Friday, August 5, 2016

২২শে........

কয়েক বছর আগেকার কথা। সে ঘটনার কথা মনে পড়লেই এক আকাশ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই আজও। কতকটা মিঠে পাতা পানের মতো। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে গুলকান্দ এর মিষ্টি প্রলেপ পড়ে সারা জিভ জুড়ে, দোসর থাকে এলাচ, মৌরির এক্কা দোক্কা। চর্বিতচর্বনে হারিয়ে যাওয়ার ঈঙ্গিত থাকে স্পষ্ট। সেদিন অফিস থেকে গিয়েছিলাম সল্টলেক সেক্টর ফাইভের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। সামনে বেশ বড় একটা ইভেন্ট ছিল সেবার। ফলস্বরূপ একটি টেলিভিশন পার্টনারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিলো খুব স্বাভাবিক নিয়মেই। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো আমি, তাই নির্দ্বিধায় দায়ভারের হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দিয়েছিলুম বিনা বাক্যব্যয়ে। স্বীকার করতে বাধা নেই, সেদিন খুব বেশি প্যাঁচ পয়জার কষতে হয়নি। খুব মসৃন ভাবেই আমাদের প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে সে যাত্রা। ডিল ফাইনাল হওয়াতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ফিরে আসছিলাম অফিসের গাড়িতে। অকস্মাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল।

দক্ষিণ পশ্চিমের আকাশে তখন দুর্বার গতিতে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। ফুটন্ত কেটলির মুখ দিয়ে যেভাবে ভুড়ভুড়িয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে, ঠিক সেইরকম সরু, একফালি, ধূসর প্রান্তরেখা হয়ে ক্রমশ বিস্তৃতি ঘটিয়ে তার তমসাবৃত চাদরে যেন ঢেকে ফেলতে চাইছে চতুর্দিক। ভিজে হাওয়ার গন্ধরা তখন চাক ভাঙা মৌমাছির মতো রে রে করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শহর জুড়ে। সোঁদা মাটির ঘ্রানে চোখ ফেরাতে পারলাম না কিছুতেই। একদৃষ্টে দেখে যেতে লাগলাম আলো আঁধারির বেলাগাম দৌরাত্মি। শুধু মুখ ফুটে একবার বললাম, 'পঙ্কজ দা' !................... উত্তর এলো,
- হুমমম, দেখেছি, খুব জোর আসছে.......
- বেশ তো ! আসুক, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, তুমি আস্তেই চালাও, দেরি হলে কিচ্ছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

স্টিয়ারিঙে হাত রেখেই আড়চোখে আমায় দেখে নেয় পঙ্কজদা। চিবুকের হাড়ে মৃদু হাসি খেলে যায়। বুঝতে পারে বোধহয়, সময় অপচয়টা কতকটা  ইচ্ছাকৃত। অবশ্য পঙ্কজদার পক্ষে সেটা বোঝাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বহূ নিকট - দূরের জার্নির একনিষ্ঠ ও ভরসাযোগ্য সঙ্গী ছিল সেসময়। শহরের একটু বা অনেকটা দূরের গল্প হলেই পারতপক্ষে আমরা পঙ্কজদা ছাড়া অন্য কাউকে নিতাম না সঙ্গে। সুতরাং আমার মতো দু একজন ডেপোঁ কলিগের সাথেই খুব সহজেই সখ্যতা গড়ে উঠতে বেশি দেরি হয়নি তার। এযাত্রাও সে সামনের কাঁচের দিকে স্থির ছাউনি দিয়ে বললো, 'বলছো ?' আমি সহাস্যে বলে উঠলাম, 'নিশ্চিন্তে'। মুখের হাসি তেমনি অটুট রেখে জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে এক রাউন্ড চা হলে মন্দ হয় না..... কি বলো' ? হাত নাড়িয়ে বললুম, 'কিছুমাত্র না'। 'বেশ তাহলে একটা স্পেশাল চায়ের দোকানে নিয়ে যাই তোমায়...... চলো', বলেই বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেয় বিদেশী যানের দিশি সারথি।

বাইপাসের চওড়া মেদহীন চিকন পথ ছেড়ে আমরা ঝপ করে এসে পড়লুম অপেক্ষাকৃত রুক্ষ পিচের রাস্তায়। জানলার দুপাশের চিত্রগুলো সিনেমার কাটশটের মতো বদলে যেতে লাগলো মুহুর্মুহু। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর চোখে পড়লো টালির চাল দেওয়া কাঁচামাটির ঘর, বাঁশ বাগান, খানকতক পুকুর, ডোবা, এধার ওধার থেকে ছুটে আসা মুরগির পাল, দেওয়ালের গায়ে যত্রতত্র ঘুঁটের নকশা কাটা প্যাটার্ন আর চোখ জুড়ানো সবুজের দিগন্ত বিস্তৃত আহ্লাদ। এক ঝটকায় শহরের মানচিত্রটা আমূল বদলে গিয়ে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো আদি বাংলার আটপেড়ে সহজিয়া উষ্ণতা। যেখানে গাঢ় রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে, কপালে এত্তবড় সূর্যের লাল মেখে কোনো এক গাঁয়ের বধূ অপেক্ষায় আছে শীতলপাটি বিছিয়ে। উঠোনে পা দিলেই গ্লাসে করে এগিয়ে দেবে কুঁজোর মিঠে নির্যাস, তালপাতার পাখায় এক নিমেষে মিলিয়ে যাবে দিনগুজরানের ঘামশরীর।    

এদিকটায় আসিনি কখনো। শহরের বুকের মধ্যেই যে এমন একটুকরো লুকোনো জিয়নকাঠি খুঁজে পাবো এ আমার কল্পনাতীত। ফলে অপরিচিত রোদ্দুর হলেও পরিচিত মাটির টানটা দিব্যি গায়ে মেখে নিচ্ছিলাম ধুলোয় বালিতে। মেদিনীপুরে আমাদের আদি বাড়ির নিকোনো উঠোনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারেবার। একটা চায়ের দোকানের সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো পঙ্কজ দা। বলল, 'নামো'। কাঁচা রাস্তার ওপর নেমে দাঁড়ালাম। বাঁশের খুঁটির ওপর খড়ের চাল, দরমার খাঁচা, মাটির উনুন আর সামনে দু সারি ইঁটের ওপর  একটা কাঠের তক্তা দিয়ে পরিপাটি বসার জায়গা করা পঙ্কজদার স্পেশাল চায়ের দোকান। দুটো চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসলাম। ততক্ষনে আকাশ বেয়ে এক দু ফোঁটা করে গায়ের ওপর পড়ছে অবিন্যস্ত রূপোলী গুঁড়ো। লক্ষ্য করলাম, কিছুটা দূরে একটা মাঠের ধারে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। একটা ছোট স্টেজ আর সামনে লাইন করে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে কিছু মানুষ বসেছে। মুখ ঘুরিয়ে দোকানের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'ওখানে কি হচ্ছে ভাই ?' এক বিশেষ ভঙ্গিমায় চায়ের ছাঁকনি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, 'ফানশন হচ্ছে ফানশন, ফি বচ্ছর হয় এখানে'। ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসের' ? চায়ের ভাঁড়গুলো হাতে ধরাতে ধরাতে বললো, 'বাইশে শ্রাবন। ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি আর গান করে'। .............. চমকে ওঠার সেই শুরু। এমন এক অজ পাড়াগাঁ যেখানে অভাবের চিত্রটা দুপুরের রোদের মতোই উজ্জ্বল ও চোখে পড়ার মতো সেখানে ম্যারাপ বেঁধে রবীন্দ্রচর্চা ! দুমুঠো ভাতের খোঁজে উদয়স্ত যাদের ক্ষেতের ওপর লাঙ্গল চষতে হয় তাদের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রস্তব করছে খরচ করে ! পরক্ষনেই ভাবলাম, নাকি, এরা বলেই করছে বা হয়তো এরাই করে থাকে। কি জানি ! আমাদের মতো শহুরে চাষিদের সময় কই ওতো ! ঘড়ির দামে সময় বিকোয় আমাদের। এরকম বেয়াড়া কিছু প্রশ্নের ভিড়ে চায়ের ভাঁড়ে আলগা চুমুক দিতে থাকি আর অপলক তাকিয়ে থাকি স্টেজের দিকটায়।

মাঠের বুক চিরে কানে ভেসে আসছে........ 'শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে.......পড়ুক ঝরে, তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে বুকের 'পরে'.......
ভারী মিষ্টি করে গাইছে। মনকেমন করে ওঠে ততক্ষণাৎ। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতে কেন জানিনা বড্ডো এমনটা হয়। কতকটা সবুজ ঘাসের মাঠ পেলেই যেমন সটান শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল দেখলেই যেমন হাত বোলাতে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমনটা, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোনোটাই করা হয়ে ওঠে না, ভিতরে ভিতরে শুধু ফুঁপিয়ে মরার যন্ত্রনাটা টের পাওয়া যায়। মনে হলো একছুটে পালিয়ে যাই ওখান থেকে। গিয়ে দাঁড়াই মেঠো পথের একেবারে শেষ চৌকাঠে যেখানে থাকবে না কোনো পিছুটানের বদভ্যাস, শুধু থাকবে প্রান্তজনের সাথে গুটিকতক আলাপী মুহূর্ত আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানোর অলস আধছটাক প্রেম..

ডান পাশে তাকিয়ে দেখলাম একজন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুচ্ছেন। হাড় জিরজিরে শীর্ণ চেহারা, খালি গা, পরনে সরু বাদামি পাড়ের ধুতি আর খালি পা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি..............খানিক্ষণ বাদে ভিজে গলায় নিজে থেকেই বলে উঠলেন, 'রবিঠাকুরের গান শুনলেই মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে গো বাপ....... সেই কত্ত ছোটবেলা বেলা থেকে শুনে আসচি, আজও ময়লা হয় নি গো, যেমনকার ঠিক তেমনি আছে'। এমন অকপট অনুভূতির ঝাপটায় বেশ অবাক হলাম। বললাম, 'আপনি বুঝি ওনার গান খুব ভালোবাসেন' ? ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলেন আমাকে কিঞ্চিৎ, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, 'ওনার গানের কথাতেই তো জীবনের সারমর্ম বাপ....... দিনযাপনের গুরুমন্তরটা তো উনিই দিয়ে গেছেন, ভালোবাসি বলে অচ্ছেদ্দ্যা করতে পারবো না গো, তার পায়ে মাথা কুটে মরতে পারলে তবে যে আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম '...............

