Tuesday, April 17, 2018
ভবঘুরে
Labels:bengali short stories articles poems molat
কবিতা
Tuesday, April 10, 2018
জিয়ানস্টাল ৩ # আজবৈশাখী ঝড়
তখন আমার চার সাড়ে চার বছর বয়স। চৈত্র মাসে হপ্তাশেষের ছুটিতে মা আর আমি মামার বাড়ি গেছি। মাঝেমাঝেই আমরা শনিবার সকালে যেতুম আর রোববার সন্ধ্যের দিকে বাবা গিয়ে নিয়ে আসতো আমাদের। আমাদের এই চটজলদি হাওয়াবদলের বেশ একটা রেওয়াজ ছিল তখন। সাধারণত শনিবার হলেই সকাল সকাল বাহারি জামা প্যান্ট পরে মায়ের হাত ধরে ট্যাক্সিতে উঠে পড়তুম চেতলার মোড় থেকে। তারপর সোজা সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরতুম। চিতপুর রোড হয়ে জোড়াসাঁকোর ধার ঘেঁষে ডানদিক নিয়ে শিকদার পাড়া স্ট্রিটে এসে থামতুম। উত্তর কলকাতার অতি চেনা বনেদী পাড়ার সরু সর্পিল গলি। গলির একমাথা থেকে আরেকমাথা অবধি বাড়িগুলো এমন বেমক্কা গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকত যে মনে হত যেন গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে এসেছে। আদি ঐতিহাসিক শহরের অনন্য প্রচ্ছদ আর এক আশ্চর্য নোনাধরা দেওয়ালের গন্ধে মনটা মাখামাখি হয়ে যেত। সেই সময় চোখ বুজলেও দিব্যি বলে দিতে পারতুম মামারবাড়ির আশেপাশে কোথাও একটা এসেছি। পুরনো তিনতলা বাড়িটার নিচের তলায় একটা ছোট্ট সোনা রুপোর দোকান ছিল। চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেই কারিগরদের ছেনি হাতুড়ির ঠুক ঠুক আওয়াজ শোনা যেত। ভারি মন মাতানো ছন্দ ছিল সে শব্দে। ভিতরে ঢুকে একটা শান বাঁধানো কলতলা পেরিয়ে কাঠের রেলিং ঘেরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হতো। সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু থাকার দরুণ আমাকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হতো।
একদিন দুপুরে দোতলার ঘরে সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে। সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা পুরোনো আমলের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক, তাতে আমি, মা আর দিদা পাশাপাশি শুয়ে আছি। দাদু আর মামারা যে যার কাজে বাড়ির বাইরে। আমার অনিচ্ছা সত্বেও অকারণ ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমাকে প্রায় জোর করেই ঘুম পাড়ানো হতো। সেদিন কি এক কারণে কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। বাড়ির পূর্বদিক লাগোয়া একটা মার্বেলের কারখানা ছিল। সর্বক্ষণ মেশিনের আওয়াজ আর মিস্ত্রীদের অনর্গল কথাবার্তা শোনা যেত। মনে আছে একবার দিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম এই এতো আওয়াজে ঘুমোও কি করে। দিদা বলেছিল, 'অভ্যেস হয়ে গেছে রে, এখন এই আওয়াজটা না হলে যেন ঘুমই আসতে চায় না'। ভারী অবাক হয়েছিলুম সে কথায়।
