পরদিন সকালে নিয়মমাফিক বাজারের থলি হাতে বেরোয় রতন। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকে, দুচারজন পথচারী কুশল প্রশ্ন করে, সেসব কান অবধি পৌঁছয় না তার। ভারী অবাক হয় লোকজন। প্রাণোচ্ছল রতনের গুম হয়ে থাকার কারণটা বুঝতে পারে না অনেকেই। পাড়ার চায়ের দোকানে যার গলা পাওয়া যেত সবার আগে, আজ সে চা না খেয়েই চায়ের দোকান পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কোথা থেকে পাড়ার কচি ছেলের দল হৈ হৈ করে এসে পথ আটকায় রতনের, বলে, 'কি গো রতন দা, কাল তো তুমি আর এলেই না, আমরা তো মাঞ্জা, টাঞ্জা দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আজ কিন্তু তোমাদের ছাত থেকেই ঘুড়ি ওড়াবো। আমরা সকাল সকাল রেডি হয়ে গেছি'। মৃদু হাসে রতন, বলে, 'বেশ তো, তোরা ঘুড়ি লাটাই নিয়ে যা, আমি বাজারটা সেরে আসছি'। ছেলেদের দল নাচতে নাচতে চলে যায়।
গলির বাঁক ঘুরতেই সহসা দেখা হয়ে যায় সেই ভাড়াটে মহিলার সাথে। বাজার সেরে ফিরছে। রতন তাকে দেখেই গুটিয়ে যায় খানিক। মহিলা এক নজর তাকায় রতনের দিকে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় নিজের বাড়ির দিকে। রতন কোনোরকমে ঘাড় মুখ গুঁজে বাজার সেরে ফিরে আসে বাড়িতে। চটজলদি থলিটা নামিয়ে দিয়েই চেঁচিয়ে বলে, 'মা, বাজারটা রেখে গেলুম, আমি একটু ঘুরে আসছি'। জয়া হন্তদন্ত হয়ে বলেন, 'ব্যাস ! অমনি চললি তো পাড়া বেরোতে ? বলি কিছু অন্তত মুখে দিয়ে যা'। ভিতরের ঘর থেকে সুধাময় বলে ওঠেন, 'হুঁ, এমনি দিনে টিকি পাওয়া যায় না, আজ তো আবার বিশ্বকর্মা পুজো ! সারাদিন ধরে প্যাঁচ কষবে না ? বলিহারি যাই, কোথায় একটু রোজগারের চিন্তা করবে তা নয় প্যাঁচাতে ব্যস্ত, যত্তসব অকাল কুষ্মান্ড' !
মধ্যবিত্ত সংসারে পিতার ধৈর্যের অভাব ঘটে। ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তাঁর। সে কথা কানে যাওয়ার আগেই রতন পা বাড়ায় চায়ের দোকানের দিকে, কতকটা আনমনেই। আজ সকাল থেকে যেন কোনো কিছুতেই মন লাগছে না তার। এ গলি ও গলি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে খেয়াল হয় যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা চায়ের দোকান নয় মোটেই। সেটা নিবারণ গাঙ্গুলির বাড়ি। কি আশ্চর্য ! তার তো চায়ের দোকানে যাওয়ার কথা।
জটিল মনস্তত্ব। মনোবিদরা বলবেন, এমনটা তো খুব স্বাভাবিক, মানুষের মনে এমন বহু সূক্ষ্ম চিন্তার সঞ্চার হয় যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ এমন অনেক কাজ করে থাকে যার স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। তবে রতনের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া সত্যিই ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। স্থান কালের হিসেবে গুলিয়ে ফেলার ছেলে আর যেই হোক, রতন নয়। কিছুক্ষন সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে। তারপর চলে আসার জন্য যেই পা বাড়াতে যায়, অমনি বারান্দায় সেই ভাড়াটে মহিলাটি বেরিয়ে আসে। হাতে ভিজে কাপড় নিয়ে তারের ওপর মেলতে থাকে। হঠাৎ চোখাচোখি হয় রতনের সাথে। ভারী অপ্রস্তুত হয় রতন। মহিলা কাপড় মেলতে মেলতে খানিক থমকায়। রতন একছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, পারে না। মনে হয় কে যেন এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে রেখেছে গোড়ালি দুটো। কিছু না পেরে বোকার মতো হাসে, তারপর চোখ নামিয়ে নেয়। মহিলা ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে......
