Thursday, April 8, 2021
ভাষার জুলুম
Saturday, October 17, 2020
দূরত্ত্বের মাঝামাঝি
পরবর্তী স্টেশন, কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ডানদিকে।
আগলা স্টেশন, কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ডাহিনে তরফ।
দ্য নেক্সট স্টেশন ইজ কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ইজ অন দ্য রাইট সাইড।
সুকন্যা সিট্ পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। সামাজিক দূরত্বের নিয়মে একটা সিট্ ছেড়ে বসতে হয় এখন। স্বাভাবিকভাবেই টালিগঞ্জ বা তার আগের স্টেশন থেকেই সিটগুলো ভর্তি হয়ে আসে। সুকন্যা রবীন্দ্র সরোবর থেকে ওঠে বরাবর, চারু মার্কেটের কাছাকছি থাকার ফলে সুবিধে হয়। তার গন্তব্য মহাত্মা গান্ধী রোড স্টেশন। দেরি আছে এখন। সোয়া দশটার মধ্যে ইউনিভার্সিটি ঢুকতে হবে। সাড়ে দশটায় ফার্স্ট ক্লাস।
কম্প্যারেটিভ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচারের ছাত্রী সুকন্যা, ফাইনাল ইয়ার মাস্টার্স । ভারতীয় ভাষার প্রতি অগাধ অনুরাগ। সেখানে তাকে আরও বেশি আকর্ষণ করে থিয়েটার এন্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ। এই ভালোবাসাটা সুকন্যা শিরায় উপশিরায় বয়ে বেড়ায়। এমন বিরল বিষয়ের প্রতি প্রেম খুব একটা আকস্মিক নয়। তার কারণ সুকন্যার মা একই বিষয়ের ছাত্রী ছিলেন। পাশাপাশি একটা নামী নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে কয়েক বছর মঞ্চে অভিনয় করেছেন। খুব ছোট বয়েসে সুকন্যার পিতৃবিয়োগের পর সমস্ত তালিম মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে এসেছে সে। সুতরাং এই আবহে বড় হয়ে ওঠাটা একরকম অনুঘটকের কাজ করেছে সুকন্যার বিষয় নির্বাচনে।
পরবর্তী স্টেশন যতীন দাস পার্ক, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে.......
অভ্যাসবশত সুকন্যা দেওয়ালে ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সেখান থেকে চোখ নামাতে গিয়ে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায় একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে। মধ্য পঞ্চাশের আশেপাশে বয়স হবে। ছ ফুটের কাছাকাছি হাইট, মাঝারি গড়ন। মাথায় কাঁচাপাকা ঘন চুল। চোখে রিমলেস চশমা। সুপুরুষ বললে অন্যায় কিছু বলা হবে না। ভদ্রলোক অকলুষ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। সামান্য অপ্রস্তুত হয় সুকন্যা। পথেঘাটে পুরুষ মানুষদের বিভিন্ন চাহনিতে অভ্যাস হয়ে গেছে তার। আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিতা সুকন্যার সুশ্রী চেহারায় লাবণ্যের চিহ্ন ভীষণ রকম চোখ টানে। সুকন্যা খেয়াল করে ভদ্রলোক যেন বেশ খানিকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন।
এই সামাজিক দূরত্বের সময়ে এমনটা বড় বেমানান লাগে। মুখেচোখে অস্বস্তি প্রকাশ পেলেও সুকন্যা কোনো কথা বলে না, সামান্য বাঁদিকে সরে দাঁড়ায়। যতীন দাস পার্ক স্টেশনে কিছু মানুষ ওঠার ফলে ভদ্রলোকও খানিকটা সরে আসেন সুকন্যার দিকে। সুকন্যা ভারী বিরক্ত হয় এবার, দু'পা আরও সরে দাঁড়ায়। আড়চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকায়। কি আশ্চর্য ! ভদ্রলোক এখনো অপলক চেয়ে আছেন তার দিকে তাকিয়ে। রাগে গা জ্বলে যায় সুকন্যার। বিরক্তি ভাবটা কাটাতে ব্যাগের চেন খুলে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে ঘাঁটতে থাকে আর মনে মনে ভদ্রলোকের প্রতি বাংলা ভাষার অন্য প্রয়োগ করতে থাকে।
পরবর্তী স্টেশন নেতাজি ভবন, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে.......
খানিক বাদে কামরার বাঁদিকের দরজা দিয়ে আরও কয়েকজন যাত্রী ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই সুকন্যাকে এবার ডানদিকে সরে দাঁড়াতে হয়। দু'পা দূরত্ত্বে সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। সুকন্যা গম্ভীর হয়ে বলে, "আপনি একটু সরে দাঁড়াবেন প্লিজ" ?
"আমায় বলছেন ! কেন, আমি তো সরেই দাঁড়িয়েছি"। ভদ্রলোকের স্বরে চাপা কৌতুকের ইঙ্গিত।
সুকন্যার কান লাল হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বলে, "না, সরে দাঁড়ানোটা যথেষ্ট নয়। বেসিক ডিস্ট্যান্সটা মেন্টেন করুন একটু"।
ভদ্রলোক রসিক ভঙ্গিতে জবাব দেন, "বেসিক ডিসট্যান্স বলতে যদি আপনি ছ ফিটের দূরত্ত্ব বোঝান তাহলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সেটা কতটা সম্ভব হচ্ছে তা আপনিই বলুন"।
ভদ্রলোক যে কথাটা ভুল কিছু বলেননি, এটা সুকন্যা মনে মনে বুঝলেও বাইরে তা প্রকাশ পেতে দেয় না।
আশেপাশে যে কজন যাত্রী দাঁড়িয়েছিল তারা সকলেই প্রায় ঘাড় নেড়ে সহমত প্রকাশ করে ভদ্রলোকের কথায়। মুহূর্তে কামরায় একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়। একেবারে টাটকা বিষয়ের ওপর রেখাপাত করাটা কেউই প্রায় এড়িয়ে যেতে চায় না। বিশেষ করে যেখানে একটা গোটা আস্ত পৃথিবী জড়িয়ে, সেখানে চটজলদি আলোকপাত করাটা আবশ্যিক হয়ে ওঠে।
সেটা লক্ষ্য করে সুকন্যা আরও খানিকটা গম্ভীর হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে, "কিন্তু তাই বলে সামান্য দূরত্ত্ব রাখার সৌজন্যবোধটুকুও দেখাব না আমরা, তাইত" ?
একথায় ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে তাকান সুকন্যার দিকে। বিস্ময়ে বিহ্বলতায় খানিকটা দমে যান যেন। গলার স্বরে কৌতুক উধাও হয়ে যায় পলকে। আনমনে বিড়বিড় করে বলেন, "দূরত্ত্ব রাখার সৌজন্যবোধ" !
"হ্যাঁ, দূরত্ত্ববিধি না মানাটাকে আমরা নানান অজুহাত দিয়ে বেঁধে ফেলেছি, তাই আমাদের যতই সাবধান করা হোক না কেন, আমরা নির্বিচারে সেসব জলাঞ্জলি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখি। এতে অবশ্য আর কিছু না হোক, আপনার মতো লোকেরা খানিকটা তামাশার খোরাক পেয়ে যান, আর বাকিদের জন্য সেটা খুবই বিব্রতকর হয়"। একটানা কথাগুলো বলে থেমে যায় সুকন্যা। শব্দের তীক্ষ্ণতায় কামরার গুঞ্জন খানিক নিভে আসে।
ভদ্রলোক আর কোনো কথা বলেন না। মুখ ফিরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। টানেলের দেওয়ালে খোপকাটা চৌকো আলোর সারি স্মৃতির মতো পরপর সরে যেতে থাকে তীব্র গতিতে। যে চোখে বিদ্রুপ খেলা করছিল কিছুক্ষন আগেও, সেখানে ঘনিয়ে আসে বিষণ্ণতার ধূসর। ট্রেন চলতে থাকে নির্বিবাদ দুরন্ত গতিতে, সমান লয়ে কামরার মধ্যে যান্ত্রিক শব্দের ছন্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে একটানা।
বাইরে পরপর কিছু স্টেশন বদলে যায় প্রেক্ষাপটের মতো। যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমে যাওয়ায় দুজনের মাঝখানে ব্যবধান বাড়ে। যোগ্য জবাব দেওয়ায় সুকন্যা মনেমনে পরম তৃপ্তি পায়। উটকো আলগা কথাবার্তাকে কখনোই সে পাত্তা দেয়নি, বিশেষ করে যেসমস্ত দিশাহীন আলোচনা শক্ত পাথরের মতো তার দিকে উড়ে আসে সেসব নিমেষে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তার অনমনীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। এক মুহৃর্ত আড়চোখে সুকন্যা দেখে নেয় সেই ভদ্রলোককে। একইরকম ভাবে নির্লিপ্ত হয়ে তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে। তাচ্ছিল্যের হাসি অধরপ্রান্ত ছুঁয়ে যায় সুকন্যার।
পরবর্তী স্টেশন মহাত্মা গান্ধী রোড, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে.......
সুকন্যা দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। অভ্যাসমতো ডিজিটাল স্ক্রিনে চোখ যায়, তারপর বাঁহাতের কব্জিতে সময় মেপে নেয় একপলক। কাঁটায় কাঁটায় দশটা বাজে। সুতরাং হাতে এখনো আধঘন্টা মতো সময় আছে। ক্যান্টিনে গিয়ে চট করে কিছু খেয়ে নিতে হবে, তারপর সোজা ক্লাসে। দরজা খোলার সাথে সাথে ট্রেন থেকে নেমে এগিয়ে যায় এস্কেলেটরের দিকে। কয়েক পা এগোনোর পর কে যেন পিছন থেকে ডাকে।
- এই যে শুনছেন !! হ্যালো ?.... হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি......
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সুকন্যা। কি আশ্চর্য ! ট্রেনের সেই ভদ্রলোক ! ব্যস্ত হয়ে সুকন্যার দিকে এগিয়ে আসছেন।
'কি ব্যাপার' ! কঠিনস্বরে জিজ্ঞেস করে সুকন্যা।
- আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।
- আমাকে ?
