Monday, July 24, 2017

রেনি ডে

আজ নিয়ে তিন দিন হল। একটানা, অবিরাম বৃষ্টিতে কলকাতা কার্যত ভাসছে। কোনোরকমে হাতের ছাতাটা সামলে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নিউআলিপুর অবধি এসেছি। এমন সময় টালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিক থেকে একটা ট্যাক্সি ডান দিক বরাবর এসে প্রায় শৈল্পিক ভঙ্গিমায় গর্তের ভেতর থেকে কয়েক আঁজলা জল ছিটিয়ে প্যান্টের অর্দ্ধেকটা ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম আর মনে মনে যথেচ্ছ শাপ শাপান্ত করতে লাগলুম ট্যাক্সির ড্রাইভারকে। বৃষ্টির তোড়ে ততক্ষনে আমার জামাটার ডান পাশটাও ভিজতে শুরু করেছে। ঝাপসা চশমার ভেতর থেকে প্রাণপণে একটা অটোর খোঁজ করে চলেছি। কিন্তু আমার কপালকে আমি খুব চিনি। বেশ কিছুক্ষন নির্বিবাদ সপসপে ভিজে সর্দি না ধরানো অবধি কোনো অটো পাব না। অগত্যা ফুটপাথের ওপর ত্রিভঙ্গ মুরারীর এঙ্গেল প্রাকটিস করতে লাগলুম আর একমনে ভাবতে লাগলুম ঈশশশশ অফিসেও যদি একটা করে রেনি ডে হতো !!......................... ঝাঁ করে মনে পড়ে গেল বেশ কয়েক বছর আগের কথা। 

তখন আমি ক্লাস টু কিম্বা থ্রী। আমাদের স্কুলের জুনিয়র সেক্শনটা মেনকা সিনেমার ঠিক পিছন দিকটায় ছিল। সেবার দারুন বৃষ্টির মধ্যেও স্কুলের বাসে করে এসেছি। শুধু আমি নই। আমার মতো হাভাতেরা যাদের স্কুল অন্ত প্রাণ ছিল এবং যারা বৃষ্টির দিনে চুপচাপ বাড়িতে বসে পেঁয়াজি ভাজাটা কোনো কাজের কথা মনে করতো না, তারাও প্রায় সকলেই এসেছে। গত রাত থেকে তুমুল বৃষ্টি হওয়ার ফলে স্কুলের সামনে এক কোমর জল তখন ডুব সাঁতারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে সীমাহীন সমূদ্র ও অজস্র পাঁকের জঞ্জাল সাঁতরে গেট অবধি পৌঁছনোর আগেই শুনলাম আজ স্কুল বন্ধ। দূর থেকে আমাদের আন্টিদের দেখলুম হাত নেড়ে সবাইকে ফিরে যেতে বলছেন। এ আবার কি কথা ! শনি, রবিবার আর ছুটির দিন ছাড়া কখনো স্কুল বন্ধ হতে শুনিনি। আজ কি হল ? বিভিন্ন কথাবার্তায় জানতে পারলুম স্কুলে জল ঢুকেছে। কি আশ্চর্য ! স্কুলে আবার জল ঢোকে নাকি ? 

আসলে ওই সেকশনে বছরের প্রথম মাসগুলোতে আমাদের কোনোরকম বর্ষার অভিজ্ঞতা হয়নি। সুতরাং এহেন গভীর নিম্নচাপে স্কুলেরও যে নিদারুণ চাপ হতে পারে এ আমাদের কল্পনাতীত ছিল। যাই হোক মুখের কথায় আমি খুব একটা বিশ্বাসী ছিলাম না তখনও। তাই সে দুর্দান্ত জলরাশিকে তুচ্ছ মনে করে কোনোক্রমে গেট অবধি পৌঁছে যা দেখলুম তাতে করে আমার সে যাবৎ পড়া পৃথিবীর সমস্ত আশ্চর্য মিথ্যে হয়ে গেল একেবারে। আমাদের সেই স্কুলটা বাইরের পিচ রাস্তার থেকে বেশ কিছুটা নিচু ছিল। অর্থাৎ সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে, একটা চাতাল পেরিয়ে খানিকটা হেঁটে গিয়ে বাঁ দিকের সরু রাস্তা ধরে সোজা ক্লাসরুমগুলোতে গিয়ে শেষ হতো। অমনটা হওয়ার কারণ যে কি ছিল সে আমি জানতে পারিনি কখনো। যাইহোক, মুখ বাড়িয়ে দেখলুম, সেই চাতালটায় প্রায় বুক সমান ঢেউ উঠছে একের পর এক। ছোটখাট স্কুবা ডাইভিং করা যাবে এতটাই জল জমেছে সেখানে। আমাদের দারোয়ান ও স্কুলের অন্যান্য স্টাফরা একপ্রকার ডাইভ দিয়েই বালতি বালতি জল তুলে পাশের গলিটায় ফেলছেন আর প্রায় ইঁদুর তাড়ানোর মতো করে ছেলেমেয়েদের গেট থেকে ভাগিয়ে দিচ্ছেন । এহেন জিনিস আগে দেখিনি প্রায় কেউই। স্বভাবতই বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো সে 'বার্তা রটে গেল ক্রমে'। যারা ছিল তারা তো রইলই, যারা চলে যাচ্ছিল তারাও সবাই মিলে জড় হয়ে সে আশ্চর্য দৃশ্যর নিস্পলক সাক্ষী হতে লাগল। পরবর্তী কালে এই দৃশ্যের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলুম তার কারণ অধিক বৃষ্টিপাতে যে আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যাবে এটা আন্দাজ করাটা খুব একটা পারদর্শিতার কাজ ছিল না। কিন্তু তাই বলে স্কুল কামাই করতুম না আমরা কিছুতেই।  

এর বহু বছর পর এই ছুটির দিনগুলোর সঠিক সদ্ব্যবহার করার উপায় বের করে ফেললুম আমরা সকলেই। তখন আমার ক্লাস টেন। আমাদের সিনিয়র সেকশনটা তখন সাদার্ন এভিনিউতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা পিঠের দুপাশে অদৃশ্য পাখার উপস্থিতি টের পেতে শুরু করেছিলুম। এবং সময়নুসারে সে পাখা মেলে ধরতেও আমরা কিছুমাত্র কুন্ঠা বোধ করতুম না। সেবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন সকাল থেকেই মেঘের বজ্রনিনাদ ও তাল মেলানো অক্লান্ত বর্ষণে আনন্দে নেচে উঠেছিলুম। ভেবেছিলুম এই বিল্ডিংটায় জল জমুক না জমুক, এমন ঘনঘোর ঝঞ্ঝায় আর কিছু না হোক রেনি ডে টা অন্তত হবে। আর তারপরেই দিগ্বিদিগ শূন্য হয়ে আমরা চষে বেড়াবো শহরের মেঘ্লাতম দিনে। কিন্তু প্রকৃতি যে আমার আবেগ নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলবে এ আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। স্কুলে যখন পৌঁছলুম তখন বৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে থেমে গেছে। গেট খুলে গেছে এবং নির্বিবাদে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার একটা অপ্রত্যাশিত উপক্রম দেখা দিয়েছে। স্বভাবতই ভীষণ ভেঙে পড়লুম। আমার মতো আরও অনেকে যারা এই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার অপেক্ষায় ছিল তাদের সকলের মুখ চুন। কানাঘুষোয় জানতে পারলুম অনেকেই বুড়ি ছোঁয়ার মতো স্কুলটা ছুঁয়েই মেনকা বা নবীনার উদ্দেশ্যে রওনা হবে ভেবেছিল। কিন্তু তাদের সকলেরই এখন মাথায় হাত। ঘোর কালিমালিপ্ত চোখ মুখ নিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে ঘোরাফেরা করছে স্কুলের সামনেটাতেই। এহেন সময় গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো আরেকটা সংবাদ পেলুম। কিছু কিছু স্টুডেন্ট যারা আদ্যোপান্ত বৃষ্টিতে ভিজেছিল তাদেরকে পত্রপাঠ বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। যারা ভেজেনি তাদের নিয়ে বাকি ক্লাস হবে এমনটা ঠিক হয়েছে। এমনকি পাঁচ ছজন হলেও। এই খবরে প্রায় মুচ্ছ যেতে বসেছিলুম আমরা কয়েকজন। কোনো এক বিশেষ কারণে আমরা তখন খরার মত শুকনো। জলের কোনো ছিটেফোঁটা গায়ে লাগেনি। তার কারণ বৃষ্টিতে ভেজাটা উদ্দেশ্য ছিল না। রেনি ডের ষোলোকলা পূরণ হবে ভেবে আগাম বাঁচিয়ে রেখেছিলাম নিজেদের। কে জানবে জলের অভাবে আমাদের সমস্ত প্রকল্প একেবারে জলাঞ্জলি যাবে !

এমন করুণ পরিস্থিতিতে আমরা যখন প্রায় মড়া কান্না জুড়েছি এমন সময় এক বন্ধু আঙ্গুল তুলে এমন এক জিনিস দেখালে যা দেখে হৈহৈ করে এক পৈশাচিক উল্লাসে ওকে প্রায় কাঁধে তুলে আমরা নাচতে লাগলুম। আমাদের মেন্ বিল্ডিংটার ঠিক পরের বাড়িতে দক্ষিণদিকে দেওয়ালঘেঁষা একটা পুরোনো পাইপ ছিল। কোনোভাবে সেই পাইপ ফেটে হড়হড় করে একেবারে বানের জলের মতো জল বেরোচ্ছে তখন। আমরা আর কালক্ষেপ না করে গলির দিকে মুখ করে পরপর সব দাঁড়িয়ে পড়লুম সেই পাইপের তলায়। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও এমন অভাবনীয় আকস্মিক বর্ষার ধারাপাত হবে ভাবিনি। ফলস্বরূপ যে কজন আমরা কাকভেজা ভিজেছিলাম তাদের সকলেরই ছুটি মঞ্জুর হল এবং বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে আমরা তড়িঘড়ি নবীণার দিকে দৌড় দিলুম। এখনো মনে আছে, সেবার নুন শোয়ে নবীনার রিয়ার স্টলের প্রায় তিনটে রো শুধু মাত্র স্কুলের স্টুডেন্টেই ভর্তি ছিল........ 

শুধুমাত্র এই সমস্ত কার্যকারণে নয়, বন্ধুদের সাথে নিছক আড্ডা দিয়ে নিরলস সময় কাটানোর অন্যতম দিনও ছিল রেনি ডে। গড়িয়াহাটের অটোয় যেতে যেতে ভাবছিলাম, আমার আড়াই বছরের পোলাপানটা এমনই এক বৃষ্টির দিনে স্কুল যাওয়ার আশ্চর্য বায়না জুড়েছিলো। নানারকম ভয় ও প্রলোভনেও সে পিছপা হয় নি একটুও। শুধু আমি জানি, এমন দিনেই স্কুল যেতে হয় কারণ এমন দিনগুলোতেই তো রেনি ডে হয়...........

