নিচের ফ্লোরে রাখবেন এবার থেকে, ওপরে আর নয়।
- কিন্তু কেন ? আমি তো বরাবর এখানেই রাখি।
- অফিসের কিছু গাইডলাইনস তৈরী করেছি মিঃ মুখার্জ্জী, ম্যানেজার বা সমগোত্রীয় এমপ্লয়ীজরা তাঁদের গাড়ি সেকেন্ড ফ্লোরে পার্ক করবেন আর বাকি স্টাফদের নিচের ফ্লোরে পার্ক করতে হবে।
- এটা একটু জবরদস্তি হয়ে গেলো নাকি ?
- কি হলো না হলো সেটার কৈফিয়ৎ নিশ্চই আপনাকে দেব না । বরং যেটা বলা হয়েছে সেটাই করবেন এখন থেকে ।

নিখিলেশের মনে হলো কেউ যেন মাথার ভেতরটায় সজোরে হাতুড়ি দিয়ে পিটছে একনাগাড়ে । কপালের দুপাশে শিরা ফুলে উঠেছে । হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে । দাঁতে দাঁত চেপে পাল্টা জবাব দেন, 'কৈফিয়ৎ আপনি নাই দিতে পারেন, কিন্তু অন্যায্য কারণে আপনারও হুকুম মানতে ঠিক বাধ্য নই আমি'। এহেন অপ্রত্যাশিত জবাবে ম্যানেজার ক্ষণিক স্তব্ধ হয়ে যান এবং পরক্ষনেই ভয়ানক চিৎকার করে বলেন, 'হাউ ডেয়ার ইউ টক্ টু মি লাইক দিস !! আপনি জানেন আপনি কার সাথে কথা বলছেন' ?
নিখিলেশের চোখ মুখ দাবানলের মতো জ্বলতে থাকে । সারা শরীর দারুণ উত্তাপে ঝলসে যেতে থাকে যেন। ক্রুদ্ধ চাহনি দিয়ে বলেন, 'জানি..... আমি একজন অভদ্র, উন্মাদ, এরোগেন্ট মূর্খের সাথে কথা বলছি, যে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না, দুর্ব্যবহার ও হেনস্থার চাবুকে কর্মচারীদের নাজেহাল করে রাখে'....... । 
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠেন ম্যানেজার, 'শাট ইওর ফাকিং মাউথ মুখার্জ্জীইই !! আই উইল মেক ইয়োর লাইফ হেল ইউ ব্লাডি সোয়াইন........' । কথাটা পুরো শেষ করতে পারেন না। তার আগেই পাঁচিলের ধার ঘেঁষে পরে থাকা একটা কংক্রিটের চাঙড় তুলে নিয়ে সজোরে ম্যানেজারের মাথায় বসিয়ে দেন নিখিলেশ। মিনিট খানেকের কম্পন আর মৃদু গোঙানির আওয়াজ। কিছুক্ষনের মধ্যেই পার্কিং ফ্লোরে নিথর হয়ে যায় ম্যানেজারের শরীর............

পরদিন সকালে ডাইনিং টেবিলে নিয়মমতো চায়ের কাপের সাথে সকালের কাগজটা বাড়িয়ে দেয় প্রসাদ। নিখিলেশ চায়ের কাপে হালকা চুমুক দেন। প্রসাদ জিজ্ঞেস করে, 'ওষুধটা এনে দেব দাদা' ? নিখিলেশ বলেন, 'থাক, দরকার নেই, কাল থেকে আর ব্যাথাটা হচ্ছে না' । 'তুমি কি এখনি অফিস বেরোবে' ? প্রসাদ আবার জিজ্ঞেস করে। নিখিলেশ নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেন, 'নাহ, আজ আর বেরোব না কোথাও'। প্রসাদ আশ্বস্ত হয়ে বলে, 'সেই ভাল, আজ বরং একটু বিশ্রাম নাও, গতকাল রাত থেকে তো দুচোখের পাতা এক করতে পারনি, আমায় ফাঁকি দিতে পারবে না, আমি জানি'। মৃদু হাসেন নিখিলেশ, বলেন, 'সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও পার্কিংয়ের সিসিটিভিটাকে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারিনি জানিস, ধরা ঠিক পরেই যাব। বছর ত্রিশ আগে পার পেয়ে গেছি.......তবে আজ আর কোনো উপায় নেই'। প্রসাদ অবাক হয়ে বলে,       'মানে' ? কোনো উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে কাগজটা চোখের সামনে ধরেন নিখিলেশ। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় হেডলাইনটা গোটা গোটা হরফে জ্বলজ্বল করছে -
"কলকাতার বুকে স্টোনম্যানের পুনরাবির্ভাব"।



#bengalishortstories #bengalisuspensestories #thrill #drama #saptahiki

Tuesday, November 1, 2016

অবধী রেস্তোঁরা

বিরাট খাইয়ে পার্টি বলে কোনোদিনই আমার তেমন সুনাম ছিল না। অপরিমিত আহার ও দেদার মজলিশী মশলাদার খানার সাথে আমার উদরের দোস্তি নেই সেরকম। তবু কিছু কিছু আফগানী ও নবাবী কড়াইয়ের দিলখুশ ঘ্রান নাকে গেলেই কেন কে জানে নোলা বেড়ে যায় শতগুন। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো ভাইফোঁটার ছুটিটা যখন পাওয়া গেলো তখন অর্ধাঙ্গিনীর আবদারে দেশপ্রিয় পার্কের আশেপাশে একটা রেস্তোঁরার খোঁজ করলাম অনলাইনে। চোখ আটকে গেলো একটি নবাবী রেস্তোঁরায়। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে - অবধী রেস্তোঁরা । যার ওয়েবসাইট দেখে আপনার খানিকটা সম্ভ্রম জাগবে তো বটেই। আরও জাগবে যখন সশরীরে পৌঁছবেন ২৩ / বি দেশপ্রিয় পার্ক, কলকাতা ছাব্বিশে। রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে যেখানে দাঁড়াবেন, সেটা কালচে বাদামী কাঠ, লাল হলুদ শার্সি ও মোঘলাই নকশার লম্বাটে একটা বাড়ি............... 'আউধ ১৫৯০'। যাঁরা উদারহস্তে খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন, যাঁরা সুযোগ পেলেই বিভিন্ন উপলক্ষে মুখের স্বাদ পাল্টে থাকেন তাঁদের জন্য একপ্রকার উত্তম ঠিকানা, এটুকু হলপ করে বলতে পারি। 

ঠিক দুপুর বারোটায় ভারী কাঠের লোহার বড় পেরেক পোঁতা দরজাটা খুলে যায় ভিতরের দিকে । প্রায় আটশো - নশো স্কয়ার ফিটের একতলা জায়গাটায় ঢুকেই আপনার চোখ আঁটকাবে প্রায় সমস্ত দিকেই। তাক লাগানো জাফরী করা কাঠের কারুকাজ ও বাদশাহী ঝাড়বাতির নিভু আলোর দাওয়াতী মূর্ছনায় একঝটকায় পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর । বেগম আখতারী ঠুমরিতে দেওয়াল জুড়ে নবাবী নর্তকীর তৈল চিত্রগুলি যেন জীবন্ত মনে হবে অচিরেই। এক লহমায় আপনি বুঁদ হয়ে বসবেন পালিশ করা কাঠের কুর্শি তালিকায়। রঙিন খোপকাটা মেঝের দিকে তাকালে মনে হবে হাতের এক তালিতেই হয়তো শুরু হবে ঠুমরি গজলের মেজাজী মজলিশ। ইতিহাসের ছায়াপথ বেয়ে জেগে উঠবে পুরোনো কাঠকয়লার গন্ধে রসনাপূর্তির উৎসব। এক গেলাস তৃপ্তি করে জল খাবার পর আপনার সামনে আসবে প্রায় দু কিলো ওজনের একটা পেল্লায় মেনু কিতাব। প্রায় প্রত্যেক পাতায় আপনার নাকে ভেসে আসবে আফগানী কাবাব, বিরিয়ানী, শোর্বার জিভে জল আনা মশল্লা খুশবু।  কিছুক্ষনের জন্য আপনি বিভ্রান্তও হয়ে যেতে পারেন সেসব পাহাড়প্রমাণ নামের ধাক্কায় । স্থির হয়ে তশরিফ রাখার পর আপনার মনে হবে যে মেহমান নওয়াজির সুচারু আদব কায়দায় সে বাড়ির দিওয়ার ঝরোখাও বিলকুল চোস্ত । 

এই অবধী রেস্তোঁরার বৈশিষ্ট হলো ঢিমে আঁচের 'দম পুখত' রন্ধন প্রণালী। মুখবন্ধ কড়াইতে জাফরান, দারুচিনি, এলাচ, শুকনো ফল ও হরেক রকমের শাকের ব্যবহার আপনাকে শুধু অবাক করবে না, তৃপ্তির উল্লাসে আপনাকে বাকরুদ্ধ করবে আরো বেশ কতকটা । বিশেষ করে 'গালাউটি কাবাব' ও 'অবধী হান্ডি বিরিয়ানী'র সুখানুভূতি আপনি বেশ কয়েকদিন অবলীলায় বয়ে বেড়াতে পারবেন। অবধী রান্নার চিত্তাকর্ষক মশলার গন্ধ আপনি চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবেন না। শেষ পাতে আপনার কেল্লা ফতে হবে না যদি না আপনি 'শাহী টুকরা' অর্ডার করেন। পুডিং, শুকনো ফল ও এলাচ দিয়ে যথাযথ দরবারী মিষ্টিটা অনবদ্য বললেও কম বলা হয়। যতক্ষণ না আপনি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন ততক্ষন আপনি অজান্তেই বন্দী হয়ে থাকবেন এই নবাবী রঙমহলে। মনে মনে নিশ্চিত প্রতিজ্ঞা করে যাবেন ফিরে আসার এবং অন্যান্য পদগুলিও চেখে দেখার। তবে পাশাপাশি এটাও জানিয়ে রাখি মূল্যের বিচারে একটু ওপরের দিকে হলেও নিশ্চিন্তে এটি মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যেই। বলাই বাহূল্য দক্ষিণ কলকাতায় এমন একটি দাওয়াতের ব্যবস্থা করায় আমি যারপরনাই আহ্লাদিত এবং সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা শিলাদিত্য চৌধুরী ও দেবাদিত্য চৌধুরীকে আমার অনেক সাধুবাদ।