- হ্যাঁ, মানে... না বললে আর বলা হবে না বোধহয়।
- ওহ ! এতক্ষন ধরে আমাকে দেওয়ার মতো উত্তর খুঁজছিলেন, আর তাই এসেছেন আবার নতুন করে কথা বাড়াতে ? শুনুন মিস্টার ! আপনার সাথে অপচয় করার মতো সময় বা ধৈর্য কোনোটাই আমার নেই। তাই মাপ করবেন।
ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বলেন, 'না না, আপনি দূরত্ত্ব রাখার কথা বলছিলেন না ? জানেন, আমি সেই দূরত্ত্বটা প্রায় সাতাশ আঠাশ বছর ধরে মেন্টেন করে আসছি। আমার কথা দেওয়া ছিল যে, আর আজ অবধি সে কথার খেলাপ করিনি কখনো। তাই আপনার দূরত্ত্ববিধির কথাটা আমার ক্ষেত্রে ঠিক খাটে না, তাই না' ?
চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করে সুকন্যা, 'তার মানে ? কি ভুলভাল বকছেন' ?
- মানেটা বরং আপনি সুভাকে জিজ্ঞেস করবেন।
- সুভা ?
- হ্যাঁ সুভা..... মানে সুপ্রভা...... সুপ্রভা বাগচী....আপনার মা !
সুকন্যার কানের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে যেন। চরম বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে কয়েক মুহূর্ত। তারপর মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, 'আপনি আমার মা কে কিভাবে চেনেন' ?
'কই আগে তো একে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না', মনে মনে ভাবে সুকন্যা। ভদ্রলোক স্মিত হেসে বলে ওঠেন, 'যদি সময় দেন তাহলে মনের ভার কিছুটা লাঘব করতে পারি, আপনারও....... আর সাথে আমারও'। বাঁ হাত দিয়ে অনতিদূরে একটা প্ল্যাটফর্ম সিট দেখান ভদ্রলোক। সুকন্যা বাধ্য ছাত্রীর মতো সেখানে গিয়ে বসে পড়ে।
'তুমি বললে অসুবিধে নেই তো ? আপনি আমার থেকে অনেকটাই ছোট', ভদ্রলোক সম্মতি চেয়ে নেন। সুকন্যা বিনা বাক্যব্যয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। যে কিছুক্ষন আগেও দাবানলের মতো জ্বলছিল, ঘটনার আকস্মিতায় সে এখন মাঝসমুদ্রের মত স্থির। একটা সিট ছেড়ে পাশের সিটে বসেন অপরিচিত বয়স্ক। তারপর ধীরে ধীরে শুরু করেন.....
'নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, তখন আমি চুটিয়ে থিয়েটার করছি। কলকাতা শহরের বুকে যে কটা নামকরা দল ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল নাট্যদর্শন, হয়ত তুমি নাম শুনে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা শো করে বেড়াতাম। সেবার পুজোয় আমাদের জলপাইগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অভিনেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাদের পরিচালক সুপ্রভাকে নিয়ে আসেন। সুপ্রভার বাবা অর্থাৎ তোমার দাদু নারায়ণ সরকার ছিলেন পরিচালকের সহৃদয় বন্ধু। ভীষণ রাশভারী মানুষ ছিলেন। প্রথমটায় সটান নাকচ করে দিলেও পরে কতকটা নিমরাজি হয়ে সুভাকে পারমিশন দেন। রিহার্সালেই আমাদের প্রথম আলাপ। দিনের পর দিন মহড়া, একসাথে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, সমস্তটা জুড়ে একটা নতুন সম্পর্কের গন্ধ পেতে থাকি আমরা দুজনে।
জলপাইগুড়িতে আমাদের শো দারুন হিট হয়। ফিরে এসে আমরা নিয়মিত বাইরে দেখা করতে শুরু করি। তখন সুভা মাস্টার্স পড়ছে। সুতরাং অসুবিধে হয়নি খুব একটা। প্রায় বছর দুই পর আমরা মনস্থির করি যে এবার বাড়িতে জানাব। আমাদের সমস্ত স্বপ্ন মিথ্যে করে দিয়ে তোমার দাদু এই সম্পর্কটা মেনে নিলেন না। স্থায়ী রোজগেরে পাত্র ছিলাম না, তাছাড়া থিয়েটারটা ভালবেসে করতাম, দু পয়সা কামাব বলে মঞ্চে উঠিনি কখনো। নিরুপায় হয়ে ঠিক করলাম তোমার দাদুর অমতেই সুভাকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে তুলব। সুভা রাজি ছিল, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
হঠাৎ এর কয়েকমাস বাদে তোমার দাদুর হৃদরোগ ধরা পড়ল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুভাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে আমাদের যেন কখনোই বিয়ে না হয়। হ্যাঁ, শুনতে ঠিক সিনেমার মতো লাগলেও কতকটা সেরকমই ঘটেছিল। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল সেদিন। তবে আমি সম্মানহানি করিনি কারোর। ওই যেটা তুমি ট্রেনে বলছিলে - সৌজন্যবোধ, ঠিক ওই কারণেই কিছু করে উঠতে পারিনি। শুধু দগ্ধ হয়েছি তিলে তিলে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সুভা দুরত্ত্ব রাখার কথা দিয়েছিল ওর বাবাকে, আর আমি কথা দিয়েছিলাম সুভাকে। যার অন্যথা আজ অবধি হয়নি।
সুকন্যা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, 'আ....আপনার নাম' ?
- প্রশান্ত....প্রশান্ত চৌধুরী।
মাথাটা টলে যায় কেমন সুকন্যার। এই নামটা তো সে বহুকাল আগে শুনেছে মায়ের কাছে। বিস্তারিত না হলেও ভাষাভাষা একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল তার মনে। প্রশান্তকে বড় চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছা ছিল সুকন্যার। আজ সে ইচ্ছা এভাবে পূরণ হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। কি করবে সে ? মা কে জানাবে ? ওনাকেই বা কি বলবে এখন ? এই হেমন্তের সকালে সুকন্যার বুকে কালবৈশাখীর দামামা বেজে ওঠে। অধীর উত্তেজনায় গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে। কোনোরকমে জিগ্যেস করে, 'তারপর' ?
- তারপর তোমার দাদু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার মাস দুয়েকের মধ্যেই ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দেন সুভার। আমি আরো কিছুকাল থিয়েটারটা চালিয়ে যাই একইভাবে। পরবর্তীকালে দলটা ভেঙে যাওয়ায় কোনোক্রমে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়ে শহরের বাইরে চলে যাই।
- আর বিয়ে ?
- সেসব আর করা হয়ে ওঠেনি। বলতে পারো হৃদয় থেকে আর কখনো কোনো সাড়া পাইনি।
- কিন্তু আমায় চিনলেন কি করে ?
- গত পরশু তোমায় মেট্রোয় দেখে চমকে উঠেছিলাম। অবিকল তরুণী সুভার মুখ। যেমন ঋজু ভঙ্গিমা তেমনই বলিষ্ঠ চলন। তোমার ওই হ্যান্ড ব্যাগের ট্যাগে সুকন্যা বাগচী লেখা দেখে সন্দেহ হয়েছিল। শুনেছিলাম দক্ষিণ কলকাতার কোনো এক বাগচী পরিবারের সাথে সুভার বিয়ে হয়। পদবীটা মনে ছিল। তাই তোমার নামটা পরখ করতে একদিন ফেসবুকে তোমায় খুঁজলাম। ফোটো সেকশনে তোমার মায়ের সাথে তোমার কয়েকটা ছবি ছিল। এত বছর পরেও সুভাকে চিনতে আমার এতটুকু ভুল হয়নি।
এ পর্যন্ত বলে প্রশান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বেশ কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা। একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় উল্টোদিকে । কিছু যাত্রী নামে........দুরত্ত্ব বজায় রেখে যে যার নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। খানিক বাদে নীরবতা ভেঙে সুকন্যা জিজ্ঞেস করে -
- কিন্তু এতবছর আগের কথা এতদিন ধরে কেন এভাবে বয়ে বেড়ালেন ? কি পেলেন আপনি ?
একথার কোনো উত্তর দেন না প্রশান্ত। কিছু কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না বোধহয়। 'কি পেলেন' কথাটা যেন ভারী ধাতব শব্দ করে ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনটা। প্রশান্ত নির্বাক বসে থাকেন সে দিকে তাকিয়ে।
সুকন্যা ধীরে ধীরে বলে, 'আপনি কি একবার কথা বলবেন মায়ের সাথে, নাম্বার দেব' ?
- না সুকন্যা, কথা বলার হলে নাম্বার আমি আগেই জোগাড় করতে পারতাম। বরং সামাজিক দূরত্ত্বটা বজায় থাক, যে সময়টা চলে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। আর এতদিন বাদে তার কোনো অর্থও আমি দেখি না।
তুমি বরং এগোও, তোমায় আর দেরি করাব না। তোমার সাথে কথা বলব বলে আমি আমার স্টেশনের আগেই নেমে পড়েছি। পরের ট্রেনের জন্য এখানেই ওয়েট করি বরং। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল......ভালো থেকো.....
সুকন্যা কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। টালমাটাল করতে থাকে মাথাটা। ধীরে ধীরে সিট্ ছেড়ে উঠে পড়ে। দোনোমোনো করে বলে, 'কাল কি আপনি একই টাইমের মেট্রো ধরবেন' ?
- নাহ, তার আর প্রয়োজন পড়বে না। আগামীকালের ফ্লাইটে আমি দিল্লি ফিরে যাচ্ছি। কলকাতায় কয়েকদিনের জন্য একটা কাজে এসেছিলাম। আমার সব কাজ শেষ হয়েছে...
- ওহ ! আচ্ছা.....বেশ...... আমি চলি তাহলে........ ভালো থাকবেন......
