Saturday, April 29, 2017

এ মণিহার

স্রোতের অভিমুখে চলা এক আর স্রোতের বিপরীতে চলা আরেক। আমি সাধারণ, নির্ঝঞ্ঝাট, নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয় একজন। জলে নামতেই ভয় পাই, সাঁতরানো তো দূর। দশটা ছটা অফিস করি, সংসারের নিয়ম মেনে কিছু কাজ করি আবার কিছু করিও না। মাজি-মধ্যি এলার্জি হলে ঘাড় মুখ গুঁজে কলমের আঁচড় কাটতে থাকি। সে আঁচড়ের দাগে কখনো গল্প, কখনো কবিতা আবার কখনো ছাইপাঁশ তৈরী হয়। সেসব জড়ো করে লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে ফেসবুক ও ব্লগের দেওয়ালে পোস্টারের মতো সাঁটিয়ে দিই। গুণীজনরা সেসব পড়েন, ভালোবাসেন, সমালোচনা করেন, উৎসাহ দেন, কেউ বিরক্ত হন আবার কেউ এড়িয়ে যান। এহেন লোকের কাছে যদি ছোটবেলার স্কুল টিচারের মেসেজ আসে তবে ঘাবড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয় বৈকি। মনে হতে থাকে এইরে ! নীল ডাউন হবার মতো কিছু করলাম নাকি ? অবশ্য ওতে আমি ভয় পাইনা মোটে। ওসবে যথেচ্ছ অভিজ্ঞতা আছে আমার। শুধু বুড়ো বয়েসে লোকে পোলাপান বলে হাসবে, ওতেই যা এট্টু মানহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ফোন করে তিনি যা বললেন তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছের আবডালে উঠে স্থির হয়ে জিরোচ্ছিল বেশ কিছুক্ষন। খানকতক চড়াইপাখি বনবন করে ফ্যানের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার চারপাশে। দুচারবার বিষম খেয়ে বুঝতে পারলুম নবনালন্দার সুবর্ণজয়ন্তী ম্যাগাজিনে আমার "নব নালন্দা ডট ইস্কুল" লেখাটা চাইছেন।

কি আশ্চর্য !........ যে স্কুলের ম্যাগাজিন ছোটোর থেকে বরাবর হাতে নিয়ে পড়ার অভ্যেস ছিল সেই স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী প্রকাশনায় আমার লেখা ? বিশ্বাস হয়নি প্রথমটায়। সেজন্য অনিরুদ্ধ স্যারকে দুয়েকবার ফোন করে বিরক্তও করেছি। হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন সমস্ত কিছুর। হঠাৎ করে যেন কোনো এক নাম না জানা নদী কুলকুল করে বয়ে গিয়েছিলো বুকের মধ্যে দিয়ে। সেই জলের সুরে আমার আহ্লাদ, আনন্দ, নষ্টালজিয়া প্রভাত বীণার মতো বেজে উঠেছিল। অনুরণনে ছড়িয়ে পড়েছিল মুগ্ধতার বেরোখ উচ্ছাস। কেবলই মনে হয়েছিল, ছুটে যাই একবার, দেখা করে আসি সবার সাথে। ছোট ছোট কাঠের বেঞ্চিগুলোয় পিঠ ঠেকিয়ে আয়েস করে বসে গল্প জমাই। পাকেচক্রে কিছুতেই হয়ে উঠলো না, সেজন্য আমি আন্তরিক লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। প্রতিশ্রুতি রইল, একদিন প্রপার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে স্কুলে গিয়ে দেখা করে আসবো। আর অনিরুদ্ধ স্যারকে শুকনো ধন্যবাদ দেব না। আমার জীবনে অন্যতম আনন্দঘন মুহূর্তের কারণ আপনি, ঋণী হয়ে রইলাম চিরতরে..........। মাঝে মধ্যেই ফোন করে বিরক্ত করব আবার। সম্পাদক মণ্ডলীর সমস্ত আন্টি, স্যার এবং গোটা পরিচালন পর্ষদকে আমার আজানু প্রণাম ও অফুরান ভালোবাসা। 

