Saturday, August 10, 2019

বন্ধু চল # ৪ - ফলতা

কতটা মরিয়া হলে মানুষ এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে সেদিন আমাদের দেখলে খানিকটা হলেও
ছবি : সৌম্য 
বোঝা যেত বোধহয়। বাইক নিয়ে শেষ বেরিয়েছিলাম সেই গত বছর। তারপর যাচ্ছি যাব করে দুটো গ্রীষ্ম, দুটো বর্ষা আর একটা শীত পেরিয়ে গেলেও কিছুতেই ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে পারিনি দুজনে। বাইরে না বেরোতে পারার গুমোট ভাবটা ততদিনে কয়লার ধোঁয়ার মতো লতিয়ে উঠেছে। অবশেষে, 'নিকুচি করেছে ! যা থাকে কপালে' বলে দুম করে বানিয়ে ফেললাম একেবারে দুদিন-এক রাত কাটানোর মতো একটা চরমতম প্ল্যান। নাহ, ফ্যামিলি নিয়ে নয়, বরং লাগামছাড়া বাউলের মতো স্বাধীনভাবে কাটানো কয়েক মুহূর্তের অবকাশ যাপন।  

যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাড়িতে সমস্তটা গুছিয়ে বলার আগেই গুগল ঘেঁটে ফলতার হোটেল সি-বার্ড ইন্টারন্যাশনাল বুক করা হয়ে গেল। এ যেন কতকটা সেই স্কুলের পিকনিকে যাওয়ার মতো। বাস তো বুক করা হয়ে গিয়েছে, এখন তো আর না বলার উপায় নেই।

"কি আশ্চর্য ! বুক করে ফেললে ! কোথায় হোটেল ? কি ব্যাপার ? সঙ্গে আমরা গেলেও তো হত ! দিনের দিনে কি ফেরা যেত না" ? এমন ধারার নানাবিধ প্রশ্নকে মেসির মতো ডজ করে কাটিয়ে বেরিয়ে গেলুম দুজনেই। কারণ আগেই বলেছি মরিয়া হলে মানুষ যা ইচ্ছে করতে পারে। অতএব সক্কাল সক্কাল বাইকে তেল ভরে নিয়েই ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে দে চম্পট।

ছবি : নিজস্ব 
মাঝে শুধু একবার মাত্র দাঁড়িয়েছিলাম। আমতলা পেরিয়ে সরিষাহাট মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে দু তিন কিলোমিটারের মাথায় একটা স্বামীনারায়ণের মন্দির পড়ে। সে এক দেখার মতো স্থাপত্য। পোড়ামাটির রঙে সে আশ্চর্য শিল্প অজান্তেই মনের মধ্যে সম্ভ্রম জাগায়। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আবার দৌড়।

অর্জুন, শাল, টিক, মেহগনি আর সেগুন গাছের ছায়ায় ততক্ষনে আমাদের শহুরে ক্লান্তি খসে পড়েছে শরীর থেকে। রাস্তার দু দিকে ঘাড় ঘোরালে অজস্র সবুজের কোলাজে চোখে নেমে আসছে পরম শান্তি। দূর আকাশে ধূসর মেঘের ছবি আঁকা হয়ে চলেছে রাস্তার ওপরেই, বাইকের চাকা সে ছবি ছুঁয়ে ছুটে চলেছে অদম্য, অজানা আকর্ষণে।

প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর নৈনান মোড় থেকে বাঁদিক ঘুরে সটান উপস্থিত হলাম হোটেলের সামনে। আশেপাশে আরও দু একটা হোটেল আছে বটে তবে আমাদেরটা গঙ্গার একেবারে লাগোয়া। এমনিতে জনবসতি শূন্য এলাকা তবে দু একটা ইন্ডাস্ট্রি থাকার ফলে রাস্তার ওপর কখনো কখনো মানুষের দেখা মেলে। অবশ্য আমাদের তাতে কিছু আসে যায়নি। বেলেল্লাপনা করাটাই যাদের লক্ষ্য তাদের কাছে চড়াই পাখিও যা, চিংড়ি মাছও তা।

প্রথমটায় কটেজ বুক করা ছিল। দেখার পর নাপসন্দ করে আমরা সোজা একটা ডিলাক্স রুম ভাড়া
ছবি : হোটেল সি বার্ড 
নিই, ডাবল বেডরুমের ভাড়াতেই। ম্যানেজার কি কারণে সদয় হয়েছিল জানা নেই। বোধহয় ভেবেছিল, আহারে ! অত দূর থেকে দুটো বাঁধা গরু ছাড়া পেয়ে এসেছে, ওদের খানিক শান্তি  না দিলে নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হতে পারে। সে যাইহোক, চটপট লাগেজপত্র রেখে তোয়ালে নিয়ে চলে গেলুম সুইমিংপুলের ধারে। কোমর সমান জল, তাতেই কৈ মাছের মতো এমাথা ওমাথা সাঁতার কেটে নিল সৌম্য। আমার বরাবরই ডুবে যাবার ভয়, তাই আধা ডুবন্ত - আধা ভেসে থাকা অবস্থায় সুইমিং পুলের পার ধরে হেঁটে চলে বেড়ানোটাই নিরাপদ বলে মনে হল । যেদিকটায় জল বেশি, অর্থাৎ আমার গলা পর্যন্ত  ডুবছে সেদিকটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলাম।  সৌম্য যদিও আমাকে সাঁতার শেখাবে বলে জানপ্রাণ লাগিয়ে দিয়েছিল, তবু কাতলা মাছের মতো ঝটাপটি করা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছুই হয়ে উঠল না সে যাত্রা।

ঘন্টাখানেক পর সুইমিংপুলের মায়া ত্যাগ করে ঘরে এসে চেঞ্জ করে ডাইনিং হলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মিনিট পাঁচেক বাদেই চলে এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, এক চামচ ঘি, সোনামুগের ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, চাটনি আর পাঁপড়। খিদের চোটে সেসব কর্পূরের মতো উবে গেল দেখতে দেখতে। আয়েশের ঢেকুর তুলে মৌরি চিবোতে চিবোতে ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটে ছোঁব কি ছোঁব না করছে।

ছবি : হোটেল সি বার্ড 
রিমোট নিয়ে এদিক ওদিক চেক করতে করতে দেখলাম কোনো একটা মুভ্যি চ্যানেলে 'লাডলা'  চলছে, সবে শুরু হয়েছে। নব্বই দশকের অনিল কাপুর - শ্রীদেবীর দুরন্ত হিট ছবি। প্রত্যেকটা গান আমাদের মুখস্ত ছিল। মনে পড়ল স্কুলে এক সময় টেবিল বাজিয়ে এই ছবির কত গান করেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে ছবিটা দেখতে শুরু করে দিলাম দুজনেই। যেন এতো দূরে এসেছি দুপুরবেলা লাঞ্চ করে 'লাডলা' দেখব বলে। এক একটা সিন্ চলছে আর আমরা নিজেরাই ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছি। আবার ভেবে অবাকও হচ্ছি যে সিন্ পর্যন্ত মুখস্ত আছে আমাদের, এখনও......

দুপুর গড়িয়ে, বিকেল পেরিয়ে কখন সন্ধ্যে নেমেছে আমাদের খেয়াল ছিল না। সিনেমা শেষ হতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরেটা ধূসর হয়ে এসেছে। হোটেলের বাইরে গঙ্গার পারে বসে চা খাব বলে ঠিক করলাম। দু মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে গঙ্গার পারে এসে দেখলাম একটা ঢাউস স্টিমার নদীর একেবারে মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে জিরোচ্ছে বলে মনে হল। হলদিয়ার বন্দরটা সীমান্তের শেষে আবছায়া দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপরে টিমটিমে আলোয় একটা চায়ের দোকানে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। তার সোঁদা গন্ধ কুণ্ডলী পাকিয়ে নদী পেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। দোকানের পাশেই ভূত বাংলোর মতো একটা সাদা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। অন্ধকারে কয়েক বছরের জীর্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। বেশ একটা গা ছমছমে মায়াবী পরিবেশ। বেশি দূর এগোলাম না আর আমরা। একটা শান বাঁধানো ধাপিতে বসে খানিক গুলতানি করে আবার পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

ফিরে এসে আবার আরেক রাউন্ড সিনেমা। যেন সিনেমা দেখাই মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের। অবশ্য বিনা বাধায় বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পাওয়া অনেকটা লটারি পাওয়ার মতোই। যাঁরা বিবাহিত তাঁরা নিশ্চই সহমত হবেন আমার সঙ্গে। আপনার পছন্দের সেরা ছবিটা টিভিতে চলছে, আর আপনি নিশ্চিন্তে বসে মৌজ করে সেটা গিলছেন, এমনটা আপনার কপালে যদি জুটে থাকে তাহলে আপনি যথেষ্ট ঈর্ষার পাত্র। খানিক সিনেমা দেখে আর বেশ খানিকটা আড্ডা মেরে আমাদের সময় কাটছিল। রাতে তন্দুরি রুটি আর মালাই কোফতা খেয়ে দিব্যি আমেজ এল। বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেদেরই খেয়াল ছিল না।

পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল। সৌম্যর ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বেচারা কোনো কাজ না পেয়ে ঘরের টেবিল চেয়ার সরিয়ে ঠিক করে রাখছিল। সংসারী ছেলে। সেসবের আওয়াজেই ঘুম ভাঙে আমার। এমন নির্ঝঞ্ঝাট অলস সকাল শেষ কবে পেয়েছিলুম মনে করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার দিকে। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বুকভরা অজস্র মুহূর্ত আর বেঁচে থাকার রসদটুকু। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে পিছুটান ভুলে এমন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অনেকটা দূরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরাটা একটু বেপরোয়া হলেও দিব্যি লেগেছিল কিন্তু আমাদের।

এই প্রসঙ্গে বলি - পরের বারটার জন্য একটা বেড়ে লোকেশন খুঁজছি.....জানা থাকলে বলবেন তো.....

কৃতজ্ঞতা : সৌম্য ও সৌম্যর বাইক 


ছবি : নিজস্ব 
#bengalitravelblog #traveldiaries #Molat #debdattasinha #bengaliarticle #bengalweekendtour #travelstories

Friday, June 14, 2019

পিচ-বৃষ্টি ও আন্দোলন

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ বৈচিত্রে ভরপুর। সমর্থকদের জন্য এমন অভূতপূর্ব সারপ্রাইজ মাথাকুটেও ভাবা যায় না। মারকাটারি খেলার সাথে সাথে বাম্পার বোনাঞ্জার মতো বৃষ্টি দেখার আনন্দটুকুও যে ষোলো কলায় পূর্ণ  হবে এ বোধহয় অতি বড় সমর্থকও বুঝতে পারেননি। আর এই খেলাকে খেলা না বলে ছেলেখেলা বলব না পুতুল খেলা বলব সেসব ভাবতে গেলে আবার একটা ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে বরং বসে বসে সুপার সপারের কেরামতি দেখি ও গোটা মাঠ না ঢাকার ফলে মাঠকর্মীদের দ্বিগুন পরিশ্রমের পর্যালোচনা করে দুখী মনটাকে চায়ের কাপে ভিজিয়ে নিই।  

জনৈক উচ্চপদস্থ এক আইসিসি কর্মকর্তা বলেছেন যে ওনারা জানতেন ইংল্যাণ্ডে বৃষ্টি হবে তবে দ্বিগুন বৃষ্টি হবে সেটা নাকি আগাম আঁচ করতে পারেন নি। আবহাওয়াবিদরা অনেক আগেই বলেছেন এই সময়টায় বৃষ্টি হবে - এটাই যথেষ্ট নয় কি এবং সেটা জানার পরও এই সময় ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেললেন কি কারণে ? থর কি হাতুড়ি মারফত স্বপ্নাদেশে বরাভয় দান করেছিলেন নাকি আগাম সতর্কবার্তাকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তারা বলতে চেয়েছিলেন "চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা"...…..

১৮টা ম্যাচের মধ্যে এখনো অবধি ৪টে ম্যাচ বাতিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এই বছরটা বাদ দিলে এখনো অবধি শুধুমাত্র দুটো ম্যাচই বাতিলের খাতায় নাম তুলেছে। একটি ২০১৫ সালে এবং আরেকটি ১৯৭৯ সালে। এক্ষেত্রে রিসার্ভড-ডের উপকারিতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইসিসির কর্মকর্তারা বলছেন যে প্রত্যেকটা ম্যাচের জন্য রিসার্ভড-ডে রাখা হলে বহুদিন ধরে খেলা চালিয়ে যাওয়া পারতপক্ষে সম্ভব ছিল না। হরিবোল ! খেলাটা যখন বিশ্বকাপ এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের নজর থাকবে যেখানে সেটা নিয়ে আরও একটু দূরদর্শিতা দেখালে কি বিগ বাজারের উইকেন্ড ডিসকাউন্টটা মিস হয়ে যেত ! একটি চমকপ্রদ তথ্য দিই। ১৯৯৯ সালে এই ইংল্যান্ডেই আয়োজিত বিশ্বকাপে প্রত্যেকটি ম্যাচের জন্য একটি করে রিসার্ভড-ডে রাখা ছিল। 

আগামী দিনগুলোর মধ্যে যে সব দিনে ম্যাচ হবে সেখানে কয়েকটা দিন বাদ দিলে বাকি প্রায় সবকটা ম্যাচেই বৃষ্টি হবার প্রভূত সম্ভাবনা আছে - এমনটাই নাকি পূর্বাভাস। হরি হে মাধব ! চান করব না গা ধোব ! সুতরাং যে সমস্ত টিমের ম্যাচ বাতিল হতে থাকবে সেমি ফাইনালে ওঠাটা তাদের পক্ষে ততটাই দুঃসাধ্য হতে থাকবে। সবথেকে আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে ইংল্যান্ডের প্রায় সবকটা মাঠেই নাকি জল নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। শুধু পিচ ও পিচের চারিধারটা ঢেকে ফেললেই নিশ্চিন্তি, এতেই রাত্তিরে ভালো ঘুম হবে। ওরে পাগল ! ইডেনটা একবার দেখে যেতে পারতিস তো। তাছাড়া চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে সাব-এয়ার ড্রেনেজ সিস্টেমটা শিখে নিলেও তো হত। শ্রীলঙ্কায় পর্যন্ত গোটা মাঠ ঢাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আদ্যিকালের ভেঁপু বাজিয়ে কি আর জাস্টিন বিবারের শো হয় গুরুদেব ! 
   