চিত্রার্পিতের মতো বসে রইলুম। এমন কথা শুনিনি আগে.........ভালোবাসা অশ্রদ্ধা !! গুরুমন্ত্রই প্রাণের আধার !!......লোকটা বলে কি !! রবীন্দ্রশ্রদ্ধায় এমন সহজ, সরল, প্রাঞ্জল নিবেদন আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়লো না। শ্রাবনের সোঁদা মৌতাতে মনটা মাখামাখি হয়ে গেলো কেমন। বুকের মধ্যে আকুলিবিকুলি করতে লাগলো দিনযাপনের গুরুমন্তর, আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম......... নেশাগ্রস্তের মতো বসেছিলুম...........কতক্ষন জানিনা ..............বড় বড় ফোঁটায় শব্দের মেহফিল জমে উঠেছে ততক্ষনে,........ সম্বিৎ ফিরলো পঙ্কজদার কথায়, 'এবার চলো, আর বসে থাকা যাবে না, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে'। কোনো মতে টেনে তুললাম নিজেকে, যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে বারে বারে বৃদ্ধকে দেখছিলাম। এখনো ঠিক তেমনি ভাবে বসে আছেন। টলটলে শ্রাবনের জলে অশ্রু মিলেমিশে একাকার । গাড়ির দরজা বন্ধ করলাম। পঙ্কজদা চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল, এফ এম এ বাজতে শুরু করেছে .........
'শাওন বরষে.....তরসে দিল.......কিউঁ নাআআ নিকলে, ঘরসে দিল.......
বরখা মে ভি দিল পেয়াসা হ্যায়.....ইয়ে প্যায়ার নেহি তো ক্যায়া হ্যায়'..............  

কি আশ্চর্য মিল ! শ্রাবন বোধহয় এমন করেই মিলিয়ে দিতে পারে......তাই না ?

চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত
ছোট করে বলে রাখা ভালো এই চিত্রটি শুধুমাত্রই গ্রাফিক্স নয় আমার কাছে,
এটি একটি আদ্যোপান্ত রচনা, যা অর্ণবের সৃজনে ও কল্পনায় প্রাণ পেয়েছে।


চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত 


#bengaliarticles #rabindranathtagore #tributetorabindranathtagore #tribute

Tuesday, August 2, 2016

অনুপদ্য - ১০

ছবি : নিজস্ব 
মনের সাথে আড়ি আমার
মনের কাছেই ভয়
মনের কথা তুমিই জানো
তবু তুমি আমার নয়..........
মনের ভাষায় ভাসিয়েছিলেম
স্বপ্ন মেঘের ভেলা
মনের ভুলেই সাঙ্গ হলো
মিথ্যে মনের খেলা...........






#bengalipoems #bengalilovepoems #bengaliromanticpoems

Friday, July 29, 2016

মনদুপুর

ছবি : নিজস্ব 
কিংখাবে মোড়া যত রাজকীয় গলি
খুঁজে খুঁজে হয়রান কাকে আমি বলি.....
বোবা ঘরে বাস্পতে ভিজে ওঠে জল
মন কষাকষি হোক, কার সাথে বল ?

দুধগোলা দুপুরে চুপ থাকা দায়
শ্যাওলারা কার্নিশ, ঘেঁষে চলে যায়
ছায়া গোনে জৌরালি, শালিখের দল
মন কষাকষি আজ, কার সাথে বল........







#bengalipoems #bengalilovepoems #bengaliromanticpoems

Tuesday, July 26, 2016

নাগাল

ছবি : নিজস্ব 
দূরভাষে কত কথা উড়ে এসে বসে
তবুও খানিক, সংলাপ রয়ে যায়
তোর নামের তালাশ জারি থাকে
বেসামাল মন আলাপ ছুঁতে চায়.....

মধুর লেখনী নাই বা হল তেমন
চিঠির আদলে জবানবন্দি বাঁচুক
কেমন করে বোঝাই বলত তোকে
মরুভূমিও চায় কালবৈশাখী আসুক.....

রাতের বালিশ প্রেম খোঁজে চুপিচুপি
ঘুম জাগানিয়া ওয়াক্ত গুজরতা যায়
আশমানি চাঁদ গালে হাত দিয়ে ভাবে
কেমন করে তোর নাগাল পাওয়া যায়....


#bengalipoems #bengalilovepoems #bengaliromanticpoems

Saturday, July 23, 2016

সাপ্তাহিকী ১৪ # জ্যোতিষী

দুপুরের গনগনে আঁচটা এমাসে আর তেমন নেই বললেই চলে। ঘড়ির কাঁটা চারটে দশ ছুঁই ছুঁই করছে। শ্রাবনের শেষের দিনগুলো ইদানিং একটু গুমোট বেঁধে আছে। অস্থির হয়ে উঠেছে রায়া। সিমেন্টের বেঞ্চিটাতে বসে ঘন ঘন হাতঘড়িটার দিকে তাকাতে থাকে। কিঞ্জল বড্ডো দেরি করছে যেন আজকে ! দক্ষিণ কলকাতার লেকের এই পূর্ব-দক্ষিণ দিকটা বরাবর তাদের ভীষণ প্রিয়। শান্ত, নিরিবিলি, ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটায় দুদণ্ড কথা বলা যায় মনের সুখে। সামান্য অযত্নের জঙ্গল আর এভিনিউ সম্মিলনী ক্লাবের পিছন দিক হওয়ার দরুন অনেকেই এদিকটা এড়িয়ে চলে। ফলে নিজেদের আলাপচারিতার টুকরো মুহূর্তগুলো অবলীলায় প্রজাপতির মতো বাধাহীন উড়ে বেড়ায় ইতিউতি।

অকস্মাৎ বাঁদিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে রায়ার। দুটো বিবর্ণ ঘোলাটে চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঝট করে চোখ সরিয়ে নেয় রায়া। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা অস্বস্তি শুরু হয় যেন। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। প্রবল আশঙ্কায় ধীরে ধীরে আবার বাঁ দিকে ঘুরে তাকায় সে। একজন রোগাটে, শীর্ণ বৃদ্ধ অপলক তাকিয়ে আছেন তার দিকে। বড় অদ্ভুত সে চাহনি। মাথা থেকে পা অবধি পড়ে ফেলার এক তীব্র প্রচেষ্টা যেন সে চোখ দুটোতে। প্রথম নজরে চমকে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কি করবে ভেবে পায়না রায়া। উঠে চলে যাবে নাকি অন্য কোনো দিকে ? গিয়ে বসবে অন্য কোনো বেঞ্চিতে ? কিঞ্জলটাই বা দেরি করছে কেন এতো ? শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হতে থাকে অজান্তেই।

- কিরে ? কতক্ষণ ?
চমকে ওঠে রায়া। কিঞ্জলকে সামনে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ঠোঁটের ওপর আলগা হাসি ঝুলিয়ে, হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে ঈষৎ হাঁপাচ্ছে কিঞ্জল।

- এতো দেরি করলি ? আমি তো সেই কখন থেকে ওয়েট করছি !!
- আর বলিস না, অফিস থেকে বেরোতে যাবো, অমনি বসের জরুরী তলব। তড়িঘড়ি একটা কাজ            মিটিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছি।
- হুমম, যত কাজ তোর, আর আমার সময়ের কোনো দাম নেই না ?
- বুঝিসই তো, প্রাইভেট কোম্পানি, হুট্ করে বেরোনোটা খুব চাপের হয়। নেহাত অফিসটা পাশেই, তাই   কিছুক্ষনের জন্য ম্যানেজ করতে পেরেছি।  যাইহোক...... বল, হঠাৎ ডেকে পাঠালি ?
- হ্যাঁ, কথা ছিল। বাবা ফোন করেছিলেন কাকুকে গত রাত্রে, জানিস নিশ্চই ?
- হ্যাঁ, জানি তো।
- বিয়ের ডেটটা খুব সম্ভব নভেম্বরেই ফিক্সড হচ্ছে।
- হ্যাঁ, সেটাও জানি........তো ?
- আঃ, তুই ব্যাপারটা বুঝছিস না ! আমার কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে ভেতর ভেতর।
- হ্যাঁ, এরকমটা হয় বটে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে....... তো ?
- ধ্যাৎ ! কি তো তো করছিস তখন থেকে ? এরকম একটা ইম্পরট্যান্ট ইস্যু, আগের থেকে একটু ভাবা     দরকার কিনা আমাদের ? তা নয়, শুধু ইয়ার্কি !
- হাহাহাহাহা, দ্যাখ রায়া, এতো টেনশন করছিস কেন ? আমাদের বাবা মায়েরা তো অনেকদিন আগে  থেকেই জানেন আমাদের সম্পর্কটা, তাঁরা তো কোনো আপত্তি করেননি কখনোই, তাই না ? আর  তাছাড়া আমরা ছোটবেলার বন্ধু। দুজনে দুজনের বাড়ির লোকদের খুব ভালো করে চিনি। ফলে  কোনো সমস্যা হবে না দেখিস। আমি বলছি তো, দ্যাখ সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, শুধুশুধু টেনশন করিস  না ওতো।
- তুই জানিস নারে কিনু, আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে জানিস আজ সকাল থেকে, একটা চাপা      অস্বস্তি............বুকের মধ্যে কেমন যেন....... মানে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না তোকে, কিন্তু কেন  যেন আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে......... ভয়ঙ্কর কিছু একটা !
- ধুর পাগল ! ওসব ভাবিস না তো। তারচেয়ে বরং চল, আমরা একটু শপিং করে নিই, হাতে আর মাত্র     কয়েকটা দিন......
- নাহ ! আমার এখন এসব কিচ্ছু ভালো লাগছে না, আমি কোত্থাও যাবো না........
- সে কিরেএএ !! তোর শপিং এ অনীহা ! আমি তো ভাবতেই পারছি না মাইরি !
- হ্যাঁ, আজ বাদ দে, অন্য কোনো একদিন যাবো, আজ মোটেই ইচ্ছে করছে না।

ভারী অবাক হয় কিঞ্জল। সচরাচর এমনটা দেখেনি সে, শপিং বলতেই যে এক পায়ে খাড়া হয়ে যেত সে আজ যেতেই চাইছে না কোথাও !

