কতটা মরিয়া হলে মানুষ এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে সেদিন আমাদের দেখলে খানিকটা হলেও
প্রথমটায় কটেজ বুক করা ছিল। দেখার পর নাপসন্দ করে আমরা সোজা একটা ডিলাক্স রুম ভাড়া
#bengalitravelblog #traveldiaries #Molat #debdattasinha #bengaliarticle #bengalweekendtour #travelstories
![]() |
| ছবি : সৌম্য |
বোঝা যেত বোধহয়। বাইক নিয়ে শেষ বেরিয়েছিলাম সেই গত বছর। তারপর যাচ্ছি যাব করে দুটো গ্রীষ্ম, দুটো বর্ষা আর একটা শীত পেরিয়ে গেলেও কিছুতেই ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে পারিনি দুজনে। বাইরে না বেরোতে পারার গুমোট ভাবটা ততদিনে কয়লার ধোঁয়ার মতো লতিয়ে উঠেছে। অবশেষে, 'নিকুচি করেছে ! যা থাকে কপালে' বলে দুম করে বানিয়ে ফেললাম একেবারে দুদিন-এক রাত কাটানোর মতো একটা চরমতম প্ল্যান। নাহ, ফ্যামিলি নিয়ে নয়, বরং লাগামছাড়া বাউলের মতো স্বাধীনভাবে কাটানো কয়েক মুহূর্তের অবকাশ যাপন।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাড়িতে সমস্তটা গুছিয়ে বলার আগেই গুগল ঘেঁটে ফলতার হোটেল সি-বার্ড ইন্টারন্যাশনাল বুক করা হয়ে গেল। এ যেন কতকটা সেই স্কুলের পিকনিকে যাওয়ার মতো। বাস তো বুক করা হয়ে গিয়েছে, এখন তো আর না বলার উপায় নেই।
"কি আশ্চর্য ! বুক করে ফেললে ! কোথায় হোটেল ? কি ব্যাপার ? সঙ্গে আমরা গেলেও তো হত ! দিনের দিনে কি ফেরা যেত না" ? এমন ধারার নানাবিধ প্রশ্নকে মেসির মতো ডজ করে কাটিয়ে বেরিয়ে গেলুম দুজনেই। কারণ আগেই বলেছি মরিয়া হলে মানুষ যা ইচ্ছে করতে পারে। অতএব সক্কাল সক্কাল বাইকে তেল ভরে নিয়েই ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে দে চম্পট।
![]() |
| ছবি : নিজস্ব |
মাঝে শুধু একবার মাত্র দাঁড়িয়েছিলাম। আমতলা পেরিয়ে সরিষাহাট মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে দু তিন কিলোমিটারের মাথায় একটা স্বামীনারায়ণের মন্দির পড়ে। সে এক দেখার মতো স্থাপত্য। পোড়ামাটির রঙে সে আশ্চর্য শিল্প অজান্তেই মনের মধ্যে সম্ভ্রম জাগায়। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আবার দৌড়।
অর্জুন, শাল, টিক, মেহগনি আর সেগুন গাছের ছায়ায় ততক্ষনে আমাদের শহুরে ক্লান্তি খসে পড়েছে শরীর থেকে। রাস্তার দু দিকে ঘাড় ঘোরালে অজস্র সবুজের কোলাজে চোখে নেমে আসছে পরম শান্তি। দূর আকাশে ধূসর মেঘের ছবি আঁকা হয়ে চলেছে রাস্তার ওপরেই, বাইকের চাকা সে ছবি ছুঁয়ে ছুটে চলেছে অদম্য, অজানা আকর্ষণে।
প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর নৈনান মোড় থেকে বাঁদিক ঘুরে সটান উপস্থিত হলাম হোটেলের সামনে। আশেপাশে আরও দু একটা হোটেল আছে বটে তবে আমাদেরটা গঙ্গার একেবারে লাগোয়া। এমনিতে জনবসতি শূন্য এলাকা তবে দু একটা ইন্ডাস্ট্রি থাকার ফলে রাস্তার ওপর কখনো কখনো মানুষের দেখা মেলে। অবশ্য আমাদের তাতে কিছু আসে যায়নি। বেলেল্লাপনা করাটাই যাদের লক্ষ্য তাদের কাছে চড়াই পাখিও যা, চিংড়ি মাছও তা।
প্রথমটায় কটেজ বুক করা ছিল। দেখার পর নাপসন্দ করে আমরা সোজা একটা ডিলাক্স রুম ভাড়া
![]() |
| ছবি : হোটেল সি বার্ড |
নিই, ডাবল বেডরুমের ভাড়াতেই। ম্যানেজার কি কারণে সদয় হয়েছিল জানা নেই। বোধহয় ভেবেছিল, আহারে ! অত দূর থেকে দুটো বাঁধা গরু ছাড়া পেয়ে এসেছে, ওদের খানিক শান্তি না দিলে নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হতে পারে। সে যাইহোক, চটপট লাগেজপত্র রেখে তোয়ালে নিয়ে চলে গেলুম সুইমিংপুলের ধারে। কোমর সমান জল, তাতেই কৈ মাছের মতো এমাথা ওমাথা সাঁতার কেটে নিল সৌম্য। আমার বরাবরই ডুবে যাবার ভয়, তাই আধা ডুবন্ত - আধা ভেসে থাকা অবস্থায় সুইমিং পুলের পার ধরে হেঁটে চলে বেড়ানোটাই নিরাপদ বলে মনে হল । যেদিকটায় জল বেশি, অর্থাৎ আমার গলা পর্যন্ত ডুবছে সেদিকটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলাম। সৌম্য যদিও আমাকে সাঁতার শেখাবে বলে জানপ্রাণ লাগিয়ে দিয়েছিল, তবু কাতলা মাছের মতো ঝটাপটি করা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছুই হয়ে উঠল না সে যাত্রা।
