Wednesday, August 30, 2017
অনুপদ্য - ১৫
Labels:bengali short stories articles poems molat
অনুপদ্য
Thursday, August 17, 2017
Monday, August 7, 2017
সাপ্তাহিকী ৩০ # প্রতিবিম্ব - অন্তিম পর্ব
এ কথায় মৈথিলী সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে যায়। আঙুলের নখ দিয়ে চেয়ারের কোন খুঁটতে থাকে। কিছুক্ষন বাদে ডঃ সেন আবার কোমলস্বরে জিজ্ঞেস করেন, 'আমি জানি মৈথিলী, জীবনের কিছু কিছু প্রশ্ন বড্ড জটিল হয়, কিন্তু তার উত্তর না পেলে যে আমার চিকিৎসা পদ্ধতি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুতরাং, আপনার মনে এই সময় কি চলছে সেটা জানা ভীষণ জরুরী'।
কিছুক্ষন নীরব থেকে অস্ফুটে বলে ওঠে মৈথিলী, 'আমি সঠিক জানি না, তবে এই ক দিনে আমার কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে জানেন, প্রতিদিন দেখতে দেখতেই হয়তো........এক অদ্ভুত চাহিদা তৈরী হয়েছে, তবে সেটাকে ইমোশনাল এট্যাচমেন্ট বলে কিনা আমার জানা নেই ডক্টর'।
- আচ্ছা, আপনি বলছিলেন আপনাকে কেউ ফলো করছে কয়েকদিন ধরে, তাকে দেখেছেন কখনো ?
- না, আসলে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের গলিটা বেশ অন্ধকার থাকে, তাই হয়তো তেমন ঠাহর করে উঠতে পারিনি। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে, হয়তো বা আমারই মনের ভুল। হয়তো তেমন কিছু নয়। সবটাই মিথ্যে।
ডঃ সেন ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা পঞ্চাশ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, 'বেশ, আজ বরং এই অবধিই থাক মৈথিলী। আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। পরপর কয়েকদিন নিয়ম করে খেয়ে যান। সপ্তাহখানেক বাদে আবার আসবেন। তখন নাহয় আমরা আরেকটা সেশন করব। কেমন' ?
মৈথিলী প্রেসক্রিপশন ভাঁজ করতে করতে বলে, 'আয়নায় অন্য মুখ দেখা একদমই স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তা আমি জানি ডক্টর। আর তাছাড়া আমি ভূত প্রেতে মোটেই বিশ্বাস করি না। করলে একা ফ্ল্যাটে কিছুতেই থাকতে পারতাম না। আমি জানি না কেন এমনটা হচ্ছে । আচ্ছা ডক্টর,....আমার ঠিক কি হয়েছে সেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন ?
- কিছুটা........যদিও আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হবে আপনি হ্যালুসিনেট করছেন।
- হ্যালুসিনেশন !! কিন্তু কেন ?
- সেই প্রশ্নের উত্তরটাই তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে মৈথিলী। আমার বিশ্বাস সে প্রশ্নের উত্তর আগামী সেশনেই পাব। আপাততঃ আপনি ওষুধগুলো খেয়ে যান। চিন্তার কিছু নেই। বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট কার্ল জাং কি বলেছেন জানেন ?
মৈথিলী দুদিকে ঘাড় নাড়ে।
- বলেছেন, 'who looks outside.......dreams ; who looks inside......awakes'। সুতরাং, মনের ভেতরের মানুষটাকে জানা খুব প্রয়োজন, ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট সেটা.........আমাদের আবার দেখা হবে মৈথিলী।
ডঃ সেন দুহাত জড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন। মৈথিলী প্রতিনমস্কার করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডঃ সেন চিন্তাক্লিষ্ট মুখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে, মনে মনে সম্ভাব্য ঝড়ের আভাস টের পেলেন বোধহয়।
সপ্তাহখানেক বাদে। ডঃ সেনের চেম্বারে মৈথিলীকে অনেকটা ক্লান্তিমুক্ত লাগে। মুখের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ ভাব লক্ষ্য করা যায়। 'কেমন আছেন মৈথিলী' ? মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করেন ডঃ সেন।
- আগের থেকে ভালো....
- ওষুধগুলো ঠিকঠাক চলছে তো ?
- হ্যাঁ, যেমনটা বলে দিয়েছেন..... ইদানীং রাত্রে ভালো ঘুম হচ্ছে।
- বেশ বেশ, এতো সুখবর......
একথায় আলগা হাসে মৈথিলী। ডঃ সেন দু চোখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'এর মধ্যে সেই মুখটা আর দেখতে পেলেন' ?
- রোজ দেখিনি, তবে এই কদিনে বার দুয়েক দেখেছি....
- কোথায় ? বাড়িতে না বাইরে ?
- বাড়িতেই.....
- চিনতে পারলেন ?
- নাহ, কিন্তু আগের বারের মতো এবারেও ভীষণ চেনা মনে হলো জানেন।
- হুমমম........... কোনোরকম কথার আদান প্রদান ?
- নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম.....
- কি বলল ?
- কিছু বলেনি, শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে.....
- কিন্তু তার নাম তো আপনার জানার কথা, তাই না মৈথিলী ?
'আমার জানার কথা' !! মৈথিলী বিস্মিত হয় খুব। 'এ আপনি কি বলছেন ডঃ সেন ? আমি জানলে কি আপনাকে বলতাম না.....'
ডঃ সেন বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুলে বললেন, 'এমনও তো হতে পারে আপনি বলতে চান না......'
- এ কেমন কথা ডক্টর ! নাম লুকিয়ে আমার কি লাভ ? আর খামোকা লুকোতেই বা যাব কেন ?
- বেশ........আমরা একটা কাজ করি বরং মৈথিলী, আজ আপনি আপনার অতীতের কথা বলুন আমাকে, যতটা পারবেন.....আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো সূত্র আমরা পাবই। কি, বলবেন তো ?
- বেশ, বলব.....
ডঃ সেন নিজের চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে এলেন সামনে, ঈষৎ ঝুঁকে বললেন, 'আপনি যাতে মুক্তমনে সবটা বলতে পারেন তার জন্য আমাকে সামান্য হিপটোনিজমের সাহায্য নিতে হবে। শুধু আপনি মনের দরজা জানলাগুলো সম্পূর্ণ খুলে রাখবেন, তাতে আপনার ভার লাঘব হবে শতগুন। আমি কথা দিচ্ছি, এতে কোনোরকম ঝুঁকি নেই'। মৈথিলী মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে । দুহাত কোলের ওপর জড়ো করে নিস্তব্ধ বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত। ডঃ সেন মৈথিলীর মনের ভাব আন্দাজ করতে পেরে বললেন, 'দেখুন, এই হিপ্নোটিজমটা সম্পূর্ণ আপনার সম্মতির ওপরেই নির্ভর করছে। আপনি রাজি না হলে আমি কখনোই জোর করব না'। মৈথিলী মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, 'আমি জানি ডক্টর, আমায় শুধু বলুন আপনি কি জানতে পারবেন ওই মুখটা কার' ?
- আমার বিশ্বাস আমি পারব, যদি আপনি কোয়াপরেট করেন তবেই......
মৈথিলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।
- আর কি দেখতে পাচ্ছেন ?
- আমি বসে আছি ............সামনে দুমড়ানো মুচড়ানো একটা কাগজ..........
- কিসের কাগজ ?
- চিঠি..............ইন্দ্রনীলকে লিখেছিলাম.........
- তারপর ?
-সে ফেরত দিয়ে গেছে.........বলেছে আমার গার্লফ্রেন্ড হবার যোগ্যতা নেই........আমি কাঁদছি.......একা.....
- আর কি দেখছেন মৈথিলী ?
কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা......... আবার মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এল.......
- আউট্রাম ঘাট................হাওড়া ব্রিজ.............চারিদিকে সন্ধ্যের আলো জ্বলছে........
- আপনি একা ?
- না...............পারিজাত আছে......
- পারিজাত ?
- পুরোনো অফিসের কলিগ.......
- কি বলছে পারিজাত ?
- বিয়ে করতে পারবে না...........
- কেন ?
- বাড়িতে...............সুন্দরী বৌ চায়...............আলো নিভে যাচ্ছে.........আমি কাঁদছি.............একা.......
- আর কিছু মনে পড়ছে মৈথিলী, আর কিছু ?
"আপনি কেন মৈথিলীকে কষ্ট দিচ্ছেন ? কি চান আপনি"..........??
চমকে ওঠেন ডঃ সেন। দু হাতে চেয়ারের হাতলদুটো আঁকড়ে ধরেন উত্তেজনায়। বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে থাকেন মৈথিলীর দিকে। সন্দেহের তীর যে এতো অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যভেদ করবে বিশ্বাস করতে পারেন না। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, 'ক্কে, কে কথা বলল' ? কিছুক্ষনের শীতল নীরবতা বয়ে যায় সমস্ত ঘর জুড়ে । ডঃ সেন আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, 'বলুন, কথা বলুন, কে আপনি'। কোনো এক অতল গভীর থেকে সে পুরুষ কণ্ঠস্বর আবার কথা বলে ওঠে, 'আমি ময়ূখ..... ময়ূখ দাশগুপ্ত'।
- ময়ূখ !! কে ময়ূখ ?
- আমি মৈথিলীকে ভালোবাসি......
ডঃ সেন প্রায় হাঁ হয়ে গেলেন এই কথায়। কিছুক্ষনের জন্য মুখে কোনো কথা সরল না। পরক্ষণেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, 'আপনাদের পরিচয় হল কি করে' ?
- চিঠি লিখত !! আপনাকে ?
