Thursday, March 16, 2017

সাপ্তাহিকী ২৫ # সুলভ ইন্টারন্যাশনাল

রমাপদ ভীষণ খাইতে ভালোবাসে। উৎকৃষ্ট মানের সুস্বাদু রান্না হইলে তাহার আর কিছুই লাগে না। খাবার সময় থালার পাশে চার পাঁচটি বাটি যদি না থাকে তাহা হইলে তাহার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সেদিন তাহার মনে হয় সে যেন আধপেটা খাইয়া রহিয়াছে। উত্তরোত্তর ক্ষুধা পাইতে থাকে তখন। তাহার সাধের ভুঁড়িটি গ্যাসহীন বেলুনের ন্যায় চুপসিয়া যায় যেন। এহেন রমাপদ ভদ্রেশ্বরে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছিলো। পরীক্ষার ছুটিতে তাহার স্ত্রী ও কন্যাকে যত্নসহকারে গ্যারেজ করিয়া চব্যচষ্য উদরস্থ করিয়া সে ফিরিয়া আসিতেছিল। কিয়দকাল একাকী থাকিবার প্রলোভনে রমাপদ বেশ ফুরফুরে মেজাজে ট্রেনে চাপিয়া বসিল।

ট্রেন ভদ্রেশ্বর স্টেশন ছাড়িয়া হাওড়া অভিমুখে যাত্রা আরম্ভ করিল। দুপুরের দিকে ভিড় কম থাকার দরুন রমাপদ খুব সহজেই জানলার সিট্ পাইয়া আরাম করিয়া পা মেলিয়া দিল। মনে মনে ভাবিল, প্রায় পৌনে একঘন্টা মতো লাগিবে পৌঁছাইতে, তাই দু চোখের পাতা এক করিয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতে পারিলে মন্দ হয় না। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বসন্তের মিঠে হাওয়ায় ও ট্রেনের যুগপৎ দুলুনিতে সবে নিদ্রার যোগ আসিতেছিল এমন সময় ভয়ঙ্কর রূপে রমাপদর পেট কামড়াইয়া উঠিল।

সে ধড়মড় করিয়া সোজা হইয়া বসিল। এমন তো হইবার কথা নহে। তাহা হইলে ব্যাপারখানা কি ? বলিতে না বলিতেই পুনরায় বিকট এক কামড়। নিমেষে রমাপদ ঘামিয়ে উঠিল। এ কামড় রমাপদ বিলক্ষণ চেনে। এ কোনো সাধারণ উদর পীড়া নহে। অম্বল, গ্যাস, চোঁয়া ঢেঁকুর, বুকজ্বালা কোনো প্রজাতির ব্যথার সহিত ইহার কোনোরূপ কোনোপ্রকারের মিল নাই। সকালবেলার এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে অনুরূপ ব্যাথা অনুভূত হয়। এবং সে ব্যাথা হইলেই রমাপদ বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করিতে পারে না। উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াইয়া, আট মিটারের দূরত্ব এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে অতিক্রম করিয়া এক ঝটকায় বাথরুম বন্ধ করিয়া সে কমোডের শূন্যস্থান পূরণে তৎপর হইয়া ওঠে।

তাহার পর সমস্ত ব্যাথা খালি হইলে পর সে প্রসন্নচিত্তে বাহির হইয়া আসে। কিন্তু এখন এই চলমান ট্রেনে সে কি করিবে ? কোথায় যাইবে ? কাহাকে বলিবে ? এই সমস্ত চিন্তা করিয়া ঘামিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। তাহার উপর লোকাল ট্রেন, টয়লেটের কোনোরকম বন্দোবস্ত নাই, সুতরাং রমাপদ যে নিশ্চিন্তে কাজ হাসিল করিয়া হালকা হইয়া চলিয়া আসিবে তেমন কোনো সম্ভাবনাও নাই। সেইটে চিন্তা করিয়া রমাপদ আরও মুষড়িয়া পড়িল। একবার ভাবিল সামনের স্টেশনে নামিয়া টয়লেট খুঁজিয়া লইবে। পরক্ষনেই ভাবিল একবার নামিয়ে পড়িলে পরের ট্রেন আসিতে প্রায় একঘন্টা লাগিবে, হাওড়া পৌঁছাইতে দেরি হইবে বিস্তর। তাহার চেয়ে কোনোরূপ পেট চাপিয়া ধরে পরপর স্টেশনগুলি পার করিতে পারিলে একেবারে হাওড়ায় গিয়াই কাজ সারিয়া লইবে।

সেইমতো কষ্ট করিয়া রমাপদ কিছু স্টেশন পার করিল। উপায়ন্তর না দেখিয়া অনিচ্ছাকৃতভাবে বার দুয়েক বায়ু নির্গমনও করিল। ছুটন্ত ট্রেনে ঝড়ের বেগে সে বায়ু ছড়াইয়া পড়িল দিগ্বিদিগ। সহযাত্রীরা চমকাইয়া উঠিয়া যে যার মতো রুমাল চাপিয়া ধরিল নাকে। রমাপদ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করিল না। দাঁতে দাঁত চাপিয়া যুদ্ধ জয়ের আশায় বসিয়া রহিল। কিন্তু প্রকৃতির ডাক বড় কঠিন ডাক। যতই বলিষ্ঠ মানুষ হোক না কেন সে নিশির ডাক উপেক্ষা করিবে এই ধরাধামে এরূপ দুঃসাহস দেখাইবার মতো মানুষ খুঁজিয়া পাওয়া দুস্কর। অতএব রমাপদর মতো সাধারণও নিজেকে বেশিক্ষণ ধরিয়া রাখিতে পারিল না। কোন্নগর আসিবার পূর্বেই সে চক্ষে সর্ষেফুল দেখিতে লাগিল।

স্টেশন আসিবামাত্র সে বিদ্যুৎবেগে ট্রেন থেকে নামিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ধাবমান হইল সম্মুখের দিকে। এক জিআরপিএফকে দেখিতে পাইয়া তাহাকে কাতর হইয়া বলিল, 'দাদা, স্টেশনের টয়লেটটা কোনদিকে বলুন, জলদি...... '। জিআরপিএফ রমাপদর দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি হানিয়া গম্ভীরস্বরে কহিল, 'স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে'। রমাপদ বেশি জোরে দৌড়াইতে পারিল না, তাও যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হাঁটিয়া, সিঁড়ি টপকাইয়া শৌচালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইল। কপাল খারাপ থাকিলে মানুষের যা যা ঘটিতে পারে রমাপদর ক্ষেত্রে তখন ঠিক তাহাই ঘটিল।

শৌচালয়ের গেটে একটি বড় তালা ঝুলিতেছে। তাহার মুখ শুকাইয়া পাংশু হইয়া গেল। এই করুণ অভিজ্ঞতা রমাপদর জীবনে খুব বেশি ঘটে নাই। সুতরাং তালা দেখিয়া তাহার একেবারে মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করিল। কারণ পেটের ভিতর ততক্ষণে উদ্দাম তাণ্ডবনৃত্য শুরু হইয়া গেছে। সুনামীর ঢেউয়ের ন্যায় সে মরণ বেগ তাহার উদরের ভিতর একের পর এক আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। সামান্য অসাবধানে এক বিরাট গোলযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা প্রবল হইয়া উঠিল। আশেপাশে খুঁজিয়াও যখন শৌচালয়ের কাহাকেও সে দেখিতে পাইল না তখন সে অনন্যোপায় হইয়া এক রিক্সাওয়ালাকে পাকড়াও করিল।

রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল, 'বাবু কোথায় যাবেন' ? রমাপদ মুখ দিয়া কোনো কথা কহিতে পারিল না, শুধু করুণভাবে ইশারায় শৌচালয়ের দিকে আঙ্গুল তুলিয়া দেখাইল। রিক্সাওয়ালা সেদিকে তাকাইয়া কহিল, 'কি মুস্কিল, তা ওখানে যেতে আমাকে টানছেন কেন ? এর জন্য আবার রিকশা করে নাকি কেউ' ? রিক্সাওয়ালার তাচ্ছিল্যে রমাপদ ভীষণ বিরক্ত হইয়া কিছু একটা বলিতে যাইতেছিলো। পরক্ষনেই পেট চাপিয়া ধরিয়া অস্ফুটে কহিল, 'ওখানে লোক কই, কখন খুলবে' ? রিক্সাওয়ালা সে বিপদভঞ্জন ঘরের দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল, 'ওহ, বন্ধ বুঝি ? ওর লোক তো খেতে গেছে, ঘন্টাখানেক বাদে আসবে'।

রমাপদর মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। প্রায় মাটিতে বসিয়া পড়িবার উপক্রম হইল, মিহিস্বরে কহিল, 'তাহলে' ? রিক্সাওয়ালা বলিল, 'আপনি এক কাজ করুন, প্ল্যাটফর্মে চলে যান, স্টেশনকর্মীদের একটা বাথরুম আছে। জিজ্ঞাসা করুন, বলে দেবে'। রমাপদ সেকথা শুনিয়া প্রায় হামাগুড়ি দিয়া প্ল্যাটফর্মে আসিয়া উপস্থিত হইল। সটান ঢুকিয়া পড়িল স্টেশনমাস্টারের রুমে। সম্মুখে এক ভদ্রলোককে দেখিতে পাইয়া বিকৃত মুখে কোনোরকমে কয়েকটা শব্দ বাহির করিল, 'দাদা, আপনাদের টয়লেটটা.........'

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকাইয়া চশমার ভিতর হইতে কহিলেন, 'টয়লেটটা কি' ? রমাপদ কোনোপ্রকার একপায়ের ওপর আরেক পা ভর দিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, 'একবার যাব.......'।

ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ মাছি তাড়াইবার মতো করিয়া হাত নাড়িয়া কহিলেন, 'না নাঃ, ও বাইরের লোকের জন্য নয়, আর তাছাড়া যাত্রীদের জন্য তো বাইরে শৌচালয় আছে, সেখানে যান'। রমাপদ বলিল, 'আজ্ঞে, সেইটে বন্ধ, এক্ষুনি ঘুরে এসেছি, দয়া করে যদি আপনাদের টয়লেটটা একবার.........'।

সেই ভদ্রলোক এবার মুখ না তুলিয়াই বলিলেন, 'বন্ধ থাকলে একটু ওয়েট করুন, খুললে যাবেন, আমাদেরটা ব্যবহার করা যাবে না, স্যরি'। একথায় রমাপদ একেবারে হাঁউমাঁউ করিয়া কাঁদিয়া পড়িল। সামনে আসিয়া ভদ্রলোকের হাত জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, 'স্যার, প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন, সেই শৌচালয় ঘন্টাখানেক বাদে খুলবে, কিন্তু ততক্ষণে আমার বাঁধের লকগেট খুলে গিয়ে সমস্ত কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে একেবারে তছনছ করে চলে যাবে। আপনি কি তাই চান' ? ভদ্রলোক তখনও না না করিতে লাগিলেন, রমাপদর কাকুতিমিনতি কর্ণপাত পর্যন্ত করিলেন না।

এইবার রমাপদ সম্পূর্ণ বেসামাল হইয়া গেল। সে আর ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে পারিল না, সমস্ত সাহস সঞ্চয় করিয়া, অকুতোভয় হইয়া কহিল, 'তবে আমি এই চেয়ারের ওপর বসলুম উবু হয়ে, আমি এইখানেই করব, আপনার যা করার করে নিন'। বলিয়াই সে অনতিদূরে একটি চেয়ারের নিকট নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলিতে লাগিল। ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করিয়া উঠিলেন, ভীষণ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বলিলেন, 'একি করছেন, একি করছেন, এটা তো অফিস ! আরে ওই চেয়ারটা যে বড়বাবুর......'। রমাপদ চোখ মুখ কুঁচকাইয়া কহিল, 'আমার আর কিচ্ছু করার নেই স্যার, বড়বাবুর জন্য নতুন চেয়ার আনিয়ে নেবেন'। 

ভদ্রলোক ত্বড়িৎগতিতে ড্রয়ার খুলিয়া চাবি বাহির করিয়া রমাপদর হাতে দিয়া বলিলেন, 'এই নিন, এই নিন, ডানদিকে ওই কোণের দরজাটা, সোজা চলে যান, কিন্তু এখানে প্লিজ না'। রমাপদ আর কালক্ষেপ করিল না। চাবিটা প্রায় ছিনিয়া লইয়া বিশেষ ঘরের অভিমুখে হনহন করিয়া হাঁটা লাগাইল। পশ্চাতে শুনিতে পাইল ভদ্রলোক বলিতেছেন, 'হয়ে গেলে জলটা ঠিক করে দেবেন কিন্তু..................' ।

রমাপদ দড়াম করিয়া দরজা বন্ধ করিল। নিদারুণ আতশবাজির শব্দে গোটা অফিস মুখরিত হইয়া উঠিল, বাহিরে স্টেশনে এনাউন্স হইল, 'দুনম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়ছে............'

অলংকরণ : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalifunnystories #saptahiki #sulabh     

Monday, March 13, 2017

এই বসন্তে

বসন্ত আজ দিয়েছে ডাক
কলরবে সব তফাত যাক
চল, আঁকাবাকা ওই পথের গলিতে ভিড় হয়ে যাই

হুল্লোড়ে আজ উঠুক তুফান
তোর আর আমার স্বপ্নের গান
গেয়ে যাব তবু ক্লান্ত যতই হোক না সবাই

চল, ফাগুন ওড়াই দুহাত দিয়ে
একতারাতে গান শুনিয়ে
তুষের আগুন জ্বলবে সেথায় নির্নিমেষ

রঙের খেলায় মাতব যত
রঙিন হবে হৃদয় তত
দোলের দিনে তোর্ সাথে হব নিরুদ্দেশ..............