কোনোরকমে কথাগুলো বলে সুকন্যা। করজোড়ে একটা নমস্কার করে সামনে এগিয়ে যায়। টিকিটিং মেশিনে চেক আউট করার আগে একবার পিছন ফিরে দেখে। ভদ্রলোক ক্লান্ত মুখে বসে আছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে যায় সুকন্যা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ব্যাগের মধ্যে ফোনটা বেজে ওঠে।
- হ্যাঁ মা।
- কিরে ! তুই ফোন করলি না ? এখনো ইউনিভার্সিটি ঢুকিসনি ?
- নাহ, আজ একটু দেরি হল......
- কেন রে ? ট্রেন লেট্ ?
- না, ট্রেন ঠিক সময়ই এসেছিল, দূরত্ত্বটা বুঝতে অনেকটা দেরি হল।
- কি আবোলতাবোল বলছিস ? কি হয়েছে ?
- প্রশান্ত চৌধুরীর সাথে দেখা হল মা। তোমার মনে আছে তুমি যার কথা আমায় বলেছিলে ?
'কে !.......কার সাথে দেখা হল ? কি নাম বললি' ? গলাটা সামান্য কেঁপে যায় সুপ্রভার। এত বছর পর পুরোনো একটা নাম শুনে মাথার ভেতরটা কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে যায়।
- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছ। প্রশান্ত চৌধুরী। অদ্ভুতভাবে মেট্রোয় দেখা হল জানো।
- মেট্রোয় দেখা হল ??.......তার মানে প্রশান্ত কলকাতায় !! কিন্তু আমি যতদূর জানতাম ও তো কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছিল !
- হ্যাঁ আমাকেও তাই বললেন। কদিনের জন্য এসেছিলেন। কালই ফিরে যাচ্ছেন। জানো তোমাদের দুজনের পুরোনো দিনের অনেক কথা বললেন। তোমাদের প্রথম দেখা, রিহার্সাল, নাটক, আরও কত কি।
- তোর সাথে এতো কথা হল !
- হ্যাঁ, হল তো । তুমি কথা বলবে একবার ? তুমি চাইলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। নিচে প্ল্যাটফর্মে বসে আছেন পরের ট্রেনের জন্য.............. কি ?.... কথা বলবে ?
'বলব বলছিস ! পারবি তুই ? পারবি একবার কথা বলিয়ে দিতে ! ছুটে যা না তাহলে একবারটি ! বল আমি কথা বলতে চাইছি', কাতরস্বরে বলেন সুপ্রভা, 'বলতে না চাইলে বলবি আমাদের প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়েছে' !
গুপ্তধন ফিরে পাওয়ার উত্তেজনায় সুপ্রভা ছটফট করতে থাকেন মনে মনে। পুরোনো যা কিছু গ্লানি, অভিমান তার কিছুটা বোধহয় লাঘব করার সময় এসেছে এবার। সুপ্রভার দুচোখ বেয়ে অপেক্ষার ধারা নেমে আসে।
'আচ্ছা দাঁড়াও আমি দেখছি', বলে সুকন্যা ফিরে যায় সিঁড়ির দিকে। ফোনে কথা বলতে বলতে প্রায় স্টেশনের গেটের কাছে এসে গেছিল। এখন অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আবার চেক ইন করতে হবে। কোনোরকমে কাঁধের ব্যাগটা সামলে সিঁড়ি বেয়ে সে তরতর করে নামতে থাকে। ডানদিক ঘুরে আবার কয়েকটা সিঁড়ি। সেখান থেকে নেমে একটা বাঁক ঘুরে তারপর টিকিটিং মেশিন। পড়িমরি করে ছুট লাগায় সুকন্যা। স্টেশনের ডিজিটাল টাইমারে এখন সময় দশটা আটত্রিশ। উনচল্লিশে পরের ট্রেন। সামনে জনা দশেকের লাইন। "ওহ ভগবান ! কি করি ! হাতে আর এক মিনিট সময় আছে", মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠে সুকন্যা । লাইনের পিছনে পিছনে এগিয়ে গিয়ে কার্ড পাঞ্চ করে ভিতরে ঢোকে। সামনে আরও কিছু সিঁড়ি পেরিয়ে তবে নিচে প্ল্যাটফর্ম।
ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যেন !
দুরন্ত গতিতে নিচে নেমে আসে সুকন্যা । ট্রেন ঢুকে পড়েছে ততক্ষনে প্ল্যাটফর্মে। সুকন্যা দৌড়ে যায় সেই প্ল্যাটফর্ম সিটটার দিকে। সিটিটা খালি ! কোথায় গেলেন প্রশান্ত। কি আশ্চর্য ! এই তো বসে ছিলেন। ট্রেনে উঠেছেন তো আদৌ ! ট্রেনের দরজা খুলে যায়। কামরাগুলো থেকে বেশ কিছু যাত্রী বেরিয়ে আসে। সুকন্যা পাগলের মতো প্রত্যেকটা কামরার দরজার কাছে গিয়ে খুঁজতে থাকে প্রশান্তকে। কোথায় গেলেন ভদ্রলোক ! যান্ত্রিক শব্দ করে কয়েক সেকেন্ড বাদেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ প্রশান্তকে দেখতে পায় সুকন্যা। পরের কামরায় জানলার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন।
দূর থেকে সুকন্যা আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, 'প্রশান্তবাবু !! প্রশান্তবাবু !! আপনার ফোন এসেছে। ........ প্রশান্তবাবু......' !
কঠিন পুরু কাঁচের জানলা ভেদ করে শব্দেরা ভিতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ট্রেন চলতে শুরু করে । সুকন্যা পাশে পাশে দৌড়তে শুরু করে..... 'প্রশান্তবাবু........আপনার ফোন......একবার কথা বলুন প্লিজ .....একটিবার অন্তত.......প্রশান্তবাবু.........' !
ট্রেন গতি বাড়ায়, সুকন্যাও কোনোরকমে টলোমলো পায়ে ছুটতে থাকে......'প্রশান্তবাবু আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন ???'.............ফোনটা ধরুন প্লিজ.!!.......... আপনার প্রায়শ্চিত্ত..............' কথাটা শেষ করতে পারে না সুকন্যা। মেট্রো পুলিশ ছুটে এসে পথ আটকায়। ট্রেন ক্রমশ গতিবেগ বাড়িয়ে উল্কার মতো ছুটে পাতাল প্রান্তের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
'প্রশান্তবাবুউউউউউ ............' !!!!!
সুকন্যার ব্যর্থ মর্মন্তুদ হাহাকার প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে আছড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িযে পড়ে ............মাঝের দুরত্ত্বটা মহাকাশের কৃষ্ণগহ্বরের মতো একটানা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বেড়েই চলে.........বাড়তেই থাকে ক্রমশ..........
![]() |
| গ্রাফিক্স : নিজস্ব |
#bengalishortstories #bengalilovestories #bengalishortfilmscript #Molat #DebdattaSinha
Friday, July 10, 2020
অনুপদ্য - ২৩
Friday, April 3, 2020
বসন্ত আটকে গেছে
পুনশ্চ : এরই মধ্যে যাঁরা আপৎকালীন পরিষেবার জন্য দিনরাত এক করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁদের জন্য আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বস্তুত আপনাদের জন্যই এযাত্রা টিকে যাব বোধহয়।
Tuesday, October 1, 2019
শর্ট ম্যাসাজ সার্ভিস
রাজু হল অল্পবয়সী খোস মেজাজি বিহারী নাপিত। বয়স ২৬ - ২৭ হবে। শ্যামলা রং, মাঝারি গড়ন, পান মশলায় বেশ আসক্তি আছে। 'একে' বলতে যাকে বোঝালো সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক চুল কাটাতে কাটাতে ভারী বীরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখেমুখে অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট । মনে মনে ভাবলেন বোধহয়, কোথাকার কোন নবাব খাঞ্জা খাঁ এসেছি যে মাত্র দুটো মিনিটেই ছেড়ে দিতে হবে ! আমি বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। অকারণ মাতামাতি সহ্য হয় না। তবু রাজু আমায় বিশেষ খাতির করে। কি কারণে করে তা বলতে পারব না। হতে পারে আমি তার কাঁচির তলায় নির্বিচারে মাথা পেতে দিই এবং সমস্ত নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলি। রাজুও দিব্যি খোশগল্প করতে থাকে আমার সাথে। তার কোনো কথায় আমি বাধা দিই না, বরং সে একজন শান্ত নির্বাক শ্রোতা পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে চুল কাটতে থাকে।
পিছন থেকে শুরু করে কানের দুপাশ দিয়ে রাজুর কাঁচি নির্বিবাদ চলতে লাগল। আর আমিও সামনের আয়নায় আমার চুলের ব্রেকিং নিউজ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। পেছনের দেওয়ালে শাহরুখ আর আমির আমার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে। প্রীতি জিন্টা সমানে মুচকি হাসছে। খানিক বাদে এই খুনখারাপির অবসান ঘটল। বরাবরই আমার চুল কাটতে বিশেষ সময় লাগে না। কমতে কমতে বর্তমান সময়ে এসে মাথার ওপর যে ক'গাছা পড়ে আছে তা ছোটবেলার স্মৃতি আর গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘাড়ের চারিদিকে খোঁচাওয়ালা পাউডার লাগিয়ে দিল রাজু। এই জিনিসটা তাকে প্রত্যেকবার বারণ করা হলেও সে শোনে না। খামোখা অত পাউডার লাগিয়ে ফুলবাবু সাজিয়ে ঠিক কি লাভ হয় বুঝিনা। অথবা হয়ত ভাবে, যে এই অবস্থায় ঠাকুর দেখে আসা সম্ভব.....
সমস্তটা হয়ে যাওয়ার পর রাজু জিজ্ঞেস করল, 'ওউর বলেন দাদা.........'