- হ্যাঁ........প্রতি রাত্রে নিয়ম করে...........ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয় ......আমরা ভালোবাসতে শুরু করি একে অপরকে।
- মৈথিলী আপনাকে ভালোবাসে ? আপনাকে বলেছে সে কথা ?
- হ্যাঁ বলেছে, চিঠির মধ্যে দিয়ে.......নিঃশব্দে জেনেছি আমরা একে অপরকে.............. প্রতিনিয়ত আয়নার মধ্যে দিয়ে খুঁজে নিয়েছি দুজনকে ..............মৈথিলী আমার প্রাণ...........মৈথিলী আমার প্রেম।
- কিন্তু......আপনি তো মৈথিলীরই অন্য স্বত্বা। নিজের সাথেই নিজের সম্পর্ক তৈরী হওয়া..... এ কি করে সম্ভব ?
- নিজেকে ভালোবাসা অপরাধ নাকি ডাক্তার ? কে বলে ?
- কিন্তু আপনি মৈথিলীর দুর্বলতাকে আশ্রয় করে তার মনে বাসা বেঁধেছেন......একথা মৈথিলী জানলে সে কখনোই আপনাকে প্রশ্রয় দিত না।
'আপনি ভুল বলছেন ডঃ সেন', চিৎকার করে ওঠে পুরুষ কণ্ঠস্বর, 'আপনি ভুল..........আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক, বেঁচে থাকার প্রেরণা'।
- না আমি ভুল নই ময়ূখ, আমি একজন স্পেশালিস্ট ডাক্তার, সমস্তটা জেনেই আমি বলছি। পক্ষান্তরে আপনি মৈথিলীর চরম ক্ষতি করছেন।
- আমি ক্ষতি করছি মৈথিলীর ? আমি !!
- অবশ্যই করছেন, একটা অবাস্তব সম্পর্কের বন্ধনে মৈথিলীর মনস্তত্বে আপনি ধীরে ধীরে ক্ষত সৃষ্টি করছেন। সময়ের সাথে সাথে সে ক্ষতের আকার এমন বিপর্যয় ডেকে আনবে, তখন মৈথিলীকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
- না না, আমি মানি না, আপনার সমস্ত কথা মিথ্যে।
- আমার কথা বিশ্বাস করুন ময়ূখ, আপনি বরং মৈথিলীকে বোঝান, সে নিশ্চই বুঝবে আপনার কথা। সময় বিশেষে তার কষ্ট হবে একথা ঠিক, কিন্তু এই অলীক সম্পর্কের জেরে মৈথিলীকে আপনি অজান্তেই নিদারুন বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। আপনি কি চান না মৈথিলী সুস্থ হয়ে আর চার পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকুক ? ভালোবেসেছেন যখন, তখন ভালোবাসাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্য নয় কি ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আবার একা হয়ে পড়বে ? তখন ?
- উনি আজ একা আছেন, কাল নাও থাকতে পারেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকায় আপনি অন্তরায় হবেন কেন ?
- কিন্তু মৈথিলী যে আমায় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে.......
- ঠিক, কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঘটনার অস্বাভাবিকতায় সে নিজেই একজন ডাক্তারের পরামর্শ চেয়েছে। সুতরাং আপনি যদি তার বাস্তব হতেন তাহলে সে কখনোই আমার কাছে আসতো না। তাই না ??.....বলুন ময়ূখ ? বলুন আমাকে......
ডঃ সেন চশমা মুছতে মুছতে বলেন, 'মনস্তত্ব বড় জটিল জিনিস মৈথিলী। মানুষের মনের হদিস পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার, বিশেষ করে সে মন যদি রোগাক্রান্ত হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে মানুষের মন হচ্ছে কতকটা সমুদ্রের মতো। আমরা সাইকিয়াট্রিস্টরা সেই সমুদ্রের মাঝে ডুব দিয়ে কিছু কিছু স্পন্দন ছুঁয়ে আসতে পারি মাত্র। অধিকাংশটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আপনার ক্ষেত্রেও কতকটা তাই ঘটেছে। বেশ কিছুটা জানতে পেরেছি, বাকিটা সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পাবে আশা করি.....'। মৈথিলী অবাক হয়ে বলে, 'আপনি ঠিক কি বলছেন, আমি তো কিছুই............'।
'বলছি', স্মিত হাসেন ডঃ সেন, চশমাটা গলিয়ে নিয়ে বলেন, 'আপনার যে রোগটি হয়েছে সেটি সচরাচর দেখা যায় না। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার, সংক্ষেপে ডিআইডি। প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার। অর্থাৎ একই দেহের মধ্যে একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি। আমার অনুমান এই রোগ সম্বন্ধে আপনি শুনে থাকবেন আগে, কারণ এই বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্বে রিসার্চ চলছে এবং অগণিত বই ও সিনেমাও বেরিয়েছে। মৈথিলী একরাশ বিস্ময় মিশিয়ে বলে, 'আর.... আর সেই মুখটা, সেই মুখটার ব্যাপারে জানতে পারলেন কিছু' ?
