Monday, September 25, 2017
অনুপদ্য - ১৭
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Thursday, September 21, 2017
সাপ্তাহিকী - ৩২ # সেবুর প্যান্ডেল - অন্তিম পর্ব
পলকের আকস্মিকতা কাটাইয়া সবাই কোলাহল করিয়া উঠিল। ব্যাটা বলে কি ? পুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধবে ! সকলেই সমস্বরে বলিল, 'না না না, এ অসম্ভব' ! প্যাণ্ডেল বাঁধিতে গিয়া সেবু যে ভীষণ রকম একটা কাণ্ড ঘটাইয়া ফেলিবে এ বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত হইয়া বিধুচরণের নিকট তদ্বির করিল। বিধুচরণও মাথা নাড়িয়া বলিলেন, 'না না, সেবু তা হয় না। তুই কি প্যাণ্ডেল বেঁধেছিস আগে যে হঠাৎ করে একেবারে দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেল বাঁধতে লাগবি' ? সেবু ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'অাহ্ আমি কি বলেছি আমি একাই বেঁধে ফেলব ? ভূপেন মাঝি ও তার দলবল তো থাকবেই, আমি শুধু একটু হাত লাগাবো, এই যেমন ধরো একটা দড়ি বেঁধে দিলাম বা একটু বাঁশটা পুঁতে দিলাম এই আর কি। আমার ভারী ইচ্ছে, সেই ছোটোর থেকে..........বিশ্বাস করো'। শেখর ও গোরা হৈ হৈ করিয়া বলিল, 'না না, মিত্রমশাই, আপনি একদম শুনবেন না ওর কথা। আমাদের তো আগে কম বিপদ হয় নি। তাছাড়া দুর্গাপুজো নিয়ে কোনো রকম ছেলেমানুষি আমাদের না করাই ভালো'। বিধুচরণ মহা ফাঁপরে পড়িলেন। একদিকে সেবুর আবদার তিনি না মিটিয়া থাকিতে পারেন না আবার অন্যদিকে তাহাকে অনুমতি দিতেও ভরসা পাইতেছেন না। কতকটা ফাটা বাঁশের মধ্যে আটকা পড়িয়া তিনি ছটফট করিতে লাগিলেন।
সেবু তাহার জ্যাঠার পরিস্থিতি আঁচ করিয়া বলিয়া উঠিল, 'আচ্ছা জ্যেঠু, জেলেপাড়ার বসুমতীকে চেন' ? বিধুচরণ অবাক হইয়া বলিলেন, 'বসুমতী ? না, চিনি না। কেন, সে কে' ? এ কথায় শেখরের মুখ পাংশু হইয়া গেল। সে বিবাহিত অথচ বেশ কয়েকদিন হইল জেলেপাড়ার বসুমতীর সহিত তাহার একটি সম্পর্ক জমিয়া উঠিয়াছে। একথা মনোহরপুরের কাকপক্ষীও জানে না। তাহা সেবুর গোচরে কি করিয়া আইল এইটা ভাবিয়া শেখর যারপরনাই অস্থির হইয়া উঠিল। কারণ এই সম্পর্ক জানাজানি হইলে তাহার সংসারে কেন গোটা পাড়ায় কুরুক্ষেত্র হইতে বাকি থাকিবে না শেখর তাহা বিলক্ষণ জানে। সেদিকে তাকাইয়া সেবু বলিল, 'না, মানে সে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে তালপুকুরের ধারে চুপটি করে বসে থাকে। কেন ? তুমি জান' ?
বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া দুদিকে মাথা নাড়িলেন। সেবুর কথার গোপন মর্মার্থ তিনি উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। উল্টোদিকে শেখর প্রায় ঘামিয়া স্নান করিয়া গেল। বসুমতীর সাথে তাহার দেখা করিবার স্থান তালপুকুরই বটে। সন্ধ্যের দিকে সে সমস্ত রকম আঁটঘাঁট বাঁধিয়া খুবই সন্তর্পণে বসুমতীর নিকট আসে। তাহাদের প্রেমালাপ করিবার একটি গোপন আস্তানা আছে। আজ অবধি কেউ টের পায় নাই। হতভাগা সেবু কি করিয়া জানিতে পারিয়া আজ মোক্ষম সময়ে সেসব কথা তুলিতেছে। পাড়ার পাঁচজনের সামনে মাথা হেঁট হইয়া যায় বুঝি।
পরিস্থিতি নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া শেখর গলা খাকরাইয়া বলিয়া উঠিল, 'আঃ সেবু, কি সব অবান্তর কথা বলছিস ? হচ্ছিল একটা কাজের কথা, তা নয় যত্তসব অপ্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে। আমাদের আর দেরি করলে চলবে না কিন্তু, সময় বয়ে যাচ্ছে। ঝটপট ভূপেনকে একটা খবর দে দিকি'।
সেবু একগাল হাসিয়া বলিল, 'সে তো আমি এখনই দিতে পারি। কিন্তু আমার কথাটাও একবার.........'। বিধুচরণ ফোঁস করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন। শেখর একবার বিধুচরণের মুখের দিকে তাকাইয়া নিয়া বলিল, 'আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন, চারটে বাঁশ নাহয় তুইই বাঁধিস। ভূপেনকে খবরটা তো দে আগে'। বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, 'সে কি কথা শেখর, ওর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা তো সবই জানো। ও যদি কোনো বিপদ ঘটায়, তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারবো না এ আমি আগেই সাফ জানিয়ে রাখলুম'। শেখর স্মিতহাস্যে কহিল, 'আহা সেবুর ইচ্ছে হয়েছে যখন, একটু প্যাণ্ডেলের কাজ করল নাহয়। ছোটবেলার শখ বলছে তো, করুক না একটু। আমাদেরও তো কতসময় কতরকম শখ জাগে, তাই না ? ও কিছু না। আপনি আর এ নিয়ে আপত্তি করবেন না মিত্রমশাই। সেবু তো আমাদেরই ঘরের ছেলে, কি সেবু এবার খুশি তো' ?
সেবু মহানন্দে তাহার দন্ত কপাটি বাহির করিল। বিধুচরণ বলিলেন, 'বেশ, তবে তাই হোক। তুমি পুজোর সেক্রেটারি হয়ে যখন বলছ তখন আর আমার আপত্তি করবার কিছু নেই'। এই কথাটি বলিয়াই তিনি হঠাৎ সেবুর দিকে ঘুরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তবে, তুই বসুমতী না কার যেন কি একটা কথা বলছিলি' ? সেবু চটপট হাত নাড়িয়া বলিল, 'না না সেসব কিছু না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমি বরং যাই, চানটা করে নিয়ে ভূপেন মাঝি কে খবরটা দিই গে যাই'। বলিয়াই সে ছুটিয়া ঘর হইতে অন্তর্ধান হইল। বিধুচরণ চক্ষু বুজিয়া কহিলেন, 'হরি হে ! কখন যে তোমার কি ইচ্ছে........ '।
দেখিতে দেখিতে দেড়মাস কাটিয়া গেল। প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষের পথে। ভূপেন মাঝি ও তার দলবল ঝড়ের গতিতে কাজ করিতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের মতো দুর্দান্ত আকার না হইলেও হরিসভার নৌকার আদলটা মোটামুটি হইয়াছে। যদিও গোটা নৌকা বানাইবার দরকার পড়ে নাই। সামনের দিকটায় চমৎকার একটা বজরার রূপ দিয়া পিছন দিকটায় ছোট করিয়া হাল বাঁধিয়া দিয়াছে। সামনে দাঁড়াইলে নৌকার ছাউনি ও মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাইবে। কিন্তু সেসব ছাপাইয়া যাহা চোখে পড়িবার মতো তাহা হইল সেবুর উৎসাহ ও কাজ করিবার উদ্দীপনা। বাঁশ বাঁধা, কাঁচা মালের আনা নেওয়া করা, মিস্ত্রিদের খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছুই সে নিজের হাতে দেখিতেছে। বোঝা যাইতেছে তাহার শখ পূরণের সমস্ত রসটুকু সে পরম তৃপ্তিতে আস্বাদন করিতেছে। সময়ে অসময়ে বিধুচরণ, শেখর, গোরা ও ক্লাবের বাকিরা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী সমস্ত কাজই তদারকি করিতেছেন।
