Tuesday, August 30, 2016

সাপ্তাহিকী ১৫ # ঢাকাই জামদানি

প্যাকেটটা খুলেই চোখ কপালে উঠে যায় সুজাতার। একি কাণ্ড ! এমনটা তো হবার ছিল না। ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে সে বারকতক। নাহ, এড্রেস তো ঠিকই আছে, নিজের নামটাও জ্বলজ্বল করছে লেবেলের ওপর। প্রেরকের নামটাও দিব্যি মিলে গেছে। তাহলে ? তবে কি পুরো টাকাটাই চোট গেলো ? মনে মনে হায় হায় করতে থাকে সুজাতা। অমন খাদি সিল্কের ওপর হাফ এন হাফ প্যাটার্নের ময়ূরপঙ্খী শাড়ি, সেটা কিনা আমূল বদলে গিয়ে সিঁদুর আলতা রঙের ঢাকাই জামদানি এসেছে ! বলিহারি যাই, এমন ভুলটা সে করলো কি করে ? শাড়ি কেনার ব্যাপারে এমন ভুল তো তার হয়না সচরাচর। বরং পরিচিত মহলে তার শাড়ি সিলেকশনের বেশ কদর আছে। গড়িয়াহাট, নিউমার্কেট চষে, সময় নিয়ে, যত্ন করে, বাছাই করা যেসমস্ত শাড়ি সে কিনে এসেছে এতকাল, তা তারিফযোগ্য বললে কম বলা হবে। বরং হালফ্যাশনের অফবিট শাড়িই হোক অথবা আদি অকৃত্রিম, সাবেকি ধাঁচেরই হোক, শাড়ির কালেকশন নিয়ে তাকে যে বরাবর সমীহের চোখে দেখে লোকজন তাতে তার প্রচ্ছন্ন গর্ববোধটা তার আঁচলের মতোই ফিন্ফিনে আলগা হাওয়ায় উড়তে থাকে বেশ। আর সেই কিনা এই ভুলটা করে বসলো ! ছি, ছি................

প্যাকেটটা নিয়ে সে একছুটে ভিতরের ঘরে চলে যায়। তাড়াতাড়ি মোবাইলে অনলাইন শাড়ির পোর্টালটা খোলে। অর্ডার লিস্ট চেক করে দ্রুতগতিতে।  নাহ, সে তো ঠিক অর্ডারই দিয়েছিলো। যাক ! তার মানে ভুল সে করেনি, শাড়িটা যারা পাঠিয়েছে তারাই গন্ডগোলটা পাকিয়েছে তাহলে। এই হচ্ছে মুশকিল ! মনে মনে ভাবে সুজাতা। বরাবর সে পায়ে হেঁটে, দোকান ঘুরে, অজস্র, অগুন্তি শাড়ি নামিয়ে, একেবারে চিলের চোখে জরিপ করে, তবে মনের মতো দুএকটায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে যুদ্ধজয়ের উল্লাস করে। সেখানে অনলাইন বলে মনটা একবার খুঁতখুঁত করেছিলো বটে তবে পছন্দসই শাড়িটা পেয়ে যেতে আর দ্বিতীয় বার ভাবে নি। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে একচান্সে 'অর্ডার নাউ' বাটনটা টিপে দিয়েছিলো নির্দ্বিধায়। যেমন চোখটানা ময়ূরপঙ্খী রঙ, তেমনি মনকাড়া ডিজাইন, ছাড়া যায় না কি কখনো ? অষ্টমীতে একবার গায়ে তুলতে পারলে আর দেখতে হবে না। হাঁ হয়ে থাকা ছাড়া আর গতি থাকবে না কারোর। সবার ট্যারা চাউনিগুলোই মেডেলের মতো গলায় শোভা পাবে নির্ঘাৎ।..............  অথচ এখন ? নিজের গালেই ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে সুজাতার। অর্ডার বিলে ফোননম্বর আছে কি না চেক করতে থাকে সে। পাওয়া গেছে !! যাক, এইবার ফোন করতে হবে, আচ্ছা করে দুচার কথা শুনিয়ে দিতে হবে যা হোক। শাড়ি নিয়ে ইয়ার্কি ? বুঝবে বাছাধনরা ! তড়িৎগতিতে আঙ্গুল চালিয়ে নম্বর ডায়াল করে। কিছুক্ষন কথা বলে দূরভাষে, তারপর একরাশ বিরক্তি আর পাঁচন গেলা মুখ নিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। সকাল সকাল তেতো হয়ে যায় মনটা। কোনোরকমে নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে চলে যায়। ফিরে এসে অভিরূপকে জানাতে হবে। ভালো গ্যাঁড়াকল হলো !............

সেদিন রাত্রে

- এই শুনছ ? কি গো ?
- হুমমম......
- শোনো না, একটা কথা আছে....
- কি ?
- আহ ! কি সারাক্ষন টিভিটা মুখে করে নিয়ে বসে থাকো। আমার তো কোনো কথা থাকতে পারে, নাকি ?
- শুনছি তো....বলো.....
- বলছি কি, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে...... 
- হুমমম.......
- দেখেছো তো, আমাকে পাত্তা না দেওয়াটা তোমার কেমন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, টিভির মধ্যে তো ঢুকে যাবে এবার ! আমার দিকে ঘুরে বসো তো, ইম্পরট্যান্ট কথা আছে.......
- আঃ,.. আচ্ছা জ্বালাতন মাইরি, কি হয়েছে কি ? 

টিভির দিকে চোখ রেখে বিছানার ওপর এলিয়ে শুয়ে ছিল অভিরূপ। সুজাতার কথায় সামান্য বিরক্তি নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে।

- দুদিন আগে একটা শাড়ি অর্ডার করেছিলুম অনলাইনে, আজ সকালে দেখলাম ভুল শাড়ি এসেছে। 
- বেশ তো, ফিরিয়ে দিলেই হলো। 
- সে চেষ্টা কি আর করিনি ভাবছো ? ফোন করেছিলাম তো। বলল, ছবি তুলে, অর্ডার নাম্বার দিয়ে একটা মেল্ করতে হবে। 
- হ্যাঁ, করে দাও, কি অসুবিধে ?
- সকাল থেকে চেষ্টা করছি, একদম পারছি না, বলছি কি......... তুমি একটু মেলটা করে দাও না....... 
- আশ্চর্য ! তুমি অনলাইনে শাড়ি অর্ডার করতে পারলে আর একটা মেল্ করতে পারছ না ? ওটাও আমাকে করতে হবে ?
- করে দাও না লক্ষীটি, দেখছো তো বিপদে পড়েছি। 
- অদ্ভুত !

