Monday, October 9, 2017
অনুপদ্য - ১৯
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Thursday, October 5, 2017
অনুপদ্য - ১৮
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Monday, September 25, 2017
অনুপদ্য - ১৭
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Thursday, September 21, 2017
সাপ্তাহিকী - ৩২ # সেবুর প্যান্ডেল - অন্তিম পর্ব
পলকের আকস্মিকতা কাটাইয়া সবাই কোলাহল করিয়া উঠিল। ব্যাটা বলে কি ? পুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধবে ! সকলেই সমস্বরে বলিল, 'না না না, এ অসম্ভব' ! প্যাণ্ডেল বাঁধিতে গিয়া সেবু যে ভীষণ রকম একটা কাণ্ড ঘটাইয়া ফেলিবে এ বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত হইয়া বিধুচরণের নিকট তদ্বির করিল। বিধুচরণও মাথা নাড়িয়া বলিলেন, 'না না, সেবু তা হয় না। তুই কি প্যাণ্ডেল বেঁধেছিস আগে যে হঠাৎ করে একেবারে দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধতে লাগবি' ? সেবু ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'অাহ্ আমি কি বলেছি আমি একাই বেঁধে ফেলব ? ভূপেন মাঝি ও তার দলবল তো থাকবেই, আমি শুধু একটু হাত লাগাবো, এই যেমন ধরো একটা দড়ি বেঁধে দিলাম বা একটু বাঁশটা পুঁতে দিলাম এই আর কি। আমার ভারী ইচ্ছে, সেই ছোটোর থেকে..........বিশ্বাস করো'। শেখর ও গোরা হৈ হৈ করিয়া বলিল, 'না না, মিত্রমশাই, আপনি একদম শুনবেন না ওর কথা। আমাদের তো আগে কম বিপদ হয় নি। তাছাড়া দুর্গাপুজো নিয়ে কোনো রকম ছেলেমানুষি আমাদের না করাই ভালো'। বিধুচরণ মহা ফাঁপরে পড়িলেন। একদিকে সেবুর আবদার তিনি না মিটিয়া থাকিতে পারেন না আবার অন্যদিকে তাহাকে অনুমতি দিতেও ভরসা পাইতেছেন না। কতকটা ফাটা বাঁশের মধ্যে আটকা পড়িয়া তিনি ছটফট করিতে লাগিলেন।
সেবু তাহার জ্যাঠার পরিস্থিতি আঁচ করিয়া বলিয়া উঠিল, 'আচ্ছা জ্যেঠু, জেলেপাড়ার বসুমতীকে চেন' ? বিধুচরণ অবাক হইয়া বলিলেন, 'বসুমতী ? না, চিনি না। কেন, সে কে' ? এ কথায় শেখরের মুখ পাংশু হইয়া গেল। সে বিবাহিত অথচ বেশ কয়েকদিন হইল জেলেপাড়ার বসুমতীর সহিত তাহার একটি সম্পর্ক জমিয়া উঠিয়াছে। একথা মনোহরপুরের কাকপক্ষীও জানে না। তাহা সেবুর গোচরে কি করিয়া আইল এইটা ভাবিয়া শেখর যারপরনাই অস্থির হইয়া উঠিল। কারণ এই সম্পর্ক জানাজানি হইলে তাহার সংসারে কেন গোটা পাড়ায় কুরুক্ষেত্র হইতে বাকি থাকিবে না শেখর তাহা বিলক্ষণ জানে। সেদিকে তাকাইয়া সেবু বলিল, 'না, মানে সে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে তালপুকুরের ধারে চুপটি করে বসে থাকে। কেন ? তুমি জান' ?
বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া দুদিকে মাথা নাড়িলেন। সেবুর কথার গোপন মর্মার্থ তিনি উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। উল্টোদিকে শেখর প্রায় ঘামিয়া স্নান করিয়া গেল। বসুমতীর সাথে তাহার দেখা করিবার স্থান তালপুকুরই বটে। সন্ধ্যের দিকে সে সমস্ত রকম আঁটঘাঁট বাঁধিয়া খুবই সন্তর্পণে বসুমতীর নিকট আসে। তাহাদের প্রেমালাপ করিবার একটি গোপন আস্তানা আছে। আজ অবধি কেউ টের পায় নাই। হতভাগা সেবু কি করিয়া জানিতে পারিয়া আজ মোক্ষম সময়ে সেসব কথা তুলিতেছে। পাড়ার পাঁচজনের সামনে মাথা হেঁট হইয়া যায় বুঝি।
পরিস্থিতি নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া শেখর গলা খাকরাইয়া বলিয়া উঠিল, 'আঃ সেবু, কি সব অবান্তর কথা বলছিস ? হচ্ছিল একটা কাজের কথা, তা নয় যত্তসব অপ্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে। আমাদের আর দেরি করলে চলবে না কিন্তু, সময় বয়ে যাচ্ছে। ঝটপট ভূপেনকে একটা খবর দে দিকি'।
সেবু একগাল হাসিয়া বলিল, 'সে তো আমি এখনই দিতে পারি। কিন্তু আমার কথাটাও একবার.........'। বিধুচরণ ফোঁস করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন। শেখর একবার বিধুচরণের মুখের দিকে তাকাইয়া নিয়া বলিল, 'আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন, চারটে বাঁশ নাহয় তুইই বাঁধিস। ভূপেনকে খবরটা তো দে আগে'। বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, 'সে কি কথা শেখর, ওর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা তো সবই জানো। ও যদি কোনো বিপদ ঘটায়, তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারবো না এ আমি আগেই সাফ জানিয়ে রাখলুম'। শেখর স্মিতহাস্যে কহিল, 'আহা সেবুর ইচ্ছে হয়েছে যখন, একটু প্যাণ্ডেলের কাজ করল নাহয়। ছোটবেলার শখ বলছে তো, করুক না একটু। আমাদেরও তো কতসময় কতরকম শখ জাগে, তাই না ? ও কিছু না। আপনি আর এ নিয়ে আপত্তি করবেন না মিত্রমশাই। সেবু তো আমাদেরই ঘরের ছেলে, কি সেবু এবার খুশি তো' ?
সেবু মহানন্দে তাহার দন্ত কপাটি বাহির করিল। বিধুচরণ বলিলেন, 'বেশ, তবে তাই হোক। তুমি পুজোর সেক্রেটারি হয়ে যখন বলছ তখন আর আমার আপত্তি করবার কিছু নেই'। এই কথাটি বলিয়াই তিনি হঠাৎ সেবুর দিকে ঘুরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তবে, তুই বসুমতী না কার যেন কি একটা কথা বলছিলি' ? সেবু চটপট হাত নাড়িয়া বলিল, 'না না সেসব কিছু না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমি বরং যাই, চানটা করে নিয়ে ভূপেন মাঝি কে খবরটা দিই গে যাই'। বলিয়াই সে ছুটিয়া ঘর হইতে অন্তর্ধান হইল। বিধুচরণ চক্ষু বুজিয়া কহিলেন, 'হরি হে ! কখন যে তোমার কি ইচ্ছে........ '।
দেখিতে দেখিতে দেড়মাস কাটিয়া গেল। প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষের পথে। ভূপেন মাঝি ও তার দলবল ঝড়ের গতিতে কাজ করিতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের মতো দুর্দান্ত আকার না হইলেও হরিসভার নৌকার আদলটা মোটামুটি হইয়াছে। যদিও গোটা নৌকা বানাইবার দরকার পড়ে নাই। সামনের দিকটায় চমৎকার একটা বজরার রূপ দিয়া পিছন দিকটায় ছোট করিয়া হাল বাঁধিয়া দিয়াছে। সামনে দাঁড়াইলে নৌকার ছাউনি ও মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাইবে। কিন্তু সেসব ছাপাইয়া যাহা চোখে পড়িবার মতো তাহা হইল সেবুর উৎসাহ ও কাজ করিবার উদ্দীপনা। বাঁশ বাঁধা, কাঁচা মালের আনা নেওয়া করা, মিস্ত্রিদের খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছুই সে নিজের হাতে দেখিতেছে। বোঝা যাইতেছে তাহার শখ পূরণের সমস্ত রসটুকু সে পরম তৃপ্তিতে আস্বাদন করিতেছে। সময়ে অসময়ে বিধুচরণ, শেখর, গোরা ও ক্লাবের বাকিরা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী সমস্ত কাজই তদারকি করিতেছেন।
পরের এক সপ্তাহে বাকি সমস্ত কাজই নিয়মমাফিক চলিয়া শেষ হইয়া গেল। প্যাণ্ডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেল। কিন্তু কেহ জানিতে পারিল না নৌকার পিছন দিকে এক ভীষণরকম কালসর্পের যোগ ঘটিয়াছে। সেটি কি তাহা পরে বলিতেছি। এদিকে ইতিমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটিল। যাহারা মনোহরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা তাহারা নিত্য আসা যাওয়ার পথে সকলেই সচক্ষে দেখিতে পাইতেছিলেন যে কোন প্যাণ্ডেলটি কিরূপ প্রস্তুত হইতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের অপেক্ষা হরিসভার নৌকা যে উত্তম কিছু হইতেছে না এ তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিলেন। হরিসভার নৌকা ধারে ও ভারে কোনোপ্রকারেই উড়োজাহাজকে টেক্কা দিতে পারিতেছিল না। তাহার কারণ উড়োজাহাজটি দুতলা সমান পেল্লাই হইয়াছিল এবং দেখিতে অবিকল আসল উড়োজাহাজের মতোই লাগিতেছিল। সেখানে হরিসভার নৌকাটি মোটের উপর চলনসই হইয়াছিল। সুতরাং ধীরে ধীরে এরকম একটি বার্তা রটিয়া গেল যে এবার হরিসভা তেমন কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের সমস্ত কর্মকর্তাদের নিকট অনুরূপ সংবাদ পৌঁছাইল। এহেন পীড়াদায়ী জনশ্রুতিতে সকলেই প্রায় ভাঙিয়া পড়িলেন। বিধুচরণও কঠিন মনকষ্টে ভুগিতে লাগিলেন। পুজো লইয়া তাহার সমস্ত উদ্দীপনা ধূম্রের ন্যায় মিলাইয়া যাইতে লাগিল।
তবুও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের যথাবিধি নিয়ম পালন করিতে হইবে। তাই ক্লাবের মধ্যে ঠিক হইল চতুর্থীর দিন প্রতিমা আনা হইবে ও পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় পাঁজির সময়ানুসারে বিধুচরণ ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উদ্বোধন করিবেন।
যথাসময়ে পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যাবেলা সকলে ক্লাবের মাঠে উপস্থিত হইলেন। মণ্ডপের সামনে একটি বিশাল ত্রিপল খাটাইয়া রাখা হইয়াছে। সামান্য কিছু উৎসুক জনতাও মাঠের ধারে জড়ো হইল। কারণ বেশিরভাগ মানুষই উড়োজাহাজের দিকে উড়িয়া গিয়াছেন। বিধুচরণ শ্বেতশুভ্র ধাক্কা পাড়ের ধুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরিহিত হইয়া ব্যথিত হৃদয়ে ক্লাবে পদার্পন করিলেন। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝা যাইতেছিল যেন তিনি এক কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন। মাঠ প্রায় জনশূন্য দেখিয়া তিনি আরও হতোদ্যম হইয়া পড়িলেন। অন্যান্য বৎসর গুলিতে যেখানে উদ্বোধনের দিন একেবারে লোক ভাঙিয়া পড়িত, আজ সেখানে ছন্নছাড়া কয়েকজন আসিয়াছে। ক্লাবের অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইয়া মণ্ডপে লইয়া আনিলেন। ঢাকিরা আগে হইতেই প্রস্তুত ছিল। তাহারা বিধুচরণকে দেখিয়া একসাথে ঢাক বাজাইতে শুরু করিল। কিন্তু সে ঢাকের আওয়াজও কেমন যেন করুণ প্রাণ মনে হইল। পাড়ার কয়েকজন মহিলা উলুধ্বনি দিয়া ও মঙ্গলশঙ্খ বাজাইয়া কোনোমতে বিলীন উৎসাহটুকু জাগাইয়া রাখিলেন।
ত্রিপল সরাইয়া, পঞ্চপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিয়া পুজোর উদ্বোধন হইবে। বিধুচরণ একটি গম্ভীর নিঃশ্বাস ছাড়িয়া রশি টানিয়া ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উন্মোচন করিলেন। তাহার পর পঞ্চপ্রদীপে আলো সঞ্চার করিয়া মণ্ডপের সিঁড়ির নিকটে আসিলেন। ইতস্তত দু একটি হাততালির শব্দ শোনা গেল। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বিধুচরণ মণ্ডপে উঠিতে গিয়া থমকাইয়া গেলেন। মণ্ডপের দিকে চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া গেল। তিনি শ্বাসরুদ্ধ করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া ক্লাবের বাকিরাও মণ্ডপের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাহাদের হৃদপিণ্ড প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেল।
দেখা গেল নৌকারূপী মণ্ডপটি ডানদিকে বেশ কিছুটা হেলিয়া কাত হইয়া গিয়াছে। কতকটা পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো। পড়িয়া যায় নাই এই রক্ষে, কিন্তু পড়িয়া যাইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। বিধুচরণ কোনো কথা কহিতে পারিলেন না প্রথমটায়। ধীরে ধীরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন অগ্নি নিক্ষেপ হইতে লাগিল। চরম ক্রোধে তিনি থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। পাশে দাঁড়ানো শেখরকে চাপাস্বরে ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'এটা কি ? এ কি করে হল' ? শেখরের প্রায় অজ্ঞান হইবার উপক্রম হইল। সে সভয়ে কহিল, 'আজ্ঞে, সকাল অবধি তো সোজাই দাঁড়িয়েছিল এখন যে কি করে হেলে গেল জানি না'। বিধুচরণ অগ্নিনেত্রে বাকিদের থেকে ইশারায় জানিতে চাহিলেন যে ব্যাপারখানা কি। কিন্তু কেউই কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিল না। ভূপেন মাঝি কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সেও চক্ষু গোলগোল করিয়া তাকাইয়া ছিল তাহার সাধের নৌকার দিকে। বিধুচরণ তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিতে টানিতে মণ্ডপের অনতিদূরে লইয়া গিয়া কহিলেন, 'এসবের মানে কি ভূপেন ? এটা কি মস্করা হচ্ছে ? নৌকা এতো হেলে গেল কি করে' ? ভূপেন মাঝি মিনমিন করিয়া কহিল, 'আজ্ঞে মিত্রমশাই আ-আমি সত্যি কিছু জানি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলুম আমি। আজ সকালেও দেখেছি, তখন তো কিচ্ছুটি হয় নি'।
'ন্যাকা সাজছিস তুই ? সকালেও দেখেছি ? তাহলে কি বিকেলে উঠে সমুদ্রে জাল ফেলেছিস মাছ ধরবি বলে, যে নৌকা হেলে গেল' ? বিধুচরণ ক্রোধান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন। ভূপেন হাঁউমাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। বিধুচরণ আবার কহিলেন, 'সত্যি করে বল ভূপি, কি করে হল নইলে তোকে আমি এই মাঠে জ্যান্ত পুঁতব বলে রাখলুম'। ভূপেন ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল ,'আজ্ঞে, আমায় একটু সময় দিন কত্তা, আমি একবার পিছনদিকটা দেখে আসি'। বলিয়াই সে ছুটিয়া নৌকার পিছন দিকে চলিয়া গেল। কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া সে আবার ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, 'আজ্ঞে হালের দিকে দুটো বাঁশ আলগা বাঁধা হয়েছে কত্তা, দড়ি হড়কে গিয়ে বাঁশ কাত হয়ে গেছে, তাই নৌকাও হেলে গেছে খানিক'।
'আলগা বাঁধা হয়েছে মানে ? কেন, বাঁধার সময় তুমি কি কেষ্টঠাকুরের লীলে দেখছিলে বজ্জাত' ? বিধুচরণ অগ্নিশর্মা হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন। ভূপেন কুঁই কুঁই করিয়া বলিল, 'আজ্ঞে ওই বাঁশদুটো আমি সেবুকে বাঁধতে দিয়েছিলুম। ঐটে বাঁধবে বলে সে খুবই জোড়াজুড়ি করে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই..........'। সেবু কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, 'হ্যাঁ, আমিই বেঁধেছিলুম বটে, কিন্তু আমি ভূপেনদার কথামতো ঘন্টাকেও দেখিয়ে নিয়েছিলুম। সে বলেছিল ঠিক আছে'। বিধুচরণ স্তব্ধ হইয়া গেলেন একথা শুনে। তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।
ঘটনাটা ঠিক কি হইয়াছিল তাহা বলি এখন পাঠকদের।
সেবুর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখিয়া ভূপেন তাহাকে দুটি বাঁশ বাঁধিতে দিয়াছিল। কাজটি ছিল এই যে হালের দিকটায় একটি বাঁশের সহিত আরেকটি বাঁশ কায়দা করিয়া বাঁধিতে হইবে। তাহার সহিত একজন কারিগরকেও রাখিয়াছিল পুরোটা ভালো করিয়া দেখিয়া লইবার জন্য। তাহার নাম ঘন্টা। কিন্তু মুশকিল হইল, সন্ধ্যে হইলেই ঘন্টা গাঁজা ও কল্কের মায়ায় জড়াইয়া পড়ে। তখন আশেপাশে বোমা মারিলেও ঘন্টার ঘড়িতে কিছুমাত্র বিকার ঘটে না। সেবুর দুইটা বাঁশ বাঁধিতে সেদিন সন্ধ্যে হইয়া গিয়াছিল। কাজের শেষে সে ঘন্টাকে ডাকিয়া লইয়া ভালো করিয়া দেখাইয়াছিল। তুমুল নেশার চোটে ঘন্টা তখন চোখ খুলিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। ফলে সে বুঝিতে পারে নাই যে বাঁশ দুইটি একেবারে আলগা বাঁধা হইয়াছে। কতকটা হামাগুড়ি দিয়া সে দড়ির উপর হাত বুলাইয়াই জড়ানো কণ্ঠে বলিয়াছিল, 'ঠিক আছে, বেশ বাঁধা হয়েছে'। নানান কাজের মধ্যে ভূপেনেরও পুরোটা ভালো করিয়া দেখা হয় নাই। এখন সময়কালে এই ভয়ঙ্কর বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
সেবুর মুখে ঘন্টার কথা শুনিয়া সকলেই একপ্রকার বিপদের ঘন্টাধ্বনি শুনিতে পাইলেন। কে কি বলিবে কেহ ভাবিয়া পাইলেন না। আশেপাশে কোথাও ঘণ্টাকেও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে যে জনতা দূরে জড়ো হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে এক অদ্ভুত গুঞ্জন শুরু হইল। সে গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়িয়া এক আশ্চর্য রূপ লইতে লাগিল। কারণ তাহারা কেহ জানিতে পারে নাই যে নৌকার এমন দুর্দশা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটিয়াছে। তাহারা ভাবিতে লাগিল, এইটি বোধহয় হরিসভা ক্লাবের শেষবেলার চমক, তুরুপের তাস। একেবারে অন্তিমলগ্নে আস্তিন হইতে বাহির করিয়াছে আদর্শ পল্লীকে মাত দিবে বলিয়া। এবং এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখিয়া তাহারা একেবারে হাঁ হইয়া গেল। তাহার কারণ হইল এই যে নৌকাটি হেলিয়া থাকিবার ফলে এক অদ্ভুত বাস্তব রূপ লইয়াছে। দূর হইতে দেখিলে মনে হইবে যে তুমুল ঝড়ের মধ্যে নৌকাটি কোনোপ্রকারে হেলিয়া গিয়া শেষ অবধি বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। সঙ্গে জলরাশির আবহশব্দ, মৃদু আলোর খেলা ও সন্ধ্যার মেঘাবৃত আকাশের মেলবন্ধনে গোটা ব্যাপারখানায় যেন এক মায়াবী দৃশ্যপট প্রস্তুত হইয়াছে। তাহাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিবার পর কয়েকটি উক্তি এধার ওধার থেকে উড়িয়া আসিতে লাগিল। যেমন সপত্নী সাগর ডাক্তার কহিলেন, 'ইট্স ওয়ান্ডারফুল ! এমেজিং' ! বাংলার শিক্ষক হলধর সামন্ত বলিলেন, 'দুর্দান্ত ! ওস্তাদের মার শেষরাতে'। মধু স্যাকরা বলিয়া উঠিল, 'কেয়াবাৎ ! শেষবেলায় হরিসভা কিন্তু দেখিয়ে দিলে'। কিছু কচিকাঁচার দল সহর্ষে হাততালি দিয়া উঠিল। উপস্থিত দর্শক সকলেই হরিসভার সৃজনী পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
বিধুচরণ ও তাঁহার দলবল হকচকিয়ে গেলেন। এ কি হইল ! যে মাঠ কিয়দকাল আগে পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ও স্বপ্নভঙ্গের আঁধারে ডুবিয়া যাইতেছিল এখন সেখানেই উল্লাস ও উৎসবের আলো জ্বলিতেছে ! বিধুচরণ চকিতে পুরোটা আঁচ করিয়া ক্লাবকর্তাদের বলিলেন, 'আমাদের শীঘ্রই এটা সামাল দিতে হবে। লোকজন যদি নৌকায় উঠে পড়ে তাহলে তো সবশুদ্ধু জলাঞ্জলি যাবে ? তখন কি হবে' ? ভূপেনমাঝি আগাইয়া আসিয়া কহিল, 'কত্তা, আমি ভালো করে দেখে নিয়েচি। দড়ি খুলে গেছে বটে, তবে নৌকায় লোক না উঠলে কিচ্ছুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এ নৌকা পড়বে না'। বিধুচরণ ভুরু কুঁচকাইয়া কহিলেন, 'কি করে বলছিস পড়বে না ?