এমতাবস্থাতেও আইসিসির পক্ষ থেকে তেমন কোনো হেলদোল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পরের ম্যাচগুলো ভেস্তে গেলে ঠিক কি হতে পারে তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভাবটা এমন যে ছাড়ুন তো মশাই, মোটে তো চারটে বছর, ও দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। পরের বার নাহয় ভরা জ্যৈষ্ঠে  সাহারা মরুভূমিতে স্টেডিয়াম করে বিশ্বকাপ করাব। বৃষ্টি হলেও বালিতে শুষে নেবে। সে আপনারা করুন গে, কিন্তু তাই বলে সমর্থকদের অপেক্ষা, আনন্দ আর উত্তেজনা মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, তার কি হবে ? কয়েকশো কোটি টাকার ভোজে প্যান্ডেলটাই ঠিক মতো বেঁধে উঠতে পারলেন না যে। অগত্যা সন্ধ্যের দিকে টিভি খুলে চপ মুড়ি খেতে খেতে শাপ শাপান্ত করা ছাড়া আর তেমন কোনো গতি নেই সমর্থকদের। একটা লাভ অবশ্য আছে। চপ মুড়ির শিল্পে একটা উন্নতি দেখা দিলেও দিতে পারে।
 



#molat #rainatengland #matchabandoned #CWC2019 #DebdattaSinha
   
 

Thursday, May 2, 2019

অনুপদ্য - ২২

জানলা ঘেরা আতস কাঁচে
                 সূর্য ধরার ছাপ
বৈশাখী রোদ প্রহর গোনে
           চৌকো ঘরের মাপ

বাইরে আলো রঙের প্রলেপ
                মুক্ত মনের দ্বার
ঘরের ভিতর জমাট কালো
                ভীষণ অন্ধকার


ছবি : নিজস্ব 














#shortbengalipoem #bengaliblog #shortpoems #banglakobita #Molat #DebdattaSinha 






Saturday, March 16, 2019

প্যহলে ভোট, ফির ইন্টারভিউ...

৭ই মে, ২০১৪, হিমাচল প্রদেশ.....

কল্পা উপত্যকায় এখন একের পর এক মেঘের ছায়া সরে যাচ্ছে। কিন্নর জেলার এই ছোট্ট শহরে কাল রাতেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কাগজে কলমে গ্রীষ্মকাল হলেও বাতাসে এই শিরশিরানি ভাবটা যেন কিছুতেই শরীর ছাড়তে চায় না। একটা চৌকোনো জানলা দিয়ে হিমালয় ছুঁয়ে আসা আলো এসে পড়েছে একটা কাঠের বিছানায়। ভোরের প্রথম সূর্যের গন্ধে চোখ মেলে তাকালেন এক শীর্ন জরাক্রান্ত বৃদ্ধ। গায়ের লেপটা সরিয়ে কোনোমতে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলেন ফুলহাতা সোয়েটার আর উলের টুপি পরিহিত শ্যামশরণ। দুটো পা নামিয়ে গলিয়ে নিলেন একজোড়া ক্যাম্বিসের জুতো। মুখ ঘুরিয়ে জানলার দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। মুখের অগণিত দীর্ঘ বলিরেখায় অতীতের অক্ষর স্পষ্ট। আজ এক বিশেষ দিন। সপ্তাহখানেক আগে নির্বাচন কমিশন থেকে চিঠিটা এসেছে।
একটা আলগা হাসি খেলে যায় শ্যামশরণের দু চোখ জুড়ে...…..

১৯৭৫ সালে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছিলেন শ্যামশরণ। তারপর থেকে পরিবার ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। বর্তমানে ছোট ছেলে চন্দ্রপ্রকাশের পরিবার তাঁর সঙ্গে থাকে। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ আর তিন নাতি নাতনি নিয়ে সংসার। এখন সারাদিনের সঙ্গী বলতে একটা ছাইরঙা রেডিও যার ওপর আঙুল বুলিয়ে দেশের হালহকিকত নেড়েচেড়ে দেখেন মাঝেমাঝেই।

কয়েক মুহূর্ত থমকে, দুহাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন অতিপ্রবীণ মানুষটি। মিহি গলায় বলে উঠলেন, 'পানি লা দো বিটিয়া '। ভিতরের ঘর থেকে পুত্রবধূ সুরমা এক গ্লাস জল এনে দেয় তাঁকে। মৃদু হেসে বলে, 'জলদি উঠ গ্যায় বাবা' ?

- হাঁ বিটিয়া....প্যতা হ্যায় না আজ কন সা তারিখ হ্যায় ?
- জি বাবা
- হমে দেড় নহি হোনা.....
- জি বাবা, পানি গরম হ্যায়, আপ নহা লিজিয়ে...…..

শ্যামশরণ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন, পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যান কলতলার দিকে।

খানিক বেলা বাড়তেই একটা ভিড় জড় হতে থাকে শ্যামশরণের বাড়ির উঠোনটায়। পুলিশ, মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের শব্দে চারপাশটা যেন মৌমাছির গুঞ্জন বলে ভ্রম হয়। যে ঘটনা ঘটতে চলেছে তার সাক্ষী থেকে যেতে চান সকলেই। এমন একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত মুঠোবন্দি করতে উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করতে থাকেন সাংবাদিকরা। হিমালয়ের বুকে ৯ হাজার ৭০০ ফিট উচ্চতায় যে ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে আছে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে তৎপর দেশের তামাম মিডিয়া। সময়ের সাথে সাথে ভিড় আরও গাঢ় হতে থাকে। কয়েকজন উচ্চপদস্থ নির্বাচন আধিকারিক এসেছেন গাড়ি নিয়ে। কয়েক দশকের অতীতকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন মাণ্ডির বুথে। সবারই লেন্সের ফোকাস তাক করা থাকে কাঠের বাড়িটার দরজার দিকে।

শ্যামশরণের পুত্র চন্দ্রপ্রকাশ একঝলক জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিয়ে বলে, 'উও লোগ আ গ্যায় বাবা'। দেওয়ালে ঝোলানো একটা পুরোনো ক্ষয়াটে আয়নায় শ্যামশরণ মাথার টুপিটা ঠিক করে নেন একবার। তারপর মুখ ঘুরিয়ে স্মিত হেসে বলেন, 'চলো ফির'। দুজন পুলিশ দরজার দিকে এগিয়ে আসে। 

মুহূর্তে হৈহৈ করে ওঠেন সবাই। কুয়াশার পাতলা চাদর সরে গিয়ে দেখা দেন দৃঢ়চেতা বৃদ্ধ। একটা লাঠির ওপর ভর দিয়ে পলকা নড়বড়ে শরীরটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ৯৭ বছরের শতাব্দী প্রবীণ শ্যামশরণ নেগি। গায়ে একটা বাদামি রঙের কর্ডের জ্যাকেট, সাথে মানানসই ট্রাউজার আর মাথায় লাল-সবজে রঙের শেরপা টুপি পড়ে একগাল হাসি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সবার সামনে। সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সকলে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল একের পর এক। সাথে শিলা বর্ষণের মত প্রশ্ন ধেয়ে এল তাঁর দিকে। কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে শ্যামশরণ বললেন, 'প্যহলে ভোট, ফির ইন্টারভিউ'। সকলে যেন বাধ্য ছাত্রের মতো কথা শুনলেন প্রাচীন শিক্ষকের। দুপাশে সরে গিয়ে ওনার পথ করে দিলেন সবাই। নির্বাচন কমিশন থেকে পাঠানো গাড়ির দিকে মন্থরপদে এগিয়ে গেলেন শ্যামশরণ নেগি - ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের ব্র্যাণ্ড এম্বাস্যাডর, স্বাধীন ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ভোটার ও এক অনন্য ইতিহাসের রচয়িতা......

(১৯৫১ সালের ২৫শে অক্টবর চিন্নি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রথম ভোট হয়। সেই দিনে শানতুং আর কল্পায় একই সাথে ভোটগ্রহণ হয়। ভোর সাড়ে ছটায় কল্পা উপত্যকায় প্রথম ভোট দেন শ্যামশরণ নেগি যিনি সেদিন থেকে আজ অবধি কোনো সাধারণ নির্বাচন উপেক্ষা করেননি। ২০১৪ সালে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ওনাকে লোকসভা নির্বাচনের ব্র্যাণ্ড এম্বাস্যাডর ঘোষিত করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ১০২ বছর এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে প্রস্তুত। ) 




#firstindianvoter #shyamsarannegi #electioncommissionbrandambassador #parliamentelection2014 #bengaliarticle #bengalishortstories #molat

Saturday, February 2, 2019

স্বপ্নের মতো

আমাকে অনেক সময় অনেকেই বলেছেন যে গল্প ছাপানোর ক্ষেত্রে কেন আমি উদ্যোগ নিচ্ছি না বা নিই না। এর সম্যক দু একটা কারণ আছে। মুস্কিলটা হল আমি চাকুরিজীবি এবং তদুপরি বাঙালি। প্রথম ক্ষেত্রে হাঁপ ছাড়ার পর যেটুকু সময় বাঁচে তা দিয়ে সংসার নামক একটি ধর্ম আমাকে মন প্রাণ দিয়ে মেনে চলতে হয় (কিছু লোকে মানতে চায়না যদিও)। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অবকাশের আচ্ছন্নতায় হারিয়ে যাওয়া আমার রক্তে আছে। তাছাড়া পাণ্ডুলিপি আঁকড়ে ধরে প্রকাশকদের দরজায় দরজায় টিপসই দেব এমন একটি রোবব্বার আমার কপালে জোটেনি এ অবধি। যদিও গল্প ছেপে বেরোনোর শখ আমার সাড়ে সতেরো আনাই আছে, এ স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। 

আমার সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে, এহেন মোক্ষম সময় এক সহৃদয় প্রকাশনা এগিয়ে এলেন এবং আমার মতো আরো নতুন কলমদের সুযোগ দেওয়ার মনস্থির করলেন। এবং সঙ্গে এও জানালেন যে এই বইয়ের প্রকাশ হবে যে সে জায়গায় নয়, হবে একেবারে এবছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। প্রথমটায় বিশ্বাস করতে মন চায়নি কারণ আমার সাথে কোনো প্রকাশক নিজের থেকেই যোগাযোগ করবেন এটা কতকটা অলীক স্বপ্নের মতো। তাই কুণ্ঠায় মাখামাখি হয়ে আমার দুটি গল্প এগিয়ে দিয়েছিলাম প্রকাশকের টেবিলে। ভেবেছিলাম সহস্র গল্পের ভিড়ে তাদের বোধহয় পথভ্রম হবে। কিন্তু আমার সমস্ত আশঙ্কা মিথ্যে করে 'ছায়াসঙ্গী' জায়গা করে নিল  উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রাদের মাঝে, প্রতিলিপির আকাশে। 



সূচিপত্রে নাম দেখে প্রথম হওয়া প্রেমের মতো বুক কেঁপে উঠেছিল। আত্মহারা হয়ে রাস্তার ধারেই মোবাইল ধরে দাঁড়িয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। রঙিন মলাটের ফাঁকে আমার 'মলাটের' পাতা থেকে উঠে আসা গল্প, মধুর বিস্ময়ে থমকে আছে প্রকাশের অপেক্ষায়, পাঠকের অপেক্ষায়, বইমেলার অপেক্ষায়। উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দিরের কর্মকর্তা এবং সম্পাদকদ্বয় মৌমিতা দত্ত ও শুভ্রজ্যোতি পাল - কে আমার অনেক ভালোবাসা ও সেলাম। শেষের পাতায় কিংবদন্তি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দু চার পংক্তি লেখা শিহরণ জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট। সর্বোপরি আমার সমস্ত পাঠকদের আমার নতুন করে কিচ্ছু বলার নেই, পাশে থেকে এই পিঠ চাপড়ানোটা না পেলে হয়ত এটা কখনোই সম্ভব হতো না। আপনাদের সকলকে কুর্নিশ।

পুনশ্চ : এই বইটি পাওয়া যাবে বইমেলার ৬ নম্বর গেটে, ২৫৬ নং স্টলে। ভালো থাকবেন......


#Molat #KolkataInternationalBookFair #KolkataBookFair2019 #bengalishortstories #bengaliliterature

Saturday, October 6, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৮ # বিবাহ বিভ্রাট

কৈলাশ। ভাদ্র মাসের সকাল। বেলা দশটার আশেপাশে। একটা অস্ফুট কান্নার চাপা আওয়াজ ভেসে আসছে যেন । দেখা গেল মহিষাসুর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে একটা শিলনোড়া দিয়ে পোস্ত বাটছে। আর মাঝে মাঝেই বাঁ হাত দিয়ে আলতো করে চোখ মুছে নিচ্ছে। পাশ দিয়ে লুচির থালা নিয়ে পার্বতী হেঁটে যাচ্ছিলেন দেবাদিদেবকে খাওয়াবেন বলে। এমন সময় কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখলেন মহিষাসুরকে, তারপর বললেন......

পার্বতী : কি ব্যাপার রে ? এই সাতসকালে পোগোর মোষের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস কেন ? কিছু হয়েছে ?

মহিষাসুর করুন মুখে ঘুরে তাকাল । চোখের জলে সাধের পাকানো গোঁফটা পর্যন্ত ভিজে জবজব করছে। পার্বতীর দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়াল । অর্থাৎ কিচ্ছু হয় নি।


পার্বতী : (বিরক্ত হয়ে) তাহলে কাঁদছিস যে বড় ?...….ওহ ! কুসুমদোলা দেখেছিস বুঝি ?

মহিষাসুর সেকথাতেও দুদিকে ঘাড় নাড়াল।  

পার্বতী : (আতঙ্কিত হয়ে) তবে কি ডাস্টিং করতে গিয়ে কাঁচের ফুলদানিটা ভাঙলি ?
মহিষাসুর : (করুণসুরে) না, তা নয়…
পার্বতী : (গম্ভীর গলায়) বাবা কি কিছু বলেছে ? আমি কিন্তু জানি, ইদানিং তুমি বাবার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে গাঁজা ভাঙ ধরেছ। রোজ সন্ধ্যেয় ওই পিপুল গাছের আড়ালে তোমাদের আড্ডা বসে।
মহিষাসুর : (কাঁদো কাঁদো হয়ে) না মা, সেসব নয়…..
পার্বতী : (ভীষণ রেগে গিয়ে) তবে কি আসল কথাটা বলবি, নাকি উঠোনের মুড়ো ঝ্যাঁটাটা দিয়ে আচ্ছা করে ঘা কতক দেব ?