সুজাতার মোবাইলটা নিয়ে বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে নেট অন করে অভিরূপ। টিভিতে টি২০ সিরিজটার মাঝে ব্যাঘাত সহ্য হয় না মোটে, নিঃশব্দ কষাঘাত অনুভূত হয় যেন সারা শরীরে। কিন্তু উপায়ও নেই, যতক্ষণ না কাজটা করবে কানের কাছে একনাগাড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো বলতেই থাকবে সুজাতা। বিড়বিড় করতে থাকে অভিরূপ মনে মনে বলে, 'যত্তসব আদিখ্যেতা'। শাড়িটা বের করে দেয় সুজাতা। অভিরূপ একনজর দেখে শাড়িটার দিকে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে, 'শাড়িটা অন্য কাউকে দিয়ে দিলেই তো হয়, আত্মীয়স্বজন তো কম নয় আমাদের কারোর'।

-প্রথমটা তেমনই ভেবেছিলাম জানো, কিন্তু পরে মনে হলো এই শাড়িটা পড়ার মতো লোক নেই। 
- কেন ? মা......
- তোমার মা ঠিক এই রঙের ঢাকাই জামদানি পড়বেন না এই বয়েসে। আমি জানি। 
- তাহলে মাসিমণি ?
- খেপেছ নাকি ! বিরাট কারুকাজ করা শাড়ি মাসিমণি মোটেই পছন্দ করেন না, সেবার দেখলে না, তসর দিয়েছিলাম, তাও পাড়ে অত কলকার কাজ করা ছিল বলে তুলে রেখেছিলেন। জোরাজুরি করতে চুমকির মুখেভাতে পরেছিলেন কোনোরকমে। না না, মাসিমণি এটা পছন্দ করবেন না।  
- আচ্ছা সে নাহয় হলো, তোমার সেজকাকিমা ? তিনি তো বেশ সাজতে টাজতে ভালোবাসেন, ওনাকে দিয়ে দিলেই তো হয়।  
- হুমম, কায়দা করে ফোন করেছিলাম আজ বিকেলে, বললেন লাল রঙটা নাকি এভোয়েড করছেন ইদানীং......কি একটা যেন সমস্যা হচ্ছে।  
- সে আবার কি ? ইদানীং এভোয়েড করছেন মানে !! এ আবার কেমন কথা ? 
- কি জানি বাপু, কি ব্যাপার, ওনার যে কখন কি মর্জি হয় !! জানোই তো ওনাকে ? ছেলের বিয়েতে লগ্ন নিয়ে কিরকম সিন্ ক্রিয়েট করলেন....মনে নেই ? 
- হুমম, তবে একটা কাজ করো, বিন্দুপিসিকে দিয়ে দাও, অমন ফর্সা গায়ের রঙ, মানাবে ভাল, তাই না ?
- না ওটা করা যাবে না, গতবার পুজোয় এই ঢাকাই জামদানিই দিয়েছিলাম। পরপর একইরকম হলে মুখ ব্যাঁকাবে। তার চেয়ে বরং দেরি না করে তুমি মেলটাই করে দাও, শাড়ি নিয়ে চলে যাক, আমার টাকাটা ফেরত দিক।   

অভিরূপের মুখ ব্যাজার হয়ে যায়। কোনোভাবেই এই উটকো ঝামেলাটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। সমস্ত অস্ত্রই বিপক্ষ শিবিরে লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়। অগত্যা...... বাধ্য সেবকের মতো মেল্ করতে বসে যায় সে। বেশ কিছুক্ষন ধরে নাড়াঘাটা করতে থাকে মোবাইলটা নিয়ে, শেষমেশ, 'দুত্তোর' বলে দুধ সাদা যন্ত্রটা ফেলে রাখে পাশে, নিজেও গা এলিয়ে দেয় কোলবালিশটা জড়িয়ে। সুজাতা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, 'কি হলো, পাঠালে না' ?
- নাহ তোমার মোবাইলটা ভারী অদ্ভুত, নেট আসছে যাচ্ছে, কিছুতেই ছবিটা এট্যাচ হচ্ছে না। 

সুজাতা চোখ সরু করে তাকায় অভিরূপের দিকে, হাড়ে হাড়ে চেনে সে। যেটা ইচ্ছে করবে না সেটা কোনো না কোনো অজুহাতে ঠিক পাশ কাটিয়ে চলে যাবে অভিরূপ। তাই মোবাইলটা নিজে হাতে নিয়ে চেক করে..... সত্যিই নেটটা প্রব্লেম করছে। বিরক্ত লাগে সবকিছুর ওপর, তারচেয়েও বেশি করে যেন নিজের ওপর, কেন যে অর্ডার করতে গেলো সেদিন, এখন হাতে নাতে ফল পাচ্ছে। নেহাত এইরকম একটা শাড়ির প্রতি অনেকদিন ধরেই ঝোঁক ছিল....... সেজন্যই তো, তাই বলে যে এমন উটকো গাড্ডায় পড়বে এমনটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। নইলে কি আর শাড়ির অভাব ? তবে কম দাম নয় শাড়িটার, কড়কড়ে সতেরোশো টাকা গুনে দিয়েছে, এখন ফেরত দিতে না পারলে..... মনের মধ্যে নানারকম চিন্তা ভাবনার স্রোত বয়ে চলে। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সুজাতা, একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা লেগে আসে চোখে। পাশে অভিরূপ একমনে খেলা দেখে চলে টিভিতে.......... 

