Thursday, November 30, 2017

বন্ধু চল # ২

ছবি : সৌম্য 
কয়েকদিন যাবৎ দুদিক থেকেই ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিল। টিপ্ করে কেউই একটা কমন ডেট লাগাতে পারছিলুম না। শেষমেষ 'দুত্তোর নিকুচি করেছে' বলে একটা শনিবার তাক করে জুতো মোজা পড়ে দুজনেই ফুলবাবুটি সেজে বেরিয়ে পড়লুম। অবশ্যি যাবার আগে কেউই তেমন বাড়িতে বলে বেরোতে পারিনি ঠিক কোথায় যাচ্ছি। কারণটা পরে বলছি। 'চললাম, ফিরতে দেরি হবে' বলে কতকটা বুক চিতিয়ে কুচকাওয়াজের ঢঙে বেরিয়ে পড়েছিলাম শহরের দক্ষিণ দিক বরাবর। এটা অনেকটা আমাদের এক পুরোনো স্কুল বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরোনোর মতো।  বিকেল বেলায় 'মা, একটু বেরোচ্ছি'... বলে সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে রাঁচি এক্সপ্রেস ধরে এক্কেবারে বিহার চলে গিয়েছিলো সে। পাক্কা হপ্তাখানেক পর বাড়ি ফেরাতে তার বাবা বাঁজখাই গলায় বলেছিলেন, 'যেখানেই যাও না কেন তোমার বডি আমার চাই, রোজগার করতে না পারো তোমার ইন্সিওরেন্সের টাকাতে সংসারের হিল্লে হবে অন্তত কিছুটা'। তবে এক্ষেত্রে ততটা দুঃসাহস দেখানোর মতো বুকের পাটা ইদানীং কালে আমাদের কারোরই হয় নি। ঘর সংসারের নাগপাশে যাঁরা বন্দী হয়ে উইকেণ্ডের ছুটিতে দুদণ্ড নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পান না তাঁরা বুঝবেন নিশ্চই। সে যাগ্গে.....

ছবি : নিজস্ব 
টালিগঞ্জের গাছতলা স্টপেজে যখন দুজনে দেখা করলুম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটা ছুঁয়েছে। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঝিলমিলে রোদের ফাঁকে দুজনেই নিরুদ্দেশের ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছি প্রাণপণে। কিছু না পেয়ে, দোনোমোনো করে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা চললুম বারুইপুরের দিকে। সেখানে গিয়ে কোথায় যাব, কি করব তেমন সম্যক ধারণা দুজনের কারোরই ছিল না। বারুইপুর পৌঁছে আমার খেয়াল হল আমি প্রায় কোনো টাকাপয়সা না নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। 'ওরে ও বাউল শোন, মণিকাঞ্চনে  নাহি মন '.......  অতএব চটজলদি একটা এটিএমের সামনে দাঁড়াতে হল। খানিক বাদে রাস্তা পেরিয়ে যখন বন্ধুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালুম তখন সে বললে, 'বুঝলি, একটা কাজ করা যেতে পারে। এদিক ওদিক না ঘুরে চল ডায়মন্ড হারবার চলে যাই। এখান থেকে ঘন্টা আড়াইয়ের পথ হবে। এখন সাড়ে বারোটা বাজে, তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাব, তারপর কোথাও একটা লাঞ্চ করে গঙ্গার পারে বসে একটু আড্ডা মেরে ফিরে আসব। কি বলিস' ?

এমন অবাক করা কথায় আমিও অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারলুম না সেই সময়। ডায়মন্ড হারবার !! কলকাতার বাইরে অন্য সমস্তরকম রাস্তা আমার কাছে পার্ল হারবারের সামিল। ঢোঁক গিলে বললুম, 'তুই রাস্তা চিনিস' ? কোনোরকম কুন্ঠা না রেখে সে বললে, 'নাহ, জিজ্ঞেস করতে করতে চলে যাব, অসুবিধে হবে না'। কালক্ষেপ না করে বললুম, 'চল তবে'...........'বাহির হয়েছি  আজ, কিসের শরম, কিসের লাজ  '......

ছবি : নিজস্ব 
অতএব একের পর এক তেপান্তরের পথ অতিক্রম করে আমাদের দু চাকার পক্ষীরাজ উড়ে চলল। মাঝে একটা স্টেশন পেরোলাম। নামটা ভারী মায়াময়  - 'কৃষ্ণমোহন'। জায়গাটা বেশ ঘুম জড়ানো। শান্ত, ধীর স্থির। শহরের ক্যাকোফোনি থেকে কয়েক যোজন দূরে। নামের সাথে তাল মিলিয়ে যদি সেখানে মোহনবাঁশির রাগ শুনতে পেতুম বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হতুম না। সে চত্ত্বরের আশেপাশে বিশেষ জনবসতি নেই। একটা পুরোনো চায়ের দোকান আর কয়েক হাত দূরে দূরে গোটা কয়েক মাটির ঘর। দুরন্ত হাঁস মুরগির পায়ের ছাপে দুপুর গড়ায় সেখানে। পল্লী বাংলার আদি অকৃত্রিম চিত্রপট। খানিক এগিয়ে একটা ডাবওলাকে দেখে বাইক দাঁড় করানো হল। টলটলে মিষ্টি জলে প্রাণ জুড়িয়ে গেল একেবারে। দু চারটে ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললুম সামনে। যাবার আগে রুটটা জিজ্ঞেস করেছিলুম একজনকে। বলল, 'পঁচিশ কিলোমিটার নাক বরাবর এগিয়ে যান, বিষ্ণুপুরের আগে আর কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার পড়বে না'। 'আজ হারিয়ে যাবার মন , অত শুধোবার কি প্রয়োজন '.........অগত্যা....... 

ছবি : নিজস্ব 
জয়নগর পেরিয়ে যে মনভোলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছিলাম তার ভুবনমোহিনী রূপ চোখে না দেখলে দু চার কথায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। দু দিকে বট, অশ্বত্থ আর মেহগনি গাছের অনুষ্টুপ সারি। একদিক থেকে আরেকদিকে ঝুঁকে পড়ে যে যার মতো জড়াজড়ি করে পথের ওপর আলোছায়ার আলপনা তৈরী করেছে। সে ছায়াপথের একদিকে দিগন্ত জোড়া মাঠ আর ক্ষেতের সবুজ হাতছানি আর অন্যদিকে একফালি লম্বাটে ডোবা সোজা চলে গেছে দূরের থেকেও দূরে। সেই ডোবার ওপর থোকা থোকা পানিফলের আগাছা ভেসে রয়েছে দ্বিপ্রহরের সূর্যের দিকে চেয়ে। দু চার গজ অন্তর যেখানে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে আগাম শীতের জানান দিচ্ছে। দেরি না করে নেমে পড়লুম সেখানে। একটানা জার্নির ধকল উধাও হল মুহূর্তে। শরীরের আনাচে কানাচে বয়ে গেল হেমন্তের মিঠে পশমিনা হাওয়া। বদ্ধ শহরের আগল খুলে খোলা হাওয়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম দুজনে। খানিক্ষন রাস্তার ধারে গুলতানি করে আবার এগিয়ে চললুম। সামনে বিষ্ণুপুর। ...... 'এ পথের নেই শেষ, আমার বাংলা, এই আমার দেশ '...... 

ছবি : নিজস্ব 
আরও মিনিট কুড়ি চালিয়ে বিষ্ণুপুর পৌঁছে ডানদিক নিয়ে সোজা এগিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়লাম। মাথার ওপর মেঘের নীল পেরিয়ে চলেছি একের পর এক। কালো রাস্তার পিচে আমাদের নাছোড়বান্দা ছায়া আঁকা হয়ে চলেছে সমানতালে। আলটপকা সুরে গেয়ে উঠছি কখনো কখনো.......ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি........ দেখতে দেখতে বহুদূরে চোখের সামনে ঝলসে উঠলো সহস্র রুপোলি আলো। ঈষৎ কম্পমান নদীর জলে সূর্যের রশ্মি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গার পার বাঁদিকে রেখে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম ডায়মন্ড হারবারের বুকে। বাইক স্ট্যান্ড করেই দৌড়ে গেলাম পারের ধারে। ডানদিক বাঁদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু জল। নদীর অন্য প্রান্তে হলদিয়া পোর্টের আবছায়া রেখা দেখতে পেলুম। তার কিছুটা আগে একটা জাহাজ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। নোঙর ফেলে দিনবদলের অপেক্ষা করছে যেন। জোয়ারের মৃদু দুলুনিতে জলের সাথে ভাটিয়ালি আলাপ জমাচ্ছে বোধহয়। বেশিক্ষন দাঁড়ালাম না কারণ খিদে পেয়েছে জোর। 'দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, খালিপেট আর নাহি সয় '.......

ছবি : সৌম্য 
যেতে যেতে মালুম হয়নি তিনটে বেজে গেছে অনেক্ষন। বিনা বাক্যব্যয়ে উল্টোদিকে সাগরিকা হোটেলের পথে পা বাড়ালুম। যা অর্ডার দিয়েছিলুম তাতে করে এমনি সময় আরও একজনের খাওয়া হয়ে যেত। ভাত, সোনামুগের ডাল, ঝিরঝিরে আলুভাজা, আলুপোস্ত, পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় এরা কেউই পাতে পড়ার সময় পেল না। আসার মিনিট পনেরোর মধ্যেই উড়ে গেল সেসব। তার সাথে চলল দেদার আবোলতাবোল কথা, অযৌক্তিক ফাজলামো ও প্রাণখোলা হাসি। মৌরি চিবোতে চিবোতে আরও একদফা পারে গিয়ে বসলুম দুজনে। একটা নিরিবিলি বটতলার বেদির নিচে আয়েস করে বসে বসে দেখতে লাগলুম একদল জেলেদের মাছ ধরা। দু একবার খালি জাল ওঠার পর তাদের সাথে সাথে আমরাও আফসোস করতে লেগেছিলুম খানিক।পশ্চিম আকাশে তখন বকের ডানায় সন্ধ্যা নামছে পা টিপে টিপে। এবার ফেরার পালা। একবুক তৃপ্তি আর ভালোলাগা নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলুম আবার। ডায়মন্ড হারবার রোডের অন্ধকার পেরিয়ে কখন যে কলকাতা এসে পৌঁছলুম টেরও পাইনি। 

এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে সফর করে এলাম, সঙ্গী করে নিয়ে এলাম ফেরারী মন আর মুঠোভর্তি বেঁচে থাকার কারণ। দুজনে পণ করলাম, আসছে মাসে আবার......... কিন্তু কোথায় ? আজ্ঞে কত্তা, জানিতে চাহিয়া লজ্জা দিবেন না....... 

কৃতজ্ঞতা : সৌম্যর বাইক - ১০০ কিমির বেশি চলেছিল সেদিন ।

ছবি : নিজস্ব 
 #bengaliarticle #bengalitravelstory #diamondharbourtour    

Thursday, November 23, 2017

কার্ত্তিক শীল

ছবি : নিজস্ব 
উপরোক্ত নামটি কোনো রক্তমাংসের মানুষের নয়। অকপট ভক্তি, স্থির বিশ্বাস ও গভীর শ্রদ্ধার নামান্তর মাত্র। যুগ যুগ ধরে সমস্ত পৌরাণিক উপচার ও নিয়মবিধি মেনে পূজিত হচ্ছেন যিনি, তাঁকে অধিকাংশ সময়েই বাড়ির চৌকাঠে ফেলে রাখা হয় সুসন্তান লাভের আশায়। অনেকেই হয়ত জানেন না, অবহেলা অনাদরের ঠাকুরটি কিন্তু রীতিমতো খাস জমিদারি কায়দায় পূজিত হন পশ্চিমবঙ্গের এক বিশেষ জায়গায়। 'চুঁচুড়ার শীলবাড়ি' - এই নাম বললে সে তল্লাটে একডাকে লোকে বাড়ি অবধি চিনিয়ে দিয়ে যাবে। যদিও চুঁচুড়ার অন্যান্য জায়গায় কার্ত্তিক পুজো মহা আড়ম্বরেই হয় তবু জৌলুশ ও প্রাচুর্যে কামারপাড়ায় বিখ্যাত বনেদী শীলবাড়ির পুজো একাধারে বর্ণাঢ্য এবং ঐতিহাসিক। তিনশো বছর ধরে যার বৈচিত্রের প্রতিফলন বাড়ির সমস্ত সদস্যদের হৃদয়ে কোহিনূরের মতো উজ্জ্বল।

ছবি : নিজস্ব 
চুঁচুড়া স্টেশন থেকে নেমে প্রথমে টোটো বা অটো স্ট্যান্ডে আসতে হবে। ফুরফুরে দূষণহীন যাত্রার জন্য টোটো যানটির বিকল্প নেই । সেইটে চড়ে একেবারে শীলগলির মুখে নামবেন, তেমন তেমন হলে বাড়ির সিংদরজায় গাড়িবারান্দার তলাতেও নামিয়ে দিতে পারে। পেরেক পোঁতা ভারী সবুজ কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে আপনি এসে দাঁড়াবেন এক মনকেমন করা উঠোনের একেবারে মাঝ মধ্যিখানে। যে উঠোনে অনায়াসে একটা চার পাঁচতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে চারকোনা জায়গা জুড়ে। তারপরেও যেটুকু জায়গা অবশিষ্ট থাকবে তাতে করে মনের মতো একটা বাগান সাজিয়ে নেওয়া কঠিন কিছু হবে না, এমনই তার ব্যাপ্তি। ওপরে তাকালে খোপকাটা চৌকো আকাশের আলো চুঁইয়ে পড়বে আপনার গায়ে। 

ছবি : নিজস্ব 
মুখ ঘুরিয়ে পূর্ব দিকে যদি দেখেন তাহলে লাল টুকটুকে শান বাঁধানো গোটা আষ্টেক সিঁড়ি পাবেন। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে এক ফুঁয়ে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাবে আপনার ফেলে আসা শহর, যানজট আর দূষণের অবিমিশ্র কোলাহল। মুখোমুখি এসে দাঁড়াবেন কয়েকশো বছরের পুরোনো ইতিহাসের দোরগোড়ায়। সেখানে ফিসফিস করে সংলাপ বলে চলে আদি বাংলার ইতিবৃত্ত। নকশা কাটা দেওয়াল ও খিলান দেওয়া ঐরাবতীয় স্তম্ভের নিচে একটা প্রশস্ত ঠাকুরদালান লম্বালম্বি শুয়ে থাকে যা আড়ে বহরে প্রায় রাখালিয়া মাঠের সমান। তার ঠিক মাঝামাঝি পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ঝলমলে বাদশাহী পোশাক পরিহিত পনেরো ফিটের উঁচু 'রাজা কার্তিক'। শীলবাড়ির আরাধ্য দেবতা, সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বিশ্বস্ত সঙ্গী ও মহলের একনিষ্ঠ রক্ষক। 

ছবি : সৌরভ শীল 
এই বাড়িতে প্রথম পুজো চালু করেন শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র শীল। তখন বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে ঘাঁটি গড়েন এই চুঁচুড়া শহরে। শুরু করেন রাজবেশী কার্ত্তিকের আরাধনা। বংশপরম্পরার হাত ধরে একবিংশ শতকে এসেও যার অন্যথা হয়নি বিন্দুমাত্র। এক বিরাটকায় ময়ূরের ওপর আসীন হয়ে রাজকীয় ঢংয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটানা পূজিত হয়ে চলেছেন এই ধনুর্ধারী রাজা।