একথায় মহিষাসুর প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠল।

পার্বতী : (মেগা বিরক্ত হয়ে) এতো আচ্ছা ঝামেলা হল দেখছি.....
শিব : (ত্রিশূল নিয়ে যোগাসন করতে করতে) কৈ গো ! লুচি আনতে যে রাত কাবার করে দিলে। পেট তো জ্বলে যাচ্ছে।
পার্বতী : এদিকে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। সকাল সকাল মহিষটা কেমন মরা কান্না জুড়েছে দ্যাখো।
শিব : (চোখ মুখ কচ্লে মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে) কি আশ্চর্য ! তুই কাঁদছিস কেন !! নাহয় কাল একটু বেশিই হয়ে গেছিল। তাই বলে সামান্য হ্যাংওভারও যদি সকালবেলাতে কাটিয়ে না উঠতে পারিস, তাহলে আজ থেকে আর পিপুলের পিছনে আসিস না বাপু। লোকের কাছে মান থাকে না আমার।
মহিষাসুর : আঃ, কি আবোল তাবোল বকছেন মাইরি ! বলছি তো সেসব কিছু নয়।
শিব : তবে কি ডান্স বাংলা ডান্সে সিলেকশন হয়নি বলে মন খারাপ ? আমি আগেই বলেছিলুম ওসব তোর কম্ম নয়। আমার কাছে ট্রেনিংটা পর্যন্ত নিলি না ঠিক করে।
মহিষাসুর : (কান্না থামিয়ে) নিকুচি করেছে...... (তারপর জোর গলায়) এবার পুজোয় আমি মর্ত্যে যাব না।

এই শুনে পার্বতী তাড়াতাড়ি লুচির থালাটা শিবের হাতে চালান করে দিয়ে কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়ালেন।


পার্বতী : (অত্যন্ত রেগে) তার মানে ?
মহিষাসুর : (মিন মিন করে) মানে আমি ঠিক করেছি আমি যাব না।
পার্বতী : একি ইয়ার্কি হচ্ছে !! সমস্ত জায়গায় প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেছে, চতুর্দিকে নীলসাদা রং হয়ে গেছে, পুজো কমিটিদের কোটি টাকা দেওয়া হয়ে গেছে, মহালয়ার প্রোমো পর্যন্ত চলছে, আর এখন বলছিস যাব না !
মহিষাসুর : (মাথা নিচু করে) না, এবারটা আমায় ছেড়ে দিন…..
শিব: (শান্ত হয়ে লুচি চিবোতে চিবোতে) আঃ ছেড়ে দাও না, যেতে যখন চাইছে না তখন খামোখা টানাটানি করে লাভ কি ? নাহয় আমার সাথেই থাকল ওই ক'দিন।
পার্বতী : (ক্ষিপ্তস্বরে) হুঁহ, ওকে তোমার কাছে ছেড়ে দিয়ে যাই আর সকলে মিলে এখানে মোচ্ছবের মহল্লা তৈরী করো। ওটি হচ্ছে না। (তারপর মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে) অ্যাই ন্যাশনাল জিওগ্রাফির রিজেক্টেড মোষ ! আসল কারণটা বল এক্ষুনি, নাহলে তোকে যেকোনো একটা ব্রিজের নিচে বেঁধে রেখে আসব, এই বলে দিলুম।

সকলে উৎসুক নেত্রে মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নন্দী, ভৃঙ্গী, গণেশ, কার্ত্তিক সকলে মজা দেখবে বলে পায়ে পায়ে এসে জড় হল সামনে। শিবের তৃতীয় নয়ন পর্যন্ত খুলে গিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। মহিষাসুর কতকটা কাঁচুমাচু হয়ে মুখ খুলল অবশেষে। 

মহিষাসুর : (খানিক লজ্জা পেয়ে, আমতা আমতা করে) ইয়ে, মানে... আমি বিয়ে করব…..

কৈলাশে যেন বাজে পড়ল তৎক্ষণাৎ। শিবের মুখ থেকে লুচির টুকরো খসে পড়ল মাটিতে। পার্বতী প্রকাণ্ড একটা হাঁ করে রইলেন। সকলে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন একঠায়। এমন আজব, অস্বাভাবিক কথায় কারোর মুখে রা পর্যন্ত সরল না। কি বলবেন, কি করবেন, কেউ বুঝেই উঠতে পারলেন না। মধ্যিখান থেকে গনেশ আর কার্ত্তিক  'মামা বিয়ে করবে, মামা বিয়ে করবে' বলে হর্ষধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললে একেবারে। আকস্মিক সংবাদের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠলেন পার্বতী।

পার্বতী : (গলা খাঁকরে) তুই যা বলছিস, ভেবে বলছিস তো ?
মহিষাসুর : (আরও খানিকটা লজ্জা পেয়ে) হ্যাঁ.... আমি বিয়ে করব…..
পার্বতী : তোকে ঠাস করে এক চড় মারব.......... উটপাখির এরোপ্লেন হওয়ার শখ ! বাথরুম সিঙ্গার নাকি কোক ষ্টুডিও যাবে ! বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ?
শিব : (মোলায়েম স্বরে) আহা, ওকে অত তড়পাচ্ছ কেন ? বেচারা বিয়েই তো করবে বলেছে, রোহিঙ্গা তাড়াবে তো আর বলেনি।
পার্বতী : ওহ ! বেচারা ? মাইনরিটি সেকশন ? রোজ সকালে, তোমার ব্লাড সুগারের জন্য কচি নিমপাতা কি নিজে থেঁতো করবে ভাবছ ? তাছাড়া সারা সপ্তাহের বাজার, দোকানের জিনিসপত্র, মাস গেলে আমার মোবাইলের রিচার্জ, সংসারের আরও যাবতীয় খুঁটিনাটি  এসব কে করবে শুনি.......তুমি ?
শিব : আহা ! এসব তো আর ও একা করে না, নন্দীরাও তো হেল্প করে, নাকি ?
পার্বতী : হেল্প !! কে কি করে জানা আছে তোমার ? খোঁজ রাখো কিছুর ? যবে থেকে ওয়ার্ল্ড যোগা ডে চালু হয়েছে তবে থেকে পাড়ার দেবদেবীদের নিয়ে তোমার ব্যাচের পর ব্যাচ যোগা ট্রেনিং চলে। আর সন্ধ্যে হলেই পিপুল গাছের পিছনে চলে যাওয়া। এই তো তোমার রুটিন। ছেলেমেয়েগুলোকে একটু টিউশন থেকে নিয়েও তো আসতে পারো।
শিব : এই দ্যাখো, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে চলে যাচ্ছে.....

এমন সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে নারদমুনির প্রবেশ। ইনফাইনাইট লুপে 'নারায়ণ নারায়ণ' ছাড়াও ইদানিং 'দিল দিয়া গল্লা' গানটা খুব শুনছেন। গানের পজ বাটনটা টিপে, হেডফোন খুলে সামনের দিকে মুখ তুলে তাকালেন।

নারদ : (পার্বতীর দিকে তাকিয়ে) পেন্নাম হই জগজ্জননী......(শিবের দিকে তাকিয়ে) জয় মহাদেবের জয় !

সকাল সকাল নারদের এমন অনাহূত আগমনে শিব ভারী বিরক্ত হলেন। একটা লুচি মুখে চালান করে দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন...…

শিব : ওই এল ! এক নম্বরের বিসি.....
নারদ : আজ্ঞে , কিছু বললেন মহাদেব ?
শিব : (শশব্যস্ত হয়ে), কই, কিছু না তো !
নারদ : আমার মনে হল আপনি বোধহয় আমাকে কাঁচা ভাষায় কিছু একটা বললেন।
শিব : (অমায়িক হেসে) ও কিছু নয় রে পাগলা, ও কিছু নয়। আমি বলছিলাম তুমি হলে কিনা স্বর্গের ব্রডকাস্টিং চ্যানেল অর্থাৎ বিসি । হেঁ হেঁ হেঁ......তুমি চাপ নিও না নাড়ু। তা আজ, এদিকে ? কি মনে করে ?
নারদ : না আমি তো আসলে দিল দিয়া শুনতে শুনতে (পরক্ষনেই সামলে নিয়ে) আই মিন এ দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় হট্টগোল শুনে থমকে দাঁড়ালাম, ভাবলাম কৈলাসে আবার কোন কেলেঙ্কারি হল, দেখে যাই।
শিব : ("শশালা….বা…....")  (গলা খাঁকরে) তা বেশ করেছ……..লুচি খাবে ?


শিব লুচির থালাটা বাড়িয়ে দেন সামনে।

নারদ : (শিবের মনের কথাটা খানিক আঁচ করে) আজ্ঞে না, আপনি চিবোন....... (তারপর পার্বতীর দিকে তাকিয়ে).....কি হয়েছে মা, এখানে এত চেঁচামেচি কিসের ?

গনেশ : (ফিচেল হাসি দিয়ে) মামা বলছে বিয়ে করবে.....
কার্ত্তিক : আর আমি নিতবর হব........
নারদ : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) বলিস কি !!!
পার্বতী :  কি আর বলব রে নাড়ু, এসব হচ্ছে বাংলা সিরিয়াল দেখার ফল। যথেচ্ছ বিয়ে আর পরকীয়া দেখে মহিষের মাথাটা গুবলেট হয়ে গেছে একেবারে। বলছে মর্ত্যে যাবে না, বিয়ে করবে। এই লাস্ট মোমেন্টে এসব হ্যাপা কি পোষায় বল দিকি !
নারদ : (গম্ভীর হয়ে) কঠিন সমস্যা মা….. আপনার কথাও ঠিক আবার দেখতে গেলে মহিষেরও একটা ন্যায্য দাবি আছে। কোনোটাই ফেলে দেবার নয়। আমার মনে হয় এই সময় একমাত্র যিনি হেল্প করতে পারেন, তিনি হলেন পরম কল্যাণময় স্বয়ং নারায়ণ।
শিব : (মনে মনে) ব্যাস ! একা নরেন রক্ষে নেই, রাহুল দোসর......
পার্বতী : (চিন্তান্বিত হয়ে) বলছিস ! উনি পারবেন ?
নারদ : হেঁ হেঁ,... কি যে বলেন মা ! উনি পারেন না বিশ্বসংসারে এমন কাজ কই !
শিব : (তির্যক ভাবে) হ্যাঁ ! সে আর বলতে ……(পরক্ষনেই গলা খাঁকরে) তবে ওনার কি সময় হবে ?
নারদ : আজ্ঞে হ্যাঁ, এই সময়টা তো উনি ফেসবুকে 'পপুলার বেঙ্গলি জোকস' পড়েন। সকলে মিলে স্মরণ করুন, এক্ষুনি আবির্ভূত হবেন।

একথায় সকলে মিলে হাতজোড় করে নারায়ণ স্তব করতে লাগলেন। যথাসময়ে তেজদীপ্ত আলোকরশ্মির মধ্যে দিয়ে সাদা শার্ট আর জিন্স পরিহিত চতুর্ভূজ, কমলকান্তি শ্রীবিষ্ণু প্রকট হলেন স্বমহিমায়। সকলেই নতজানু হয়ে শ্রীবিষ্ণুর অভ্যর্থনা করলেন।  এমন সময় ……..

নন্দী : (আর্তনাদ করে) ওরে বাবারে, ওরে দাদারে, লাগছে লাগছে ...…..

সবাই মিলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সবিস্ময়ে নন্দীর দিকে ঘুরে তাকালেন। নারায়ণও ভারী বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নন্দীকে দেখলেন।

নন্দী : (নারায়ণের দিকে তাকিয়ে) আঃ ! পা'টা ছাড়ুন মাইরি, ছাড়ুন প্লিজ। ডানদিক বাঁদিক না তাকিয়ে একেবারে সোজা আমার পায়ের উপর এসে প্রকট হলেন যে বড় ! কি ভেবে ? হ্যাঁ ??

নারায়ণ ব্যাপারটা আঁচ করে তড়াক করে লাফ দিয়ে পাশে সরে দাঁড়ালেন।

নারায়ণ : (জিভ কেটে) ইসসস্স, একদম দেখতে পায়নি না রে ভাইপো। আসলে আমার জিপিএসটা ক'দিন ধরে খুব গোলমাল করছে। ল্যাটিচিউড লঙ্গিচিউড মোটে মিলছে না। এই তো কদিন আগে ভোরভোর একটু ঝিলের ধারে জগিং করতে যাব বলে চোখ বুজে জিপিএসটা অন করলুম । চোখ খুলে দেখি যমপত্নীর কোলে শুয়ে আছি। কি লজ্জা কি লজ্জা !.......

পার্বতী : সে যাগ্গে। এদিকে শুনেছ তো কেমন গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। কি করবে এবার দ্যাখো, আমরা তো আর ওকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পারছি না বাপু।
নারায়ণ : হ্যাঁ মা।  আমার অজ্ঞাত কিছুই নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সালটে নিচ্ছি পুরোটা। (এরপর মহিষের দিকে তাকিয়ে) দ্যাখো ছোটভাই, বিয়ের চিন্তাভাবনা করছ এ অতি ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে তোমার একটা দায়িত্ত্ব আছে সেটা ভুলে গেলে চলবে কি করে ?
মহিষ : বেশ তো। আমার বিয়েটা আগে দিয়ে দিন। তারপর মর্ত্যে যাব, কোনো চাপ নেই।
নারায়ণ : আহাহাহা, কি মুশকিল ! বিয়েটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া বিয়ের জোগাড় করতেও তো সময় লাগে নাকি ? উঠল বাই আর সিঙ্গুর যাই অমন করলে চলে নাকি। সবকিছুরই একটা ভেবে দেখার বিষয় আছে।  আর কেউ তো বলছে না বিয়ে কোরো না। পুজোটা ভালোই ভালোই মিটিয়ে এসে ছাদনাতলায় বসলেই হল। ঠিক কিনা ?

