Friday, April 3, 2020

বসন্ত আটকে গেছে

এই আশ্চর্য দুনিয়ায় নানান জিনিস দেখার আছে। তবে চোখ বুজে যে সব জিনিস দেখতে পাই তাদের মধ্যে অন্যতম হল স্বপ্ন। সে স্বপ্ন নীল আকাশে বকের ডানায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়াক বা অন্ধ গলির বাঁকে হুমড়ি খেয়ে পড়ুক, স্বপ্ন দেখতে আমার বরাবরই দিব্যি লাগে।  

তবে কিনা আমি শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী, ল্যাদখোর বাঙালি। নিত্যদিনের অফিস আর সংসারের আওতায় নিজের জীবনটাকে আচ্ছা করে গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলেছি। এর থেকে বেশি লংজাম্প দিয়ে হনুমানের মতো গন্ধমাদন বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়, বা হলেও তেমন কোনো ইচ্ছে মনের মধ্যে পোষণ করি না। সারা সপ্তাহ নানান চাপের জোয়াল কাঁধে বয়ে রোববারের বারবেলাটুকু কচি পাঁঠার লাল লাল ঝোলের তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারলেই নিশ্চিন্তি, অর্ধেকের বেশি যুদ্ধ আমার ওখানেই জেতা হয়ে যায়। এর ওপর রয়েছে সিনেমা, শপিং মল, রেস্তোঁরা ও বছরে একবার পারিবারিক ভ্রমণের অব্যক্ত উত্তেজনা। তার ওপর যদি প্রসংশার মালা গলায় ঝোলে তাহলে তো চোখের জল মাপতে চিবুকের নিচে বাটি ধরতে হয় আমাকে ।

কিছু কিছু স্বপ্ন আমার যেমন আওতার মধ্যেই থাকে। এই ধরুন বন্ধু জুটিয়ে দুম করে বেপাত্তা হয়ে যথেচ্ছ বেলেল্লাপনা করে ফিরে আসা অথবা চিলেকোঠার ঘরে চুপচাপ নির্বিবাদ ল্যাদ খেতে খেতে বই পড়া বা খানিক লেখালিখি করা ইত্যাদি। যদিও এসব ক্ষেত্রে সাফল্যের হার নিচের দিকেই থাকে, তবু এ সমস্ত স্বপ্ন দেখতে আমি বিন্দুমাত্র কসুর করি না, কারণ ওটুকুতেই আমার স্বর্গলাভ হয়।
 
বরং সেই সমস্ত স্বপ্ন আমি দেখিই না যেগুলো আমার আওতার বাইরে। এই যেমন মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আমাদের জীবনে রে রে করে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল করোনাভাইরাস নামক একধরণের সাইক্লোন যা আমাদের সমস্ত হিসেবের খাতা এক নিমেষে ওলোট পালট করে দিশেহারা করে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চব্বিশ ঘন্টার জনতা কার্ফ্যু, তার পরেই ৩১শে মার্চ অবধি ট্রেন-মেট্রোর বন্ধ ঘোষণা আর তার দুদিন কাটতে না কাটতেই একেবারে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন।

চোখ মুখ একযোগে ঝাপসা হয়ে গেল আমার। প্রথমটায় খানিক থম মেরে গেলেও ধীরে ধীরে প্রাথমিক শকটা কাটিয়ে উঠে এই সময় ঠিক কি করা প্রয়োজন তার একটা লিস্ট আমি মনে মনেই বানিয়ে ফেলে ছিলাম। সঙ্গে আগামী ২১ দিন কি কি অসুবিধে হতে পারে আর কেমন করে সেগুলো ডজ করে বেরোতে হবে এটাও ভাবতে আমার দু মিনিটের বেশি সময় লাগে নি।

আমি নিশ্চিত, এসময় অনেকেই হয়ত আমার মতো চিমটি কেটে দেখেছেন নিজেদের, এই ভেবে, যে স্বপ্নটা কি বেশি দেখা হয়ে গেল নাকি ? কাল রাতে ভুল করে কিছু খেয়ে ফেলিনি তো বাপ্ ! ভিতরে ভিতরে অনেকেই নির্ঘাত ভেবেছেন - ২১ দিনের অপরিমিত ল্যাদ ! মাইরি ! ঠিক শুনছি তো ?

টানা বেশ ক'দিন রুটি আর পানসে তরকারি খাওয়ার পর হঠাৎ করে যদি গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি পাতে পড়ে, তখন মুখ চোখের ওপর যেমন চরম উল্লাসের মানচিত্র ফুটে ওঠে এ খবর শোনার পর আমারও প্রাণটা চড়াই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে শরীর থেকে বেরিয়ে সারা ঘর নেচে কুদে আবার বুকের মধ্যে সেঁধিয়েছিল। যতটা পেরেছি মুখ চোখ ভাবলেশহীন রেখেছিলুম। কি জানি, বেশি আমোদ করলে আবার লোকে বলবে,কেমন মানুষ তুমি বাছা ? সারা দেশে যুদ্ধ লেগেছে, লোকজন মরতে বসেছে , মানুষের চাকরি থাকবে কিনা ঠিক নেই, খাবার পাব কিনা জানা নেই আর তুমি ল্যাদ খাবে বলে তার সুখটানের খুসবু ছড়াচ্ছ চাদ্দিকে !

