Wednesday, June 27, 2018

কা(আপ)ডেট # ২

ভেবেছিলাম দ্বিতীয় পর্বটা আর লিখব না। চোখের সামনে একের পর এক অঘটন দেখে মনে হচ্ছিল  বিশ্বজয়ী টিমরা খেই হারিয়ে ফেলেছে। যথেচ্ছ ক্লাব ফুটবল আর মুহুর্মুহু চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ঝড়ের দাপটে উড়ে গেছে নিজেদের দেশের হয়ে খেলার উন্মাদনা। ধ্বংসাবশেষের মতো পড়ে আছে শুধু নিয়মমাফিক বিশ্বকাপ খেলতে আসার অনিচ্ছেটুকু। আইসল্যান্ডের সাথে আর্জেন্টিনার ড্র, পরের দিকে বিরাট ব্যবধানে ক্রোয়েশিয়ার কাছে নতিস্বীকার, সুইজারল্যান্ডের সাথে ব্রাজিলের ড্র, পরের ম্যাচে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে কোনোরকমে গোল, মেক্সিকোর সাথে জার্মানির বিপর্যয় এবং ফ্রান্স জিতলেও তাদের ঢিলেঢালা ফুটবলে সেই আবেগ বড় অনুপস্থিত লেগেছিল। বড় বড় টিমের এমন অবিন্যস্ত ফুটবল দেখার অভিজ্ঞতা আমার মতো ক্রীড়াপ্রেমীদের একেবারেই যে নেই এটুকু বাজি রেখে বলতে পারি। তাই রাতের পর রাত জাগাটা যে ক্রমশ মাঠে মারা যাচ্ছে সেটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিলাম।  

লাভের মধ্যে ছোট ছোট টিমগুলোর যে চরম উত্তেজনা আর কমিটমেন্ট দেখলাম তাতে করে মনে হচ্ছিল এদের মধ্যে অনেককেই হয়ত নক আউট পর্যায়ের ওপরের দিকে দেখতে পাব। বিশেষভাবে উল্লেখ্য পেরু, ইরান, মরোক্কো, জাপান, সুইডেন এবং সেনেগাল যারা সবুজ ঘাসের কানায় কানায় যে দরদটা মজুদ করে  এল তা বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখার মতো। এর পাশাপাশি ছিল রাশিয়া, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড আর ঊরুগুয়ের চোখ ধাঁধানো ফুটবল আর অক্লান্ত নিম্নচাপ বর্ষণের মতো বেশ কিছু গোল। চেয়ার ছেড়ে ওঠার অবকাশটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না তার আগেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গোলপোস্টের জালে আছড়ে পড়ছে একের পর এক সোনালী মুহূর্তরা। 

কিন্তু কথায় আছে পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে, এবং সময় বুঝে তা বাড়লও বটে। ৩০ মিনিটের মাথায় সুইডেনের বিরুদ্ধে এক গোল খাওয়ার পর জার্মানরা ফেরার টিকিট প্রায় নিশ্চিত করে নিয়েছিল। কিন্তু জার্মান রক্ত যে অন্য ধাতু দিয়ে গড়া তা বুঝতে বেশিক্ষন সময় লাগল না। হাফ টাইমের ঠিক পরেই মার্কো রিউসের গোলে জার্মানি সমান সমান পাঞ্জা কষতে শুরু করল। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো জার্মান ডিফেন্ডার বোয়েতাং বেরিয়ে গেল রেড কার্ড দেখে। ১০ জন মিলেও যে বিধ্বংসী ফুটবল খেলা যায় সেটা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল জার্মানি। ইনজুরি টাইমে পেনাল্টি বক্সের সামান্য বাইরে কোনাকুনি জায়গা থেকে ফ্রি কিকে যে গোলটা করল টনি ক্রুস সেখান থেকে গোল হওয়া একরকম অসম্ভব। ঠিক সেই অসম্ভব কাজটাই অসাধারণ বাঁকানো শটে গোল করে গ্রূপের প্রথম ম্যাচ জিতল জার্মানি। তবে পুরোনো চাল ভাতে বাড়লেও মুখ অবধি পৌঁছতে পেলো না। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে লজ্জাজনক পরাজয়ে জার্মানি যে লীগ টেবিল থেকেই ছিটকে যাবে এটা বোধহয় অতি বড় ফুটবল বোদ্ধারও বোঝার ঊর্দ্ধে ছিল।    