আমি খানিক ইতস্ততঃ করে বললাম, 'ইয়ে মানে তুমি তো ম্যাসাজ করো দেখি। আমার ঘাড় আর মাথার দিকটা একটু করে দিতে পারো......সকাল থেকে বড্ড টনটন করছে'।
রাজুর সারা মুখমন্ডল জুড়ে শরতের রোদ খেলে গেল যেন। আমার এহেন আবদার সে যে কিভাবে পূরণ করবে ভেবেই পেল না। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললে, 'আরে কি বলছেন দাদা, একদমসে করে দেব। আপনাকে এমন স্পেশাল ম্যাসাজ দেব যে আপনার নেশা লেগে যাবে'।
মনে মনে ভারি আশ্চর্য হলাম, 'ম্যাসাজের নেশা ! এ ব্যাটা বলে কি ! এতেও কি মানুষের আসক্তি আছে নাকি ? অবশ্যি তথাকথিত ম্যাসাজ পারলারের যে সমস্ত খবর কানে আসে তাতে করে ম্যাসাজ বিষম বস্তু হতেই পারে বৈকি'।
সে যাই হোক, রাজু সামনের ড্রয়ার খুলে সযত্নে চিরুনি আর কাঁচি রেখে দিল তাতে। তারপর দু হাত ওপরে তুলে নিজের দশটা আঙ্গুল কটমট করে ফাটিয়ে নিল। ঘাড়টা দুপাশে কাত করে নানান কায়দায় কসরত করে রেডি হয়ে গেল একেবারে। বক্সিং শুরু করার আগে ফাইটাররা যেমন করে থাকে, কতকটা সেই রকম। আমার কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এ যেন বল্লালদেবকে নিকেশ করার আগে বাহুবলী প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিনেমার দৃশ্যটা ভেবেই আমার গলা শুকিয়ে এল একেবারে। কেবলই মনে হতে লাগল একটু বেশি রিস্ক নিয়ে ফেললাম নাতো !
অবশ্য খুব একটা ভাবার অবকাশ পেলাম না। কারণ ততক্ষনে রাজু দুহাত দিয়ে কপ করে আমার মাথাটা ধরে ফেলেছে। দু আঙুলের মুদ্রায় কপালের সামনেটা টেনে টেনে ধরতে লাগল। তারপর একইভাবে ভাবে কপালের দুপাশে চক্রাকারে আঙ্গুল ঘোরাতে লাগল। বেশ আরাম পেলাম। মনে মনে রাজুর প্রতিভার তারিফ না করে পারলাম না। এরপর মাথার পিছন দিকটায় দু হাত দিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে জড়ো করে আঙুলের বিশেষ কায়দায় চটপটি বাজনার মতো করে ফটাফট শব্দ করতে লাগল। মাথার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের তরঙ্গ খেলে গেল যেন। দু চোখে অপার শান্তির ঘুম নেমে এলো আমার। কয়েক মুহূর্ত সেলুন আর স্বর্গের তফাৎ করতে পারলাম না।
বেশ খানিকক্ষণ এমনটা হবার পরে রাজু আমার কাঁধের দিকে নেমে এল। ফেনিল মসৃন ঢেউয়ের মতো সে আমার কাঁধের ওপর ছোট ছোট অবকাশে আঙ্গুল চালাতে লাগল। এমন স্তিমিত মৃদু অঙ্গুলিচালনায় মনে মনে একেবারে নিশ্চিত হলাম যে ম্যাসাজ কম্পিটিশনের ওয়ার্ল্ড কাপটা একমাত্র রাজুরই পাওয়া উচিত। এমন চমৎকার ট্যালেন্ট বুড়োশিবতলার গলিতে অবহেলায় ও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে ভেবে মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল।
হর্ষ আর করুণার দোলাচলে দুলতে দুলতে আমার অন্তরাত্মায় প্রগাঢ় আবেগ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আমার দু কাঁধের ওপর নেমে এলো বিরাশি সিক্কার দুখানি রাম রদ্দা । কতকটা সাংঘাতিক ঠোক্কর খাওয়ার মত মালুম হল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, আধা চোখ খুলে বললুম, 'ওরে আস্তে রে পাগল ! অমন করে কেউ মারে' ?
রাজু অকপট ভাবে বলল, 'এতক্ষন মেলোডি ছিল দাদা, এইবার রক দিচ্ছি'।
একথায় আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্ট্যাচুর মতো নিশ্চল হয়ে গেলাম। সে প্রাণান্তকর কথা অনুধাবন করতে খানিক সময় লাগল আমার মতো মূর্খের। যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। দু কথা বলার অবকাশ পর্যন্ত সে দিল না আমায়। তার আগেই আমার বাঁ হাতটা টেনে ধরে গামছার জল নিংড়ানোর মতো করে মোচড়াতে শুরু করলে। আমার চোখে কালবৈশাখীর আঁধার নেমে এল প্রায়।
ঢোঁক গিলে বললুম, 'একি কচ্ছিস রাজু ? হাতটা তো খুলে যাবে মাইরি' !
রাজু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলল, 'কি যে বলেন দাদা, হাত আবার অমনি খুলে যায় নাকি ! একি টেবিলের ড্রয়ার না আলমারির দরজা, যে টানলাম আর খুলে গেল' !
আমি প্রায় হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলাম, বললুম, 'ছেড়ে দে সোনাভাই আমার, ছেড়ে দে আমায়, যথেষ্ট হয়েছে আমি আর ম্যাসাজ নিতে চাইনা, এই অবধিই নেওয়ার ছিল আমার, আজ আর নয়.......'
রাজু শোনার পাত্র নয়। ঘাড় নেড়ে বললে, ' তা বললে কি হয় দাদা, এতদিন বাদে আপনি ম্যাসাজ নিচ্ছেন, অমন ছেড়ে দেয়া যায় নাকি ? সবে তো শুরু হল, এবার পিঠটা ভালো করে চাপড়ে দলাই মলাই না করলে মনেই হবে না যে ম্যাসাজ হচ্ছে'।
আমি কাতর ভাবে রাজুকে বললাম, 'দ্যাখ রাজু, এতদিন ম্যাসাজ নিইনি মানে এই নয়, যে আজ আমাকে পুরোটা উসুল করে নিতে হবে। আর তাছাড়া খামোখা আমার পিঠ চাপড়ে কি করবি বল ? বলার মতো তো তেমন কোনো কাজ করে উঠতে পারিনি আমি, সুতরাং অত তরিবত না করলেও চলবে......... আ - আমায় ছেড়ে দে ভাইটি.....'
রাজুর প্রত্যয়ী মুখে চোখে তেমন কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেল না। তবু আমি চেষ্টা করতে ছাড়লাম না। ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, 'শোন না, লক্ষ্মী ভাইটি, আমার না হঠাৎ একটা অফিসের কাজ মনে পড়েছে, বাড়িতে গিয়ে চট করে করতে হবে বুঝলি, আজ ছেড়ে দে, পরে নাহয় অন্য কোনো একদিন..........'
রাজু আমার ছেলে ভোলানো কথাকে অবলীলায় ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল, 'না দাদা, রোববারে আবার অফিসের কাজ কি, আর এতো কাজ করে করেই তো পিঠে ব্যথা হয়েছে। এরপর তো কোমর আছে, আপনি আরাম করে বসুন না, ঘাবড়াচ্ছেন কেন.....পিঠের বাইপাস ম্যাসাজটা আমি দেবই' ।
বাইপাস ম্যাসাজ !! আতঙ্কে আমার পেটের ভেতর সবকিছু যেন ফণীর ঝড়ের মতো গুলিয়ে উঠল। আমি প্রায় কেঁদে উঠে বললুম, 'ওরে ! আমার কোমরের দায়ভার তোর না নিলেও চলবে ভাই, বাঁকা পথ দিয়ে তাও মানুষ ভবনদী পেরোতে পারে কিন্তু ভাঙা কোমর নিয়ে আমি যে সরু নালাও টপকাতে পারব না'।
আমার কথার মর্মার্থ তার মাথায় ঢুকল কিনা জানি না কিন্তু আমাকে সে একেবারে প্রশ্রয় দিল না। বলল, 'অত ভয় পাচ্ছেন কেন দাদা, দেখুন না কেমন জম্পেশ টাইপের করে দিচ্ছি' ।
আড়চোখে দেখলাম, আশেপাশের লোকজন কেউই এই যাত্রাপালাটা মিস করছে না। দু চারজন সেলুনের বাইরেও জড়ো হয়েছে বিনি পয়সার কমেডি দেখবে বলে। আমার কেবলই মনে হতে লাগল আমার মতো অসহায় জীব এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ নেই।
তবে উল্টোদিক থেকে ভয় পাওয়ার কথা বললে চিরকালই বাঙালির পৌরুষে আঘাত লাগে, আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। ভিতরে ভিতরে কলজের মুড়োটা আচ্ছা করে বেঁধে নিলাম আমার দুঃসাহসের ফিতে দিয়ে। সাদা আলখাল্লার ভেতর দিয়ে প্রাণপণে চেয়ারের হ্যান্ডেল চেপে ধরলাম। এরপর যা শুরু হল তার সাথে একপ্রকার নটরাজের নৃত্যেরই তুলনা করা যায়।
কোনোমতে নাক মুখ গুঁজে নিরুপায় হয়ে সহ্য করতে লাগলাম সেসব। ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করল না। প্রীতি জিনটা নির্ঘাত শাহরুখ আর আমিরের সাথে মিলে আমায় ট্রোল করছে। মনে হল সেলুনের বাকিরাও ভোগের বাতাসের মতো সবটুকু সাঁতলে লুটেপুটে নিচ্ছে। আমি প্রায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম। সীতা হলে বলতুম - ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু এখানে কোনো কিছুই বলে উঠতে পারলুম না। আর বললেই বা ! শুনছে কৈ ?