আহ, সে চিন্তা কি আর আমার নেই বলে ভাবছেন ? আছে গো কত্তা আছে, বরং আমার এবং আমার মতো আরও অনেকেরই আছে। চাকরি পেতে আর সেইটা ধরে রাখতে কি কি করতে হয় সে আর আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে ! আর খাবার ? সে তো সরকার বন্দোবস্ত করছে । সুতরাং সারা সপ্তাহ পাহাড়প্রমাণ চাষের পর ওটুকু ল্যাদের স্বপ্ন বলদও দেখে থাকে, আমরা তো কোন ছার !

যাগ্গে যাক, যে কথা হচ্ছিল.............তো সময়মতো লকডাউন হল। আর আমার মনের মধ্যে অযাচিত ভাবেই 'দোলে মন দোলে, অকারণ হরষে…' এর মতো অবস্থা হতে লাগল।

এই গোটা সিজনে আমার ক্যালকুলেশনে চরম ভুলটা ওইখানেই হল। ওয়ার্ক ফ্রম হোম ডিক্লেয়ার ছিল আগে থেকেই আর তার সাথে ছিল শেষ না হওয়া কাজের লিস্ট। তাই সকাল বিকেল কতকটা নারায়ণের মতো আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপের সামনে ধ্যানগম্ভীর মুখ করে কাজ করলাম। কাজের সময়টুকু শেষ হবার পর পরই লাগামছাড়া গরুর মতো সারা বাড়ি পায়চারি করে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলাম, ভাবটা এমন যে কি কি কাজ বাকি আছে দেখে নিই, সেগুলো এই লকডাউনেই সরে ফেলতে হবে। এছাড়া অতি উৎসাহে ঝাড়পোঁছ, আনাজ কেটে দেওয়া, বাজার করা, গাছে জল দেওয়া, কাপড় শুকোতে দেওয়া আবার নামিয়ে আনা ইত্যাদি বিবিধ গৃহস্থালি কাজে একেবারে পারদর্শী হয়ে উঠলাম।  

তবে বেশ কদিন কেটে যাওয়ার পর আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে যাওয়ার মতো চেতনার উন্মেষ ঘটল যেন। মনে হল,বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে চরে বেড়ানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমন করে বসন্ত এল কই ????? অর্থাৎ কিনা যে প্রলম্বিত অবসরের কথা ভেবে মনে মনে উত্তেজনার আঁচ পোহাচ্ছিলুম সেতো দুদিন না যেতে যেতেই ফুস করে নিভে গেল। 

উপরন্তু কাজের পরিমান দ্বিগুন হল......তার কারণ কাজের ও রান্নার মাসিরা আগের থেকেই আসব না বলে পেন্নাম ঠুকে রেখেছেন। মধ্যিখান থেকে আমি বলির পাঁঠা হয়ে খামোখাই দিন রাত জবাই হতে লাগলুম। বাড়ির গিন্নি তিন বেলা রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতে লাগলেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই যাবতীয় ঠিকে কাজটা আমারই ঘাড়ে এসে পড়ার যোগাড় হল। অতএব যে কাজটা 'বোনাস দিলুম' বলে এক দু'বার করে দিয়েছিলুম সে কাজটাই যেন প্রত্যেকদিন গলার ফাঁস হয়ে চেপে বসতে লাগল। তার ওপর সন্তান ছোট এবং স্কুল যেহেতু ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ, সেক্ষেত্রে তারও অর্দ্ধেক দায়িত্ত্ব এসে পড়ল এই শর্মারই কাঁধে, বোঝো ঠ্যালা ! এ যে ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার হয়ে গেল……!  মাইরি বলছি, এমন বসন্ত চেয়েছি বলে তো মনে করতে পারছি না। 

বাড়ি ফিরে অনেক সময়ই বলতাম ‘আজ ব্যাপক স্ট্রেস গেছে, একটু চা করে দিও প্লিজ’। মুশকিলটা হচ্ছে এই বাজারে কোথা থেকে ফিরব আর কাকেই বা বলব ! অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের থেকেই চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিতে হয়েছে। তাতে অবশ্য মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হচ্ছে না, বরং তেমন দেখতে গেলে বলা যায় প্রেম খানিকটা বাড়ছে বইকি…….. এইটাই বা কম কি! তবে ঝামেলাও যে হচ্ছে না তাই বা বলি কি করে....ঘরের বাসন কোসন একত্রে পাশাপাশি রয়েছে অথচ ঝনঝন করে শব্দ হবে না এমন অলীক কল্পনা আমি করি না। এই করেই চলছে....... সাথে গুরুমন্ত্রের মতো কাঁসর বাজানো আর লাইট জ্বালানো তো আছেই......

আমার বিশ্বাস অনেকেরই বাড়িতে একই ঘটনা ঘটছে। যারা ভাগ্যবান এবং এসব তুচ্ছ জিনিসের উর্দ্ধে তাঁদেরকে আমার প্রণাম কিন্তু যাঁরা আমার মতো অন্য বসন্তের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা আপাতত ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রেমটাই ভালো করে করতে থাকুন, আর কি করবেন ? কিছু কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থাকুক নাহয়।

পুনশ্চ : এরই মধ্যে যাঁরা আপৎকালীন পরিষেবার জন্য দিনরাত এক করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁদের জন্য আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বস্তুত আপনাদের জন্যই এযাত্রা টিকে যাব বোধহয়। 



#bengaliarticle #molat #coronavirus #COVID19 #debdattasinha