গ্রূপ ডির শেষ ম্যাচে যখন আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া মুখোমুখি হচ্ছিল তখন ক্যামেরার ফ্রেমে বারে বারে উঠে আসছিল লিওনেল মেসির মুখটা। গ্যালারিতে তখন নীল সাদার উৎকণ্ঠার মেঘ জমেছে। আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি মিস আর তার পরেই ক্রোয়েশিয়ার কাছে বড় ব্যবধানে হার, এই দুয়ে মিলে বিশ্বের চাপ নিয়ে শুধু টিমটা মাঠে নামছে না, যেন গোটা আর্জেন্টিনা দেশটা খেলতে নামছে তাদের প্রিয় ঈশ্বরের স্বর্গীয় আতশবাজির ঝলক দেখার জন্য। সমস্ত উদ্বেগ, গ্লানি এক লহমায় নস্যাৎ করে দিয়ে, গোটা স্টেডিয়ামকে প্রায় বাকরুদ্ধ করে যেন ঐশ্বরিক প্রত্যাবর্তন ঘটল মেসির। ১৪ মিনিটের মাথায় মাঝ মাঠ থেকে ব্যানেগার একটা উড়ন্ত পাশ ধরার জন্য যে দুর্দান্ত স্প্রিন্ট টেনে বলটা  রিসিভ করল বাঁ পায়ের ঊরুতে সেটা অনেকের কাছেই স্বপ্ন। ওই একইভাবে দৌড়তে দৌড়োতে ঊরু থেকে বলটা বাঁ পায়ের পাতার ওপর নিয়ে দু চার পা আরও দৌড়ে ডান পায়ের কোণাকুণি মর্মভেদী শটে জাল কাঁপিয়ে দিল আর্জেন্টিনার বন্দিত মহানায়ক। অন্যান্য ফুটবলারের চোখের পলক পড়ার সময়টুকুর মধ্যে যে ক্ষিপ্রতায় গোলটা হল সেটা দেখার জন্য আরও অনেক রাত জাগা যেতে পারে। নাইজেরিয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা ফেরালেও আর্জেন্টিনা যে ফুটবলটা খেলল তাতে প্রত্যাশিত ভাবে শেষ গোলটা হল মার্কোস রোহোর দুরন্ত ফিনিশে।

এছাড়া সাম্বা ফুটবলের শৈল্পিক ভাঁজে নেইমার, কুটিনহো, পৌলিনহোদের দেশ অবলীলায় সার্বিয়াকে পাশ কাটিয়ে রাউন্ড ১৬ তে মেক্সিকোর মুখোমুখি হতে চলেছে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর ফিনিশ বিশ্বমানের ফুটবলাররা করবে তাতে সন্দেহ নেই বটে তবে মনের মধ্যে যেটুকু কুয়াশা জমেছিল সেটা কেটে গিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি খেলা জমে উঠেছে........


(চলবে)   


  #fifaworldcup2018 #bengliarticle #football #Molat  

Saturday, June 16, 2018

কা(আপ)ডেট # ১

বাপ্ রে বাপ্ ! এই তিনটে শব্দ ছাড়া আর কিচ্ছু মাথায় আসেনি লেখার আগে। ঠিক যেভাবে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কথা তার চেয়ে অনেকগুন বেশি চমক দিয়ে শুরু হল ১৪ই জুনের সন্ধ্যেটা। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে তখন চাকবাঁধা মৌমাছির মতো প্রায় আশি হাজার দর্শকের গুঞ্জনে কান পাতা দায়। স্টেডিয়ামের আশেপাশের রাস্তায় অগণিত মোহাচ্ছন্ন মানুষের ভিড় । সেন্টার স্টেজে একের পর এক গেয়ে চলেছেন রবি উইলিয়ামস, আগুন পাখির ডানায় ভর করে এডা গ্যারিফুলিনার প্রবেশ আর বাকি লাইমলাইটের সবটুকু শুষে নিয়ে গেলেন ব্রাজিলের রোনাল্ডো, তাঁর নায়কোচিত উপস্থিতি দিয়ে। 