একথায় মহিষ গম্ভীর মুখে বারমুডার পকেট থেকে চারটি কাঁঠাল পাতা বের করে চোখ বুজে চিবোতে লাগল। নারায়ণের কথায় খানিক জাবর কাটল বটে কিন্তু সঠিক মনস্থির করে উঠতে পারল না।

মহিষ :  নাহ, আপনি আমায় কথার জালে ফাঁসাচ্ছেন মাইরি।
নারায়ণ : আরে, এতো আচ্ছা পাগল ! একি লোকসভার ইলেকশন হচ্ছে নাকি ? তোমায় ফাঁসিয়ে কার কি লাভ হবে শুনি ?  আর তাছাড়া বড়রা যখন বলছেন তখন অমন জেদ করতে নেই। আমরা তো বলছি বিয়ে হবে। কথা দিচ্ছি।
মহিষ : নাহ, আপনারা কাজ গুছিয়ে নিতে ওস্তাদ। কাজ হয়ে গেলে আর ফিরেও তাকাবেন না, আমি জানি।
পার্বতী : মারব এক থাপ্পড়। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস ? বড়দের মুখে মুখে চোপা !
শিব : আঃ পারো। এই সময় ভায়োলেন্স নয়। কমন সেন্স ইউজ করো। ওর দোষ কোথায় ? যুগের পর যুগ ধরে তো ভুগছে। আচ্ছে দিন এসেছে কি ? ডিজিটাল স্বর্গ মানেই তো আর ডেভেলপ্ড স্বর্গ নয়। এটা বুঝতে হবে। আমার মনে হয় প্রজাপতি ব্রহ্মাকে একবার কল দেওয়া উচিত। উনি সর্বজ্ঞানী, এই বিশ্ব চরাচরের সমস্ত সমাধান ওনারই কৃপায়। এহেন সমস্যায় যোগ্য সিদ্ধান্ত উনিই নিতে পারবেন একমাত্র। এস আমরা কালবিলম্ব না করে ওনাকে স্মরণ করি ।

প্রজাপতি ব্রহ্মা অনতিদূরেই একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। এ যাবৎ ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে চুপিচুপি শুনে নিয়েছেন ওখানে দাঁড়িয়েই। স্বর্গে ফোর জি চালু হয়ে যাওয়াতে ওনার ধারেকাছে বিশেষ কেউ ঘেঁষে না। সমস্ত দিনটা উনি ফাঁকাই থাকেন। সময় সুযোগ পেলে পুরোনো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভিতে সারেগামাপা দেখে পা নাচান অথবা নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম শুনে দুঃখ পান। মহিষের ঘটনায় উনি বেশ মজা পেয়েছেন এবং লুকিয়ে অকুস্থলে এসে হাজির হয়েছেন। সকলে মিলে স্মরণ করতেই উনি তড়িঘড়ি সামনে এসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে শুরু করলেন।

ব্রহ্মা :  বন্ধুগণ........ সরি, দেবদেবীগণ, তোমাদের আর ডাকাডাকি করতে হবে না।  আমি নিজে থেকেই হাজির হয়েছি। আফটার অল তোমাদের পাশে দাঁড়ানোটাই আমার প্রধান কর্তব্য। বিষয়ের গুরুত্ব বিচার করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে যতক্ষণ না মহিষের একটা হিল্লে হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত অসুর ভাতায় ওকে একটা সাইকেল দেওয়া হবে। আপাতত ওই সাইকেলটা চড়েই ও ঘোরাঘুরি করুক, পরে কিছু একটা করা যাবে।
নারায়ণ : (বিরক্ত হয়ে) এই, এটা  কে রে ! সাইকেল দেওয়ার সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক ! আর তাছাড়া পরে আর কবে ? একি এসএসসি পরীক্ষা ? পরে কোনো একটা সময় করে নিলেই হল।
শিব : আঃ অত উত্তেজিত হতে নেই, ধৈর্য ধর। (ব্রহ্মার দিকে তাকিয়ে) কৈলাসে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই প্রজাপতি। আমি বরং গোড়া থেকে আপনাকে বুঝিয়ে বলি, তাহলে আপনার পুরোটা বুঝতে সুবিধা হবে।
ব্রহ্মা : (হাত তুলে থামিয়ে) ভুলে যেও না দেবাদিদেব, আমি সর্বজ্ঞ, আমার অজানা কিছুই নেই। রণে বনে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমায় স্মরণ করিও, আমি তোমাদের রক্ষা করিব।
নন্দী : (ফিসফিস করে ভৃঙ্গিকে) যাহ কলা ! এতো লোকনাথ বাবার ডায়লগ। বেমালুম ঝেঁপে দিল যে !!
ভৃঙ্গি: চেপে যা রে ভাই, ভাঁওতাবাজি দিয়েই চলছে চাদ্দিক । বেশি বলবি, মাওবাদী বলে খেদিয়ে দেবে।
শিব : যাক ! তাহলে তো ভালোই হল। এবার এই ক্যাচালটার আপনি একটা বিহিত করুন তো দেখি।  সেই সকাল থেকে কান মাথা সব ঝালাপালা হয়ে গেল।
ব্রহ্মা : মাথা টনটন, কান ঝনঝন
        মহিষ বলেছে আড়ি.....
        হাতে লণ্ঠন মাছি ভনভন
        না এসে কি পারি ?

কবিতার রসেই হোক অথবা কিছু না বুঝেই  হোক উপস্থিত সকলে মিলে হাততালি দিয়ে উঠলেন।


নন্দী : (ফিসফিস করে) কবিতাটায় কেমন যেন একটা চেনা প্যাটার্ন পাওয়া যাচ্ছে .....নারে ?
ভৃঙ্গি : ঠিকই ধরেছিস। তবে শুনেছি নাকি অফটাইমে অফবিট ছবিও আঁকছেন এখন।
ব্রহ্মা : (মহিষের দিকে তাকিয়ে) এই যে মোষের পো, বিয়ে করবে সে ভালো কথা কিন্তু কাকে করবে শুনি ? বলি পাত্রীটি কে ?

সকলে উৎসুক নেত্রে মহিষের দিকে চেয়ে রইলেন। মহিষ লজ্জিত হয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। কিছুতেই  মুখ ফুটে বলে উঠতে পারল না। এইভাবে বেশ কিছুক্ষন কাটল। ধীরে ধীরে সকলেই অধৈর্য হয়ে পড়লেন।

নারায়ণ : কিরে ছোটভাই ? নামটা বল, চট করে টুইট করে দিই.......
গনেশ : বলো না মামা...... মামীর নাম কি ?
পার্বতী : (ধৈর্য হারিয়ে) এই ! তুই কি ইন্ডিয়ান আইডলের অডিশন দিতে এসেছিস যে চুপ করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছিস ? নামটা বলবি নাকি পিছনে গরম ত্রিশূলের খোঁচা দেব ?
মহিষ : (থতমত খেয়ে ) সানি ........ও..ওর নাম হল সানি..........
ব্রহ্মা : লিওন ???......জয় গুরু .....
পার্বতী : সে আবার কে ?

শিব ফিসফিস করে যতটা সম্ভব সহজ ভাষায় পার্বতীকে নামের ইতিবৃত্ত বুঝিয়ে দিলেন । সবটা শুনে পার্বতীর চোখ কপালে উঠে গেল। ধপ করে বসে পড়লেন পাশের বেদীতে।

নারায়ণ : যাই বলো, নামের মধ্যে কিন্তু বেশ একটা ষ্টার ষ্টার ব্যাপার আছে। জমবে ভালো।
শিব : দাঁড়া বাপু ! আমি যদ্দুর জানি তার তো বিয়ে হয়ে গেছে ? সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিবাহটা বেআইনি।
ব্রহ্মা : একজ্যাক্টলি। তাছাড়া পরকীয়া আইনসিদ্ধ হয়েছে বলে তুমি একেবারে পরস্ত্রী ফুঁসলে আনবে একথাও তো ঠিক নয়।  
নারায়ণ : শুধু তাই নয়, যাকে বিয়ে করবে সে রাজি আছে কিনা সেটাও তো জানা দরকার। এতো আর কোলগেট নয় যে নিম, লবঙ্গ, নুন আছে কিনা জানলেই হয়ে গেল। বিয়ে বলে কথা।
নারদ : তেমন হলে আমি গিয়ে একবার জেনে আসতে পারি ........যাব ?
ব্রহ্মা : তুই থাম ছোঁড়া। নাম শুনেই অমনি দৌড়ে মেডেল আনতে চলল। আগে সবটা জানা দরকার, তারপর অন্য কথা।
মহিষ : কি আশ্চর্য মাইরি !! আপনারা কি আবোল তাবোল বকছেন ?
শিব : তার মানে ?
মহিষ : এ সানি সে সানি নয় .....
নারায়ণ : খেয়েছে ! তবে কোন সানি ?
নন্দী : (ফিসফিস করে ভৃঙ্গিকে ) আমার মনে হয় গাভাস্কারের কথা বলছে।
পার্বতী : হা কপাল !!
মহিষ : এসব কি হচ্ছে !!! কাদের সব নাম বলছেন বলুন তো ? এরা কেউ নয়।
সকলে একযোগে : তবে কে  ?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিষ একবার সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ খুলল।

মহিষ : সানি...... মানে ইয়ে, আমাদের সূর্যদেবের কথা বলছিলুম......

একথা শুনে পার্বতী প্রায় মূর্চ্ছা গেলেন। শিব তাড়াতাড়ি একঘটি জল এনে পার্বতীর মুখেচোখে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। উপস্থিত বাকি সকলেই বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। পোষা সিংহটাও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মহিষের দিকে। গোটা কৈলাসে নিস্তব্ধতার ছায়া ঘনিয়ে এল। কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করলেন না। এই অপ্রত্যাশিত নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথমে ব্রহ্মা সরব হলেন।

ব্রহ্মা : একি সত্যি নাকি !
মহিষ : (বিড়বিড় করে) পুরোটাই....
শিব : কদ্দিন ধরে ?
মহিষ : তা, বছরখানেক হল........
নারায়ণ : ইয়ে....মানে, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না ?
নারদ : হরিবোল.....
শিব : দাঁড়াও দাঁড়াও। আমরা একটু শক খেয়েছি বটে, কিন্তু তাই বলে প্রতিবাদী মিছিল করার কোনো দরকার নেই। আমি তো এতে দোষের কিছু দেখছি না।
ব্রহ্মা ; ঠিকই, তাছাড়া এমনটা তো নতুন নয়। মর্ত্যে যদি ৩৭৭ চেঞ্জ হতে পারে তাহলে আমাদের এখানে নয় কেন। আমাদেরও খোলা মনে ব্যাপারটা বিবেচনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি বরং অসুরশ্রীর একটা ব্যবস্থা করে দেব।

পার্বতী কিছুটা সুস্থলাভ করার পর কোনোরকমে উঠে মহিষের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।

পার্বতী : (মেলোড্রামাটিক সুরে) আমি তোর ওপর বড্ড বেশি অত্যাচার করি......নারে ? তাই বোধহয় এভাবে শোধ নিলি ?
মহিষ : (জনপ্রিয় শিল্পীর নকলে) আ--আমি কিছু করিনি । বিশ্বাস করুন, আ--আমি অন্যায় করিনি ।
শিব : দ্যাখো পার্বতী, তুমি মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছ। হৃদয় বিনিময় কোনো নিয়ম মেনে হয় নাকি ? নাকি তার কোনো সংজ্ঞা আছে ? তুমি তো মা। সন্তানের সুখ দুঃখের ভার তো তোমারই। এমন সময় পিছিয়ে এলে কি করে হবে ? তুমি সম্মতি না দিলে ও যে সারাটা জীবন কষ্ট পাবে। মা হয়ে তুমি কি তাই চাও ?

পার্বতী চোখ বুজে নিজের মতো করে চিন্তা করতে লাগলেন।

ব্রহ্মা : তাছাড়া এখানেও কিন্তু একইভাবে সেই দ্বিতীয় বিবাহের প্রশ্নটা থেকে যায়। সানি, আই মিন, সূর্যদেবও কিন্তু বিবাহিত। সূর্যপত্নী কি মেনে নেবেন ব্যাপারটা ?
মহিষ : হ্যাঁ, সেটা কথা বলা আছে। সানির স্ত্রী, ওঁর এই ওরিয়েন্টেশনটা জানার পর নিজে থেকেই  ডিভোর্স ফাইল করেছেন। আপাতত আমরা লিভ ইন করব, ডিভোর্স পেলেই বিয়ে ।
নারায়ণ : আশ্চর্য, এতো কিছু হয়ে গেলো অথচ আমরা কেউ টেরই পেলুম না !
নারদ : আমার কিন্তু একটা জিনিস খচখচ করছে বাপু। অমন প্রখর তেজস্বী ব্যক্তিত্ব, কাছাকাছি গেলেই তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবার রিস্ক থাকে। সেক্ষেত্রে কিভাবে......
মহিষ : (লাজুকস্বরে) সাধারণত সকাল আর দুপুরের দিকটা এড়িয়ে চলি। সন্ধ্যের পর থেকেই ওর মধ্যে একটা ডিমলাইট টাইপের ভাব চলে আসে.....তারপর আর অসুবিধে হয় না.....
শিব : ব্রাভো ! তোর বুদ্ধি দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি মাইরি ! (পার্বতীর দিকে ঘুরে) দ্যাখো পারো, ওদের ইন্টেন্সিটিটা লক্ষ্য কর একবার। এরপরও তুমি আপত্তি করবে ? তুমিই তো বলো, তোমার প্রত্যেক সন্তানের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। এসময় আমাদের সকলের ওর পাশে থাকাটা খুব জরুরি।
পার্বতী : (একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বেশ, তোমরা যেমন ভালো বোঝো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
মহিষ : বলুন মা।
পার্বতী : মর্ত্যের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। ওদেরকে লাস্ট মোমেন্টে কোনোভাবেই ডিপ্রাইভ করতে পারব না। সুতরাং আগে পুজো, পরে বিয়ে। ফিরে এসেই নাহয় আমিই সেসবের ব্যবস্থা করব।
শিব : (অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে) ওরে তোর মা রাজি হয়েছেন রে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কি ইডিয়ট, একটা পেন্নাম কর শিগগির। 

মহিষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলল। চিৎকার করে বলল, "বলো দুগ্গা মাইকী".........গোটা কৈলাস হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে একসাথে গলা মেলাল মহিষের সাথে।




বিন্যাস  : অর্ণব দাসগুপ্ত 

















 




#Durgapuja #bengalishortstories #durgapujastories #pujabarshiki #Molat #DebdattaSinha

Saturday, September 29, 2018

শারদপ্রাতে

এবার উৎসবের পালা, খানিক বিশ্রামের সময়
মেঘলা চায়ের কাপে যেখানে সন্ধ্যেরাও ঘুমায়
সেখানে বেঁধে নিতে হবে অবকাশের ঘর  
পুরোনো যা কিছু, ঝালিয়ে নেওয়া অতঃপর।

দেরাজে বইয়ের খাঁজে অসমাপ্ত সম্পর্কের ভিড়ে
নিখোঁজ, নিরুদ্দেশ আমার 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' 
সেটুকু খুঁজে নেবার অপেক্ষা, আর কিছু নয়
শুনেছি শারদপ্রাতে অজান্তে এমনটাই নাকি হয়।


বিন্যাস : নিজস্ব

















#bengalipoems #Durgapuja #Molat #DebdattaSinha

Friday, September 7, 2018

অস্থায়ী সংলাপ

বিন্যাস : নিজস্ব

এ পৃথিবীর কোনো কিছুই যে স্থায়ী নয় তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আজ যা আছে কাল তা নেই এ যেন আমাদের সংক্ষিপ্ত যাপনের মর্মকথা। সংবাদপত্রের পাতায় একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনার সাজানো অক্ষরের রেলগাড়ি ছুটে যায় আমাদের চোখের সামনে দিয়ে। সেসব আমাদের ভাবায়, শেখায় আবার কখনো বা উপেক্ষার রুক্ষ প্রান্তরে ধুলোমেখে গড়াগড়ি খেতে থাকে। উপেক্ষার একমাত্র কারণ বোধহয় অভ্যাস, যার দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলতেই ভালোবাসি আমরা সকলে। বন্যা, সেতুভঙ্গ, জনসমক্ষে খুন, রাহাজানি ও সর্বোপরি শৈশব ছিনতাই - এর কোনোটাই বোধহয় আর দাগ কাটে না আমাদের। 'এই বেশ আছি' এই ফাঁপা বোধটা আঁকড়ে ধরে নিশ্চিন্তে বালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকি রাতের পর রাত। পরের দিন মনখারাপের জেটল্যাগ কাটিয়ে আবার আগামী স্বপ্নের ফিতে কাটতে বেড়িয়ে পড়ি।   