পরের এক সপ্তাহে বাকি সমস্ত কাজই নিয়মমাফিক চলিয়া শেষ হইয়া গেল। প্যাণ্ডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেল। কিন্তু কেহ জানিতে পারিল না নৌকার পিছন দিকে এক ভীষণরকম কালসর্পের যোগ ঘটিয়াছে। সেটি কি তাহা পরে বলিতেছি। এদিকে ইতিমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটিল। যাহারা মনোহরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা তাহারা নিত্য আসা যাওয়ার পথে সকলেই সচক্ষে দেখিতে পাইতেছিলেন যে কোন প্যাণ্ডেলটি কিরূপ প্রস্তুত হইতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের অপেক্ষা হরিসভার নৌকা যে উত্তম কিছু হইতেছে না এ তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিলেন। হরিসভার নৌকা ধারে ও ভারে কোনোপ্রকারেই উড়োজাহাজকে টেক্কা দিতে পারিতেছিল না। তাহার কারণ উড়োজাহাজটি দুতলা সমান পেল্লাই হইয়াছিল এবং দেখিতে অবিকল আসল উড়োজাহাজের মতোই লাগিতেছিল। সেখানে হরিসভার নৌকাটি মোটের উপর চলনসই হইয়াছিল। সুতরাং ধীরে ধীরে এরকম একটি বার্তা রটিয়া গেল যে এবার হরিসভা তেমন কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের সমস্ত কর্মকর্তাদের নিকট অনুরূপ সংবাদ পৌঁছাইল। এহেন পীড়াদায়ী জনশ্রুতিতে সকলেই প্রায় ভাঙিয়া পড়িলেন। বিধুচরণও কঠিন মনকষ্টে ভুগিতে লাগিলেন। পুজো লইয়া তাহার সমস্ত উদ্দীপনা ধূম্রের ন্যায় মিলাইয়া যাইতে লাগিল।
তবুও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের যথাবিধি নিয়ম পালন করিতে হইবে। তাই ক্লাবের মধ্যে ঠিক হইল চতুর্থীর দিন প্রতিমা আনা হইবে ও পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় পাঁজির সময়ানুসারে বিধুচরণ ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উদ্বোধন করিবেন।
যথাসময়ে পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যাবেলা সকলে ক্লাবের মাঠে উপস্থিত হইলেন। মণ্ডপের সামনে একটি বিশাল ত্রিপল খাটাইয়া রাখা হইয়াছে। সামান্য কিছু উৎসুক জনতাও মাঠের ধারে জড়ো হইল। কারণ বেশিরভাগ মানুষই উড়োজাহাজের দিকে উড়িয়া গিয়াছেন। বিধুচরণ শ্বেতশুভ্র ধাক্কা পাড়ের ধুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরিহিত হইয়া ব্যথিত হৃদয়ে ক্লাবে পদার্পন করিলেন। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝা যাইতেছিল যেন তিনি এক কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন। মাঠ প্রায় জনশূন্য দেখিয়া তিনি আরও হতোদ্যম হইয়া পড়িলেন। অন্যান্য বৎসর গুলিতে যেখানে উদ্বোধনের দিন একেবারে লোক ভাঙিয়া পড়িত, আজ সেখানে ছন্নছাড়া কয়েকজন আসিয়াছে। ক্লাবের অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইয়া মণ্ডপে লইয়া আনিলেন। ঢাকিরা আগে হইতেই প্রস্তুত ছিল। তাহারা বিধুচরণকে দেখিয়া একসাথে ঢাক বাজাইতে শুরু করিল। কিন্তু সে ঢাকের আওয়াজও কেমন যেন করুণ প্রাণ মনে হইল। পাড়ার কয়েকজন মহিলা উলুধ্বনি দিয়া ও মঙ্গলশঙ্খ বাজাইয়া কোনোমতে বিলীন উৎসাহটুকু জাগাইয়া রাখিলেন।
ত্রিপল সরাইয়া, পঞ্চপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিয়া পুজোর উদ্বোধন হইবে। বিধুচরণ একটি গম্ভীর নিঃশ্বাস ছাড়িয়া রশি টানিয়া ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উন্মোচন করিলেন। তাহার পর পঞ্চপ্রদীপে আলো সঞ্চার করিয়া মণ্ডপের সিঁড়ির নিকটে আসিলেন। ইতস্তত দু একটি হাততালির শব্দ শোনা গেল। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বিধুচরণ মণ্ডপে উঠিতে গিয়া থমকাইয়া গেলেন। মণ্ডপের দিকে চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া গেল। তিনি শ্বাসরুদ্ধ করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া ক্লাবের বাকিরাও মণ্ডপের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাহাদের হৃদপিণ্ড প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেল।
দেখা গেল নৌকারূপী মণ্ডপটি ডানদিকে বেশ কিছুটা হেলিয়া কাত হইয়া গিয়াছে। কতকটা পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো। পড়িয়া যায় নাই এই রক্ষে, কিন্তু পড়িয়া যাইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। বিধুচরণ কোনো কথা কহিতে পারিলেন না প্রথমটায়। ধীরে ধীরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন অগ্নি নিক্ষেপ হইতে লাগিল। চরম ক্রোধে তিনি থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। পাশে দাঁড়ানো শেখরকে চাপাস্বরে ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'এটা কি ? এ কি করে হল' ? শেখরের প্রায় অজ্ঞান হইবার উপক্রম হইল। সে সভয়ে কহিল, 'আজ্ঞে, সকাল অবধি তো সোজাই দাঁড়িয়েছিল এখন যে কি করে হেলে গেল জানি না'। বিধুচরণ অগ্নিনেত্রে বাকিদের থেকে ইশারায় জানিতে চাহিলেন যে ব্যাপারখানা কি। কিন্তু কেউই কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিল না। ভূপেন মাঝি কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সেও চক্ষু গোলগোল করিয়া তাকাইয়া ছিল তাহার সাধের নৌকার দিকে। বিধুচরণ তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিতে টানিতে মণ্ডপের অনতিদূরে লইয়া গিয়া কহিলেন, 'এসবের মানে কি ভূপেন ? এটা কি মস্করা হচ্ছে ? নৌকা এতো হেলে গেল কি করে' ? ভূপেন মাঝি মিনমিন করিয়া কহিল, 'আজ্ঞে মিত্রমশাই আ-আমি সত্যি কিছু জানি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলুম আমি। আজ সকালেও দেখেছি, তখন তো কিচ্ছুটি হয় নি'।
'ন্যাকা সাজছিস তুই ? সকালেও দেখেছি ? তাহলে কি বিকেলে উঠে সমুদ্রে জাল ফেলেছিস মাছ ধরবি বলে, যে নৌকা হেলে গেল' ? বিধুচরণ ক্রোধান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন। ভূপেন হাঁউমাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। বিধুচরণ আবার কহিলেন, 'সত্যি করে বল ভূপি, কি করে হল নইলে তোকে আমি এই মাঠে জ্যান্ত পুঁতব বলে রাখলুম'। ভূপেন ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল ,'আজ্ঞে, আমায় একটু সময় দিন কত্তা, আমি একবার পিছনদিকটা দেখে আসি'। বলিয়াই সে ছুটিয়া নৌকার পিছন দিকে চলিয়া গেল। কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া সে আবার ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, 'আজ্ঞে হালের দিকে দুটো বাঁশ আলগা বাঁধা হয়েছে কত্তা, দড়ি হড়কে গিয়ে বাঁশ কাত হয়ে গেছে, তাই নৌকাও হেলে গেছে খানিক'।
'আলগা বাঁধা হয়েছে মানে ? কেন, বাঁধার সময় তুমি কি কেষ্টঠাকুরের লীলে দেখছিলে বজ্জাত' ? বিধুচরণ অগ্নিশর্মা হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন। ভূপেন কুঁই কুঁই করিয়া বলিল, 'আজ্ঞে ওই বাঁশদুটো আমি সেবুকে বাঁধতে দিয়েছিলুম। ঐটে বাঁধবে বলে সে খুবই জোড়াজুড়ি করে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই..........'। সেবু কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, 'হ্যাঁ, আমিই বেঁধেছিলুম বটে, কিন্তু আমি ভূপেনদার কথামতো ঘন্টাকেও দেখিয়ে নিয়েছিলুম। সে বলেছিল ঠিক আছে'। বিধুচরণ স্তব্ধ হইয়া গেলেন একথা শুনে। তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।
