টক দই এর মত ঘন জমাট বেঁধে আছে সন্ধেটা। লেকের ধারে সিমেন্টের বেঞ্চগুলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। বিস্ময়ের ঘোর লেগে থাকে আত্রেয়ীর চোখে মুখে। পলকা কথার ঢিলে সম্পর্কের কাঁচটা যে এভাবে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যাবে এমনটা আন্দাজ করতে পারেনি সে কখনই। চোখের কাজলের মত লেপ্টে ছিল অরিজিৎ এতদিন। ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করার সময় থেকে রূপকথার জালবোনা শুরু। অত ছেলেমেয়ের ভিড়ে আলাদা করে চোখ টেনেছিল ছিপছিপে, ফর্সা, মাঝারি উচ্চতার তরুণটি। প্রথম দিকের আলগা চাউনি থেকে মাঝের আলাপী খেজুর ও শেষের দিকে কখন যে আঙ্গুল ছুঁয়ে প্রেমের আগুন জ্বলেছিল তা হয়ত এখন আর দুজনের কারোরই মনে নেই।
'আমরা বিয়ে করব না'? কোনো এক নরম বিকেলের আলোতে শুধিয়েছিল আত্রেয়ী। কেরিয়ার ও পারিবারিক জটিলতার দোহাই দিয়ে প্রত্যেকবার কাটিয়ে দিয়েছে অরিজিৎ। বলেছে, এখনি সংসারের ঘেরাটোপে বদ্ধ হতে রাজি নয় সে। আগে চাকরি তে সেট্ল করবে, প্রমোশন পেয়ে তারপর বিয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনা। এই কবছর তাই চুটিয়ে প্রেম করেছে দুজনে। অনুরাগের উত্তাপে সেঁকে নিয়েছে একে অপরকে। কিন্তু আত্রেয়ীর জন্য সময় থেমে থাকে নি। সামাজিক নিয়ম মেনে পাত্র দেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক দিন আগে থেকেই। রক্ষনশীল বাড়িতে আত্রেয়ীর কোনো কথা কানেই নেয় নি কেউই। তাই আজ বাধ্য হয়ে অরিজিৎ কে চাপ দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল পুরোনো লেকের ধারে। করুণ মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, 'আর কবে? এখন তো তোর চাকরি বাঁধা, কিছুদিনেই প্রমোশন হবে, এটলিস্ট আমার বাড়িতে তো কথা বলে রাখ। সবাই যেরকম উঠে পড়ে লেগেছে তাতে তো কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেবে আমার'। শুনে অদ্ভূত উত্তর দিয়েছিল অরিজিৎ।
-'এখন কোনো মতেই সম্ভব নয়, নতুন প্রজেক্ট এসেছে, সামনের মাসে অফিস থেকে বিদেশ পাঠাচ্ছে দু বছরের জন্য। ফিরে এসে তারপর চিন্তা ভাবনা করব'। শুনে থ হয়ে গিয়েছিল আত্রেয়ী। অস্ফুটে বলেছিল, 'আর আমি !! আমি কি চিরকাল অপেক্ষা করে থাকব তোর জন্য? সেটাই কি তুই চাইছিস'? উত্তর দেয়নি অরিজিৎ। প্রশ্নটা শুনে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। নিঃশব্দের মোড়কে না বলা উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিল আত্রেয়ী। ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করেছিল, 'তবে কেন স্বপ্ন দেখালি আমায়.......একসাথে ঘর বাঁধার, একসাথে বাঁচার' ?
-আমি তো কোনো স্বপ্ন দেখাইনি তোকে, বরং তুই স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলি, তাই দেখেছিস। তার দায়টা নিশ্চই আমার নয়, তাই না ?
- ওহ, নতুন ভবিষ্যতের হাতছানিতে পুরনো যা কিছু সব ধুলো ময়লার মত ঝেড়ে ফেলতে চাইছিস ? তাই তো ?