পিঠ চাপড়ানো শেষ হতে রাজু এবার কোমর নিয়ে পড়ল। যা চলল তাতে করে কোমরের কৌমার্য হরণ হল বলা যায়। চোখের সামনে আমার বাঁচার কোনো রাস্তাই আর খোলা দেখতে পেলুম না। কোমরের ওপর দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে সে আমার শিরদাঁড়ার প্রতিটা হাড় যথাস্থানে আছে কিনা একেবারে অর্থোপেডিক ডাক্তারের মতো পরখ করতে লাগল। আয়নায় নিজের কাতর মুখটা দেখে আমি আরও বিমর্ষ হয়ে পড়লুম। নিজের এতো করুন মুখ আমি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমার অন্তঃরাত্মা হাহাকার করে উঠল সে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ম্যাসাজের ঠেলায়।
আরো মিনিট দশেক বাদে সে বিষাক্ত তান্ডব শেষ হল। ঝড়ের শেষে তালগাছ যেমন একদিকে হেলে নুয়ে পড়ে, আমিও কতকটা ডানদিকে হেলে কাত হয়ে গেলাম। চেয়ারের হ্যান্ডেলের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে তৃভঙ্গমুরারীর কায়দায় উঠে দাঁড়ালাম। রাজু একগাল হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। বুঝতে পারলাম দারুন বা সাবাশ টাইপের কিছু একটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মনে হল ওর চুলের মুঠিটা ধরে সামনের আয়নায় মাথাটা ঠুকে চুরমার করে দিই। পুলিশি হ্যাপা আমার পোষাবে না ভেবে ওই প্ল্যান ভেস্তে দিলুম মনে মনেই। বিশেষ কিছুই আর বলতে ইচ্ছে করল না আমার, তবু কোনোরকমে দাঁত চেপে, বাঁকা মুখ করে বললাম, 'টাকাটা রাখ, পুজো ভালো কাটাস.......'
বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে। বহুযুগ আগে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় মহাভারত সিরিয়ালে শকুনির চরিত্রে গুফি পেন্টাল যেভাবে হেঁটেছিল আমিও কার্যত কতকটা তেমনই আধা খুঁড়িয়ে আধা বেঁকে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা চালালুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম ম্যাসাজের মায়াজালে আর নয় রে ভাই। যতই হোক, পিতৃদত্ত প্রাণের সাথে ছেলেখেলা করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।
যাঁরা নিয়মিত ম্যাসাজ নেন এবং ম্যাসাজ নেওয়াটাকে প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছেন তাঁরা নিশ্চই ভাবছেন, ওঃ ! ছেলের যেন ননীর শরীর, সামান্য ম্যাসাজেই কাতর হয়ে পড়েছে ! কৈ ! আমরা তো এতো বছর ধরে নিচ্ছি আমাদের তো কিছু হয়নি। তাঁদেরকে হাত জোড় করে বলি, আপনারা প্রণম্য ব্যক্তি, ঈশ্বর আপনাদের সাহস ও শক্তি দুটোই দিয়েছেন। তবে বিশ্বাস করুন, এর থেকে মেট্রো বা বনগাঁ লোকালের ভিড় সামলানো সহজ, সারারাত কালী পুজোর মাইকের অত্যাচার এর কাছে নস্যি, এমনকি খালি পায়ে গরম পিচের রাস্তায় হাঁটাও সুখের, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তাতে করে ম্যাসাজ কথাটা আমার কাছে যে আমৃত্যু বিভীষিকাময় অসুর হয়েই থাকবে এ বলাই বাহুল্য......
তবে আপনাদের সবার পুজো নির্ভাবনায় ও নির্বিবাদে ভালো কাটুক এই কামনা করি......শুভ শারদীয়া।
#pujobarshiki #bengalishortstories #pujastories #bengalihumours #molat #DebdattaSinha
Saturday, August 10, 2019
বন্ধু চল # ৪ - ফলতা
![]() |
| ছবি : সৌম্য |
![]() |
| ছবি : নিজস্ব |
প্রথমটায় কটেজ বুক করা ছিল। দেখার পর নাপসন্দ করে আমরা সোজা একটা ডিলাক্স রুম ভাড়া
![]() |
| ছবি : হোটেল সি বার্ড |
দুপুর গড়িয়ে, বিকেল পেরিয়ে কখন সন্ধ্যে নেমেছে আমাদের খেয়াল ছিল না। সিনেমা শেষ হতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরেটা ধূসর হয়ে এসেছে। হোটেলের বাইরে গঙ্গার পারে বসে চা খাব বলে ঠিক করলাম। দু মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে গঙ্গার পারে এসে দেখলাম একটা ঢাউস স্টিমার নদীর একেবারে মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে জিরোচ্ছে বলে মনে হল। হলদিয়ার বন্দরটা সীমান্তের শেষে আবছায়া দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপরে টিমটিমে আলোয় একটা চায়ের দোকানে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। তার সোঁদা গন্ধ কুণ্ডলী পাকিয়ে নদী পেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। দোকানের পাশেই ভূত বাংলোর মতো একটা সাদা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। অন্ধকারে কয়েক বছরের জীর্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। বেশ একটা গা ছমছমে মায়াবী পরিবেশ। বেশি দূর এগোলাম না আর আমরা। একটা শান বাঁধানো ধাপিতে বসে খানিক গুলতানি করে আবার পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
ফিরে এসে আবার আরেক রাউন্ড সিনেমা। যেন সিনেমা দেখাই মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের। অবশ্য বিনা বাধায় বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পাওয়া অনেকটা লটারি পাওয়ার মতোই। যাঁরা বিবাহিত তাঁরা নিশ্চই সহমত হবেন আমার সঙ্গে। আপনার পছন্দের সেরা ছবিটা টিভিতে চলছে, আর আপনি নিশ্চিন্তে বসে মৌজ করে সেটা গিলছেন, এমনটা আপনার কপালে যদি জুটে থাকে তাহলে আপনি যথেষ্ট ঈর্ষার পাত্র। খানিক সিনেমা দেখে আর বেশ খানিকটা আড্ডা মেরে আমাদের সময় কাটছিল। রাতে তন্দুরি রুটি আর মালাই কোফতা খেয়ে দিব্যি আমেজ এল। বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেদেরই খেয়াল ছিল না।
পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল। সৌম্যর ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বেচারা কোনো কাজ না পেয়ে ঘরের টেবিল চেয়ার সরিয়ে ঠিক করে রাখছিল। সংসারী ছেলে। সেসবের আওয়াজেই ঘুম ভাঙে আমার। এমন নির্ঝঞ্ঝাট অলস সকাল শেষ কবে পেয়েছিলুম মনে করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার দিকে। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বুকভরা অজস্র মুহূর্ত আর বেঁচে থাকার রসদটুকু। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে পিছুটান ভুলে এমন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অনেকটা দূরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরাটা একটু বেপরোয়া হলেও দিব্যি লেগেছিল কিন্তু আমাদের।
এই প্রসঙ্গে বলি - পরের বারটার জন্য একটা বেড়ে লোকেশন খুঁজছি.....জানা থাকলে বলবেন তো.....
কৃতজ্ঞতা : সৌম্য ও সৌম্যর বাইক
![]() |
| ছবি : নিজস্ব |
Friday, June 14, 2019
পিচ-বৃষ্টি ও আন্দোলন
জনৈক উচ্চপদস্থ এক আইসিসি কর্মকর্তা বলেছেন যে ওনারা জানতেন ইংল্যাণ্ডে বৃষ্টি হবে তবে দ্বিগুন বৃষ্টি হবে সেটা নাকি আগাম আঁচ করতে পারেন নি। আবহাওয়াবিদরা অনেক আগেই বলেছেন এই সময়টায় বৃষ্টি হবে - এটাই যথেষ্ট নয় কি এবং সেটা জানার পরও এই সময় ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেললেন কি কারণে ? থর কি হাতুড়ি মারফত স্বপ্নাদেশে বরাভয় দান করেছিলেন নাকি আগাম সতর্কবার্তাকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তারা বলতে চেয়েছিলেন "চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা"...…..
Thursday, May 2, 2019
অনুপদ্য - ২২
Saturday, March 16, 2019
প্যহলে ভোট, ফির ইন্টারভিউ...
একটা আলগা হাসি খেলে যায় শ্যামশরণের দু চোখ জুড়ে...…..
#firstindianvoter #shyamsarannegi #electioncommissionbrandambassador #parliamentelection2014 #bengaliarticle #bengalishortstories #molat
Saturday, February 2, 2019
স্বপ্নের মতো
আমার সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে, এহেন মোক্ষম সময় এক সহৃদয় প্রকাশনা এগিয়ে এলেন এবং আমার মতো আরো নতুন কলমদের সুযোগ দেওয়ার মনস্থির করলেন। এবং সঙ্গে এও জানালেন যে এই বইয়ের প্রকাশ হবে যে সে জায়গায় নয়, হবে একেবারে এবছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। প্রথমটায় বিশ্বাস করতে মন চায়নি কারণ আমার সাথে কোনো প্রকাশক নিজের থেকেই যোগাযোগ করবেন এটা কতকটা অলীক স্বপ্নের মতো। তাই কুণ্ঠায় মাখামাখি হয়ে আমার দুটি গল্প এগিয়ে দিয়েছিলাম প্রকাশকের টেবিলে। ভেবেছিলাম সহস্র গল্পের ভিড়ে তাদের বোধহয় পথভ্রম হবে। কিন্তু আমার সমস্ত আশঙ্কা মিথ্যে করে 'ছায়াসঙ্গী' জায়গা করে নিল উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রাদের মাঝে, প্রতিলিপির আকাশে।
সূচিপত্রে নাম দেখে প্রথম হওয়া প্রেমের মতো বুক কেঁপে উঠেছিল। আত্মহারা হয়ে রাস্তার ধারেই মোবাইল ধরে দাঁড়িয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। রঙিন মলাটের ফাঁকে আমার 'মলাটের' পাতা থেকে উঠে আসা গল্প, মধুর বিস্ময়ে থমকে আছে প্রকাশের অপেক্ষায়, পাঠকের অপেক্ষায়, বইমেলার অপেক্ষায়। উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দিরের কর্মকর্তা এবং সম্পাদকদ্বয় মৌমিতা দত্ত ও শুভ্রজ্যোতি পাল - কে আমার অনেক ভালোবাসা ও সেলাম। শেষের পাতায় কিংবদন্তি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দু চার পংক্তি লেখা শিহরণ জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট। সর্বোপরি আমার সমস্ত পাঠকদের আমার নতুন করে কিচ্ছু বলার নেই, পাশে থেকে এই পিঠ চাপড়ানোটা না পেলে হয়ত এটা কখনোই সম্ভব হতো না। আপনাদের সকলকে কুর্নিশ।Saturday, October 6, 2018
সাপ্তাহিকী ৩৮ # বিবাহ বিভ্রাট
পার্বতী : কি ব্যাপার রে ? এই সাতসকালে পোগোর মোষের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস কেন ? কিছু হয়েছে ?