পুনশ্চ : "নব নালন্দা ডট ইস্কুল" যদি কেউ পড়তে চান তাহলে আমার ব্লগের ডান দিকে 'জনপ্রিয় পোস্ট' কলামটির শীর্ষে দেখুন। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি এই লেখাটিতে এখনো পর্যন্ত প্রায় চারহাজার ভিউজ হয়েছে।
চিত্র : নিজস্ব 

চিত্র : নিজস্ব 

চিত্র : নিজস্ব 

#bengaliarticle #oldschool #schoolmemories #nostalgia #navanalanda #navanalandaalumni #schoolmagazine #goldenjubilee

Tuesday, April 18, 2017

সাপ্তাহিকী ২৬ # গুপ্তপ্রাণ


বিকেলের আলো নিভে গেছে অনেক্ষণ। দাওয়ার ওপর জামরুল গাছের ছায়ায় সন্ধ্যে নেমেছে। বাঁশ বেড়ার ওপার থেকে গুটিকয়েক বাড়ি থেকে বসন্তের হাওয়ায় শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে। 

পায়ে পায়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন ইন্দিরা। শাঁখের আওয়াজে হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন তুলসী মঞ্চের সামনেটায়। 

মাটির ওপর ধূপকাঠি পুঁতে হেঁটে হয়ে মাথা ঠেকালেন মঞ্চের কারুকাজ করা ধাপিতে। বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে আরেকদফা হাত জড়ো করলেন কপালে। 

অকস্মাৎ, সাঁৎ করে যেন একটা ছায়ামূর্তি সরে গেলো উঠোনের পশ্চিম দিকে। অন্ধকারে ঠাহর করতে পারলেন না ইন্দিরা। 

তবু অভ্যাসবশে হাঁক পেড়ে বললেন, 'কে এলি ? বিশু নাকি' ? যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে জিভ কেটে প্রকট হল আলোয়।

ইন্দিরা তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, 'আচ্ছা বিশু, কতবার তোকে বলেছি যে এমন ভর সন্ধেবেলা গেরস্থের বাড়ি পা টিপে টিপে ঢুকবি নে, তাও আবার পশ্চিমের পাঁচিল টপকে। কথা কিছুতেই কানে যায়না দেখি তোর' !! 

বিশু অত্যন্ত কুন্ঠিত হয়ে জবাব দিল, 'আজ্ঞে মাঠাকরুণ, পত্যেকবার ভুল হয়ে যায়, এতোদিনকার অভ্যেস তো, কিচ্ছুতে মনে থাকে না'।

- 'হুঁ, তোর ভুলের ঠেলায় বাড়ির একটা অকল্যাণ হোক আর কি, তাই কি চাস তুই' ?

বিশু একথায় প্রায় মাটিতে মিশে যায়, একহাত জিভ বার করে বলে, 'ছি ছি মাঠাকরুন, অকল্যাণ আপনার হতে যাবে কেন, হোক আপনার শত্তুরের। তাছাড়া আমি থাকতে কেউ সাহস করুক তো দেখি' ! 

বিশুর ডেঁপমি দেখে হেসে ফেলেন ইন্দিরা, বলেন, 'ওই তো তোর সিড়িঙ্গেপানা চেহারা, তুই কোন কাজে লাগবি আমার ? তোর যত বাতেলা ওই মুখেই.......'

সেকথায় বিশু গলার তেজ চড়িয়ে বলে, 'মাঠাকরুণ, আমার বাপ ছিল হারু ডাকাত। বাবার ভয়ে তাবড় জমিদাররা ভয়ে জুজু হয়ে থাকতো, এক হাঁকে সাতগাঁয়ের লেঠেলদের মুখের রক্ত সরে যেত। মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে, কপালে শ্মশান কালীর তিলক লাগিয়ে যখন ওই পাহাড়ের মতো শরীরটা নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতো, ভয়ে মুচ্ছ যেতে দেখেছি অনেককেই। আমি সেই হারু ডাকাতের ছেলে, চেহারাটা না থাকলে কি হবে, শরীরে তেনার রক্তই তো বইছে। 

ইন্দিরা বললেন, 'সে নাহয় বুঝলুম, তা তুই ওমনধারা কাজ করিস কেন বাপু ? যার বাপ নামকরা ডাকাত ছিল সে এমন রাত বিরেতে ছিঁচকে চুরি করতে বেরোয় কেন বল দিকি ? এতে কি তোর বাপের মান থাকে' ?

