কয়েক বছর আগেকার কথা। সে ঘটনার কথা মনে পড়লেই এক আকাশ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই আজও। কতকটা মিঠে পাতা পানের মতো। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে গুলকান্দ এর মিষ্টি প্রলেপ পড়ে সারা জিভ জুড়ে, দোসর থাকে এলাচ, মৌরির এক্কা দোক্কা। চর্বিতচর্বনে হারিয়ে যাওয়ার ঈঙ্গিত থাকে স্পষ্ট। সেদিন অফিস থেকে গিয়েছিলাম সল্টলেক সেক্টর ফাইভের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। সামনে বেশ বড় একটা ইভেন্ট ছিল সেবার। ফলস্বরূপ একটি টেলিভিশন পার্টনারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিলো খুব স্বাভাবিক নিয়মেই। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো আমি, তাই নির্দ্বিধায় দায়ভারের হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দিয়েছিলুম বিনা বাক্যব্যয়ে। স্বীকার করতে বাধা নেই, সেদিন খুব বেশি প্যাঁচ পয়জার কষতে হয়নি। খুব মসৃন ভাবেই আমাদের প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে সে যাত্রা। ডিল ফাইনাল হওয়াতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ফিরে আসছিলাম অফিসের গাড়িতে। অকস্মাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল।
দক্ষিণ পশ্চিমের আকাশে তখন দুর্বার গতিতে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। ফুটন্ত কেটলির মুখ দিয়ে যেভাবে ভুড়ভুড়িয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে, ঠিক সেইরকম সরু, একফালি, ধূসর প্রান্তরেখা হয়ে ক্রমশ বিস্তৃতি ঘটিয়ে তার তমসাবৃত চাদরে যেন ঢেকে ফেলতে চাইছে চতুর্দিক। ভিজে হাওয়ার গন্ধরা তখন চাক ভাঙা মৌমাছির মতো রে রে করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শহর জুড়ে। সোঁদা মাটির ঘ্রানে চোখ ফেরাতে পারলাম না কিছুতেই। একদৃষ্টে দেখে যেতে লাগলাম আলো আঁধারির বেলাগাম দৌরাত্মি। শুধু মুখ ফুটে একবার বললাম, 'পঙ্কজ দা' !................... উত্তর এলো,
- হুমমম, দেখেছি, খুব জোর আসছে.......
- বেশ তো ! আসুক, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, তুমি আস্তেই চালাও, দেরি হলে কিচ্ছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
স্টিয়ারিঙে হাত রেখেই আড়চোখে আমায় দেখে নেয় পঙ্কজদা। চিবুকের হাড়ে মৃদু হাসি খেলে যায়। বুঝতে পারে বোধহয়, সময় অপচয়টা কতকটা ইচ্ছাকৃত। অবশ্য পঙ্কজদার পক্ষে সেটা বোঝাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বহূ নিকট - দূরের জার্নির একনিষ্ঠ ও ভরসাযোগ্য সঙ্গী ছিল সেসময়। শহরের একটু বা অনেকটা দূরের গল্প হলেই পারতপক্ষে আমরা পঙ্কজদা ছাড়া অন্য কাউকে নিতাম না সঙ্গে। সুতরাং আমার মতো দু একজন ডেপোঁ কলিগের সাথেই খুব সহজেই সখ্যতা গড়ে উঠতে বেশি দেরি হয়নি তার। এযাত্রাও সে সামনের কাঁচের দিকে স্থির ছাউনি দিয়ে বললো, 'বলছো ?' আমি সহাস্যে বলে উঠলাম, 'নিশ্চিন্তে'। মুখের হাসি তেমনি অটুট রেখে জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে এক রাউন্ড চা হলে মন্দ হয় না..... কি বলো' ? হাত নাড়িয়ে বললুম, 'কিছুমাত্র না'। 'বেশ তাহলে একটা স্পেশাল চায়ের দোকানে নিয়ে যাই তোমায়...... চলো', বলেই বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেয় বিদেশী যানের দিশি সারথি।