পুনশ্চ : এই রেস্তোঁরার কোনো মানুষের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো যোগাযোগ বা পরিচয় নেই তাই পাবলিসিটি করাটা মূল উদ্দেশ্য নয়। 'আউধ ১৫৯০' এর উত্তম রন্ধন ও আয়োজনের দরুন আমি আপ্লুত বলেই এটি না লিখে পারলাম না । 



ছবি : নিজস্ব


ছবি : নিজস্ব


ছবি : নিজস্ব

#bengaliarticles #bengaliwriteups #bengalirestaurant #awadhicuisine #oudh1590          


Friday, October 28, 2016

সাপ্তাহিকী ১৯ # প্রান্তিকা

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের টিপটা ঠিক করে নেয় প্রান্তিকা। ভালো করে নিজের মুখটা দেখে নেয় বারকতক। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শাড়ির কুঁচি আর আঁচলটা সমান করতে থাকে সে। আজকের দিনটা ভীষণ ইম্পরট্যান্ট। কোনোভাবেই আজকের দিনে যেন খুঁত থেকে না যায় কোনোখানে। শিফন শাড়ির ভাঁজে আঙ্গুল চালিয়ে পরিপাটির চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে সে যত্ন করে। আনন্দ আর উত্তেজনায় জ্বর জ্বর ভাব লাগে যেন শরীরের ভেতর। আজ যে তার বিশেষ বন্ধুর সাথে অফিসিয়াল ডেটে যাওয়ার দিন। 

মধ্যবিত্ত হলেও সচ্ছল পরিবারে মানুষ হয়েছে প্রান্তিকা। তবুও একবিংশ শতাব্দীর চৌকাঠে এসে তাকে হোঁচট খেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। সম্পর্কটা অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেননি প্রান্তিকার বাবা মা কেউই, সে যতই তাঁরা আগের থেকে আন্দাজ করতে পারুন না কেন। শেষটায় রাজি হয়েছেন একরকম অনন্যোপায় হয়েই। প্রান্তিকার অফিসের সিনিয়র কলিগ। অন্য ডিপার্টমেন্ট হলেও কাজের সূত্রে কথার লেনদেন, আলাপ, ভালোলাগা ও পরবর্তীকালে প্রেম হয়। আগাগোড়াই মিতভাষী প্রান্তিকা এক অপার্থিব আবেশে আকর্ষিত হয়েছিল তার সহকর্মীর নিয়মবহির্ভূত দৃষ্টিভঙ্গিতে। জীবনের সরলরেখায় পা মেপে পথ চলায় যার প্রবল অনীহা, সমাজের শিকড়ে বাসা বেঁধে থাকা নিয়মাবলী যে দূরে নিক্ষেপ করে প্রতি মুহূর্তে, এহেন মানুষের সংস্পর্শে এসে যেন প্রাণ পেয়েছিলো বছর চব্বিশের তরুণী প্রান্তিকা। সম মনোভাবের মানুষকে পেয়ে সে ঠিক করে নিয়েছিল যদি গাঁটছড়া বাঁধতে হয় তাহলে এর সাথেই বাঁধবে, বাবা মা র পছন্দ করা বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ পাত্রের সাথে নয়। তার মনের মানুষ অবশ্য তাকে সাবধান করেছিল অনেক আগেই, লৌকিকতার কাঁটাতারের জ্বালা মনে করিয়ে দিয়েছিলো বারেবার। কিন্তু প্রান্তিকাকে নিরস্ত করা যায় নি। কোনো এক সন্ধের লঞ্চঘাটে আশমানি চাঁদের আলো ও রুপোলী নক্ষত্রদের সাক্ষী রেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল, 'তোমার আপত্তি নেই তো' ? মৃদু হেসে পরম আদরে তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল তার সিনিয়র সহকর্মী। মাথায় নরম আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলেছিলো, 'সামনের বুধবার, চল্ আমরা অফিসিয়াল ডেটে যাই, তোকে নিয়ম মেনে, যাকে বলে একেবারে অফিসিয়ালি প্রপোজ করব'।

আজ সেই দিন। ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ যায় প্রান্তিকার। আর একটু বাদেই সে আসবে। ত্রস্ত হাতে চুল বাঁধতে থাকে সে। পাশের ঘর থেকে পায়ে পায়ে দময়ন্তী এসে দাঁড়ান ড্রেসিং টেবিলের পাশে। আলতো স্বরে বলেন, 'তুই কিন্তু আরেকটিবার ভেবে দেখতে পারতিস, বড্ডো তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না কি' ? প্রান্তিকা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, 'আমি তো অপরাধ কিছু করছি না মা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্য করে তুললে যখন, তখন সেই সিদ্ধান্তটাই নিতে দাও। তোমরা তো আমাকে সুখী করতে চেয়েছিলো। বিশ্বাস করো আমি সুখ খুঁজে পেয়েছি। শুধু এটুকুই বলার, তোমরা আমার পাশে থেকো, আগের মতোই '। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দময়ন্তী। চিরুনিটা নিয়ে প্রান্তিকার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলেন, 'তোর কি আজ দেরি হবে আসতে' ?  'না, খুব বেশি হবে না, তবে তোমরা খেয়ে নিও', আস্তে আস্তে বলে তাঁর একমাত্র কন্যা। 

নিচে গাড়ির হর্ন বাজে। পর্দার আড়াল সরিয়ে জানলা দিয়ে নিচে তাকায় প্রান্তিকা। চাপা উত্তেজনায় ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, 'আমি তাহলে আসি' ? ঠোঁটে আলগা হাসি ঝুলিয়ে সামান্য ঘাড় কাত করেন দময়ন্তী। মাকে একপলক জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে যায় সে। সদর দরজা খুলে দেখে ইস্পাত রঙের সিডান গাড়িটা অপেক্ষা করছে একেবারে দোরগোড়ায়। পিছন ফিরে মুখ তুলে তাকায় সে। দক্ষিণের জানলায় বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁ হাতটা জানলার কাঁচের ওপর পাতা। দূর থেকে আশীর্বাদের মতো মনে হয় যেন প্রান্তিকার। বিড়বিড় করে বলে, 'আমার প্রণাম নিও' । তারপরেই ঘুরে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে উঠে পড়ে সে। ড্রাইভারের সিটে রূপকথা তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। গোধূলি রঙা কুর্তিতে পরীর মতো দেখতে লাগছে সহকর্মীকে। রূপকথা চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কি রে ? সব ঠিক আছে তো'? প্রান্তিকা ঘাড় নাড়ে। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে রূপকথা বলে, 'বেশ, আজ তাহলে তুই বল, কোথায় যাবো.......? প্রান্তিকা সলাজ গলায় বলে, 'লঞ্চঘাট.......... ' ।

 ছবি : গুগল 

#bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories #love #romance #drama                

Tuesday, October 25, 2016

সম্মান

পাজামারও বুকপকেট ! গুবরে পোকাও এরোপ্লেন ! আর আমিও নাকি লেখক !
নাহয় কদিন লেখালিখির দরুণ কজন পাঠক পাঠিকা জুটেছে, তাই বলে একেবারে ফুলকারীর আসন বিছিয়ে মাথায় মৃদুমন্দ তালপাখার বাতাস ! বলেন কি কত্তা ! এমন অসম্ভব কাণ্ডও হয় ? আর যাঁরা এই অসম্ভব কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন তাঁদের প্রতি আমার অফুরান ভালোবাসা ও সশ্রদ্ধ প্রণাম। কলমের আঁচড় তরবারির শানিত ফলার চেয়েও মোক্ষম এ আমরা সকলেই জানি। ফেসবুকের দেওয়ালে যাঁরা নিয়মিত লেখালিখি করেন তাঁরা একাধারে গুণীজন এবং বেশ জনপ্রিয়ও বটে, সেখানে আমার কলম সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর বেশি কিছু নয়। তবু আমার কপালে যে এমন প্রাণকাড়া জলখাবারের আয়োজন ছিল আর তার জন্য যে মনের মধ্যে বেশ ফুরফুরে ভালোলাগার স্রোত বয়ে গেছে তা সর্বসমক্ষে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। তাই অঙ্কুরের সমস্ত সদস্যদের জন্য আমার অকুন্ঠ মঙ্গলকামনা। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য - সুরজিৎ হালদার, যিনি আমার কথা আলাদা করে ভেবেছেন ও ডাকযোগে এই সম্মান পত্রটি পাঠিয়েছেন। আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই সুরজিৎবাবু। শুধুমাত্র সমৃদ্ধ হয়েছি বললে ভুল বলা হবে বরং এহেন কর্মকাণ্ডে স্তব্ধ হয়ে গেছি। 

আমার ব্লগের যে কতিপয় পাঠক পাঠিকা আছেন এই সম্মানের সিংহভাগ দাবিদার তাঁরাই । তাঁদের উৎসাহ ও পরামর্শতেই আমায় কলমের কালি আরও মসৃন হয়। তাঁদের সকলকে আমার কুর্নিশ ও সেলাম।  


#bengaliarticles #bengaliwriteups #respect #gratitude #certificate

Thursday, October 20, 2016

অনুপদ্য - ১১

নে বাপু, হয়েছে অনেক গুরুগম্ভীর তক্কো বিতক্ক,
এ জগতে কি আর কিছুই বলার নাই !
দে না চাড্ডি নারকেল নাড়ু, খই মুড়কি যাহোক এট্টু
খানকতক তাই নাহয় চিবিয়ে চিবিয়ে খাই...........