ইন্দিরার কটাক্ষে বিশু মিইয়ে যায় খানিক। 

আমতা আমতা করে বলে, 'আজ্ঞে, সবই তো জানেন মা, উনি সেই যে নিঁখোজ হলেন তারপর তো দলটাই ভেঙে গেলো। যে যার মতো ছিটকে গেল এদিক ওদিক। দু চারটেকে পুলিশ পাকড়াও করলে আর পাড়ার লোকে আমাকে দূর করে দিলে আমার ভিটে থেকে। কাজের চেষ্টা করেছিলুম দিনকতক কিন্তু নামের জন্য কেউ আমায় রাখতে চাইলে না। কি করব মা, পেটটা তো চালাতে হবে, তাই আর উপায় না দেখে এই কাজে নেমে পড়লুম'। 

'তা এইসব করে চলে যায় তোর' ? ইন্দিরা কোমল স্বরে জানতে চান।

- রোজ কি আর চলে মাঠাকরুণ, বড় হাত আর মারতে পারি কই, সবাই সেয়ানা হয়ে গেছে, এমন এমন জায়গায় মালপত্র লুকিয়ে রাখে ঘরের মাছি পর্যন্ত জানতে পারেনা। আমি তো কোন ছার। তাছাড়া ধরা পড়লে হাটুরে ঠ্যাঙানি তো আছেই। এই তো গেলো বিষ্যুৎবার, তপেন স্যাঁকরার টেবিলের ওপর থেকে একশো টাকার নোটটা প্রায় নিয়ে ফেলেছিলুম জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে। তাড়াহুড়োয় হাতটা বের করতে গিয়ে ঠক করে লেগে গেলো গরাদে। অমনি তপেন কোথা থেকে এসে খপ আমার হাতটা ধরে এক পেল্লায় গাঁট্টা মেরে আমার বহ্মতালু গরম করে দিলে একেবারে ! বলি, তোর তো স্যাঁকরার ব্যবসা, অমন একটা একশো টাকার নোটের জন্য এই ডাকাত সন্তানের গায়ে হাত তুললি ? ধম্মে সইবে তো তোর' ?

ইন্দিরা বিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন। নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। মেধাবী ছাত্র, কলেজ শেষ করে সেই যে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলো আজ দশ বচ্ছর হয়ে গেছে সে গ্রামের মাটিতে পা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। সময়ের শরীর বেয়ে স্মৃতিটুকু লেপ্টে থাকে শুধু, যোগাযোগের সূত্রটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। তবু স্নেহের আঁচলের ঘের কম পড়েনি ইন্দিরার। বিশুকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন। সময় অসময় বিশুর সাথেই গালগল্প করে দিন কাটে তাঁর। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশুকে জিজ্ঞেস করেন, 'খেয়েছিস কিছু ? মুড়ি খাবি চাট্টি' ? 

বিশু গদগদ হয়ে বলে, 'তা আপনি দিলে কি আর আপত্তি করতে হয় মাঠাকরুণ, তবে কিনা দুটো লঙ্কা আর পেঁয়াজ দেবেন সাথে, মুখটা ছেড়ে যায় তাহলে'। 

স্মিত হেসে হেঁসেলের দিকে পা বাড়ান ইন্দিরা। মৃদু হাওয়ায় বিশু আয়েস করে বসে উঠোনের একপাশে।

হঠাৎ রে রে করে চারজন ষণ্ডামার্ক লোক ঢুকে পড়ে বেড়ার দরজা খুলে। বিশু ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। 

সবারই প্রায় পেটানো চেহারা। চোখে মুখে আগুন জ্বলছে যেন। কোমরে গোঁজা ছুঁচোলো অস্ত্রের বাঁটগুলো জামার আড়াল থেকে উঁকি মারছে। এছাড়া হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আছে লাঠি, দা, কোদাল। উঠোনের মাঝবরাবর এসে চারজনেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিশুর দিকে। 

তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বিশুর কাঁধে হাত রেখে আগুনদৃষ্টি হেনে বলে, 'কি রে.....চিনতে পারছিস' ? 

