Tuesday, September 27, 2016

সাপ্তাহিকী ১৮ # রত্নাকর - অন্তিম পর্ব

পরদিন সকালে নিয়মমাফিক বাজারের থলি হাতে বেরোয় রতন। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকে, দুচারজন পথচারী কুশল প্রশ্ন করে, সেসব কান অবধি পৌঁছয় না তার। ভারী অবাক হয় লোকজন। প্রাণোচ্ছল রতনের গুম হয়ে থাকার কারণটা বুঝতে পারে না অনেকেই। পাড়ার চায়ের দোকানে যার গলা পাওয়া যেত সবার আগে, আজ সে চা না খেয়েই চায়ের দোকান পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কোথা থেকে পাড়ার কচি ছেলের দল হৈ হৈ করে এসে পথ আটকায় রতনের, বলে, 'কি গো রতন দা, কাল তো তুমি আর এলেই না, আমরা তো মাঞ্জা, টাঞ্জা দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আজ কিন্তু তোমাদের ছাত থেকেই ঘুড়ি ওড়াবো। আমরা সকাল সকাল রেডি হয়ে গেছি'। মৃদু হাসে রতন, বলে, 'বেশ তো, তোরা ঘুড়ি লাটাই নিয়ে যা, আমি বাজারটা সেরে আসছি'। ছেলেদের দল নাচতে নাচতে চলে যায়।

গলির বাঁক ঘুরতেই সহসা দেখা হয়ে যায় সেই ভাড়াটে মহিলার সাথে। বাজার সেরে ফিরছে। রতন তাকে দেখেই গুটিয়ে যায় খানিক। মহিলা এক নজর তাকায় রতনের দিকে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় নিজের বাড়ির দিকে। রতন কোনোরকমে ঘাড় মুখ গুঁজে বাজার সেরে ফিরে আসে বাড়িতে। চটজলদি থলিটা নামিয়ে দিয়েই চেঁচিয়ে বলে, 'মা, বাজারটা রেখে গেলুম, আমি একটু ঘুরে আসছি'। জয়া হন্তদন্ত হয়ে বলেন, 'ব্যাস ! অমনি চললি তো পাড়া বেরোতে ? বলি কিছু অন্তত মুখে দিয়ে যা'। ভিতরের ঘর থেকে সুধাময় বলে ওঠেন, 'হুঁ, এমনি দিনে টিকি পাওয়া যায় না, আজ তো আবার বিশ্বকর্মা পুজো ! সারাদিন ধরে প্যাঁচ কষবে না ? বলিহারি যাই, কোথায় একটু রোজগারের চিন্তা করবে তা নয় প্যাঁচাতে ব্যস্ত, যত্তসব অকাল কুষ্মান্ড' !

মধ্যবিত্ত সংসারে পিতার ধৈর্যের অভাব ঘটে। ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তাঁর। সে কথা কানে যাওয়ার আগেই রতন পা বাড়ায় চায়ের দোকানের দিকে, কতকটা আনমনেই। আজ সকাল থেকে যেন কোনো কিছুতেই মন লাগছে না তার। এ গলি ও গলি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে খেয়াল হয় যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা চায়ের দোকান নয় মোটেই। সেটা নিবারণ গাঙ্গুলির বাড়ি। কি আশ্চর্য ! তার তো চায়ের দোকানে যাওয়ার কথা।

জটিল মনস্তত্ব। মনোবিদরা বলবেন, এমনটা তো খুব স্বাভাবিক, মানুষের মনে এমন বহু সূক্ষ্ম চিন্তার সঞ্চার হয় যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ এমন অনেক কাজ করে থাকে যার স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। তবে রতনের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া সত্যিই ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। স্থান কালের হিসেবে গুলিয়ে ফেলার ছেলে আর যেই হোক, রতন নয়। কিছুক্ষন সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে। তারপর চলে আসার জন্য যেই পা বাড়াতে যায়, অমনি বারান্দায় সেই ভাড়াটে মহিলাটি বেরিয়ে আসে। হাতে ভিজে কাপড় নিয়ে তারের ওপর মেলতে থাকে। হঠাৎ চোখাচোখি হয় রতনের সাথে। ভারী অপ্রস্তুত হয় রতন। মহিলা কাপড় মেলতে মেলতে খানিক থমকায়। রতন একছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, পারে না। মনে হয় কে যেন এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে রেখেছে গোড়ালি দুটো। কিছু না পেরে বোকার মতো হাসে, তারপর চোখ নামিয়ে নেয়। মহিলা ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে......
'আপনি কি কাউকে খুঁজছেন' ?
'কই..... না তো' ! তোতলাতে থাকে পাড়ার তেজী যুবক। পরক্ষনেই কিছুটা সাহসে ভর করে বলে, 'ইয়ে......মানে সেদিনকার জন্য.....আমি ভীষণ ................
'অনুতপ্ত......তাই তো' ? খেই ধরিয়ে দেন মহিলা।
'হ্যাঁ মানে ওই আর কি', আমতা আমতা করতে থাকে রতন, 'আসলে কিছু না বুঝেই এমন..............'
- চা খাবেন ?
- হ্যাঁ ???
- বলছি চা খাবেন ? জল চাপিয়েছি..... আশা করি দুজনের হয়ে যাবে.......

'না' কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনা, জিভ জড়িয়ে যায় রতনের। অপরিচিত নারীর অনুরোধ কোনো এক অজানা কারণে ফেলতে পারে না সে। ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি প্রদান করে। 'আসুন তবে', অপরিচিতা পথ দেখায়। পিছন পিছন বাধ্য ছাত্রের মতো ঘরে গিয়ে ঢোকে রতন। 'বসুন', একটা সোফার দিকে আঙুল দেখায় নারী। ঘরের চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে রতন। গোটা ঘর জুড়ে আধুনিকতার ছাপ না থাকলেও, যত্নের চিহ্ন স্পষ্ট। সোফার পিছনের দেয়ালে একটা ফটোফ্রেম, তাতে একটা ছোট মেয়ে শাড়ি পড়ে নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে একমনে দেখতে থাকে সে।
'আপনার চা', নারীকণ্ঠে সম্বিৎ ফেরে রতনের। চা নিয়ে একটু জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে। সুরুৎ করে এক চুমুক দিয়ে বলে, 'ওপরের এই ফটোফ্রেমটায় মেয়েটি কে' ?

মহিলা হেসে ফেলে। একমুঠো শিউলি ফুল ঝরে পরে যেন। সে হাসি কতকটা লজ্জার, কতকটা ধরা পড়ে যাওয়ার। সেদিকে অপলক চেয়ে থাকে রতন। যুবক হৃদয়ে হিল্লোল ওঠেবা হয়তো। সেদিন এতটা ঠাহর করে দেখা হয়নি। সাধারন বেশভূষায় আপাত কঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি নম্র দিকও আছে বটে। এমনিতে সুন্দরী না হলেও সুশ্রী বলা যেতে পারে। বিশেষত হাসলে পরে গালে টোল পড়ে । মহিলা সলাজ গলায় বলে, 'ওটা আমার ছোটবেলা। তখন নাচ শিখতাম' ।
- ওঃ আচ্ছা.........আপনি কি এখনো ........ ?
- না না, সেসব ছেড়ে দিয়েছি বহু বছর, সময় কোথায় এখন ?
- আপনি এখন কি করেন ? মানে মাপ করবেন..... অহেতুক কৌতূহল আর কি.......
- একটা মেয়েদের স্কুলে পড়াই, এছাড়া টুকটাক টিউশনি করি বাড়িতে।
- ওহ, আপনি তাহলে দিদিমণি ?
আবার শিউলি ফুল ঝরে পড়ে যেন একরাশ। রতনের বুক কেঁপে ওঠে। টোল পড়া হাসির মর্মার্থ তার মতো ব্রতচারী যুবকের পক্ষে বুঝে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
- তা একরকম বলতে পারেন........তবে এখানকার পাট বোধহয় চুকল। একমাস হল এসেছি, এরই মধ্যে যে আবার ঘর খুঁজতে হবে এমনটা বুঝতে পারিনি। আগে জানলে এখানে ভাড়া আসতাম না।
- হ্যাঁ, আসলে নিবারণ কাকা বড্ডো জেদ করছে, নাহলে এখানে কি আর অসুবিধে, তাই না ? এই পাড়াটা তো ভালোই .........
- আমার ধারণা উনি একজন ভালো প্রোমোটার পেয়েছেন, খুব সম্ভব এখানে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি হবে.......

চুপ করে থাকে রতন। এ খবর সে আগেই পেয়েছে। কোনো উচ্চবাচ্য করে না এ ব্যাপারে। শুধু বলে, 'তিন মাস সময় আছে তো, আপনি ঠিক একটা বাড়ি পেয়ে যাবেন ম্যাডাম'।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মহিলা, বলে, 'আসলে কি জানেন রতনবাবু, বাড়ি বদলানো যায়, ঘরের আসবাব বদলানো যায়, কিন্তু সংসার বদলানো, খুব একটা সহজ কাজ নয়। যে গাছের মাটি বারেবারে আলগা হয়, তার শিকড় আপনিই দুর্বল হয়ে পড়ে, সে খবর আমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে বলুন ?
এ কথার কি উত্তর দেবে, রতন ভেবে পায় না। পরিণয় যার হয় নি, পরিণতির করুণ আবেগ তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবুও মহিলার কথাগুলো বিষাদের বারিধারার মতো তাকে ছুঁয়ে যায়। সে বলে, 'আপনার যদি আপত্তি না থেকে তাহলে আমি বাড়ির ব্যাপারে চেষ্টা করতে পারি'।

- আপনি আর কতটুকু করবেন রতনবাবু, আজকের দিনে সস্তায় বাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আর তাছাড়া হুট্ করলেই তো আর ভাড়া দিচ্ছে না কেউ।
- সেটা আমি দেখে নিচ্ছি। প্রথমত, আপনি প্লিজ বাবু বাবু করবেন না, আমায় নাম ধরেই ডাকতে পারেন।
মহিলা মৃদু হেসে বলে, 'আচ্ছা বেশ........ তবে আপনার ভালো নাম........একটা আছে নিশ্চই.......'
- হ্যাঁ........ শ্রীযুক্ত রত্নাকর ঘোষ।
'ওরেব্বাবা, একেবারে রত্নাকর ! আপনি কি দস্যু নাকি' ! বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে আপাতকঠিন রমণী। রতন ভারী লজ্জা পায় সে কথায়। মাথা নামিয়ে মুচকি হাসে। এমন সময় কোথা থেকে একটি ছোট্ট ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে ঘরে। মহিলা কোলে তুলে নেয় তাকে। রতনকে দেখিয়ে বলে, 'এই আমার বিট্টু......., আমার স্বপ্ন'। রতন সামান্য আদর করে দেয় বিট্টুকে। তারপর বলে, 'আজ তাহলে আসি ম্যাডাম, ওদিকে আবার পুজোর কিছু কাজ আছে, যাই একটু সামলে দিই গে। আর বাড়ির ব্যাপারে আমি খোঁজ লাগাচ্ছি, অবশ্য আপনার যদি এতে আপত্তি না থাকে'। মহিলা স্মিত হেসে বলে, 'আপত্তি আছে বৈকি, তবে ওই ম্যাডাম কথাটায়। আপনি আমায় পল্লবী বলে ডাকতে পারেন'। রতনের বুকের ভিতর যেন দুম দুম করে হাতুড়ি পিটতে থাকে কেউ। 'আচ্ছা', বলে একছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

কয়েক মাস কেটে যায়। ঋতুর পরিবর্তন হয়...... মনেরও। পল্লবীর বাড়িতে রতনের যাওয়া আসা বাড়ে। টুকটাক চা পর্ব, বিট্টুকে নিয়ে পার্কে বেরোনো, একটা দুটো করে বাড়ির খোঁজ আনা, খোলা আকাশের মেঘের মতো দুটো ঘুড়ি ভেসে বেড়াতে থাকে সেসব আপন খেয়ালে। সেসময় এখনকার মতো ছিল না। কার উনুনে কতটা ভাত সেদ্ধ হলো, কার আঁচে কতটা তেল পুড়লো সে খবর পাড়াসুদ্ধু লোক জানতো। গন্ধ শুঁকে বলে দেওয়া যেত কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে। আর মুচমুচে পদ হলে তো কথাই নেই। একেবারে উল্কার গতিতে রাষ্ট্র হতো সেসব। দুপুরের আড্ডা হোক বা সন্ধ্যার জমায়েত, টাটকা পঞ্চায়েতিটা না করলে পেটের ভেতরটা যেন গুড়গুড় করতো সবার। সেখানে রতনের বাড়ি খোঁজার উৎসাহটা যেন বেশি করে চোখে পড়তে লাগলো পাড়ার লোকেদের। ফিসফাস, কানাকানি শুরু হলো পাল্লা দিয়ে।

সেসব কথা নিবারণ গাঙ্গুলির বাড়ি অবধি পৌঁছতে বেশি দেরি হলো না। উঠতে বসতে পল্লবীকে খোঁচা দিতে শুরু করলেন তিনি। একদিন বলেই ফেললেন, 'এসব নষ্টামো আমার বাড়িতে চলবে না। এ পাড়ায় ভদ্র পরিবারের বাস। পত্রপাঠ বিদেয় হও.........' ইত্যাদি। পল্লবী কান পেতে শোনে সেসব। প্রত্যুত্তর দিতে রুচিতে বাধে তার। সামাজিক কাঁটাতারের জালে জড়িয়ে গিয়ে ছটফট করতে থাকে। বাধ্য হয়ে রতনকে ডেকে পাঠায় একদিন বিকেলে। পাড়ার বাইরে, একটু দূরে, নিরিবিলিতে। একটা বেঞ্চির ওপর বসে দুজনে।

'আপনাকে স্পষ্ট করে কতগুলো কথা বলতে চাই রতন। আপনি কি ভাবে নেবেন আমি জানি না, তবু কথাগুলো বলা খুব প্রয়োজন আমার', থেমে থেমে কথাগুলো বলে পল্লবী।
রতন ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কিছু হয়েছে ?..... মানে আপনাকে এতো অস্থির লাগছে আজ'। সে কথার উত্তর না দিয়ে পল্লবী একটু রূঢ় স্বরে বলে, 'আজ থেকে আপনাকে আর বাড়ি খুঁজতে হবে না আমার। যেমন করেই হোক আমি নিজেই একটা বাসস্থান ঠিক খুঁজে নিতে পারবো বলে মনে হয়। আপনি এতদিন যে চেষ্টা করেছেন, সেজন্য যথেষ্ট ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। তাই আমার অনুরোধ, আপনি শুধুশুধু কষ্ট করে আমাকে আর পাপের ভাগী করবেন না' ।

রতনের মুখটা পাংশু হয়ে যায়। সে কোনোরকমে আমতা আমতা করে বলে, 'আমি জানি পল্লবী, আপনি কেন এই কথাগুলো বলছেন। লোকজনের কথায় কান দেওয়ার তো কোনো দরকার নেই আমাদের। যারা এসব আলোচনা করছে তাদের মুখ কি করে বন্ধ করতে হয় সে আমার জানা আছে। আর বাড়ি খোঁজার যে কষ্টটা বলছেন সে নাহয় একটু করলুমই, সে আর এমন কি। তবে আপনি কি করে পাপের ভাগী হচ্ছেন সেইটে ঠিক বুঝে উঠতে পারলুম না'।  

পল্লবীর গলা বুজে আসে কথা বলতে গিয়ে। ডুবন্ত প্রাণীর কাছে খড়কুটোর অবলম্বনটাই নতুন করে বাঁচার হাতছানি দেয়। হাত বাড়িয়ে যখন সেটুকুও নাগালের মধ্যে আসে না তখন আপনিই মৃত্যু হয়, আলাদা করে আর ডুবতে হয় না। সে কথা রতনকে বোঝায় কি করে পল্লবী। ঠোঁট কামড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে অচিরেই। হৃদয়ের কানাগলিতে অবদমিত কষ্টের প্রতিধ্বনি হতে থাকে। সে আবেগের কিছুটা রতন আঁচ করতে পারে। বলাই বাহুল্য রতনের পক্ষ থেকেও অনুরূপ আবেগের খামতি ঘটে নি কখনই । সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, 'সামাজিক দায়ভার যতটা আপনার, আমারও ততটাই। পিছিয়ে যাওয়ার মতো মানসিকতা নিয়ে আমি এগিয়ে আসিনি পল্লবী। সবার মাঝখানে সেকথা বলার মতো যথেষ্ট সাহসও আমি রাখি। আমি মনে করি, সামাজিক নিয়মে উপযুক্ত সম্মান আপনার পাওয়া উচিত এবং সে প্রাপ্য সম্মান দিতে আমি কখনই পিছপা হবো না। অবশ্য আপনার অনুমতি নিয়েই। আপনি যদি সম্মত হন তাহলে আমি বাড়িতে কথা বলতে পারি'। পল্লবীর গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সূর্যাস্তের আলোয় চোখ মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে। কোনোমতে বলে, 'আমি জানি সে আপনি পারবেন, কিন্তু............