ঘটনাটা ঠিক কি হইয়াছিল তাহা বলি এখন পাঠকদের।
সেবুর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখিয়া ভূপেন তাহাকে দুটি বাঁশ বাঁধিতে দিয়াছিল। কাজটি ছিল এই যে হালের দিকটায় একটি বাঁশের সহিত আরেকটি বাঁশ কায়দা করিয়া বাঁধিতে হইবে। তাহার সহিত একজন কারিগরকেও রাখিয়াছিল পুরোটা ভালো করিয়া দেখিয়া লইবার জন্য। তাহার নাম ঘন্টা। কিন্তু মুশকিল হইল, সন্ধ্যে হইলেই ঘন্টা গাঁজা ও কল্কের মায়ায় জড়াইয়া পড়ে। তখন আশেপাশে বোমা মারিলেও ঘন্টার ঘড়িতে কিছুমাত্র বিকার ঘটে না। সেবুর দুইটা বাঁশ বাঁধিতে সেদিন সন্ধ্যে হইয়া গিয়াছিল। কাজের শেষে সে ঘন্টাকে ডাকিয়া লইয়া ভালো করিয়া দেখাইয়াছিল। তুমুল নেশার চোটে ঘন্টা তখন চোখ খুলিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। ফলে সে বুঝিতে পারে নাই যে বাঁশ দুইটি একেবারে আলগা বাঁধা হইয়াছে। কতকটা হামাগুড়ি দিয়া সে দড়ির উপর হাত বুলাইয়াই জড়ানো কণ্ঠে বলিয়াছিল, 'ঠিক আছে, বেশ বাঁধা হয়েছে'। নানান কাজের মধ্যে ভূপেনেরও পুরোটা ভালো করিয়া দেখা হয় নাই। এখন সময়কালে এই ভয়ঙ্কর বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
সেবুর মুখে ঘন্টার কথা শুনিয়া সকলেই একপ্রকার বিপদের ঘন্টাধ্বনি শুনিতে পাইলেন। কে কি বলিবে কেহ ভাবিয়া পাইলেন না। আশেপাশে কোথাও ঘণ্টাকেও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে যে জনতা দূরে জড়ো হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে এক অদ্ভুত গুঞ্জন শুরু হইল। সে গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়িয়া এক আশ্চর্য রূপ লইতে লাগিল। কারণ তাহারা কেহ জানিতে পারে নাই যে নৌকার এমন দুর্দশা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটিয়াছে। তাহারা ভাবিতে লাগিল, এইটি বোধহয় হরিসভা ক্লাবের শেষবেলার চমক, তুরুপের তাস। একেবারে অন্তিমলগ্নে আস্তিন হইতে বাহির করিয়াছে আদর্শ পল্লীকে মাত দিবে বলিয়া। এবং এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখিয়া তাহারা একেবারে হাঁ হইয়া গেল। তাহার কারণ হইল এই যে নৌকাটি হেলিয়া থাকিবার ফলে এক অদ্ভুত বাস্তব রূপ লইয়াছে। দূর হইতে দেখিলে মনে হইবে যে তুমুল ঝড়ের মধ্যে নৌকাটি কোনোপ্রকারে হেলিয়া গিয়া শেষ অবধি বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। সঙ্গে জলরাশির আবহশব্দ, মৃদু আলোর খেলা ও সন্ধ্যার মেঘাবৃত আকাশের মেলবন্ধনে গোটা ব্যাপারখানায় যেন এক মায়াবী দৃশ্যপট প্রস্তুত হইয়াছে। তাহাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিবার পর কয়েকটি উক্তি এধার ওধার থেকে উড়িয়া আসিতে লাগিল। যেমন সপত্নী সাগর ডাক্তার কহিলেন, 'ইট্স ওয়ান্ডারফুল ! এমেজিং' ! বাংলার শিক্ষক হলধর সামন্ত বলিলেন, 'দুর্দান্ত ! ওস্তাদের মার শেষরাতে'। মধু স্যাকরা বলিয়া উঠিল, 'কেয়াবাৎ ! শেষবেলায় হরিসভা কিন্তু দেখিয়ে দিলে'। কিছু কচিকাঁচার দল সহর্ষে হাততালি দিয়া উঠিল। উপস্থিত দর্শক সকলেই হরিসভার সৃজনী পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
বিধুচরণ ও তাঁহার দলবল হকচকিয়ে গেলেন। এ কি হইল ! যে মাঠ কিয়দকাল আগে পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ও স্বপ্নভঙ্গের আঁধারে ডুবিয়া যাইতেছিল এখন সেখানেই উল্লাস ও উৎসবের আলো জ্বলিতেছে ! বিধুচরণ চকিতে পুরোটা আঁচ করিয়া ক্লাবকর্তাদের বলিলেন, 'আমাদের শীঘ্রই এটা সামাল দিতে হবে। লোকজন যদি নৌকায় উঠে পড়ে তাহলে তো সবশুদ্ধু জলাঞ্জলি যাবে ? তখন কি হবে' ? ভূপেনমাঝি আগাইয়া আসিয়া কহিল, 'কত্তা, আমি ভালো করে দেখে নিয়েচি। দড়ি খুলে গেছে বটে, তবে নৌকায় লোক না উঠলে কিচ্ছুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এ নৌকা পড়বে না'। বিধুচরণ ভুরু কুঁচকাইয়া কহিলেন, 'কি করে বলছিস পড়বে না ?
- আজ্ঞে, দড়ি আলগা হয়েছে, কিন্তু বাঁশদুটো তো আর পড়ে যায় নি। সে দুটো এমন ভাবে মাটির সাথে গেঁথে আছে যে এই চাপটুকু বয়ে নিতে পারবে। তবে লোকজন যেন না ওঠে এইটে খেয়াল রাখতে হবে।
- ঠিক বলছিস ?
- আজ্ঞে মা দুগ্গার দিব্যি কত্তা, হলপ করে বলছি। বরং লোকজনদের দূর থেকে দেখাবার ব্যবস্থা করুন। দড়ি বেঁধে দিন, সবাই বাঁদিক থেকে ঠাকুর দর্শন করে ডানদিক দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যাবে।
- বেশ, সে ব্যবস্থা আমরা করছি, তবে নৌকা যদি পড়ে যায় তবে ওই বাঁশ খুলে আমি তোর পিঠে ভাঙব এই বলে দিলুম।
শেখর বলিল, 'আলগা দড়ি আরেকবার বেঁধে দিলেই তো হয়'। ভূপেন কহিল, 'না দাদা, এই অবস্থায় হাত লাগাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে মানুষ আটকাবার ব্যবস্থা করুন'। বিধুচরণ তৎক্ষণাৎ গোরার দিকে ইশারা করিলেন। গোরা ঘাড় নাড়িয়া দৌড়াইয়া দড়ির ব্যবস্থা করিতে গেল।
হরিসভার যেন সমস্ত দিক হইতেই শাপমোচন হইল। 'হেলা নৌকা' র মাহাত্ম্য ছড়াইতে বেশি বিলম্ব হইল না। লোকজনের মুখে মুখে রটিয়া গেল যে হরিসভার 'হেলা নৌকা' তাহাদের অভিনব কুশলী কায়দায় শেষবেলায় আদর্শ পল্লীকে টেক্কা দিয়াছে। এই দুর্দান্ত ও চমৎকার দর্শনীয় বস্তুটি না দেখিলে সমস্তটাই বৃথা। ক্রমে ক্রমে মানুষের আগমন ঘটিতে লাগিল। এবং সকলেরই মুখে একটি প্রশ্নই ঘুরিতে লাগিল যে হরিসভা এই আশ্চর্য হেলানো অবস্থাটি বাস্তবে সম্ভব করিল কি প্রকারে ? কিন্তু সেসকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কেহই দিতে পারিল না। ফলে 'হেলা নৌকা' লইয়া আগ্রহ যেন দিগ্বিদিক ছাপাইয়া গগনচুম্বী হইল। ষষ্ঠীর দিন সকাল হইতে স্রোতের ন্যায় মানুষের ঢল নামিল হরিসভার মাঠে। বিধুচরণ ও ক্লাবের অন্যান্যদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিল। হরিসভার ঘাম ছুটিয়া গেল ভিড় সামাল দিতে দিতে।
বিধুচরণ বিজয়ীর হাসি লইয়া ক্লাবের মধ্যে সকলকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা করিলেন যে এমন আনন্দ উৎসবের মধ্যে তিনি একটি ভোজের ব্যবস্থা করিতেছেন। ক্লাবের সকলেই যেন নিজ নিজ পরিবার লইয়া সপ্তমীর রাত্রে উক্ত ভোজে সামিল হন। সকলেই বিধুচরণের জয়ধ্বনি দিতে লাগিল। সেবু এক কোনে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে জিজ্ঞাসা করিল, 'ইয়ে জ্যেঠু, আমার একটি অনুরোধ আছে'। সকলে সেবুর দিকে আতঙ্কিত হইয়া চাহিয়া রহিল। বিধুচরণ ঘাড় নাড়িয়া কিছু বলিবার পূর্বেই সে আবার বলিয়া উঠিল, 'আমিও এই ভোজে রাঁধুনির সাথে দু একটা পদ রাঁধতে চাই, রাঁধবার আমার ভারী ইচ্ছে....... সেই ছোটোর থেকে..........'। সকলে সমস্বরে গগন বিদীর্ণ করিয়া তাহাকে ধমকাইল, 'সেবুউউউউউ ......' !