এই প্রসঙ্গে বহুদিন আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। সালটা বোধহয় '৯৩ বা '৯৪ হবে। তখন আমি এইট বা নাইনে পড়ি। সম্ভবত ছুটির দিন হওয়াতে আমি বাড়িতেই ছিলাম। এমন সময় অনাহূত প্রচন্ড ঝড়ের মতো আমার নার্সারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের মৃত্যুসংবাদ এল। সে স্কুলের কথা ভাবলেই আলিপুর রোডের মোড়ে দুটো বিরাট কালো রঙের থামওয়ালা একটা তিনতলা বাড়ির কথা মনে পড়ে। ছোট্ট একটা লোহার গেট পেরিয়ে কাঠের দরজা খুলে যে ঘরটায় ঢুকতাম তার দেওয়ালে আঁকা থাকত আমার আধো, অস্ফুট শৈশব। ঘন সবুজ ছায়াঘেরা জঙ্গল আর তার মধ্যে থাকত হাতি, গণ্ডার, জিরাফ আর বাঘের খেয়ালি রূপকথারা। ভিতরের দরজা দিয়ে ঢুকতেন গোলগাল, গৌরবর্ণা, সহজপ্রাণ এক প্রবীণা। ঠিক আমার দিদিমার মতো মুখের অবয়ব। তাঁর পরিপাটি শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা স্নেহের ঘ্রান পেতুম সেসময়। তিনি আমার অবোধ সময়ের বড় আন্টি। তিনি আর নেই এই খবরটা শোনার পর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সোজা হাজির হয়েছিলুম পুরোনো স্কুলের দোরগোড়ায়। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গিয়েছিলুম দোতলার বড় ঘরটাতে যেখানে প্রায়শই আমাদের অনেককেই ডেকে নিয়ে বারান্দার বাগান দেখাতেন। এসমস্ত জলছবির মত মনে আছে আজও তার কারণ সেসব মুহূর্তদের ভুলে যেতে চাইনি কখনোই। 

ঘরটায় এসে যখন দাঁড়ালাম তখন তিনি লাল সিমেন্টের মেঝেতে ফরাস পাতা গদির ওপর পরমশান্তিতে ঘুমিয়ে ছিলেন। আত্মীয়স্বজনের থমথমে মুখ আর দীর্ঘশ্বাসের আবহে সময়ের ঘরে কাঁটা সরছে না। ঘরভর্তি মানুষের মাঝখানে স্থানুর মতো কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। সম্বিৎ ভাঙল যখন কেউ একজন অকস্মাৎ বলে উঠলেন, 'মা, তুমি টিউশন চলে যাও, শ্মশানে যাওয়ার দেরি আছে এখনো, টিউশনটা কামাই কোরো না'। তাকিয়ে দেখলাম, মা বলে যাকে সম্বোধন করা হল সে আর কেউ নয়, বড় আন্টির আদরের নাতনি। খানিকক্ষণ দোনোমনো করে ছলছল চোখে সে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সম্ভবত কোচিং ক্লাসের গুরুত্বটা তার কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল অথবা গুরুজনের বজ্রনির্ঘোষ উপেক্ষা করে না বলাটা সে রপ্ত করতে পারেনি সেসময়। স্তম্ভিত হয়েছিলাম বললেও খুব ছোট করে বলা হয়। কথাটা যেন তীরের মতো ছুটে এসে মাথাটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠা তথা অঞ্চলের অন্যতম প্রবীণা শিক্ষিকার প্রয়াণের থেকে কোচিং ক্লাসের গুরুত্ব কেন যে এত অপরিসীম তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি সেদিন। আরও আশ্চর্য হয়েছিলাম কারণ পরিবারের দু চারজন সে কথার সমর্থন করেছিলেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার দরুণ বিবিধ সমীকরনের সান্নিধ্যে এসেছি, কিন্তু এহেন জটিল সমীকরণ কিভাবে মেলাতে হয় তা আমার বুদ্ধির বাইরে ছিল। 

আজ বুঝতে পারি, যেকোনো মৃত্যুই একটা ঘটনা মাত্র। স্থান, কাল, পাত্রের চিত্রপটে তা কখনো গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে আবার সময়ের প্রলেপে হয়ে পড়ে নির্জীব, গুরুত্বহীন। বিশেষত পরিবারের বাইরে হলে গম্ভীর মুখে পাশে গিয়ে দাঁড়াই বটে তবে অনুভবের ইচ্ছে বা শক্তি দুটোর কোনোটাই থাকে না। তাতে অবশ্য দোষের কিছু দেখি না। তার জন্য দায়ী ব্যক্তিগত ঘেরাটোপ বা সময়ের স্বার্থপরতা। দুটোই মাধ্যাকর্ষনের মোহে টানতে থাকে নিজেদের মাপা কক্ষপথের দিকে। সেখান থেকে বেরোবার বিশেষ উপায় থাকে না। তার ওপর যখন মরণোত্তর পুরস্কারের ঘোষণা থাকে তখন যেন প্রাণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ভাবি, যাক বাবা ! কিছুটা অন্তত রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট পাওয়া গেছে। মনে শান্তি আসে, পেট ভর্তি চোরা অম্বলের তৃপ্তির ঢেকুর তুলে গুটিগুটি পায় বিছানার দিকে পা বাড়াই। বুঝতে পারলেও ঘুনাক্ষরেও নিজেকে টের পেতে দিই না যে যখন তখন 'আছি' থেকে 'নেই' হয়ে যেতে পারি। সমালোচকরা অবশ্য বলবেন জন্ম মৃত্যু তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। ঠিক ! কিন্তু তাকে অস্বাভাবিকতার রাংতায় মুড়ে রোজ রোজ অকাল প্রয়ানের প্লেটে সাজিয়ে দেওয়ার মধ্যে ঠিক কোন বাহাদুরি আছে তা আমার জানা নেই।  অন্য কারোর জানা থাকলে বলবেন, তাহলে রাস্তায় যাঁরা বেরোচ্ছেন তাঁরা পিছন ফিরে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আপনজনদের টা টা করবেন....এই আর কি ! 

#Molat #bengaliarticle #majherhat #bridgecollapse #kolkata


Thursday, August 9, 2018

পুরস্কার

যেকোনো রকম কম্পিটিশনের নাম শুনলেই বুক কাঁপে আমার…...সেই ছোটোর থেকে আমাদের পুরোনো পাড়ায় একটা বিরাট বড় খেলার মাঠ ছিল। নাম ছিল ডালমিয়ার মাঠ। সেই মাঠে ফি বছর স্পোর্টস হত আর আমি নাম দিতাম সেখানে, অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মতোই। নাম ডাকা শুরু হলেই পিলেটা লাফিয়ে উঠত আচম্কা। স্টার্টিং পয়েন্টে দাঁড়ানোর সময় দুকানের মধ্যে দিয়ে গরম হাওয়া বইত যেন। ঠোঁট শুকিয়ে আসত, অসাড় লাগত সমস্ত শরীর। মনে মনে ভাবতাম, নিকুচি করেচে ! কেন যে মরতে নাম দিলাম কে জানে। কানের পাশে হুইসেল বাজলেই সাদা দাগ দেওয়া লাইনগুলোর ফাঁক দিয়ে তীরবেগে দৌড়োতে শুরু করতাম। ফিনিশিং লাইনে আসার পরেও মনে হত যেন দৌড়েই চলেছি। একবার তো দৌড়ে বাড়িই চলে এসেছিলাম। 
তবে ইদানীংকালে তেমনটা না হলেও ভেতর ভেতর একটা ধুকপুকানি থেকেই যায়। এই যেমন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা একরকম আর সাহিত্যের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আরেকরকম। সাহিত্যের প্রতিযোগিতায় আমার মতো আনকোরা লেখকের যে লেখা গ্রাহ্য হবে এইটেই অনেক বড় ছিল আমার কাছে। এ যাবৎ আমার কবিতা বা লেখা দু একটা জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে বটে কিন্তু একেবারে কম্পিটিশন জিতে প্রথম পুরস্কার বাগিয়ে ফেলব এহেন চিন্তা দুঃস্বপ্নেও করিনি কখনো। আর তাই প্রতিলিপির দপ্তর থেকে যখন মেল্ পেলাম তখন দু চারবার চোখ কচ্লে দেখতে হয়েছিল যে ঠিক দেখছি তো ! বিশ্বাস করতে পারিনি বলে রিপ্লাই দিয়ে ফলাফলের লিঙ্ক চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। সেটাও যখন মিলে গেল তখন যতটা না আশ্চর্য হয়েছিলাম তার থেকেও কয়েকগুন এক অব্যক্ত ভালোলাগায় ভরে গিয়েছিল ভেতরটা। কারণ প্রতিলিপির প্রথম সারির লেখায় আমার গল্প - "ছায়াসঙ্গী" শীর্ষস্থান পেয়েছে এর অনুভূতি কি তা আমি হাজার পাতা লিখেও বুঝিয়ে উঠতে পারব না। 
প্রতিলিপির সমগ্র বিচারকমণ্ডলীকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সর্বোপরি প্রতিলিপির কর্মকর্তা মৌমিতা দত্তর প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। লেখা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেছি ও সর্বোপরি ফলাফলের লিঙ্ক চেয়ে বিরক্ত করেছি। অথচ সবটাই হাসিমুখে উনি উত্তর দিয়েছেন এবং প্রয়োজনমতো সাহায্য করেছেন। আপনাদের সংস্থার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি। আর মলাটের পাঠকদের কাছে যে আমি চিরঋণী এ বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনাদের উৎসাহতেই কলম চলছে। পাশে থাকুন এভাবেই...…... 
"ছায়াসঙ্গী" গল্পের  লিংক দিলাম এখানে -
https://debdattasinha.blogspot.com/2016/06/blog-post_6.html  - প্রথম পর্ব
https://debdattasinha.blogspot.com/2016/06/blog-post_15.html - অন্তিম পর্ব 

    
#bengalishortstories #bengaliarticle #pratilipi #bengalipratilipi #Molat #DebdattaSinha

Wednesday, June 27, 2018

কা(আপ)ডেট # ২

ভেবেছিলাম দ্বিতীয় পর্বটা আর লিখব না। চোখের সামনে একের পর এক অঘটন দেখে মনে হচ্ছিল  বিশ্বজয়ী টিমরা খেই হারিয়ে ফেলেছে। যথেচ্ছ ক্লাব ফুটবল আর মুহুর্মুহু চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ঝড়ের দাপটে উড়ে গেছে নিজেদের দেশের হয়ে খেলার উন্মাদনা। ধ্বংসাবশেষের মতো পড়ে আছে শুধু নিয়মমাফিক বিশ্বকাপ খেলতে আসার অনিচ্ছেটুকু। আইসল্যান্ডের সাথে আর্জেন্টিনার ড্র, পরের দিকে বিরাট ব্যবধানে ক্রোয়েশিয়ার কাছে নতিস্বীকার, সুইজারল্যান্ডের সাথে ব্রাজিলের ড্র, পরের ম্যাচে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে কোনোরকমে গোল, মেক্সিকোর সাথে জার্মানির বিপর্যয় এবং ফ্রান্স জিতলেও তাদের ঢিলেঢালা ফুটবলে সেই আবেগ বড় অনুপস্থিত লেগেছিল। বড় বড় টিমের এমন অবিন্যস্ত ফুটবল দেখার অভিজ্ঞতা আমার মতো ক্রীড়াপ্রেমীদের একেবারেই যে নেই এটুকু বাজি রেখে বলতে পারি। তাই রাতের পর রাত জাগাটা যে ক্রমশ মাঠে মারা যাচ্ছে সেটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিলাম।  

লাভের মধ্যে ছোট ছোট টিমগুলোর যে চরম উত্তেজনা আর কমিটমেন্ট দেখলাম তাতে করে মনে হচ্ছিল এদের মধ্যে অনেককেই হয়ত নক আউট পর্যায়ের ওপরের দিকে দেখতে পাব। বিশেষভাবে উল্লেখ্য পেরু, ইরান, মরোক্কো, জাপান, সুইডেন এবং সেনেগাল যারা সবুজ ঘাসের কানায় কানায় যে দরদটা মজুদ করে  এল তা বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখার মতো। এর পাশাপাশি ছিল রাশিয়া, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড আর ঊরুগুয়ের চোখ ধাঁধানো ফুটবল আর অক্লান্ত নিম্নচাপ বর্ষণের মতো বেশ কিছু গোল। চেয়ার ছেড়ে ওঠার অবকাশটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না তার আগেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গোলপোস্টের জালে আছড়ে পড়ছে একের পর এক সোনালী মুহূর্তরা। 

কিন্তু কথায় আছে পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে, এবং সময় বুঝে তা বাড়লও বটে। ৩০ মিনিটের মাথায় সুইডেনের বিরুদ্ধে এক গোল খাওয়ার পর জার্মানরা ফেরার টিকিট প্রায় নিশ্চিত করে নিয়েছিল। কিন্তু জার্মান রক্ত যে অন্য ধাতু দিয়ে গড়া তা বুঝতে বেশিক্ষন সময় লাগল না। হাফ টাইমের ঠিক পরেই মার্কো রিউসের গোলে জার্মানি সমান সমান পাঞ্জা কষতে শুরু করল। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো জার্মান ডিফেন্ডার বোয়েতাং বেরিয়ে গেল রেড কার্ড দেখে। ১০ জন মিলেও যে বিধ্বংসী ফুটবল খেলা যায় সেটা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল জার্মানি। ইনজুরি টাইমে পেনাল্টি বক্সের সামান্য বাইরে কোনাকুনি জায়গা থেকে ফ্রি কিকে যে গোলটা করল টনি ক্রুস সেখান থেকে গোল হওয়া একরকম অসম্ভব। ঠিক সেই অসম্ভব কাজটাই অসাধারণ বাঁকানো শটে গোল করে গ্রূপের প্রথম ম্যাচ জিতল জার্মানি। তবে পুরোনো চাল ভাতে বাড়লেও মুখ অবধি পৌঁছতে পেলো না। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে লজ্জাজনক পরাজয়ে জার্মানি যে লীগ টেবিল থেকেই ছিটকে যাবে এটা বোধহয় অতি বড় ফুটবল বোদ্ধারও বোঝার ঊর্দ্ধে ছিল।    

গ্রূপ ডির শেষ ম্যাচে যখন আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া মুখোমুখি হচ্ছিল তখন ক্যামেরার ফ্রেমে বারে বারে উঠে আসছিল লিওনেল মেসির মুখটা। গ্যালারিতে তখন নীল সাদার উৎকণ্ঠার মেঘ জমেছে। আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি মিস আর তার পরেই ক্রোয়েশিয়ার কাছে বড় ব্যবধানে হার, এই দুয়ে মিলে বিশ্বের চাপ নিয়ে শুধু টিমটা মাঠে নামছে না, যেন গোটা আর্জেন্টিনা দেশটা খেলতে নামছে তাদের প্রিয় ঈশ্বরের স্বর্গীয় আতশবাজির ঝলক দেখার জন্য। সমস্ত উদ্বেগ, গ্লানি এক লহমায় নস্যাৎ করে দিয়ে, গোটা স্টেডিয়ামকে প্রায় বাকরুদ্ধ করে যেন ঐশ্বরিক প্রত্যাবর্তন ঘটল মেসির। ১৪ মিনিটের মাথায় মাঝ মাঠ থেকে ব্যানেগার একটা উড়ন্ত পাশ ধরার জন্য যে দুর্দান্ত স্প্রিন্ট টেনে বলটা  রিসিভ করল বাঁ পায়ের ঊরুতে সেটা অনেকের কাছেই স্বপ্ন। ওই একইভাবে দৌড়তে দৌড়োতে ঊরু থেকে বলটা বাঁ পায়ের পাতার ওপর নিয়ে দু চার পা আরও দৌড়ে ডান পায়ের কোণাকুণি মর্মভেদী শটে জাল কাঁপিয়ে দিল আর্জেন্টিনার বন্দিত মহানায়ক। অন্যান্য ফুটবলারের চোখের পলক পড়ার সময়টুকুর মধ্যে যে ক্ষিপ্রতায় গোলটা হল সেটা দেখার জন্য আরও অনেক রাত জাগা যেতে পারে। নাইজেরিয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা ফেরালেও আর্জেন্টিনা যে ফুটবলটা খেলল তাতে প্রত্যাশিত ভাবে শেষ গোলটা হল মার্কোস রোহোর দুরন্ত ফিনিশে।

এছাড়া সাম্বা ফুটবলের শৈল্পিক ভাঁজে নেইমার, কুটিনহো, পৌলিনহোদের দেশ অবলীলায় সার্বিয়াকে পাশ কাটিয়ে রাউন্ড ১৬ তে মেক্সিকোর মুখোমুখি হতে চলেছে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর ফিনিশ বিশ্বমানের ফুটবলাররা করবে তাতে সন্দেহ নেই বটে তবে মনের মধ্যে যেটুকু কুয়াশা জমেছিল সেটা কেটে গিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি খেলা জমে উঠেছে........