ছবি ও চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব 


#rainyday #rain #bengaliarticle  

Saturday, July 15, 2017

ইন্ডিয়া - পাকিস্তান

রাতঘড়িতে তখন বারোটা দুই। বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক্ষন। রাস্তার ওপর সোডিয়াম ল্যাম্পের চিকন আলো ছাড়া আর কোথাও কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। ড্রয়িং রুমের ডানদিকে নীল সোফার ওপর আধশোয়া হয়ে একের পর এক চ্যানেল ঘুরিয়ে চলেছি আনমনে। লক্ষ্য একটাই  - ভালো সিনেমা দেখা। বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে গত কয়েকদিনে না লেখার দরুন যে মেঘ জমা হয়েছে তার তাড়নায় মন খারাপের কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। কথায় বলে 'অভাবে স্বভাব নষ্ট'। তেমনই আমার সময়াভাবে, লেখা নষ্ট হওয়ার জোগাড় হতে বসেছে। এমন মনঃপীড়া নিয়ে ছটফট করতে করতে যে চ্যানেলটায় এসে থামলাম, ভাবিনি লেখার রসদ পেয়ে যাব সেখানেই। 

ইন্ডিয়া - পাকিস্তান ম্যাচ, মহিলাদের, তদুপরি হাইলাইটস। তবুও শেষ অবধি চোখ ফেরাতে পারিনি কোনোভাবেই। যাঁরা দেখেননি তাঁদের অবশ্যই বলব, সুযোগ করে একবার দেখে নিন। আমি জানি, আমরা সচিন, সৌরভ, সেওয়াগ, যুবরাজ , ধোনি, কোহলি, রায়নাদের যুগশিল্প দেখে দেখে চোখে হাজা ধরিয়ে ফেলেছি। সেখানে মেয়েরা একটু ব্যাট করবে,হাত ঘুরিয়ে বল করবে, এ আবার রাত জেগে দেখার কি আছে ? তাহলে বলি, পুনম রাউত, দীপ্তি শর্মা, সুষমা ভর্মা - এঁদের যাঁরা চেনেন না তাঁরা আগামী দিনে এঁদের নাম মুহুর্মুহু শুনতে পাবেন এ বিষয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। তুলনামূলক ভাবে মন্থর হলেও এঁরা যে ইনিংসগুলো খেললেন তাতে করে ইতিহাসের পাতায় সহজেই নাম তুলে ফেললেন ভারতবর্ষের নীলরত্নরা। দুরন্ত কভার ড্রাইভ, স্কোয়ার কাট ও স্ট্রেট ড্রাইভ গুলো শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, তার পিছনে যে দৃপ্ত ফুটওয়ার্ক ও মধুর টাইমিংয়ের যুগলবন্দী দেখলাম তাতে বারবার হৃদয় জুড়ে একটাই শব্দ উঠে আসছিল - 'কেয়াবাৎ'......'কেয়াবাৎ'। পুনম রাউত একটুর জন্য হাফ সেঞ্চুরি মিস করে গেলেও সুষমা ভর্মা ও ঝুলন গোস্বামীর নির্ভীক লফ্টেড শটগুলো যখন পাকিস্তানী ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারি লাইনে আছড়ে পড়ছিল ঝড়ের গতিতে, তখন ভরা রাতেও সোফা ছেড়ে হাততালি দিতে কোনো কসুর করিনি। যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম তার থেকে মন ভালো হয়ে গেছিল দ্বিগুণ। যদিও বিস্মিত হওয়ার বাকি ছিল অনেক। খেলার ফল আগে থেকেই জানতাম তবু চোখে দেখার বিস্ময় থেকে বঞ্চিত হইনি বিন্দুমাত্র। 

ফিল্ডিং এর সময় প্রায় ফিতে দিয়ে লাইন লেংথ মাপা বোলিংয়ের ধার ও ভারে এক এক করে কেটে যেতে লাগলেন পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানরা। ঝুলন গোস্বামীর মসৃন একশন, গুড লেংথ বোলিং ও একতা বিস্তের ধারালো স্পিনে প্রথম ধাপেই ১০ রানের মধ্যে পাকিস্তান তিন উইকেট হারিয়ে ডুবন্ত নাবিকের মতো ছটফট করছিল। পরের দিকে মানসী যোশী ও একতা বিস্তের তালমেলানো নিখুঁত বোলিং পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডারে শেষ পেরেকগুলো পুঁতে দিয়ে চলে গেল। এর সাথে অনবদ্য ফিল্ডিং - যেখানে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রান আটকানোর চেষ্টা, পাকিস্তানের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এমন অনমনীয়, অদম্য লড়াই হালফিলে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। ভারতের ১৬৯ রান নিঃসন্দেহে স্কোরবোর্ডের বিস্ময় নয় তবে ৭৪ রানে ১০ উইকেট ফেলে দেওয়াটা যে পাকিস্তানের আজন্ম লজ্জার কারণ হয়ে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ম্যাচটা লাইভ দেখার আফশোষ ছিল বহুদিন, তবে হাইলাইটসটা অনেকাংশেই সে ক্ষতে মলমের কাজ করেছে। বিশেষ করে পুরুষদের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত - পাকিস্তান ফাইনাল ম্যাচের পর। মহিলাদের ভারতকে কুর্ণিশ ও অসংখ্য সাধুবাদ, গর্বের মুকুটে এক নতুন পালকের সংযোজন হল, হৃদয়েও.........


বিন্যাস : নিজস্ব 
#IndiaPakistanICCWomensWorldCup2017 #cricketarticles #ICCWomensWorldCup2017        

Saturday, July 1, 2017

সাপ্তাহিকী ২৮ # ছোট্ট উপহার

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। দুর্যোগের কালো মেঘ যেন ঘনিয়ে এসেছে গোটা শহর জুড়ে। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ফলা বর্শার মতো ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। প্রবাহ দক্ষিণের জানলার সমানে এসে দাঁড়ায়। অনতিদূরে স্ট্রিট ল্যাম্পের নিয়ন আলো ফোঁটায় ফোঁটায় জানলার কাঁচ ভেদ করে চুঁইয়ে পড়ছে। প্রবাহ সেদিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। পাশের বাড়ির এসবেস্টসের ছাদে কোনো এক মোহময় ছন্দে জলের তীব্রধ্বনি বেজে চলেছে এক নাগাড়ে। খুব কাছেই কোথাও একটা কড়কড় শব্দে বাজ পড়ে। কেঁপে ওঠে প্রবাহ। আজ রাত্রিটা অফিসেই কাটাতে হবে মনে হচ্ছে। কয়েক ঘন্টার একটানা বৃষ্টিতে অফিসের আশেপাশের এলাকায় জল জমেছে বেশ। এই অবস্থায় বাইক চালিয়ে কসবা থেকে বাড়ি ফেরা একপ্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া কাল সকালেই আবার অফিস থেকে সুন্দরবন যেতে হবে তাকে। সুতরাং সমস্ত দিক ভেবে অফিসেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে প্রবাহ। বসকে আগাম জানিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষন আগে বাড়িতেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।

উল্টো দিকের চাইনিজ রেস্তোঁরার হাক্কা নুডলস দিয়ে চটজলদি ডিনার সারা হয়ে যায় তার। দশটা অবধি জনা তিনেক ছিল অফিসে। ধীরে ধীরে তারাও যে যার সুবিধেমতো বেড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই। অতঃপর এই চারতলার বিল্ডিংটায় ভূতের মতো চুপচাপ রাত কাটানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সিকিউরিটি আছে একজন অবশ্য, নাম হরিপদ। সেও বোধহয় এতক্ষনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে লোহার গেট বন্ধ করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। নিচের থেকে হিন্দী গানের একটা কলি ভেসে আসছে যেন। হরিপদ বোধহয় রেডিও চালিয়েছে। গুনগুন করে সেই সুরটা ভাঁজতে ভাঁজতে প্রবাহ সোফার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। পশ্চিমের এই ঘরটা খুব একটা বড় না হলেও বেশ আরামদায়ক। দক্ষিণ আর পূর্ব দিকে একটা করে জানলা, কোণের  দিকে একটা টেবিল, ডান পাশে একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর খানকতক অফিসের কিছু জার্নাল, ম্যাগাজিন, একটা পেন স্ট্যান্ড আর একটা টেবিল ক্যালেণ্ডার। ঘরের পশ্চিম দেওয়াল ঘেঁষে একটা সুদৃশ্য মেহগনী রঙের এলাহী সোফা যার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে প্রবাহ একটার পর একটা ধোঁয়ার রিং ছাড়তে থাকে। এই ঘরটা আগে সিনিয়র অপারেশন ম্যানেজারের ঘর ছিল। তিনি দুতলায় শিফট হয়ে যাওয়াতে এখন টুকটাক অবসর কাজের জন্যই এটা ব্যবহৃত হয়। প্রবাহর কাছে অবশ্য অফিসে রাত কাটানোটা নতুন কিছু নয়। প্রোডাকশন হাউজ হওয়ার দরুন এডিটিংয়ের কাজে মাঝেমাঝেই টিমের প্রায় সকলকেই এখানে থাকতে হয়েছে কোনো না কোনো সময়ে। তবে তফাতের মধ্যে আজ শুধু প্রবাহকে একা থাকতে হচ্ছে। সেটাও হতো না যদি না কাল সকাল সকাল বেরোনোর ঝঞ্ঝাট থাকতো।

হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচটা নিভিয়ে দেয় প্রবাহ। উইন্ডো এসিটাকে বাইশ ডিগ্রিতে সেট করে নিজের ফোনটা বের করে আনে। এখন সবে সাড়ে বারোটা। রাস্তা থেকে কোনো এক গাড়ির হেডলাইটের আলো, জানলার মসৃন কাঁচ ছুঁয়ে ঘরের দেওয়াল বেয়ে মিলিয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টিটা বোধহয় সামান্য ধরেছে। যতক্ষণ না ঘুম আসে ততক্ষন একটা সিনেমা দেখার প্ল্যান করে নেয় সে।

ফোনের স্ক্রিনে হাত দিতেই ফোনটা তীক্ষ্ন সুরে বেজে ওঠে। স্ক্রিনের আলোয় দপদপ করছে দীপ্তদার নাম। কি আশ্চর্য এতো রাত্রে ? উঠে বসে প্রবাহ। বোধহয় খোঁজ নিতেই ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে ফোনটা কানের কাছে ধরতেই ওদিক থেকে দীপ্তদার গলা পাওয়া যায়।

- কিরে, কাঁচা ঘুম ভাঙালাম নাকি ?
- না না, ঘুমোইনি, বলো.....
- তিনতলার অফিসে আছিস তো ?
- হ্যাঁ, ওখানেই.....কেন ?
- আমি আসছি দু মিনিটে.....মোড়ের মাথায় সিগারেট কিনছি.....
- সেকি ? এতো রাত্রে ? মানে তুমি, কিভাবে....... !!
- বলছি বলছি....এসে সব বলছি.....

দীপ্ত একই অফিসের কর্মী। প্রবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। একটা আনন্দ ও অবিশ্বাস মিশ্রিত ঢেউ খেলে যায় মনের মধ্যে। কতকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন। যাক ! এখন এই বিভীষিকার মধ্যে আর একা থাকতে হবে না। তড়িঘড়ি বলে, 'আচ্ছা, এসো এসো..... আমি হরিপদকে বলছি গেটটা খুলে দিতে '।
- তার দরকার নেই, হরিপদকে ফোন করা হয়ে গেছে আমার, তুই বরং ফ্লোরের দরজাটা খুলে রাখ।  
- আচ্ছা বেশ.....

