Friday, December 29, 2023

মন-মেহুলী


একটুকরো মেঘই বটে। সার্থক নামকরণ এই খামারবাড়িটার। একটা ছায়াঘেরা গ্রাম, আঁকাবাঁকা মাটির পথ, চোখ জুড়ানো ধানের ক্ষেত আর একটা টলটলে সায়র, এই সবটা মিলিয়ে 'মেহুলী'। বীরভূম জেলায় ইলামবাজার আর বোলপুরের মাঝামাঝি একটা প্রত্যন্ত গ্রাম কামারপাড়া। এই কামারপাড়ার শেষ প্রান্তে মেহুলী অপেক্ষায় থাকে পর্যটকদের। 

সপ্তাহান্তের ভ্রমণের জন্য মেহুলী একেবারে নিখুঁত স্পট। বর্ধমান - গুসকরা - বোলপুর ছুঁয়ে আমরা যখন কামারপাড়া পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল। ছোট্ট লোহার গেট খুলে যখন সামনের বাগানটায় পা রাখতেই মন জুড়িয়ে গেলো এক লহমায়। মাথার ওপর নানান রকমের গাছ, পাখিদের ঘরে ফেরার গান আর "গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথের" মনকেমন করা গন্ধ, মনে হল এই জায়গাটার অপেক্ষাতেই ছিলুম যেন কতকাল। মাটির ওপরে সারি দিয়ে সাজানো স্ল্যাব পেরিয়ে যখন বারান্দায় উপস্থিত হলাম তখন খিদে পেয়েছে সাংঘাতিক। বারান্দাতেই পরিপাটি করে খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মুরগির ঝোল - অমৃতও বোধহয় এতো সুস্বাদু হয় না, তার ছাপ আমাদের চোখে মুখে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। 

লাগেজ রেখে একটা অটো বুক করে আমরা সোজা রওনা দিয়েছিলুম সোনাঝুড়ির হাটে। সেখান থেকে খানিক কেনাকাটা করে যখন ফিরলাম ততক্ষনে সূর্য অস্ত গেছে। নির্মেঘ আকাশটা তখন কালো চাদরে মুখ ঢেকেছে, অসংখ্য নক্ষত্রের আলো আর ঝিঁঝি পোকার শব্দে চারপাশটা ভেসে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে রাতের বাগানটাতেই পায়চারি করলাম খানিক, ঠান্ডা খানিক জোরালো হওয়ায় ঘরের ভেতর ঢুকেছিলাম। 

বেশ খানিক্ষন আড্ডা মারার পর রাতের খাবারের সময় হল। প্রায়ান্ধকার বারান্দায় আর লণ্ঠনের টিমটিমে আলোয় যে পরিবেশটা তৈরী হয়েছিল তাতে করে তাতে করে যেকোনো বাংলা ছবির পরিচালককে দৃশ্য পরিকল্পনায় খুব বেশি খাটতে হবে না। আমাদের মনে হয়েছিল ঠান্ডাটা না থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় এখানে। 

 

পরদিন ঘুম ভাঙলো টিয়াপাখির আওয়াজে। আগের থেকে খেজুরের রসের কথা বলা ছিল। ভোর পাঁচটায় যখন কাচের গ্লাসে চুমুক দিলাম তখন মনে হল স্বর্গ শুধু কাশ্মীরে নয় এই পশ্চিমবঙ্গেও আছে। প্রায় দু গ্লাস খাওয়ার পর উত্তর দিকের সায়রটার দিকে এগিয়ে গেলাম। জলের ঠিক মাঝামাঝি খানিক কুয়াশা আর চারপাশটা আলো হয়ে আছে। পুরো সায়রটা একচক্কর দিয়ে আসতে আমাদের প্রায় আধঘন্টা সময় লেগেছিল। 

দিনের সময়টা শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় কাটিয়ে সন্ধ্যের দিকে ফিরে এলাম আবার মেহুলীর স্নিগ্ধতায়। এমন মনকাড়া, পরিপাটি, যত্নের ছাপ আর কোনো হোমস্টেতে পাবেন কিনা জানা নেই। আমরা দুরাত্রি - তিনদিন কাটিয়ে অপার ভালোলাগা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম কলকাতায়। 

ধন্যবাদ প্রাপ্য মেহুলীর শ্বেতাদির , যাঁর জন্য এই ট্যুরটা সম্ভব হল, আর অবশ্যই আমাদের বন্ধু সৌম্য আর সুস্মিতার যারা এই ঠিকানার খোঁজ দিয়েছিল। 


এই জায়গায় যেতে হলে আপনি গাড়ি নিয়ে বর্ধমান - গুসকরা - বোলপুর ছুঁয়ে আসতে পারেন আবার ইলামবাজার হয়েও ঢুকতে পারেন। ট্রেনে আসতে গেলে আপনাকে বোলপুর স্টেশন নামতে হবে। স্টেশন থেকে অটো বা টোটো করে নিতে পারেন কামারপাড়া অবধি। বাকিটা মিনিটখানেক। কামারপাড়াতে থেকে আপনি অনায়েসেই বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে পারেন - বোলপুর-শান্তিনিকেতন, খোয়াই, ইলামবাজারের জঙ্গল ইত্যাদি। 

হলপ করে বলতে পারি, ছোট্ট উইকেন্ড ট্রিপের জন্য মেহুলীর বিকল্প খুব কমই আছে, বিশেষ করে শীতকালে।