৭ই মে, ২০১৪, হিমাচল প্রদেশ.....
কল্পা উপত্যকায় এখন একের পর এক মেঘের ছায়া সরে যাচ্ছে। কিন্নর জেলার এই ছোট্ট শহরে কাল রাতেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কাগজে কলমে গ্রীষ্মকাল হলেও বাতাসে এই শিরশিরানি ভাবটা যেন কিছুতেই শরীর ছাড়তে চায় না। একটা চৌকোনো জানলা দিয়ে হিমালয় ছুঁয়ে আসা আলো এসে পড়েছে একটা কাঠের বিছানায়। ভোরের প্রথম সূর্যের গন্ধে চোখ মেলে তাকালেন এক শীর্ন জরাক্রান্ত বৃদ্ধ। গায়ের লেপটা সরিয়ে কোনোমতে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলেন ফুলহাতা সোয়েটার আর উলের টুপি পরিহিত শ্যামশরণ। দুটো পা নামিয়ে গলিয়ে নিলেন একজোড়া ক্যাম্বিসের জুতো। মুখ ঘুরিয়ে জানলার দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। মুখের অগণিত দীর্ঘ বলিরেখায় অতীতের অক্ষর স্পষ্ট। আজ এক বিশেষ দিন। সপ্তাহখানেক আগে নির্বাচন কমিশন থেকে চিঠিটা এসেছে।
একটা আলগা হাসি খেলে যায় শ্যামশরণের দু চোখ জুড়ে...…..
একটা আলগা হাসি খেলে যায় শ্যামশরণের দু চোখ জুড়ে...…..
১৯৭৫ সালে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছিলেন শ্যামশরণ। তারপর থেকে পরিবার ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। বর্তমানে ছোট ছেলে চন্দ্রপ্রকাশের পরিবার তাঁর সঙ্গে থাকে। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ আর তিন নাতি নাতনি নিয়ে সংসার। এখন সারাদিনের সঙ্গী বলতে একটা ছাইরঙা রেডিও যার ওপর আঙুল বুলিয়ে দেশের হালহকিকত নেড়েচেড়ে দেখেন মাঝেমাঝেই।
কয়েক মুহূর্ত থমকে, দুহাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন অতিপ্রবীণ মানুষটি। মিহি গলায় বলে উঠলেন, 'পানি লা দো বিটিয়া '। ভিতরের ঘর থেকে পুত্রবধূ সুরমা এক গ্লাস জল এনে দেয় তাঁকে। মৃদু হেসে বলে, 'জলদি উঠ গ্যায় বাবা' ?
- হাঁ বিটিয়া....প্যতা হ্যায় না আজ কন সা তারিখ হ্যায় ?
- জি বাবা
- হমে দেড় নহি হোনা.....
- জি বাবা, পানি গরম হ্যায়, আপ নহা লিজিয়ে...…..
শ্যামশরণ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন, পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যান কলতলার দিকে।
খানিক বেলা বাড়তেই একটা ভিড় জড় হতে থাকে শ্যামশরণের বাড়ির উঠোনটায়। পুলিশ, মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের শব্দে চারপাশটা যেন মৌমাছির গুঞ্জন বলে ভ্রম হয়। যে ঘটনা ঘটতে চলেছে তার সাক্ষী থেকে যেতে চান সকলেই। এমন একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত মুঠোবন্দি করতে উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করতে থাকেন সাংবাদিকরা। হিমালয়ের বুকে ৯ হাজার ৭০০ ফিট উচ্চতায় যে ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে আছে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে তৎপর দেশের তামাম মিডিয়া। সময়ের সাথে সাথে ভিড় আরও গাঢ় হতে থাকে। কয়েকজন উচ্চপদস্থ নির্বাচন আধিকারিক এসেছেন গাড়ি নিয়ে। কয়েক দশকের অতীতকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন মাণ্ডির বুথে। সবারই লেন্সের ফোকাস তাক করা থাকে কাঠের বাড়িটার দরজার দিকে।
শ্যামশরণের পুত্র চন্দ্রপ্রকাশ একঝলক জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিয়ে বলে, 'উও লোগ আ গ্যায় বাবা'। দেওয়ালে ঝোলানো একটা পুরোনো ক্ষয়াটে আয়নায় শ্যামশরণ মাথার টুপিটা ঠিক করে নেন একবার। তারপর মুখ ঘুরিয়ে স্মিত হেসে বলেন, 'চলো ফির'। দুজন পুলিশ দরজার দিকে এগিয়ে আসে।
মুহূর্তে হৈহৈ করে ওঠেন সবাই। কুয়াশার পাতলা চাদর সরে গিয়ে দেখা দেন দৃঢ়চেতা বৃদ্ধ। একটা লাঠির ওপর ভর দিয়ে পলকা নড়বড়ে শরীরটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ৯৭ বছরের শতাব্দী প্রবীণ শ্যামশরণ নেগি। গায়ে একটা বাদামি রঙের কর্ডের জ্যাকেট, সাথে মানানসই ট্রাউজার আর মাথায় লাল-সবজে রঙের শেরপা টুপি পড়ে একগাল হাসি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সবার সামনে। সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সকলে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল একের পর এক। সাথে শিলা বর্ষণের মত প্রশ্ন ধেয়ে এল তাঁর দিকে। কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে শ্যামশরণ বললেন, 'প্যহলে ভোট, ফির ইন্টারভিউ'। সকলে যেন বাধ্য ছাত্রের মতো কথা শুনলেন প্রাচীন শিক্ষকের। দুপাশে সরে গিয়ে ওনার পথ করে দিলেন সবাই। নির্বাচন কমিশন থেকে পাঠানো গাড়ির দিকে মন্থরপদে এগিয়ে গেলেন শ্যামশরণ নেগি - ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের ব্র্যাণ্ড এম্বাস্যাডর, স্বাধীন ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ভোটার ও এক অনন্য ইতিহাসের রচয়িতা......
(১৯৫১ সালের ২৫শে অক্টবর চিন্নি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রথম ভোট হয়। সেই দিনে শানতুং আর কল্পায় একই সাথে ভোটগ্রহণ হয়। ভোর সাড়ে ছটায় কল্পা উপত্যকায় প্রথম ভোট দেন শ্যামশরণ নেগি যিনি সেদিন থেকে আজ অবধি কোনো সাধারণ নির্বাচন উপেক্ষা করেননি। ২০১৪ সালে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ওনাকে লোকসভা নির্বাচনের ব্র্যাণ্ড এম্বাস্যাডর ঘোষিত করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ১০২ বছর এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে প্রস্তুত। )
#firstindianvoter #shyamsarannegi #electioncommissionbrandambassador #parliamentelection2014 #bengaliarticle #bengalishortstories #molat
