Thursday, November 30, 2017

বন্ধু চল # ২

ছবি : সৌম্য 
কয়েকদিন যাবৎ দুদিক থেকেই ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিল। টিপ্ করে কেউই একটা কমন ডেট লাগাতে পারছিলুম না। শেষমেষ 'দুত্তোর নিকুচি করেছে' বলে একটা শনিবার তাক করে জুতো মোজা পড়ে দুজনেই ফুলবাবুটি সেজে বেরিয়ে পড়লুম। অবশ্যি যাবার আগে কেউই তেমন বাড়িতে বলে বেরোতে পারিনি ঠিক কোথায় যাচ্ছি। কারণটা পরে বলছি। 'চললাম, ফিরতে দেরি হবে' বলে কতকটা বুক চিতিয়ে কুচকাওয়াজের ঢঙে বেরিয়ে পড়েছিলাম শহরের দক্ষিণ দিক বরাবর। এটা অনেকটা আমাদের এক পুরোনো স্কুল বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরোনোর মতো।  বিকেল বেলায় 'মা, একটু বেরোচ্ছি'... বলে সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে রাঁচি এক্সপ্রেস ধরে এক্কেবারে বিহার চলে গিয়েছিলো সে। পাক্কা হপ্তাখানেক পর বাড়ি ফেরাতে তার বাবা বাঁজখাই গলায় বলেছিলেন, 'যেখানেই যাও না কেন তোমার বডি আমার চাই, রোজগার করতে না পারো তোমার ইন্সিওরেন্সের টাকাতে সংসারের হিল্লে হবে অন্তত কিছুটা'। তবে এক্ষেত্রে ততটা দুঃসাহস দেখানোর মতো বুকের পাটা ইদানীং কালে আমাদের কারোরই হয় নি। ঘর সংসারের নাগপাশে যাঁরা বন্দী হয়ে উইকেণ্ডের ছুটিতে দুদণ্ড নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পান না তাঁরা বুঝবেন নিশ্চই। সে যাগ্গে.....

ছবি : নিজস্ব 
টালিগঞ্জের গাছতলা স্টপেজে যখন দুজনে দেখা করলুম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটা ছুঁয়েছে। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঝিলমিলে রোদের ফাঁকে দুজনেই নিরুদ্দেশের ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছি প্রাণপণে। কিছু না পেয়ে, দোনোমোনো করে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা চললুম বারুইপুরের দিকে। সেখানে গিয়ে কোথায় যাব, কি করব তেমন সম্যক ধারণা দুজনের কারোরই ছিল না। বারুইপুর পৌঁছে আমার খেয়াল হল আমি প্রায় কোনো টাকাপয়সা না নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। 'ওরে ও বাউল শোন, মণিকাঞ্চনে  নাহি মন '.......  অতএব চটজলদি একটা এটিএমের সামনে দাঁড়াতে হল। খানিক বাদে রাস্তা পেরিয়ে যখন বন্ধুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালুম তখন সে বললে, 'বুঝলি, একটা কাজ করা যেতে পারে। এদিক ওদিক না ঘুরে চল ডায়মন্ড হারবার চলে যাই। এখান থেকে ঘন্টা আড়াইয়ের পথ হবে। এখন সাড়ে বারোটা বাজে, তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাব, তারপর কোথাও একটা লাঞ্চ করে গঙ্গার পারে বসে একটু আড্ডা মেরে ফিরে আসব। কি বলিস' ?

এমন অবাক করা কথায় আমিও অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারলুম না সেই সময়। ডায়মন্ড হারবার !! কলকাতার বাইরে অন্য সমস্তরকম রাস্তা আমার কাছে পার্ল হারবারের সামিল। ঢোঁক গিলে বললুম, 'তুই রাস্তা চিনিস' ? কোনোরকম কুন্ঠা না রেখে সে বললে, 'নাহ, জিজ্ঞেস করতে করতে চলে যাব, অসুবিধে হবে না'। কালক্ষেপ না করে বললুম, 'চল তবে'...........'বাহির হয়েছি  আজ, কিসের শরম, কিসের লাজ  '......

ছবি : নিজস্ব 
অতএব একের পর এক তেপান্তরের পথ অতিক্রম করে আমাদের দু চাকার পক্ষীরাজ উড়ে চলল। মাঝে একটা স্টেশন পেরোলাম। নামটা ভারী মায়াময়  - 'কৃষ্ণমোহন'। জায়গাটা বেশ ঘুম জড়ানো। শান্ত, ধীর স্থির। শহরের ক্যাকোফোনি থেকে কয়েক যোজন দূরে। নামের সাথে তাল মিলিয়ে যদি সেখানে মোহনবাঁশির রাগ শুনতে পেতুম বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হতুম না। সে চত্ত্বরের আশেপাশে বিশেষ জনবসতি নেই। একটা পুরোনো চায়ের দোকান আর কয়েক হাত দূরে দূরে গোটা কয়েক মাটির ঘর। দুরন্ত হাঁস মুরগির পায়ের ছাপে দুপুর গড়ায় সেখানে। পল্লী বাংলার আদি অকৃত্রিম চিত্রপট। খানিক এগিয়ে একটা ডাবওলাকে দেখে বাইক দাঁড় করানো হল। টলটলে মিষ্টি জলে প্রাণ জুড়িয়ে গেল একেবারে। দু চারটে ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললুম সামনে। যাবার আগে রুটটা জিজ্ঞেস করেছিলুম একজনকে। বলল, 'পঁচিশ কিলোমিটার নাক বরাবর এগিয়ে যান, বিষ্ণুপুরের আগে আর কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার পড়বে না'। 'আজ হারিয়ে যাবার মন , অত শুধোবার কি প্রয়োজন '.........অগত্যা....... 

ছবি : নিজস্ব 
জয়নগর পেরিয়ে যে মনভোলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছিলাম তার ভুবনমোহিনী রূপ চোখে না দেখলে দু চার কথায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। দু দিকে বট, অশ্বত্থ আর মেহগনি গাছের অনুষ্টুপ সারি। একদিক থেকে আরেকদিকে ঝুঁকে পড়ে যে যার মতো জড়াজড়ি করে পথের ওপর আলোছায়ার আলপনা তৈরী করেছে। সে ছায়াপথের একদিকে দিগন্ত জোড়া মাঠ আর ক্ষেতের সবুজ হাতছানি আর অন্যদিকে একফালি লম্বাটে ডোবা সোজা চলে গেছে দূরের থেকেও দূরে। সেই ডোবার ওপর থোকা থোকা পানিফলের আগাছা ভেসে রয়েছে দ্বিপ্রহরের সূর্যের দিকে চেয়ে। দু চার গজ অন্তর যেখানে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে আগাম শীতের জানান দিচ্ছে। দেরি না করে নেমে পড়লুম সেখানে। একটানা জার্নির ধকল উধাও হল মুহূর্তে। শরীরের আনাচে কানাচে বয়ে গেল হেমন্তের মিঠে পশমিনা হাওয়া। বদ্ধ শহরের আগল খুলে খোলা হাওয়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম দুজনে। খানিক্ষন রাস্তার ধারে গুলতানি করে আবার এগিয়ে চললুম। সামনে বিষ্ণুপুর। ...... 'এ পথের নেই শেষ, আমার বাংলা, এই আমার দেশ '...... 