'আপনি কি কাউকে খুঁজছেন' ?
'কই..... না তো' ! তোতলাতে থাকে পাড়ার তেজী যুবক। পরক্ষনেই কিছুটা সাহসে ভর করে বলে, 'ইয়ে......মানে সেদিনকার জন্য.....আমি ভীষণ ................
'অনুতপ্ত......তাই তো' ? খেই ধরিয়ে দেন মহিলা।
'হ্যাঁ মানে ওই আর কি', আমতা আমতা করতে থাকে রতন, 'আসলে কিছু না বুঝেই এমন..............'
- চা খাবেন ?
- হ্যাঁ ???
- বলছি চা খাবেন ? জল চাপিয়েছি..... আশা করি দুজনের হয়ে যাবে.......
'না' কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনা, জিভ জড়িয়ে যায় রতনের। অপরিচিত নারীর অনুরোধ কোনো এক অজানা কারণে ফেলতে পারে না সে। ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি প্রদান করে। 'আসুন তবে', অপরিচিতা পথ দেখায়। পিছন পিছন বাধ্য ছাত্রের মতো ঘরে গিয়ে ঢোকে রতন। 'বসুন', একটা সোফার দিকে আঙুল দেখায় নারী। ঘরের চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে রতন। গোটা ঘর জুড়ে আধুনিকতার ছাপ না থাকলেও, যত্নের চিহ্ন স্পষ্ট। সোফার পিছনের দেয়ালে একটা ফটোফ্রেম, তাতে একটা ছোট মেয়ে শাড়ি পড়ে নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে একমনে দেখতে থাকে সে।
'আপনার চা', নারীকণ্ঠে সম্বিৎ ফেরে রতনের। চা নিয়ে একটু জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে। সুরুৎ করে এক চুমুক দিয়ে বলে, 'ওপরের এই ফটোফ্রেমটায় মেয়েটি কে' ?
মহিলা হেসে ফেলে। একমুঠো শিউলি ফুল ঝরে পরে যেন। সে হাসি কতকটা লজ্জার, কতকটা ধরা পড়ে যাওয়ার। সেদিকে অপলক চেয়ে থাকে রতন। যুবক হৃদয়ে হিল্লোল ওঠেবা হয়তো। সেদিন এতটা ঠাহর করে দেখা হয়নি। সাধারন বেশভূষায় আপাত কঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি নম্র দিকও আছে বটে। এমনিতে সুন্দরী না হলেও সুশ্রী বলা যেতে পারে। বিশেষত হাসলে পরে গালে টোল পড়ে । মহিলা সলাজ গলায় বলে, 'ওটা আমার ছোটবেলা। তখন নাচ শিখতাম' ।
- ওঃ আচ্ছা.........আপনি কি এখনো ........ ?
- না না, সেসব ছেড়ে দিয়েছি বহু বছর, সময় কোথায় এখন ?
- আপনি এখন কি করেন ? মানে মাপ করবেন..... অহেতুক কৌতূহল আর কি.......
- একটা মেয়েদের স্কুলে পড়াই, এছাড়া টুকটাক টিউশনি করি বাড়িতে।
- ওহ, আপনি তাহলে দিদিমণি ?