ছবি : 'রামলীলা' পোস্টারের সৌজন্যে 

#bengalipoems #poetries #love #romance #dolyatra #holi #basantautsav

Thursday, March 9, 2017

সাপ্তাহিকী ২৪ # নারী কথা

- কিরে কাঁকন, আবার পড়তে বসেছিস বুঝি ? এই যে টিউশন পড়িয়ে এলি........বলিহারি.....
- হ্যাঁ গো মিতিনকাকী, সামনেই পরীক্ষা তো, একদম সময় নেই হাতে.......সন্ধের এই সময়টুকুই যা         পাই।
- ওওও......তা তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কিছু মনে করবিনে তো ?
- না না, বলো না........
- তোর স্কুলের সেই বান্ধবী, কি যেন নাম......হ্যাঁ মনে পড়েছে স্বপ্না। ওরই তো বিয়ে ছিল গত সপ্তাহে,        তাই না ?
- হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো, খুব মজা করেছি জানো......
- আর তোর কলেজের সেই মেয়েটি, দেবিকা, সেই যে রে খুব আসতো তোদের বাড়ি, ওর বিয়ে হয়ে গেছে ?
- হ্যাঁ, ওর তো গত বছরই বিয়ে হয়ে গেছে। মনে নেই বৌভাতের সেই গল্পটা শুনিয়েছিলাম।
- আচ্ছা, আরেকজন ছিল না, তোর সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়তো, খুব সুন্দরী, তারও কি বিয়ে হয়েছে ?
-  হ্যাঁ তো, ওর তো সেই কবে...... একটা মেয়েও হয়েছে। কিন্তু, হঠাৎ এদের কথা জিজ্ঞেস করছো যে ?
- কিছুই না, আসলে তোরও তো বিয়ের বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছে কিনা। তাও প্রায় ঊনত্রিশ হতে চলল, তাই না রে ?
- হ্যাঁ, কিন্তু আমার তো বিএড ফাইনাল আছে এখন। সামনের এসএসসিটা দিয়ে চাকরি পেয়ে তবে তো বিয়ে করব।
- সে নাহয় হলো, কিন্তু তাই বলে কি আর ভালো ভালো পাত্ররা হাঁ দাঁড়িয়ে থাকবে বল দেখি ? তুই কবে পাশ করবি, চাকরীর পরীক্ষা দিবি তারপর চাকরী করবি.......বেলা যে অনেক গড়িয়ে যাবে ততদিনে।
- গড়িয়ে গেলে গড়িয়ে যাক কাকী, কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপরই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেব, তার আগে নয়।
- কি জানি বাপু, তোদের রকম সকম বুঝি না, একেই এতো বয়েস হয়ে গেছে, ঊনত্রিশ পেড়িয়ে ত্রিশের কোঠায় যখন পড়বি তখন কে যে তোকে বিয়ে করবে বাপু কে জানে।
- কেউ বিয়ে না করলে না করবে, তাই বলে পড়াশোনাটা ছেড়ে দেব নাকি?
- শোনো মেয়ের কথা ! তা এতো দিনরাত পড়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জোগাড় করতে পারবি তো ? দেখিস তখন যেন হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসিস নে আবার।
- বেশ তো, তাতে তোমার কি সমস্যাটা হবে সেটা একটু বুঝিয়ে বলো দেখি আমায়।
- ট্যারা ট্যারা কথা চারটি বলতে শিখেছিস বটে। আমার আর কি, তোর বাড়ির পাশে থাকি, ছোটোর থেকে দেখে আসছি তোকে, তোর ভালো চাই তাই বললুম......নাহলে আমার আর কি দায় পড়েছে বল যে তোর মতো শিক্ষিত মেয়েকে বাড়ি বয়ে এসে চারটি ভালো উপদেশ দেব। আমরা কি আর তোদের মতো বিদ্বান রে ভাই ?
- আচ্ছা কাকী, ঝুমার তো খুব অল্প বয়েসে বিয়ে হয়েছে না ?
- হ্যাঁ, সে আর বলতে, কলেজের পর পরই খুব ভালো একটা পাত্র দেখে ছাদনাতলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলুম। বলেছিলো কি সব নাকি এমএ ফেমে করবে। আমি পষ্ট বলে দিয়েছিলুম, দ্যাখ, ওসব  ছাইপাঁশ পড়ে তোর কোন শাক চচ্চড়ি রাঁধতে কাজে লাগবে শুনি ? তাই শুনে মেয়ের কি কান্না ! পরে অবশ্য ওর বাবার দাবড়ানিতে সুড়সুড় করে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসেছিল। ওহ ! সে এক হ্যাঙ্গাম বটে,  বাব্বাঃ.........
- ঝুমা তো এখন তোমাদের সাথেই থাকছে কয়েক মাস ধরে, তাই না ? শুনলুম, জামাইকে তোমরা গাড়ি কিনে দিচ্ছ না বলে ওকে নাকি খুব মারধর করে..........সত্যি ?
- ইয়ে.....মানে, আমি এখন উঠি রে কাঁকন, ওদিকে আবার মেলা কাজ পড়ে আছে। ভাতটা বসাতে  হবে নাহলে আবার তোর কাকা এসে....... 


চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories #marriage #drama  

Wednesday, March 1, 2017

স্বপ্নের মতো

অফিস থেকে ফিরে, ড্রয়িং রুমে অভ্যাসমতো কাঁধ থেকে ব্যাগটা রাখতেই মা বললেন, 'তোর একটা ক্যুরিয়ার এসেছে, ভেতরের ঘরে দেরাজের ওপর রাখা আছে'। মনে পড়তেই বুকের মধ্যে মৃদু কম্পন অনুভব করলুম। একটা পার্সেল আসার কথা ছিল বটে। জিজ্ঞেস করলাম, 'কখন এসেছে' ?
- ওই দুপুরের দিকে.......আড়াইটে তিনটে নাগাদ হবে। 
- ও........আচ্ছা।  

পায়ে পায়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। দেরাজের ওপর থেকে সাদা খামটা নিয়ে এক ঝটকায় মুখটা ছিঁড়ে ফেললুম। যেটা বেরিয়ে এলো সেটা আমার এতদিনকার নিরন্তর কলম পিষে চলার প্রথম স্বীকৃতি, আমার গোপন প্রেমের স্থির অক্ষরচিহ্ন। তবে বসন্ত বোধহয় সত্যিই এলো। আসবে যে, তার আগাম খবর পেয়েছিলুম, কিন্তু সে যে আমার তালুবন্দী হয়ে আমারই হৃদস্পন্দন দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলবে এ আমার কল্পনাতীত ছিল। একটা মাঝারি সাইজের কবিতার বই যার রঙিন প্রচ্ছদের জলরঙে আমার মধ্যবয়সী বাউন্ডুলে আবেগ মিলেমিশে এক হয়ে যেতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা হাতে সূচিপত্র খুঁজে বের করে ফেললুম আটচল্লিশ নম্বর পাতাটা। সে পাতার ওপর সারি সারি কালো কালির বিন্যাস যেন আমার বুকের ভেতর কালবৈশাখীর ঝড় হয়ে বইতে শুরু করে দিলে। আর আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠায় চেয়ে রইলুম আমার শব্দসন্তানের দিকে। 'ঘুম আসছে' - আমার প্রথম ছেপে আসা কবিতা। 

বাড়ি বসেই যে এমন ম্যাজিক দেখতে পাবো ভাবিনি কখনো। তাই সম্পাদক সুরজিৎ হালদারকে শুকনো ধন্যবাদ দেব না। আমার কবিতা ও লেখা পড়ে আপনি যে অঙ্কুরের কবিতা সংকলনে আমার কবিতাটি মনোনীত করেছেন তার জন্য চিরতরে ঋণী হয়ে রইলুম আপনার ও সংস্থার অন্যান্য সদস্যদের প্রতি। আপনাদের মঙ্গল হোক। আর কি বলি ? এই অনুভূতি প্রথম প্রেম নিবেদনেই বাজিমাত করার মতো কতকটা, ভাষায় বুঝিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমার 'মলাটের' পাঠক পাঠিকাদের অনুরোধ করি এভাবেই পাশে থাকুন..........আপনাদের উৎসাহতেই এটি সম্ভব হলো।  

পুনশ্চ : বইয়ের মূল্য চল্লিশ টাকা। এটি সংগ্রহ করার জন্য সম্পাদক সুরজিৎ হালদারের সাথে যোগাযোগ করুন সত্ত্বর।

ছবি : নিজস্ব 

ছবি : নিজস্ব 


#bengaliarticles #bengaliwriteups #respect #gratitude


Wednesday, February 15, 2017

সাপ্তাহিকী ২৩ # ছোট্ট প্রেমের গল্প

ভ্যালেনটাইন্স ডের সকালবেলায় ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল শুভেন্দুর। বাঁ হাত দিয়ে বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা বের করে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। স্ক্রিনের ওপর অপর্ণার নামটা জ্বলছে নিভছে। কি আশ্চর্য ! এতো সকাল সকাল তো ফোন আসেনা। কিছু হলো নাকি ? কল রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে, 'হ্যাঁ বলো......., এই সময় হঠাৎ' ?
ওদিক থেকে অপর্ণার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়। 
- তুমি একটু চট করে রেডি হয়ে নিয়ে বেরোতে পারবে ? 
-  কেন, কি হয়েছে ?
- বাড়িতে সমস্যা হচ্ছে খুব, একটা ডিসিশন নিতে হবে, ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসতে পারবে কি ?
ঘুম কেটে যায় শুভেন্দুর। ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসে। অপর্ণার বাড়িতে গত কয়েকদিন ধরেই সমস্যা চলছে, শুভেন্দু জানে সেটা। নিশ্চই বড় রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে আজ, নাহলে ধীর স্থির অপর্ণা এতো তাড়াহুড়ো করার মানুষ নয়। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, 'আচ্ছা বেশ, বেরোচ্ছি, কোথায় আসতে হবে বলো' ? 'গোলপার্ক.......মৌচাকের সামনে', বলে ফোনটা কেটে দেয় অপর্ণা। 

অপর্ণা শুভেন্দুর আলাপ হয় একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। প্রায় বছর দুয়েক আগে কোনো এক জ্যোৎস্না ভরা হেমন্তের রাত্রে। প্রথম পরিচয় থেকে পরবর্তী আলাপচারিতা গাঢ় হতে সময় নেয়নি বেশি। দুজন সমমনস্ক মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব ঘুচে যাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে ভালোলাগার রূপান্তর ঘটেছিলো ভালোবাসায়। 'ভালোবাসি' বলতে হয়নি কাউকেই, বরং পরিণত অনুরাগ ও আবেগের বন্ধনে অজান্তেই কাছাকাছি চলে এসেছিলো দুজনে। অপর্ণার ভালো লেগেছিলো শুভেন্দুর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। জীবনের সহজ সরল উপলব্ধি মুগ্ধ করেছিল অপর্ণাকে। শুভেন্দুকে টেনেছিল অপর্ণার স্বাধীনচেতা মনোভাব। যে কোনো জটিল পরিস্থিতি খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অপর্ণা, আশ্চর্য দক্ষতায় মানিয়ে নেয় ছোট ছোট চড়াই উতরাইয়ের মুহূর্তগুলো। সময়ের উজান বেয়ে ভেসে বেড়িয়েছিল দুজনে হাত ধরাধরি করে। বলাই বাহুল্য এই সম্পর্কের আঁচ দুজনের বাড়ি অবধি পৌঁছেছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। দুর্ভাগ্যবশত কোনো বাড়িই এদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। শুভেন্দুর বাড়িতে দারুন গোলযোগ না হলেও অপর্ণার বাড়িতে দুর্ভোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিলো অচিরেই। পরিস্থিতি কণ্টকময় হয়ে এসেছিলো ক্রমশ আর তাই অপর্ণার এই জরুরি তলব। 

নির্দিষ্ট সময় গোলপার্কে চলে আসে শুভেন্দু। দূর থেকে হাত নেড়ে ডেকে নেয় অপর্ণা। 
- ব্রেকফাস্ট করোনি নিশ্চই ?
- নাহ, তুমি এতো তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালে, কোনোরকমে স্নানটা সেরেই বেরিয়ে এসেছি। কি ব্যাপার বলো তো ?
- বলছি, চলো, তার আগে একটু পেটে কিছু দিয়ে নি। আমারও সকাল থেকে খাওয়া হয়নি কিছু। 

দুজনে আনন্দ কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। দুটো ডিম্ টোস্ট আর চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসে। শুভেন্দু জিজ্ঞেস করে, 'তুমি আজ কলেজ যাবে না' ? অপর্ণা গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলে, 'নাহ, আজ দুটো মাত্র লেকচার ছিল, আসবো না বলে দিয়েছি, তেমন অসুবিধে হবে না'। শুভেন্দু অপর্ণার হাতে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে, 'বাড়িতে কি খুব সমস্যা হচ্ছে' ?

- হ্যাঁ, বাড়িতে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কাল রাতে বিশ্রী ঝামেলা হয়েছে। কেউই এই সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছে না। 
- তুমি কি চাইছ ?
- তোমার সাথে থাকতে চাইছি, ব্যাস এটুকুই।

অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দু। পূর্ব দিকের জানলা দিয়ে কড়ামিঠে রোদ এসে পড়েছে অপর্ণার গালে। অদ্ভুত দ্যুতিময় লাগে মুখের চারপাশটা। তৃপ্তিতে শুভেন্দুর গলা বুজে আসে। অপর্ণার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, 'আমার বাড়িতেও যে কম সমস্যা নেই সে তো তোমার অজানা নয় অপা, তাহলে............'। 
- আমি জানি, আর তাই সমস্ত দিক ভেবে একরকম ঠিক করেই এসেছি। 
'কি রকম' ? সন্দিহান হয় শুভেন্দু। 
- যাদবপুরের দিকে একটা দুকামরার ফ্ল্যাট আছে। মেন রোড থেকে সামান্য ভিতরে। আমার কলেজের কলিগের থেকে খবরটা পেয়েছি। ইনফ্যাক্ট ওরই যোগসূত্রে ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে কথা হয়েছে কাল। আমাদের দুজনের স্বচ্ছন্দে হয়ে যাবে মনে হয়। একবার দেখতে যাবে ?  
- কত দাম চাইছে ?
- লাখ বিশেকের মধ্যেই। আমার জমানো যা টাকা আছে তাতে ডাউন পেমেন্টটা করে দিতে পারবো। বাকিটা লোন নিয়ে নেব। কি বলো ?
শুভেন্দু আমতা আমতা করে বলে, 'সে নাহয় হলো। কিন্তু আমাকে তো লোন দেবে না কেউ। আমার তো চাকরি নেই, তুমি জানো'।
- আমার তো আছে, আর তাই লোনটা আমার নামেই নেব। ওটা নিয়ে ভেবো না। 
- তা কি করে হয়। সমস্ত টাকাটাই তুমি দিচ্ছ, আমার ওপরেও তো কোনো দায়িত্ত্ব বর্তায়, নাকি ?