প্রবাহ ঘর থেকে বেরিয়ে তিনতলার দরজাটা খুলে দেয়। কিছুক্ষন বাদেই জুতোর মশমশ শব্দ করতে করতে দীপ্ত উঠে আসে ওপরে। ঘরে এসেই একগাল হাসি দিয়ে বলে, 'কিরে, কেমন সারপ্রাইজ দিলুম বল' ? প্রবাহ হৈ হৈ করে ওঠে, উচ্চস্বরে বলে, 'ওয়েলকাম ওয়েলকাম। এ যে একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটিয়ে দিলে তুমি ! এটা কি করে সম্ভব হল' ? জল ঝাড়তে ঝাড়তে ছাতাটা এককোণে রাখে দীপ্ত। তারপর ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি ঝুলিয়ে বলে, 'বলছি বলছি, খাওয়া দাওয়া করেছিস তো' ? 'হ্যাঁ হ্যাঁ সেসব করে নিয়েছি অনেক্ষণ, তুমি বলো, হঠাৎ এখানে কিভাবে, কি করে' ? প্রবাহর আর তর সয় না। দীপ্ত চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে। ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, 'আর বলিস কেন, বাড়ি ফিরে দেখি তোর বৌদি মুখটা এত্তবড় হাঁড়ি করে বসে আছে'। জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ব্যাপার, এমন মুড্ অফ কেন ? কিছু হয়েছে ? তা সে বললে আমি নাকি কথা দিয়েছিলুম আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব, একসাথে সিনেমা দেখব, আমি নাকি কথার খেলাপ করেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি...... আরেবাবা, বৃষ্টি কি আর আগাম নোটিশ পাঠিয়ে কলকাতার বুকে ঝরে পড়বে, নাকি আমি হাত গুনে বলে দিতে পারব যে আজ আকাশের পরিস্থিতি কেমন থাকবে' ?

প্রবাহ হাহা করে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করে, 'তারপর' ? 

- তারপর আর কি, যতই বোঝাতে যাই আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি, ততই সে ইনিয়ে বিনিয়ে নানারকম ফিরিস্তি দিয়ে প্রমান করতে থাকে আমি নাকি এক কথার মানুষ নই, আমি যেন ইচ্ছে করেই এসব ষড়যন্ত্র করি, আড্ডা মারা নাকি আমার বেসিক ট্রেটের মধ্যে পরে, সমস্তটাই আমার কারসাজি, অমুক তমুক..........'।
প্রবাহ কোনোক্রমে হাসি চেপে জিজ্ঞেস করে, 'আর তাই তুমি রাগ করে বেরিয়ে এলে, তাইতো' ?

- হ্যাঁ, আমিও দুত্তোর নিকুচি করেছে বলে চটপট জামাকাপড় গলিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। বেরিয়েই ভাবলুম, কোথায় যাই এতো রাত্রে, বেরিয়ে তো পড়েছি, কিন্তু এবার ? পরক্ষনেই তোর কথা মনে হলো, ভাবলুম তুই তো একাই আছিস, তোর সাথে গল্পটল্প করে দিব্যি সময় কেটে যাবেখন, তাই সটান ট্যাক্সি বুক করে চলে এলুম।
- বেশ বেশ, সে একরকম ভালোই করেছ তুমি। আমিও একা একা কি করব ভেবেই উঠতে পারছিলাম না, যাহোক তবু একটা গল্প করার লোক পাওয়া গেল।

দীপ্ত অমায়িক হাসে। ঘরের চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, 'অনেকদিন পর এই ঘরটায় আবার জমায়েত হওয়া গেল, কি বল' ?
- হ্যাঁ তো তো বটেই, শেষ যেবার ছিলাম আমরা, সেটাও তো প্রায় মাসতিনেক হয়ে গেল, তাই না ?.....
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস.....সেবার বেশ মজা হয়েছিল।

হঠাৎ করে দীপ্তর হাতের দিকে চোখ যায় প্রবাহর। নিরীক্ষণ করে বলে, 'আচ্ছা তোমার কনুইয়ের কাছটা অমন ফোলা লাগছে কেন গো, পড়েটড়ে গিয়েছিলে নাকি' ? আঙ্গুল উঁচিয়ে দীপ্তর হাতের দিকে দেখায় প্রবাহ। দীপ্ত সে দিকে তাকিয়ে হাতটাকে ভাঁজ করে বলে, 'হ্যাঁ রে, এই আসার সময়টাতেই তো। ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে অসাবধানে কনুইটা এমন জোর ঠুকে গেল দরজায়, কি বলব'।
'ওষুধ টষুধ দিয়েছো কিছু', প্রবাহ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, 'ইশশ ছড়েও তো গেছে কিছুটা, ডেটল নিয়ে আসি' ? দীপ্ত হাত নাড়িয়ে বলে, 'আরে দূর, সামান্য চোট, তার আবার ওষুধ ! ও একদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। বাদ দে তো, তার চেয়ে বল, কাল সুন্দরবনের প্রজেক্টে কি কি হচ্ছে'............ ?

বর্ষার রাতে দুজনের মধ্যে গল্প জমে ওঠে বেশ। একই বয়েসি না হলেও একই ডিপার্টমেন্ট হওয়ার দরুন বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে নানাবিধ আলোচনা চলতে থাকে। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষন পর দীপ্তর সম্বিৎ ফেরে। চমকে উঠে বলে, 'এই রে, অনেক বেজে গেল রে। ঘড়ির দিকে তো খেয়ালই করিনি। কাল সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে যে তোকে'। প্রবাহ ঘড়ির দিকে তাকায়। দুটো দশ। মাথা নেড়ে বলে, 'হ্যাঁ, তাইতো ! রাত হয়েছে ঢের, চলো এবার একটু চোখ বুজে নিই কিছুক্ষন'। দীপ্ত উঠে দাঁড়ায়, বাঁহাত থেকে ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখে, বলে, 'আমি একটু টয়লেট থেকে ঘুরে আসি। এসে একটা সুখটান দিয়ে তবেই ঘুমোবো। তুই দেরি করিসনা, ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে তো অনেকটা পথ পেরোতে হবে তোকে' । প্রবাহ আলতো হাসে, টেবিলের ওপর রাখা দীপ্তর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, 'দাদা তোমার ঘড়ির ডায়াল শেপটা কিন্তু দারুন, বেশ অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে, যতবার দেখি ততবারই মুগ্ধ হয়ে পড়ি'। দীপ্ত মুচকি হাসে, বলে, 'তাই বুঝি ? এইরকম ডায়াল তোর খুব পছন্দ না রে' ?

- ভীষণ !.....কোথা থেকে কিনেছিলে যেন ?
- কিনিনি তো ! মনে নেই ? একটা কর্পোরেটের জন্য জিঙ্গল লিখেছিলাম, তারাই গিফট করেছিল.....
- ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ ,মনে পড়েছে। আচ্ছা আমায় একদিন পড়তে দেবে ঘড়িটা ?
- বেশ তো, নিস্ বরং, চাইলে অবশ্য কালই পড়ে যেতে পারিস।
- একেবারে কালই !
- হ্যাঁ কালই .........পড়বি ?
- তোমার অসুবিধে হবে না ?
- বিন্দুমাত্র না....
- বেশ, তবে কালই ওটা পরে নতুন প্রজেক্টের কাজে যাব।

দীপ্ত মৃদু হেসে টয়লেটের দিকে চলে যায়। প্রবাহ ঘড়িটার দিকে ঠায় দেখতে থাকে। এই ঘড়িটার প্রশংসা আগেও অনেকবার করেছে প্রবাহ। ভেবেছিলো দেশপ্রিয় পার্কের নামী ব্র্যাণ্ডের দোকানটায় গিয়ে একটা ফ্যাশনেবল রিস্টওয়াচ কিনবে। বিভিন্ন কাজের চাপে ও সময়াভাবে যাওয়া হয় নি.......দীপ্তকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় প্রবাহ। এক কথাতেই ঘড়িটা পড়তে দিয়ে দিল। এমন প্রাণখোলা মানুষ আজকের দিনে বিরল। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে আপনিই চোখ লেগে আসে প্রবাহর।

পরদিন সকালবেলা মোবাইলে সাতটার এলার্মে ঘুম ভেঙে যায়। প্রবাহ চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে। ঘর ভর্তি রোদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই কোনোরকম। মোবাইলের ডানদিকের সরু বাটনটা টিপে এলার্ম বন্ধ করে। একটা বিরাট হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে। প্রথমেই দীপ্তর কথা মনে হয় তার। দীপ্ত ছিল বলে কাল রাতের অনেকটা সময় গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া গেছে। দীপ্তর আসার কারণটা মনে পড়তেই মনে মনে হাসি পায় প্রবাহর। পায়ে পায়ে দরজা খুলে পাশের ঘরে গিয়ে খোঁজ করে। ঘর খালি ! কি আশ্চর্য ! এতো সকালে গেল কোথায় ? তাহলে কি নিচের ফ্লোরের টয়লেটে ? নাকি হরিপদকে চায়ের কথা বলতে গেছে ?  নানারকম ভাবতে থাকে প্রবাহ। মনে মনে বলে, 'ভালোই করেছে বরং দীপ্তদা, সকাল সকাল চা টা পাওয়া গেলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে পারব। পৌনে আটটার মধ্যে বেরোতে হবে যে করে হোক। তার আগে বরং অফিসের সুকান্তদাকে একবার ফোন করে তাড়া দিতে হবে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে কিনা জেনে নিতে হবে।পৌনে আটটার মধ্যেই অফিসে চলে আসার কথা'। সোফায় এসে তাড়াতাড়ি নাম্বারটা বের ডায়াল করে প্রবাহ। ওদিক থেকে সুকান্তদার গলা পেতেই প্রবাহ জিজ্ঞেস করে, 'দাদা বেরিয়ে পড়েছ তো ? আমিও রেডি হচ্ছি এদিকে'।
সুকান্তদার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায় অন্যপ্রান্ত থেকে।  

- একটা খারাপ খবর আছে রে প্রবাহ.....
'খারাপ খবর' ! সুকান্তর গলার স্বরে চমকে ওঠে প্রবাহ, 'কি খবর দাদা' ?
- গতরাতে দীপ্তর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, রাস্তাতেই স্পট হয়ে..... 

চমকে ওঠে প্রবাহ। ক্ষনিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে বলে, 'কি যাতা বলছ ! দীপ্তদা তো কাল রাত থেকে আমার সাথেই আছে......'
- কিঃ !! তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে ? নাকি এখনো ঘুমের ঘোর কাটেনি ! কাল রাত থেকে আমরা কজন মিলে সমানে হাসপাতালে বসে রয়েছি। তুই অনেকটা দূরে আছিস বলেই আর ডাকিনি ইচ্ছে করে। 
- কি বলছ সুকান্তদা !! কিন্তু আমি আর দীপ্তদা যে অনেক রাত অবধি গল্পগুজব করে......... 

ওপ্রান্ত থেকে কথাটা শেষ করতে দেয় না সুকান্ত, বলে, 'প্রবাহ, আমার মনে হচ্ছে তুই বোধহয় স্বপ্নটপ্ন দেখেছিস কিছু। তুই একটু সামলে নে নিজেকে, আর আজকের ট্রিপটা ক্যানসেল কর। আমরা আছি হাসপাতালে, বডি ছাড়লে তোকে ফোন করছি'। ফোনটা কেটে যায়..... 

বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো বসে থাকে প্রবাহ। মাথার মধ্যে তোলপাড় চলতে থাকে। গতরাতের ঘটনা গুলো পরপর জলছবির মতো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মনে মনে বলে, 'এ কিছুতেই সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়। যার সাথে আড্ডা মেরে প্রায় গোটা রাত কাটিয়েছি, কিছুক্ষন আগে অবধি যে ওই সামনের চেয়ারটায় বসেছিল, এখন তার মৃত্যুসংবাদ কিভাবে আসা সম্ভব' ? অজান্তেই সর্বাঙ্গ ঘেমে নেয়ে ওঠে প্রবাহর। 

ঘরের ভিতর হরিপদ এসে দাঁড়ায় চা নিয়ে। প্রবাহকে দেখে বলে, 'ওহ, আপনি উঠে পড়েছেন ? ভালোই হয়েছে, এই নিন, চা টা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন ....... হরিপদর দিকে তাকিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে প্রবাহ, বলে, 'আচ্ছা হরিপদ, কাল রাতে দীপ্তদাকে তুমি গেট খুলে দিয়েছিলে না' ? 
অমন আচমকা প্রশ্নে হরিপদ ঘাবড়ে যায় খানিক। মিন মিন করে বলে, 'দীপ্তবাবু !! কাল, কখন?
- এই বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ.......
- কই না তো ? দীপ্তবাবু তো সেই নটা নাগাদ বের হলেন বাকিদের সাথে......তারপর তো......
- হ্যাঁ হ্যাঁ..... তারপর তো রাতের দিকে আবার এসেছিলো, আমায় ফোন করল, সারপ্রাইজ দিল.....তুমি তো নিচে ছিলে !!
- কিন্তু দাদা, দীপ্তবাবু তো আর আসেননি, আমি তো একটা অবধি জেগেই ছিলুম কাল, রেডিওতে গান শুনছিলুম তো.....
- কি আবোলতাবোল বকছ, ভালো করে মনে করে দেখো, দীপ্তদা তো তোমাকে ফোনও করেছিল...... 

'এ কি বলছেন দাদা' !, হরিপদ কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় প্রায়, 'এই তো.....এই তো দেখুন আমার ফোন, কই দীপ্তবাবু তো ফোন করেননি আমায়.....'

প্রবাহ ফোনটা নিয়ে পাগলের মতো কল হিস্ট্রি সার্চ করতে থাকে, কোত্থাও দীপ্তর নাম খুঁজে পায় না। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সোফার ওপর বসে পড়ে আবার। বিড়বিড় করে বলে, 'কিন্তু এতটা সময়, এতগুলো কথা, সেসব ধোঁয়ার মতো কি করে মিলিয়ে যেতে পারে' ? হরিপদ থতমত খেয়ে যায় বেশ, 'আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে দাদা, কিছু হয়েছে নাকি ? আপনি এমন করে.......'

হরিপদর কথায় আমল দেয় না প্রবাহ, অস্ফুটে বলে, 'আর.........আর সেই ঘড়িটা, যেটা দীপ্তদা আমাকে.........' বলতে বলতেই টেবিলের ওপর চোখ যায় তার। সকালের নরম রোদে ঘড়ির ডায়ালটা টলটলে হ্রদের জলের মতো চিকচিক করছে। যেন দীপ্তই তাকিয়ে আছে আর রহস্যের মর্মান্তিক পরিণতিতে তারিয়ে তারিয়ে হাসছে। বিমূঢ় বিস্ময়ে প্রবাহ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে।
শেষ উপহারের যন্ত্রনা মনের মধ্যে ঘনীভূত হতে থাকে গত রাত্রের মেঘের মতো............

বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories 

Monday, June 26, 2017

অনুপদ্য - ১৩

















#rainyday #brishtirkobita #bengalipoem #bengalipoetry

Sunday, June 25, 2017

ভগবান

মর্ত্যের প্রশস্ত মসৃণ পথে
ঈশ্বর, মানুষ চলে একসাথে
কোলাহলে মুখরিত ভক্তি উল্লাস
জাগ্রত মূর্তি অকূল বিশ্বাস
স্তুতিস্তবে মন্ত্র দেব অধিষ্ঠান
রথ চলে, সাথে চলে ভক্তের ভগবান।

চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব 














#rathayatra #ratha2017 #bengalipoems #bengalipoetries

Friday, June 16, 2017

স্মরণে

খবরের নিচে খবর চাপা পড়ে থাকে
জোনাকির আলোয় বেঁচে থাকে কিছু নাম
অকালের বৈশাখীতে ধুলো হয়ে গেছে যাঁরা
এ পৃথিবীতে, তাঁদের কতটুকুই বা দাম ?

ধূপের ধোঁয়ায় ভারী হয়ে আসে বুক
অতীত প্রহর হাতছানি দিয়ে ডাকে
ফ্রেমবন্দী ছবির কালযাপনের সুখ
নীরব মৃত্যু আর কেই বা মনে রাখে ?

বিন্যাস : নিজস্ব















#bengalipoems #bengalipoetry

Wednesday, May 17, 2017

সাপ্তাহিকী ২৭ # তুমি রবে নীরবে


- আমি বিয়ে করব না.......।

কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে অর্কর, মাথাটা ঈষৎ টলে যায় যেন। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন, তারপর ভুরু কুঁচকে ঝুঁকে আসে সামনে।

- তার মানে ?
- মানেটা যা বললাম, সেটাই.......
- তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি মারছো ?
- নাহ ! সত্যি বলছি.....

'এসবের অর্থ কি পাখি ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না' !!!  
অর্কর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। চোখে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে।

- তুমি বুঝবেও না........
- অদ্ভুত তো ! আমার সাথেই বিয়ে, আর আমিই বুঝব না ?

পাখি সে কথার কোনো উত্তর দেয় না। নির্লিপ্ত ভাবে কফিশপের জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে শুধু। তারাতলা-মাঝেরহাট ক্রসিং, অগণিত গাড়ি দুদিক দিয়ে অবিরাম ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। বুকের মধ্যে ঐরাবতের উন্মত্ততা টের পায় অর্ক।
 
- এক সেকেন্ড ! তোমায় কি কেউ কিছু বলেছে ?
- না....
- স্কুলে কিছু গোলমাল ?
- না....
- তবে ?

পাখি আবার চুপ করে যায়। মুখ নামিয়ে হলুদ ওড়নার খুঁটটা ধরে পেঁচাতে থাকে এক মনে। 

অর্কর সাথে দু বছর হলো বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। পাশাপাশি দুটো স্কুলে দুজনে শিক্ষকতা করে। একজনের বিজ্ঞান আর আরেকজনের ইতিহাস। অসম বিষয়ের মধ্যে রসায়ন জমতে সময় লাগেনি খুব একটা। টুকরো আলাপচারিতায় সমভাবাবেগ বয়ে গিয়েছিল দুজনেরই হৃদয় জুড়ে। ধীরে ধীরে সে আবেগের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে বিয়ের পিঁড়ির দিকে আরও ঘন হয়েছে। কোনো বাড়িতেই আপত্তি করেনি। বরং হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সবাই । বিয়ের দিন আর বেশি বাকি নেই। 

এহেন মোক্ষম সময় অর্ককে প্রায় মাঝসমুদ্রে ফেলে বেঁকে বসেছে পাখি। অর্ক অধৈর্য হয়ে ওঠে ভীষণ। মুখচোখ কঠিন হয়ে যায় তার।

- ওহ !! তুমি বুঝি অন্য কারোর প্রেমে পড়েছ ?
- এতো ঘন ঘন আমি প্রেমে পড়তে পারিনা তোমার মতো.....
- ঘন ঘন ? কি মুশকিল..... অনিন্দিতা তো এখন অতীত। সেটা তুমিও ভালো করে জানো। আর তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর শুধু তোমাকে নিয়েই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। সুতরাং...........কেন, অনিন্দিতা কি তোমাকে কিছু.......?

বেয়ারা এসে দুটো ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায়।

'নাহ....অনিন্দিতা কিছু বলেনি....... কেন ? তেমন বলার মতো কিছু ছিল বুঝি' ? ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিতে দিতে পাখির চোখে ব্যাঙ্গের ইঙ্গিত খেলে যায়।

- দ্যাখো পাখি, এবার কিন্তু ভীষণ বাড়াবাড়ি করছ, কি হয়েছে সেটা বলো, নচেৎ এক্ষুনি তোমার বাড়ি গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করব এই ব্যাপারে।

- আমার এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না, সেইটে জানাবো বলেই তোমায় ডেকেছি। 
- বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না মানে ??!! বিয়ের আবার এখন তখন কি !!!
- করতে ইচ্ছে করছে না, ব্যাস !

- আচ্ছা, তোমার কি মাথা খারাপ হলো? বিয়ের আর হপ্তাখানেক বাকি, কার্ড বিলি হয়ে গেছে। ডেকোরেটর, ক্যাটেরার সব বলা হয়ে গেছে, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাই জেনে গেছে, আর তুমি বলছ এখন বিয়ে করব না ??? !!

- ঠিক তাই....
- দ্যাখো, আমার কিন্তু ভীষণ টেনশন হচ্ছে ? সত্যি করে বলো প্লিজ, কি সমস্যা হয়েছে ?
- কিচ্ছু না....
- তোমার বাড়িতে কোনো .....?
- না, কিছু হয়নি.....
- আমার বাবা মা কি কিছু......
- নাহ ! কেউ কিচ্ছুটি বলেনি......
- তাহলে কারণটা কি ? সেটা তো বলবে ? যাই জিজ্ঞেস করছি সবেতেই না বলছ !

- এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
- আশ্চর্য ! যেখানে তোমার আমার দুজনের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে, সেখানে দুম করে তুমি একা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে !! কেন ?

- তার কারণ তুমি আমায় প্রপোজ করোনি..... !!

আশেপাশের লোকজন মাঝেমাঝেই আড়চোখে তাকাতে থাকে তাদের দিকে । 

অর্ক যেন খেই পায় না কোনো কিছুর। পাখি নানারকম বিদঘুটে আবদার করে এসেছে বটে এ যাবৎ, কিন্তু এটা যেন পুরনো সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে গেল। নিজেকে নিপীড়িত অসহায় মনে হতে থাকে অর্কর। পরিষ্কার করে মনে করতে পারে না যে এমন বিপাকে আগে কখনো পড়েছে কিনা। অপলক, ভাষাহীন দৃষ্টিতে অর্ক তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে। পাখির সারা মুখে কোথাও লেশমাত্র কৌতুকের চিহ্ন নেই, বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে যেন। সে দৃঢ়তার আলোকছটায় ধাঁধিয়ে যায় অর্ক।

- আজ, এইখানে, এই মুহূর্তে, প্রপোজ করো। তবেই বিয়ে.......নয়ত........ভালো করেই চেনো আমাকে......

অর্ক কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় প্রায়। হাত বাড়িয়ে পাখির হাত দুটো চেপে ধরার চেষ্টা করে।

- প্রপোজ করাটাই সবচেয়ে জরুরী হল তোমার কাছে, আর এতদিন যে এত মুহূর্ত একসাথে কাটালাম আমরা, একসাথে পথচলার অঙ্গীকার করলাম, তার কোনো মূল্য নেই বুঝি ? ভালোবাসি কথাটা ব্যবহার করতেই হবে ? একটা শব্দ তোমার কাছে এতো প্রয়োজনীয় ? এতো দামী ?