বাইপাসের চওড়া মেদহীন চিকন পথ ছেড়ে আমরা ঝপ করে এসে পড়লুম অপেক্ষাকৃত রুক্ষ পিচের রাস্তায়। জানলার দুপাশের চিত্রগুলো সিনেমার কাটশটের মতো বদলে যেতে লাগলো মুহুর্মুহু। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর চোখে পড়লো টালির চাল দেওয়া কাঁচামাটির ঘর, বাঁশ বাগান, খানকতক পুকুর, ডোবা, এধার ওধার থেকে ছুটে আসা মুরগির পাল, দেওয়ালের গায়ে যত্রতত্র ঘুঁটের নকশা কাটা প্যাটার্ন আর চোখ জুড়ানো সবুজের দিগন্ত বিস্তৃত আহ্লাদ। এক ঝটকায় শহরের মানচিত্রটা আমূল বদলে গিয়ে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো আদি বাংলার আটপেড়ে সহজিয়া উষ্ণতা। যেখানে গাঢ় রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে, কপালে এত্তবড় সূর্যের লাল মেখে কোনো এক গাঁয়ের বধূ অপেক্ষায় আছে শীতলপাটি বিছিয়ে। উঠোনে পা দিলেই গ্লাসে করে এগিয়ে দেবে কুঁজোর মিঠে নির্যাস, তালপাতার পাখায় এক নিমেষে মিলিয়ে যাবে দিনগুজরানের ঘামশরীর।
এদিকটায় আসিনি কখনো। শহরের বুকের মধ্যেই যে এমন একটুকরো লুকোনো জিয়নকাঠি খুঁজে পাবো এ আমার কল্পনাতীত। ফলে অপরিচিত রোদ্দুর হলেও পরিচিত মাটির টানটা দিব্যি গায়ে মেখে নিচ্ছিলাম ধুলোয় বালিতে। মেদিনীপুরে আমাদের আদি বাড়ির নিকোনো উঠোনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারেবার। একটা চায়ের দোকানের সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো পঙ্কজ দা। বলল, 'নামো'। কাঁচা রাস্তার ওপর নেমে দাঁড়ালাম। বাঁশের খুঁটির ওপর খড়ের চাল, দরমার খাঁচা, মাটির উনুন আর সামনে দু সারি ইঁটের ওপর একটা কাঠের তক্তা দিয়ে পরিপাটি বসার জায়গা করা পঙ্কজদার স্পেশাল চায়ের দোকান। দুটো চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসলাম। ততক্ষনে আকাশ বেয়ে এক দু ফোঁটা করে গায়ের ওপর পড়ছে অবিন্যস্ত রূপোলী গুঁড়ো। লক্ষ্য করলাম, কিছুটা দূরে একটা মাঠের ধারে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। একটা ছোট স্টেজ আর সামনে লাইন করে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে কিছু মানুষ বসেছে। মুখ ঘুরিয়ে দোকানের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'ওখানে কি হচ্ছে ভাই ?' এক বিশেষ ভঙ্গিমায় চায়ের ছাঁকনি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, 'ফানশন হচ্ছে ফানশন, ফি বচ্ছর হয় এখানে'। ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসের' ? চায়ের ভাঁড়গুলো হাতে ধরাতে ধরাতে বললো, 'বাইশে শ্রাবন। ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি আর গান করে'। .............. চমকে ওঠার সেই শুরু। এমন এক অজ পাড়াগাঁ যেখানে অভাবের চিত্রটা দুপুরের রোদের মতোই উজ্জ্বল ও চোখে পড়ার মতো সেখানে ম্যারাপ বেঁধে রবীন্দ্রচর্চা ! দুমুঠো ভাতের খোঁজে উদয়স্ত যাদের ক্ষেতের ওপর লাঙ্গল চষতে হয় তাদের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রস্তব করছে খরচ করে ! পরক্ষনেই ভাবলাম, নাকি, এরা বলেই করছে বা হয়তো এরাই করে থাকে। কি জানি ! আমাদের মতো শহুরে চাষিদের সময় কই ওতো ! ঘড়ির দামে সময় বিকোয় আমাদের। এরকম বেয়াড়া কিছু প্রশ্নের ভিড়ে চায়ের ভাঁড়ে আলগা চুমুক দিতে থাকি আর অপলক তাকিয়ে থাকি স্টেজের দিকটায়।
মাঠের বুক চিরে কানে ভেসে আসছে........ 'শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে.......পড়ুক ঝরে, তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে বুকের 'পরে'.......