তাঁর গৌরবর্ণ, সৌম্যকান্তি মুখের দিকে তাকালে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, খেয়াল থাকে না কোনোরকম সময়ের বা পিছুটানের। মনে হয় ঠাকুরদালানের একপাশে জায়গা করে দিলে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে সে নির্মলমূর্তির সামনে। বাড়ির খিড়কি দুয়ারের পুকুরে যখন সূর্য ডোবে তখন দালান জুড়ে গড়িয়ে পড়ে সোনালী আলোর মূর্ছনা। জোড়া ঢাক, কাঁসর আর ঘন্টার প্রতিধ্বনিতে সে বাড়ি জেগে ওঠে অতীতের মাটি ফুঁড়ে, শুরু হয় রাজবন্দনার উৎসব। গোটা শীলবাড়ি প্রাঙ্গন মূর্ত হয়ে ওঠে দৈবিক অবয়বে। প্রায় দুশো আড়াইশো মানুষ জমা হয় এই মিলনমেলায়, একে ওপরের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গনে সম্পর্কের ওম জড়ায় শরীরে। তাঁদের আপ্যায়নের মাধুর্যে ও আন্তরিকতার স্পর্শে হৃদয় গলবে কখন আপনি টেরও পাবেন না। শুধু মনে হবে এই সাতপুরুষের ভিটেয় ইতিহাসের ছবিটা বরং গোপন থাকুক, ঠিক এমনি করেই, তবেই বোধহয় প্রকৃত পুজো হবে প্রচারের আড়ালে, দেবতার উপস্থিতিতে।



ছবি : নিজস্ব 
আদিগন্ত বিস্তৃত এজমালি ছাতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যতক্ষণে সন্ধ্যে নামে ততক্ষনে হয়ত আপনি স্টেশন পৌঁছে যাবেন। টানা দুদিনের আনন্দোল্লাসের পর যখন ফিরে আসবেন তখনও আপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনশো বছরের সোঁদা গন্ধ লেগে থাকবে আবার ফিরে আসার অপেক্ষায়, যেমন করে শীলবাড়ির প্রতিটি মানুষ অপেক্ষা করেন প্রত্যেক বছর। যাঁরা চুঁচুড়া গেছেন বা যাননি তাঁদের বলব কার্ত্তিক মাসের শেষ দিনটা একবার অন্তত নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে আসুন। এমন  নয়নাভিরাম সাবেকী উন্মাদনা পশ্চিমবঙ্গের বুকে খুব কমই বেঁচে আছে। আপ্যায়নের কোনোরকম ত্রুটি ঘটবে না এটুকু বলতে পারি, কারণ শ্বশুরবাড়ির অভ্যর্থনা চৌকাঠে আমিও দাঁড়াই।


ছবি : নিজস্ব 

#bengaliarticle #kartikpuja #chuchurasilbari #silbarirkartikpuja




    

Tuesday, November 14, 2017

সাপ্তাহিকী - ৩৩ # ডাবলস পার্টনার

গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে থমকে দাঁড়াল অর্জুন। ইদানীং সাড়ে পাঁচটাতেই সন্ধ্যে নেমে আসছে। পশ্চিম আকাশে মরিচগুঁড়োর মতো ধূসর রং জমেছে। বৃষ্টি হবে নাকি ? এই হেমন্তের শুরুতেই অকালবর্ষণ হয়ে গেছে একদিন। আজও যদি বৃষ্টি হয় তাহলে খেলাটা মাটি হবে একেবারে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে ফ্লাইওভারের তলায় পার্কিং স্পেসটাতে এসে দাঁড়ায়। পলাশ আর সুমন এসে গেছে ততক্ষনে। অর্জুনকে দেখতে পেয়েই দুজনে প্রায় একসাথে বলে উঠল, 'কিরে, দেরি করলি যে' ? পলাশের মুখের দিকে তাকিয়ে অর্জুন একটু ধমক দিয়ে বলে, 'তোদের মতো কি আর আরামের চাকরি রে ভাই, যে বললেই টুক করে বেরিয়ে পড়ব ? সাতঘাটের কাজ নামিয়ে তবে আসতে হল'। সুমন সুর করে বলে, 'আহা ! চটছ কেন বরফি ? বৃষ্টি টিষ্টি আসতে পারে তাই আর কি'.......।

অর্জুন একটা বেঞ্চের ওপর কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'অনুপমদাকে দেখছি না তো ? কোথায় সে ? আসেনি এখনো' ? পলাশ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, 'আরে অনুপমদাকে তো কখন থেকে ফোন করছি, ধরছেই না। কি ব্যাপার কে জানে' ? সুমন অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলে, 'দ্যাখগে আবার ডুব মারল কিনা। না এলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে'। অর্জুনের চোখে সন্দেহ ঘনায়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বলে, 'আমি দেখি একবার ট্রাই করে, তোরা ততক্ষনে বোর্ডটা বার কর'।

গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের নিচে ক্যারাম প্লেয়ার্স এসোসিয়েশনের মেম্বার অর্জুন, পলাশ, সুমন, অনুপম এবং আরও অনেকে। প্রত্যেক সন্ধ্যেবেলা নিয়মিত খেলা হয় সেখানে। ছটা থেকে নটা। পার্কিং স্পেসটার ডানদিকে একটা উঁচু চাতালের ওপর দুটো বোর্ড সাজানো হয়। সন্ধ্যের দিকে বেশ বড় একটা জমায়েত হয়। যারা নিয়মিত খেলে তারা তো থাকেই এছাড়া দর্শকের সংখ্যাও নেহাত মন্দ হয় না। সবমিলিয়ে বেশ একটা জমজমাট আসর বসে। আসছে শনিবার টুর্নামেন্ট আছে। কয়েকদিন আগেই এনাউন্স হয়েছে। দুদিকে দুটো ফ্লেক্সও টাঙানো হয়েছে। পথচলতি ক্যারাম আগ্রহীদের কাছে এটা একটা বিষয় বটে। প্লেয়াররা রীতিমত সিরিয়াস। এর মধ্যে প্রায় প্রতিদিন ওয়ার্ম আপ ম্যাচ আছে। ডাবলসে যে যার জুটির সাথে নিয়মিত প্রাকটিস করছে। যারা ভালো খেলে অর্জুন তাদের মধ্যে অন্যতম। বুদ্ধিদীপ্ত খেলায় ইতিমধ্যেই সে বাহবা কুড়িয়েছে সবার। সিঙ্গল শট এঙ্গেল হোক বা ডাবল শটের কাট, অর্জুনের মতো শিল্পী হাতের তালিকা নামমাত্র সেখানে। একমাত্র সম্রাট আর মোহিতই আছে যারা অর্জুনকে টক্কর দিতে পারে সমানে সমানে। তারাও আসন্ন টুর্নামেন্টের আঁচে সেঁকে নিচ্ছে নিজেদের। সকলে বলাবলি করছে সম্রাট - মোহিত আর অর্জুন - অনুপম এর মধ্যেই ফাইনালটা হবে। এহেন মোক্ষম সময় অনুপম ফোন তুলছে না।

ভারী বিরক্ত হয় অর্জুন। ফোনটা কেটে রিডায়াল করে। বেশ কিছুক্ষন রিং হবার পর ওদিক থেকে মহিলা কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়।

- হ্যালো ?
- হ্যালো, কে বৌদি ? অর্জুন বলছি....
- ওহ অর্জুন ! বলো কি ব্যাপার !
- অনুপমদাকে একটু দেবে ? অনেক্ষন থেকে ট্রাই করছি, পাচ্ছি না......
- তোমার অনুপমদার তো অবস্থা খারাপ, ফোন তুলবে কি ! সে তো বিছানায় শুয়ে আছে....
- সেকি !! কেন কি হয়েছে ??
- তিনদিন ধরে জ্বর, আজ সকালে ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট পেয়েছি - ডেঙ্গু !
- বলো কি !! ইস্সসস ! এ যে একেবারে কেলেঙ্কারি হল !
- আর বলো কেন ? তোমার অনুপমদার ঠেলায় সংসার মাথায় উঠেছে আমার।
- আচ্ছা, প্লেটলেট কি খুব কমে গেছে ?
- নাহ, ওটা মোটামুটি ঠিকই আছে, তবে জ্বরটা কমছে না মোটে। ডাক্তার বলেছে দিন পনেরোর আগে বিছানা ছেড়ে ওঠার কোনো প্রশ্নই নেই।
- ওহ ! আচ্ছা বেশ, আমি নাহয় কালকের দিকে যাব একবার। কোনো প্রয়োজন হলে বোলো কিন্তু.......

দুচারটে টুকটাক কথা সেরে ফোন কেটে দেয় অর্জুন। শুকনো মুখে ফিরে আসে চাতালটার দিকে। সুমন সে দিকে তাকিয়ে বলে, 'কি রে, অনুপমদাকে পেলি ? আসছে' ? অর্জুন হতাশ হয়ে বলে, 'নাহ, অনুপমদার ডেঙ্গু হয়েছে, পনেরো দিনের জন্য গ্যারেজ' ।

- য়্যাঁ !! সে কি রে ?? তাহলে ?

অর্জুন বিড়বিড় করে বলতে যায়, 'তাহলে আর কি, আমার হাতে তো আর কিছু..........' । কথাটা শেষ করতে পারে না। উল্টোদিক থেকে মোহিত আর সম্রাট হৈহৈ করে এগিয়ে আসে। মোহিত বলে, 'তাহলে তো তোর হাতে হ্যারিকেন অর্জুন' ! একথায় সম্রাট খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে। বলে, 'ট্রফিটা ফস্কে গেল হে অর্জুন, এই শেষ সময় পার্টনার ডুব ? হরি হে মাধোবো, চান করব না গা ধোবো' ! একথায় আশেপাশের সমস্ত লোকজন খলখলিয়ে হেসে ওঠে।

গা জ্বলে যায় অর্জুনের। পায়ে পায়ে নিজেদের বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখেচোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। পলাশ জিজ্ঞেস করে, 'ভাই, কি করবি এবার' ? অর্জুন এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। আশেপাশের তীব্র হর্নের শব্দে তার কানে যেন ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে একনাগাড়ে। টুর্নামেন্টটা কি তাহলে সত্যিই ফস্কে গেল ? অনুপমদার দাঁড়ানোর উল্টোদিকে ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। ডাবলস পার্টনারের অনুপস্থিতিটা ঘুণপোকার মতো কুড়তে থাকে ভিতরে ভিতরে। সন্ধ্যে ঘন হয়ে জমাট বাঁধে।

'আচ্ছা এখানে মেম্বার হতে গেলে কি করতে হয়' ?

এক অতর্কিত নারীকন্ঠের প্রশ্নে সকলেই হতচকিত হয়। অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একজন তেইশ চব্বিশ বছরের শ্যামলা তরুণী তার দিকেই তাকিয়ে আছে বড়বড় চোখ করে। যেন প্রশ্নটা সে অর্জুনকেই করেছে। সে চোখের দিকে তাকিয়ে থতমত খায় অর্জুন। পরক্ষনেই সুমনকে ইশারা করে ব্যস্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সুমন তৎক্ষণাৎ গলায় কপট গাম্ভীর্য এনে বলে ওঠে, 'এককালীন রেজিস্ট্রেশন ফিইজ আছে, এছাড়া মাসে মাসে একটা মেম্বারশিপ ফিইজ দিতে হয়, এই, এছাড়া আর কিছু নেই'। পলাশ মাতব্বরের মতো জিজ্ঞেস করে, 'কে খেলবে ? ভাই না বয়ফ্রেন্ড' ?

তরুণী নিঃশব্দ থাকে কিছুক্ষন, তারপর ধীরে ধীরে বলে, 'আমি' !

বোম ফাটার মতো আওয়াজ করে কাছেই কোথাও একটা ট্যাক্সির টায়ার বার্স্ট হয়। কিন্তু সে আওয়াজ ছাপিয়ে অপিরিচিতা তন্বীর আত্মবিশ্বাসের স্বর ছড়িয়ে পড়ে চারিপাশে। অর্জুনদের বোর্ড তো বটেই তাদের পাশের বোর্ড থেকেও লোকজন উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকে এদিকে। অর্জুন, সুমন আর পলাশ গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে থাকে তরুণীর দিকে। সুমন অপার বিস্ময়ে বলে, 'আপনি' !!??
অপরিচিতা ততধিক ঋজু ভঙ্গিমায় বলে, 'হ্যাঁ আমি। কেন, মহিলা মেম্বার হওয়া যায় না ? নাকি, হলে আপত্তি আছে ? অর্জুন অস্ফুটে বলে, 'না, তা নেই বটে, তবে আমাদের মহিলা মেম্বার কেউ হয়নি এখনো অবধি। আপনারই অসুবিধে হতে পারে'।

তরুণী স্মিত হেসে বলে, 'না না, তাতে আমার কোনো অসুবিধে নেই'।
অর্জুন ঘাড় নেড়ে বলে, 'বেশ। তাহলে ওই দিকটায় এগিয়ে যান, সুবিমলদা বলে একজন বসে আছেন, উনিই মেম্বারশিপটা দেখেন, ওনাকে গিয়ে বলুন, উনিই বলে দেবেন কি কি করতে হবে'।
'ধন্যবাদ' , বলে তরুণী এগিয়ে যায় সুবিমলদার দিকে। পলাশ আর সুমন একঠায় চেয়ে থাকে ব্লু জিন্স আর ধূসর টপ পরিহিতার দৃঢ় পদক্ষেপের দিকে। অর্জুন ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়। বলে, 'আঃ কি ক্যাবলার মতো চেয়ে আছিস তোরা ? মেয়ে দেখিসনি নাকি আগে' ?

পলাশ স্বগতোক্তির ঢঙে বলে, 'দেখেছি গুরু, কিন্তু লেডি ক্যারাম প্লেয়ার তো তেমন দেখিনি আগে' ! সুমন হাহা করে হেসে ওঠে। অর্জুনও ফিক করে হেসে বলে, 'ওসব কিচ্ছু না রে পলাশ, এ হলো হুজুগ। আজকাল সব নানারকম ট্রেন্ড হয়েছে কিনা। রাজকন্যের খেয়াল হয়েছে গড়িয়াহাটের মোড়ে ম্যাচ বোর্ডে একটু আঙ্গুল ঘষবে, এই আর কি। অমন আনকোরা আঁতেল আমি ঢের দেখেছি। দুদিন যেতে দে, পাখি নিজেই উড়ে যাবে'। পলাশ আর সুমন একযোগে হেসে ওঠে। সন্ধ্যের ক্যাকোফোনির সঙ্গতে স্ট্রাইকার আর ঘুঁটির সঙ্গীত জমে ওঠে দারুণ। খেলা চলতে থাকে পরের পর। আজ অনুপম না আসায় অর্জুন অন্য একজন মেম্বারকে নিয়ে খেলতে থাকে। পলাশ আর সুমন যথারীতি পার্টনার।
বেশ কিছুক্ষন পর আবার সেই নারীকন্ঠস্বর পাওয়া যায়।

- রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে আমার....