এরপর যে খেলাটা শুরু হল সেটাকে খেলা না বলে ছেলেখেলা বললে বোধহয় বেশি ভালো হতো। বিশ্বকাপ শুরুর দিনেই যে লজ্জাটা সৌদি আরব পেল সেটা ভুলতে বেশ কয়েক বছর লাগবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায়। প্রথম দশ বারো মিনিটের মাথাতেই গোলোভিনের ক্রস থেকে গ্যাজিনস্কির গোল ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে ২০১৮ র প্রথম গোল হিসেবে। ঠিক তার পরেই যেন লক গেট খুলে যাবার মতো উপক্রম হল সৌদি ডিফেনসের। ভেবেছিলাম আরবি ঘোড়ার দল ঘুরে দাঁড়াবে। অচিরেই ভুল প্রমাণিত হলাম। প্রথম হাফে দুটি গোল এবং পরবর্তী হাফে তিনটে গোল, মোট পাঁচটা গোল দিয়ে তিন পয়েন্ট নিয়ে গ্রূপের শীর্ষে চলে গেল রাশিয়া। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য গোলোভিন নামক প্লেয়ারটি যাঁর মধ্যে আগামী দিনে তারকা হওয়ার বারুদ জমা হয়ে আছে। মুহুর্মুহু ক্রসে একের পর এক গোল এবং শেষ মিনিটে নিঁখুত, অনবদ্য ফ্রিকিকে জাত চিনিয়ে দিয়ে গেল এই তরুণ রুশ ফুটবলার। এবারে রাশিয়ার সেরা চমক সন্দেহ নেই।

১৫ই জুন রাত জাগা সার্থক। পর্তুগাল স্পেনের খেলায় যাঁরা ঘুমিয়েছিলেন তাঁদের বলব সময় করে হাইলাইটসটা দেখে নেবেন। খেলা শুরুর প্রথম চার মিনিটের মাথায় রোনাল্ডোকে পেনাল্টি বক্সে ফাউল এবং পর্তুগালের পেনাল্টি কিক। স্বভাবসুলভ ডান পায়ের গর্জন এবং গোলকিপারকে উল্টোদিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে প্রথম গোলে রোনাল্ডোচিত জয়োল্লাস। এখানেই ভেবেছিলাম স্পেন বোধহয় ব্যাকফুটে চলে যাবে। কিন্তু তারকাখচিত স্পেন গুছিয়ে নিতে সময় নিল মিনিট কুড়ি মতো। ছোট ছোট পাসে নিজেদের খেলাটাকেই শুধু নয় আত্মবিশ্বাসটাকেও জড়ো করে নিল সবাই। আর তার পরেই দিয়েগো কোস্তার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে দুজনকে ড্রিবল করে প্রায় মেসিসুলভ ভঙ্গিতে গোল। এরপর স্পেন যে খেলাটা খেলল তাতে করে এটা বোঝা গেল যে তিকিতাকা পাসের ওপর ভর করে দুফুট বাই দুফুট জমি ফাঁকা পেলেও তাতে দিব্যি ফুটবল খেলা যায়। এর ঠিক পরেই  তীক্ষ্ন কাউন্টার এট্যাকে হাফটাইমের প্রায় মিনিটখানেক আগে রোনাল্ডো আরও একবার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে জোরালো শটে গোল করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল 'পিকচার আভি বাকি হ্যায়'। 