ছবি : গুগল 
















#bengalipoems #shortpoems

Monday, October 17, 2016

ছুটির একদিন

মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। ওই যে সেই কে যেন বলে গিয়েছিল...... 'Man proposes, God disposes'..............এক্কেরে খাঁটি কথা যা হোক। কি রকম ? এই যেমন ধরুন না একটা ছুটির দিন। যেই আপনি ভেবে বসে আছেন আজ তো নটার আগে ওঠাই নেই.......... ব্যাস ! অমনি কিছু না কিছু কারনে ভোর ছটায় আপনার ঘুমটা ভাঙবেই ভাঙবে ! হাই তুলে, নিতাই গৌরাঙ্গর মত দুহাত ছড়িয়ে কাঁচা ঘুমের জাবর কাটতে কাটতে ভাবছেন, যাই হোক ঘুমটা যখন ভেঙেই গেল তাহলে একটু এফ এম চালিয়ে প্রভাতি গানের অনুষ্ঠানটা শুনে নেওয়া যাক। অমনি ঘরের ভেতর থেকে অর্ডার আসবে, 'হাঁ করে বসে থেকো না, ব্রাউন ব্রেডটা নিয়ে এস তাড়াতাড়ি, আজকে একটু স্যান্ডুইচ করব ভাবছি' ! আপনি হয়ত মনে মনে ভাবছেন, 'আপদ ! আর বলার সময় পেলে না, দুদণ্ড যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে দিনের শুরুটা একেবারে শিশির ভেজার মত করে প্রান জুড়ানো হবে তা নয়, মুডের ওপর দিলে একেবারে স্যান্ডুইচের পাতিলেবু ঘষে'। অমনি আরেকদফা আওয়াজ, 'চা দিয়েছি, জুড়িয়ে গেল, খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকো, তুমি তো আবার বাথরুম না করে এক পা নড়তে চাওনা মোটে'। আপনি ততক্ষনে নিমপাতা গেলার মত মুখ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন. আর মনে মনে ভাবছেন, 'বাদামি রুটি ! উফফফ, এর চাইতে অফিস চলে গেলে মানসিক ছুটিটা পাওয়া যেত খানিক ' ! 
এখনি কি হয়েছে ভাবচেন, এই ত সবে শুরু হল !

ছুটির দিনে এরকম অভিজ্ঞতা কম বেশি সকলেরই হয়। যখনি আপনি আয়েস করে মউরি চিবিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে দিন কাটানোর চিন্তা করছেন তখনি আপনার কপালে উটকো কাজের ঝুরি নিয়ে কেউ না কেউ হাজির হয়ে যাবে ঠিক। 'দাদা, পাড়ায় অনুষ্ঠান আছে, একটু সভাপতির বক্তৃতাটা লিখে দিন না' অথবা 'দাদা, এবারের কালী পুজোর চাঁদাটা একটু বাড়িয়ে.......',  নিদেনপক্ষে, 'আমার খুড়তুতো বোনের জন্য একটা ভালো পাত্রর কথা বলেছিলুম, পেলেন নাকি' ?............., ইত্যাদি। দুদণ্ড শান্তিতে কোলবালিশ জড়িয়ে জিরোবার কথা ভেবেছেন কি আপনাকে একেবারে ঘরছাড়া করে ছাড়বে আপনারই ঘরের লোক। যেন এ ধরাধামে আপনি সে অধিকার নিয়ে আসেন নি । ওসব বিলাসিতা আপনার মত অজাত কুজাতের ললাটে মানায় না। আপনি হচ্ছেন কলুর সাবালক বলদ, নাকে দড়ি দিয়ে সংসারের চরকিপাক দেওয়াটাই আপনার একমাত্র ভবিতব্য। তবু সে যদিবা হাতের কাজগুলো আপনি সেরে রাখলেন, টিভির রিমোটটা কিছুতেই হাতাতে পারবেন না।............ কেন ? প্রশ্ন করে শত্তুর বাড়াবেন নাকি মশাই ! তার চাইতে সিগারেট জ্বালিয়ে বারান্দায় চলে যাওয়া ভাল। মনে মনে গুনগুন করুন, 'সেই ভাল, সেই ভাল, আমারে নাহয় না জানো.............'। হয়ত আপনি বারান্দার আরাম কেদারায় বসে বসে ভাবছেন, 'যাক........এইবার বাকি সময়টুকু নিশ্চিন্তি.................', সম্পূর্ণ ভুল ভাবছেন। কারন ঠিক সেই সময়,  'ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে' এর মতো আপনার কানের কাছে দরদী গলায় মৌমাছির গুঞ্জনে ভেসে আসবে,.......... 'এই শোনো, মিলন মেলায় টেরাকোটার ভালো কাজ এসেছে, চলো একবার ঢুঁ মেরে আসি' .......বা........ 'এই জানো ? দক্ষিণাপণে কি ভালো সেল দিচ্ছে, এরকম চমকদার ডিস্কাউন্টে শাড়ি সালোয়ার না কেনাটা বৃথা বুঝলে' ?..... না, না, চমকানোর কিছু নেই, 'হাড়িকাঠে গলা দিয়েছ পেতে, এখন তো সাগরসঙ্গমে হবেই যেতে' । বিকেলের বকলমে আপনি নিচুতলার কর্মী শ্রেণীভুক্ত বেশি বই নয়, অমন দুচারটে ডিস্কাউন্টের ডিসকাস থ্রো আপনার এড়িয়ে যাওয়ার জাস্ট কোনো উপায় নেই। যদি না আপনি ঠিক সেই সময়, পেট চেপে ধরে, 'উফফফ কি ভয়ানক ব্যাথা' বলে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে থাকেন। তাহলে হয়তো ঢাকুরিয়ার অটোটা আপনি এড়ালেও এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তাও সাময়িক। আপনাকে শপিং রেডি করে নেওয়ার জন্য গোটা দুয়েক ডেকোলিক ট্যাবলেট ততক্ষনে আপনার পেটে চালান হয়ে গেছে দিব্যি। আর আপনি ঘুড়ন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আপনার দুরন্ত জীবনের কভার ড্রাইভের মিসটাইম হয়ে যাওয়াটা দেখে চলেছেন নিস্পলক।   

কোথায় আপনি ভেবেছিলেন আধবেলার অবসরে সাধের গীটারটা নিয়ে একটু টুংটাং করবেন, অথবা টিভিতে ইন্ডিয়া নিউজিল্যান্ডের ওয়ান ডে ম্যাচটা সাপ্টে চেটেপুটে খাবেন, বা কমপ্লেক্সের কমিউনিটি হলে তাসের আড্ডা বা ক্যারামের ঘুঁটি সাজিয়ে তুলবেন, তা নয় আপনাকে হয়তো কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে ফলের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হতে হবে, তিনি সদ্য হাসপাতাল থেকে ফলতঃ ফেরত এসেছেন বলে। অথবা কোনো এক বিয়ের নিমন্ত্রণে না গেলে সে হয়তো বিয়ের পিঁড়ি থেকেই লাফিয়ে উঠে চলে যাবে, ইত্যাদি, যাবতীয় কাজে হাতযশ না প্রমান করা অবধি আপনার নামযশের আশা খুবই ক্ষীণ। আবার এমনও হতে পারে, আপনার যদি দু কলি গাওয়া বা লেখার অভ্যেস থাকে এবং আপনি সেটা করবেন বলে ভাবছেন এমন সময় হৈ হৈ করে আপনার পাশের বাড়ির জ্যাঠিমা বা মাসিমা পান দোক্তা চিবোতে চিবোতে এসে বলবেন, 'কি গো শুনলুম নাকি তুমি বাবা হবে !! আমাদের কাছেই সুখবরটা চেপে গেলে ?' এবং এই সময় হবু বাবা মায়ের ঠিক কি কি করা দরকার তার সমস্তটা একেবারে ফর্দ করে বুঝিয়ে দিয়ে চা, চানাচুর, ডিমের ডেভিল খেয়ে তবে ক্ষান্ত হবেন। সে যতই আপনি ভাবলেশহীন মুখ করে বসে থাকুন না কেন, যতই আপনি নীরবে বলার চেষ্টা করুন না কেন, 'আচ্ছা বেশ, আমার একটু কাজ আছে', তবু সে অযাচিত টিউশন ছেড়ে উঠে যাবার জো নেই। সে দুষ্প্রাপ্য, অমোঘ বক্তিমে আপনাকে শুনতেই হবে....... 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়' এর মতো করে।   

এহেন সমস্ত গুরু দায়দায়িত্ব পালন করে যতক্ষণে আপনি 'পথভোলা এক পথিক' আবার ফিরে আসবেন আপনার একান্তে, ততক্ষনে হয়তো সারা দিনের ছুটিটা আঙুলের ফাঁক গলে কখন বালির মতো পড়ে গেছে ঝুরঝুর করে আপনার খেয়ালও থাকবে না। রাতের ডিনার টেবিলে বসে আপনি মনে মনে হিসাব কষবেন, 'এই রে ! এটা তো করা হলো না, যাহ !, ওটা তো বাকি রয়ে গেল' তখন আপনার কল্পনায় কপাল চাপড়ানোটা অদৃশ্যই থেকে যাবে, সারাদিনে করা অন্যান্য কাজের মতোই। গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আবার কবে এমন ছুটি আসবে, যেটায় না করা কাজগুলো এক এক করে সেরে ফেলা যাবে। সে ছুটির দিন সপ্তাহ ঘুরলেই যে আসবে এমনটা নয় কারণ গত সপ্তাহতেই ঠিক করে রাখা আছে কোন বাঁশের খুঁটিতে বলদকে বাঁধা হবে। অনেকেই হয়তো বলবেন, 'ওরে তোরা অতো ছুটি পাস্, তারপরেও নাক সিঁটকোস কেন' ? কি বলবো কত্তা ! ছুটিগুলো ক্যালেন্ডারে থাকে ঠিকই, কিন্তু ছুটোছুটিও হয় বিস্তর........... 

অতএব, 'আমাদের ছুটি - ছুটি চল নেবো লুটি এই আনন্দ ঝর্ণায়'......... এটা মনে মনেই গাইতে থাকুন। আনন্দ ঝর্ণার অবগাহনে দিব্যি বেশ একটা ছুটির আমেজ আসবে.........কাল্পনিকই হোক না ক্ষতি কি ! 