- আজ্ঞে, দড়ি আলগা হয়েছে, কিন্তু বাঁশদুটো তো আর পড়ে যায় নি। সে দুটো এমন ভাবে মাটির সাথে গেঁথে আছে যে এই চাপটুকু বয়ে নিতে পারবে। তবে লোকজন যেন না ওঠে এইটে খেয়াল রাখতে হবে।
- ঠিক বলছিস ?
- আজ্ঞে মা দুগ্গার দিব্যি কত্তা, হলপ করে বলছি। বরং লোকজনদের দূর থেকে দেখাবার ব্যবস্থা করুন। দড়ি বেঁধে দিন, সবাই বাঁদিক থেকে ঠাকুর দর্শন করে ডানদিক দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যাবে।
- বেশ, সে ব্যবস্থা আমরা করছি, তবে নৌকা যদি পড়ে যায় তবে ওই বাঁশ খুলে আমি তোর পিঠে ভাঙব এই বলে দিলুম।
শেখর বলিল, 'আলগা দড়ি আরেকবার বেঁধে দিলেই তো হয়'। ভূপেন কহিল, 'না দাদা, এই অবস্থায় হাত লাগাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে মানুষ আটকাবার ব্যবস্থা করুন'। বিধুচরণ তৎক্ষণাৎ গোরার দিকে ইশারা করিলেন। গোরা ঘাড় নাড়িয়া দৌড়াইয়া দড়ির ব্যবস্থা করিতে গেল।
হরিসভার যেন সমস্ত দিক হইতেই শাপমোচন হইল। 'হেলা নৌকা' র মাহাত্ম্য ছড়াইতে বেশি বিলম্ব হইল না। লোকজনের মুখে মুখে রটিয়া গেল যে হরিসভার 'হেলা নৌকা' তাহাদের অভিনব কুশলী কায়দায় শেষবেলায় আদর্শ পল্লীকে টেক্কা দিয়াছে। এই দুর্দান্ত ও চমৎকার দর্শনীয় বস্তুটি না দেখিলে সমস্তটাই বৃথা। ক্রমে ক্রমে মানুষের আগমন ঘটিতে লাগিল। এবং সকলেরই মুখে একটি প্রশ্নই ঘুরিতে লাগিল যে হরিসভা এই আশ্চর্য হেলানো অবস্থাটি বাস্তবে সম্ভব করিল কি প্রকারে ? কিন্তু সেসকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কেহই দিতে পারিল না। ফলে 'হেলা নৌকা' লইয়া আগ্রহ যেন দিগ্বিদিক ছাপাইয়া গগনচুম্বী হইল। ষষ্ঠীর দিন সকাল হইতে স্রোতের ন্যায় মানুষের ঢল নামিল হরিসভার মাঠে। বিধুচরণ ও ক্লাবের অন্যান্যদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিল। হরিসভার ঘাম ছুটিয়া গেল ভিড় সামাল দিতে দিতে।
বিধুচরণ বিজয়ীর হাসি লইয়া ক্লাবের মধ্যে সকলকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা করিলেন যে এমন আনন্দ উৎসবের মধ্যে তিনি একটি ভোজের ব্যবস্থা করিতেছেন। ক্লাবের সকলেই যেন নিজ নিজ পরিবার লইয়া সপ্তমীর রাত্রে উক্ত ভোজে সামিল হন। সকলেই বিধুচরণের জয়ধ্বনি দিতে লাগিল। সেবু এক কোনে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে জিজ্ঞাসা করিল, 'ইয়ে জ্যেঠু, আমার একটি অনুরোধ আছে'। সকলে সেবুর দিকে আতঙ্কিত হইয়া চাহিয়া রহিল। বিধুচরণ ঘাড় নাড়িয়া কিছু বলিবার পূর্বেই সে আবার বলিয়া উঠিল, 'আমিও এই ভোজে রাঁধুনির সাথে দু একটা পদ রাঁধতে চাই, রাঁধবার আমার ভারী ইচ্ছে....... সেই ছোটোর থেকে..........'। সকলে সমস্বরে গগন বিদীর্ণ করিয়া তাহাকে ধমকাইল, 'সেবুউউউউউ ......' !
#bengalishortstories #durgapujastory #durgapuja
সেবু তাহার জ্যাঠার পরিস্থিতি আঁচ করিয়া বলিয়া উঠিল, 'আচ্ছা জ্যেঠু, জেলেপাড়ার বসুমতীকে চেন' ? বিধুচরণ অবাক হইয়া বলিলেন, 'বসুমতী ? না, চিনি না। কেন, সে কে' ? এ কথায় শেখরের মুখ পাংশু হইয়া গেল। সে বিবাহিত অথচ বেশ কয়েকদিন হইল জেলেপাড়ার বসুমতীর সহিত তাহার একটি সম্পর্ক জমিয়া উঠিয়াছে। একথা মনোহরপুরের কাকপক্ষীও জানে না। তাহা সেবুর গোচরে কি করিয়া আইল এইটা ভাবিয়া শেখর যারপরনাই অস্থির হইয়া উঠিল। কারণ এই সম্পর্ক জানাজানি হইলে তাহার সংসারে কেন গোটা পাড়ায় কুরুক্ষেত্র হইতে বাকি থাকিবে না শেখর তাহা বিলক্ষণ জানে। সেদিকে তাকাইয়া সেবু বলিল, 'না, মানে সে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে তালপুকুরের ধারে চুপটি করে বসে থাকে। কেন ? তুমি জান' ?
বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া দুদিকে মাথা নাড়িলেন। সেবুর কথার গোপন মর্মার্থ তিনি উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। উল্টোদিকে শেখর প্রায় ঘামিয়া স্নান করিয়া গেল। বসুমতীর সাথে তাহার দেখা করিবার স্থান তালপুকুরই বটে। সন্ধ্যের দিকে সে সমস্ত রকম আঁটঘাঁট বাঁধিয়া খুবই সন্তর্পণে বসুমতীর নিকট আসে। তাহাদের প্রেমালাপ করিবার একটি গোপন আস্তানা আছে। আজ অবধি কেউ টের পায় নাই। হতভাগা সেবু কি করিয়া জানিতে পারিয়া আজ মোক্ষম সময়ে সেসব কথা তুলিতেছে। পাড়ার পাঁচজনের সামনে মাথা হেঁট হইয়া যায় বুঝি।
পরিস্থিতি নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া শেখর গলা খাকরাইয়া বলিয়া উঠিল, 'আঃ সেবু, কি সব অবান্তর কথা বলছিস ? হচ্ছিল একটা কাজের কথা, তা নয় যত্তসব অপ্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে। আমাদের আর দেরি করলে চলবে না কিন্তু, সময় বয়ে যাচ্ছে। ঝটপট ভূপেনকে একটা খবর দে দিকি'।
সেবু একগাল হাসিয়া বলিল, 'সে তো আমি এখনই দিতে পারি। কিন্তু আমার কথাটাও একবার.........'। বিধুচরণ ফোঁস করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন। শেখর একবার বিধুচরণের মুখের দিকে তাকাইয়া নিয়া বলিল, 'আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন, চারটে বাঁশ নাহয় তুইই বাঁধিস। ভূপেনকে খবরটা তো দে আগে'। বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, 'সে কি কথা শেখর, ওর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা তো সবই জানো। ও যদি কোনো বিপদ ঘটায়, তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারবো না এ আমি আগেই সাফ জানিয়ে রাখলুম'। শেখর স্মিতহাস্যে কহিল, 'আহা সেবুর ইচ্ছে হয়েছে যখন, একটু প্যাণ্ডেলের কাজ করল নাহয়। ছোটবেলার শখ বলছে তো, করুক না একটু। আমাদেরও তো কতসময় কতরকম শখ জাগে, তাই না ? ও কিছু না। আপনি আর এ নিয়ে আপত্তি করবেন না মিত্রমশাই। সেবু তো আমাদেরই ঘরের ছেলে, কি সেবু এবার খুশি তো' ?
সেবু মহানন্দে তাহার দন্ত কপাটি বাহির করিল। বিধুচরণ বলিলেন, 'বেশ, তবে তাই হোক। তুমি পুজোর সেক্রেটারি হয়ে যখন বলছ তখন আর আমার আপত্তি করবার কিছু নেই'। এই কথাটি বলিয়াই তিনি হঠাৎ সেবুর দিকে ঘুরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তবে, তুই বসুমতী না কার যেন কি একটা কথা বলছিলি' ? সেবু চটপট হাত নাড়িয়া বলিল, 'না না সেসব কিছু না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমি বরং যাই, চানটা করে নিয়ে ভূপেন মাঝি কে খবরটা দিই গে যাই'। বলিয়াই সে ছুটিয়া ঘর হইতে অন্তর্ধান হইল। বিধুচরণ চক্ষু বুজিয়া কহিলেন, 'হরি হে ! কখন যে তোমার কি ইচ্ছে........ '।
দেখিতে দেখিতে দেড়মাস কাটিয়া গেল। প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষের পথে। ভূপেন মাঝি ও তার দলবল ঝড়ের গতিতে কাজ করিতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের মতো দুর্দান্ত আকার না হইলেও হরিসভার নৌকার আদলটা মোটামুটি হইয়াছে। যদিও গোটা নৌকা বানাইবার দরকার পড়ে নাই। সামনের দিকটায় চমৎকার একটা বজরার রূপ দিয়া পিছন দিকটায় ছোট করিয়া হাল বাঁধিয়া দিয়াছে। সামনে দাঁড়াইলে নৌকার ছাউনি ও মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাইবে। কিন্তু সেসব ছাপাইয়া যাহা চোখে পড়িবার মতো তাহা হইল সেবুর উৎসাহ ও কাজ করিবার উদ্দীপনা। বাঁশ বাঁধা, কাঁচা মালের আনা নেওয়া করা, মিস্ত্রিদের খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছুই সে নিজের হাতে দেখিতেছে। বোঝা যাইতেছে তাহার শখ পূরণের সমস্ত রসটুকু সে পরম তৃপ্তিতে আস্বাদন করিতেছে। সময়ে অসময়ে বিধুচরণ, শেখর, গোরা ও ক্লাবের বাকিরা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী সমস্ত কাজই তদারকি করিতেছেন।
পরের এক সপ্তাহে বাকি সমস্ত কাজই নিয়মমাফিক চলিয়া শেষ হইয়া গেল। প্যাণ্ডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেল। কিন্তু কেহ জানিতে পারিল না নৌকার পিছন দিকে এক ভীষণরকম কালসর্পের যোগ ঘটিয়াছে। সেটি কি তাহা পরে বলিতেছি। এদিকে ইতিমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটিল। যাহারা মনোহরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা তাহারা নিত্য আসা যাওয়ার পথে সকলেই সচক্ষে দেখিতে পাইতেছিলেন যে কোন প্যাণ্ডেলটি কিরূপ প্রস্তুত হইতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের অপেক্ষা হরিসভার নৌকা যে উত্তম কিছু হইতেছে না এ তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিলেন। হরিসভার নৌকা ধারে ও ভারে কোনোপ্রকারেই উড়োজাহাজকে টেক্কা দিতে পারিতেছিল না। তাহার কারণ উড়োজাহাজটি দুতলা সমান পেল্লাই হইয়াছিল এবং দেখিতে অবিকল আসল উড়োজাহাজের মতোই লাগিতেছিল। সেখানে হরিসভার নৌকাটি মোটের উপর চলনসই হইয়াছিল। সুতরাং ধীরে ধীরে এরকম একটি বার্তা রটিয়া গেল যে এবার হরিসভা তেমন কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের সমস্ত কর্মকর্তাদের নিকট অনুরূপ সংবাদ পৌঁছাইল। এহেন পীড়াদায়ী জনশ্রুতিতে সকলেই প্রায় ভাঙিয়া পড়িলেন। বিধুচরণও কঠিন মনকষ্টে ভুগিতে লাগিলেন। পুজো লইয়া তাহার সমস্ত উদ্দীপনা ধূম্রের ন্যায় মিলাইয়া যাইতে লাগিল।
তবুও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের যথাবিধি নিয়ম পালন করিতে হইবে। তাই ক্লাবের মধ্যে ঠিক হইল চতুর্থীর দিন প্রতিমা আনা হইবে ও পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় পাঁজির সময়ানুসারে বিধুচরণ ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উদ্বোধন করিবেন।
যথাসময়ে পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যাবেলা সকলে ক্লাবের মাঠে উপস্থিত হইলেন। মণ্ডপের সামনে একটি বিশাল ত্রিপল খাটাইয়া রাখা হইয়াছে। সামান্য কিছু উৎসুক জনতাও মাঠের ধারে জড়ো হইল। কারণ বেশিরভাগ মানুষই উড়োজাহাজের দিকে উড়িয়া গিয়াছেন। বিধুচরণ শ্বেতশুভ্র ধাক্কা পাড়ের ধুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরিহিত হইয়া ব্যথিত হৃদয়ে ক্লাবে পদার্পন করিলেন। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝা যাইতেছিল যেন তিনি এক কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন। মাঠ প্রায় জনশূন্য দেখিয়া তিনি আরও হতোদ্যম হইয়া পড়িলেন। অন্যান্য বৎসর গুলিতে যেখানে উদ্বোধনের দিন একেবারে লোক ভাঙিয়া পড়িত, আজ সেখানে ছন্নছাড়া কয়েকজন আসিয়াছে। ক্লাবের অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইয়া মণ্ডপে লইয়া আনিলেন। ঢাকিরা আগে হইতেই প্রস্তুত ছিল। তাহারা বিধুচরণকে দেখিয়া একসাথে ঢাক বাজাইতে শুরু করিল। কিন্তু সে ঢাকের আওয়াজও কেমন যেন করুণ প্রাণ মনে হইল। পাড়ার কয়েকজন মহিলা উলুধ্বনি দিয়া ও মঙ্গলশঙ্খ বাজাইয়া কোনোমতে বিলীন উৎসাহটুকু জাগাইয়া রাখিলেন।
ত্রিপল সরাইয়া, পঞ্চপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিয়া পুজোর উদ্বোধন হইবে। বিধুচরণ একটি গম্ভীর নিঃশ্বাস ছাড়িয়া রশি টানিয়া ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উন্মোচন করিলেন। তাহার পর পঞ্চপ্রদীপে আলো সঞ্চার করিয়া মণ্ডপের সিঁড়ির নিকটে আসিলেন। ইতস্তত দু একটি হাততালির শব্দ শোনা গেল। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বিধুচরণ মণ্ডপে উঠিতে গিয়া থমকাইয়া গেলেন। মণ্ডপের দিকে চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া গেল। তিনি শ্বাসরুদ্ধ করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া ক্লাবের বাকিরাও মণ্ডপের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাহাদের হৃদপিণ্ড প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেল।
দেখা গেল নৌকারূপী মণ্ডপটি ডানদিকে বেশ কিছুটা হেলিয়া কাত হইয়া গিয়াছে। কতকটা পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো। পড়িয়া যায় নাই এই রক্ষে, কিন্তু পড়িয়া যাইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। বিধুচরণ কোনো কথা কহিতে পারিলেন না প্রথমটায়। ধীরে ধীরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন অগ্নি নিক্ষেপ হইতে লাগিল। চরম ক্রোধে তিনি থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। পাশে দাঁড়ানো শেখরকে চাপাস্বরে ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'এটা কি ? এ কি করে হল' ? শেখরের প্রায় অজ্ঞান হইবার উপক্রম হইল। সে সভয়ে কহিল, 'আজ্ঞে, সকাল অবধি তো সোজাই দাঁড়িয়েছিল এখন যে কি করে হেলে গেল জানি না'। বিধুচরণ অগ্নিনেত্রে বাকিদের থেকে ইশারায় জানিতে চাহিলেন যে ব্যাপারখানা কি। কিন্তু কেউই কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিল না। ভূপেন মাঝি কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সেও চক্ষু গোলগোল করিয়া তাকাইয়া ছিল তাহার সাধের নৌকার দিকে। বিধুচরণ তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিতে টানিতে মণ্ডপের অনতিদূরে লইয়া গিয়া কহিলেন, 'এসবের মানে কি ভূপেন ? এটা কি মস্করা হচ্ছে ? নৌকা এতো হেলে গেল কি করে' ? ভূপেন মাঝি মিনমিন করিয়া কহিল, 'আজ্ঞে মিত্রমশাই আ-আমি সত্যি কিছু জানি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলুম আমি। আজ সকালেও দেখেছি, তখন তো কিচ্ছুটি হয় নি'।
'ন্যাকা সাজছিস তুই ? সকালেও দেখেছি ? তাহলে কি বিকেলে উঠে সমুদ্রে জাল ফেলেছিস মাছ ধরবি বলে, যে নৌকা হেলে গেল' ? বিধুচরণ ক্রোধান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন। ভূপেন হাঁউমাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। বিধুচরণ আবার কহিলেন, 'সত্যি করে বল ভূপি, কি করে হল নইলে তোকে আমি এই মাঠে জ্যান্ত পুঁতব বলে রাখলুম'। ভূপেন ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল ,'আজ্ঞে, আমায় একটু সময় দিন কত্তা, আমি একবার পিছনদিকটা দেখে আসি'। বলিয়াই সে ছুটিয়া নৌকার পিছন দিকে চলিয়া গেল। কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া সে আবার ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, 'আজ্ঞে হালের দিকে দুটো বাঁশ আলগা বাঁধা হয়েছে কত্তা, দড়ি হড়কে গিয়ে বাঁশ কাত হয়ে গেছে, তাই নৌকাও হেলে গেছে খানিক'।