শুভেন্দুর কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে অপর্ণা। বলে, 'বেশ তো, রোজের বাজারটা কোরো আর সারা মাসের আনুষাঙ্গিক খরচগুলো তুমিই নাহয় দিও, কেমন ? স্মিত হাসে শুভেন্দু। ভেবে পায়না কি বলবে। অপর্ণার এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে বিমূঢ় হয়ে যায় কিছুটা। অথচ অপর্ণা যা বলছে, যা করছে তা সমস্ত দিক ভেবেই করছে, এছাড়া আর সত্যিই কোনো উপায় নেই, শুভেন্দু জানে সে কথা। ইদানীং দুতরফেরই বাড়ির পরিস্থিতি বিষময় হয়ে উঠেছে । নিত্যদিনের বিষোদ্গীরণ বড় বুকে বাজে। সেকথা কাউকে বলবার নয়, কাউকে বোঝানোর নয়। একমাত্র অপর্ণা জানে। জীবনের তপ্ত মরুপ্রান্তরে অপর্ণাই একমাত্র মরুদ্যান তার কাছে। হৃদস্পন্দনের অন্যতম বলিষ্ঠ কারণ। নানারকম ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় শুভেন্দু। অপর্ণার ছোঁয়ায় চটক ভাঙে। 

- কি এতো ভাবছো শুভ ?
- না....., তেমন কিছু নয় ........
- আমি জানি, বাড়ির লোকজনদের ছেড়ে থাকাটা বড় কঠিন কাজ। সে কাজ করতে তোমায় জোর করবো না আমি। আর তাছাড়া আমার মতে যে তোমাকে চলতে হবেই এমন কোনো কথা নেই। তেমন হলে তুমি দুদিন ভাবার সময় নাও। ফ্ল্যাট তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তারপরেও যদি তোমার আপত্তি থাকে, জেনো, আমি বিন্দুমাত্র কিছু মনে করবো না। আমি শুধু তোমায় পেতে চেয়েছি শুভ, নিজের মতো করে, কিন্তু তোমার অমতে নয়। 
- ওকথা বোলো না অপা, আমি কি তোমার ভেতরটা পড়িনি ভাবছো ? আমায় ভুল বুঝো না, একসাথে পথচলার সংকল্প করেছি যখন, পিছিয়ে আসার ভণ্ডামি আমার সইবে না। ওতে যে মরেও সুখ পাবো না। 

শুভেন্দুর দুগাল বেয়ে অব্যক্ত বুকচাপা স্রোত নেমে আসে। অপর্ণা শক্ত করে হাত দুটো চেপে ধরে শুভেন্দুর। শুভেন্দু চোখ নামিয়ে বলে, 'শুধু একটাই আফশোষ থাকবে জানো,..............' 
- কি ?
- দাদুভাইকে রোজ দেখতে পাবো না.........

অপর্ণা নির্বাক বসে থাকে। বুকের ভেতরটা বেদনায় মুচড়ে ওঠে। ষাটোর্দ্ধ মানুষটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। তার নিজের নাতি নাতনি নেই বটে, তবু সংসারের মায়া যে কতবড় নাগপাশ এ তার থেকে ভালো আর কেউই জানে না। বিয়ের পর পরই স্বামী দেহত্যাগ করে। কলেজে চাকরি করে একমাত্র মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছে আজ অনেক বছর। সেও তার স্বামীকে নিয়ে অপর্ণার কাছেই থাকে। বিপত্নীক শুভেন্দুর সাথে ঘনিষ্ঠতা মেয়ে জামাই মেনে নিতে পারেনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়ে। শুভেন্দুর বাড়িতেও তার একমাত্র সন্তান ও বৌমার মুখের ভাষা লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। রিটায়ার্ড বাবার একা থাকার পরিনাম যে পরিণয়তেও শেষ হতে পারে একথা চিন্তা করা তাদের কাছে আত্মহত্যা করার সামিল। সে সংসারের একমাত্র সূক্ষ্ম যোগ শুভেন্দুর দুবছরের আদরের নাতি, যার আধো আধো গলায় দাদু শব্দটায় স্বর্গ খুঁজে পায় শুভেন্দু। সুতরাং কয়েক মাস ধরে দুজনকেই অন্যত্র স্থায়ী ঠিকানার কথা ভাবতে হয়েছে। আজ সে সন্ধিক্ষণ আগত প্রায়। শুভেন্দুর সামলে উঠতে ক্ষণিক সময় লাগে। তবুও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। অপর্ণা জিজ্ঞেস করে, 'বাড়ি যাবে তো ? ট্যাক্সি ডেকে দিই' ? 

শুভেন্দু মাথা নাড়ে দুদিকে। দৃঢ়কণ্ঠে বলে, 'ট্যাক্সি ডাকো, তবে বাড়ি নয়, যাদবপুর যাব............ফ্ল্যাটটা দেখে নিতে হবে তো ঠিকঠাক করে......... '


অলংকরণ : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories #love #romance #saptahiki

Monday, February 6, 2017

জন্মান্তর

জন্মাবধি শুনিয়াছি ভালো ছেলে হইতে হইবে। ভালো ছেলের যে প্রকৃত অর্থ কি তাহা বুঝিয়া উঠিতে সময় লাগিয়াছিল অনেক। যতদিনে বুঝিয়াছিলাম ততদিনে ছেলে হইয়া উঠিয়াছিলাম রীতিমতো, ভালো হইয়াছিলাম কিনা জানি না। ছোট থাকিতে অনেকেই জিজ্ঞাসা করিত, 'বড় হইয়া তুমি কি হইতে চাও খোকা' ? কোনোপ্রকারেই গুছাইয়া বলিতে পারিতাম না। গুছাইয়া বলিবার শিল্পটা রপ্ত করিতে পারি নাই তখন, ফলতঃ অধিকাংশ সময়ই না বলা কথাগুলি গলার কাছে আসিয়া আটকা পড়িত, কিছুতেই শব্দের পর শব্দ বসাইয়া বলিয়া উঠিতে পারিতাম না। প্রশ্নকর্তার বা কর্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম ফ্যালফ্যাল করিয়া। তিনি অবোধ বালক বলিয়া করুণা করিতেন, ভাবিতেন বোধহয় কথাই ফুটিয়া ওঠেনি, ও বেচারা এই কঠিন প্রশ্নের কি উত্তর দিবে। প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় জন্মদাত্রী রক্তচক্ষু হানিতেন আমার উপর। ভাবিতেন এ সমস্তই আমার ছল চাতুরি, কচি মাথার শয়তানি। জনসমক্ষে কথা না কহিয়া ওনাকে ছোট করিবার ফিকির খুঁজিয়া ফিরিতেছি।

কিন্তু সত্য ঘটনা তাহা নহে। সত্যটি হইল, আমি বড় হইতেই চাহিতাম না। তাহার অর্থ এই নহে যে বড় হইবার সমস্ত রকম ক্ষতিকর দিকগুলি আমার জানা ছিল । না....... বরং স্কুলে যাইয়া বন্ধুদের সাথে চরম দুরন্তপনা করা বা বাড়ি ফিরিয়া পশ্চিমের মাঠে ক্রিকেট বা ফুটবল পেটানো আমার যারপরনাই মনোরম লাগিত। কিয়দংশ হইলেও মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে বড় হইয়া কাঁধে ব্যাগ লইয়া সকাল সকাল অফিস যাইতে হইবে। যতক্ষণে ফিরিয়া আসিব বিকাল গড়াইয়া সন্ধ্যে হইবে, মাঠ অন্ধকার হইয়া আসিবে, খেলাধুলা হইবে না। সুতরাং বড় হইবার তেমন প্রয়োজন বোধ করিতাম না। আর তাই এই কারণেই সেসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে চাহিতাম না। জানিতাম লোকসমাজে হাস্যস্পদ হইব, মা জোর কানমলা দিবেন, কেননা যে ছেলের বড় হইবার কোনো সাধ নাই সে ছেলের অদূর ভবিষ্যৎ যে ঘন কৃষ্ণ কালিমালিপ্ত হইবে এ আর নুতন কথা কি। তাই চুপ করিয়া থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করিতাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার পাইয়া যাইতাম, কিছু ক্ষেত্রে পারিতাম না। তাঁহারা মাকে বলিতেন, 'তোমার ছেলেটি বড় কম কথা বলে, চারটে প্রশ্ন করিলে একটির উত্তর দেয়, দু দণ্ড বসিয়া যে আলাপ করিব তার জো নাই, সর্বক্ষণ পালাই পালাই করিতেছে'। মা ব্যর্থ হাসিতেন, বলিতেন, 'ও একটু লাজুক আছে, দুদিন যাক আপনিই আলাপ জমাবে'। কথাটা সত্য। সে মানুষ যদি আলাপ জমানোর মত হইত আমি নিজে নিজেই জমাইয়া লইতাম, কিন্তু তা যদি না হইত পারতপক্ষে এড়াইয়া চলিতাম। সে জন্য অবশ্য তাঁহারা কটাক্ষ করিতে ছাড়িতেন না, জনান্তিকে বলিতেন, 'ও ছোঁড়ার বড্ড দেমাক, মাটিতে পা পড়ে না, মিশিতে জানে না'। এ অপবাদ অবশ্য আমার অর্ধাঙ্গিনীও দিয়ে থাকেন। তাহাকে বুঝাইয়া উঠিতে পারিনা যে কম কথার মানুষও পৃথিবীতে বাঁচে, যাঁহারা বেশি কথা বলেন তাঁহাদের মতো করিয়াই। কিন্তু সফল হই নাই এ অবধি।

বেশ মনে পড়ে ছোটবেলায় বন্ধুরা আলোচনা করিতাম, যে, পরজন্মে যদি আবার এ ধরণীতে আসিবার সুযোগ পাই তাহা হইলে কি হইয়া জন্মিব। নানা রকম বলিত সকলে, কেউ বলিত গাঙচিল, কেউ বলিত প্রজাপতি, কেউ বলিত বাঘ, কেউ বলিত হাঙর। আমি ভাবিয়া কুলকিনারা পাইতাম না। পুনঃ পুনঃ মনে হইত মানব জনম লইয়া তো দেখা হইয়া গিয়াছে, তাহা হইলে কি এমন হওয়া যায়, যাহা করিয়া দিব্যি হাসিয়া খেলিয়া দিন কাটাইয়া দেওয়া যাইতে পারে। প্রথমে ভাবিতাম গরু হইলে বেশ হয়। মা শুনিলে বলিত ও আর কষ্ট করিয়া হইবার কি আছে। তবুও এই প্রাণীটির উপর ভারি মায়া হয় আমার।  বেচারা সারাদিন মাঠে লাঙল চষিয়া গোয়ালঘরে ঝিম মারিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া জাবনা চিবাইতে থাকে। অবশ্য তাহার পরেই সকাল বেলার দুধ দোয়ার অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়া সে ভাবনার কথা ত্যাগ করিয়াছিলাম। পরে ভাবিয়া দেখিয়াছি চতুষ্পদ জীব হইতে গেলে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হইবে। খেয়াল খুশিমতো নানাবিধ কাজ করা যাইতে পারলেও দু চার ঘা খাইবার ভয়ও যথেষ্ট থাকে। তদুপরি মনে হইত, মানুষ ছাড়া সকল জীবজন্তুই মনের মতো করিয়া জীবন অতিবাহিত করে, একমাত্র মানুষই এক অদৃশ্য শৃঙ্খল বেষ্টিত হইয়া ঘুরিতেছে। তাহা হইলে সকল রকম জীব হইয়া এক একবার করিয়া জন্মিতে পারিলে বেশ হয়। বলিতে বাধা নাই সে ভাবনা এখনো মনের মধ্যে জীবিত আছে। সযত্নে তাহাকে লালন পালন করিয়া রাখিয়াছি। 

সুযোগ পাইলেই প্রথমে মৎস্য দিয়া শুরু করিব। একেবারে পুরাণের মৎস্য অবতারের মতো কিয়দটা। তারপর কূর্ম , বরাহ , নরসিংহ অবধি গিয়া থামিয়া যাইতে হইবে। তাহার কারণ হইল এই, যে এর পরেই বামন অবতার, সেটা হইলেই চাঁদে হাত বাড়াইবার স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিব পুনরায়। আবার সেই ঘূর্ণিজলের মধ্যে পড়িয়া যাওয়া। আবার মানব ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সে আমার দ্বারা হইবে না। অতএব দেখিয়া বুঝিয়া জন্মিতে হইবে। সামান্য গাফিলতি হইয়াছে কি সংশোধনের অবকাশটুকু পাইব না। বিদ্বজনেরা এতক্ষনে আমার মুণ্ডপাত করিতেছেন হয়ত। হয়ত ভাবিতেছেন ছোঁড়াটার মাথাটা একেবারে গিয়াছে। মানুষ হইয়া জন্মানো যে কত বড় পুণ্যের কাজ, কত জন্ম জন্মান্তরে, কত যুগ শতাব্দী ধরে যে এ দুর্ভেদ্য বাধা পেরিয়ে আসিতে হয় তাহা আর তোমার মতো নরপাতক বুঝিবে কি করিয়া ? তা বটে, তবে বিশ্বাস করুন কত্তা, ও আর আমি বুঝিতে চাই না। বেশি বুঝিতে গেলে গোলমাল বাধে, ঝাপসা হইয়া ওঠে চতুর্দিক, শেষটায় নিদ্রা পায়। মুহুর্মুহু হাই তুলিতে থাকি। তাই জাগিয়া থাকিতে গেলে ওসব বাঁকা কথা চিন্তা করিতে সাহস পাই না। জন্মের আরও একটি বছর পার হওয়ার পর শুধু এই কথাটি ভাবিতে থাকি, মানব জন্ম হইল বটে তবে মনুষ্যোচিত কাজ করিতে পারিলাম কি। কি জানি। আপনাদেরও বলি, পরজন্মে কি হইতে চাহেন সেইটে আমাকে জানান দয়া করিয়া। দেখিয়া বুঝিয়া একটি পছন্দ করিয়া লইতে হইবে। সেইমতো ঈশ্বরকে আগাম জানাইয়া রাখিব, কি বলেন ?

পুনশ্চ : যাঁরা জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন তাঁদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

ছবি : গুগল 

#bengaliarticles #birthdaywriteups #bengaliwriteups 

Tuesday, January 24, 2017

২৬এর কবিতা

অপ্রতিহতরা আন্দোলনের পথে হাঁটে
রেকাবির ওপর সাজানো থাকে গারদ
ইনকিলাবের স্লোগান ছিল মুখেমুখে
বিপ্লবের আঁচে ঘেমে উঠেছিল পারদ.........

স্মরণীয়রা, রক্তে ভিজেছিল......
স্বাধীনতার, পতাকায় লেখা নাম
যে পথে যত শহীদ গিয়েছে হেঁটে
সে পথের ধুলোয় লক্ষকোটি প্রণাম........

এ পৃথিবী রাখবে তাঁদের মনে
এ পৃথিবীর সকল কাজের মাঝে
বিপ্লব মুছে যায় না কখনো
বিপ্লব এখনো বুকের ভিতর বাঁচে..........


ছবি : গুগল ;  বিন্যাস : নিজস্ব  















#republicday #bengalipoem #26thjanuary #tribute

Saturday, January 7, 2017

বন্ধু চল্

ইদানীং যেন শীতঘুম ভাঙতেই চায় না। চোখ খোলার বেশ কিছুক্ষন পরেও লেপ কম্বলের অন্তরাল যেন আর ঘন করে জাপ্টে জড়িয়ে ধরতে চায়। সে দুর্বার আকর্ষণের মায়াজাল ছিঁড়ে যখন বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করি তখন মনে হয় আজকের দিনটা নাহয় থাকুক এক কোনে পড়ে, আজ নাহয় নাইবা করলাম কিছু। আজ বরং নিজের সাথে নিজের মত করে দু চার কথা বলি, নিজের মত করে হেঁটে আসি দু চার কোশ পথ। উত্তুরে হাওয়ায় ঝরা পাতার মত রাস্তা জুড়ে শুয়ে থাকি আর শরীরের ওপর আঁকা হয়ে যাক পৌষের পটচিত্র। কানে ভেসে আসুক নবান্নের মর্মর ধ্বনি, তলিয়ে যাই কোনো এক বেনামী দুপুরে, নরম রোদের হাতছানিতে.............