'না', দৃঢ়তা ফুটে ওঠে রতনের গলায়, 'আর কোনো কিন্তু নয় পল্লবী, আমি যদি এতটুকুও কাছে আসতে পারি আপনার, সে আমার ভাগ্য। আর তার জন্যে যেটুকু অধিকার জন্মেছে আপনার প্রতি সেই অধিকার বোধ থেকেই বলছি আপনার ও বিট্টুর দায়িত্ত্ব নিতে রাজি আছি আমি, আমায় শুধু একটু সময় দিন', কথাগুলো বলেই হনহন করে হাঁটা লাগায় রতন। দমকা হাওয়ায় এলোমেলো চুল উড়তে থাকে, এক দস্যুর মতোই লাগে যেন রতনকে। পল্লবী অপার অনুরাগে চেয়ে থাকে সে দিকে। সেই দস্যুর প্রতি অমোঘ টান অনুভব করতে থাকে মনে মনে। কিন্তু কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম কাঁটাও বিঁধতে থাকে খচখচ করে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই রতন, পল্লবীর কথাটা পাড়ে বাড়িতে। সুধাময়ের মুখ পলকে থমথমে হয়ে যায়। জয়া ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সন্তানের নিশ্চিত অবনমনটা যেন চোখের সামনে দেখতে পান দুজনেই। তার পরে পরেই ভেসে ওঠে পারিবারিক মর্যাদার কথা। সামাজিক অস্তিত্ব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার চিত্রটা কল্পনা করে মনে মনে শিউরে ওঠেন সুধাময়। ছেলের কচি মাথাটা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য জয়া একনাগাড়ে শাপ শাপান্ত করতে থাকেন পল্লবীকে। রতনের সমস্ত চেষ্টাই বিফলে যায়। ঐতিহ্যবাহী ঘোষবাড়িতে কলঙ্কের কালি লেপে দিয়ে যাবে কোনো এক অজ্ঞাত কুলশীল বিবাহবিচ্ছিন্না, একথা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না দুজনে। তেমন তেমন হলে রতনকে যে ত্যাজ্যপুত্র করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না একথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন সুধাময়।

সমস্ত রাত ভাবতে থাকে রতন। একদিকে ঘোষবাড়ির সম্মান অন্যদিকে হৃদয়। অসম অনুপাতের দরুন সম উচ্চতায় আসে না দুটোর কোনোটাই। মূল্যবোধের দাঁড়িপাল্লায় হৃদয়ের দিকেই ভার হয় বেশি। মনে মনে তার আগামী পদক্ষেপ ঠিক করে নেয় সে। খুব তাড়াতাড়ি একটা বাড়ি জুটিয়ে ফেলতে হবে, আর তারপরেই একটা কাজ। ভবিষ্যতের পথচিত্রটা এঁকে ফেলতে হবে দ্রুত। মনের সমস্ত জড়তা কাটিয়ে ফেলতে সময় লাগে না তার। এই সিদ্ধান্তের কথা পল্লবীকে গিয়ে না বলা অবধি সে অস্থির হয়ে ওঠে। পল্লবীর সাথে তার জীবনের গ্রন্থিগুলো বাঁধা পড়বে আর কিছু দিনের মধ্যেই, এটা ভেবেই ভিতরে ভিতরে চাপা সুখ অনুভূত হয়। পরম পাওয়ার উৎকণ্ঠায় সারারাত প্রায় জেগেই কাটিয়ে দেয় রতন ।

পরদিন সকালবেলাই বেড়িয়ে পড়ে তড়িঘড়ি। সুধাময় আর জয়ার সমস্ত রকম বারণ অগ্রাহ্য করে পল্লবীর বাড়ির দিকে ছুটে যায় সে। যে নদী জোয়ারের টানে এতকাল পর তার চলার পথ খুঁজে পেয়েছে তাকে আটকায় কার সাধ্য ! খানিক দূর যেতেই ছোটুর সাথে দেখা হয়। হন্তদন্ত হয়ে সে এসে বলে, 'রতন দা, তোমার জন্য একটা চিঠি আছে' । 'চিঠি ? কে দিলে' ? ভারী অবাক হয় রতন।
- নিবারণ কাকাদের বাড়ির দিদিমণি, এই চিঠিটা তোমায় দিতে বললেন.........
রতন ব্যস্ত হয়ে চিঠির ভাঁজ খোলে, তাতে লেখা আছে............

দস্যু,
কিছু কথা সেদিন বাকি ছিল। সবটা বলা হয়ে ওঠেনি, সবটা বলতে পারিনি। আজ বলি বরং।
গ্রাজুয়েশনের পর পরই আমার বিয়ে হয়। মধ্যবিত্ত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভার লাঘব করি অনেক অল্প বয়েসেই। সেসময় বিয়ে করার মতো মানসিক ভাবে তৈরী না থাকলেও একরকম ভবিতব্য জেনেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। অন্যান্য নব্য গৃহিণীদের মতো আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম এক পরিপূর্ণ সংসারের। নিজের ব্যক্তিগত ছোট বড় আকাঙ্খা গুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছিলাম আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের চাহিদার সাথে। নানা রকম সাধ পূরণের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেসময়। ধীরে ধীরে যত দিন গড়িয়েছিল, বুঝতে পেরেছিলাম দম দেওয়া পুতুলের ভূমিকা পালন করা ছাড়া তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা আমার নেই সে বাড়িতে। অথচ আমি আমার কর্তব্যে গাফিলতি করিনি। স্বামীকে ভালোবেসেছিলাম প্রাণ দিয়ে। প্রতিদানে তাঁর লাঞ্ছনা ও বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সাক্ষী থেকেছি শুধু। প্রত্যাশিত ভাবেই শুরু হয় অবহেলা আর অনাদর। সংসারের ঘানিতে পিষে যেতে থাকে আমার আত্মসম্মান, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। মনে মনে ঠিক করি এই অসম্মানের ছাতের তলায় আর নয়। চরম প্রতিকূলতায় যখন বি এড পাশ করি তখন বিট্টু আমার পেটে। সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসি শ্বশুর বাড়ি থেকে। বছরখানেক বাদে ডিভোর্স হয় আমাদের। ছেলেকে বাপের বাড়িতে রেখেই মানুষ করতে থাকি। বি এড টা থাকার ফলে এই স্কুলটায় চাকরি পেতে অসুবিধে হয়নি। বাবা মার গলগ্রহ হতে চাইনি বলেই আলাদা থাকি তারপর থেকেই। এই পাড়ায় এসে তোমার সাথে আলাপ হলো। আমাদের প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম তোমার মনটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ।রেকাবিতে সাজানো পুজোর ফুলের মতোই পবিত্র তুমি। তোমার অভ্যাসে অনভ্যাসে যে শিশুসুলভ সারল্যের আভাস পেয়েছিলাম তাতে বড় মুগ্ধ হই, জানো। তোমার মনের আয়নায় নিজেকে স্পষ্ট দেখেছিলাম যেদিন, সেদিন আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম নতুন করে ছাউনি বাঁধার, আবার করে সাজাতে শুরু করেছিলাম আমার সাধের মঞ্জিল। আমার বর্তমান পরিস্থিতি জেনেও যখন আপন করে নেবার সিদ্ধান্ত নিলে তখন থেকেই তোমাকে উচ্চ আসনে বসিয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর আমাদের পথ আলাদা করে রেখেছেন। হৃদয়ের সুর একই তারে বাঁধা হলেও সে কখনোই সঙ্গীত হয়ে উঠবে না সে আমি জানি। বড় স্বার্থপর আমি রতন, বড় স্বার্থপর। শুধু নিজের কথাটাই ভেবে গেছি...... তোমার পরিণতির কথা মনে হয়নি একবারও। আমার কাছে তোমার মাথা উঁচু হলেও, তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজনের কাছে যে খুব ছোট হয়ে যাবে তুমি, সেকথা ভুলে গেছিলাম। তোমার বাড়িতে যে আমি অপাংক্তেয় তা কি আমি আন্দাজ করতে পারিনি ভাবছো ? আমি জানি সেসবের তুমি পরোয়া কর না। কিন্তু যাঁরা তোমায় জন্ম দিলেন, যাদের কোল ঘেঁষে তুমি বড় হলে, যাদের সাথে সময় কাটালে তাদের কথা একটিবারও ভাববে না তুমি ? দুদিনের আলাপ তোমার নিকট আত্মীয়ের থেকে আজ এতো বড় হলো ? সে অপবাদ যে আমি সইতে পারবো না......... তাছাড়া আমি ঘরপোড়া গরু, আমার দুর্ভাগ্যের আকাশে যে সিঁদুরে মেঘ দেখা দেবে না তা কি কেউ বলতে পারে। সে ঘটনা যদি আবার ঘটে তাহলে যে তোমার পল্লবীর মৃত্যু হবে রতন। তুমি কি তাই চাও ? আমায় যদি এতটুকুও ভালোবেসে থাক, শপথ কর তুমি বাড়ি ছাড়বে না, কখনোই, কোনো অবস্থাতেই। জেনো তবেই আমি শান্তি পাবো........

এ চিঠি যখন তুমি পাবে তখন আমি বর্ধমানের পথে, ওখানকার একটা স্কুলে এপ্লাই করেছিলাম, মঞ্জুর হয়েছে। তাই একরকম মনস্থির করে বেরিয়ে পড়লাম। আমি জানি তুমি ঠিক ক্ষমা করবে আমায়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি রত্নের মতো উজ্জ্বল থেকো এমনই......চিরটাকাল। তোমায় চেয়েছি একথা সত্যি, কিন্তু তোমার বিসর্জন দিয়ে নয়...........

ইতি
তোমার........  

ছবি : গুগল 
#bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories #love #romance #separation #drama

Friday, September 23, 2016

সাপ্তাহিকী ১৭ # রত্নাকর - প্রথম পর্ব

করিৎকর্মা বলে রতনের বেশ সুনাম আছে পাড়াতে। ছোট, বড়, মাঝারি, যে কোনো মাপেরই কাজ হোক, রতনের জুড়ি মেলা ভার। জলের পাইপ ফেটেছে, রতনকে ডাকো, বাড়ির কার্নিশ ভেঙে পড়েছে, রতনকে চাই, গলির মোড়ে একহাঁটু জল, রতনকে খবর দাও, এমন বিবিধ কাজে রতন ছাড়া গতি নেই। সময়মতো লোক ডেকে, দাঁড়িয়ে থেকে এমন নিঁখুত করে কাজ উতরে দেবে যে দ্বিতীয়বার আর তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না। আর এসমস্ত কাজে রতনের উৎসাহও যেন চোখে পড়ার মতো। যেন তার জন্মই হয়েছে পরোপকার করতে। অবশ্য পাড়ার মানুষও যে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে রতনকে সেটা না বললে অবিচার করা হয় বৈকি। প্রায় সমস্ত বাড়ির হেঁশেল অবধি তার অবাধ যাতায়াত। কচি পাঁঠার ঝোল, ইলিশ মাছের  পাতুরি, পৌষের পিঠেপুলি, নবান্নের পায়েস, রতনকে না খাইয়ে তৃপ্তি হয় না কারোর। এদিকে রতনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার বাবার চিন্তার অন্ত নেই। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় যখন দুবারেও উৎরানো গেলো না, তখন রতনের বাবা বাধ্য হয়ে বললেন, 'থাক বাবা, অনেক হয়েছে, ও তোমার কম্মো নয়, তার চেয়ে বরং আমার কাপড়ের দোকানে সময় দাও, আমার একটু সুরাহা হয় তাতে'। সেকথায় কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেনি সে, উল্টে সমাজসেবার পুস্করিণীতে নিমজ্জিত প্রাণ রতনের মনে হয়েছে এসমস্ত গুরুত্বহীন কাজ আর যার হোক, তার জন্য নয়। এই জটিল ভবসংসারের মায়ায় আচ্ছন্ন না হয়ে মানবসেবাই একমাত্র সঠিক ব্রত বলে মনে হয়েছে তার। অবশ্য তার এই ব্রতচারী স্বভাব পাড়ার অল্পবয়সী মেয়েদের চোরা চাউনিগুলোকে কখনোই ঠেকাতে পারেনি। তার যথাযথ কারণ ছিল যদিও। দারুন সুদর্শন না হলেও, বছর আঠাশের রতন ব্যায়ামনিষ্ঠ ছিল বেশ। চওড়া ছাতি, বাইসেপ ট্রাইসেপ ধারী, গৌরবর্ণ রতন যখন শার্টের হাতা গুটিয়ে রাস্তায় বেরোতো, তখন পিছন ফিরে দেখত না এমন মানুষ খুব কমই ছিল। পাকানো গোঁফের আড়ালে শিশুসুলভ হাসিতে ঘায়েল হয়ে যেত অষ্টাদশী থেকে চল্লিশোর্ধ সকলেই। সেসকল গোপিনীদের দৃষ্টিকে হেলায় উপেক্ষা করার মতো কলজের জোর রতনের ছিল যথেষ্ট। সব মিলিয়ে পাড়ার মধ্যে বেশ একটা শান্তির বাতাবরণ ছিল। চোর টোর পারতপক্ষে ঘেঁষতো না সে পাড়ায়, কারণ সকলেই জানতো রতনের কাছে উত্তমমধ্যম খেলে উঠে দাঁড়ানো বেশ কষ্টকর হবে।

এহেন আপাত শান্ত পাড়ায় অকস্মাৎ কোথা থেকে যেন অশান্তির মেঘ ঘনিয়ে এলো। যে সময়ের কথা বলছি সেটা আশির দশকের শুরু। চারিদিকে তখন এতো ফ্ল্যাটবাড়ির রমরমা হয়নি। পাড়া সংস্কৃতির সমস্ত রকম চিহ্ন সর্বত্র বিদ্যমান। কালীপুজো দুর্গাপুজোর চাঁদা থেকে শুরু করে, রকে বসে আড্ডা মারা, দেওয়াল লিখন বা চায়ের দোকানে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের তুফান পর্যন্ত বেশ যত্ন সহকারে কালচার হতো। সেবার বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন রতন তার কচি সাগরেদদের নিয়ে মোড়ের মাথায় খুব দায়িত্বভরে মাঞ্জা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে, এমন সময় ছোটু দৌড়োতে দৌড়োতে এসে বললে, 'রতন দা, শিগগির চলো, বিষ্টুদের বাড়িতে ভারি ঝামেলা হচ্ছে'। 'কেন কি হচ্ছে ?' মাঞ্জা দিতে দিতেই রতন জিজ্ঞেস করে। 'সবটা জানিনা, তবে লোক জড়ো হয়েছে খুব, আর নিবারণ কাকা খুব তড়পাচ্ছে', হড়হড় করে সমস্তটা উদ্গীরণ করে ছোটু। 'আচ্ছা চল দেখি, বাকিরা এখানেই থাকিস, আমি এসে আবার দেবখন' , বাকিদের হাতে মাঞ্জার গুরুভার সোঁপে দিয়ে ছোটুর সাথে এগিয়ে যায় রতন।