#bengalishortstories #durgapujastory #durgapuja
সেবু তাহার জ্যাঠার পরিস্থিতি আঁচ করিয়া বলিয়া উঠিল, 'আচ্ছা জ্যেঠু, জেলেপাড়ার বসুমতীকে চেন' ? বিধুচরণ অবাক হইয়া বলিলেন, 'বসুমতী ? না, চিনি না। কেন, সে কে' ? এ কথায় শেখরের মুখ পাংশু হইয়া গেল। সে বিবাহিত অথচ বেশ কয়েকদিন হইল জেলেপাড়ার বসুমতীর সহিত তাহার একটি সম্পর্ক জমিয়া উঠিয়াছে। একথা মনোহরপুরের কাকপক্ষীও জানে না। তাহা সেবুর গোচরে কি করিয়া আইল এইটা ভাবিয়া শেখর যারপরনাই অস্থির হইয়া উঠিল। কারণ এই সম্পর্ক জানাজানি হইলে তাহার সংসারে কেন গোটা পাড়ায় কুরুক্ষেত্র হইতে বাকি থাকিবে না শেখর তাহা বিলক্ষণ জানে। সেদিকে তাকাইয়া সেবু বলিল, 'না, মানে সে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে তালপুকুরের ধারে চুপটি করে বসে থাকে। কেন ? তুমি জান' ?
বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া দুদিকে মাথা নাড়িলেন। সেবুর কথার গোপন মর্মার্থ তিনি উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। উল্টোদিকে শেখর প্রায় ঘামিয়া স্নান করিয়া গেল। বসুমতীর সাথে তাহার দেখা করিবার স্থান তালপুকুরই বটে। সন্ধ্যের দিকে সে সমস্ত রকম আঁটঘাঁট বাঁধিয়া খুবই সন্তর্পণে বসুমতীর নিকট আসে। তাহাদের প্রেমালাপ করিবার একটি গোপন আস্তানা আছে। আজ অবধি কেউ টের পায় নাই। হতভাগা সেবু কি করিয়া জানিতে পারিয়া আজ মোক্ষম সময়ে সেসব কথা তুলিতেছে। পাড়ার পাঁচজনের সামনে মাথা হেঁট হইয়া যায় বুঝি।
পরিস্থিতি নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া শেখর গলা খাকরাইয়া বলিয়া উঠিল, 'আঃ সেবু, কি সব অবান্তর কথা বলছিস ? হচ্ছিল একটা কাজের কথা, তা নয় যত্তসব অপ্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে। আমাদের আর দেরি করলে চলবে না কিন্তু, সময় বয়ে যাচ্ছে। ঝটপট ভূপেনকে একটা খবর দে দিকি'।
সেবু একগাল হাসিয়া বলিল, 'সে তো আমি এখনই দিতে পারি। কিন্তু আমার কথাটাও একবার.........'। বিধুচরণ ফোঁস করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন। শেখর একবার বিধুচরণের মুখের দিকে তাকাইয়া নিয়া বলিল, 'আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন, চারটে বাঁশ নাহয় তুইই বাঁধিস। ভূপেনকে খবরটা তো দে আগে'। বিধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, 'সে কি কথা শেখর, ওর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা তো সবই জানো। ও যদি কোনো বিপদ ঘটায়, তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারবো না এ আমি আগেই সাফ জানিয়ে রাখলুম'। শেখর স্মিতহাস্যে কহিল, 'আহা সেবুর ইচ্ছে হয়েছে যখন, একটু প্যাণ্ডেলের কাজ করল নাহয়। ছোটবেলার শখ বলছে তো, করুক না একটু। আমাদেরও তো কতসময় কতরকম শখ জাগে, তাই না ? ও কিছু না। আপনি আর এ নিয়ে আপত্তি করবেন না মিত্রমশাই। সেবু তো আমাদেরই ঘরের ছেলে, কি সেবু এবার খুশি তো' ?
সেবু মহানন্দে তাহার দন্ত কপাটি বাহির করিল। বিধুচরণ বলিলেন, 'বেশ, তবে তাই হোক। তুমি পুজোর সেক্রেটারি হয়ে যখন বলছ তখন আর আমার আপত্তি করবার কিছু নেই'। এই কথাটি বলিয়াই তিনি হঠাৎ সেবুর দিকে ঘুরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তবে, তুই বসুমতী না কার যেন কি একটা কথা বলছিলি' ? সেবু চটপট হাত নাড়িয়া বলিল, 'না না সেসব কিছু না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমি বরং যাই, চানটা করে নিয়ে ভূপেন মাঝি কে খবরটা দিই গে যাই'। বলিয়াই সে ছুটিয়া ঘর হইতে অন্তর্ধান হইল। বিধুচরণ চক্ষু বুজিয়া কহিলেন, 'হরি হে ! কখন যে তোমার কি ইচ্ছে........ '।
দেখিতে দেখিতে দেড়মাস কাটিয়া গেল। প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষের পথে। ভূপেন মাঝি ও তার দলবল ঝড়ের গতিতে কাজ করিতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের মতো দুর্দান্ত আকার না হইলেও হরিসভার নৌকার আদলটা মোটামুটি হইয়াছে। যদিও গোটা নৌকা বানাইবার দরকার পড়ে নাই। সামনের দিকটায় চমৎকার একটা বজরার রূপ দিয়া পিছন দিকটায় ছোট করিয়া হাল বাঁধিয়া দিয়াছে। সামনে দাঁড়াইলে নৌকার ছাউনি ও মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাইবে। কিন্তু সেসব ছাপাইয়া যাহা চোখে পড়িবার মতো তাহা হইল সেবুর উৎসাহ ও কাজ করিবার উদ্দীপনা। বাঁশ বাঁধা, কাঁচা মালের আনা নেওয়া করা, মিস্ত্রিদের খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছুই সে নিজের হাতে দেখিতেছে। বোঝা যাইতেছে তাহার শখ পূরণের সমস্ত রসটুকু সে পরম তৃপ্তিতে আস্বাদন করিতেছে। সময়ে অসময়ে বিধুচরণ, শেখর, গোরা ও ক্লাবের বাকিরা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী সমস্ত কাজই তদারকি করিতেছেন।
পরের এক সপ্তাহে বাকি সমস্ত কাজই নিয়মমাফিক চলিয়া শেষ হইয়া গেল। প্যাণ্ডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেল। কিন্তু কেহ জানিতে পারিল না নৌকার পিছন দিকে এক ভীষণরকম কালসর্পের যোগ ঘটিয়াছে। সেটি কি তাহা পরে বলিতেছি। এদিকে ইতিমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটিল। যাহারা মনোহরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা তাহারা নিত্য আসা যাওয়ার পথে সকলেই সচক্ষে দেখিতে পাইতেছিলেন যে কোন প্যাণ্ডেলটি কিরূপ প্রস্তুত হইতেছে। আদর্শ পল্লীর উড়োজাহাজের অপেক্ষা হরিসভার নৌকা যে উত্তম কিছু হইতেছে না এ তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিলেন। হরিসভার নৌকা ধারে ও ভারে কোনোপ্রকারেই উড়োজাহাজকে টেক্কা দিতে পারিতেছিল না। তাহার কারণ উড়োজাহাজটি দুতলা সমান পেল্লাই হইয়াছিল এবং দেখিতে অবিকল আসল উড়োজাহাজের মতোই লাগিতেছিল। সেখানে হরিসভার নৌকাটি মোটের উপর চলনসই হইয়াছিল। সুতরাং ধীরে ধীরে এরকম একটি বার্তা রটিয়া গেল যে এবার হরিসভা তেমন কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের সমস্ত কর্মকর্তাদের নিকট অনুরূপ সংবাদ পৌঁছাইল। এহেন পীড়াদায়ী জনশ্রুতিতে সকলেই প্রায় ভাঙিয়া পড়িলেন। বিধুচরণও কঠিন মনকষ্টে ভুগিতে লাগিলেন। পুজো লইয়া তাহার সমস্ত উদ্দীপনা ধূম্রের ন্যায় মিলাইয়া যাইতে লাগিল।
তবুও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের যথাবিধি নিয়ম পালন করিতে হইবে। তাই ক্লাবের মধ্যে ঠিক হইল চতুর্থীর দিন প্রতিমা আনা হইবে ও পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় পাঁজির সময়ানুসারে বিধুচরণ ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উদ্বোধন করিবেন।
যথাসময়ে পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যাবেলা সকলে ক্লাবের মাঠে উপস্থিত হইলেন। মণ্ডপের সামনে একটি বিশাল ত্রিপল খাটাইয়া রাখা হইয়াছে। সামান্য কিছু উৎসুক জনতাও মাঠের ধারে জড়ো হইল। কারণ বেশিরভাগ মানুষই উড়োজাহাজের দিকে উড়িয়া গিয়াছেন। বিধুচরণ শ্বেতশুভ্র ধাক্কা পাড়ের ধুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরিহিত হইয়া ব্যথিত হৃদয়ে ক্লাবে পদার্পন করিলেন। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝা যাইতেছিল যেন তিনি এক কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন। মাঠ প্রায় জনশূন্য দেখিয়া তিনি আরও হতোদ্যম হইয়া পড়িলেন। অন্যান্য বৎসর গুলিতে যেখানে উদ্বোধনের দিন একেবারে লোক ভাঙিয়া পড়িত, আজ সেখানে ছন্নছাড়া কয়েকজন আসিয়াছে। ক্লাবের অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইয়া মণ্ডপে লইয়া আনিলেন। ঢাকিরা আগে হইতেই প্রস্তুত ছিল। তাহারা বিধুচরণকে দেখিয়া একসাথে ঢাক বাজাইতে শুরু করিল। কিন্তু সে ঢাকের আওয়াজও কেমন যেন করুণ প্রাণ মনে হইল। পাড়ার কয়েকজন মহিলা উলুধ্বনি দিয়া ও মঙ্গলশঙ্খ বাজাইয়া কোনোমতে বিলীন উৎসাহটুকু জাগাইয়া রাখিলেন।