গত সপ্তাহে বছরের শেষ দিনে এমনটা হওয়াতে গোঁজ মেরে বসেছিলুম সকালবেলায়। টাটকা ফুরফুরে হাওয়ার মত ফোন এসেছিল এমন একজনের কাছ থেকে যার সাথে ছোটবেলার অগুন্তি মুহূর্ত চোখ বন্ধ করলে চলচ্চিত্রের মত দেখতে পাই আজও। ছেলেবেলার অসংখ্য বেপরোয়া সময়ের সাক্ষী, সমস্ত বিচিত্র রকম কর্মকাণ্ডের দোসর ও আমার অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু - সৌম্য। বলতে বাধা নেই কালের ঘুর্ণিঝড়ে বাঁধা পড়ে আজকাল আমাদের দেখাসাক্ষাৎ প্রায় কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তবে ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যোগাযোগটা এখনো অটুট যদিও। অথচ একসময়, এই আমরাই সারা শহর জুড়ে তুর্কি নাচন করতাম। বেহিসেবী ছেলে ছোকরার মতো উড়ে বেড়াতাম টালিগঞ্জ থেকে ধর্মতলা - চাঁদনী চক পর্যন্ত। বিভিন্ন সিনেমা হলে নিয়মিত এটেনডেন্স দেওয়া, পুজোর ভিড়ে গুঁতোগুঁতি করে ঠাকুর দেখা, বইমেলায় যথেচ্ছ বই কেনা, মাঝেমাঝেই এদিক ওদিক হারিয়ে যাওয়া, স্কুলের নানারকম কেলেঙ্কারিতে হাতযশ পাকানো, এ সমস্তই আমাদের রোজনামচা ছিল সেসময়। আজ সময়ের পলি পড়ে গিয়ে কেমন যেন আচমকা আমরা সকলেই স্থবির হয়ে গেছি। গতানুগতিক জীবনযাত্রার ছাঁচে ঢেলে নিয়ে পুরোনো 'আমি'টাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন 'আমি'র আবির্ভাব ঘটেছে যেন আমাদের। তাই ফোন পেয়ে যখন জানতে পারলাম উল্টোদিকের অবস্থাও তথৈবচ তখন একেবারে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম পুরোনো 'আমি'র সন্ধানে। প্ল্যান করতে দুমিনিটের বেশি লাগলো না। আগে আগে যেমন সূক্ষ্ম অছিলায় স্কুল, কলেজ, লেকচার বাঙ্ক করতাম, ঠিক তেমনি করে চট্জলদি হিসেব করে নিলাম দুজনের কেউই সেদিন আর অফিসমুখ হবো না। রাজারহাট আর কসবার মায়া ত্যাগ করে বিবাগী হব যেদিকে দুচোখ যায়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম বন্ধুর বাইকে সওয়ারি হয়ে। মনে মনে ঠিক করে নিলুম, আগে যে যে জায়গায় নিয়মিত যেতুম দুজনে সেইসব জায়গায় আরেকবার করে চক্কর দিয়ে আসবো। 

সাদার্ন এভিনিউর মুখটায় আসা মাত্রই চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্কুলের মেন্ বিল্ডিংটা, বর্তমানে যার ধ্বংসস্তূপের ওপর একটু একটু করে বেড়ে উঠছে নব নালন্দার নব পরিকাঠামো, যার ইঙ্গিত আমার 'নব নালন্দা ডট ইস্কুল' নামক লেখাটায় দিয়েছি এর আগে। আশপাশের বাড়ি ঘরগুলো আর উল্টোদিকের বুলেভার্ডটা যেমনটা রেখে গিয়েছিলুম ঠিক তেমনি রয়ে গেছে। ঝপ করে ফিরে গেলুম বছর কুড়ি আগে। সাদা শার্ট, ধূসর রঙের ট্রাউজার আর লাল টাইএর কচিবেলা যেন স্পষ্ট দেখতে পেলুম চোখের সামনে। বেল পড়ার শব্দ শুনতে পেলুম বুকের ভিতর। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখলুম সেও নিবিষ্ট মনে বুলেভার্ডটার দিকে চেয়ে আছে।
বিড়বিড় করে বলল, 'এই একফালি মাঠটাতে কত দৌড়াদৌড়ি করেছি একসময়, তাই না বল' ?
আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলুম।
সে বললে, 'আমাদের কুড়ি বছরের পুরোনো সেই ধুলোগুলো খুঁজলে এখনো পাওয়া যাবে.......না রে' ?
আমি কোনো কথা বলতে পারলুম না, মনের মধ্যে ধুলোঝড়ের পূর্বাভাস টের পেলুম। সে ঝড়ের ঝাপটায় পাছে চোখ ঝাপসা হয় সেই ভয় অস্ফুটে বললুম, 'চল্............... কবীর রোডে যে নতুন ব্রাঞ্চটা খুলেছে সেইটে একবার দেখে আসি'।

কবীর রোডের ব্রাঞ্চ স্বাভাবিকভাবেই শীতের ছুটিতে বন্ধ, তাই বাইরে থেকে একবার চোখের দেখা দেখে নিয়ে লেকের দিকে উড়ে চললুম। যাঁরা দক্ষিণ কলকাতা নিবাসী তাঁরা জানবেন দুপুর বিকেলের দিকে লেকের মহিমাই আলাদা। রবীন্দ্র সরোবর স্টেশন থেকে পূর্ব দিক বরাবর লেক গার্ডেন্স অবধি বিস্তৃত টলটলে হ্রদ আর দুপাশে চিরহরিৎ সীমাহীন সবুজের সারি, মন আপনিই জুড়িয়ে আসে। শান্ত, নিরিবিলি, নির্ঝঞ্ঝাট স্পটের যদি খোঁজ করেন কেউ, লেকের থেকে উত্তম স্থান আর কিছু হতে পারে না, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। আমাদের কাছে অবশ্যি লেক জড়িত সুখস্মৃতি বড়ই চিত্তাকর্ষক। মনে পড়ে, বেশ কয়েক দফা মেনকায় সিনেমা দেখে এসে লেকে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। সেসব দিনে ঘটি গরম ও ঝালমুড়ির স্বাদ যেন অমৃতকেও হার মানাতো। হাবিজাবি কথা, অকারণে হাহাহিহি হাসি আর জলের দিকে চোখ রেখে সময় পেরিয়ে যেত হুশ করে। প্রচুর আড্ডা দিয়েও যেন হুঁশ ফিরত না কারও। সেদিন লেকে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম দুজনে। আগের থেকে অনেক সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজানো। কয়েক হাত অন্তর অন্তর বসার সিট ও মেঘছোঁয়া বট, অশ্বত্থ, মেহগনির বৈভবে ছোটখাট উপবন বললে খুব একটা ভুল হবে না। মাঝের সরু রাস্তা ধরে মেনকা সিনেমার দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল এই মেনকায় একবার 'মোহরা' বলে একটি ছবি এসেছিল। সে সময় এই ছবিটি  সুপার ডুপার হিট । বলাই বাহুল্য 'মোহরা' নিয়ে আমাদের উত্তেজনাও ছিল তুঙ্গে। বেশ মনে আছে অক্ষয় কুমার রবিনা ট্যান্ডনের 'টিপ টিপ বরষা পানি' আমাদের সদ্য কৈশোর পেরোনো হৃদয়ে চরম হিল্লোল তুলেছিল সেসময়। তখন মল - মাল্টিপ্লেক্সের বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিল না কোথাও। মোবাইল ঘেঁটে বা ইন্টারনেট সার্চ করে টিকিট কাটা প্রায় চাঁদে যাওয়ার সামিল ছিল। ছবি দেখার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার উন্মাদনা যে কি, সে আমরা বিলক্ষণ জানতাম। আর তাই শুধু মেনকা কেন, নবিনা, প্রিয়া, বসুশ্রী, উজ্জ্বলা, পূর্ণ, ইন্দিরা, তার সাথে মধ্য কলকাতার মেট্রো, গ্লোব, চ্যাপ্লিন, সোসাইটি, রক্সি, এলিট এসমস্ত হলে যাতায়াত যেন পাড়ার গলিতে পায়চারি করার মত ছিল আমাদের দুজনের। আজ ভাবতে অবাক লাগে এই সব হলের অধিকাংশই এখন বন্ধ। মুষ্টিমেয় কিছু সিঙ্গল স্ক্রীন এখন মুছে যাওয়া ধূসর স্মৃতি বহন করে চলেছে নিঃশব্দে। 

লেক থেকে বেরিয়ে ভাবছিলাম লাঞ্চটা সেরে নেব 'ব্যানানা লিফ' রেস্টুরেন্টে। কয়েক যুগ যাওয়া হয়নি সেখানে। সেকথা বলব বলে সৌম্যর মুখের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠলো, 'চল্, আজ ব্যানানা লিফে খাব'..............। ভেবে আশ্চর্য হলুম যে হালফিলে দেখাসাক্ষাৎ হয় না বটে, তবে আমাদের পছন্দের হেরফের ঘটেনি মোটেও। মনে পড়ে গেলো স্কুলে বা স্কুলের বাইরে সামান্য চোখের ইশারায় আমরা কত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতুম নিমেষে। তার ফল অধিকাংশ সময়ই খুব একটা সুখের হতো না। মনে আছে তখন সেভেন কি এইটে পড়ি। একবার স্কুলে আমাদের গার্জেন কল হয়েছিল, একসাথে। ক্লাস টিচার দুজনের মায়েদের মধুর আপ্যায়ন করে বসিয়ে পুঙ্খাণুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছিলেন ঠিক কেমন করে আমরা ক্লাস ডিস্টার্ব করি। সেবার বাড়ি ফিরে দুজনেরই পিঠ লাল করে দিয়েছিলেন মায়েরা। তবে এমন গার্জেন কল প্রায় সবারই হতো ঘুরেফিরে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাঁদরামো করাটা যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছিল ক্লাসের প্রায় সবারই। সে প্রসঙ্গ অন্য আরেকদিন তুলব নাহয়। 

রেস্টুরেন্টে খেয়ে সোজা চলে গিয়েছিলুম ময়দানে। একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় বাইক ষ্ট্যান্ড করে মাঠের ধরে ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছিলাম প্রায় সোয়া একঘন্টা। ছোটবেলার কথা মনে করে আবেগে গলা বুজে এসেছিলো যেমন আবার বেশ কিছু মজার ঘটনা মনে করে খিল্লিও করেছি দারুন। সেসমস্ত কথা নতুন করে লিখে আর লম্বা করবো না বেশি, তবে দুজনেই পণ করেছি, যে এবার থেকে মাঝে মাঝেই এমন নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়ব হুড়মুড়িয়ে। তাতে করে আর যাই হোক বুকের ভিতর অক্সিজেনের যোগানটা সঠিক অনুপাতে হবে, এ ব্যাপারে আমরা একশভাগ নিশ্চিত। সর্বোপরি যাঁরা পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পারেন না বা সুযোগ খুঁজে পান না, তাঁদের বলি, একদিন এভাবেই এবসেন্ট হয়ে যান ডেইলি রুটিন থেকে। সবাইকে একসাথে না পেলেও দুএকজনকে জোগাড় করুন, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিন আর হুল্লোড় করে কাটান গোটা দিনটা। বুক ঠুকে বলতে পারি আমাদের মতো আপনিও ছোটবেলার খাঁটি  'আমি'টাকে খুঁজে পাবেন আবার........... নিঃসন্দেহে ..................

পুনশ্চ : পরেরবার যাঁরা বিবাগী হতে রাজি তাঁরা আমাদের যোগাযোগ করতে পারেন। খিল্লি গ্যারেন্টীড। 

ছবি : নিজস্ব 

#bengaliarticles #bengaliwriteups #nostalgia #bestfriends #reunion #schoolfriends #oldmemories #friendsmeet

Thursday, December 22, 2016

সাপ্তাহিকী ২২ # শখের জিনিস - অন্তিম পর্ব

চৈতালীর তির্যক মন্তব্যের উত্তর না দিয়ে দেবাঞ্জন চলে যান শোবার ঘরে। মনের মধ্যে একরাশ দ্বন্দ্ব সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করতে থাকে। 'ভবিষ্যৎ' কথাটা কাঁটার মতো বিঁধে থাকে কোনো এক গহীন স্থানে ।

পরদিন সকালে অভ্যাসমতো অফিস বেরোলেন দেবাঞ্জন। চোখে সানগ্লাস। নতুন চশমাটা ব্যাগে নিয়ে নিয়েছেন। নানারকম চিন্তায় অন্যমনস্ক ভাবে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যান। পথচলতি দু চারজন চেনা মানুষের 'কেমন আছেন' , 'গুড মর্নিং' , ইত্যাদি কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করেন না। অফিসে পৌঁছে নিজের কিউবিক্যলে গুছিয়ে বসেন। সামান্য ইতস্তত করে নতুন চশমাটা বাক্স থেকে বের করে পড়ে নেন। বাকি কলিগদের নজর এড়ায় না সেটা। দেবাঞ্জনের নতুন অবয়বে হৈ  হৈ করে ওঠে গোটা অফিস। সবাই মিলে ঘিরে ধরে তাঁকে। 'দারুন লাগছে', 'চোখ আছে বটে' , 'কোথা থেকে কিনলে', 'কত দাম নিল',  ইত্যাদি সমস্ত কথাবার্তায় দেবাঞ্জনের মনের গুরুভার লাঘব হয় কিছুটা। দেবাঞ্জনও যতটা সম্ভব ছোট করে বর্ণনা করেন কেমন করে এই বিরল জিনিসটি তাঁর হাতে এসে পড়লো। স্বাভাবিকভাবেই গতরাতের ঘটনাও কিছুটা ফিকে হয়ে আসে আপনিই । অসোয়াস্তির কালো মেঘ কেটে যেতে থাকে একটু একটু করে। দেবাঞ্জন মনে মনে মেনে নেন ওটা হয়তো দেখারই ভুল ছিল। সমস্ত কিছুই নিজস্ব নিয়মে ফিরে আসছিলো একটু একটু করে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় দেবাঞ্জনকে নিয়ে অন্য কোনো পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলে তাঁর স্বস্তির কাল খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সারাদিনের রুটিনমাফিক সমস্ত কাজই করলেন দেবাঞ্জন। সামনে জেনারেল মিটিং আসছে, মার্কেটিংয়ের প্রেজেন্টেশন তৈরির কাজটা প্রায় হয়ে এসেছে। আর দু একটা ডেটাশিট পেয়ে গেলেই শেষ করে ফেলবেন। সেটা নাহয় কালই দেখা যাবে এই ভেবে ডেস্কটপের শাট ডাউন বাটন টা ক্লিক করলেন। স্ক্রিনের আলো ক্রমশ আবছা হতে হতে মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো।