হাফটাইমের পরে দিয়েগো কোস্তার দ্বিতীয় গোলে স্পেন ফিরে এলো স্বমহিমায়। ইস্কো, সিল্ভা, ইনিয়েস্তা আর ন্যাচোর মিলিত আক্রমণে পর্তুগিজ ডিফেন্সে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। ফলস্বরূপ, আটান্ন মিনিটের মাথায়  পেনাল্টি বক্সের কয়েক গজ দূর থেকে ন্যাচোর ডান পা থেকে বর্শার ফলার মতো ইনসুইঙ্গার শট পোস্টে লেগে দুরন্ত গোল। ম্যাচের ভাগ্য নির্ণয় হয়ে যায় প্রায় তখনই। ৩ - ২ গোলে স্পেন জিতছে এই ভবিষ্যৎ বাণীটা যে কেউ করতে পারবে তখন। কিন্তু রিয়্যাল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ  প্লেয়ারটা যখন খেলছে তখন পঁয়তাল্লিশ হাজার দর্শকও শেষ দেখার অপেক্ষায় বসে ছিল। শেষ বাঁশি বাজার মিনিট কয়েক আগেই ফ্রিকিক পেল পর্তুগাল। এরপর যা হল তা ইতিহাস। দুচার বার লম্বা শ্বাস নিয়ে প্যান্টটা ঈষৎ গুটিয়ে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল রোনাল্ডো। ততক্ষনে ডানদিকে ওয়াল সাজিয়ে নিয়েছে স্পেনের গোলকিপার দি' গিয়া। সমস্ত দর্শকের হৃদপিণ্ড স্তব্ধপ্রায়। ধীরে ধীরে চোখ খুলে ছুটে এসে ডান পায়ের ভেল্কিতে যে শটটা নিল সেটা সারারাত রিওয়াইন্ড করে দেখার মতো। ওয়ালের ওপর দিয়ে নিঁখুত বাঁকে গোলপোস্টের প্রায় বাইরে থেকে ঢুকে এসে বলটা জড়িয়ে গেল জালে। দি' গিয়া একইঞ্চি নড়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত পায়নি। ৩ - ৩ স্কোরটা শুধুমাত্র একটা স্কোর নয়, আগামী দিনে এমন অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার আগুন জিইয়ে রাখল যার আঁচে পুড়তে থাকবে গোটা বিশ্ব।

(চলবে)



#fifaworldcup2018 #bengliarticle #football #Molat    

Saturday, June 2, 2018

সাপ্তাহিকী ৩৭ # আট-আর সারপ্রাইজ

কলকাতা।বছর আটেক আগে।রাত্রি নটার আশেপাশে,ঘরে টিভি চলছে।

পাত্রের মা : (হাসিহাসি মুখে) এই নে, ছবিটা দেখ।
পাত্র : (ছবিটা হাতে নিয়ে ) এটা কি ?
পাত্রের মা : পাত্রী। কাল দেখতে যাচ্ছি। তুই যাবি সঙ্গে ?
পাত্র : (মনে মনে) গেলেই হয়......
পাত্রের মা : হ্যাঁ ? কিছু বললি ?
পাত্র : না না, কিছু না। ও আমার অন্য কাজ আছে কাল। তোমরা যাও....
পাত্রের মা : ছুটির দিনে আবার কাজ কিসের ?
পাত্র : অফিসের ইভেন্ট আছে। আমায় যেতেই হবে....তোমরা দেখে এসো। কোনও চাপ নেই...
পাত্রের মা : চাপ নেইটা আবার কি ধরণের কথা ?
পাত্র : ইয়ে...(মাথা চুলকে) মানে ওটা চলতি কথা। অর্থাৎ কোনো সমস্যা নেই ।
পাত্রের মা : চলতি কথা ! কই শুনিনি তো আগে ?
পাত্র : আঃ তুমি এসব কি করে শুনবে। কিছু কিছু কথা ব্যাপক খাচ্ছে এখন.....
পাত্রের মা : ব্যাপক খাচ্ছে !!! .....(অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে) এসবের মানে কি ?
পাত্র : মানে এগুলো এখন চলছে......কিছু কিছু শব্দের, ভাষার রূপবদল হয়েছে আর কি। অনেক কথা একসাথে বলার চেয়ে ছোট ছোট কথায় বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। যেমন ধরো - কোনো একটা জিনিস দারুন লেগেছে। সেটা অনেক কথায় না বলে বললাম.... 'একঘর' ..
পাত্রের মা : ওহ তাই নাকি ? আসলে ভদ্রলোকের মুখে শোনা যায়না তো এসব, তাই বোধহয় শুনিনি.....
পাত্র : (চুপ) (একমনে টিভি দেখতে থাকে)