-দ্যাখ, তুই যদি না যাস তবে আমি চললুম অফিসে, খামোকা এখানে বসে থেকে থেকে আমার  কাজগুলো হ্যাম্পার হবে। এমনিতেই বিয়ের কাজে টুকটাক ছুটি নিতে হবে, তারওপর লম্বা ছুটি তো  আছেই পরে। তাই এখন কোনোরকম ফাঁকি মারাটা এফোর্ড করতে পারবো না, সিরিয়াসলি !
- ঠিক আছে, তুই যা অফিস। অন্য কোনো একদিন বেরোবো না হয়।
- বোঝো ঠ্যালা ! কি হলো বলতো তোর ? শরীর ঠিক আছে তো ?
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, আমি বরং একটু বসি এখানে, তারপর চলে যাবো।
- তুই সিওর ? যাবি না তো তাহলে ?
- হুমম।
- বেশ, আমি আসছি, সাবধানে বাড়ি যাস, দেখি সন্ধের দিকে যদি একবার তোর বাড়িতে ঢুঁ মারতে            পারি।
- আচ্ছা।

হাত নেড়ে কিঞ্জলকে টাটা করে দেয় রায়া। যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো, অফিসের তাড়ায় ঠিক তেমনই ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায় কিঞ্জল। গেট অবধি চোখ যায় রায়ার, কিঞ্জল চলে যেতেই মুখ ঘুরিয়ে লেকের জলের দিকে তাকায় সে। দমবন্ধ ভাবটা কাটছে না কিছুতেই। বাঁদিকে তাকাতেই আবার একপ্রস্থ চোখাচোখি হয় সেই বৃদ্ধের সাথে। ঘোলাটে চাউনির সাথে এবার যোগ হয়েছে কিঞ্চিৎ পরিহাস। কিছু বুঝে উঠতে পারে না রায়া। দোনোমোনো করে উঠে পরে বেঞ্চটা থেকে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বৃদ্ধের দিকে। ভালো করে জরিপ করে নেয় আপাদমস্তক। সত্তরের আসেপাশে বয়েস হবে। উস্কোখুস্কো সাদা চুল, কাঁচা পাকা দাড়ি, পুরোনো সুতির পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত বৃদ্ধের সারা শরীর জুড়ে অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতার ছাপ। মুখের বলিরেখায় দৃঢ়তার চিহ্ন স্পষ্ট। অনাবশ্যক কৌতূহল জাগে রায়ার।

- কি ব্যাপার বলুন তো ? আমি দেখছিলাম আপনি সমানে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আপনি কি       কিছু বলবেন ?

একটা শান্ত, স্মিত হাসি খেলে যায় বৃদ্ধের মুখজুড়ে, ধীরে ধীরে ঘোলাটে দৃষ্টিটা পরিষ্কার হয়। একটু কেশে, চোখ তুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করেন রায়াকে। তারপর পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলেন, 'বোসো'। কৌতূহলের বশে বৃদ্ধের পাশে বসে পরে রায়া, সামান্য দূরত্ব রেখে। ভাঙা গলায় খুব আস্তে আস্তে শুরু করেন তিনি।

- তোমায় দু একটা কথা বলার ছিল মা, অবশ্যি তোমার যদি সময় থাকে কিছুটা।
- কি ব্যাপারে ? মানে আমি তো ঠিক.......
- বলছি, বলছি, তার আগে তোমার নামটা বলো দেখি.......
- রায়া..........রায়া সেনগুপ্ত।
- হুমমমমম,........ (সামান্য দম নিয়ে) খুব মন দিয়ে শোনো মা। আমি যা বলছি সেটা বিশ্বাস করা একটু   কঠিন হবে, তবে একটুও মনগড়া কিছু বলছি না এটুকু জেনে রেখো।

রায়া এবার একটু নড়েচড়ে বসে বেঞ্চিটায়। বাঁ হাতটা চিবুকের তলায় রেখে একনিষ্ঠ শ্রোতার মতো বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিস্পলক। বৃদ্ধ কম্পিত স্বরে বলে চলেন........

- খুব টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ তুমি মা। তোমার গ্রহকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এর অবিশ্যি দু একটা কারণ আছে বটে, তবে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তোমার হবে না। তাই আমি পরামর্শ দেব, তুমি একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো রাস্তাঘাটে। গ্রহরাজের প্রকোপটা বড় বেশি পড়েছে এই সময়টাতে। তোমার নক্ষত্রেরা অন্য পথে ছুটতে শুরু করেছে,....... অর্থাৎ..... একটা ভীষণ রকমের গোলমাল হতে পারে যখন তখন। সুতরাং খুউউব সাবধাআন ! সামনে তোমার চরম বিপদ !! তুমি হয়তো জানো না, সে বিপদ ছায়ার মতো তোমার সাথেই ঘোরাফেরা করছে সর্বক্ষণ। একটু অন্যমনস্ক হয়েছ কি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। তখন কিন্তু আর রক্ষে থাকবে না। তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না, এই আমি বলে দিলুম হ্যাঁ।

চোখের পলক পড়ে না রায়ার। হ্রদের জলে বিকেল মিশে এসেছে অনেকটা। ঘরের ফেরার তাড়াহুড়োয় একঝাঁক পাখি কিচিরমিচির করতে করতে  উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ধীর লয়ে বহুদূর থেকে কোনো এক ঠান্ডা অথচ মৃদু হাওয়া বইতে থাকে। জলের ওপর ছোট ছোট তরঙ্গের রেখা আঁকা হয়ে যায় অচিরেই। হঠাৎই একটু শীত শীত করতে থাকে রায়ার। খানিক থমকে, সমস্ত জড়তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে গলা খাকারি দেয়। তারপর বলে,

- এসব কি আবোলতাবোল বকছেন বলুন তো ? আমার বিপদ ! হঠাৎ আমার বিপদ কেন হতে যাবে ?     আর আপনি কে, বলা নেই কওয়া নেই আমায় আজগুবি গল্প শোনাচ্ছেন।
- হাহাহাহা, আমি তো প্রথমটাতেই বলেছিলুম যে তোমার বিশ্বাস হবে না, অথচ তুমিই জানতে চাইছিলে আমার কিছু বলার আছে কিনা।

চোখের কোণে কৌতুক খেলে যায় বৃদ্ধের। কিন্তু পরমুহূর্তেই চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে, দু চোখের দৃষ্টি পাল্টে যায় এক লহমায়। ঘড়ঘড়ে গলায় বলে ওঠেন, "শোনো হে খুকি ! আমি হলুম জ্যোতিষ কালীপ্রসাদ মুখুজ্জে, শহরের নামি দামী জ্যোতিষীরা আমার নাম আউড়ে, মনে মনে পেন্নাম ঠুকে তবে গণনার আঁক কষতে বসে, আমার বিধান ইস্পাতের ফলার মতোই কঠিন এবং দৃঢ়। যা বলে এসেছি তার একচুলও নড়চড় হয়নি কোনোদিন, তার অন্যথা আজও হবে না জেনে রেখো। তোমায় সাবধান করা উচিত বলে মনে হলো, তাই বললুম, বিশ্বাস করা না করাটা তোমার ব্যাপার, বিপদে যখন পড়বে তখনই টনক নড়বে দেখছি"।

হাঁ হয়ে যায় রায়া, কোনো কথাই জোগায় না মুখে, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বৃদ্ধের মুখের দিকে। ওনার কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনি হতে থাকে কানের মধ্যে। কোনো মতে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা আমার যে বিপদ তা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন"?
এক চিলতে হাসি খেলে যায় কালীপ্রসাদের দাড়িগোঁফের ফাঁকে।
-আমি জানতুম, তুমি এই প্রশ্নই করবে। একটু পরীক্ষা করে নিতে চাইছ, তাই তো ? আচ্ছা বেশ, তোমার জন্ম তারিখটা বলো.....
- ১৯শে আগস্ট ১৯৮৯।
-  আর জন্ম সময়টা...... মনে আছে কি ?
- খুব সম্ভব..... সকাল আটটা পয়ঁত্রিশ।
- বেশ.....

দুপা জড়ো করে সটান বাবু হয়ে বসেন কালীপ্রসাদ, দুটো হাত রাখেন কোলের ওপর, তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেন। বিস্ময়ে হতবাক রায়া নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধের দিকে। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কাটে, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খোলেন উনি। রায়ার দিকে এক অদ্ভুত রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, "শিবরামপুরে তোমাদের একটা জমি আছে সেটা নিয়ে বিস্তর ঝামেলা হচ্ছে কমাস ধরে........... গত কয়েকদিন যাবৎ তোমার মা বেজায় কোমরের ব্যাথায় ভুগছেন...........গতকাল সন্ধে থেকে তোমার ভাইয়ের জ্বর হয়েছে...........আজ সকালে বাড়ির সদর দরজায় পিছলে পড়ে গেছিলে তুমি............দুপুরে খাওয়ার সময় তোমার বাবার গলায় ইলিশ মাছের কাঁটা ফুঁটে যায়............ তোমার সাধের মিনি বেড়ালটা আজ দুদিন হলো বেপাত্তা..........
কি ? আরও  বলব, নাকি এতেই যথেষ্ট মনে হচ্ছে" ?

