আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের টিপটা ঠিক করে নেয় প্রান্তিকা। ভালো করে নিজের মুখটা দেখে নেয় বারকতক। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শাড়ির কুঁচি আর আঁচলটা সমান করতে থাকে সে। আজকের দিনটা ভীষণ ইম্পরট্যান্ট। কোনোভাবেই আজকের দিনে যেন খুঁত থেকে না যায় কোনোখানে। শিফন শাড়ির ভাঁজে আঙ্গুল চালিয়ে পরিপাটির চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে সে যত্ন করে। আনন্দ আর উত্তেজনায় জ্বর জ্বর ভাব লাগে যেন শরীরের ভেতর। আজ যে তার বিশেষ বন্ধুর সাথে অফিসিয়াল ডেটে যাওয়ার দিন।
মধ্যবিত্ত হলেও সচ্ছল পরিবারে মানুষ হয়েছে প্রান্তিকা। তবুও একবিংশ শতাব্দীর চৌকাঠে এসে তাকে হোঁচট খেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। সম্পর্কটা অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেননি প্রান্তিকার বাবা মা কেউই, সে যতই তাঁরা আগের থেকে আন্দাজ করতে পারুন না কেন। শেষটায় রাজি হয়েছেন একরকম অনন্যোপায় হয়েই। প্রান্তিকার অফিসের সিনিয়র কলিগ। অন্য ডিপার্টমেন্ট হলেও কাজের সূত্রে কথার লেনদেন, আলাপ, ভালোলাগা ও পরবর্তীকালে প্রেম হয়। আগাগোড়াই মিতভাষী প্রান্তিকা এক অপার্থিব আবেশে আকর্ষিত হয়েছিল তার সহকর্মীর নিয়মবহির্ভূত দৃষ্টিভঙ্গিতে। জীবনের সরলরেখায় পা মেপে পথ চলায় যার প্রবল অনীহা, সমাজের শিকড়ে বাসা বেঁধে থাকা নিয়মাবলী যে দূরে নিক্ষেপ করে প্রতি মুহূর্তে, এহেন মানুষের সংস্পর্শে এসে যেন প্রাণ পেয়েছিলো বছর চব্বিশের তরুণী প্রান্তিকা। সম মনোভাবের মানুষকে পেয়ে সে ঠিক করে নিয়েছিল যদি গাঁটছড়া বাঁধতে হয় তাহলে এর সাথেই বাঁধবে, বাবা মা র পছন্দ করা বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ পাত্রের সাথে নয়। তার মনের মানুষ অবশ্য তাকে সাবধান করেছিল অনেক আগেই, লৌকিকতার কাঁটাতারের জ্বালা মনে করিয়ে দিয়েছিলো বারেবার। কিন্তু প্রান্তিকাকে নিরস্ত করা যায় নি। কোনো এক সন্ধের লঞ্চঘাটে আশমানি চাঁদের আলো ও রুপোলী নক্ষত্রদের সাক্ষী রেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল, 'তোমার আপত্তি নেই তো' ? মৃদু হেসে পরম আদরে তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল তার সিনিয়র সহকর্মী। মাথায় নরম আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলেছিলো, 'সামনের বুধবার, চল্ আমরা অফিসিয়াল ডেটে যাই, তোকে নিয়ম মেনে, যাকে বলে একেবারে অফিসিয়ালি প্রপোজ করব'।
আজ সেই দিন। ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ যায় প্রান্তিকার। আর একটু বাদেই সে আসবে। ত্রস্ত হাতে চুল বাঁধতে থাকে সে। পাশের ঘর থেকে পায়ে পায়ে দময়ন্তী এসে দাঁড়ান ড্রেসিং টেবিলের পাশে। আলতো স্বরে বলেন, 'তুই কিন্তু আরেকটিবার ভেবে দেখতে পারতিস, বড্ডো তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না কি' ? প্রান্তিকা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, 'আমি তো অপরাধ কিছু করছি না মা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্য করে তুললে যখন, তখন সেই সিদ্ধান্তটাই নিতে দাও। তোমরা তো আমাকে সুখী করতে চেয়েছিলো। বিশ্বাস করো আমি সুখ খুঁজে পেয়েছি। শুধু এটুকুই বলার, তোমরা আমার পাশে থেকো, আগের মতোই '। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দময়ন্তী। চিরুনিটা নিয়ে প্রান্তিকার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলেন, 'তোর কি আজ দেরি হবে আসতে' ? 'না, খুব বেশি হবে না, তবে তোমরা খেয়ে নিও', আস্তে আস্তে বলে তাঁর একমাত্র কন্যা।
নিচে গাড়ির হর্ন বাজে। পর্দার আড়াল সরিয়ে জানলা দিয়ে নিচে তাকায় প্রান্তিকা। চাপা উত্তেজনায় ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, 'আমি তাহলে আসি' ? ঠোঁটে আলগা হাসি ঝুলিয়ে সামান্য ঘাড় কাত করেন দময়ন্তী। মাকে একপলক জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে যায় সে। সদর দরজা খুলে দেখে ইস্পাত রঙের সিডান গাড়িটা অপেক্ষা করছে একেবারে দোরগোড়ায়। পিছন ফিরে মুখ তুলে তাকায় সে। দক্ষিণের জানলায় বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁ হাতটা জানলার কাঁচের ওপর পাতা। দূর থেকে আশীর্বাদের মতো মনে হয় যেন প্রান্তিকার। বিড়বিড় করে বলে, 'আমার প্রণাম নিও' । তারপরেই ঘুরে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে উঠে পড়ে সে। ড্রাইভারের সিটে রূপকথা তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। গোধূলি রঙা কুর্তিতে পরীর মতো দেখতে লাগছে সহকর্মীকে। রূপকথা চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কি রে ? সব ঠিক আছে তো'? প্রান্তিকা ঘাড় নাড়ে। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে রূপকথা বলে, 'বেশ, আজ তাহলে তুই বল, কোথায় যাবো.......? প্রান্তিকা সলাজ গলায় বলে, 'লঞ্চঘাট.......... ' ।
![]() |
| ছবি : গুগল |
#bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories #love #romance #drama