নিবারণ গাঙ্গুলি, পেশায় সরকারী কর্মচারী, পেশার খাতিরে রাইটার্স বিল্ডিংএ যাতায়াত আছে বেশ। কথায় কথায় অমুক মন্ত্রী তমুক মন্ত্রীর উল্লেখ করে থাকেন যত্রতত্র। পাড়ার লোকেও তাকে বেশ সমঝে চলে। যথোপযুক্ত ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক, আইনি শলাপরামর্শ করতে অনেকেই সন্ধের দিকে ওনার বাড়িতে জড়ো হন। সুতরাং এ নিয়ে তাঁর গুমোরটাও বেশ চোখে পড়ার মতো। নিবারণের বড় তেতলা বাড়ি, বাড়ির দুতলায় আর তিনতলায় স্ত্রী পুত্র নিয়ে ভাগাভাগি করে থাকেন। একতলাটা এক বিবাহ বিচ্ছিন্না যুবতী মহিলা ও তাঁর তিন বছরের সন্তানকে ভাড়া দিয়েছেন সম্প্রতি। বেশ কয়েকদিন হলো এক প্রোমোটারের সাথে কথাবার্তা চলছে। বাড়িটা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে একটি নতুন আবাসন তৈরী হবে, তাতে শুধু দুটো ফ্ল্যাট নয় সঙ্গে বেশ কিছু নগদ আমদানি হবারও প্রভূত সুযোগ রয়েছে। সবই ঠিক ছিল, মাস দুয়েকের মধ্যেই কাজ শুরু হবার কথা, কিন্তু বাধ সেধেছে ভাড়াটে মহিলাটি। কিছুতেই সে বাড়িটা ছাড়তে রাজি হচ্ছে না।

রতন গিয়ে পৌঁছয় সেখানে। সামনের দিকটা জটলা হয়েছে বেশ। এ এক চেনা পরিবেশ। মধ্যবিত্ত পারিবারিক সমস্যা অধিকাংশ সময়ই অল্প কিছু কালের পরই কেমন সার্বজনীন হয়ে ওঠে। অযাচিত দর্শকের ভূমিকা পালন করা তদুপরি উপদেশ দেওয়াটা এক ভীষণ রকম কর্তব্যের মধ্যে পড়ে তখন। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় রতন। একতলার একফালি দালানের ওপর দাঁড়িয়ে নিবারণ গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করছেন , 'এ বাড়ি আমার, আমি কখন কাকে থাকতে দেব না দেব সেটা আমার ব্যাপার, রাইটার্সে গিয়ে সমস্ত হেস্তনেস্ত করে আসব' ইত্যাদি। ভাড়াটে মহিলাটি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, পরণে একটি গেরস্থালি তাঁতের শাড়ি, অনাড়ম্বর মুখে বিরক্তি ও কুণ্ঠার ছাপ। সে দিকে একনজর দিয়ে রতন জিজ্ঞেস করে, 'কি ব্যাপার নিবারণ কাকা ? এই সাতসকালে হল্লা কিসের ?'

'এই যে রতন......... এর একটা বিহিত করো তো বাপু !, বলি আমার বাড়ি, আমার ভাড়া, আগে ভাড়াটে থাকতে দিয়েছি, এখন আর দেব না, ব্যাস। অথচ ও কিছুতেই নড়বে না ? একি হুজ্জতি রে বাবা ! এখন দেখছি ভাড়া দেওয়াই কাল হলো আমার' ! এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেন নিবারণ। রতন মহিলাটির দিকে তাকায়, চোখেমুখে একটা তালেবর ভাব এনে বলে, 'ঠিকই তো, আপনি যেতে চাইছেন না কেন, ব্যাপারটা কি, পরিষ্কার করে বলুন দেখি' ?

'আপনি' ? খুব শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে পরিচয় জানতে চান মহিলাটি। রতন থতমত খেয়ে যায়, এভাবে কেউ কখনো প্রশ্ন করেনি আগে, বলা ভালো করার সাহস পায় নি। তাছাড়া রতনকে চেনে না বা জানে না আশেপাশের কোনো পাড়াতেই এমন কোনো ঘরের বাস নেই। সেখানে সবার সামনে একটি অপরিচিত মহিলার প্রশ্নবাণ একেবারে ফলার মতো মতো গিয়ে বেঁধে রতনকে। বেচারা হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর দ্রুত সামলে নিয়ে বলে, 'আমি রতন...........এ পাড়াতেই থাকি, দেখেছেন বোধহয়'।

'নাহ', মহিলা নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয়। অমন বেপরোয়া উত্তরে সামান্য দমে যায় রতন। তবু গলা পরিষ্কার করে আরও একবার বলে, 'আপনি ভাড়াটে, নিবারণ কাকা থাকতে দিয়েছেন, এখন উনি আর ভাড়াটে রাখবেন না, এতে আপনার আপত্তি কিসের' ? 'আমি তো তাতে আপত্তি করিনি রতন বাবু, আসলে আপনি কিছু না জেনেই বিষয়টার মধ্যে ঢুকেছেন তো তাই আপনার একটু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে'. একইরকম নির্লিপ্ত গলায় বলে মহিলা। রতন সম্পূর্ণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে। সত্যিই তো সে এটার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানে না। কিন্তু তাই বলে একহাট লোকের মাঝখানে এভাবে অপদস্থ হওয়া প্রায় যেচে চড় খাওয়ার সামিল। সে ভেবেছিল পাড়ার অন্যান্য সমস্যার মতো এটাও তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে, উল্টে এই বাচাল মহিলার শব্দবোমা সহ্য করতে হচ্ছে এখন। দুয়ে মিলে বেশ ফাঁপড়ে পড়ে রতন। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে মহিলা খুব ধীর লয়ে বলে, 'নিবারণ বাবু, আমাদের তো দুবছরের এগ্রিমেন্ট হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে জরুরি পরিস্থিতিতে যদি আপনাকে বাড়ি খালি করতে হয় তাহলে ভাড়াটেকে অন্তত তিন মাস সময় দিতে হবে। অথচ আপনি বলছেন সামনের মাসেই উঠে যেতে হবে, এটা কি ন্যায্য কথা হলো বলুন' ?

'ও ওসব এগ্রিমেন্ট ফেগ্রীমেন্ট আমাকে দেখাতে এস না মেয়ে, আমার বাড়ি খালি করে দিতে হবে ব্যাস, এইটে আমার সাফ কথা' ! উত্তেজিত হয়ে ওঠেন নিবারণ। মহিলাটি দ্রুত ঘরের ভিতর চলে যায়, পরমুহূর্তেই একটা দলিল হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে আসে। রতনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে , 'আপনি পড়তে পারেন তো' ?
- আজ্ঞে ?
- বাংলা..... আপনি পড়তে পারেন নিশ্চই......?
রতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এ তাচ্ছিল্যের কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। শুধু সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলে, 'হ্যাঁ পারি......কেন' ?
- তাহলে এই পাঁচ নম্বর পয়েন্টটা পড়ুন একবার, জোরে জোরে।

রতন দলিলটা হাতে নিয়ে পাঁচ নম্বর পয়েন্টটা খুঁজে নিয়ে পড়তে শুরু করে, 'এমতাবস্থায় কোনো বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজন পড়িলে, বাড়ি খালি করিবার স্বার্থে, বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে অন্ততঃ পক্ষে তিন মাস সময় দিবেন। কোনো প্রকারের বলপ্রয়োগ বেআইনি বলিয়া গ্রাহ্য হইবে'।
'নিশ্চই বুঝতে পারছেন আমি ভুল কিছু বলছি না', কথাটা রতনের উদ্দেশ্যে বলে মহিলা। রতন ধীরে ধীরে দলিলটা ফিরিয়ে দেয়, কোনো কথা বলে না। ভিতরে ভিতরে লজ্জিত হয় বেশ। তারপর নিবারণের দিকে তাকিয়ে বলে, 'নিবারণ কাকা, দলিলে যা লেখা আছে, তাতে করে তো ওনার কিছুটা সময় পাওয়ারই কথা, আপনি বরং এ নিয়ে আর ঝামেলা করবেন না, উনি তো বলছেন চলে যাবেন, একটু অপেক্ষা করুন'। 'ওঃ, তার মানে আমার বাড়ি আমি খালি পাব না, তাইতো ? ঠিক আছে আমিও দেখবো, যতদূর যেতে হয় ততদূর যাবো', গজগজ করতে করতে ভিতরে চলে যান নিবারণ।

ভিড়টা যথারীতি পাতলা হয়ে যায় আস্তে আস্তে। সম্ভাব্য যাত্রাপালার এমন যবনিকাপাত হওয়াতে প্রায় সকলেই ক্ষুন্ন মনে যে যার পথ ধরে। ভাড়াটে মহিলার দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে রতন বলে, 'ইয়ে ম্যাডাম.......... মানে আমি খুব সরি, আপনাকে একটু ধমকে ফেলেছি, আমি আসলে জানতাম না কেসটা'। মহিলা খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রতনের দিকে। সে তাকানোর অর্থ যে কি, তা রতন বিস্তর ভেবেও খুঁজে পায় না। একটাও শব্দ খরচ না করেই মহিলা ঢুকে যায় ঘরের ভেতর। রতন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়।

পুরুষরা কিছুতেই নিজের পুরুষকারে ঘা খাওয়াটা সহ্য করতে পারে না, সে যত হীন, দুর্বল পুরুষই হোক না কেন, তাও যদি আবার নিজের মুর্খামির জন্য হয় তাহলে তো আর মুখ লুকোবার জায়গা থাকে না। সেখানে রতনের মতো বীরপুঙ্গব হলে অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে ওঠে। সমস্ত দিন এক আশ্চর্য রকম অস্বস্তি নিয়ে ছটফট করতে থাকে রতন। ভিতরে ভিতরে অনুশোচনাও হয় খুব। সারারাত ভাবতে থাকে কিভাবে এই অনিচ্ছাকৃত ভুল শোধরানো যায়..........

( ক্রমশ )

ছবি : গুগল 


 #bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories  #love #romance

Tuesday, September 13, 2016

সাপ্তাহিকী ১৬ # দুর্গা

'এ বছর কেমন অর্ডার হলো গো' ? সোমলতা বঁটিতে খড় কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করে রাখালকে। দাওয়ার এক কোনে বসে রাখাল এক মনে মাটি লেপে যায় মৃন্ময়ী মুখের ওপর। কথাটার খুব একটা আমল দেয় না সে, দ্রুত হাতে কাজ শেষ করতে হচ্ছে এখন, পুজোর বেশি দেরি নেই আর। শেষ বেলার অর্ডারগুলো ছেড়ে দিতে পারলে তবে নিশ্চিন্তি। সোমলতা আবার জিজ্ঞেস করে, 'কি গো ? কথার উত্তর দিচ্ছ না যে মোটে '? নিপুণ হাতের টানে মাটি কেটে দেবীর চোখ তৈরীর কাজ শেষ করে রাখাল। ছাঁচটা আলতো করে পাশে রেখে উঠে গিয়ে বালতির জলে হাত ধুতে ধুতে বলে, 'মা লক্ষীর কৃপায় এবার মন্দ হয় নি, শুধু বিষ্টিটা আর না হলেই বাঁচি'। খড়ের বান্ডিল হাতে নিয়েই দুহাত মাথায় ছোঁয়ায় সোমলতা। বিড়বিড় করে বলে, 'মা, মাগো, জগজ্জননী মা, দেখো একটু'। হলদেটে তাঁতের শাড়ির আঁচলের মতো বিকেলের পড়ন্ত আলো এলিয়ে পড়ে আছে উঠোনের পশ্চিম দিকটায়। সেদিকে তাকিয়ে রাখাল জিজ্ঞেস করে, 'দুগ্গা ফেরেনি এখনো' ?

বলতে বলতেই দুদ্দাড় করে ছুটতে ছুটতে ঢোকে একটি বছর সতেরোর শ্যামলা তরুণী। 'মা ভাত দাও তাড়াতাড়ি। আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেলো'। সাইকেলটা কোনোরকমে হেঁশেলের দেওয়ালের ওপর হেলান দিয়ে রেখে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় সে।

- ঐ এলেন, দুদণ্ড জিরোবার সময় নেই, সবসময় যেন রেলগাড়ির মতো ছুটছে, বলি হাত মুখটা তো ধুবি, তবে তো ভাত বাড়ব.......

'আমি হাত মুখ ধুয়ে নেব মা, তুমি ভাতটা বাড় দেখি তাড়াতাড়ি', ঘরের ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে বলে দুর্গা।

সোমলতা ব্যস্ত হয়ে বঁটি সরিয়ে উঠে পরে, গাল ফুলিয়ে বলে, 'আমি অত হুড়োমাতুনি করতে পারবো না বাপু, আসন পাত্চি, ধীরে সুস্থে এসে বোসো'।  

রাখাল মৃদু হাসে, মা মেয়ের কথা চালাচালিতে বেশ মজা লাগে তার। দাওয়ায় বসে মৌজ করে বিড়ি ধরিয়ে তালপাখা ঘোরাতে থাকে একহাতে। দুর্গা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে ইতিমধ্যে, শাড়ি ছেড়ে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নিয়েছে, গোয়ালপাড়ায় রিন্টুদের বাড়ি যেতে হবে। কিছু ছাত্রছাত্রী পড়ায় সেখানে। বাবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে দুর্গা। যৎসামান্য প্রসাধনে পানপাতার মতো মুখখানা লাবণ্যময় লাগে। দেখে ভারী মায়া হয় রাখালের। অভাবের সংসারে মেয়েটার যত্নআত্তি হয়না তেমন। অথচ গেলো বার মাধ্যমিকে দারুন ফল করে রাখালের বুকটা গর্বে ভরিয়ে দিয়েছে। তাই পণ করেছে, যে করেই হোক মেয়েকে যতদূর পারবে লেখাপড়া শেখাবে, সমাজের চারটি লোকের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াবার যুগ্যি করে তুলবে। অনটনের গেরস্থে সেটা খুব একটা সহজ কাজ নয় তা খুব ভালো করেই জানে দুর্গা আর তাই ছাত্র পড়িয়ে সেও যতটা সম্ভব বাবার বোঝা লাঘব করার চেষ্টা করে। দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়, সন্ধ্যে নেমে আসছে, ছেলেমেয়েগুলো হাঁ করে বসে থাকবে.............