'আলগা বাঁধা হয়েছে মানে ? কেন, বাঁধার সময় তুমি কি কেষ্টঠাকুরের লীলে দেখছিলে বজ্জাত' ? বিধুচরণ অগ্নিশর্মা হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন। ভূপেন কুঁই কুঁই করিয়া বলিল, 'আজ্ঞে ওই বাঁশদুটো আমি সেবুকে বাঁধতে দিয়েছিলুম। ঐটে বাঁধবে বলে সে খুবই জোড়াজুড়ি করে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই..........'। সেবু কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, 'হ্যাঁ, আমিই বেঁধেছিলুম বটে, কিন্তু আমি ভূপেনদার কথামতো ঘন্টাকেও দেখিয়ে নিয়েছিলুম। সে বলেছিল ঠিক আছে'। বিধুচরণ স্তব্ধ হইয়া গেলেন একথা শুনে। তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।
ঘটনাটা ঠিক কি হইয়াছিল তাহা বলি এখন পাঠকদের।
সেবুর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখিয়া ভূপেন তাহাকে দুটি বাঁশ বাঁধিতে দিয়াছিল। কাজটি ছিল এই যে হালের দিকটায় একটি বাঁশের সহিত আরেকটি বাঁশ কায়দা করিয়া বাঁধিতে হইবে। তাহার সহিত একজন কারিগরকেও রাখিয়াছিল পুরোটা ভালো করিয়া দেখিয়া লইবার জন্য। তাহার নাম ঘন্টা। কিন্তু মুশকিল হইল, সন্ধ্যে হইলেই ঘন্টা গাঁজা ও কল্কের মায়ায় জড়াইয়া পড়ে। তখন আশেপাশে বোমা মারিলেও ঘন্টার ঘড়িতে কিছুমাত্র বিকার ঘটে না। সেবুর দুইটা বাঁশ বাঁধিতে সেদিন সন্ধ্যে হইয়া গিয়াছিল। কাজের শেষে সে ঘন্টাকে ডাকিয়া লইয়া ভালো করিয়া দেখাইয়াছিল। তুমুল নেশার চোটে ঘন্টা তখন চোখ খুলিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। ফলে সে বুঝিতে পারে নাই যে বাঁশ দুইটি একেবারে আলগা বাঁধা হইয়াছে। কতকটা হামাগুড়ি দিয়া সে দড়ির উপর হাত বুলাইয়াই জড়ানো কণ্ঠে বলিয়াছিল, 'ঠিক আছে, বেশ বাঁধা হয়েছে'। নানান কাজের মধ্যে ভূপেনেরও পুরোটা ভালো করিয়া দেখা হয় নাই। এখন সময়কালে এই ভয়ঙ্কর বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
সেবুর মুখে ঘন্টার কথা শুনিয়া সকলেই একপ্রকার বিপদের ঘন্টাধ্বনি শুনিতে পাইলেন। কে কি বলিবে কেহ ভাবিয়া পাইলেন না। আশেপাশে কোথাও ঘণ্টাকেও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে যে জনতা দূরে জড়ো হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে এক অদ্ভুত গুঞ্জন শুরু হইল। সে গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়িয়া এক আশ্চর্য রূপ লইতে লাগিল। কারণ তাহারা কেহ জানিতে পারে নাই যে নৌকার এমন দুর্দশা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটিয়াছে। তাহারা ভাবিতে লাগিল, এইটি বোধহয় হরিসভা ক্লাবের শেষবেলার চমক, তুরুপের তাস। একেবারে অন্তিমলগ্নে আস্তিন হইতে বাহির করিয়াছে আদর্শ পল্লীকে মাত দিবে বলিয়া। এবং এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখিয়া তাহারা একেবারে হাঁ হইয়া গেল। তাহার কারণ হইল এই যে নৌকাটি হেলিয়া থাকিবার ফলে এক অদ্ভুত বাস্তব রূপ লইয়াছে। দূর হইতে দেখিলে মনে হইবে যে তুমুল ঝড়ের মধ্যে নৌকাটি কোনোপ্রকারে হেলিয়া গিয়া শেষ অবধি বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। সঙ্গে জলরাশির আবহশব্দ, মৃদু আলোর খেলা ও সন্ধ্যার মেঘাবৃত আকাশের মেলবন্ধনে গোটা ব্যাপারখানায় যেন এক মায়াবী দৃশ্যপট প্রস্তুত হইয়াছে। তাহাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিবার পর কয়েকটি উক্তি এধার ওধার থেকে উড়িয়া আসিতে লাগিল। যেমন সপত্নী সাগর ডাক্তার কহিলেন, 'ইট্স ওয়ান্ডারফুল ! এমেজিং' ! বাংলার শিক্ষক হলধর সামন্ত বলিলেন, 'দুর্দান্ত ! ওস্তাদের মার শেষরাতে'। মধু স্যাকরা বলিয়া উঠিল, 'কেয়াবাৎ ! শেষবেলায় হরিসভা কিন্তু দেখিয়ে দিলে'। কিছু কচিকাঁচার দল সহর্ষে হাততালি দিয়া উঠিল। উপস্থিত দর্শক সকলেই হরিসভার সৃজনী পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
বিধুচরণ ও তাঁহার দলবল হকচকিয়ে গেলেন। এ কি হইল ! যে মাঠ কিয়দকাল আগে পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ও স্বপ্নভঙ্গের আঁধারে ডুবিয়া যাইতেছিল এখন সেখানেই উল্লাস ও উৎসবের আলো জ্বলিতেছে ! বিধুচরণ চকিতে পুরোটা আঁচ করিয়া ক্লাবকর্তাদের বলিলেন, 'আমাদের শীঘ্রই এটা সামাল দিতে হবে। লোকজন যদি নৌকায় উঠে পড়ে তাহলে তো সবশুদ্ধু জলাঞ্জলি যাবে ? তখন কি হবে' ? ভূপেনমাঝি আগাইয়া আসিয়া কহিল, 'কত্তা, আমি ভালো করে দেখে নিয়েচি। দড়ি খুলে গেছে বটে, তবে নৌকায় লোক না উঠলে কিচ্ছুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এ নৌকা পড়বে না'। বিধুচরণ ভুরু কুঁচকাইয়া কহিলেন, 'কি করে বলছিস পড়বে না ?
- আজ্ঞে, দড়ি আলগা হয়েছে, কিন্তু বাঁশদুটো তো আর পড়ে যায় নি। সে দুটো এমন ভাবে মাটির সাথে গেঁথে আছে যে এই চাপটুকু বয়ে নিতে পারবে। তবে লোকজন যেন না ওঠে এইটে খেয়াল রাখতে হবে।
- ঠিক বলছিস ?
- আজ্ঞে মা দুগ্গার দিব্যি কত্তা, হলপ করে বলছি। বরং লোকজনদের দূর থেকে দেখাবার ব্যবস্থা করুন। দড়ি বেঁধে দিন, সবাই বাঁদিক থেকে ঠাকুর দর্শন করে ডানদিক দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যাবে।
- বেশ, সে ব্যবস্থা আমরা করছি, তবে নৌকা যদি পড়ে যায় তবে ওই বাঁশ খুলে আমি তোর পিঠে ভাঙব এই বলে দিলুম।
শেখর বলিল, 'আলগা দড়ি আরেকবার বেঁধে দিলেই তো হয়'। ভূপেন কহিল, 'না দাদা, এই অবস্থায় হাত লাগাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে মানুষ আটকাবার ব্যবস্থা করুন'। বিধুচরণ তৎক্ষণাৎ গোরার দিকে ইশারা করিলেন। গোরা ঘাড় নাড়িয়া দৌড়াইয়া দড়ির ব্যবস্থা করিতে গেল।
হরিসভার যেন সমস্ত দিক হইতেই শাপমোচন হইল। 'হেলা নৌকা' র মাহাত্ম্য ছড়াইতে বেশি বিলম্ব হইল না। লোকজনের মুখে মুখে রটিয়া গেল যে হরিসভার 'হেলা নৌকা' তাহাদের অভিনব কুশলী কায়দায় শেষবেলায় আদর্শ পল্লীকে টেক্কা দিয়াছে। এই দুর্দান্ত ও চমৎকার দর্শনীয় বস্তুটি না দেখিলে সমস্তটাই বৃথা। ক্রমে ক্রমে মানুষের আগমন ঘটিতে লাগিল। এবং সকলেরই মুখে একটি প্রশ্নই ঘুরিতে লাগিল যে হরিসভা এই আশ্চর্য হেলানো অবস্থাটি বাস্তবে সম্ভব করিল কি প্রকারে ? কিন্তু সেসকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কেহই দিতে পারিল না। ফলে 'হেলা নৌকা' লইয়া আগ্রহ যেন দিগ্বিদিক ছাপাইয়া গগনচুম্বী হইল। ষষ্ঠীর দিন সকাল হইতে স্রোতের ন্যায় মানুষের ঢল নামিল হরিসভার মাঠে। বিধুচরণ ও ক্লাবের অন্যান্যদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিল। হরিসভার ঘাম ছুটিয়া গেল ভিড় সামাল দিতে দিতে।
বিধুচরণ বিজয়ীর হাসি লইয়া ক্লাবের মধ্যে সকলকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা করিলেন যে এমন আনন্দ উৎসবের মধ্যে তিনি একটি ভোজের ব্যবস্থা করিতেছেন। ক্লাবের সকলেই যেন নিজ নিজ পরিবার লইয়া সপ্তমীর রাত্রে উক্ত ভোজে সামিল হন। সকলেই বিধুচরণের জয়ধ্বনি দিতে লাগিল। সেবু এক কোনে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে জিজ্ঞাসা করিল, 'ইয়ে জ্যেঠু, আমার একটি অনুরোধ আছে'। সকলে সেবুর দিকে আতঙ্কিত হইয়া চাহিয়া রহিল। বিধুচরণ ঘাড় নাড়িয়া কিছু বলিবার পূর্বেই সে আবার বলিয়া উঠিল, 'আমিও এই ভোজে রাঁধুনির সাথে দু একটা পদ রাঁধতে চাই, রাঁধবার আমার ভারী ইচ্ছে....... সেই ছোটোর থেকে..........'। সকলে সমস্বরে গগন বিদীর্ণ করিয়া তাহাকে ধমকাইল, 'সেবুউউউউউ ......' !
![]() |
| চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব |
Monday, September 18, 2017
সাপ্তাহিকী ৩১ # সেবুর প্যাণ্ডেল - প্রথম পর্ব
সেবু বড় আমুদে ছেলে। হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়া সে সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে উঠিয়াছে। রক্ত তাহার গরম। সে করিতে পারে না বিশ্ব সংসারে এমন কোনো কাজ নাই। অন্তত সে নিজে তাহাই বিশ্বাস করে। অবশ্য তাহার এই অতি চাঞ্চল্য শুধু তাহাকে নয় সময় বিশেষে তাহার বাড়ির লোকজনকেও যথেষ্ট বিপাকে ফেলিয়াছে। তাহার একমাত্র কারণ হইল সেবু ভারী পরোপকার করিতে ভালোবাসে। সে উপকার লোকের প্রয়োজনে লাগুক চাই না লাগুক সমাজসেবার নূন্যতম উপায় দেখিলেই সেবুকে ধরিয়া রাখা মুশকিল। যেন তেন প্রকারেন সেবুকে সে কাজ করিতেই হইবে। তাহাতে অধিকাংশ সময়ই অর্থের বিনিময়ে সেবুর জ্যাঠাকে সেসব অনর্থের মূল্য চোকাইতে হইয়াছে। কিন্তু ভবি ভুলিবার নহে।
এখানে বলিয়া রাখা ভালো, সেবুর বাড়িতে তাহার বাবা মা থাকিলেও বাড়ির গার্জেন হিসেবে তাহার জ্যাঠা অর্থাৎ বিধুচরণ মিত্রকে সে বেশ সমঝিয়া চলে। বিধুচরণ মনোহরপুরের নামকরা উকিল ও স্থানীয় ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। এলাকায় তাঁহার প্রতিপত্তি যথেষ্ট। বিয়ে থা করেননি। নিজে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়াছেন ও ছোট ভাইটিকেও শিখাইয়াছেন। ছোট ভাই স্কুলমাষ্টার বিদ্যাচরণ ও ভাতৃবধূ সরলা দুজনেই তাঁহাকে পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। বিদ্যাচরণ ও সরলার যখন পুত্রসন্তান হইল বিধুচরণ তখন তাহার নাম রাখিলেন সেবাব্রত। কিন্তু সেবাব্রত যে বড় হইয়া তাহার নামের প্রতি সুনাম বজায় রাখিতে তৎপর হইয়া উঠিবে তাহা তিনি ঘুনাক্ষরেও টের পান নাই। অথচ সেবুর বাবা মা হইতে তিনি সেবুকে অধিক স্নেহ করেন এবং কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ও দেন। এ যাবৎ সেবুর সমস্ত রকম বায়নাক্কা তিনিই স্মিতহাস্যে মিটিয়া আসিয়াছেন।
বিদ্যাচরণ দাদাকে এ বিষয় বলিতে গেলেই তিনি বলেন, 'আহা ! সেবু আমার আরজন্মের সন্তান, এই জন্মে তোদের কোলে এসেছে, ওকে কি আমি কিছু বলতে পারি' ? বিদ্যাচরণ তাহার দাদাকে নিরস্ত করিতে চায়, বলে, 'এ তোমার ভারী অন্যায় দাদা, ও চাদ্দিকে যা নয় তাই করে বেড়াচ্ছে, সে খবর তো পাও। কত জায়গায় নাজেহাল হতে হয়েছে বলত আমাদের, তাও কি তুমি ওমন চোখ বুজে থাকবে, একটুও শাসন করবে না ভাইপো কে' ? এ কথায় বিধুচরণ বলেন, 'তোরা করছিস তো শাসন, তাতে হচ্চে না ? আমাকেও লাগবে' ? বিদ্যাচরণ তৎক্ষণাৎ বলে, 'ও কি তোমাকে ছাড়া কারোর কথা শোনে না পাত্তা দেয় যে আমরা বললেই একেবারে বাধ্য ছেলের মতো ঘরে চুপটি করে বসবে' ? বিধুচরণ নিরুত্তর থাকেন, চুপ করিয়া চক্ষু বুজিয়া বারান্দার আরাম কেদারায় দোল খাইতে থাকেন। এই ধরণের বাক্যালাপ সাধারণত বেশিক্ষন গড়ায় না কোনোদিনই। বিদ্যাচরণও বিরক্ত হইয়া উঠিয়া চলিয়া যায়।
এ কথা সত্য যে সেবুর কান্ডকারখানায় পাড়াসুদ্ধু মানুষ ত্রস্ত। সে যে কখন কি করিয়া বসে তাহার ঠিক নাই। এই যেমন গত মাঘে চণ্ডীতলার মাঠে ফুটবল খেলার আয়োজন হইয়াছিল। সেখানে সেবু নিজে না খেলিয়া ক্লাবের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ধরিয়া একটি ম্যাচে রেফারি হইয়াছিল। সে বিশেষ কিছু করে নাই শুধু দুইটি ভুল পেনাল্টি দিয়াছিল। যাহার ফলে পাড়ার ক্লাব সেবার দুটি গোল বেশি খাইয়া লীগ হইতে একেবারে বাহির হইয়া যায়। ক্লাবের প্রেসিডেন্টের পদে বিধুচরণ ছিলেন বলিয়া সে যাত্রা সেবু কোনোমতে পার পাইয়া যায়। নয়ত ঠিক হইয়াছিল পাড়ার মোড়ে সেবুকে কান ধরিয়া গুনে গুনে পঞ্চাশ বার ওঠবস করিতে হইবে এবং গোবর মাখিয়া নিজের হাতে একশত ঘুঁটে প্রস্তুত করিতে হইবে। তাহার জ্যেঠু ক্লাবের ছেলেদেরকে বসিয়া পাঁঠার মাংসভাত খাওয়াইবার ব্যবস্থা করাইতে তবে তাহারা ক্ষান্ত হয়। এমন লঙ্কাকাণ্ড আরও আছে তবে সেসব বলিতে গেলে নূতন করে রামায়ণ রচনা করিতে হইবে।
যাহা হউক, তাহার পর হইতে সেবু খানিক দমিলেও সময়ানুক্রমে তাহার এই পরোপকারের পোকাটা নড়িয়া ওঠে মাঝে মাঝেই। এমনই একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলি।
শ্রাবন মাস। পুজোর আর বেশি দেরি নাই। মনোহরপুর তো বটেই আশেপাশের তল্লাটেও একেবারে সাজসাজ রব পড়িয়া গিয়াছে। মেঘলা আকাশে রোদের লুকোচুরিতে মানুষের মনে আগমনীর ছোঁয়া কাশফুলের মতোই দোদুল্যমান। রবিবারের বিকেল। বিধুচরণ তাহার বাড়ির বৈঠকখানায় ক্লাবের কর্তা ব্যক্তিদের সহিত আসন্ন শারদ উৎসব লইয়া আলোচনা করিতেছেন। মনোহরপুর সম্বন্ধে যাহারা খোঁজ খবর রাখেন তাহারা জানেন মনোহরপুরে মহা আড়ম্বরে দুইটি বড় পূজা হয়। বিধুচরণদের ক্লাব - 'হরিসভা' এবং 'আদর্শ পল্লী'। এই দুইটি ক্লাবের মধ্যে রেষারেষিও চরম হইয়া থাকে। কে কাহাকে কিভাবে টেক্কা দিবে তাহা লইয়া বহুদূর অবধি জল গড়ায়। প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জা, আলো ও আবহশব্দের মিশেলে দুইটা পুজোই দেখিবার মতো এক একখানা বস্তু তৈরী হয় বটে। আশেপাশের অঞ্চল তো বটেই বহুদূর হইতেও শয়ে শয়ে মানুষ জমা হয় এই আশ্চর্য কাণ্ডদ্বয় সচক্ষে দেখিবে বলিয়া। তাহার উপর আবার প্রাইজের হাতছানি রহিয়াছে। এ যাবৎ হরিসভা সর্বাধিক বার ফার্স্ট প্রাইজ পাইয়া ক্লাবের ও বিধুচরণের সুনাম বজায় রাখিয়াছে। কিন্তু এই বছরের পুজো লইয়া সকলেই একটু বেশি চিন্তিত। তাহার কারণ হইল এই, যে খবর পাওয়া গিয়াছে এই বৎসর আদর্শ পল্লী নাকি উড়োজাহাজ বানাইবে। শহর হইতে নামকরা কারিগর ও দক্ষ মিস্ত্রী লইয়া তাহারা অতিপূর্বেই তাহাদের কাজ আরম্ভ করিয়াছে। জনান্তিকে শোনা যাইতেছে, যেরূপ গতি ও লক্ষ্য লইয়া আদর্শ পল্লী অগ্রসর হইতেছে তাহাতে তাহারা একেবারে ফার্স্ট প্রাইজটি লইয়া তবে থামিবে।
স্বভাবতই বৈঠকখানায় হরিসভার কর্মকর্তাদের মুখ তমসাচ্ছন্ন হইয়া আছে। সকলেই বিধুচরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বসিয়া আছেন। এই সংকট মুহূর্তে তাঁহাদের একমাত্র ভরসা তিনিই কারণ তাঁহার বুদ্ধি ও অর্থের উপরই নির্ভর করিবে এই বৎসর হরিসভার কি থিম হইবে। অথচ বিধুচরণ তাহার সাধের তক্তপোশের ওপর বসিয়া নির্বিকার তামাক সেবন করিতেছেন। কোনো কথা কহিতেছেন না। ক্লাবের সেক্রেটারী মাঝবয়েসী শেখর চৌধুরী নিরুপায় হইয়া বলিয়া উঠিলেন, 'মিত্রমশাই কিছু বলুন, আমরা তো কোনো হদিসই পাচ্ছিনা। তেমন কিছু না হলে আদর্শ পল্লীকে ঠেকানো মুশকিল হবে এবার'। বিধুচরণ তাহার তামাকের নলটি একপাশে সরাইয়া রাখিয়া খানিক দাবড়ানির স্বরে কহিলেন, 'দ্যাখো শেখর, তুমি বলছ বিশ্বেশ্বরের মন্দির করবে আর গোরা বলছে তাজমহল বানাবে। বলি তারপর কি দুজন সেক্রেটারি আর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিলে শিবঠাকুর আর শাজাহান হয়ে বটতলার মোড়ে বিড়ি ফুঁকবে ? কি ভেবেছ কি ? টাকাটা আসবে কোত্থেকে শুনি, য়্যাঁ ?