মৈথিলী বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, 'কেমন করে.......? উত্তরে ডঃ সেন বলেন, 'একাধিক প্রত্যাখ্যান ও বহুদিনের নিঃসঙ্গতার কারণে আপনি মনে মনে এমন এক পুরুষ চরিত্রের কল্পনা করেছেন যে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে কোনোরকম কারণ ছাড়াই। বিশেষত রূপের কারণে তো নয়ই। আমরা সাধারণ মানুষ সেটাই চেয়ে থাকি, কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার দরুণ আপনার ক্ষেত্রে সে ভালোবাসার আবির্ভাব ঘটেনি বলেই আপনি এক কাল্পনিক প্রেমিকের চিত্র এঁকেছেন মনে মনে। রাতের পর রাত প্রেমপত্র লিখেছেন কোনো এক অজ্ঞাত ভালোবাসার মানুষকে। এবং পরবর্তীকালে, অজান্তেই, 'ময়ূখ দাশগুপ্ত' নাম দিয়ে আপনি হাজির করেছেন সেই কল্পনার পুরুষকে। আপনার কল্পনার তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি তাকে বিভিন্ন জায়গায় হ্যালুসিনেট করতে শুরু করেন, কখনো বাড়িতে আবার কখনো বাইরে। কিন্তু আপনি আমাকে একটা ছোট্ট অথচ ভাইটাল ইনফরমেশন চেপে গেছেন। আমার বিশ্বাস আপনার এই চিঠি লেখালিখিটা আরও আগের থেকেই। কিন্তু পরে যখন আপনি চোখের সামনে একটা মুখ দেখতে পেলেন তখনই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। কারণ আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এইবার এই ঘটনাগুলো একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। তবে যেহেতু এটা আর্লি স্টেজ এবং আপনার মৈথিলী সত্ত্বার প্রভাব অনেকাংশেই বেশি তাই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কিছুটা এড়ানো গেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেতে সময় লাগবে এখনো।
মৈথিলী উদ্বিগ্ন মুখে বলে, 'তাহলে ডক্টর, এখন উপায়' ?
- একমাত্র উপায় হচ্ছে রেগুলার কাউন্সেলিং, নিয়মিত কিছু ওষুধ খাওয়া ও মানসিক জোর বাড়ানো।
- তাহলেই কি আমি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবো ?
- হাই চান্স, তবে অধিকাংশটাই আপনার ওপর ডিপেন্ড করছে। আপনি কি চাইছেন এবং মনকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন সেটাই মেজর ইস্যু। এখন থেকে আপনার প্রধান কাজ হবে ময়ূখের সত্বাকে কোনোরকম ভাবেই ইনফ্লুয়েন্স না করা এবং এই বিষয়ে কোনোভাবেই চিন্তা না করা। অবসর সময় ভালো বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, অথবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিন। মনকে শান্ত রাখা বড় কঠিন মৈথিলী, আমি জানি, কিন্তু এই কঠিন কাজটাই আপনাকে করে যেতে হবে। বাকিটা আমি চেষ্টা করব সাধ্যমতো। এই ওষুধ কটা লিখে দিলাম, এগুলো কোনোভাবেই বন্ধ করবেন না, তাহলে কিন্তু আবার এটাকটা হতে পারে। আমার বিশ্বাস আমরা যদি দুজনেই যথাযথ চেষ্টা করি, তাহলে এই রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। আপনি বরং সামনের সোমবারই চলে আসুন, সেদিন থেকেই আপনার থেরাপি শুরু হবে। কেমন ?
সমস্তটা শুনে মৈথিলী ধীরে ধীরে উঠে পড়ে সোফা থেকে। একবুক চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ। কোনো রকম শব্দ খরচ না করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মন্থর গতিতে ।
পরদিন সকালে নিয়মমতো এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে মৈথিলীর। পরদার ফাঁক দিয়ে মনখারাপের আলো ঢুকে পড়েছে যেন। কেমন যেন অন্য রকম একটা দিন আজ, মেঘলা, ছন্নছাড়া মতো । বিছানা ছেড়ে উঠে অলস পায়ে একটা ছোট দেরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রয়ারটা টানতেই ভেতর থেকে কিছু ওষুধের পাতা আর একগোছা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আসে। ডঃ সেনের কথা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ । ঘুম থেকে উঠেই ওষুধটা খাওয়ার কথা বলেছেন। ওষুধের পাতাটা হাতে নিয়ে কাগজের টুকরোগুলোয় চোখ বোলাতে থাকে মৈথিলী। ময়ূখকে লেখা সমস্ত চিঠি। ওষুধটা খাওয়া মানেই ময়ূখকে ভুলে যাওয়ার পথে এক কদম বাড়ানো। ময়ূখের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সূত্রপাত। গভীর চিন্তা করে মৈথিলী। নিজের সাথে কয়েক দিনের অন্তরঙ্গতায় তার সমস্ত দুর্বলতাকে ছাপিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বাদ পেয়েছে সে। অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে সে এতদিনে। নিজের বিপরীত স্বত্বার প্রতি অনুরাগ হলেও নিখাদ, নিষ্পাপ প্রেমই তো ! এটাই তো চেয়েছিল সে। ওষুধ খেলে সুস্থ হবে হয়তো, ভালো করে বাঁচতে পারবে কি ? বেঁচে থাকা কাকে বলে..... ? এক অদ্ভুত উভয়সংকটে পড়ে দিশাহীন খাঁচার পাখির মতো ছটফট করতে থাকে মৈথিলী। এমন সময় কোনো এক নিভৃত অতল থেকে এক পুরুষের মরমী কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, 'মৈথিলী.............মৈথিলী................'