(চলবে)   


  #fifaworldcup2018 #bengliarticle #football #Molat  

Saturday, June 16, 2018

কা(আপ)ডেট # ১

বাপ্ রে বাপ্ ! এই তিনটে শব্দ ছাড়া আর কিচ্ছু মাথায় আসেনি লেখার আগে। ঠিক যেভাবে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কথা তার চেয়ে অনেকগুন বেশি চমক দিয়ে শুরু হল ১৪ই জুনের সন্ধ্যেটা। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে তখন চাকবাঁধা মৌমাছির মতো প্রায় আশি হাজার দর্শকের গুঞ্জনে কান পাতা দায়। স্টেডিয়ামের আশেপাশের রাস্তায় অগণিত মোহাচ্ছন্ন মানুষের ভিড় । সেন্টার স্টেজে একের পর এক গেয়ে চলেছেন রবি উইলিয়ামস, আগুন পাখির ডানায় ভর করে এডা গ্যারিফুলিনার প্রবেশ আর বাকি লাইমলাইটের সবটুকু শুষে নিয়ে গেলেন ব্রাজিলের রোনাল্ডো, তাঁর নায়কোচিত উপস্থিতি দিয়ে। 

এরপর যে খেলাটা শুরু হল সেটাকে খেলা না বলে ছেলেখেলা বললে বোধহয় বেশি ভালো হতো। বিশ্বকাপ শুরুর দিনেই যে লজ্জাটা সৌদি আরব পেল সেটা ভুলতে বেশ কয়েক বছর লাগবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায়। প্রথম দশ বারো মিনিটের মাথাতেই গোলোভিনের ক্রস থেকে গ্যাজিনস্কির গোল ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে ২০১৮ র প্রথম গোল হিসেবে। ঠিক তার পরেই যেন লক গেট খুলে যাবার মতো উপক্রম হল সৌদি ডিফেনসের। ভেবেছিলাম আরবি ঘোড়ার দল ঘুরে দাঁড়াবে। অচিরেই ভুল প্রমাণিত হলাম। প্রথম হাফে দুটি গোল এবং পরবর্তী হাফে তিনটে গোল, মোট পাঁচটা গোল দিয়ে তিন পয়েন্ট নিয়ে গ্রূপের শীর্ষে চলে গেল রাশিয়া। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য গোলোভিন নামক প্লেয়ারটি যাঁর মধ্যে আগামী দিনে তারকা হওয়ার বারুদ জমা হয়ে আছে। মুহুর্মুহু ক্রসে একের পর এক গোল এবং শেষ মিনিটে নিঁখুত, অনবদ্য ফ্রিকিকে জাত চিনিয়ে দিয়ে গেল এই তরুণ রুশ ফুটবলার। এবারে রাশিয়ার সেরা চমক সন্দেহ নেই।

১৫ই জুন রাত জাগা সার্থক। পর্তুগাল স্পেনের খেলায় যাঁরা ঘুমিয়েছিলেন তাঁদের বলব সময় করে হাইলাইটসটা দেখে নেবেন। খেলা শুরুর প্রথম চার মিনিটের মাথায় রোনাল্ডোকে পেনাল্টি বক্সে ফাউল এবং পর্তুগালের পেনাল্টি কিক। স্বভাবসুলভ ডান পায়ের গর্জন এবং গোলকিপারকে উল্টোদিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে প্রথম গোলে রোনাল্ডোচিত জয়োল্লাস। এখানেই ভেবেছিলাম স্পেন বোধহয় ব্যাকফুটে চলে যাবে। কিন্তু তারকাখচিত স্পেন গুছিয়ে নিতে সময় নিল মিনিট কুড়ি মতো। ছোট ছোট পাসে নিজেদের খেলাটাকেই শুধু নয় আত্মবিশ্বাসটাকেও জড়ো করে নিল সবাই। আর তার পরেই দিয়েগো কোস্তার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে দুজনকে ড্রিবল করে প্রায় মেসিসুলভ ভঙ্গিতে গোল। এরপর স্পেন যে খেলাটা খেলল তাতে করে এটা বোঝা গেল যে তিকিতাকা পাসের ওপর ভর করে দুফুট বাই দুফুট জমি ফাঁকা পেলেও তাতে দিব্যি ফুটবল খেলা যায়। এর ঠিক পরেই  তীক্ষ্ন কাউন্টার এট্যাকে হাফটাইমের প্রায় মিনিটখানেক আগে রোনাল্ডো আরও একবার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে জোরালো শটে গোল করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল 'পিকচার আভি বাকি হ্যায়'। 

হাফটাইমের পরে দিয়েগো কোস্তার দ্বিতীয় গোলে স্পেন ফিরে এলো স্বমহিমায়। ইস্কো, সিল্ভা, ইনিয়েস্তা আর ন্যাচোর মিলিত আক্রমণে পর্তুগিজ ডিফেন্সে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। ফলস্বরূপ, আটান্ন মিনিটের মাথায়  পেনাল্টি বক্সের কয়েক গজ দূর থেকে ন্যাচোর ডান পা থেকে বর্শার ফলার মতো ইনসুইঙ্গার শট পোস্টে লেগে দুরন্ত গোল। ম্যাচের ভাগ্য নির্ণয় হয়ে যায় প্রায় তখনই। ৩ - ২ গোলে স্পেন জিতছে এই ভবিষ্যৎ বাণীটা যে কেউ করতে পারবে তখন। কিন্তু রিয়্যাল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ  প্লেয়ারটা যখন খেলছে তখন পঁয়তাল্লিশ হাজার দর্শকও শেষ দেখার অপেক্ষায় বসে ছিল। শেষ বাঁশি বাজার মিনিট কয়েক আগেই ফ্রিকিক পেল পর্তুগাল। এরপর যা হল তা ইতিহাস। দুচার বার লম্বা শ্বাস নিয়ে প্যান্টটা ঈষৎ গুটিয়ে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল রোনাল্ডো। ততক্ষনে ডানদিকে ওয়াল সাজিয়ে নিয়েছে স্পেনের গোলকিপার দি' গিয়া। সমস্ত দর্শকের হৃদপিণ্ড স্তব্ধপ্রায়। ধীরে ধীরে চোখ খুলে ছুটে এসে ডান পায়ের ভেল্কিতে যে শটটা নিল সেটা সারারাত রিওয়াইন্ড করে দেখার মতো। ওয়ালের ওপর দিয়ে নিঁখুত বাঁকে গোলপোস্টের প্রায় বাইরে থেকে ঢুকে এসে বলটা জড়িয়ে গেল জালে। দি' গিয়া একইঞ্চি নড়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত পায়নি। ৩ - ৩ স্কোরটা শুধুমাত্র একটা স্কোর নয়, আগামী দিনে এমন অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার আগুন জিইয়ে রাখল যার আঁচে পুড়তে থাকবে গোটা বিশ্ব।

(চলবে)



#fifaworldcup2018 #bengliarticle #football #Molat    

Saturday, June 2, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৭ # আট-আর সারপ্রাইজ

কলকাতা।বছর আটেক আগে।রাত্রি নটার আশেপাশে,ঘরে টিভি চলছে।

পাত্রের মা : (হাসিহাসি মুখে) এই নে, ছবিটা দেখ।
পাত্র : (ছবিটা হাতে নিয়ে ) এটা কি ?
পাত্রের মা : পাত্রী। কাল দেখতে যাচ্ছি। তুই যাবি সঙ্গে ?
পাত্র : (মনে মনে) গেলেই হয়......
পাত্রের মা : হ্যাঁ ? কিছু বললি ?
পাত্র : না না, কিছু না। ও আমার অন্য কাজ আছে কাল। তোমরা যাও....
পাত্রের মা : ছুটির দিনে আবার কাজ কিসের ?
পাত্র : অফিসের ইভেন্ট আছে। আমায় যেতেই হবে....তোমরা দেখে এসো। কোনও চাপ নেই...
পাত্রের মা : চাপ নেইটা আবার কি ধরণের কথা ?
পাত্র : ইয়ে...(মাথা চুলকে) মানে ওটা চলতি কথা। অর্থাৎ কোনো সমস্যা নেই ।
পাত্রের মা : চলতি কথা ! কই শুনিনি তো আগে ?
পাত্র : আঃ তুমি এসব কি করে শুনবে। কিছু কিছু কথা ব্যাপক খাচ্ছে এখন.....
পাত্রের মা : ব্যাপক খাচ্ছে !!! .....(অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে) এসবের মানে কি ?
পাত্র : মানে এগুলো এখন চলছে......কিছু কিছু শব্দের, ভাষার রূপবদল হয়েছে আর কি। অনেক কথা একসাথে বলার চেয়ে ছোট ছোট কথায় বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। যেমন ধরো - কোনো একটা জিনিস দারুন লেগেছে। সেটা অনেক কথায় না বলে বললাম.... 'একঘর' ..
পাত্রের মা : ওহ তাই নাকি ? আসলে ভদ্রলোকের মুখে শোনা যায়না তো এসব, তাই বোধহয় শুনিনি.....
পাত্র : (চুপ) (একমনে টিভি দেখতে থাকে)

পরদিন রাত্রে। দশটার আশেপাশে....পাত্র উপুড় হয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে।

পাত্রের মা : (বেশ উত্তেজিত হয়ে) কি রে কোথায় গেলি ? এই যে ! পড়ছিস বুঝি ?....আচ্ছা শোন, আজ দেখে এলাম রে !
পাত্র : (পড়তে পড়তে) হুমম.....
পাত্রের মা : আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে বুঝলি। মেয়েটা ভীষণ গুণী (পাত্রের বাবার দিকে ঘুরে) কি গো তাই না ?
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ , মানে আমাদের তো মত আছে... এখন তুই যদি....
পাত্রের মা : (ভুরু কুঁচকে) মত ? মত আবার কি ? আমি তো একরকম কথা দিয়েই এলুম....
পাত্র : (ধড়মড় করে উঠে বসে) সে কি ! দেখলাম না শুনলাম না, একেবারে কথা দিয়ে এলে মানে ? আমার কি কোনো মতামত নেই !!!!
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ মানে... আমিও ঠিক সেই কথাই বলছিলাম। তোর মতামতটা অন্তত একবার....
পাত্রের মা : (দাবড়ানির স্বরে) তুমি থামো তো........(পাত্রের দিকে ঘুরে) তোর আবার মতামত কিসের ? যেমনটা চাইছিলি প্রায় তেমনটাই তো দেখে এলাম। মেয়েটি উচ্চশিক্ষিতা, রুচিশীলা। তাছাড়া আমি চেয়েছিলাম নূন্যতম কোনো একটা শিল্প জানুক। সেটাও তো দারুণ ম্যাচ করেছে......
পাত্র : মানে ?
পাত্রের মা : (একগাল হাসি) ভরতনাট্যমে থার্ড ইয়ার কমপ্লিট করেছে রে।
পাত্র : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) নাচ জানে বলে তুমি একেবারে কথা দিয়ে চলে এলে !! আমার কথাটা চিন্তাই করলে না ? আমি কি ভরতনাট্যম শিখব নাকি !!!!
পাত্রের মা : (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) চাইলে শিখতেও পারিস.....ও শিখিয়ে দিতে পারবে বলে মনে হয়।
পাত্র : (ভীষণ রেগে) এসব কি হচ্ছে ! (বাবার দিকে ঘুরে) তুমি কি করছিলে ? তুমিও কিছু না বলে ঘাড় নেড়ে চলে এলে....??
পাত্রের বাবা : (আমতা আমতা করে) দ্যাখ, আমার তো ওনাদের ব্যবহার খুবই ভাল লেগেছে। এমন বনেদী বাড়ি, পাত্রীর বাবা রিটায়ার্ড হেডমাস্টার.....তাছাড়া নলেন গুড়ের এমন একটা মিষ্টি খাওয়ালেন.....আহহ.... কি স্বাদ ! এখনও মুখে লেগে আছে। (তৃপ্তির হাসি দিয়ে) আমি তো চারটে খেয়েছি।
পাত্র : তুমি কেমন বাবা !.....তুমি কি মিষ্টির দোকানে গেছিলে যে মিষ্টি খাওয়ালো আর অমনি ছেলের বিয়ের কথা দিয়ে দিলে......??
পাত্রের বাবা : আহ ! অত চিন্তার কি আছে। তুই গেলে তোকেও খাওয়াবে....
পাত্র : (বিমর্ষ হয়ে) বাহ বাহ ! কি অদ্ভুত পাত্রী দেখে এলেন দুজনে। ভরতনাট্যম আর নলেন গুড়ের জাঁতাকলে আমার ভবিষ্যতটা বন্ধক রেখে এলে একেবারে।
পাত্রের মা : বেশি নাটক করিস না তো। তুই গেলে কি বলতিস ? (ডান হাত তুলে) "ওকে, থ্যাঙ্কু সবাই। এ বিয়েতে আমি রাজি....কোনো চাপ নেবেন না আপনারা".... এই তো তোর ভাষা হবে.......
পাত্র : (কাঁদো কাঁদো হয়ে) কিন্তু তাই বলে....
পাত্রের বাবা : শোন, অত দুঃখ করার কিছু হয়নি। বলে এসেছি আগামী রোববার তুই যাবি। তখন যা কথা বলার বলে নিস। সঙ্গে মামা আর মেসো যাবে, আমি বলে দেবখন।
পাত্র : (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) যাক ! তবু ভালো....
পাত্রের মা : আর হ্যাঁ....... "চাপ নেবেন না", "ব্যাপক খাচ্ছে" এই ধরণের শব্দ ইউজ করবে না একেবারে....
পাত্র : তুমি কি ভাবো বলো তো আমাকে......ওসব চাপ নিও না.....(পরক্ষনেই দাঁত কেটে) ইয়ে মানে চিন্তা করো না......ওসব কিছু বলব না।
পাত্রের মা : মনে থাকে যেন...