'আজ্ঞে টাকাটা যদি আমরা সবাই মিলে এ বছর একটু বেশি করে তুলি, তাহলে' ? গোরা মিনমিন করিয়া জিজ্ঞেস করে। বিধুচরণ ব্যঙ্গ করিয়া বলেন, 'টাকা কি শিউলি ফুল, যে কাছে গেলাম আর টুক করে তুলে নিলাম। চাঁদা বাড়ালেই যে সবাই রাজি হবে তাতো আর নয়। দিনকাল যা পড়েছে তাতে ট্যাক্সোর ঠেলায় মানুষ পাজামা ছেড়ে হাফ প্যান্টে নেমে এসেছে আর তুমি বলছ বেশি করে টাকা তুলি, হুঁহ' ।
শেখর আমতা আমতা করিয়া জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে উপায়' ? বিধুচরণ বলেন, 'সে কিছুটা নাহয় আমিই দিলাম আর কিছুটা চাঁদা উঠলো, কিন্তু বাকিটা ? তার কি কোনো উপায় ভেবেছ' ? বিজন মুখ বাড়াইয়া বলে, 'আজ্ঞে স্পনসর জোগাড় করতে পারলেই কিন্তু অনেকটাই.......... ' ।
কথাটা শেষ করিতে দেন না বিধুচরণ,ধমক দিয়া বলেন, 'গন্ডমূর্খের মতো কথা বোলো না বিজন, এটা কলকাতা নয় যে কোম্পানিগুলো একমাস আগে থেকেই সারিবাঁধা বাঁশের ওপর লাফিয়ে উঠে বসে পড়বে। এটা মনোহরপুর এখানে নিজেদের টাকা নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে সেটা মাথায় রাখো'। এ কথায় বিজন ও অন্যান্যরা মুষড়িয়া পড়িল। বিধুচরণ আবার বলিয়া উঠিলেন, 'ওহে বিজন, তুমি তো ক্যাশিয়ার, হিসেবে করে বলো দিকি, বাকি টাকার অঙ্কটা ঠিক কত' ? সে ব্যস্ত হইয়া খাতাপত্র খুলিয়া বলিল, 'আজ্ঞে সর্বসাকুল্যে লাখখানেক মতো কম পড়ছে' ।
বিধুচরণ গম্ভীর মুখে বলিলেন, 'নাহ, তাহলে বিশেষ কিছু করা যাবে না দেখছি। কম বাজেটের মধ্যে কিছু একটা ভাবা হোক'।
এ কথায় সকলেই মাথা চুলকাইতে লাগিল। আদর্শ পল্লী কে টক্কর দিবার মতো তেমন কিছু কারোরই মাথায় আসিল না। সবাই এর ওর মুখের দিকে দেখিতে লাগিল। নানারকম ইশারা করিতে লাগিল কিন্তু কাজের কাজ কিছু হইল না। বিকেল গড়াইয়া সন্ধ্যা নামিল।
এমন সময় বিজন ঘরের দক্ষিণ দিকে আঙুল তুলিয়া কি একটা দেখাইয়া ভূ.... ভূ....করিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িয়া দিল। তাহার চিৎকারে উপস্থিত সকলেই চমকাইয়া সে দিকে মুখ তুলিয়া তাকাইল। যাহা দেখিল তাহাতে সবারই পিলে ছাদ ফুঁড়িয়া লাফাইয়া উঠিল প্রায়। একটি ঘন কালো বিটকেল মূর্তি তাহাদের দিকে চাহিয়া দাঁত বার করিয়া হাসিতেছে। কিছুক্ষন পর সেই মূর্তি কথা কহিয়া উঠিল। 'কি গো বিজন দাদা, ভয় পেলে নাকি গো ? আমায় চিনতে পারোনি' ? তাহার গলার স্বর বিধুচরণ চিনিতে পারিয়া কহিলেন, 'এ কিরেএএএ ? সেবু ! একি দশা করেছিস নিজের ! এতো পাঁক মেখে এলি কোথা থেকে' ? ঘরের সকলেই 'সেবু' নামটি শুনিয়া ধড়ে প্রাণ ফিরিয়া পাইল। সেবু ঠিক তেমনই দাঁত বাহির করিয়া বলিল, 'ওই ঘোষেদের বাগানে পেয়ারা পাড়তে উঠেছিলুম, পা ফস্কে পাশের ডোবাটায় পড়ে গেছিলুম আর কি' ?
- ছিছিছি সেবু, এতো বয়সেও তুই পেয়ারা চুরি করে খাচ্ছিস ? কেন শীতলকে বললে অমনি দুটো পেয়ারা তোকে পেড়ে দিতে পারতে না যে তুই একেবারে গাছে উঠে চুরি করতে গেলি ?
- না জ্যেঠু, শীতল ঘোষ ভারী নচ্ছার লোক, পেয়ারা চাইতে গেলে দুকথা শুনিয়ে দেয়.....
ঘরের মধ্যে উপস্থিত গোরা ঘোষের মুখচোখ শক্ত হইয়া গেল। তাহারই সামনে সেবু তাহার বাবাকেই গালাগাল করিতেছে । সে দিকে এক নজর দিয়া বিধুচরণ সেবুকে ধমকাইলেন, 'ছিঃ সেবু, ওকি মুখের ভাষা ? গুরুজনের প্রতি সম্মান রাখা উচিৎ। তাছাড়া তুমি পেয়ারা চুরি করে মোটেও ঠিক করোনি, পারলে সেগুলো ফেরত দাও এক্ষুনি'। সেবু ব্যাজার মুখ করিয়া প্যান্টের দুই পকেট হইতে দুটা প্রমান সাইজের পেয়ারা বাহির করিয়া গোরার সামনে ধরিল। পাঁকমাখা দুইটা পেয়ারা গোরা ফিরিয়া লইতে চাহিল না। নাকে হাত দিয়া কহিল, 'থাক থাক, ছোট ছেলে পেড়ে এনেছে যখন, খাগ্গে, ও কি আর এমন' ? সেবু কঠিনস্বরে কহিল, 'না, জ্যাঠামশায়ের হুকুম, ও তোমায় নিতেই হবে'। গোরা করুণমুখে বিধুচরণের মুখের দিকে একবার চাহিয়া কহিল, 'আচ্ছা আচ্ছা রেখে দে এখন, যাবার সময় নিয়ে যাব'।
পেয়ারাগুলো যথাস্থানে রাখিয়া সেবু একগাল হাসিয়া কহিল, 'তা তোমাদের কি আলোচনা হচ্ছিল ? আদর্শ পল্লী নিয়ে কি একটা শুনলুম যেন' ?বিধুচরণ চিন্তান্বিত হইয়া বলিলেন, 'হ্যাঁ, আদর্শ পল্লী এবার যা প্যান্ডেল করছে তাতে করে আমাদের ঠাকুর দেখতে আর তেমন ভিড় হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া বিরাট কিছু করবার টাকাও নেই আমাদের। কি করে যে সমস্ত দিক ব্যবস্থা করি সেটা ভেবেই আর কুলকিনারা পাচ্ছি না....' ?
'শুনলুম তারা নাকি উড়োজাহাজ করছে' ? সেবু জিজ্ঞাসা করে।
- হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিস.......
সেবু চটপট কহিল, 'তা বেশ তো। তোমরা বরং একটা পালতোলা নৌকো করো। ওদেরটা আকাশের আর আমাদেরটা জলের। সমানে সমানে লড়াই হবে। তাছাড়া নৌকো তৈরীর খরচও বিশাল নয়'। সবাই যে যার মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতে লাগিল। অর্থাৎ প্রস্তাবটা যে খুব একটা মন্দ নয় তার আভাস সকলেরই মুখেচোখে খানিক খেলিয়া গেল। বিজন ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'সে কিরকম' ? বাকিরাও উৎসুক মুখে সেবুর দিকে চাহিয়া রহিল। সেবু বলিল, 'কেন ভূপেন মাঝি আর তার সাকরেদদের বললে ঠিক কম খরচায় কিছু না কিছু একটা করে দেবে। ওরা তো হামেশাই নৌকা বানায়, জানোই তো। এই তো গেল হপ্তাতেই একটা বড় নৌকো ভাসালো তমালনদীর জলে, মনে নেই ? ওদেরকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চই করবে। তাতে হরিসভার মানও থাকে, খরচও কম হয়'।
হাতের কাছে এরকম একটা সস্তা অথচ লোভনীয় প্রস্তাবে সকলেই প্রায় লাফাইয়া উঠিল। বিধুচরণ ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, 'উত্তম প্রস্তাব সন্দেহ নেই কিন্তু ভূপেন কম খরচায় নৌকা বানাতে রাজি হবে ? নৌকার খরচও তো নেহাত মন্দ নয়'। সেবু বীরের হাসি হাসিয়া বলিল, 'গোটা নৌকো তো আর বানানো হচ্চে না, নৌকোর আদলে প্যাণ্ডেল হবে। ও তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও জ্যেঠু, আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব। হাজার হোক হরিসভার সম্মান বলে কথা, রাজি সে হবেই'। বিধুচরণ বাকিদের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, 'তোমরা কি বলো হে সবাই.....কি শেখর ? তুমি তো সেক্রেটারি, তোমার কি মত' ?
শেখর ঘাড় নাড়িয়া বলে, 'আজ্ঞে বিশ্বেশ্বরের মন্দিরটা বেশি ভালো ছিল তবে এই প্রস্তাবটা বাজেটে কুলিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এখন ভূপেনমাঝির সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা বলে ফাইনাল করে নিলেই হয়'। বিধুচরণ আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন, 'বেশ, তাহলে ভূপেনকে কালই একবার সন্ধ্যের দিকে বাড়ি আসতে বলিস সেবু, আর তোমরাও থেকো সকলে'। সেবু খানিক ইতস্তত করিয়া বলিল, 'আচ্ছা বলে দেব। তবে, ইয়ে......মানে আমার একটি শর্ত আছে'। বিধুচরণের ভুরু কুঁচকাইয়া যায়, জিজ্ঞেস করেন, 'শর্ত !! তোর আবার কিসের শর্ত রে' ? বাকিরাও সন্দেহের চোখে সেবুর দিকে তাকাইয়া রহিল। সেবু অস্ফুটে বলিল, 'ভূপেন মাঝিদের সাথে আমিও প্যাণ্ডেল বাঁধব। আমার খুব ইচ্ছে......' ।
#bengalishortstories #durgapujastories #pujabarshiki
Monday, September 11, 2017
অনুপদ্য - ১৬
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Wednesday, August 30, 2017
অনুপদ্য - ১৫
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Thursday, August 17, 2017
Monday, August 7, 2017
সাপ্তাহিকী ৩০ # প্রতিবিম্ব - অন্তিম পর্ব
এ কথায় মৈথিলী সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে যায়। আঙুলের নখ দিয়ে চেয়ারের কোন খুঁটতে থাকে। কিছুক্ষন বাদে ডঃ সেন আবার কোমলস্বরে জিজ্ঞেস করেন, 'আমি জানি মৈথিলী, জীবনের কিছু কিছু প্রশ্ন বড্ড জটিল হয়, কিন্তু তার উত্তর না পেলে যে আমার চিকিৎসা পদ্ধতি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুতরাং, আপনার মনে এই সময় কি চলছে সেটা জানা ভীষণ জরুরী'।
কিছুক্ষন নীরব থেকে অস্ফুটে বলে ওঠে মৈথিলী, 'আমি সঠিক জানি না, তবে এই ক দিনে আমার কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে জানেন, প্রতিদিন দেখতে দেখতেই হয়তো........এক অদ্ভুত চাহিদা তৈরী হয়েছে, তবে সেটাকে ইমোশনাল এট্যাচমেন্ট বলে কিনা আমার জানা নেই ডক্টর'।
- আচ্ছা, আপনি বলছিলেন আপনাকে কেউ ফলো করছে কয়েকদিন ধরে, তাকে দেখেছেন কখনো ?
- না, আসলে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের গলিটা বেশ অন্ধকার থাকে, তাই হয়তো তেমন ঠাহর করে উঠতে পারিনি। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে, হয়তো বা আমারই মনের ভুল। হয়তো তেমন কিছু নয়। সবটাই মিথ্যে।
ডঃ সেন ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা পঞ্চাশ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, 'বেশ, আজ বরং এই অবধিই থাক মৈথিলী। আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। পরপর কয়েকদিন নিয়ম করে খেয়ে যান। সপ্তাহখানেক বাদে আবার আসবেন। তখন নাহয় আমরা আরেকটা সেশন করব। কেমন' ?
মৈথিলী প্রেসক্রিপশন ভাঁজ করতে করতে বলে, 'আয়নায় অন্য মুখ দেখা একদমই স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তা আমি জানি ডক্টর। আর তাছাড়া আমি ভূত প্রেতে মোটেই বিশ্বাস করি না। করলে একা ফ্ল্যাটে কিছুতেই থাকতে পারতাম না। আমি জানি না কেন এমনটা হচ্ছে । আচ্ছা ডক্টর,....আমার ঠিক কি হয়েছে সেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন ?
- কিছুটা........যদিও আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হবে আপনি হ্যালুসিনেট করছেন।
- হ্যালুসিনেশন !! কিন্তু কেন ?
- সেই প্রশ্নের উত্তরটাই তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে মৈথিলী। আমার বিশ্বাস সে প্রশ্নের উত্তর আগামী সেশনেই পাব। আপাততঃ আপনি ওষুধগুলো খেয়ে যান। চিন্তার কিছু নেই। বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট কার্ল জাং কি বলেছেন জানেন ?
মৈথিলী দুদিকে ঘাড় নাড়ে।
- বলেছেন, 'who looks outside.......dreams ; who looks inside......awakes'। সুতরাং, মনের ভেতরের মানুষটাকে জানা খুব প্রয়োজন, ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট সেটা.........আমাদের আবার দেখা হবে মৈথিলী।
ডঃ সেন দুহাত জড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন। মৈথিলী প্রতিনমস্কার করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডঃ সেন চিন্তাক্লিষ্ট মুখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে, মনে মনে সম্ভাব্য ঝড়ের আভাস টের পেলেন বোধহয়।
সপ্তাহখানেক বাদে। ডঃ সেনের চেম্বারে মৈথিলীকে অনেকটা ক্লান্তিমুক্ত লাগে। মুখের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ ভাব লক্ষ্য করা যায়। 'কেমন আছেন মৈথিলী' ? মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করেন ডঃ সেন।
- আগের থেকে ভালো....