"দু এক্কে দুই .....দু দুকুনে চার.........তিন দুকুনে ছয়........ চার দুকুনে আট......" দুলে দুলে নামতা মুখস্থ করতে থাকে কচি ছেলেমেয়ের দল।

বাকিদের কিছু সরল যোগ বিয়োগের আঁক কষে দেখায় দুর্গা। কিন্তু কিছুতেই যেন আজ মন দিতে পারে না সেদিকে। বারে বারে অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। চোখ চলে যায় উত্তরের জানলার বাইরে। পলকা হাওয়ায় ছিট্ কাপড়ের পর্দা উড়তে থাকে আর সেই পর্দার আড়াল দিয়ে আড়চোখে দেখতে থাকে দুর্গা।

চায়ের দোকানের ঠিক বাঁদিক ঘেঁষে তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর। কিছু একটা বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে আর মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ চাউনিতে রিন্টুদের বাড়ির এই জানলাটা মেপে নিচ্ছে একনজর করে। ছেলেগুলোকে চিনতে পারে না দুর্গা। কিন্তু তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু এবং চাউনির লক্ষ্য যে সে নিজে সেটা বুঝতে একফোঁটা অসুবিধে হয় না তার। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি ক্রমাগত খোঁচা দিতে থাকে তাকে।

ঘড়ির কাঁটায় সাতটা বাজে। আজ আর মন দিতে পারছে না দুর্গা। নির্ধারিত সময়ের আগেই সে ক্লাস ছুটি দিয়ে দেয়। ছুটির আনন্দে কচিকাঁচার দল হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে যে যার মতো।

শুধু রিন্টু এসে অপার বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, 'দিদি, আজ যে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিলে' ?

রিন্টুর সরল প্রশ্নে হেসে ফেলে দুর্গা, বলে, 'আজ দিয়েছি, কাল কিন্তু সব অঙ্ক করে রাখিস, তবেই ছুটি, মনে থাকে যেন'।

বাধ্য ছাত্রের মতো ঘাড় হেলায় রিন্টু। দুর্গা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে সেই তিনটে ছেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবকটাই তেইশ চব্বিশ বছরের আশেপাশে। ঠিক ঠাহর করতে পারে না তাদের। তবে, একটি ছেলের মুখ যেন আবছা মনে পড়ছে এখন। গতমাসের ভোটে এই ছেলেটিকেই ঝান্ডা লাগাতে দেখেছিলো না তাদের পাড়ায় ? তাই তো ! জামালপুরের পার্টি অফিসে হপ্তা দুয়েক আগে গিয়েছিলো বাবার সাথে একটা কাজে, হ্যাঁ সেখানেও যেন দেখেছে এই ছেলেটিকে। কি যেন নাম বলছিলো, কি যেন.................
নাহ কিছুতেই মনে করতে পারে না সে। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় দুর্গা, গোয়ালপাড়া ছাড়িয়ে, পুকুরঘাট পেরিয়ে নিজের পাড়ার দিকে ঘুরে যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই।

এরপর কয়েক দিন কেটে যায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত দুর্গার জীবন রুটিনমাফিক বয়ে চলে, যেমন করে খেয়ামতি বয়ে চলেছে গ্রামের দক্ষিণ দিক বরাবর, তেমনি। স্কুলে যাওয়া আসা, বন্ধুদের সাথে বটতলার মাঠে আড্ডা দেওয়া, বাবাকে হাতে হাতে মূর্তি গড়ার কাজ এগিয়ে দেওয়া, নিজের পড়াশুনো, রিন্টুদের বাড়ি ছাত্র পড়ানো সবই চলতে থাকে জাগতিক নিয়মের ফিতে বেঁধে।

এরই মাঝে তাল কেটে যাওয়ার মতো সেবন্তীর কথায় তার খটকা লাগে বেশ। সেবন্তী, দুর্গার সুখ দুঃখের সহচরী ও অভিন্ন হৃদয়ের সই।

স্কুল যাওয়ার পথে সে দুর্গাকে জিজ্ঞেস করে, 'কি ব্যাপার বলতো ? আজ কদিন ধরে লক্ষ্য করছি রন্জু  তোর পিছু পিছু ঘুরছে, কিছু হয়েছে'?

দুর্গা ভারী অবাক হয়ে বলে, 'রন্জু ! সে আবার কে' ?

'ওই তো, সুখেন মুদির ভাইপো, জামালপুরে থাকে, বাইক নিয়ে ঘোরে, পার্টি ফার্টিও করে নাকি শুনেছি', নিঁখুত বর্ণনা দেয় সেবন্তী। 

এক ঝট্কায় কদিন আগেকার কথা মনে পড়ে যায় দুর্গার। ঢোঁক গিলে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে, 'হ্যাঁ রে, মনে পড়েছে, কদিন আগে রিন্টুদের বাড়ির সামনেও দেখেছি, সঙ্গে আরও দুটো ছেলে ছিল, কি বিশ্রী চাউনি........ কিন্তু, তুই কি করে জানলি ?'

- রোজ স্কুলের ছুটির পর রন্জুকে দাঁড়াতে দেখছি চালতা বাগানের মোড়ে, আর তোর দিকেই যে নজর রাখছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন ?

- আসলে ওই জামালপুরের পার্টি অফিসে গিয়েছিলাম বাবাকে নিয়ে, বেশ কয়েকদিন আগে, সেখানে দু একটা ব্যাপারে কথা কাটাকাটি হয় আমার, হতে পারে সেটার জের থেকেই হয়তো.........

- সাবধানে চলাফেরা করিস দুর্গা, একটু নজর করিস সবদিক, তেমন উল্টোপাল্টা কিছু হলে জানাস, আমরা মহিলা সমিতিতে যাব.......

- আচ্ছা.......আজ তবে আসি রে, বাড়িতে আবার মেলা কাজ পরে রয়েছে.......

সেবন্তীকে হাত নেড়ে বাড়ির দিকে সাইকেল ঘোরায় দুর্গা, হাজারো চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে  থাকে। বাঁদিক ঘুরে শিবমন্দিরের দিকে যেতেই সামনে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। রন্জু দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে সেই দুটো ছেলে, পাশে একটা লাল বাইক দাঁড় করানো। পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায় দুর্গা, রন্জু পথ আটকে দাঁড়ায়। দুর্গার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।

শিবমন্দিরের এদিকের জায়গাটা নিঃঝুম থাকে বরাবর। আশেপাশে বাঁশবাগান ছাড়া আর কিছুই নেই, জলা জঙ্গল বলে লোকজন খুব একটা যাওয়া আসাও করে না তেমন। শর্টকাট হবে বলে প্রত্যেকবার এদিককার পথটাই ধরে দুর্গা। কোনোদিন কল্পনাও করেনি যে এমন বিপদ হতে পারে। রন্জু হেলতে দুলতে পান মশলা চেবানো দাঁত বের করে সামনে এসে দাঁড়ায়।

আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেয় সারা শরীরে। সে চাউনিতে দুর্গা কুঁকড়ে যায় খানিক। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ফেলে একটা কর্কশ সুরে বলে, 'রোজ রোজ ঘু ঘু তুমি খেয়ে যাবে ধান ? আর আমি কি বসে বসে শুধুই চেবাবো পান'?

খ্যাঁকখ্যাক করে পিছনের ছেলেদুটো হেসে ওঠে রন্জুর কথা শুনে ।

'কি চাও তুমি ?' দুর্গার গলা কেঁপে ওঠে।

'আমি সুধু তোমায় চাই গো দুগ্গাদেবী, সুধু তোমায় চাই', বলেই দুর্গার হাতটা খপ করে  চেপে ধরে রন্জু ।

তারপর চোখের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলে, 'কেন ? পার্টি অফিসে সবার সামনে আমাকে অপমান করার সময় মনে ছিল না? আজ যদি তোকে তুলে নিয়ে যাই, কেমন হয় ? তোর ফড়ফড়ে বুলি আওড়ানোর সখ একলপ্তে মিটিয়ে দিই, কি বল'? হিসহিসিয়ে ওঠে রন্জু ।

দুর্গা থরথর করে কাঁপতে থাকে সাইকেলটা চেপে ধরে। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় কেমন। নিথর মূর্তির মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময়ে উল্টো দিক থেকে ভঁপু বাজাতে বাজাতে একটা সাইকেল রিকশা আসতেই ঝট করে হাত ছেড়ে দেয় রন্জু । আর ওই সুযোগেই দুর্গা প্যাডেলে চাপ দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় তড়িঘড়ি। রিকশাটার জন্য দুর্গাকে আটকানোর সুযোগ পায়না সে।

তবু পিছন ফিরে চিৎকার করে বলে, 'ভাবিস না এখানেই শেষ হল, সন্ধেবেলা পড়াতে বেরোবি না ? তখন বাকিটা বুঝে নেব', বাইকে স্টার্ট দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যায় সবাই ।  

বাড়ি ফিরে কোনো কথা বলে না দুর্গা, কোনোরকমে ভাতের থালা নাড়াচাড়া করে উঠে পরে, ঘরে ঢুকে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। সোমলতার কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেয় না সে।

রাখাল পায়ে পায়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। জিজ্ঞেস করে, 'কি হয়েছে মা, আজ এতো চুপচাপ আছিস যে ? কেউ কিছু বলেছে ?

'কদিন ধরে একদল কুকুর তাড়া করছে বাবা', শান্ত স্বরে জবাব দেয় দুর্গা।

রাখাল সেকথার মানে বুঝতে পারে না। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মেয়ের দিকে।

দুর্গা স্মিত হেসে বলে 'মেয়েদের পিছনে ওমন অনেক কুকুর ঘুরঘুর করে বাবা, ভয় পেলে কি চলে আমাদের ? এখন উঠি বরং, যাই, ছাত্ররা অপেক্ষা করছে, আজ হয়তো ফিরতে একটু দেরি হবে আমার, সামনে পরীক্ষা আছে ওদের'।

'আমি কি তোকে নিতে আসবো' ? রাখাল উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে।

দুর্গা আস্বস্ত করে বলে, 'না না, তুমি কিছু চিন্তা করো না, আমি ঠিক চলে আসব'।

উঠোনের এক কোনে দাঁড় করানো প্রায় তৈরী হয়ে আসা দুর্গামূর্তিটা পিছন ফিরে দেখে একপলক, হ্যালোজেনের আলোতে মূর্তির ছায়ায় দুর্গার ছায়া মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে রিন্টুদের বাড়ির দিকে। মনের মধ্যে এলোপাথাড়ি হাওয়া তোলপাড় করতে থাকে.........

পড়াতে পড়াতে বারেবারেই দুর্গার চোখ চলে যায় বাইরের দিকে। চায়ের দোকানটা খোলা আছে বটে, তবে ছেলেগুলোকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। তবু যেন উদ্বেগের শেষ থাকে না, রন্জুর কথাগুলো ঘুরেফিরে মনের মধ্যে বাজতে থাকে একনাগাড়ে। আর সেগুলো মনে পড়লেই ভয়, লজ্জা আর কুন্ঠা মিশ্রিত একরকম ঘূর্ণিঝড় পাক খেয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত সম্ভ্রমের চাদরটা যে এভাবে ছিঁড়ে যেতে পারে তা এতটুকু আঁচ করতে পারেনি সে কখনোই, আর তাই ভিতরে ভিতরে একরকম বিতৃষ্ণা তৈরী হয়ে যায় অজান্তেই।

ঘড়ির কাঁটায় আটটা বাজতেই ছুটি দিয়ে দেয়। আজ আর শিবমন্দিরের রাস্তাটা ধরবে না সে। বরং হাটখোলা মাঠের পাশ দিয়ে চলে যাবে। একটু ঘুরপথে হবে যদিও, তবু ক্ষতি নেই। বেশ কিছুটা পথ যেতে হবে। প্যাডেল ঘোরায় দুর্গা।

গোয়ালপাড়ার পূর্বদিকটা পিছনে ফেলে দুচাকা এগোতে থাকে হাটখোলা মাঠের দিকে। সকাল বেলায় বাজার বসে এদিকটায়, দিব্যি গমগম করে তখন, সন্ধ্যে হলেই একটু শুনশান হয়ে যায়। দুচারজন পথচলতি মানুষ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না তেমন। আজ তবু একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে আকাশে।

এমন সময় ভটভট ভটভট করে গুরুগম্ভীর ইঞ্জিনের শব্দ হতে থাকে কোথাও যেন। পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করে দুর্গা, একটা তীব্র জোরালো আলো পিচ রাস্তার বুক ভেদ করে এগিয়ে আসছে। একসেকেন্ড সময় লাগে না বুঝতে যে সেটা রন্জুর বাইকের আওয়াজ। প্রমাদ গোনে দুর্গা। দেখতে দেখতেই বাইকটা চলে আসে সাইকেলের এক্কেবারে পাশে।

'আমায় ফেলেই চলে যাচ্ছিস যে' !

একটা বিশ্রী হেসে রন্জু ছুঁড়ে দেয় কথাটা, পিছনে বসা ছেলে দুটোও চিৎকার করে নানারকম আকার ইঙ্গিত করতে থাকে।

দুর্গা কোনো উত্তর দেয় না। ওদের অঙ্গভঙ্গি দেখে হাড় হিম হয়ে যায় পলকে। জোরকদমে প্যাডেল ঘোরাতে থাকে সে। চরম বিপদ যেন কালো মেঘের মতো গ্রাস করতে ছুটে এসেছে কোথা থেকে। বিস্তর জোরে চালিয়েও ইঞ্জিনের ক্ষমতাকে কিছুতেই টেক্কা দিতে পারে না দুর্গা।

রন্জু বাইকের সামনের চাকা দিয়ে একটা ছোট্ট ঠেলা দেয়। সাইকেল শুদ্ধু একেবারে আছাড় খেয়ে মাঠের ওপর পড়ে।

"মা গো" বলেই হাঁটু চেপে ধরে যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে দুর্গা। ওদিকে বাইকটাকে স্ট্যান্ড করে মাঠের ধারে রেখে ধীর পায়ে এগোতে থাকে রন্জু ও তার ছেলেরা। হিমেল স্রোত নেমে যায় দুর্গার শিরদাঁড়া বেয়ে, কোনোরকমে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে তোলে নিজেকে, তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটতে থাকে সামনের দিকে। পিছন পিছন রন্জুরাও ছুটতে শুরু করে বুনো হায়নার মতো।

নাগালের মধ্যে শিকার পেয়ে সবারই রক্ত ফুটতে থাকে টগবগ করে। বেশ কিছুটা দৌড়োনোর পর একটুকরো মাটির ঢ্যালায় হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে দুর্গা। থুতনিটা ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে।

একলাফে শিকারী কুকুরের মতো ছেঁকে ধরে রন্জুরা। কোনোরকমে হাঁচোড় পাঁচোড় করতে করতে উঠে দাঁড়ায় দুর্গা।

'এবার? এবার কি করবে দুগ্গাদেবী'? রন্জু বাঘের মতো এগিয়ে আসে সামনে।

পৈশাচিক উল্লাসে হাটখোলার মাঠ কেঁপে ওঠে। ঠোঁটের ডগায় জিভ লকলক করে ওঠে সবার।

দুর্গা বাঁ হাতের চেটো দিয়ে থুতনির কাছটা মুছে নেয় একবার। হাঁপাতে হাঁপাতে সরাসরি চোখ রাখে রন্জুর চোখে, তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে অদ্ভুত ভাবে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসতে থাকে হি হি করে।

হকচকিয়ে যায় রন্জু, বাকি ছেলেদুটোও, এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে অবাক বিস্ময়ে।

দুর্গা আঙ্গুল তুলে দেখায় পিছন দিকে। সে দিকে তাকিয়ে রন্জুর মুখে ধরা সিগারেটটা ফস করে পড়ে যায় মাটিতে। চূড়ান্ত ভয়ে মুখ সাদা হয়ে যায় সকলেরই। মাঠের ঈশান কোন বরাবর একদল ছায়ামূর্তি জড়ো হয়েছে। চাঁদের আলোয় সে অবয়ব পরিষ্কার হতে থাকে ধীরে ধীরে।

প্রায় ষাট সত্তরজন মহিলা আগুনে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তাদের প্রত্যেকেরই হাতে দা, কাস্তে, বঁটি, হাঁসুয়া, ঝলসে উঠছে সহস্র নক্ষত্রের রুপোলি আলোয়।

একফাঁকে মহিলা সমিতিতে দুর্গার দেখা করে আসার ঘটনাটা রন্জুরা টের পায়নি কখনোই। বিপদের পাশাটা আমূল বদলে উল্টে যায় তাদের চোখের সামনেই। শিকারী হতে গিয়ে যে শিকার হয়ে যেতে হবে এমনটা রন্জুরা আঁচ করতেই পারেনি।

কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে বসে পড়ে তিনজন মাঠের ওপরে। করুনার আর্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দুর্গার দিকে।

দুর্গার এলোচুল উড়তে থাকে মেঠো হাওয়ার টানে, চন্দ্রলোকের মায়াবী ছটায় দেবীর চেয়ে কম কিছু মনে হয় না তাকে। বহুদূরে, শেষপ্রান্তে কারা যেন.কোলাহল করে ওঠে .........'বলো দুগ্গা মাইকী'..........গ্রামের কোনো এক পাড়ার প্যান্ডেলে মা আসছেন বোধহয় .............