অর্জুন ডান দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। প্রত্যুত্তরে একটা 'বাহ্' বলে নিজের বাঁ দিকে একটা লাইন ঘেঁষা বেস খেলতে লাগে সে। সুমন একবার পলাশের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, 'কার্ড পেয়েছেন তো ? কবে থেকে খেলবেন তাহলে' ? মেয়েটি তার উত্তরে বলে, 'না, কার্ডটা কাল দেবেন বলেছেন সুবিমলদা। আর বললেন সুযোগ হলে আজ থেকেই খেলতে পারি'। পলাশ বলে উঠল, 'ওহ ! এতো দারুন ব্যাপার'। কথাটা শেষ হতে না হতেই অর্জুনের ওপরের একটা কোণাকুণি এঙ্গেল মিস করে ফেলল। ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, 'অাহ্ পলাশ ! গল্পই যদি করবি তো সাইডে গিয়ে কর। খেলার সময় ভীষণ ইরিটেটিং লাগে এসব'। সুমন সেটা লক্ষ্য করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করেই বলল, 'তা আপনি যদি চান আজই খেলতে পারেন, মানে এই বোর্ডেই'। অর্জুন ক্রুদ্ধনেত্রে তাকাল সুমনের দিকে। সুমনের মুখেচোখে একটা ফিচেল চাপা হাসি খেলে যায়। অনাহূত তরুণী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, 'না না আপনারা তো একটা গেম খেলছেন, ওটা শেষ হোক আগে.....তারপর না হয়..........'
খেলা চলতে লাগল নিজস্ব নিয়মে।

মিনিট চল্লিশেক বাদে অর্জুনের প্রায় একার কৃতিত্ত্বে পলাশ আর সুমন গেম খেয়ে গেল। মেয়েটি হাততালি দিয়ে উঠল। চোখে মুখে উচ্ছাস নিয়ে অর্জুনের দিকে ফিরে বলল, 'আপনি তো দারুন খেলেন' ! অর্জুন প্রত্যুত্তরে সামান্য হাসল শুধু। আসলে এই অযাচিত উপস্থিতি সে একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না। বিশেষ করে এই খেলার সময়। ক্যারামটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে অর্জুন। আর এই খেলা ঘিরে কোনোরকম ছেলেমানুষি বা বালখিল্যতা সে পছন্দ করে না একেবারেই। সুমন পলাশের দিকে একবার চোখে চোখে ইশারা করে নিয়ে মেয়েটিকে বলল, 'ইয়ে মানে, আপনি খেলতে পারেন এবার। অনুপমদা মানে অর্জুনের রেগুলার পার্টনার এবসেন্ট। আপনি বরং অর্জুনের পার্টনার হয়েই শুরু করুন'।

উল্টো দিক থেকে মোহিত চেঁচিয়ে বলে, 'অর্জুন কি নতুন পার্টনার পেল সুমন' ? অর্জুন সেকথায় পাত্তা না দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বলল, 'দ্যাখ সুমন, ক্যারামটা ঠিক হাসি ঠাট্টার খেলা নয়, যে যখন তখন যেভাবে খুশি আমায় খেলতে হবে। আমায় বরং আজ মাপ কর। তোরা খেল, আমি যাই'। তারপর মেয়েটির দিকে ফিরে কঠিন সুরে বলল, 'আসলে এই খেলাটা আমি ভালোবেসে খেলি, তাই ঠাট্টা তামাশা করে খেলা আমার দ্বারা হবে না, দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না'।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে বলে, 'দেখুন আপনি যদি না চান, আমি না হয় অন্য একজন পার্টনার নিয়ে খেলব। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কাছেও ক্যারাম খুব পছন্দের খেলা। তাছাড়া আমি আপনার নাম শুনেছি অর্জুনবাবু। তাই আপনার সাথে খেলার ইচ্ছে ছিল, এই আর কি'। একথায় তিনজনেই অবাক হয়ে যে যার মুখের দিকে তাকাতে থাকে। নাম শুনে খেলতে আসার ব্যাপারটা সবার কাছেই বেশ আশ্চর্যের বিষয় মনে হয়। অর্জুন খানিক অপ্রতিভ হয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, 'আমার নাম শুনেছেন ? মানে ?...... ঠিক বুঝলাম না তো '।

'দেখুন গড়িয়াহাট চত্ত্বরে ক্যারাম প্লেয়ারদের মধ্যে আপনার নাম প্রথম সারিতে আসে। আর যেহেতু আমিও খেলাটাকে ভালোবাসি সেই সূত্রেই বলতে পারেন আপনার নাম শুনেছি। আপনার একরকম ভক্ত বলতে পারেন', মেয়েটি মোলায়েমস্বরে উত্তর দিল। অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। ক্যারাম খেলেও যে ফ্যান অর্জন করা যায় এটা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না কিছুতেই। কি বলবে ভেবেই উঠতে পারল না সে। সাময়িক বিরতির পর সুমন বলল, 'বেশ তো অর্জুন, তুই পলাশকে নিয়ে খেল আর আমি নাহয় ম্যাডামকে নিয়ে খেলি। তাহলে হবে তো ? আর তাছাড়া উনি তোর নাম শুনে এসেছেন, তুই না খেললে ভীষণ খারাপ দেখায় তাই না' ? একথায় মেয়েটি করুণ মুখে তাকিয়ে রইল অর্জুনের দিকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কতকটা নিমরাজি হল অর্জুন। এই গেমটা চার বোর্ডের বেশি লাগবে না ভেবে পলাশের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি দাঁড়াল অর্জুনের বাঁদিকে, সুমনের মুখোমুখি। পলাশ প্রায় বিড়বিড় করে বলল, 'এখানে ম্যাডাম যখন আজ প্রথম খেলছেন, তখন আর লাইন করে কাজ নেই, হিটটা বরং উনিই করুন, তাই না ?' সুমন আর অর্জুন ঘাড় নেড়ে সায় দিল। আগন্তুক বলে উঠল, 'আমায় ম্যাডাম বলবেন না প্লিজ, আমার নাম চিত্রা'।

নামটা বেশ শোনা শোনা লাগল অর্জুনের। কিন্তু কোথায় শুনেছে কিছুতেই মনে করে উঠতে পারল না। 'চিত্রা.....চিত্রা....', নামটা বার কয়েক মৌমাছির মতো গুনগুন করতে লাগল মাথার মধ্যে। নাঃ, মনে পড়ছে না একদম। ঝুলন্ত বাল্বের হলুদ আলোয় আনমনা হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। চটক ভাঙল হিটের খ্যাটাক আওয়াজে।

ব্ল্যাঙ্ক হিট করেছে চিত্রা। কোনো পকেটেই ঘুঁটি যায় নি। লজ্জায় লাল হয়ে যায় চিত্রার মুখ। জিভ কেটে বলে, 'আসলে এখানে নতুন তো, এক দুটো বোর্ড লাগবে হাত সেট হতে'। অর্জুন একটা মিহি হাসি ঝুলিয়ে আড়চোখে সুমন আর পলাশের দিকে তাকায়। ভাবটা এমন যে আমি আগেই বলেছিলুম এসব আনকোরাকে নিয়ে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর পাঁচটা ঘুঁটি পরপর পকেট করে অর্জুন। সুমন আর পলাশের দান ঘুরে আবার চিত্রার স্ট্রাইক আসে। ডানদিকের একটা বেস খেলার পর একটা সহজ ইঞ্চি মিস করে চিত্রা। অর্জুনের স্ট্রাইক আসে। রেড সমেত পরপর দুটো ঘুঁটি ফেলে দিয়ে একটা বেস নামায় পলাশের হাতে। সুমন তিনটে ঘুঁটি ফেলার পর পলাশ দান পেয়ে বাকি ঘুঁটি ক্লিয়ার করে বোর্ড শেষ করে। প্রথম বোর্ডে এগারো পয়েন্ট পায় অর্জুন আর পলাশ। চিত্রার মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যায়। প্রথম দিন এসেই নীল গেম খেয়ে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা দেখতে পায় চোখের সামনে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হেসে অর্জুন ঘুঁটি সাজিয়ে হিট করে। জোরালো হিটে রেডশুদ্ধু দুটো সাদা ঘুঁটি পকেটে চলে যায়। এরপর নিখুঁত এঙ্গেলে ঘুঁটি ফেলতে থাকে পরের পর। প্রায় সেঞ্চুরীর মুখে এসে লাস্ট ঘুঁটিটা ভুলবশত মিস করে। সুমন দান পেয়ে চারটে ঘুঁটি ফেলে কোনোরকমে। মিস করার পর পলাশ শেষ সাদা ঘুঁটি পকেট করে। চিত্রা দান পায় না, তার আগেই বোর্ড শেষ হয়ে যায়। দুটো বোর্ড মিলিয়ে মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় একুশ। পলাশ কতকটা মস্করার সুরে চিত্রাকে বলে, 'আপনি কি এই প্রথম ক্যারাম খেলছেন না আগেও খেলেছেন' ?

সুপ্ত খোঁচাটা ধরতে ভুল হয় না চিত্রার। হেসে বলে, 'আমি খেলি মাঝে মাঝে'।
'কোথায় ? উইকেন্ডে বাড়িতে সবার সাথে গোল হয়ে বসে..... তাই না' ? পলাশ হাসির দমক সামলে বলে ওঠে।

চিত্রা একথার কোনো উত্তর দেয় না। সামান্য হাসে শুধু। সুমন হিট করে। পরপর তিনটে ঘুঁটি ফেলে। হাত ঘুরে পলাশের কাছে যায়। পলাশ একটা দূরের কালো ঘুঁটি এঙ্গেল করতে গিয়ে মিস করে। বাঁদিকে একটা বেস পায় চিত্রা। সেটা দেখার পর পুরো বোর্ডটা ভালো করে জরিপ করে সে সময় নিয়ে। বাকি ঘুঁটির পজিশন দেখতে দেখতে এলোচুলটা টাইট করে পনিটেল বেঁধে নেয়। এরপর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে একটা জোরে টোকা মেরে বেসটাকে হিট করে চিত্রা। বেসটা তো পড়েই তদুপরি স্ট্রাইকার ঘুরে বাঁদিকে একটা ইঞ্চি ঘুঁটিও পেয়ে যায়। চমৎকার শট ! এমন চোখজুড়ানো শটে অর্জুন হাঁ হয়ে যায়। পলাশ আর সুমনের চোখ গোলগোল হয়ে ওঠে। সেদিকে আমল না দিয়ে ইঞ্চিটাকে তাক করে চিত্রা। একটু বেঁকিয়ে ইঞ্চিটাকে ডানপকেটে ফেলে দিয়ে একই শটে রেডটাকেও হিট করে। নিখুঁত এঙ্গেলে রেডটা প্রায় ভেসে গিয়ে টুপ্ করে বাঁদিকের পকেটে ঢুকে যায়। দুর্দান্ত ডাবল শট ! অর্জুন, পলাশ, সুমন যে যার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। দর্শকরা অভিভূত হয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে। দূরের একটা ঘুঁটিকে এরপর সফলভাবে এঙ্গেল করে চিত্রা, রিটার্ন স্ট্রাইকারে একটা বেস নিয়ে আসে। এই বেসটাকেও কায়দা করে পকেট করার ফলে বাঁদিকে দূরের পকেটে একটা সহজ ঘুঁটি পেয়ে যায় সে। বোর্ডের বিটে স্ট্রাইকার ঘুরিয়ে ওই ঘুঁটিটা তো ফেলেই, তার ওপর শেষ ঘুঁটিটা পেয়ে যায় একেবারে হাতের নাগালে। ডানদিক আর বাঁদিকের পকেট ব্লক থাকায় একটা মাপা টাঙ্কি শটে শেষ ঘুঁটিটা পকেট করে চিত্রা। একবোর্ডেই চোদ্দ পয়েন্ট পায় চিত্রা আর সুমন। অর্জুন চান্সই পায় না এই বোর্ডে। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে সে চিত্রার দিকে। দর্শকরা হইহই করে ওঠে। 'সাবাশ' , 'কেয়াবাৎ' ইত্যাদি শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশটা। ভিড় বাড়তে থাকে একটু একটু করে। আশেপাশের দুচারজন ভূয়সী প্রশংসা করে নবাগতা প্লেয়ারের।মৃদু হাসে চিত্রা.....

পরের বোর্ড। পলাশ দারুন হিট করে। তিনটে ঘুঁটি একসাথে পকেটে পড়ে। দুটো বাঁদিকে আর একটা ডানদিকে। পরের ঘুঁটিটা মারতে গিয়ে মিস করে। দান পায় চিত্রা। দুরন্ত এঙ্গেলে দুদিকের পকেটে দুটো ঘুঁটি ফেলে দেয়। সার্কেলের ভিতর থাকা একটা অনবদ্য চাপ খেলে সে রেডটাকে  নামিয়ে দেয় সুমনের হাতে। অর্জুন যেন থৈ পায় না। এমন তুখোড় খেলার সামনে একটু থতমত খেয়ে যায়। হাতের সামনে একটা সহজ ঘুঁটি থাকা সত্ত্বেও রেডটা সুমনের বেসে চলে যাওয়াতে নিরুপায় হয়ে রেড খেলতে হয় অর্জুনকে। তাতেই মারাত্মক ভুলটা করে বসে অর্জুন। মুহূর্তের অসতর্কতায় রেডটা মিস করে ফেলে। রেডে স্ট্রাইকার লাগলেও ঘুরে এসে আবার সুমনের হাতের নাগালেই বসে পড়ে রেডটা। হাত মিস হয় অর্জুনের। দান পেয়ে রেডটা ফেলে দেয় সুমন। সুন্দর এঙ্গেলে দুটো ঘুঁটি নামিয়ে দেয় চিত্রার হাতে। একটা কঠিন ঘুঁটি খেলতে গিয়ে পলাশের হাত মিস হয় আবার। দান পায় চিত্রা। বেসলাইনের ওপর একটা ঘুঁটি দারুন ভাবে টপ করে ডাবল শটে দূরের একটা ঘুঁটিও ফেলে সে। পরের ঘুঁটি মিস হয়। অর্জুন দান পেয়ে দুর্দান্ত খেলে দুটো ঘুঁটি পকেট করে। কিন্তু আর কোনো ঘুঁটি হাতে না থাকায় একটা ইঞ্চি নামিয়ে দেয় পলাশের হাতে। সুমন হাত পায় এরপর। অসাধারণ খেলে অবশিষ্ট কালো ঘুঁটি পকেট করে। এই বোর্ডে নয় পয়েন্ট পেয়ে চিত্রা আর সুমনের মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় তেইশ। অর্জুনের আর পলাশের পয়েন্ট টপকে দুকদম এগিয়ে থাকে।

অর্জুনের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। কারণ এই তেইশ পয়েন্টটা তাদের জন্য এক বিপজ্জনক বস্তু। রেড ব্যতীত ছ পয়েন্ট পেলেও গেম আবার রেড সহ এক পয়েন্ট পেলেও গেম। বলাই বাহুল্য অর্জুন আর পলাশের কাছে গেমটা মান বাঁচানোর লড়াই হয়ে ওঠে এখন।

দুনম্বর বোর্ডে একটি অপিরচিতা তরুণী দুর্দান্ত খেলে অর্জুন আর পলাশকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে, এই খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। দেখতে দেখতে মন্দিরের জমায়েতের মতো ভিড় জমে যায়। সকলেই ফিসফাস করতে থাকে। অর্জুনের সারা মুখে অমানিশা ঘনিয়ে আসে। একজন অপরিচিতা নবীনার কাছে সবার মাঝে অপদস্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখতে পায় যেন চোখের সামনে। ধীরে ধীরে হিট সাজায় চিত্রা। অর্জুনের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে সজোরে হিট করে।

এবারে আর ব্ল্যাঙ্ক হিট হয় না। একসাথে দুটো ঘুঁটি পড়ে। এরপর যেন স্বপ্নের খেলা খেলতে থাকে চিত্রা । দর্শকদের সাথে সাথে চুপ করে সে মোহময় খেলা প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না অর্জুন আর পলাশের। নিপুণ এঙ্গেল আর তুখোড় ডাবল শটের যুগলবন্দীতে পরপর ছটা ঘুঁটি পকেটে ফেলে উড়ালপুলের দর্শকদের মাঝে চিত্রা আলোড়ন তুলতে থাকে একের পর এক। সাময়িক ঝড়ের বিরতিতে দান পায় অর্জুন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে তার। হালভাঙ্গা নাবিকের মতো আসন্ন ভরাডুবি দেখতে পায় যেন। এমন অদ্ভুত নির্ভুল খেলা দেখে ক্ষণিক বেগ পায় বটে সেও দমে যায় না কিছুতেই। 

দুর্দান্ত খেলে একের পর এক ঘুঁটি পকেট করতে থাকে অর্জুন। আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণের উত্তাপে স্ট্রাইকার ঘুঁটির খেলা মারাত্মক জমে ওঠে। নামের প্রতি সুবিচার করে পরপর অবাক করে দেওয়ার মতো শট খেলতে থাকে অর্জুন। আটটা ঘুঁটি ফেলে বোর্ডটা প্রায় শেষ করে আনে একা। ওদিকে চিত্রা আর সুমনের এখনো তিনটে ঘুঁটি বাকি। পরিস্থিতিটা যেন সম্পূর্ণ রূপে হঠাৎ করেই ভোল বদল হয়ে যায় সবার চোখের সামনে। অর্জুনদের একুশ পয়েন্টে থাকায় এখন রেড সহ একটা ঘুঁটি ফেললেই চিত্রা আর সুমন গেম খেয়ে যাবে। বোর্ডের দিকে তাকিয়ে চিত্রা মনে মনে প্রমাদ গোনে। ডানদিকে একটা কালো ঘুঁটির সাথে রেডটা কোনাকুনি অবস্থায় বসে আছে। ডাবল শটের নিশ্চিত সুযোগ। দর্শকরা একঠায় তাকিয়ে থাকে অর্জুনের দিকে। ফিসফাস বলাবলি শুরু হয়, 'এ তো অত্যন্ত সহজ ডাবল শট। অর্জুনের হাতের মোয়া' ইত্যাদি। কালো ঘুঁটিটা ঠিকঠাক এঙ্গেল করতে পারলে একই শটে রেড পড়ে অথবা বেসে চলে আসে। যে কোনোভাবেই চিত্রা আর সুমনের হার নিশ্চিত।