প্রত্যয়ী পাখির মুখাভাবে কোনোরকম পরিবর্তন হয় না। অর্ক কি করে জানবে পাখির শব্দহীন জগতে ওই একটা মাত্র শব্দ কত গুরুত্বপূর্ণ, কত দুর্মূল্য। ছোটবেলায় এক নির্মম পথ দুর্ঘটনায় মা বাবা হারানোর সাথে সাথে পাখি হারিয়ে ফেলে তার বাক্শক্তি ও শ্রবণ ক্ষমতাও। 

তারপর থেকে কাকাদের কাছেই সে মানুষ। নীরব সংগ্রামের সেই শুরু । ব্যক্তিগত যোগ্যতায় পড়াশোনা শেষ করে একটি মূক ও বধির স্কুলে সে চাকরি পায়। উপযুক্ত ভালোবাসার অভাব বোধ করেছে সে চিরটাকাল। 

অর্কর সাথে দেখা হয়ে তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে সে অনুরাগের সঞ্জীবনী। অর্ক উন্মাদের মতো ভালোবাসে তাকে, সে জানে। পাখির সাথে কথা বলার জন্য অর্ক শিখে নিয়েছিল মুখ ও বধিরের বিশেষ ভাষা। পরিণত যুবক যুবতীর মধ্যে শব্দ কবলিত ভাষা অন্তরায় হয় নি কখনো। ভালোবাসি বলতে হয়নি কাউকেই, বরং সময়ের স্বাভাবিক গতিতে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল পরিণয়ের পথে। 

তবু আজ পাখি চায় অর্ক প্রেম নিবেদন করুক, ভালোবাসি কথাটা কানে শুনতে না পেলেও সরাসরি চোখে দেখার তৃপ্তি থেকে সে কিছুতেই বঞ্চিত হবে না আজ। আর তাই অর্ককে ডেকে এনেছে সে। আঙুলের বিশেষ কায়দায় অর্ককে প্রশ্ন করে,     

- কি ?... প্রপোজ করবে ? নাকি.......

অর্ক থমকায় এক মুহূর্ত। চারপাশটা দেখে নেয় এক নজর। কেউ বিশেষ লক্ষ্য করছে না। স্মিত হেসে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে । হাঁটুমুড়ে বসে পড়ে পাখির পায়ের কাছে। চোখে চোখ রেখে দু হাতের আঙুলের ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলে অনুপম অভিব্যক্তি.........

'আমায় ক্ষমা কোরো, আমি এটুকু বলতে সামান্য দেরি করে ফেললাম। আমার অতীত ও বর্তমানে একটাই তফাৎ জানো....., একটায় তুমি ছিলেনা, আর অন্যটায় তুমি আছ। তোমার সান্নিধ্যে যে প্রগাঢ় শান্তি পেয়েছি, এই জীবনে আমার জন্য তা অনেকখানি। আমার সমস্ত সত্ত্বা ও আত্মার সাথে জড়িয়ে আছ শুধু তুমি, কারণ তোমাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি.............পাখি চৌধুরী, তুমি কি আমার চিরসাথী হবে' ? 

পাখির চোখ দিয়ে ফল্গুধারার মতো নেমে আসে আনন্দাশ্রু। দু হাতে সে মুখ ঢেকে নেয় তৎক্ষণাৎ।   
     
কফিশপের সমস্ত লোকজন, যাঁরা এ যাবৎ পাখি অর্কর মধ্যে অঙ্গুলিহেলনে বলা টুকরো কথাবার্তাগুলো না বোঝার ফলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, তারা অর্ককে হাঁটু মুড়ে বসতে দেখে ও পাখির অনুরূপ আবেগ আন্দাজ করে সোল্লাস করে ওঠেন। ঘর জুড়ে বয়ে যায় হর্ষধ্বনি ও হাততালির বন্যা। কেউ কেউ এসে পাখি আর অর্ককে শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়। কফিশপ থেকে কমপ্লিমেন্টারি কেকের ব্যবস্থা করা হয়। 

অর্ক আর পাখি কোনোদিকে খেয়াল করে না। দুজনে স্বপ্নাবিষ্টের মতো চেয়ে থাকে দুজনের দিকে। গোধূলির স্বর্ণালী আভা কাঁচের জানলা ভেদ করে টেবিল ছাপিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে যায় দুজনের চোখমুখ........লজ্জাবনত পাখি ধীরে ধীরে মিশে যায় অর্কর বুকে ।


অলংকরণ : অর্ণব দাশগুপ্ত 

 #bengalilovestories #bengalishortstories #bengaliromanticstories

Friday, May 5, 2017

অনুপদ্য - ১২

অবদমিত ইচ্ছেরা প্রতিশ্রুতি হারায়
শরীর জুড়ে বয়ে চলে কালবৈশাখী টান
অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজুক শহর বরং.....
বেপরোয়া সময়ে বাজুক দিনবদলের গান


ছবি : নিজস্ব 














#bengali #bengalipoems #bengalipoetries 

Saturday, April 29, 2017

এ মণিহার

স্রোতের অভিমুখে চলা এক আর স্রোতের বিপরীতে চলা আরেক। আমি সাধারণ, নির্ঝঞ্ঝাট, নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয় একজন। জলে নামতেই ভয় পাই, সাঁতরানো তো দূর। দশটা ছটা অফিস করি, সংসারের নিয়ম মেনে কিছু কাজ করি আবার কিছু করিও না। মাজি-মধ্যি এলার্জি হলে ঘাড় মুখ গুঁজে কলমের আঁচড় কাটতে থাকি। সে আঁচড়ের দাগে কখনো গল্প, কখনো কবিতা আবার কখনো ছাইপাঁশ তৈরী হয়। সেসব জড়ো করে লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে ফেসবুক ও ব্লগের দেওয়ালে পোস্টারের মতো সাঁটিয়ে দিই। গুণীজনরা সেসব পড়েন, ভালোবাসেন, সমালোচনা করেন, উৎসাহ দেন, কেউ বিরক্ত হন আবার কেউ এড়িয়ে যান। এহেন লোকের কাছে যদি ছোটবেলার স্কুল টিচারের মেসেজ আসে তবে ঘাবড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয় বৈকি। মনে হতে থাকে এইরে ! নীল ডাউন হবার মতো কিছু করলাম নাকি ? অবশ্য ওতে আমি ভয় পাইনা মোটে। ওসবে যথেচ্ছ অভিজ্ঞতা আছে আমার। শুধু বুড়ো বয়েসে লোকে পোলাপান বলে হাসবে, ওতেই যা এট্টু মানহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ফোন করে তিনি যা বললেন তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছের আবডালে উঠে স্থির হয়ে জিরোচ্ছিল বেশ কিছুক্ষন। খানকতক চড়াইপাখি বনবন করে ফ্যানের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার চারপাশে। দুচারবার বিষম খেয়ে বুঝতে পারলুম নবনালন্দার সুবর্ণজয়ন্তী ম্যাগাজিনে আমার "নব নালন্দা ডট ইস্কুল" লেখাটা চাইছেন।

কি আশ্চর্য !........ যে স্কুলের ম্যাগাজিন ছোটোর থেকে বরাবর হাতে নিয়ে পড়ার অভ্যেস ছিল সেই স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী প্রকাশনায় আমার লেখা ? বিশ্বাস হয়নি প্রথমটায়। সেজন্য অনিরুদ্ধ স্যারকে দুয়েকবার ফোন করে বিরক্তও করেছি। হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন সমস্ত কিছুর। হঠাৎ করে যেন কোনো এক নাম না জানা নদী কুলকুল করে বয়ে গিয়েছিলো বুকের মধ্যে দিয়ে। সেই জলের সুরে আমার আহ্লাদ, আনন্দ, নষ্টালজিয়া প্রভাত বীণার মতো বেজে উঠেছিল। অনুরণনে ছড়িয়ে পড়েছিল মুগ্ধতার বেরোখ উচ্ছাস। কেবলই মনে হয়েছিল, ছুটে যাই একবার, দেখা করে আসি সবার সাথে। ছোট ছোট কাঠের বেঞ্চিগুলোয় পিঠ ঠেকিয়ে আয়েস করে বসে গল্প জমাই। পাকেচক্রে কিছুতেই হয়ে উঠলো না, সেজন্য আমি আন্তরিক লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। প্রতিশ্রুতি রইল, একদিন প্রপার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে স্কুলে গিয়ে দেখা করে আসবো। আর অনিরুদ্ধ স্যারকে শুকনো ধন্যবাদ দেব না। আমার জীবনে অন্যতম আনন্দঘন মুহূর্তের কারণ আপনি, ঋণী হয়ে রইলাম চিরতরে..........। মাঝে মধ্যেই ফোন করে বিরক্ত করব আবার। সম্পাদক মণ্ডলীর সমস্ত আন্টি, স্যার এবং গোটা পরিচালন পর্ষদকে আমার আজানু প্রণাম ও অফুরান ভালোবাসা। 

পুনশ্চ : "নব নালন্দা ডট ইস্কুল" যদি কেউ পড়তে চান তাহলে আমার ব্লগের ডান দিকে 'জনপ্রিয় পোস্ট' কলামটির শীর্ষে দেখুন। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি এই লেখাটিতে এখনো পর্যন্ত প্রায় চারহাজার ভিউজ হয়েছে।
চিত্র : নিজস্ব 

চিত্র : নিজস্ব 

চিত্র : নিজস্ব 

#bengaliarticle #oldschool #schoolmemories #nostalgia #navanalanda #navanalandaalumni #schoolmagazine #goldenjubilee

Tuesday, April 18, 2017

সাপ্তাহিকী ২৬ # গুপ্তপ্রাণ


বিকেলের আলো নিভে গেছে অনেক্ষণ। দাওয়ার ওপর জামরুল গাছের ছায়ায় সন্ধ্যে নেমেছে। বাঁশ বেড়ার ওপার থেকে গুটিকয়েক বাড়ি থেকে বসন্তের হাওয়ায় শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে। 

পায়ে পায়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন ইন্দিরা। শাঁখের আওয়াজে হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন তুলসী মঞ্চের সামনেটায়। 

মাটির ওপর ধূপকাঠি পুঁতে হেঁটে হয়ে মাথা ঠেকালেন মঞ্চের কারুকাজ করা ধাপিতে। বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে আরেকদফা হাত জড়ো করলেন কপালে। 

অকস্মাৎ, সাঁৎ করে যেন একটা ছায়ামূর্তি সরে গেলো উঠোনের পশ্চিম দিকে। অন্ধকারে ঠাহর করতে পারলেন না ইন্দিরা। 

তবু অভ্যাসবশে হাঁক পেড়ে বললেন, 'কে এলি ? বিশু নাকি' ? যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে জিভ কেটে প্রকট হল আলোয়।

ইন্দিরা তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, 'আচ্ছা বিশু, কতবার তোকে বলেছি যে এমন ভর সন্ধেবেলা গেরস্থের বাড়ি পা টিপে টিপে ঢুকবি নে, তাও আবার পশ্চিমের পাঁচিল টপকে। কথা কিছুতেই কানে যায়না দেখি তোর' !! 

বিশু অত্যন্ত কুন্ঠিত হয়ে জবাব দিল, 'আজ্ঞে মাঠাকরুণ, পত্যেকবার ভুল হয়ে যায়, এতোদিনকার অভ্যেস তো, কিচ্ছুতে মনে থাকে না'।

- 'হুঁ, তোর ভুলের ঠেলায় বাড়ির একটা অকল্যাণ হোক আর কি, তাই কি চাস তুই' ?