আবার শিউলি ফুল ঝরে পড়ে যেন একরাশ। রতনের বুক কেঁপে ওঠে। টোল পড়া হাসির মর্মার্থ তার মতো ব্রতচারী যুবকের পক্ষে বুঝে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
- তা একরকম বলতে পারেন........তবে এখানকার পাট বোধহয় চুকল। একমাস হল এসেছি, এরই মধ্যে যে আবার ঘর খুঁজতে হবে এমনটা বুঝতে পারিনি। আগে জানলে এখানে ভাড়া আসতাম না।
- হ্যাঁ, আসলে নিবারণ কাকা বড্ডো জেদ করছে, নাহলে এখানে কি আর অসুবিধে, তাই না ? এই পাড়াটা তো ভালোই .........
- আমার ধারণা উনি একজন ভালো প্রোমোটার পেয়েছেন, খুব সম্ভব এখানে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি হবে.......
চুপ করে থাকে রতন। এ খবর সে আগেই পেয়েছে। কোনো উচ্চবাচ্য করে না এ ব্যাপারে। শুধু বলে, 'তিন মাস সময় আছে তো, আপনি ঠিক একটা বাড়ি পেয়ে যাবেন ম্যাডাম'।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মহিলা, বলে, 'আসলে কি জানেন রতনবাবু, বাড়ি বদলানো যায়, ঘরের আসবাব বদলানো যায়, কিন্তু সংসার বদলানো, খুব একটা সহজ কাজ নয়। যে গাছের মাটি বারেবারে আলগা হয়, তার শিকড় আপনিই দুর্বল হয়ে পড়ে, সে খবর আমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে বলুন ?
এ কথার কি উত্তর দেবে, রতন ভেবে পায় না। পরিণয় যার হয় নি, পরিণতির করুণ আবেগ তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবুও মহিলার কথাগুলো বিষাদের বারিধারার মতো তাকে ছুঁয়ে যায়। সে বলে, 'আপনার যদি আপত্তি না থেকে তাহলে আমি বাড়ির ব্যাপারে চেষ্টা করতে পারি'।
- আপনি আর কতটুকু করবেন রতনবাবু, আজকের দিনে সস্তায় বাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আর তাছাড়া হুট্ করলেই তো আর ভাড়া দিচ্ছে না কেউ।
- সেটা আমি দেখে নিচ্ছি। প্রথমত, আপনি প্লিজ বাবু বাবু করবেন না, আমায় নাম ধরেই ডাকতে পারেন।
মহিলা মৃদু হেসে বলে, 'আচ্ছা বেশ........ তবে আপনার ভালো নাম........একটা আছে নিশ্চই.......'
- হ্যাঁ........ শ্রীযুক্ত রত্নাকর ঘোষ।
'ওরেব্বাবা, একেবারে রত্নাকর ! আপনি কি দস্যু নাকি' ! বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে আপাতকঠিন রমণী। রতন ভারী লজ্জা পায় সে কথায়। মাথা নামিয়ে মুচকি হাসে। এমন সময় কোথা থেকে একটি ছোট্ট ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে ঘরে। মহিলা কোলে তুলে নেয় তাকে। রতনকে দেখিয়ে বলে, 'এই আমার বিট্টু......., আমার স্বপ্ন'। রতন সামান্য আদর করে দেয় বিট্টুকে। তারপর বলে, 'আজ তাহলে আসি ম্যাডাম, ওদিকে আবার পুজোর কিছু কাজ আছে, যাই একটু সামলে দিই গে। আর বাড়ির ব্যাপারে আমি খোঁজ লাগাচ্ছি, অবশ্য আপনার যদি এতে আপত্তি না থাকে'। মহিলা স্মিত হেসে বলে, 'আপত্তি আছে বৈকি, তবে ওই ম্যাডাম কথাটায়। আপনি আমায় পল্লবী বলে ডাকতে পারেন'। রতনের বুকের ভিতর যেন দুম দুম করে হাতুড়ি পিটতে থাকে কেউ। 'আচ্ছা', বলে একছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