অকস্মাৎ, এক মায়াবী আলোর ঝলকানিতে সামনের স্ক্রিনটা ফের সচল হয়ে উঠলো। দেবাঞ্জন আঁতকে উঠলেন। ভালো করে দেখতে লাগলেন স্ক্রীনটাকে। স্ক্রিনের ওপর ফুটে উঠেছে আগুনের লেলিহান শিখা। সে শিখার সর্বগ্রাসী জিহ্বা স্ক্রিনের চারিদিকে এঁকে বেঁকে ঘুরতে লাগলো ভয়ঙ্কর লালসায়। ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন দেবাঞ্জন। স্পষ্ট দেখতে পেলেন একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে আগুন জ্বলছে। ভারী চেনা লাগলো বিল্ডিংটাকে, কিন্তু মনে করতে পারলেন না কোথায় দেখেছেন। এ দিক ওদিক তাকিয়ে বাকি কলিগদের লক্ষ্য করলেন দেবাঞ্জন। বুঝতে পারলেন ওর স্ক্রিনের দিকে কেউই নজর করছে না তেমন। অজান্তেই গলা শুকিয়ে এলো। চশমাটা সামান্য নাকের নিচে নামিয়ে খালি চোখে দেখার চেষ্টা করলেন স্ক্রিনটা। অবিশ্বাস্য ! স্ক্রিনটা ঘন কালো, নিরীহ বোকা বাক্সের মতো তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, আগুনের ছিঁটেফোঁটা নেই কোনো জায়গাতে। চশমাটা উঠিয়ে নিতেই আবার আগুনের তুর্কি নাচন প্রত্যক্ষ করলেন। তাড়াতাড়ি করে ডেস্কের ওপর থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই ছুটে চলে গেলেন লিফটের দিকে। অফিস থেকে বেরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়লেন মেট্রো স্টেশনের দিকে। মেট্রোতে উঠে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন সমানে। ডিসেম্বরের হিমেল সন্ধ্যাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখাচিত্র ফুটে উঠলো।

বাড়ি ফিরে চৈতালীর সাথে বেশি কথা বললেন না।  চৈতালী ভারী অবাক হলেন। সচরাচর এমনটা হয় না, ডিনার টেবিলে সারাদিনের আলোচনা চলে সুখী দম্পতির মধ্যে। আজ সেখানে দেবাঞ্জন একটাও কথা বললেন না, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। কোনোমতে দুটো রুটি নাকেমুখে গুঁজে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে এলেন। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি যেন রাতের নিস্তব্ধতায় বেশি করে শুনতে পেলেন নিজে। বারে বারে স্ক্রিনের ছবিটা ফুটে উঠছিলো চোখের সামনে। এরকমটা কেন দেখলেন আবার ? তাহলে কি গতরাত্রে আয়নায় যা দেখেছিলেন সেটাও সত্যি ? তবে কি কোথাও আগুন লাগবে আজ ? বিল্ডিংটা যে ভারী চেনা চেনা ঠেকছে, কোথায় যেন দেখেছেন.........কোথায় যেন...........ভাবতে ভাবতেই ড্রয়িং রুমে ফোন বেজে উঠলো তারস্বরে। চমকে উঠলেন দেবাঞ্জন। কান পেতে শুনলেন চৈতালী ফোনটা ধরেছে। কিছুক্ষন কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রেখে দৌড়োতে দৌড়োতে চৈতালী বারান্দায় এসে বললেন, 'এই শোনো, বিভাস ফোন করেছিল, বলল তোমাদের অফিসে নাকি আগুন লেগেছে, দুটো ফ্লোর পুড়ে ছাই একেবারে, তোমায় ফোন করতে বলল তাড়াতাড়ি'।

ফস করে সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে গেলো দেবাঞ্জনের। এক ঝটকায় মনে পড়ে  গেলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে যে বিল্ডিংটা দেখেছিলেন সেটা তাঁর অফিসেরই উত্তর দিক, ওদিকটা খুব একটা যাওয়া হয় না বলেই স্পষ্ট মনে পড়ছিলো না। নিমেষে দেবাঞ্জনের মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেলো ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন বারান্দার ধাপিতে।

চৈতালী চেঁচিয়ে উঠলেন, 'কি হলো' ?
 "ভবিষ্যৎ !.......ভবিষ্যৎ" !, ভয়ার্ত গলায় ঘড়ঘড় করতে লাগলেন দেবাঞ্জন।
'কিসের ভবিষ্যৎ ? কি বলছ কি ?'  চৈতালী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা হাত তুলে তর্জনী দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। চৈতালী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেবাঞ্জনের নতুন চশমাটা রাখা আছে উপুড় করে। টেবিলের ওপর থেকে পড়া সাদা আলোতে যেন তার ঔজ্বল্য বেড়ে গিয়েছে আরও কয়েকগুন । সে চশমাটা যেন উপুড় হয়েই তাকিয়ে রয়েছে তাদের দুজনের দিকে। চশমার লেন্স দিয়ে যেন নিক্ষেপিত হচ্ছে কোনো এক পৈশাচিক হাহাকারের জ্বলন্ত দৃষ্টি।

সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সমস্ত ঘটনা শুনে, চৈতালী কাকতলীয় বলে উড়িয়ে দিলেও নিজেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না পুরোপুরি। একটা সূক্ষ্ম ধন্দ রয়ে গেলো তাঁর মনেও। ইতিমধ্যে দেবাঞ্জনের অফিসে অস্থায়ী কর্মবিরতি ঘোষণা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মচারীদের অনুরোধ করা হয়েছে যে আগামী নোটিস না পাওয়া অবধি কেউ যেন অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন। 

পরের দিন দেবাঞ্জন ঠিক করে নিলেন যেমন করেই হোক একবার বৌবাজারের সেই দোকানে যোগাযোগ করতে হবে। আসল সত্যটা কি, সেটা খুঁজে বার না করা অবধি তিনি শান্তি পাবেন না। টেবিল, আলমারি তন্নতন্ন করে ফেললেন দেবাঞ্জন কিন্তু কোথাও চশমার রিসিটটা খুঁজে পেলেন না। বৃদ্ধ দোকানির ফোন নম্বরটা যে ওতেই লেখা ছিল। চৈতালী বারে বারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন যে এই সমস্ত ঘটনায় অলৌকিক কিছু খুঁজে বেড়ানো সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু দেবাঞ্জন তাঁর কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না। ভবিষ্যতের বিভীষিকা দেবাঞ্জনকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ফেলতে লাগলো। এক অজানা নেশায় মত্ত হয়ে উঠলেন যেন। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, 'আজ সকালেও আমি চশমাটা পড়েছিলাম। কি দেখলাম জানো ? সেই বৃদ্ধ দোকানদার যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওহ ! কি ভয়ঙ্কর প্রলয় সে চাহনিতে ! স্পষ্ট দেখতে পেলাম সে যেন আমার দিকে হাত নেড়ে নেড়ে কি একটা বলছে, কিন্তু আমি একবর্ণ বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু সে উত্তরে এক কুটিল হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো চোখের সামনে থেকে'।   

- এ সমস্তটাই তোমার অতি কল্পনা দেবাঞ্জন। তুমি উচ্চশিক্ষিত, বাস্তববাদী, এসব খেয়ালী বিভ্রম তোমাকে মানায় না। 
- তুমি বুঝবে না চৈতালী, চশমাটা পড়া অবধি আমি ভিতরে ভিতরে বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পাচ্ছি । সে অনুভূতির কেমন যেন এক অন্ধকার, অমোঘ আকর্ষণ। সে আকর্ষণ অবজ্ঞা করার ক্ষমতা নেই আমার। কতকটা............ কতকটা যেন নিশির পিছনে ধাওয়া করার মতো। 
 - এ কি বলছ তুমি দেবাঞ্জন ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? কোথাকার কি একটা চশমা, কি দেখতে কি দেখেছ, তাই দিয়ে নিজের মাথা খারাপ করছ খামোকা ?
- ভুল আমি কিছু দেখিনি চৈতালী........ কোনোরকম ভুল আমার হয় নি, আমি শুধু জানি এ চশমা কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে, একটা ভয়ঙ্কর কিছুর ! আ.....আমায় সেই দোকানে যেতেই হবে......... যে করেই হোক। 

চৈতালী নির্বাক নিস্তব্ধ বসে রইলেন। দেবাঞ্জনকে ক্ষান্ত করতে পারলেন না একবিন্দু। সমস্ত রকম চেষ্টা বিফলে গেলো তাঁর। দেবাঞ্জন বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে গেলেন বৌবাজারের উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োতে একটা ভুল করে বসলেন। চশমাটা ভুলে রেখে গেলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপর। কিছুক্ষণ পর চৈতালীর সে দিকে নজরে পড়তেই ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চশমাটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একটা নীলচে আভা আছে যেন। তবে অসাধারণ কিছু নয়। দেখতে দেখতেই এক অদ্ভুত টান অনুভব করলেন চশমাটা পড়ে দেখার। নিয়তির অমোঘ আকর্ষণের বেড়াজালে জড়িয়ে গেলেন ক্ষনিকের বেখেয়ালে। আলতো হাতে চশমাটা তুলে ধীরে ধীরে চোখের ওপর বসালেন। আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখলেন নিজেকে। ছেলেদের চশমা হলেও মন্দ লাগছে না তাকে। তাছাড়া, কি আছে চশমাটাতে ? দেবাঞ্জন অযথাই পাগলামো করছে। একটা নিরীহ গোবেচারা চশমা, তাই নিয়ে একেবারে আকাশকুসুম কল্পনা করছে দেবাঞ্জন। মনে মনেই হাসতে থাকলেন চৈতালী। 'ভবিষ্যৎ' !! ওহ পারেও বটে লোকটা, বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ছাড়া আর কিস্যু নয়। মনে মনে ভাবলেন, একবার বাড়ি ফিরুক, আচ্ছা করে পেছনে লাগবেন দেবাঞ্জনের।

মনের দ্বন্দ্ব সরে যেতেই চশমাটা খুলতে গেলেন চৈতালী। হঠাৎ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো খানিক। পরক্ষণেই সামনেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে চশমার মধ্যে দিয়ে যা দেখলেন তাতে তৎক্ষণাৎ ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেলো তাঁর। পলক পড়লো না চোখে। শ্বাসরুদ্ধ করে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নিস্পৃহ ভাবটা কেটে যেতেই চশমাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেলেন মোবাইলটা আনতে। দেবাঞ্জনকে ফোন করতে হবে...... এক্ষুনি।    

অটো চেঞ্জ করে মেট্রো ধরে নিলেন দেবাঞ্জন। পুঞ্জীভূত মেঘের মতো দমবন্ধ কৌতূহল ঘন জমাট বাঁধতে লাগলো বুকের মধ্যে। সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমেই ডান দিকের ফুটপাথ ধরে হনহন করে হাঁটা লাগালেন। মিনিট তিনেকের পথ। প্রবল আশঙ্কায় হৃদস্পন্দন দ্বিগুন হলো। সামনের সিগন্যাল পেরিয়ে ডানদিকে ঘোরার জন্য রাস্তায় নামলেন। এমন সময় পকেটের ভেতর ঝনঝন করে বেজে উঠলো মোবাইল ফোনটা। দেবাঞ্জন ফোনটা তুললেন না। এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ফোন আসাতে কপালে একরাশ  বিরক্তির ভাঁজ দেখা দিল। ফোনটা কেটে গেলো আপনাআপনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার কম্পন অনুভব করলেন পকেটের মধ্যে। চোখ মুখ কুঁচকে হাত গলিয়ে পকেট থেকে বের করলেন দূরভাষ যন্ত্রটি। চৈতালী ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে রিসিভ করে বললেন, 'হ্যাঁ বলো' । খেয়াল করলেন না ওদিকে সিগনালের রংও সবুজ হয়ে গেছে কখন। চকিতের অন্যমনস্কতায় কথা বলতে বলতে রাস্তা পেরোতে গেলেন দেবাঞ্জন। ঠিক সেই সময়েই বাঁ দিক থেকে সাক্ষাৎ দানবের মতো একটা কালো সিডান এসে সজোরে ধাক্কা মারলো তাঁর কোমরে। তীব্র চিৎকার করে প্রায় কুড়ি গজ দূরে ছিটকে পড়লেন দেবাঞ্জন। মোবাইলটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো রাস্তার চারপাশে। মুহূর্তের মধ্যে রক্তের স্রোত নেমে এলো দেবাঞ্জনের গাল আর চিবুক বেয়ে। সর্পিল গতিতে এঁকে বেঁকে রক্তাভ করে তুললো কালো পিচের পথ । হৈ হৈ করে ভিড় জমে গেলো আশেপাশে। চৈতালীর শেষ ফোনটা তুলতে পারলেন না দেবাঞ্জন। সাবধান বাণী আটকে পড়ে রইল অপ্রত্যাশিত দুর্ভাগা মুহূর্তদের মধ্যে। অবশ দেহে ডান হাতের কম্পমান রক্তাত আঙ্গুল তুলে ফোনের একটা টুকরো ছুঁতে চাইলেন কোনোরকমে................পারলেন না। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন ভিড় ঠেলে সেই বৃদ্ধ দোকানি এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। ভুরু তুলে এক রহস্যময় চোখে বিড়বিড় করে বললেন, 'চশমা বড়িয়া থি না বাবুজি ? একদম হটকে' ? 
দেবাঞ্জনের চোখের পাতায় ঘন অন্ধকার নেমে এলো ক্রমে ।

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব


#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki


Saturday, December 17, 2016

সাপ্তাহিকী ২১ # শখের জিনিস - প্রথম পর্ব

সকালের কাগজটা নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালেন দেবাঞ্জন। সামান্য ঝাপসা লাগছে যেন। তবে কি পাওয়ার বাড়লো ? তা কি করে হয় ? এই তো কমাস আগেই দোকানে গিয়ে পাওয়ার চেক করালেন। ঠিকই তো ছিল। তবে ? তাহলে বোধহয় চোখে কিছু পড়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে ভালো করে চোখে মুখে জল দিয়ে এলেন, কিন্তু না, ঝাপসা ভাবটা কিছুতেই যেন কাটছে না। ভারী বিপদ হলো। সত্যিই যদি পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো সবকটা চশমার লেন্স চেঞ্জ করতে হবে। সে তো বিরাট ঝক্কির কাজ। নয় নয় করে কম চশমা নেই দেবাঞ্জনের। খান পনেরো বিশেক তো হবেই। দেবাঞ্জনের চশমার ফ্রেমের ভারী শখ। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে নিত্য নতুন চশমার ফ্রেম কিনতে ভারী পছন্দ করেন তিনি। পাড়ার দোকানগুলো তো বটেই বৌবাজারের প্রায় সবকটা দোকানই দেবাঞ্জনকে বিলক্ষণ চেনে। নতুন কোনো ডিজাইন এলেই একাধিক দোকান থেকে ফোন আসে দেবাঞ্জনের কাছে। চশমার খাঁটি সমঝদার হিসেবে পরিচিত মহলেও বেশ সুনাম আছে তাঁর। সুতরাং এহেন দেবাঞ্জনের যদি চোখের পাওয়ার বেড়ে গিয়ে থাকে তবে সমূহ সমস্যা তো বটেই । সাতপাঁচ ভেবে দেবাঞ্জন ঠিক করলেন অফিস ফেরত একবার ইন্ডিয়ান অপ্টিকালসটা ঘুরে আসবেন। লালবাজার আর বৌবাজারের সংযোগস্থলে বহু বছরের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এখানেই দেবাঞ্জন চোখ দেখিয়ে থাকেন বরাবর। আজ একটু কায়দা করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে...........