পরদিন সকালে 

- 'বিছানার চাদরটা টানটান করে পাত মুনিয়া। শোবার ঘরের চাদর কুঁচকে থাকলে ভীষণ গা ঘিনঘিন করে'।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে কথাগুলো বলে সুজাতা। কথাগুলোতে যেন একটা চাপা ঝাঁঝের ইঙ্গিত পায় অভিরূপ। আড়চোখে দেখে নেয় সুজাতাকে খবরের কাগজের ফাঁক দিয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিঠছাপানো চুলে চিরুনি চালাচ্ছে মধ্যযৌবনা অর্ধাঙ্গিনী। বরাবর সকাল সকাল স্নান করে নেবার অভ্যাস সুজাতার। ভিজে চুলে ভারী স্নিগ্ধ লাগে সুজাতাকে। বিয়ের পরের দিনই সেকথা বলেছিলো অভিরূপ, তারপর থেকে সুজাতাকে স্নান করে চুল আঁচড়াতে দেখলেই হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকে সে। সুজাতা ভারী অপ্রুস্তুত হয় তাতে। অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না অভিরূপের। ছবছর বিয়ে হয়েছে বটে, তবে সে স্নিগ্ধতা এতটুকু ম্লান হয়নি আজও। ভোরের আলোর মতোই উজ্জ্বল অথচ এক মৃদু ভালোলাগার বলয় তৈরী হয় সুজাতার চারপাশটায়। কোনো এক নাম না জানা ভিজে গন্ধে ঘরের ভেতরটা ম ম করতে থাকে। এরই মধ্যে গত রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে অভিরূপের, সুজাতার ঝাঁঝের আন্দাজ পায় খানিকটা। কোনো কথা না বলে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে দেয়। হঠাৎ করে সুজাতা গর্জে ওঠে আবার, 'কি রে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড় ! বারান্দাটা কে ঝাঁড় দেবে..... আমি' ? অনাহূত আক্রমণে থতমত খেয়ে যায় মুনিয়া, ঢোঁক গিলে বলে, 'না দি'ভাই, আমি দিয়ে দিচ্ছি, ওঘরের কাজগুলো সেরে নিই'। সুজাতা সে কথার কোনো উত্তর দেয় না। গম্ভীর মুখে চিরুনি থেকে জড়ানো কুঁচো চুল বের করে দক্ষিণের জানলা দিয়ে উড়িয়ে দেয়। অভিরূপ সেটা দেখে আপত্তি করতে গিয়েও সম্ভাব্য ঝড়ের কথা ভেবে নিজেকে আটকায় । খানিক্ষন বাদে আবার মুনিয়া এসে দাঁড়ায় ঘরে। 
-দি'ভাই, একটা কথা ছিল.......
- কি ?
- ইয়ে, মানে আজ বিকেলে না, আসতে পারবো না.....
-কেন ??
- মা কে নিয়ে বেরুবো...... একটু কাজ আছে...

আগুনে যেন ঘি পড়ে, সুজাতা সটান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, 'ব্যাস !! তবে আর কি, এদিন কাজ আছে, ওদিন শরীর খারাপ, আজ অমুক জায়গায় যাবো , কাল তমুক লোক আসবে......এই করিয়ে চালিয়ে দে, আমাদের কথা আর ভাবার দরকার নেই তোর, তাই না' ?? মুনিয়া ভারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বুঝতে পারে তার দি'ভাইয়ের মেজাজটা ঠিক জুত নেই আজ। আকাশপাতাল ভেবেও কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কোনোমতে মিন মিন করতে করতে বলে, 'না মানে, সত্যি একটু কাজ ছিল, তবে তেমন অসুবিধে হলে আমি নাহয় অন্যদিন যাবো, তুমি রাগ কোরো না দি'ভাই'। বছর বিশের শীর্ণ, শ্যামলা মুনিয়ার কথা কোনো পাত্তাই দেয় না সুজাতা, হাত নাড়িয়ে বলে, 'না না আজ রোববার, আমরা একটু বেরুবো বিকেলে, তুই অন্য কোনো দিন চলে যাস'। কোনোরকম বেচাল করার সাহস পায় না মুনিয়া, 'আচ্ছা', বলে পিছন ফেরে বাকি কাজ সারতে থাকে । 'তবুও...... কোন হট্টমেলায় যাওয়া হতো শুনি' ? বাঁকা চোখে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সুজাতা। অভিরূপও কাগজ নামিয়ে মুখ তুলে তাকায় মুনিয়ার দিকে। বারান্দার গ্রিলে বসা চড়ুইটাও ঈষৎ ঘাড় ঘোরায় যেন।  'নতুনবাজার', মুনিয়া ধীর লয়ে চোখ নামায়, তারপর কিছুটা কুন্ঠিত হয়ে বলে, 'আসলে দি'ভাই, তুমি যে আজ মাইনের টাকাটা দেবে, তাই দিয়ে মা কে একটা শাড়ি কিনে দেব ভেবেছি। আমি তো কখনোই মা কে কিছু দিই নি........... ছোটোর থেকে মা কেই দেখেছি এটা ওটা কিনে আনতো আমার আর ভাইয়ের জন্য। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মাকেই টেনেটুনে সংসারটা চালাতে হচ্ছে। এখন তোমাদের কাছে কাজ করছি, হাতে দুটো টাকা আসবে, তাই মনে করেছিলাম, প্রথম মাইনের টাকা পেয়ে মাকে নতুনবাজারের বড়দোকান থেকে একটা শাড়ি দেব..........কিন্তু.....'। 

ঘরের মধ্যে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা জমা হয়। সুজাতার মুখে কোনো কথা সরে না, বোবা দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মুনিয়ার দিকে। চোখের পাতায় গুমোট মেঘ ভেসে আসে কোথা থেকে। ঠোঁট শুকিয়ে আসে গভীর, তীব্র যন্ত্রনায়। বোধহয় কোনো পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় এক ঝটকায়। অভিরূপ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কাগজটা মুড়ে কোলের ওপর রাখে। বারান্দায় চড়ুইটা টুপ্ করে উড়ে পালিয়ে যায়। কিছু সময়ের পর সাময়িক জড়তা কাটিয়ে ওঠে সুজাতা। ধীর পায়ে মুনিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুনিয়া চোখ তুলে তাকায় তার দি'ভাইয়ের মুখের দিকে। সে চোখের সরল, মায়া জড়ানো, ছলছল দৃষ্টিতে সুজাতা মোম হয়ে গলতে থাকে ভাদ্রের সকালে। কোনো কথা উচ্চারণ না করে চাবি ঘুরিয়ে আলমারির দরজা খুলে বের করে আনে সেই ঢাকাই জামদানি। মুনিয়ার হাতে দিয়ে বলে.......... 'এইটা দিস তোর মাকে, বলিস........তোর প্রথম রোজগার'..............
ড্যাবড্যাব করে শাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে মুনিয়া। হাতের ওপর ওজন লাগে বড়।  

- 'কিন্তু দি'ভাই....... এ শাড়ির তো অনেক দাম গো' !
- 'মায়ের শাড়ির আবার দাম হয় নাকি রে বোকা' ?