বিশু একথায় প্রায় মাটিতে মিশে যায়, একহাত জিভ বার করে বলে, 'ছি ছি মাঠাকরুন, অকল্যাণ আপনার হতে যাবে কেন, হোক আপনার শত্তুরের। তাছাড়া আমি থাকতে কেউ সাহস করুক তো দেখি' ! 

বিশুর ডেঁপমি দেখে হেসে ফেলেন ইন্দিরা, বলেন, 'ওই তো তোর সিড়িঙ্গেপানা চেহারা, তুই কোন কাজে লাগবি আমার ? তোর যত বাতেলা ওই মুখেই.......'

সেকথায় বিশু গলার তেজ চড়িয়ে বলে, 'মাঠাকরুণ, আমার বাপ ছিল হারু ডাকাত। বাবার ভয়ে তাবড় জমিদাররা ভয়ে জুজু হয়ে থাকতো, এক হাঁকে সাতগাঁয়ের লেঠেলদের মুখের রক্ত সরে যেত। মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে, কপালে শ্মশান কালীর তিলক লাগিয়ে যখন ওই পাহাড়ের মতো শরীরটা নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতো, ভয়ে মুচ্ছ যেতে দেখেছি অনেককেই। আমি সেই হারু ডাকাতের ছেলে, চেহারাটা না থাকলে কি হবে, শরীরে তেনার রক্তই তো বইছে। 

ইন্দিরা বললেন, 'সে নাহয় বুঝলুম, তা তুই ওমনধারা কাজ করিস কেন বাপু ? যার বাপ নামকরা ডাকাত ছিল সে এমন রাত বিরেতে ছিঁচকে চুরি করতে বেরোয় কেন বল দিকি ? এতে কি তোর বাপের মান থাকে' ?

ইন্দিরার কটাক্ষে বিশু মিইয়ে যায় খানিক। 

আমতা আমতা করে বলে, 'আজ্ঞে, সবই তো জানেন মা, উনি সেই যে নিঁখোজ হলেন তারপর তো দলটাই ভেঙে গেলো। যে যার মতো ছিটকে গেল এদিক ওদিক। দু চারটেকে পুলিশ পাকড়াও করলে আর পাড়ার লোকে আমাকে দূর করে দিলে আমার ভিটে থেকে। কাজের চেষ্টা করেছিলুম দিনকতক কিন্তু নামের জন্য কেউ আমায় রাখতে চাইলে না। কি করব মা, পেটটা তো চালাতে হবে, তাই আর উপায় না দেখে এই কাজে নেমে পড়লুম'। 

'তা এইসব করে চলে যায় তোর' ? ইন্দিরা কোমল স্বরে জানতে চান।

- রোজ কি আর চলে মাঠাকরুণ, বড় হাত আর মারতে পারি কই, সবাই সেয়ানা হয়ে গেছে, এমন এমন জায়গায় মালপত্র লুকিয়ে রাখে ঘরের মাছি পর্যন্ত জানতে পারেনা। আমি তো কোন ছার। তাছাড়া ধরা পড়লে হাটুরে ঠ্যাঙানি তো আছেই। এই তো গেলো বিষ্যুৎবার, তপেন স্যাঁকরার টেবিলের ওপর থেকে একশো টাকার নোটটা প্রায় নিয়ে ফেলেছিলুম জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে। তাড়াহুড়োয় হাতটা বের করতে গিয়ে ঠক করে লেগে গেলো গরাদে। অমনি তপেন কোথা থেকে এসে খপ আমার হাতটা ধরে এক পেল্লায় গাঁট্টা মেরে আমার বহ্মতালু গরম করে দিলে একেবারে ! বলি, তোর তো স্যাঁকরার ব্যবসা, অমন একটা একশো টাকার নোটের জন্য এই ডাকাত সন্তানের গায়ে হাত তুললি ? ধম্মে সইবে তো তোর' ?

ইন্দিরা বিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন। নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। মেধাবী ছাত্র, কলেজ শেষ করে সেই যে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলো আজ দশ বচ্ছর হয়ে গেছে সে গ্রামের মাটিতে পা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। সময়ের শরীর বেয়ে স্মৃতিটুকু লেপ্টে থাকে শুধু, যোগাযোগের সূত্রটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। তবু স্নেহের আঁচলের ঘের কম পড়েনি ইন্দিরার। বিশুকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন। সময় অসময় বিশুর সাথেই গালগল্প করে দিন কাটে তাঁর। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশুকে জিজ্ঞেস করেন, 'খেয়েছিস কিছু ? মুড়ি খাবি চাট্টি' ? 

বিশু গদগদ হয়ে বলে, 'তা আপনি দিলে কি আর আপত্তি করতে হয় মাঠাকরুণ, তবে কিনা দুটো লঙ্কা আর পেঁয়াজ দেবেন সাথে, মুখটা ছেড়ে যায় তাহলে'। 

স্মিত হেসে হেঁসেলের দিকে পা বাড়ান ইন্দিরা। মৃদু হাওয়ায় বিশু আয়েস করে বসে উঠোনের একপাশে।

হঠাৎ রে রে করে চারজন ষণ্ডামার্ক লোক ঢুকে পড়ে বেড়ার দরজা খুলে। বিশু ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। 

সবারই প্রায় পেটানো চেহারা। চোখে মুখে আগুন জ্বলছে যেন। কোমরে গোঁজা ছুঁচোলো অস্ত্রের বাঁটগুলো জামার আড়াল থেকে উঁকি মারছে। এছাড়া হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আছে লাঠি, দা, কোদাল। উঠোনের মাঝবরাবর এসে চারজনেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিশুর দিকে। 

তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বিশুর কাঁধে হাত রেখে আগুনদৃষ্টি হেনে বলে, 'কি রে.....চিনতে পারছিস' ? 

বিশু থতমত খায় খানিক। তারপর ভালো করে ঠাহর করে বলে, 'মনোহর দাদা না' ? 

পাকানো গোঁফের নিচে এক ঝলক হাসি খেলে যায় মনোহরের ঠোঁট ঘেঁষে। বলে, 'চিনেছিস তাহলে ?

- কি যে বলো ! বাবার ডান হাত ছিলে যে তুমি, আর তোমায় চিনব না গো ?

- তা ভালো, তাহলে তো সুবিধেই হল.......

বলেই মনোহর আড়চোখে তাকিয়ে নেয় তার বাকি সঙ্গীদের দিকে। 

বিশু মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে, কিসের সুবিধে' ? 

মনোহর ফিসফিস করে বলে, 'বুড়ি কি ঘরের ভেতর নাকি' ?

-কে ? মাঠাকরুন ? হ্যাঁ তিনি তো ঘরের ভিতরেই আছেন, আমার জন্য মুড়ি আনতে গেছেন কিনা........

একথায় হো হো করে হেসে ওঠে মনোহর ও তার সাগরেদরা।

- এক্কেবারে মা ছেলের সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েচিস দেখছি, হ্যাঁ ?....ভালো ভালো, তোর বুদ্ধির তারিফ করতে হয় রে বিশু ।

মনোহরের কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না বিশু, বোকার মতো মুখের দিকে চেয়ে থাকে। 

মনোহর আবার বলে ওঠে, 'শোন, ওই তুলসী মঞ্চের তলায় যে হারু কাকা ঘড়া পুঁতে গেছে সে খবর আমরাও পেয়েচি, বুঝলি ? তাই পুরো মালটা একা হাতাবি সেটা মোটেও ভাবিস না'। 

বিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, 'তুলসী মঞ্চ !! ঘড়া !! কি বলছ মনোহর দাদা......আমি তো কিছুই.......'। 

বিশুকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে মনোহর কর্কশ গলায় বলে ওঠে, 'ন্যাকা সাজিস নে বিশে, হারু কাকা নিরুদ্দেশ হবার আগে ওখানে যে ঘড়াটা পুঁতে রেখেছিলো সেইটে নিতে এসেছি আজ। ওতে আমাদের সকলের হিস্সা আছে, এটা ভালো করে বুঝে নে, নাহলে...........'।

'কার সাথে কথা বলছিস বিশু ? কে এসেছে রে' ? ইন্দিরা মুড়ির বাটি নিয়ে বাইরে আসেন। 

উঠোনের মাঝখানে কজন ভীমকায় পুরুষ দেখে কাঠ হয়ে যান এক লহমায়। ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'কে তোমরা বাছা, বলা নেই কওয়া নেই একেবারে দোর খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েছ' ? 

'আমরা আমাদের জিনিস নিতে এসেছি, পেয়ে গেলেই চলে যাবো', ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় মনোহর।

ইন্দিরা সে রক্তবর্ণ চোখের দিকে তাকাতে পারে না, বিশুর দিকে ফিরে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করেন, 'ও কি বলছে বিশু ? কে ও ? তুই চিনিস নাকি' ? 

বিশু বলে, 'আজ্ঞে, ও মনোহর দাদা, বাবার দলে ছিল। বলছে বাবা নাকি ওই তুলসী মঞ্চের নিচে কি একটা ঘড়া পুঁতে রেখেছিল, সেইটে নিতে এসেছে'। 

ইন্দিরা ভারী অবাক হয়ে বলেন, 'তুলসী মঞ্চের নিচে ঘড়া ? হারু পুঁতেছে ? কি বাজে বকছিস, তেমন হলে আমি জানব না ? আর তাছাড়া এ কবেকার তুলসী মঞ্চ, শুধু হারু কেন, কাউকেই আমি ছুঁতে দিইনি কখনো' ? 

মনোহর ইন্দিরার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, 'বাজে আমরা বকচিনে মাসিমা, সমস্ত খবর নিয়ে তবে এসেচি, তাছাড়া বিশু তো সবই জানে, কিরে বিশু ?

- আ-আমি কিন্তু সত্যি জানিনা মনোহর দাদা যে বাবা এখানে কিছু পুঁতে রেখে গেছে কিনা........

- তাই নাকি ! বেশ, তবে আর তোর জেনে কাজ নেই, এখনই তুলসী মঞ্চ ভেঙে ঘড়া তুলে নিয়ে চলে যাবো, তাহলেই সব জানতে পারবি।

ইন্দিরা মুড়ির বাটিটা ঠক করে দাওয়ায় নামিয়ে রেখে মনোহরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। 

চোখে চোখ রেখে বললেন, 'সেইটে হচ্ছে না বাপু, ওই তুলসী গাছ আমি নিজের হাতে পুঁতেছি এককালে, ও গাছ আমি উপড়াতে দেব না'। 

মনোহর দাঁত কিড়মিড় করে বলে, 'বটে ! তা কে আটকাবে শুনি ? আপনি ?

বিশু বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসে সামনে, ইন্দিরাকে আড়াল করে গম্ভীর গলায় বলে, 'না.........আমি' ?

একথায় মনোহরের দলবল অট্টহাস্য করে ওঠে। 

মনোহর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 'তাহলে বুড়িকে মেরে পুরোটাই একা হাপিস করবি ভাবচিস, তাই তো' ?