#bengalishortstories #womenempowerment #durgapuja #thrill    


Saturday, September 3, 2016

জিয়ানস্টাল ২ # অফ পিরিয়ড

"দুই......চাআআর.......ছওওওক্কা........ "
কোথা থেকে যেন উটকো কথার টুকরোগুলো কানে এসে ঠক করে লাগলো। গেলো হপ্তার কথা। নিউআলিপুর থেকে বাসে উঠেছি অফিস যাবো বলে। পিছনের দিকে একটা জানলার ধারের সিট পেয়ে বেশ আয়েশ করে বসেছি। হাঁসফাঁশ গরমে মৃদুমন্দ এসির হাওয়ায় শরীরটা বেশ জুত লাগছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ফাঁকা বাস তায় আবার উইন্ডো সিট্ ! চোখ বুজে ভাবছি বঙ্গলক্ষী বাম্পার লটারীটা কাটবো কিনা, এমন সময় আবার সেই অযাচিত শব্দধ্বনি। আচ্ছা জ্বালা তো ! সাময়িক নিরিবিলির ব্যাঘাত ঘটাচ্ছো কে ভাই ? বলি ব্যাপারখানা কি ! পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দভেদী বাণের মতো জোরালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম। যা দেখলুম তাতে থ হয়ে গেলুম খানিক। দুটো স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলে একটা বই নিয়ে প্রজাপতির ডানার মতো একবার খুলছে আবার বন্ধ করছে, আর মাঝেমাঝেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠছে ...."চাআআর....ছওওওক্কা...."  পোলাপানরা করে কি !! ছানাবড়াও লজ্জা পাবে এমন গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলুম। প্রায় ফসিল হয়ে যাওয়া একটা খেলা, সেটাই কিনা এই স্মার্ট ফোন, এংগ্রি বার্ডের যুগে দিব্যি খেলে চলেছে দুজনে ! একরাশ প্রভাতী শিউলি ফুলের মতো অদ্ভুতরকম বুকচাপা আনন্দ ঝরে পড়লো মনের মধ্যে, বড় মনভালো করা এক সৃষ্টিছাড়া আবেগ। প্রায় কুড়ি বছর পর কাউকে "বুক ক্রিকেট" খেলতে দেখলুম......... 

আবছা আলোয় একটা কাগজের উড়োজাহাজ উড়ে গেলো যেন চোখের সামনে দিয়ে, সে উড়োজাহাজ এঁকে বেঁকে গোঁত্তা খেয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লো একেবারে আমাদের ক্লাস টু এর ঘরটাতে। স্পষ্ট দেখতে পেলুম এমন প্রচুর উড়োজাহাজ ক্লাস জুড়ে উড়ে চলেছে জলফড়িঙের মতো, এর ওর হাত থেকে পটাপট তৈরী হয়ে যাচ্ছে সাদা সাদা রুলটানা কাগজের অজস্র খোয়াবি উড়ান। খেয়ালি হাওয়ার টানে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত আর সেই স্বপ্নের উড়ানে সওয়ারী হয়ে খিলখিলিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের গোল্লাছুটের দিনগুলো। কতরকম যে খেলা খেলতাম সেসময় তার ইয়ত্তা নেই। মনে আছে, আমাদের ক্লাস ফোরে এই বুক ক্রিকেট খেলাটাই খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ক্রমশ সে এক মহামারীর আকার ধারণ করেছিল। একেবারে টুর্নামেন্ট অবধি গিয়ে ঠেকেছিল শেষটায়। আমার ধারণা শুধু আমাদের স্কুল কেন, কমবেশি সকলের স্কুলেই এমন অসংখ্য বেমক্কা খেলার রসবড়া সাজানো থাকতো থরে থরে, যা সকলে মিলে চেটেপুটে খেলেও আশ মিটতো না এতটুকু। এ সমস্ত বেঞ্চ গেম্স্ নিতান্তই খেলা ছিল না তখন, বরং বন্ধুদের সাথে দেদার খিল্লি করার নানাবিধ ফিকির ছিল যা আমাদের সবাইকে এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘন করে বেঁধে রাখতো, আলগা হওয়ার জো ছিল না মোটে। সেসব খেলাগুলো যখন মনের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ভিড় করে এলই, তাহলে বরং তরিবত করে দু চার কলম বলেই ফেলি।

শুধু ক্রিকেটেই আমাদের নন্দী ভৃঙ্গীর নাচগুলো থেমে থাকে নি। 'চোর -পুলিশ -বাবু' র পুরিয়া তোলা, আঙ্গুল পেতে 'ইকির মিকির' খেলা, 'নেম, প্লেস, এনিম্যাল, থিং' কাগজের ওপর লিখে একই শব্দ খুঁজে বার করা, রাবারব্যান্ডে কাগজের গুলতি তৈরী করে একে ওকে ছুঁড়ে মারা, ইরেযারের ওপর নামের আদ্যক্ষর লিখে লুডো খেলা, রাফ খাতার পাতা ছিঁড়ে কাগজের বন্দুক বানানো, এমনকি বেঞ্চের ওপর ফুটবল পর্যন্ত শুরু হয়ে গিয়েছিলো একসময়। বেঞ্চের একপ্রান্তে আঙ্গুল ছড়িয়ে গোলপোস্ট বানানো ও  শেষপ্রান্ত থেকে টিপ্ করে পেন্সিল ছুঁড়ে গোল করা প্রায়শই অফ পিরিয়ডে গনউৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমাদের। সচরাচর এই অফ পিরিয়েডেই আমাদের মাথার পোকাগুলো গা ঝাড়া দিয়ে উঠতো বেশি করে। অপেক্ষা করে থাকতুম ক্লাসের ফাঁকে কখন একটু সময় পাবো, আর তারপরেই শুরু হতো ইতরামির চুড়ান্ত। সেসব চরম বেলেল্লাপনায় হাতযশ ছিল প্রায় সবারই, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে। একটা বিপজ্জনক খেলা ছিল সেসময়। 'রসকষ, সিঙ্গারা, বুলবুলি, মস্তক'।  অবশ্য এক্ষেত্রে একজনের বিপদই হতো বেশি, আঙ্গুল গুনে শেষমেশ যে পড়ে থাকতো তারই কপাল পুড়ত অনেকটা। হাঁড়িকাঠে গলা দেবার মতো করে তাকে হাত বাড়িয়ে দিতে হতো সামনে, আর পালা করে সকলে মিলে পরের পর চটাস চটাস করে চড় মেরে চলত তার হাতে। বলাই বাহুল্য সে রামচড়ের ধাক্কায় শুধু তার হাত নয়, শরীরের বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গও জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠতো। মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে, কিছুই হয়নি ভাব করে বেমালুম সহ্য করতে হতো সেসব অত্যাচার। তবে সে খেলা শেষের দিকের ক্লাসগুলোতে খুব একটা খেলা হতো না কারণ সে আড়ংধোলাই কেউই খুব একটা খেতে রাজি হতো না তেমন।

মনে পড়ে, সেই সময় দূরদর্শনে 'ছন্দবাণী ক্লাব' বলে একটি সিরিয়াল হতো। ছন্দ মিলিয়ে কথা বলা সেই সিরিয়ালের এক বৈশিষ্টতা ছিল। দেখাদেখি আমরাও কয়েকজন সেবার খুব ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলুম ক্লাসে। সেসব ছন্দ কাল হয়ে বিপদ ডেকে এনেছিল। একবার ক্লাসে আমার এক সহপাঠী কোনো এক প্রশ্নের উত্তর ছন্দ মিলিয়ে দিতে গিয়েছিল। ফলস্বরূপ স্যারের ছোঁড়া ডাস্টার অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তারপর থেকে আমরাও বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো সহজ সরল ভাষাতেই কথা বলতুম। সেসমস্ত ছন্দের আকরে আমাদের ছোটবেলার দুরন্তপনাগুলো নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে আজও, বয়সের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেও, কয়েক যোজন দূরের কচিবেলার সোঁদামাটির ঘ্রাণে তা একইরকম মিঠে ও স্মৃতিমেদুর। আজকের আধুনিক খেলাধুলোয় সেগুলো বেমানান লাগলেও আমাদের হৃদয়ে তারা এমনভাবেই মাঝেমাঝে ডুবসাঁতার দিয়ে বুড়বুড়ি কেটে উঠবে নিশ্চিত ভাবেই। হাজার সুনামিতেও ধুয়ে মুছে মিলিয়ে যাবে না কখনো, মিলিয়ে যাতে পারে না....... কিছুতেই।

বাস থেকে নামার সময় হয়ে গেছিল। মুখ ঘুরিয়ে ছেলেদুটোকে দেখে নিলুম এক পলক, সকালবেলার নরম রোদে ঝক্ঝক করছে মুখগুলো, মনে হল পুরোনো কিছু কিছু খেলা হারিয়ে যায় না কখনো, ইতিহাসের গল্পদের মতো ঘুরে ফিরে এমনি করেই আসে বারেবার, মনকেমনের দরজায় কড়া নাড়িয়ে, রঙচটা পিলসুজের আগুন একবার হলেও অন্ততঃ উস্কে দিয়ে যাবে, সেটাই তো নিয়ম.............তাই না ?

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : অনুরাধা সেনগুপ্ত
বেশ কিছু বেঞ্চ গেম্স্ ভুলিয়েই গিয়েছিলুম প্রায়। এই লেখাটা লিখবো বলে ওর সাহায্য চাইতেই এক পায়ে খাড়া হয়ে অতদূর থেকেও সময় করে সমস্ত গেমসের নাম পাঠিয়েছিল। পুজোর আগে তোর জন্য একগোছা কাশফুল, অনু, ভালো থাকিস।  

ছবি : গুগল    
#bengaliarticles #schooldiaries #schoolarticles #schoolwriteups #navanalanda #navanalandaalumni #nostalgia #oldschool #schoolmemories #bookcricket #schoolgames   

Friday, September 2, 2016

হরতাল

স্তব্ধ বাজার স্তব্ধ শহর, অবাক রাস্তা ঘাট
বন্‌ধ আমাদের জাতীয় ছুটি, বন্‌ধ জিন্দাবাদ।

সকাল থেকেই সাইলেন্টে.... মোবাইল ভাইব্রেটর
আজকে অফিস ? পাগল নাকি ? ভয়ানক জেরবার !

কি থেকে কি হয় যে বিপদ, কিসের আছে মানে......
প্রাণটা তবে যায় বেঘোরে, কখন যে কে জানে !

মিটিং মিছিল চলছে হেথায়, দূর্গাপুরের ব্রিজে
হাঁড়ির খবর জমে বরফ, ডাবল ডোরের ফ্রিজে

মোটের ওপর দিনটা কাটে, হরেক কথায় কাজে
বন্‌ধ টা যেন কিসের ছিল ? প্রশ্নটা খুব বাজে !

যাগ্গে তবে, কি আর এমন ! কয়েক কোটি জলে
আমার তাতে কি আসে যায়, অমন কতই চলে

আবোল তাবোল রাজনীতির, ওরা করুক মুন্ডপাত
বন্‌ধ টা গুরু বেজায় ভালো...... বন্‌ধ জিন্দাবাদ !!

ছবি : নিজস্ব 


















#bengalipoems #poetries #banglabandh

Tuesday, August 30, 2016

সাপ্তাহিকী ১৫ # ঢাকাই জামদানি

প্যাকেটটা খুলেই চোখ কপালে উঠে যায় সুজাতার। একি কাণ্ড ! এমনটা তো হবার ছিল না। ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে সে বারকতক। নাহ, এড্রেস তো ঠিকই আছে, নিজের নামটাও জ্বলজ্বল করছে লেবেলের ওপর। প্রেরকের নামটাও দিব্যি মিলে গেছে। তাহলে ? তবে কি পুরো টাকাটাই চোট গেলো ? মনে মনে হায় হায় করতে থাকে সুজাতা। অমন খাদি সিল্কের ওপর হাফ এন হাফ প্যাটার্নের ময়ূরপঙ্খী শাড়ি, সেটা কিনা আমূল বদলে গিয়ে সিঁদুর আলতা রঙের ঢাকাই জামদানি এসেছে ! বলিহারি যাই, এমন ভুলটা সে করলো কি করে ? শাড়ি কেনার ব্যাপারে এমন ভুল তো তার হয়না সচরাচর। বরং পরিচিত মহলে তার শাড়ি সিলেকশনের বেশ কদর আছে। গড়িয়াহাট, নিউমার্কেট চষে, সময় নিয়ে, যত্ন করে, বাছাই করা যেসমস্ত শাড়ি সে কিনে এসেছে এতকাল, তা তারিফযোগ্য বললে কম বলা হবে। বরং হালফ্যাশনের অফবিট শাড়িই হোক অথবা আদি অকৃত্রিম, সাবেকি ধাঁচেরই হোক, শাড়ির কালেকশন নিয়ে তাকে যে বরাবর সমীহের চোখে দেখে লোকজন তাতে তার প্রচ্ছন্ন গর্ববোধটা তার আঁচলের মতোই ফিন্ফিনে আলগা হাওয়ায় উড়তে থাকে বেশ। আর সেই কিনা এই ভুলটা করে বসলো ! ছি, ছি................

প্যাকেটটা নিয়ে সে একছুটে ভিতরের ঘরে চলে যায়। তাড়াতাড়ি মোবাইলে অনলাইন শাড়ির পোর্টালটা খোলে। অর্ডার লিস্ট চেক করে দ্রুতগতিতে।  নাহ, সে তো ঠিক অর্ডারই দিয়েছিলো। যাক ! তার মানে ভুল সে করেনি, শাড়িটা যারা পাঠিয়েছে তারাই গন্ডগোলটা পাকিয়েছে তাহলে। এই হচ্ছে মুশকিল ! মনে মনে ভাবে সুজাতা। বরাবর সে পায়ে হেঁটে, দোকান ঘুরে, অজস্র, অগুন্তি শাড়ি নামিয়ে, একেবারে চিলের চোখে জরিপ করে, তবে মনের মতো দুএকটায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে যুদ্ধজয়ের উল্লাস করে। সেখানে অনলাইন বলে মনটা একবার খুঁতখুঁত করেছিলো বটে তবে পছন্দসই শাড়িটা পেয়ে যেতে আর দ্বিতীয় বার ভাবে নি। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে একচান্সে 'অর্ডার নাউ' বাটনটা টিপে দিয়েছিলো নির্দ্বিধায়। যেমন চোখটানা ময়ূরপঙ্খী রঙ, তেমনি মনকাড়া ডিজাইন, ছাড়া যায় না কি কখনো ? অষ্টমীতে একবার গায়ে তুলতে পারলে আর দেখতে হবে না। হাঁ হয়ে থাকা ছাড়া আর গতি থাকবে না কারোর। সবার ট্যারা চাউনিগুলোই মেডেলের মতো গলায় শোভা পাবে নির্ঘাৎ।..............  অথচ এখন ? নিজের গালেই ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে সুজাতার। অর্ডার বিলে ফোননম্বর আছে কি না চেক করতে থাকে সে। পাওয়া গেছে !! যাক, এইবার ফোন করতে হবে, আচ্ছা করে দুচার কথা শুনিয়ে দিতে হবে যা হোক। শাড়ি নিয়ে ইয়ার্কি ? বুঝবে বাছাধনরা ! তড়িৎগতিতে আঙ্গুল চালিয়ে নম্বর ডায়াল করে। কিছুক্ষন কথা বলে দূরভাষে, তারপর একরাশ বিরক্তি আর পাঁচন গেলা মুখ নিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। সকাল সকাল তেতো হয়ে যায় মনটা। কোনোরকমে নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে চলে যায়। ফিরে এসে অভিরূপকে জানাতে হবে। ভালো গ্যাঁড়াকল হলো !............