মৈথিলী দ্রুত হাত চাপা দেয় কানে। কিন্তু সে অদম্য কণ্ঠস্বর সমস্ত প্রতিরোধ কাটিয়ে আবার ডেকে ওঠে, 'মৈথিলী...................' ওষুধের পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মৈথিলী। সমস্ত পিছুটান, সংযম, মিথ্যে করে একছুটে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আয়নায় চোখ রেখে বলে ওঠে,...........
Labels:bengali short stories articles poems molat
ছোট গল্প,
রহস্য-রোমাঞ্চ,
সিরিজ
Saturday, August 5, 2017
সাপ্তাহিকী ২৯ # প্রতিবিম্ব - প্রথম পর্ব
হাঁটতে হাঁটতে সমানে পিছনে তাকাতে থাকে মৈথিলী। বর্ষার রাস্তায় জুতোর ভারে মশমশ শব্দ হতে থাকে। সন্তর্পণে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সে চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। এক নিঃশব্দ আশঙ্কা যেন বেড়ালের মতো গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। কেউ পিছু নিয়েছে নাকি ? ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে একবার দেখে নেয়.... নাহ ! কেউ তো নেই। গলির শেষ প্রান্তে বড় রাস্তার আধা নীলচে আলো বৃত্তাকারে এলিয়ে পড়ে আছে। তাহলে কি মনের ভুল ?...... বুড়োশিবতলা থেকে কয়েক পা এগিয়ে বাঁ দিকের এই সরু গলিটা প্রায়শই অন্ধকার থাকে। ত্রিশ ফুট অন্তর পরপর তিনটে স্ট্রিট ল্যাম্প। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কখনো কখনো জ্বলে না কোনোটাই। বাকি এলাকার তুলনায় আপাত নির্জীব এই গলিটার প্রতি কেউই খুব একটা পাত্তা দেয় না। সুতরাং আলোর চেয়ে অন্ধকারেই ডুবে থাকে ফুট আটেকের চওড়া এই পথটা। তাতে অবশ্য মৈথিলীর খুব একটা সমস্যা হয় না, কিন্তু গত কয়েকদিনে এই পিছু নেওয়ার ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। বিশেষ করে রাত্রি সাড়ে আটটা নটার পর, অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই টের পাওয়া যাচ্ছে যেন। মৈথিলী ভেবে পায় না তার পিছু কেন কেউ নিতে যাবে।
মৈথিলীর পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস, অবিবাহিতা। সুন্দরী বা সুশ্রী কোনোটাই বলা চলে না তাকে। মুখে গোটাকয়েক বসন্তের দাগ, গায়ের রং গাঢ় শ্যামলা, শরীরের গড়ন স্থূল। সুতরাং এমন কুরূপা মাঝবয়েসী মহিলাকে ফলো করবে এমন আহাম্মক এই পাড়ায় কেন, আশেপাশের পাড়াতেও নেই বললেই চলে। অবশ্য হালফিলের কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনায় আট থেকে আশি যেখানে কেউই রেহাই পাচ্ছে না, সে তো নস্যি মাত্র। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গলিটা কোনোরকমে পার করে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে মৈথিলী। কোলাপ্সিবল গেটে তালা দিয়ে দু তিন বার চেক করে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালায়।
দু কামরার এই ফ্ল্যাটটায় একাই থাকে সে। সামনে একটা ছোট্ট ড্রইং রুম পেরিয়ে দুদিকে দুটো বেডরুম। বাঁ দিকে টয়লেট আর কিচেন। কাজের লোক বা রান্নার লোক রাখেনি মৈথিলী। একার সংসারে নিজেই হাত বাড়িয়ে সমস্তটা করে ফেলে। বরং বলা ভালো করতে পছন্দ করে। শাড়িটা চেঞ্জ করে এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে টিভির সুচটা অন করে। খাওয়া দাওয়ার পর এই সময়টা বেশির ভাগ টিভি দেখেই কাটিয়ে দেয় মৈথিলী। এই সময়টা তার ভারী পছন্দের ধারাবাহিক হয়...... 'সাজন'। একটি নামকরা হিন্দি চ্যানেলের মুখ্য অভিনেতাকে বেশ লাগে তার। ধপধপে ফর্সা গায়ের রং, দুর্দান্ত স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম ছেলেটির দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকাটা একরকম অভ্যেস হয়ে গেছে যেন। ফোনটাকেও সাইলেন্ট করে রাখে এই সময়। মনে মনে ছেলেটিকে কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে মৈথিলী।