ছবি : নিজস্ব 
আরও মিনিট কুড়ি চালিয়ে বিষ্ণুপুর পৌঁছে ডানদিক নিয়ে সোজা এগিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়লাম। মাথার ওপর মেঘের নীল পেরিয়ে চলেছি একের পর এক। কালো রাস্তার পিচে আমাদের নাছোড়বান্দা ছায়া আঁকা হয়ে চলেছে সমানতালে। আলটপকা সুরে গেয়ে উঠছি কখনো কখনো.......ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি........ দেখতে দেখতে বহুদূরে চোখের সামনে ঝলসে উঠলো সহস্র রুপোলি আলো। ঈষৎ কম্পমান নদীর জলে সূর্যের রশ্মি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গার পার বাঁদিকে রেখে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম ডায়মন্ড হারবারের বুকে। বাইক স্ট্যান্ড করেই দৌড়ে গেলাম পারের ধারে। ডানদিক বাঁদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু জল। নদীর অন্য প্রান্তে হলদিয়া পোর্টের আবছায়া রেখা দেখতে পেলুম। তার কিছুটা আগে একটা জাহাজ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। নোঙর ফেলে দিনবদলের অপেক্ষা করছে যেন। জোয়ারের মৃদু দুলুনিতে জলের সাথে ভাটিয়ালি আলাপ জমাচ্ছে বোধহয়। বেশিক্ষন দাঁড়ালাম না কারণ খিদে পেয়েছে জোর। 'দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, খালিপেট আর নাহি সয় '.......

ছবি : সৌম্য 
যেতে যেতে মালুম হয়নি তিনটে বেজে গেছে অনেক্ষন। বিনা বাক্যব্যয়ে উল্টোদিকে সাগরিকা হোটেলের পথে পা বাড়ালুম। যা অর্ডার দিয়েছিলুম তাতে করে এমনি সময় আরও একজনের খাওয়া হয়ে যেত। ভাত, সোনামুগের ডাল, ঝিরঝিরে আলুভাজা, আলুপোস্ত, পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় এরা কেউই পাতে পড়ার সময় পেল না। আসার মিনিট পনেরোর মধ্যেই উড়ে গেল সেসব। তার সাথে চলল দেদার আবোলতাবোল কথা, অযৌক্তিক ফাজলামো ও প্রাণখোলা হাসি। মৌরি চিবোতে চিবোতে আরও একদফা পারে গিয়ে বসলুম দুজনে। একটা নিরিবিলি বটতলার বেদির নিচে আয়েস করে বসে বসে দেখতে লাগলুম একদল জেলেদের মাছ ধরা। দু একবার খালি জাল ওঠার পর তাদের সাথে সাথে আমরাও আফসোস করতে লেগেছিলুম খানিক।পশ্চিম আকাশে তখন বকের ডানায় সন্ধ্যা নামছে পা টিপে টিপে। এবার ফেরার পালা। একবুক তৃপ্তি আর ভালোলাগা নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলুম আবার। ডায়মন্ড হারবার রোডের অন্ধকার পেরিয়ে কখন যে কলকাতা এসে পৌঁছলুম টেরও পাইনি। 

এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে সফর করে এলাম, সঙ্গী করে নিয়ে এলাম ফেরারী মন আর মুঠোভর্তি বেঁচে থাকার কারণ। দুজনে পণ করলাম, আসছে মাসে আবার......... কিন্তু কোথায় ? আজ্ঞে কত্তা, জানিতে চাহিয়া লজ্জা দিবেন না....... 

কৃতজ্ঞতা : সৌম্যর বাইক - ১০০ কিমির বেশি চলেছিল সেদিন ।

ছবি : নিজস্ব 
 #bengaliarticle #bengalitravelstory #diamondharbourtour    

Thursday, November 23, 2017

কার্ত্তিক শীল

ছবি : নিজস্ব 
উপরোক্ত নামটি কোনো রক্তমাংসের মানুষের নয়। অকপট ভক্তি, স্থির বিশ্বাস ও গভীর শ্রদ্ধার নামান্তর মাত্র। যুগ যুগ ধরে সমস্ত পৌরাণিক উপচার ও নিয়মবিধি মেনে পূজিত হচ্ছেন যিনি, তাঁকে অধিকাংশ সময়েই বাড়ির চৌকাঠে ফেলে রাখা হয় সুসন্তান লাভের আশায়। অনেকেই হয়ত জানেন না, অবহেলা অনাদরের ঠাকুরটি কিন্তু রীতিমতো খাস জমিদারি কায়দায় পূজিত হন পশ্চিমবঙ্গের এক বিশেষ জায়গায়। 'চুঁচুড়ার শীলবাড়ি' - এই নাম বললে সে তল্লাটে একডাকে লোকে বাড়ি অবধি চিনিয়ে দিয়ে যাবে। যদিও চুঁচুড়ার অন্যান্য জায়গায় কার্ত্তিক পুজো মহা আড়ম্বরেই হয় তবু জৌলুশ ও প্রাচুর্যে কামারপাড়ায় বিখ্যাত বনেদী শীলবাড়ির পুজো একাধারে বর্ণাঢ্য এবং ঐতিহাসিক। তিনশো বছর ধরে যার বৈচিত্রের প্রতিফলন বাড়ির সমস্ত সদস্যদের হৃদয়ে কোহিনূরের মতো উজ্জ্বল।

ছবি : নিজস্ব 
চুঁচুড়া স্টেশন থেকে নেমে প্রথমে টোটো বা অটো স্ট্যান্ডে আসতে হবে। ফুরফুরে দূষণহীন যাত্রার জন্য টোটো যানটির বিকল্প নেই । সেইটে চড়ে একেবারে শীলগলির মুখে নামবেন, তেমন তেমন হলে বাড়ির সিংদরজায় গাড়িবারান্দার তলাতেও নামিয়ে দিতে পারে। পেরেক পোঁতা ভারী সবুজ কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে আপনি এসে দাঁড়াবেন এক মনকেমন করা উঠোনের একেবারে মাঝ মধ্যিখানে। যে উঠোনে অনায়াসে একটা চার পাঁচতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে চারকোনা জায়গা জুড়ে। তারপরেও যেটুকু জায়গা অবশিষ্ট থাকবে তাতে করে মনের মতো একটা বাগান সাজিয়ে নেওয়া কঠিন কিছু হবে না, এমনই তার ব্যাপ্তি। ওপরে তাকালে খোপকাটা চৌকো আকাশের আলো চুঁইয়ে পড়বে আপনার গায়ে। 