- ওষুধগুলো ঠিকঠাক চলছে তো ?
- হ্যাঁ, যেমনটা বলে দিয়েছেন..... ইদানীং রাত্রে ভালো ঘুম হচ্ছে।
- বেশ বেশ, এতো সুখবর......
একথায় আলগা হাসে মৈথিলী। ডঃ সেন দু চোখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'এর মধ্যে সেই মুখটা আর দেখতে পেলেন' ?
- রোজ দেখিনি, তবে এই কদিনে বার দুয়েক দেখেছি....
- কোথায় ? বাড়িতে না বাইরে ?
- বাড়িতেই.....
- চিনতে পারলেন ?
- নাহ, কিন্তু আগের বারের মতো এবারেও ভীষণ চেনা মনে হলো জানেন।
- হুমমম........... কোনোরকম কথার আদান প্রদান ?
- নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম.....
- কি বলল ?
- কিছু বলেনি, শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে.....
- কিন্তু তার নাম তো আপনার জানার কথা, তাই না মৈথিলী ?
'আমার জানার কথা' !! মৈথিলী বিস্মিত হয় খুব। 'এ আপনি কি বলছেন ডঃ সেন ? আমি জানলে কি আপনাকে বলতাম না.....'
ডঃ সেন বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুলে বললেন, 'এমনও তো হতে পারে আপনি বলতে চান না......'
- এ কেমন কথা ডক্টর ! নাম লুকিয়ে আমার কি লাভ ? আর খামোকা লুকোতেই বা যাব কেন ?
- বেশ........আমরা একটা কাজ করি বরং মৈথিলী, আজ আপনি আপনার অতীতের কথা বলুন আমাকে, যতটা পারবেন.....আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো সূত্র আমরা পাবই। কি, বলবেন তো ?
- বেশ, বলব.....
ডঃ সেন নিজের চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে এলেন সামনে, ঈষৎ ঝুঁকে বললেন, 'আপনি যাতে মুক্তমনে সবটা বলতে পারেন তার জন্য আমাকে সামান্য হিপটোনিজমের সাহায্য নিতে হবে। শুধু আপনি মনের দরজা জানলাগুলো সম্পূর্ণ খুলে রাখবেন, তাতে আপনার ভার লাঘব হবে শতগুন। আমি কথা দিচ্ছি, এতে কোনোরকম ঝুঁকি নেই'। মৈথিলী মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে । দুহাত কোলের ওপর জড়ো করে নিস্তব্ধ বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত। ডঃ সেন মৈথিলীর মনের ভাব আন্দাজ করতে পেরে বললেন, 'দেখুন, এই হিপ্নোটিজমটা সম্পূর্ণ আপনার সম্মতির ওপরেই নির্ভর করছে। আপনি রাজি না হলে আমি কখনোই জোর করব না'। মৈথিলী মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, 'আমি জানি ডক্টর, আমায় শুধু বলুন আপনি কি জানতে পারবেন ওই মুখটা কার' ?
- আমার বিশ্বাস আমি পারব, যদি আপনি কোয়াপরেট করেন তবেই......
মৈথিলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।
- আর কি দেখতে পাচ্ছেন ?
- আমি বসে আছি ............সামনে দুমড়ানো মুচড়ানো একটা কাগজ..........
- কিসের কাগজ ?
- চিঠি..............ইন্দ্রনীলকে লিখেছিলাম.........
- তারপর ?
-সে ফেরত দিয়ে গেছে.........বলেছে আমার গার্লফ্রেন্ড হবার যোগ্যতা নেই........আমি কাঁদছি.......একা.....
- আর কি দেখছেন মৈথিলী ?
কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা......... আবার মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এল.......
- আউট্রাম ঘাট................হাওড়া ব্রিজ.............চারিদিকে সন্ধ্যের আলো জ্বলছে........
- আপনি একা ?
- না...............পারিজাত আছে......
- পারিজাত ?
- পুরোনো অফিসের কলিগ.......
- কি বলছে পারিজাত ?
- বিয়ে করতে পারবে না...........
- কেন ?
- বাড়িতে...............সুন্দরী বৌ চায়...............আলো নিভে যাচ্ছে.........আমি কাঁদছি.............একা.......
- আর কিছু মনে পড়ছে মৈথিলী, আর কিছু ?
"আপনি কেন মৈথিলীকে কষ্ট দিচ্ছেন ? কি চান আপনি"..........??
চমকে ওঠেন ডঃ সেন। দু হাতে চেয়ারের হাতলদুটো আঁকড়ে ধরেন উত্তেজনায়। বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে থাকেন মৈথিলীর দিকে। সন্দেহের তীর যে এতো অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যভেদ করবে বিশ্বাস করতে পারেন না। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, 'ক্কে, কে কথা বলল' ? কিছুক্ষনের শীতল নীরবতা বয়ে যায় সমস্ত ঘর জুড়ে । ডঃ সেন আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, 'বলুন, কথা বলুন, কে আপনি'। কোনো এক অতল গভীর থেকে সে পুরুষ কণ্ঠস্বর আবার কথা বলে ওঠে, 'আমি ময়ূখ..... ময়ূখ দাশগুপ্ত'।
- ময়ূখ !! কে ময়ূখ ?
- আমি মৈথিলীকে ভালোবাসি......
ডঃ সেন প্রায় হাঁ হয়ে গেলেন এই কথায়। কিছুক্ষনের জন্য মুখে কোনো কথা সরল না। পরক্ষণেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, 'আপনাদের পরিচয় হল কি করে' ?
- চিঠি লিখত !! আপনাকে ?
- হ্যাঁ........প্রতি রাত্রে নিয়ম করে...........ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয় ......আমরা ভালোবাসতে শুরু করি একে অপরকে।
- মৈথিলী আপনাকে ভালোবাসে ? আপনাকে বলেছে সে কথা ?
- হ্যাঁ বলেছে, চিঠির মধ্যে দিয়ে.......নিঃশব্দে জেনেছি আমরা একে অপরকে.............. প্রতিনিয়ত আয়নার মধ্যে দিয়ে খুঁজে নিয়েছি দুজনকে ..............মৈথিলী আমার প্রাণ...........মৈথিলী আমার প্রেম।
- কিন্তু......আপনি তো মৈথিলীরই অন্য স্বত্বা। নিজের সাথেই নিজের সম্পর্ক তৈরী হওয়া..... এ কি করে সম্ভব ?
- নিজেকে ভালোবাসা অপরাধ নাকি ডাক্তার ? কে বলে ?
- কিন্তু আপনি মৈথিলীর দুর্বলতাকে আশ্রয় করে তার মনে বাসা বেঁধেছেন......একথা মৈথিলী জানলে সে কখনোই আপনাকে প্রশ্রয় দিত না।
'আপনি ভুল বলছেন ডঃ সেন', চিৎকার করে ওঠে পুরুষ কণ্ঠস্বর, 'আপনি ভুল..........আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক, বেঁচে থাকার প্রেরণা'।
- না আমি ভুল নই ময়ূখ, আমি একজন স্পেশালিস্ট ডাক্তার, সমস্তটা জেনেই আমি বলছি। পক্ষান্তরে আপনি মৈথিলীর চরম ক্ষতি করছেন।
- আমি ক্ষতি করছি মৈথিলীর ? আমি !!
- অবশ্যই করছেন, একটা অবাস্তব সম্পর্কের বন্ধনে মৈথিলীর মনস্তত্বে আপনি ধীরে ধীরে ক্ষত সৃষ্টি করছেন। সময়ের সাথে সাথে সে ক্ষতের আকার এমন বিপর্যয় ডেকে আনবে, তখন মৈথিলীকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
- না না, আমি মানি না, আপনার সমস্ত কথা মিথ্যে।
- আমার কথা বিশ্বাস করুন ময়ূখ, আপনি বরং মৈথিলীকে বোঝান, সে নিশ্চই বুঝবে আপনার কথা। সময় বিশেষে তার কষ্ট হবে একথা ঠিক, কিন্তু এই অলীক সম্পর্কের জেরে মৈথিলীকে আপনি অজান্তেই নিদারুন বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। আপনি কি চান না মৈথিলী সুস্থ হয়ে আর চার পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকুক ? ভালোবেসেছেন যখন, তখন ভালোবাসাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্য নয় কি ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আবার একা হয়ে পড়বে ? তখন ?
- উনি আজ একা আছেন, কাল নাও থাকতে পারেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকায় আপনি অন্তরায় হবেন কেন ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আমায় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে.......
- ঠিক, কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঘটনার অস্বাভাবিকতায় সে নিজেই একজন ডাক্তারের পরামর্শ চেয়েছে। সুতরাং আপনি যদি তার বাস্তব হতেন তাহলে সে কখনোই আমার কাছে আসতো না। তাই না ??.....বলুন ময়ূখ ? বলুন আমাকে......
ডঃ সেন চশমা মুছতে মুছতে বলেন, 'মনস্তত্ব বড় জটিল জিনিস মৈথিলী। মানুষের মনের হদিস পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার, বিশেষ করে সে মন যদি রোগাক্রান্ত হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে মানুষের মন হচ্ছে কতকটা সমুদ্রের মতো। আমরা সাইকিয়াট্রিস্টরা সেই সমুদ্রের মাঝে ডুব দিয়ে কিছু কিছু স্পন্দন ছুঁয়ে আসতে পারি মাত্র। অধিকাংশটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আপনার ক্ষেত্রেও কতকটা তাই ঘটেছে। বেশ কিছুটা জানতে পেরেছি, বাকিটা সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পাবে আশা করি.....'। মৈথিলী অবাক হয়ে বলে, 'আপনি ঠিক কি বলছেন, আমি তো কিছুই............'।
'বলছি', স্মিত হাসেন ডঃ সেন, চশমাটা গলিয়ে নিয়ে বলেন, 'আপনার যে রোগটি হয়েছে সেটি সচরাচর দেখা যায় না। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার, সংক্ষেপে ডিআইডি। প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার। অর্থাৎ একই দেহের মধ্যে একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি। আমার অনুমান এই রোগ সম্বন্ধে আপনি শুনে থাকবেন আগে, কারণ এই বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্বে রিসার্চ চলছে এবং অগণিত বই ও সিনেমাও বেরিয়েছে। মৈথিলী একরাশ বিস্ময় মিশিয়ে বলে, 'আর.... আর সেই মুখটা, সেই মুখটার ব্যাপারে জানতে পারলেন কিছু' ?
মৈথিলী বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, 'কেমন করে.......? উত্তরে ডঃ সেন বলেন, 'একাধিক প্রত্যাখ্যান ও বহুদিনের নিঃসঙ্গতার কারণে আপনি মনে মনে এমন এক পুরুষ চরিত্রের কল্পনা করেছেন যে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে কোনোরকম কারণ ছাড়াই। বিশেষত রূপের কারণে তো নয়ই। আমরা সাধারণ মানুষ সেটাই চেয়ে থাকি, কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার দরুণ আপনার ক্ষেত্রে সে ভালোবাসার আবির্ভাব ঘটেনি বলেই আপনি এক কাল্পনিক প্রেমিকের চিত্র এঁকেছেন মনে মনে। রাতের পর রাত প্রেমপত্র লিখেছেন কোনো এক অজ্ঞাত ভালোবাসার মানুষকে। এবং পরবর্তীকালে, অজান্তেই, 'ময়ূখ দাশগুপ্ত' নাম দিয়ে আপনি হাজির করেছেন সেই কল্পনার পুরুষকে। আপনার কল্পনার তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি তাকে বিভিন্ন জায়গায় হ্যালুসিনেট করতে শুরু করেন, কখনো বাড়িতে আবার কখনো বাইরে। কিন্তু আপনি আমাকে একটা ছোট্ট অথচ ভাইটাল ইনফরমেশন চেপে গেছেন। আমার বিশ্বাস আপনার এই চিঠি লেখালিখিটা আরও আগের থেকেই। কিন্তু পরে যখন আপনি চোখের সামনে একটা মুখ দেখতে পেলেন তখনই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। কারণ আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এইবার এই ঘটনাগুলো একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। তবে যেহেতু এটা আর্লি স্টেজ এবং আপনার মৈথিলী সত্ত্বার প্রভাব অনেকাংশেই বেশি তাই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কিছুটা এড়ানো গেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেতে সময় লাগবে এখনো।
মৈথিলী উদ্বিগ্ন মুখে বলে, 'তাহলে ডক্টর, এখন উপায়' ?
- একমাত্র উপায় হচ্ছে রেগুলার কাউন্সেলিং, নিয়মিত কিছু ওষুধ খাওয়া ও মানসিক জোর বাড়ানো।
- তাহলেই কি আমি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবো ?
- হাই চান্স, তবে অধিকাংশটাই আপনার ওপর ডিপেন্ড করছে। আপনি কি চাইছেন এবং মনকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন সেটাই মেজর ইস্যু। এখন থেকে আপনার প্রধান কাজ হবে ময়ূখের সত্বাকে কোনোরকম ভাবেই ইনফ্লুয়েন্স না করা এবং এই বিষয়ে কোনোভাবেই চিন্তা না করা। অবসর সময় ভালো বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, অথবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিন। মনকে শান্ত রাখা বড় কঠিন মৈথিলী, আমি জানি, কিন্তু এই কঠিন কাজটাই আপনাকে করে যেতে হবে। বাকিটা আমি চেষ্টা করব সাধ্যমতো। এই ওষুধ কটা লিখে দিলাম, এগুলো কোনোভাবেই বন্ধ করবেন না, তাহলে কিন্তু আবার এটাকটা হতে পারে। আমার বিশ্বাস আমরা যদি দুজনেই যথাযথ চেষ্টা করি, তাহলে এই রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। আপনি বরং সামনের সোমবারই চলে আসুন, সেদিন থেকেই আপনার থেরাপি শুরু হবে। কেমন ?
সমস্তটা শুনে মৈথিলী ধীরে ধীরে উঠে পড়ে সোফা থেকে। একবুক চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ। কোনো রকম শব্দ খরচ না করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মন্থর গতিতে ।
পরদিন সকালে নিয়মমতো এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে মৈথিলীর। পরদার ফাঁক দিয়ে মনখারাপের আলো ঢুকে পড়েছে যেন। কেমন যেন অন্য রকম একটা দিন আজ, মেঘলা, ছন্নছাড়া মতো । বিছানা ছেড়ে উঠে অলস পায়ে একটা ছোট দেরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রয়ারটা টানতেই ভেতর থেকে কিছু ওষুধের পাতা আর একগোছা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আসে। ডঃ সেনের কথা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ । ঘুম থেকে উঠেই ওষুধটা খাওয়ার কথা বলেছেন। ওষুধের পাতাটা হাতে নিয়ে কাগজের টুকরোগুলোয় চোখ বোলাতে থাকে মৈথিলী। ময়ূখকে লেখা সমস্ত চিঠি। ওষুধটা খাওয়া মানেই ময়ূখকে ভুলে যাওয়ার পথে এক কদম বাড়ানো। ময়ূখের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সূত্রপাত। গভীর চিন্তা করে মৈথিলী। নিজের সাথে কয়েক দিনের অন্তরঙ্গতায় তার সমস্ত দুর্বলতাকে ছাপিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বাদ পেয়েছে সে। অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে সে এতদিনে। নিজের বিপরীত স্বত্বার প্রতি অনুরাগ হলেও নিখাদ, নিষ্পাপ প্রেমই তো ! এটাই তো চেয়েছিল সে। ওষুধ খেলে সুস্থ হবে হয়তো, ভালো করে বাঁচতে পারবে কি ? বেঁচে থাকা কাকে বলে..... ? এক অদ্ভুত উভয়সংকটে পড়ে দিশাহীন খাঁচার পাখির মতো ছটফট করতে থাকে মৈথিলী। এমন সময় কোনো এক নিভৃত অতল থেকে এক পুরুষের মরমী কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, 'মৈথিলী.............মৈথিলী................'
মৈথিলী দ্রুত হাত চাপা দেয় কানে। কিন্তু সে অদম্য কণ্ঠস্বর সমস্ত প্রতিরোধ কাটিয়ে আবার ডেকে ওঠে, 'মৈথিলী...................' ওষুধের পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মৈথিলী। সমস্ত পিছুটান, সংযম, মিথ্যে করে একছুটে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আয়নায় চোখ রেখে বলে ওঠে,...........