পরদিন রাত্রে। দশটার আশেপাশে....পাত্র উপুড় হয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে।

পাত্রের মা : (বেশ উত্তেজিত হয়ে) কি রে কোথায় গেলি ? এই যে ! পড়ছিস বুঝি ?....আচ্ছা শোন, আজ দেখে এলাম রে !
পাত্র : (পড়তে পড়তে) হুমম.....
পাত্রের মা : আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে বুঝলি। মেয়েটা ভীষণ গুণী (পাত্রের বাবার দিকে ঘুরে) কি গো তাই না ?
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ , মানে আমাদের তো মত আছে... এখন তুই যদি....
পাত্রের মা : (ভুরু কুঁচকে) মত ? মত আবার কি ? আমি তো একরকম কথা দিয়েই এলুম....
পাত্র : (ধড়মড় করে উঠে বসে) সে কি ! দেখলাম না শুনলাম না, একেবারে কথা দিয়ে এলে মানে ? আমার কি কোনো মতামত নেই !!!!
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ মানে... আমিও ঠিক সেই কথাই বলছিলাম। তোর মতামতটা অন্তত একবার....
পাত্রের মা : (দাবড়ানির স্বরে) তুমি থামো তো........(পাত্রের দিকে ঘুরে) তোর আবার মতামত কিসের ? যেমনটা চাইছিলি প্রায় তেমনটাই তো দেখে এলাম। মেয়েটি উচ্চশিক্ষিতা, রুচিশীলা। তাছাড়া আমি চেয়েছিলাম নূন্যতম কোনো একটা শিল্প জানুক। সেটাও তো দারুণ ম্যাচ করেছে......
পাত্র : মানে ?
পাত্রের মা : (একগাল হাসি) ভরতনাট্যমে থার্ড ইয়ার কমপ্লিট করেছে রে।
পাত্র : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) নাচ জানে বলে তুমি একেবারে কথা দিয়ে চলে এলে !! আমার কথাটা চিন্তাই করলে না ? আমি কি ভরতনাট্যম শিখব নাকি !!!!
পাত্রের মা : (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) চাইলে শিখতেও পারিস.....ও শিখিয়ে দিতে পারবে বলে মনে হয়।
পাত্র : (ভীষণ রেগে) এসব কি হচ্ছে ! (বাবার দিকে ঘুরে) তুমি কি করছিলে ? তুমিও কিছু না বলে ঘাড় নেড়ে চলে এলে....??
পাত্রের বাবা : (আমতা আমতা করে) দ্যাখ, আমার তো ওনাদের ব্যবহার খুবই ভাল লেগেছে। এমন বনেদী বাড়ি, পাত্রীর বাবা রিটায়ার্ড হেডমাস্টার.....তাছাড়া নলেন গুড়ের এমন একটা মিষ্টি খাওয়ালেন.....আহহ.... কি স্বাদ ! এখনও মুখে লেগে আছে। (তৃপ্তির হাসি দিয়ে) আমি তো চারটে খেয়েছি।
পাত্র : তুমি কেমন বাবা !.....তুমি কি মিষ্টির দোকানে গেছিলে যে মিষ্টি খাওয়ালো আর অমনি ছেলের বিয়ের কথা দিয়ে দিলে......??
পাত্রের বাবা : আহ ! অত চিন্তার কি আছে। তুই গেলে তোকেও খাওয়াবে....
পাত্র : (বিমর্ষ হয়ে) বাহ বাহ ! কি অদ্ভুত পাত্রী দেখে এলেন দুজনে। ভরতনাট্যম আর নলেন গুড়ের জাঁতাকলে আমার ভবিষ্যতটা বন্ধক রেখে এলে একেবারে।
পাত্রের মা : বেশি নাটক করিস না তো। তুই গেলে কি বলতিস ? (ডান হাত তুলে) "ওকে, থ্যাঙ্কু সবাই। এ বিয়েতে আমি রাজি....কোনো চাপ নেবেন না আপনারা".... এই তো তোর ভাষা হবে.......
পাত্র : (কাঁদো কাঁদো হয়ে) কিন্তু তাই বলে....
পাত্রের বাবা : শোন, অত দুঃখ করার কিছু হয়নি। বলে এসেছি আগামী রোববার তুই যাবি। তখন যা কথা বলার বলে নিস। সঙ্গে মামা আর মেসো যাবে, আমি বলে দেবখন।
পাত্র : (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) যাক ! তবু ভালো....
পাত্রের মা : আর হ্যাঁ....... "চাপ নেবেন না", "ব্যাপক খাচ্ছে" এই ধরণের শব্দ ইউজ করবে না একেবারে....
পাত্র : তুমি কি ভাবো বলো তো আমাকে......ওসব চাপ নিও না.....(পরক্ষনেই দাঁত কেটে) ইয়ে মানে চিন্তা করো না......ওসব কিছু বলব না।
পাত্রের মা : মনে থাকে যেন...