পরদিন সকালে এলার্মের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তার। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর ছোট ঘড়িটাকে শান্ত করে। অভ্যাসমত স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে অর্ধমুদ্রিত চোখে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়ায় মৈথিলী। সামনের পুরোনো, মলিন আয়নায় নিজের মুখটাকে দেখে বারকতক। মনে মনে ভাবে আবার একটা দিন, আরও একবার একঘেঁয়ে একাতিত্বের সময় নিয়ে নিষ্ফল বেঁচে থাকা। নিমেষে তেতো হয়ে যায় মনটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করতে থাকে মন্থর গতিতে। মুখ ধুয়ে, মাথা তুলে আরেকবার আয়নার দিকে তাকাতেই তীক্ষ্ন আর্তনাদ করে ভয়ে ছিটকে সরে আসে মৈথিলী। আতঙ্কে মুখ সাদা হয়ে যায় তার। হাত থেকে টুথব্রাশটা ঠক করে মেঝেতে পড়ে যায়। চরম বিস্ময়ে চেয়ে দেখে আয়নায় কার যেন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। একটা পুরুষের মুখাবয়ব। অমায়িক ভঙ্গিতে নিস্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক ঝটকায় পিছন ফিরে তাকায় মৈথিলী। কি আশ্চর্য ! পিছনে তো কেউ নেই ! তাহলে কি ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকল ? কোনো চোর টোর, নাকি অন্য কেউ ? তাড়াতাড়ি ড্রয়িং রুমের চারপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে মৈথিলী।
সামনের দিকে দুটো বেতের চেয়ার, একটা কাঁচের টেবিল, ডানদিকের ঘরের কোনায় একটা ছোট বসার টুল। একপাশে একটা মাঝারি সাইজের কাঠের আলমারি। কই কেউ তো কোথাও নেই ! তাহলে কি পাশের ঘরে ঢুকল ? একছুটে লাগোয়া ঘরটায় গিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজে মৈথিলী। বাঁদিকে ঠাকুরের কিছু ফটো আর একটা লোহার ফোল্ডিং খাট ভাঁজ করে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা আছে। যেখানে যা ছিল তার থেকে একচুলও এদিক ওদিক হয়নি কিছু। বারান্দা থেকেও একবার ঘুরে এল সে। কি আশ্চর্য, লোকটা উবে গেল নাকি ? কোলাপ্সিবল গেটে তালা ঝুলছে, বারান্দাটাও গ্রিলে ঘেরা, সুতরাং বাইরে থেকে আসা বা বেরোনোর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাহলে গেল কোথায় ? নাকি ভুল দেখল সে ? পায়ে পায়ে আরেকবার বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মৈথিলী। বুকের মধ্যে তীব্র ধুকপুকানি নিয়ে উঁকি দিল আয়নায়। ডিম্বাকৃতি আয়নার ওপর নিজের মুখ ছাড়া আর কোনো কিছুর চিহ্ন নেই সেখানে। একটা হিমেল স্রোত বয়ে যায় সারা শরীর জুড়ে। দু চারবার ঢোঁক গিলে নিজের বেডরুমে গিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। একি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল ? পাগল পাগল লাগতে থাকে তার। একলা থাকার নরক যন্ত্রনা কি তাকে পেয়ে বসল শেষে ? না না এ মনের ভুল হবে নিশ্চই। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিতে থাকে মৈথিলী।
ধীরে সুস্থে কোনোরকমে নিজেকে স্থির করে রেডি হয়ে নিয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে আরও একপ্রস্থ দরজা, কোলাপ্সিবল গেট ভালো করে পরীক্ষা করে নিয়ে বেরোয়। নিত্য নৈমিত্তিক কিছু কাজ আর কাজের ফাঁকে দু একজন কলিগের সাথে সামান্য আলাপচারিতা, এছাড়া তার একপেশে জীবনে তেমন কোনো হিল্লোল ওঠে না। বন্ধুবান্ধব প্রায় নেই বললেই চলে। রূপের কারণে পুরুষ বন্ধু তো একেবারেই নেই। ঈশ্বর কেন যে তার এই দিকটায় কার্পণ্য করলেন কে জানে। বিধাতার কাছে এই নিয়ে তার অনুযোগ বিস্তর, কিন্তু হায়, সে অনুযোগ বোধহয় লক্ষকোটি প্রার্থনার ভিড়ে তাঁর দরবার অবধি গিয়ে পৌঁছয় না।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে নিয়মিত কাজ সেরে মৈথিলী ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখের বসন্তের দাগের ওপর আঙ্গুল বোলাতে থাকে অন্যমনস্ক হয়ে। অজান্তেই ভিজে ওঠে চোখের কোণ। নিজের অদৃষ্টকে অভিশাপ দিতে থাকে মনে মনে।
অকস্মাৎ, আয়নার দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে ! এ কি ! এ কি দেখছে সে আবার চোখের সামনে ? তার মুখের গড়নটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে আয়নায়। এক লহমার জন্য হৃদকম্পন স্তব্ধ হয়ে যায় যেন। ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে মৈথিলী তাকিয়ে থাকে একঠায়। সকালের সেই পুরুষ মুখের পুনরাগমন ঘটে কাঁচের ওপর অবিকল এক জায়গায়। এক মর্মভেদী চিৎকার করে ওঠে মৈথিলী। মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে..........