বিশু থতমত খায় খানিক। তারপর ভালো করে ঠাহর করে বলে, 'মনোহর দাদা না' ? 

পাকানো গোঁফের নিচে এক ঝলক হাসি খেলে যায় মনোহরের ঠোঁট ঘেঁষে। বলে, 'চিনেছিস তাহলে ?

- কি যে বলো ! বাবার ডান হাত ছিলে যে তুমি, আর তোমায় চিনব না গো ?

- তা ভালো, তাহলে তো সুবিধেই হল.......

বলেই মনোহর আড়চোখে তাকিয়ে নেয় তার বাকি সঙ্গীদের দিকে। 

বিশু মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে, কিসের সুবিধে' ? 

মনোহর ফিসফিস করে বলে, 'বুড়ি কি ঘরের ভেতর নাকি' ?

-কে ? মাঠাকরুন ? হ্যাঁ তিনি তো ঘরের ভিতরেই আছেন, আমার জন্য মুড়ি আনতে গেছেন কিনা........

একথায় হো হো করে হেসে ওঠে মনোহর ও তার সাগরেদরা।

- এক্কেবারে মা ছেলের সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েচিস দেখছি, হ্যাঁ ?....ভালো ভালো, তোর বুদ্ধির তারিফ করতে হয় রে বিশু ।

মনোহরের কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না বিশু, বোকার মতো মুখের দিকে চেয়ে থাকে। 

মনোহর আবার বলে ওঠে, 'শোন, ওই তুলসী মঞ্চের তলায় যে হারু কাকা ঘড়া পুঁতে গেছে সে খবর আমরাও পেয়েচি, বুঝলি ? তাই পুরো মালটা একা হাতাবি সেটা মোটেও ভাবিস না'। 

বিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, 'তুলসী মঞ্চ !! ঘড়া !! কি বলছ মনোহর দাদা......আমি তো কিছুই.......'। 

বিশুকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে মনোহর কর্কশ গলায় বলে ওঠে, 'ন্যাকা সাজিস নে বিশে, হারু কাকা নিরুদ্দেশ হবার আগে ওখানে যে ঘড়াটা পুঁতে রেখেছিলো সেইটে নিতে এসেছি আজ। ওতে আমাদের সকলের হিস্সা আছে, এটা ভালো করে বুঝে নে, নাহলে...........'।

'কার সাথে কথা বলছিস বিশু ? কে এসেছে রে' ? ইন্দিরা মুড়ির বাটি নিয়ে বাইরে আসেন। 

উঠোনের মাঝখানে কজন ভীমকায় পুরুষ দেখে কাঠ হয়ে যান এক লহমায়। ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করেন, 'কে তোমরা বাছা, বলা নেই কওয়া নেই একেবারে দোর খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েছ' ? 

'আমরা আমাদের জিনিস নিতে এসেছি, পেয়ে গেলেই চলে যাবো', ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় মনোহর।

ইন্দিরা সে রক্তবর্ণ চোখের দিকে তাকাতে পারে না, বিশুর দিকে ফিরে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করেন, 'ও কি বলছে বিশু ? কে ও ? তুই চিনিস নাকি' ? 

বিশু বলে, 'আজ্ঞে, ও মনোহর দাদা, বাবার দলে ছিল। বলছে বাবা নাকি ওই তুলসী মঞ্চের নিচে কি একটা ঘড়া পুঁতে রেখেছিল, সেইটে নিতে এসেছে'। 

ইন্দিরা ভারী অবাক হয়ে বলেন, 'তুলসী মঞ্চের নিচে ঘড়া ? হারু পুঁতেছে ? কি বাজে বকছিস, তেমন হলে আমি জানব না ? আর তাছাড়া এ কবেকার তুলসী মঞ্চ, শুধু হারু কেন, কাউকেই আমি ছুঁতে দিইনি কখনো' ? 