পুনশ্চ : এই লেখাটি যে কোনো লিঙ্গের প্রতিই প্রযোজ্য, খামোকা একপেশে মনোভাবে আমাকে দোষের ভাগী করবেন না।


#bengaliarticles #bengaliwriteups #holiday #relax

Thursday, October 6, 2016

লোগো

তৃতীয়া থেকেই লোকজন নাওয়া খাওয়া ভুলে যেরকম মণ্ডপে মণ্ডপে পিলপিল করে জড়ো হতে শুরু করেচে, তাতে করে পুজোর বাকি দিনগুলোতে যে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হবে এটা আন্দাজ করতে কোনো গ্রহ নক্ষত্রের ছক লাগবে না এ আমি নিশ্চিত। যে রাস্তা অতিক্রম করতে আধঘন্টার বেশি লাগতো না সেই রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে, গোঁফ দাড়ি না গজানো অবধি পেরোনো দুস্কর হচ্ছে। এই আনন্দোৎসবে যখন সব্বাই ফুরফুরে স্নো পাউডারে সেজে উঠছে তখন আমিও ভাবলুম আমার মলাটকেও একটা নতুন জামা পরিয়ে দেখি কেমন হয়। হাজার হোক পুজো বলে কতা, সামান্য কিছু না দিলে রাতবিরেতে যদি জ্বালাতন করে মারে ? তাই ওরেও দিলুম একখান টেকসই কভার। মলাটেরও আবার মলাট ! কি আজগুবি ব্যাপার কত্তা ! কেউ কেউ মনে মনে ভাবছেন, 'বলিহারি বাপু, কালে কালে আরও কত কি যে দেখবো'। বিশ্বাস করুন, দিব্বি গেলে বলছি, আমিও অমনটা শুনিনি আগে। সে যাইহোক, দেখতে দেখতে মাস পাঁচেকেই এই আজগুবি গপ্পের সংখ্যা এখন ১৮ হয়েচে, খান ১৯ কবিতা, ১০ টা অনুপদ্য আর ৮টা প্রবন্ধ নিয়ে মলাটের গাড়ি এখন দিব্যি গড়গড়িয়ে চলচে। ব্লগ ভিউয়ের সংখ্যাও প্রায় ছ হাজার ছুঁই ছুঁই করচে। আহ্লাদে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো না হলেও মন্দ নয়, কি বলুন ! তাই আগাপাশতলা চিন্তা করে ভাবলুম একটা জুতসই লোগো তৈরী করি বরং, যার মধ্যে ব্লগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও সর্বোপরি বাঙালীয়ানাটা শোভা পাবে।      

একটা গান মনে পড়ে যাচ্ছে এই প্রসঙ্গে। 'দুনিয়া মে লোগো কো ধোঁকা কভি হো যাতা হ্যায়'.........
আর ঠিক এই কারণেই যাতে ধোঁকার ডালনা দিয়ে ভাত না খেতে হয় তাই এই লোগোর আবির্ভাব। যদ্দুর মনে হয় 'মলাট' নামে কোনো বাংলা ব্লগ নেই, তবু সাবধানের মার্ এড়িয়ে ব্রাউন পেপারের মোড়কে লোগোতে যে শুঁড় পেঁচানোর আদিখ্যেতাটি করেছি তা একরকম বাধ্য হয়েই, কতকটা এক শিল্পী বন্ধুর চাপে। এরকমটা না করলে নাকি লেখার সাথে ঠিক খাপ খাবে না ব্লগের বিন্যাস। একরকম প্রায় জোর করেই মলাটের জামাটা বানিয়ে ছাড়লে। অগত্যা তৈরী হলো ব্লগের বাদামী ব্যঞ্জনা। কাঁপা কাঁপা হাতে গোটা আর্টওয়ার্কটা বানালেও, মূলভাবনায় সূক্ষ্ম তুলির যে শেষ টানটা দিয়েছে প্রিয়ম এটা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। আর তাই প্রিয়মের সৃজনশীলতাকে ধন্যবাদ ও কুর্নিশ। বাকি, নতুন কাঠামোয় 'মলাট' কেমন লাগছে জানাবেন। আপনাদের  মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
আর..................শুভ শারদীয়া।

মূলভাবনা : প্রিয়ম বিশ্বাস
অলংকরণ : নিজস্ব      


#bengaliarticles #logo #bengaliwriteups

Sunday, October 2, 2016

আশ্বিনের পুজো

দেখতে দেখতে এসে গেলো। আকাশ জুড়ে তুলতুলে মেঘের জলছবি আঁকা হয়ে আছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। মনছুপছুপ ভিজে হাওয়ায় শহর জুড়ে খুশির মন্তাজ। অসীম ব্যস্ততার ফাঁকেও পাড়ায় পাড়ায় আবাহনের সঙ্গীতে মুখর ছোট বড় প্যান্ডেলগুলো। সারা বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর উৎসবের আমেজে তাথৈ নেচে উঠছে কচিবুড়ো সকলেই। এমনটা হলেই যেন বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করতে থাকে। কতকটা যেন সুখবর পাওয়ার অপেক্ষায় আস্তিনের খুঁটটা খামচে ধরে চেয়ে থাকার মতো। আর মাত্র কটা দিন। তারপরেই ঢাক আর কাঁসর ঘন্টার মেজাজী গুঞ্জনে কেঁপে উঠবে রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামটাও। ধুপ ধুনোর গন্ধে ম ম করবে বাঙালীর দিন পাঁচেকের শান্তির অবকাশ। পুজো আসছে........

পুজোর ছুটিতে কলকাতার জনসমুদ্রে গা ভাসাবার পরিকল্পনা করছেন এখন অনেকেই। কোন মণ্ডপটা ভোর ভোর ঢুঁ মারতে হবে আর কোনটায় রাতের নক্ষত্রে চোখ সার্থক হবে তার কলরব এখন কান পাতলেই দিব্যি পাওয়া যাবে। যাঁরা দুদণ্ড শান্তির খোঁজ করছেন অন্য কোথাও, তাঁরা হয়তো এতক্ষনে একটা একটা করে জামা কাপড় ভরছেন ব্যাগের মধ্যে, টিকিট তো তিন মাস আগেই কাটা হয়ে গেছে। যাঁরা বলছেন, 'ওরেব্বাবা এই ভিড়ে রাস্তায় ? রক্ষে করো !', তাঁরা মিনে করা ধুতি পাঞ্জাবি বা জমকালো শাড়িতে চালচিত্রের মতো এমাথা থেকে ওমাথা আলো করে বসবেন চাঁদের হাটে। ঢালাও খিচুড়ি ভোগ আর বেগুন ভাজা চাটনির জিভে জল আনা রন্ধনশৈলীর মশলা চেটে দেখছেন হয়তো অনেকেই মনে মনে। লাস্ট মিনিট সাজেশনের মতো কেউ আবার নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট, হাতিবাগানে চত্ত্বরে, কোমরের বেল্ট, পায়ের চটি, মাথার ক্লিপ, গলার পোড়ামাটির হার, শাড়ির ফলস-পিকো, চশমার ফ্রেম, জিন্স কাটানো, ইত্যাদি টুকিটাকি কাজ সেরে রাখছেন। শেষবেলার শপিং এর আঁচে দোকানিরা সেঁকে নিচ্ছেন কাস্টমারের ফরমায়েশী উত্তেজনা। পুজো আসছে........

যাঁরা রাজ্যের বা দেশের বাইরে আছেন তাঁদের জন্য জানলার গরাদে পড়ছে কতশত উৎসুক মুখের ছায়া। অপেক্ষায় আর উৎকণ্ঠায় নিস্পলক তাকিয়ে আছেন আপনজনের ফিরে আসার পথে। জাঁকজমকের পরিবেশের ফাঁকে ব্যস্ত ফোনের এপার থেকে শুনে নিতে চাইছেন পরম আত্মীয়ের ঘরে ফেরার আশ্বাস। যাঁরা ফিরছেন তাদের ঘরে জ্বলে উঠছে হাজার তারার রোশনাই। যাঁদের ফেরার উপায় নেই তাঁরা দূরভাষের উত্তাপে ছুঁয়ে নিচ্ছেন একে অপরকে, নিঃশ্বাসে ভরে নিচ্ছেন বোধনের মিঠে ঘ্রান। বহু দূর থেকেও হাত জোর করে মায়ের পায়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন বেলপাতা তুলসী দুব্বোর প্রণামী ফুল। ভক্তিভরে আউড়ে নিচ্ছেন 'যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতাঃ, নমস্ত্যশৈ নমস্ত্যশৈ, নমস্ত্যশৈ নমো নমঃ'। বিভিন্ন দুর্ঘটনা জনিত কারণে যাঁদের পুজো খানিক হলেও ম্লান, শিউলি ফুলের টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ মঙ্গলশাঁখের মতো তাদের কানেও বাজছে। বাকি সকলের মতো উচ্ছাসের স্রোতে গা না ভাসালেও আশ্বিনের শারদ প্রাতে ঘুমজাগানিয়া রোদের উষ্ণতায় তাঁরাও স্নাত হবেন। এমন নানাবিধ ঘটনার পঞ্চপ্রদীপ জ্বলবে শহর, গ্রাম, মফস্বল জুড়ে।

তবু, পুজো আসছে......আর এমন করেই পুজো আসে প্রত্যেক বছর। শারদীয়ার পুণ্যিপুকুরে এমন করেই ধুয়ে যাবে সারা বছরের হতাশা, গ্লানি, বিদ্বেষ আর বিষাদের ধুলোমাটি। লক্ষ কোটি মানুষের অস্থিমজ্জায় গেঁথে যাওয়া একটা উৎসবের চাঁদোয়ায়, কিছুদিনের জন্য হলেও, ঢাকা পড়ে থাকবে ব্যক্তিগত রোষ, শত্রুতা, বিরোধ, বৈপরীত্য। দিকে দিকে বেজে উঠবে আলোর বেণু, ভুবন জুড়ে ফুটে উঠবে সর্বজাতি সর্বধর্মের হৃদকমল। সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমীর চড়ুইভাতিতে পাত পড়বে বাঙালী অবাঙালীর একসাথে। পাশাপাশি আসনে প্রসাদী ফলে কামড়  বসাবেন আস্তিক নাস্তিক দু তরফেই। চন্ডীপাঠের স্তোত্র আকাশ বাতাস ফুঁড়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়বে গুঁড়ো আবিরের মতো, মানুষের মনে যার রেশ থেকে যাবে বিসর্জনের পরেও।

পুজো আসছে............যাঁদের 'আসছে' শব্দটায় বুক কাঁপে, যাঁরা 'আসছে' শব্দটার দিকে তাকিয়ে থাকেন সারা বছর তাঁরা জানেন পুজো আসবে..... এমনি করেই...... বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, যতদিন না পৃথিবীর শেষ আসে, ততদিন পর্যন্ত মহামায়ার পদধ্বনি শুনতে পাবো মননে, স্বপনে, প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে কারণ আমরা যে চাই জাগ্রত, জ্যোতির্ময়ী, জগন্মাতার আবির্ভাব ঘটুক, কারণ আমরা যে সকলেই অপেক্ষায় থাকি 'মা'................ 


চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব
#bengaliarticles #durgapujadiaries #bengalipujawriteups #durgapuja 

Tuesday, September 27, 2016

সাপ্তাহিকী ১৮ # রত্নাকর - অন্তিম পর্ব

পরদিন সকালে নিয়মমাফিক বাজারের থলি হাতে বেরোয় রতন। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকে, দুচারজন পথচারী কুশল প্রশ্ন করে, সেসব কান অবধি পৌঁছয় না তার। ভারী অবাক হয় লোকজন। প্রাণোচ্ছল রতনের গুম হয়ে থাকার কারণটা বুঝতে পারে না অনেকেই। পাড়ার চায়ের দোকানে যার গলা পাওয়া যেত সবার আগে, আজ সে চা না খেয়েই চায়ের দোকান পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কোথা থেকে পাড়ার কচি ছেলের দল হৈ হৈ করে এসে পথ আটকায় রতনের, বলে, 'কি গো রতন দা, কাল তো তুমি আর এলেই না, আমরা তো মাঞ্জা, টাঞ্জা দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আজ কিন্তু তোমাদের ছাত থেকেই ঘুড়ি ওড়াবো। আমরা সকাল সকাল রেডি হয়ে গেছি'। মৃদু হাসে রতন, বলে, 'বেশ তো, তোরা ঘুড়ি লাটাই নিয়ে যা, আমি বাজারটা সেরে আসছি'। ছেলেদের দল নাচতে নাচতে চলে যায়।

গলির বাঁক ঘুরতেই সহসা দেখা হয়ে যায় সেই ভাড়াটে মহিলার সাথে। বাজার সেরে ফিরছে। রতন তাকে দেখেই গুটিয়ে যায় খানিক। মহিলা এক নজর তাকায় রতনের দিকে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় নিজের বাড়ির দিকে। রতন কোনোরকমে ঘাড় মুখ গুঁজে বাজার সেরে ফিরে আসে বাড়িতে। চটজলদি থলিটা নামিয়ে দিয়েই চেঁচিয়ে বলে, 'মা, বাজারটা রেখে গেলুম, আমি একটু ঘুরে আসছি'। জয়া হন্তদন্ত হয়ে বলেন, 'ব্যাস ! অমনি চললি তো পাড়া বেরোতে ? বলি কিছু অন্তত মুখে দিয়ে যা'। ভিতরের ঘর থেকে সুধাময় বলে ওঠেন, 'হুঁ, এমনি দিনে টিকি পাওয়া যায় না, আজ তো আবার বিশ্বকর্মা পুজো ! সারাদিন ধরে প্যাঁচ কষবে না ? বলিহারি যাই, কোথায় একটু রোজগারের চিন্তা করবে তা নয় প্যাঁচাতে ব্যস্ত, যত্তসব অকাল কুষ্মান্ড' !

মধ্যবিত্ত সংসারে পিতার ধৈর্যের অভাব ঘটে। ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তাঁর। সে কথা কানে যাওয়ার আগেই রতন পা বাড়ায় চায়ের দোকানের দিকে, কতকটা আনমনেই। আজ সকাল থেকে যেন কোনো কিছুতেই মন লাগছে না তার। এ গলি ও গলি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে খেয়াল হয় যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা চায়ের দোকান নয় মোটেই। সেটা নিবারণ গাঙ্গুলির বাড়ি। কি আশ্চর্য ! তার তো চায়ের দোকানে যাওয়ার কথা।

জটিল মনস্তত্ব। মনোবিদরা বলবেন, এমনটা তো খুব স্বাভাবিক, মানুষের মনে এমন বহু সূক্ষ্ম চিন্তার সঞ্চার হয় যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ এমন অনেক কাজ করে থাকে যার স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। তবে রতনের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া সত্যিই ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। স্থান কালের হিসেবে গুলিয়ে ফেলার ছেলে আর যেই হোক, রতন নয়। কিছুক্ষন সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে। তারপর চলে আসার জন্য যেই পা বাড়াতে যায়, অমনি বারান্দায় সেই ভাড়াটে মহিলাটি বেরিয়ে আসে। হাতে ভিজে কাপড় নিয়ে তারের ওপর মেলতে থাকে। হঠাৎ চোখাচোখি হয় রতনের সাথে। ভারী অপ্রস্তুত হয় রতন। মহিলা কাপড় মেলতে মেলতে খানিক থমকায়। রতন একছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, পারে না। মনে হয় কে যেন এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে রেখেছে গোড়ালি দুটো। কিছু না পেরে বোকার মতো হাসে, তারপর চোখ নামিয়ে নেয়। মহিলা ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে......
'আপনি কি কাউকে খুঁজছেন' ?
'কই..... না তো' ! তোতলাতে থাকে পাড়ার তেজী যুবক। পরক্ষনেই কিছুটা সাহসে ভর করে বলে, 'ইয়ে......মানে সেদিনকার জন্য.....আমি ভীষণ ................
'অনুতপ্ত......তাই তো' ? খেই ধরিয়ে দেন মহিলা।
'হ্যাঁ মানে ওই আর কি', আমতা আমতা করতে থাকে রতন, 'আসলে কিছু না বুঝেই এমন..............'
- চা খাবেন ?
- হ্যাঁ ???
- বলছি চা খাবেন ? জল চাপিয়েছি..... আশা করি দুজনের হয়ে যাবে.......

'না' কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনা, জিভ জড়িয়ে যায় রতনের। অপরিচিত নারীর অনুরোধ কোনো এক অজানা কারণে ফেলতে পারে না সে। ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি প্রদান করে। 'আসুন তবে', অপরিচিতা পথ দেখায়। পিছন পিছন বাধ্য ছাত্রের মতো ঘরে গিয়ে ঢোকে রতন। 'বসুন', একটা সোফার দিকে আঙুল দেখায় নারী। ঘরের চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে রতন। গোটা ঘর জুড়ে আধুনিকতার ছাপ না থাকলেও, যত্নের চিহ্ন স্পষ্ট। সোফার পিছনের দেয়ালে একটা ফটোফ্রেম, তাতে একটা ছোট মেয়ে শাড়ি পড়ে নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে একমনে দেখতে থাকে সে।
'আপনার চা', নারীকণ্ঠে সম্বিৎ ফেরে রতনের। চা নিয়ে একটু জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে। সুরুৎ করে এক চুমুক দিয়ে বলে, 'ওপরের এই ফটোফ্রেমটায় মেয়েটি কে' ?

মহিলা হেসে ফেলে। একমুঠো শিউলি ফুল ঝরে পরে যেন। সে হাসি কতকটা লজ্জার, কতকটা ধরা পড়ে যাওয়ার। সেদিকে অপলক চেয়ে থাকে রতন। যুবক হৃদয়ে হিল্লোল ওঠেবা হয়তো। সেদিন এতটা ঠাহর করে দেখা হয়নি। সাধারন বেশভূষায় আপাত কঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি নম্র দিকও আছে বটে। এমনিতে সুন্দরী না হলেও সুশ্রী বলা যেতে পারে। বিশেষত হাসলে পরে গালে টোল পড়ে । মহিলা সলাজ গলায় বলে, 'ওটা আমার ছোটবেলা। তখন নাচ শিখতাম' ।
- ওঃ আচ্ছা.........আপনি কি এখনো ........ ?
- না না, সেসব ছেড়ে দিয়েছি বহু বছর, সময় কোথায় এখন ?
- আপনি এখন কি করেন ? মানে মাপ করবেন..... অহেতুক কৌতূহল আর কি.......
- একটা মেয়েদের স্কুলে পড়াই, এছাড়া টুকটাক টিউশনি করি বাড়িতে।
- ওহ, আপনি তাহলে দিদিমণি ?
আবার শিউলি ফুল ঝরে পড়ে যেন একরাশ। রতনের বুক কেঁপে ওঠে। টোল পড়া হাসির মর্মার্থ তার মতো ব্রতচারী যুবকের পক্ষে বুঝে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
- তা একরকম বলতে পারেন........তবে এখানকার পাট বোধহয় চুকল। একমাস হল এসেছি, এরই মধ্যে যে আবার ঘর খুঁজতে হবে এমনটা বুঝতে পারিনি। আগে জানলে এখানে ভাড়া আসতাম না।
- হ্যাঁ, আসলে নিবারণ কাকা বড্ডো জেদ করছে, নাহলে এখানে কি আর অসুবিধে, তাই না ? এই পাড়াটা তো ভালোই .........
- আমার ধারণা উনি একজন ভালো প্রোমোটার পেয়েছেন, খুব সম্ভব এখানে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি হবে.......

চুপ করে থাকে রতন। এ খবর সে আগেই পেয়েছে। কোনো উচ্চবাচ্য করে না এ ব্যাপারে। শুধু বলে, 'তিন মাস সময় আছে তো, আপনি ঠিক একটা বাড়ি পেয়ে যাবেন ম্যাডাম'।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মহিলা, বলে, 'আসলে কি জানেন রতনবাবু, বাড়ি বদলানো যায়, ঘরের আসবাব বদলানো যায়, কিন্তু সংসার বদলানো, খুব একটা সহজ কাজ নয়। যে গাছের মাটি বারেবারে আলগা হয়, তার শিকড় আপনিই দুর্বল হয়ে পড়ে, সে খবর আমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে বলুন ?
এ কথার কি উত্তর দেবে, রতন ভেবে পায় না। পরিণয় যার হয় নি, পরিণতির করুণ আবেগ তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবুও মহিলার কথাগুলো বিষাদের বারিধারার মতো তাকে ছুঁয়ে যায়। সে বলে, 'আপনার যদি আপত্তি না থেকে তাহলে আমি বাড়ির ব্যাপারে চেষ্টা করতে পারি'।

- আপনি আর কতটুকু করবেন রতনবাবু, আজকের দিনে সস্তায় বাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আর তাছাড়া হুট্ করলেই তো আর ভাড়া দিচ্ছে না কেউ।
- সেটা আমি দেখে নিচ্ছি। প্রথমত, আপনি প্লিজ বাবু বাবু করবেন না, আমায় নাম ধরেই ডাকতে পারেন।
মহিলা মৃদু হেসে বলে, 'আচ্ছা বেশ........ তবে আপনার ভালো নাম........একটা আছে নিশ্চই.......'
- হ্যাঁ........ শ্রীযুক্ত রত্নাকর ঘোষ।
'ওরেব্বাবা, একেবারে রত্নাকর ! আপনি কি দস্যু নাকি' ! বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে আপাতকঠিন রমণী। রতন ভারী লজ্জা পায় সে কথায়। মাথা নামিয়ে মুচকি হাসে। এমন সময় কোথা থেকে একটি ছোট্ট ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে ঘরে। মহিলা কোলে তুলে নেয় তাকে। রতনকে দেখিয়ে বলে, 'এই আমার বিট্টু......., আমার স্বপ্ন'। রতন সামান্য আদর করে দেয় বিট্টুকে। তারপর বলে, 'আজ তাহলে আসি ম্যাডাম, ওদিকে আবার পুজোর কিছু কাজ আছে, যাই একটু সামলে দিই গে। আর বাড়ির ব্যাপারে আমি খোঁজ লাগাচ্ছি, অবশ্য আপনার যদি এতে আপত্তি না থাকে'। মহিলা স্মিত হেসে বলে, 'আপত্তি আছে বৈকি, তবে ওই ম্যাডাম কথাটায়। আপনি আমায় পল্লবী বলে ডাকতে পারেন'। রতনের বুকের ভিতর যেন দুম দুম করে হাতুড়ি পিটতে থাকে কেউ। 'আচ্ছা', বলে একছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