ঘন্টাখানেক পর সুইমিংপুলের মায়া ত্যাগ করে ঘরে এসে চেঞ্জ করে ডাইনিং হলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মিনিট পাঁচেক বাদেই চলে এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, এক চামচ ঘি, সোনামুগের ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, চাটনি আর পাঁপড়। খিদের চোটে সেসব কর্পূরের মতো উবে গেল দেখতে দেখতে। আয়েশের ঢেকুর তুলে মৌরি চিবোতে চিবোতে ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটে ছোঁব কি ছোঁব না করছে।
রিমোট নিয়ে এদিক ওদিক চেক করতে করতে দেখলাম কোনো একটা মুভ্যি চ্যানেলে 'লাডলা' চলছে, সবে শুরু হয়েছে। নব্বই দশকের অনিল কাপুর - শ্রীদেবীর দুরন্ত হিট ছবি। প্রত্যেকটা গান আমাদের মুখস্ত ছিল। মনে পড়ল স্কুলে এক সময় টেবিল বাজিয়ে এই ছবির কত গান করেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে ছবিটা দেখতে শুরু করে দিলাম দুজনেই। যেন এতো দূরে এসেছি দুপুরবেলা লাঞ্চ করে 'লাডলা' দেখব বলে। এক একটা সিন্ চলছে আর আমরা নিজেরাই ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছি। আবার ভেবে অবাকও হচ্ছি যে সিন্ পর্যন্ত মুখস্ত আছে আমাদের, এখনও......
দুপুর গড়িয়ে, বিকেল পেরিয়ে কখন সন্ধ্যে নেমেছে আমাদের খেয়াল ছিল না। সিনেমা শেষ হতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরেটা ধূসর হয়ে এসেছে। হোটেলের বাইরে গঙ্গার পারে বসে চা খাব বলে ঠিক করলাম। দু মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে গঙ্গার পারে এসে দেখলাম একটা ঢাউস স্টিমার নদীর একেবারে মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে জিরোচ্ছে বলে মনে হল। হলদিয়ার বন্দরটা সীমান্তের শেষে আবছায়া দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপরে টিমটিমে আলোয় একটা চায়ের দোকানে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। তার সোঁদা গন্ধ কুণ্ডলী পাকিয়ে নদী পেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। দোকানের পাশেই ভূত বাংলোর মতো একটা সাদা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। অন্ধকারে কয়েক বছরের জীর্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। বেশ একটা গা ছমছমে মায়াবী পরিবেশ। বেশি দূর এগোলাম না আর আমরা। একটা শান বাঁধানো ধাপিতে বসে খানিক গুলতানি করে আবার পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
ফিরে এসে আবার আরেক রাউন্ড সিনেমা। যেন সিনেমা দেখাই মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের। অবশ্য বিনা বাধায় বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পাওয়া অনেকটা লটারি পাওয়ার মতোই। যাঁরা বিবাহিত তাঁরা নিশ্চই সহমত হবেন আমার সঙ্গে। আপনার পছন্দের সেরা ছবিটা টিভিতে চলছে, আর আপনি নিশ্চিন্তে বসে মৌজ করে সেটা গিলছেন, এমনটা আপনার কপালে যদি জুটে থাকে তাহলে আপনি যথেষ্ট ঈর্ষার পাত্র। খানিক সিনেমা দেখে আর বেশ খানিকটা আড্ডা মেরে আমাদের সময় কাটছিল। রাতে তন্দুরি রুটি আর মালাই কোফতা খেয়ে দিব্যি আমেজ এল। বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেদেরই খেয়াল ছিল না।
পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল। সৌম্যর ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বেচারা কোনো কাজ না পেয়ে ঘরের টেবিল চেয়ার সরিয়ে ঠিক করে রাখছিল। সংসারী ছেলে। সেসবের আওয়াজেই ঘুম ভাঙে আমার। এমন নির্ঝঞ্ঝাট অলস সকাল শেষ কবে পেয়েছিলুম মনে করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার দিকে। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বুকভরা অজস্র মুহূর্ত আর বেঁচে থাকার রসদটুকু। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে পিছুটান ভুলে এমন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অনেকটা দূরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরাটা একটু বেপরোয়া হলেও দিব্যি লেগেছিল কিন্তু আমাদের।
এই প্রসঙ্গে বলি - পরের বারটার জন্য একটা বেড়ে লোকেশন খুঁজছি.....জানা থাকলে বলবেন তো.....