সেদিন রাত্রে

- এই শুনছ ? কি গো ?
- হুমমম......
- শোনো না, একটা কথা আছে....
- কি ?
- আহ ! কি সারাক্ষন টিভিটা মুখে করে নিয়ে বসে থাকো। আমার তো কোনো কথা থাকতে পারে, নাকি ?
- শুনছি তো....বলো.....
- বলছি কি, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে...... 
- হুমমম.......
- দেখেছো তো, আমাকে পাত্তা না দেওয়াটা তোমার কেমন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, টিভির মধ্যে তো ঢুকে যাবে এবার ! আমার দিকে ঘুরে বসো তো, ইম্পরট্যান্ট কথা আছে.......
- আঃ,.. আচ্ছা জ্বালাতন মাইরি, কি হয়েছে কি ? 

টিভির দিকে চোখ রেখে বিছানার ওপর এলিয়ে শুয়ে ছিল অভিরূপ। সুজাতার কথায় সামান্য বিরক্তি নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে।

- দুদিন আগে একটা শাড়ি অর্ডার করেছিলুম অনলাইনে, আজ সকালে দেখলাম ভুল শাড়ি এসেছে। 
- বেশ তো, ফিরিয়ে দিলেই হলো। 
- সে চেষ্টা কি আর করিনি ভাবছো ? ফোন করেছিলাম তো। বলল, ছবি তুলে, অর্ডার নাম্বার দিয়ে একটা মেল্ করতে হবে। 
- হ্যাঁ, করে দাও, কি অসুবিধে ?
- সকাল থেকে চেষ্টা করছি, একদম পারছি না, বলছি কি......... তুমি একটু মেলটা করে দাও না....... 
- আশ্চর্য ! তুমি অনলাইনে শাড়ি অর্ডার করতে পারলে আর একটা মেল্ করতে পারছ না ? ওটাও আমাকে করতে হবে ?
- করে দাও না লক্ষীটি, দেখছো তো বিপদে পড়েছি। 
- অদ্ভুত !

সুজাতার মোবাইলটা নিয়ে বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে নেট অন করে অভিরূপ। টিভিতে টি২০ সিরিজটার মাঝে ব্যাঘাত সহ্য হয় না মোটে, নিঃশব্দ কষাঘাত অনুভূত হয় যেন সারা শরীরে। কিন্তু উপায়ও নেই, যতক্ষণ না কাজটা করবে কানের কাছে একনাগাড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো বলতেই থাকবে সুজাতা। বিড়বিড় করতে থাকে অভিরূপ মনে মনে বলে, 'যত্তসব আদিখ্যেতা'। শাড়িটা বের করে দেয় সুজাতা। অভিরূপ একনজর দেখে শাড়িটার দিকে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে, 'শাড়িটা অন্য কাউকে দিয়ে দিলেই তো হয়, আত্মীয়স্বজন তো কম নয় আমাদের কারোর'।

-প্রথমটা তেমনই ভেবেছিলাম জানো, কিন্তু পরে মনে হলো এই শাড়িটা পড়ার মতো লোক নেই। 
- কেন ? মা......
- তোমার মা ঠিক এই রঙের ঢাকাই জামদানি পড়বেন না এই বয়েসে। আমি জানি। 
- তাহলে মাসিমণি ?
- খেপেছ নাকি ! বিরাট কারুকাজ করা শাড়ি মাসিমণি মোটেই পছন্দ করেন না, সেবার দেখলে না, তসর দিয়েছিলাম, তাও পাড়ে অত কলকার কাজ করা ছিল বলে তুলে রেখেছিলেন। জোরাজুরি করতে চুমকির মুখেভাতে পরেছিলেন কোনোরকমে। না না, মাসিমণি এটা পছন্দ করবেন না।  
- আচ্ছা সে নাহয় হলো, তোমার সেজকাকিমা ? তিনি তো বেশ সাজতে টাজতে ভালোবাসেন, ওনাকে দিয়ে দিলেই তো হয়।  
- হুমম, কায়দা করে ফোন করেছিলাম আজ বিকেলে, বললেন লাল রঙটা নাকি এভোয়েড করছেন ইদানীং......কি একটা যেন সমস্যা হচ্ছে।  
- সে আবার কি ? ইদানীং এভোয়েড করছেন মানে !! এ আবার কেমন কথা ? 
- কি জানি বাপু, কি ব্যাপার, ওনার যে কখন কি মর্জি হয় !! জানোই তো ওনাকে ? ছেলের বিয়েতে লগ্ন নিয়ে কিরকম সিন্ ক্রিয়েট করলেন....মনে নেই ? 
- হুমম, তবে একটা কাজ করো, বিন্দুপিসিকে দিয়ে দাও, অমন ফর্সা গায়ের রঙ, মানাবে ভাল, তাই না ?
- না ওটা করা যাবে না, গতবার পুজোয় এই ঢাকাই জামদানিই দিয়েছিলাম। পরপর একইরকম হলে মুখ ব্যাঁকাবে। তার চেয়ে বরং দেরি না করে তুমি মেলটাই করে দাও, শাড়ি নিয়ে চলে যাক, আমার টাকাটা ফেরত দিক।   

অভিরূপের মুখ ব্যাজার হয়ে যায়। কোনোভাবেই এই উটকো ঝামেলাটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। সমস্ত অস্ত্রই বিপক্ষ শিবিরে লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়। অগত্যা...... বাধ্য সেবকের মতো মেল্ করতে বসে যায় সে। বেশ কিছুক্ষন ধরে নাড়াঘাটা করতে থাকে মোবাইলটা নিয়ে, শেষমেশ, 'দুত্তোর' বলে দুধ সাদা যন্ত্রটা ফেলে রাখে পাশে, নিজেও গা এলিয়ে দেয় কোলবালিশটা জড়িয়ে। সুজাতা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, 'কি হলো, পাঠালে না' ?
- নাহ তোমার মোবাইলটা ভারী অদ্ভুত, নেট আসছে যাচ্ছে, কিছুতেই ছবিটা এট্যাচ হচ্ছে না। 

সুজাতা চোখ সরু করে তাকায় অভিরূপের দিকে, হাড়ে হাড়ে চেনে সে। যেটা ইচ্ছে করবে না সেটা কোনো না কোনো অজুহাতে ঠিক পাশ কাটিয়ে চলে যাবে অভিরূপ। তাই মোবাইলটা নিজে হাতে নিয়ে চেক করে..... সত্যিই নেটটা প্রব্লেম করছে। বিরক্ত লাগে সবকিছুর ওপর, তারচেয়েও বেশি করে যেন নিজের ওপর, কেন যে অর্ডার করতে গেলো সেদিন, এখন হাতে নাতে ফল পাচ্ছে। নেহাত এইরকম একটা শাড়ির প্রতি অনেকদিন ধরেই ঝোঁক ছিল....... সেজন্যই তো, তাই বলে যে এমন উটকো গাড্ডায় পড়বে এমনটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। নইলে কি আর শাড়ির অভাব ? তবে কম দাম নয় শাড়িটার, কড়কড়ে সতেরোশো টাকা গুনে দিয়েছে, এখন ফেরত দিতে না পারলে..... মনের মধ্যে নানারকম চিন্তা ভাবনার স্রোত বয়ে চলে। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সুজাতা, একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা লেগে আসে চোখে। পাশে অভিরূপ একমনে খেলা দেখে চলে টিভিতে.......... 

পরদিন সকালে 

- 'বিছানার চাদরটা টানটান করে পাত মুনিয়া। শোবার ঘরের চাদর কুঁচকে থাকলে ভীষণ গা ঘিনঘিন করে'।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে কথাগুলো বলে সুজাতা। কথাগুলোতে যেন একটা চাপা ঝাঁঝের ইঙ্গিত পায় অভিরূপ। আড়চোখে দেখে নেয় সুজাতাকে খবরের কাগজের ফাঁক দিয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিঠছাপানো চুলে চিরুনি চালাচ্ছে মধ্যযৌবনা অর্ধাঙ্গিনী। বরাবর সকাল সকাল স্নান করে নেবার অভ্যাস সুজাতার। ভিজে চুলে ভারী স্নিগ্ধ লাগে সুজাতাকে। বিয়ের পরের দিনই সেকথা বলেছিলো অভিরূপ, তারপর থেকে সুজাতাকে স্নান করে চুল আঁচড়াতে দেখলেই হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকে সে। সুজাতা ভারী অপ্রুস্তুত হয় তাতে। অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না অভিরূপের। ছবছর বিয়ে হয়েছে বটে, তবে সে স্নিগ্ধতা এতটুকু ম্লান হয়নি আজও। ভোরের আলোর মতোই উজ্জ্বল অথচ এক মৃদু ভালোলাগার বলয় তৈরী হয় সুজাতার চারপাশটায়। কোনো এক নাম না জানা ভিজে গন্ধে ঘরের ভেতরটা ম ম করতে থাকে। এরই মধ্যে গত রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে অভিরূপের, সুজাতার ঝাঁঝের আন্দাজ পায় খানিকটা। কোনো কথা না বলে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে দেয়। হঠাৎ করে সুজাতা গর্জে ওঠে আবার, 'কি রে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড় ! বারান্দাটা কে ঝাঁড় দেবে..... আমি' ? অনাহূত আক্রমণে থতমত খেয়ে যায় মুনিয়া, ঢোঁক গিলে বলে, 'না দি'ভাই, আমি দিয়ে দিচ্ছি, ওঘরের কাজগুলো সেরে নিই'। সুজাতা সে কথার কোনো উত্তর দেয় না। গম্ভীর মুখে চিরুনি থেকে জড়ানো কুঁচো চুল বের করে দক্ষিণের জানলা দিয়ে উড়িয়ে দেয়। অভিরূপ সেটা দেখে আপত্তি করতে গিয়েও সম্ভাব্য ঝড়ের কথা ভেবে নিজেকে আটকায় । খানিক্ষন বাদে আবার মুনিয়া এসে দাঁড়ায় ঘরে। 
-দি'ভাই, একটা কথা ছিল.......
- কি ?
- ইয়ে, মানে আজ বিকেলে না, আসতে পারবো না.....
-কেন ??
- মা কে নিয়ে বেরুবো...... একটু কাজ আছে...

আগুনে যেন ঘি পড়ে, সুজাতা সটান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, 'ব্যাস !! তবে আর কি, এদিন কাজ আছে, ওদিন শরীর খারাপ, আজ অমুক জায়গায় যাবো , কাল তমুক লোক আসবে......এই করিয়ে চালিয়ে দে, আমাদের কথা আর ভাবার দরকার নেই তোর, তাই না' ?? মুনিয়া ভারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বুঝতে পারে তার দি'ভাইয়ের মেজাজটা ঠিক জুত নেই আজ। আকাশপাতাল ভেবেও কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কোনোমতে মিন মিন করতে করতে বলে, 'না মানে, সত্যি একটু কাজ ছিল, তবে তেমন অসুবিধে হলে আমি নাহয় অন্যদিন যাবো, তুমি রাগ কোরো না দি'ভাই'। বছর বিশের শীর্ণ, শ্যামলা মুনিয়ার কথা কোনো পাত্তাই দেয় না সুজাতা, হাত নাড়িয়ে বলে, 'না না আজ রোববার, আমরা একটু বেরুবো বিকেলে, তুই অন্য কোনো দিন চলে যাস'। কোনোরকম বেচাল করার সাহস পায় না মুনিয়া, 'আচ্ছা', বলে পিছন ফেরে বাকি কাজ সারতে থাকে । 'তবুও...... কোন হট্টমেলায় যাওয়া হতো শুনি' ? বাঁকা চোখে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সুজাতা। অভিরূপও কাগজ নামিয়ে মুখ তুলে তাকায় মুনিয়ার দিকে। বারান্দার গ্রিলে বসা চড়ুইটাও ঈষৎ ঘাড় ঘোরায় যেন।  'নতুনবাজার', মুনিয়া ধীর লয়ে চোখ নামায়, তারপর কিছুটা কুন্ঠিত হয়ে বলে, 'আসলে দি'ভাই, তুমি যে আজ মাইনের টাকাটা দেবে, তাই দিয়ে মা কে একটা শাড়ি কিনে দেব ভেবেছি। আমি তো কখনোই মা কে কিছু দিই নি........... ছোটোর থেকে মা কেই দেখেছি এটা ওটা কিনে আনতো আমার আর ভাইয়ের জন্য। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মাকেই টেনেটুনে সংসারটা চালাতে হচ্ছে। এখন তোমাদের কাছে কাজ করছি, হাতে দুটো টাকা আসবে, তাই মনে করেছিলাম, প্রথম মাইনের টাকা পেয়ে মাকে নতুনবাজারের বড়দোকান থেকে একটা শাড়ি দেব..........কিন্তু.....'। 

ঘরের মধ্যে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা জমা হয়। সুজাতার মুখে কোনো কথা সরে না, বোবা দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মুনিয়ার দিকে। চোখের পাতায় গুমোট মেঘ ভেসে আসে কোথা থেকে। ঠোঁট শুকিয়ে আসে গভীর, তীব্র যন্ত্রনায়। বোধহয় কোনো পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় এক ঝটকায়। অভিরূপ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কাগজটা মুড়ে কোলের ওপর রাখে। বারান্দায় চড়ুইটা টুপ্ করে উড়ে পালিয়ে যায়। কিছু সময়ের পর সাময়িক জড়তা কাটিয়ে ওঠে সুজাতা। ধীর পায়ে মুনিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুনিয়া চোখ তুলে তাকায় তার দি'ভাইয়ের মুখের দিকে। সে চোখের সরল, মায়া জড়ানো, ছলছল দৃষ্টিতে সুজাতা মোম হয়ে গলতে থাকে ভাদ্রের সকালে। কোনো কথা উচ্চারণ না করে চাবি ঘুরিয়ে আলমারির দরজা খুলে বের করে আনে সেই ঢাকাই জামদানি। মুনিয়ার হাতে দিয়ে বলে.......... 'এইটা দিস তোর মাকে, বলিস........তোর প্রথম রোজগার'..............
ড্যাবড্যাব করে শাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে মুনিয়া। হাতের ওপর ওজন লাগে বড়।  

- 'কিন্তু দি'ভাই....... এ শাড়ির তো অনেক দাম গো' !
- 'মায়ের শাড়ির আবার দাম হয় নাকি রে বোকা' ?