বিস্ফারিত চোখে রায়া তাকিয়ে থাকে কালীপ্রসাদের দিকে। শব্দগুলো জিভের সাথে জড়িয়ে যায় মুখের ভিতর। চোখের সামনে লেকের চারপাশটা দুলে ওঠে কেমন যেন। কোনো মতে আমতা আমতা করে জড়ানো স্বরে বলে, "আপনি কি করে এসব.........!!! মানে আপনাকে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না, অথচ আপনি গড়গড় করে সমস্ত কিছু............ কিভাবে !!!  এ, এ  কেমন করে সম্ভব ??
- কালীপ্রসাদের কিছু দেখতে শুনতে লাগে না মা........ নিখুঁত,নির্ভুল গণনায় বরাবর আমি সিদ্ধহস্ত।

রায়ার ঘোর কাটে না কিছুতেই, কেমন নেশার মতো বুঁদ হয়ে কালীপ্রসাদের কথা শুনতে থাকে অবিচল। কালীপ্রসাদ বলেন, "সে যাইহোক, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যাটা হলো তোমার বিপদ, যে অজান্তেই তোমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, একটা ভুল পদক্ষেপ আর তুমিও তোমার বন্ধুর মতো......."
- আমি ঠিক বুঝলাম না.......আমার বন্ধু.... ? মানে ?
এদিক ওদিক সন্তর্পনে তাকিয়ে গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন কালীপ্রসাদ, "তোমায় ডাকছে রায়া, তোমার বন্ধু তোমায় ডাকছে......... তুমি সাড়া দিলেই বিপদ !!........"
- আপনি কি বলছেন......... আমি ঠিক.......
- কেন ? তোমার ছোটবেলার বন্ধু.........তোমার হবু স্বামী.......কিঞ্জল !!
- কিঞ্জল ?? কেন......কিঞ্জলের কি হবে !!
- কিঞ্জল যে তোমায় ডাকছে মা ! বহুদূর থেকে বারেবারে সে যে ডেকেই চলেছে তোমায়.......সে ডাক অগ্রাহ্য কোরো তুমি, নাহলে আর বাঁচবে না কিছুতেই......
- এ আপনি কি বলছেন ?? দুদিন পর যার সাথে আমার বিয়ে, তাকে অগ্রাহ্য করতে বলছেন ?? শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায় রায়ার।
"এ বিয়ে তো হওয়ার কথা নয় মা, অশরীরীর সাথে বিয়ে তো হয় না কোনো মানুষের..........." ঠান্ডা গলায় বলেন কালীপ্রসাদ। একটা পেঁচা ডানা ঝাপটিয়ে চলে যায় এগাছ  থেকে ওগাছে।

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পরে রায়া। রেগে যায় প্রচন্ড। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, "এবার কিন্তু আপনি বড্ডো বাড়াবাড়ি করছেন মশাই, অতীত, ভবিষ্যতের কথা জ্যোতিষীরা মিলিয়ে দেয় বটে, তবে এটা আপনি যা বললেন তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না"।
-আমি কোনো কথাই এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না............টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আজ দুপুরের পথ দুর্ঘটনায় তোমার কিঞ্জল.............

"না-না-নাআআআ", এক মরমী, গগনভেদী চিৎকার করে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে তোলে রায়া। "এই তো কিছুক্ষন আগেই আমার সাথে দেখা করে গেল........আর আপনি বলছেন........না না, এ হতে পারে না, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন, এ সমস্তটাই আপনার ভণ্ডামি, সস্তার ট্রিক্স দেখিয়ে টাকা কামানোর উপায় ফেঁদে বসা, আমি এসব বুঝি না ভেবেছেন ??
-ঠিকই বলেছো, কিছুক্ষন আগে যে তোমার সাথে দেখা করে গেল সে কিঞ্জলই বটে, তবে রক্তমাংসের নয় এটুকু হলপ করে বলতে পারি। আর সে তোমায় নিয়ে যেতে এসেছিলো তার সঙ্গে করে, তোমার ভিতরের চাপা অস্বস্তিটাই তার পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলে। তবে বিপদ দূর হয়নি এখনো। সে আবার আসবে.............
- কিঞ্জলের যদি কিছু হতো তাহলে আমার কাছে ফোন আসতো সবার আগে। কই তেমন তো কিছু আসেনি এখনো।
- তোমার ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই......... পরখ করে দেখতে পারো।

তাড়াহুড়ো করে কাঁধের ব্যাগের চেন খুলে ভিতর থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে রায়া, তড়িৎ গতিতে আঙ্গুল চালায় কিপ্যাডে, পরক্ষনেই বুকটা কেঁপে ওঠে ধড়াস করে...................
ফোনটা সুইচড অফ !!.............. এক অব্যক্ত আতঙ্ক নিয়ে তাকায় কালীপ্রসাদের দিকে। কালীপ্রসাদ মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, "কি......আমার কথা মিলল তো" ?

গলা শুকিয়ে আসে রায়ার, পেটের ভিতর থেকে কে যেন জিভটাকে ভিতর দিকে টেনে নামিয়ে আনতে চাইছে। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোয় গলা থেকে, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বলে, "কিন্তু....... ফোন সুইচড অফ হওয়াটা তো কাকতলীয়ও হতে পারে তাই না"?
-বেশ.......... এখনো যদি আমার কথা বিশ্বাস নাহয় তাহলে বরং ওই ডালমুটওলাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, সে তো এদিকটাতেই ঘুরছে অনেক্ষণ ধরে, জিজ্ঞেস করো সে তোমার কিঞ্জলকে দেখেছিলো কিনা।

হ্রদের ধার ঘেঁষে পড়িমরি করে দৌড়য় রায়া উল্টোদিকে। ডালমুটওলার সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "ভাই একটা কথা বলবে" ? ডালমুটওলা ভারী অবাক হয়ে চোখ কুঁচকে তাকায় রায়ার দিকে ।
- আমি যখন বিকেলের দিকে এই বেঞ্চিটায় বসে ছিলাম........এই যে এই বেঞ্চিটায়........ আমার পাশে       নীল রঙের চেকশার্ট পরা একটি ছেলেকে বসতে দেখেছিলে ?
- কিছু মনে করবেন না দিদি,..... মানে....... একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
- কি ?
- আপনার কি শরীরটা একটু খারাপ লাগছে ?
- আঃ...... যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তরটা দাও ভাই, আমার পাশে কি কোনো নীল রঙের শার্ট পরা ছেলেকে বসতে দেখেছো তুমি ?
রোগা ছিপছিপে ছেলেটি এক কথায় উত্তর দেয়.....  "না".........

মাথাটা ভীষণরকম টলে যায় রায়ার, চেঁচিয়ে বলে, "কি যাতা বলছো !!......... আমার পাশে কাউকে বসতে দেখোনি তুমি !!!
- না দিদি, শুধু এই বেঞ্চিটা কেন ? আপনি এই বেঞ্চিতে বসার কিছুক্ষন পরেই উঠে গিয়ে ওই দিকের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন, তারপর কি যেন সব বিড়বিড় করতে লাগলেন, কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে...........কি ব্যাপার বলুন তো দিদি !! আপনার কি শরীর খারাপ ??

এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে পিছনে দূরের বেঞ্চিটার দিকে দেখে রায়া। যেখানে কালীপ্রসাদ আর সে এতক্ষন বসে কথা বলছিলো........ আশ্চর্য !!! বেঞ্চিটা বেমালুম ফাঁকা !! হাড়হিম করা একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় রায়ার পিঠ বেয়ে। তবে কি ??........... তবে কি পুরোটাই ভুল দেখলো এতক্ষণ, মাথাটা কি তাহলে খারাপ হয়ে গেলো তার ? তবে এতটা সময় কালীপ্রসাদের সাথে এতগুলো কথা.........!!!
সবটাই কি মিথ্যে ?? একের পর এক প্রশ্ন ঝড়ের মতো তোলপাড় করতে থাকে রায়ার মনের মধ্যে। মিনমিন করে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি বলছো, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা কোনো বয়স্ক ভদ্রলোককে আমার সাথে দেখোনি ওই বেঞ্চিটায় ?
-  সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ? বয়স্ক ভদ্রলোক ? আচ্ছা কাঁচা পাকা দাড়ি আর উস্কো খুস্কো চুল ছিল কি ??
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছো একদম......তুমি চেনো তাকে ?
- আমি চিনিনা বটে, তবে এক বিখ্যাত জ্যোতিষী কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওখানে এসে বসতেন বরাবর, অনেক লোকজন আসতো, প্রচুর আড্ডা হতো। দারুন নামডাক ছিল ওনার, কিন্তু উনি তো বেশ কিছুদিন হলো মারা গেছেন শুনেছি, টিবি হয়েছিল খুব সম্ভব। কেন বলুন তো ?

মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে রায়ার। কোনো দিশা পায়না কোথাও, চোখের ওপর ঘন কুয়াশার মত অন্ধকার ঘনিয়ে আসে ধীরে ধীরে ...... এ কি করে সম্ভব !! এ কি করে.........!!!!
হঠাৎ মোবাইলটা  বেজে ওঠে এক তীব্র আওয়াজ করে........সুইচড অফ ফোন বাজছে কি করে ?
এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে খেতেই স্ক্রিনের ওপর চোখ চলে যায়..........স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠেছে...... "কিঞ্জল কলিং" !!
দড়াম করে মাথা ঘুরে পড়ে যায় রায়া মাটির ওপর। মোবাইলটা বেজেই চলে একনাগাড়ে...............          

ছবি: গুগল 

#bengalishortstories #bengalihorrorstories #suspense #thrill #murder #mystery #astrology #bengalighoststories
         

Sunday, July 17, 2016

অন্য মেলা

বরাবর ঘুম থেকে উঠে দেখেছি, বেশ অফ ফোকাস লাগে চারপাশটা। সেটা ঘুম থেকে ওঠার ফলেই হোক কিম্বা "চশমাটা খুলে গেলে মুস্কিলে পড়ার" কারণেই হোক, যদিও বাড়িতে থাকলে পড়ালেখার কাজ ছাড়া খুব একটা চশমা আঁটা হয় না নাকে। সে যাইহোক, চোখ কচলে অস্পষ্ট ভাবটা কাটিয়ে উঠতে দিব্যি কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। আজ সকালেও বিছানায় উঠে বসে ঠিক তেমনি করেই অস্পষ্ট ভাবটা কাটাচ্ছিলুম। যথারীতি সকালের কাগজটা হাতড়াতে গিয়ে গিয়ে যেটা চোখে পড়লো সেটা দেখেই পলকে একরাশ শরতের মেঘ জমা হলো মনে, এই ঘোর শ্রাবনের সকালবেলাতেও । এক লহমায় পুরোনো পলেস্তারার মতো ঝুরঝুর করে খসে পড়লো শরীরের যাবতীয় ল্যাদ। কারণ বাংলা ও ইংরেজি কাগজের ফাঁক দিয়ে যে পরিচিত লোগোটা উঁকি মারছে সেটা আমার বা আমার মতো অনেকেরই সেপিয়া মোডের একটুকরো ছেলেবেলা। তার চেয়ে বরং বলা ভালো একটা কাগজের নৌকো। যে নৌকোর সারা শরীর জুড়ে অক্ষরের ছাপ, পরতে পরতে গল্পের ঢেউ, পাতার পর পাতা জুড়ে রঙিন কমিক্স, ইতস্তত এডভেঞ্চারের যতিচিহ্ন ও সর্বোপরি রূপকথার জালে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ার অকুন্ঠ আকাঙ্খা। বড্ড মন ভালো হওয়া সকাল হলো.........