- দ্যাখ আত্রেয়ী, আমায় অহেতুক দোষ দিস না, তোর সাথে এই দুএক বছর কাটিয়েছি বলেই যে বিয়ের পিঁড়িতে বসব এমন দাসখত তো লিখে দিই নি। তাছাড়া তোর অমতেও হয়নি কিছু, সেটা বোধকরি ভালো করেই জানিস।
- তার মানে কানাঘুষোয় যা শুনতে পাচ্ছি সেটাই সত্যি।
- কি শুনেছিস ঠিক ?
- তোর অফিসের এক কলিগের সাথে এ যাবৎ তোর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। বিভিন্ন জায়গায় একসাথে দেখা যাচ্ছে তোদের, একথা অস্বীকার করতে পারবি তুই ?
- অন্তরা আমায় প্রপোজ করেছে মাত্র। আমি এখনো উত্তর দিই নি। আমার কথা বাদ দে, কলেজে এরকম প্রপোজাল তো তুইও অনেক পেয়েছিলি। ইনফ্যাক্ট সৈকতের প্রপোজ করার পরের দিনই আমি প্রপোজ করি তোকে। মনে আছে নিশ্চই ?
- আছে। ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নে সৈকতের সাথে তোর রেষারেষিটাও মনে আছে আমার। শুধু ইউনিয়ন কেন, পড়াশোনা, খেলার মাঠ, ক্যান্টিন এমনকি সমস্ত এক্টিভিটি তে সৈকতকে টেক্কা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা দেখেছিলাম সেসময়।
- হেরে যাবার ছেলে কোনদিনই আমি ছিলাম না আত্রেয়ী, সৈকতের কাছে তো নয়ই।
-তার মানে বলতে চাইছিস আমি শুধু সৈকতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া একটা ট্রফি মাত্র ? একজন জিতে যাওয়া ক্যান্ডিডেটের বিজয় স্মারক ? যাকে কাঁধে নিয়ে কিছুদিন বয়ে বেড়ানো যায়, সস্তা আড়ম্বরে বুক ফুলিয়ে গোটা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানো যায় আর পুরনো হয়ে গেলেই ঘরের এক কোনে ফেলে দিতে হয় অন্য সব আসবাবের মত। এ ছাড়া আমার আর কোনো মূল্য নেই তোর কাছে ?
-দ্যাখ, অনর্থক ঝগড়া বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি আগেই বলেছি আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়। তোর বাড়িতে বিয়ে দিতে চাইছে, বিয়ে করে নে, খামোকা আমার জন্য ওয়েট করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই।
বিষাদের মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল আত্রেয়ীর সারা মুখ জুড়ে। বুকের অতল থেকে উঠে আসা যন্ত্রণাগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে এসেছিল ফোঁটায় ফোঁটায়।
- সময় নষ্ট !!! হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস, তাই বোধহয় করে এলাম এতকাল। তোকে প্রতিদিন ফোন করে ঘুম থেকে তোলা, তোর চাকরির জন্য কাগজের বিজ্ঞাপন খুঁজে বার করা, তোর পছন্দের রেসিপি তৈরী করা, ইন্টারভিউয়ের ডেট মনে করিয়ে দেওয়া, এসবই সময় নষ্ট ছিল রে আমার................ তবে তুইও জেনে রাখিস তুই শুধু সময় কুড়িয়েছিস আরেকজনের ফেলে যাওয়া সময় থেকে, নিজের জন্য সময় তৈরী করেছিস তারই তৈরী করা মুহূর্ত থেকে। ট্রফিটা তুই জিতলি বটে..........খেলাটা তোর কখনই জেতা হলো না অরিজিৎ। আজ তাহলে সত্যি কথাটা শুনে যা।
- সত্যি কথা !!!! কোন সত্যিটা ? তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায় অরিজিৎ আত্রেয়ীর দিকে।
- সৈকত আমাকে কোনোদিনই প্রপোজ করেনি অরিজিৎ, ইনফ্যাক্ট আমিই সৈকত কে প্রপোজ করি।
- কিইই !!!!??................. না না, তুই মিথ্যে কথা বলছিস।
- মিথ্যে আমি বলছি না অরিজিৎ............