ত্রিপল সরাইয়া, পঞ্চপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিয়া পুজোর উদ্বোধন হইবে। বিধুচরণ একটি গম্ভীর নিঃশ্বাস ছাড়িয়া রশি টানিয়া ত্রিপল সরাইয়া মণ্ডপ উন্মোচন করিলেন। তাহার পর পঞ্চপ্রদীপে আলো সঞ্চার করিয়া মণ্ডপের সিঁড়ির নিকটে আসিলেন। ইতস্তত দু একটি হাততালির শব্দ শোনা গেল। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বিধুচরণ মণ্ডপে উঠিতে গিয়া থমকাইয়া গেলেন। মণ্ডপের দিকে চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া গেল। তিনি শ্বাসরুদ্ধ করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া ক্লাবের বাকিরাও মণ্ডপের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাহাদের হৃদপিণ্ড প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেল।
দেখা গেল নৌকারূপী মণ্ডপটি ডানদিকে বেশ কিছুটা হেলিয়া কাত হইয়া গিয়াছে। কতকটা পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো। পড়িয়া যায় নাই এই রক্ষে, কিন্তু পড়িয়া যাইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। বিধুচরণ কোনো কথা কহিতে পারিলেন না প্রথমটায়। ধীরে ধীরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন অগ্নি নিক্ষেপ হইতে লাগিল। চরম ক্রোধে তিনি থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। পাশে দাঁড়ানো শেখরকে চাপাস্বরে ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'এটা কি ? এ কি করে হল' ? শেখরের প্রায় অজ্ঞান হইবার উপক্রম হইল। সে সভয়ে কহিল, 'আজ্ঞে, সকাল অবধি তো সোজাই দাঁড়িয়েছিল এখন যে কি করে হেলে গেল জানি না'। বিধুচরণ অগ্নিনেত্রে বাকিদের থেকে ইশারায় জানিতে চাহিলেন যে ব্যাপারখানা কি। কিন্তু কেউই কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিল না। ভূপেন মাঝি কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সেও চক্ষু গোলগোল করিয়া তাকাইয়া ছিল তাহার সাধের নৌকার দিকে। বিধুচরণ তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিতে টানিতে মণ্ডপের অনতিদূরে লইয়া গিয়া কহিলেন, 'এসবের মানে কি ভূপেন ? এটা কি মস্করা হচ্ছে ? নৌকা এতো হেলে গেল কি করে' ? ভূপেন মাঝি মিনমিন করিয়া কহিল, 'আজ্ঞে মিত্রমশাই আ-আমি সত্যি কিছু জানি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলুম আমি। আজ সকালেও দেখেছি, তখন তো কিচ্ছুটি হয় নি'।
'ন্যাকা সাজছিস তুই ? সকালেও দেখেছি ? তাহলে কি বিকেলে উঠে সমুদ্রে জাল ফেলেছিস মাছ ধরবি বলে, যে নৌকা হেলে গেল' ? বিধুচরণ ক্রোধান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন। ভূপেন হাঁউমাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। বিধুচরণ আবার কহিলেন, 'সত্যি করে বল ভূপি, কি করে হল নইলে তোকে আমি এই মাঠে জ্যান্ত পুঁতব বলে রাখলুম'। ভূপেন ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল ,'আজ্ঞে, আমায় একটু সময় দিন কত্তা, আমি একবার পিছনদিকটা দেখে আসি'। বলিয়াই সে ছুটিয়া নৌকার পিছন দিকে চলিয়া গেল। কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া সে আবার ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, 'আজ্ঞে হালের দিকে দুটো বাঁশ আলগা বাঁধা হয়েছে কত্তা, দড়ি হড়কে গিয়ে বাঁশ কাত হয়ে গেছে, তাই নৌকাও হেলে গেছে খানিক'।
'আলগা বাঁধা হয়েছে মানে ? কেন, বাঁধার সময় তুমি কি কেষ্টঠাকুরের লীলে দেখছিলে বজ্জাত' ? বিধুচরণ অগ্নিশর্মা হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন। ভূপেন কুঁই কুঁই করিয়া বলিল, 'আজ্ঞে ওই বাঁশদুটো আমি সেবুকে বাঁধতে দিয়েছিলুম। ঐটে বাঁধবে বলে সে খুবই জোড়াজুড়ি করে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই..........'। সেবু কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, 'হ্যাঁ, আমিই বেঁধেছিলুম বটে, কিন্তু আমি ভূপেনদার কথামতো ঘন্টাকেও দেখিয়ে নিয়েছিলুম। সে বলেছিল ঠিক আছে'। বিধুচরণ স্তব্ধ হইয়া গেলেন একথা শুনে। তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।
ঘটনাটা ঠিক কি হইয়াছিল তাহা বলি এখন পাঠকদের।
সেবুর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখিয়া ভূপেন তাহাকে দুটি বাঁশ বাঁধিতে দিয়াছিল। কাজটি ছিল এই যে হালের দিকটায় একটি বাঁশের সহিত আরেকটি বাঁশ কায়দা করিয়া বাঁধিতে হইবে। তাহার সহিত একজন কারিগরকেও রাখিয়াছিল পুরোটা ভালো করিয়া দেখিয়া লইবার জন্য। তাহার নাম ঘন্টা। কিন্তু মুশকিল হইল, সন্ধ্যে হইলেই ঘন্টা গাঁজা ও কল্কের মায়ায় জড়াইয়া পড়ে। তখন আশেপাশে বোমা মারিলেও ঘন্টার ঘড়িতে কিছুমাত্র বিকার ঘটে না। সেবুর দুইটা বাঁশ বাঁধিতে সেদিন সন্ধ্যে হইয়া গিয়াছিল। কাজের শেষে সে ঘন্টাকে ডাকিয়া লইয়া ভালো করিয়া দেখাইয়াছিল। তুমুল নেশার চোটে ঘন্টা তখন চোখ খুলিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। ফলে সে বুঝিতে পারে নাই যে বাঁশ দুইটি একেবারে আলগা বাঁধা হইয়াছে। কতকটা হামাগুড়ি দিয়া সে দড়ির উপর হাত বুলাইয়াই জড়ানো কণ্ঠে বলিয়াছিল, 'ঠিক আছে, বেশ বাঁধা হয়েছে'। নানান কাজের মধ্যে ভূপেনেরও পুরোটা ভালো করিয়া দেখা হয় নাই। এখন সময়কালে এই ভয়ঙ্কর বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
সেবুর মুখে ঘন্টার কথা শুনিয়া সকলেই একপ্রকার বিপদের ঘন্টাধ্বনি শুনিতে পাইলেন। কে কি বলিবে কেহ ভাবিয়া পাইলেন না। আশেপাশে কোথাও ঘণ্টাকেও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে যে জনতা দূরে জড়ো হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে এক অদ্ভুত গুঞ্জন শুরু হইল। সে গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়িয়া এক আশ্চর্য রূপ লইতে লাগিল। কারণ তাহারা কেহ জানিতে পারে নাই যে নৌকার এমন দুর্দশা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটিয়াছে। তাহারা ভাবিতে লাগিল, এইটি বোধহয় হরিসভা ক্লাবের শেষবেলার চমক, তুরুপের তাস। একেবারে অন্তিমলগ্নে আস্তিন হইতে বাহির করিয়াছে আদর্শ পল্লীকে মাত দিবে বলিয়া। এবং এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখিয়া তাহারা একেবারে হাঁ হইয়া গেল। তাহার কারণ হইল এই যে নৌকাটি হেলিয়া থাকিবার ফলে এক অদ্ভুত বাস্তব রূপ লইয়াছে। দূর হইতে দেখিলে মনে হইবে যে তুমুল ঝড়ের মধ্যে নৌকাটি কোনোপ্রকারে হেলিয়া গিয়া শেষ অবধি বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। সঙ্গে জলরাশির আবহশব্দ, মৃদু আলোর খেলা ও সন্ধ্যার মেঘাবৃত আকাশের মেলবন্ধনে গোটা ব্যাপারখানায় যেন এক মায়াবী দৃশ্যপট প্রস্তুত হইয়াছে। তাহাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিবার পর কয়েকটি উক্তি এধার ওধার থেকে উড়িয়া আসিতে লাগিল। যেমন সপত্নী সাগর ডাক্তার কহিলেন, 'ইট্স ওয়ান্ডারফুল ! এমেজিং' ! বাংলার শিক্ষক হলধর সামন্ত বলিলেন, 'দুর্দান্ত ! ওস্তাদের মার শেষরাতে'। মধু স্যাকরা বলিয়া উঠিল, 'কেয়াবাৎ ! শেষবেলায় হরিসভা কিন্তু দেখিয়ে দিলে'। কিছু কচিকাঁচার দল সহর্ষে হাততালি দিয়া উঠিল। উপস্থিত দর্শক সকলেই হরিসভার সৃজনী পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
বিধুচরণ ও তাঁহার দলবল হকচকিয়ে গেলেন। এ কি হইল ! যে মাঠ কিয়দকাল আগে পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ও স্বপ্নভঙ্গের আঁধারে ডুবিয়া যাইতেছিল এখন সেখানেই উল্লাস ও উৎসবের আলো জ্বলিতেছে ! বিধুচরণ চকিতে পুরোটা আঁচ করিয়া ক্লাবকর্তাদের বলিলেন, 'আমাদের শীঘ্রই এটা সামাল দিতে হবে। লোকজন যদি নৌকায় উঠে পড়ে তাহলে তো সবশুদ্ধু জলাঞ্জলি যাবে ? তখন কি হবে' ? ভূপেনমাঝি আগাইয়া আসিয়া কহিল, 'কত্তা, আমি ভালো করে দেখে নিয়েচি। দড়ি খুলে গেছে বটে, তবে নৌকায় লোক না উঠলে কিচ্ছুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এ নৌকা পড়বে না'। বিধুচরণ ভুরু কুঁচকাইয়া কহিলেন, 'কি করে বলছিস পড়বে না ?