ছবি : নিজস্ব 
মুখ ঘুরিয়ে পূর্ব দিকে যদি দেখেন তাহলে লাল টুকটুকে শান বাঁধানো গোটা আষ্টেক সিঁড়ি পাবেন। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে এক ফুঁয়ে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাবে আপনার ফেলে আসা শহর, যানজট আর দূষণের অবিমিশ্র কোলাহল। মুখোমুখি এসে দাঁড়াবেন কয়েকশো বছরের পুরোনো ইতিহাসের দোরগোড়ায়। সেখানে ফিসফিস করে সংলাপ বলে চলে আদি বাংলার ইতিবৃত্ত। নকশা কাটা দেওয়াল ও খিলান দেওয়া ঐরাবতীয় স্তম্ভের নিচে একটা প্রশস্ত ঠাকুরদালান লম্বালম্বি শুয়ে থাকে যা আড়ে বহরে প্রায় রাখালিয়া মাঠের সমান। তার ঠিক মাঝামাঝি পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ঝলমলে বাদশাহী পোশাক পরিহিত পনেরো ফিটের উঁচু 'রাজা কার্তিক'। শীলবাড়ির আরাধ্য দেবতা, সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বিশ্বস্ত সঙ্গী ও মহলের একনিষ্ঠ রক্ষক। 

ছবি : সৌরভ শীল 
এই বাড়িতে প্রথম পুজো চালু করেন শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র শীল। তখন বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে ঘাঁটি গড়েন এই চুঁচুড়া শহরে। শুরু করেন রাজবেশী কার্ত্তিকের আরাধনা। বংশপরম্পরার হাত ধরে একবিংশ শতকে এসেও যার অন্যথা হয়নি বিন্দুমাত্র। এক বিরাটকায় ময়ূরের ওপর আসীন হয়ে রাজকীয় ঢংয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটানা পূজিত হয়ে চলেছেন এই ধনুর্ধারী রাজা।

তাঁর গৌরবর্ণ, সৌম্যকান্তি মুখের দিকে তাকালে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, খেয়াল থাকে না কোনোরকম সময়ের বা পিছুটানের। মনে হয় ঠাকুরদালানের একপাশে জায়গা করে দিলে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে সে নির্মলমূর্তির সামনে। বাড়ির খিড়কি দুয়ারের পুকুরে যখন সূর্য ডোবে তখন দালান জুড়ে গড়িয়ে পড়ে সোনালী আলোর মূর্ছনা। জোড়া ঢাক, কাঁসর আর ঘন্টার প্রতিধ্বনিতে সে বাড়ি জেগে ওঠে অতীতের মাটি ফুঁড়ে, শুরু হয় রাজবন্দনার উৎসব। গোটা শীলবাড়ি প্রাঙ্গন মূর্ত হয়ে ওঠে দৈবিক অবয়বে। প্রায় দুশো আড়াইশো মানুষ জমা হয় এই মিলনমেলায়, একে ওপরের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গনে সম্পর্কের ওম জড়ায় শরীরে। তাঁদের আপ্যায়নের মাধুর্যে ও আন্তরিকতার স্পর্শে হৃদয় গলবে কখন আপনি টেরও পাবেন না। শুধু মনে হবে এই সাতপুরুষের ভিটেয় ইতিহাসের ছবিটা বরং গোপন থাকুক, ঠিক এমনি করেই, তবেই বোধহয় প্রকৃত পুজো হবে প্রচারের আড়ালে, দেবতার উপস্থিতিতে।



ছবি : নিজস্ব 
আদিগন্ত বিস্তৃত এজমালি ছাতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যতক্ষণে সন্ধ্যে নামে ততক্ষনে হয়ত আপনি স্টেশন পৌঁছে যাবেন। টানা দুদিনের আনন্দোল্লাসের পর যখন ফিরে আসবেন তখনও আপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনশো বছরের সোঁদা গন্ধ লেগে থাকবে আবার ফিরে আসার অপেক্ষায়, যেমন করে শীলবাড়ির প্রতিটি মানুষ অপেক্ষা করেন প্রত্যেক বছর। যাঁরা চুঁচুড়া গেছেন বা যাননি তাঁদের বলব কার্ত্তিক মাসের শেষ দিনটা একবার অন্তত নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে আসুন। এমন  নয়নাভিরাম সাবেকী উন্মাদনা পশ্চিমবঙ্গের বুকে খুব কমই বেঁচে আছে। আপ্যায়নের কোনোরকম ত্রুটি ঘটবে না এটুকু বলতে পারি, কারণ শ্বশুরবাড়ির অভ্যর্থনা চৌকাঠে আমিও দাঁড়াই।


ছবি : নিজস্ব 

#bengaliarticle #kartikpuja #chuchurasilbari #silbarirkartikpuja




    

Tuesday, November 14, 2017

সাপ্তাহিকী - ৩৩ # ডাবলস পার্টনার

গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে থমকে দাঁড়াল অর্জুন। ইদানীং সাড়ে পাঁচটাতেই সন্ধ্যে নেমে আসছে। পশ্চিম আকাশে মরিচগুঁড়োর মতো ধূসর রং জমেছে। বৃষ্টি হবে নাকি ? এই হেমন্তের শুরুতেই অকালবর্ষণ হয়ে গেছে একদিন। আজও যদি বৃষ্টি হয় তাহলে খেলাটা মাটি হবে একেবারে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে ফ্লাইওভারের তলায় পার্কিং স্পেসটাতে এসে দাঁড়ায়। পলাশ আর সুমন এসে গেছে ততক্ষনে। অর্জুনকে দেখতে পেয়েই দুজনে প্রায় একসাথে বলে উঠল, 'কিরে, দেরি করলি যে' ? পলাশের মুখের দিকে তাকিয়ে অর্জুন একটু ধমক দিয়ে বলে, 'তোদের মতো কি আর আরামের চাকরি রে ভাই, যে বললেই টুক করে বেরিয়ে পড়ব ? সাতঘাটের কাজ নামিয়ে তবে আসতে হল'। সুমন সুর করে বলে, 'আহা ! চটছ কেন বরফি ? বৃষ্টি টিষ্টি আসতে পারে তাই আর কি'.......।

অর্জুন একটা বেঞ্চের ওপর কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'অনুপমদাকে দেখছি না তো ? কোথায় সে ? আসেনি এখনো' ? পলাশ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, 'আরে অনুপমদাকে তো কখন থেকে ফোন করছি, ধরছেই না। কি ব্যাপার কে জানে' ? সুমন অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলে, 'দ্যাখগে আবার ডুব মারল কিনা। না এলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে'। অর্জুনের চোখে সন্দেহ ঘনায়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বলে, 'আমি দেখি একবার ট্রাই করে, তোরা ততক্ষনে বোর্ডটা বার কর'।

গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের নিচে ক্যারাম প্লেয়ার্স এসোসিয়েশনের মেম্বার অর্জুন, পলাশ, সুমন, অনুপম এবং আরও অনেকে। প্রত্যেক সন্ধ্যেবেলা নিয়মিত খেলা হয় সেখানে। ছটা থেকে নটা। পার্কিং স্পেসটার ডানদিকে একটা উঁচু চাতালের ওপর দুটো বোর্ড সাজানো হয়। সন্ধ্যের দিকে বেশ বড় একটা জমায়েত হয়। যারা নিয়মিত খেলে তারা তো থাকেই এছাড়া দর্শকের সংখ্যাও নেহাত মন্দ হয় না। সবমিলিয়ে বেশ একটা জমজমাট আসর বসে। আসছে শনিবার টুর্নামেন্ট আছে। কয়েকদিন আগেই এনাউন্স হয়েছে। দুদিকে দুটো ফ্লেক্সও টাঙানো হয়েছে। পথচলতি ক্যারাম আগ্রহীদের কাছে এটা একটা বিষয় বটে। প্লেয়াররা রীতিমত সিরিয়াস। এর মধ্যে প্রায় প্রতিদিন ওয়ার্ম আপ ম্যাচ আছে। ডাবলসে যে যার জুটির সাথে নিয়মিত প্রাকটিস করছে। যারা ভালো খেলে অর্জুন তাদের মধ্যে অন্যতম। বুদ্ধিদীপ্ত খেলায় ইতিমধ্যেই সে বাহবা কুড়িয়েছে সবার। সিঙ্গল শট এঙ্গেল হোক বা ডাবল শটের কাট, অর্জুনের মতো শিল্পী হাতের তালিকা নামমাত্র সেখানে। একমাত্র সম্রাট আর মোহিতই আছে যারা অর্জুনকে টক্কর দিতে পারে সমানে সমানে। তারাও আসন্ন টুর্নামেন্টের আঁচে সেঁকে নিচ্ছে নিজেদের। সকলে বলাবলি করছে সম্রাট - মোহিত আর অর্জুন - অনুপম এর মধ্যেই ফাইনালটা হবে। এহেন মোক্ষম সময় অনুপম ফোন তুলছে না।

ভারী বিরক্ত হয় অর্জুন। ফোনটা কেটে রিডায়াল করে। বেশ কিছুক্ষন রিং হবার পর ওদিক থেকে মহিলা কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়।

- হ্যালো ?
- হ্যালো, কে বৌদি ? অর্জুন বলছি....
- ওহ অর্জুন ! বলো কি ব্যাপার !
- অনুপমদাকে একটু দেবে ? অনেক্ষন থেকে ট্রাই করছি, পাচ্ছি না......
- তোমার অনুপমদার তো অবস্থা খারাপ, ফোন তুলবে কি ! সে তো বিছানায় শুয়ে আছে....
- সেকি !! কেন কি হয়েছে ??
- তিনদিন ধরে জ্বর, আজ সকালে ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট পেয়েছি - ডেঙ্গু !
- বলো কি !! ইস্সসস ! এ যে একেবারে কেলেঙ্কারি হল !
- আর বলো কেন ? তোমার অনুপমদার ঠেলায় সংসার মাথায় উঠেছে আমার।
- আচ্ছা, প্লেটলেট কি খুব কমে গেছে ?
- নাহ, ওটা মোটামুটি ঠিকই আছে, তবে জ্বরটা কমছে না মোটে। ডাক্তার বলেছে দিন পনেরোর আগে বিছানা ছেড়ে ওঠার কোনো প্রশ্নই নেই।
- ওহ ! আচ্ছা বেশ, আমি নাহয় কালকের দিকে যাব একবার। কোনো প্রয়োজন হলে বোলো কিন্তু.......

দুচারটে টুকটাক কথা সেরে ফোন কেটে দেয় অর্জুন। শুকনো মুখে ফিরে আসে চাতালটার দিকে। সুমন সে দিকে তাকিয়ে বলে, 'কি রে, অনুপমদাকে পেলি ? আসছে' ? অর্জুন হতাশ হয়ে বলে, 'নাহ, অনুপমদার ডেঙ্গু হয়েছে, পনেরো দিনের জন্য গ্যারেজ' ।

- য়্যাঁ !! সে কি রে ?? তাহলে ?

অর্জুন বিড়বিড় করে বলতে যায়, 'তাহলে আর কি, আমার হাতে তো আর কিছু..........' । কথাটা শেষ করতে পারে না। উল্টোদিক থেকে মোহিত আর সম্রাট হৈহৈ করে এগিয়ে আসে। মোহিত বলে, 'তাহলে তো তোর হাতে হ্যারিকেন অর্জুন' ! একথায় সম্রাট খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে। বলে, 'ট্রফিটা ফস্কে গেল হে অর্জুন, এই শেষ সময় পার্টনার ডুব ? হরি হে মাধোবো, চান করব না গা ধোবো' ! একথায় আশেপাশের সমস্ত লোকজন খলখলিয়ে হেসে ওঠে।

গা জ্বলে যায় অর্জুনের। পায়ে পায়ে নিজেদের বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখেচোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। পলাশ জিজ্ঞেস করে, 'ভাই, কি করবি এবার' ? অর্জুন এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। আশেপাশের তীব্র হর্নের শব্দে তার কানে যেন ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে একনাগাড়ে। টুর্নামেন্টটা কি তাহলে সত্যিই ফস্কে গেল ? অনুপমদার দাঁড়ানোর উল্টোদিকে ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। ডাবলস পার্টনারের অনুপস্থিতিটা ঘুণপোকার মতো কুড়তে থাকে ভিতরে ভিতরে। সন্ধ্যে ঘন হয়ে জমাট বাঁধে।

'আচ্ছা এখানে মেম্বার হতে গেলে কি করতে হয়' ?

এক অতর্কিত নারীকন্ঠের প্রশ্নে সকলেই হতচকিত হয়। অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একজন তেইশ চব্বিশ বছরের শ্যামলা তরুণী তার দিকেই তাকিয়ে আছে বড়বড় চোখ করে। যেন প্রশ্নটা সে অর্জুনকেই করেছে। সে চোখের দিকে তাকিয়ে থতমত খায় অর্জুন। পরক্ষনেই সুমনকে ইশারা করে ব্যস্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সুমন তৎক্ষণাৎ গলায় কপট গাম্ভীর্য এনে বলে ওঠে, 'এককালীন রেজিস্ট্রেশন ফিইজ আছে, এছাড়া মাসে মাসে একটা মেম্বারশিপ ফিইজ দিতে হয়, এই, এছাড়া আর কিছু নেই'। পলাশ মাতব্বরের মতো জিজ্ঞেস করে, 'কে খেলবে ? ভাই না বয়ফ্রেন্ড' ?

তরুণী নিঃশব্দ থাকে কিছুক্ষন, তারপর ধীরে ধীরে বলে, 'আমি' !

বোম ফাটার মতো আওয়াজ করে কাছেই কোথাও একটা ট্যাক্সির টায়ার বার্স্ট হয়। কিন্তু সে আওয়াজ ছাপিয়ে অপিরিচিতা তন্বীর আত্মবিশ্বাসের স্বর ছড়িয়ে পড়ে চারিপাশে। অর্জুনদের বোর্ড তো বটেই তাদের পাশের বোর্ড থেকেও লোকজন উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকে এদিকে। অর্জুন, সুমন আর পলাশ গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে থাকে তরুণীর দিকে। সুমন অপার বিস্ময়ে বলে, 'আপনি' !!??
অপরিচিতা ততধিক ঋজু ভঙ্গিমায় বলে, 'হ্যাঁ আমি। কেন, মহিলা মেম্বার হওয়া যায় না ? নাকি, হলে আপত্তি আছে ? অর্জুন অস্ফুটে বলে, 'না, তা নেই বটে, তবে আমাদের মহিলা মেম্বার কেউ হয়নি এখনো অবধি। আপনারই অসুবিধে হতে পারে'।

তরুণী স্মিত হেসে বলে, 'না না, তাতে আমার কোনো অসুবিধে নেই'।
অর্জুন ঘাড় নেড়ে বলে, 'বেশ। তাহলে ওই দিকটায় এগিয়ে যান, সুবিমলদা বলে একজন বসে আছেন, উনিই মেম্বারশিপটা দেখেন, ওনাকে গিয়ে বলুন, উনিই বলে দেবেন কি কি করতে হবে'।
'ধন্যবাদ' , বলে তরুণী এগিয়ে যায় সুবিমলদার দিকে। পলাশ আর সুমন একঠায় চেয়ে থাকে ব্লু জিন্স আর ধূসর টপ পরিহিতার দৃঢ় পদক্ষেপের দিকে। অর্জুন ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়। বলে, 'আঃ কি ক্যাবলার মতো চেয়ে আছিস তোরা ? মেয়ে দেখিসনি নাকি আগে' ?