কয়েক মাস কেটে যায়। ঋতুর পরিবর্তন হয়...... মনেরও। পল্লবীর বাড়িতে রতনের যাওয়া আসা বাড়ে। টুকটাক চা পর্ব, বিট্টুকে নিয়ে পার্কে বেরোনো, একটা দুটো করে বাড়ির খোঁজ আনা, খোলা আকাশের মেঘের মতো দুটো ঘুড়ি ভেসে বেড়াতে থাকে সেসব আপন খেয়ালে। সেসময় এখনকার মতো ছিল না। কার উনুনে কতটা ভাত সেদ্ধ হলো, কার আঁচে কতটা তেল পুড়লো সে খবর পাড়াসুদ্ধু লোক জানতো। গন্ধ শুঁকে বলে দেওয়া যেত কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে। আর মুচমুচে পদ হলে তো কথাই নেই। একেবারে উল্কার গতিতে রাষ্ট্র হতো সেসব। দুপুরের আড্ডা হোক বা সন্ধ্যার জমায়েত, টাটকা পঞ্চায়েতিটা না করলে পেটের ভেতরটা যেন গুড়গুড় করতো সবার। সেখানে রতনের বাড়ি খোঁজার উৎসাহটা যেন বেশি করে চোখে পড়তে লাগলো পাড়ার লোকেদের। ফিসফাস, কানাকানি শুরু হলো পাল্লা দিয়ে।

সেসব কথা নিবারণ গাঙ্গুলির বাড়ি অবধি পৌঁছতে বেশি দেরি হলো না। উঠতে বসতে পল্লবীকে খোঁচা দিতে শুরু করলেন তিনি। একদিন বলেই ফেললেন, 'এসব নষ্টামো আমার বাড়িতে চলবে না। এ পাড়ায় ভদ্র পরিবারের বাস। পত্রপাঠ বিদেয় হও.........' ইত্যাদি। পল্লবী কান পেতে শোনে সেসব। প্রত্যুত্তর দিতে রুচিতে বাধে তার। সামাজিক কাঁটাতারের জালে জড়িয়ে গিয়ে ছটফট করতে থাকে। বাধ্য হয়ে রতনকে ডেকে পাঠায় একদিন বিকেলে। পাড়ার বাইরে, একটু দূরে, নিরিবিলিতে। একটা বেঞ্চির ওপর বসে দুজনে।

'আপনাকে স্পষ্ট করে কতগুলো কথা বলতে চাই রতন। আপনি কি ভাবে নেবেন আমি জানি না, তবু কথাগুলো বলা খুব প্রয়োজন আমার', থেমে থেমে কথাগুলো বলে পল্লবী।
রতন ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কিছু হয়েছে ?..... মানে আপনাকে এতো অস্থির লাগছে আজ'। সে কথার উত্তর না দিয়ে পল্লবী একটু রূঢ় স্বরে বলে, 'আজ থেকে আপনাকে আর বাড়ি খুঁজতে হবে না আমার। যেমন করেই হোক আমি নিজেই একটা বাসস্থান ঠিক খুঁজে নিতে পারবো বলে মনে হয়। আপনি এতদিন যে চেষ্টা করেছেন, সেজন্য যথেষ্ট ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। তাই আমার অনুরোধ, আপনি শুধুশুধু কষ্ট করে আমাকে আর পাপের ভাগী করবেন না' ।

রতনের মুখটা পাংশু হয়ে যায়। সে কোনোরকমে আমতা আমতা করে বলে, 'আমি জানি পল্লবী, আপনি কেন এই কথাগুলো বলছেন। লোকজনের কথায় কান দেওয়ার তো কোনো দরকার নেই আমাদের। যারা এসব আলোচনা করছে তাদের মুখ কি করে বন্ধ করতে হয় সে আমার জানা আছে। আর বাড়ি খোঁজার যে কষ্টটা বলছেন সে নাহয় একটু করলুমই, সে আর এমন কি। তবে আপনি কি করে পাপের ভাগী হচ্ছেন সেইটে ঠিক বুঝে উঠতে পারলুম না'।  

পল্লবীর গলা বুজে আসে কথা বলতে গিয়ে। ডুবন্ত প্রাণীর কাছে খড়কুটোর অবলম্বনটাই নতুন করে বাঁচার হাতছানি দেয়। হাত বাড়িয়ে যখন সেটুকুও নাগালের মধ্যে আসে না তখন আপনিই মৃত্যু হয়, আলাদা করে আর ডুবতে হয় না। সে কথা রতনকে বোঝায় কি করে পল্লবী। ঠোঁট কামড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে অচিরেই। হৃদয়ের কানাগলিতে অবদমিত কষ্টের প্রতিধ্বনি হতে থাকে। সে আবেগের কিছুটা রতন আঁচ করতে পারে। বলাই বাহুল্য রতনের পক্ষ থেকেও অনুরূপ আবেগের খামতি ঘটে নি কখনই । সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, 'সামাজিক দায়ভার যতটা আপনার, আমারও ততটাই। পিছিয়ে যাওয়ার মতো মানসিকতা নিয়ে আমি এগিয়ে আসিনি পল্লবী। সবার মাঝখানে সেকথা বলার মতো যথেষ্ট সাহসও আমি রাখি। আমি মনে করি, সামাজিক নিয়মে উপযুক্ত সম্মান আপনার পাওয়া উচিত এবং সে প্রাপ্য সম্মান দিতে আমি কখনই পিছপা হবো না। অবশ্য আপনার অনুমতি নিয়েই। আপনি যদি সম্মত হন তাহলে আমি বাড়িতে কথা বলতে পারি'। পল্লবীর গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সূর্যাস্তের আলোয় চোখ মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে। কোনোমতে বলে, 'আমি জানি সে আপনি পারবেন, কিন্তু............

'না', দৃঢ়তা ফুটে ওঠে রতনের গলায়, 'আর কোনো কিন্তু নয় পল্লবী, আমি যদি এতটুকুও কাছে আসতে পারি আপনার, সে আমার ভাগ্য। আর তার জন্যে যেটুকু অধিকার জন্মেছে আপনার প্রতি সেই অধিকার বোধ থেকেই বলছি আপনার ও বিট্টুর দায়িত্ত্ব নিতে রাজি আছি আমি, আমায় শুধু একটু সময় দিন', কথাগুলো বলেই হনহন করে হাঁটা লাগায় রতন। দমকা হাওয়ায় এলোমেলো চুল উড়তে থাকে, এক দস্যুর মতোই লাগে যেন রতনকে। পল্লবী অপার অনুরাগে চেয়ে থাকে সে দিকে। সেই দস্যুর প্রতি অমোঘ টান অনুভব করতে থাকে মনে মনে। কিন্তু কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম কাঁটাও বিঁধতে থাকে খচখচ করে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই রতন, পল্লবীর কথাটা পাড়ে বাড়িতে। সুধাময়ের মুখ পলকে থমথমে হয়ে যায়। জয়া ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সন্তানের নিশ্চিত অবনমনটা যেন চোখের সামনে দেখতে পান দুজনেই। তার পরে পরেই ভেসে ওঠে পারিবারিক মর্যাদার কথা। সামাজিক অস্তিত্ব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার চিত্রটা কল্পনা করে মনে মনে শিউরে ওঠেন সুধাময়। ছেলের কচি মাথাটা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য জয়া একনাগাড়ে শাপ শাপান্ত করতে থাকেন পল্লবীকে। রতনের সমস্ত চেষ্টাই বিফলে যায়। ঐতিহ্যবাহী ঘোষবাড়িতে কলঙ্কের কালি লেপে দিয়ে যাবে কোনো এক অজ্ঞাত কুলশীল বিবাহবিচ্ছিন্না, একথা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না দুজনে। তেমন তেমন হলে রতনকে যে ত্যাজ্যপুত্র করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না একথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন সুধাময়।

সমস্ত রাত ভাবতে থাকে রতন। একদিকে ঘোষবাড়ির সম্মান অন্যদিকে হৃদয়। অসম অনুপাতের দরুন সম উচ্চতায় আসে না দুটোর কোনোটাই। মূল্যবোধের দাঁড়িপাল্লায় হৃদয়ের দিকেই ভার হয় বেশি। মনে মনে তার আগামী পদক্ষেপ ঠিক করে নেয় সে। খুব তাড়াতাড়ি একটা বাড়ি জুটিয়ে ফেলতে হবে, আর তারপরেই একটা কাজ। ভবিষ্যতের পথচিত্রটা এঁকে ফেলতে হবে দ্রুত। মনের সমস্ত জড়তা কাটিয়ে ফেলতে সময় লাগে না তার। এই সিদ্ধান্তের কথা পল্লবীকে গিয়ে না বলা অবধি সে অস্থির হয়ে ওঠে। পল্লবীর সাথে তার জীবনের গ্রন্থিগুলো বাঁধা পড়বে আর কিছু দিনের মধ্যেই, এটা ভেবেই ভিতরে ভিতরে চাপা সুখ অনুভূত হয়। পরম পাওয়ার উৎকণ্ঠায় সারারাত প্রায় জেগেই কাটিয়ে দেয় রতন ।

পরদিন সকালবেলাই বেড়িয়ে পড়ে তড়িঘড়ি। সুধাময় আর জয়ার সমস্ত রকম বারণ অগ্রাহ্য করে পল্লবীর বাড়ির দিকে ছুটে যায় সে। যে নদী জোয়ারের টানে এতকাল পর তার চলার পথ খুঁজে পেয়েছে তাকে আটকায় কার সাধ্য ! খানিক দূর যেতেই ছোটুর সাথে দেখা হয়। হন্তদন্ত হয়ে সে এসে বলে, 'রতন দা, তোমার জন্য একটা চিঠি আছে' । 'চিঠি ? কে দিলে' ? ভারী অবাক হয় রতন।
- নিবারণ কাকাদের বাড়ির দিদিমণি, এই চিঠিটা তোমায় দিতে বললেন.........
রতন ব্যস্ত হয়ে চিঠির ভাঁজ খোলে, তাতে লেখা আছে............