যাইহোক সবাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখে আমি দিব্যি পা টিপে টিপে ঘরের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এলুম। এরপর বাঁদিক ঘুরে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ছাতে চলে এসেছিলুম। ছাতটা খুব বেশি বড় না হলেও উঁচু পাঁচিল আর খোপকাটা জাফরির খাঁজে খাঁজে বিকেল দেখাটা ভারী মনোরম বস্তু ছিল আমার। মান্ধাতা যুগের এজমালি ছাতে একটা চিলেকোঠার ঘর আর সামনে খানিকটা বেওয়ারিশ একফালি চৌকো মতন জায়গা ছিল। ওই জায়গাটায় দাঁড়ালে ছাতের একেবারে মাঝখানটাতে গিয়ে দাঁড়ানো হতো। সেখান থেকে চারপাশটা খুব ভালো করে দেখা যেত। ছোট ছিলাম বলে পাঁচিল পেরিয়ে নিচে রাস্তা দেখতে পেতুম না বটে তবে আশেপাশের বাড়ি আর অনেকটা খোলা আকাশ দেখতে পাওয়ার রোমাঞ্চই ছিল আলাদা।পরে শুনেছিলুম ছাতের দক্ষিণ পূর্ব কোণটা নাকি বাড়ির প্রায় সবারই প্রিয় অবসর ছিল। ওই কোণে বসার জন্য মা আর মামাদের মধ্যে নাকি হাতাহাতি হয়ে যেত প্রায়। বরাবরের মতো ছাতের একচক্কর ঘুরে আমিও ওই কোণটায় এসে দাঁড়িয়েছি।
এমন সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ভয়ানক মেঘ করেছে। পাক খেতে খেতে ধূসর তুলোটে গোলাগুলো যেন রে রে করে তেড়ে আসছে আমারই দিকে। ক্রমশ তার সাথে উড়ে এল ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত। ক্ষনিকের মধ্যেই জমাট বাঁধা দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেল যেন। স্নিগ্ধ তিরতিরে হাওয়ার এক ঝাপটায় আমার শরীরের আনাচে কানাচে আতরের মতো ছড়িয়ে পড়ল ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। এক অদ্ভুত নেশার মতো পেয়ে বসেছিল আমায়। কতক্ষন এভাবে বুঁদ হয়ে দেখছিলুম জানি না। আমার পিলে চমকে দিয়ে হঠাৎ কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল কাছেই। পাল্লা দিয়ে শুরু হল প্রবল ঝড়ের তান্ডব। চোখের সামনে এমন অপরিকল্পিত চিত্রনাট্য দেখে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলুম। তাড়াতাড়ি কোনোমতে সেই চিলেকোঠা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। চিড় খাওয়া কাঠের ফাঁক দিয়ে দেখলুম চতুর্দিক কেমন আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। যেন কেউ তুলির ওপর কালো কালি লাগিয়ে ক্রমাগত আকাশের একদিক থেকে আরেক দিকে বুলিয়ে দিচ্ছে। নাম না জানা উত্তেজনা আর অবিমিশ্র ভয়ের যুগলবন্দিতে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। অদ্ভুতভাবে নিচে নেমে যেতেও মন চাইল না। কোনো এক অনুচ্চারিত মন্ত্রবলে কিছুতেই এক পা নড়াতে পর্যন্ত পারলুম না। শোঁ শোঁ শব্দে গোটা ব্রহ্মান্ড যেন তোলপাড় করছে তখন। দরজাটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছিলুম। মনে হল এই ঝড় যেন আমায় দেখতেই হবে। এরপর যা যা হবে তা না দেখলে বড্ড আফশোষ রয়ে যাবে আমার।