মনোহর ইন্দিরার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, 'বাজে আমরা বকচিনে মাসিমা, সমস্ত খবর নিয়ে তবে এসেচি, তাছাড়া বিশু তো সবই জানে, কিরে বিশু ?

- আ-আমি কিন্তু সত্যি জানিনা মনোহর দাদা যে বাবা এখানে কিছু পুঁতে রেখে গেছে কিনা........

- তাই নাকি ! বেশ, তবে আর তোর জেনে কাজ নেই, এখনই তুলসী মঞ্চ ভেঙে ঘড়া তুলে নিয়ে চলে যাবো, তাহলেই সব জানতে পারবি।

ইন্দিরা মুড়ির বাটিটা ঠক করে দাওয়ায় নামিয়ে রেখে মনোহরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। 

চোখে চোখ রেখে বললেন, 'সেইটে হচ্ছে না বাপু, ওই তুলসী গাছ আমি নিজের হাতে পুঁতেছি এককালে, ও গাছ আমি উপড়াতে দেব না'। 

মনোহর দাঁত কিড়মিড় করে বলে, 'বটে ! তা কে আটকাবে শুনি ? আপনি ?

বিশু বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসে সামনে, ইন্দিরাকে আড়াল করে গম্ভীর গলায় বলে, 'না.........আমি' ?

একথায় মনোহরের দলবল অট্টহাস্য করে ওঠে। 

মনোহর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 'তাহলে বুড়িকে মেরে পুরোটাই একা হাপিস করবি ভাবচিস, তাই তো' ?

বিশু আচমকা কোথা থেকে যেন জোর পায়, হুঙ্কার দিয়ে বলে, 'উনি আমার মায়ের মতো, ওনার গায়ে হাত লাগাতে দেব না আমি, এই কথাটা ভালো করে বুঝে নাও মনোহর দাদা। উনি যখন বলচেন এখানে ঘড়া নেই, তাহলে সত্যিই নেই। মানে মানে তফাৎ হয়ে যাও, নাহলে ভালো হবে না কিন্তু........'। 

মনোহর আর সামলাতে পারেনা নিজেকে, হাতের লাঠিটা দিয়ে সজোরে চালিয়ে দেয় বিশুর মাথা লক্ষ্য করে। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় মাথা সরিয়ে সে লাঠির ধাক্কা এড়ায় বিশু,পরক্ষনেই বেড়ার ধার থেকে একটা মাঝারি মাপের মোটা বাঁশ নিয়ে চড়াও হয়ে যায় মনোহরের ওপর। 

দলের বাকিরা বিশুকে ঘিরে ধরে। ইন্দিরা ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বিশুর নিপুণ লাঠি চালনায় দুজন ঘায়েল হয়ে পড়ে খুব শীঘ্রই। বাকি দুজনের সাথে চরম লড়াই হতে থাকে। 

হঠাৎই তীব্র বেগে মনোহরের লাঠি বিশুর পাঁজরে আছড়ে পড়ে। বিশু যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে, টলমল করতে করতে জমির ওপর বসে পড়ে পাঁজরে হাত দিয়ে। কালক্ষেপ না করে মনোহর লাঠি ঘুরিয়ে বিশুর মাথায় মোক্ষম আঘাত করতে যায়। ইন্দিরা চিৎকার করে ছুটে এসে জাপ্টে ধরেন বিশুকে। 

মনোহরের লাঠি অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ইন্দিরার কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। মাথায় হাত দিয়ে উঠোনের ওপর লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা। বিশু আর্তনাদ করে ওঠে। হাতের বাঁশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে এসে ধরে ফেলে ইন্দিরাকে। 

ইন্দিরার কপাল বেয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকে। বিশু কোনোরকমে ধরাধরি করে দাওয়ার ওপর ইন্দিরাকে উঠিয়ে বসায়। 