পলাশ স্বগতোক্তির ঢঙে বলে, 'দেখেছি গুরু, কিন্তু লেডি ক্যারাম প্লেয়ার তো তেমন দেখিনি আগে' ! সুমন হাহা করে হেসে ওঠে। অর্জুনও ফিক করে হেসে বলে, 'ওসব কিচ্ছু না রে পলাশ, এ হলো হুজুগ। আজকাল সব নানারকম ট্রেন্ড হয়েছে কিনা। রাজকন্যের খেয়াল হয়েছে গড়িয়াহাটের মোড়ে ম্যাচ বোর্ডে একটু আঙ্গুল ঘষবে, এই আর কি। অমন আনকোরা আঁতেল আমি ঢের দেখেছি। দুদিন যেতে দে, পাখি নিজেই উড়ে যাবে'। পলাশ আর সুমন একযোগে হেসে ওঠে। সন্ধ্যের ক্যাকোফোনির সঙ্গতে স্ট্রাইকার আর ঘুঁটির সঙ্গীত জমে ওঠে দারুণ। খেলা চলতে থাকে পরের পর। আজ অনুপম না আসায় অর্জুন অন্য একজন মেম্বারকে নিয়ে খেলতে থাকে। পলাশ আর সুমন যথারীতি পার্টনার।
বেশ কিছুক্ষন পর আবার সেই নারীকন্ঠস্বর পাওয়া যায়।

- রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে আমার....

অর্জুন ডান দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। প্রত্যুত্তরে একটা 'বাহ্' বলে নিজের বাঁ দিকে একটা লাইন ঘেঁষা বেস খেলতে লাগে সে। সুমন একবার পলাশের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, 'কার্ড পেয়েছেন তো ? কবে থেকে খেলবেন তাহলে' ? মেয়েটি তার উত্তরে বলে, 'না, কার্ডটা কাল দেবেন বলেছেন সুবিমলদা। আর বললেন সুযোগ হলে আজ থেকেই খেলতে পারি'। পলাশ বলে উঠল, 'ওহ ! এতো দারুন ব্যাপার'। কথাটা শেষ হতে না হতেই অর্জুনের ওপরের একটা কোণাকুণি এঙ্গেল মিস করে ফেলল। ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, 'অাহ্ পলাশ ! গল্পই যদি করবি তো সাইডে গিয়ে কর। খেলার সময় ভীষণ ইরিটেটিং লাগে এসব'। সুমন সেটা লক্ষ্য করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করেই বলল, 'তা আপনি যদি চান আজই খেলতে পারেন, মানে এই বোর্ডেই'। অর্জুন ক্রুদ্ধনেত্রে তাকাল সুমনের দিকে। সুমনের মুখেচোখে একটা ফিচেল চাপা হাসি খেলে যায়। অনাহূত তরুণী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, 'না না আপনারা তো একটা গেম খেলছেন, ওটা শেষ হোক আগে.....তারপর না হয়..........'
খেলা চলতে লাগল নিজস্ব নিয়মে।

মিনিট চল্লিশেক বাদে অর্জুনের প্রায় একার কৃতিত্ত্বে পলাশ আর সুমন গেম খেয়ে গেল। মেয়েটি হাততালি দিয়ে উঠল। চোখে মুখে উচ্ছাস নিয়ে অর্জুনের দিকে ফিরে বলল, 'আপনি তো দারুন খেলেন' ! অর্জুন প্রত্যুত্তরে সামান্য হাসল শুধু। আসলে এই অযাচিত উপস্থিতি সে একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না। বিশেষ করে এই খেলার সময়। ক্যারামটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে অর্জুন। আর এই খেলা ঘিরে কোনোরকম ছেলেমানুষি বা বালখিল্যতা সে পছন্দ করে না একেবারেই। সুমন পলাশের দিকে একবার চোখে চোখে ইশারা করে নিয়ে মেয়েটিকে বলল, 'ইয়ে মানে, আপনি খেলতে পারেন এবার। অনুপমদা মানে অর্জুনের রেগুলার পার্টনার এবসেন্ট। আপনি বরং অর্জুনের পার্টনার হয়েই শুরু করুন'।

উল্টো দিক থেকে মোহিত চেঁচিয়ে বলে, 'অর্জুন কি নতুন পার্টনার পেল সুমন' ? অর্জুন সেকথায় পাত্তা না দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বলল, 'দ্যাখ সুমন, ক্যারামটা ঠিক হাসি ঠাট্টার খেলা নয়, যে যখন তখন যেভাবে খুশি আমায় খেলতে হবে। আমায় বরং আজ মাপ কর। তোরা খেল, আমি যাই'। তারপর মেয়েটির দিকে ফিরে কঠিন সুরে বলল, 'আসলে এই খেলাটা আমি ভালোবেসে খেলি, তাই ঠাট্টা তামাশা করে খেলা আমার দ্বারা হবে না, দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না'।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে বলে, 'দেখুন আপনি যদি না চান, আমি না হয় অন্য একজন পার্টনার নিয়ে খেলব। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কাছেও ক্যারাম খুব পছন্দের খেলা। তাছাড়া আমি আপনার নাম শুনেছি অর্জুনবাবু। তাই আপনার সাথে খেলার ইচ্ছে ছিল, এই আর কি'। একথায় তিনজনেই অবাক হয়ে যে যার মুখের দিকে তাকাতে থাকে। নাম শুনে খেলতে আসার ব্যাপারটা সবার কাছেই বেশ আশ্চর্যের বিষয় মনে হয়। অর্জুন খানিক অপ্রতিভ হয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, 'আমার নাম শুনেছেন ? মানে ?...... ঠিক বুঝলাম না তো '।