পরের রোববার। দুপুরের দিকে। চুঁচুড়ার শীলবাড়ি। কড়ি বর্গা দেওয়া দোতলার ঘর। আশেপাশে আত্মীয়স্বজনের ভিড় চোখে পড়ার মতো। পাত্রের মামা মেসো বেশ কিছুক্ষন ধরে কথা বলেছেন পাত্রীর বাবা মা এর  সাথে। থেকে থেকে বিচিত্র সব বিষয় উঠে আসছে আলোচনার মধ্যে। অধিকাংশই শারীরিক রোগ সম্পর্কিত। যেমন পাত্রের মামার অর্শর ব্যাথা,পাত্রীর বাবার হাঁটুর সমস্যা ইত্যাদি। পাত্র পাত্রী দুচারবার চোখাচোখি করলেও এখনো অবধি শব্দ খরচ করেনি কেউ। 

পাত্রের মামা : (বেশ কিছুক্ষন পর) তোরা বরং একটু কথা বল। (পাত্রীর বাবার দিকে তাকিয়ে)  ততক্ষনে চলুন আমরা একটু বাড়িটা দেখি। কি সুন্দর চারপাশটা......
পাত্রের বাবা : হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চলুন, তিনশো বছরের পুরোনো বাড়ি.......কত ইতিহাস.....কত ঘটনা....

কণ্ঠস্বরগুলো ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যায়....... 

পাত্রী : আপনি কি করেন ?
পাত্র : (সামান্য নার্ভাস) আমি মানে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি।
পাত্রী : কি দেখেন ?
পাত্র : মার্কেটিং............(তারপর থেমে থেমে) আপনি....কি....করেন  ?
পাত্রী : এস.এস.সি দিয়েছি। রেজাল্টের অপেক্ষা করছি।
পাত্র : পাবেন ?
পাত্রী : (চোখ কুঁচ্কে) মানে ?
পাত্র : না মানে আপনি ভালো স্টুডেন্ট পেয়ে যাবেন নিশ্চই। তাই না ? হেঁহেঁ.....
পাত্রী : (সামান্য গম্ভীর) আশা করি.........কেন, চাকরীতে আপনার আপত্তি আছে নাকি ?
পাত্র : নানা ছিছি। আমি ঠিক তা বলিনি.........(সামান্য একটু থেমে) আচ্ছা...... ইয়ে মানে আপনি নাচেন শুনলাম.......
পাত্রী : (রেগে গিয়ে)...আজ্ঞে না, আমি নাচি না.....আমি নাচ শিখতাম। অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি....
পাত্র : ওহ.....আচ্ছা আচ্ছা.....
পাত্রী : কেন বলুন তো ? আপনি শিখবেন ?
পাত্র : (অম্লান বদনে) হাহা......না না মানে আমি কি করে.......
পাত্রী : শুনলাম আপনিও নাকি খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন ?
পাত্র : হ্যাঁ ওই আর কি.....
পাত্রী : তাহলে খাচ্ছেন না কেন ? সব তো সাজানো আছে সামনে.....
পাত্র : তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই তেমন,.... খাবোখন.....আপনি চাপ.... (পরক্ষনেই জিভ কেটে) মানে চিন্তা করবেন না।
পাত্রী : তেমন চাইলে নিয়েও যেতে পারেন.... বলব প্যাক করে দিতে ?
পাত্র : না না ব্যস্ত হবেন না, আমি তো লাঞ্চ করে এসেছি.......
(সামান্য বিরতি)
পাত্রী : আচ্ছা, অবসর সময়ে কি করেন ? মানে আপনার হবি আছে কোনো ?
পাত্র : (ফিসফিস করে) ল্যাদ খাই....
পাত্রী : হ্যাঁ ? কি বললেন ?
পাত্র : (সামলে নিয়ে) না মানে সিনেমা দেখি, বই পড়ি, টুকটাক ছবি তোলার শখ আছে, এই আর কি....

