Saturday, August 20, 2016

ঘোগের বাসা

প্রায় দুশতক পরে যেন কলম ধরেছি মনে হচ্ছে, থুড়ি, কিবোর্ড ধরেছি। মাঝের হপ্তা দুয়েক বিছানার সাথে একেবারে লেপ্টে ছিলুম যাকে বলে। এক্কেরে মাখামাখি অবস্থা যাহোক। যতবার বলেছি ওরে ছাড়, মেলা কাজ পরে আছে, তোত্তোবার যেন বাবা বাছা বলে জাপ্টে ধরে আয়েশ করে, মাথায় হাত বুলিয়ে সকালের ডিম্ টোস্ট, দুপুরের গরম ভাত, সন্ধের চা মুড়ি খাওয়ার লোভ দেখিয়েছে । তার সাথে কুড়মুড়ে পাঁপড়ভাজার মতো জুটেছে লাগামছাড়া সেবা, যা শেষ কবে পেয়েছিলুম, কপাল চাপড়িয়েও মনে করতে পারছি না তেমন। সে মায়ার বাঁধন যদি বা টুকুন কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, তাই বলে যে এখন টারজানের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠে এগাছ সেগাছ নাঁপিয়ে বেড়াবো সে ক্ষমতা একেবারেই নেই। কি হয়েছিল ?.......... বলছি বলছি, এটুকু বলতেই হাঁপ ধরে গেলো কত্তা !

গেলো হপ্তার রোববার থেকেই গা টা কেমন যেন ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছিলো। তেমন পাত্তা না দিয়ে প্যারাসিটামলের বড়ি গিলে নিলুম। বলা নেই কওয়া নেই হতভাগা জ্বরটা একেবারে হুড়মুড়িয়ে গায়ের ওপর এসে পড়লে রাতের দিকে। একশো একেই গোঁ গোঁ করে ভূতের মতো ডাক ছাড়তে লাগলুম । দুদিনের মধ্যেই আষ্টেপৃষ্টে নাগপাশের মতো জড়াচ্ছে দেখে বদ্যি বললে, 'রক্ত পরীক্ষাটা করিয়ে নাও হে, লক্ষণগুলো ভারী চেনা চেনা ঠেকছে বাপু' । চেনা অচেনার বেড়াজালে ঠোক্কর খেতে খেতে রক্তিম স্রোত বইয়ে দিলুম অকাতরে। শিশি ভরে ভরে রক্তদান শিবির স্বার্থক করে তুললুম বিনা বাক্যব্যয়ে, সঙ্গে চলতে লাগলো এন্টিবায়োটিকের তাল মেলানো ডোজের কাব্যিক সঙ্গত । রিপোর্টে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড সবই নেগেটিভ বেরোতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। বাড়ির লোকজনও স্বস্তির শ্বাস ফেললো। ভাইরাল ফিভারও কুপোকাৎ করছে ভেবে নিজেই নিজেকে বাঁকা চোখে দেখতে লাগলুম । ভাবটা কতকটা যেন, 'হুঁ: ! ইঁদুরেও লেঙ্গি মেরে গেলো' !.....যাইহোক বয়েস হচ্ছে ভেবে ক্ষমা ঘেন্না করে দিলুম নিজেকে ।