মহিষাসুর করুন মুখে ঘুরে তাকাল । চোখের জলে সাধের পাকানো গোঁফটা পর্যন্ত ভিজে জবজব করছে। পার্বতীর দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়াল । অর্থাৎ কিচ্ছু হয় নি।
পার্বতী : (বিরক্ত হয়ে) তাহলে কাঁদছিস যে বড় ?...….ওহ ! কুসুমদোলা দেখেছিস বুঝি ?
মহিষাসুর সেকথাতেও দুদিকে ঘাড় নাড়াল।
পার্বতী : (আতঙ্কিত হয়ে) তবে কি ডাস্টিং করতে গিয়ে কাঁচের ফুলদানিটা ভাঙলি ?
মহিষাসুর : (করুণসুরে) না, তা নয়…
পার্বতী : (গম্ভীর গলায়) বাবা কি কিছু বলেছে ? আমি কিন্তু জানি, ইদানিং তুমি বাবার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে গাঁজা ভাঙ ধরেছ। রোজ সন্ধ্যেয় ওই পিপুল গাছের আড়ালে তোমাদের আড্ডা বসে।
মহিষাসুর : (কাঁদো কাঁদো হয়ে) না মা, সেসব নয়…..
পার্বতী : (ভীষণ রেগে গিয়ে) তবে কি আসল কথাটা বলবি, নাকি উঠোনের মুড়ো ঝ্যাঁটাটা দিয়ে আচ্ছা করে ঘা কতক দেব ?
একথায় মহিষাসুর প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠল।
পার্বতী : (মেগা বিরক্ত হয়ে) এতো আচ্ছা ঝামেলা হল দেখছি.....
শিব : (ত্রিশূল নিয়ে যোগাসন করতে করতে) কৈ গো ! লুচি আনতে যে রাত কাবার করে দিলে। পেট তো জ্বলে যাচ্ছে।
পার্বতী : এদিকে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। সকাল সকাল মহিষটা কেমন মরা কান্না জুড়েছে দ্যাখো।
শিব : (চোখ মুখ কচ্লে মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে) কি আশ্চর্য ! তুই কাঁদছিস কেন !! নাহয় কাল একটু বেশিই হয়ে গেছিল। তাই বলে সামান্য হ্যাংওভারও যদি সকালবেলাতে কাটিয়ে না উঠতে পারিস, তাহলে আজ থেকে আর পিপুলের পিছনে আসিস না বাপু। লোকের কাছে মান থাকে না আমার।
মহিষাসুর : আঃ, কি আবোল তাবোল বকছেন মাইরি ! বলছি তো সেসব কিছু নয়।
শিব : তবে কি ডান্স বাংলা ডান্সে সিলেকশন হয়নি বলে মন খারাপ ? আমি আগেই বলেছিলুম ওসব তোর কম্ম নয়। আমার কাছে ট্রেনিংটা পর্যন্ত নিলি না ঠিক করে।
মহিষাসুর : (কান্না থামিয়ে) নিকুচি করেছে...... (তারপর জোর গলায়) এবার পুজোয় আমি মর্ত্যে যাব না।
এই শুনে পার্বতী তাড়াতাড়ি লুচির থালাটা শিবের হাতে চালান করে দিয়ে কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়ালেন।
পার্বতী : (অত্যন্ত রেগে) তার মানে ?
মহিষাসুর : (মিন মিন করে) মানে আমি ঠিক করেছি আমি যাব না।
পার্বতী : একি ইয়ার্কি হচ্ছে !! সমস্ত জায়গায় প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেছে, চতুর্দিকে নীলসাদা রং হয়ে গেছে, পুজো কমিটিদের কোটি টাকা দেওয়া হয়ে গেছে, মহালয়ার প্রোমো পর্যন্ত চলছে, আর এখন বলছিস যাব না !
মহিষাসুর : (মাথা নিচু করে) না, এবারটা আমায় ছেড়ে দিন…..
শিব: (শান্ত হয়ে লুচি চিবোতে চিবোতে) আঃ ছেড়ে দাও না, যেতে যখন চাইছে না তখন খামোখা টানাটানি করে লাভ কি ? নাহয় আমার সাথেই থাকল ওই ক'দিন।
পার্বতী : (ক্ষিপ্তস্বরে) হুঁহ, ওকে তোমার কাছে ছেড়ে দিয়ে যাই আর সকলে মিলে এখানে মোচ্ছবের মহল্লা তৈরী করো। ওটি হচ্ছে না। (তারপর মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে) অ্যাই ন্যাশনাল জিওগ্রাফির রিজেক্টেড মোষ ! আসল কারণটা বল এক্ষুনি, নাহলে তোকে যেকোনো একটা ব্রিজের নিচে বেঁধে রেখে আসব, এই বলে দিলুম।
সকলে উৎসুক নেত্রে মহিষাসুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নন্দী, ভৃঙ্গী, গণেশ, কার্ত্তিক সকলে মজা দেখবে বলে পায়ে পায়ে এসে জড় হল সামনে। শিবের তৃতীয় নয়ন পর্যন্ত খুলে গিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। মহিষাসুর কতকটা কাঁচুমাচু হয়ে মুখ খুলল অবশেষে।
মহিষাসুর : (খানিক লজ্জা পেয়ে, আমতা আমতা করে) ইয়ে, মানে... আমি বিয়ে করব…..
কৈলাশে যেন বাজে পড়ল তৎক্ষণাৎ। শিবের মুখ থেকে লুচির টুকরো খসে পড়ল মাটিতে। পার্বতী প্রকাণ্ড একটা হাঁ করে রইলেন। সকলে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন একঠায়। এমন আজব, অস্বাভাবিক কথায় কারোর মুখে রা পর্যন্ত সরল না। কি বলবেন, কি করবেন, কেউ বুঝেই উঠতে পারলেন না। মধ্যিখান থেকে গনেশ আর কার্ত্তিক 'মামা বিয়ে করবে, মামা বিয়ে করবে' বলে হর্ষধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললে একেবারে। আকস্মিক সংবাদের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠলেন পার্বতী।
পার্বতী : (গলা খাঁকরে) তুই যা বলছিস, ভেবে বলছিস তো ?
মহিষাসুর : (আরও খানিকটা লজ্জা পেয়ে) হ্যাঁ.... আমি বিয়ে করব…..
পার্বতী : তোকে ঠাস করে এক চড় মারব.......... উটপাখির এরোপ্লেন হওয়ার শখ ! বাথরুম সিঙ্গার নাকি কোক ষ্টুডিও যাবে ! বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ?
শিব : (মোলায়েম স্বরে) আহা, ওকে অত তড়পাচ্ছ কেন ? বেচারা বিয়েই তো করবে বলেছে, রোহিঙ্গা তাড়াবে তো আর বলেনি।
পার্বতী : ওহ ! বেচারা ? মাইনরিটি সেকশন ? রোজ সকালে, তোমার ব্লাড সুগারের জন্য কচি নিমপাতা কি নিজে থেঁতো করবে ভাবছ ? তাছাড়া সারা সপ্তাহের বাজার, দোকানের জিনিসপত্র, মাস গেলে আমার মোবাইলের রিচার্জ, সংসারের আরও যাবতীয় খুঁটিনাটি এসব কে করবে শুনি.......তুমি ?
শিব : আহা ! এসব তো আর ও একা করে না, নন্দীরাও তো হেল্প করে, নাকি ?
পার্বতী : হেল্প !! কে কি করে জানা আছে তোমার ? খোঁজ রাখো কিছুর ? যবে থেকে ওয়ার্ল্ড যোগা ডে চালু হয়েছে তবে থেকে পাড়ার দেবদেবীদের নিয়ে তোমার ব্যাচের পর ব্যাচ যোগা ট্রেনিং চলে। আর সন্ধ্যে হলেই পিপুল গাছের পিছনে চলে যাওয়া। এই তো তোমার রুটিন। ছেলেমেয়েগুলোকে একটু টিউশন থেকে নিয়েও তো আসতে পারো।
শিব : এই দ্যাখো, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে চলে যাচ্ছে.....
এমন সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে নারদমুনির প্রবেশ। ইনফাইনাইট লুপে 'নারায়ণ নারায়ণ' ছাড়াও ইদানিং 'দিল দিয়া গল্লা' গানটা খুব শুনছেন। গানের পজ বাটনটা টিপে, হেডফোন খুলে সামনের দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
নারদ : (পার্বতীর দিকে তাকিয়ে) পেন্নাম হই জগজ্জননী......(শিবের দিকে তাকিয়ে) জয় মহাদেবের জয় !
সকাল সকাল নারদের এমন অনাহূত আগমনে শিব ভারী বিরক্ত হলেন। একটা লুচি মুখে চালান করে দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন...…
শিব : ওই এল ! এক নম্বরের বিসি.....
নারদ : আজ্ঞে , কিছু বললেন মহাদেব ?
শিব : (শশব্যস্ত হয়ে), কই, কিছু না তো !
নারদ : আমার মনে হল আপনি বোধহয় আমাকে কাঁচা ভাষায় কিছু একটা বললেন।
শিব : (অমায়িক হেসে) ও কিছু নয় রে পাগলা, ও কিছু নয়। আমি বলছিলাম তুমি হলে কিনা স্বর্গের ব্রডকাস্টিং চ্যানেল অর্থাৎ বিসি । হেঁ হেঁ হেঁ......তুমি চাপ নিও না নাড়ু। তা আজ, এদিকে ? কি মনে করে ?
নারদ : না আমি তো আসলে দিল দিয়া শুনতে শুনতে (পরক্ষনেই সামলে নিয়ে) আই মিন এ দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় হট্টগোল শুনে থমকে দাঁড়ালাম, ভাবলাম কৈলাসে আবার কোন কেলেঙ্কারি হল, দেখে যাই।
শিব : ("শশালা….বা…....") (গলা খাঁকরে) তা বেশ করেছ……..লুচি খাবে ?