পাত্রীর মায়ের প্রবেশ

পাত্রীর মা : (পাত্রীর দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা ওকে নিয়ে একটু ছাতে যা না বরং। আমাদের বাড়িটা দেখতে পাবে পুরোটা। (পাত্রের দিকে তাকিয়ে) তুমি যাও বাবা, ওপর থেকে ঘুরে এস, ভালো লাগবে।
পাত্রী : ফাঁকা ছাত !......ওতে আবার দেখার কি আছে ?
পাত্রীর মা : (বিরক্ত হয়ে) অাহ্ , তোর সবতাতে তর্ক।
পাত্র : (হাঁপ ছেড়ে) হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো.......
পাত্রী : (ব্যাজার মুখে) চলুন তবে.........মিষ্টিটা কি খেতে খেতে যাবেন ?
পাত্র : (ব্যস্ত হয়ে) না না থাক, ও পরে খেয়ে নেবখন.....

কলকাতা। পাত্রের বাড়ি। সন্ধ্যের দিকে, সাতটা নাগাদ। 

পাত্রের মা : (উত্তেজিত হয়ে) কি রে কেমন দেখলি ? পছন্দ তো ?
পাত্র : নাহ.....
পাত্রের মা : না মানে !!! পছন্দ হয়নি !!
পাত্র : নাহ.....
পাত্রের মা : ওমা ! সে কি কথা ! কিন্তু কেন ?
পাত্র : আঃ ! আমি অত ডিটেলস বলতে পারব না।
পাত্রের মা : আরে কি হয়েছে সেটা বলবি তো ? অপছন্দের কারণটা কি ?
পাত্র : বড্ড বাজে বকে......
পাত্রের মা : বাজে বকে !! কই আমাদের সাথে তো তেমন কিছু.......(পাত্রের বাবার দিকে তাকিয়ে) কি গো তুমি কিছু খেয়াল করেছিলে সেদিন ?
পাত্রের বাবা : কই না তো ! বরং ভালোই তো কথা বলল। একটা কনফিডেন্স দেখেছিলাম যেন.....
পাত্র : কনফিডেন্স ! হুঁহ, ওদিকে আমার সেলফ ডিফেন্সটাই ভেঙে দিল। বলছে নাকি মিষ্টি প্যাক করে দেবে।
পাত্রের বাবা : সে তো ভালো কথা। চুঁচুড়ার মিষ্টি বিখ্যাত। নাহয় দুটো নিয়েই..........
পাত্র : তুমি তো অদ্ভুত বাবা দেখছি !
পাত্রীর মা : (হতাশ হয়ে) বোঝো কাণ্ড ! আমি এখন কি বলব ওনাদের ?
পাত্র : আমি একটু ভেবে দেখি......