কিয়দকাল সুস্থ বোধ করাতে অফিসের প্রতি অমোঘ টান অনুভব করলুম ও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে এবং বাড়ির চোখরাঙানি কে উপেক্ষা করে, হৈ হৈ করে একদিন দুদিন করে বুক ফুলিয়ে সারাদিন কাটিয়ে এলুম অফিসে। ঐটে কাল হলো এক্কেবারে। খ্যাপাটে জেদী ঘোড়ার মতো টগবগ করে শিরা উপশিরার মধ্যে বয়ে যেতে লাগলো বন্য জ্বরের তেজী আস্ফালন। বাড়ি ফিরে প্রায় মুচ্ছো যেতে বসেছিলুম। শুরু হলো অজস্র কাশির দমক। সে একেবারে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গলার কাছে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো ক্ষনে ক্ষনে, পরের পর । অল্প সময়ের মধ্যেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের হার দ্বিগুন হলো বেশ । চোখে মুখে নিশি রাতের আঁধার ছেয়ে এলো অচিরেই। প্রমাদ গুনলুম, 'একি হলো !! এমনটা তো হয়নি আগে ? খেয়েছে...... তবে কি সময় ফুরিয়ে এলো ? "নিভলো তবে দীপের বাতি, শেষের সময় কিছু বাকি" ? আগডুম বাগডুম কাব্যি করতে লাগলুম মনে মনে । পরের দিন পড়ি কি মড়ি করে ছুটলুম অন্য বদ্যির কাছে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পিঠে টিপে দেখে শুনে 'হুমমম.....' বলে গুম হয়ে রয়ে রইলেন কিছুক্ষন, তারপর বললেন, 'ডেঙ্গির সিম্পটম বটে, তবে বড় অদ্ভুত ঠেকচে হে, তুমি বরং রক্ত পরীক্ষার সাথে বুকের এক্স রে টাও করিয়ে নাও একেবারে, বলা তো যায় না কি বাসা বেঁধেচে শরীরে' । বোঝো কাণ্ড ! নিজের শরীরটা যেন ভাড়ার বাড়ি, যে কেউ এসে বাসা বাঁধলেই হলো ! ট্যাক্সো নেই ! আহাম্মকের মতো হে হে করতে করতে বেরিয়ে সটান হাজির হলুম পরীক্ষাগারে। যুগপৎ রক্ত দিয়ে ও এক্স রে করিয়ে ফিরলুম। এন্টিবায়োটিক চলতে লাগলো সমান তালে । বাড়ির লোকের ভয় বাড়িয়ে অবস্থার তেমন উন্নতি ঘটলো না। এরপর দুদিন ঠায় অপেক্ষা করতে হলো রিপোর্টের জন্য। মড়ার মতো পড়ে থাকা ও টিভির দিকে চোখ রাখা ছাড়া বাকিটা চলত্শক্তিহীনের মতোই কাটাতে লাগলুম। অবশেষে রিপোর্ট বেরুলো ও সেটিকে বগলদাবা করে পুনরায় বদ্যির কাছে হাজিরা দিলুম। যথারীতি ডেঙ্গি নেই, আগেই দেখে নিয়েচি, শুধু এক্স রে টা বোধগম্য হয় নি বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম ত্রাতার দিকে। আলোর দিকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে এক্সরে প্লেট টা টেবিলের ওপর রেখে চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। বললেন, 'ডেঙ্গি ফেঙ্গি  কিস্যু নয় হে, তোমার নিউমোনিয়া হয়েছে ছোকরা' ! বাবা আর আমি পাল্লা দিয়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিলুম। এই বয়েসে নিউমোনিয়া ! বলিহারি ! এমনও হয় ! আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বদ্যি বললেন, 'অত চিন্তার কিছু নেই, ওষুধ চেঞ্জ করে দিচ্ছি, ভয় পেয়ো না, ফুল বেড রেস্ট নাও, ঠিক হয়ে যাবে......'। কাঁচুমাচু মুখে বাড়ি ফিরে এলুম, মনে হলো কতকটা মুখ পুড়িয়েই এলুম যেন। এ যেন এনুয়াল পরীক্ষায় কম নাম্বার পাওয়ার মতো, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া দূরঅস্ত, শেষকালে নিউমোনিয়া !!!!

যদিও নিউমোনিয়া ধারে ও ভারে বেশ পঙ্গু করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং রেস্টে না থাকলে ফের জ্বর আসার চান্স থাকে যথেষ্টই, তবুও এরকম বিতিকিচ্ছিরি অসুখ আমার মতো ধাড়ির কেমন করে করে হলো সে প্রশ্নের উত্তর ঢের খুঁজেও মনমতো পেলাম না। বদ্যি বললেন এসির জন্য হতে পারে বা বৃষ্টিতে ভিজেও হতে পারে। হ্যাঁ, তা বিলক্ষণ হতে পারে বৈকি, বৃষ্টিতে ভিজে এসিতে বসাটা খুব পুরোনো মনে হলো না। তবুও.......তাই বলে একেবারে নিউমোনিয়া ? একজন তো ফোনে বলেই ফেললে, 'সেকি মশাই নিউমোনিয়া তো কচি ছেলেদের হয় শুনেচি, আপনি বাধালেন কি করে' ? কোনোক্রমে সে প্রশ্নের চাপ কাটিয়েছি এই বলে, 'হেঁ হেঁ ....... আমার তো খুব বেশি বয়েস বাড়েনি কিনা, তাই আর কি' ! লজ্জায় মরে গিয়েছিলাম মরমে ।

যাইহোক অফিস ভরসা জুগিয়েছে অনেকটাই, বন্ধুরা দেদার ফোন করে, হোয়াটস আপ করে আশ্বাস দিয়েছেন, তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তবু সকলকেই সাবধান বাণী শুনিয়ে যাই। তা হলো সময় ও কাল টা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না কত্তা আমাদের ! বিশেষ করে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে রয়েচেন তাঁরা তো সাবধান হন অবশ্যই। এমন বেয়াড়া ওয়েদারে বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা না করাই ভালো। বরঞ্চ 'ওষুধ খেলে সেরে যাবে, সময়মতো দেখে নেবোখন' মাফিক চিন্তা ভাবনা দূরে সরিয়ে আগে থেকে সতর্ক থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্যাঁচালো অসুখে সত্যি সত্যি সোজা সরল ওষুধে কাজ দিচ্ছে না মোটে। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি তাই বলছি। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বাঁধতে দেরি হচ্ছে না, তাই নিজেকে ব্যাঘ্রসমান ভাবলেও......এ যাত্রা সাধু সাবধান !!...... না হলে নিউমোনিয়া হয় ???  ঘোর কলি মশাই......... ঘোর কলি !!

পুনশ্চ : খবর পেয়েছি বিভিন্ন বাঁকাচোরা ব্যাধিতে বন্ধুবান্ধবরা আক্রান্ত, এমনকি এই অসময়ে হামও হচ্ছে, সুতরাং চেষ্টা করুন, সুস্থ থাকুন, ঠিক পারবেন। আমি বলচি !





ছবি : গুগল

#bengaliarticles #bengalifunnywriteups #pneumonia

No comments:

Post a Comment