'দেখুন গড়িয়াহাট চত্ত্বরে ক্যারাম প্লেয়ারদের মধ্যে আপনার নাম প্রথম সারিতে আসে। আর যেহেতু আমিও খেলাটাকে ভালোবাসি সেই সূত্রেই বলতে পারেন আপনার নাম শুনেছি। আপনার একরকম ভক্ত বলতে পারেন', মেয়েটি মোলায়েমস্বরে উত্তর দিল। অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। ক্যারাম খেলেও যে ফ্যান অর্জন করা যায় এটা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না কিছুতেই। কি বলবে ভেবেই উঠতে পারল না সে। সাময়িক বিরতির পর সুমন বলল, 'বেশ তো অর্জুন, তুই পলাশকে নিয়ে খেল আর আমি নাহয় ম্যাডামকে নিয়ে খেলি। তাহলে হবে তো ? আর তাছাড়া উনি তোর নাম শুনে এসেছেন, তুই না খেললে ভীষণ খারাপ দেখায় তাই না' ? একথায় মেয়েটি করুণ মুখে তাকিয়ে রইল অর্জুনের দিকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কতকটা নিমরাজি হল অর্জুন। এই গেমটা চার বোর্ডের বেশি লাগবে না ভেবে পলাশের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি দাঁড়াল অর্জুনের বাঁদিকে, সুমনের মুখোমুখি। পলাশ প্রায় বিড়বিড় করে বলল, 'এখানে ম্যাডাম যখন আজ প্রথম খেলছেন, তখন আর লাইন করে কাজ নেই, হিটটা বরং উনিই করুন, তাই না ?' সুমন আর অর্জুন ঘাড় নেড়ে সায় দিল। আগন্তুক বলে উঠল, 'আমায় ম্যাডাম বলবেন না প্লিজ, আমার নাম চিত্রা'।

নামটা বেশ শোনা শোনা লাগল অর্জুনের। কিন্তু কোথায় শুনেছে কিছুতেই মনে করে উঠতে পারল না। 'চিত্রা.....চিত্রা....', নামটা বার কয়েক মৌমাছির মতো গুনগুন করতে লাগল মাথার মধ্যে। নাঃ, মনে পড়ছে না একদম। ঝুলন্ত বাল্বের হলুদ আলোয় আনমনা হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। চটক ভাঙল হিটের খ্যাটাক আওয়াজে।

ব্ল্যাঙ্ক হিট করেছে চিত্রা। কোনো পকেটেই ঘুঁটি যায় নি। লজ্জায় লাল হয়ে যায় চিত্রার মুখ। জিভ কেটে বলে, 'আসলে এখানে নতুন তো, এক দুটো বোর্ড লাগবে হাত সেট হতে'। অর্জুন একটা মিহি হাসি ঝুলিয়ে আড়চোখে সুমন আর পলাশের দিকে তাকায়। ভাবটা এমন যে আমি আগেই বলেছিলুম এসব আনকোরাকে নিয়ে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর পাঁচটা ঘুঁটি পরপর পকেট করে অর্জুন। সুমন আর পলাশের দান ঘুরে আবার চিত্রার স্ট্রাইক আসে। ডানদিকের একটা বেস খেলার পর একটা সহজ ইঞ্চি মিস করে চিত্রা। অর্জুনের স্ট্রাইক আসে। রেড সমেত পরপর দুটো ঘুঁটি ফেলে দিয়ে একটা বেস নামায় পলাশের হাতে। সুমন তিনটে ঘুঁটি ফেলার পর পলাশ দান পেয়ে বাকি ঘুঁটি ক্লিয়ার করে বোর্ড শেষ করে। প্রথম বোর্ডে এগারো পয়েন্ট পায় অর্জুন আর পলাশ। চিত্রার মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যায়। প্রথম দিন এসেই নীল গেম খেয়ে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা দেখতে পায় চোখের সামনে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হেসে অর্জুন ঘুঁটি সাজিয়ে হিট করে। জোরালো হিটে রেডশুদ্ধু দুটো সাদা ঘুঁটি পকেটে চলে যায়। এরপর নিখুঁত এঙ্গেলে ঘুঁটি ফেলতে থাকে পরের পর। প্রায় সেঞ্চুরীর মুখে এসে লাস্ট ঘুঁটিটা ভুলবশত মিস করে। সুমন দান পেয়ে চারটে ঘুঁটি ফেলে কোনোরকমে। মিস করার পর পলাশ শেষ সাদা ঘুঁটি পকেট করে। চিত্রা দান পায় না, তার আগেই বোর্ড শেষ হয়ে যায়। দুটো বোর্ড মিলিয়ে মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় একুশ। পলাশ কতকটা মস্করার সুরে চিত্রাকে বলে, 'আপনি কি এই প্রথম ক্যারাম খেলছেন না আগেও খেলেছেন' ?

সুপ্ত খোঁচাটা ধরতে ভুল হয় না চিত্রার। হেসে বলে, 'আমি খেলি মাঝে মাঝে'।
'কোথায় ? উইকেন্ডে বাড়িতে সবার সাথে গোল হয়ে বসে..... তাই না' ? পলাশ হাসির দমক সামলে বলে ওঠে।

চিত্রা একথার কোনো উত্তর দেয় না। সামান্য হাসে শুধু। সুমন হিট করে। পরপর তিনটে ঘুঁটি ফেলে। হাত ঘুরে পলাশের কাছে যায়। পলাশ একটা দূরের কালো ঘুঁটি এঙ্গেল করতে গিয়ে মিস করে। বাঁদিকে একটা বেস পায় চিত্রা। সেটা দেখার পর পুরো বোর্ডটা ভালো করে জরিপ করে সে সময় নিয়ে। বাকি ঘুঁটির পজিশন দেখতে দেখতে এলোচুলটা টাইট করে পনিটেল বেঁধে নেয়। এরপর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে একটা জোরে টোকা মেরে বেসটাকে হিট করে চিত্রা। বেসটা তো পড়েই তদুপরি স্ট্রাইকার ঘুরে বাঁদিকে একটা ইঞ্চি ঘুঁটিও পেয়ে যায়। চমৎকার শট ! এমন চোখজুড়ানো শটে অর্জুন হাঁ হয়ে যায়। পলাশ আর সুমনের চোখ গোলগোল হয়ে ওঠে। সেদিকে আমল না দিয়ে ইঞ্চিটাকে তাক করে চিত্রা। একটু বেঁকিয়ে ইঞ্চিটাকে ডানপকেটে ফেলে দিয়ে একই শটে রেডটাকেও হিট করে। নিখুঁত এঙ্গেলে রেডটা প্রায় ভেসে গিয়ে টুপ্ করে বাঁদিকের পকেটে ঢুকে যায়। দুর্দান্ত ডাবল শট ! অর্জুন, পলাশ, সুমন যে যার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। দর্শকরা অভিভূত হয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে। দূরের একটা ঘুঁটিকে এরপর সফলভাবে এঙ্গেল করে চিত্রা, রিটার্ন স্ট্রাইকারে একটা বেস নিয়ে আসে। এই বেসটাকেও কায়দা করে পকেট করার ফলে বাঁদিকে দূরের পকেটে একটা সহজ ঘুঁটি পেয়ে যায় সে। বোর্ডের বিটে স্ট্রাইকার ঘুরিয়ে ওই ঘুঁটিটা তো ফেলেই, তার ওপর শেষ ঘুঁটিটা পেয়ে যায় একেবারে হাতের নাগালে। ডানদিক আর বাঁদিকের পকেট ব্লক থাকায় একটা মাপা টাঙ্কি শটে শেষ ঘুঁটিটা পকেট করে চিত্রা। একবোর্ডেই চোদ্দ পয়েন্ট পায় চিত্রা আর সুমন। অর্জুন চান্সই পায় না এই বোর্ডে। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে সে চিত্রার দিকে। দর্শকরা হইহই করে ওঠে। 'সাবাশ' , 'কেয়াবাৎ' ইত্যাদি শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশটা। ভিড় বাড়তে থাকে একটু একটু করে। আশেপাশের দুচারজন ভূয়সী প্রশংসা করে নবাগতা প্লেয়ারের।মৃদু হাসে চিত্রা.....

