![]() |
| ছবি : সৌম্য |
রাস্তায় বেরিয়ে পথ হারানোর অভ্যাসটা যেন রপ্ত করে ফেলেছি আমরা। বেরোনোর আগের দিন পাক্কা আধঘন্টা ধরে নিখুঁত প্ল্যান ছকে ফেলা হল। অর্থাৎ কোন রাস্তা দিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরব শুরু করে, সাঁতরাগাছি পেরোনোর পর কোন কোন জায়গার ওপর দিয়ে যাব তার একটা নির্ভুল চিত্র এঁকে ফেলা হল প্রায়। চিত্র তো দূর, গুগল খুলে ম্যাপটা পর্যন্ত একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে ফেললুম দুজনে। ঠিক তার পরের দিন, যথারীতি সাঁতরাগাছি পেরোনোর পর বেভুল হয়ে চলে গেলাম একেবারে অন্য দিকে। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আশেপাশের অঞ্চলটা অপিরিচিত লাগার ফলে বাধ্য হয়ে এক জায়গায় বাইক থামালাম। একজন গ্রাম্য পথিককে জিজ্ঞেস করলাম কোলাঘাট যাওয়ার সঠিক পথটা। সে বেশ খানিক্ষন আমাদের নিরীক্ষণ করার পর জিজ্ঞেস করল, 'কোলাঘাট যাবেন ? তা দিল্লীরোড ধরেছেন কেন, আপনারা কি দিল্লী যাবেন, তাহলে এদিক দিয়ে সোজা...........' ? সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, 'না দাদা না, আমরা এখন দিল্লী যেতে চাই না, মাইরি বলছি, কোলাঘাট কি করে যাব সেটা দেখিয়ে দিন প্লিজ' । ভদ্রলোক খানিক ব্যাজার হয়ে বললেন, 'আচ্ছা বেশ, বাইক ঘুরিয়ে উল্টোদিকে চলে যান, একটা ব্রিজ পাবেন, তার তলা দিয়ে ঘুরে গিয়ে হাইওয়ে ধরুন, একেবারে সোজা কোলাঘাট'। একপলক থমকে, বাইক ঘুরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলুম। ভাগ্যিস জিজ্ঞেস করেছিলুম, না হলে বোধহয় মিতরোঁর সাথে কোলাকুলি করাটাই বাকি থাকত শুধু।
| ছবি : সৌম্য |
হাইওয়েতে দুবার থেমেছিলুম। একবার প্রকৃতি ডেকেছিল আরেকবার ডাবওয়ালা, দুবারই জলের কারণে। আর কোথাও থামিনি। মাঝে একবার এক পিকনিক পার্টির লোককে আওয়াজ দিয়েছিলুম। সে হতভাগা টেম্পোর পিছনে পা ঝুলিয়ে দোল খেতে খেতে যাচ্ছিল। তাকে চোস্ত বাংলা ভাষায় বুঝিয়ে দিতে সে তখন ভিতরে ঢুকে বসে। এছাড়া একটা বুলডোজারকে মাঝরাস্তায় থামিয়ে দিয়েছিলুম প্রায়। তার সমস্ত চাকাই যে ঘুরছে এটা বলার পর সে ধেয়ে এসেছিল আমাদের দিকে। সেখান থেকে এক্কেরে নাকবরাবর বাইক ছুটিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের বর্ডারে পৌঁছলুম। শরৎ সেতু দিয়ে যখন নামছি তখন রূপনারায়ণের ওপর হাজারে হাজারে রূপোর কুঁচি ঝকঝক করছে। মন ভালো হয়ে গিয়েছিল এক নিমেষে। ব্রিজ থেকে নেমে অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকেছিলুম শের-এ-পাঞ্জাবে। পেটে তখন ছুঁচোয় টি টোয়েন্টি খেলছে। তন্দুরি রুটি - তড়কা, আলুপরোটা - তরকারী আর স্যালাড এই দিয়ে ডান হাতের কাজটা চেটেপুটে শেষ করলুম। সেখান থেকে একটা মেঠো পথ ধরে সোজা রূপনারায়ণের পার। যাবার আগে অবশ্য এক সরল ছেলেকে এক অপিরিচিত দাদার বাইক পাহারায় দাঁড় করিয়ে এসেছিলুম। সে বেচারা কতক্ষন ঠায় দাঁড়িয়েছিল জানি না।