শিব লুচির থালাটা বাড়িয়ে দেন সামনে।
নারদ : (শিবের মনের কথাটা খানিক আঁচ করে) আজ্ঞে না, আপনি চিবোন....... (তারপর পার্বতীর দিকে তাকিয়ে).....কি হয়েছে মা, এখানে এত চেঁচামেচি কিসের ?
গনেশ : (ফিচেল হাসি দিয়ে) মামা বলছে বিয়ে করবে.....
কার্ত্তিক : আর আমি নিতবর হব........
নারদ : (অত্যাশ্চর্য হয়ে) বলিস কি !!!
পার্বতী : কি আর বলব রে নাড়ু, এসব হচ্ছে বাংলা সিরিয়াল দেখার ফল। যথেচ্ছ বিয়ে আর পরকীয়া দেখে মহিষের মাথাটা গুবলেট হয়ে গেছে একেবারে। বলছে মর্ত্যে যাবে না, বিয়ে করবে। এই লাস্ট মোমেন্টে এসব হ্যাপা কি পোষায় বল দিকি !
নারদ : (গম্ভীর হয়ে) কঠিন সমস্যা মা….. আপনার কথাও ঠিক আবার দেখতে গেলে মহিষেরও একটা ন্যায্য দাবি আছে। কোনোটাই ফেলে দেবার নয়। আমার মনে হয় এই সময় একমাত্র যিনি হেল্প করতে পারেন, তিনি হলেন পরম কল্যাণময় স্বয়ং নারায়ণ।
শিব : (মনে মনে) ব্যাস ! একা নরেন রক্ষে নেই, রাহুল দোসর......
পার্বতী : (চিন্তান্বিত হয়ে) বলছিস ! উনি পারবেন ?
নারদ : হেঁ হেঁ,... কি যে বলেন মা ! উনি পারেন না বিশ্বসংসারে এমন কাজ কই !
শিব : (তির্যক ভাবে) হ্যাঁ ! সে আর বলতে ……(পরক্ষনেই গলা খাঁকরে) তবে ওনার কি সময় হবে ?
নারদ : আজ্ঞে হ্যাঁ, এই সময়টা তো উনি ফেসবুকে 'পপুলার বেঙ্গলি জোকস' পড়েন। সকলে মিলে স্মরণ করুন, এক্ষুনি আবির্ভূত হবেন।
একথায় সকলে মিলে হাতজোড় করে নারায়ণ স্তব করতে লাগলেন। যথাসময়ে তেজদীপ্ত আলোকরশ্মির মধ্যে দিয়ে সাদা শার্ট আর জিন্স পরিহিত চতুর্ভূজ, কমলকান্তি শ্রীবিষ্ণু প্রকট হলেন স্বমহিমায়। সকলেই নতজানু হয়ে শ্রীবিষ্ণুর অভ্যর্থনা করলেন। এমন সময় ……..
নন্দী : (আর্তনাদ করে) ওরে বাবারে, ওরে দাদারে, লাগছে লাগছে ...…..
সবাই মিলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সবিস্ময়ে নন্দীর দিকে ঘুরে তাকালেন। নারায়ণও ভারী বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নন্দীকে দেখলেন।
নন্দী : (নারায়ণের দিকে তাকিয়ে) আঃ ! পা'টা ছাড়ুন মাইরি, ছাড়ুন প্লিজ। ডানদিক বাঁদিক না তাকিয়ে একেবারে সোজা আমার পায়ের উপর এসে প্রকট হলেন যে বড় ! কি ভেবে ? হ্যাঁ ??
নারায়ণ ব্যাপারটা আঁচ করে তড়াক করে লাফ দিয়ে পাশে সরে দাঁড়ালেন।
নারায়ণ : (জিভ কেটে) ইসসস্স, একদম দেখতে পায়নি না রে ভাইপো। আসলে আমার জিপিএসটা ক'দিন ধরে খুব গোলমাল করছে। ল্যাটিচিউড লঙ্গিচিউড মোটে মিলছে না। এই তো কদিন আগে ভোরভোর একটু ঝিলের ধারে জগিং করতে যাব বলে চোখ বুজে জিপিএসটা অন করলুম । চোখ খুলে দেখি যমপত্নীর কোলে শুয়ে আছি। কি লজ্জা কি লজ্জা !.......
পার্বতী : সে যাগ্গে। এদিকে শুনেছ তো কেমন গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। কি করবে এবার দ্যাখো, আমরা তো আর ওকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পারছি না বাপু।
নারায়ণ : হ্যাঁ মা। আমার অজ্ঞাত কিছুই নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সালটে নিচ্ছি পুরোটা। (এরপর মহিষের দিকে তাকিয়ে) দ্যাখো ছোটভাই, বিয়ের চিন্তাভাবনা করছ এ অতি ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে তোমার একটা দায়িত্ত্ব আছে সেটা ভুলে গেলে চলবে কি করে ?
মহিষ : বেশ তো। আমার বিয়েটা আগে দিয়ে দিন। তারপর মর্ত্যে যাব, কোনো চাপ নেই।
নারায়ণ : আহাহাহা, কি মুশকিল ! বিয়েটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া বিয়ের জোগাড় করতেও তো সময় লাগে নাকি ? উঠল বাই আর সিঙ্গুর যাই অমন করলে চলে নাকি। সবকিছুরই একটা ভেবে দেখার বিষয় আছে। আর কেউ তো বলছে না বিয়ে কোরো না। পুজোটা ভালোই ভালোই মিটিয়ে এসে ছাদনাতলায় বসলেই হল। ঠিক কিনা ?
একথায় মহিষ গম্ভীর মুখে বারমুডার পকেট থেকে চারটি কাঁঠাল পাতা বের করে চোখ বুজে চিবোতে লাগল। নারায়ণের কথায় খানিক জাবর কাটল বটে কিন্তু সঠিক মনস্থির করে উঠতে পারল না।
মহিষ : নাহ, আপনি আমায় কথার জালে ফাঁসাচ্ছেন মাইরি।
নারায়ণ : আরে, এতো আচ্ছা পাগল ! একি লোকসভার ইলেকশন হচ্ছে নাকি ? তোমায় ফাঁসিয়ে কার কি লাভ হবে শুনি ? আর তাছাড়া বড়রা যখন বলছেন তখন অমন জেদ করতে নেই। আমরা তো বলছি বিয়ে হবে। কথা দিচ্ছি।
মহিষ : নাহ, আপনারা কাজ গুছিয়ে নিতে ওস্তাদ। কাজ হয়ে গেলে আর ফিরেও তাকাবেন না, আমি জানি।
পার্বতী : মারব এক থাপ্পড়। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস ? বড়দের মুখে মুখে চোপা !
শিব : আঃ পারো। এই সময় ভায়োলেন্স নয়। কমন সেন্স ইউজ করো। ওর দোষ কোথায় ? যুগের পর যুগ ধরে তো ভুগছে। আচ্ছে দিন এসেছে কি ? ডিজিটাল স্বর্গ মানেই তো আর ডেভেলপ্ড স্বর্গ নয়। এটা বুঝতে হবে। আমার মনে হয় প্রজাপতি ব্রহ্মাকে একবার কল দেওয়া উচিত। উনি সর্বজ্ঞানী, এই বিশ্ব চরাচরের সমস্ত সমাধান ওনারই কৃপায়। এহেন সমস্যায় যোগ্য সিদ্ধান্ত উনিই নিতে পারবেন একমাত্র। এস আমরা কালবিলম্ব না করে ওনাকে স্মরণ করি ।
প্রজাপতি ব্রহ্মা অনতিদূরেই একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। এ যাবৎ ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে চুপিচুপি শুনে নিয়েছেন ওখানে দাঁড়িয়েই। স্বর্গে ফোর জি চালু হয়ে যাওয়াতে ওনার ধারেকাছে বিশেষ কেউ ঘেঁষে না। সমস্ত দিনটা উনি ফাঁকাই থাকেন। সময় সুযোগ পেলে পুরোনো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভিতে সারেগামাপা দেখে পা নাচান অথবা নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম শুনে দুঃখ পান। মহিষের ঘটনায় উনি বেশ মজা পেয়েছেন এবং লুকিয়ে অকুস্থলে এসে হাজির হয়েছেন। সকলে মিলে স্মরণ করতেই উনি তড়িঘড়ি সামনে এসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে শুরু করলেন।
ব্রহ্মা : বন্ধুগণ........ সরি, দেবদেবীগণ, তোমাদের আর ডাকাডাকি করতে হবে না। আমি নিজে থেকেই হাজির হয়েছি। আফটার অল তোমাদের পাশে দাঁড়ানোটাই আমার প্রধান কর্তব্য। বিষয়ের গুরুত্ব বিচার করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে যতক্ষণ না মহিষের একটা হিল্লে হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত অসুর ভাতায় ওকে একটা সাইকেল দেওয়া হবে। আপাতত ওই সাইকেলটা চড়েই ও ঘোরাঘুরি করুক, পরে কিছু একটা করা যাবে।
নারায়ণ : (বিরক্ত হয়ে) এই, এটা কে রে ! সাইকেল দেওয়ার সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক ! আর তাছাড়া পরে আর কবে ? একি এসএসসি পরীক্ষা ? পরে কোনো একটা সময় করে নিলেই হল।
শিব : আঃ অত উত্তেজিত হতে নেই, ধৈর্য ধর। (ব্রহ্মার দিকে তাকিয়ে) কৈলাসে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই প্রজাপতি। আমি বরং গোড়া থেকে আপনাকে বুঝিয়ে বলি, তাহলে আপনার পুরোটা বুঝতে সুবিধা হবে।
ব্রহ্মা : (হাত তুলে থামিয়ে) ভুলে যেও না দেবাদিদেব, আমি সর্বজ্ঞ, আমার অজানা কিছুই নেই। রণে বনে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমায় স্মরণ করিও, আমি তোমাদের রক্ষা করিব।
নন্দী : (ফিসফিস করে ভৃঙ্গিকে) যাহ কলা ! এতো লোকনাথ বাবার ডায়লগ। বেমালুম ঝেঁপে দিল যে !!