একঠায় নির্বাক দাঁড়িয়ে ঝড়ের রুদ্ররূপ প্রত্যক্ষ করলুম দুচোখ ভরে। এর পরপরই শুরু হল তেড়ে বৃষ্টি। তীক্ষ্ন ছুরির ডগা দিয়ে আকাশের মাঝবরাবর কেউ যেন ফালা ফালা করে কেটে দিয়েছে। অবিরাম শ্বেত রক্তক্ষরণের বড় বড় ফোঁটায় ছাতের এক কোণ থেকে আরেক কোণ সে ভিজিয়ে দিল অবলীলায়। নিমেষে জলধ্বনির চরবর চরবর আওয়াজে আমার উৎকণ্ঠাকে দ্বিগুন বাড়িয়ে বাড়ির লোকজনকে একেবারে জাগিয়ে তুললে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার খোঁজ পড়ে গেল চারদিকে। কারণ আমার হারিয়ে যাবার বদরোগের সাথে মামার বাড়ির সকলেই বিশেষ অবগত ছিল। সে আরেক গল্প। অন্য একদিন বলব নাহয়। ততক্ষনে মা ছুটে গেছে নিচে আর দিদা আমার খোঁজে ছাতে চলে এসেছে। আমি তখন দরজার আড়ালে বিমুগ্ধ্ নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। দিদা এসে জিজ্ঞেস করেছিল, 'কি রে ! তুই কাউকে না বলে দিব্যি ছাতে এসে একলা একলা কি করছিস' ? আমি বলেছিলাম, 'এই যে কেমন ঝড় হচ্ছে ! সেটাই দেখছি গো'। দিদা বললে, 'এই ঝড় কি আর একলা বাইরে এসে দেখার জিনিস রে ? এ যে কালবৈশাখী ! তোকে যে উড়িয়ে নিয়ে যায়নি এই আমাদের ভাগ্যি, নিচে চল শিগগির'।
সেই প্রথম আমি এই ঝড়ের নাম জানলুম। কালবৈশাখীর সাথে সেই আমার প্রথম একক পরিচয়। এমন দুর্নিবার উন্মাদ আচরণ অন্য কোনো কিছুর হতে দেখিনি আগে। যে বেলাগাম দুরন্ত প্রতিচ্ছবি দেখলুম তা সেসময় অন্য কিছু দেখার কাছে নস্যি। এর তুলনা বোধহয় একমাত্র প্রথম জুরাসিক পার্ক দেখার অভিজ্ঞতার সাথে করা যায়। তবে প্রজন্মের কাঁধে মাথা রেখে ইতিহাস যে পুনঃরচিত হয় তার প্রমাণ পেলুম গতকাল হাতেনাতে।
![]() |
| চিত্র : নিজস্ব |
গতকাল ঠিক তেমনি করেই আমার তিন বছরের পুত্র তাকিয়ে ছিল বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে। বাইরে তখন দিগ্বিদিগ কাঁপিয়ে তীব্র প্রলয় চলছে। তার সাথে একের পর এক ছুটে আসছে মর্মভেদী জলের বাণ। চরম বিস্ময়ে আধো আধো গলায় সে শুধিয়েছিল, 'এতা কি হচ্ছে বাবা' ? বললুম, 'ঝড় হচ্ছে রে..... কালবৈশাখী ঝড়....... তোর ভালো লাগছে' ? সে কথার উত্তর না দিয়ে বড় বড় চোখে শুধু আলতো করে ঘাড় নেড়েছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলুম কালবৈশাখী দেখার প্রখর উন্মাদনা উজ্জ্বল আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তার সারামুখ জুড়ে। গভীর বিস্ময়ে লেপ্টে থাকা অবয়বে প্রথম ঝড়ের তৃপ্তি । যেমনটা ঠিক বছর পঁয়ত্রিশ আগে শিকদার পাড়া স্ট্রিটের কোনো এক অখ্যাত বাড়ির ছাতে একটা বছর পাঁচেকের ছেলের মুখে ছিল। অবিকল একইরকম। সোঁদা গন্ধ মেশানো, বৃষ্টি ভেজা, অনামী ছোট্ট চিলেকোঠার ছাপ। অবশ্য চরিত্রের বদল ঘটেছে, বদল ঘটেছে স্থান কালেরও। শুধু বদল হয়নি আদি অকৃত্রিম মুহূর্ত রোমাঞ্চের, বদল হয়নি বৈশাখীর......কাল ছিল......সে আজও তেমনি আছে।
#kalboishakhi #nostalgia #childhoodmemories #bengaliarticle #Molat
Labels:bengali short stories articles poems molat
জিয়ানস্টাল,
প্রবন্ধ
Subscribe to:
Comments (Atom)