- এরকমটা কি আগেও হয়েছে ?
- কক্ষনো না....
- কতদিন থেকে হচ্ছে এমনটা ?
- তা প্রায় সপ্তাহ তিনেক হল। প্রথম দুবার বাড়িতেই হয়েছিল। ইদানিং বাইরেও হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট যেখানেই আয়না দেখছি সেখানেই......
- আপনি কি ড্রাগ বা অন্য কোনোরকম কিছু...... ?
- না না, আমার কোনোরকম নেশা নেই।
ষাটোর্দ্ধ ডঃ অবিনাশ সেন গম্ভীর হয়ে গেলেন একথা শুনে। দু হাতের আঙুলের ওপর থুতনি রেখে চেয়ে রইলেন মাটির দিকে। মৈথিলীর চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। পরপর কয়েক সপ্তাহের দুরন্ত ঝঞ্ঝা প্রায় ন্যুব্জ করে দিয়েছে তাকে। কলকাতার এই অন্যতম নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টের নাম জানতে পারে অফিসেরই এক কলিগের থেকে। প্রথম প্রথম মন সায় দেয়নি। কিন্তু পরের দিকে ঘটনাগুলোর তাৎপর্য বুঝে আর উপেক্ষা করেনি সে। ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তড়িঘড়ি দেখা করতে এসেছে তাঁর দেশপ্রিয় পার্কের চেম্বারে। চেম্বারটা অবশ্য ওনার বাড়িতেই। ক্ষনিকের বিরতিতে চারপাশটা নজর বোলায় মৈথিলী। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা বড় সুদৃশ্য হলঘরে মুখোমুখি দুটো গদিওয়ালা চেয়ার। একপাশে একটা কারুকাজ করা টিপয়, তার ওপর বাহারি ফুলদানি বসানো। মখমলি কার্পেটের ওপর পা রাখলেই চোখ বুজে আসে আপনি। একটা শান্ত ধীর স্থির ভাব রয়েছে গোটা ঘর জুড়ে। দুদিকের দেওয়াল জুড়ে নয়নাভিরাম অয়েল পেন্টিং। একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। পশ্চিমের জানলা দিয়ে বিকেলের নরম আলো ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরটায় বেশ মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বোধহয় পেশেন্টদের জন্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে এমনটা বানানো। ডঃ সেন মুখ তুলে তাকালেন আবার।
- আপনি কি একাই থাকেন ফ্ল্যাটে ?
- হ্যাঁ...
- বরাবর ?
- আসলে আমি জ্যাঠার কাছে মানুষ। এটা ওনারই ফ্ল্যাট। অনেক ছোটবেলায় আমার বাবা মা মারা যান। তারপর জ্যাঠাই নিজের কাছে নিয়ে আসেন আমাকে। পড়াশুনার সমস্ত দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। নিজের মেয়ের মতো বড় করেছেন আমাকে। বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান ছিলেন। তাই অপত্য স্নেহের ছায়ায় কখনো বাবা মার অভাব বুঝতে দেন নি। মৃত্যুর আগে আমায় ফ্ল্যাটটা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন।
- বেশ........আপনি বিবাহিতা ?
- নাহ, আগেও ছিলাম না, এখনো নই......
- কোনো বিশেষ কারণ ?
- (সামান্য হাসি) সেটা আমাকে দেখেও বুঝতে পারছেন না ডঃ সেন ?
- কিরকম ?
- রূপ বড় বিষম বস্তু ডক্টর। এর ক্ষমতা গগনস্পর্শী। অথচ কি অদ্ভুত দেখুন, এর স্থায়িত্ব কিন্তু ক্ষণকালের। আমরা সাধারণ মানুষ রূপের মোহতেই ভুলি, রূপের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা হৃদয়ের খোঁজ করতে যাইনা সচরাচর। কথাতেও আছে না, 'পেহলে দর্শনধারী ফির গুণবিচারী' । আমার ক্ষেত্রে কথাটা একেবারে একশো শতাংশ খাঁটি।
- কিন্তু কখনোই কি আপনার জীবনে.......মানে আমি বলতে চাইছি আজকের দিনে রূপের কারণে বিয়ে না হওয়াটা........