মনোহর বজ্রকঠিন স্বরে বলে, 'লাঠিতে হাত পাকিয়েছিস বলে ভাবিস না মনোহরকে মাত দিবি। ওখানেই চুপ করে বোস, এর যদি অন্যথা হয়েছে তবে আর লাঠি নয়, এই ভোজালি দিয়ে তোর গলার নলিটা কেটে দিয়ে যাব'। 

বিশু বশ্যতা স্বীকার করে, দ্বিতীয়বার আর কোনো কথা বলে না। 

কাঁপা কাঁপা হাতে ইন্দিরার শুশ্রষা করতে থাকে। মনোহর চোখের ইশারায় তার সাগরেদদের তুলসী মঞ্চের দিকে দেখায়। বিনা বাক্যব্যয়ে বাকি তিনজন চটপট খুঁড়তে শুরু করে। 

বেশ খানিক্ষন খোঁড়ার পর হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ হয়। সবাই লুব্ধ দৃষ্টিতে যে যার মুখের দিকে তাকায়। বিশুও উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকে সেদিকে। মনোহরের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। 

নিজেই এগিয়ে এসে একজনের হাত থেকে কোদাল কেড়ে নিয়ে দ্বিগুন বেগে খুঁড়তে শুরু করে। কিছুটা খোঁড়ার পরই এক ভয়ার্ত শব্দ করে হাতের কোদাল ফেলে ছিটকে দুকদম পিছিয়ে আসে সে। 

পলকে বাকিদের মুখও ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে যায়। বিশু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, তুলসী মঞ্চের নিচের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। মাটির ভেতর থেকে উঁকি মারছে ফ্যাকাশে বিবর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া একটা আস্ত নরখুলি। তমসাচ্ছন্ন, ভয়াল তার চাহনি ! কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে অতীতের জমাট নিকষ কালো অন্ধকার যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চাইছে স্তব্ধ দর্শকের চোখ। 

মনোহর ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বার হয় না। 

ইন্দিরার দু গাল বেয়ে সরু জলের রেখা নেমে আসে। 

বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, 'কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত ছিল...........আমি রান্নাঘরে হাঁড়ি চাপিয়েছিলুম। এমন সময়ে উঠোনের কাছে ধড়াম করে একটা শব্দ হয়। আমি নিচে নেমে এসে দেখি হারু চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওই গোয়ালঘরের দিকটায়। ওকে দেখে আমি ছুটে যাই। পুলিশের গুলি লেগেছিলো বুকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল মাটি। বাঁচার আশা ছিল না। 

বদ্যি ডাকবো বলে চিৎকার করে উঠতেই হারু শক্ত করে আমার হাতদুটো ধরে মুখ ফুটে বলেছিলো, 'পুলিশের হাতে যেতে চাই নে রে ইন্দি.......... চিরকাল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েচি। মরার পর তারা আমার লাশ নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে, গর্ব করে বলবে হারু ডাকাতকে মেরেছে, তা যেন না হয়। তুই দেখিস। আর পারলে তোর এই উঠোনটায় আমার জন্য একটু জায়গা করে দিস, যেমন করে এতকাল.................বলেই শরীরটা একবার কেঁপে উঠেই নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিলো' ।

'আমি হারুর শেষ কথা রেখেছিলাম..........' , দুহাতে মুখ চেপে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন ইন্দিরা। অতীতের অব্যক্ত গ্লানি হু হু করে বেরিয়ে আসে তাঁর দুচোখ থেকে। 

সবাই নির্বাক শ্রোতার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নিমেষে থমথমে ভারি হয়ে যায় পরিবেশটা। মাথার ওপর দিয়ে করুণ রাতের কোনো পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়। ইন্দিরার অকপট বয়ানে মোহাচ্ছন্ন নিস্পন্দ বিশু অপলক চেয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে । 

বিহ্বলতার ঘোর কাটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখে ইন্দিরার, নরম স্বরে বলে, 'ঘরে চলুন মাঠাকরুন, অনেকটা কপাল কেটে গেছে আপনার........... রক্ত ঝরছে এখনো..............'    
 

