মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। ওই যে সেই কে যেন বলে গিয়েছিল...... 'Man proposes, God disposes'..............এক্কেরে খাঁটি কথা যা হোক। কি রকম ? এই যেমন ধরুন না একটা ছুটির দিন। যেই আপনি ভেবে বসে আছেন আজ তো নটার আগে ওঠাই নেই.......... ব্যাস ! অমনি কিছু না কিছু কারনে ভোর ছটায় আপনার ঘুমটা ভাঙবেই ভাঙবে ! হাই তুলে, নিতাই গৌরাঙ্গর মত দুহাত ছড়িয়ে কাঁচা ঘুমের জাবর কাটতে কাটতে ভাবছেন, যাই হোক ঘুমটা যখন ভেঙেই গেল তাহলে একটু এফ এম চালিয়ে প্রভাতি গানের অনুষ্ঠানটা শুনে নেওয়া যাক। অমনি ঘরের ভেতর থেকে অর্ডার আসবে, 'হাঁ করে বসে থেকো না, ব্রাউন ব্রেডটা নিয়ে এস তাড়াতাড়ি, আজকে একটু স্যান্ডুইচ করব ভাবছি' ! আপনি হয়ত মনে মনে ভাবছেন, 'আপদ ! আর বলার সময় পেলে না, দুদণ্ড যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে দিনের শুরুটা একেবারে শিশির ভেজার মত করে প্রান জুড়ানো হবে তা নয়, মুডের ওপর দিলে একেবারে স্যান্ডুইচের পাতিলেবু ঘষে'। অমনি আরেকদফা আওয়াজ, 'চা দিয়েছি, জুড়িয়ে গেল, খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকো, তুমি তো আবার বাথরুম না করে এক পা নড়তে চাওনা মোটে'। আপনি ততক্ষনে নিমপাতা গেলার মত মুখ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন. আর মনে মনে ভাবছেন, 'বাদামি রুটি ! উফফফ, এর চাইতে অফিস চলে গেলে মানসিক ছুটিটা পাওয়া যেত খানিক ' !
এখনি কি হয়েছে ভাবচেন, এই ত সবে শুরু হল !
ছুটির দিনে এরকম অভিজ্ঞতা কম বেশি সকলেরই হয়। যখনি আপনি আয়েস করে মউরি চিবিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে দিন কাটানোর চিন্তা করছেন তখনি আপনার কপালে উটকো কাজের ঝুরি নিয়ে কেউ না কেউ হাজির হয়ে যাবে ঠিক। 'দাদা, পাড়ায় অনুষ্ঠান আছে, একটু সভাপতির বক্তৃতাটা লিখে দিন না' অথবা 'দাদা, এবারের কালী পুজোর চাঁদাটা একটু বাড়িয়ে.......', নিদেনপক্ষে, 'আমার খুড়তুতো বোনের জন্য একটা ভালো পাত্রর কথা বলেছিলুম, পেলেন নাকি' ?............., ইত্যাদি। দুদণ্ড শান্তিতে কোলবালিশ জড়িয়ে জিরোবার কথা ভেবেছেন কি আপনাকে একেবারে ঘরছাড়া করে ছাড়বে আপনারই ঘরের লোক। যেন এ ধরাধামে আপনি সে অধিকার নিয়ে আসেন নি । ওসব বিলাসিতা আপনার মত অজাত কুজাতের ললাটে মানায় না। আপনি হচ্ছেন কলুর সাবালক বলদ, নাকে দড়ি দিয়ে সংসারের চরকিপাক দেওয়াটাই আপনার একমাত্র ভবিতব্য। তবু সে যদিবা হাতের কাজগুলো আপনি সেরে রাখলেন, টিভির রিমোটটা কিছুতেই হাতাতে পারবেন না।............ কেন ? প্রশ্ন করে শত্তুর বাড়াবেন নাকি মশাই ! তার চাইতে সিগারেট জ্বালিয়ে বারান্দায় চলে যাওয়া ভাল। মনে মনে গুনগুন করুন, 'সেই ভাল, সেই ভাল, আমারে নাহয় না জানো.............'। হয়ত আপনি বারান্দার আরাম কেদারায় বসে বসে ভাবছেন, 'যাক........এইবার বাকি সময়টুকু নিশ্চিন্তি.................', সম্পূর্ণ ভুল ভাবছেন। কারন ঠিক সেই সময়, 'ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে' এর মতো আপনার কানের কাছে দরদী গলায় মৌমাছির গুঞ্জনে ভেসে আসবে,.......... 'এই শোনো, মিলন মেলায় টেরাকোটার ভালো কাজ এসেছে, চলো একবার ঢুঁ মেরে আসি' .......বা........ 