স্মিত হাসে সুজাতা, আঁচলের খুঁট দিয়ে চট করে নিজের চোখ মুছে নেয়। বলে, 'তোর মাইনের টাকাটাও রাখ, ভাইকে কিনে দিস কিছু একটা......'। ভোরের সিঁদুরে আলতা আভার মতোই মুনিয়ার মুখচোখ উজ্জ্বল আলোকছটায় ভরে ওঠে সহসা, একগাল হেসে, ঢিপ করে সুজাতাকে একটা প্রণাম করে। সুজাতা বলে, 'আচ্ছা আছে হয়েছে, এখন পালা দেখি, আমার মেলা কাজ আছে...........আর শোন, বিকেলে আসার দরকার নেই, চালিয়ে নেবোখন একবেলা'। উদ্দাম, বেপরোয়া হাওয়ার মতো মুনিয়া ছুট লাগায় দরজার দিকে...............

অভিরূপ উঠে এসে সুজাতার কাঁধে হাত রাখে, সুজাতার অকালে মা হারানোর যন্ত্রনাটা ভালো মতোই জানে সে। সুজাতা ভেবেছিলো চাকরি পেয়ে প্রথম মাইনের টাকা দিয়ে মা কে শাড়ি কিনে দেবে। এমএম পাশ করে স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় বসার সময়টাতেই মা চলে যান। তাই প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে মা কে শাড়ি কিনে দেবার শখ কখনোই পূরণ হয়নি সুজাতার। জগদ্দল পাথরের মতো সেই সুপ্ত বাসনা আজও চাপ হয়ে বসে আছে সুজাতার বুকে। আর তাই পুজোর আগে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনকে শাড়ি দিয়ে সে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে খানিকটা। আজ মুনিয়া আর নিজেকে একই নৌকার নাবিক মনে হয়েছে তার। যে নৌকা প্রান্তিকের মৌতাতে দাঁড় বেয়ে চলেছে একটানা, নিরলস, নিরন্তর। 
দুজনে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। দক্ষিণের আকাশে ঋতু পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আশ্বিনের মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে এখনই। সুজাতাকে নিয়ে গর্ব হয় অভিরূপের, এক অনির্বচনীয়, মনোময় আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে যায় দুজনে, যা শোবার ঘরের বিছানার চাদরের মতোই মসৃন, টানটান হয়ে থাকে, অতি ঝড়েও অবিন্যস্ত হয়না কখনো.....................


 ছবি : গুগল 

#bengalishortstories #bengalilovestories #mother'sdaystory


Saturday, August 27, 2016

দান

সময় হয়েছে তব......আহ্বানে করি নব
না রাখিব আর স্মৃতি জড়ায়ে
এবারে নূতন গান......বিকশিত হোক প্রাণ
হে পুরাতন, তোমারি দান, তোমারে দিব ফিরায়ে ।

ক্ষমা কোরো মোরে...... আর না চাহিব কিছু
যত ক্লান্তি, যত গ্লানি, আর না হাঁটিব পিছু
সকলি পুরানো কথা, সকলি যাতনা, রাখিব দূরে সরায়ে
এবারে নূতন গান..........বিকশিত হোক প্রাণ
হে পুরাতন, তোমারি দান, তোমারে দিব ফিরায়ে ।

ভুলিয়া যেও..... সে জীর্ণ মর্মর বাণী
যতটুকু সঞ্চিত আবেগ, তার কতটুকুই বা মানি
ফিরায়ে লও সে ক্ষণকাল, তব রেখেছি হৃদয় ভরায়ে.......
এবারে নূতন গান..........বিকশিত হোক প্রাণ
হে পুরাতন, তোমারি দান, তোমারে দিব ফিরায়ে ।

ছবি : নিজস্ব 
















#bengalipoems #poetries

Wednesday, August 24, 2016

অভিমান

বেলা পড়ে এলো, মিছেই দেরি করিস আজ
আলো আঁধারির ছায়ায় লেগে আছে দেখ
কত শত বেলফুলের দিলখুশ মন্তাজ.........
ঘাড়গোঁজা একবগ্গা অভিমান তোর, এ  কেমনতরো ?
পুকুরঘাটে সন্ধ্যে গড়ায়, আজও যে ডাকতে এলি না বড় !
তবে কি জলপাইয়ের সাথে মিশে গেলি.........
তবে কি আলটপকা আমায় গেলি ছেড়ে ?
আমার কিন্তু এখনো শুনে ওঠা হয়নি জানিস,
সুলতান খাঁর, আলবেলাআআ...সজন、 আয়ো  রি !............

ছবি : নিজস্ব 















#bengalipoems #poetries

Saturday, August 20, 2016

ঘোগের বাসা

প্রায় দুশতক পরে যেন কলম ধরেছি মনে হচ্ছে, থুড়ি, কিবোর্ড ধরেছি। মাঝের হপ্তা দুয়েক বিছানার সাথে একেবারে লেপ্টে ছিলুম যাকে বলে। এক্কেরে মাখামাখি অবস্থা যাহোক। যতবার বলেছি ওরে ছাড়, মেলা কাজ পরে আছে, তোত্তোবার যেন বাবা বাছা বলে জাপ্টে ধরে আয়েশ করে, মাথায় হাত বুলিয়ে সকালের ডিম্ টোস্ট, দুপুরের গরম ভাত, সন্ধের চা মুড়ি খাওয়ার লোভ দেখিয়েছে । তার সাথে কুড়মুড়ে পাঁপড়ভাজার মতো জুটেছে লাগামছাড়া সেবা, যা শেষ কবে পেয়েছিলুম, কপাল চাপড়িয়েও মনে করতে পারছি না তেমন। সে মায়ার বাঁধন যদি বা টুকুন কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, তাই বলে যে এখন টারজানের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠে এগাছ সেগাছ নাঁপিয়ে বেড়াবো সে ক্ষমতা একেবারেই নেই। কি হয়েছিল ?.......... বলছি বলছি, এটুকু বলতেই হাঁপ ধরে গেলো কত্তা !