স্মিত হাসে সুজাতা, আঁচলের খুঁট দিয়ে চট করে নিজের চোখ মুছে নেয়। বলে, 'তোর মাইনের টাকাটাও রাখ, ভাইকে কিনে দিস কিছু একটা......'। ভোরের সিঁদুরে আলতা আভার মতোই মুনিয়ার মুখচোখ উজ্জ্বল আলোকছটায় ভরে ওঠে সহসা, একগাল হেসে, ঢিপ করে সুজাতাকে একটা প্রণাম করে। সুজাতা বলে, 'আচ্ছা আছে হয়েছে, এখন পালা দেখি, আমার মেলা কাজ আছে...........আর শোন, বিকেলে আসার দরকার নেই, চালিয়ে নেবোখন একবেলা'। উদ্দাম, বেপরোয়া হাওয়ার মতো মুনিয়া ছুট লাগায় দরজার দিকে...............

অভিরূপ উঠে এসে সুজাতার কাঁধে হাত রাখে, সুজাতার অকালে মা হারানোর যন্ত্রনাটা ভালো মতোই জানে সে। সুজাতা ভেবেছিলো চাকরি পেয়ে প্রথম মাইনের টাকা দিয়ে মা কে শাড়ি কিনে দেবে। এমএম পাশ করে স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় বসার সময়টাতেই মা চলে যান। তাই প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে মা কে শাড়ি কিনে দেবার শখ কখনোই পূরণ হয়নি সুজাতার। জগদ্দল পাথরের মতো সেই সুপ্ত বাসনা আজও চাপ হয়ে বসে আছে সুজাতার বুকে। আর তাই পুজোর আগে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনকে শাড়ি দিয়ে সে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে খানিকটা। আজ মুনিয়া আর নিজেকে একই নৌকার নাবিক মনে হয়েছে তার। যে নৌকা প্রান্তিকের মৌতাতে দাঁড় বেয়ে চলেছে একটানা, নিরলস, নিরন্তর। 
দুজনে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। দক্ষিণের আকাশে ঋতু পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আশ্বিনের মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে এখনই। সুজাতাকে নিয়ে গর্ব হয় অভিরূপের, এক অনির্বচনীয়, মনোময় আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে যায় দুজনে, যা শোবার ঘরের বিছানার চাদরের মতোই মসৃন, টানটান হয়ে থাকে, অতি ঝড়েও অবিন্যস্ত হয়না কখনো.....................


 ছবি : গুগল 

#bengalishortstories #bengalilovestories #mother'sdaystory


Saturday, August 27, 2016

দান

সময় হয়েছে তব......আহ্বানে করি নব
না রাখিব আর স্মৃতি জড়ায়ে
এবারে নূতন গান......বিকশিত হোক প্রাণ
হে পুরাতন, তোমারি দান, তোমারে দিব ফিরায়ে ।

ক্ষমা কোরো মোরে...... আর না চাহিব কিছু
যত ক্লান্তি, যত গ্লানি, আর না হাঁটিব পিছু
সকলি পুরানো কথা, সকলি যাতনা, রাখিব দূরে সরায়ে
এবারে নূতন গান..........বিকশিত হোক প্রাণ
হে পুরাতন, তোমারি দান, তোমারে দিব ফিরায়ে ।

ভুলিয়া যেও..... সে জীর্ণ মর্মর বাণী
যতটুকু সঞ্চিত আবেগ, তার কতটুকুই বা মানি
ফিরায়ে লও সে ক্ষণকাল, তব রেখেছি হৃদয় ভরায়ে.......
এবারে নূতন গান..........বিকশিত হোক প্রাণ
হে পুরাতন, তোমারি দান, তোমারে দিব ফিরায়ে ।

ছবি : নিজস্ব 
















#bengalipoems #poetries

Wednesday, August 24, 2016

অভিমান

বেলা পড়ে এলো, মিছেই দেরি করিস আজ
আলো আঁধারির ছায়ায় লেগে আছে দেখ
কত শত বেলফুলের দিলখুশ মন্তাজ.........
ঘাড়গোঁজা একবগ্গা অভিমান তোর, এ  কেমনতরো ?
পুকুরঘাটে সন্ধ্যে গড়ায়, আজও যে ডাকতে এলি না বড় !
তবে কি জলপাইয়ের সাথে মিশে গেলি.........
তবে কি আলটপকা আমায় গেলি ছেড়ে ?
আমার কিন্তু এখনো শুনে ওঠা হয়নি জানিস,
সুলতান খাঁর, আলবেলাআআ...সজন、 আয়ো  রি !............

ছবি : নিজস্ব 















#bengalipoems #poetries

Saturday, August 20, 2016

ঘোগের বাসা

প্রায় দুশতক পরে যেন কলম ধরেছি মনে হচ্ছে, থুড়ি, কিবোর্ড ধরেছি। মাঝের হপ্তা দুয়েক বিছানার সাথে একেবারে লেপ্টে ছিলুম যাকে বলে। এক্কেরে মাখামাখি অবস্থা যাহোক। যতবার বলেছি ওরে ছাড়, মেলা কাজ পরে আছে, তোত্তোবার যেন বাবা বাছা বলে জাপ্টে ধরে আয়েশ করে, মাথায় হাত বুলিয়ে সকালের ডিম্ টোস্ট, দুপুরের গরম ভাত, সন্ধের চা মুড়ি খাওয়ার লোভ দেখিয়েছে । তার সাথে কুড়মুড়ে পাঁপড়ভাজার মতো জুটেছে লাগামছাড়া সেবা, যা শেষ কবে পেয়েছিলুম, কপাল চাপড়িয়েও মনে করতে পারছি না তেমন। সে মায়ার বাঁধন যদি বা টুকুন কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, তাই বলে যে এখন টারজানের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠে এগাছ সেগাছ নাঁপিয়ে বেড়াবো সে ক্ষমতা একেবারেই নেই। কি হয়েছিল ?.......... বলছি বলছি, এটুকু বলতেই হাঁপ ধরে গেলো কত্তা !

গেলো হপ্তার রোববার থেকেই গা টা কেমন যেন ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছিলো। তেমন পাত্তা না দিয়ে প্যারাসিটামলের বড়ি গিলে নিলুম। বলা নেই কওয়া নেই হতভাগা জ্বরটা একেবারে হুড়মুড়িয়ে গায়ের ওপর এসে পড়লে রাতের দিকে। একশো একেই গোঁ গোঁ করে ভূতের মতো ডাক ছাড়তে লাগলুম । দুদিনের মধ্যেই আষ্টেপৃষ্টে নাগপাশের মতো জড়াচ্ছে দেখে বদ্যি বললে, 'রক্ত পরীক্ষাটা করিয়ে নাও হে, লক্ষণগুলো ভারী চেনা চেনা ঠেকছে বাপু' । চেনা অচেনার বেড়াজালে ঠোক্কর খেতে খেতে রক্তিম স্রোত বইয়ে দিলুম অকাতরে। শিশি ভরে ভরে রক্তদান শিবির স্বার্থক করে তুললুম বিনা বাক্যব্যয়ে, সঙ্গে চলতে লাগলো এন্টিবায়োটিকের তাল মেলানো ডোজের কাব্যিক সঙ্গত । রিপোর্টে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড সবই নেগেটিভ বেরোতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। বাড়ির লোকজনও স্বস্তির শ্বাস ফেললো। ভাইরাল ফিভারও কুপোকাৎ করছে ভেবে নিজেই নিজেকে বাঁকা চোখে দেখতে লাগলুম । ভাবটা কতকটা যেন, 'হুঁ: ! ইঁদুরেও লেঙ্গি মেরে গেলো' !.....যাইহোক বয়েস হচ্ছে ভেবে ক্ষমা ঘেন্না করে দিলুম নিজেকে ।

কিয়দকাল সুস্থ বোধ করাতে অফিসের প্রতি অমোঘ টান অনুভব করলুম ও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে এবং বাড়ির চোখরাঙানি কে উপেক্ষা করে, হৈ হৈ করে একদিন দুদিন করে বুক ফুলিয়ে সারাদিন কাটিয়ে এলুম অফিসে। ঐটে কাল হলো এক্কেবারে। খ্যাপাটে জেদী ঘোড়ার মতো টগবগ করে শিরা উপশিরার মধ্যে বয়ে যেতে লাগলো বন্য জ্বরের তেজী আস্ফালন। বাড়ি ফিরে প্রায় মুচ্ছো যেতে বসেছিলুম। শুরু হলো অজস্র কাশির দমক। সে একেবারে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গলার কাছে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো ক্ষনে ক্ষনে, পরের পর । অল্প সময়ের মধ্যেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের হার দ্বিগুন হলো বেশ । চোখে মুখে নিশি রাতের আঁধার ছেয়ে এলো অচিরেই। প্রমাদ গুনলুম, 'একি হলো !! এমনটা তো হয়নি আগে ? খেয়েছে...... তবে কি সময় ফুরিয়ে এলো ? "নিভলো তবে দীপের বাতি, শেষের সময় কিছু বাকি" ? আগডুম বাগডুম কাব্যি করতে লাগলুম মনে মনে । পরের দিন পড়ি কি মড়ি করে ছুটলুম অন্য বদ্যির কাছে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পিঠে টিপে দেখে শুনে 'হুমমম.....' বলে গুম হয়ে রয়ে রইলেন কিছুক্ষন, তারপর বললেন, 'ডেঙ্গির সিম্পটম বটে, তবে বড় অদ্ভুত ঠেকচে হে, তুমি বরং রক্ত পরীক্ষার সাথে বুকের এক্স রে টাও করিয়ে নাও একেবারে, বলা তো যায় না কি বাসা বেঁধেচে শরীরে' । বোঝো কাণ্ড ! নিজের শরীরটা যেন ভাড়ার বাড়ি, যে কেউ এসে বাসা বাঁধলেই হলো ! ট্যাক্সো নেই ! আহাম্মকের মতো হে হে করতে করতে বেরিয়ে সটান হাজির হলুম পরীক্ষাগারে। যুগপৎ রক্ত দিয়ে ও এক্স রে করিয়ে ফিরলুম। এন্টিবায়োটিক চলতে লাগলো সমান তালে । বাড়ির লোকের ভয় বাড়িয়ে অবস্থার তেমন উন্নতি ঘটলো না। এরপর দুদিন ঠায় অপেক্ষা করতে হলো রিপোর্টের জন্য। মড়ার মতো পড়ে থাকা ও টিভির দিকে চোখ রাখা ছাড়া বাকিটা চলত্শক্তিহীনের মতোই কাটাতে লাগলুম। অবশেষে রিপোর্ট বেরুলো ও সেটিকে বগলদাবা করে পুনরায় বদ্যির কাছে হাজিরা দিলুম। যথারীতি ডেঙ্গি নেই, আগেই দেখে নিয়েচি, শুধু এক্স রে টা বোধগম্য হয় নি বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম ত্রাতার দিকে। আলোর দিকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে এক্সরে প্লেট টা টেবিলের ওপর রেখে চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। বললেন, 'ডেঙ্গি ফেঙ্গি  কিস্যু নয় হে, তোমার নিউমোনিয়া হয়েছে ছোকরা' ! বাবা আর আমি পাল্লা দিয়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিলুম। এই বয়েসে নিউমোনিয়া ! বলিহারি ! এমনও হয় ! আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বদ্যি বললেন, 'অত চিন্তার কিছু নেই, ওষুধ চেঞ্জ করে দিচ্ছি, ভয় পেয়ো না, ফুল বেড রেস্ট নাও, ঠিক হয়ে যাবে......'। কাঁচুমাচু মুখে বাড়ি ফিরে এলুম, মনে হলো কতকটা মুখ পুড়িয়েই এলুম যেন। এ যেন এনুয়াল পরীক্ষায় কম নাম্বার পাওয়ার মতো, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া দূরঅস্ত, শেষকালে নিউমোনিয়া !!!!

যদিও নিউমোনিয়া ধারে ও ভারে বেশ পঙ্গু করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং রেস্টে না থাকলে ফের জ্বর আসার চান্স থাকে যথেষ্টই, তবুও এরকম বিতিকিচ্ছিরি অসুখ আমার মতো ধাড়ির কেমন করে করে হলো সে প্রশ্নের উত্তর ঢের খুঁজেও মনমতো পেলাম না। বদ্যি বললেন এসির জন্য হতে পারে বা বৃষ্টিতে ভিজেও হতে পারে। হ্যাঁ, তা বিলক্ষণ হতে পারে বৈকি, বৃষ্টিতে ভিজে এসিতে বসাটা খুব পুরোনো মনে হলো না। তবুও.......তাই বলে একেবারে নিউমোনিয়া ? একজন তো ফোনে বলেই ফেললে, 'সেকি মশাই নিউমোনিয়া তো কচি ছেলেদের হয় শুনেচি, আপনি বাধালেন কি করে' ? কোনোক্রমে সে প্রশ্নের চাপ কাটিয়েছি এই বলে, 'হেঁ হেঁ ....... আমার তো খুব বেশি বয়েস বাড়েনি কিনা, তাই আর কি' ! লজ্জায় মরে গিয়েছিলাম মরমে ।

যাইহোক অফিস ভরসা জুগিয়েছে অনেকটাই, বন্ধুরা দেদার ফোন করে, হোয়াটস আপ করে আশ্বাস দিয়েছেন, তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তবু সকলকেই সাবধান বাণী শুনিয়ে যাই। তা হলো সময় ও কাল টা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না কত্তা আমাদের ! বিশেষ করে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে রয়েচেন তাঁরা তো সাবধান হন অবশ্যই। এমন বেয়াড়া ওয়েদারে বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা না করাই ভালো। বরঞ্চ 'ওষুধ খেলে সেরে যাবে, সময়মতো দেখে নেবোখন' মাফিক চিন্তা ভাবনা দূরে সরিয়ে আগে থেকে সতর্ক থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্যাঁচালো অসুখে সত্যি সত্যি সোজা সরল ওষুধে কাজ দিচ্ছে না মোটে। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি তাই বলছি। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বাঁধতে দেরি হচ্ছে না, তাই নিজেকে ব্যাঘ্রসমান ভাবলেও......এ যাত্রা সাধু সাবধান !!...... না হলে নিউমোনিয়া হয় ???  ঘোর কলি মশাই......... ঘোর কলি !!

পুনশ্চ : খবর পেয়েছি বিভিন্ন বাঁকাচোরা ব্যাধিতে বন্ধুবান্ধবরা আক্রান্ত, এমনকি এই অসময়ে হামও হচ্ছে, সুতরাং চেষ্টা করুন, সুস্থ থাকুন, ঠিক পারবেন। আমি বলচি !





ছবি : গুগল

#bengaliarticles #bengalifunnywriteups #pneumonia

Tuesday, August 16, 2016

প্রহর

অনেকটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে.....
অনেকটা সময় ফাঁকি দিয়ে গেছে তাই
এক প্রহর রাত জেগেছি আমি আজ
আরও এক প্রহর বেশি জাগতে চাই ।

খোয়াবের খোঁজে পাশ ফিরে ঘুম
সেঁজুতির চৌকাঠ নিকষ নিঝুম....
পরজীবী লতায় বয়স বাড়ছে তাই
এক প্রহর রাত জেগেছি আমি আজ
আরও এক প্রহর বেশি জাগতে চাই ।

ইচ্ছেনদী এমনি বয়ে গেছে কত.....
অকুল সোহাগ ছাইচাপা আগুনের মত....
ধিকিধিকি পুড়তে থাকে গোটা জীবনটাই
এক প্রহর রাত জেগেছি আমি আজ
আরও এক প্রহর বেশি জাগতে চাই......