ধীরে ধীরে স্ট্রাইকার বসায় অর্জুন। চার পাঁচ সেকেণ্ড সময় নেয় তাক করার। তারপরেই ধনুকের ছিলা থেকে অব্যর্থ তীরের মতো স্ট্রাইকার বেরিয়ে কালো ঘুঁটিতে হিট করে। অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটে ! যে শটটা দশবারে দশবারই পকেট করতে পারে অর্জুন আজ সামান্য এঙ্গেলের হেরফেরে সেই ডাবল শট মিস হয়ে যায় সম্পূর্ণ। বিস্ময়ে থ হয়ে যায় অর্জুন........সঙ্গে বাকি দর্শকও। নিজের অপারগতায় ধিক্কার দিতে থাকে মনে মনে। রেড আর কালো ঘুঁটিটা পলাশের নাগালের বাইরে চলে যায়। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে সুমন নিজের দানে দুটো ঘুঁটি পকেট করে। দুতরফেই একটা একটা করে ঘুঁটি পড়ে থাকে এরপর। পলাশ দান পায়। অনেকটা দূরে থাকায় রেডটা মারতে গিয়ে মিস করে ফেলে। রেডটা ঘুরে চিত্রার বেস লাইনের নিচে বসে পড়ে। রেডের সামান্য কাছে ওপরের দিকে কালো ঘুঁটিটা থাকায় স্ট্রাইকার বসিয়ে আঙুল ছোঁয়ানো কঠিন হয় চিত্রার পক্ষে। স্ট্রাইকার বসছে কিন্তু আঙুল বসানো যাচ্ছে না। ভুলবশত কালো ঘুঁটিতে আঙুল ছুঁলেই ফাইন হবে।কপালে ভাঁজ পড়ে চিত্রার। দর্শক মহল থেকে এমন অসম্ভব বেস না খেলার বিস্তর মতামত আসতে থাকে। অর্জুনও মাথা নাড়তে থাকে, কোনোভাবেই এই বেসটা খেলা সম্ভব নয়। 


বেশ কিছুক্ষন পর স্ট্রাইকার বসায় চিত্রা, সমস্ত রকম জটিলতা, বারণ অগ্রাহ্য করে ঠিক ওই জায়গাতেই। এমন খামখেয়ালী সিদ্ধান্তে আলগা হাসে অর্জুন। ফাইন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। উপস্থিত দর্শকদের থামিয়ে মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে কতকটা তুড়ি মারার কায়দায় অভিনব ভাবে রেডটাকে ব্যাক স্ট্রাইক করে চিত্রা। ওপরের কালো ঘুঁটিটা একসুতোও নড়ে না। উপরন্তু মর্মভেদী শটে রেডটা পকেট হয় ও স্ট্রাইকার ঘুরে সাদা ঘুঁটিতে লাগে। বাঁদিকে কোণার পকেটে সেটাও মখমলের মতো ভেসে গিয়ে পড়ে যায়। অপ্রত্যাশিত শট এবং গেম !


মুহূর্তের জন্য দর্শকদের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায় যেন। চোখের পলক পড়ে না অর্জুনদেরও। এমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাক স্ট্রাইকের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে সবার। আর তারপরেই সমস্ত নিস্তব্ধতা কাটিয়ে উচ্ছাসে, কলরবে উড়ালপুলের নিচেটা গমগম করে ওঠে। নিমেষে চিত্রাকে নিয়ে উৎসবের আকার নেয় গড়িয়াহাট চত্ত্বর। হৈহৈ করে অকুন্ঠ প্রশংসায় ভরিয়ে তোলে চিত্রাকে।

অর্জুনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে হাসিমুখে সবাইকে অভিবাদন করে বেরিয়ে আসে চিত্রা। পিছুপিছু অর্জুন এসে অবিশ্বাসী কণ্ঠে চিত্রাকে প্রশ্ন করে, 'একটু শুনুন, ব্যাক স্ট্রাইকে বেস ফেলার শটটা কোথা থেকে শিখলেন আপনি' ? থমকে দাঁড়ায় চিত্রা। খানিক্ষন মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, 'আমায় এখনো চিনতে পারলে না অর্জুনদা' ? অর্জুন থতমত খেয়ে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে চিত্রার দিকে। চিত্রা থেমে থেমে বলে, 'আমি চিত্রাঙ্গদা...... চিত্রাঙ্গদা বসু .......কুদঘাটে বাড়ি ছিল। তোমার মনে নেই' ? 

অর্জুন থমকায় খানিক, স্বগতোক্তির মতো করে বলে, 'কুদঘাটের বাড়ি' ? তারপরেই মনে পড়ে যায় সব। গলায় একরাশ উল্লাস এনে বলে, 'তুমি মানে....... তুই শচীন কাকার মেয়ে' ? চিত্রা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। বলে, 'মনে আছে ? বছর বারো আগে যখন আমরা একই পাড়ায় থাকতুম, তোমায় চিঠি পাঠিয়েছিলুম বইয়ের ভাঁজে। তুমি বলেছিলে আগে আমায় ক্যারামে হারাবি তারপর ভাবব'। 

অর্জুন বলে, 'সে তো অনেকদিনের কথা.....তুই এখনো......' !
'তুমি পাড়া ছেড়ে চলে যাবার কয়েকমাস পর বাবার বদলির চাকরিতে আমরাও শিলিগুড়ি শিফট করি। কয়েক বছর বাদে দমদম পার্কে বাড়ি করে আবার ফিরে আসি। ফিরে এসে তোমায় অনেক খুঁজেছিলাম জানো ? কোত্থাও পাইনি। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজে নিজেই পাড়ার ক্লাবে গিয়ে ক্যারাম খেলতাম বাকিদের সাথে। সেখানেই প্র্র্যাক্টিস। মাসখানেক আগে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপের ফর্ম তুলতে যাচ্ছিলাম এই রাস্তা দিয়েই। হঠাৎ করে এখানে দেখলাম তোমায়। তারপর কদিন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার খেলা দেখতে এসেছিলাম। চোখাচোখি হয়েছিল দু একবার। তুমি চিনতে পারনি। আজ একেবারে রেজিস্ট্রেশন করে তোমার সাথে খেলব বলে এসেছি। কিন্তু দৈব দুর্বিপাকে তুমি যে সত্যিই হেরে যাবে, একেবারে ভাবিনি। তবে আমি কিন্তু কথা রেখেছি। এবার তোমার পালা', লজ্জাবনত হয় চিত্রা।

এতটা অবাক অর্জুন হয়নি কখনো আগে। পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল এক এক করে। কৈশোরের হৃত প্রেমের জোয়ারে সমস্ত হৃদয় জুড়ে একটা প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছিলো। বিড়বিড় করে বলে, 'বারো বছর আগে যা বলেছিলাম তা মনের কথা নয়। নিছকই মজা ছিল। পাড়া ছেড়ে দেবার পর তোকেও কম খুজিনি আমি। শেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়েছিলাম। তবে, তুই কিন্তু এমনিই এসে পরিচয় দিতে পারতিস। খেলার প্রয়োজন পড়তো না'। 

চিত্রা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, 'কি করে জানব তোমার মনের কথা ? তাছাড়া তোমার ধনুক ভাঙা পণ ছিল যে' ! অর্জুন লজ্জা পায় বেশ। মুখ নামিয়ে বলে, 'বিশ্বাস কর হেরেও যে এতো আনন্দ পাওয়া যায় ভাবিনি আগে'। চিত্রা ঠোঁট কামড়ায়। অর্জুন এগিয়ে এসে বলে, 'তুই আমার.......ডাবলস পার্টনার হবি' ? 

দুহাতে মুখ চাপা দেয় চিত্রা। কাছেই কোনো মোবাইলে বেজে ওঠে....'আলবেলা.....সজন আয়ও রি......'


ছবি : গুগল 
  
#bengalishortstories #carromstories #drama #lovestories

    


Monday, October 9, 2017

অনুপদ্য - ১৯

অকাল শ্রাবণ ধূসর প্লাবন, নয়ানজুলি ভাসে
হিয়া ছলছল, বারি চঞ্চল, বর্ষা নেমে আসে
প্রেম বয়ে যায় নিভৃত পায়ে ছুপছুপে ভিজে ভোর
দেখেছি তোমায়, জল ছুঁয়ে যায় এই মেঘলা শহর
















#bengalipoems #rainydaypoems 

Thursday, October 5, 2017

অনুপদ্য - ১৮

রাঙাচরণ আলতামাখা, চিহ্ন চৌকাঠ.....
থৈথৈ মন চাঁদের আলো, তেপান্তরের মাঠ
পেঁচার ডানায় সাঁতার কাটে আবাহনের সুখ
কোজাগরীর সন্ধ্যাপটে দেখেছি মায়ের মুখ

চিত্র : নিজস্ব




















#laxmipuja #bengalishortpoems #laxmipujapoems

Monday, September 25, 2017

অনুপদ্য - ১৭

চিত্র ও বিন্যাস - নিজস্ব 
#bengalishortpoems #durgapujapoems #durgapuja

Thursday, September 21, 2017

সাপ্তাহিকী - ৩২ # সেবুর প্যান্ডেল - অন্তিম পর্ব

পলকের আকস্মিকতা কাটাইয়া সবাই কোলাহল করিয়া উঠিল। ব্যাটা বলে কি ? পুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধবে ! সকলেই সমস্বরে বলিল, 'না না না, এ অসম্ভব' ! প্যাণ্ডেল বাঁধিতে গিয়া সেবু যে ভীষণ রকম একটা কাণ্ড ঘটাইয়া ফেলিবে এ বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত হইয়া বিধুচরণের নিকট তদ্বির করিল। বিধুচরণও মাথা নাড়িয়া বলিলেন, 'না না, সেবু তা হয় না। তুই কি প্যাণ্ডেল বেঁধেছিস আগে যে হঠাৎ করে একেবারে দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধতে লাগবি' ? সেবু ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'অাহ্ আমি কি বলেছি আমি একাই বেঁধে ফেলব ? ভূপেন মাঝি ও তার দলবল তো থাকবেই, আমি শুধু একটু হাত লাগাবো, এই যেমন ধরো একটা দড়ি বেঁধে দিলাম বা একটু বাঁশটা পুঁতে দিলাম এই আর কি। আমার ভারী ইচ্ছে, সেই ছোটোর থেকে..........বিশ্বাস করো'। শেখর ও গোরা হৈ হৈ করিয়া বলিল, 'না না, মিত্রমশাই, আপনি একদম শুনবেন না ওর কথা। আমাদের তো আগে কম বিপদ হয় নি। তাছাড়া দুর্গাপুজো নিয়ে কোনো রকম ছেলেমানুষি আমাদের না করাই ভালো'। বিধুচরণ মহা ফাঁপরে পড়িলেন। একদিকে সেবুর আবদার তিনি না মিটিয়া থাকিতে পারেন না আবার অন্যদিকে তাহাকে অনুমতি দিতেও ভরসা পাইতেছেন না। কতকটা ফাটা বাঁশের মধ্যে আটকা পড়িয়া তিনি ছটফট করিতে লাগিলেন।

সেবু তাহার জ্যাঠার পরিস্থিতি আঁচ করিয়া বলিয়া উঠিল, 'আচ্ছা জ্যেঠু, জেলেপাড়ার বসুমতীকে চেন' ? বিধুচরণ অবাক হইয়া বলিলেন, 'বসুমতী ? না, চিনি না। কেন, সে কে' ? এ কথায় শেখরের মুখ পাংশু হইয়া গেল। সে বিবাহিত অথচ বেশ কয়েকদিন হইল জেলেপাড়ার বসুমতীর সহিত তাহার একটি সম্পর্ক জমিয়া উঠিয়াছে। একথা মনোহরপুরের কাকপক্ষীও জানে না। তাহা সেবুর গোচরে কি করিয়া আইল এইটা ভাবিয়া শেখর যারপরনাই অস্থির হইয়া উঠিল। কারণ এই সম্পর্ক জানাজানি হইলে তাহার সংসারে কেন গোটা পাড়ায় কুরুক্ষেত্র হইতে বাকি থাকিবে না শেখর তাহা বিলক্ষণ জানে। সেদিকে তাকাইয়া সেবু বলিল, 'না, মানে সে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে তালপুকুরের ধারে চুপটি করে বসে থাকে। কেন ? তুমি জান' ?

বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া দুদিকে মাথা নাড়িলেন। সেবুর কথার গোপন মর্মার্থ তিনি উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। উল্টোদিকে শেখর প্রায় ঘামিয়া স্নান করিয়া গেল। বসুমতীর সাথে তাহার দেখা করিবার স্থান তালপুকুরই বটে। সন্ধ্যের দিকে সে সমস্ত রকম আঁটঘাঁট বাঁধিয়া খুবই সন্তর্পণে বসুমতীর নিকট আসে। তাহাদের প্রেমালাপ করিবার একটি গোপন আস্তানা আছে। আজ অবধি কেউ টের পায় নাই। হতভাগা সেবু কি করিয়া জানিতে পারিয়া আজ মোক্ষম সময়ে সেসব কথা তুলিতেছে। পাড়ার পাঁচজনের সামনে মাথা হেঁট হইয়া যায় বুঝি।

পরিস্থিতি নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া শেখর গলা খাকরাইয়া বলিয়া উঠিল, 'আঃ সেবু, কি সব অবান্তর কথা বলছিস ? হচ্ছিল একটা কাজের কথা, তা নয় যত্তসব অপ্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে। আমাদের আর দেরি করলে চলবে না কিন্তু, সময় বয়ে যাচ্ছে। ঝটপট ভূপেনকে একটা খবর দে দিকি'।

সেবু একগাল হাসিয়া বলিল, 'সে তো আমি এখনই দিতে পারি। কিন্তু আমার কথাটাও একবার.........'। বিধুচরণ ফোঁস করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন। শেখর একবার বিধুচরণের মুখের দিকে তাকাইয়া নিয়া বলিল, 'আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন, চারটে বাঁশ নাহয় তুইই বাঁধিস। ভূপেনকে খবরটা তো দে আগে'। বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, 'সে কি কথা শেখর, ওর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা তো সবই জানো। ও যদি কোনো  বিপদ ঘটায়, তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারবো না এ আমি আগেই সাফ জানিয়ে রাখলুম'। শেখর স্মিতহাস্যে কহিল, 'আহা সেবুর ইচ্ছে হয়েছে যখন, একটু প্যাণ্ডেলের কাজ করল নাহয়। ছোটবেলার শখ বলছে তো, করুক না একটু। আমাদেরও তো কতসময় কতরকম শখ জাগে, তাই না ? ও কিছু না। আপনি আর এ নিয়ে আপত্তি করবেন না মিত্রমশাই। সেবু তো আমাদেরই ঘরের ছেলে, কি সেবু এবার খুশি তো' ?