গেলো হপ্তার রোববার থেকেই গা টা কেমন যেন ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছিলো। তেমন পাত্তা না দিয়ে প্যারাসিটামলের বড়ি গিলে নিলুম। বলা নেই কওয়া নেই হতভাগা জ্বরটা একেবারে হুড়মুড়িয়ে গায়ের ওপর এসে পড়লে রাতের দিকে। একশো একেই গোঁ গোঁ করে ভূতের মতো ডাক ছাড়তে লাগলুম । দুদিনের মধ্যেই আষ্টেপৃষ্টে নাগপাশের মতো জড়াচ্ছে দেখে বদ্যি বললে, 'রক্ত পরীক্ষাটা করিয়ে নাও হে, লক্ষণগুলো ভারী চেনা চেনা ঠেকছে বাপু' । চেনা অচেনার বেড়াজালে ঠোক্কর খেতে খেতে রক্তিম স্রোত বইয়ে দিলুম অকাতরে। শিশি ভরে ভরে রক্তদান শিবির স্বার্থক করে তুললুম বিনা বাক্যব্যয়ে, সঙ্গে চলতে লাগলো এন্টিবায়োটিকের তাল মেলানো ডোজের কাব্যিক সঙ্গত । রিপোর্টে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড সবই নেগেটিভ বেরোতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। বাড়ির লোকজনও স্বস্তির শ্বাস ফেললো। ভাইরাল ফিভারও কুপোকাৎ করছে ভেবে নিজেই নিজেকে বাঁকা চোখে দেখতে লাগলুম । ভাবটা কতকটা যেন, 'হুঁ: ! ইঁদুরেও লেঙ্গি মেরে গেলো' !.....যাইহোক বয়েস হচ্ছে ভেবে ক্ষমা ঘেন্না করে দিলুম নিজেকে ।

কিয়দকাল সুস্থ বোধ করাতে অফিসের প্রতি অমোঘ টান অনুভব করলুম ও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে এবং বাড়ির চোখরাঙানি কে উপেক্ষা করে, হৈ হৈ করে একদিন দুদিন করে বুক ফুলিয়ে সারাদিন কাটিয়ে এলুম অফিসে। ঐটে কাল হলো এক্কেবারে। খ্যাপাটে জেদী ঘোড়ার মতো টগবগ করে শিরা উপশিরার মধ্যে বয়ে যেতে লাগলো বন্য জ্বরের তেজী আস্ফালন। বাড়ি ফিরে প্রায় মুচ্ছো যেতে বসেছিলুম। শুরু হলো অজস্র কাশির দমক। সে একেবারে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গলার কাছে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো ক্ষনে ক্ষনে, পরের পর । অল্প সময়ের মধ্যেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের হার দ্বিগুন হলো বেশ । চোখে মুখে নিশি রাতের আঁধার ছেয়ে এলো অচিরেই। প্রমাদ গুনলুম, 'একি হলো !! এমনটা তো হয়নি আগে ? খেয়েছে...... তবে কি সময় ফুরিয়ে এলো ? "নিভলো তবে দীপের বাতি, শেষের সময় কিছু বাকি" ? আগডুম বাগডুম কাব্যি করতে লাগলুম মনে মনে । পরের দিন পড়ি কি মড়ি করে ছুটলুম অন্য বদ্যির কাছে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পিঠে টিপে দেখে শুনে 'হুমমম.....' বলে গুম হয়ে রয়ে রইলেন কিছুক্ষন, তারপর বললেন, 'ডেঙ্গির সিম্পটম বটে, তবে বড় অদ্ভুত ঠেকচে হে, তুমি বরং রক্ত পরীক্ষার সাথে বুকের এক্স রে টাও করিয়ে নাও একেবারে, বলা তো যায় না কি বাসা বেঁধেচে শরীরে' । বোঝো কাণ্ড ! নিজের শরীরটা যেন ভাড়ার বাড়ি, যে কেউ এসে বাসা বাঁধলেই হলো ! ট্যাক্সো নেই ! আহাম্মকের মতো হে হে করতে করতে বেরিয়ে সটান হাজির হলুম পরীক্ষাগারে। যুগপৎ রক্ত দিয়ে ও এক্স রে করিয়ে ফিরলুম। এন্টিবায়োটিক চলতে লাগলো সমান তালে । বাড়ির লোকের ভয় বাড়িয়ে অবস্থার তেমন উন্নতি ঘটলো না। এরপর দুদিন ঠায় অপেক্ষা করতে হলো রিপোর্টের জন্য। মড়ার মতো পড়ে থাকা ও টিভির দিকে চোখ রাখা ছাড়া বাকিটা চলত্শক্তিহীনের মতোই কাটাতে লাগলুম। অবশেষে রিপোর্ট বেরুলো ও সেটিকে বগলদাবা করে পুনরায় বদ্যির কাছে হাজিরা দিলুম। যথারীতি ডেঙ্গি নেই, আগেই দেখে নিয়েচি, শুধু এক্স রে টা বোধগম্য হয় নি বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম ত্রাতার দিকে। আলোর দিকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে এক্সরে প্লেট টা টেবিলের ওপর রেখে চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। বললেন, 'ডেঙ্গি ফেঙ্গি  কিস্যু নয় হে, তোমার নিউমোনিয়া হয়েছে ছোকরা' ! বাবা আর আমি পাল্লা দিয়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিলুম। এই বয়েসে নিউমোনিয়া ! বলিহারি ! এমনও হয় ! আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বদ্যি বললেন, 'অত চিন্তার কিছু নেই, ওষুধ চেঞ্জ করে দিচ্ছি, ভয় পেয়ো না, ফুল বেড রেস্ট নাও, ঠিক হয়ে যাবে......'। কাঁচুমাচু মুখে বাড়ি ফিরে এলুম, মনে হলো কতকটা মুখ পুড়িয়েই এলুম যেন। এ যেন এনুয়াল পরীক্ষায় কম নাম্বার পাওয়ার মতো, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া দূরঅস্ত, শেষকালে নিউমোনিয়া !!!!