বাংলা ইংরেজি কাগজের ফাঁক দিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর চাপে প্রায় কান ধরে আনার মতো করে বার করে আনলাম এক অবাধ্য পক্ষীরাজ ঘোড়াকে।  যে বছরের এক বিশেষ সময়তেই টগবগিয়ে এসে সারাবছরের খাঁজে খাঁজে জমে যাওয়া ধুলোকে এক ঝটকায় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে ঠিক আগের মতোই ঝকঝকে তকতকে করে দেয়..................... আমার "পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা'। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে নতুন বাঁধানো বইয়ের গন্ধ নিতে নিতেই এক দমকা হাওয়ায় পাতাগুলো ফড়ফড় করে এক এক করে উল্টে যেতে লাগলো চোখের সামনে, নিজে থেকেই। আমাকে অবাক করে চারপাশের দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগলো অচিরেই। ঘরের দেওয়াল, জানলা, দরজা, আলমারি মুহূর্তে উধাও। কেমন অজান্তেই মেরি গো রাউন্ডের কাঠের ঘোড়ায় চেপে ঘূর্ণিপাক খেয়ে আমিও পিছিয়ে গেলুম ছাব্বিশ - সাতাশ বছরের পুরোনো কোনো এক রবিবারের দুপুরবেলায়..............

চেতলার বাড়ি। কানে ভেসে আসছে কোয়াটার্সের ঠিক পূর্ব দিকে শীতলা মন্দিরের ঘন্টার গুরুগম্ভীর ঢং ঢং শব্দ। সামনের রাধাচূড়া গাছটায় দুই শালিখের বেরোখ ঝগড়া, জি ই সি ফ্যানের ঘড়ঘড়ানি আর প্লাস্টিকের হ্যান্ডল ওয়ালা ফিলিপসের একটা চালসে পড়া রেডিওতে সন্ধ্যা - হেমন্তর কণ্ঠে লো ভলিউমে বিবিধ ভারতীর মনকেমন করা জনপ্রিয় সঙ্গীতের আসর। তার সাথে মাঝে মাঝেই ফুটনোটের মতো যোগ হচ্ছে হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স, কেও কার্পিন হেয়ার ভার্টিলাইজার, স্যালিকোল মলম এর রিদমিক মূর্ছনা। আর সেসব ছাপিয়ে, বিন্দুমাত্র কোনোদিকে পাত্তা না দিয়ে আমি ঝড়ের বেগে শেষ করছি একের এক কাকাবাবু, ফেলুদা, পান্ডব গোয়েন্দা, অর্জুন, কর্নেল ইত্যাদি। স্পষ্ট দেখতে পেলুম গরাদের শিক দেওয়া কাঠের জানলার ধাপিতে আয়েশ করে বসেছে বছর দশেকের আমি আর কোলের ওপর খোলা আছে আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকী। চোখের পলক পড়াও নিদারুন সময়ের অপচয় মনে হচ্ছে তখন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছাপানো লাইনের ফাঁকে ফাঁকে শুষে চলেছি আমার কৈশোরের মিঠে নির্যাস । তখন পুজোর ঠিক আগে আগেই বেরোতো পূজাবার্ষিকী। ততদিনে আকাশের রঙে পরিবর্তন দেখা দিত, দিগন্ত বিলীন কাশফুলের মাঠে অপু দুর্গারা ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি শুরু করে দিত, মহালয়ার রাগ ভৈরবীর অপেক্ষায় হাতের কর গুনতাম আমি ও আমার মতো আরো অনেকেই। পূজাবার্ষিকীটা হাতে পড়া মানেই ঢাকে কাঠি পড়ার মতোই ছিল তখন । সাইকেলের ট্রিং ট্রিং করে ঘন্টি বাজিয়ে একগাল হাসি নিয়ে সুদেব কাকু আনন্দমেলা হাতে নিয়ে দাঁড়াতো বারান্দার নিচে। গ্লস পেপারের চকচকে বাঁধানো বইটা দেখেই একরাশ ভালোবাসা ঢেলে দিতুম সুদেব কাকুর জন্য। তারপর বইটা নিয়ে একছুটে আমার প্রিয় জানলার ধাপিতে..............

'ভাই চা' ! রীনাদির বাড়ানো চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে সম্বিৎ ফিরলো। অদৃশ্য টাইম মেশিনের চরকিপাকে কৈশোরের দুপুরবেলা থেকে ভোঁ করে  ফিরে ফিরে এলুম আজকের রবিবারে। 'রাখো' , বলে আনন্দমেলাটা টেনে নিলুম কোলের ওপর। চৌকো মাপের দস্তাবেজের ওজন কম কিছু নয়। দেবাশীষ দেবের প্রচ্ছদ....... কার্টুনের ডিটেইলিংটা দেখতেই প্রায় মিনিট পনেরো সময় লাগে। গরদের পাঞ্জাবি পড়ে কার্তিকের বুক চিতিয়ে সেলফি তোলার কায়দাটা এবার অনন্য। পাতা ওল্টালুম, অন্য পৃথিবীর উন্মোচন হলো একরকম। চোখ রাখলুম সূচিপত্রে। উপন্যাসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, তিলোত্তমা মজুমদার, দেবাশীষ বন্দোপাধ্যায়, ঋতা বসু ও আরো অনেকে। কমিক্সে সত্যজিৎ রায়, সমরেশ বসু আর লতানে গাছের মতো জড়াজড়ি করে আরো এক গুচ্ছ ছোটগল্প আর মজাদার আর্টিকল। যোগ্য জুড়িদার হিসেবে 'গলা খুসখুস এবং সর্দি কাশিতে তালমিছরি' , 'সার্টিফায়েড খাঁটি গ্রহরত্ন' , 'মনকাড়া সোনার গয়না' , 'বেনারসী বা সিল্কের শাড়ির একটাই ঠিকানা' , 'ছিপির পিছনে সিল দেখে নিন ' প্রভৃতি না বদলানোর ছাপ গোটা বইটা জুড়ে। আড়মোড়া ভেঙে গুছিয়ে বসি বরং ......... আজ আর কোনো কাজ নেই.........দুনিয়ার কর্মযোগী তফাৎ যাও.........সবার আগে কমিক্সটা দিয়ে শুরু করতে হবে..........!!!!!

 ছবি : নিজস্ব
         



 ছবি : নিজস্ব

















#bengaliarticles #anandamela #nostalgia #pujabarshiki #bengalimagazine

Saturday, July 16, 2016

প্রথম

যেভাবে চলে গেলি, সেভাবে ফিরেও আসতে পারিস
আচম্বিতে, অতর্কিতে কোনো এক মুহূর্তের হাত ধরে
কোনো এক তীব্র আকাঙ্খায়
যেখানে অনিবার্য প্রেম স্বস্তি পায়.............

সেখানে তোর ফিরে আসার চিহ্ন লেগে থাকুক
লেগে থাকুক তোর একগুঁয়েমি আদর
অপরাহ্নের বাদলে ঢেকে যাক মুখ
বল দেখি আমায়, কত গল্প বলার আছে......
জানিস, নিরলস তৃপ্তিতে এভাবেই কত মানুষ
প্রথম প্রেম নিয়ে বেঁচে আছে.............

ছবি : নিজস্ব 















#bengalipoems #lovepoems #romanticpoems

Thursday, July 14, 2016

জিয়ানস্টাল ১ # নব নালন্দা ডট ইস্কুল

কাব্যে গদ্যে 'ধূসর অতীত' কথাটার বিচ্ছুরণ ঘটে অনাবিল ভাবেই কোনো রকম গাণিতিক নিয়ম না মেনে। আমার জীবনে ধূসর অতীত শুধুমাত্র গণিত নয়, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, জীব বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, মায় শরীর শিক্ষা পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি ঘটে। শুধু আমার কেন, আমার বিশ্বাস আমার প্রত্যেক সহপাঠী বা সহপাঠিনীর ক্ষেত্রে তা একইরকম প্রযোজ্য। ধূসর রঙের ইউনিফর্মটা দশ বছর দ্বিতীয় ত্বকের মতোই টানটান লেপ্টে ছিল আমাদের শরীরের সঙ্গে, যার ঘ্রান এখনো কোনো এক মনখারাপের দুপুরবেলাতে দিব্যি পাওয়া যায়। গতকাল রাতে আমার স্কুলের বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ এর একটি গ্ৰুপে আলোচনা করছিলুম, যদি হঠাৎ করে সবাই মিলে একদিন পুরনো স্কুলটাতে গিয়ে হাজির হওয়া যেত, বিনা পরিকল্পনায়, প্রায় বিনা নোটিশেই....তাহলে কেমন হত ? 