সেবু মহানন্দে তাহার দন্ত কপাটি বাহির করিল। বিধুচরণ বলিলেন, 'বেশ, তবে তাই হোক। তুমি পুজোর সেক্রেটারি হয়ে যখন বলছ তখন আর আমার আপত্তি করবার কিছু নেই'। এই কথাটি বলিয়াই তিনি হঠাৎ সেবুর দিকে ঘুরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তবে, তুই বসুমতী না কার যেন কি একটা কথা বলছিলি' ? সেবু চটপট হাত নাড়িয়া বলিল, 'না না সেসব কিছু না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমি বরং যাই, চানটা করে নিয়ে ভূপেন মাঝি কে খবরটা দিই গে যাই'। বলিয়াই সে ছুটিয়া ঘর হইতে অন্তর্ধান হইল। বিধুচরণ চক্ষু বুজিয়া কহিলেন, 'হরি হে ! কখন যে তোমার কি ইচ্ছে........ '।

দেখিতে দেখিতে দেড়মাস কাটিয়া গেল। প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষের পথে। ভূপেন মাঝি ও তার দলবল ঝড়ের গতিতে কাজ করিতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের মতো দুর্দান্ত আকার না হইলেও হরিসভার নৌকার আদলটা মোটামুটি হইয়াছে। যদিও গোটা নৌকা বানাইবার দরকার পড়ে নাই। সামনের দিকটায় চমৎকার একটা বজরার রূপ দিয়া পিছন দিকটায় ছোট করিয়া হাল বাঁধিয়া দিয়াছে। সামনে দাঁড়াইলে নৌকার ছাউনি ও মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাইবে। কিন্তু সেসব ছাপাইয়া যাহা চোখে পড়িবার মতো তাহা হইল সেবুর উৎসাহ ও কাজ করিবার উদ্দীপনা। বাঁশ বাঁধা, কাঁচা মালের আনা নেওয়া করা, মিস্ত্রিদের খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছুই সে নিজের হাতে দেখিতেছে। বোঝা যাইতেছে তাহার শখ পূরণের সমস্ত রসটুকু সে পরম তৃপ্তিতে আস্বাদন করিতেছে। সময়ে অসময়ে বিধুচরণ, শেখর, গোরা ও ক্লাবের বাকিরা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী সমস্ত কাজই তদারকি করিতেছেন।

পরের এক সপ্তাহে বাকি সমস্ত কাজই নিয়মমাফিক চলিয়া শেষ হইয়া গেল। প্যাণ্ডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেল। কিন্তু কেহ জানিতে পারিল না নৌকার পিছন দিকে এক ভীষণরকম কালসর্পের যোগ ঘটিয়াছে। সেটি কি তাহা পরে বলিতেছি। এদিকে ইতিমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটিল। যাহারা মনোহরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা তাহারা নিত্য আসা যাওয়ার পথে সকলেই সচক্ষে দেখিতে পাইতেছিলেন যে কোন প্যাণ্ডেলটি কিরূপ প্রস্তুত হইতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের অপেক্ষা হরিসভার নৌকা যে উত্তম কিছু হইতেছে না এ তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিলেন। হরিসভার নৌকা ধারে ও ভারে কোনোপ্রকারেই উড়োজাহাজকে টেক্কা দিতে পারিতেছিল না। তাহার কারণ উড়োজাহাজটি দুতলা সমান পেল্লাই হইয়াছিল এবং দেখিতে অবিকল আসল উড়োজাহাজের মতোই লাগিতেছিল। সেখানে হরিসভার নৌকাটি মোটের উপর চলনসই হইয়াছিল। সুতরাং ধীরে ধীরে এরকম একটি বার্তা রটিয়া গেল যে এবার হরিসভা তেমন কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের সমস্ত কর্মকর্তাদের নিকট অনুরূপ সংবাদ পৌঁছাইল। এহেন পীড়াদায়ী জনশ্রুতিতে সকলেই প্রায় ভাঙিয়া পড়িলেন। বিধুচরণও কঠিন মনকষ্টে ভুগিতে লাগিলেন। পুজো লইয়া তাহার সমস্ত উদ্দীপনা ধূম্রের ন্যায় মিলাইয়া যাইতে লাগিল।

তবুও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের যথাবিধি নিয়ম পালন করিতে হইবে। তাই ক্লাবের মধ্যে ঠিক হইল চতুর্থীর দিন প্রতিমা আনা হইবে ও পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় পাঁজির সময়ানুসারে বিধুচরণ ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উদ্বোধন করিবেন।

যথাসময়ে পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যাবেলা সকলে ক্লাবের মাঠে উপস্থিত হইলেন। মণ্ডপের সামনে একটি বিশাল ত্রিপল খাটাইয়া রাখা হইয়াছে। সামান্য কিছু উৎসুক জনতাও মাঠের ধারে জড়ো হইল। কারণ বেশিরভাগ মানুষই উড়োজাহাজের দিকে উড়িয়া গিয়াছেন। বিধুচরণ শ্বেতশুভ্র ধাক্কা পাড়ের ধুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরিহিত হইয়া ব্যথিত হৃদয়ে ক্লাবে পদার্পন করিলেন। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝা যাইতেছিল যেন তিনি এক কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন। মাঠ প্রায় জনশূন্য দেখিয়া তিনি আরও হতোদ্যম হইয়া পড়িলেন। অন্যান্য বৎসর গুলিতে যেখানে উদ্বোধনের দিন একেবারে লোক ভাঙিয়া পড়িত, আজ সেখানে ছন্নছাড়া কয়েকজন আসিয়াছে। ক্লাবের অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইয়া মণ্ডপে লইয়া আনিলেন। ঢাকিরা আগে হইতেই প্রস্তুত ছিল। তাহারা বিধুচরণকে দেখিয়া একসাথে ঢাক বাজাইতে শুরু করিল। কিন্তু সে ঢাকের আওয়াজও কেমন যেন করুণ প্রাণ মনে হইল। পাড়ার কয়েকজন মহিলা উলুধ্বনি দিয়া ও মঙ্গলশঙ্খ বাজাইয়া কোনোমতে বিলীন উৎসাহটুকু জাগাইয়া রাখিলেন।

ত্রিপল সরাইয়া, পঞ্চপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিয়া পুজোর উদ্বোধন হইবে। বিধুচরণ একটি গম্ভীর নিঃশ্বাস ছাড়িয়া রশি টানিয়া ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উন্মোচন করিলেন। তাহার পর পঞ্চপ্রদীপে আলো সঞ্চার করিয়া মণ্ডপের সিঁড়ির নিকটে আসিলেন। ইতস্তত দু একটি হাততালির শব্দ শোনা গেল। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বিধুচরণ মণ্ডপে উঠিতে গিয়া থমকাইয়া গেলেন। মণ্ডপের দিকে চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া গেল। তিনি শ্বাসরুদ্ধ করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া ক্লাবের বাকিরাও মণ্ডপের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাহাদের হৃদপিণ্ড প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেল।

দেখা গেল নৌকারূপী মণ্ডপটি ডানদিকে বেশ কিছুটা হেলিয়া কাত হইয়া গিয়াছে। কতকটা পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো। পড়িয়া যায় নাই এই রক্ষে, কিন্তু পড়িয়া যাইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। বিধুচরণ কোনো কথা কহিতে পারিলেন না প্রথমটায়। ধীরে ধীরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন অগ্নি নিক্ষেপ হইতে লাগিল। চরম ক্রোধে তিনি থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। পাশে দাঁড়ানো শেখরকে চাপাস্বরে ফিসফিস করিয়া  জিজ্ঞাসা করিলেন, 'এটা কি ? এ কি করে হল' ? শেখরের প্রায় অজ্ঞান হইবার উপক্রম হইল। সে সভয়ে কহিল, 'আজ্ঞে, সকাল অবধি তো সোজাই দাঁড়িয়েছিল এখন যে কি করে হেলে গেল জানি না'। বিধুচরণ অগ্নিনেত্রে বাকিদের থেকে ইশারায় জানিতে চাহিলেন যে ব্যাপারখানা কি। কিন্তু কেউই কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিল না। ভূপেন মাঝি কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সেও চক্ষু গোলগোল করিয়া তাকাইয়া ছিল তাহার সাধের নৌকার দিকে। বিধুচরণ তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিতে টানিতে মণ্ডপের অনতিদূরে লইয়া গিয়া কহিলেন, 'এসবের মানে কি ভূপেন ? এটা কি মস্করা হচ্ছে ? নৌকা এতো হেলে গেল কি করে' ? ভূপেন মাঝি মিনমিন করিয়া কহিল, 'আজ্ঞে মিত্রমশাই আ-আমি সত্যি কিছু জানি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলুম আমি। আজ সকালেও দেখেছি, তখন তো কিচ্ছুটি হয় নি'।

'ন্যাকা সাজছিস তুই ? সকালেও দেখেছি ? তাহলে কি বিকেলে উঠে সমুদ্রে জাল ফেলেছিস মাছ ধরবি বলে, যে নৌকা হেলে গেল' ? বিধুচরণ ক্রোধান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন। ভূপেন হাঁউমাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। বিধুচরণ আবার কহিলেন, 'সত্যি করে বল ভূপি, কি করে হল নইলে তোকে আমি এই মাঠে জ্যান্ত পুঁতব বলে রাখলুম'। ভূপেন ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল ,'আজ্ঞে, আমায় একটু সময় দিন কত্তা, আমি একবার পিছনদিকটা দেখে আসি'। বলিয়াই সে ছুটিয়া নৌকার পিছন দিকে চলিয়া গেল। কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া সে আবার ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, 'আজ্ঞে হালের দিকে দুটো বাঁশ আলগা বাঁধা হয়েছে কত্তা, দড়ি হড়কে গিয়ে বাঁশ কাত হয়ে গেছে, তাই নৌকাও হেলে  গেছে খানিক'।

'আলগা বাঁধা হয়েছে মানে ? কেন, বাঁধার সময় তুমি কি কেষ্টঠাকুরের লীলে দেখছিলে বজ্জাত' ? বিধুচরণ অগ্নিশর্মা হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন। ভূপেন কুঁই কুঁই করিয়া বলিল, 'আজ্ঞে ওই বাঁশদুটো আমি সেবুকে বাঁধতে দিয়েছিলুম। ঐটে বাঁধবে বলে সে খুবই জোড়াজুড়ি করে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই..........'। সেবু কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, 'হ্যাঁ, আমিই বেঁধেছিলুম বটে, কিন্তু আমি ভূপেনদার কথামতো ঘন্টাকেও দেখিয়ে নিয়েছিলুম। সে বলেছিল ঠিক আছে'। বিধুচরণ স্তব্ধ হইয়া গেলেন একথা শুনে। তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।

ঘটনাটা ঠিক কি হইয়াছিল তাহা বলি এখন পাঠকদের।  
সেবুর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখিয়া ভূপেন তাহাকে দুটি বাঁশ বাঁধিতে দিয়াছিল। কাজটি ছিল এই যে হালের দিকটায় একটি বাঁশের সহিত আরেকটি বাঁশ কায়দা করিয়া বাঁধিতে হইবে। তাহার সহিত একজন কারিগরকেও রাখিয়াছিল পুরোটা ভালো করিয়া দেখিয়া লইবার জন্য। তাহার নাম ঘন্টা। কিন্তু মুশকিল হইল, সন্ধ্যে হইলেই ঘন্টা গাঁজা ও কল্কের মায়ায় জড়াইয়া পড়ে। তখন আশেপাশে বোমা মারিলেও ঘন্টার ঘড়িতে কিছুমাত্র বিকার ঘটে না। সেবুর দুইটা বাঁশ বাঁধিতে সেদিন সন্ধ্যে হইয়া গিয়াছিল। কাজের শেষে সে ঘন্টাকে ডাকিয়া লইয়া ভালো করিয়া দেখাইয়াছিল। তুমুল নেশার চোটে ঘন্টা তখন চোখ খুলিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। ফলে সে বুঝিতে পারে নাই যে বাঁশ দুইটি একেবারে আলগা বাঁধা হইয়াছে। কতকটা হামাগুড়ি দিয়া সে দড়ির উপর হাত বুলাইয়াই জড়ানো কণ্ঠে বলিয়াছিল, 'ঠিক আছে, বেশ বাঁধা হয়েছে'। নানান কাজের মধ্যে ভূপেনেরও পুরোটা ভালো করিয়া দেখা হয় নাই। এখন সময়কালে এই ভয়ঙ্কর বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

সেবুর মুখে ঘন্টার কথা শুনিয়া সকলেই একপ্রকার বিপদের ঘন্টাধ্বনি শুনিতে পাইলেন। কে কি বলিবে কেহ ভাবিয়া পাইলেন না। আশেপাশে কোথাও ঘণ্টাকেও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।

ইতিমধ্যে যে জনতা দূরে জড়ো হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে এক অদ্ভুত গুঞ্জন শুরু হইল। সে গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়িয়া এক আশ্চর্য রূপ লইতে লাগিল। কারণ তাহারা কেহ জানিতে পারে নাই যে নৌকার এমন দুর্দশা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটিয়াছে। তাহারা ভাবিতে লাগিল, এইটি বোধহয় হরিসভা ক্লাবের শেষবেলার চমক, তুরুপের তাস। একেবারে অন্তিমলগ্নে আস্তিন হইতে বাহির করিয়াছে আদর্শ পল্লীকে মাত দিবে বলিয়া। এবং এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখিয়া তাহারা একেবারে হাঁ হইয়া গেল। তাহার কারণ হইল এই যে নৌকাটি হেলিয়া থাকিবার ফলে এক অদ্ভুত বাস্তব রূপ লইয়াছে। দূর হইতে দেখিলে মনে হইবে যে তুমুল ঝড়ের মধ্যে নৌকাটি কোনোপ্রকারে হেলিয়া গিয়া শেষ অবধি বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। সঙ্গে জলরাশির আবহশব্দ, মৃদু আলোর খেলা ও সন্ধ্যার মেঘাবৃত আকাশের মেলবন্ধনে গোটা ব্যাপারখানায় যেন এক মায়াবী দৃশ্যপট প্রস্তুত হইয়াছে। তাহাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিবার পর কয়েকটি উক্তি এধার ওধার থেকে উড়িয়া আসিতে লাগিল। যেমন সপত্নী সাগর ডাক্তার কহিলেন, 'ইট্স ওয়ান্ডারফুল ! এমেজিং' ! বাংলার শিক্ষক হলধর সামন্ত বলিলেন, 'দুর্দান্ত ! ওস্তাদের মার শেষরাতে'। মধু স্যাকরা বলিয়া উঠিল, 'কেয়াবাৎ ! শেষবেলায় হরিসভা কিন্তু দেখিয়ে দিলে'।  কিছু কচিকাঁচার দল সহর্ষে হাততালি দিয়া উঠিল। উপস্থিত দর্শক সকলেই হরিসভার সৃজনী পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

বিধুচরণ ও তাঁহার দলবল হকচকিয়ে গেলেন। এ কি হইল ! যে মাঠ কিয়দকাল আগে পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ও স্বপ্নভঙ্গের আঁধারে ডুবিয়া যাইতেছিল এখন সেখানেই উল্লাস ও উৎসবের আলো জ্বলিতেছে ! বিধুচরণ চকিতে পুরোটা আঁচ করিয়া ক্লাবকর্তাদের বলিলেন, 'আমাদের শীঘ্রই এটা সামাল দিতে হবে। লোকজন যদি নৌকায় উঠে পড়ে তাহলে তো সবশুদ্ধু জলাঞ্জলি যাবে ? তখন কি হবে' ? ভূপেনমাঝি আগাইয়া আসিয়া কহিল, 'কত্তা, আমি ভালো করে দেখে নিয়েচি। দড়ি খুলে গেছে বটে, তবে নৌকায় লোক না উঠলে কিচ্ছুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এ নৌকা পড়বে না'। বিধুচরণ ভুরু কুঁচকাইয়া কহিলেন, 'কি করে বলছিস পড়বে না ?