- হ্যাঁ, অত্যন্ত আশ্চর্যের বটে। কিন্তু আমার জীবনে ঠিক তাই ঘটেছে। আমি যে বিয়ে করতে চাইনি তা নয়। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন বাঁকে যে সমস্ত পুরুষের সংস্পর্শে এসেছি তারা কখনোই প্রেম নিবেদন করেনি আমায়, উল্টে আমার দিক থেকে অনুরাগের লেশমাত্র অনুমান করতে পারলেই তারা যেন নিজেরাই সরে যেত মানে মানে। তাই আর...........
- বেশ, আমায় একটা কথা বলুন দেখি এবার ?
দু চোখে একরাশ বিষাদ নিয়ে তাকায় মৈথিলী। ডঃ সেন প্রশ্ন করেন, 'আচ্ছা, আয়নায় যে মুখ আপনি দেখছেন, সে কি প্রত্যেকবার একই মানুষ, নাকি সময়বিশেষে পাল্টে যাচ্ছে' ?
- না না, প্রত্যেকবার একই মুখ, একই গড়ন, একই চোখ, নাক, কান.......কিচ্ছু পাল্টাচ্ছে না.....
- এরকম দেখতে কারোর কথা মনে পড়ে আপনার ?
ব্যস্ত হয়ে ওঠে মৈথিলী, বলে, 'আমি জানিনা, আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু, বহু অতীতের ঘটনা আবার নতুন করে মনে করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিচ্ছু মনে পড়েনি। অথচ যখনই আমি আয়নায় ওই মুখটা দেখি আমার ভারী চেনা মনে হয় জানেন। মনে হয়, কোথায় যেন দেখেছি একে, কোথায় যেন......... কিন্তু কিছুতেই......... ওহ, আমি পাগল হয়ে যাব ডঃ সেন, আমি পাগল হয়ে যাব......'
দুহাতে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মৈথিলী। অব্যক্ত যন্ত্রণার মেঘ ছড়িয়ে পড়ে ঘরের চারপাশে। ডঃ সেন এগিয়ে এসে মৈথিলীর দুটো হাত ধরেন। বলেন, 'আপনি ধৈর্য ধরুন। এতো সহজে ভেঙে পড়বেন না। আপনি যাকে দেখছেন তাকে আমরা ঠিক খুঁজে বার করবই। নিন একটু জল খান'। একটা জগ থেকে খানিকটা জল গ্লাসে ঢেলে এনে মুখের সামনে ধরলেন ডঃ সেন। মৈথিলী সবটুকু শেষ করে রুমাল বার করে চোখ মুখ মুছে নিজেকে গুছিয়ে নেয় আবার। ডঃ সেন পরের প্রশ্ন করেন।
- আপনি কি সেই মুখের একটা বয়স আন্দাজ করতে পারেন ?
- হ্যাঁ পারি....... মাঝবয়েসী, এই পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে........
- কেমন দেখতে ?
- মন্দ না, গায়ের রং ময়লার দিকেই, ব্যাকব্রাশ করা চুল, গোলগাল মুখ, হালকা দাড়ি আছে, চোখের চাউনি বেশ মায়াময়.....
- আপনি কি কমিউনিকেট করতে পারছেন তার সঙ্গে, মানে এই কয়েক সপ্তাহে আপনি তো প্রায় অনেক বার দেখেছেন......
- কমিউনিকেট ? না, তা পারিনি, কিন্তু প্রতিবার মনে হয়েছে সে যেন কিছু বলতে চাইছে আমায়...... আমি তার চোখ দেখেছি জানেন ডক্টর, সে চোখে অনেক আবদার, অনেক কথা লুকিয়ে আছে, কি অদ্ভুত প্রাণের আকুতি সে চোখে, কি করুণ মায়াভরা দৃষ্টি......আ আমি প্রত্যেকবার তাকে ছুঁয়ে দেখতে গেছি, কিন্তু তারপরই হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, নয়তো সে মিলিয়ে যায়।
- তার মানে এখনো পর্যন্ত সে কোনোরকম এগ্রেসিভ আচরণ করেনি, তাই তো ?
- না না, একেবারেই নয়, বরং সে শুধুই তাকিয়ে থেকেছে, কখনো এমনি, কখনো বা সরল দৃষ্টিতে, আবার কখনো......
- আবার কখনো ?
- কখনো আবার স্মিত হেসেছে.......
- হেসেছে ?........ স্ট্রেঞ্জ !
- হ্যাঁ, মানে, কেন যে করছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি.....
মৈথিলীর সলাজ কণ্ঠস্বরের আবেগ ডঃ সেনের চোখ এড়াতে পারে না। সে দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করেন তিনি, 'আমায় একটা সত্যি কথা বলবেন ? মানে, আপনি কি কোনোভাবে..........সেই মুখের সাথে ইমোশনালি এট্যাচড হচ্ছেন' ?
(ক্রমশ)
![]() |
| চিত্রবিন্যাস : নিজস্ব |
Labels:bengali short stories articles poems molat
ছোট গল্প,
রহস্য-রোমাঞ্চ,
সিরিজ
Subscribe to:
Comments (Atom)