ছবি : নিজস্ব 
















#bengalipoems #poetry

Wednesday, August 10, 2016

আলাপ

পক্ষান্তরে ভালোবাসারা উহ্য থাকে
আলগা চাউনিতে গড়ে ওঠে পরিচয়
মেঘভাঙা জলে আবেগের ডুবসাঁতার
কাঁচভাঙা হাসিতে মুগ্ধ বিলম্বিত লয়.....

অপরিহার্য থাকে সমস্ত চাওয়া পাওয়া
নদীর স্রোতে আকাশ জেগে রয়......
দীর্ঘ কথার প্রতিচ্ছবি চারিপাশে,
আলাপ জমানো তেমন কঠিন কিছু নয়......

মুখরায় সুর বেঁধে দেয় হৃদমাঝার
বেয়াড়া মুখে ফুটছে কত খই.......
আমার সাথে আলাপ জমাও ভিনদেশী
আমিও তোমার মত রাত্রি জেগে রই......

ছবি : নিজস্ব 


#bengalipoems #lovepoems #romanticpoems

Friday, August 5, 2016

২২শে........

কয়েক বছর আগেকার কথা। সে ঘটনার কথা মনে পড়লেই এক আকাশ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই আজও। কতকটা মিঠে পাতা পানের মতো। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে গুলকান্দ এর মিষ্টি প্রলেপ পড়ে সারা জিভ জুড়ে, দোসর থাকে এলাচ, মৌরির এক্কা দোক্কা। চর্বিতচর্বনে হারিয়ে যাওয়ার ঈঙ্গিত থাকে স্পষ্ট। সেদিন অফিস থেকে গিয়েছিলাম সল্টলেক সেক্টর ফাইভের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। সামনে বেশ বড় একটা ইভেন্ট ছিল সেবার। ফলস্বরূপ একটি টেলিভিশন পার্টনারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিলো খুব স্বাভাবিক নিয়মেই। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো আমি, তাই নির্দ্বিধায় দায়ভারের হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দিয়েছিলুম বিনা বাক্যব্যয়ে। স্বীকার করতে বাধা নেই, সেদিন খুব বেশি প্যাঁচ পয়জার কষতে হয়নি। খুব মসৃন ভাবেই আমাদের প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে সে যাত্রা। ডিল ফাইনাল হওয়াতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ফিরে আসছিলাম অফিসের গাড়িতে। অকস্মাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল।

দক্ষিণ পশ্চিমের আকাশে তখন দুর্বার গতিতে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। ফুটন্ত কেটলির মুখ দিয়ে যেভাবে ভুড়ভুড়িয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে, ঠিক সেইরকম সরু, একফালি, ধূসর প্রান্তরেখা হয়ে ক্রমশ বিস্তৃতি ঘটিয়ে তার তমসাবৃত চাদরে যেন ঢেকে ফেলতে চাইছে চতুর্দিক। ভিজে হাওয়ার গন্ধরা তখন চাক ভাঙা মৌমাছির মতো রে রে করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শহর জুড়ে। সোঁদা মাটির ঘ্রানে চোখ ফেরাতে পারলাম না কিছুতেই। একদৃষ্টে দেখে যেতে লাগলাম আলো আঁধারির বেলাগাম দৌরাত্মি। শুধু মুখ ফুটে একবার বললাম, 'পঙ্কজ দা' !................... উত্তর এলো,
- হুমমম, দেখেছি, খুব জোর আসছে.......
- বেশ তো ! আসুক, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, তুমি আস্তেই চালাও, দেরি হলে কিচ্ছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

স্টিয়ারিঙে হাত রেখেই আড়চোখে আমায় দেখে নেয় পঙ্কজদা। চিবুকের হাড়ে মৃদু হাসি খেলে যায়। বুঝতে পারে বোধহয়, সময় অপচয়টা কতকটা  ইচ্ছাকৃত। অবশ্য পঙ্কজদার পক্ষে সেটা বোঝাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বহূ নিকট - দূরের জার্নির একনিষ্ঠ ও ভরসাযোগ্য সঙ্গী ছিল সেসময়। শহরের একটু বা অনেকটা দূরের গল্প হলেই পারতপক্ষে আমরা পঙ্কজদা ছাড়া অন্য কাউকে নিতাম না সঙ্গে। সুতরাং আমার মতো দু একজন ডেপোঁ কলিগের সাথেই খুব সহজেই সখ্যতা গড়ে উঠতে বেশি দেরি হয়নি তার। এযাত্রাও সে সামনের কাঁচের দিকে স্থির ছাউনি দিয়ে বললো, 'বলছো ?' আমি সহাস্যে বলে উঠলাম, 'নিশ্চিন্তে'। মুখের হাসি তেমনি অটুট রেখে জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে এক রাউন্ড চা হলে মন্দ হয় না..... কি বলো' ? হাত নাড়িয়ে বললুম, 'কিছুমাত্র না'। 'বেশ তাহলে একটা স্পেশাল চায়ের দোকানে নিয়ে যাই তোমায়...... চলো', বলেই বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেয় বিদেশী যানের দিশি সারথি।

বাইপাসের চওড়া মেদহীন চিকন পথ ছেড়ে আমরা ঝপ করে এসে পড়লুম অপেক্ষাকৃত রুক্ষ পিচের রাস্তায়। জানলার দুপাশের চিত্রগুলো সিনেমার কাটশটের মতো বদলে যেতে লাগলো মুহুর্মুহু। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর চোখে পড়লো টালির চাল দেওয়া কাঁচামাটির ঘর, বাঁশ বাগান, খানকতক পুকুর, ডোবা, এধার ওধার থেকে ছুটে আসা মুরগির পাল, দেওয়ালের গায়ে যত্রতত্র ঘুঁটের নকশা কাটা প্যাটার্ন আর চোখ জুড়ানো সবুজের দিগন্ত বিস্তৃত আহ্লাদ। এক ঝটকায় শহরের মানচিত্রটা আমূল বদলে গিয়ে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো আদি বাংলার আটপেড়ে সহজিয়া উষ্ণতা। যেখানে গাঢ় রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে, কপালে এত্তবড় সূর্যের লাল মেখে কোনো এক গাঁয়ের বধূ অপেক্ষায় আছে শীতলপাটি বিছিয়ে। উঠোনে পা দিলেই গ্লাসে করে এগিয়ে দেবে কুঁজোর মিঠে নির্যাস, তালপাতার পাখায় এক নিমেষে মিলিয়ে যাবে দিনগুজরানের ঘামশরীর।    

এদিকটায় আসিনি কখনো। শহরের বুকের মধ্যেই যে এমন একটুকরো লুকোনো জিয়নকাঠি খুঁজে পাবো এ আমার কল্পনাতীত। ফলে অপরিচিত রোদ্দুর হলেও পরিচিত মাটির টানটা দিব্যি গায়ে মেখে নিচ্ছিলাম ধুলোয় বালিতে। মেদিনীপুরে আমাদের আদি বাড়ির নিকোনো উঠোনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারেবার। একটা চায়ের দোকানের সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো পঙ্কজ দা। বলল, 'নামো'। কাঁচা রাস্তার ওপর নেমে দাঁড়ালাম। বাঁশের খুঁটির ওপর খড়ের চাল, দরমার খাঁচা, মাটির উনুন আর সামনে দু সারি ইঁটের ওপর  একটা কাঠের তক্তা দিয়ে পরিপাটি বসার জায়গা করা পঙ্কজদার স্পেশাল চায়ের দোকান। দুটো চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসলাম। ততক্ষনে আকাশ বেয়ে এক দু ফোঁটা করে গায়ের ওপর পড়ছে অবিন্যস্ত রূপোলী গুঁড়ো। লক্ষ্য করলাম, কিছুটা দূরে একটা মাঠের ধারে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। একটা ছোট স্টেজ আর সামনে লাইন করে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে কিছু মানুষ বসেছে। মুখ ঘুরিয়ে দোকানের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'ওখানে কি হচ্ছে ভাই ?' এক বিশেষ ভঙ্গিমায় চায়ের ছাঁকনি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, 'ফানশন হচ্ছে ফানশন, ফি বচ্ছর হয় এখানে'। ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসের' ? চায়ের ভাঁড়গুলো হাতে ধরাতে ধরাতে বললো, 'বাইশে শ্রাবন। ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি আর গান করে'। .............. চমকে ওঠার সেই শুরু। এমন এক অজ পাড়াগাঁ যেখানে অভাবের চিত্রটা দুপুরের রোদের মতোই উজ্জ্বল ও চোখে পড়ার মতো সেখানে ম্যারাপ বেঁধে রবীন্দ্রচর্চা ! দুমুঠো ভাতের খোঁজে উদয়স্ত যাদের ক্ষেতের ওপর লাঙ্গল চষতে হয় তাদের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রস্তব করছে খরচ করে ! পরক্ষনেই ভাবলাম, নাকি, এরা বলেই করছে বা হয়তো এরাই করে থাকে। কি জানি ! আমাদের মতো শহুরে চাষিদের সময় কই ওতো ! ঘড়ির দামে সময় বিকোয় আমাদের। এরকম বেয়াড়া কিছু প্রশ্নের ভিড়ে চায়ের ভাঁড়ে আলগা চুমুক দিতে থাকি আর অপলক তাকিয়ে থাকি স্টেজের দিকটায়।

মাঠের বুক চিরে কানে ভেসে আসছে........ 'শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে.......পড়ুক ঝরে, তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে বুকের 'পরে'.......
ভারী মিষ্টি করে গাইছে। মনকেমন করে ওঠে ততক্ষণাৎ। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতে কেন জানিনা বড্ডো এমনটা হয়। কতকটা সবুজ ঘাসের মাঠ পেলেই যেমন সটান শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল দেখলেই যেমন হাত বোলাতে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমনটা, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোনোটাই করা হয়ে ওঠে না, ভিতরে ভিতরে শুধু ফুঁপিয়ে মরার যন্ত্রনাটা টের পাওয়া যায়। মনে হলো একছুটে পালিয়ে যাই ওখান থেকে। গিয়ে দাঁড়াই মেঠো পথের একেবারে শেষ চৌকাঠে যেখানে থাকবে না কোনো পিছুটানের বদভ্যাস, শুধু থাকবে প্রান্তজনের সাথে গুটিকতক আলাপী মুহূর্ত আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানোর অলস আধছটাক প্রেম..

ডান পাশে তাকিয়ে দেখলাম একজন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুচ্ছেন। হাড় জিরজিরে শীর্ণ চেহারা, খালি গা, পরনে সরু বাদামি পাড়ের ধুতি আর খালি পা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি..............খানিক্ষণ বাদে ভিজে গলায় নিজে থেকেই বলে উঠলেন, 'রবিঠাকুরের গান শুনলেই মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে গো বাপ....... সেই কত্ত ছোটবেলা বেলা থেকে শুনে আসচি, আজও ময়লা হয় নি গো, যেমনকার ঠিক তেমনি আছে'। এমন অকপট অনুভূতির ঝাপটায় বেশ অবাক হলাম। বললাম, 'আপনি বুঝি ওনার গান খুব ভালোবাসেন' ? ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলেন আমাকে কিঞ্চিৎ, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, 'ওনার গানের কথাতেই তো জীবনের সারমর্ম বাপ....... দিনযাপনের গুরুমন্তরটা তো উনিই দিয়ে গেছেন, ভালোবাসি বলে অচ্ছেদ্দ্যা করতে পারবো না গো, তার পায়ে মাথা কুটে মরতে পারলে তবে যে আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম '...............

চিত্রার্পিতের মতো বসে রইলুম। এমন কথা শুনিনি আগে.........ভালোবাসা অশ্রদ্ধা !! গুরুমন্ত্রই প্রাণের আধার !!......লোকটা বলে কি !! রবীন্দ্রশ্রদ্ধায় এমন সহজ, সরল, প্রাঞ্জল নিবেদন আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়লো না। শ্রাবনের সোঁদা মৌতাতে মনটা মাখামাখি হয়ে গেলো কেমন। বুকের মধ্যে আকুলিবিকুলি করতে লাগলো দিনযাপনের গুরুমন্তর, আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম......... নেশাগ্রস্তের মতো বসেছিলুম...........কতক্ষন জানিনা ..............বড় বড় ফোঁটায় শব্দের মেহফিল জমে উঠেছে ততক্ষনে,........ সম্বিৎ ফিরলো পঙ্কজদার কথায়, 'এবার চলো, আর বসে থাকা যাবে না, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে'। কোনো মতে টেনে তুললাম নিজেকে, যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে বারে বারে বৃদ্ধকে দেখছিলাম। এখনো ঠিক তেমনি ভাবে বসে আছেন। টলটলে শ্রাবনের জলে অশ্রু মিলেমিশে একাকার । গাড়ির দরজা বন্ধ করলাম। পঙ্কজদা চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল, এফ এম এ বাজতে শুরু করেছে .........
'শাওন বরষে.....তরসে দিল.......কিউঁ নাআআ নিকলে, ঘরসে দিল.......
বরখা মে ভি দিল পেয়াসা হ্যায়.....ইয়ে প্যায়ার নেহি তো ক্যায়া হ্যায়'..............  

কি আশ্চর্য মিল ! শ্রাবন বোধহয় এমন করেই মিলিয়ে দিতে পারে......তাই না ?

চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত
ছোট করে বলে রাখা ভালো এই চিত্রটি শুধুমাত্রই গ্রাফিক্স নয় আমার কাছে,
এটি একটি আদ্যোপান্ত রচনা, যা অর্ণবের সৃজনে ও কল্পনায় প্রাণ পেয়েছে।


চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত 


#bengaliarticles #rabindranathtagore #tributetorabindranathtagore #tribute

Tuesday, August 2, 2016

অনুপদ্য - ১০

ছবি : নিজস্ব 
মনের সাথে আড়ি আমার
মনের কাছেই ভয়
মনের কথা তুমিই জানো
তবু তুমি আমার নয়..........
মনের ভাষায় ভাসিয়েছিলেম
স্বপ্ন মেঘের ভেলা
মনের ভুলেই সাঙ্গ হলো
মিথ্যে মনের খেলা...........






#bengalipoems #bengalilovepoems #bengaliromanticpoems

Friday, July 29, 2016

মনদুপুর

ছবি : নিজস্ব 
কিংখাবে মোড়া যত রাজকীয় গলি
খুঁজে খুঁজে হয়রান কাকে আমি বলি.....
বোবা ঘরে বাস্পতে ভিজে ওঠে জল
মন কষাকষি হোক, কার সাথে বল ?

দুধগোলা দুপুরে চুপ থাকা দায়
শ্যাওলারা কার্নিশ, ঘেঁষে চলে যায়
ছায়া গোনে জৌরালি, শালিখের দল
মন কষাকষি আজ, কার সাথে বল........







#bengalipoems #bengalilovepoems #bengaliromanticpoems

Tuesday, July 26, 2016

নাগাল

ছবি : নিজস্ব 
দূরভাষে কত কথা উড়ে এসে বসে
তবুও খানিক, সংলাপ রয়ে যায়
তোর নামের তালাশ জারি থাকে
বেসামাল মন আলাপ ছুঁতে চায়.....

মধুর লেখনী নাই বা হল তেমন
চিঠির আদলে জবানবন্দি বাঁচুক
কেমন করে বোঝাই বলত তোকে
মরুভূমিও চায় কালবৈশাখী আসুক.....

রাতের বালিশ প্রেম খোঁজে চুপিচুপি
ঘুম জাগানিয়া ওয়াক্ত গুজরতা যায়
আশমানি চাঁদ গালে হাত দিয়ে ভাবে
কেমন করে তোর নাগাল পাওয়া যায়....


#bengalipoems #bengalilovepoems #bengaliromanticpoems