কৃতজ্ঞতা : সৌম্য ও সৌম্যর বাইক
দুপুর গড়িয়ে, বিকেল পেরিয়ে কখন সন্ধ্যে নেমেছে আমাদের খেয়াল ছিল না। সিনেমা শেষ হতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরেটা ধূসর হয়ে এসেছে। হোটেলের বাইরে গঙ্গার পারে বসে চা খাব বলে ঠিক করলাম। দু মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে গঙ্গার পারে এসে দেখলাম একটা ঢাউস স্টিমার নদীর একেবারে মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে জিরোচ্ছে বলে মনে হল। হলদিয়ার বন্দরটা সীমান্তের শেষে আবছায়া দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপরে টিমটিমে আলোয় একটা চায়ের দোকানে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। তার সোঁদা গন্ধ কুণ্ডলী পাকিয়ে নদী পেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। দোকানের পাশেই ভূত বাংলোর মতো একটা সাদা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। অন্ধকারে কয়েক বছরের জীর্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। বেশ একটা গা ছমছমে মায়াবী পরিবেশ। বেশি দূর এগোলাম না আর আমরা। একটা শান বাঁধানো ধাপিতে বসে খানিক গুলতানি করে আবার পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
ফিরে এসে আবার আরেক রাউন্ড সিনেমা। যেন সিনেমা দেখাই মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের। অবশ্য বিনা বাধায় বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পাওয়া অনেকটা লটারি পাওয়ার মতোই। যাঁরা বিবাহিত তাঁরা নিশ্চই সহমত হবেন আমার সঙ্গে। আপনার পছন্দের সেরা ছবিটা টিভিতে চলছে, আর আপনি নিশ্চিন্তে বসে মৌজ করে সেটা গিলছেন, এমনটা আপনার কপালে যদি জুটে থাকে তাহলে আপনি যথেষ্ট ঈর্ষার পাত্র। খানিক সিনেমা দেখে আর বেশ খানিকটা আড্ডা মেরে আমাদের সময় কাটছিল। রাতে তন্দুরি রুটি আর মালাই কোফতা খেয়ে দিব্যি আমেজ এল। বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেদেরই খেয়াল ছিল না।
পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল। সৌম্যর ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বেচারা কোনো কাজ না পেয়ে ঘরের টেবিল চেয়ার সরিয়ে ঠিক করে রাখছিল। সংসারী ছেলে। সেসবের আওয়াজেই ঘুম ভাঙে আমার। এমন নির্ঝঞ্ঝাট অলস সকাল শেষ কবে পেয়েছিলুম মনে করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার দিকে। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বুকভরা অজস্র মুহূর্ত আর বেঁচে থাকার রসদটুকু। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে পিছুটান ভুলে এমন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অনেকটা দূরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরাটা একটু বেপরোয়া হলেও দিব্যি লেগেছিল কিন্তু আমাদের।
এই প্রসঙ্গে বলি - পরের বারটার জন্য একটা বেড়ে লোকেশন খুঁজছি.....জানা থাকলে বলবেন তো.....
কৃতজ্ঞতা : সৌম্য ও সৌম্যর বাইক
![]() |
| ছবি : নিজস্ব |