শীতকাল বলে সন্ধে হয়ে গেছে অনেক্ষণ। চোখ দেখানো হয়ে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন দেবাঞ্জন। পাওয়ার বাড়েনি, ডাক্তার বলেছেন বয়সকালে অমন হয় একটু আধটু। মাঝে মাঝে দৃষ্টি ঝাপসা লাগে। তেমন চিন্তার কিছু নেই। একটা আই ড্রপ লিখে দিয়েছেন শুধু। কয়েকদিন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ফুরফুরে হিমেল হাওয়ায় শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে দেবাঞ্জনের। হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের দিকে এগোতে থাকেন তিনি। সহসা একটা সরু গলির মধ্যে দূরে একটা ভাঙাচোরা দোকানের দিকে চোখ পড়ে যায়। টিমটিম করে একটা হলদেটে বাল্ব জ্বলছে সামনেটায়। একজন বৃদ্ধ একমনে একটা লেন্স পরিষ্কার করছেন একটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয়। দেবাঞ্জন ভেবে মনে করতে পারেন না এই দোকানটা আগে দেখেছিলেন কিনা। আশপাশের দুচারটে দোকান বন্ধ থাকাতে বেশি করে যেন নজর পড়ে এই দোকানটার দিকে। হতে পারে বাকি দোকানের ভিড়ে এই দোকানটা বেমানান বলে ততটা দৃশ্যমান ছিল না। কৌতূহলবশে পায়ে পায়ে এগিয়ে যান দেবাঞ্জন। দোকানের আশপাশটা বেশ সংকীর্ণ, অন্ধকার। বাল্বের আলোর ছটায় দোকানের সামনেটাই যা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চারপাশের জীর্ণ দেওয়ালগুলোয় মান্ধাতা আমলের ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যায় এই গলিটায় খুব একটা জনসমাগম হয় না। দেবাঞ্জনের পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকান বৃদ্ধ। খনখনে গলায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলেন, 'সেলাম বাবুজি, কুছ চাহিয়ে' ?। দেবাঞ্জন লক্ষ্য করেন বৃদ্ধের পরনে সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি পাজামা, মাথায় সাদা মুসলমানি টুপি। কাঁচাপাকা দাড়ির আড়ালে মুখে সরল মৃদু হাসির আভাস। দেবাঞ্জন বলে ওঠেন, ' না না, কিছু চাই না, আসলে এই গলিটায় তো ঢুকিনি কখনো, আপনার দোকানের আলো জ্বলছে দেখে এগিয়ে এলাম'।

'তো কেয়া হুয়া বাবুজি, আপ তসরিফ রাখিয়ে, আপকো আভি বড়িয়া ফ্রেম দিখাতে হেঁ,' বলেই বৃদ্ধ প্লাস্টিকের টুলটা এগিয়ে দেন দেবাঞ্জনের দিকে। দেবাঞ্জন চলে আসতে চান, কিন্তু অশীতিপরের প্রতি অসম্মান করা হবে ভেবে বসে যান খানিক। মনে মনে ভাবেন, 'ঠিক আছে, দু একটা ফ্রেম দেখেই উঠে পড়বেন নাহয়, তাছাড়া দোকান দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওঁর মনের মতো জিনিস এখানে পাওয়া সম্ভব নয়'। বৃদ্ধ কাঁচের আলমারি থেকে একের পর এক ফ্রেম বের করে রাখতে থাকেন টেবিলের ওপর। অধিকাংশ ডিজাইনই হয় পুরোনো আমলের নয় সাধারণ মানের। দেবাঞ্জনের মতো শৌখিন মানুষের উপযুক্ত নয় সেসব। দু একটা ফ্রেম নেড়েচেড়ে উঠে পড়েন তিনি। কোনোটাই পাতে দেবার মতো নয়। বলেন, 'আজ নাহয় থাক, আমি আরেকদিন আসব'। বৃদ্ধ হাঁ হাঁ করে ওঠেন, 'সে কি বাবুজি, ঔর একদিন কিঁউ, হাম আভি আপকো...........' কথাটা শেষ করতে দেন না দেবাঞ্জন, বিরক্ত হয়ে বলেন, 'না না থাক, আমি অন্যদিন আসবখন'। বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বলেন, 'আচ্ছা আচ্ছা রুকিয়ে, মুঝে পাতা হ্যায় আপকো ক্যায়সা ফ্রেম পসন্দ আয়েগা, এক মিনিট'..........বলেই পিছন ফিরে আলমারির তলা থেকে বের করে আনেন একটা সোনালী রঙের কাজ করা চৌকো মতো বাহারি কাঠের বাক্স। কাঠের বাক্সটা দেখে কিঞ্চিত থমকান দেবাঞ্জন। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বাক্স খুলে মখমলি কাপড়ের মধ্যে থেকে বের করে আনেন একটা ঈষৎ নীলচে রঙের মোটা ফ্রেমের চশমা। সে চশমার কোনো অসামান্য কারুকাজ নেই বটে তবে তার জৌলুস ও চেকনাই যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সে দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে যান দেবাঞ্জন। বহু ডিজাইনার চশমা পড়েছেন এ যাবৎ কিন্তু এমন জিনিস কখনই তাঁর নজরে আসেনি। হলদেটে বাল্বের আলোয় সে চশমার দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোতে থাকে।

'প্যহনিয়ে বাবুজি, একবার প্যহনকে কে তো দেখিয়ে', মিটিমিটি হাসতে থাকেন বৃদ্ধ। চশমাটা পড়ে নিয়ে আয়নায় চোখ রাখেন দেবাঞ্জন, বাহান্ন বছরের মুখটা যেন ঝকঝক করছে, বয়সের বলিরেখা ছাপিয়ে এক আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে যেন। বেশ বুঝতে পারেন এ জিনিস দিশি নয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কোথায় পেলেন এইটা' ? বৃদ্ধ এক মোহময় হাসি ছড়িয়ে বলেন, 'বাহারকা চিজ হ্যায় বাবুজি, সিঙ্গাপুর সে আয়া হ্যায়, সোচেথে কোই আচ্ছা সমঝদার আয়েগা তো নিকালেঙ্গে ইসে। আপহিকো দিখরহেঁ পেহলিবার'। দেবাঞ্জন চশমাটা খুলে তেরছা চোখে বলেন, 'লেন্সের পাওয়ার বললে কত তাড়াতাড়ি বানিয়ে দিতে পারবেন' ? বৃদ্ধ সামান্য চোখ কুঁচকে বলেন, 'করিব একঘন্টে মে রেডি হো জায়গা সাহাব'।

- আর দাম কত নেবেন ? ঠিক করে বলবেন কিন্তু, নাহলে........
- ঢাইহাজার কা এক পয়সা কম নেহি হোগা বাবুজি.......আপ সে কেয়া ঝুট বোলনা, আপ পেহলইবার মেরে দুকান আয়েহেঁ.....

সামান্য একটু চিন্তা করেন দেবাঞ্জন, তারপর পকেট থেকে সদ্য পাওয়া প্রেসক্রিপশনের কাগজটা বের করে বলেন, 'ঠিক আছে, যত তাড়াতাড়ি পারেন বানিয়ে দিন, আমি ওয়েট করছি'............   

নতুন চশমা পাওয়ার আনন্দে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢোকেন দেবাঞ্জন। চৈতালী জিজ্ঞেস করেন, 'কি ব্যাপার এতো দেরি করলে আজ' ?
- আর বোলো না বৌবাজার গিয়েছিলাম চোখ দেখাতে, ফেরার পথে একটা ভালো ফ্রেম পেলাম বুঝলে, কিনে নিলাম। বানাতেই যা একটু সময় লাগলো। 
- ওফফ, আবার চশমা, তোমাকে যে কি এক অদ্ভুত শখে পেয়ে বসেছে ভগবান জানেন। 

চৈতালীর কটাক্ষে খুব একটা পাত্তা দিলেন না দেবাঞ্জন। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ডিনার সেরে নিলেন। চশমাটা আরেকবার চোখে না পড়া অবধি শান্তি নেই। ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঠের বাক্স খুলে বের করে আনেন চশমাটা। টিউব লাইটের আলোয় ফ্রেমটা চকচক করে ওঠে। দেবাঞ্জনের মুখাবয়ব জুড়ে চরম তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে পড়ে। পুরোনো চশমাটা খুলে রেখে নতুন ফ্রেম গলিয়ে নেন দু কানের পাশে । প্রথমটায় সামান্য একটু ঝাপসা লাগে। আলতো হাতে ফ্রেমটা আরেকবার সেট করেন নাকের ওপর। এইবার পরিষ্কার লাগে চারিদিক। বেশ দেখাচ্ছে। তারিয়ে তারিয়ে দেখতে থাকেন নিজেকে আর মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেন বিরল অর্জনের উল্লাসে।
  
কিন্তু এ কি !! এটা কি দেখছেন ! কপালের ওপর একটা কাটা দাগ আর সামান্য ফোলা লাগছে যেন।
কি আশ্চর্য ! এটা তো খেয়াল করেননি আগে। কখন চোট লাগলো আর কোথায়ই বা লাগলো ? দেবাঞ্জন চিন্তা করতে লাগলেন। কিন্তু কপালের চোটটা কিছুতেই মনে করে উঠতে পারলেন না। দোকানে কি আয়না দেখেছিলেন ? হ্যাঁ, কিন্তু তখন তো ছিল না। তাহলে কি মেট্রোতে কোনোভাবে ধাক্কা টাক্কা ..................নাহ, মনে পড়ছে না বিন্দুমাত্র। ছটফট করতে থাকেন দেবাঞ্জন। আনন্দের এমন সন্ধিক্ষণে সামান্য চোটের চিন্তায় বিব্রত হয়ে পড়েন বেশ। হাত বাড়িয়ে কাটা জায়গাটায় ছুঁয়ে দেখলেন একবার। অদ্ভুত ! কোনো ব্যাথা তো নেই ! চশমাটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে রেখে আবার আয়নার দিকে তাকালেন। একি ! একি দেখছেন তিনি ? বার কতক ভালো করে মুখটা দেখলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কপালের কাটা দাগটা বেমালুম উধাও। আশ্চর্য ! এই তো ছিল ! তাহলে কি ভুল দেখছিলেন এতক্ষণ ? তাড়াতাড়ি চশমাটা গলিয়ে নিয়ে আবার আয়নায় চোখ রাখলেন।  এই তো ! এই তো দেখা যাচ্ছে কাটা দাগটা ! কি ব্যাপার হলো ? চশমা পড়ে দাগটা দেখা যাচ্ছে দিব্যি অথচ চশমা খুলতেই দাগটা উধাও ! চশমাটা খুলে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন দেবাঞ্জন, সন্দেহ করার মতো কিছু পেলেন না খুঁজে। টেবিলের ওপর চশমাটা রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন । এ কি হচ্ছে ? এমনটাতো হয়নি আগে, তবে কি বয়েসের ভারে চোখেও ভুল দেখতে শুরু করলেন এবার ? মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন তোলপাড় করতে লাগলো। ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে এগোলেন কপাল কুঁচকে। চৈতালী রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হলো ফ্রেমটা দেখালে না আমায়' ? ব্যাজার মুখ করে দেবাঞ্জন বললেন, 'আসছি, ব্রাশটা করে আসি'। 

এইবার এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। বাথরুম থেকে বেরোবার সময়, ক্ষনিকের বেখেয়ালে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে দড়াম করে সামনে পরে গেলেন দেবাঞ্জন। মাথাটা জোর ঠুকে গেলো বাঁদিকের বেসিনটাতে। 'কি হলো কি হলো' বলে চিৎকার করে ছুটে এলেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কপাল ধরে মুখ কুঁচকে বসে রইলেন মেঝের ওপর। চরম যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছে সারা শরীর জুড়ে। কোনোরকমে ধরাধরি করে দেবাঞ্জনকে ওঠালেন। বললেন, 'একটু দেখে বেরোবে তো, ইশশশশ..... দেখো তো কপালটা কেমন কেটে গেলো বিচ্ছিরিরকম, তুমি সোফায় গিয়ে বস, আমি আয়োডিন নিয়ে আসছি',। 

আয়োডিন লাগিয়ে ধীরে ধীরে সোফা থেকে উঠলেন দেবাঞ্জন। বিছানায় যাবার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন একবার। ভালো করে দেখতে লাগলেন কতটা কেটেছে। যা দেখলেন তাতে দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। দুহাত আয়নার ওপর ভর দিয়ে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন কপালটা। কিছুক্ষন আগে আয়নায় দেখা কপালের অবিকল একই জায়গায় চোটটা লেগেছে, ঠিক ততটাই কেটেছে এবং ততটাই ফুলে উঠেছে। বেশ কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চুপ। ভুল দেখছেন নাকি ? এ কি করে সম্ভব ! চিৎকার করে ডাকলেন চৈতালীকে। চৈতালী ছুটে এলেন হুড়মুড়িয়ে।

'কি ব্যাপার ? আবার কিছু হলো নাকি' ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'আচ্ছা, মনে করে দেখো তো, বাড়ি ঢোকার পর আমার কপালে কি কোনো কাটা দাগ বা চোট দেখতে পেয়েছিলে' ?.......... 'চোট ? কই না তো.......... কেন' ? চৈতালী অবাক হন। 'না, মানে আমি নতুন চশমাটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম জানো, স্পষ্ট দেখতে পেলাম কপালের এই বাঁদিকটায় একটা কাটা দাগ আর কেমন ফুলেও উঠেছিল' , বলে আঙুল দিয়ে কপালের জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দেখান দেবাঞ্জন। চৈতালী ভারী আশ্চর্য হয়ে দেবাঞ্জনের মুখের দিকে তাকান, তারপর বলেন, 'আমি কিন্তু কোনো চোট টোট দেখিনি বাপু, আমার মনে হয় তুমি ভুল দেখেছ'। 
'না না চৈতালী, ভুল আমি দেখিনি, বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছিলাম, কারণ আমি চশমাটা পড়েছিলাম,....... দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক এই জায়গাটায়..............' তোতলাতে থাকেন দেবাঞ্জন। 
'হ্যাঁ বুঝেছি, তুমি আয়নায় দেখলে আর তারপরেই পড়ে গিয়ে এক্কেবারে কপালের ঠিক ঐখানটাতেই চোট পেলে তাই তো' ? ঘাড় বেঁকিয়ে কৌতুকভরে জিজ্ঞেস করেন চৈতালী। দেবাঞ্জন হতভম্ব হয়ে যান, স্ত্রীর পরিহাসের কি উত্তর দেবেন ভেবে পান না। বটেই তো, যে আগের ঘটনাটা দেখেনি তাকে নির্ভুল ভাবে বোঝানো অসম্ভব, তাছাড়া বয়সজনিত সমস্যাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয় একেবারে। কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন দেবাঞ্জন, তারপর অস্ফুটে বলতে থাকেন, 'আমি কিন্তু ঠিকই দেখেছিলাম....... জানিনা কি করে ................' 
চৈতালী অট্টহাস্য করে ওঠেন, বলেন, 'তোমার নতুন চশমায়, কয়েক ঘন্টা পর কি হবে সেসব দেখা যায় বুঝি ? হাঃহাঃহাঃহাঃ, ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া যায় বলছো' ?....................