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengalishortstories #saptahiki

Thursday, April 13, 2017

পয়লাবার

পয়লাবার যেদিন আমি স্কুলে
দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন লাগার ঘোর
একলা থাকার অভ্যাসটা ভুলে
প্রথম পাওয়া বৈশাখী এক ভোর।

পয়লাবার স্বাদ বসলো মুখে
হজমিগুলি বিটনুন সব কালো
মেঘলা দুপুর বিকেল আলোর সুখে
হাফপ্যান্টে কাটছিলো দিন ভালো।

পয়লাবার বৃষ্টিশহর বুক
ট্রামলাইন আর সিনেমা নাটক ভিড়
প্রথম দেখায় তুমি আমি চুপ
কালবৈশাখী সন্ধ্যারাগের মীড়।

পয়লাবার বিরহ বিষম জ্বালা
আটপৌড়ে নালিশ বাজে কানে
ছন্নছাড়া পায়ের মেপে চলা
রূপকথারা বিষাদ ডেকে আনে।

পয়লাবার পাশ ফিরল মন
বসন্তগানে কোকিল বসে দূর
শাস্ত্রমতে অমল আয়োজন
সাতপাকেতে সানাই সোহাগ সুর।

পয়লাবার পিতৃধর্ম পালন
স্কুল, কাছারি, সংসার, ডালভাত
নিয়মবাঁধা রুলটানা ক্ষণযাপন
পাহাড়, সমূদ্র, কদাচিৎ  দৈবাৎ।

পয়লাবার স্পষ্ট দেখছি আজ
বার্ধক্যের ঝাপসা ঘরের কোন
অতীত ঘেঁষা মুহূর্ত কোলাজ
একলা থাকার বৈশাখী স্পন্দন।

শহর, বাড়ি, জ্যোৎস্না ভরা রাত
নির্ঘুমজ্বর আঁকড়ে ধরে সব
পয়লাবার সুযোগ ছোঁয় হাত
পিছুটানের শৈশব কলরব।


চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব 
#poilabaisakh #bengalinewyear #bengali #bengalipoems #poetries

Wednesday, April 5, 2017

১ বছর

আজ একবছর পূর্ণ হল। দেখতে গেলে এই তো সেদিনের কথা মনে হয়। হ্যাঁ, তখন দু চার কলম পদ্য, কবিতা ও অন্যান্য অভিজ্ঞতার কথা লিখতুম বটে। যখন যেমন মনে আসতো.....গান লেখার ভারী শখ ছিল, লিখেওছিলুম খানকতক সেসময়। কিন্তু গল্প, প্রবন্ধ ? নাহ, সেসব লেখার কথা দুঃস্বপ্নেও মনে হয়নি কখনো। তবু কি করে যেন বসন্তের খেয়ালী হাওয়ার মতো আপনা আপনি কলম চলতে লাগলো। কখনো মৃদু গতিতে, কখনো কাঁচভাঙ্গা ঝড়ের দাপটে। কালির নদীপথ পেরিয়ে গল্পের মোহনা ছুঁয়ে কখন যে সাহিত্যের সমুদ্রে ঝাঁপ দিলুম মনে পড়ে না। হয়তো এর শিকড় খুঁজতে গেলে দেখা যাবে ৩০শে মার্চ ২০১৬য় এই কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনাই এর মূল কারণ। সেবার সংবাদ মাধ্যমের চ্যানেলে চ্যানেলে আমরা লাইভ দেখেছিলাম মৃত্যুর মিছিল, আর্তের হাহাকার, কংক্রিটের ছাদের তলায় প্রতি মিনিটে পিষে যাওয়া শেষ প্রাণটুকুর নিস্পন্দ আর্তনাদ। আর দেখেছিলাম উদ্ধারকার্যে দলে দলে বিবিধ মানুষের তৎপরতা, আগুপিছু না ভেবে পাথরের আড়াল থেকে খুঁজে বের করা প্রাণের শেষ আধার, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া হাতের দিকে জলের বোতল বাড়িয়ে দেওয়ার অন্তিম চেষ্টা। পোস্তা ব্রিজের ভগ্নাংশে তখন রাজদণ্ড সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক কষছে। প্রতিবাদের ঝঞ্ঝা বয়ে গিয়েছিলো শহরের বুকের ওপর দিয়ে। মনে হয়েছিল আমারও কিছু করা প্রয়োজন, যে করেই হোক যতটুকু সামর্থের মধ্যে পড়ে। সেই লিখতে শুরু করি। কিন্তু সে লেখা যে কখন চেতনার কানাগলি ছুঁয়ে গল্পের ছাঁচে গড়ে  উঠেছিল বুঝে উঠতে পারিনি। পুরোটা লেখার পর মনে হল, বেশ হয়েছে, এমনটাই তো চেয়েছিলুম। অস্ত্র নিয়ে ছুটে যেতে না পারি, বাকিদের সাথে বিদ্রোহের পতাকাটা তো চেপে ধরে রাখতে পারি। 