যদিও নিউমোনিয়া ধারে ও ভারে বেশ পঙ্গু করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং রেস্টে না থাকলে ফের জ্বর আসার চান্স থাকে যথেষ্টই, তবুও এরকম বিতিকিচ্ছিরি অসুখ আমার মতো ধাড়ির কেমন করে করে হলো সে প্রশ্নের উত্তর ঢের খুঁজেও মনমতো পেলাম না। বদ্যি বললেন এসির জন্য হতে পারে বা বৃষ্টিতে ভিজেও হতে পারে। হ্যাঁ, তা বিলক্ষণ হতে পারে বৈকি, বৃষ্টিতে ভিজে এসিতে বসাটা খুব পুরোনো মনে হলো না। তবুও.......তাই বলে একেবারে নিউমোনিয়া ? একজন তো ফোনে বলেই ফেললে, 'সেকি মশাই নিউমোনিয়া তো কচি ছেলেদের হয় শুনেচি, আপনি বাধালেন কি করে' ? কোনোক্রমে সে প্রশ্নের চাপ কাটিয়েছি এই বলে, 'হেঁ হেঁ ....... আমার তো খুব বেশি বয়েস বাড়েনি কিনা, তাই আর কি' ! লজ্জায় মরে গিয়েছিলাম মরমে ।

যাইহোক অফিস ভরসা জুগিয়েছে অনেকটাই, বন্ধুরা দেদার ফোন করে, হোয়াটস আপ করে আশ্বাস দিয়েছেন, তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তবু সকলকেই সাবধান বাণী শুনিয়ে যাই। তা হলো সময় ও কাল টা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না কত্তা আমাদের ! বিশেষ করে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে রয়েচেন তাঁরা তো সাবধান হন অবশ্যই। এমন বেয়াড়া ওয়েদারে বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা না করাই ভালো। বরঞ্চ 'ওষুধ খেলে সেরে যাবে, সময়মতো দেখে নেবোখন' মাফিক চিন্তা ভাবনা দূরে সরিয়ে আগে থেকে সতর্ক থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্যাঁচালো অসুখে সত্যি সত্যি সোজা সরল ওষুধে কাজ দিচ্ছে না মোটে। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি তাই বলছি। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বাঁধতে দেরি হচ্ছে না, তাই নিজেকে ব্যাঘ্রসমান ভাবলেও......এ যাত্রা সাধু সাবধান !!...... না হলে নিউমোনিয়া হয় ???  ঘোর কলি মশাই......... ঘোর কলি !!

পুনশ্চ : খবর পেয়েছি বিভিন্ন বাঁকাচোরা ব্যাধিতে বন্ধুবান্ধবরা আক্রান্ত, এমনকি এই অসময়ে হামও হচ্ছে, সুতরাং চেষ্টা করুন, সুস্থ থাকুন, ঠিক পারবেন। আমি বলচি !





ছবি : গুগল

#bengaliarticles #bengalifunnywriteups #pneumonia

Tuesday, August 16, 2016

প্রহর

অনেকটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে.....
অনেকটা সময় ফাঁকি দিয়ে গেছে তাই
এক প্রহর রাত জেগেছি আমি আজ
আরও এক প্রহর বেশি জাগতে চাই ।

খোয়াবের খোঁজে পাশ ফিরে ঘুম
সেঁজুতির চৌকাঠ নিকষ নিঝুম....
পরজীবী লতায় বয়স বাড়ছে তাই
এক প্রহর রাত জেগেছি আমি আজ
আরও এক প্রহর বেশি জাগতে চাই ।

ইচ্ছেনদী এমনি বয়ে গেছে কত.....
অকুল সোহাগ ছাইচাপা আগুনের মত....
ধিকিধিকি পুড়তে থাকে গোটা জীবনটাই
এক প্রহর রাত জেগেছি আমি আজ
আরও এক প্রহর বেশি জাগতে চাই......

ছবি : নিজস্ব 
















#bengalipoems #poetry

Wednesday, August 10, 2016

আলাপ

পক্ষান্তরে ভালোবাসারা উহ্য থাকে
আলগা চাউনিতে গড়ে ওঠে পরিচয়
মেঘভাঙা জলে আবেগের ডুবসাঁতার
কাঁচভাঙা হাসিতে মুগ্ধ বিলম্বিত লয়.....

অপরিহার্য থাকে সমস্ত চাওয়া পাওয়া
নদীর স্রোতে আকাশ জেগে রয়......
দীর্ঘ কথার প্রতিচ্ছবি চারিপাশে,
আলাপ জমানো তেমন কঠিন কিছু নয়......

মুখরায় সুর বেঁধে দেয় হৃদমাঝার
বেয়াড়া মুখে ফুটছে কত খই.......
আমার সাথে আলাপ জমাও ভিনদেশী
আমিও তোমার মত রাত্রি জেগে রই......

ছবি : নিজস্ব 


#bengalipoems #lovepoems #romanticpoems

Friday, August 5, 2016

২২শে........

কয়েক বছর আগেকার কথা। সে ঘটনার কথা মনে পড়লেই এক আকাশ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই আজও। কতকটা মিঠে পাতা পানের মতো। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে গুলকান্দ এর মিষ্টি প্রলেপ পড়ে সারা জিভ জুড়ে, দোসর থাকে এলাচ, মৌরির এক্কা দোক্কা। চর্বিতচর্বনে হারিয়ে যাওয়ার ঈঙ্গিত থাকে স্পষ্ট। সেদিন অফিস থেকে গিয়েছিলাম সল্টলেক সেক্টর ফাইভের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। সামনে বেশ বড় একটা ইভেন্ট ছিল সেবার। ফলস্বরূপ একটি টেলিভিশন পার্টনারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিলো খুব স্বাভাবিক নিয়মেই। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো আমি, তাই নির্দ্বিধায় দায়ভারের হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দিয়েছিলুম বিনা বাক্যব্যয়ে। স্বীকার করতে বাধা নেই, সেদিন খুব বেশি প্যাঁচ পয়জার কষতে হয়নি। খুব মসৃন ভাবেই আমাদের প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে সে যাত্রা। ডিল ফাইনাল হওয়াতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ফিরে আসছিলাম অফিসের গাড়িতে। অকস্মাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল।