(ক্রমশ)

শিল্প বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #drama #thrill #saptahiki

Thursday, December 8, 2016

চিঠি

সন্ধ্যাতারা হারিয়ে গেছে 
ধূসর মেঘে খুঁজেছিলাম 
চিঠির জবাব পাইনি তবু 
কাল, তোমায় চিঠি লিখেছিলাম...... 

বলার সবই রইল বাকি 
চলার পথে পড়ল ফাঁকি 
ঘূর্ণি ঝড়ে অথৈ জলে 
সোনার তরী ভাসিয়েছিলাম 
চিঠির জবাব পাইনি তবু 
কাল, তোমায় চিঠি লিখেছিলাম...... 

ছায়ার মতো অন্ধকারে 
ছায়াটাকেই সঙ্গে করে 
রুদ্ধশ্বাসে বন্ধদ্বারে 
প্রতীক্ষাতে কাটিয়েছিলাম
চিঠির জবাব পাইনি তবু 
কাল, তোমায় চিঠি লিখেছিলাম..... 

ছবি : গুগল 













#bengalipoems #poetries

Monday, November 21, 2016

দুষ্টু ছেলে - ২

পুণ্যতোয়া নদীর তীরে মধ্যবিত্তের শহর......
কার কত জমা পাপ, সকলি রেখেছে খবর । 

Friday, November 18, 2016

দুষ্টু ছেলে - ১

খেটে খাওয়া অগুন্তি মানুষের ভিড়ে
তুমি পাঁচফোড়ন, আর আমি শুধুই কালো জিরে !! 

Monday, November 14, 2016

সাপ্তাহিকী ২০ # শিরঃপীড়া


মাথার পিছনে একটা অদ্ভুত ব্যাথা হচ্ছে নিখিলেশের । সাধারণ মাথাধরা নয়। একনাগাড়ে একটানাও নয়। থেমে থেমে ধীর লয়ে ব্যাথাটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ভারী কিছু একটা জিনিস দিয়ে অল্প অল্প চাপ দিচ্ছে পিছন থেকে। গতকাল রাতে ঘুমের ওষুধটা খাওয়ার পর থেকেই যেন শুরু হয়েছিল। অতটা পাত্তা না দিয়ে নিয়মমাফিক খানিক্ষন টিভি দেখেই শুয়ে পড়েন নিখিলেশ। ভেবেছিলেন ভালো ঘুম হলেই কেটে যাবে। অথচ সকালে উঠেও ব্যাথাটা দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে। ভারী মুস্কিলে পড়লেন, সারাদিন ধরে এই বেয়াড়া ব্যাথাটা যদি পাথরের মতো বয়ে বেড়াতে হয় তাহলেই তো হয়েছে। অফিসের কাজ তো গোল্লায় যাবে। বেসরকারী অফিসে হিসাব রক্ষকের কাজ তো কম ঝক্কির নয়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই বড় রকমের ঝামেলা পোয়াতে হবে তখন। পেশাগত দক্ষতায় এত বছরের কর্মময় জীবনে খুব একটা গলদ তাঁর হয়নি কখনো। তবুও শারীরিক দুর্বলতার কারণে হিসেবের গরমিল, মোটেও কাজের কথা নয়। তার ওপর অফিসের নতুন ম্যানেজার একাধারে বেশ দাপুটে এবং বাচাল। ছোটখাটো সমস্যাতেও লঘু গুরু জ্ঞান করেন না কখনো। দু চার কথা শুনিয়ে দেবার সুযোগ খোঁজেন যেন সবসময়। এই তো দুদিন আগে, মান্থলি মিটিংয়ে, জনসংযোগ দপ্তরের এক জুনিয়র কলিগকে যাচ্ছেতাই কথা শোনালেন সবার সামনে, শুধুমাত্রই একটা ভুল মেল্ টাইপ করেছেন বলে। নিরীহ, মিতভাষী নিখিলেশ ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিবাদটা এড়িয়ে গেছেন ইচ্ছে করে। ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পারতপক্ষে সহ্য হয় না তাঁর। আর তাছাড়া আর তো তিন চার বছর বাকি । তারপরেই অখণ্ড বেহিসেব অবসর। শেষের এই বছরগুলো যতটা শান্তিতে কাটানো যায় ততই মঙ্গল। খামোকা তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করাই ভালো।

মাথার পেছনটা আবার টনটন করে ওঠে। ঘাড় কাত করে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নেন নিখিলেশ। নাহ, অফিস ফেরত একবার মনোময় ডাক্তারের চেম্বার থেকে ঘুরে আসতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি হলে আবার বিপদ আছে। একলা মানুষ নিখিলেশ। বিয়ে থা করেন নি। পৈতৃক বাড়িটায় ভূতের মতন একাই থাকেন। অনেক ছোট বয়েসে বাবা মারা যান। আর তিরিশ বছর বয়েসে মা ও চলে যান কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। মাকে খুবই ভালোবাসতেন নিখিলেশ। মা মারা যাওয়ার পর পরই নিখিলেশ অস্বাভাবিক রকমের অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। কোনো এক অজানা কারণে লোকজনের সাথে মেলামেশা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছিল। প্রায় এক বছর উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন এদিক ওদিক। মুম্বই, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর চরকিপাক খেয়েছেন শুধু। সেসময় এরকমই একটা মাথাব্যথা হতো, বেশ মনে আছে । আত্মীয় স্বজনরা কানাঘুষো বলত, নিখিলেশের নাকি মানসিক রোগ হয়েছে, কারণ নিখিলেশ মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভুত উগ্র আচরণ করতেন যার কোনো সহজ স্বাভাবিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না। ডাক্তার, মনোবিদ সমস্তরকম কনসাল্ট করে বেশ খানিকটা সুরাহা হয়েছিল পরবর্তীকালে। বছর দুয়েক বাদে কোনো এক দূরসম্পর্কের জ্যাঠা মশাইয়ের বদান্যতায় মাস্টার্স ইন কমার্স নিখিলেশের এই চাকরিটা জুটেছিল। ধীরে ধীরে চাকরিটায় থিতু হয়ে যান, হিসেব রাখার কাজটাও বেশ ভালো লেগে গিয়েছিলো পরের দিকে। ক্রমশ উন্নতিও হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু সেই থেকে আর বিয়েটা করা হয়ে ওঠে নি। এমন নয় যে জীবনে কোনো নারীর আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি কোনোটাই। নিখিলেশের কোনো না কোনো বেমক্কা আচরণে শেষে গিয়ে ঠিক নাকচ হয়ে যেত সম্বন্ধগুলো । একটা সময়ের পর নিখিলেশের একা থাকাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। তাই কয়েক বছর পর বিয়ের পিঁড়ির প্রতি আর তেমন আকর্ষণ অনুভব করেন নি। সারাদিনে অফিসের কাজ আর পাড়ায় দু চার জনের সাথে আড্ডা দিয়েই সময় কেটে যায় এখন। বাড়ির খুঁটিনাটি কাজের জন্য একজন সারাদিনের লোক আছে, নিখিলেশের থেকে বছর দশেকের ছোট, মেদিনীপুর নিবাসী, বিশ্বস্ত অনুচর, নাম - প্রসাদ। বহু বছর আগে এ বাড়িতে সে ভিক্ষে করতে এসেছিলো। সেই থেকে এখানেই থাকে। রান্নাবান্না, ঘর দোর পরিষ্কার করা ইত্যাদি সমস্ত কাজ সে যত্ন করেই করে। নিখিলেশের রোজনামচা তার মুখস্ত।

আজ সে ভাত বেড়ে দিয়ে নিখিলেশের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'দাদার কি শরীরটা খারাপ লাগছে' ? নিখিলেশ ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে বলেন, হ্যাঁ রে, মাথাটা বেজায় টনটন করছে কেমন যেন, পুরোনো রোগটা আবার ফিরে এলো কিনা কে জানে'।
'তাহলে কি একবার সন্ধের দিকে, মনোময় ডাক্তারের কাছে...........' কথাটা শেষ করতে পারে না প্রসাদ। তার আগেই নিখিলেশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, 'হুমমম, সেরকমই ভেবেছি, দেখি, ফেরার পথে একবার দেখিয়ে আসবো' । 'আচ্ছা', বলে ভিতরে ঢুকে যায় প্রসাদ। নিখিলেশও ভাতের থালা নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েন । শরীরে অস্বস্তি হওয়ার ফলে খেতেও ইচ্ছে করে না তেমন। মুখ হাত ধুয়ে বাদামি চামড়ার ব্যাগটা কাঁধে ফেলে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যান তাড়াতাড়ি । নীলচে রঙের পুরোনো মডেলের একটা মারুতি এইট হান্ড্রেড। চাকরিতে ঢোকার বছর সাত আটেকের মধ্যেই লোনের টাকায় গাড়িটা কিনেছিলেন। বড় শখের গাড়ি তাঁর। পরের দিকে উপায় থাকলেও গাড়িটা আর চেঞ্জ করেন নি। ভালোবেসে ফেলেছিলেন তার সাধের মারুতিটাকে। এখনো সমান যত্ন করেন এবং নিজের সন্তানের মতোই আগলে রাখেন। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অফিসের দিকে বেরিয়ে যান নিখিলেশ। ব্যাথাটা হতেই থাকে ঢিমে তালে।

বিকেলের দিকে নিখিলেশের ডাক পড়ে ম্যানেজারের চেম্বারে।
'আপনার আক্কেলটা বলিহারি মিঃ মুখার্জ্জী, স্টক ব্যালেন্সের সোজা হিসেবগুলো যদি এইভাবে গুলিয়ে ফেলেন তাহলে তো দুদিনেই ব্যবসা লাটে উঠবে। আপনার ভুলের মাশুল নিশ্চয়ই  কোম্পানী দেবে না' ? কথাগুলো বলে ভীষণ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন ম্যানেজার। অপরাধীর মতো মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন নিখিলেশ। মাথার ব্যাথা তার সাথে অন্যমনস্কতা, দুয়ে মিলেই এমন বিচ্ছিরি অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে। তার জন্য নিখিলেশ যারপরনাই লজ্জিত। বার তিনেক ঢোঁক গিলে ক্ষমাও চেয়েছেন, কিন্তু অধস্তন কর্মচারীকে কোনোরকম সুযোগই দিচ্ছেন না দাপুটে কর্তৃপক্ষ । একের পর এক বাঁকা শব্দের শরাঘাতে বিদ্ধ করছেন নিখিলেশকে। নিখিলেশ কাঁচুমাচু মুখ করে বলেন, 'স্যার, আমি এক্সট্রিমলি সরি, আমাকে একটু সময় দিন, আমি পুরোটা রিচেক করে আপডেট করে দেব সমস্ত কিছু। ঘন্টাখানেকের বেশি লাগবে না, কথা দিচ্ছি' ।

 - স্ট্রেঞ্জ, ঘন্টাখানেক সময়টা কি আপনি সময় বলে মনে করেন না মিঃ মুখার্জ্জী ! নাকি আপনি ভাবছেন অমন ঘন্টার পর ঘন্টা অপচয় করার মতো যথেষ্ট সময় আছে আমাদের ?
- আজ্ঞে স্যার, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। সামান্য একটা ভুল......আমি এখুনি ঠিক করে দিচ্ছি।
- হাসালেন মিঃ মুখার্জ্জী, কোনটা সামান্য আর কোনটা অসামান্য সে বিচার করার বোধ যদি আপনার থাকতো তাহলে এই ভুলটা কিছুতেই করে উঠতে পারতেন না।
- আসলে স্যার, গত দুদিন ধরে আমার একটা অদ্ভুত মাথাব্যথা........
- এই হচ্ছে মুশকিল জানেন তো ! বুড়ো ঘোড়া তায় আবার বাঙালী ! এই দিয়ে কি আর রেসের বাজি জেতা যায় ? এই বয়েসে এখন আপনার মাথাব্যথা, অম্বল, গ্যাস, বুকজ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর এসব হবেই, তাই বলে তো আর কোম্পানী আপনার সুস্থ হওয়ার দিকে হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতে পারবে না, তাই না ?