একুশ বছরের প্রায়ান্ধকার একটা স্মৃতির ঘরে টিমটিম করে লো ওয়াটের বাল্বের মতো আমাদের কচিবেলা জ্বলছে, সেটাই নাহয় চোখের দেখা দেখে এলাম একবার, ছোটোছুটি করলাম নাহয় ফেলে আসা কিছু মুহূর্ত গলির আনাচে কানাচে, শ্বাস প্রশ্বাসে আবার করে ভরে নিলাম নাহয় বছর দশেকের স্নিগ্ধ টাটকা ইতিহাস, বেশ হতো, তাই না?................ নানাবিধ আলোচনায় যেটা জানতে পারলাম সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলুম না মোটেই, তাই বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে যন্ত্রনা পেয়েছি দ্বিগুন। সে ব্যাথা স্বজন হারানোর যন্ত্রণার থেকে কম বড় নয়। আমাদের স্কুলের মেইন বিল্ডিং এর গোটাটাই নাকি ভাঙা হয়েছে, কারণ নতুন বিল্ডিং মাথা তুলে দাঁড়াবে চড়চড়িয়ে। ২৫নং, সাদার্ন এভিনিউ এখন একটা ফাঁকা মাঠ বই আর কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে লাল দেওয়ালের ওপর শ্যাওলার মতো আটকে থাকা আমাদের পুরোনো সময়গুলো পলেস্তরার মতো ভেঙে ঝরে পড়েছে, একথা ভাবতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে অজান্তেই । এমন ঘটনায় কিভাবে রিয়্যাক্ট করব জানিনা, অনেকেই হয়তো বলবে, "এতো সুখবর ! নতুন নির্মাণে ছাদের পরিসরটাও তো বাড়ল খানকতকটা"। হয়তো সত্যিই তাই। পুরোনো কাঠামোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে বটে, তবে পুরোনো ছাদটা ধূলিসাৎ হওয়ার সাথে সাথে অতীতের চিহ্নগুলোও বিলুপ্তির পথে কয়েক গজ পা বাড়ালো না কি ?

নবনালন্দা বলতেই গুগল ম্যাপে সাদার্ন এভিনিউয়ে ঢোকার মুখে বাঁদিকে সবুজ লোকাটরটা দেখাবে বটে, তবে যেটা দেখাবে না বা আর কখনোই দেখা যাবে না তা হলো লাল মাটির নকশা করা ১৯৬৭ র একটা চাঁপাফুল রঙা আদি দোতলা বাড়ি। যে বাড়ির সামনে দুটো লোহার গেট দুপাশে ফাঁক হলেই খুলে যেত আমাদের বাঁধভাঙ্গা উল্লাসের ম্যাজিক বক্স। যেখান থেকে বেরিয়ে আস্ত আমাদের কচিবেলার হুল্লোড়ের পায়রাগুলো, যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেলাগাম উড়ে বেড়াতো ঠিক মাঝখানের তকতকে উঠোনটায়। যেখানে নিয়ম করে সারি দিয়ে দাঁড়াতে হতো প্রেয়ারের সময় আর তার সাথে উড়ে আসতো উটকো চিমটি আর ফক্কুড়ি এদিক ওদিক থেকে। ফলে, 'ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা' দায়সাড়া গোছের কিছু প্রেয়ার করে যে যার খোপে ঢুকে যেতুম এক এক করে। 'পিনড্রপ সাইলেন্সের' ঝিঁ ঝিঁ পোকাটা নাগাড়ে বেজে চলতো কানের মধ্যে টিফিন টাইম অবধি। বাদিক ঘেঁষা বাঁধানো সিমেন্টের জলের ট্যাঙ্কটা অপেক্ষা করে থাকতো কখন আমরা টিফিন টাইমে ঠেলাঠেলি করে এ ওর গায়ে জল ছেটাবো। গুরুগম্ভীর ধমকানি বা গার্জেন কলের তোয়াক্কা করতুম না আমরা তেমন কেউই। পিছন দিকের আম গাছ আর বাঁদিকের নিম গাছটা নিপাট সাক্ষী থাকতো সেসব ডেঁপোমির। রেক্টর রুমের সামনে একটা একোরিয়াম ছিল, পানিশমেন্টের সময় অনেকেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো সেদিকে চেয়ে, ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ঘোর কাটতো না। মাছেদের কথা শুনতে পেতুম হয়তো আমরা কেউ কেউ । ঠিক তার ডান দিকেই কাঠের রেলিং দেওয়া শান বাঁধানো, কুয়াশা মাখা (আধো অন্ধকার থাকতো ) একটা সিঁড়ি ছিল যেটা দোতলায় উঠে লম্বা করিডোর শুরু হওয়ার ঠিক আগেই শেষ হতো। করিডোর বরাবর তিনটে সেকশনের তিনটে ক্লাসরুম ছিল যার প্রত্যেকটায় পিছনের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যেত। আমরা অনেকেই সেদিকে তাকিয়ে থাকাটা বেশি ইম্পরট্যান্ট মনে করতুম ব্ল্যাকবোর্ডের চেয়ে। ফলে নীল ডাউন বা বেঞ্চির ওপর গণ দাঁড়ানোটা প্রায় রেওয়াজই হয়ে গিয়েছিলো একরকম। আজও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, 'চল না ! আরো একবার দাঁড়াই সকলে মিলে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, ঠিক যেমনি করে দাঁড়াতুম সেই সব দিনে'..................

সেই জানলাগুলো বোধহয় না খোলার যন্ত্রনায় গুমরে মরেছে এতদিনে। সেই মেরুন রঙের সোফাটা, যেটা একাউন্টস সেকশনের প্রবেশপথে পড়ত, সেটা হয়তো আজ আস্তাকুঁড়ে বোঝাপড়া করছে অতীতের সঙ্গে। নিচের উঠোনটার চারপাশে লাল রঙের দেওয়াল ঘেরা ক্লাসরুম গুলোয় মৌমাছির গুঞ্জন এখনো কান পাতলে শোনা যাবে দস্তুরমতো। সেই লাল রঙে আঙ্গুল ছুঁলে হাতে রং উঠে আসতো সেসময়, অথচ কোনো এক জাদুবলে সেই জায়গাটার রং ফিকে হতো না কিছুতেই। এই ধাঁধাটা সেসময় বিস্তর মাথা চুলকেও বুঝে উঠতে পারিনি, আজ পারি। আর তাই ছিটেফোঁটা যেটুকু বাকি আছে সে রঙের, সেইটে দুহাত দিয়ে জাপ্টে জড়িয়ে রেখেছি, নিজের কাছে............ এটুকুই তো সম্বল, এটুকুই থাক বরং.........    

সাঁঝবেলার ছেলেমেয়েদের বাগানের মাটি উপড়ে নতুন করে নতুন গাছ লাগানো হোক নির্দ্বিধায়, ক্ষতি নেই, তবে পুরোনো ফুলের গন্ধগুলো অমলিন ও টাটকা থাকবে আমাদের সকলের, সে ব্যাপারে আমি দুশোভাগ নিশ্চিত। তবুও.................... আলাদা করে আরেকটা বাগান করা যেত না কি ?                                

"যে আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্বলে
      নিভে যায় - ডুবে যায় - তারা যায় স্খলে
নতুন আকাঙ্খা আসে  - চলে আসে নতুন সময়
        পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,
              নতুনেরা আসিতেছে বলে"
                                                                                            ............জীবনানন্দ দাশ
                                                 


#bengaliarticles #schooldiaries #schoolarticles #schoolwriteups #navanalanda #navanalandaalumni #nostalgia #oldschool #schoolmemories

Tuesday, July 12, 2016

অনুপদ্য - ৯

ছবি : নিজস্ব 
অনুশব্দরা কথা বলে থাকে বিস্তর
আজব খোয়াবে এরাও ভাসতে জানে
এদেরও না বলা কথা থাকে অনেক
কারণ এরাও ভালোবাসতে জানে........

তবু কিছু কথা লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে
তবু কিছু কথা ওড়ে মর্জিমাফিক
না বলা কথাদের যারা শুনতে পায়
এ পৃথিবীর তারাই আসল প্রেমিক.......










#bengalipoems #lovepoems #romanticpoems

Monday, July 11, 2016

কাঞ্চনজঙ্ঘা

যদি তুমি কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে.....
এক মুঠো পাহাড়ী কুয়াশা নিয়ে
এক ছুটে পৌঁছে যেতাম তোমার কাছে
রাস্তার বাঁকে উদ্দাম ঝর্নাকে
বলতাম তোমার পড়শী হতে
যদি তুমি কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে........

যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে.....
পাইন ইউক্যালিপ্টাসের শিকড়ে
বানাতাম আমাদের স্বপ্নের আশিয়ানা
তীব্র আকাঙ্খায় দুর্নিবার স্রোতে
তিস্তা হয়ে বয়ে যেতাম অন্য খাতে
যদি তুমি কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে........

যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে....
তবে তোমার উচ্চতায় গর্বিত হতাম 
তোমার তুষারের আবরণে ঢেকে নিতাম নিজেকে 
অগণিত তারার নিঃশ্বাসে জেগে থাকতে রাতে
তুমি আমার চোখে চোখ রেখে
যদি একটিবার.......কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে........

ছবি : নিজস্ব 

#bengalipoems #kanchendzonga #kangchenjungha #lovepoems #romanticpoems

Saturday, July 9, 2016

জন্ম

বয়েসের পারদটা কেমন যেন সময়ের তাপে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কেমন হত ! যদি আমার জীবনের মোড়ে মোড়ে সিগন্যাল থাকতো ? বেশ হত বোধহয়। লাল হলেই পুরোনো  জমা খরচের ব্যালান্স শিটটা একবার চট করে মিলিয়ে নেওয়া যেত। ডানদিক বাঁদিক মিলে গেলেই আবার পথ চলার শুরু। আটত্রিশ এর পাপোষে পা ঘষে যখন পিছন ফিরি, তখন দেখি এতগুলো বছরের আনন্দ, সুখ, দুঃখ, হতাশা, গ্লানি কখন একটা পরজীবী লতার মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে নিজের সাথে। পুরনো রঙচটা খয়াটে জামার মত ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করলেও ফেলে উঠতে পারিনা কখনই। নখের কোনে জমে ওঠা ময়লার মত ওটাও আমার, ওতপ্রোত ভাবেই আমার। এমতবস্থায় সুখটানের ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে পাক খাওয়া যায় অথবা ঘুম থেকে উঠে গায়ে থাকা দোনমনার চাদরটা একটানে সরিয়ে ফেলে আয়নার মুখোমুখি হযে বলা যায় অস্বস্তি চাই......অস্বস্তি .........স্বস্তি নয়।
কর গুনতে থাকি, দেখি এ বছরটা কেমন যায় !!!!...............