কয়েক মাস কেটে যায়। ঋতুর পরিবর্তন হয়...... মনেরও। পল্লবীর বাড়িতে রতনের যাওয়া আসা বাড়ে। টুকটাক চা পর্ব, বিট্টুকে নিয়ে পার্কে বেরোনো, একটা দুটো করে বাড়ির খোঁজ আনা, খোলা আকাশের মেঘের মতো দুটো ঘুড়ি ভেসে বেড়াতে থাকে সেসব আপন খেয়ালে। সেসময় এখনকার মতো ছিল না। কার উনুনে কতটা ভাত সেদ্ধ হলো, কার আঁচে কতটা তেল পুড়লো সে খবর পাড়াসুদ্ধু লোক জানতো। গন্ধ শুঁকে বলে দেওয়া যেত কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে। আর মুচমুচে পদ হলে তো কথাই নেই। একেবারে উল্কার গতিতে রাষ্ট্র হতো সেসব। দুপুরের আড্ডা হোক বা সন্ধ্যার জমায়েত, টাটকা পঞ্চায়েতিটা না করলে পেটের ভেতরটা যেন গুড়গুড় করতো সবার। সেখানে রতনের বাড়ি খোঁজার উৎসাহটা যেন বেশি করে চোখে পড়তে লাগলো পাড়ার লোকেদের। ফিসফাস, কানাকানি শুরু হলো পাল্লা দিয়ে।
সেসব কথা নিবারণ গাঙ্গুলির বাড়ি অবধি পৌঁছতে বেশি দেরি হলো না। উঠতে বসতে পল্লবীকে খোঁচা দিতে শুরু করলেন তিনি। একদিন বলেই ফেললেন, 'এসব নষ্টামো আমার বাড়িতে চলবে না। এ পাড়ায় ভদ্র পরিবারের বাস। পত্রপাঠ বিদেয় হও.........' ইত্যাদি। পল্লবী কান পেতে শোনে সেসব। প্রত্যুত্তর দিতে রুচিতে বাধে তার। সামাজিক কাঁটাতারের জালে জড়িয়ে গিয়ে ছটফট করতে থাকে। বাধ্য হয়ে রতনকে ডেকে পাঠায় একদিন বিকেলে। পাড়ার বাইরে, একটু দূরে, নিরিবিলিতে। একটা বেঞ্চির ওপর বসে দুজনে।
'আপনাকে স্পষ্ট করে কতগুলো কথা বলতে চাই রতন। আপনি কি ভাবে নেবেন আমি জানি না, তবু কথাগুলো বলা খুব প্রয়োজন আমার', থেমে থেমে কথাগুলো বলে পল্লবী।
রতন ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কিছু হয়েছে ?..... মানে আপনাকে এতো অস্থির লাগছে আজ'। সে কথার উত্তর না দিয়ে পল্লবী একটু রূঢ় স্বরে বলে, 'আজ থেকে আপনাকে আর বাড়ি খুঁজতে হবে না আমার। যেমন করেই হোক আমি নিজেই একটা বাসস্থান ঠিক খুঁজে নিতে পারবো বলে মনে হয়। আপনি এতদিন যে চেষ্টা করেছেন, সেজন্য যথেষ্ট ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। তাই আমার অনুরোধ, আপনি শুধুশুধু কষ্ট করে আমাকে আর পাপের ভাগী করবেন না' ।
রতনের মুখটা পাংশু হয়ে যায়। সে কোনোরকমে আমতা আমতা করে বলে, 'আমি জানি পল্লবী, আপনি কেন এই কথাগুলো বলছেন। লোকজনের কথায় কান দেওয়ার তো কোনো দরকার নেই আমাদের। যারা এসব আলোচনা করছে তাদের মুখ কি করে বন্ধ করতে হয় সে আমার জানা আছে। আর বাড়ি খোঁজার যে কষ্টটা বলছেন সে নাহয় একটু করলুমই, সে আর এমন কি। তবে আপনি কি করে পাপের ভাগী হচ্ছেন সেইটে ঠিক বুঝে উঠতে পারলুম না'।