পরের রোববার। দুপুরের দিকে। চুঁচুড়ার শীলবাড়ি। কড়ি বর্গা দেওয়া দোতলার ঘর। আশেপাশে আত্মীয়স্বজনের ভিড় চোখে পড়ার মতো। পাত্রের মামা মেসো বেশ কিছুক্ষন ধরে কথা বলেছেন পাত্রীর বাবা মা এর  সাথে। থেকে থেকে বিচিত্র সব বিষয় উঠে আসছে আলোচনার মধ্যে। অধিকাংশই শারীরিক রোগ সম্পর্কিত। যেমন পাত্রের মামার অর্শর ব্যাথা,পাত্রীর বাবার হাঁটুর সমস্যা ইত্যাদি। পাত্র পাত্রী দুচারবার চোখাচোখি করলেও এখনো অবধি শব্দ খরচ করেনি কেউ। 

পাত্রের মামা : (বেশ কিছুক্ষন পর) তোরা বরং একটু কথা বল। (পাত্রীর বাবার দিকে তাকিয়ে)  ততক্ষনে চলুন আমরা একটু বাড়িটা দেখি। কি সুন্দর চারপাশটা......
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চলুন, তিনশো বছরের পুরোনো বাড়ি.......কত ইতিহাস.....কত ঘটনা....

কণ্ঠস্বরগুলো ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যায়....... 

পাত্রী : আপনি কি করেন ?
পাত্র : (সামান্য নার্ভাস) আমি মানে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি।
পাত্রী : কি দেখেন ?
পাত্র : মার্কেটিং............(তারপর থেমে থেমে) আপনি....কি....করেন  ?
পাত্রী : এস.এস.সি দিয়েছি। রেজাল্টের অপেক্ষা করছি।
পাত্র : পাবেন ?
পাত্রী : (চোখ কুঁচ্কে) মানে ?
পাত্র : না মানে আপনি ভালো স্টুডেন্ট পেয়ে যাবেন নিশ্চই। তাই না ? হেঁহেঁ.....
পাত্রী : (সামান্য গম্ভীর) আশা করি.........কেন, চাকরীতে আপনার আপত্তি আছে নাকি ?
পাত্র : নানা ছিছি। আমি ঠিক তা বলিনি.........(সামান্য একটু থেমে) আচ্ছা...... ইয়ে মানে আপনি নাচেন শুনলাম.......
পাত্রী : (রেগে গিয়ে)...আজ্ঞে না, আমি নাচি না.....আমি নাচ শিখতাম। অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি....
পাত্র : ওহ.....আচ্ছা আচ্ছা.....
পাত্রী : কেন বলুন তো ? আপনি শিখবেন ?
পাত্র : (অম্লান বদনে) হাহা......না না মানে আমি কি করে.......
পাত্রী : শুনলাম আপনিও নাকি খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন ?
পাত্র : হ্যাঁ ওই আর কি.....
পাত্রী : তাহলে খাচ্ছেন না কেন ? সব তো সাজানো আছে সামনে.....
পাত্র : তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই তেমন,.... খাবোখন.....আপনি চাপ.... (পরক্ষনেই জিভ কেটে) মানে চিন্তা করবেন না।
পাত্রী : তেমন চাইলে নিয়েও যেতে পারেন.... বলব প্যাক করে দিতে ?
পাত্র : না না ব্যস্ত হবেন না, আমি তো লাঞ্চ করে এসেছি.......
(সামান্য বিরতি)
পাত্রী : আচ্ছা, অবসর সময়ে কি করেন ? মানে আপনার হবি আছে কোনো ?
পাত্র : (ফিসফিস করে) ল্যাদ খাই....
পাত্রী : হ্যাঁ ? কি বললেন ?
পাত্র : (সামলে নিয়ে) না মানে সিনেমা দেখি, বই পড়ি, টুকটাক ছবি তোলার শখ আছে, এই আর কি....

পাত্রীর মায়ের প্রবেশ

পাত্রীর মা : (পাত্রীর দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা ওকে নিয়ে একটু ছাতে যা না বরং। আমাদের বাড়িটা দেখতে পাবে পুরোটা। (পাত্রের দিকে তাকিয়ে) তুমি যাও বাবা, ওপর থেকে ঘুরে এস, ভালো লাগবে।
পাত্রী : ফাঁকা ছাত !......ওতে আবার দেখার কি আছে ?
পাত্রীর মা : (বিরক্ত হয়ে) অাহ্ , তোর সবতাতে তর্ক।
পাত্র : (হাঁপ ছেড়ে) হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো.......
পাত্রী : (ব্যাজার মুখে) চলুন তবে.........মিষ্টিটা কি খেতে খেতে যাবেন ?
পাত্র : (ব্যস্ত হয়ে) না না থাক, ও পরে খেয়ে নেবখন.....

কলকাতা। পাত্রের বাড়ি। সন্ধ্যের দিকে, সাতটা নাগাদ। 

পাত্রের মা : (উত্তেজিত হয়ে) কি রে কেমন দেখলি ? পছন্দ তো ?
পাত্র : নাহ.....
পাত্রের মা : না মানে !!! পছন্দ হয়নি !!
পাত্র : নাহ.....
পাত্রের মা : ওমা ! সে কি কথা ! কিন্তু কেন ?
পাত্র : আঃ ! আমি অত ডিটেলস বলতে পারব না।
পাত্রের মা : আরে কি হয়েছে সেটা বলবি তো ? অপছন্দের কারণটা কি ?
পাত্র : বড্ড বাজে বকে......
পাত্রের মা : বাজে বকে !! কই আমাদের সাথে তো তেমন কিছু.......(পাত্রের বাবার দিকে তাকিয়ে) কি গো তুমি কিছু খেয়াল করেছিলে সেদিন ?
পাত্রের বাবা : কই না তো ! বরং ভালোই তো কথা বলল। একটা কনফিডেন্স দেখেছিলাম যেন.....
পাত্র : কনফিডেন্স ! হুঁহ, ওদিকে আমার সেলফ ডিফেন্সটাই ভেঙে দিল। বলছে নাকি মিষ্টি প্যাক করে দেবে।
পাত্রের বাবা : সে তো ভালো কথা। চুঁচুড়ার মিষ্টি বিখ্যাত। নাহয় দুটো নিয়েই..........
পাত্র : তুমি তো অদ্ভুত বাবা দেখছি !
পাত্রীর মা : (হতাশ হয়ে) বোঝো কাণ্ড ! আমি এখন কি বলব ওনাদের ?
পাত্র : আমি একটু ভেবে দেখি......

চুঁচুড়ার শীলবাড়ি। নিচের ঘর। 

পাত্রীর মা : তাহলে আমরা হ্যাঁ বলি ? কি গো ?
পাত্রীর বাবা : হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো। এই মাসের শেষের দিকে গিয়ে ডেটটা ফাইনাল করে ফেলা দরকার। তারপর তো মেলা কাজ আছে।
পাত্রী : দাঁড়াও দাঁড়াও, অত তাড়াহুড়ো কোরো না।
পাত্রীর মা : সেকি কথা ? তাড়াহুড়ো করব না মানে ?
পাত্রী : মানে আমার একটু সময় চাই।
পাত্রীর মা : কেন , তোর কি পছন্দ হয়নি ?
পাত্রী : কি করে হবে ? চারটে প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়। কোনোদিন শুনেছ ল্যাদ খাওয়া কারোর হবি হতে পারে ? তাছাড়া কেমন যেন। একরকম ভাবছে, আরেকরকম বলছে। আমার তো মনে হয়  ছেলেটার মাথায় ছিট্ আছে।
পাত্রীর মা : (আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে) না না, ছিট্ আবার কি। ও হয়ত ঘাবড়ে গিয়ে একটু........অমনটা তো হতেই পারে।
পাত্রী : তুমি থামো তো। কচি ছেলে নাকি যে ঘাবড়ে যাবে ?
পাত্রীর মা : সর্বনাশ ! তাহলে এবার কি হবে গো ! ওনারা তো ফোন করলেন বলে.....কি বলব ওঁদের ?
পাত্রী : আমায় একটু ভাবতে দাও.....

এর প্রায় বেশ কয়েকদিন পর। রোববার সকালবেলা। ঘরে টিভি চলছে। পাত্র আধশোয়া হয়ে ল্যাদ খাচ্ছে। হঠাৎ ফোন। 

পাত্র : হ্যালো......
পাত্রী : সকাল সকাল বিরক্ত করলাম না তো।
পাত্র : ওহ আপনি ! (অমায়িকভাবে) না না কি যে বলেন.....
পাত্রী : আসলে একটা কথা বলার ছিল। আপনার কি সময় হবে একটু ?
পাত্র : হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি তো দিব্যি ফ্রী.......না মানে....(চটপট সামলে নিয়ে) ওই একটু বাইরে যাওয়ার ছিল আরকি......
পাত্রী : ওহ....আচ্ছা তাহলে পরে করব ?
পাত্র :না না, বলুন বলুন.....এখন সময় আছে....
পাত্রী : শুনলাম আপনার নাকি এ বিয়েতে মত নেই ?
পাত্র : কই না তো ! (আবার সামলে নিয়ে) না মানে হ্যাঁ......আসলে সেদিন.....
পাত্রী : হ্যাঁ সেদিন আমি বোধহয় একটু বেশিই বলে ফেলেছিলাম। অমন করে হয়ত বলা উচিত হয়নি। তবে আপনারও কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যারাম আছে জানেন তো ?
পাত্র : (হতচকিত হয়ে) আমার !! ক্কি কি বলুন তো ?
পাত্রী : কোনো কথারই যেন ঠিকমতো উত্তর দেন না। কিছুটা পেটে রাখেন কিছুটা মুখে, কেন বলুন তো ?
পাত্র : ইয়ে মানে ওটা আমার বদভ্যাস বলতে পারেন....
পাত্রী : দেখুন কথা চেপে রাখাটা কিন্তু মোটেই পছন্দ করি না আমি, বুঝেছেন তো.....ওটা হলে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী হয় না বলে আমি মনে করি।
পাত্র : তা ঠিক....তা ঠিক......
পাত্রী : যাগ্গে, আমারটা নয় আমি শুধরে নেব, আপনি তাহলে কি ঠিক করলেন ?
পাত্র : কি করা যায় বলুন তো !
পাত্রী : এটা আমায় জিগ্গ্যেস করছেন ?
পাত্র : না মানে আমিও শুনেছি আপনিও নাকি এই বিয়েতে তেমন কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।
পাত্রী : আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, আমি কেন ফোন করেছি আজ আপনাকে ?
পাত্র : (সরল কণ্ঠে) বোধহয় এই নাম্বারটা আমারই কিনা সেটাই ভেরিফাই করার......
পাত্রী : না না আমি ঠিকই বুঝেছি আপনার মাথায় একটু ছিট্ আছে। আমি রাখছি......
পাত্র : না না শুনুন......ইয়ে শোনো.....তোমার মতটা তো জানাই হলো না.......হ্যালো........

ওপাশ থেকে ফোন কেটে যাওয়ার শব্দ। পিছনে সানাইয়ের সুর বেজে ওঠে....

(এছাড়া আরও অনেক কিছুই ঘটেছিল। সবটা লিখলে ধরানো মুশকিল। তাই যতটা সম্ভব ছোট করে বলা হল)
ছবি : রাজ দত্ত

Saturday, May 26, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৬ # স্বরলিপি


প্রিয় রূপম,
এই চিঠি লেখার প্রয়োজন পড়বে ভাবিনি কখনো। অথচ কিছু না বলা কথার পাহাড় জমে আছে বুকে।

ফ্রেশার্সের দিন স্টেজে যখন সি মেজরে ধরলে 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ' ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর একের পর এক 'একটুকু ছোঁয়া লাগে', 'তুমি রবে নীরবে' শুনতে লাগলাম, কেমন মাতাল মাতাল লাগছিলো জানো। অজান্তে কোনো এক অলীক ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। বেঁহুশ জ্বরের মতো তোমার গানের হাত ধরে ছায়াপথের যাত্রী মনে হচ্ছিল নিজেকে।

আমি জানি তুমি ঠিক লক্ষ্য করেছিলে আমায়। অনুষ্ঠানের শেষে কায়দা করে জেনে নিয়েছিলে আমার কেমন লেগেছে। 'ভালো' ছাড়া কিছুই বলে উঠতে পারিনি তখন। তুমি সামনে এসে দাঁড়াতেই খানিক আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলাম যে। ছাইরঙের পাঞ্জাবি, রিমলেস ফ্রেম আর হালকা দাড়িতে দিব্বি মানিয়েছিল। 

ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকতে না ঢুকতেই ফাইনাল ইয়ারের রূপম চক্রবর্তীর সাথে প্রেম, আমরা তখন বেদুইন মেঘের মতো হাওয়ায় উড়ছি। সবাই কানাঘুষো বলত পল সায়েন্স আর ইংলিশ লিটারেচারের মহাজোট তৈরি হয়েছে। 

তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম ক্যান্টিন, সিনেমা, নন্দন, আর ময়দানের সেই অশ্বত্থ গাছের ছায়া ছায়া দিনগুলো। নারায়ণগঞ্জের পিকনিক স্পটে যখন সবার আড়ালে তুমি কাছে এলে, কি লজ্জা কি লজ্জা ! তোমায় ছুঁয়ে দেখার লোভ সামলানো বড় কঠিন ছিল জানো, পারিও নি....। 

এরপর থেকেই বোধহয় লুকোচুরির পালা চুকল আমাদের, তাই না ? ছোটখাট অসুস্থতায় তুমি বাড়ি অবধি চলে আসতে, মনে পড়ে ? ফোনে নাকি আমার মুখ দেখা যায় না, এসএমএসে কথা হয় না, আরও কত কি ! ক্রমে দুই বাড়ির লোকজনের কাছে আমরা আরও স্পষ্ট হলাম। সাড়ে তিন বছরের প্রেম পরিণত হল পরিণয়ের দোরগোড়ায় এসে। এক পৌষের সন্ধ্যায় তোমার মা এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন।

আমার তখন ফাইনাল ইয়ার শেষ। তুমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে একবছর হল চাকরিতে ঢুকেছ। কয়েক মাস বাদেই তোমার বিদেশযাত্রা। এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ বলে মেনে নিলেন সকলে। সেদিন কুণ্ঠার ভারে তোমার বাবা মায়ের সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি। বলতে পারিনি তুমি ফেরার পরেই বিয়ে নিয়ে ভাবা যেতে পারে। তোমার চোখেমুখের ঔজ্জ্বল্য আমার কণ্ঠরোধ করেছিল সেবার। তোমাকে নিরাশ করতে প্রাণ চায়নি। বেশ মনে আছে, সিঁদুরদানের সময় আমার পা কাঁপছিল। বারবার ভেবেছিলাম যদি তুমি না ফেরো, আর যদি না আসো...........। মনকে বুঝিয়েছিলাম এমন কপাল কজনের থাকে ? হৃদয়ের ঘরে যার আসন পাতা সেই এসে বসছে এমন ভাগ্য কজনার হয় ?