বিশু আচমকা কোথা থেকে যেন জোর পায়, হুঙ্কার দিয়ে বলে, 'উনি আমার মায়ের মতো, ওনার গায়ে হাত লাগাতে দেব না আমি, এই কথাটা ভালো করে বুঝে নাও মনোহর দাদা। উনি যখন বলচেন এখানে ঘড়া নেই, তাহলে সত্যিই নেই। মানে মানে তফাৎ হয়ে যাও, নাহলে ভালো হবে না কিন্তু........'। 

মনোহর আর সামলাতে পারেনা নিজেকে, হাতের লাঠিটা দিয়ে সজোরে চালিয়ে দেয় বিশুর মাথা লক্ষ্য করে। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় মাথা সরিয়ে সে লাঠির ধাক্কা এড়ায় বিশু,পরক্ষনেই বেড়ার ধার থেকে একটা মাঝারি মাপের মোটা বাঁশ নিয়ে চড়াও হয়ে যায় মনোহরের ওপর। 

দলের বাকিরা বিশুকে ঘিরে ধরে। ইন্দিরা ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বিশুর নিপুণ লাঠি চালনায় দুজন ঘায়েল হয়ে পড়ে খুব শীঘ্রই। বাকি দুজনের সাথে চরম লড়াই হতে থাকে। 

হঠাৎই তীব্র বেগে মনোহরের লাঠি বিশুর পাঁজরে আছড়ে পড়ে। বিশু যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে, টলমল করতে করতে জমির ওপর বসে পড়ে পাঁজরে হাত দিয়ে। কালক্ষেপ না করে মনোহর লাঠি ঘুরিয়ে বিশুর মাথায় মোক্ষম আঘাত করতে যায়। ইন্দিরা চিৎকার করে ছুটে এসে জাপ্টে ধরেন বিশুকে। 

মনোহরের লাঠি অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ইন্দিরার কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। মাথায় হাত দিয়ে উঠোনের ওপর লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা। বিশু আর্তনাদ করে ওঠে। হাতের বাঁশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে এসে ধরে ফেলে ইন্দিরাকে। 

ইন্দিরার কপাল বেয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকে। বিশু কোনোরকমে ধরাধরি করে দাওয়ার ওপর ইন্দিরাকে উঠিয়ে বসায়। 

মনোহর বজ্রকঠিন স্বরে বলে, 'লাঠিতে হাত পাকিয়েছিস বলে ভাবিস না মনোহরকে মাত দিবি। ওখানেই চুপ করে বোস, এর যদি অন্যথা হয়েছে তবে আর লাঠি নয়, এই ভোজালি দিয়ে তোর গলার নলিটা কেটে দিয়ে যাব'। 

বিশু বশ্যতা স্বীকার করে, দ্বিতীয়বার আর কোনো কথা বলে না। 

কাঁপা কাঁপা হাতে ইন্দিরার শুশ্রষা করতে থাকে। মনোহর চোখের ইশারায় তার সাগরেদদের তুলসী মঞ্চের দিকে দেখায়। বিনা বাক্যব্যয়ে বাকি তিনজন চটপট খুঁড়তে শুরু করে। 

বেশ খানিক্ষন খোঁড়ার পর হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ হয়। সবাই লুব্ধ দৃষ্টিতে যে যার মুখের দিকে তাকায়। বিশুও উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকে সেদিকে। মনোহরের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। 

নিজেই এগিয়ে এসে একজনের হাত থেকে কোদাল কেড়ে নিয়ে দ্বিগুন বেগে খুঁড়তে শুরু করে। কিছুটা খোঁড়ার পরই এক ভয়ার্ত শব্দ করে হাতের কোদাল ফেলে ছিটকে দুকদম পিছিয়ে আসে সে। 

পলকে বাকিদের মুখও ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে যায়। বিশু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, তুলসী মঞ্চের নিচের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। মাটির ভেতর থেকে উঁকি মারছে ফ্যাকাশে বিবর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া একটা আস্ত নরখুলি। তমসাচ্ছন্ন, ভয়াল তার চাহনি ! কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে অতীতের জমাট নিকষ কালো অন্ধকার যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চাইছে স্তব্ধ দর্শকের চোখ। 

মনোহর ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বার হয় না। 

ইন্দিরার দু গাল বেয়ে সরু জলের রেখা নেমে আসে। 

বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, 'কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত ছিল...........আমি রান্নাঘরে হাঁড়ি চাপিয়েছিলুম। এমন সময়ে উঠোনের কাছে ধড়াম করে একটা শব্দ হয়। আমি নিচে নেমে এসে দেখি হারু চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওই গোয়ালঘরের দিকটায়। ওকে দেখে আমি ছুটে যাই। পুলিশের গুলি লেগেছিলো বুকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল মাটি। বাঁচার আশা ছিল না। 

বদ্যি ডাকবো বলে চিৎকার করে উঠতেই হারু শক্ত করে আমার হাতদুটো ধরে মুখ ফুটে বলেছিলো, 'পুলিশের হাতে যেতে চাই নে রে ইন্দি.......... চিরকাল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েচি। মরার পর তারা আমার লাশ নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে, গর্ব করে বলবে হারু ডাকাতকে মেরেছে, তা যেন না হয়। তুই দেখিস। আর পারলে তোর এই উঠোনটায় আমার জন্য একটু জায়গা করে দিস, যেমন করে এতকাল.................বলেই শরীরটা একবার কেঁপে উঠেই নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিলো' ।

'আমি হারুর শেষ কথা রেখেছিলাম..........' , দুহাতে মুখ চেপে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন ইন্দিরা। অতীতের অব্যক্ত গ্লানি হু হু করে বেরিয়ে আসে তাঁর দুচোখ থেকে। 

সবাই নির্বাক শ্রোতার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নিমেষে থমথমে ভারি হয়ে যায় পরিবেশটা। মাথার ওপর দিয়ে করুণ রাতের কোনো পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়। ইন্দিরার অকপট বয়ানে মোহাচ্ছন্ন নিস্পন্দ বিশু অপলক চেয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে । 

বিহ্বলতার ঘোর কাটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখে ইন্দিরার, নরম স্বরে বলে, 'ঘরে চলুন মাঠাকরুন, অনেকটা কপাল কেটে গেছে আপনার........... রক্ত ঝরছে এখনো..............'    
 

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #saptahiki

Thursday, April 13, 2017

পয়লাবার

পয়লাবার যেদিন আমি স্কুলে
দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন লাগার ঘোর
একলা থাকার অভ্যাসটা ভুলে
প্রথম পাওয়া বৈশাখী এক ভোর।

পয়লাবার স্বাদ বসলো মুখে
হজমিগুলি বিটনুন সব কালো
মেঘলা দুপুর বিকেল আলোর সুখে
হাফপ্যান্টে কাটছিলো দিন ভালো।

পয়লাবার বৃষ্টিশহর বুক
ট্রামলাইন আর সিনেমা নাটক ভিড়
প্রথম দেখায় তুমি আমি চুপ
কালবৈশাখী সন্ধ্যারাগের মীড়।

পয়লাবার বিরহ বিষম জ্বালা
আটপৌড়ে নালিশ বাজে কানে
ছন্নছাড়া পায়ের মেপে চলা
রূপকথারা বিষাদ ডেকে আনে।

পয়লাবার পাশ ফিরল মন
বসন্তগানে কোকিল বসে দূর
শাস্ত্রমতে অমল আয়োজন
সাতপাকেতে সানাই সোহাগ সুর।

পয়লাবার পিতৃধর্ম পালন
স্কুল, কাছারি, সংসার, ডালভাত
নিয়মবাঁধা রুলটানা ক্ষণযাপন
পাহাড়, সমূদ্র, কদাচিৎ  দৈবাৎ।

পয়লাবার স্পষ্ট দেখছি আজ
বার্ধক্যের ঝাপসা ঘরের কোন
অতীত ঘেঁষা মুহূর্ত কোলাজ
একলা থাকার বৈশাখী স্পন্দন।

শহর, বাড়ি, জ্যোৎস্না ভরা রাত
নির্ঘুমজ্বর আঁকড়ে ধরে সব
পয়লাবার সুযোগ ছোঁয় হাত
পিছুটানের শৈশব কলরব।


চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব 
#poilabaisakh #bengalinewyear #bengali #bengalipoems #poetries

Wednesday, April 5, 2017

১ বছর

আজ একবছর পূর্ণ হল। দেখতে গেলে এই তো সেদিনের কথা মনে হয়। হ্যাঁ, তখন দু চার কলম পদ্য, কবিতা ও অন্যান্য অভিজ্ঞতার কথা লিখতুম বটে। যখন যেমন মনে আসতো.....গান লেখার ভারী শখ ছিল, লিখেওছিলুম খানকতক সেসময়। কিন্তু গল্প, প্রবন্ধ ? নাহ, সেসব লেখার কথা দুঃস্বপ্নেও মনে হয়নি কখনো। তবু কি করে যেন বসন্তের খেয়ালী হাওয়ার মতো আপনা আপনি কলম চলতে লাগলো। কখনো মৃদু গতিতে, কখনো কাঁচভাঙ্গা ঝড়ের দাপটে। কালির নদীপথ পেরিয়ে গল্পের মোহনা ছুঁয়ে কখন যে সাহিত্যের সমুদ্রে ঝাঁপ দিলুম মনে পড়ে না। হয়তো এর শিকড় খুঁজতে গেলে দেখা যাবে ৩০শে মার্চ ২০১৬য় এই কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনাই এর মূল কারণ। সেবার সংবাদ মাধ্যমের চ্যানেলে চ্যানেলে আমরা লাইভ দেখেছিলাম মৃত্যুর মিছিল, আর্তের হাহাকার, কংক্রিটের ছাদের তলায় প্রতি মিনিটে পিষে যাওয়া শেষ প্রাণটুকুর নিস্পন্দ আর্তনাদ। আর দেখেছিলাম উদ্ধারকার্যে দলে দলে বিবিধ মানুষের তৎপরতা, আগুপিছু না ভেবে পাথরের আড়াল থেকে খুঁজে বের করা প্রাণের শেষ আধার, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া হাতের দিকে জলের বোতল বাড়িয়ে দেওয়ার অন্তিম চেষ্টা। পোস্তা ব্রিজের ভগ্নাংশে তখন রাজদণ্ড সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক কষছে। প্রতিবাদের ঝঞ্ঝা বয়ে গিয়েছিলো শহরের বুকের ওপর দিয়ে। মনে হয়েছিল আমারও কিছু করা প্রয়োজন, যে করেই হোক যতটুকু সামর্থের মধ্যে পড়ে। সেই লিখতে শুরু করি। কিন্তু সে লেখা যে কখন চেতনার কানাগলি ছুঁয়ে গল্পের ছাঁচে গড়ে  উঠেছিল বুঝে উঠতে পারিনি। পুরোটা লেখার পর মনে হল, বেশ হয়েছে, এমনটাই তো চেয়েছিলুম। অস্ত্র নিয়ে ছুটে যেতে না পারি, বাকিদের সাথে বিদ্রোহের পতাকাটা তো চেপে ধরে রাখতে পারি। 