- আজ্ঞে, দড়ি আলগা হয়েছে, কিন্তু বাঁশদুটো তো আর পড়ে যায় নি। সে দুটো এমন ভাবে মাটির সাথে গেঁথে আছে যে এই চাপটুকু বয়ে নিতে পারবে। তবে লোকজন যেন না ওঠে এইটে খেয়াল রাখতে হবে।
- ঠিক বলছিস ?
- আজ্ঞে মা দুগ্গার দিব্যি কত্তা, হলপ করে বলছি। বরং লোকজনদের দূর থেকে দেখাবার ব্যবস্থা করুন। দড়ি বেঁধে দিন, সবাই বাঁদিক থেকে ঠাকুর দর্শন করে ডানদিক দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যাবে।
- বেশ, সে ব্যবস্থা আমরা করছি, তবে নৌকা যদি পড়ে যায় তবে ওই বাঁশ খুলে আমি তোর পিঠে ভাঙব এই বলে দিলুম।
শেখর বলিল, 'আলগা দড়ি আরেকবার বেঁধে দিলেই তো হয়'। ভূপেন কহিল, 'না দাদা, এই অবস্থায় হাত লাগাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে মানুষ আটকাবার ব্যবস্থা করুন'। বিধুচরণ তৎক্ষণাৎ গোরার দিকে ইশারা করিলেন। গোরা ঘাড় নাড়িয়া দৌড়াইয়া দড়ির ব্যবস্থা করিতে গেল।
হরিসভার যেন সমস্ত দিক হইতেই শাপমোচন হইল। 'হেলা নৌকা' র মাহাত্ম্য ছড়াইতে বেশি বিলম্ব হইল না। লোকজনের মুখে মুখে রটিয়া গেল যে হরিসভার 'হেলা নৌকা' তাহাদের অভিনব কুশলী কায়দায় শেষবেলায় আদর্শ পল্লীকে টেক্কা দিয়াছে। এই দুর্দান্ত ও চমৎকার দর্শনীয় বস্তুটি না দেখিলে সমস্তটাই বৃথা। ক্রমে ক্রমে মানুষের আগমন ঘটিতে লাগিল। এবং সকলেরই মুখে একটি প্রশ্নই ঘুরিতে লাগিল যে হরিসভা এই আশ্চর্য হেলানো অবস্থাটি বাস্তবে সম্ভব করিল কি প্রকারে ? কিন্তু সেসকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কেহই দিতে পারিল না। ফলে 'হেলা নৌকা' লইয়া আগ্রহ যেন দিগ্বিদিক ছাপাইয়া গগনচুম্বী হইল। ষষ্ঠীর দিন সকাল হইতে স্রোতের ন্যায় মানুষের ঢল নামিল হরিসভার মাঠে। বিধুচরণ ও ক্লাবের অন্যান্যদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিল। হরিসভার ঘাম ছুটিয়া গেল ভিড় সামাল দিতে দিতে।
বিধুচরণ বিজয়ীর হাসি লইয়া ক্লাবের মধ্যে সকলকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা করিলেন যে এমন আনন্দ উৎসবের মধ্যে তিনি একটি ভোজের ব্যবস্থা করিতেছেন। ক্লাবের সকলেই যেন নিজ নিজ পরিবার লইয়া সপ্তমীর রাত্রে উক্ত ভোজে সামিল হন। সকলেই বিধুচরণের জয়ধ্বনি দিতে লাগিল। সেবু এক কোনে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে জিজ্ঞাসা করিল, 'ইয়ে জ্যেঠু, আমার একটি অনুরোধ আছে'। সকলে সেবুর দিকে আতঙ্কিত হইয়া চাহিয়া রহিল। বিধুচরণ ঘাড় নাড়িয়া কিছু বলিবার পূর্বেই সে আবার বলিয়া উঠিল, 'আমিও এই ভোজে রাঁধুনির সাথে দু একটা পদ রাঁধতে চাই, রাঁধবার আমার ভারী ইচ্ছে....... সেই ছোটোর থেকে..........'। সকলে সমস্বরে গগন বিদীর্ণ করিয়া তাহাকে ধমকাইল, 'সেবুউউউউউ ......' !
![]() |
| চিত্র বিন্যাস : নিজস্ব |
Monday, September 18, 2017
সাপ্তাহিকী ৩১ # সেবুর প্যাণ্ডেল - প্রথম পর্ব
সেবু বড় আমুদে ছেলে। হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়া সে সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে উঠিয়াছে। রক্ত তাহার গরম। সে করিতে পারে না বিশ্ব সংসারে এমন কোনো কাজ নাই। অন্তত সে নিজে তাহাই বিশ্বাস করে। অবশ্য তাহার এই অতি চাঞ্চল্য শুধু তাহাকে নয় সময় বিশেষে তাহার বাড়ির লোকজনকেও যথেষ্ট বিপাকে ফেলিয়াছে। তাহার একমাত্র কারণ হইল সেবু ভারী পরোপকার করিতে ভালোবাসে। সে উপকার লোকের প্রয়োজনে লাগুক চাই না লাগুক সমাজসেবার নূন্যতম উপায় দেখিলেই সেবুকে ধরিয়া রাখা মুশকিল। যেন তেন প্রকারেন সেবুকে সে কাজ করিতেই হইবে। তাহাতে অধিকাংশ সময়ই অর্থের বিনিময়ে সেবুর জ্যাঠাকে সেসব অনর্থের মূল্য চোকাইতে হইয়াছে। কিন্তু ভবি ভুলিবার নহে।
এখানে বলিয়া রাখা ভালো, সেবুর বাড়িতে তাহার বাবা মা থাকিলেও বাড়ির গার্জেন হিসেবে তাহার জ্যাঠা অর্থাৎ বিধুচরণ মিত্রকে সে বেশ সমঝিয়া চলে। বিধুচরণ মনোহরপুরের নামকরা উকিল ও স্থানীয় ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। এলাকায় তাঁহার প্রতিপত্তি যথেষ্ট। বিয়ে থা করেননি। নিজে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়াছেন ও ছোট ভাইটিকেও শিখাইয়াছেন। ছোট ভাই স্কুলমাষ্টার বিদ্যাচরণ ও ভাতৃবধূ সরলা দুজনেই তাঁহাকে পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। বিদ্যাচরণ ও সরলার যখন পুত্রসন্তান হইল বিধুচরণ তখন তাহার নাম রাখিলেন সেবাব্রত। কিন্তু সেবাব্রত যে বড় হইয়া তাহার নামের প্রতি সুনাম বজায় রাখিতে তৎপর হইয়া উঠিবে তাহা তিনি ঘুনাক্ষরেও টের পান নাই। অথচ সেবুর বাবা মা হইতে তিনি সেবুকে অধিক স্নেহ করেন এবং কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ও দেন। এ যাবৎ সেবুর সমস্ত রকম বায়নাক্কা তিনিই স্মিতহাস্যে মিটিয়া আসিয়াছেন।