পল্লবীর গলা বুজে আসে কথা বলতে গিয়ে। ডুবন্ত প্রাণীর কাছে খড়কুটোর অবলম্বনটাই নতুন করে বাঁচার হাতছানি দেয়। হাত বাড়িয়ে যখন সেটুকুও নাগালের মধ্যে আসে না তখন আপনিই মৃত্যু হয়, আলাদা করে আর ডুবতে হয় না। সে কথা রতনকে বোঝায় কি করে পল্লবী। ঠোঁট কামড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে অচিরেই। হৃদয়ের কানাগলিতে অবদমিত কষ্টের প্রতিধ্বনি হতে থাকে। সে আবেগের কিছুটা রতন আঁচ করতে পারে। বলাই বাহুল্য রতনের পক্ষ থেকেও অনুরূপ আবেগের খামতি ঘটে নি কখনই । সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, 'সামাজিক দায়ভার যতটা আপনার, আমারও ততটাই। পিছিয়ে যাওয়ার মতো মানসিকতা নিয়ে আমি এগিয়ে আসিনি পল্লবী। সবার মাঝখানে সেকথা বলার মতো যথেষ্ট সাহসও আমি রাখি। আমি মনে করি, সামাজিক নিয়মে উপযুক্ত সম্মান আপনার পাওয়া উচিত এবং সে প্রাপ্য সম্মান দিতে আমি কখনই পিছপা হবো না। অবশ্য আপনার অনুমতি নিয়েই। আপনি যদি সম্মত হন তাহলে আমি বাড়িতে কথা বলতে পারি'। পল্লবীর গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সূর্যাস্তের আলোয় চোখ মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে। কোনোমতে বলে, 'আমি জানি সে আপনি পারবেন, কিন্তু............
'না', দৃঢ়তা ফুটে ওঠে রতনের গলায়, 'আর কোনো কিন্তু নয় পল্লবী, আমি যদি এতটুকুও কাছে আসতে পারি আপনার, সে আমার ভাগ্য। আর তার জন্যে যেটুকু অধিকার জন্মেছে আপনার প্রতি সেই অধিকার বোধ থেকেই বলছি আপনার ও বিট্টুর দায়িত্ত্ব নিতে রাজি আছি আমি, আমায় শুধু একটু সময় দিন', কথাগুলো বলেই হনহন করে হাঁটা লাগায় রতন। দমকা হাওয়ায় এলোমেলো চুল উড়তে থাকে, এক দস্যুর মতোই লাগে যেন রতনকে। পল্লবী অপার অনুরাগে চেয়ে থাকে সে দিকে। সেই দস্যুর প্রতি অমোঘ টান অনুভব করতে থাকে মনে মনে। কিন্তু কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম কাঁটাও বিঁধতে থাকে খচখচ করে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই রতন, পল্লবীর কথাটা পাড়ে বাড়িতে। সুধাময়ের মুখ পলকে থমথমে হয়ে যায়। জয়া ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সন্তানের নিশ্চিত অবনমনটা যেন চোখের সামনে দেখতে পান দুজনেই। তার পরে পরেই ভেসে ওঠে পারিবারিক মর্যাদার কথা। সামাজিক অস্তিত্ব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার চিত্রটা কল্পনা করে মনে মনে শিউরে ওঠেন সুধাময়। ছেলের কচি মাথাটা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য জয়া একনাগাড়ে শাপ শাপান্ত করতে থাকেন পল্লবীকে। রতনের সমস্ত চেষ্টাই বিফলে যায়। ঐতিহ্যবাহী ঘোষবাড়িতে কলঙ্কের কালি লেপে দিয়ে যাবে কোনো এক অজ্ঞাত কুলশীল বিবাহবিচ্ছিন্না, একথা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না দুজনে। তেমন তেমন হলে রতনকে যে ত্যাজ্যপুত্র করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না একথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন সুধাময়।