জন্মদিন উপলক্ষ্যে ফেসবুকের পাতায় প্রকাশিত ; ৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ 

ছবি : নিজস্ব 















#bengaliarticles #birthdayarticle

Friday, July 8, 2016

অনুপদ্য - ৮

ছবি : গুগল 

রাতপোশাকেরও ভালোবাসা পায়

তাদেরও বুকপকেটে থাকে খাম......

উষ্ণতার শেষটুকু ছুঁয়ে দিয়ে যায়

কামিজের আদরে লেগে থাকা ঘাম......







#bengalishortpoems

Thursday, July 7, 2016

অনুপদ্য - ৭

ছবি : নিজস্ব

সে কবিতা লিখে লাভ কি

যে কবিতা মনে রাখে না লোকে !

সে কবিতাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া ভালো

যদি সে ঘুম চোখেই না ওঠে !









#bengalishortpoems

Tuesday, July 5, 2016

অনুপদ্য - ৬

ছবি : নিজস্ব 

ঈশানী মেঘ বলতে পারেনি
আজও দমকা হাওয়া ব্যস্ত ছিল.......
জোনাকিরাও বলতে পারেনি
ভুল ঠিকানার ভয় ছিল........

ভেবেছি তোর সন্ধানে পাঠাব তাদের
আজ যারা....... বৃষ্টিতে ভিজেছিল......







#bengalishortpoems 

Saturday, July 2, 2016

সাপ্তাহিকী ১৩ # পাঠক

চ্যাটবক্স # রাত ১১.৩০ # মঙ্গলবার 

- নমস্কার....... আপনার কবিতাটা বেশ লাগলো !
- নমস্কার।...... কোন কবিতাটা ?
- ঐ যে কয়েকদিন আগে ফেসবুকে যেটা পোস্ট করলেন ......সেইটা।
- ফেসবুকে তো অনেক কবিতাই পোস্ট করি। কোনটা বলুন তো !
- 'নষ্ট' নামক কবিতাটা।
- ওঃ..... আচ্ছা....
- বড় ভালো লিখেছেন।
- ধন্যবাদ।
- কবিতাটার শেষ দুটো লাইন বড় অদ্ভুত, কেমন স্বপ্ন দেখায়........তাই না ?
- হুমমম.........তাই কি ?
- তা নয় বলছেন ?
- হতে পারে......আত্মিকরণের ওপর নির্ভর করে অনেকটা।
- তা হবে.......তবে স্বপ্ন দেখাটা একরকম আত্মার শান্তি কি বলেন ?
- কি রকম ?
- না মানে, আপনি যদি স্বপ্ন না দেখতেন তাহলে কি এটা লিখতে পারতেন ?
- নাঃ...... কোনো স্বপ্ন দেখে তো লিখিনি এটা। বরং, যা দেখি চারপাশে, যা শুনি, তাই অনুধাবন করে লেখার চেষ্টা করি মাত্র।
- তা বটে....... তবে "ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার" এলিমেন্টটা কি সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় ?
- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা !!.......তা এড়িয়ে যাওয়া যায় না বটে তবে সেটার সৌভাগ্য হয় না সবসময়।
- এক্ষেত্রে কি, হয়েছে ?
- ঠিক বুঝলাম না !
- না, আমি বলতে চাইছি......এই কবিতার ক্ষেত্রে, আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোনো রকম প্রভাব পড়েছে কি ?

(অফলাইন)

চ্যাটবক্স # রাত ১১.৩৩ # বুধবার

- কাল শুভরাত্রি বলার সুযোগটুকু দিলেন না.....তার আগেই.....
- সব রাত্রি শুভ হয় না, আর আমি সুযোগ দেওয়ার কে ?
- তা বটে, আপনি স্বনামধন্য লেখিকা যুথিকা মিত্র ! আমার মতো ছাপোষা পাঠকের সুযোগ পাওয়া কঠিন।
- সুযোগ কথাটা আপেক্ষিক আমার কাছে। সর্বক্ষেত্রে সবাইকে যে সুযোগসন্ধানী হতে হবে এমনটা আমি বিশ্বাস করি না।
- নিজের জীবনের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য নিশ্চই ?
- একশোবার.........তবে..... আপনার কথায় কেমন যেন হেঁয়ালির গন্ধ পাচ্ছি ............
- আপনি জনপ্রিয় মানুষ, আমার মতো পুঁচকে পাঠকদের হেঁয়ালি অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আপনার নিশ্চই আছে।
- আশ্চর্য !! এই খোঁচাটা দেওয়ার কারণ ?
- ঐ যে বলেছিলুম, 'ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা'........ওটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না সবসময়।
--------------------------------------------
- এইমাত্র আপনার প্রোফাইল দেখলাম সাগ্নিক, ব্যক্তিগত কোনোরকম অভিজ্ঞতার কথা মনে করতে পারছি না। একটু মনে করিয়ে দিলে ভালো হয়।
- হতাশ হলেন বোধহয় ?
- বরং কৌতূহলী হচ্ছি।
- হাহাহাহা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার তেমন সুযোগ ঘটেনি আমাদের।
- তাহলে, খোঁচা দেওয়ার কারণটা পরিষ্কার হলো না তো তেমন !
- ওটাও আপনি আপেক্ষিক হিসেবেই ধরে নিন নাহয়............
- হুমমম.......আপনার প্রোফাইলে যা দেওয়া আছে তার বাইরে আপনার পরিচয় ?
- আমি আপনার একনিষ্ঠ পাঠক মাত্র।
- তার মানে পরিচয় গোপন করাটা ইচ্ছাকৃত........ কিন্তু..... কারণটা কি ?
- সে কি কথা ! কারণ অকারণের বিচার তো বিখ্যাতরা করেন না সচরাচর........ওটা তো পরিচয় পিপাসুদেরই একমাত্র অধিকার।
- পরিচয় পিপাসু !! তা আপনিও কি সেই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ?
- বলতে পারেন......... সবার মতো আমিও একটা সিঁড়ি খুঁজছি।
- সবাই সিঁড়ি খুঁজে বেড়ায় বলছেন ?
- খোঁজে না বলছেন ?
- ভীষণ আশ্চর্য হচ্ছি আপনার কথায়।
- আশ্চর্য হবার মতো তো কিছু নয়, ওপরে ওঠার ধাপে সবাই পা রাখতে চায়, সে যেমন করেই হোক..... এই ইচ্ছেটাকে সবাই খুব যত্ন করে, অস্বীকার করার উপায় আছে ?
- তর্কের খাতিরে কিছুটা মেনে নিলেও পুরোপুরি একমত হতে পারছি না আপনার সঙ্গে।
- "নিন্দুকেরা বলবে কথা বলুক তারা যতই, পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটুকু আমার তোমার মতোই" - আপনার লেখা কবিতাটার শেষ দুটো লাইন........এর পরেও আশ্চর্য হবেন ?
- বেশ....... উন্নতির পথ আর পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে - এর মধ্যে তো কোনো সাদৃশ্য নেই।
- আসলে কি জানেন সিঁড়ি ভাঙার অঙ্কটা সবাই ঠিক সল্ভ করতে পারে না অথচ কষতে চায় সবাই। ভবিষ্যতের গুপ্তধনের চাবিটা অতীতের গহ্বরেই লুকিয়ে থাকে, কেউ কেউ সেটা ঠিক সময় খুঁজে পেয়ে যায়। যারা পায়না তারা বোধহয় আমার মতো খোঁচা দেওয়ার লক্ষ্য খোঁজে !
- ঠিক পরিষ্কার হল না ...........
- কেন ? সে চাবি তো আপনিও খুঁজে পেয়েছেন, তাই দিয়ে কি সিন্দুকের তালা খোলেননি ? সিঁড়ি ভাঙার অঙ্কটা আপনার থেকে কে আর ভালো মেলাতে পেরেছে বলুন ?  ......... কি ?.......... ভুল বলছি  না তো ?
- আমার অতীত সম্পর্কে কি জানেন আপনি ? আর সেসব নিয়ে আলোচনা কেনই বা করব আপনার মতো অচেনা লোকের সাথে !!!!!
- সে তো বটেই....... চেনা পরিচিতের গন্ডিটা যে বড় সুখের জায়গা আপনার। অনর্থক অপরিচিত চৌহদ্দির ফাঁকে যে দিকভ্রম হওয়ার ভয় থাকে।
- আপনার কথাগুলো বড় অদ্ভুত ঠেকছে ........ কেন বলুন তো ?

(অফলাইন)

চ্যাটবক্স # রাত ১১.০০ # বৃহস্পতিবার 

- অহেতুক কৌতূহল বলে উপেক্ষা করবেন না, আপনার কালকের কথাগুলো বড় ভাবিয়ে তুলেছে। আপনার স্বম্বন্ধে একটু জানতে চাইব সাগ্নিক।
- কি সৌভাগ্য আমার !!!! এ যে মেঘ না চাইতেই জল, শহরের নামকরা লেখিকা একজন সামান্য পাঠকের ইতিবৃত্ত জানতে চাইছে !!
- আপনার ব্যঙ্গটিকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছি না এই মুহূর্তে, কারণ কৌতূহল চেপে রাখাটা আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তিকর।
- পাত্তা পাওয়াটাকে একটা শিল্প বলে মনে করি জানেন। অনেকেই পাত্তা পায় না অনেক জায়গাতে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে হেয় হলে সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াবার পথটাও কেমন সংকুচিত হয়ে যায়। অসম্মানের খড়কুটো দিয়ে কি আর ঘর বাঁধার ছাউনি দেওয়া যায় বলুন ? যে দেওয়াল ঘরের ভিত মজবুত করে সেই দেওয়ালের ওপর গোবরও লেপে দিয়ে যায় মানুষ। ভিত এর গুরুত্বটা তখন আর খেয়াল থাকে না কারো, গোবরের গন্ধটাই বেশি করে নাকে লাগে সবার।

- আমি কিন্তু ভীষণ অবাক হচ্ছি !