দক্ষিণ পশ্চিমের আকাশে তখন দুর্বার গতিতে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। ফুটন্ত কেটলির মুখ দিয়ে যেভাবে ভুড়ভুড়িয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে, ঠিক সেইরকম সরু, একফালি, ধূসর প্রান্তরেখা হয়ে ক্রমশ বিস্তৃতি ঘটিয়ে তার তমসাবৃত চাদরে যেন ঢেকে ফেলতে চাইছে চতুর্দিক। ভিজে হাওয়ার গন্ধরা তখন চাক ভাঙা মৌমাছির মতো রে রে করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শহর জুড়ে। সোঁদা মাটির ঘ্রানে চোখ ফেরাতে পারলাম না কিছুতেই। একদৃষ্টে দেখে যেতে লাগলাম আলো আঁধারির বেলাগাম দৌরাত্মি। শুধু মুখ ফুটে একবার বললাম, 'পঙ্কজ দা' !................... উত্তর এলো,
- হুমমম, দেখেছি, খুব জোর আসছে.......
- বেশ তো ! আসুক, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, তুমি আস্তেই চালাও, দেরি হলে কিচ্ছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

স্টিয়ারিঙে হাত রেখেই আড়চোখে আমায় দেখে নেয় পঙ্কজদা। চিবুকের হাড়ে মৃদু হাসি খেলে যায়। বুঝতে পারে বোধহয়, সময় অপচয়টা কতকটা  ইচ্ছাকৃত। অবশ্য পঙ্কজদার পক্ষে সেটা বোঝাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বহূ নিকট - দূরের জার্নির একনিষ্ঠ ও ভরসাযোগ্য সঙ্গী ছিল সেসময়। শহরের একটু বা অনেকটা দূরের গল্প হলেই পারতপক্ষে আমরা পঙ্কজদা ছাড়া অন্য কাউকে নিতাম না সঙ্গে। সুতরাং আমার মতো দু একজন ডেপোঁ কলিগের সাথেই খুব সহজেই সখ্যতা গড়ে উঠতে বেশি দেরি হয়নি তার। এযাত্রাও সে সামনের কাঁচের দিকে স্থির ছাউনি দিয়ে বললো, 'বলছো ?' আমি সহাস্যে বলে উঠলাম, 'নিশ্চিন্তে'। মুখের হাসি তেমনি অটুট রেখে জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে এক রাউন্ড চা হলে মন্দ হয় না..... কি বলো' ? হাত নাড়িয়ে বললুম, 'কিছুমাত্র না'। 'বেশ তাহলে একটা স্পেশাল চায়ের দোকানে নিয়ে যাই তোমায়...... চলো', বলেই বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেয় বিদেশী যানের দিশি সারথি।

বাইপাসের চওড়া মেদহীন চিকন পথ ছেড়ে আমরা ঝপ করে এসে পড়লুম অপেক্ষাকৃত রুক্ষ পিচের রাস্তায়। জানলার দুপাশের চিত্রগুলো সিনেমার কাটশটের মতো বদলে যেতে লাগলো মুহুর্মুহু। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর চোখে পড়লো টালির চাল দেওয়া কাঁচামাটির ঘর, বাঁশ বাগান, খানকতক পুকুর, ডোবা, এধার ওধার থেকে ছুটে আসা মুরগির পাল, দেওয়ালের গায়ে যত্রতত্র ঘুঁটের নকশা কাটা প্যাটার্ন আর চোখ জুড়ানো সবুজের দিগন্ত বিস্তৃত আহ্লাদ। এক ঝটকায় শহরের মানচিত্রটা আমূল বদলে গিয়ে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো আদি বাংলার আটপেড়ে সহজিয়া উষ্ণতা। যেখানে গাঢ় রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে, কপালে এত্তবড় সূর্যের লাল মেখে কোনো এক গাঁয়ের বধূ অপেক্ষায় আছে শীতলপাটি বিছিয়ে। উঠোনে পা দিলেই গ্লাসে করে এগিয়ে দেবে কুঁজোর মিঠে নির্যাস, তালপাতার পাখায় এক নিমেষে মিলিয়ে যাবে দিনগুজরানের ঘামশরীর।    

এদিকটায় আসিনি কখনো। শহরের বুকের মধ্যেই যে এমন একটুকরো লুকোনো জিয়নকাঠি খুঁজে পাবো এ আমার কল্পনাতীত। ফলে অপরিচিত রোদ্দুর হলেও পরিচিত মাটির টানটা দিব্যি গায়ে মেখে নিচ্ছিলাম ধুলোয় বালিতে। মেদিনীপুরে আমাদের আদি বাড়ির নিকোনো উঠোনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারেবার। একটা চায়ের দোকানের সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো পঙ্কজ দা। বলল, 'নামো'। কাঁচা রাস্তার ওপর নেমে দাঁড়ালাম। বাঁশের খুঁটির ওপর খড়ের চাল, দরমার খাঁচা, মাটির উনুন আর সামনে দু সারি ইঁটের ওপর  একটা কাঠের তক্তা দিয়ে পরিপাটি বসার জায়গা করা পঙ্কজদার স্পেশাল চায়ের দোকান। দুটো চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসলাম। ততক্ষনে আকাশ বেয়ে এক দু ফোঁটা করে গায়ের ওপর পড়ছে অবিন্যস্ত রূপোলী গুঁড়ো। লক্ষ্য করলাম, কিছুটা দূরে একটা মাঠের ধারে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। একটা ছোট স্টেজ আর সামনে লাইন করে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে কিছু মানুষ বসেছে। মুখ ঘুরিয়ে দোকানের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'ওখানে কি হচ্ছে ভাই ?' এক বিশেষ ভঙ্গিমায় চায়ের ছাঁকনি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, 'ফানশন হচ্ছে ফানশন, ফি বচ্ছর হয় এখানে'। ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসের' ? চায়ের ভাঁড়গুলো হাতে ধরাতে ধরাতে বললো, 'বাইশে শ্রাবন। ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি আর গান করে'। .............. চমকে ওঠার সেই শুরু। এমন এক অজ পাড়াগাঁ যেখানে অভাবের চিত্রটা দুপুরের রোদের মতোই উজ্জ্বল ও চোখে পড়ার মতো সেখানে ম্যারাপ বেঁধে রবীন্দ্রচর্চা ! দুমুঠো ভাতের খোঁজে উদয়স্ত যাদের ক্ষেতের ওপর লাঙ্গল চষতে হয় তাদের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রস্তব করছে খরচ করে ! পরক্ষনেই ভাবলাম, নাকি, এরা বলেই করছে বা হয়তো এরাই করে থাকে। কি জানি ! আমাদের মতো শহুরে চাষিদের সময় কই ওতো ! ঘড়ির দামে সময় বিকোয় আমাদের। এরকম বেয়াড়া কিছু প্রশ্নের ভিড়ে চায়ের ভাঁড়ে আলগা চুমুক দিতে থাকি আর অপলক তাকিয়ে থাকি স্টেজের দিকটায়।