- আজ্ঞে, দড়ি আলগা হয়েছে, কিন্তু বাঁশদুটো তো আর পড়ে যায় নি। সে দুটো এমন ভাবে মাটির সাথে গেঁথে আছে যে এই চাপটুকু বয়ে নিতে পারবে। তবে লোকজন যেন না ওঠে এইটে খেয়াল রাখতে হবে।
- ঠিক বলছিস ?
- আজ্ঞে মা দুগ্গার দিব্যি কত্তা, হলপ করে বলছি। বরং লোকজনদের দূর থেকে দেখাবার ব্যবস্থা করুন। দড়ি বেঁধে দিন, সবাই বাঁদিক থেকে ঠাকুর দর্শন করে ডানদিক দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যাবে।
- বেশ, সে ব্যবস্থা আমরা করছি, তবে নৌকা যদি পড়ে যায় তবে ওই বাঁশ খুলে আমি তোর পিঠে ভাঙব এই বলে দিলুম।

শেখর বলিল, 'আলগা দড়ি আরেকবার বেঁধে দিলেই তো হয়'। ভূপেন কহিল, 'না দাদা, এই অবস্থায় হাত লাগাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে মানুষ আটকাবার ব্যবস্থা করুন'। বিধুচরণ তৎক্ষণাৎ গোরার দিকে ইশারা করিলেন। গোরা ঘাড় নাড়িয়া দৌড়াইয়া দড়ির ব্যবস্থা করিতে গেল।

হরিসভার যেন সমস্ত দিক হইতেই শাপমোচন হইল। 'হেলা নৌকা' র মাহাত্ম্য ছড়াইতে বেশি বিলম্ব হইল না। লোকজনের মুখে মুখে রটিয়া গেল যে হরিসভার 'হেলা নৌকা' তাহাদের অভিনব কুশলী কায়দায় শেষবেলায় আদর্শ পল্লীকে টেক্কা দিয়াছে। এই দুর্দান্ত ও চমৎকার দর্শনীয় বস্তুটি না দেখিলে সমস্তটাই বৃথা। ক্রমে ক্রমে মানুষের আগমন ঘটিতে লাগিল। এবং সকলেরই মুখে একটি প্রশ্নই ঘুরিতে লাগিল যে হরিসভা এই আশ্চর্য হেলানো অবস্থাটি বাস্তবে সম্ভব করিল কি প্রকারে ? কিন্তু সেসকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কেহই দিতে পারিল না। ফলে 'হেলা নৌকা' লইয়া আগ্রহ যেন দিগ্বিদিক ছাপাইয়া গগনচুম্বী হইল। ষষ্ঠীর দিন সকাল হইতে স্রোতের ন্যায় মানুষের ঢল নামিল হরিসভার মাঠে। বিধুচরণ ও ক্লাবের অন্যান্যদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিল। হরিসভার ঘাম ছুটিয়া গেল ভিড় সামাল দিতে দিতে।

বিধুচরণ বিজয়ীর হাসি লইয়া ক্লাবের মধ্যে সকলকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা করিলেন যে এমন আনন্দ উৎসবের মধ্যে তিনি একটি ভোজের ব্যবস্থা করিতেছেন। ক্লাবের সকলেই যেন নিজ নিজ পরিবার লইয়া সপ্তমীর রাত্রে উক্ত ভোজে সামিল হন। সকলেই বিধুচরণের জয়ধ্বনি দিতে লাগিল। সেবু এক কোনে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে জিজ্ঞাসা করিল, 'ইয়ে জ্যেঠু, আমার একটি অনুরোধ আছে'। সকলে সেবুর দিকে আতঙ্কিত হইয়া চাহিয়া রহিল। বিধুচরণ ঘাড় নাড়িয়া কিছু বলিবার পূর্বেই সে আবার বলিয়া উঠিল, 'আমিও এই ভোজে রাঁধুনির সাথে দু একটা পদ রাঁধতে চাই, রাঁধবার আমার ভারী ইচ্ছে....... সেই ছোটোর থেকে..........'। সকলে সমস্বরে গগন বিদীর্ণ করিয়া তাহাকে ধমকাইল, 'সেবুউউউউউ ......' !

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories #durgapujastory #durgapuja

  

Monday, September 18, 2017

সাপ্তাহিকী ৩১ # সেবুর প্যাণ্ডেল - প্রথম পর্ব

সেবু বড় আমুদে ছেলে। হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়া সে সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে উঠিয়াছে। রক্ত তাহার গরম। সে করিতে পারে না বিশ্ব সংসারে এমন কোনো কাজ নাই। অন্তত সে নিজে তাহাই বিশ্বাস করে। অবশ্য তাহার এই অতি চাঞ্চল্য শুধু তাহাকে নয় সময় বিশেষে তাহার বাড়ির লোকজনকেও যথেষ্ট বিপাকে ফেলিয়াছে। তাহার একমাত্র কারণ হইল সেবু ভারী পরোপকার করিতে ভালোবাসে। সে উপকার লোকের প্রয়োজনে লাগুক চাই না লাগুক সমাজসেবার নূন্যতম উপায় দেখিলেই সেবুকে ধরিয়া রাখা মুশকিল। যেন তেন প্রকারেন সেবুকে সে কাজ করিতেই হইবে। তাহাতে অধিকাংশ সময়ই অর্থের বিনিময়ে সেবুর জ্যাঠাকে সেসব অনর্থের মূল্য চোকাইতে হইয়াছে। কিন্তু ভবি ভুলিবার নহে।

এখানে বলিয়া রাখা ভালো, সেবুর বাড়িতে তাহার বাবা মা থাকিলেও বাড়ির গার্জেন হিসেবে তাহার জ্যাঠা অর্থাৎ বিধুচরণ মিত্রকে সে বেশ সমঝিয়া চলে। বিধুচরণ মনোহরপুরের নামকরা উকিল ও স্থানীয় ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। এলাকায় তাঁহার প্রতিপত্তি যথেষ্ট। বিয়ে থা করেননি। নিজে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়াছেন ও ছোট ভাইটিকেও শিখাইয়াছেন। ছোট ভাই স্কুলমাষ্টার বিদ্যাচরণ ও ভাতৃবধূ সরলা দুজনেই তাঁহাকে পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। বিদ্যাচরণ ও সরলার যখন পুত্রসন্তান হইল বিধুচরণ তখন তাহার নাম রাখিলেন সেবাব্রত। কিন্তু সেবাব্রত যে বড় হইয়া তাহার নামের প্রতি সুনাম বজায় রাখিতে তৎপর হইয়া উঠিবে তাহা তিনি ঘুনাক্ষরেও টের পান নাই। অথচ সেবুর বাবা মা হইতে তিনি সেবুকে অধিক স্নেহ করেন এবং কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ও দেন। এ যাবৎ সেবুর সমস্ত রকম বায়নাক্কা তিনিই স্মিতহাস্যে মিটিয়া আসিয়াছেন।

বিদ্যাচরণ দাদাকে এ বিষয় বলিতে গেলেই তিনি বলেন, 'আহা ! সেবু আমার আরজন্মের সন্তান, এই জন্মে তোদের কোলে এসেছে, ওকে কি আমি কিছু বলতে পারি' ? বিদ্যাচরণ তাহার দাদাকে নিরস্ত করিতে চায়, বলে, 'এ তোমার ভারী অন্যায় দাদা, ও চাদ্দিকে যা নয় তাই করে বেড়াচ্ছে, সে খবর তো পাও। কত জায়গায় নাজেহাল হতে হয়েছে বলত আমাদের, তাও কি তুমি ওমন চোখ বুজে থাকবে, একটুও শাসন করবে না ভাইপো কে' ?  এ কথায় বিধুচরণ বলেন, 'তোরা করছিস তো শাসন, তাতে হচ্চে না ? আমাকেও লাগবে' ? বিদ্যাচরণ তৎক্ষণাৎ বলে, 'ও কি তোমাকে ছাড়া কারোর কথা শোনে না পাত্তা দেয় যে আমরা বললেই একেবারে বাধ্য ছেলের মতো ঘরে চুপটি করে বসবে' ? বিধুচরণ নিরুত্তর থাকেন, চুপ করিয়া চক্ষু বুজিয়া বারান্দার আরাম কেদারায় দোল খাইতে থাকেন। এই ধরণের বাক্যালাপ সাধারণত বেশিক্ষন গড়ায় না কোনোদিনই। বিদ্যাচরণও বিরক্ত হইয়া উঠিয়া চলিয়া যায়।

এ কথা সত্য যে সেবুর কান্ডকারখানায় পাড়াসুদ্ধু মানুষ ত্রস্ত। সে যে কখন কি করিয়া বসে তাহার ঠিক নাই। এই যেমন গত মাঘে চণ্ডীতলার মাঠে ফুটবল খেলার আয়োজন হইয়াছিল। সেখানে সেবু নিজে না খেলিয়া ক্লাবের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ধরিয়া একটি ম্যাচে রেফারি হইয়াছিল। সে বিশেষ কিছু করে নাই শুধু দুইটি ভুল পেনাল্টি দিয়াছিল। যাহার ফলে পাড়ার ক্লাব সেবার দুটি গোল বেশি খাইয়া লীগ হইতে একেবারে বাহির হইয়া যায়। ক্লাবের প্রেসিডেন্টের পদে বিধুচরণ ছিলেন বলিয়া সে যাত্রা সেবু কোনোমতে পার পাইয়া যায়। নয়ত ঠিক হইয়াছিল পাড়ার মোড়ে সেবুকে কান ধরিয়া গুনে গুনে পঞ্চাশ বার ওঠবস করিতে হইবে এবং গোবর মাখিয়া নিজের হাতে একশত ঘুঁটে প্রস্তুত করিতে হইবে। তাহার জ্যেঠু ক্লাবের ছেলেদেরকে বসিয়া পাঁঠার মাংসভাত খাওয়াইবার ব্যবস্থা করাইতে তবে তাহারা ক্ষান্ত হয়। এমন লঙ্কাকাণ্ড আরও আছে তবে সেসব বলিতে গেলে নূতন করে রামায়ণ রচনা করিতে হইবে।

যাহা হউক, তাহার পর হইতে সেবু খানিক দমিলেও সময়ানুক্রমে তাহার এই পরোপকারের পোকাটা নড়িয়া ওঠে মাঝে মাঝেই। এমনই একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলি।

শ্রাবন মাস। পুজোর আর বেশি দেরি নাই। মনোহরপুর তো বটেই আশেপাশের তল্লাটেও একেবারে সাজসাজ রব পড়িয়া গিয়াছে। মেঘলা আকাশে রোদের লুকোচুরিতে মানুষের মনে আগমনীর ছোঁয়া কাশফুলের মতোই দোদুল্যমান। রবিবারের বিকেল। বিধুচরণ তাহার বাড়ির বৈঠকখানায় ক্লাবের কর্তা ব্যক্তিদের সহিত আসন্ন শারদ উৎসব লইয়া আলোচনা করিতেছেন। মনোহরপুর সম্বন্ধে যাহারা খোঁজ খবর রাখেন তাহারা জানেন মনোহরপুরে মহা আড়ম্বরে দুইটি বড় পূজা হয়। বিধুচরণদের ক্লাব - 'হরিসভা' এবং 'আদর্শ পল্লী'। এই দুইটি ক্লাবের মধ্যে রেষারেষিও চরম হইয়া থাকে। কে কাহাকে কিভাবে টেক্কা দিবে তাহা লইয়া বহুদূর অবধি জল গড়ায়। প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জা, আলো ও আবহশব্দের মিশেলে দুইটা পুজোই দেখিবার মতো এক একখানা বস্তু তৈরী হয় বটে। আশেপাশের অঞ্চল তো বটেই বহুদূর হইতেও শয়ে শয়ে মানুষ জমা হয় এই আশ্চর্য কাণ্ডদ্বয় সচক্ষে দেখিবে বলিয়া। তাহার উপর আবার প্রাইজের হাতছানি রহিয়াছে। এ যাবৎ হরিসভা সর্বাধিক বার ফার্স্ট প্রাইজ পাইয়া ক্লাবের ও বিধুচরণের সুনাম বজায় রাখিয়াছে। কিন্তু এই বছরের পুজো লইয়া সকলেই একটু বেশি চিন্তিত। তাহার কারণ হইল এই, যে খবর পাওয়া গিয়াছে এই বৎসর আদর্শ পল্লী নাকি উড়োজাহাজ বানাইবে। শহর হইতে নামকরা কারিগর ও দক্ষ মিস্ত্রী লইয়া তাহারা অতিপূর্বেই তাহাদের কাজ আরম্ভ করিয়াছে। জনান্তিকে শোনা যাইতেছে, যেরূপ গতি ও লক্ষ্য লইয়া আদর্শ পল্লী অগ্রসর হইতেছে তাহাতে তাহারা একেবারে ফার্স্ট প্রাইজটি লইয়া তবে থামিবে।

স্বভাবতই বৈঠকখানায় হরিসভার কর্মকর্তাদের মুখ তমসাচ্ছন্ন হইয়া আছে। সকলেই বিধুচরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বসিয়া আছেন। এই সংকট মুহূর্তে তাঁহাদের একমাত্র ভরসা তিনিই কারণ তাঁহার বুদ্ধি ও অর্থের উপরই নির্ভর করিবে এই বৎসর হরিসভার কি থিম হইবে। অথচ বিধুচরণ তাহার সাধের তক্তপোশের ওপর বসিয়া নির্বিকার তামাক সেবন করিতেছেন। কোনো কথা কহিতেছেন না। ক্লাবের সেক্রেটারী মাঝবয়েসী শেখর চৌধুরী নিরুপায় হইয়া বলিয়া উঠিলেন, 'মিত্রমশাই কিছু বলুন, আমরা তো কোনো হদিসই পাচ্ছিনা। তেমন কিছু না হলে আদর্শ পল্লীকে ঠেকানো মুশকিল হবে এবার'। বিধুচরণ তাহার তামাকের নলটি একপাশে সরাইয়া রাখিয়া খানিক দাবড়ানির স্বরে কহিলেন, 'দ্যাখো শেখর, তুমি বলছ বিশ্বেশ্বরের মন্দির করবে আর গোরা বলছে তাজমহল বানাবে। বলি তারপর কি দুজন সেক্রেটারি আর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিলে শিবঠাকুর আর শাজাহান হয়ে বটতলার মোড়ে বিড়ি ফুঁকবে ? কি ভেবেছ কি ? টাকাটা আসবে কোত্থেকে শুনি, য়্যাঁ ?

'আজ্ঞে টাকাটা যদি আমরা সবাই মিলে এ বছর একটু বেশি করে তুলি, তাহলে' ? গোরা মিনমিন করিয়া জিজ্ঞেস করে। বিধুচরণ ব্যঙ্গ করিয়া বলেন, 'টাকা কি শিউলি ফুল, যে কাছে গেলাম আর টুক করে তুলে নিলাম। চাঁদা বাড়ালেই যে সবাই রাজি হবে তাতো আর নয়। দিনকাল যা পড়েছে তাতে ট্যাক্সোর ঠেলায় মানুষ পাজামা ছেড়ে হাফ প্যান্টে নেমে এসেছে আর তুমি বলছ বেশি করে টাকা তুলি, হুঁহ' ।

শেখর আমতা আমতা করিয়া জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে উপায়' ? বিধুচরণ বলেন, 'সে কিছুটা নাহয় আমিই দিলাম আর কিছুটা চাঁদা উঠলো, কিন্তু বাকিটা ? তার কি কোনো উপায় ভেবেছ' ? বিজন মুখ বাড়াইয়া বলে, 'আজ্ঞে স্পনসর জোগাড় করতে পারলেই কিন্তু অনেকটাই.......... ' ।

কথাটা শেষ করিতে দেন না বিধুচরণ,ধমক দিয়া বলেন, 'গন্ডমূর্খের মতো কথা বোলো না বিজন, এটা কলকাতা নয় যে কোম্পানিগুলো একমাস আগে থেকেই সারিবাঁধা বাঁশের ওপর লাফিয়ে উঠে বসে পড়বে। এটা মনোহরপুর এখানে নিজেদের টাকা নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে সেটা মাথায় রাখো'। এ কথায় বিজন ও অন্যান্যরা মুষড়িয়া পড়িল। বিধুচরণ আবার বলিয়া উঠিলেন, 'ওহে বিজন, তুমি তো ক্যাশিয়ার, হিসেবে করে বলো দিকি, বাকি টাকার অঙ্কটা ঠিক কত' ? সে ব্যস্ত হইয়া খাতাপত্র খুলিয়া বলিল, 'আজ্ঞে সর্বসাকুল্যে লাখখানেক মতো কম পড়ছে' ।
বিধুচরণ গম্ভীর মুখে বলিলেন, 'নাহ, তাহলে বিশেষ কিছু করা যাবে না দেখছি। কম বাজেটের মধ্যে কিছু একটা ভাবা হোক'। 

এ কথায় সকলেই মাথা চুলকাইতে লাগিল। আদর্শ পল্লী কে টক্কর দিবার মতো তেমন কিছু কারোরই মাথায় আসিল না। সবাই এর ওর মুখের দিকে দেখিতে লাগিল। নানারকম ইশারা করিতে লাগিল কিন্তু কাজের কাজ কিছু হইল না। বিকেল গড়াইয়া সন্ধ্যা নামিল।

এমন সময় বিজন ঘরের দক্ষিণ দিকে আঙুল তুলিয়া কি একটা দেখাইয়া ভূ.... ভূ....করিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িয়া দিল। তাহার চিৎকারে উপস্থিত সকলেই চমকাইয়া সে দিকে মুখ তুলিয়া তাকাইল। যাহা দেখিল তাহাতে সবারই পিলে ছাদ ফুঁড়িয়া লাফাইয়া উঠিল প্রায়। একটি ঘন কালো বিটকেল মূর্তি তাহাদের দিকে চাহিয়া দাঁত বার করিয়া হাসিতেছে। কিছুক্ষন পর সেই মূর্তি কথা কহিয়া উঠিল। 'কি গো বিজন দাদা, ভয় পেলে নাকি গো ? আমায় চিনতে পারোনি' ? তাহার গলার স্বর বিধুচরণ চিনিতে পারিয়া কহিলেন, 'এ কিরেএএএ ? সেবু ! একি দশা করেছিস নিজের ! এতো পাঁক মেখে এলি কোথা থেকে' ? ঘরের সকলেই 'সেবু' নামটি শুনিয়া ধড়ে প্রাণ ফিরিয়া পাইল। সেবু ঠিক তেমনই দাঁত বাহির করিয়া বলিল, 'ওই ঘোষেদের বাগানে পেয়ারা পাড়তে উঠেছিলুম, পা ফস্কে পাশের ডোবাটায় পড়ে গেছিলুম আর কি' ?