দস্যু,
কিছু কথা সেদিন বাকি ছিল। সবটা বলা হয়ে ওঠেনি, সবটা বলতে পারিনি। আজ বলি বরং।
গ্রাজুয়েশনের পর পরই আমার বিয়ে হয়। মধ্যবিত্ত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভার লাঘব করি অনেক অল্প বয়েসেই। সেসময় বিয়ে করার মতো মানসিক ভাবে তৈরী না থাকলেও একরকম ভবিতব্য জেনেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। অন্যান্য নব্য গৃহিণীদের মতো আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম এক পরিপূর্ণ সংসারের। নিজের ব্যক্তিগত ছোট বড় আকাঙ্খা গুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছিলাম আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের চাহিদার সাথে। নানা রকম সাধ পূরণের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেসময়। ধীরে ধীরে যত দিন গড়িয়েছিল, বুঝতে পেরেছিলাম দম দেওয়া পুতুলের ভূমিকা পালন করা ছাড়া তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা আমার নেই সে বাড়িতে। অথচ আমি আমার কর্তব্যে গাফিলতি করিনি। স্বামীকে ভালোবেসেছিলাম প্রাণ দিয়ে। প্রতিদানে তাঁর লাঞ্ছনা ও বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সাক্ষী থেকেছি শুধু। প্রত্যাশিত ভাবেই শুরু হয় অবহেলা আর অনাদর। সংসারের ঘানিতে পিষে যেতে থাকে আমার আত্মসম্মান, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। মনে মনে ঠিক করি এই অসম্মানের ছাতের তলায় আর নয়। চরম প্রতিকূলতায় যখন বি এড পাশ করি তখন বিট্টু আমার পেটে। সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসি শ্বশুর বাড়ি থেকে। বছরখানেক বাদে ডিভোর্স হয় আমাদের। ছেলেকে বাপের বাড়িতে রেখেই মানুষ করতে থাকি। বি এড টা থাকার ফলে এই স্কুলটায় চাকরি পেতে অসুবিধে হয়নি। বাবা মার গলগ্রহ হতে চাইনি বলেই আলাদা থাকি তারপর থেকেই। এই পাড়ায় এসে তোমার সাথে আলাপ হলো। আমাদের প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম তোমার মনটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ।রেকাবিতে সাজানো পুজোর ফুলের মতোই পবিত্র তুমি। তোমার অভ্যাসে অনভ্যাসে যে শিশুসুলভ সারল্যের আভাস পেয়েছিলাম তাতে বড় মুগ্ধ হই, জানো। তোমার মনের আয়নায় নিজেকে স্পষ্ট দেখেছিলাম যেদিন, সেদিন আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম নতুন করে ছাউনি বাঁধার, আবার করে সাজাতে শুরু করেছিলাম আমার সাধের মঞ্জিল। আমার বর্তমান পরিস্থিতি জেনেও যখন আপন করে নেবার সিদ্ধান্ত নিলে তখন থেকেই তোমাকে উচ্চ আসনে বসিয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর আমাদের পথ আলাদা করে রেখেছেন। হৃদয়ের সুর একই তারে বাঁধা হলেও সে কখনোই সঙ্গীত হয়ে উঠবে না সে আমি জানি। বড় স্বার্থপর আমি রতন, বড় স্বার্থপর। শুধু নিজের কথাটাই ভেবে গেছি...... তোমার পরিণতির কথা মনে হয়নি একবারও। আমার কাছে তোমার মাথা উঁচু হলেও, তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজনের কাছে যে খুব ছোট হয়ে যাবে তুমি, সেকথা ভুলে গেছিলাম। তোমার বাড়িতে যে আমি অপাংক্তেয় তা কি আমি আন্দাজ করতে পারিনি ভাবছো ? আমি জানি সেসবের তুমি পরোয়া কর না। কিন্তু যাঁরা তোমায় জন্ম দিলেন, যাদের কোল ঘেঁষে তুমি বড় হলে, যাদের সাথে সময় কাটালে তাদের কথা একটিবারও ভাববে না তুমি ? দুদিনের আলাপ তোমার নিকট আত্মীয়ের থেকে আজ এতো বড় হলো ? সে অপবাদ যে আমি সইতে পারবো না......... তাছাড়া আমি ঘরপোড়া গরু, আমার দুর্ভাগ্যের আকাশে যে সিঁদুরে মেঘ দেখা দেবে না তা কি কেউ বলতে পারে। সে ঘটনা যদি আবার ঘটে তাহলে যে তোমার পল্লবীর মৃত্যু হবে রতন। তুমি কি তাই চাও ? আমায় যদি এতটুকুও ভালোবেসে থাক, শপথ কর তুমি বাড়ি ছাড়বে না, কখনোই, কোনো অবস্থাতেই। জেনো তবেই আমি শান্তি পাবো........

এ চিঠি যখন তুমি পাবে তখন আমি বর্ধমানের পথে, ওখানকার একটা স্কুলে এপ্লাই করেছিলাম, মঞ্জুর হয়েছে। তাই একরকম মনস্থির করে বেরিয়ে পড়লাম। আমি জানি তুমি ঠিক ক্ষমা করবে আমায়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি রত্নের মতো উজ্জ্বল থেকো এমনই......চিরটাকাল। তোমায় চেয়েছি একথা সত্যি, কিন্তু তোমার বিসর্জন দিয়ে নয়...........

ইতি
তোমার........  

ছবি : গুগল 
#bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories #love #romance #separation #drama

Friday, September 23, 2016

সাপ্তাহিকী ১৭ # রত্নাকর - প্রথম পর্ব

করিৎকর্মা বলে রতনের বেশ সুনাম আছে পাড়াতে। ছোট, বড়, মাঝারি, যে কোনো মাপেরই কাজ হোক, রতনের জুড়ি মেলা ভার। জলের পাইপ ফেটেছে, রতনকে ডাকো, বাড়ির কার্নিশ ভেঙে পড়েছে, রতনকে চাই, গলির মোড়ে একহাঁটু জল, রতনকে খবর দাও, এমন বিবিধ কাজে রতন ছাড়া গতি নেই। সময়মতো লোক ডেকে, দাঁড়িয়ে থেকে এমন নিঁখুত করে কাজ উতরে দেবে যে দ্বিতীয়বার আর তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না। আর এসমস্ত কাজে রতনের উৎসাহও যেন চোখে পড়ার মতো। যেন তার জন্মই হয়েছে পরোপকার করতে। অবশ্য পাড়ার মানুষও যে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে রতনকে সেটা না বললে অবিচার করা হয় বৈকি। প্রায় সমস্ত বাড়ির হেঁশেল অবধি তার অবাধ যাতায়াত। কচি পাঁঠার ঝোল, ইলিশ মাছের  পাতুরি, পৌষের পিঠেপুলি, নবান্নের পায়েস, রতনকে না খাইয়ে তৃপ্তি হয় না কারোর। এদিকে রতনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার বাবার চিন্তার অন্ত নেই। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় যখন দুবারেও উৎরানো গেলো না, তখন রতনের বাবা বাধ্য হয়ে বললেন, 'থাক বাবা, অনেক হয়েছে, ও তোমার কম্মো নয়, তার চেয়ে বরং আমার কাপড়ের দোকানে সময় দাও, আমার একটু সুরাহা হয় তাতে'। সেকথায় কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেনি সে, উল্টে সমাজসেবার পুস্করিণীতে নিমজ্জিত প্রাণ রতনের মনে হয়েছে এসমস্ত গুরুত্বহীন কাজ আর যার হোক, তার জন্য নয়। এই জটিল ভবসংসারের মায়ায় আচ্ছন্ন না হয়ে মানবসেবাই একমাত্র সঠিক ব্রত বলে মনে হয়েছে তার। অবশ্য তার এই ব্রতচারী স্বভাব পাড়ার অল্পবয়সী মেয়েদের চোরা চাউনিগুলোকে কখনোই ঠেকাতে পারেনি। তার যথাযথ কারণ ছিল যদিও। দারুন সুদর্শন না হলেও, বছর আঠাশের রতন ব্যায়ামনিষ্ঠ ছিল বেশ। চওড়া ছাতি, বাইসেপ ট্রাইসেপ ধারী, গৌরবর্ণ রতন যখন শার্টের হাতা গুটিয়ে রাস্তায় বেরোতো, তখন পিছন ফিরে দেখত না এমন মানুষ খুব কমই ছিল। পাকানো গোঁফের আড়ালে শিশুসুলভ হাসিতে ঘায়েল হয়ে যেত অষ্টাদশী থেকে চল্লিশোর্ধ সকলেই। সেসকল গোপিনীদের দৃষ্টিকে হেলায় উপেক্ষা করার মতো কলজের জোর রতনের ছিল যথেষ্ট। সব মিলিয়ে পাড়ার মধ্যে বেশ একটা শান্তির বাতাবরণ ছিল। চোর টোর পারতপক্ষে ঘেঁষতো না সে পাড়ায়, কারণ সকলেই জানতো রতনের কাছে উত্তমমধ্যম খেলে উঠে দাঁড়ানো বেশ কষ্টকর হবে।

এহেন আপাত শান্ত পাড়ায় অকস্মাৎ কোথা থেকে যেন অশান্তির মেঘ ঘনিয়ে এলো। যে সময়ের কথা বলছি সেটা আশির দশকের শুরু। চারিদিকে তখন এতো ফ্ল্যাটবাড়ির রমরমা হয়নি। পাড়া সংস্কৃতির সমস্ত রকম চিহ্ন সর্বত্র বিদ্যমান। কালীপুজো দুর্গাপুজোর চাঁদা থেকে শুরু করে, রকে বসে আড্ডা মারা, দেওয়াল লিখন বা চায়ের দোকানে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের তুফান পর্যন্ত বেশ যত্ন সহকারে কালচার হতো। সেবার বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন রতন তার কচি সাগরেদদের নিয়ে মোড়ের মাথায় খুব দায়িত্বভরে মাঞ্জা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে, এমন সময় ছোটু দৌড়োতে দৌড়োতে এসে বললে, 'রতন দা, শিগগির চলো, বিষ্টুদের বাড়িতে ভারি ঝামেলা হচ্ছে'। 'কেন কি হচ্ছে ?' মাঞ্জা দিতে দিতেই রতন জিজ্ঞেস করে। 'সবটা জানিনা, তবে লোক জড়ো হয়েছে খুব, আর নিবারণ কাকা খুব তড়পাচ্ছে', হড়হড় করে সমস্তটা উদ্গীরণ করে ছোটু। 'আচ্ছা চল দেখি, বাকিরা এখানেই থাকিস, আমি এসে আবার দেবখন' , বাকিদের হাতে মাঞ্জার গুরুভার সোঁপে দিয়ে ছোটুর সাথে এগিয়ে যায় রতন।