![]() |
| ছবি : সৌম্য |
নদীর পারে এসে যখন পৌঁছলুম তখন সূর্য পশ্চিমের দিকে সামান্য ঘাড় কাত করেছে। ধলেশ্বরী নাম নিয়ে পুরুলিয়া থেকে তার চলার শুরু, মাঝে বাঁকুড়ায় নাম পাল্টে দ্বারকেশ্বর, তারপর ঘাটালে শিলাবতী নদীর সাথে মিশে রূপনারায়ণের নামকরণ। তারই পারে একটা ফাঁকা নিরিবিলি জায়গা দেখে আয়েস করে দুজনে পাথরের ওপর বসলুম। আবেশে শরীর জুড়িয়ে এল আপনিই। দুদিকে যতদূর দেখা যায় শুধু রুপোলি মুগ্ধতা। তার মাঝ বরাবর দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলেছে ছৈ বাঁধা ছোট্ট একটা জেলে নৌকো। এমন অপরূপ মায়া জড়ানো নদীর ধার ঘেঁষে চুপচাপ বসে রইলুম দুজনে। টুকরো কথাবার্তায় নিস্তব্ধতা ভাঙছিল ঐটুকুই.......বাকিটা অপাপবিদ্ধ জলের ছিঁটেফোঁটা উড়ে এসে পড়ছিল চোখেমুখে। ডানদিকে একটা পুরোনো কাঠের ঘুপচি ঘর চোখে পড়ল। পার থেকে ঝুলে এসে প্রায় জলের ওপর পড়ে, এমন আশ্চর্য কায়দায় সে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হল কত বছরের ভাটিয়ালি ইতিহাস ধুলোদানার মতো লেগে আছে গায়। যে অতীত, যে মুহূর্তরা জোয়ার ভাঁটায় গা ভাসিয়েছে, তার একনিষ্ঠ নিরবিচ্ছিন্ন সাক্ষী সেই একফালি ঘেরাটোপ। মনে হয়েছিল সপ্তাহান্তে যদি একবার করে এসে থাকতে পারতুম সেই ঘরে, বেশ হত। কত অবলীলায় জলের গান ভেসে আসত, কত বকের দল সন্ধ্যে নামাতো, দেখতুম বসে। পার বরাবর গাছের শিকড়ে মিষ্টি সুরের ছলাৎ শুনতে পেতুম হয়ত।
| ছবি : সৌম্য |
পার বেয়ে খুব সহজেই নদীতে নামা যায়, তবে সে দুঃসাহস আমরা দেখাইনি। যে রূপ আমরা চোখের সামনে দেখেছি তা ছুঁয়ে দেখার ধৃষ্টতা করিনি ইচ্ছে করেই। প্রাণভরে শুধু দূর থেকে তার আমেজ নিয়েছি। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কাতলা মাছের বুদ্ বুদ্ ভেসে উঠছিল মাঝে মাঝেই। দুহাত অন্তর অন্তর লাফ দিয়ে যেন তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। আর আমরা বাচ্চা ছেলেদের মতো কর গুনে মনে রাখছিলুম কে কটা দেখতে পেলুম। সে ভারী আনন্দের জিনিস। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তবে তার থেকেও কঠিন ছিল বোধহয় ফেরার টান, যা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই ছিল না। সন্ধ্যে নামার আগেই বালি ঝেড়ে উঠে পড়লুম। অনেকটা পথ, আবার অনেকটা সময়। ফেরারী মনেরও হয়ত একটা বাঁধ থাকে, একটা ফিরে আসার আশ্রয় থাকে। তবে এই অপরিকল্পিত হারিয়ে যাওয়ার উন্মাদনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সাধ নেই আমাদের। সে কয়েক সপ্তাহ পরেই হোক বা কয়েক মাস, যাদের পায়ের তলায় সর্ষে আছে তারা কতক্ষন আর সিঁড়িভাঙার অংক কষবে ! শুধু একবার বাইক স্টার্ট দেওয়ার অপেক্ষা...........তারপর...........
#bengaliarticle #suddenbreak #holiday #Molat #Kolaghat