সমস্ত রাত ভাবতে থাকে রতন। একদিকে ঘোষবাড়ির সম্মান অন্যদিকে হৃদয়। অসম অনুপাতের দরুন সম উচ্চতায় আসে না দুটোর কোনোটাই। মূল্যবোধের দাঁড়িপাল্লায় হৃদয়ের দিকেই ভার হয় বেশি। মনে মনে তার আগামী পদক্ষেপ ঠিক করে নেয় সে। খুব তাড়াতাড়ি একটা বাড়ি জুটিয়ে ফেলতে হবে, আর তারপরেই একটা কাজ। ভবিষ্যতের পথচিত্রটা এঁকে ফেলতে হবে দ্রুত। মনের সমস্ত জড়তা কাটিয়ে ফেলতে সময় লাগে না তার। এই সিদ্ধান্তের কথা পল্লবীকে গিয়ে না বলা অবধি সে অস্থির হয়ে ওঠে। পল্লবীর সাথে তার জীবনের গ্রন্থিগুলো বাঁধা পড়বে আর কিছু দিনের মধ্যেই, এটা ভেবেই ভিতরে ভিতরে চাপা সুখ অনুভূত হয়। পরম পাওয়ার উৎকণ্ঠায় সারারাত প্রায় জেগেই কাটিয়ে দেয় রতন ।
পরদিন সকালবেলাই বেড়িয়ে পড়ে তড়িঘড়ি। সুধাময় আর জয়ার সমস্ত রকম বারণ অগ্রাহ্য করে পল্লবীর বাড়ির দিকে ছুটে যায় সে। যে নদী জোয়ারের টানে এতকাল পর তার চলার পথ খুঁজে পেয়েছে তাকে আটকায় কার সাধ্য ! খানিক দূর যেতেই ছোটুর সাথে দেখা হয়। হন্তদন্ত হয়ে সে এসে বলে, 'রতন দা, তোমার জন্য একটা চিঠি আছে' । 'চিঠি ? কে দিলে' ? ভারী অবাক হয় রতন।
- নিবারণ কাকাদের বাড়ির দিদিমণি, এই চিঠিটা তোমায় দিতে বললেন.........
রতন ব্যস্ত হয়ে চিঠির ভাঁজ খোলে, তাতে লেখা আছে............
দস্যু,
কিছু কথা সেদিন বাকি ছিল। সবটা বলা হয়ে ওঠেনি, সবটা বলতে পারিনি। আজ বলি বরং।
গ্রাজুয়েশনের পর পরই আমার বিয়ে হয়। মধ্যবিত্ত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভার লাঘব করি অনেক অল্প বয়েসেই। সেসময় বিয়ে করার মতো মানসিক ভাবে তৈরী না থাকলেও একরকম ভবিতব্য জেনেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। অন্যান্য নব্য গৃহিণীদের মতো আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম এক পরিপূর্ণ সংসারের। নিজের ব্যক্তিগত ছোট বড় আকাঙ্খা গুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছিলাম আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের চাহিদার সাথে। নানা রকম সাধ পূরণের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেসময়। ধীরে ধীরে যত দিন গড়িয়েছিল, বুঝতে পেরেছিলাম দম দেওয়া পুতুলের ভূমিকা পালন করা ছাড়া তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা আমার নেই সে বাড়িতে। অথচ আমি আমার কর্তব্যে গাফিলতি করিনি। স্বামীকে ভালোবেসেছিলাম প্রাণ দিয়ে। প্রতিদানে তাঁর লাঞ্ছনা ও বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সাক্ষী থেকেছি শুধু। প্রত্যাশিত ভাবেই শুরু হয় অবহেলা আর অনাদর। সংসারের ঘানিতে পিষে যেতে থাকে আমার আত্মসম্মান, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। মনে মনে ঠিক করি এই