তুমি যাওয়ার পর বড় অগোছালো হয়ে গেলাম। আমার সবটুকুন নিয়ে চলে গেলে যেন। আমি পড়ে রইলাম একক শূন্যতা নিয়ে। দিন যেতে লাগল। তুমি ফেরার পথ ভুলে গেলে। আমারও ভুল ভাঙতে একবছর সময় লেগেছিল, বিশ্বাস করতে আরও এক বছর। আমার উদ্বেগ, ভয় সমস্তটা সত্যি হল যখন শুনলাম তুমি লিভ টুগেদার করছ একজন ফরাসী শ্বেতাঙ্গীর সাথে। 

অন্তঃস্বত্ত্বা বিদেশিনীর দায়িত্ব তোমার কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল আমার থেকেও। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল রূপম। 

............ কেমন করে !! কেমন করে পারলে তুমি আমার সমস্ত অস্তিত্বকে এক ঝটকায় মিথ্যে করে দিতে ? কেমন করে পারলে তুমি জড়িবাঁধা মুহূর্তদের ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলতে ? তবে কেন গালভরা প্রতিশ্রুতির জালে বেঁধেছিলে আমায় ? এমন করে দূরে সরিয়ে দেবে বলেই কি ? পুরোনো মানুষ, পুরোনো কথার আয়ু এক - দু বছরের বেশি নয়, এ যেন তুমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে......

তবু ভেবেছিলাম তুমি ফিরবে, হয়ত কোনো একদিন..........

তোমার গানের খাতাটা যত্ন করে তুলে রেখেছি আমাদের শোবার ঘরের ছোট দেরাজে। তোমার গিটারের তারটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আশরাফের দোকান থেকে কিনে একটা নতুন লাগিয়ে দিয়েছি। বারান্দার আরাম কেদারায় তুলো বেরিয়ে গিয়েছিল। মুন্নাকে দিয়ে ফুলফুল ছিটের একটা নতুন গদি করিয়েছি। তুমি এলে সব দেখতে পাবে....... আসবে তো...... ?

ইদানিং মাথার ভেতর একটা যন্ত্রনা হতে থাকে জানো। কেমন যেন পাগল পাগল লাগে সেসময়। কানের মধ্যে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে একনাগাড়ে। বড় কষ্ট হয়, বড় কষ্ট .......... মনে হয় তোমার বুকের মধ্যে গুটিয়ে শুয়ে থাকি। তোমার শার্টের হাতাটা আঙুলের মধ্যে জড়াই। ঘুমের মধ্যে কত খুঁজেছি তোমায়, তোমার মাথার বালিশটা আঁকড়ে পড়ে থাকি রাতের পর রাত। দরজায় সামান্য আওয়াজ হলেই ঘুম ভেঙে যেত। ভাবতাম তুমি এলে বুঝি। আরও একবার মোহভঙ্গ হত।

আজকাল কেমন যেন হাত পা অবশ লাগে। বিশেষ কথা বলতে ইচ্ছে করে না। লোকে বলে আমার নাকি মাথার রোগ হয়েছে। ওরা জানে না মনের রোগের উপশম কোথায়। তুমি যদি একবার এসে বসতে কাছে, একবার যদি চুলে বিলি কেটে দিতে, আমার সকল গ্লানি, ক্ষয়, আপনিই জুড়িয়ে যেত। ক্লান্ত হয়ে গেছি রূপম, বড় ক্লান্ত লাগে এখন.........

----------------------------------------------------------------------------

এপর্যন্ত এসে অতসী জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। গরাদের গায়ে ধাক্কা লেগে ভাঙা রোদের টুকরো এসে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। দুপুরের তপ্ত হাওয়ায় চুল এলোমেলো হতে থাকে সর্বহারা উন্মাদিনীর, ফড়ফড় করে উড়তে থাকে পেপারওয়েটের নিচে রাখা অক্ষরহীন দিস্তা কাগজগুলো। মেঝের ওপর ছায়া পড়ে দুজন মানুষের। 

একজন পুরুষকণ্ঠ ডেকে ওঠেন, 'মাসিমা.........মাসিমা......' ? 

এই দুটি শব্দে অতসীর বলিরেখায় বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় না। আগের মতোই সে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে। 

পুরষকণ্ঠটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 'আজও আপনি চিঠিটা শুরু করলেন না' ?

পাশে দাঁড়ানো একজন তরুণী বিদেশিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, 'চিঠি লিখব, চিঠি লিখব করে রোজ কাগজের তলব করেন। অথচ কাগজ দিলে এক বর্ণও লিখে উঠতে পারেন না। চিঠি লেখা তো দূর উনি ভালো করে কথাই বলেন না এই হোমের কারোর সাথে। আপনিও তো গত কয়েকদিন ধরে আসছেন, ফিরে তাকাচ্ছে কি ? সর্বক্ষণ যেন অন্য জগতে পড়ে রয়েছেন । অথচ এই অবস্থায় আপনি বিদেশে  নিয়ে যেতে চাইছেন। আমি তো বলব ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন'।

'এটা ঝুঁকি নয় ডঃ সেন, উনি আমার দায়িত্ব'। স্পষ্ট বাংলায় দৃপ্তস্বরে কথাগুলো বলল শ্বেতাঙ্গী তন্বী। 

ডঃ সেন খানিক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, 'বেশ, আপনি যখন সমস্ত পেপার্স সাবমিট করেছেন আমার আর কি আপত্তি থাকতে পারে। শুধু কয়েকটা জায়গায় সইয়ের ব্যাপার আছে'। 

পাশের টেবিলের ওপর কয়েকটা জরুরী কাগজ এগিয়ে দেন চিকিৎসক। বিদেশিনী সই করতে থাকে একের পর এক। 

ডঃ সেন খানিক সংকোচে জিজ্ঞেস করলেন, 'কিছু মনে করবেন না, মানে হঠাৎ এইভাবে এতবছর পর অতদূর থেকে এসে ওনাকে নিয়ে যেতে চাইছেন......কারণটা ঠিক.............'

স্মিত হাসে তরুণী, তারপর সই করে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলে, 'বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল, আমি যেন ওনার কাছেই থাকি। কাজের সূত্রে আমার ফ্রান্সের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তাই ওনাকেই নিয়ে যেতে এসেছি। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, খুব ছোটবেলায় মা হারিয়েছি, ওনার চিকিৎসার কোনোরকম গাফিলতি আমি হতে দেব না'।

ডঃ সেন সম্মতিসূচক মৃদু ঘাড় নাড়লেন। কাগজের ওপর চোখ বুলিয়ে সইগুলো চেক করে নিলেন। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা...... ক্যাথরিন চক্রবর্তী।

ক্যাথরিন পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় জানলার দিকে। হাঁটুমুড়ে বসে অতসীর কাঁধের ওপর আলতো করে হাত রাখে। তারপর কোমলস্বরে ডাকে, 'মা......... মা......'?

ধীরে ধীরে অতসী ঘুরে তাকায় ক্যাথরিনের দিকে, বেশ কিছুক্ষন নিরীক্ষণ করে নিস্তেজ গলায় বলে, 'কেএএ......' ?  

ক্যাথরিন জড়িয়ে ধরে অতসীকে। অচেনা মানুষের ভীষণ অদ্ভুত চেনা গন্ধ এসে লাগে নাকে।  

কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যাথরিনের মুখের ওপর হাত বোলায় অতসী। অবিন্যস্ত রুপোলি চুলের ফাঁকে দৃষ্টি ঝাপসা লাগে যেন। চোখের পাতায় জল চিকচিক করতে থাকে। 

তারপর ভাঙা গলায় অস্ফুটে বলে, 'বড় চেনা লাগে মুখটা...........কোথায় যেন..........'  

ক্যাথরিনের মুখে শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি খেলে যায়। ঘরময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এক নতুন বন্ধনের আলো.......


চিত্র: গুগল ; বিন্যাস : নিজস্ব 


#bengalishortstories #bengalilovestories #Molat   





  

Saturday, May 19, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৫ # বহিছে ধারা

ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে সমরেশ গজগজ করতে থাকেন। পাঁচটার মধ্যে ফেরার কথা ঋকের। সাড়ে পাঁচটা বাজে অথচ ধারে কাছে টিকি পাওয়া যাচ্ছে না ছেলের। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে এলেন তিনি। হাজরা কালীঘাটের মুখে ডানদিকের সরু গলির দোতলা রংচটা বাড়ি। গলির শেষ মাথাটা অবধি দেখা যায় বারান্দা থেকে। দুচারজন পথচলতি মানুষের ভিড়ে অতিপরিচিত মুখটা খুঁজতে থাকেন সমরেশ। বিকেল শেষের ছিঁটেফোঁটা আলোয় সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ ছেলের দেখা নেই। আজ আইপিএলের খেলা আছে ইডেনে। প্রায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুটো টিকিট জোগাড় করেছেন সমরেশ। বাবা ছেলের ক্রিকেট দেখার শখ সাংঘাতিক। এখনই বেরোতে না পারলে ঠিকমতো গুছিয়ে বসা যাবে না। ভিড় তো আছেই তার ওপর জ্যাম। এসব ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওঠেন নিরুপায় বাবা। আর ধৈর্য রাখতে না পেরে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নম্বরটা ডায়াল করতে থাকেন। 

অকস্মাৎ দরজা ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ভিতরে ঢোকে ঋক। ব্যাগটা সাইডে ফেলে সোফার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। সমরেশ চেঁচিয়ে ওঠেন। 
-  কিরকম আক্কেল তোর ? কটা বাজে খেয়াল আছে ? এখনই বেরোতে না পারলে....... 
পুরোটা শেষ করতে দেয় না ঋক। হাত তুলে থামায় বাবাকে। টেবিলের ওপর রাখা বোতল থেকে দু ঢোঁক জল খেয়ে নেয়। তারপর একটু দম নিয়ে নিচুস্বরে বলে, 'কোচিং থেকে বেরিয়ে দেখলাম পাশের পাড়ায় ব্লাড ক্যাম্প হচ্ছে। দিয়ে আসতেই যা একটু দেরি হল'। 

মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেলেন সমরেশ। ঋকের প্রতি আরও কিছু ক্ষোভের কথা মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল আপনিই। ঘুরে তাকালেন দেওয়ালে ঝোলানো একটা বাঁধানো ছবির দিকে। একফুট বাই একফুটের কাঠের ফ্রেমে একটা গোটা ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে আছে। বছর দুয়েক আগের স্মৃতি এখনো দগদগে ঘায়ের মতো দুজনের বুকেই জীবন্ত। কান পাতলে এখনো সেই গাড়ির কর্কশ আওয়াজটা মাথার মধ্যে তীব্র জ্বালা ধরায়। মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনার ভয়াল কোপে স্নেহলতা আজ দুজনের থেকে বিচ্ছিন্না। দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে এক উন্মাদ ট্যাক্সির চাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় একটা শরীর, ক্ষতবিক্ষত হয় দুটো হৃদয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও শুধুমাত্র রক্তের অভাবে সেদিন ফেরানো যায়নি তাঁকে। 

বাবার পিছনে এসে দাঁড়ায় ঋক। ছবির কাঁচে সন্তানের ছায়া পড়ায় সম্বিৎ ফেরে সমরেশের। কোমল স্বরে বলেন, 'যা, মুখ হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। সময়মতো পৌঁছতে হবে তো'। বাবার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দেয় ঋক। কনুইয়ের ভাঁজে একটা গোলাকার ব্যান্ডেড চোখে পড়ে। তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কি ব্যাপার ! চোট লাগল কি করে তোমার' ? সমরেশ কোনোমতে কম্পিতস্বরে বলেন, 'ও কিছু না, তুই অত ভাবিস না'। ঋক হাল ছাড়ে না, গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করে, 'সত্যি করে বলো, এটা কি করে হল'। সমরেশ খানিক্ষন চুপ করে থাকেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, 'আসলে আজকের দিনেই তো........তাই অফিস যাওয়ার আগে আমিও একবার ওই ব্লাড ক্যাম্পে.......'। 
নিজেকে আর সামলাতে পারে না ঋক । এক লহমায় জড়িয়ে ধরে সমরেশকে। অন্তর্নিহিত গ্লানি জল হয়ে বেরিয়ে আসে দুজনেরই গাল বেয়ে। অস্ফুটে বলে, 'বাবা...........'

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এমন গল্প হয়ত খুঁজলে পরে অনেক পাওয়া যাবে। তার কারণ ভারতবর্ষে রক্তের জোগানে বরাবরের সমস্যা আছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক, ভারত সরকারের একটি রিপোর্টে জানা গেছে যে ২০১৬ সালে ১২ মিলিয়ন ইউনিটের চাহিদা অনুযায়ী শুধুমাত্র ১০.৯ মিলিয়ন ইউনিট রক্তই পাওয়া গেছে। সুতরাং ঘাটতির পরিমাণটা যে এখনও বিপুল তা এই সহজ অঙ্কের মাধ্যমেই বোঝা যায়। আমাদের মধ্যে এখনো অনেকেই আছেন যাঁরা রক্তদান এড়িয়ে চলেন, বিভিন্ন রকমের অজুহাত দেন এবং সর্বোপরি রক্তদান সম্পর্কে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন। যেমন - রক্তদান করলে শরীরে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে বা পরবর্তীকালে নানান রকম শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে ইত্যাদি। তাঁদেরকে বলব সময় করে নাহয় একবার আপনার চিকিৎসককেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। তাঁর কথা নিশ্চই বিশ্বাসযোগ্য হবে এই আশা রাখি।

আর বাকিদের বলি, আগামী ২০শে মে জেনেসিস হাসপাতালে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হবে। যাঁরা রক্ত দিতে ইচ্ছুক তাঁরা একঝলক এই ছবিতে চোখ বোলালেই পুরোটা বুঝতে পারবেন। বাকি সুস্থ থাকুন আর রবিবার দেখা হচ্ছে ......

#blooddonationcamp #blooddonation #bengalishortstory #Molat #GenesisHospitalKolkata