বিদ্যাচরণ দাদাকে এ বিষয় বলিতে গেলেই তিনি বলেন, 'আহা ! সেবু আমার আরজন্মের সন্তান, এই জন্মে তোদের কোলে এসেছে, ওকে কি আমি কিছু বলতে পারি' ? বিদ্যাচরণ তাহার দাদাকে নিরস্ত করিতে চায়, বলে, 'এ তোমার ভারী অন্যায় দাদা, ও চাদ্দিকে যা নয় তাই করে বেড়াচ্ছে, সে খবর তো পাও। কত জায়গায় নাজেহাল হতে হয়েছে বলত আমাদের, তাও কি তুমি ওমন চোখ বুজে থাকবে, একটুও শাসন করবে না ভাইপো কে' ? এ কথায় বিধুচরণ বলেন, 'তোরা করছিস তো শাসন, তাতে হচ্চে না ? আমাকেও লাগবে' ? বিদ্যাচরণ তৎক্ষণাৎ বলে, 'ও কি তোমাকে ছাড়া কারোর কথা শোনে না পাত্তা দেয় যে আমরা বললেই একেবারে বাধ্য ছেলের মতো ঘরে চুপটি করে বসবে' ? বিধুচরণ নিরুত্তর থাকেন, চুপ করিয়া চক্ষু বুজিয়া বারান্দার আরাম কেদারায় দোল খাইতে থাকেন। এই ধরণের বাক্যালাপ সাধারণত বেশিক্ষন গড়ায় না কোনোদিনই। বিদ্যাচরণও বিরক্ত হইয়া উঠিয়া চলিয়া যায়।
এ কথা সত্য যে সেবুর কান্ডকারখানায় পাড়াসুদ্ধু মানুষ ত্রস্ত। সে যে কখন কি করিয়া বসে তাহার ঠিক নাই। এই যেমন গত মাঘে চণ্ডীতলার মাঠে ফুটবল খেলার আয়োজন হইয়াছিল। সেখানে সেবু নিজে না খেলিয়া ক্লাবের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ধরিয়া একটি ম্যাচে রেফারি হইয়াছিল। সে বিশেষ কিছু করে নাই শুধু দুইটি ভুল পেনাল্টি দিয়াছিল। যাহার ফলে পাড়ার ক্লাব সেবার দুটি গোল বেশি খাইয়া লীগ হইতে একেবারে বাহির হইয়া যায়। ক্লাবের প্রেসিডেন্টের পদে বিধুচরণ ছিলেন বলিয়া সে যাত্রা সেবু কোনোমতে পার পাইয়া যায়। নয়ত ঠিক হইয়াছিল পাড়ার মোড়ে সেবুকে কান ধরিয়া গুনে গুনে পঞ্চাশ বার ওঠবস করিতে হইবে এবং গোবর মাখিয়া নিজের হাতে একশত ঘুঁটে প্রস্তুত করিতে হইবে। তাহার জ্যেঠু ক্লাবের ছেলেদেরকে বসিয়া পাঁঠার মাংসভাত খাওয়াইবার ব্যবস্থা করাইতে তবে তাহারা ক্ষান্ত হয়। এমন লঙ্কাকাণ্ড আরও আছে তবে সেসব বলিতে গেলে নূতন করে রামায়ণ রচনা করিতে হইবে।
যাহা হউক, তাহার পর হইতে সেবু খানিক দমিলেও সময়ানুক্রমে তাহার এই পরোপকারের পোকাটা নড়িয়া ওঠে মাঝে মাঝেই। এমনই একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলি।
শ্রাবন মাস। পুজোর আর বেশি দেরি নাই। মনোহরপুর তো বটেই আশেপাশের তল্লাটেও একেবারে সাজসাজ রব পড়িয়া গিয়াছে। মেঘলা আকাশে রোদের লুকোচুরিতে মানুষের মনে আগমনীর ছোঁয়া কাশফুলের মতোই দোদুল্যমান। রবিবারের বিকেল। বিধুচরণ তাহার বাড়ির বৈঠকখানায় ক্লাবের কর্তা ব্যক্তিদের সহিত আসন্ন শারদ উৎসব লইয়া আলোচনা করিতেছেন। মনোহরপুর সম্বন্ধে যাহারা খোঁজ খবর রাখেন তাহারা জানেন মনোহরপুরে মহা আড়ম্বরে দুইটি বড় পূজা হয়। বিধুচরণদের ক্লাব - 'হরিসভা' এবং 'আদর্শ পল্লী'। এই দুইটি ক্লাবের মধ্যে রেষারেষিও চরম হইয়া থাকে। কে কাহাকে কিভাবে টেক্কা দিবে তাহা লইয়া বহুদূর অবধি জল গড়ায়। প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জা, আলো ও আবহশব্দের মিশেলে দুইটা পুজোই দেখিবার মতো এক একখানা বস্তু তৈরী হয় বটে। আশেপাশের অঞ্চল তো বটেই বহুদূর হইতেও শয়ে শয়ে মানুষ জমা হয় এই আশ্চর্য কাণ্ডদ্বয় সচক্ষে দেখিবে বলিয়া। তাহার উপর আবার প্রাইজের হাতছানি রহিয়াছে। এ যাবৎ হরিসভা সর্বাধিক বার ফার্স্ট প্রাইজ পাইয়া ক্লাবের ও বিধুচরণের সুনাম বজায় রাখিয়াছে। কিন্তু এই বছরের পুজো লইয়া সকলেই একটু বেশি চিন্তিত। তাহার কারণ হইল এই, যে খবর পাওয়া গিয়াছে এই বৎসর আদর্শ পল্লী নাকি উড়োজাহাজ বানাইবে। শহর হইতে নামকরা কারিগর ও দক্ষ মিস্ত্রী লইয়া তাহারা অতিপূর্বেই তাহাদের কাজ আরম্ভ করিয়াছে। জনান্তিকে শোনা যাইতেছে, যেরূপ গতি ও লক্ষ্য লইয়া আদর্শ পল্লী অগ্রসর হইতেছে তাহাতে তাহারা একেবারে ফার্স্ট প্রাইজটি লইয়া তবে থামিবে।
স্বভাবতই বৈঠকখানায় হরিসভার কর্মকর্তাদের মুখ তমসাচ্ছন্ন হইয়া আছে। সকলেই বিধুচরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বসিয়া আছেন। এই সংকট মুহূর্তে তাঁহাদের একমাত্র ভরসা তিনিই কারণ তাঁহার বুদ্ধি ও অর্থের উপরই নির্ভর করিবে এই বৎসর হরিসভার কি থিম হইবে। অথচ বিধুচরণ তাহার সাধের তক্তপোশের ওপর বসিয়া নির্বিকার তামাক সেবন করিতেছেন। কোনো কথা কহিতেছেন না। ক্লাবের সেক্রেটারী মাঝবয়েসী শেখর চৌধুরী নিরুপায় হইয়া বলিয়া উঠিলেন, 'মিত্রমশাই কিছু বলুন, আমরা তো কোনো হদিসই পাচ্ছিনা। তেমন কিছু না হলে আদর্শ পল্লীকে ঠেকানো মুশকিল হবে এবার'। বিধুচরণ তাহার তামাকের নলটি একপাশে সরাইয়া রাখিয়া খানিক দাবড়ানির স্বরে কহিলেন, 'দ্যাখো শেখর, তুমি বলছ বিশ্বেশ্বরের মন্দির করবে আর গোরা বলছে তাজমহল বানাবে। বলি তারপর কি দুজন সেক্রেটারি আর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিলে শিবঠাকুর আর শাজাহান হয়ে বটতলার মোড়ে বিড়ি ফুঁকবে ? কি ভেবেছ কি ? টাকাটা আসবে কোত্থেকে শুনি, য়্যাঁ ?