- ছিছিছি সেবু, এতো বয়সেও তুই পেয়ারা চুরি করে খাচ্ছিস ? কেন শীতলকে বললে অমনি দুটো পেয়ারা তোকে পেড়ে দিতে পারতে না যে তুই একেবারে গাছে উঠে চুরি করতে গেলি ?
- না জ্যেঠু, শীতল ঘোষ ভারী নচ্ছার লোক, পেয়ারা চাইতে গেলে দুকথা শুনিয়ে দেয়.....

ঘরের মধ্যে উপস্থিত গোরা ঘোষের মুখচোখ শক্ত হইয়া গেল। তাহারই সামনে সেবু তাহার বাবাকেই গালাগাল করিতেছে । সে দিকে এক নজর দিয়া বিধুচরণ সেবুকে ধমকাইলেন, 'ছিঃ সেবু, ওকি মুখের ভাষা ? গুরুজনের প্রতি সম্মান রাখা উচিৎ। তাছাড়া তুমি পেয়ারা চুরি করে মোটেও ঠিক করোনি, পারলে সেগুলো ফেরত দাও এক্ষুনি'। সেবু ব্যাজার মুখ করিয়া প্যান্টের দুই পকেট হইতে দুটা প্রমান সাইজের পেয়ারা বাহির করিয়া গোরার সামনে ধরিল। পাঁকমাখা দুইটা পেয়ারা গোরা ফিরিয়া লইতে চাহিল না। নাকে হাত দিয়া কহিল, 'থাক থাক, ছোট ছেলে পেড়ে এনেছে যখন, খাগ্গে, ও কি আর এমন' ? সেবু কঠিনস্বরে কহিল, 'না, জ্যাঠামশায়ের হুকুম, ও তোমায় নিতেই হবে'। গোরা করুণমুখে বিধুচরণের মুখের দিকে একবার চাহিয়া কহিল, 'আচ্ছা আচ্ছা রেখে দে এখন, যাবার সময় নিয়ে যাব'।

পেয়ারাগুলো যথাস্থানে রাখিয়া সেবু একগাল হাসিয়া কহিল, 'তা তোমাদের কি আলোচনা হচ্ছিল ? আদর্শ পল্লী নিয়ে কি একটা শুনলুম যেন' ?বিধুচরণ চিন্তান্বিত হইয়া বলিলেন, 'হ্যাঁ, আদর্শ পল্লী এবার যা প্যান্ডেল করছে তাতে করে আমাদের ঠাকুর দেখতে আর তেমন ভিড় হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া বিরাট কিছু করবার টাকাও নেই আমাদের। কি করে যে সমস্ত দিক ব্যবস্থা করি সেটা ভেবেই আর কুলকিনারা পাচ্ছি না....' ? 
'শুনলুম তারা নাকি উড়োজাহাজ করছে' ? সেবু জিজ্ঞাসা করে। 
- হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিস.......

সেবু চটপট কহিল, 'তা বেশ তো। তোমরা বরং একটা পালতোলা নৌকো করো। ওদেরটা আকাশের আর আমাদেরটা জলের। সমানে সমানে লড়াই হবে। তাছাড়া নৌকো তৈরীর খরচও বিশাল নয়'। সবাই যে যার মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতে লাগিল। অর্থাৎ প্রস্তাবটা যে খুব একটা মন্দ নয় তার আভাস সকলেরই মুখেচোখে খানিক খেলিয়া গেল। বিজন ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'সে কিরকম' ? বাকিরাও উৎসুক মুখে সেবুর দিকে চাহিয়া রহিল। সেবু বলিল, 'কেন ভূপেন মাঝি আর তার সাকরেদদের বললে ঠিক কম খরচায় কিছু না কিছু একটা করে দেবে। ওরা তো হামেশাই নৌকা বানায়, জানোই তো। এই তো গেল হপ্তাতেই একটা বড় নৌকো ভাসালো তমালনদীর জলে, মনে নেই ? ওদেরকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চই করবে। তাতে হরিসভার মানও থাকে, খরচও কম হয়'।

হাতের কাছে এরকম একটা সস্তা অথচ লোভনীয় প্রস্তাবে সকলেই প্রায় লাফাইয়া উঠিল। বিধুচরণ ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, 'উত্তম প্রস্তাব সন্দেহ নেই কিন্তু ভূপেন কম খরচায় নৌকা বানাতে রাজি হবে ? নৌকার খরচও তো নেহাত মন্দ নয়'। সেবু বীরের হাসি হাসিয়া বলিল, 'গোটা নৌকো তো আর বানানো হচ্চে না, নৌকোর আদলে প্যাণ্ডেল হবে। ও তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও জ্যেঠু, আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব। হাজার হোক হরিসভার সম্মান বলে কথা, রাজি সে হবেই'। বিধুচরণ বাকিদের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, 'তোমরা কি বলো হে সবাই.....কি শেখর ? তুমি তো সেক্রেটারি, তোমার কি মত' ?

শেখর ঘাড় নাড়িয়া বলে, 'আজ্ঞে বিশ্বেশ্বরের মন্দিরটা বেশি ভালো ছিল তবে এই প্রস্তাবটা বাজেটে কুলিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এখন ভূপেনমাঝির সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা বলে ফাইনাল করে নিলেই হয়'। বিধুচরণ আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন, 'বেশ, তাহলে ভূপেনকে কালই একবার সন্ধ্যের দিকে বাড়ি আসতে বলিস সেবু, আর তোমরাও থেকো সকলে'। সেবু খানিক ইতস্তত করিয়া বলিল, 'আচ্ছা বলে দেব। তবে, ইয়ে......মানে আমার একটি শর্ত আছে'। বিধুচরণের ভুরু কুঁচকাইয়া যায়, জিজ্ঞেস করেন, 'শর্ত !! তোর আবার কিসের শর্ত রে' ? বাকিরাও সন্দেহের চোখে সেবুর দিকে তাকাইয়া রহিল। সেবু অস্ফুটে বলিল, 'ভূপেন মাঝিদের সাথে আমিও প্যাণ্ডেল বাঁধব। আমার খুব ইচ্ছে......' । 
ঘরের ভিতর যেন বজ্রাঘাত হইল।

ক্রমশ...

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #durgapujastories #pujabarshiki

Monday, September 11, 2017

অনুপদ্য - ১৬


চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalipoems #durgapujapoems

Wednesday, August 30, 2017

অনুপদ্য - ১৫

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortpoems, #durgapoems, #durgapuja

Monday, August 7, 2017

সাপ্তাহিকী ৩০ # প্রতিবিম্ব - অন্তিম পর্ব

এ কথায় মৈথিলী সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে যায়। আঙুলের নখ দিয়ে চেয়ারের কোন খুঁটতে থাকে। কিছুক্ষন বাদে ডঃ সেন আবার কোমলস্বরে জিজ্ঞেস করেন, 'আমি জানি মৈথিলী, জীবনের কিছু কিছু প্রশ্ন বড্ড জটিল হয়, কিন্তু তার উত্তর না পেলে যে আমার চিকিৎসা পদ্ধতি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুতরাং, আপনার মনে এই সময় কি চলছে সেটা জানা ভীষণ জরুরী'।
কিছুক্ষন নীরব থেকে অস্ফুটে বলে ওঠে মৈথিলী, 'আমি সঠিক জানি না, তবে এই ক দিনে আমার কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে জানেন, প্রতিদিন দেখতে দেখতেই হয়তো........এক অদ্ভুত চাহিদা তৈরী হয়েছে, তবে সেটাকে ইমোশনাল এট্যাচমেন্ট বলে কিনা আমার জানা নেই ডক্টর'।   
- আচ্ছা, আপনি বলছিলেন আপনাকে কেউ ফলো করছে কয়েকদিন ধরে, তাকে দেখেছেন কখনো ?
- না, আসলে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের গলিটা বেশ অন্ধকার থাকে, তাই হয়তো তেমন ঠাহর করে উঠতে পারিনি। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে, হয়তো বা আমারই মনের ভুল। হয়তো তেমন কিছু নয়। সবটাই মিথ্যে।

ডঃ সেন ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা পঞ্চাশ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, 'বেশ, আজ বরং এই অবধিই থাক মৈথিলী। আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। পরপর কয়েকদিন নিয়ম করে খেয়ে যান। সপ্তাহখানেক বাদে আবার আসবেন। তখন নাহয় আমরা আরেকটা সেশন করব। কেমন' ?
মৈথিলী প্রেসক্রিপশন ভাঁজ করতে করতে বলে, 'আয়নায় অন্য মুখ দেখা একদমই স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তা আমি জানি ডক্টর। আর তাছাড়া আমি ভূত প্রেতে মোটেই বিশ্বাস করি না। করলে একা ফ্ল্যাটে কিছুতেই থাকতে পারতাম না। আমি জানি না কেন এমনটা হচ্ছে । আচ্ছা ডক্টর,....আমার ঠিক কি হয়েছে সেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন ?

- কিছুটা........যদিও আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হবে আপনি হ্যালুসিনেট করছেন।
- হ্যালুসিনেশন !! কিন্তু কেন ?
- সেই প্রশ্নের উত্তরটাই তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে মৈথিলী। আমার বিশ্বাস সে প্রশ্নের উত্তর আগামী সেশনেই পাব। আপাততঃ আপনি ওষুধগুলো খেয়ে যান। চিন্তার কিছু নেই। বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট কার্ল জাং কি বলেছেন জানেন ?

মৈথিলী দুদিকে ঘাড় নাড়ে।
- বলেছেন, 'who looks outside.......dreams ; who looks inside......awakes'। সুতরাং, মনের ভেতরের মানুষটাকে জানা খুব প্রয়োজন, ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট সেটা.........আমাদের আবার দেখা হবে মৈথিলী।

ডঃ সেন দুহাত জড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন। মৈথিলী প্রতিনমস্কার করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডঃ সেন চিন্তাক্লিষ্ট মুখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে, মনে মনে সম্ভাব্য ঝড়ের আভাস টের পেলেন বোধহয়।

সপ্তাহখানেক বাদে। ডঃ সেনের চেম্বারে মৈথিলীকে অনেকটা ক্লান্তিমুক্ত লাগে। মুখের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ ভাব লক্ষ্য করা যায়। 'কেমন আছেন মৈথিলী' ? মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করেন ডঃ সেন।
- আগের থেকে ভালো....
- ওষুধগুলো ঠিকঠাক চলছে তো ?
- হ্যাঁ, যেমনটা বলে দিয়েছেন..... ইদানীং রাত্রে ভালো ঘুম হচ্ছে।
- বেশ বেশ, এতো সুখবর......

একথায় আলগা হাসে মৈথিলী। ডঃ সেন দু চোখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'এর মধ্যে সেই মুখটা আর দেখতে পেলেন' ?
- রোজ দেখিনি, তবে এই কদিনে বার দুয়েক দেখেছি....
- কোথায় ? বাড়িতে না বাইরে ?
- বাড়িতেই.....
- চিনতে পারলেন ?
- নাহ, কিন্তু আগের বারের মতো এবারেও ভীষণ চেনা মনে হলো জানেন।
- হুমমম........... কোনোরকম কথার আদান প্রদান ?
- নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম.....
- কি বলল ?
- কিছু বলেনি, শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে.....
- কিন্তু তার নাম তো আপনার জানার কথা, তাই না মৈথিলী ?

'আমার জানার কথা' !! মৈথিলী বিস্মিত হয় খুব। 'এ আপনি কি বলছেন ডঃ সেন ? আমি জানলে কি আপনাকে বলতাম না.....'
ডঃ সেন বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুলে বললেন, 'এমনও তো হতে পারে আপনি বলতে চান না......'

- এ কেমন কথা ডক্টর ! নাম লুকিয়ে আমার কি লাভ ? আর খামোকা লুকোতেই বা যাব কেন ?
- বেশ........আমরা একটা কাজ করি বরং মৈথিলী, আজ আপনি আপনার অতীতের কথা বলুন আমাকে, যতটা পারবেন.....আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো সূত্র আমরা পাবই। কি, বলবেন তো ?
- বেশ, বলব.....

ডঃ সেন নিজের চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে এলেন সামনে, ঈষৎ ঝুঁকে বললেন, 'আপনি যাতে মুক্তমনে সবটা বলতে পারেন তার জন্য আমাকে সামান্য হিপটোনিজমের সাহায্য নিতে হবে। শুধু আপনি মনের দরজা জানলাগুলো সম্পূর্ণ খুলে রাখবেন, তাতে আপনার ভার লাঘব হবে শতগুন। আমি কথা দিচ্ছি, এতে কোনোরকম ঝুঁকি নেই'। মৈথিলী মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে । দুহাত কোলের ওপর জড়ো করে নিস্তব্ধ বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত। ডঃ সেন মৈথিলীর মনের ভাব আন্দাজ করতে পেরে বললেন, 'দেখুন, এই হিপ্নোটিজমটা সম্পূর্ণ আপনার সম্মতির ওপরেই নির্ভর করছে। আপনি রাজি না হলে আমি কখনোই জোর করব না'। মৈথিলী মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, 'আমি জানি ডক্টর, আমায় শুধু বলুন আপনি কি জানতে পারবেন ওই মুখটা কার' ?
- আমার বিশ্বাস আমি পারব, যদি আপনি কোয়াপরেট করেন তবেই......

মৈথিলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।

ডঃ সেন উঠে গিয়ে জানালার সবকটা পর্দা টেনে দিলেন। ঘরের আলো নিভিয়ে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে দিয়ে মৈথিলীর মুখোমুখি বসলেন। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র ধীরে ধীরে ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল যেন। আবছা আলোয় শুধুমাত্র দুজনের মুখ আলোকিত হয়ে রইল অজ্ঞাত কাহিনীর প্রত্যাশায়। পকেট থেকে একটা সরু ফাউন্টেন পেন বের করে আনলেন ডঃ সেন। অস্ফুটে বললেন, 'আপনি সমস্ত কিছু ভুলে যান মৈথিলী, শুধুমাত্র এই পেনের মুখের দিকে ফোকাস করুন, কোনোভাবেই এর থেকে চোখ সরাবেন না'। তারপর মৈথিলীর চোখের সামনে এক অদ্ভুত ঢিমে ছন্দে পেনটা দোলাতে লাগলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মৈথিলীর চোখ আঁটকে গেল পেনের মুখে। পেনের দুলুনির সাথে সাথে মৈথিলীর চোখও সরতে লাগলো সমানতালে। ডঃ সেন অত্যন্ত ধীরগম্ভীর গলায় বললেন, 'অতীতের কথা মনে করুন মৈথিলী, অতীতের কথা আমায় বলুন.......আপনি কি কিছু মনে করতে পারছেন..... দেখতে পাচ্ছেন কিছু' ? মায়াময় পরিবেশে মৈথিলীর চোখ বুজে এল আপনা আপনি। এক স্তিমিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল যেন বহুদূর থেকে, 'কলেজ..............ক্যান্টিন.............'