পোস্ট হল আমার প্রথম ছোট গল্প - "ফেরার' । অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম......... দাদা, দিদি ,বন্ধু, আত্মীয় পরিজন, ছোট, বড় সকলে প্রশংসা করেছিলেন। সাহস জুগিয়েছিলেন।
সেই শুরু................................................. 
'সাপ্তাহিকীর' হাত ধরে একে একে বের হতে থাকল 'টিকিট' ,'পয়লা দা', 'লাইন', 'কলরব' , 'একুশ টাকা ভাড়া' ,'আড়বাঁশি' প্রভৃতি। পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো কবিতা, অনুপদ্য, প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখা। পাশাপাশি ছিল পাঠকদের নিরন্তর ভালোবাসা ও উৎসাহ । ছোটগল্প - প্রবন্ধের সাথে তাঁরা যুক্ত হতে থাকলেন এক এক করে, নিজস্ব ভাবভঙ্গিতে জীবনের সাথে সংযোগ খুঁজে পেলেন অনেকেই । আমাকে মন খুলে বললেন সেকথা। নিয়মিত আসতে লাগলো তাঁদের মন্তব্য, প্রশ্ন, সঙ্গে বিভিন্ন গল্পের ঘটনা উল্লেখ করে তার দরদী বিশ্লেষণ। এক দৈব আনন্দে কানায় কানায় ভরে গিয়েছিলো হৃদয়। বন্ধুরা ভরসা দিলেন যেমন, অভিজ্ঞরা ছোটখাট ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে কলমের ভিতটাকে আরও মজবুত করে তুললেন। ক্রমে 'মলাট' নাম দিয়ে ব্লগ খুলে ফেললুম। কল্পনার ধোঁয়া উড়িয়ে হৈহৈ করে এগিয়ে চলল গল্পের রেলগাড়ি। এক একটা স্টেশন অতিক্রম করে আজ সর্বসাকুল্যে ২৫টা ছোটগল্প বিদ্যমান যার মধ্যে ৪টা সিরিজ 'মলাটের' পেজের ডান দিকে দিব্য জায়গাজুড়ে বসে আছে। এছাড়াও ২৪টা কবিতা, ১১টা অনুপদ্য ও ১৩টা প্রবন্ধ নিয়ে 'মলাটের' ভাঁজ আরও দৃঢ় হয়েছে। আজও দেরি হলে মেসেজ আসে, 'পরের সাপ্তাহিকীটা কবে আসছে' ? এই পরম পাওয়ার সত্যিই কোনো বিকল্প নেই।

এক বছর অনেকটা সময়। এই একবছরে পেয়েছিও অনেক, হারিয়েছিও বেশ কিছু। কিছু লিখতে পেরেছি কিছু ইচ্ছে করেই লিখিনি। এমন আনন্দঘন মুহূর্তে সে লাভ লোকসান বিচার করার সময় নয় হয়তো। তবু কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে, তবু কিছু ঋণ শোধ হয়না কখনো........ 
সময় এগিয়ে চলেছে........ আমিও........একবছর আগের ফেলে আসা দীর্ঘ ছায়ার অবয়ব দেখে আজ অবাক লাগে বৈকি........ 

ভালো থাকবেন সকলে................

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengaliarticles #experience #readers #bengaliwriteups #anniversary

Tuesday, March 28, 2017

দহন

তোমার চোখে বিষের আগুন
       তীব্র দহন জ্বালো
এড়িয়ে যাবে কার সে সাহস
        সর্বনাশের কালো

স্পর্শে বাতাস তপ্ত তোমার
   উষ্ণ আবেগ মেশে
যেমন করে রাত্রি নেভায়
     স্বর্ণাভ ভোর এসে

তেমন করে দাও কথা দাও
    পুড়িয়ে দেবে তুমি
আগুন যতই বিষাক্ত হোক
     পতঙ্গ হব আমি

বিন্যাস : নিজস্ব 






















#bengalipoems #darkpoem #poetry #love #romance


Tuesday, March 21, 2017

আজ কিন্তু বিশ্ব কবিতা দিবস - সুবোধ সরকার

কবিতা আবার কোন কাজে লাগে? কবিতার কোনও সেনসেক্স হয় না, কবিতার কোনও বাজার নেই। কবিতা কি এক ইঞ্চিও উপকার করতে পেরেছে মানুষের? জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ— এই তিনটি সময়ে তিনটি ল্যাটিন শ্লোক আর তিনটি সংস্কৃত পদ্য প্রয়োজন পড়ে বটে, তবে তার জন্য একটা বিশ্ব-কবিতা দিবস? ‘ইউনেস্কো’ যখন প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন এ ভাবেই প্রশ্ন উঠে এসেছিল কবিতার বিরুদ্ধে। আড়াই হাজার বছর আগে আরও মারাত্মক কথা উঠেছিল, কবিদের নির্বাসন দেওয়া হোক। যে প্রাচীন গ্রিসে কথাটা উঠেছিল, সেই গ্রিসই ছিল ইউরোপীয় কবিতার তলপেট।

একটা পেসমেকার যেমন কাজে লাগে, একটা হুইলচেয়ার যেমন কাজে লাগে, কবিতা কি তেমন কোনও কাজে লাগে? কবিতা লিখে তো কবিরা কিছুই পান না। টাকা নেই, পয়সা নেই, মান নেই, মর্যাদা নেই। এক ভাঁড় চা আর গলায় একটা ন্যাতা ছাড়া কবিদের কপালে কিছুই জোটে না। কবি-খ্যাতি? সে-ও তো আজ আছে, কাল নেই। তা হলে পৃথিবী জুড়ে পাঁচ শতাধিক ভাষায় কেন প্রতি দিন লেখা হয়ে চলেছে কবিতা? কবিতাই কি মনুষ্য প্রজাতির আদিমতম ও আধুনিকতম শিল্প যা মুদ্রাকে, টাকাকে, ক্যাপিটালকে তাচ্ছিল্য করে এল নিঃশব্দের তর্জনি দিয়ে?

আলাবামায় পিটার বললেন— গত দশ বছর আগে আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম কালো মানুষের সুবিচার চেয়ে। তার পিছনে ছিল একটি কবিতা, মায়া এঞ্জেলু-র ‘হোয়াই দ্য কেজেড বার্ড সিঙ্গস।’ সান্তিয়াগোর রাস্তায় যেমন এক দিন পাবলো নেরুদার কবিতা শুনে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, ধর্মতলার মোড়ে যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায় শুনে পদাতিক হয়েছিল, তেমনই ‘বিদ্রোহী’ শুনে রক্ত গরম হয়নি এ রকম কোনও বাঙালি ছিল না পরাধীন ভারতে। চারশো বছর আগে শূদ্র কবি তুকারামকে খুন করেছিল মরাঠি ব্রাহ্মণেরা। তাঁর কবিতা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাণ্ডুলিপি জলে ফেলে দিলেই কি কবিতা ডুবে যায়? সারা ভারতে যে গরিব মানুষ, দলিত মানুষ উঠে এসেছেন, তার পিছনে কি তুকারামের কবিতা নেই? হার্লেম রেনেসাঁসের সময় কি ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা আগুন দেয়নি?

ছবি : আনন্দবাজার পত্রিকা 
জীবনানন্দ দাশ (ছবিতে) লিখেছিলেন ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।’ তখন পৃথিবী জুড়ে দার্শনিক থিয়োডর অ্যাডোর্নোর কথা হেডলাইন হয়ে উঠে এসেছিল। ‘আউশভিৎস-এর পর আর কবিতা লেখা সম্ভব নয়।’ গত ৬৮ বছরে কথাটি প্রায় সমস্ত কবি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু কবিতা লেখা আরও পাঁচগুণ বেড়েছে। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসুখের নাম ‘জেনোফোবিয়া’। তুমি কি আমার মতো দেখতে? তুমি কি আমার মতো কথা বলো? তুমি কি আমার মতো করে ধর্মাচরণ করো? উত্তর ‘না’ হলে আমি তোমাকে ঘৃণা করব। এই অসুখ আটলান্টিক টপকে ইউরোপ হয়ে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বা উলটোটা।

মাহমুদ দারউইশ প্যালেস্টাইনের কবি। তিনি ইজরায়েলে ঢুকতে পারতেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ণ হাইফেনের নাম প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল। তিনি সেই হাইফেন মাথা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেয়ে লিখলেন সেই কবিতা, ‘আমি এক জন আরব, আমার কার্ড নম্বর ৫০০০০, আমার চুল চারকোল, চোখ ব্রাউন, আমার আটটা ছেলেমেয়ে।’ তারপরই লিখলেন, ‘অলিভ গাছ যদি জানত তাকে কারা বড় করেছে, তা হলে অলিভ থেকে তেল বেরত না। বেরিয়ে আসত চোখের জল।’ ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইনের লেখক ওডেহর কাছে শুনেছি, এই কবিতা কত মানুষকে কথা বলতে শিখিয়েছে। আমরা তো বেশির ভাগ সময়ই কথা বলতে পারিনি। কবিতা তা হলে ভয়কে অতিক্রম করতে পারে? আতঙ্কের কাঁধে বসে কৌতুক করতে পারে ‘ইউএসএ/ হোয়্যার/ দ্য লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু।’

বেঙ্গালুরু থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার দূরে এক জন লেখককে বাড়ি ঢুকে গুলি করে গেল ওরা। বিচার হল কই? হল না বলেই তো আবার সেই কর্নাটকে অসহিষ্ণুতা রাস্তায় নেমে এল গত সপ্তাহে। লেখক যোগেশ নাকি ‘ভগবান গণেশ’কে খারাপ ভাবে দেখিয়েছেন, তাই তাঁর মুখে কালি দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চলে গেল সাত জন বাইক আরোহী।

কবিতা ফ্যাসিজমের সামনে উঠে দাঁড়িয়েছে বার বার। কিন্তু কবিতার ক’টা মাথা? দারউইশ বলছেন, কবিরা ভেবেছিলেন, কবিতা লিখে সমাজ পালটে দেবেন। দূর বোকা ছেলের দল। কবিতা লিখে কাউকে পালটানো যায় না। শুধু চোখের কোনায় একটা অশ্রুবিন্দুর অর্ধেক বেরিয়ে আসে। আর অর্ধেক থেকে যায়— দুই অর্ধেক নিয়ে মানবজাতির কবিতা। পাঁচ হাজার বছরের দুর্যোগ তাকে বিনাশ করতে পারেনি, জেনোফোবিয়া থেকে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তখনও এক জন উইলফ্রেড আওয়েন বুকপকেটে ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে যুদ্ধবিমানে উঠবেন।

সুন্দরবনের কালো মেয়েটি, কালচিনি চা বাগানের রোগা ছেলেটি যদি একটা কবিতা পড়ে উঠে দাঁড়ায়, তা হলেই কবিতা আরও পাঁচ হাজার বছর বাঁচবে। এখনও একটা কবিতা পেসমেকার, এখনও একটা কবিতা হুইলচেয়ার, এখনও একটা কবিতা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে থাকা প্রজাপতি, এখনও একটা কবিতা হলুদ লাগা মায়ের আঁচল।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ মার্চ , ২০১৭

 #anandabazarpatrika #article #worldpoetryday #bengaliarticles #jibananandadas #subodhsarkar #bengaliwriteups

Saturday, March 18, 2017

সূর্যতপা তুমি

কত শতাব্দী ধরে আকাশ মিশে গিয়েছে জলে
মেঘ জড়ো করে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ নেবে বলে
মরুপ্রান্তর থেকে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরে
আরব সাগর হতে সুগভীর পালামৌয়ের জঙ্গলে......
সূর্যতপা দেখেছি তোমায়, একবিংশ শতকের নারী
সূর্যতপা তোমায়, অল্প হলেও কি ভালোবাসতে পারি ?

তমসাবৃত, ছিন্নমুল আমি, সাধারন একজন
অট্টালিকা আকাশকুসুম, স্বল্প আয়, অল্প আয়োজন
আমার উঠোন ঘেরা ঘাসের ওপর বসত করে সুখ
পুকুরডোবা সূর্যালোকে দেখেছি তোমার আবিররাঙা মুখ
সূর্যতপা তুমি নভস্পর্শী, শত নক্ষত্রের সারি..........
সূর্যতপা তোমায়, অণুমাত্র কি ভালোবাসতে পারি ?


ছবি : গুগল 

#bengalipoetry #bengalipoems #love #romance