'না না এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না', বিস্ময়ে, আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে অরিজিৎ।
- তুই বিশ্বাস না করলেই তো আর সত্যিটা পাল্টে যাবে না। তোর প্রপোজ করার আগের দিন, সৈকত নয়, আমিই ওকে প্রপোজ করি। কিন্তু ও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিল সেদিন। বলেছিল, ইউনিভার্সিটির ইউনিয়ন থেকেই সরাসরি সক্রিয় পলিটিক্সে ঢুকবে, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছিল সেসময়, প্রেম করার মত সময় বা পকেটের জোর কোনোটাই ওর ছিল না। সৈকত জানত তুই আমায় পছন্দ করতিস, বলেছিল, আমাকে সুখী করতে পারবি তুই.........ও নয়।
অরিজিৎ এর মুখে কোনো কথা জোগায় না। কান মাথা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। প্রবল হাওয়ায় খড় কুটোর মত উড়ে যায় আত্মাভিমান। বেলুনের মত মিইয়ে চুপসে যায় কপট দম্ভ। আকস্মিক বিহ্বলতায় ন্যুব্জ হয়ে বেঞ্চিতে বসে থাকে আত্রেয়ীর পাশে নিশ্চুপ। আত্রেয়ী বলে চলে.........
- ট্রফি জেতার অহংকারে তুই অন্ধ হয়ে ছিলি এতদিন। তোর জানা ছিল না খেলাটা অনেকদিন আগে থেকেই তুই গোহারা হেরে বসে আছিস সৈকতের কাছে। ও ছিল সৎ, নির্ভেজাল, নিজের কাছে, আমার কাছেও। রঙিন ডানা নিয়ে জন্মায়নি তোর মত আর তাই প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াবার সখও ছিল না ওর। প্রথম দফাতেই কবুল করে সেটা। তোর মত ল্যাজে খেলায় নি আমায় মাসের পর মাস ধরে। তাই ওর অকপট সিদ্ধান্ত কে আমি আজও সম্মান করি মনে মনে। আর এই যে এখন তুই ভীরু কাপুরুষের মত পালিয়ে যাচ্ছিস সেটার জন্য ঘেন্না হচ্ছে তোর ওপর। তোর ভন্ডামির মুখোসটা খুলে গেল আজ অরিজিৎ। হেরোর তকমাটা গায়ে লেগে গেল আজ থেকে তোর, সব দিক দিয়েই। দুয়ো অরিজিৎ, তোকে দুয়ো। কদাকার, মরচে পড়া মনুষ্যত্বটা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তোকে সারাজীবন। এটাই হবে তোর চরম শাস্তি। আজ থেকে আর দেখতে চাইনা তোকে...........কোনদিনও না।
রাগে অপমানে গর্জে ওঠে আত্রেয়ী। দু হাতে মুখ চেপে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে..................
কোনো রকমে শরীরটা টেনে তোলে অরিজিৎ, উঠে দাঁড়ায় আস্তে আস্তে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় গেটের দিকে, ফিরে তাকানোর মত আর সাহস ছিল না তার, ফিরে আসারও না। পিছনে জীবন্ত শবের মত বসে থাকে তার প্রাক্তন প্রণয়ী। নিভু সন্ধ্যার আলোতে লেকের চারপাশটা ফিকে হয়ে আসে। কেউ ফিরেও তাকায় না ফাঁকা বেঞ্চিটায় তুমুল অদৃশ্য ঝড়ের মধ্যে বসে থাকা একলা আত্রেয়ীর দিকে।
![]() |
| বিন্যাস : নিজস্ব |
#bengalishortstories #drama #lovestories #romanticstories #sadstories #separation