পরের বোর্ড। পলাশ দারুন হিট করে। তিনটে ঘুঁটি একসাথে পকেটে পড়ে। দুটো বাঁদিকে আর একটা ডানদিকে। পরের ঘুঁটিটা মারতে গিয়ে মিস করে। দান পায় চিত্রা। দুরন্ত এঙ্গেলে দুদিকের পকেটে দুটো ঘুঁটি ফেলে দেয়। সার্কেলের ভিতর থাকা একটা অনবদ্য চাপ খেলে সে রেডটাকে  নামিয়ে দেয় সুমনের হাতে। অর্জুন যেন থৈ পায় না। এমন তুখোড় খেলার সামনে একটু থতমত খেয়ে যায়। হাতের সামনে একটা সহজ ঘুঁটি থাকা সত্ত্বেও রেডটা সুমনের বেসে চলে যাওয়াতে নিরুপায় হয়ে রেড খেলতে হয় অর্জুনকে। তাতেই মারাত্মক ভুলটা করে বসে অর্জুন। মুহূর্তের অসতর্কতায় রেডটা মিস করে ফেলে। রেডে স্ট্রাইকার লাগলেও ঘুরে এসে আবার সুমনের হাতের নাগালেই বসে পড়ে রেডটা। হাত মিস হয় অর্জুনের। দান পেয়ে রেডটা ফেলে দেয় সুমন। সুন্দর এঙ্গেলে দুটো ঘুঁটি নামিয়ে দেয় চিত্রার হাতে। একটা কঠিন ঘুঁটি খেলতে গিয়ে পলাশের হাত মিস হয় আবার। দান পায় চিত্রা। বেসলাইনের ওপর একটা ঘুঁটি দারুন ভাবে টপ করে ডাবল শটে দূরের একটা ঘুঁটিও ফেলে সে। পরের ঘুঁটি মিস হয়। অর্জুন দান পেয়ে দুর্দান্ত খেলে দুটো ঘুঁটি পকেট করে। কিন্তু আর কোনো ঘুঁটি হাতে না থাকায় একটা ইঞ্চি নামিয়ে দেয় পলাশের হাতে। সুমন হাত পায় এরপর। অসাধারণ খেলে অবশিষ্ট কালো ঘুঁটি পকেট করে। এই বোর্ডে নয় পয়েন্ট পেয়ে চিত্রা আর সুমনের মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় তেইশ। অর্জুনের আর পলাশের পয়েন্ট টপকে দুকদম এগিয়ে থাকে।

অর্জুনের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। কারণ এই তেইশ পয়েন্টটা তাদের জন্য এক বিপজ্জনক বস্তু। রেড ব্যতীত ছ পয়েন্ট পেলেও গেম আবার রেড সহ এক পয়েন্ট পেলেও গেম। বলাই বাহুল্য অর্জুন আর পলাশের কাছে গেমটা মান বাঁচানোর লড়াই হয়ে ওঠে এখন।

দুনম্বর বোর্ডে একটি অপিরচিতা তরুণী দুর্দান্ত খেলে অর্জুন আর পলাশকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে, এই খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। দেখতে দেখতে মন্দিরের জমায়েতের মতো ভিড় জমে যায়। সকলেই ফিসফাস করতে থাকে। অর্জুনের সারা মুখে অমানিশা ঘনিয়ে আসে। একজন অপরিচিতা নবীনার কাছে সবার মাঝে অপদস্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখতে পায় যেন চোখের সামনে। ধীরে ধীরে হিট সাজায় চিত্রা। অর্জুনের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে সজোরে হিট করে।

এবারে আর ব্ল্যাঙ্ক হিট হয় না। একসাথে দুটো ঘুঁটি পড়ে। এরপর যেন স্বপ্নের খেলা খেলতে থাকে চিত্রা । দর্শকদের সাথে সাথে চুপ করে সে মোহময় খেলা প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না অর্জুন আর পলাশের। নিপুণ এঙ্গেল আর তুখোড় ডাবল শটের যুগলবন্দীতে পরপর ছটা ঘুঁটি পকেটে ফেলে উড়ালপুলের দর্শকদের মাঝে চিত্রা আলোড়ন তুলতে থাকে একের পর এক। সাময়িক ঝড়ের বিরতিতে দান পায় অর্জুন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে তার। হালভাঙ্গা নাবিকের মতো আসন্ন ভরাডুবি দেখতে পায় যেন। এমন অদ্ভুত নির্ভুল খেলা দেখে ক্ষণিক বেগ পায় বটে সেও দমে যায় না কিছুতেই। 

দুর্দান্ত খেলে একের পর এক ঘুঁটি পকেট করতে থাকে অর্জুন। আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণের উত্তাপে স্ট্রাইকার ঘুঁটির খেলা মারাত্মক জমে ওঠে। নামের প্রতি সুবিচার করে পরপর অবাক করে দেওয়ার মতো শট খেলতে থাকে অর্জুন। আটটা ঘুঁটি ফেলে বোর্ডটা প্রায় শেষ করে আনে একা। ওদিকে চিত্রা আর সুমনের এখনো তিনটে ঘুঁটি বাকি। পরিস্থিতিটা যেন সম্পূর্ণ রূপে হঠাৎ করেই ভোল বদল হয়ে যায় সবার চোখের সামনে। অর্জুনদের একুশ পয়েন্টে থাকায় এখন রেড সহ একটা ঘুঁটি ফেললেই চিত্রা আর সুমন গেম খেয়ে যাবে। বোর্ডের দিকে তাকিয়ে চিত্রা মনে মনে প্রমাদ গোনে। ডানদিকে একটা কালো ঘুঁটির সাথে রেডটা কোনাকুনি অবস্থায় বসে আছে। ডাবল শটের নিশ্চিত সুযোগ। দর্শকরা একঠায় তাকিয়ে থাকে অর্জুনের দিকে। ফিসফাস বলাবলি শুরু হয়, 'এ তো অত্যন্ত সহজ ডাবল শট। অর্জুনের হাতের মোয়া' ইত্যাদি। কালো ঘুঁটিটা ঠিকঠাক এঙ্গেল করতে পারলে একই শটে রেড পড়ে অথবা বেসে চলে আসে। যে কোনোভাবেই চিত্রা আর সুমনের হার নিশ্চিত।