পোস্ট হল আমার প্রথম ছোট গল্প - "ফেরার' । অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম......... দাদা, দিদি ,বন্ধু, আত্মীয় পরিজন, ছোট, বড় সকলে প্রশংসা করেছিলেন। সাহস জুগিয়েছিলেন।
সেই শুরু................................................. 
'সাপ্তাহিকীর' হাত ধরে একে একে বের হতে থাকল 'টিকিট' ,'পয়লা দা', 'লাইন', 'কলরব' , 'একুশ টাকা ভাড়া' ,'আড়বাঁশি' প্রভৃতি। পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো কবিতা, অনুপদ্য, প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখা। পাশাপাশি ছিল পাঠকদের নিরন্তর ভালোবাসা ও উৎসাহ । ছোটগল্প - প্রবন্ধের সাথে তাঁরা যুক্ত হতে থাকলেন এক এক করে, নিজস্ব ভাবভঙ্গিতে জীবনের সাথে সংযোগ খুঁজে পেলেন অনেকেই । আমাকে মন খুলে বললেন সেকথা। নিয়মিত আসতে লাগলো তাঁদের মন্তব্য, প্রশ্ন, সঙ্গে বিভিন্ন গল্পের ঘটনা উল্লেখ করে তার দরদী বিশ্লেষণ। এক দৈব আনন্দে কানায় কানায় ভরে গিয়েছিলো হৃদয়। বন্ধুরা ভরসা দিলেন যেমন, অভিজ্ঞরা ছোটখাট ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে কলমের ভিতটাকে আরও মজবুত করে তুললেন। ক্রমে 'মলাট' নাম দিয়ে ব্লগ খুলে ফেললুম। কল্পনার ধোঁয়া উড়িয়ে হৈহৈ করে এগিয়ে চলল গল্পের রেলগাড়ি। এক একটা স্টেশন অতিক্রম করে আজ সর্বসাকুল্যে ২৫টা ছোটগল্প বিদ্যমান যার মধ্যে ৪টা সিরিজ 'মলাটের' পেজের ডান দিকে দিব্য জায়গাজুড়ে বসে আছে। এছাড়াও ২৪টা কবিতা, ১১টা অনুপদ্য ও ১৩টা প্রবন্ধ নিয়ে 'মলাটের' ভাঁজ আরও দৃঢ় হয়েছে। আজও দেরি হলে মেসেজ আসে, 'পরের সাপ্তাহিকীটা কবে আসছে' ? এই পরম পাওয়ার সত্যিই কোনো বিকল্প নেই।

এক বছর অনেকটা সময়। এই একবছরে পেয়েছিও অনেক, হারিয়েছিও বেশ কিছু। কিছু লিখতে পেরেছি কিছু ইচ্ছে করেই লিখিনি। এমন আনন্দঘন মুহূর্তে সে লাভ লোকসান বিচার করার সময় নয় হয়তো। তবু কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে, তবু কিছু ঋণ শোধ হয়না কখনো........ 
সময় এগিয়ে চলেছে........ আমিও........একবছর আগের ফেলে আসা দীর্ঘ ছায়ার অবয়ব দেখে আজ অবাক লাগে বৈকি........ 

ভালো থাকবেন সকলে................

বিন্যাস : নিজস্ব 

#bengaliarticles #experience #readers #bengaliwriteups #anniversary