নিবারণ গাঙ্গুলি, পেশায় সরকারী কর্মচারী, পেশার খাতিরে রাইটার্স বিল্ডিংএ যাতায়াত আছে বেশ। কথায় কথায় অমুক মন্ত্রী তমুক মন্ত্রীর উল্লেখ করে থাকেন যত্রতত্র। পাড়ার লোকেও তাকে বেশ সমঝে চলে। যথোপযুক্ত ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক, আইনি শলাপরামর্শ করতে অনেকেই সন্ধের দিকে ওনার বাড়িতে জড়ো হন। সুতরাং এ নিয়ে তাঁর গুমোরটাও বেশ চোখে পড়ার মতো। নিবারণের বড় তেতলা বাড়ি, বাড়ির দুতলায় আর তিনতলায় স্ত্রী পুত্র নিয়ে ভাগাভাগি করে থাকেন। একতলাটা এক বিবাহ বিচ্ছিন্না যুবতী মহিলা ও তাঁর তিন বছরের সন্তানকে ভাড়া দিয়েছেন সম্প্রতি। বেশ কয়েকদিন হলো এক প্রোমোটারের সাথে কথাবার্তা চলছে। বাড়িটা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে একটি নতুন আবাসন তৈরী হবে, তাতে শুধু দুটো ফ্ল্যাট নয় সঙ্গে বেশ কিছু নগদ আমদানি হবারও প্রভূত সুযোগ রয়েছে। সবই ঠিক ছিল, মাস দুয়েকের মধ্যেই কাজ শুরু হবার কথা, কিন্তু বাধ সেধেছে ভাড়াটে মহিলাটি। কিছুতেই সে বাড়িটা ছাড়তে রাজি হচ্ছে না।

রতন গিয়ে পৌঁছয় সেখানে। সামনের দিকটা জটলা হয়েছে বেশ। এ এক চেনা পরিবেশ। মধ্যবিত্ত পারিবারিক সমস্যা অধিকাংশ সময়ই অল্প কিছু কালের পরই কেমন সার্বজনীন হয়ে ওঠে। অযাচিত দর্শকের ভূমিকা পালন করা তদুপরি উপদেশ দেওয়াটা এক ভীষণ রকম কর্তব্যের মধ্যে পড়ে তখন। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় রতন। একতলার একফালি দালানের ওপর দাঁড়িয়ে নিবারণ গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করছেন , 'এ বাড়ি আমার, আমি কখন কাকে থাকতে দেব না দেব সেটা আমার ব্যাপার, রাইটার্সে গিয়ে সমস্ত হেস্তনেস্ত করে আসব' ইত্যাদি। ভাড়াটে মহিলাটি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, পরণে একটি গেরস্থালি তাঁতের শাড়ি, অনাড়ম্বর মুখে বিরক্তি ও কুণ্ঠার ছাপ। সে দিকে একনজর দিয়ে রতন জিজ্ঞেস করে, 'কি ব্যাপার নিবারণ কাকা ? এই সাতসকালে হল্লা কিসের ?'

'এই যে রতন......... এর একটা বিহিত করো তো বাপু !, বলি আমার বাড়ি, আমার ভাড়া, আগে ভাড়াটে থাকতে দিয়েছি, এখন আর দেব না, ব্যাস। অথচ ও কিছুতেই নড়বে না ? একি হুজ্জতি রে বাবা ! এখন দেখছি ভাড়া দেওয়াই কাল হলো আমার' ! এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেন নিবারণ। রতন মহিলাটির দিকে তাকায়, চোখেমুখে একটা তালেবর ভাব এনে বলে, 'ঠিকই তো, আপনি যেতে চাইছেন না কেন, ব্যাপারটা কি, পরিষ্কার করে বলুন দেখি' ?

'আপনি' ? খুব শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে পরিচয় জানতে চান মহিলাটি। রতন থতমত খেয়ে যায়, এভাবে কেউ কখনো প্রশ্ন করেনি আগে, বলা ভালো করার সাহস পায় নি। তাছাড়া রতনকে চেনে না বা জানে না আশেপাশের কোনো পাড়াতেই এমন কোনো ঘরের বাস নেই। সেখানে সবার সামনে একটি অপরিচিত মহিলার প্রশ্নবাণ একেবারে ফলার মতো মতো গিয়ে বেঁধে রতনকে। বেচারা হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর দ্রুত সামলে নিয়ে বলে, 'আমি রতন...........এ পাড়াতেই থাকি, দেখেছেন বোধহয়'।

'নাহ', মহিলা নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয়। অমন বেপরোয়া উত্তরে সামান্য দমে যায় রতন। তবু গলা পরিষ্কার করে আরও একবার বলে, 'আপনি ভাড়াটে, নিবারণ কাকা থাকতে দিয়েছেন, এখন উনি আর ভাড়াটে রাখবেন না, এতে আপনার আপত্তি কিসের' ? 'আমি তো তাতে আপত্তি করিনি রতন বাবু, আসলে আপনি কিছু না জেনেই বিষয়টার মধ্যে ঢুকেছেন তো তাই আপনার একটু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে'. একইরকম নির্লিপ্ত গলায় বলে মহিলা। রতন সম্পূর্ণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে। সত্যিই তো সে এটার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানে না। কিন্তু তাই বলে একহাট লোকের মাঝখানে এভাবে অপদস্থ হওয়া প্রায় যেচে চড় খাওয়ার সামিল। সে ভেবেছিল পাড়ার অন্যান্য সমস্যার মতো এটাও তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে, উল্টে এই বাচাল মহিলার শব্দবোমা সহ্য করতে হচ্ছে এখন। দুয়ে মিলে বেশ ফাঁপড়ে পড়ে রতন। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে মহিলা খুব ধীর লয়ে বলে, 'নিবারণ বাবু, আমাদের তো দুবছরের এগ্রিমেন্ট হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে জরুরি পরিস্থিতিতে যদি আপনাকে বাড়ি খালি করতে হয় তাহলে ভাড়াটেকে অন্তত তিন মাস সময় দিতে হবে। অথচ আপনি বলছেন সামনের মাসেই উঠে যেতে হবে, এটা কি ন্যায্য কথা হলো বলুন' ?

'ও ওসব এগ্রিমেন্ট ফেগ্রীমেন্ট আমাকে দেখাতে এস না মেয়ে, আমার বাড়ি খালি করে দিতে হবে ব্যাস, এইটে আমার সাফ কথা' ! উত্তেজিত হয়ে ওঠেন নিবারণ। মহিলাটি দ্রুত ঘরের ভিতর চলে যায়, পরমুহূর্তেই একটা দলিল হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে আসে। রতনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে , 'আপনি পড়তে পারেন তো' ?
- আজ্ঞে ?
- বাংলা..... আপনি পড়তে পারেন নিশ্চই......?
রতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এ তাচ্ছিল্যের কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। শুধু সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলে, 'হ্যাঁ পারি......কেন' ?
- তাহলে এই পাঁচ নম্বর পয়েন্টটা পড়ুন একবার, জোরে জোরে।

রতন দলিলটা হাতে নিয়ে পাঁচ নম্বর পয়েন্টটা খুঁজে নিয়ে পড়তে শুরু করে, 'এমতাবস্থায় কোনো বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজন পড়িলে, বাড়ি খালি করিবার স্বার্থে, বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে অন্ততঃ পক্ষে তিন মাস সময় দিবেন। কোনো প্রকারের বলপ্রয়োগ বেআইনি বলিয়া গ্রাহ্য হইবে'।
'নিশ্চই বুঝতে পারছেন আমি ভুল কিছু বলছি না', কথাটা রতনের উদ্দেশ্যে বলে মহিলা। রতন ধীরে ধীরে দলিলটা ফিরিয়ে দেয়, কোনো কথা বলে না। ভিতরে ভিতরে লজ্জিত হয় বেশ। তারপর নিবারণের দিকে তাকিয়ে বলে, 'নিবারণ কাকা, দলিলে যা লেখা আছে, তাতে করে তো ওনার কিছুটা সময় পাওয়ারই কথা, আপনি বরং এ নিয়ে আর ঝামেলা করবেন না, উনি তো বলছেন চলে যাবেন, একটু অপেক্ষা করুন'। 'ওঃ, তার মানে আমার বাড়ি আমি খালি পাব না, তাইতো ? ঠিক আছে আমিও দেখবো, যতদূর যেতে হয় ততদূর যাবো', গজগজ করতে করতে ভিতরে চলে যান নিবারণ।

ভিড়টা যথারীতি পাতলা হয়ে যায় আস্তে আস্তে। সম্ভাব্য যাত্রাপালার এমন যবনিকাপাত হওয়াতে প্রায় সকলেই ক্ষুন্ন মনে যে যার পথ ধরে। ভাড়াটে মহিলার দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে রতন বলে, 'ইয়ে ম্যাডাম.......... মানে আমি খুব সরি, আপনাকে একটু ধমকে ফেলেছি, আমি আসলে জানতাম না কেসটা'। মহিলা খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রতনের দিকে। সে তাকানোর অর্থ যে কি, তা রতন বিস্তর ভেবেও খুঁজে পায় না। একটাও শব্দ খরচ না করেই মহিলা ঢুকে যায় ঘরের ভেতর। রতন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়।

পুরুষরা কিছুতেই নিজের পুরুষকারে ঘা খাওয়াটা সহ্য করতে পারে না, সে যত হীন, দুর্বল পুরুষই হোক না কেন, তাও যদি আবার নিজের মুর্খামির জন্য হয় তাহলে তো আর মুখ লুকোবার জায়গা থাকে না। সেখানে রতনের মতো বীরপুঙ্গব হলে অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে ওঠে। সমস্ত দিন এক আশ্চর্য রকম অস্বস্তি নিয়ে ছটফট করতে থাকে রতন। ভিতরে ভিতরে অনুশোচনাও হয় খুব। সারারাত ভাবতে থাকে কিভাবে এই অনিচ্ছাকৃত ভুল শোধরানো যায়..........

( ক্রমশ )

ছবি : গুগল 


 #bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories  #love #romance