Saturday, November 11, 2023

হৃদয়ের নাম তিনচুলে-পাবং-সিটং

ছবি : চারখোলের পাহাড় থেকে 

কলকাতার ক্যাকোফোনি কাটিয়ে এক হপ্তা যেখান থেকে ঘুরে এলাম সেখান থেকে ফিরতে মন চায়নি একটুও। পাহাড়ের খাঁজে আটকে থাকা ছবির মতো কতগুলো গ্রাম, যেখানে গেলেই মনের আনাচে কানাচে জমে থাকা মেঘগুলো সরে গিয়ে ঝকঝকে আকাশ বেরিয়ে পড়ে। ধমনীর মধ্যে দিয়ে তিরতির করে বয়ে যায় তিস্তা আর নাকে আসে ঝাউ আর পাইনের ঘ্রাণ।  

তিনচুলে

প্রায় ৬ হাজার ফিট উঁচুতে আর দার্জিলিয়ের কাছেই যে গ্রামটা তার নামের কারণটা ভারী মজার।তিনচুলে কথাটা এসেছে  "তিন" আর চুলে হল "চুলা" বা "উনুন" থেকে । তিনটি পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলে কতকটা উনুনের মত দেখতে লাগে জায়গাটা, তাই এই গ্রামের নাম তিনচুলে। আমরা ছিলাম রুমি হোমস্টেতে যার বারান্দা থেকে পূর্ব দিকের রোদটা ঝপাং করে এসে মুখে চোখে খানিক উষ্ণতা মাখিয়ে  দিয়ে যেত। চোখের সামনে পাহাড়ের গা ছুঁয়ে নামতে থাকা কুয়াশার শিফন ক্রমশ মিশত আঁকাবাঁকা তিস্তার পাড়ে। আর ঠিক পিছন দিকটা, যেখানে পাহাড় ঘেড়া ঝাউয়ের জঙ্গল সেখান থেকে একটা ঝোড়া নেমে আসে যার জলের মিঠে আওয়াজটুকু ছাড়া আর কোনো শব্দই পাওয়া যাওয়া যায় না কোথাও। হ্যাঁ সেটা সকালবেলাতেই..... এতটাই নিস্তব্ধ তিনচুলে। 

ছবি : তিনচুলের হোমস্টের বারান্দা থেকে 

তিনচুলের বারান্দায় সকালের রোদটা পুইয়ে আমরা চলে গিয়েছিলাম লেপচাজগৎ। ঘুম আর সুখিয়াপোখরির রাস্তা দিয়ে এলে খানিকটা সুবিধে হয়। প্রায় ৭ হাজার ফিট উচ্চতায় লেপচাজগৎ -এর জঙ্গল, যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল মেঘ ফুঁড়ে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার অহংকার। এখান থেকে আধঘন্টার রাস্তা - লামাহাট্টা। সেখানে যতদূর চোখ যাবে দেখতে পাওয়া যাবে তীক্ষ্ণ বর্শার মতো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন আর ঝাউ এর জঙ্গল। মনে হবে অতন্দ্র প্রহরীর মতো এরা যেন আগলে রেখেছে জায়গাটা।

পাবং 

দু রাত কাটিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম পাবং এর পথে। তিনচুলে থেকে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পথ। কালিম্পঙ এর পাহাড় ঘেরা হাতের তালুর মাপের একটা গ্রাম - পাবং। তবে সে গ্রাম আপনাকে জড়িয়ে ফেলবে আষ্টেপৃষ্ঠে, তার সমস্ত শান্তি, নিষ্পাপ সরলতা নিয়ে, আর চোখের সামনে দুহাত উপুড় করে মেলে ধরবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার অলস অবকাশ। 

ছবি : পাবং-এর হোমস্টে  থেকে  

এখান থেকে কয়েক মিনিটের পথ চারখোলে, যার নামের অর্থ - "চারদিক খোলা"। পাহাড়ের একেবারে ওপর থেকে দেখতে পাওয়া যাবে কালিম্পঙের গোটা উপত্যকাটাই। এখানে হেলায় পড়ে থাকা পাহাড়ি ফুলের রং-এ মন চাঙ্গা হয়ে যায় অচিরেই। 

সন্ধ্যে নামলে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো জ্বলে উঠত কালিম্পঙ। হোমস্টের সামনের উঠোনটায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আর আমরা দু চোখ ভোরে দেখে নিতাম। এখান থেকে লাভা, লোলেগাঁও বা রিশপ যাওয়া যেতে পারে অনায়াসেই।

সিটং 

পাবং-এও দু রাত কাটিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম সিটং এর উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে মংপু ঘুরে গিয়েছিলাম। ভারী সুন্দর জায়গা। রবীন্দ্র ভবনে খানিক সময় কাটিয়ে তারপর সিটং পৌঁছেছিলাম। তবে এখানে একটা নয়, কয়েকটা গ্রাম নিয়ে সিটং জায়গাটা। পাবং থেকে বেশ খানিকটা নিচুতে, কার্শিয়াং এলাকায় নয়নাভিরাম সিটংএর উপত্যকা ভীষণ মন টানে। এখানে দু হাত অন্তর হোমস্টে, সুতরাং বুকিংয়ের বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই। কমলালেবুর বাগানের জন্য সিটং বিখ্যাত। সারি দেওয়া কমলালেবুর গাছ দেখে তাক লেগে গিয়েছিলো আমাদের। শয়ে শয়ে কমলালেবু ঝুলছে একেবারে হাতের নাগালের মধ্যেই। পেড়ে খেয়েও ছিলাম দু একটা, পাকার সময় হয়নি বলে বেশ টক ছিল। 

ছবি : সিটং এর পথে 

এক রাত কাটিয়ে, সিটংএর উপত্যকা ছেড়ে যখন নেমে আসছিলাম, তখন রাস্তার দুপাশে সারি দেওয়া ঝাউ, শাল, সেগুন, সিঙ্কোনার জঙ্গলে দু চোখ জুড়িয়ে গেছিল। রং বেরঙের ফুলের গাছ, অজস্র ফার্ন ও কত নাম না জানা গাছ নুয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর। সেসব পেছনে ফেলে সেবকের রাস্তা ধরতেই অজান্তেই মনের কোণে মেঘ জমছিল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে যখন পিছন ফিরে তাকালাম, দূরের পাহাড়ে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। 

ট্রেনের হুইসেল কানে কানে বলে গেল - "সুযোগ হলে আবার কখনো......."

পাহাড় এড়ানো সাংঘাতিক কঠিন যে ......