Labels:bengali short stories articles poems molat
ছোট গল্প,
রহস্য-রোমাঞ্চ,
সিরিজ
Saturday, August 5, 2017
সাপ্তাহিকী ২৯ # প্রতিবিম্ব - প্রথম পর্ব
হাঁটতে হাঁটতে সমানে পিছনে তাকাতে থাকে মৈথিলী। বর্ষার রাস্তায় জুতোর ভারে মশমশ শব্দ হতে থাকে। সন্তর্পণে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সে চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। এক নিঃশব্দ আশঙ্কা যেন বেড়ালের মতো গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। কেউ পিছু নিয়েছে নাকি ? ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে একবার দেখে নেয়.... নাহ ! কেউ তো নেই। গলির শেষ প্রান্তে বড় রাস্তার আধা নীলচে আলো বৃত্তাকারে এলিয়ে পড়ে আছে। তাহলে কি মনের ভুল ?...... বুড়োশিবতলা থেকে কয়েক পা এগিয়ে বাঁ দিকের এই সরু গলিটা প্রায়শই অন্ধকার থাকে। ত্রিশ ফুট অন্তর পরপর তিনটে স্ট্রিট ল্যাম্প। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কখনো কখনো জ্বলে না কোনোটাই। বাকি এলাকার তুলনায় আপাত নির্জীব এই গলিটার প্রতি কেউই খুব একটা পাত্তা দেয় না। সুতরাং আলোর চেয়ে অন্ধকারেই ডুবে থাকে ফুট আটেকের চওড়া এই পথটা। তাতে অবশ্য মৈথিলীর খুব একটা সমস্যা হয় না, কিন্তু গত কয়েকদিনে এই পিছু নেওয়ার ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। বিশেষ করে রাত্রি সাড়ে আটটা নটার পর, অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই টের পাওয়া যাচ্ছে যেন। মৈথিলী ভেবে পায় না তার পিছু কেন কেউ নিতে যাবে।
মৈথিলীর পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস, অবিবাহিতা। সুন্দরী বা সুশ্রী কোনোটাই বলা চলে না তাকে। মুখে গোটাকয়েক বসন্তের দাগ, গায়ের রং গাঢ় শ্যামলা, শরীরের গড়ন স্থূল। সুতরাং এমন কুরূপা মাঝবয়েসী মহিলাকে ফলো করবে এমন আহাম্মক এই পাড়ায় কেন, আশেপাশের পাড়াতেও নেই বললেই চলে। অবশ্য হালফিলের কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনায় আট থেকে আশি যেখানে কেউই রেহাই পাচ্ছে না, সে তো নস্যি মাত্র। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গলিটা কোনোরকমে পার করে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে মৈথিলী। কোলাপ্সিবল গেটে তালা দিয়ে দু তিন বার চেক করে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালায়।
দু কামরার এই ফ্ল্যাটটায় একাই থাকে সে। সামনে একটা ছোট্ট ড্রইং রুম পেরিয়ে দুদিকে দুটো বেডরুম। বাঁ দিকে টয়লেট আর কিচেন। কাজের লোক বা রান্নার লোক রাখেনি মৈথিলী। একার সংসারে নিজেই হাত বাড়িয়ে সমস্তটা করে ফেলে। বরং বলা ভালো করতে পছন্দ করে। শাড়িটা চেঞ্জ করে এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে টিভির সুচটা অন করে। খাওয়া দাওয়ার পর এই সময়টা বেশির ভাগ টিভি দেখেই কাটিয়ে দেয় মৈথিলী। এই সময়টা তার ভারী পছন্দের ধারাবাহিক হয়...... 'সাজন'। একটি নামকরা হিন্দি চ্যানেলের মুখ্য অভিনেতাকে বেশ লাগে তার। ধপধপে ফর্সা গায়ের রং, দুর্দান্ত স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম ছেলেটির দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকাটা একরকম অভ্যেস হয়ে গেছে যেন। ফোনটাকেও সাইলেন্ট করে রাখে এই সময়। মনে মনে ছেলেটিকে কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে মৈথিলী।
পরদিন সকালে এলার্মের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তার। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর ছোট ঘড়িটাকে শান্ত করে। অভ্যাসমত স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে অর্ধমুদ্রিত চোখে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়ায় মৈথিলী। সামনের পুরোনো, মলিন আয়নায় নিজের মুখটাকে দেখে বারকতক। মনে মনে ভাবে আবার একটা দিন, আরও একবার একঘেঁয়ে একাতিত্বের সময় নিয়ে নিষ্ফল বেঁচে থাকা। নিমেষে তেতো হয়ে যায় মনটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করতে থাকে মন্থর গতিতে। মুখ ধুয়ে, মাথা তুলে আরেকবার আয়নার দিকে তাকাতেই তীক্ষ্ন আর্তনাদ করে ভয়ে ছিটকে সরে আসে মৈথিলী। আতঙ্কে মুখ সাদা হয়ে যায় তার। হাত থেকে টুথব্রাশটা ঠক করে মেঝেতে পড়ে যায়। চরম বিস্ময়ে চেয়ে দেখে আয়নায় কার যেন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। একটা পুরুষের মুখাবয়ব। অমায়িক ভঙ্গিতে নিস্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক ঝটকায় পিছন ফিরে তাকায় মৈথিলী। কি আশ্চর্য ! পিছনে তো কেউ নেই ! তাহলে কি ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকল ? কোনো চোর টোর, নাকি অন্য কেউ ? তাড়াতাড়ি ড্রয়িং রুমের চারপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে মৈথিলী।
সামনের দিকে দুটো বেতের চেয়ার, একটা কাঁচের টেবিল, ডানদিকের ঘরের কোনায় একটা ছোট বসার টুল। একপাশে একটা মাঝারি সাইজের কাঠের আলমারি। কই কেউ তো কোথাও নেই ! তাহলে কি পাশের ঘরে ঢুকল ? একছুটে লাগোয়া ঘরটায় গিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজে মৈথিলী। বাঁদিকে ঠাকুরের কিছু ফটো আর একটা লোহার ফোল্ডিং খাট ভাঁজ করে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা আছে। যেখানে যা ছিল তার থেকে একচুলও এদিক ওদিক হয়নি কিছু। বারান্দা থেকেও একবার ঘুরে এল সে। কি আশ্চর্য, লোকটা উবে গেল নাকি ? কোলাপ্সিবল গেটে তালা ঝুলছে, বারান্দাটাও গ্রিলে ঘেরা, সুতরাং বাইরে থেকে আসা বা বেরোনোর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাহলে গেল কোথায় ? নাকি ভুল দেখল সে ? পায়ে পায়ে আরেকবার বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মৈথিলী। বুকের মধ্যে তীব্র ধুকপুকানি নিয়ে উঁকি দিল আয়নায়। ডিম্বাকৃতি আয়নার ওপর নিজের মুখ ছাড়া আর কোনো কিছুর চিহ্ন নেই সেখানে। একটা হিমেল স্রোত বয়ে যায় সারা শরীর জুড়ে। দু চারবার ঢোঁক গিলে নিজের বেডরুমে গিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। একি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল ? পাগল পাগল লাগতে থাকে তার। একলা থাকার নরক যন্ত্রনা কি তাকে পেয়ে বসল শেষে ? না না এ মনের ভুল হবে নিশ্চই। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিতে থাকে মৈথিলী।
ধীরে সুস্থে কোনোরকমে নিজেকে স্থির করে রেডি হয়ে নিয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে আরও একপ্রস্থ দরজা, কোলাপ্সিবল গেট ভালো করে পরীক্ষা করে নিয়ে বেরোয়। নিত্য নৈমিত্তিক কিছু কাজ আর কাজের ফাঁকে দু একজন কলিগের সাথে সামান্য আলাপচারিতা, এছাড়া তার একপেশে জীবনে তেমন কোনো হিল্লোল ওঠে না। বন্ধুবান্ধব প্রায় নেই বললেই চলে। রূপের কারণে পুরুষ বন্ধু তো একেবারেই নেই। ঈশ্বর কেন যে তার এই দিকটায় কার্পণ্য করলেন কে জানে। বিধাতার কাছে এই নিয়ে তার অনুযোগ বিস্তর, কিন্তু হায়, সে অনুযোগ বোধহয় লক্ষকোটি প্রার্থনার ভিড়ে তাঁর দরবার অবধি গিয়ে পৌঁছয় না।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে নিয়মিত কাজ সেরে মৈথিলী ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখের বসন্তের দাগের ওপর আঙ্গুল বোলাতে থাকে অন্যমনস্ক হয়ে। অজান্তেই ভিজে ওঠে চোখের কোণ। নিজের অদৃষ্টকে অভিশাপ দিতে থাকে মনে মনে।
অকস্মাৎ, আয়নার দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে ! এ কি ! এ কি দেখছে সে আবার চোখের সামনে ? তার মুখের গড়নটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে আয়নায়। এক লহমার জন্য হৃদকম্পন স্তব্ধ হয়ে যায় যেন। ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে মৈথিলী তাকিয়ে থাকে একঠায়। সকালের সেই পুরুষ মুখের পুনরাগমন ঘটে কাঁচের ওপর অবিকল এক জায়গায়। এক মর্মভেদী চিৎকার করে ওঠে মৈথিলী। মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে..........
- এরকমটা কি আগেও হয়েছে ?
- কক্ষনো না....
- কতদিন থেকে হচ্ছে এমনটা ?
- তা প্রায় সপ্তাহ তিনেক হল। প্রথম দুবার বাড়িতেই হয়েছিল। ইদানিং বাইরেও হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট যেখানেই আয়না দেখছি সেখানেই......
- আপনি কি ড্রাগ বা অন্য কোনোরকম কিছু...... ?
- না না, আমার কোনোরকম নেশা নেই।
ষাটোর্দ্ধ ডঃ অবিনাশ সেন গম্ভীর হয়ে গেলেন একথা শুনে। দু হাতের আঙুলের ওপর থুতনি রেখে চেয়ে রইলেন মাটির দিকে। মৈথিলীর চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। পরপর কয়েক সপ্তাহের দুরন্ত ঝঞ্ঝা প্রায় ন্যুব্জ করে দিয়েছে তাকে। কলকাতার এই অন্যতম নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টের নাম জানতে পারে অফিসেরই এক কলিগের থেকে। প্রথম প্রথম মন সায় দেয়নি। কিন্তু পরের দিকে ঘটনাগুলোর তাৎপর্য বুঝে আর উপেক্ষা করেনি সে। ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তড়িঘড়ি দেখা করতে এসেছে তাঁর দেশপ্রিয় পার্কের চেম্বারে। চেম্বারটা অবশ্য ওনার বাড়িতেই। ক্ষনিকের বিরতিতে চারপাশটা নজর বোলায় মৈথিলী। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা বড় সুদৃশ্য হলঘরে মুখোমুখি দুটো গদিওয়ালা চেয়ার। একপাশে একটা কারুকাজ করা টিপয়, তার ওপর বাহারি ফুলদানি বসানো। মখমলি কার্পেটের ওপর পা রাখলেই চোখ বুজে আসে আপনি। একটা শান্ত ধীর স্থির ভাব রয়েছে গোটা ঘর জুড়ে। দুদিকের দেওয়াল জুড়ে নয়নাভিরাম অয়েল পেন্টিং। একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। পশ্চিমের জানলা দিয়ে বিকেলের নরম আলো ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরটায় বেশ মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বোধহয় পেশেন্টদের জন্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে এমনটা বানানো। ডঃ সেন মুখ তুলে তাকালেন আবার।
- আপনি কি একাই থাকেন ফ্ল্যাটে ?
- হ্যাঁ...
- বরাবর ?
- আসলে আমি জ্যাঠার কাছে মানুষ। এটা ওনারই ফ্ল্যাট। অনেক ছোটবেলায় আমার বাবা মা মারা যান। তারপর জ্যাঠাই নিজের কাছে নিয়ে আসেন আমাকে। পড়াশুনার সমস্ত দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। নিজের মেয়ের মতো বড় করেছেন আমাকে। বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান ছিলেন। তাই অপত্য স্নেহের ছায়ায় কখনো বাবা মার অভাব বুঝতে দেন নি। মৃত্যুর আগে আমায় ফ্ল্যাটটা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন।
- বেশ........আপনি বিবাহিতা ?
- নাহ, আগেও ছিলাম না, এখনো নই......
- কোনো বিশেষ কারণ ?
- (সামান্য হাসি) সেটা আমাকে দেখেও বুঝতে পারছেন না ডঃ সেন ?
- কিরকম ?
- রূপ বড় বিষম বস্তু ডক্টর। এর ক্ষমতা গগনস্পর্শী। অথচ কি অদ্ভুত দেখুন, এর স্থায়িত্ব কিন্তু ক্ষণকালের। আমরা সাধারণ মানুষ রূপের মোহতেই ভুলি, রূপের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা হৃদয়ের খোঁজ করতে যাইনা সচরাচর। কথাতেও আছে না, 'পেহলে দর্শনধারী ফির গুণবিচারী' । আমার ক্ষেত্রে কথাটা একেবারে একশো শতাংশ খাঁটি।
- কিন্তু কখনোই কি আপনার জীবনে.......মানে আমি বলতে চাইছি আজকের দিনে রূপের কারণে বিয়ে না হওয়াটা........
- হ্যাঁ, অত্যন্ত আশ্চর্যের বটে। কিন্তু আমার জীবনে ঠিক তাই ঘটেছে। আমি যে বিয়ে করতে চাইনি তা নয়। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন বাঁকে যে সমস্ত পুরুষের সংস্পর্শে এসেছি তারা কখনোই প্রেম নিবেদন করেনি আমায়, উল্টে আমার দিক থেকে অনুরাগের লেশমাত্র অনুমান করতে পারলেই তারা যেন নিজেরাই সরে যেত মানে মানে। তাই আর...........
- বেশ, আমায় একটা কথা বলুন দেখি এবার ?
দু চোখে একরাশ বিষাদ নিয়ে তাকায় মৈথিলী। ডঃ সেন প্রশ্ন করেন, 'আচ্ছা, আয়নায় যে মুখ আপনি দেখছেন, সে কি প্রত্যেকবার একই মানুষ, নাকি সময়বিশেষে পাল্টে যাচ্ছে' ?
- না না, প্রত্যেকবার একই মুখ, একই গড়ন, একই চোখ, নাক, কান.......কিচ্ছু পাল্টাচ্ছে না.....
- এরকম দেখতে কারোর কথা মনে পড়ে আপনার ?
ব্যস্ত হয়ে ওঠে মৈথিলী, বলে, 'আমি জানিনা, আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু, বহু অতীতের ঘটনা আবার নতুন করে মনে করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিচ্ছু মনে পড়েনি। অথচ যখনই আমি আয়নায় ওই মুখটা দেখি আমার ভারী চেনা মনে হয় জানেন। মনে হয়, কোথায় যেন দেখেছি একে, কোথায় যেন......... কিন্তু কিছুতেই......... ওহ, আমি পাগল হয়ে যাব ডঃ সেন, আমি পাগল হয়ে যাব......'
দুহাতে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মৈথিলী। অব্যক্ত যন্ত্রণার মেঘ ছড়িয়ে পড়ে ঘরের চারপাশে। ডঃ সেন এগিয়ে এসে মৈথিলীর দুটো হাত ধরেন। বলেন, 'আপনি ধৈর্য ধরুন। এতো সহজে ভেঙে পড়বেন না। আপনি যাকে দেখছেন তাকে আমরা ঠিক খুঁজে বার করবই। নিন একটু জল খান'। একটা জগ থেকে খানিকটা জল গ্লাসে ঢেলে এনে মুখের সামনে ধরলেন ডঃ সেন। মৈথিলী সবটুকু শেষ করে রুমাল বার করে চোখ মুখ মুছে নিজেকে গুছিয়ে নেয় আবার। ডঃ সেন পরের প্রশ্ন করেন।
- আপনি কি সেই মুখের একটা বয়স আন্দাজ করতে পারেন ?
- হ্যাঁ পারি....... মাঝবয়েসী, এই পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে........
- কেমন দেখতে ?
- মন্দ না, গায়ের রং ময়লার দিকেই, ব্যাকব্রাশ করা চুল, গোলগাল মুখ, হালকা দাড়ি আছে, চোখের চাউনি বেশ মায়াময়.....
- আপনি কি কমিউনিকেট করতে পারছেন তার সঙ্গে, মানে এই কয়েক সপ্তাহে আপনি তো প্রায় অনেক বার দেখেছেন......
- কমিউনিকেট ? না, তা পারিনি, কিন্তু প্রতিবার মনে হয়েছে সে যেন কিছু বলতে চাইছে আমায়...... আমি তার চোখ দেখেছি জানেন ডক্টর, সে চোখে অনেক আবদার, অনেক কথা লুকিয়ে আছে, কি অদ্ভুত প্রাণের আকুতি সে চোখে, কি করুণ মায়াভরা দৃষ্টি......আ আমি প্রত্যেকবার তাকে ছুঁয়ে দেখতে গেছি, কিন্তু তারপরই হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, নয়তো সে মিলিয়ে যায়।
- তার মানে এখনো পর্যন্ত সে কোনোরকম এগ্রেসিভ আচরণ করেনি, তাই তো ?
- না না, একেবারেই নয়, বরং সে শুধুই তাকিয়ে থেকেছে, কখনো এমনি, কখনো বা সরল দৃষ্টিতে, আবার কখনো......
- আবার কখনো ?
- কখনো আবার স্মিত হেসেছে.......
- হেসেছে ?........ স্ট্রেঞ্জ !
- হ্যাঁ, মানে, কেন যে করছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি.....
মৈথিলীর সলাজ কণ্ঠস্বরের আবেগ ডঃ সেনের চোখ এড়াতে পারে না। সে দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করেন তিনি, 'আমায় একটা সত্যি কথা বলবেন ? মানে, আপনি কি কোনোভাবে..........সেই মুখের সাথে ইমোশনালি এট্যাচড হচ্ছেন' ?
(ক্রমশ)
![]() |
| চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব |
Labels:bengali short stories articles poems molat
ছোট গল্প,
রহস্য-রোমাঞ্চ,
সিরিজ
Monday, July 24, 2017
রেনি ডে
আজ নিয়ে তিন দিন হল। একটানা, অবিরাম বৃষ্টিতে কলকাতা কার্যত ভাসছে। কোনোরকমে হাতের ছাতাটা সামলে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নিউআলিপুর অবধি এসেছি। এমন সময় টালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিক থেকে একটা ট্যাক্সি ডান দিক বরাবর এসে প্রায় শৈল্পিক ভঙ্গিমায় গর্তের ভেতর থেকে কয়েক আঁজলা জল ছিটিয়ে প্যান্টের অর্দ্ধেকটা ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম আর মনে মনে যথেচ্ছ শাপ শাপান্ত করতে লাগলুম ট্যাক্সির ড্রাইভারকে। বৃষ্টির তোড়ে ততক্ষনে আমার জামাটার ডান পাশটাও ভিজতে শুরু করেছে। ঝাপসা চশমার ভেতর থেকে প্রাণপণে একটা অটোর খোঁজ করে চলেছি। কিন্তু আমার কপালকে আমি খুব চিনি। বেশ কিছুক্ষন নির্বিবাদ সপসপে ভিজে সর্দি না ধরানো অবধি কোনো অটো পাব না। অগত্যা ফুটপাথের ওপর ত্রিভঙ্গ মুরারীর এঙ্গেল প্রাকটিস করতে লাগলুম আর একমনে ভাবতে লাগলুম ঈশশশশ অফিসেও যদি একটা করে রেনি ডে হতো !!......................... ঝাঁ করে মনে পড়ে গেল বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
তখন আমি ক্লাস টু কিম্বা থ্রী। আমাদের স্কুলের জুনিয়র সেক্শনটা মেনকা সিনেমার ঠিক পিছন দিকটায় ছিল। সেবার দারুন বৃষ্টির মধ্যেও স্কুলের বাসে করে এসেছি। শুধু আমি নই। আমার মতো হাভাতেরা যাদের স্কুল অন্ত প্রাণ ছিল এবং যারা বৃষ্টির দিনে চুপচাপ বাড়িতে বসে পেঁয়াজি ভাজাটা কোনো কাজের কথা মনে করতো না, তারাও প্রায় সকলেই এসেছে। গত রাত থেকে তুমুল বৃষ্টি হওয়ার ফলে স্কুলের সামনে এক কোমর জল তখন ডুব সাঁতারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে সীমাহীন সমূদ্র ও অজস্র পাঁকের জঞ্জাল সাঁতরে গেট অবধি পৌঁছনোর আগেই শুনলাম আজ স্কুল বন্ধ। দূর থেকে আমাদের আন্টিদের দেখলুম হাত নেড়ে সবাইকে ফিরে যেতে বলছেন। এ আবার কি কথা ! শনি, রবিবার আর ছুটির দিন ছাড়া কখনো স্কুল বন্ধ হতে শুনিনি। আজ কি হল ? বিভিন্ন কথাবার্তায় জানতে পারলুম স্কুলে জল ঢুকেছে। কি আশ্চর্য ! স্কুলে আবার জল ঢোকে নাকি ?