- আমিও বিভিন্ন ঘটনায় আগে অবাক হতাম জানেন..........ধীরে ধীরে বড় হয়েছি, দেখেছি, বুঝেছি,......  পুরোনো ঘর বাড়ির মতো মানুষেরও খসে যাওয়া পলেস্তারার পিছনে তার জীর্ণ কঙ্কালটাই আসল সত্য।
- আপনার জীবনের কোনো একটা অন্ধকার দিকের ইঙ্গিত পাচ্ছি মনে হচ্ছে।
-গল্পের উপাদান পাচ্ছেন বলুন ....... !!!!
- আপনার খোঁচাগুলো কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে আমার ........   আপনার অবশ্য বলতে যদি আপত্তি না থাকে......
- নাহ ! লুকোবার মতো গুপ্তধন কিছু নেই আমার.......তবে আপনার সময় অপচয়ের ভাগিদার হতে চাইনা আমি।
- ওটা আছে আমার আপাতত........আপনি নির্দ্বিধায় বলুন।
- বেশ......তবে আমার একটা শর্ত আছে। এই গল্পটা আপনাকে লিখতে হবে। কথা দিন, তবেই বলতে পারি।
- কথা দিতে পারছি না, তবে লেখার মতো রসদ থাকলে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।  
- বেশ..... তাহলে শুনুন ..............

আমি এক অত্যন্ত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ। কলেজে পড়ি আর টিউশনি করে পেট চালাই।  অভাবটা প্রায় গায়ের চামড়ার মতোই লেগে থাকে সর্বক্ষণ। কষ্ট হয়, যন্ত্রনায় কুঁকরেও গেছি অনেকসময়, তবে উপড়ে ফেলতে পারিনি কখনোই। সেটা হয়তো ভাগ্যের কুনজর বা যথেষ্ট কর্মদক্ষতা না থাকার ফলেও হতে পারে। সেই ছোটোর থেকে স্কুলে পড়াশুনার পাশাপাশি রোজগারের চিন্তাতেও মন দিতে হয় । টেন পাশ করার পর থেকেই এক দুরারোগ্য ব্যাধির কৃপায় বাবা শয্যাশায়ী। অতএব ভাত জোটানোর প্রাথমিক দায়িত্বটা অনেক ছোট বয়েস থেকেই আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে। তাতে অবশ্য আমার কোনো অভিযোগ নেই, ছিলও না কখনো। একরকম গা সওয়া হয়ে গেছে বলতে পারেন। স্কুলে শাস্তি পেলে টিচার যেমন নীল ডাউন করিয়ে রাখে ক্লাসের বাইরে, আমার ভাগ্যও আমাকে কতকটা কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ঘরের বাইরে, একা, সহায় সম্বলহীন করে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, মুখোশধারী ও মুখোশহীনদের মধ্যে তফাৎ করতে পারি। আর চার পাঁচটা ছেলে মেয়েদের তুলনায় আপাত দৃষ্টিতে অসহায় মনে হলেও বাকিদের থেকে অনেক বেশি মানুষ বলে মনে হয় আমার। সেইটাই আমার মৌলিক পরিচয়।

- বুঝলাম......... আপনার মা ?
- নেই।
- ওহ......আচ্ছা..............কিছু মনে করবেন না, মানে ভারতবর্ষে এমন বহু মানুষ আছেন যাঁরা ভীষণ অবহেলা বা অনাদরে মানুষ হয়েছেন বা হচ্ছেন। যে কোনো কারণেই হোক, এই বাস্তবটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের কারোর। তাহলে..........
- তাহলে আমার গল্পের রসদটা কোথায় ? তাই তো ?
- আমায় ভুল বুঝবেন না।
- বিন্দুমাত্র নয়............রসদটাতেই  আসছি। আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না ?
- হ্যা, উনি কত বছর আগে.......?
- না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। উনি বেঁচে আছেন। বলা ভালো, শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে দিব্যি আছেন। আমার যখন পাঁচ বছর বয়েস তখন উনি পরিত্যাগ করেন বাবাকে......আর আমাকে......। আমার বাবা একজন সঙ্গীতশিল্পী, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন দুজনে। বিয়ের ছ বছরের মাথায় মোহভঙ্গ হয় মায়ের। একজন মাঝারি মাপের শিল্পীর অনিশ্চিত রোজগারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা হয়েছিল ওনার। আর তাই নতুন স্বপ্নের হাতছানিতে সাড়া না দিয়ে পারেননি। দুকুল ছাপানো বন্যার মতো ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের ছোট্ট সংসারটা। লণ্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল সমস্ত কিছু। পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজনটুকু মনে করেননি একফোঁটা। বরঞ্চ ফেলে দেওয়া জঞ্জালের মতো এক নিমেষে ভুলে গিয়েছিলেন আমাদের। কোনো এক আষাঢ়ের ভোরবেলায় দলছুট হবার আগে রেখে গিয়েছিলেন একটি চিঠি। কিছুটা বড় হবার পর সেই চিঠি আমি পড়ি। ভারী চমৎকার সে লেখা।

- কি চিঠি !!!!!! কি লেখা ছিল সেই চিঠিতে ????

- প্রিয় তিমির,
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো। হাজারো চিন্তায় মাথাটা ভারী হয়ে উঠেছে কদিন ধরেই। কিভাবে বলব ভেবে উঠতে পারছিলাম না। তাই চিঠি লেখা মনস্থির করলাম।................ প্রথম যেদিন তোমার প্রেমে পড়ি, মনে হয়েছিল জীবনটা একটা পালতোলা নৌকার মতো। আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউয়ে ভেসে বেড়াতে পারবো দুজনে। প্রথম এক দেড় বছর তেমনটাই কেটেছিল আমাদের। মনে পড়ে তোমার ? কখনো তোমার স্টেজ শো, কখনো আমাদের পুরী - দীঘা বা নিদেনপক্ষে নাইটশোয়ে সিনেমা দেখার উন্মাদনাটা একটা কালো ফেট্টির মতো লেগেছিলো আমাদের দুজনের চোখে। এর পরে পরেই টুবাই এলো পেটে আর আমাদের সাধের তরীটিও কেমন যেন ঝড়ের মুখে পড়লো জানো ! বাঁধভাঙা স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে হাল ধরার ক্ষমতা তোমার ছিল না। খুব কম সময়ের মধ্যে কোমর সমান জলেই হাবুডুবু খেতে লাগলাম দুজনে। সাঁতরে পাড় খোঁজার মতো যে কলজের জোরটা দরকার সেটার বড় অভাব দেখলাম তোমার মধ্যে। ফলে দিক্চক্রবালে গোল গোল হয়ে ঘুরতে লাগলাম দুজনেই।............. আমায় হয়তো তুমি স্বার্থপর বলবে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার নিঃশ্বাস নেওয়ার জানলা দরজাগুলো অজান্তেই সব বন্ধ হয়ে আসছিলো একটু একটু করে। দু কলম না লিখতে পাড়ার যন্ত্রনাটা হয়তো তোমায় মুখে বলে বোঝাতে পারবো না......... কতকটা জগদ্দল পাথরের নিচে প্রতিনিয়ত পিষে যাওয়ার মতো। প্রথম দিকে তুমি যদিও উৎসাহ দিয়েছিলে লেখালিখিটা চালিয়ে যাওয়ার, কিন্তু মা হবার পর টুবাই ছাড়া অন্য কোনো দিকে মন দিতে পারিনি। তবে এটুকু বুঝেছিলাম আমার শিল্প সত্ত্বার বিসর্জন আমি কখনোই মেনে নিতে পারবো না, তাই সংসারের স্বস্তি আমার জন্য নয়, সুতরাং মনোমালিন্যের প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় কখন যে তোমার আমার সম্পর্কের গ্রন্থিগুলো আলগা হয়ে গিয়েছে জানতেও পারিনি, হয়তো তুমিও পারোনি। স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছেটা দমে গিয়েছিলো অজান্তেই, আর এখন যখন সেই সুযোগটা এসেছে, পিছনে ফিরে না তাকানোর সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলাম অনিবার্যভাবেই। জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না কোনোদিন......তবু ....... আজ টুবাই বড় হয়েছে কিছুটা, তুমি চালিয়ে নিতে পারবে আশা করি। ইতি -.......

- যুথিকা !!!!!!!!

- যাক !! চিঠির বয়ানটা এখনো মনে আছে তাহলে !
- আপনি !!!!..........মানে তুমি......!!!!
- বাবার কাছে শুনেছিলাম মায়ের লেখালিখির হাতটা দারুন। তার ওপর উচ্চাকাঙ্খীও ছিলেন যথেষ্ট। সেটা অবশ্য দোষের নয় মোটেই। মাতৃধর্ম পালন করতেই হবে এমনটা যদিও লেখা নেই কোথাও, তবু কি জানেন তো, দুটো পায়ের একটা কাটা পড়লে সোজা হয়ে দাঁড়ানোটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। খুঁড়িয়ে চলার যন্ত্রনাটা আমার থেকে ভালো বোধহয় আর কেউ জানে না। প্রথমটায় কষ্ট হতো বেশ। কয়েকবছর যাবৎ এই অভিশাপটার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছি। এখন আর পথ চলতে অসুবিধে হয় না তেমন।..............তাহলে.........এবার বলুন........রসদ পেলেন কিছু ??? লিখবেন তো এই গল্পটা ??              
- সাগ্নিক....... মানে টুবাই তুই......  !!!!!

- নাহ ! ভুল আমি বুঝিনি আপনাকে মিসেস মিত্র........ঠিক ভুলের সংজ্ঞাটা আজ আর আমার কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাবা আমায় মানুষ চিনতে শিখিয়েছেন। উনুনের আঁচে যার হাত পুড়েছে সে কি আর কয়লার হিসেবে কষবে বলুন ? বরং যন্ত্রনাটা ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে রান্না চাপাবে। আপনাকে খুঁজে বের করেছিলাম দু চার কথা শোনানোর জন্য নয়, বরং জানানোর জন্য যে আমাদের ছোটো উনুনে দিব্যি ভাত সেদ্ধ হচ্ছে..............আপনি চলে যাওয়ার পর.............আজও.............এই গল্পটা লিখবেন আশা করি..........ভালো থাকবেন.........

-টুবাই  !! টুবাই !! যাস না !!........আমায় একটা সুযোগ.........

(অফলাইন)......(প্রোফাইল ডিলিট)  চ্যাটবক্স # ভোর ৪.০০ #  শুক্রবার 




#bengalishortstories #drama #sadstories