মাথা নিচু করে চরম অপমানগুলো হজম করতে থাকেন নিখিলেশ। নিমেষেই কান মাথা লাল হয়ে যায় তাঁর। কাঁচের দরজার ওপারে মাঝেমাঝেই উৎসুক মুখের চাহনি টের পাওয়া যাচ্ছে । বাকি কলিগদের মাঝে সম্মানের আর অবশিষ্ট রইল না কিছু এটা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি । এই অফিসে তিনি একাধারে সিনিয়র এবং সম্মানীয় পদে আসীন। এধরনের বাক্যালাপে অভ্যস্ত নন কোনোভাবেই । আগের ম্যানেজারদের সময়তে এমনটা হয়নি কখনো। বরাবরই তাঁকে সমীহ করে এসেছেন ছোট থেকে বড় সবাই । সেখানে এমন হেনস্থায় তাঁর মাথা শুধু হেঁটই হলো না বরং আত্মাভিমানেও সপাটে চপেটাঘাত পড়লো যেন।

নিখিলেশ ধীরে ধীরে ম্যানেজারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের সিটে গিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন খানিক্ষন। চাকরীর পড়ন্ত বেলায় পাওনা বহির্ভূত অসম্মানটা হজম করতে পারেন না কিছুতেই। ভিতরে ভিতরে ঝড় বইতে থাকে। চূড়ান্ত অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে স্টক ব্যালেন্সের ফাইলটা টেনে নিয়ে দ্রুত চোখ বোলাতে থাকেন। আশপাশ থেকে কৌতূহলী চোখের আদানপ্রদান হতে থাকে, কিন্তু সেদিকে খুব একটা আমল না দিয়ে ভুলগুলো সংশোধন করতে থাকেন একমনে। কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ম্যানেজারের টেবিলে ফাইলটা রেখে বলেন, 'আমি পুরোটা রেক্টিফাই করে দিয়েছি স্যার, আপনি কি একবার চোখ বুলিয়ে নেবেন প্লিজ' ? ।

'সেটা না করে উপায় আছে নাকি' ? দরকারী কাগজপত্রে সই করতে করতে উদ্ধত কথাগুলো নিখিলেশের মুখের দিকে না তাকিয়েই ছুঁড়ে দেন ম্যানেজার। নিখিলেশ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, কি বলবেন ভেবে পান না, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নব্য ম্যানেজারের মুখের দিকে। আগের মতো মুখ নামিয়েই ম্যানেজার বলতে থাকেন, 'আমায় তো অন্যান্য কাজও করতে হয়, আগামী সপ্তাহের অডিট রিপোর্টে এমনিই ডিলে হবে, সুতরাং কালকের আগে দেখে উঠতে পারবো না.......থ্যাংকস টু ইউ ফর মেকিং দিস রিমার্কেবল পারফর্ম্যান্স' । বাঁকা কথাগুলো চাবুকের মতো পড়ে নিখিলেশের সারা শরীরে। কানের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সেসব শ্লেষের শব্দ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে বিষাক্ত জ্বালা ধরিয়ে দেয়। ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন নিখিলেশ। মাথার মধ্যে যেন আগুনের লেলিহান শিখার উপস্থিতি টের পেতে থাকেন । বুঝতে পারেন তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। হাতের কাজগুলো চটপট সেরে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত লিফটের দরজার কাছে চলে আসেন। বোতাম টিপে পার্কিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরে নেমে আসতেই মনে হয় ব্যাথাটা যেন ক্রমশ বিদ্যুৎলতার মতো মাথা থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে । গাড়ির কাছে এসে তাঁর মনে হয় একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলে ভালো হতো, তাহলে বোধহয় এই অস্থিরতা লাঘব হত কিছুটা । এই পার্কিং ফ্লোরের উত্তর দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকাই থাকে । উত্তেজনায় কাঁপা হাতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নেন নিখিলেশ। পাঁচিলের দিকটায় এগোতে যাবেন, হঠাৎ লক্ষ্য করেন ইতিমধ্যেই ম্যানেজার নেমে এসেছেন আর অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে । নিখিলেশ একটু হকচকিয়ে যান, পরক্ষনেই সামলে নিয়ে বলেন, 'কিছু বলবেন স্যার' ? ম্যানেজার আঙ্গুল তুলে নিখিলেশের গাড়ির দিকে দেখান । নিখিলেশ কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে' ?
- বেসিক সিভিক সেন্সটা কি কিছুতেই আপনার থাকতে নেই মিঃ মুখার্জ্জী ?
একথায় নিখিলেশ খানিকটা বাক্যহারা হয়ে যান, তারপর কোনোরকমে বলেন, 'আ, আমি ঠিক বুঝলাম না স্যার' । ম্যানেজার কোমরে দুহাত দিয়ে বলেন, 'আপনার এই আপদটাকে যেভাবে রেখেছেন, তাতে করে তো আমি আমার গাড়িটা বের করে উঠতে পারছি না' । কথাটা যে তাঁর মারুতি গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বলা, এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না নিখিলেশের। কঠিন গলায় বলেন, 'ওটা আমার গাড়ি স্যার.....আপদ নয়' ।
- বটে ! বেশ তবে ওটাকে নিচের ফ্লোরে রাখবেন এবার থেকে, ওপরে আর নয়।
- কিন্তু কেন ? আমি তো বরাবর এখানেই রাখি।
- অফিসের কিছু গাইডলাইনস তৈরী করেছি মিঃ মুখার্জ্জী, ম্যানেজার বা সমগোত্রীয় এমপ্লয়ীজরা তাঁদের গাড়ি সেকেন্ড ফ্লোরে পার্ক করবেন আর বাকি স্টাফদের নিচের ফ্লোরে পার্ক করতে হবে।
- এটা একটু জবরদস্তি হয়ে গেলো নাকি ?
- কি হলো না হলো সেটার কৈফিয়ৎ নিশ্চই আপনাকে দেব না । বরং যেটা বলা হয়েছে সেটাই করবেন এখন থেকে ।

নিখিলেশের মনে হলো কেউ যেন মাথার ভেতরটায় সজোরে হাতুড়ি দিয়ে পিটছে একনাগাড়ে । কপালের দুপাশে শিরা ফুলে উঠেছে । হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে । দাঁতে দাঁত চেপে পাল্টা জবাব দেন, 'কৈফিয়ৎ আপনি নাই দিতে পারেন, কিন্তু অন্যায্য কারণে আপনারও হুকুম মানতে ঠিক বাধ্য নই আমি'। এহেন অপ্রত্যাশিত জবাবে ম্যানেজার ক্ষণিক স্তব্ধ হয়ে যান এবং পরক্ষনেই ভয়ানক চিৎকার করে বলেন, 'হাউ ডেয়ার ইউ টক্ টু মি লাইক দিস !! আপনি জানেন আপনি কার সাথে কথা বলছেন' ?
নিখিলেশের চোখ মুখ দাবানলের মতো জ্বলতে থাকে । সারা শরীর দারুণ উত্তাপে ঝলসে যেতে থাকে যেন। ক্রুদ্ধ চাহনি দিয়ে বলেন, 'জানি..... আমি একজন অভদ্র, উন্মাদ, এরোগেন্ট মূর্খের সাথে কথা বলছি, যে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না, দুর্ব্যবহার ও হেনস্থার চাবুকে কর্মচারীদের নাজেহাল করে রাখে'....... । 
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠেন ম্যানেজার, 'শাট ইওর ফাকিং মাউথ মুখার্জ্জীইই !! আই উইল মেক ইয়োর লাইফ হেল ইউ ব্লাডি সোয়াইন........' । কথাটা পুরো শেষ করতে পারেন না। তার আগেই পাঁচিলের ধার ঘেঁষে পরে থাকা একটা কংক্রিটের চাঙড় তুলে নিয়ে সজোরে ম্যানেজারের মাথায় বসিয়ে দেন নিখিলেশ। মিনিট খানেকের কম্পন আর মৃদু গোঙানির আওয়াজ। কিছুক্ষনের মধ্যেই পার্কিং ফ্লোরে নিথর হয়ে যায় ম্যানেজারের শরীর............

পরদিন সকালে ডাইনিং টেবিলে নিয়মমতো চায়ের কাপের সাথে সকালের কাগজটা বাড়িয়ে দেয় প্রসাদ। নিখিলেশ চায়ের কাপে হালকা চুমুক দেন। প্রসাদ জিজ্ঞেস করে, 'ওষুধটা এনে দেব দাদা' ? নিখিলেশ বলেন, 'থাক, দরকার নেই, কাল থেকে আর ব্যাথাটা হচ্ছে না' । 'তুমি কি এখনি অফিস বেরোবে' ? প্রসাদ আবার জিজ্ঞেস করে। নিখিলেশ নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেন, 'নাহ, আজ আর বেরোব না কোথাও'। প্রসাদ আশ্বস্ত হয়ে বলে, 'সেই ভাল, আজ বরং একটু বিশ্রাম নাও, গতকাল রাত থেকে তো দুচোখের পাতা এক করতে পারনি, আমায় ফাঁকি দিতে পারবে না, আমি জানি'। মৃদু হাসেন নিখিলেশ, বলেন, 'সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও পার্কিংয়ের সিসিটিভিটাকে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারিনি জানিস, ধরা ঠিক পরেই যাব। বছর ত্রিশ আগে পার পেয়ে গেছি.......তবে আজ আর কোনো উপায় নেই'। প্রসাদ অবাক হয়ে বলে,       'মানে' ? কোনো উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে কাগজটা চোখের সামনে ধরেন নিখিলেশ। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় হেডলাইনটা গোটা গোটা হরফে জ্বলজ্বল করছে -
"কলকাতার বুকে স্টোনম্যানের পুনরাবির্ভাব"।



#bengalishortstories #bengalisuspensestories #thrill #drama #saptahiki

Tuesday, November 1, 2016

অবধী রেস্তোঁরা

বিরাট খাইয়ে পার্টি বলে কোনোদিনই আমার তেমন সুনাম ছিল না। অপরিমিত আহার ও দেদার মজলিশী মশলাদার খানার সাথে আমার উদরের দোস্তি নেই সেরকম। তবু কিছু কিছু আফগানী ও নবাবী কড়াইয়ের দিলখুশ ঘ্রান নাকে গেলেই কেন কে জানে নোলা বেড়ে যায় শতগুন। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো ভাইফোঁটার ছুটিটা যখন পাওয়া গেলো তখন অর্ধাঙ্গিনীর আবদারে দেশপ্রিয় পার্কের আশেপাশে একটা রেস্তোঁরার খোঁজ করলাম অনলাইনে। চোখ আটকে গেলো একটি নবাবী রেস্তোঁরায়। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে - অবধী রেস্তোঁরা । যার ওয়েবসাইট দেখে আপনার খানিকটা সম্ভ্রম জাগবে তো বটেই। আরও জাগবে যখন সশরীরে পৌঁছবেন ২৩ / বি দেশপ্রিয় পার্ক, কলকাতা ছাব্বিশে। রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে যেখানে দাঁড়াবেন, সেটা কালচে বাদামী কাঠ, লাল হলুদ শার্সি ও মোঘলাই নকশার লম্বাটে একটা বাড়ি............... 'আউধ ১৫৯০'। যাঁরা উদারহস্তে খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন, যাঁরা সুযোগ পেলেই বিভিন্ন উপলক্ষে মুখের স্বাদ পাল্টে থাকেন তাঁদের জন্য একপ্রকার উত্তম ঠিকানা, এটুকু হলপ করে বলতে পারি। 

ঠিক দুপুর বারোটায় ভারী কাঠের লোহার বড় পেরেক পোঁতা দরজাটা খুলে যায় ভিতরের দিকে । প্রায় আটশো - নশো স্কয়ার ফিটের একতলা জায়গাটায় ঢুকেই আপনার চোখ আঁটকাবে প্রায় সমস্ত দিকেই। তাক লাগানো জাফরী করা কাঠের কারুকাজ ও বাদশাহী ঝাড়বাতির নিভু আলোর দাওয়াতী মূর্ছনায় একঝটকায় পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর । বেগম আখতারী ঠুমরিতে দেওয়াল জুড়ে নবাবী নর্তকীর তৈল চিত্রগুলি যেন জীবন্ত মনে হবে অচিরেই। এক লহমায় আপনি বুঁদ হয়ে বসবেন পালিশ করা কাঠের কুর্শি তালিকায়। রঙিন খোপকাটা মেঝের দিকে তাকালে মনে হবে হাতের এক তালিতেই হয়তো শুরু হবে ঠুমরি গজলের মেজাজী মজলিশ। ইতিহাসের ছায়াপথ বেয়ে জেগে উঠবে পুরোনো কাঠকয়লার গন্ধে রসনাপূর্তির উৎসব। এক গেলাস তৃপ্তি করে জল খাবার পর আপনার সামনে আসবে প্রায় দু কিলো ওজনের একটা পেল্লায় মেনু কিতাব। প্রায় প্রত্যেক পাতায় আপনার নাকে ভেসে আসবে আফগানী কাবাব, বিরিয়ানী, শোর্বার জিভে জল আনা মশল্লা খুশবু।  কিছুক্ষনের জন্য আপনি বিভ্রান্তও হয়ে যেতে পারেন সেসব পাহাড়প্রমাণ নামের ধাক্কায় । স্থির হয়ে তশরিফ রাখার পর আপনার মনে হবে যে মেহমান নওয়াজির সুচারু আদব কায়দায় সে বাড়ির দিওয়ার ঝরোখাও বিলকুল চোস্ত । 

এই অবধী রেস্তোঁরার বৈশিষ্ট হলো ঢিমে আঁচের 'দম পুখত' রন্ধন প্রণালী। মুখবন্ধ কড়াইতে জাফরান, দারুচিনি, এলাচ, শুকনো ফল ও হরেক রকমের শাকের ব্যবহার আপনাকে শুধু অবাক করবে না, তৃপ্তির উল্লাসে আপনাকে বাকরুদ্ধ করবে আরো বেশ কতকটা । বিশেষ করে 'গালাউটি কাবাব' ও 'অবধী হান্ডি বিরিয়ানী'র সুখানুভূতি আপনি বেশ কয়েকদিন অবলীলায় বয়ে বেড়াতে পারবেন। অবধী রান্নার চিত্তাকর্ষক মশলার গন্ধ আপনি চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবেন না। শেষ পাতে আপনার কেল্লা ফতে হবে না যদি না আপনি 'শাহী টুকরা' অর্ডার করেন। পুডিং, শুকনো ফল ও এলাচ দিয়ে যথাযথ দরবারী মিষ্টিটা অনবদ্য বললেও কম বলা হয়। যতক্ষণ না আপনি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন ততক্ষন আপনি অজান্তেই বন্দী হয়ে থাকবেন এই নবাবী রঙমহলে। মনে মনে নিশ্চিত প্রতিজ্ঞা করে যাবেন ফিরে আসার এবং অন্যান্য পদগুলিও চেখে দেখার। তবে পাশাপাশি এটাও জানিয়ে রাখি মূল্যের বিচারে একটু ওপরের দিকে হলেও নিশ্চিন্তে এটি মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যেই। বলাই বাহূল্য দক্ষিণ কলকাতায় এমন একটি দাওয়াতের ব্যবস্থা করায় আমি যারপরনাই আহ্লাদিত এবং সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা শিলাদিত্য চৌধুরী ও দেবাদিত্য চৌধুরীকে আমার অনেক সাধুবাদ।

পুনশ্চ : এই রেস্তোঁরার কোনো মানুষের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো যোগাযোগ বা পরিচয় নেই তাই পাবলিসিটি করাটা মূল উদ্দেশ্য নয়। 'আউধ ১৫৯০' এর উত্তম রন্ধন ও আয়োজনের দরুন আমি আপ্লুত বলেই এটি না লিখে পারলাম না । 



ছবি : নিজস্ব


ছবি : নিজস্ব


ছবি : নিজস্ব

#bengaliarticles #bengaliwriteups #bengalirestaurant #awadhicuisine #oudh1590