আসলে ওই সেকশনে বছরের প্রথম মাসগুলোতে আমাদের কোনোরকম বর্ষার অভিজ্ঞতা হয়নি। সুতরাং এহেন গভীর নিম্নচাপে স্কুলেরও যে নিদারুণ চাপ হতে পারে এ আমাদের কল্পনাতীত ছিল। যাই হোক মুখের কথায় আমি খুব একটা বিশ্বাসী ছিলাম না তখনও। তাই সে দুর্দান্ত জলরাশিকে তুচ্ছ মনে করে কোনোক্রমে গেট অবধি পৌঁছে যা দেখলুম তাতে করে আমার সে যাবৎ পড়া পৃথিবীর সমস্ত আশ্চর্য মিথ্যে হয়ে গেল একেবারে। আমাদের সেই স্কুলটা বাইরের পিচ রাস্তার থেকে বেশ কিছুটা নিচু ছিল। অর্থাৎ সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে, একটা চাতাল পেরিয়ে খানিকটা হেঁটে গিয়ে বাঁ দিকের সরু রাস্তা ধরে সোজা ক্লাসরুমগুলোতে গিয়ে শেষ হতো। অমনটা হওয়ার কারণ যে কি ছিল সে আমি জানতে পারিনি কখনো। যাইহোক, মুখ বাড়িয়ে দেখলুম, সেই চাতালটায় প্রায় বুক সমান ঢেউ উঠছে একের পর এক। ছোটখাট স্কুবা ডাইভিং করা যাবে এতটাই জল জমেছে সেখানে। আমাদের দারোয়ান ও স্কুলের অন্যান্য স্টাফরা একপ্রকার ডাইভ দিয়েই বালতি বালতি জল তুলে পাশের গলিটায় ফেলছেন আর প্রায় ইঁদুর তাড়ানোর মতো করে ছেলেমেয়েদের গেট থেকে ভাগিয়ে দিচ্ছেন । এহেন জিনিস আগে দেখিনি প্রায় কেউই। স্বভাবতই বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো সে 'বার্তা রটে গেল ক্রমে'। যারা ছিল তারা তো রইলই, যারা চলে যাচ্ছিল তারাও সবাই মিলে জড় হয়ে সে আশ্চর্য দৃশ্যর নিস্পলক সাক্ষী হতে লাগল। পরবর্তী কালে এই দৃশ্যের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলুম তার কারণ অধিক বৃষ্টিপাতে যে আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যাবে এটা আন্দাজ করাটা খুব একটা পারদর্শিতার কাজ ছিল না। কিন্তু তাই বলে স্কুল কামাই করতুম না আমরা কিছুতেই।
এর বহু বছর পর এই ছুটির দিনগুলোর সঠিক সদ্ব্যবহার করার উপায় বের করে ফেললুম আমরা সকলেই। তখন আমার ক্লাস টেন। আমাদের সিনিয়র সেকশনটা তখন সাদার্ন এভিনিউতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা পিঠের দুপাশে অদৃশ্য পাখার উপস্থিতি টের পেতে শুরু করেছিলুম। এবং সময়নুসারে সে পাখা মেলে ধরতেও আমরা কিছুমাত্র কুন্ঠা বোধ করতুম না। সেবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন সকাল থেকেই মেঘের বজ্রনিনাদ ও তাল মেলানো অক্লান্ত বর্ষণে আনন্দে নেচে উঠেছিলুম। ভেবেছিলুম এই বিল্ডিংটায় জল জমুক না জমুক, এমন ঘনঘোর ঝঞ্ঝায় আর কিছু না হোক রেনি ডে টা অন্তত হবে। আর তারপরেই দিগ্বিদিগ শূন্য হয়ে আমরা চষে বেড়াবো শহরের মেঘ্লাতম দিনে। কিন্তু প্রকৃতি যে আমার আবেগ নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলবে এ আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। স্কুলে যখন পৌঁছলুম তখন বৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে থেমে গেছে। গেট খুলে গেছে এবং নির্বিবাদে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার একটা অপ্রত্যাশিত উপক্রম দেখা দিয়েছে। স্বভাবতই ভীষণ ভেঙে পড়লুম। আমার মতো আরও অনেকে যারা এই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার অপেক্ষায় ছিল তাদের সকলের মুখ চুন। কানাঘুষোয় জানতে পারলুম অনেকেই বুড়ি ছোঁয়ার মতো স্কুলটা ছুঁয়েই মেনকা বা নবীনার উদ্দেশ্যে রওনা হবে ভেবেছিল। কিন্তু তাদের সকলেরই এখন মাথায় হাত। ঘোর কালিমালিপ্ত চোখ মুখ নিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে ঘোরাফেরা করছে স্কুলের সামনেটাতেই। এহেন সময় গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো আরেকটা সংবাদ পেলুম। কিছু কিছু স্টুডেন্ট যারা আদ্যোপান্ত বৃষ্টিতে ভিজেছিল তাদেরকে পত্রপাঠ বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। যারা ভেজেনি তাদের নিয়ে বাকি ক্লাস হবে এমনটা ঠিক হয়েছে। এমনকি পাঁচ ছজন হলেও। এই খবরে প্রায় মুচ্ছ যেতে বসেছিলুম আমরা কয়েকজন। কোনো এক বিশেষ কারণে আমরা তখন খরার মত শুকনো। জলের কোনো ছিটেফোঁটা গায়ে লাগেনি। তার কারণ বৃষ্টিতে ভেজাটা উদ্দেশ্য ছিল না। রেনি ডের ষোলোকলা পূরণ হবে ভেবে আগাম বাঁচিয়ে রেখেছিলাম নিজেদের। কে জানবে জলের অভাবে আমাদের সমস্ত প্রকল্প একেবারে জলাঞ্জলি যাবে !
এমন করুণ পরিস্থিতিতে আমরা যখন প্রায় মড়া কান্না জুড়েছি এমন সময় এক বন্ধু আঙ্গুল তুলে এমন এক জিনিস দেখালে যা দেখে হৈহৈ করে এক পৈশাচিক উল্লাসে ওকে প্রায় কাঁধে তুলে আমরা নাচতে লাগলুম। আমাদের মেন্ বিল্ডিংটার ঠিক পরের বাড়িতে দক্ষিণদিকে দেওয়ালঘেঁষা একটা পুরোনো পাইপ ছিল। কোনোভাবে সেই পাইপ ফেটে হড়হড় করে একেবারে বানের জলের মতো জল বেরোচ্ছে তখন। আমরা আর কালক্ষেপ না করে গলির দিকে মুখ করে পরপর সব দাঁড়িয়ে পড়লুম সেই পাইপের তলায়। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও এমন অভাবনীয় আকস্মিক বর্ষার ধারাপাত হবে ভাবিনি। ফলস্বরূপ যে কজন আমরা কাকভেজা ভিজেছিলাম তাদের সকলেরই ছুটি মঞ্জুর হল এবং বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে আমরা তড়িঘড়ি নবীণার দিকে দৌড় দিলুম। এখনো মনে আছে, সেবার নুন শোয়ে নবীনার রিয়ার স্টলের প্রায় তিনটে রো শুধু মাত্র স্কুলের স্টুডেন্টেই ভর্তি ছিল........
শুধুমাত্র এই সমস্ত কার্যকারণে নয়, বন্ধুদের সাথে নিছক আড্ডা দিয়ে নিরলস সময় কাটানোর অন্যতম দিনও ছিল রেনি ডে। গড়িয়াহাটের অটোয় যেতে যেতে ভাবছিলাম, আমার আড়াই বছরের পোলাপানটা এমনই এক বৃষ্টির দিনে স্কুল যাওয়ার আশ্চর্য বায়না জুড়েছিলো। নানারকম ভয় ও প্রলোভনেও সে পিছপা হয় নি একটুও। শুধু আমি জানি, এমন দিনেই স্কুল যেতে হয় কারণ এমন দিনগুলোতেই তো রেনি ডে হয়...........
![]() |
| ছবি ও চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব |
#rainyday #rain #bengaliarticle
Labels:bengali short stories articles poems molat
প্রবন্ধ
Saturday, July 15, 2017
ইন্ডিয়া - পাকিস্তান
রাতঘড়িতে তখন বারোটা দুই। বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক্ষন। রাস্তার ওপর সোডিয়াম ল্যাম্পের চিকন আলো ছাড়া আর কোথাও কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। ড্রয়িং রুমের ডানদিকে নীল সোফার ওপর আধশোয়া হয়ে একের পর এক চ্যানেল ঘুরিয়ে চলেছি আনমনে। লক্ষ্য একটাই - ভালো সিনেমা দেখা। বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে গত কয়েকদিনে না লেখার দরুন যে মেঘ জমা হয়েছে তার তাড়নায় মন খারাপের কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। কথায় বলে 'অভাবে স্বভাব নষ্ট'। তেমনই আমার সময়াভাবে, লেখা নষ্ট হওয়ার জোগাড় হতে বসেছে। এমন মনঃপীড়া নিয়ে ছটফট করতে করতে যে চ্যানেলটায় এসে থামলাম, ভাবিনি লেখার রসদ পেয়ে যাব সেখানেই।
ইন্ডিয়া - পাকিস্তান ম্যাচ, মহিলাদের, তদুপরি হাইলাইটস। তবুও শেষ অবধি চোখ ফেরাতে পারিনি কোনোভাবেই। যাঁরা দেখেননি তাঁদের অবশ্যই বলব, সুযোগ করে একবার দেখে নিন। আমি জানি, আমরা সচিন, সৌরভ, সেওয়াগ, যুবরাজ , ধোনি, কোহলি, রায়নাদের যুগশিল্প দেখে দেখে চোখে হাজা ধরিয়ে ফেলেছি। সেখানে মেয়েরা একটু ব্যাট করবে,হাত ঘুরিয়ে বল করবে, এ আবার রাত জেগে দেখার কি আছে ? তাহলে বলি, পুনম রাউত, দীপ্তি শর্মা, সুষমা ভর্মা - এঁদের যাঁরা চেনেন না তাঁরা আগামী দিনে এঁদের নাম মুহুর্মুহু শুনতে পাবেন এ বিষয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। তুলনামূলক ভাবে মন্থর হলেও এঁরা যে ইনিংসগুলো খেললেন তাতে করে ইতিহাসের পাতায় সহজেই নাম তুলে ফেললেন ভারতবর্ষের নীলরত্নরা। দুরন্ত কভার ড্রাইভ, স্কোয়ার কাট ও স্ট্রেট ড্রাইভ গুলো শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, তার পিছনে যে দৃপ্ত ফুটওয়ার্ক ও মধুর টাইমিংয়ের যুগলবন্দী দেখলাম তাতে বারবার হৃদয় জুড়ে একটাই শব্দ উঠে আসছিল - 'কেয়াবাৎ'......'কেয়াবাৎ'। পুনম রাউত একটুর জন্য হাফ সেঞ্চুরি মিস করে গেলেও সুষমা ভর্মা ও ঝুলন গোস্বামীর নির্ভীক লফ্টেড শটগুলো যখন পাকিস্তানী ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারি লাইনে আছড়ে পড়ছিল ঝড়ের গতিতে, তখন ভরা রাতেও সোফা ছেড়ে হাততালি দিতে কোনো কসুর করিনি। যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম তার থেকে মন ভালো হয়ে গেছিল দ্বিগুণ। যদিও বিস্মিত হওয়ার বাকি ছিল অনেক। খেলার ফল আগে থেকেই জানতাম তবু চোখে দেখার বিস্ময় থেকে বঞ্চিত হইনি বিন্দুমাত্র।
ফিল্ডিং এর সময় প্রায় ফিতে দিয়ে লাইন লেংথ মাপা বোলিংয়ের ধার ও ভারে এক এক করে কেটে যেতে লাগলেন পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানরা। ঝুলন গোস্বামীর মসৃন একশন, গুড লেংথ বোলিং ও একতা বিস্তের ধারালো স্পিনে প্রথম ধাপেই ১০ রানের মধ্যে পাকিস্তান তিন উইকেট হারিয়ে ডুবন্ত নাবিকের মতো ছটফট করছিল। পরের দিকে মানসী যোশী ও একতা বিস্তের তালমেলানো নিখুঁত বোলিং পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডারে শেষ পেরেকগুলো পুঁতে দিয়ে চলে গেল। এর সাথে অনবদ্য ফিল্ডিং - যেখানে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রান আটকানোর চেষ্টা, পাকিস্তানের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এমন অনমনীয়, অদম্য লড়াই হালফিলে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। ভারতের ১৬৯ রান নিঃসন্দেহে স্কোরবোর্ডের বিস্ময় নয় তবে ৭৪ রানে ১০ উইকেট ফেলে দেওয়াটা যে পাকিস্তানের আজন্ম লজ্জার কারণ হয়ে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ম্যাচটা লাইভ দেখার আফশোষ ছিল বহুদিন, তবে হাইলাইটসটা অনেকাংশেই সে ক্ষতে মলমের কাজ করেছে। বিশেষ করে পুরুষদের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত - পাকিস্তান ফাইনাল ম্যাচের পর। মহিলাদের ভারতকে কুর্ণিশ ও অসংখ্য সাধুবাদ, গর্বের মুকুটে এক নতুন পালকের সংযোজন হল, হৃদয়েও.........
![]() |
| বিন্যাস : নিজস্ব |
#IndiaPakistanICCWomensWorldCup2017 #cricketarticles #ICCWomensWorldCup2017
Labels:bengali short stories articles poems molat
প্রবন্ধ
Saturday, July 1, 2017
সাপ্তাহিকী ২৮ # ছোট্ট উপহার
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। দুর্যোগের কালো মেঘ যেন ঘনিয়ে এসেছে গোটা শহর জুড়ে। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ফলা বর্শার মতো ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। প্রবাহ দক্ষিণের জানলার সমানে এসে দাঁড়ায়। অনতিদূরে স্ট্রিট ল্যাম্পের নিয়ন আলো ফোঁটায় ফোঁটায় জানলার কাঁচ ভেদ করে চুঁইয়ে পড়ছে। প্রবাহ সেদিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। পাশের বাড়ির এসবেস্টসের ছাদে কোনো এক মোহময় ছন্দে জলের তীব্রধ্বনি বেজে চলেছে এক নাগাড়ে। খুব কাছেই কোথাও একটা কড়কড় শব্দে বাজ পড়ে। কেঁপে ওঠে প্রবাহ। আজ রাত্রিটা অফিসেই কাটাতে হবে মনে হচ্ছে। কয়েক ঘন্টার একটানা বৃষ্টিতে অফিসের আশেপাশের এলাকায় জল জমেছে বেশ। এই অবস্থায় বাইক চালিয়ে কসবা থেকে বাড়ি ফেরা একপ্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া কাল সকালেই আবার অফিস থেকে সুন্দরবন যেতে হবে তাকে। সুতরাং সমস্ত দিক ভেবে অফিসেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে প্রবাহ। বসকে আগাম জানিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষন আগে বাড়িতেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।
উল্টো দিকের চাইনিজ রেস্তোঁরার হাক্কা নুডলস দিয়ে চটজলদি ডিনার সারা হয়ে যায় তার। দশটা অবধি জনা তিনেক ছিল অফিসে। ধীরে ধীরে তারাও যে যার সুবিধেমতো বেড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই। অতঃপর এই চারতলার বিল্ডিংটায় ভূতের মতো চুপচাপ রাত কাটানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সিকিউরিটি আছে একজন অবশ্য, নাম হরিপদ। সেও বোধহয় এতক্ষনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে লোহার গেট বন্ধ করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। নিচের থেকে হিন্দী গানের একটা কলি ভেসে আসছে যেন। হরিপদ বোধহয় রেডিও চালিয়েছে। গুনগুন করে সেই সুরটা ভাঁজতে ভাঁজতে প্রবাহ সোফার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। পশ্চিমের এই ঘরটা খুব একটা বড় না হলেও বেশ আরামদায়ক। দক্ষিণ আর পূর্ব দিকে একটা করে জানলা, কোণের দিকে একটা টেবিল, ডান পাশে একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর খানকতক অফিসের কিছু জার্নাল, ম্যাগাজিন, একটা পেন স্ট্যান্ড আর একটা টেবিল ক্যালেণ্ডার। ঘরের পশ্চিম দেওয়াল ঘেঁষে একটা সুদৃশ্য মেহগনী রঙের এলাহী সোফা যার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে প্রবাহ একটার পর একটা ধোঁয়ার রিং ছাড়তে থাকে। এই ঘরটা আগে সিনিয়র অপারেশন ম্যানেজারের ঘর ছিল। তিনি দুতলায় শিফট হয়ে যাওয়াতে এখন টুকটাক অবসর কাজের জন্যই এটা ব্যবহৃত হয়। প্রবাহর কাছে অবশ্য অফিসে রাত কাটানোটা নতুন কিছু নয়। প্রোডাকশন হাউজ হওয়ার দরুন এডিটিংয়ের কাজে মাঝেমাঝেই টিমের প্রায় সকলকেই এখানে থাকতে হয়েছে কোনো না কোনো সময়ে। তবে তফাতের মধ্যে আজ শুধু প্রবাহকে একা থাকতে হচ্ছে। সেটাও হতো না যদি না কাল সকাল সকাল বেরোনোর ঝঞ্ঝাট থাকতো।
হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচটা নিভিয়ে দেয় প্রবাহ। উইন্ডো এসিটাকে বাইশ ডিগ্রিতে সেট করে নিজের ফোনটা বের করে আনে। এখন সবে সাড়ে বারোটা। রাস্তা থেকে কোনো এক গাড়ির হেডলাইটের আলো, জানলার মসৃন কাঁচ ছুঁয়ে ঘরের দেওয়াল বেয়ে মিলিয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টিটা বোধহয় সামান্য ধরেছে। যতক্ষণ না ঘুম আসে ততক্ষন একটা সিনেমা দেখার প্ল্যান করে নেয় সে।
ফোনের স্ক্রিনে হাত দিতেই ফোনটা তীক্ষ্ন সুরে বেজে ওঠে। স্ক্রিনের আলোয় দপদপ করছে দীপ্তদার নাম। কি আশ্চর্য এতো রাত্রে ? উঠে বসে প্রবাহ। বোধহয় খোঁজ নিতেই ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে ফোনটা কানের কাছে ধরতেই ওদিক থেকে দীপ্তদার গলা পাওয়া যায়।
ফোনের স্ক্রিনে হাত দিতেই ফোনটা তীক্ষ্ন সুরে বেজে ওঠে। স্ক্রিনের আলোয় দপদপ করছে দীপ্তদার নাম। কি আশ্চর্য এতো রাত্রে ? উঠে বসে প্রবাহ। বোধহয় খোঁজ নিতেই ফোন করছে। সবুজ বাটনটা টিপে ফোনটা কানের কাছে ধরতেই ওদিক থেকে দীপ্তদার গলা পাওয়া যায়।
- কিরে, কাঁচা ঘুম ভাঙালাম নাকি ?
