Thursday, April 8, 2021

ভাষার জুলুম

সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক উৎসবে প্রত্যাশা মতোই মানুষের প্রাতঃরাশের থালায় এখন রাজনীতির নানান পদ। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে গড়ে ওঠা বড়, ছোট, মাঝারি সমস্ত দল অন্যদিকে ধর্মীয় রাজনীতির আবহে বেড়ে ওঠা এক সর্বভারতীয় পার্টি। 

রাজনীতির গনগনে আঁচ যখন বাংলার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক সেই সময় কোনো এক অজ্ঞাতকারণে একটি সরকারি নির্দেশনামা নেমে এল এমন এক জায়গায় যা বৈজ্ঞানিক গবেষণার শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ২৪শে মার্চ ২০২১ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দা কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠানে প্রায় সমস্ত পর্যায়ে হিন্দি ভাষাতেই লেখালিখি করতে হবে। ৫৫% চিঠিপত্র হিন্দিতে লিখতে হবে (সে মানুষ হিন্দি জানুন বা নাই জানুন, কিচ্ছু এসে যায় না) এবং হিন্দিতে লেখা চিঠির জবাব দিতে হবে হিন্দিতেই। ফাইলে প্রথম নাম লিখতে হবে হিন্দিতে, পরে ইংরেজিতে। সার্ভিস বুকও যথাসম্ভব হিন্দিতে লিখতে হবে, প্রয়োজনে ফাইলে স্বাক্ষরও করতে হবে হিন্দিতে। এখানেই শেষ নয়, এই হিন্দি ভাষার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তার নিয়মিত নজরদারি করা হবে এবং এই অত্যাশ্চর্য নিয়মের অন্যথা হলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, এমনটাই বলা আছে। 

আতঙ্কের ব্যাপার হল এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, ছাত্র, গবেষক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মীদের প্রায় ৯০ শতাংশই বাঙালি যাদের মধ্যে এহেন নির্দেশিকায় যুগপৎ বিস্ময় ও বিতর্ক ছড়িয়েছে। এই সাংঘাতিক কর্মকাণ্ডের অর্থ হল বাঙালি যদি না শোনে তাহলে বাঙালির কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে জোর করে  হিন্দিতে লেখাতে হবে এবং তেমন প্রয়োজন হলে পরবর্তী সময়ে জোর করে বলাতেও হবে।  

স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যিক ও শিক্ষিত মহলে এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ উঠে এসেছে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্তকে 'ভাষা-সন্ত্রাস' নামে আখ্যা দিয়েছেন এবং বিখ্যাত বাঙালি অধ্যাপক সুগত বসু এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছেন এমন নির্দেশ বিজ্ঞান চর্চার অন্তরায় এবং বাংলার জন্য মর্যাদাহানিকর। 

বাংলা ও বাঙালির সম্মানে এমন খড়্গাঘাত অবশ্য এখানেই থেমে থাকছ না। গত ১৩ই ডিসেম্বর ২০২০-তে আনন্দাবাজার পত্রিকায় আরেকটি প্রতিবেদনে বেরিয়েছিল যে সাংসদ সুব্রহ্মন্য়ম স্বামী ভারতের জাতীয় সংগীত জনগণমন-র পরিবর্তন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সে চিঠির দ্রুত সাড়াও পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আন্দাজ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না যে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে আপাতত এই প্রস্তাবটি স্থগিত রাখা আছে, তবে ভোট মিটলেই সে প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। 

এসবের পরে খুব সঙ্গত কয়েকটা প্রশ্ন উঠছে - আমরা কি অজান্তেই বড্ড বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি কতিপয় নেতা নেত্রীদের যার ফল ভুগতে হচ্ছে আমাদেরই ? নাকি বাংলার মানুষকে নির্বোধ ও দুর্বল ভাবছেন কিছু শ্রেণীর মানুষ ? তাই যদি হয় তাহলে যারা বাংলা ভাষাটাকে খাটো করে, জোর করে অন্য ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইছেন তাদের জেনে রাখা ভালো যে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ বা বিপ্লব, এসবের কোনো কিছু গড়ে উঠতে সময় লাগে না এই পুণ্য বঙ্গভূমিতে.... ইতিহাস জানে সে কথা.....