মাঠের বুক চিরে কানে ভেসে আসছে........ 'শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে.......পড়ুক ঝরে, তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে বুকের 'পরে'.......
ভারী মিষ্টি করে গাইছে। মনকেমন করে ওঠে ততক্ষণাৎ। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতে কেন জানিনা বড্ডো এমনটা হয়। কতকটা সবুজ ঘাসের মাঠ পেলেই যেমন সটান শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল দেখলেই যেমন হাত বোলাতে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমনটা, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোনোটাই করা হয়ে ওঠে না, ভিতরে ভিতরে শুধু ফুঁপিয়ে মরার যন্ত্রনাটা টের পাওয়া যায়। মনে হলো একছুটে পালিয়ে যাই ওখান থেকে। গিয়ে দাঁড়াই মেঠো পথের একেবারে শেষ চৌকাঠে যেখানে থাকবে না কোনো পিছুটানের বদভ্যাস, শুধু থাকবে প্রান্তজনের সাথে গুটিকতক আলাপী মুহূর্ত আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানোর অলস আধছটাক প্রেম..

ডান পাশে তাকিয়ে দেখলাম একজন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুচ্ছেন। হাড় জিরজিরে শীর্ণ চেহারা, খালি গা, পরনে সরু বাদামি পাড়ের ধুতি আর খালি পা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি..............খানিক্ষণ বাদে ভিজে গলায় নিজে থেকেই বলে উঠলেন, 'রবিঠাকুরের গান শুনলেই মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে গো বাপ....... সেই কত্ত ছোটবেলা বেলা থেকে শুনে আসচি, আজও ময়লা হয় নি গো, যেমনকার ঠিক তেমনি আছে'। এমন অকপট অনুভূতির ঝাপটায় বেশ অবাক হলাম। বললাম, 'আপনি বুঝি ওনার গান খুব ভালোবাসেন' ? ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলেন আমাকে কিঞ্চিৎ, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, 'ওনার গানের কথাতেই তো জীবনের সারমর্ম বাপ....... দিনযাপনের গুরুমন্তরটা তো উনিই দিয়ে গেছেন, ভালোবাসি বলে অচ্ছেদ্দ্যা করতে পারবো না গো, তার পায়ে মাথা কুটে মরতে পারলে তবে যে আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম '...............

চিত্রার্পিতের মতো বসে রইলুম। এমন কথা শুনিনি আগে.........ভালোবাসা অশ্রদ্ধা !! গুরুমন্ত্রই প্রাণের আধার !!......লোকটা বলে কি !! রবীন্দ্রশ্রদ্ধায় এমন সহজ, সরল, প্রাঞ্জল নিবেদন আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়লো না। শ্রাবনের সোঁদা মৌতাতে মনটা মাখামাখি হয়ে গেলো কেমন। বুকের মধ্যে আকুলিবিকুলি করতে লাগলো দিনযাপনের গুরুমন্তর, আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম......... নেশাগ্রস্তের মতো বসেছিলুম...........কতক্ষন জানিনা ..............বড় বড় ফোঁটায় শব্দের মেহফিল জমে উঠেছে ততক্ষনে,........ সম্বিৎ ফিরলো পঙ্কজদার কথায়, 'এবার চলো, আর বসে থাকা যাবে না, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে'। কোনো মতে টেনে তুললাম নিজেকে, যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে বারে বারে বৃদ্ধকে দেখছিলাম। এখনো ঠিক তেমনি ভাবে বসে আছেন। টলটলে শ্রাবনের জলে অশ্রু মিলেমিশে একাকার । গাড়ির দরজা বন্ধ করলাম। পঙ্কজদা চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল, এফ এম এ বাজতে শুরু করেছে .........
'শাওন বরষে.....তরসে দিল.......কিউঁ নাআআ নিকলে, ঘরসে দিল.......
বরখা মে ভি দিল পেয়াসা হ্যায়.....ইয়ে প্যায়ার নেহি তো ক্যায়া হ্যায়'..............  

কি আশ্চর্য মিল ! শ্রাবন বোধহয় এমন করেই মিলিয়ে দিতে পারে......তাই না ?

চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত
ছোট করে বলে রাখা ভালো এই চিত্রটি শুধুমাত্রই গ্রাফিক্স নয় আমার কাছে,
এটি একটি আদ্যোপান্ত রচনা, যা অর্ণবের সৃজনে ও কল্পনায় প্রাণ পেয়েছে।


চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত 


#bengaliarticles #rabindranathtagore #tributetorabindranathtagore #tribute

Tuesday, August 2, 2016

অনুপদ্য - ১০

ছবি : নিজস্ব 
মনের সাথে আড়ি আমার
মনের কাছেই ভয়
মনের কথা তুমিই জানো
তবু তুমি আমার নয়..........
মনের ভাষায় ভাসিয়েছিলেম
স্বপ্ন মেঘের ভেলা
মনের ভুলেই সাঙ্গ হলো
মিথ্যে মনের খেলা...........






#bengalipoems #bengalilovepoems #bengaliromanticpoems