- না না, ঘুমোইনি, বলো.....
- তিনতলার অফিসে আছিস তো ?
- হ্যাঁ, ওখানেই.....কেন ?
- আমি আসছি দু মিনিটে.....মোড়ের মাথায় সিগারেট কিনছি.....
- সেকি ? এতো রাত্রে ? মানে তুমি, কিভাবে....... !!
- বলছি বলছি....এসে সব বলছি.....
দীপ্ত একই অফিসের কর্মী। প্রবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। একটা আনন্দ ও অবিশ্বাস মিশ্রিত ঢেউ খেলে যায় মনের মধ্যে। কতকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন। যাক ! এখন এই বিভীষিকার মধ্যে আর একা থাকতে হবে না। তড়িঘড়ি বলে, 'আচ্ছা, এসো এসো..... আমি হরিপদকে বলছি গেটটা খুলে দিতে '।
- তার দরকার নেই, হরিপদকে ফোন করা হয়ে গেছে আমার, তুই বরং ফ্লোরের দরজাটা খুলে রাখ।
- আচ্ছা বেশ.....
প্রবাহ ঘর থেকে বেরিয়ে তিনতলার দরজাটা খুলে দেয়। কিছুক্ষন বাদেই জুতোর মশমশ শব্দ করতে করতে দীপ্ত উঠে আসে ওপরে। ঘরে এসেই একগাল হাসি দিয়ে বলে, 'কিরে, কেমন সারপ্রাইজ দিলুম বল' ? প্রবাহ হৈ হৈ করে ওঠে, উচ্চস্বরে বলে, 'ওয়েলকাম ওয়েলকাম। এ যে একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটিয়ে দিলে তুমি ! এটা কি করে সম্ভব হল' ? জল ঝাড়তে ঝাড়তে ছাতাটা এককোণে রাখে দীপ্ত। তারপর ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি ঝুলিয়ে বলে, 'বলছি বলছি, খাওয়া দাওয়া করেছিস তো' ? 'হ্যাঁ হ্যাঁ সেসব করে নিয়েছি অনেক্ষণ, তুমি বলো, হঠাৎ এখানে কিভাবে, কি করে' ? প্রবাহর আর তর সয় না। দীপ্ত চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে। ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, 'আর বলিস কেন, বাড়ি ফিরে দেখি তোর বৌদি মুখটা এত্তবড় হাঁড়ি করে বসে আছে'। জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ব্যাপার, এমন মুড্ অফ কেন ? কিছু হয়েছে ? তা সে বললে আমি নাকি কথা দিয়েছিলুম আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব, একসাথে সিনেমা দেখব, আমি নাকি কথার খেলাপ করেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি...... আরেবাবা, বৃষ্টি কি আর আগাম নোটিশ পাঠিয়ে কলকাতার বুকে ঝরে পড়বে, নাকি আমি হাত গুনে বলে দিতে পারব যে আজ আকাশের পরিস্থিতি কেমন থাকবে' ?
প্রবাহ হাহা করে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করে, 'তারপর' ?
প্রবাহ হাহা করে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করে, 'তারপর' ?
- তারপর আর কি, যতই বোঝাতে যাই আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি, ততই সে ইনিয়ে বিনিয়ে নানারকম ফিরিস্তি দিয়ে প্রমান করতে থাকে আমি নাকি এক কথার মানুষ নই, আমি যেন ইচ্ছে করেই এসব ষড়যন্ত্র করি, আড্ডা মারা নাকি আমার বেসিক ট্রেটের মধ্যে পরে, সমস্তটাই আমার কারসাজি, অমুক তমুক..........'।
প্রবাহ কোনোক্রমে হাসি চেপে জিজ্ঞেস করে, 'আর তাই তুমি রাগ করে বেরিয়ে এলে, তাইতো' ?
- হ্যাঁ, আমিও দুত্তোর নিকুচি করেছে বলে চটপট জামাকাপড় গলিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। বেরিয়েই ভাবলুম, কোথায় যাই এতো রাত্রে, বেরিয়ে তো পড়েছি, কিন্তু এবার ? পরক্ষনেই তোর কথা মনে হলো, ভাবলুম তুই তো একাই আছিস, তোর সাথে গল্পটল্প করে দিব্যি সময় কেটে যাবেখন, তাই সটান ট্যাক্সি বুক করে চলে এলুম।
- বেশ বেশ, সে একরকম ভালোই করেছ তুমি। আমিও একা একা কি করব ভেবেই উঠতে পারছিলাম না, যাহোক তবু একটা গল্প করার লোক পাওয়া গেল।
দীপ্ত অমায়িক হাসে। ঘরের চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, 'অনেকদিন পর এই ঘরটায় আবার জমায়েত হওয়া গেল, কি বল' ?
- হ্যাঁ তো তো বটেই, শেষ যেবার ছিলাম আমরা, সেটাও তো প্রায় মাসতিনেক হয়ে গেল, তাই না ?.....
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস.....সেবার বেশ মজা হয়েছিল।
হঠাৎ করে দীপ্তর হাতের দিকে চোখ যায় প্রবাহর। নিরীক্ষণ করে বলে, 'আচ্ছা তোমার কনুইয়ের কাছটা অমন ফোলা লাগছে কেন গো, পড়েটড়ে গিয়েছিলে নাকি' ? আঙ্গুল উঁচিয়ে দীপ্তর হাতের দিকে দেখায় প্রবাহ। দীপ্ত সে দিকে তাকিয়ে হাতটাকে ভাঁজ করে বলে, 'হ্যাঁ রে, এই আসার সময়টাতেই তো। ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে অসাবধানে কনুইটা এমন জোর ঠুকে গেল দরজায়, কি বলব'।
'ওষুধ টষুধ দিয়েছো কিছু', প্রবাহ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, 'ইশশ ছড়েও তো গেছে কিছুটা, ডেটল নিয়ে আসি' ? দীপ্ত হাত নাড়িয়ে বলে, 'আরে দূর, সামান্য চোট, তার আবার ওষুধ ! ও একদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। বাদ দে তো, তার চেয়ে বল, কাল সুন্দরবনের প্রজেক্টে কি কি হচ্ছে'............ ?
'ওষুধ টষুধ দিয়েছো কিছু', প্রবাহ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, 'ইশশ ছড়েও তো গেছে কিছুটা, ডেটল নিয়ে আসি' ? দীপ্ত হাত নাড়িয়ে বলে, 'আরে দূর, সামান্য চোট, তার আবার ওষুধ ! ও একদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। বাদ দে তো, তার চেয়ে বল, কাল সুন্দরবনের প্রজেক্টে কি কি হচ্ছে'............ ?
বর্ষার রাতে দুজনের মধ্যে গল্প জমে ওঠে বেশ। একই বয়েসি না হলেও একই ডিপার্টমেন্ট হওয়ার দরুন বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে নানাবিধ আলোচনা চলতে থাকে। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষন পর দীপ্তর সম্বিৎ ফেরে। চমকে উঠে বলে, 'এই রে, অনেক বেজে গেল রে। ঘড়ির দিকে তো খেয়ালই করিনি। কাল সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে যে তোকে'। প্রবাহ ঘড়ির দিকে তাকায়। দুটো দশ। মাথা নেড়ে বলে, 'হ্যাঁ, তাইতো ! রাত হয়েছে ঢের, চলো এবার একটু চোখ বুজে নিই কিছুক্ষন'। দীপ্ত উঠে দাঁড়ায়, বাঁহাত থেকে ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখে, বলে, 'আমি একটু টয়লেট থেকে ঘুরে আসি। এসে একটা সুখটান দিয়ে তবেই ঘুমোবো। তুই দেরি করিসনা, ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে তো অনেকটা পথ পেরোতে হবে তোকে' । প্রবাহ আলতো হাসে, টেবিলের ওপর রাখা দীপ্তর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, 'দাদা তোমার ঘড়ির ডায়াল শেপটা কিন্তু দারুন, বেশ অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে, যতবার দেখি ততবারই মুগ্ধ হয়ে পড়ি'। দীপ্ত মুচকি হাসে, বলে, 'তাই বুঝি ? এইরকম ডায়াল তোর খুব পছন্দ না রে' ?
- ভীষণ !.....কোথা থেকে কিনেছিলে যেন ?
- কিনিনি তো ! মনে নেই ? একটা কর্পোরেটের জন্য জিঙ্গল লিখেছিলাম, তারাই গিফট করেছিল.....
- ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ ,মনে পড়েছে। আচ্ছা আমায় একদিন পড়তে দেবে ঘড়িটা ?
- বেশ তো, নিস্ বরং, চাইলে অবশ্য কালই পড়ে যেতে পারিস।
- একেবারে কালই !
- হ্যাঁ কালই .........পড়বি ?
- তোমার অসুবিধে হবে না ?
- বিন্দুমাত্র না....
- বেশ, তবে কালই ওটা পরে নতুন প্রজেক্টের কাজে যাব।
দীপ্ত মৃদু হেসে টয়লেটের দিকে চলে যায়। প্রবাহ ঘড়িটার দিকে ঠায় দেখতে থাকে। এই ঘড়িটার প্রশংসা আগেও অনেকবার করেছে প্রবাহ। ভেবেছিলো দেশপ্রিয় পার্কের নামী ব্র্যাণ্ডের দোকানটায় গিয়ে একটা ফ্যাশনেবল রিস্টওয়াচ কিনবে। বিভিন্ন কাজের চাপে ও সময়াভাবে যাওয়া হয় নি.......দীপ্তকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় প্রবাহ। এক কথাতেই ঘড়িটা পড়তে দিয়ে দিল। এমন প্রাণখোলা মানুষ আজকের দিনে বিরল। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে আপনিই চোখ লেগে আসে প্রবাহর।
পরদিন সকালবেলা মোবাইলে সাতটার এলার্মে ঘুম ভেঙে যায়। প্রবাহ চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে। ঘর ভর্তি রোদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই কোনোরকম। মোবাইলের ডানদিকের সরু বাটনটা টিপে এলার্ম বন্ধ করে। একটা বিরাট হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে। প্রথমেই দীপ্তর কথা মনে হয় তার। দীপ্ত ছিল বলে কাল রাতের অনেকটা সময় গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া গেছে। দীপ্তর আসার কারণটা মনে পড়তেই মনে মনে হাসি পায় প্রবাহর। পায়ে পায়ে দরজা খুলে পাশের ঘরে গিয়ে খোঁজ করে। ঘর খালি ! কি আশ্চর্য ! এতো সকালে গেল কোথায় ? তাহলে কি নিচের ফ্লোরের টয়লেটে ? নাকি হরিপদকে চায়ের কথা বলতে গেছে ? নানারকম ভাবতে থাকে প্রবাহ। মনে মনে বলে, 'ভালোই করেছে বরং দীপ্তদা, সকাল সকাল চা টা পাওয়া গেলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে পারব। পৌনে আটটার মধ্যে বেরোতে হবে যে করে হোক। তার আগে বরং অফিসের সুকান্তদাকে একবার ফোন করে তাড়া দিতে হবে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে কিনা জেনে নিতে হবে।পৌনে আটটার মধ্যেই অফিসে চলে আসার কথা'। সোফায় এসে তাড়াতাড়ি নাম্বারটা বের ডায়াল করে প্রবাহ। ওদিক থেকে সুকান্তদার গলা পেতেই প্রবাহ জিজ্ঞেস করে, 'দাদা বেরিয়ে পড়েছ তো ? আমিও রেডি হচ্ছি এদিকে'।
সুকান্তদার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায় অন্যপ্রান্ত থেকে।
সুকান্তদার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায় অন্যপ্রান্ত থেকে।
- একটা খারাপ খবর আছে রে প্রবাহ.....
'খারাপ খবর' ! সুকান্তর গলার স্বরে চমকে ওঠে প্রবাহ, 'কি খবর দাদা' ?
- গতরাতে দীপ্তর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, রাস্তাতেই স্পট হয়ে.....
চমকে ওঠে প্রবাহ। ক্ষনিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে বলে, 'কি যাতা বলছ ! দীপ্তদা তো কাল রাত থেকে আমার সাথেই আছে......'
- কিঃ !! তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে ? নাকি এখনো ঘুমের ঘোর কাটেনি ! কাল রাত থেকে আমরা কজন মিলে সমানে হাসপাতালে বসে রয়েছি। তুই অনেকটা দূরে আছিস বলেই আর ডাকিনি ইচ্ছে করে।
- কি বলছ সুকান্তদা !! কিন্তু আমি আর দীপ্তদা যে অনেক রাত অবধি গল্পগুজব করে.........
ওপ্রান্ত থেকে কথাটা শেষ করতে দেয় না সুকান্ত, বলে, 'প্রবাহ, আমার মনে হচ্ছে তুই বোধহয় স্বপ্নটপ্ন দেখেছিস কিছু। তুই একটু সামলে নে নিজেকে, আর আজকের ট্রিপটা ক্যানসেল কর। আমরা আছি হাসপাতালে, বডি ছাড়লে তোকে ফোন করছি'। ফোনটা কেটে যায়.....
বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো বসে থাকে প্রবাহ। মাথার মধ্যে তোলপাড় চলতে থাকে। গতরাতের ঘটনা গুলো পরপর জলছবির মতো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মনে মনে বলে, 'এ কিছুতেই সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়। যার সাথে আড্ডা মেরে প্রায় গোটা রাত কাটিয়েছি, কিছুক্ষন আগে অবধি যে ওই সামনের চেয়ারটায় বসেছিল, এখন তার মৃত্যুসংবাদ কিভাবে আসা সম্ভব' ? অজান্তেই সর্বাঙ্গ ঘেমে নেয়ে ওঠে প্রবাহর।
ঘরের ভিতর হরিপদ এসে দাঁড়ায় চা নিয়ে। প্রবাহকে দেখে বলে, 'ওহ, আপনি উঠে পড়েছেন ? ভালোই হয়েছে, এই নিন, চা টা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন ....... হরিপদর দিকে তাকিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে প্রবাহ, বলে, 'আচ্ছা হরিপদ, কাল রাতে দীপ্তদাকে তুমি গেট খুলে দিয়েছিলে না' ?
অমন আচমকা প্রশ্নে হরিপদ ঘাবড়ে যায় খানিক। মিন মিন করে বলে, 'দীপ্তবাবু !! কাল, কখন?
- এই বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ.......
- কই না তো ? দীপ্তবাবু তো সেই নটা নাগাদ বের হলেন বাকিদের সাথে......তারপর তো......
- হ্যাঁ হ্যাঁ..... তারপর তো রাতের দিকে আবার এসেছিলো, আমায় ফোন করল, সারপ্রাইজ দিল.....তুমি তো নিচে ছিলে !!
- কিন্তু দাদা, দীপ্তবাবু তো আর আসেননি, আমি তো একটা অবধি জেগেই ছিলুম কাল, রেডিওতে গান শুনছিলুম তো.....
- কি আবোলতাবোল বকছ, ভালো করে মনে করে দেখো, দীপ্তদা তো তোমাকে ফোনও করেছিল......
'এ কি বলছেন দাদা' !, হরিপদ কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় প্রায়, 'এই তো.....এই তো দেখুন আমার ফোন, কই দীপ্তবাবু তো ফোন করেননি আমায়.....'
প্রবাহ ফোনটা নিয়ে পাগলের মতো কল হিস্ট্রি সার্চ করতে থাকে, কোত্থাও দীপ্তর নাম খুঁজে পায় না। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সোফার ওপর বসে পড়ে আবার। বিড়বিড় করে বলে, 'কিন্তু এতটা সময়, এতগুলো কথা, সেসব ধোঁয়ার মতো কি করে মিলিয়ে যেতে পারে' ? হরিপদ থতমত খেয়ে যায় বেশ, 'আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে দাদা, কিছু হয়েছে নাকি ? আপনি এমন করে.......'
হরিপদর কথায় আমল দেয় না প্রবাহ, অস্ফুটে বলে, 'আর.........আর সেই ঘড়িটা, যেটা দীপ্তদা আমাকে.........' বলতে বলতেই টেবিলের ওপর চোখ যায় তার। সকালের নরম রোদে ঘড়ির ডায়ালটা টলটলে হ্রদের জলের মতো চিকচিক করছে। যেন দীপ্তই তাকিয়ে আছে আর রহস্যের মর্মান্তিক পরিণতিতে তারিয়ে তারিয়ে হাসছে। বিমূঢ় বিস্ময়ে প্রবাহ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে।
শেষ উপহারের যন্ত্রনা মনের মধ্যে ঘনীভূত হতে থাকে গত রাত্রের মেঘের মতো............
#bengalishortstories
শেষ উপহারের যন্ত্রনা মনের মধ্যে ঘনীভূত হতে থাকে গত রাত্রের মেঘের মতো............
![]() |
| বিন্যাস : নিজস্ব |
Labels:bengali short stories articles poems molat
ছোট গল্প,
ভূতের গল্প
Monday, June 26, 2017
অনুপদ্য - ১৩
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Sunday, June 25, 2017
ভগবান
Labels:bengali short stories articles poems molat
কবিতা
Subscribe to:
Comments (Atom)