- আর কি দেখতে পাচ্ছেন ?
- আমি বসে আছি ............সামনে দুমড়ানো মুচড়ানো একটা কাগজ..........
- কিসের কাগজ ?
- চিঠি..............ইন্দ্রনীলকে লিখেছিলাম.........
- তারপর ?
-সে ফেরত দিয়ে গেছে.........বলেছে আমার গার্লফ্রেন্ড হবার যোগ্যতা নেই........আমি কাঁদছি.......একা.....
- আর কি দেখছেন মৈথিলী ?

কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা......... আবার মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এল.......

- আউট্রাম ঘাট................হাওড়া ব্রিজ.............চারিদিকে সন্ধ্যের আলো জ্বলছে........
- আপনি একা ?
- না...............পারিজাত আছে......
- পারিজাত ?
- পুরোনো অফিসের কলিগ.......
- কি বলছে পারিজাত ?
- বিয়ে করতে পারবে না...........
- কেন ?
- বাড়িতে...............সুন্দরী বৌ চায়...............আলো নিভে যাচ্ছে.........আমি কাঁদছি.............একা.......
- আর কিছু মনে পড়ছে মৈথিলী, আর কিছু ?

মৈথিলীর চোখের পাশ দিয়ে সরু জলের রেখা গড়িয়ে পড়তে থাকে। ডঃ সেন গলাটা আরও এক খাদ নিচে নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'বলুন মৈথিলী........আমায় বলতে থাকুন, থামবেন না.......'। মৈথিলী নিরুত্তর বসে থাকে......সামান্য ঠোঁট নড়ে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ পাওয়া যায় না, চোখের পাতা কাঁপতে থাকে তিরতির করে। এমন সময় হঠাৎ, ঘরের সমস্ত নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে এক চাপা অথচ কঠিন পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে ওঠে মৈথিলীর ভেতর থেকে।

"আপনি কেন মৈথিলীকে কষ্ট দিচ্ছেন ? কি চান আপনি"..........??

চমকে ওঠেন ডঃ সেন। দু হাতে চেয়ারের হাতলদুটো আঁকড়ে ধরেন উত্তেজনায়। বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে থাকেন মৈথিলীর দিকে। সন্দেহের তীর যে এতো অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যভেদ করবে বিশ্বাস করতে পারেন না। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, 'ক্কে, কে কথা বলল' ? কিছুক্ষনের শীতল নীরবতা বয়ে যায় সমস্ত ঘর জুড়ে । ডঃ সেন আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, 'বলুন, কথা বলুন, কে আপনি'। কোনো এক অতল গভীর থেকে সে পুরুষ কণ্ঠস্বর আবার কথা বলে ওঠে, 'আমি ময়ূখ..... ময়ূখ দাশগুপ্ত'।

- ময়ূখ !! কে ময়ূখ ?
- আমি মৈথিলীকে ভালোবাসি......

ডঃ সেন প্রায় হাঁ হয়ে গেলেন এই কথায়। কিছুক্ষনের জন্য মুখে কোনো কথা সরল না। পরক্ষণেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, 'আপনাদের পরিচয় হল কি করে' ?

- মৈথিলী আমাকে চিঠি লিখত।
- চিঠি লিখত !! আপনাকে ?
- হ্যাঁ........প্রতি রাত্রে নিয়ম করে...........ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয় ......আমরা ভালোবাসতে শুরু করি একে অপরকে।
- মৈথিলী আপনাকে ভালোবাসে ? আপনাকে বলেছে সে কথা ?
- হ্যাঁ বলেছে, চিঠির মধ্যে দিয়ে.......নিঃশব্দে জেনেছি আমরা একে অপরকে.............. প্রতিনিয়ত আয়নার মধ্যে দিয়ে খুঁজে নিয়েছি দুজনকে ..............মৈথিলী আমার প্রাণ...........মৈথিলী আমার প্রেম।
- কিন্তু......আপনি তো মৈথিলীরই অন্য স্বত্বা। নিজের সাথেই নিজের সম্পর্ক তৈরী হওয়া..... এ কি করে সম্ভব ? 
- নিজেকে ভালোবাসা অপরাধ নাকি ডাক্তার ? কে বলে ?
- কিন্তু আপনি মৈথিলীর দুর্বলতাকে আশ্রয় করে তার মনে বাসা বেঁধেছেন......একথা মৈথিলী জানলে সে কখনোই আপনাকে প্রশ্রয় দিত না।

'আপনি ভুল বলছেন ডঃ সেন', চিৎকার করে ওঠে পুরুষ কণ্ঠস্বর, 'আপনি ভুল..........আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক, বেঁচে থাকার প্রেরণা'।
- না আমি ভুল নই ময়ূখ, আমি একজন স্পেশালিস্ট ডাক্তার, সমস্তটা জেনেই আমি বলছি। পক্ষান্তরে আপনি মৈথিলীর চরম ক্ষতি করছেন।
- আমি ক্ষতি করছি মৈথিলীর ? আমি !!
- অবশ্যই করছেন, একটা অবাস্তব সম্পর্কের বন্ধনে মৈথিলীর মনস্তত্বে আপনি ধীরে ধীরে ক্ষত সৃষ্টি করছেন। সময়ের সাথে সাথে সে ক্ষতের আকার এমন বিপর্যয় ডেকে আনবে, তখন মৈথিলীকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
- না না, আমি মানি না, আপনার সমস্ত কথা মিথ্যে।
- আমার কথা বিশ্বাস করুন ময়ূখ, আপনি বরং মৈথিলীকে বোঝান, সে নিশ্চই বুঝবে আপনার কথা। সময় বিশেষে তার কষ্ট হবে একথা ঠিক, কিন্তু এই অলীক সম্পর্কের জেরে মৈথিলীকে আপনি অজান্তেই নিদারুন বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। আপনি কি চান না মৈথিলী সুস্থ হয়ে আর চার পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকুক ? ভালোবেসেছেন যখন, তখন ভালোবাসাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্য নয় কি ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আবার একা হয়ে পড়বে ? তখন ?
- উনি আজ একা আছেন, কাল নাও থাকতে পারেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকায় আপনি অন্তরায় হবেন কেন ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আমায় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে.......
- ঠিক, কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঘটনার অস্বাভাবিকতায় সে নিজেই একজন ডাক্তারের পরামর্শ চেয়েছে। সুতরাং আপনি যদি তার বাস্তব হতেন তাহলে সে কখনোই আমার কাছে আসতো না। তাই না ??.....বলুন ময়ূখ ? বলুন আমাকে......

বিপরীত চরিত্র নিরুত্তর থাকে । ডঃ সেন অধৈর্য হয়ে ওঠেন, বলেন, 'কথা বলুন ময়ূখ, কথা বলুন আমার সাথে'। কিন্তু ময়ূখের দিক থেকে আর কোনো রকম সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। বারকয়েকের চেষ্টাতেও যখন ময়ূখ নীরব থাকে তখন উপায়ন্তর না দেখে ডঃ সেন নিজস্ব পদ্ধতিতে মৈথিলীকে জাগিয়ে তোলেন ধীরে ধীরে। মৈথিলী কোনো এক গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে নির্বাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। ঘরের সমস্ত আলো জ্বালিয়ে দিয়ে ডঃ সেন নিজের চেয়ারে এসে বসেন। 'একটু জল', মিনমিন করে বলে মৈথিলী। মৈথিলীর সামনে একটা জলের গ্লাস রাখেন ডঃ সেন। ঢকঢক করে সমস্ত জলটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে মৈথিলী। চোখেমুখে অপার ক্লান্তি নিয়ে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসে চেয়ারে।

ডঃ সেন চশমা মুছতে মুছতে বলেন, 'মনস্তত্ব বড় জটিল জিনিস মৈথিলী। মানুষের মনের হদিস পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার, বিশেষ করে সে মন যদি রোগাক্রান্ত হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে মানুষের মন হচ্ছে কতকটা সমুদ্রের মতো। আমরা সাইকিয়াট্রিস্টরা সেই সমুদ্রের মাঝে ডুব দিয়ে কিছু কিছু স্পন্দন ছুঁয়ে আসতে পারি মাত্র। অধিকাংশটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আপনার ক্ষেত্রেও কতকটা তাই ঘটেছে। বেশ কিছুটা জানতে পেরেছি, বাকিটা সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পাবে আশা করি.....'। মৈথিলী অবাক হয়ে বলে, 'আপনি ঠিক কি বলছেন, আমি তো কিছুই............'।

'বলছি', স্মিত হাসেন ডঃ সেন, চশমাটা গলিয়ে নিয়ে বলেন, 'আপনার যে রোগটি হয়েছে সেটি সচরাচর দেখা যায় না। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার, সংক্ষেপে ডিআইডি। প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার। অর্থাৎ একই দেহের মধ্যে একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি। আমার অনুমান এই রোগ সম্বন্ধে আপনি শুনে থাকবেন আগে, কারণ এই বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্বে রিসার্চ চলছে এবং অগণিত বই ও সিনেমাও বেরিয়েছে। মৈথিলী একরাশ বিস্ময় মিশিয়ে বলে, 'আর.... আর সেই মুখটা, সেই মুখটার ব্যাপারে জানতে পারলেন কিছু' ?

-যে মুখ আপনি আয়নায় দেখেছেন সে আপনারই ছায়া মৈথিলী, আপনার অবিচ্ছেদ্য প্রতিবিম্ব.......

মৈথিলী বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, 'কেমন করে.......? উত্তরে ডঃ সেন বলেন, 'একাধিক প্রত্যাখ্যান ও বহুদিনের নিঃসঙ্গতার কারণে আপনি মনে মনে এমন এক পুরুষ চরিত্রের কল্পনা করেছেন যে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে কোনোরকম কারণ ছাড়াই। বিশেষত রূপের কারণে তো নয়ই। আমরা সাধারণ মানুষ সেটাই চেয়ে থাকি, কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার দরুণ আপনার ক্ষেত্রে সে ভালোবাসার আবির্ভাব ঘটেনি বলেই আপনি এক কাল্পনিক প্রেমিকের চিত্র এঁকেছেন মনে মনে। রাতের পর রাত প্রেমপত্র লিখেছেন কোনো এক অজ্ঞাত ভালোবাসার মানুষকে। এবং পরবর্তীকালে, অজান্তেই, 'ময়ূখ দাশগুপ্ত' নাম দিয়ে আপনি হাজির করেছেন সেই কল্পনার পুরুষকে। আপনার কল্পনার তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি তাকে বিভিন্ন জায়গায় হ্যালুসিনেট করতে শুরু করেন, কখনো বাড়িতে আবার কখনো বাইরে। কিন্তু আপনি আমাকে একটা ছোট্ট অথচ ভাইটাল ইনফরমেশন চেপে গেছেন। আমার বিশ্বাস আপনার এই চিঠি লেখালিখিটা আরও আগের থেকেই। কিন্তু পরে যখন আপনি চোখের সামনে একটা মুখ দেখতে পেলেন তখনই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। কারণ আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এইবার এই ঘটনাগুলো একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। তবে যেহেতু এটা আর্লি স্টেজ এবং আপনার মৈথিলী সত্ত্বার প্রভাব অনেকাংশেই বেশি তাই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কিছুটা এড়ানো গেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেতে সময় লাগবে এখনো।

মৈথিলী উদ্বিগ্ন মুখে বলে, 'তাহলে ডক্টর, এখন উপায়' ?

- একমাত্র উপায় হচ্ছে রেগুলার কাউন্সেলিং, নিয়মিত কিছু ওষুধ খাওয়া ও মানসিক জোর বাড়ানো।
- তাহলেই কি আমি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবো ?

- হাই চান্স, তবে অধিকাংশটাই আপনার ওপর ডিপেন্ড করছে। আপনি কি চাইছেন এবং মনকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন সেটাই মেজর ইস্যু। এখন থেকে আপনার প্রধান কাজ হবে ময়ূখের সত্বাকে কোনোরকম ভাবেই ইনফ্লুয়েন্স না করা এবং এই বিষয়ে কোনোভাবেই চিন্তা না করা। অবসর সময় ভালো বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, অথবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিন। মনকে শান্ত রাখা বড় কঠিন মৈথিলী, আমি জানি, কিন্তু এই কঠিন কাজটাই আপনাকে করে যেতে হবে। বাকিটা আমি চেষ্টা করব সাধ্যমতো। এই ওষুধ কটা লিখে দিলাম, এগুলো কোনোভাবেই বন্ধ করবেন না, তাহলে কিন্তু আবার এটাকটা হতে পারে। আমার বিশ্বাস আমরা যদি দুজনেই যথাযথ চেষ্টা করি, তাহলে এই রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। আপনি বরং সামনের সোমবারই চলে আসুন, সেদিন থেকেই আপনার থেরাপি শুরু হবে। কেমন ?

সমস্তটা শুনে মৈথিলী ধীরে ধীরে উঠে পড়ে সোফা থেকে। একবুক চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ। কোনো রকম শব্দ খরচ না করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মন্থর গতিতে ।

পরদিন সকালে নিয়মমতো এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে মৈথিলীর। পরদার ফাঁক দিয়ে মনখারাপের আলো ঢুকে পড়েছে যেন। কেমন যেন অন্য রকম একটা দিন আজ, মেঘলা, ছন্নছাড়া মতো । বিছানা ছেড়ে উঠে অলস পায়ে একটা ছোট দেরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রয়ারটা টানতেই ভেতর থেকে কিছু ওষুধের পাতা আর একগোছা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আসে। ডঃ সেনের কথা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ । ঘুম থেকে উঠেই ওষুধটা খাওয়ার কথা বলেছেন। ওষুধের পাতাটা হাতে নিয়ে কাগজের টুকরোগুলোয় চোখ বোলাতে থাকে মৈথিলী। ময়ূখকে লেখা সমস্ত চিঠি। ওষুধটা খাওয়া মানেই ময়ূখকে ভুলে যাওয়ার পথে এক কদম বাড়ানো। ময়ূখের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সূত্রপাত। গভীর চিন্তা করে মৈথিলী। নিজের সাথে কয়েক দিনের অন্তরঙ্গতায় তার সমস্ত দুর্বলতাকে ছাপিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বাদ পেয়েছে সে। অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে সে এতদিনে। নিজের বিপরীত স্বত্বার প্রতি অনুরাগ হলেও নিখাদ, নিষ্পাপ প্রেমই তো ! এটাই তো চেয়েছিল সে। ওষুধ খেলে সুস্থ হবে হয়তো, ভালো করে বাঁচতে পারবে কি ? বেঁচে থাকা কাকে বলে..... ? এক অদ্ভুত উভয়সংকটে পড়ে দিশাহীন খাঁচার পাখির মতো ছটফট করতে থাকে মৈথিলী। এমন সময় কোনো এক নিভৃত অতল থেকে এক পুরুষের মরমী কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, 'মৈথিলী.............মৈথিলী................'

মৈথিলী দ্রুত হাত চাপা দেয় কানে। কিন্তু সে অদম্য কণ্ঠস্বর সমস্ত প্রতিরোধ কাটিয়ে আবার ডেকে ওঠে, 'মৈথিলী...................'  ওষুধের পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মৈথিলী। সমস্ত পিছুটান, সংযম, মিথ্যে করে একছুটে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আয়নায় চোখ রেখে বলে ওঠে,...........
'ময়ূখ ? কেমন আছ ময়ূখ ? আজ দেরি করলে যে ..................' !!

চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব 
#bengalishortstories #drama #thriller