অসম্মানের ছাতের তলায় আর নয়। চরম প্রতিকূলতায় যখন বি এড পাশ করি তখন বিট্টু আমার পেটে। সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসি শ্বশুর বাড়ি থেকে। বছরখানেক বাদে ডিভোর্স হয় আমাদের। ছেলেকে বাপের বাড়িতে রেখেই মানুষ করতে থাকি। বি এড টা থাকার ফলে এই স্কুলটায় চাকরি পেতে অসুবিধে হয়নি। বাবা মার গলগ্রহ হতে চাইনি বলেই আলাদা থাকি তারপর থেকেই। এই পাড়ায় এসে তোমার সাথে আলাপ হলো। আমাদের প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম তোমার মনটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ।রেকাবিতে সাজানো পুজোর ফুলের মতোই পবিত্র তুমি। তোমার অভ্যাসে অনভ্যাসে যে শিশুসুলভ সারল্যের আভাস পেয়েছিলাম তাতে বড় মুগ্ধ হই, জানো। তোমার মনের আয়নায় নিজেকে স্পষ্ট দেখেছিলাম যেদিন, সেদিন আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম নতুন করে ছাউনি বাঁধার, আবার করে সাজাতে শুরু করেছিলাম আমার সাধের মঞ্জিল। আমার বর্তমান পরিস্থিতি জেনেও যখন আপন করে নেবার সিদ্ধান্ত নিলে তখন থেকেই তোমাকে উচ্চ আসনে বসিয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর আমাদের পথ আলাদা করে রেখেছেন। হৃদয়ের সুর একই তারে বাঁধা হলেও সে কখনোই সঙ্গীত হয়ে উঠবে না সে আমি জানি। বড় স্বার্থপর আমি রতন, বড় স্বার্থপর। শুধু নিজের কথাটাই ভেবে গেছি...... তোমার পরিণতির কথা মনে হয়নি একবারও। আমার কাছে তোমার মাথা উঁচু হলেও, তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজনের কাছে যে খুব ছোট হয়ে যাবে তুমি, সেকথা ভুলে গেছিলাম। তোমার বাড়িতে যে আমি অপাংক্তেয় তা কি আমি আন্দাজ করতে পারিনি ভাবছো ? আমি জানি সেসবের তুমি পরোয়া কর না। কিন্তু যাঁরা তোমায় জন্ম দিলেন, যাদের কোল ঘেঁষে তুমি বড় হলে, যাদের সাথে সময় কাটালে তাদের কথা একটিবারও ভাববে না তুমি ? দুদিনের আলাপ তোমার নিকট আত্মীয়ের থেকে আজ এতো বড় হলো ? সে অপবাদ যে আমি সইতে পারবো না......... তাছাড়া আমি ঘরপোড়া গরু, আমার দুর্ভাগ্যের আকাশে যে সিঁদুরে মেঘ দেখা দেবে না তা কি কেউ বলতে পারে। সে ঘটনা যদি আবার ঘটে তাহলে যে তোমার পল্লবীর মৃত্যু হবে রতন। তুমি কি তাই চাও ? আমায় যদি এতটুকুও ভালোবেসে থাক, শপথ কর তুমি বাড়ি ছাড়বে না, কখনোই, কোনো অবস্থাতেই। জেনো তবেই আমি শান্তি পাবো........
এ চিঠি যখন তুমি পাবে তখন আমি বর্ধমানের পথে, ওখানকার একটা স্কুলে এপ্লাই করেছিলাম, মঞ্জুর হয়েছে। তাই একরকম মনস্থির করে বেরিয়ে পড়লাম। আমি জানি তুমি ঠিক ক্ষমা করবে আমায়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি রত্নের মতো উজ্জ্বল থেকো এমনই......চিরটাকাল। তোমায় চেয়েছি একথা সত্যি, কিন্তু তোমার বিসর্জন দিয়ে নয়...........
ইতি
তোমার........
![]() |
| ছবি : গুগল |