চুঁচুড়ার শীলবাড়ি। নিচের ঘর। 

পাত্রীর মা : তাহলে আমরা হ্যাঁ বলি ? কি গো ?
পাত্রীর বাবা : হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো। এই মাসের শেষের দিকে গিয়ে ডেটটা ফাইনাল করে ফেলা দরকার। তারপর তো মেলা কাজ আছে।
পাত্রী : দাঁড়াও দাঁড়াও, অত তাড়াহুড়ো কোরো না।
পাত্রীর মা : সেকি কথা ? তাড়াহুড়ো করব না মানে ?
পাত্রী : মানে আমার একটু সময় চাই।
পাত্রীর মা : কেন , তোর কি পছন্দ হয়নি ?
পাত্রী : কি করে হবে ? চারটে প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়। কোনোদিন শুনেছ ল্যাদ খাওয়া কারোর হবি হতে পারে ? তাছাড়া কেমন যেন। একরকম ভাবছে, আরেকরকম বলছে। আমার তো মনে হয়  ছেলেটার মাথায় ছিট্ আছে।
পাত্রীর মা : (আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে) না না, ছিট্ আবার কি। ও হয়ত ঘাবড়ে গিয়ে একটু........অমনটা তো হতেই পারে।
পাত্রী : তুমি থামো তো। কচি ছেলে নাকি যে ঘাবড়ে যাবে ?
পাত্রীর মা : সর্বনাশ ! তাহলে এবার কি হবে গো ! ওনারা তো ফোন করলেন বলে.....কি বলব ওঁদের ?
পাত্রী : আমায় একটু ভাবতে দাও.....

এর প্রায় বেশ কয়েকদিন পর। রোববার সকালবেলা। ঘরে টিভি চলছে। পাত্র আধশোয়া হয়ে ল্যাদ খাচ্ছে। হঠাৎ ফোন। 

পাত্র : হ্যালো......
পাত্রী : সকাল সকাল বিরক্ত করলাম না তো।
পাত্র : ওহ আপনি ! (অমায়িকভাবে) না না কি যে বলেন.....
পাত্রী : আসলে একটা কথা বলার ছিল। আপনার কি সময় হবে একটু ?
পাত্র : হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি তো দিব্যি ফ্রী.......না মানে....(চটপট সামলে নিয়ে) ওই একটু বাইরে যাওয়ার ছিল আরকি......
পাত্রী : ওহ....আচ্ছা তাহলে পরে করব ?
পাত্র :না না, বলুন বলুন.....এখন সময় আছে....
পাত্রী : শুনলাম আপনার নাকি এ বিয়েতে মত নেই ?
পাত্র : কই না তো ! (আবার সামলে নিয়ে) না মানে হ্যাঁ......আসলে সেদিন.....
পাত্রী : হ্যাঁ সেদিন আমি বোধহয় একটু বেশিই বলে ফেলেছিলাম। অমন করে হয়ত বলা উচিত হয়নি। তবে আপনারও কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যারাম আছে জানেন তো ?
পাত্র : (হতচকিত হয়ে) আমার !! ক্কি কি বলুন তো ?
পাত্রী : কোনো কথারই যেন ঠিকমতো উত্তর দেন না। কিছুটা পেটে রাখেন কিছুটা মুখে, কেন বলুন তো ?
পাত্র : ইয়ে মানে ওটা আমার বদভ্যাস বলতে পারেন....
পাত্রী : দেখুন কথা চেপে রাখাটা কিন্তু মোটেই পছন্দ করি না আমি, বুঝেছেন তো.....ওটা হলে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী হয় না বলে আমি মনে করি।
পাত্র : তা ঠিক....তা ঠিক......
পাত্রী : যাগ্গে, আমারটা নয় আমি শুধরে নেব, আপনি তাহলে কি ঠিক করলেন ?
পাত্র : কি করা যায় বলুন তো !
পাত্রী : এটা আমায় জিগ্গ্যেস করছেন ?
পাত্র : না মানে আমিও শুনেছি আপনিও নাকি এই বিয়েতে তেমন কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।
পাত্রী : আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, আমি কেন ফোন করেছি আজ আপনাকে ?
পাত্র : (সরল কণ্ঠে) বোধহয় এই নাম্বারটা আমারই কিনা সেটাই ভেরিফাই করার......
পাত্রী : না না আমি ঠিকই বুঝেছি আপনার মাথায় একটু ছিট্ আছে। আমি রাখছি......
পাত্র : না না শুনুন......ইয়ে শোনো.....তোমার মতটা তো জানাই হলো না.......হ্যালো........

ওপাশ থেকে ফোন কেটে যাওয়ার শব্দ। পিছনে সানাইয়ের সুর বেজে ওঠে....

(এছাড়া আরও অনেক কিছুই ঘটেছিল। সবটা লিখলে ধরানো মুশকিল। তাই যতটা সম্ভব ছোট করে বলা হল)
ছবি : রাজ দত্ত