ধীরে ধীরে স্ট্রাইকার বসায় অর্জুন। চার পাঁচ সেকেণ্ড সময় নেয় তাক করার। তারপরেই ধনুকের ছিলা থেকে অব্যর্থ তীরের মতো স্ট্রাইকার বেরিয়ে কালো ঘুঁটিতে হিট করে। অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটে ! যে শটটা দশবারে দশবারই পকেট করতে পারে অর্জুন আজ সামান্য এঙ্গেলের হেরফেরে সেই ডাবল শট মিস হয়ে যায় সম্পূর্ণ। বিস্ময়ে থ হয়ে যায় অর্জুন........সঙ্গে বাকি দর্শকও। নিজের অপারগতায় ধিক্কার দিতে থাকে মনে মনে। রেড আর কালো ঘুঁটিটা পলাশের নাগালের বাইরে চলে যায়। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে সুমন নিজের দানে দুটো ঘুঁটি পকেট করে। দুতরফেই একটা একটা করে ঘুঁটি পড়ে থাকে এরপর। পলাশ দান পায়। অনেকটা দূরে থাকায় রেডটা মারতে গিয়ে মিস করে ফেলে। রেডটা ঘুরে চিত্রার বেস লাইনের নিচে বসে পড়ে। রেডের সামান্য কাছে ওপরের দিকে কালো ঘুঁটিটা থাকায় স্ট্রাইকার বসিয়ে আঙুল ছোঁয়ানো কঠিন হয় চিত্রার পক্ষে। স্ট্রাইকার বসছে কিন্তু আঙুল বসানো যাচ্ছে না। ভুলবশত কালো ঘুঁটিতে আঙুল ছুঁলেই ফাইন হবে।কপালে ভাঁজ পড়ে চিত্রার। দর্শক মহল থেকে এমন অসম্ভব বেস না খেলার বিস্তর মতামত আসতে থাকে। অর্জুনও মাথা নাড়তে থাকে, কোনোভাবেই এই বেসটা খেলা সম্ভব নয়। 


বেশ কিছুক্ষন পর স্ট্রাইকার বসায় চিত্রা, সমস্ত রকম জটিলতা, বারণ অগ্রাহ্য করে ঠিক ওই জায়গাতেই। এমন খামখেয়ালী সিদ্ধান্তে আলগা হাসে অর্জুন। ফাইন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। উপস্থিত দর্শকদের থামিয়ে মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে কতকটা তুড়ি মারার কায়দায় অভিনব ভাবে রেডটাকে ব্যাক স্ট্রাইক করে চিত্রা। ওপরের কালো ঘুঁটিটা একসুতোও নড়ে না। উপরন্তু মর্মভেদী শটে রেডটা পকেট হয় ও স্ট্রাইকার ঘুরে সাদা ঘুঁটিতে লাগে। বাঁদিকে কোণার পকেটে সেটাও মখমলের মতো ভেসে গিয়ে পড়ে যায়। অপ্রত্যাশিত শট এবং গেম !


মুহূর্তের জন্য দর্শকদের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায় যেন। চোখের পলক পড়ে না অর্জুনদেরও। এমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাক স্ট্রাইকের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে সবার। আর তারপরেই সমস্ত নিস্তব্ধতা কাটিয়ে উচ্ছাসে, কলরবে উড়ালপুলের নিচেটা গমগম করে ওঠে। নিমেষে চিত্রাকে নিয়ে উৎসবের আকার নেয় গড়িয়াহাট চত্ত্বর। হৈহৈ করে অকুন্ঠ প্রশংসায় ভরিয়ে তোলে চিত্রাকে।

অর্জুনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে হাসিমুখে সবাইকে অভিবাদন করে বেরিয়ে আসে চিত্রা। পিছুপিছু অর্জুন এসে অবিশ্বাসী কণ্ঠে চিত্রাকে প্রশ্ন করে, 'একটু শুনুন, ব্যাক স্ট্রাইকে বেস ফেলার শটটা কোথা থেকে শিখলেন আপনি' ? থমকে দাঁড়ায় চিত্রা। খানিক্ষন মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, 'আমায় এখনো চিনতে পারলে না অর্জুনদা' ? অর্জুন থতমত খেয়ে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে চিত্রার দিকে। চিত্রা থেমে থেমে বলে, 'আমি চিত্রাঙ্গদা...... চিত্রাঙ্গদা বসু .......কুদঘাটে বাড়ি ছিল। তোমার মনে নেই' ? 

অর্জুন থমকায় খানিক, স্বগতোক্তির মতো করে বলে, 'কুদঘাটের বাড়ি' ? তারপরেই মনে পড়ে যায় সব। গলায় একরাশ উল্লাস এনে বলে, 'তুমি মানে....... তুই শচীন কাকার মেয়ে' ? চিত্রা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। বলে, 'মনে আছে ? বছর বারো আগে যখন আমরা একই পাড়ায় থাকতুম, তোমায় চিঠি পাঠিয়েছিলুম বইয়ের ভাঁজে। তুমি বলেছিলে আগে আমায় ক্যারামে হারাবি তারপর ভাবব'। 

অর্জুন বলে, 'সে তো অনেকদিনের কথা.....তুই এখনো......' !
'তুমি পাড়া ছেড়ে চলে যাবার কয়েকমাস পর বাবার বদলির চাকরিতে আমরাও শিলিগুড়ি শিফট করি। কয়েক বছর বাদে দমদম পার্কে বাড়ি করে আবার ফিরে আসি। ফিরে এসে তোমায় অনেক খুঁজেছিলাম জানো ? কোত্থাও পাইনি। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজে নিজেই পাড়ার ক্লাবে গিয়ে ক্যারাম খেলতাম বাকিদের সাথে। সেখানেই প্র্র্যাক্টিস। মাসখানেক আগে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপের ফর্ম তুলতে যাচ্ছিলাম এই রাস্তা দিয়েই। হঠাৎ করে এখানে দেখলাম তোমায়। তারপর কদিন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার খেলা দেখতে এসেছিলাম। চোখাচোখি হয়েছিল দু একবার। তুমি চিনতে পারনি। আজ একেবারে রেজিস্ট্রেশন করে তোমার সাথে খেলব বলে এসেছি। কিন্তু দৈব দুর্বিপাকে তুমি যে সত্যিই হেরে যাবে, একেবারে ভাবিনি। তবে আমি কিন্তু কথা রেখেছি। এবার তোমার পালা', লজ্জাবনত হয় চিত্রা।

এতটা অবাক অর্জুন হয়নি কখনো আগে। পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল এক এক করে। কৈশোরের হৃত প্রেমের জোয়ারে সমস্ত হৃদয় জুড়ে একটা প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছিলো। বিড়বিড় করে বলে, 'বারো বছর আগে যা বলেছিলাম তা মনের কথা নয়। নিছকই মজা ছিল। পাড়া ছেড়ে দেবার পর তোকেও কম খুজিনি আমি। শেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়েছিলাম। তবে, তুই কিন্তু এমনিই এসে পরিচয় দিতে পারতিস। খেলার প্রয়োজন পড়তো না'। 

চিত্রা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, 'কি করে জানব তোমার মনের কথা ? তাছাড়া তোমার ধনুক ভাঙা পণ ছিল যে' ! অর্জুন লজ্জা পায় বেশ। মুখ নামিয়ে বলে, 'বিশ্বাস কর হেরেও যে এতো আনন্দ পাওয়া যায় ভাবিনি আগে'। চিত্রা ঠোঁট কামড়ায়। অর্জুন এগিয়ে এসে বলে, 'তুই আমার.......ডাবলস পার্টনার হবি' ? 

দুহাতে মুখ চাপা দেয় চিত্রা। কাছেই কোনো মোবাইলে বেজে ওঠে....'আলবেলা.....সজন আয়ও রি......'


ছবি : গুগল 
  
#bengalishortstories #carromstories #drama #lovestories