ভৃঙ্গি: চেপে যা রে ভাই, ভাঁওতাবাজি দিয়েই চলছে চাদ্দিক । বেশি বলবি, মাওবাদী বলে খেদিয়ে দেবে।
শিব : যাক ! তাহলে তো ভালোই হল। এবার এই ক্যাচালটার আপনি একটা বিহিত করুন তো দেখি। সেই সকাল থেকে কান মাথা সব ঝালাপালা হয়ে গেল।
ব্রহ্মা : মাথা টনটন, কান ঝনঝন
মহিষ বলেছে আড়ি.....
হাতে লণ্ঠন মাছি ভনভন
না এসে কি পারি ?
কবিতার রসেই হোক অথবা কিছু না বুঝেই হোক উপস্থিত সকলে মিলে হাততালি দিয়ে উঠলেন।
নন্দী : (ফিসফিস করে) কবিতাটায় কেমন যেন একটা চেনা প্যাটার্ন পাওয়া যাচ্ছে .....নারে ?
ভৃঙ্গি : ঠিকই ধরেছিস। তবে শুনেছি নাকি অফটাইমে অফবিট ছবিও আঁকছেন এখন।
ব্রহ্মা : (মহিষের দিকে তাকিয়ে) এই যে মোষের পো, বিয়ে করবে সে ভালো কথা কিন্তু কাকে করবে শুনি ? বলি পাত্রীটি কে ?
সকলে উৎসুক নেত্রে মহিষের দিকে চেয়ে রইলেন। মহিষ লজ্জিত হয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। কিছুতেই মুখ ফুটে বলে উঠতে পারল না। এইভাবে বেশ কিছুক্ষন কাটল। ধীরে ধীরে সকলেই অধৈর্য হয়ে পড়লেন।
নারায়ণ : কিরে ছোটভাই ? নামটা বল, চট করে টুইট করে দিই.......
গনেশ : বলো না মামা...... মামীর নাম কি ?
পার্বতী : (ধৈর্য হারিয়ে) এই ! তুই কি ইন্ডিয়ান আইডলের অডিশন দিতে এসেছিস যে চুপ করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছিস ? নামটা বলবি নাকি পিছনে গরম ত্রিশূলের খোঁচা দেব ?
মহিষ : (থতমত খেয়ে ) সানি ........ও..ওর নাম হল সানি..........
ব্রহ্মা : লিওন ???......জয় গুরু .....
পার্বতী : সে আবার কে ?
শিব ফিসফিস করে যতটা সম্ভব সহজ ভাষায় পার্বতীকে নামের ইতিবৃত্ত বুঝিয়ে দিলেন । সবটা শুনে পার্বতীর চোখ কপালে উঠে গেল। ধপ করে বসে পড়লেন পাশের বেদীতে।
নারায়ণ : যাই বলো, নামের মধ্যে কিন্তু বেশ একটা ষ্টার ষ্টার ব্যাপার আছে। জমবে ভালো।
শিব : দাঁড়া বাপু ! আমি যদ্দুর জানি তার তো বিয়ে হয়ে গেছে ? সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিবাহটা বেআইনি।
ব্রহ্মা : একজ্যাক্টলি। তাছাড়া পরকীয়া আইনসিদ্ধ হয়েছে বলে তুমি একেবারে পরস্ত্রী ফুঁসলে আনবে একথাও তো ঠিক নয়।
নারায়ণ : শুধু তাই নয়, যাকে বিয়ে করবে সে রাজি আছে কিনা সেটাও তো জানা দরকার। এতো আর কোলগেট নয় যে নিম, লবঙ্গ, নুন আছে কিনা জানলেই হয়ে গেল। বিয়ে বলে কথা।
নারদ : তেমন হলে আমি গিয়ে একবার জেনে আসতে পারি ........যাব ?
ব্রহ্মা : তুই থাম ছোঁড়া। নাম শুনেই অমনি দৌড়ে মেডেল আনতে চলল। আগে সবটা জানা দরকার, তারপর অন্য কথা।
মহিষ : কি আশ্চর্য মাইরি !! আপনারা কি আবোল তাবোল বকছেন ?
শিব : তার মানে ?
মহিষ : এ সানি সে সানি নয় .....
নারায়ণ : খেয়েছে ! তবে কোন সানি ?
নন্দী : (ফিসফিস করে ভৃঙ্গিকে ) আমার মনে হয় গাভাস্কারের কথা বলছে।
পার্বতী : হা কপাল !!
মহিষ : এসব কি হচ্ছে !!! কাদের সব নাম বলছেন বলুন তো ? এরা কেউ নয়।
সকলে একযোগে : তবে কে ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিষ একবার সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ খুলল।
মহিষ : সানি...... মানে ইয়ে, আমাদের সূর্যদেবের কথা বলছিলুম......
একথা শুনে পার্বতী প্রায় মূর্চ্ছা গেলেন। শিব তাড়াতাড়ি একঘটি জল এনে পার্বতীর মুখেচোখে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। উপস্থিত বাকি সকলেই বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। পোষা সিংহটাও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মহিষের দিকে। গোটা কৈলাসে নিস্তব্ধতার ছায়া ঘনিয়ে এল। কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করলেন না। এই অপ্রত্যাশিত নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথমে ব্রহ্মা সরব হলেন।
ব্রহ্মা : একি সত্যি নাকি !
মহিষ : (বিড়বিড় করে) পুরোটাই....
শিব : কদ্দিন ধরে ?
মহিষ : তা, বছরখানেক হল........
নারায়ণ : ইয়ে....মানে, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না ?
নারদ : হরিবোল.....
শিব : দাঁড়াও দাঁড়াও। আমরা একটু শক খেয়েছি বটে, কিন্তু তাই বলে প্রতিবাদী মিছিল করার কোনো দরকার নেই। আমি তো এতে দোষের কিছু দেখছি না।
ব্রহ্মা ; ঠিকই, তাছাড়া এমনটা তো নতুন নয়। মর্ত্যে যদি ৩৭৭ চেঞ্জ হতে পারে তাহলে আমাদের এখানে নয় কেন। আমাদেরও খোলা মনে ব্যাপারটা বিবেচনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি বরং অসুরশ্রীর একটা ব্যবস্থা করে দেব।
পার্বতী কিছুটা সুস্থলাভ করার পর কোনোরকমে উঠে মহিষের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।
পার্বতী : (মেলোড্রামাটিক সুরে) আমি তোর ওপর বড্ড বেশি অত্যাচার করি......নারে ? তাই বোধহয় এভাবে শোধ নিলি ?
মহিষ : (জনপ্রিয় শিল্পীর নকলে) আ--আমি কিছু করিনি । বিশ্বাস করুন, আ--আমি অন্যায় করিনি ।
শিব : দ্যাখো পার্বতী, তুমি মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছ। হৃদয় বিনিময় কোনো নিয়ম মেনে হয় নাকি ? নাকি তার কোনো সংজ্ঞা আছে ? তুমি তো মা। সন্তানের সুখ দুঃখের ভার তো তোমারই। এমন সময় পিছিয়ে এলে কি করে হবে ? তুমি সম্মতি না দিলে ও যে সারাটা জীবন কষ্ট পাবে। মা হয়ে তুমি কি তাই চাও ?
পার্বতী চোখ বুজে নিজের মতো করে চিন্তা করতে লাগলেন।
ব্রহ্মা : তাছাড়া এখানেও কিন্তু একইভাবে সেই দ্বিতীয় বিবাহের প্রশ্নটা থেকে যায়। সানি, আই মিন, সূর্যদেবও কিন্তু বিবাহিত। সূর্যপত্নী কি মেনে নেবেন ব্যাপারটা ?
মহিষ : হ্যাঁ, সেটা কথা বলা আছে। সানির স্ত্রী, ওঁর এই ওরিয়েন্টেশনটা জানার পর নিজে থেকেই ডিভোর্স ফাইল করেছেন। আপাতত আমরা লিভ ইন করব, ডিভোর্স পেলেই বিয়ে ।
নারায়ণ : আশ্চর্য, এতো কিছু হয়ে গেলো অথচ আমরা কেউ টেরই পেলুম না !
নারদ : আমার কিন্তু একটা জিনিস খচখচ করছে বাপু। অমন প্রখর তেজস্বী ব্যক্তিত্ব, কাছাকাছি গেলেই তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবার রিস্ক থাকে। সেক্ষেত্রে কিভাবে......
মহিষ : (লাজুকস্বরে) সাধারণত সকাল আর দুপুরের দিকটা এড়িয়ে চলি। সন্ধ্যের পর থেকেই ওর মধ্যে একটা ডিমলাইট টাইপের ভাব চলে আসে.....তারপর আর অসুবিধে হয় না.....
শিব : ব্রাভো ! তোর বুদ্ধি দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি মাইরি ! (পার্বতীর দিকে ঘুরে) দ্যাখো পারো, ওদের ইন্টেন্সিটিটা লক্ষ্য কর একবার। এরপরও তুমি আপত্তি করবে ? তুমিই তো বলো, তোমার প্রত্যেক সন্তানের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। এসময় আমাদের সকলের ওর পাশে থাকাটা খুব জরুরি।
পার্বতী : (একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বেশ, তোমরা যেমন ভালো বোঝো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
মহিষ : বলুন মা।
পার্বতী : মর্ত্যের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। ওদেরকে লাস্ট মোমেন্টে কোনোভাবেই ডিপ্রাইভ করতে পারব না। সুতরাং আগে পুজো, পরে বিয়ে। ফিরে এসেই নাহয় আমিই সেসবের ব্যবস্থা করব।
শিব : (অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে) ওরে তোর মা রাজি হয়েছেন রে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কি ইডিয়ট, একটা পেন্নাম কর শিগগির।
মহিষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলল। চিৎকার করে বলল, "বলো দুগ্গা মাইকী".........গোটা কৈলাস হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে একসাথে গলা মেলাল মহিষের সাথে।
#Durgapuja #bengalishortstories #durgapujastories #pujabarshiki #Molat #DebdattaSinha