'এই জানো ? দক্ষিণাপণে কি ভালো সেল দিচ্ছে, এরকম চমকদার ডিস্কাউন্টে শাড়ি সালোয়ার না কেনাটা বৃথা বুঝলে' ?..... না, না, চমকানোর কিছু নেই, 'হাড়িকাঠে গলা দিয়েছ পেতে, এখন তো সাগরসঙ্গমে হবেই যেতে' । বিকেলের বকলমে আপনি নিচুতলার কর্মী শ্রেণীভুক্ত বেশি বই নয়, অমন দুচারটে ডিস্কাউন্টের ডিসকাস থ্রো আপনার এড়িয়ে যাওয়ার জাস্ট কোনো উপায় নেই। যদি না আপনি ঠিক সেই সময়, পেট চেপে ধরে, 'উফফফ কি ভয়ানক ব্যাথা' বলে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে থাকেন। তাহলে হয়তো ঢাকুরিয়ার অটোটা আপনি এড়ালেও এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তাও সাময়িক। আপনাকে শপিং রেডি করে নেওয়ার জন্য গোটা দুয়েক ডেকোলিক ট্যাবলেট ততক্ষনে আপনার পেটে চালান হয়ে গেছে দিব্যি। আর আপনি ঘুড়ন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আপনার দুরন্ত জীবনের কভার ড্রাইভের মিসটাইম হয়ে যাওয়াটা দেখে চলেছেন নিস্পলক।
কোথায় আপনি ভেবেছিলেন আধবেলার অবসরে সাধের গীটারটা নিয়ে একটু টুংটাং করবেন, অথবা টিভিতে ইন্ডিয়া নিউজিল্যান্ডের ওয়ান ডে ম্যাচটা সাপ্টে চেটেপুটে খাবেন, বা কমপ্লেক্সের কমিউনিটি হলে তাসের আড্ডা বা ক্যারামের ঘুঁটি সাজিয়ে তুলবেন, তা নয় আপনাকে হয়তো কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে ফলের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হতে হবে, তিনি সদ্য হাসপাতাল থেকে ফলতঃ ফেরত এসেছেন বলে। অথবা কোনো এক বিয়ের নিমন্ত্রণে না গেলে সে হয়তো বিয়ের পিঁড়ি থেকেই লাফিয়ে উঠে চলে যাবে, ইত্যাদি, যাবতীয় কাজে হাতযশ না প্রমান করা অবধি আপনার নামযশের আশা খুবই ক্ষীণ। আবার এমনও হতে পারে, আপনার যদি দু কলি গাওয়া বা লেখার অভ্যেস থাকে এবং আপনি সেটা করবেন বলে ভাবছেন এমন সময় হৈ হৈ করে আপনার পাশের বাড়ির জ্যাঠিমা বা মাসিমা পান দোক্তা চিবোতে চিবোতে এসে বলবেন, 'কি গো শুনলুম নাকি তুমি বাবা হবে !! আমাদের কাছেই সুখবরটা চেপে গেলে ?' এবং এই সময় হবু বাবা মায়ের ঠিক কি কি করা দরকার তার সমস্তটা একেবারে ফর্দ করে বুঝিয়ে দিয়ে চা, চানাচুর, ডিমের ডেভিল খেয়ে তবে ক্ষান্ত হবেন। সে যতই আপনি ভাবলেশহীন মুখ করে বসে থাকুন না কেন, যতই আপনি নীরবে বলার চেষ্টা করুন না কেন, 'আচ্ছা বেশ, আমার একটু কাজ আছে', তবু সে অযাচিত টিউশন ছেড়ে উঠে যাবার জো নেই। সে দুষ্প্রাপ্য, অমোঘ বক্তিমে আপনাকে শুনতেই হবে....... 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়' এর মতো করে।
এহেন সমস্ত গুরু দায়দায়িত্ব পালন করে যতক্ষণে আপনি 'পথভোলা এক পথিক' আবার ফিরে আসবেন আপনার একান্তে, ততক্ষনে হয়তো সারা দিনের ছুটিটা আঙুলের ফাঁক গলে কখন বালির মতো পড়ে গেছে ঝুরঝুর করে আপনার খেয়ালও থাকবে না। রাতের ডিনার টেবিলে বসে আপনি মনে মনে হিসাব কষবেন, 'এই রে ! এটা তো করা হলো না, যাহ !, ওটা তো বাকি রয়ে গেল' তখন আপনার কল্পনায় কপাল চাপড়ানোটা অদৃশ্যই থেকে যাবে, সারাদিনে করা অন্যান্য কাজের মতোই। গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আবার কবে এমন ছুটি আসবে, যেটায় না করা কাজগুলো এক এক করে সেরে ফেলা যাবে। সে ছুটির দিন সপ্তাহ ঘুরলেই যে আসবে এমনটা নয় কারণ গত সপ্তাহতেই ঠিক করে রাখা আছে কোন বাঁশের খুঁটিতে বলদকে বাঁধা হবে। অনেকেই হয়তো বলবেন, 'ওরে তোরা অতো ছুটি পাস্, তারপরেও নাক সিঁটকোস কেন' ? কি বলবো কত্তা ! ছুটিগুলো ক্যালেন্ডারে থাকে ঠিকই, কিন্তু ছুটোছুটিও হয় বিস্তর...........
অতএব, 'আমাদের ছুটি - ছুটি চল নেবো লুটি এই আনন্দ ঝর্ণায়'......... এটা মনে মনেই গাইতে থাকুন। আনন্দ ঝর্ণার অবগাহনে দিব্যি বেশ একটা ছুটির আমেজ আসবে.........কাল্পনিকই হোক না ক্ষতি কি !
পুনশ্চ : এই লেখাটি যে কোনো লিঙ্গের প্রতিই প্রযোজ্য, খামোকা একপেশে মনোভাবে আমাকে দোষের ভাগী করবেন না।
#bengaliarticles #bengaliwriteups #holiday #relax

Wow!
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ, ভালো থেকো
ReplyDeleteekkere thik koisen :D
ReplyDeleteহাহাহাহাহা, বাস্তব অভিজ্ঞতা বন্ধু !
Delete