ভারী মিষ্টি করে গাইছে। মনকেমন করে ওঠে ততক্ষণাৎ। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতে কেন জানিনা বড্ডো এমনটা হয়। কতকটা সবুজ ঘাসের মাঠ পেলেই যেমন সটান শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল দেখলেই যেমন হাত বোলাতে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমনটা, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোনোটাই করা হয়ে ওঠে না, ভিতরে ভিতরে শুধু ফুঁপিয়ে মরার যন্ত্রনাটা টের পাওয়া যায়। মনে হলো একছুটে পালিয়ে যাই ওখান থেকে। গিয়ে দাঁড়াই মেঠো পথের একেবারে শেষ চৌকাঠে যেখানে থাকবে না কোনো পিছুটানের বদভ্যাস, শুধু থাকবে প্রান্তজনের সাথে গুটিকতক আলাপী মুহূর্ত আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানোর অলস আধছটাক প্রেম..
ডান পাশে তাকিয়ে দেখলাম একজন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুচ্ছেন। হাড় জিরজিরে শীর্ণ চেহারা, খালি গা, পরনে সরু বাদামি পাড়ের ধুতি আর খালি পা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি..............খানিক্ষণ বাদে ভিজে গলায় নিজে থেকেই বলে উঠলেন, 'রবিঠাকুরের গান শুনলেই মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে গো বাপ....... সেই কত্ত ছোটবেলা বেলা থেকে শুনে আসচি, আজও ময়লা হয় নি গো, যেমনকার ঠিক তেমনি আছে'। এমন অকপট অনুভূতির ঝাপটায় বেশ অবাক হলাম। বললাম, 'আপনি বুঝি ওনার গান খুব ভালোবাসেন' ? ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলেন আমাকে কিঞ্চিৎ, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, 'ওনার গানের কথাতেই তো জীবনের সারমর্ম বাপ....... দিনযাপনের গুরুমন্তরটা তো উনিই দিয়ে গেছেন, ভালোবাসি বলে অচ্ছেদ্দ্যা করতে পারবো না গো, তার পায়ে মাথা কুটে মরতে পারলে তবে যে আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম '...............
চিত্রার্পিতের মতো বসে রইলুম। এমন কথা শুনিনি আগে.........ভালোবাসা অশ্রদ্ধা !! গুরুমন্ত্রই প্রাণের আধার !!......লোকটা বলে কি !! রবীন্দ্রশ্রদ্ধায় এমন সহজ, সরল, প্রাঞ্জল নিবেদন আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়লো না। শ্রাবনের সোঁদা মৌতাতে মনটা মাখামাখি হয়ে গেলো কেমন। বুকের মধ্যে আকুলিবিকুলি করতে লাগলো দিনযাপনের গুরুমন্তর, আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম......... নেশাগ্রস্তের মতো বসেছিলুম...........কতক্ষন জানিনা ..............বড় বড় ফোঁটায় শব্দের মেহফিল জমে উঠেছে ততক্ষনে,........ সম্বিৎ ফিরলো পঙ্কজদার কথায়, 'এবার চলো, আর বসে থাকা যাবে না, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে'। কোনো মতে টেনে তুললাম নিজেকে, যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে বারে বারে বৃদ্ধকে দেখছিলাম। এখনো ঠিক তেমনি ভাবে বসে আছেন। টলটলে শ্রাবনের জলে অশ্রু মিলেমিশে একাকার । গাড়ির দরজা বন্ধ করলাম। পঙ্কজদা চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল, এফ এম এ বাজতে শুরু করেছে .........
'শাওন বরষে.....তরসে দিল.......কিউঁ নাআআ নিকলে, ঘরসে দিল.......
বরখা মে ভি দিল পেয়াসা হ্যায়.....ইয়ে প্যায়ার নেহি তো ক্যায়া হ্যায়'..............
কি আশ্চর্য মিল ! শ্রাবন বোধহয় এমন করেই মিলিয়ে দিতে পারে......তাই না ?
চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত
ছোট করে বলে রাখা ভালো এই চিত্রটি শুধুমাত্রই গ্রাফিক্স নয় আমার কাছে,
এটি একটি আদ্যোপান্ত রচনা, যা অর্ণবের সৃজনে ও কল্পনায় প্রাণ পেয়েছে।
![]() |
| চিত্রবিন্যাস : অর্ণব দাশগুপ্ত |
#bengaliarticles #rabindranathtagore #tributetorabindranathtagore #tribute