'আজ্ঞে টাকাটা যদি আমরা সবাই মিলে এ বছর একটু বেশি করে তুলি, তাহলে' ? গোরা মিনমিন করিয়া জিজ্ঞেস করে। বিধুচরণ ব্যঙ্গ করিয়া বলেন, 'টাকা কি শিউলি ফুল, যে কাছে গেলাম আর টুক করে তুলে নিলাম। চাঁদা বাড়ালেই যে সবাই রাজি হবে তাতো আর নয়। দিনকাল যা পড়েছে তাতে ট্যাক্সোর ঠেলায় মানুষ পাজামা ছেড়ে হাফ প্যান্টে নেমে এসেছে আর তুমি বলছ বেশি করে টাকা তুলি, হুঁহ' ।
শেখর আমতা আমতা করিয়া জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে উপায়' ? বিধুচরণ বলেন, 'সে কিছুটা নাহয় আমিই দিলাম আর কিছুটা চাঁদা উঠলো, কিন্তু বাকিটা ? তার কি কোনো উপায় ভেবেছ' ? বিজন মুখ বাড়াইয়া বলে, 'আজ্ঞে স্পনসর জোগাড় করতে পারলেই কিন্তু অনেকটাই.......... ' ।
কথাটা শেষ করিতে দেন না বিধুচরণ,ধমক দিয়া বলেন, 'গন্ডমূর্খের মতো কথা বোলো না বিজন, এটা কলকাতা নয় যে কোম্পানিগুলো একমাস আগে থেকেই সারিবাঁধা বাঁশের ওপর লাফিয়ে উঠে বসে পড়বে। এটা মনোহরপুর এখানে নিজেদের টাকা নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে সেটা মাথায় রাখো'। এ কথায় বিজন ও অন্যান্যরা মুষড়িয়া পড়িল। বিধুচরণ আবার বলিয়া উঠিলেন, 'ওহে বিজন, তুমি তো ক্যাশিয়ার, হিসেবে করে বলো দিকি, বাকি টাকার অঙ্কটা ঠিক কত' ? সে ব্যস্ত হইয়া খাতাপত্র খুলিয়া বলিল, 'আজ্ঞে সর্বসাকুল্যে লাখখানেক মতো কম পড়ছে' ।
বিধুচরণ গম্ভীর মুখে বলিলেন, 'নাহ, তাহলে বিশেষ কিছু করা যাবে না দেখছি। কম বাজেটের মধ্যে কিছু একটা ভাবা হোক'।
এ কথায় সকলেই মাথা চুলকাইতে লাগিল। আদর্শ পল্লী কে টক্কর দিবার মতো তেমন কিছু কারোরই মাথায় আসিল না। সবাই এর ওর মুখের দিকে দেখিতে লাগিল। নানারকম ইশারা করিতে লাগিল কিন্তু কাজের কাজ কিছু হইল না। বিকেল গড়াইয়া সন্ধ্যা নামিল।
এমন সময় বিজন ঘরের দক্ষিণ দিকে আঙুল তুলিয়া কি একটা দেখাইয়া ভূ.... ভূ....করিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িয়া দিল। তাহার চিৎকারে উপস্থিত সকলেই চমকাইয়া সে দিকে মুখ তুলিয়া তাকাইল। যাহা দেখিল তাহাতে সবারই পিলে ছাদ ফুঁড়িয়া লাফাইয়া উঠিল প্রায়। একটি ঘন কালো বিটকেল মূর্তি তাহাদের দিকে চাহিয়া দাঁত বার করিয়া হাসিতেছে। কিছুক্ষন পর সেই মূর্তি কথা কহিয়া উঠিল। 'কি গো বিজন দাদা, ভয় পেলে নাকি গো ? আমায় চিনতে পারোনি' ? তাহার গলার স্বর বিধুচরণ চিনিতে পারিয়া কহিলেন, 'এ কিরেএএএ ? সেবু ! একি দশা করেছিস নিজের ! এতো পাঁক মেখে এলি কোথা থেকে' ? ঘরের সকলেই 'সেবু' নামটি শুনিয়া ধড়ে প্রাণ ফিরিয়া পাইল। সেবু ঠিক তেমনই দাঁত বাহির করিয়া বলিল, 'ওই ঘোষেদের বাগানে পেয়ারা পাড়তে উঠেছিলুম, পা ফস্কে পাশের ডোবাটায় পড়ে গেছিলুম আর কি' ?
- ছিছিছি সেবু, এতো বয়সেও তুই পেয়ারা চুরি করে খাচ্ছিস ? কেন শীতলকে বললে অমনি দুটো পেয়ারা তোকে পেড়ে দিতে পারতে না যে তুই একেবারে গাছে উঠে চুরি করতে গেলি ?
- না জ্যেঠু, শীতল ঘোষ ভারী নচ্ছার লোক, পেয়ারা চাইতে গেলে দুকথা শুনিয়ে দেয়.....
ঘরের মধ্যে উপস্থিত গোরা ঘোষের মুখচোখ শক্ত হইয়া গেল। তাহারই সামনে সেবু তাহার বাবাকেই গালাগাল করিতেছে । সে দিকে এক নজর দিয়া বিধুচরণ সেবুকে ধমকাইলেন, 'ছিঃ সেবু, ওকি মুখের ভাষা ? গুরুজনের প্রতি সম্মান রাখা উচিৎ। তাছাড়া তুমি পেয়ারা চুরি করে মোটেও ঠিক করোনি, পারলে সেগুলো ফেরত দাও এক্ষুনি'। সেবু ব্যাজার মুখ করিয়া প্যান্টের দুই পকেট হইতে দুটা প্রমান সাইজের পেয়ারা বাহির করিয়া গোরার সামনে ধরিল। পাঁকমাখা দুইটা পেয়ারা গোরা ফিরিয়া লইতে চাহিল না। নাকে হাত দিয়া কহিল, 'থাক থাক, ছোট ছেলে পেড়ে এনেছে যখন, খাগ্গে, ও কি আর এমন' ? সেবু কঠিনস্বরে কহিল, 'না, জ্যাঠামশায়ের হুকুম, ও তোমায় নিতেই হবে'। গোরা করুণমুখে বিধুচরণের মুখের দিকে একবার চাহিয়া কহিল, 'আচ্ছা আচ্ছা রেখে দে এখন, যাবার সময় নিয়ে যাব'।
পেয়ারাগুলো যথাস্থানে রাখিয়া সেবু একগাল হাসিয়া কহিল, 'তা তোমাদের কি আলোচনা হচ্ছিল ? আদর্শ পল্লী নিয়ে কি একটা শুনলুম যেন' ?বিধুচরণ চিন্তান্বিত হইয়া বলিলেন, 'হ্যাঁ, আদর্শ পল্লী এবার যা প্যান্ডেল করছে তাতে করে আমাদের ঠাকুর দেখতে আর তেমন ভিড় হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া বিরাট কিছু করবার টাকাও নেই আমাদের। কি করে যে সমস্ত দিক ব্যবস্থা করি সেটা ভেবেই আর কুলকিনারা পাচ্ছি না....' ?
'শুনলুম তারা নাকি উড়োজাহাজ করছে' ? সেবু জিজ্ঞাসা করে।
- হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিস.......
সেবু চটপট কহিল, 'তা বেশ তো। তোমরা বরং একটা পালতোলা নৌকো করো। ওদেরটা আকাশের আর আমাদেরটা জলের। সমানে সমানে লড়াই হবে। তাছাড়া নৌকো তৈরীর খরচও বিশাল নয়'। সবাই যে যার মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতে লাগিল। অর্থাৎ প্রস্তাবটা যে খুব একটা মন্দ নয় তার আভাস সকলেরই মুখেচোখে খানিক খেলিয়া গেল। বিজন ব্যস্ত হইয়া বলিল, 'সে কিরকম' ? বাকিরাও উৎসুক মুখে সেবুর দিকে চাহিয়া রহিল। সেবু বলিল, 'কেন ভূপেন মাঝি আর তার সাকরেদদের বললে ঠিক কম খরচায় কিছু না কিছু একটা করে দেবে। ওরা তো হামেশাই নৌকা বানায়, জানোই তো। এই তো গেল হপ্তাতেই একটা বড় নৌকো ভাসালো তমালনদীর জলে, মনে নেই ? ওদেরকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চই করবে। তাতে হরিসভার মানও থাকে, খরচও কম হয়'।
হাতের কাছে এরকম একটা সস্তা অথচ লোভনীয় প্রস্তাবে সকলেই প্রায় লাফাইয়া উঠিল। বিধুচরণ ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, 'উত্তম প্রস্তাব সন্দেহ নেই কিন্তু ভূপেন কম খরচায় নৌকা বানাতে রাজি হবে ? নৌকার খরচও তো নেহাত মন্দ নয়'। সেবু বীরের হাসি হাসিয়া বলিল, 'গোটা নৌকো তো আর বানানো হচ্চে না, নৌকোর আদলে প্যাণ্ডেল হবে। ও তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও জ্যেঠু, আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব। হাজার হোক হরিসভার সম্মান বলে কথা, রাজি সে হবেই'। বিধুচরণ বাকিদের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, 'তোমরা কি বলো হে সবাই.....কি শেখর ? তুমি তো সেক্রেটারি, তোমার কি মত' ?
শেখর ঘাড় নাড়িয়া বলে, 'আজ্ঞে বিশ্বেশ্বরের মন্দিরটা বেশি ভালো ছিল তবে এই প্রস্তাবটা বাজেটে কুলিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এখন ভূপেনমাঝির সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা বলে ফাইনাল করে নিলেই হয়'। বিধুচরণ আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন, 'বেশ, তাহলে ভূপেনকে কালই একবার সন্ধ্যের দিকে বাড়ি আসতে বলিস সেবু, আর তোমরাও থেকো সকলে'। সেবু খানিক ইতস্তত করিয়া বলিল, 'আচ্ছা বলে দেব। তবে, ইয়ে......মানে আমার একটি শর্ত আছে'। বিধুচরণের ভুরু কুঁচকাইয়া যায়, জিজ্ঞেস করেন, 'শর্ত !! তোর আবার কিসের শর্ত রে' ? বাকিরাও সন্দেহের চোখে সেবুর দিকে তাকাইয়া রহিল। সেবু অস্ফুটে বলিল, 'ভূপেন মাঝিদের সাথে আমিও প্যাণ্ডেল বাঁধব। আমার খুব ইচ্ছে......' ।
#bengalishortstories #durgapujastories #pujabarshiki
Monday, September 11, 2017
অনুপদ্য - ১৬
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Subscribe to:
Comments (Atom)



